০১. মুনির ছেলেটা একটু অদ্ভুত ধরনের

আমাদের ক্লাসে মুনির ছেলেটা একটু অদ্ভুত ধরনের। কারো সঙ্গে কথা বলে না। সব সময় পেছনের বেঞ্চিতে বসে। ক্লাসের সারাটা সময় জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। স্যার কিছু জিজ্ঞেস করলে চোখ পিটপিট করতে থাকে। তখন তার মুখ দেখে মনে হয়, সে স্যারের একটা কথাও বুঝতে পারছে না।

মুনিরের এই স্বভাব স্কুলের সব স্যাররা জানেন। কাজেই কেউ তাকে কিছু জিজ্ঞেস করেন না। শুধু আমাদের অংক স্যার মাঝে-মাঝে ক্ষেপে গিয়ে বলেন, কথা বলে না। ঢং ধরেছে। চার নম্বরি বেত দিয়ে আচ্ছা করে পেটালে ফড়ফড় করে কথা বলবে।

আমাদের স্কুলের কমন রুমে নম্বর দেয়া নানান রকমেব বেত আছে। বেত যত চিকন তার নম্বর তত বেশি। চার নম্ববি বেত খুব চিকন বেত। এক নম্বরি বেত সবচেয়ে মোটা।

কথায় কথায় বেতের কথা তুললেও অংক স্যার কখনো বেত হাতে নেন না। কিন্তু এক-এক দিন মুনিরেব উপর অসম্ভব রাগ করেন। যেমন আজ করেছেন। রাগে তাঁর শরীর কাঁপছে। মুখ দিয়ে ফেনা বের হচ্ছে।

স্যার চৌবাচ্চার একটা অংক করতে দিয়েছেন। জটিল অংক। একটা পাইপ দিয়ে পানি আসছে। একটা ফুটো দিয়ে চলে যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ফুটো বন্ধ করে দেয়া হলো— এই সব হাবিজাবি। মুনির ফন্ট করে অংকটা করে ফেলল। আমি মুনিরের পাশে বসেছি, কাজেই ওর খাতা দেখে আমিও করে ফেললাম। অংক হয়ে গেলে হাত উঁচু করে বসে থাকতে হয়, কাজেই উঁচু করেছি। আর কেউ হাত তুলছে না। তোলার কথাও না–খুব কঠিন অংক। এখন একটা সমস্যা দেখা দিল। কেউ যদি হাত না তোলে তাহলে অংক স্যার আমাকে বলবেন বোর্ডে এসে অংকটা করে দিতে। বিবাট সমস্যা হবে। আমি চট করে হাত নামিয়ে ফেললাম। অংক স্যার হুংকার দিলেন, হাত তুলে নামিয়ে ফেললি কেন? অংক হয় নাই।

জি না স্যার।

দেখি খাতা নিয়ে আয়।

খাতা নিয়ে গেলাম। স্যার খাতা দেখে। গম্ভীর গলায় বললেন, এই তো হয়েছে। হাত নামালি কেন? সত্যি কথা বল, নয় তো পাঁচ নম্বরি বেত দিয়ে কেরামতি দেখিয়ে দেব।

আমি চুপ করে রইলাম। এই শীতেও ঘাম বেরিয়ে গেল। বুক শুকিয়ে কাঠ।

বশির বলে একটা ছেলে আছে আমাদের ক্লাসে। খুব বজ্জাত। তার জীবনের লক্ষ্য হচ্ছে মানুষকে বিপদে ফেলা। যদি কোনো স্যার বেত আনতে বলেন–বশির আনন্দে হেসে ফেলে। বিনয়ে গলে গিয়ে বলে, স্যার আমি নিয়ে আসি?

যদি কোনো ছেলেকে নীলডাউন করে রাখা হয়, বশিরের মুখ আনন্দে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে–সে বড় মজা পায়

আজও তাই হলো। যেই সে দেখল। অংক স্যার পাঁচ নম্বরি বেতের কথা বললেন, ওমি সে বলল, ও স্যার মুনিরের খাতা থেকে টুকলিফাই করেছে। আমি দেখেছি।

স্যারের মুখ অন্ধকার হয়ে গেল। বশির দাঁত বের করে বলল, বেত নিয়ে আসি স্যার?

যা নিয়ে আয়।

কয় নম্বর আনব স্যার?

পাঁচ নম্বরি আন। দেখ আজ কেরামতি কাকে বলে।

বশির লাফাতে লাফাতে বেত আনতে গেল। অংক স্যার মুনিরকে জিজ্ঞেস করলেন, হুমায়ূন তোর খাতা থেকে টুকেছে?

মুনির তার স্বভাবমতো চুপ করে রইল। হ্যাঁ না কিছুই বলল না। মুনির ক্লাসে কখনো কথা বলে না।

কথা বল, নয়তো আজ তোর কেরামতিও বের করব। ব্যাটা মৌন বাবাজি, কথা বলে না। কথা বল! নয়তো তোর একদিন কী আমার একদিন।

মুনির উদাস দৃষ্টিতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল, ততক্ষণে বশির চলে এসেছে। আনন্দে সে বিলমল করছে।

অংক স্যার গম্ভীর গলায় বললেন, দুজনই পঁচিশ ঘা করে বেত খাবি। কত ধানে কত চাল বের হয়ে যাবে। ক্লাস সিক্সে পড়ে, এর মধ্যেই খাতা দেখে লেখা শিখে গেছে! মামদোবাজি! আরেক জন দরবেশ মৌনী বাবা। দেখি হাত পোত। দুই হাত।

আমি হাত পাতলাম। বশির আনন্দে ফিক করে হেসে ফেলল। আমি অবশ্যি খুব ব্যথা পেলাম না। নিঃশ্বাস বন্ধ করে রাখলে আর হাত শক্ত করে রাখলে বেশি ব্যথা পাওয়া যায়। আমি ঘনঘন নিঃশ্বাস নিতে লাগলাম আর হাত খুব নরম করে ফেললাম।

মুনিরের কোনো শাস্তি হলো না। হবে না। আমি জানতাম। কারণ ও খুব ভালো ছেলে। গণ্ডারের ইংরেজি কী তা সে চট করে বলে দিতে পারবে। শুদ্ধ বানানে। অবশ্যি মুখে বলবে না। খাতায় লিখে দেবে। ওর একটাই দোষ–কথা বলে না। এই দোষের জন্যই তার শাস্তি হা भी।

অংক স্যার একটা বক্তৃতা দিলেন, যার সারমর্ম হচ্ছে শারীরিক শাস্তিব তিনি ঘোর বিপক্ষে। কিন্তু এই ক্ষেত্রে দিলেন, কারণ অপরাধ গুরুতর। ক্ষমাব অযোগ্য। এই বয়সে যে টুকলিফাই করে, বড় হয়ে সে কী করবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমি আমার নিজের জায়গায় ফিরে যেতেই বশির চিকন গলায় বলল, পঁচিশ ঘা বেত দেয়ার কথা স্যার, আপনি মাত্র তেরটা দিয়েছেন। বারটা বাকি রইল স্যার।

বশিরটা এমন বজ্জাত! রাগে আমার গা জ্বলতে লাগল। কিন্তু কিছু করার নেই। হজম করতে হবে। সুযোগমতো একটা ব্যবস্থা করতে হবে। ফুটবলের মাঠে বেকায়দা ল্যাং মেরে ফেলে দিতে হবে। কিংবা লাল পিপড়ার বাসা মাথায় টুপির মতো পরিয়ে দিতে হবে।

আমাকে শাস্তি দিয়ে অংক স্যারের বোধহয় মনটা খারাপ হয়েছে। কারণ তিনি দেখি মাথা নিচু করে চুপচাপ বসে আছেন। অন্য সময় হলে এতক্ষণে বোর্ডে চলে যেতেন এবং ঝড়ের মতো একটির পর একটি অংক করতে থাকতেন। আমাদেরও নিঃশ্বাস ফেলার সময় থাকত না। টপাটপ খাতায় তুলতে হতো। আজ সে-রকম কিছু হচ্ছে না। স্যার আড়ে-আড়ে তাকাচ্ছেন আমার দিকে। চিৎকার, চেঁচামেচি করলেও স্যারের মনটা খুব নরম। কোনো ছেলের অসুখ হয়েছে শুনলে তিনি তার বাসায় যাবেন। বাজখাঁই গলায় বলবেন, কী যে যন্ত্রণা করিস, আবার অসুখ বাঁধালি। তাড়াতাড়ি ভালো হা। নয়তো চড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব।

মুনির এখনো দাঁড়িয়ে। শাস্তির অপেক্ষা করছে। বেশ ভয়ও পেয়েছে। অল্প অল্প কাঁপছে। অংক স্যার বললেন, তুই দাঁড়িয়ে আছিস কেন, বাস।

মুনির বসল। আড়চোখে কয়েকবার তাকাল আমার দিকে। তারপর হঠাৎ আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল, এই কুমায়ূন, ভূত পুষবি?

আমি আকাশ থেকে পড়লাম। বলে কী! ভূত পুষব মানে? ভূত কি কুকুরছানা নাকি?

মুনির ফিসফিস করে বলল, আমি আজ সন্ধ্যায় একটা ভূতের বাচ্চা আনতে যাব।

ভূতের বাচ্চা আনতে যাবি মানে! ভূতের বাচ্চা পাওয়া যায় নাকি?

একজন আজ আমাকে একটা ভূতের বাস্ত দেবে। সম্ভার সময় যেতে বলেছে। তুই যাবি।

আমি কী বলব ভেবে পেলাম না। মুনিরটা এমন আগ্রহ করে তাকাচ্ছে। আমার মার খাওয়া দেখে হয়তো তার মায়া লেগেছে। এখন আমাকে খুশি করতে চায়।

হুমায়ূন যাবি?

যাব।

খবরদার কাউকে বলবি না।

আচ্ছা বলব না।

কোনো কথা কাউকে না বলে থাকা কষ্টের ব্যাপার। তখন কথাটা পেটের মধ্যে বড় হতে থাকে। পেট গুড়গুড় করে। খুব অস্বস্তি হয়। এই জন্যে কোনো কথা বেশিক্ষণ রাখতে নেই। খুব গোপনীয় কথাগুলি বটগাছকে বলে পেট হালকা করতে হয়। বটগাছ সেই কথা কাউকে বলতে পারে না বলে আর কেউ জানতে পারে না।

স্কুল ছুটির পর আমরা রওনা হলাম। ব্ৰহ্মপুত্রের পাড় ধরে-ধরে অনেক দূর যেতে হলো। কেওটখালির কাছাকাছি এসে নদী পার হলাম। শীতকাল, কাজেই পানি বেশি নেই। খেয়া-নৌকা আছে। দশ পয়সা করে নেয়। মুনির পয়সা দিয়ে দিল। সন্ধ্যা এখনো হয় নি। এর মধ্যে চারদিক অন্ধকার। গাছপালার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি। এক সময় দোতলা একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। গাছপালায় ঢাকা জঙ্গুলে জায়গায় শ্যাওলা ঢাকা এক বাড়ি। লোহার গেট। সেই গোটে বাড়ির নাম লেখা—শান্তিনিকেতন। আমি ভয়ে-ভয়ে বললাম, কোথায় নিয়ে এলি? এটা কার বাড়ি?

আমার এক আত্মীয়-বাড়ি। দূর সম্পর্কের নানা হয়।

এই লোকই তোকে ভূতের বাচ্চা দেলে?

হুঁ।

গুল ছেড়েছে।

না, গুল ছাড়ে নি।

কী করে বুঝলি গুল ছাড়ে নি?

চেহারা দেখলে তুইও বুঝবি। সন্ন্যাসীর মতো চেহারা। সন্ন্যাসীরা কি গুল ছাড়ে?

অনেকক্ষণ দরজা ধাক্কাবার পর যিনি দরজা খুললেন, তাঁকে দেখে আমি অবাক। অবিকল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঠিক সে-রকম লম্বা দাড়ি। সাদা বাবড়ি চুল। লম্বা একজন মানুষ। পরনে আলখাল্লার মতো লম্বা একটা পোশাক। গলার স্বরও কী গম্ভীর।

দাঁড়িয়ে আছিস কেন, ভেতরে আয়। সঙ্গে এটি কে?

আমার বন্ধু। এও ভূতের বাচ্চা নেবে।

আমি কি দোকান দিয়ে বসেছি নাকি, যে-ই আসবে একটা করে ভূতেব বাচ্চা দিয়ে দেব? একটা দেব বলেছিলাম, একটা পাবি। ভেতরে এসে বস।

আমরা সিঁড়ি ভেঙে দোতলার একটা ঘরে ঢুকলাম। সেই ঘরে বই ছাড়া আর কিছুই নেই। মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত শুধু বই আর বই। মাঝখানে একটা ইজিচেয়ার ছাড়া আর কোনো আসবাব নেই। ইজিচেয়ারের পাশে ছোট্ট একটা টেবিল। টেবিলে একটা অদ্ভুত ধরনের টেবিল ল্যাম্প। উনি বোধহয় এখানে বসেই বই পড়ছিলেন।

তোরা দাঁড়িয়ে আছিস কেন, বাস। মেঝেতে পা ছড়িয়ে বস। নাকি মেঝেতে বসলে তোদের মান যাবে?

আমরা পা ছড়িযে মেঝেতে বসে পড়লাম। আমার একটু ভয়ভয় করছে।

কিছু খাবি তোরা?

জি-না।

ভূতের বাচ্চা যে নিবি, কোনো পাত্র এনেছিস?

মুনির না-সূচক মাথা নাড়ল।

ভদ্রলোক বিরক্ত হয়ে বললেন, কিছু নিয়ে আসিস নি, তাহলে নিবি কী কলে? পকেটে কের তো আর নিতে পারব না। তৃত হচ্ছে হাওয়ার তৈরি। আচ্ছা! দেখি ঘরে কিছু আছে

তিনি আমাদের বসিয়ে রেখে চলে গেলেন। বুঝতে পারছি বাড়িটা অনেক বড়। অনেকগুলি ঘর। কিন্তু এই ঘরটি ছাড়া অন্য কোনো ঘরে বাতি জ্বলছে না। লোকজনেরও কোনো সাড়া নেই। আমি ফিসফিস করে বললাম, এই বাড়িতে আব্ব কেউ থাকে না?

না।

উনার নাম কী?

আগে অন্য নাম ছিল। এখন উনাকে রবিবাবু বলে ডাকতে হয়। রবি-বাবু না ডাকলে রাগ করেন। আমি ডাকি রবি নানা।

উনি করেন কী?

কিছু করেন না। শুধু বই পড়েন। আর কবিতা লেখেন।

কবিতা লেখেন কেন?

নোবেল প্রাইজ দরকার তো, এই জন্যে কবিতা লেখেন। কবিতা না লিখলে নোবেল

প্রাইজ পাওয়া যায় না। তুই আর কথা বলিস না তো। চুপ করে থােক। বেশি কথা বললে উনি রাগ করেন।

আমি চুপ করে গেলাম। ভদ্রলোক ঢুকলেন হাতে ছোট্ট একটা হোমিওপ্যাথি, ওষুধের শিশি নিয়ে। ভূতের বাচ্চা কি উনি এর মধ্যে ভরে দেবেন? কী সর্বনাশ!

বোতল একটা পাওয়া গেছে, গরম পানিতে ধুতে হবে। সময় লাগবে।

আমি কিছু বলব না বলব না করেও বলে ফেললাম, এত ছোট বোতলের মধ্যে থাকবে?

আমার কথায় ভদ্রলোক অত্যন্ত রেগে গেলেন। চোখ বড়বড় করে বললেন, ছোট একটা কলসির মধ্যে যদি বিশাল দৈত্য থাকতে পারে, হোমিওপ্যাথির শিশির মধ্যে ভূতের বাচ্চা থাকতে পারবে না?

আমি কিছু বললাম না। ভদ্রলোক ধমকের সুরে বললেন, জবাব দাও–পারবে কী পারবে না?

পারবে।

হুঁ, দ্যাটস গুড। কী নাম তোমার?

হুমায়ূন।

ক্লাস সিক্সে পড়?

জি।

রোল নাম্বারা কত?

বত্ৰিশ।

ক্লাসে ছাত্র কত জন?

বত্ৰিশ।

তার মানে পড়াশোনা কিছুই পার না?

জি না।

স্কুল ভালো লাগে না?

জি না।

রবি ঠাকুরেরও স্কুল ভালো লাগত না। তাই বলে তুমি মনে করো না যে তুমি রবি ঠাকুর।

আমি মনে করি না।

গুড। এখন বলে তো আমার চেহারাটা রবি ঠাকুরের মতো না?

জি।

মুশকিল হচ্ছে কী জানো? টাক পড়ে যাচ্ছে। টাকিওয়ালা রবীন্দ্রনাথ অসহ্য, তাই না?

আমরা কিছু বললাম না। ভদ্রলোক আমাদের রেখে হোমিওপ্যাথির শিশি হতে নিয়ে উধাও হয়ে গেলেন। আমি মুনিবকে বললাম তোর এই নানা কি পাগল?

না, পাগল হবে কেন?

কেমন কেমন করে যেন তাকাচ্ছে।

মুনির কী একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল, কারণ ভদ্রলোক আবার এসে ঢুকেছেন। হোমিওপ্যাথি, ওষুধের শিশিতে হলুদ রঙের ধোঁয়াটে কী একটা জিনিস।

সাবধানে রাখবি। মুখ গালা দিয়ে সিল করে রেখেছি। খবরদার, সিল ভাঙবি না। মাঝে মাঝে চাঁদের আলোতে রাখবি। এরা চাঁদের আলো খায়। ব্ৰহ্মপুত্রের পাড় দিয়ে বোতল হাতে নিয়ে হাঁটবি। এরা টাটকা বাতাস পছন্দ করে।

আমি বললাম, বোতলের ভেতর তো বাতাস যাবে না।

ভদ্রলোক কড়া গলায় বললেন, এই ছেলে তো বেশি কথা বলে। শোন ছোকরা, কথা কম বলবে।

জি আচ্ছা।

এখন বাড়ি চলে যাও। যাবার আগে একটা কবিতা শুনে যাও। টাটকা কবিতা। আজ বিকেলে লিখেছি। দুঘণ্টা মতো হয়েছে। এখনো বাসি হয় নি। ছঘণ্টার আগে কবিতা বাসি হয় না। শুধু গরম কালে তিন ঘণ্টাতেই বাসি হয়।

আমরা চুপচাপ বসে আছি। রবি নানা পকেটে হাত দিয়ে কবিতা লেখা কাগজ বের করলেন। মাথা দুলিয়ে পড়তে শুরু করলেন–

আমাদের ছোটনদী চলে বাঁকে বাঁকে
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গরু
পার হয় গাড়ি।
দুই ধার উঁচু তার
ঢালু তার পাড়ি।

কবিতাটা আমার বেশ ভালো লাগল। তবে কেন জানি মনে হতে লাগল। আগেও পড়েছি।

কবিতাটা কেমন?

খুবই ভালো।

ব্ৰহ্মপুত্র নিয়ে লেখা। আচ্ছা, যাও এখন, বাড়ি যাও। রাত হয়ে যাচ্ছে।

ভূতের বাচ্চা নিয়ে আমরা চলে এলাম। আমার বারবার মনে হতে লাগল এটা সত্যি নয়। কোথাও মস্ত একটা ফাকি আছে। মুনিরের একটা হাত পকেটে। সেই হাতে সে নিশ্চয়ই বোতল ধরে আছে। একবার সে ক্ষীণ গলায় বলল, কেমন জানি গরম-গরম লাগছে।

ব্ৰহ্মপুত্রের পাশ দিয়ে আসছি। নদীর উপর ক্ষীণ চাঁদের আলো। আমাদের কেন জানি বেশ ভয়ভয় করতে লাগল। মুনির ফিসফিস করে বলল, বোতলটার ভেতর ঐটা নড়াচড়া করছে রে।

ভয় লাগছে।

হুঁ।

আমার কাছে দিয়ে দে। সকালবেলা নিয়ে নিবি। দিনের আলোয় আর ভয় লাগবে না। মুনির সঙ্গে সঙ্গে আমাকে শিশিটা দিয়ে দিল। প্যান্টের পকেটে রেখে দিলাম। কিছুক্ষণ পর পকেটে হাত দিয়ে দেখি সত্যি সত্যি একটু যেন গরম গরম লাগছে।

বাসায় এসে ভয়াবহ দুঃসংবাদ শুনলাম। অংক স্যার নাকি সন্ধ্যার পর এসেছিলেন। আমি এখনো ফিরি নি। শুনে খুব রেগে গেছেন। বলে গেছেন আবার আসবেন।

অংক স্যারের এই হচ্ছে একটা বদ অভ্যাস। হঠাৎ হঠাৎ সন্ধ্যার পর ছাত্রদের বাড়িতে উপস্থিত হন। বাজখাই গলায় বলেন, কী, পড়াশোনা হচ্ছে কেমন? দেখি পাটিগণিতটা আন তো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *