০১. মুনা ঘড়ি দেখতে চেষ্টা করল

গেটের কাছে এসে মুনা ঘড়ি দেখতে চেষ্টা করল। ডায়ালটা এত ছোট কিছুই দেখা গেল না। আলোতেই দেখা যায় না, আর এখন তো অন্ধকার। রিকশা থেকে নেমেই একবার ঘড়ি দেখেছিল সাড়ে সাত। গলির মোড় থেকে এ পর্যন্ত আসতে খুব বেশি হলে চার মিনিট লেগেছে। কাজেই এখন বাজে সাতটা পঁয়ত্ৰিশ। এমন কিছু রাত হয়নি। তবু মুনার অস্বস্তি লাগছে। কালও ফিরতে রাত হয়েছে। তার মামা শওকত সাহেব একটি কথাও বলেননি। এমন ভাব করেছেন যেন মুনাকে দেখতেই পাননি। আজও সে রকম করবেন।

মুনা গেট খুলে খুব সাবধানে ভেতরে ঢুকল। জায়গাটা প্যাচপ্যাচে কাদা হয়ে আছে। সকালে বাবুকে দুবার বলেছিল ইট বিছিয়ে দিতে। সে দেয়নি। বারান্দায় বাতিও জুলায়নি। পা পিছলে। উল্টে পড়লে শাড়ি নষ্ট হবে। নতুন জামদানী শাড়ি। আজই প্রথম পরা হয়েছে। একবার কাদা লেগে গেলে আর তোলা যাবে না। মুনা পা টিপে টিপে সাবধানে এগুতে লাগল।

মামার গলা পাওয়া যাচ্ছে। বকুলকে ইংরেজি পড়াচ্ছেন। সকাল বেলা রাখাল বালক বাঁশি বাজাইতেছিল, বল ইংরেজি কী হবে? বকুল ফোপাচ্ছে। চড়টির খেয়েছে হয়ত। ইদানীং মামার মেজাজ বেশ খারাপ যাচ্ছে। মুনা মনে মনে ট্রানস্লেশনটা করতে চেষ্টা করল। রাখাল বালকের ইংরেজি কী হবে? ফারমার বয়? না অন্য কিছু? অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে সে দরজার কড়া নাড়ল–একবার, দুবার, তিনবার। দরজা খুলতে কেউ এগিয়ে আসছে না। মুনা নিচু স্বরে ডাকল বকুল, এই বকুল।

বকুল ভয়ে ভয়ে তাকাল বাবার দিকে। শওকত সাহেব ধমকে উঠলেন একটা ট্রানস্লেশন করতে একদিন লাগে? বাঁশি বাজাইতেছিল এই ইংরেজি কী বল? বকুল ভয়ে ভয়ে বলল বাবা, মুনা আপা এসেছে। শওকত সাহেব কড়া গলায় বললেন, তোর পড়া তুই পড়। দরজা খোলার লোক আছে। মন থাকে বাইরে, পড়াটা হবে কিভাবে? মাথাতে তো গোবর ছাড়া কিছু নেই। বকুল মাথা নিচু করে ফেলল। তার চোখে পানি আসছে। বাবা দেখে ফেললে আরো রেগে যাবেন। আজেবাজে কথা বলবেন। তিনি একবার রেগে গেলে এমন সব কথা বলেন যে মরে যেতে ইচ্ছা! করে। পরশু বলছিলেন পাতিলের তলার মত মুখ তবু সাজগোজের তো কোনো কমতি দেখি না। একশ টাকার লাগে শুধু পাউডার।

মুনা আবার কড়া নাড়ল। শওকত সাহেব উঁচু গলায় ডাকলেন বাবু, বাবু। বাবু ফ্যাকাশে মুখে ঘরে ঢুকল। সে পড়ে ক্লাস সেভেনে। রোজ সন্ধ্যায়। তার মাথা ধরে বলেই ঘর অন্ধকার করে শুয়ে থাকে। শওকত সাহেব বাবুকে দেখেই রেগে উঠলেন। কানে শুনতে পাস না? বাবু ভয়ে ভয়ে তাকাল বকুলের দিকে। শওকত সাহেব হুংকার দিয়ে উঠলেন দরজা খুলতে পারিস না গরু কোথাকার।

বাবু দরজা খুলল। শওকত সাহেব মুনার দিকে ফিরেও তাকালেন না। কোনো রকম কারণ ছাড়াই বকুলের গালে ঠাস করে একটা চড় বসালেন। ব্যাপারটা ঘটল আচমকা। বকুলের মুখ টকটকে লাল হয়ে উঠল এক মুহূর্তে। মাথা অনেকখানি ঝাঁকিয়ে সে তার খাতায় কী সব লিখতে চেষ্টা করল। লেখাগুলি সব ঝাপসা। চোখ থেকে পানি উপচে পড়ছে। কিছুই দেখা যাচ্ছে না। শওকত সাহেব কর্কশ স্বরে বললেন–মাথা তোল, ঢং করিস না। বকুল মাথা তুলল না। তার ছোট্ট হালকা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। মুনা শান্ত স্বরে বলল মামা, এত বড় মেয়ের গায়ে হাত তোলা ঠিক না। শওকত সাহেব কিছু বললেন না।

মুনা আরো কিছু বলবে ভেবেছিল, বলল না। নিজেকে সামলে নিয়ে তার শোবার ঘরে ঢুকল। এ বাড়িতে দু’টি মাত্র শোবার ঘর। একটিতে মামা এবং মামি থাকেন, অন্যটিতে থাকে মুনা, বকুল এবং বাবু। মুনার রুমটি অসম্ভব ছোট। তবু সেখানে দু’টি চৌকি ঢোকানো হয়েছে। এক কোণায় একটা আলনা। আলনার পাশে বকুলের পড়ার টেবিল। টেবিলের উল্টোদিকের ফাঁকা জায়গাটা একটা বিশাল কালো রঙের ট্রাঙ্ক। তার উপরে প্যাকিং বক্সের ভেতর শীতের লেপ-কাঁথা। এখানে ঢুকলেই দাম আটকে আসে। পুব দিকের একটা বড় জানালায় আলো-হাওয়া খেলত। শওকত সাহেব পেরেক মেরে সেই জানালা বন্ধ করে দিয়েছেন। তার ধারণা খোলা জানালায় গুণ্ডা ছেলেরা এসিড-ফ্যাসিড ছুড়বে। অসহ্য গরমের দিনেও সে জানালা আজ আর খোলার উপায় নেই।

মুনা শোবার ঘরে বাতি জ্বালাল। বাবু বাতির দিকে চোখ কুঁচকে তাকিয়ে আছে। মুনা বলল, আজও মাথাব্যথা?

হুঁ।

বেশি?

বাবু জবাব দিল না। মুনা বলল, বাবু তুই একটু বাইরে দাঁড়া তো, আমি কাপড় ছাড়ব। বাবু বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এক চিলতে বারান্দা। সেখানে একটা ক্যাম্পখাট পাতা আছে। গ্রামের বাড়ি থেকে কেউ এলে এখানে ঘুমুতে দেয়া হয়। বাবু নিঃশব্দে বসিল ক্যাম্পখাটে। মাথাব্যথাটা এখন একটু কমের দিকে। বমি বমি ভাবাটাও কেটে যেতে শুরু করেছে। বাবু লক্ষ্য করেছে মুনা আপা বাসায় এলেই তার মাথাব্যথা কমতে শুরু করে।

মুনা কাপড় বদলে বারান্দায় এসে হাতে-মুখে পানি ঢালল। বাবু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে কিছু বলবে। তবে নিজ থেকে সে কখনো কিছু বলে না। জিজ্ঞেস করতে হয়। মুনা বলল, বাবু কিছু বলবি?

হুঁ।

বলে ফেল।

বাকের ভাই আজ দুপুরে জিজ্ঞেস করছিল।

কী জিজ্ঞেস করছিল?

তোমার কথা।

পরিষ্কার করে বল। অর্ধেক কথা পেটে রেখে দিলে বুঝব কিভাবে?

বাবু ইতস্তত করতে লাগল। মুনা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, বল কী বলল?

বলল, কী রে তোর আপামণি নাকি বিয়ে করছে?

তুই কী বললি?

আমি কিছু বলিনি।

কিছুই বলিসনি?

বাবু ইতস্তত করে বলল, বলেছি, আমি কিছুই জানি না। মুনা বিরক্ত স্বরে বলল, মিথ্যা বললি কেন? সত্যি কথাটা বলতে অসুবিধা কী? সত্যি কথা বললে সে কী তোকে মারত? আবার যদি কোনোদিন জিজ্ঞেস করে, তুই বলবি, হ্যাঁ বিয়ে করবে। বাবু মুখ ফিরিয়ে নিল, যেন সত্যি কথাটা সে স্বীকার করতে চায় না। এই ব্যাপারটার জন্যে সে যেন লজিত। মুনা কড়া গলায় বলল, অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে আছিস কেন? তাক আমার দিকে। বাবু তাকাল। মুনা হালকা স্বরে বলল, তোরা সবাই এ রকম ভাব করিাস যেন আমি মস্ত একটা অন্যায় করে ফেলেছি। একটা মেয়ে যদি একটা ছেলেকে পছন্দ করে এবং বিয়ে করে তাহলে তার মধ্যে লজ্জার কিছুই নেই; তুই যখন বড় হবি তখন তুইও এ রকম পছন্দ করে একটা মেয়েকে বিয়ে করবি।

যাও।

তুই দেখি লজ্জায় একেবারে মরে যাচ্ছিস।

মুনা। আপা ভাল হবে না কিন্তু।

তুই মুনা আপা মুনা আপা করিস কেন? শুধু আপা ডাকবি। কিংবা বড় আপা। সঙ্গে আবার মুনা কী জন্যে?

আচ্ছা। আপা, তোমাদের বিয়ে কবে?

সামনের মাসে।

বাবু আর কিছু জিজ্ঞেস করল না। সে মনে হল বেশ লজ্জা পাচ্ছে। মুনা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোরা কেউ আমাকে সহ্য করতে পারিস না। বাবু লজ্জিত স্বরে বলল, কী যে তুমি বল।

ঠিকই বলি। ইট বিছিয়ে রাখতে বলেছিলাম, বিছিয়েছিস? সন্ধ্যার পর বারান্দায় বাতি জ্বালিয়ে রাখতে বলেছিলাম তাও তো রাখিসনি।

বাবু কী যেন বলতে চাইল, মুনা তা শোনার জন্যে অপেক্ষা করল না। মামা-মামির শোবার ঘরে ঢুকল। এই ঘরটিতে কিছু জায়গা আছে। একটা আলমারি, ছোট একটা ড্রেসিং টেবিল; তার পাশে বিয়েতে পাওয়া পুরনো আমলের ভারী খাট, একটা কালো রঙের আলনা। তবুও কিছু ফাঁকা জায়গা আছে।

মুনা ঘরে ঢুকতেই তার মামি লতিফা হাত ইশারা করে তাকে কাছে ডাকলেন। তার হাত ইশারা করে ডাকার ভঙ্গি ও তাকানোর ধরন-ধারণ দেখেই টের পাওয়া যায় কিছু একটা ঘটেছে। মুনা বিছানার পাশেই বসল।

মামি শরীর কেমন?

ভালোই।

জ্বর আসেনি তো?

উঁহু।

মুখে উঁহু বললেও বোঝা যাচ্ছে গায়ে জ্বর আছে। চোখ লালচে। কপালের চামড়া শুকিয়ে খড়খড় করছে। চারদিকে অসুস্থ অসুস্থ গন্ধ। লতিফা তার রোগা হাতে মুনার হাত চেপে ধরলেন। গলার স্বর অনেক খানি নিচে নামিয়ে বললেন, তোর মামা যায় নাই।

কেন, যায়নি কেন?

আমি কী করে বলব?

আংটি দেখিয়েছিলো?

হুঁ! আংটি দেখে আরো রাগ করেছে। বাবু সামনে পড়ে গেল তখন। রাগের চোটে ওকে ধাক্কা মেরে ফেলেছে খাটে। জিব কেটে গেছে বোধ হয়। রক্ত পড়ছিল।

বল কী?

হুঁ।

লতিফা কান্নার মত শব্দ করতে লাগলেন। মুনা একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস গোপন করল। আজ দুপুরে লতিফার বড় ভাই মোজাম্মেল হোসেন সাহেবের ছোট মেয়ের আকিকা। সেই উপলক্ষে এ বাড়ির সবার দাওয়াত ছিল। শওকত সাহেব যেতে রাজি হলেন না। দাওয়াত প্রসঙ্গে অত্যন্ত তেতো ধরনের কিছু কথা বললেন, ফকির খাওয়ানোর বদলে আমাদের খাইয়ে দিচ্ছে। তু বলে ডাকলেই যাব নাকি? পেয়েছি কী আমাকে? আমি ভিখিৱি নাকি? আমি তো যাই না। এ বাড়ির কেউ যদি যায় ঠ্যাং ভেঙে দেব।

লতিফা এই জাতীয় কথায় বিশেষ কান দেননি। তাঁর বড় ভাই তাকে করুণার চোখে দেখে বলেই হয়ত গোপন সঞ্চয় ভেঙে মুনাকে দিয়ে একটা আংটি কিনিয়ে এনেছিলেন। তার আশা ছিল রাগটোগ ভাঙিয়ে দুপুরের দিকে পাঠাতে পারবেন। কিন্তু পারেননি।

মুনা উঠে দাঁড়াল। শান্ত স্বরে বলল, তুমি খাওয়া-দাওয়া কিছু করেছ? লতিফা জবাব দিলেন না। মুনা বলল, কাল অফিসে যাবার সময় আংটি দিয়ে আসব আর বলব তোমার অসুখের জন্যে কেউ আসতে পারেনি। কথাটা তো মিথ্যাও না। লতিফা কী যেন বললেন। মুনা শোনার অপেক্ষা না করে রান্নাঘরে চলে গেল। ভাত চড়াতে হবে। কাজের ছেলেটি চলে যাওয়ায় খুব ঝামেলা হচ্ছে। সারাদিন অফিস করে চুলার পাশে এসে বসতে ইচ্ছা করে না। বড় খারাপ লাগে।

মুনা আপা, বাবা ডাকে।

মুনা দেখল বাবুর মুখ রক্তশূন্য। যেন বড় রকমের কোনো বিপদ আশংকা করছে সে। মুনা স্বাভাবিক ভাবেই বলল, এখন যেতে পারব না। ভাত চড়াচিছে, দেরি হবে।

না, তুমি এখন চল।

কী ব্যাপার?

বাবু কিছু বলল না। তার চোখ-মুখ ফ্যাকাশে, রক্তশূন্য চেহারা। সে বেশ ভয় পেয়েছে।

শওকত সাহেব চেয়ারে পা তুলে শক্ত হয়ে বসে আছেন। ছোটখাটো মানুষ। মাস তিনেক আগেও স্বাস্থ্য ভাল ছিল। এখন অসম্ভব রোগা হয়ে গেছেন। গালটাল ভেঙে একাকার। চুল উঠতে শুরু করেছে। মাথা ভর্তি চকচকে টাকের আভাস। মেজাজও হয়েছে খারাপ। কথায় কথায় রেগে ওঠেন। গতকাল প্ৰায় বিনা কারণে কাজের ছেলেটিকে ছাড়িয়ে দিয়েছেন।

শওকত সাহেবের চোখে চশমা। এটি একটি বিশেষ ঘটনা। কারণ চশমা তিনি পরেন না। তাঁর ধারণা চশমা পরলেই চোখ খারাপ হতে থাকবে এবং বুড়ো বয়সে পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যেতে হবে। আজ হঠাৎ চশমা চোখে দেয়ার কারণ স্পষ্ট নয়। খুব সম্ভব পরিবেশ বদলাতে চাচ্ছেন।

মুনা ঢোকা মাত্র তিনি ইশারায় তাকে বসতে বললেন। মুনা বসল না। শওকত সাহেব কঠিন স্বরে বললেন, তুই আমার ছেলেমেয়েগুলিকে নষ্ট করছিস।

কীভাবে?

তোর কাছ থেকে সাহস পেয়ে এরা এ রকম করে। সামান্য একটা চড় দিয়েছি, এতেই মেয়ে উঠে গিয়ে বাথরুমে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। এত বড় সাহস।

সাহস না মামা, লজ্জা।

লজ্জা? লজ্জার কী আছে। এর মধ্যে?

তুমি বুঝবে না মামা।

বুঝবে না কেন?

মুনা চেয়ার টেনে মামার মুখোমুখি বসল। শওকত সাহেব নড়েচড়ে বসলেন। মুনাকে কেন জানি তিনি একটু ভয় করেন। মুনা শান্ত স্বরে বলল, এতবড় মেয়ের গাযে হাত তোলা ঠিক না। মামা।

এত বড় মেয়ে কোথায় দেখলি তুই?

মেট্রিক দিচ্ছে তিন মাস পর। সে ছোট মেয়ে নাকি?

নিজের মেয়েকে শাসনও করতে পারব না?

না।

না মানে?

না মানে না। আর কিছু বলবে?

তুই এ বাড়ি থেকে যাবি কবে?

বিয়ে হোক তারপর তো যাব। বিয়ের আগে যাই কী করে? নাকি তুমি চাও এখনই চলে যাই?

শওকত সাহেব সিগারেট ধরালেন। মুনা সহজ স্বরে বলল মামা, তুমি আমার সঙ্গে এ রকম ব্যবহার করছ কেন?

কী রকম ব্যবহার করছি?

কথাটথা বল না। যেন আমাকে চিনতেই পার না।

রোজ রাতদুপুরে বাসায় ফিরবি আর আমি তোকে কোলে নিয়ে নাচব? এটা ভদ্রলোকের বাসা না? পাড়ার লোকের কাছে আমার ইজ্জত নেই?

কয়েকটা দিন মামা। তারপর তুমি তোমার ইজ্জত নিয়ে থাকতে পারবে।

মুনা উঠে দাঁড়াল।

শওকত সাহেব চুপ করে গেলেন। মুনা বলল, তুমি আর কিছু বলবে? তিনি জবাব দিলেন না। মুনা চলে এল রান্নাঘরে। বাথরুমের দরজা খুলে বকুল বের হয়েছে। তার চোখ-মুখ ভেজা। আচার-আচরণ বেশ স্বাভাবিক। সে আবার তার বাবার কাছে পড়তে গেল। যেন কিছুই হয়নি। শওকত সাহেব শুকনো মুখে মেয়েকে ইংরেজি গ্রামার পড়াতে লাগলেন। বকুল এবার ইংরেজিতে তেইশ পেয়েছে। হেড মিসট্রেস প্রগ্রেস রিপোটো লিখে দিয়েছেন ইংরেজের একজন টিচার রাখার জন্যে।

ভাত চড়াবার আগে মুনা দুকাপ চা বানোল। বাবুকে দিয়ে এক কাপ পাঠাল মামার কাছে। অন্য কাপটি রাখল নিজের জন্যে। বড় ক্লান্ত লাগছে। রান্নার ব্যাপারে কোনো উৎসাহ পাওয়া যাচ্ছে না।

খাওয়া-দাওয়া সারিতে রাত হল। ভাদ্র মাস। বিশ্ৰী গরম। গা ঘামে চটচট করছে। মুনা বকুলকে সঙ্গে নিয়ে বাইরের বারান্দায় মোড়া পেতে বসেছে। কিছু বাতাস পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু শোবার ঘর নরক হয়ে আছে। আজ রাতে ঘুমানো যাবে বলে মনে হয় না। বকুল বলল, আপা তোমরা বাসা পেয়েছে?

না। মালিবাগে একটা ফ্ল্যাট দেখলাম। বেশ ভাল, চার তলায়।. খুব হাওয়া, পনেরশ টাকা চায়।

নিয়ে নাও।

নিয়ে নিলে খাব কী? ও বেতনই পায় পনেরশ।

তুমিও তো পাও।

আমি পাই নয়শ পঁচাত্তর। নয়শ পঁচাত্তরে দুজনের চলবে?

বকুল কিছু বলল না। মুনা হালকা স্বরে বলল, মনে হয় বৃষ্টি হবে। বিজলি চমকাচ্ছে। বৃষ্টি নামলে আজ ভিজব।

তোমার টনসিালের দোষ। টনসিল ফুলে যাবে।

যা ইচ্ছা হোক, আজ ভিজব। সারা রাত যদি বৃষ্টি হয়। সারা রােতই ভিজব। দেখিস তুই।

বকুল অস্পষ্ট স্বরে হাসল। মুনা আপার অনেক পাগলামি আছে। রাতের বেলা বৃষ্টি হলেই সে ভিজে অসুখ বাধায়। যেন অসুখ বাধাবার জন্যেই ভিজে। বকুল নিচু গলায় বলল, বাকের ভাই তোমার ব্যাপারে খোজখবর করছিল জানো?

জানি।

খুব নাকি হাম্বিতম্বি করছিল?

মুনা তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল, হাম্বিতম্বি মানে? সে হস্তিম্বি করার কে? তার অনুমতি নিয়ে আমাকে বিয়ে করতে হবে?

বাবুকে নাকি কী সব আজেবাজে কথা বলেছে।

কই বাবু তো আমাকে কিছুই বলেনি। আয় তো যাই জিজ্ঞেস করি।

বকুল উঠল না। তার বসে থাকতে ভালই লাগছে। ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। হয়ত সত্যি সত্যি বৃষ্টি নামবে। এই বাড়ির ছাদে টিনের হওয়ায় বৃষ্টির শব্দ চমৎকার পাওয়া যায়। মুনা বিরক্ত স্বরে ডাকল এই চল, জিজ্ঞেস করে আসি বাবুকে।

বাবু তো পালিয়ে যাচ্ছে না। আরেকটু বাস। তোমাকে একটা মজার ঘটনা বলব।

বকুল মজার ঘটনা বলতে শুরু করার আগেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। ভদ্র মাসের বৃষ্টি বেশিক্ষণ থাকে না। মুনা বকুলকে নিয়ে ভেতরের উঠোনে ভিজতে নামল। বকুল খানিকটা সংকোচ বোধ করছিল কারণ শওকত সাহেব ভেতরের বারান্দায় চশমা পরে বসে আছেন। বকুলের ধারণা তিনি বাজে ধরনের একটা ধমক দেবেন। কিন্তু শওকত সাহেব তেমন কিছুই করলেন না। তার নিজেরও কেন জানি পানিতে নেমে যেতে ইচ্ছা করছিল। এবং এর রকম একটা ইচ্ছার জন্যে লজ্জিত বোধ করছিলেন। মুনা উঁচু গলায় বাবুকে ডাকল, এই বাবু নেমে আয়। বাবু নামল না। ভয়ে ভয়ে তাকাল বাবার দিকে। মুনা বিরক্ত স্বরে বলল এত ঢং করছিস কেন? আয়।

শওকত সাহেব বাবুকে সুযোগ দেবার জন্যেই হয়ত শোবার ঘরে ঢুকে পড়লেন। বাবু বসেছে উঠোনে। বকুল একবার বলল আপা, ঠাণ্ডা লেগে যাবে। মুনা নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল লাগুক।

তোমার টনসিল।

আমার টনসিালের ভাবনা আমি ভাবব। তোর ভিজতে ইচ্ছা না করলে উঠে যা।

তুমি যতক্ষণ থাকবে আমিও ততক্ষণ থাকব।

আমি থাকব। সারারাত।

আমিও।

বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে ঘনঘন। বুপকূপ করে বৃষ্টি পড়ছে। এক সময় ইলেকট্রিসিটি চলে গিয়ে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। বাবু শীতে কাঁপতে কাঁপতে বলল আমি উঠলাম। আপা! উঠতে গিয়ে সে আবার পিছলে পড়ল। খিলখিল করে হেসে উঠল মুনা। অন্ধকার বৃষ্টির রাতে সেই হাসি এমন চমৎকার শোনাল।

1 Comment
Collapse Comments

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *