সংশয়ী রচনাবলী (অনুবাদ)
উৎসর্গ – অধ্যাপক কবীর চৌধুরী
[সংশয়ী রচনা – বাট্রাণ্ড রাসেলের স্কেপটিক্যাল প্রসেজ-এর বাংলা অনুবাদ। ১৯৯০ সালে বাংলা একাডেমী প্রথম সংস্করণ প্রকাশ করেছিলো। পরে বাংলাবাজারের প্যারীদাস রোডস্থ খান ব্রাদার্স এ্যান্ড কোম্পানি একটি নতুন সংস্করণ প্রকাশ করেছে।]
মুখবন্ধ : সংশয়বাদের মূল্যনির্ধারণ প্রসঙ্গে
আমি পাঠকদের সুবিবেচনার জন্য এমন একটি মত উপস্থিত করতে চাই যা তাদের কাছে উদ্ভট এবং ধ্বংসাত্মক মনে হবে বলে আমার আশঙ্কা হয়। কোন বক্তব্য অথবা যুক্তিকে সত্য বলে স্বীকার করার পর্যাপ্ত কারণ না থাকলে তা সত্য বলে কোন ক্ষেত্রে অনুমান না-করাই হলো আমার প্রস্তাবিত মতবাদ। আমি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস করি যে এ রকম মতবাদ সাধারণ্যে গৃহীত হলে আমাদের সামাজিক জীবনধারা এবং রাজনৈতিক পদ্ধতি যে গুলোকে এখন নির্দোষ মনে করা হয়, তার মধ্য থেকে দোষ বের করে আমাদের রাষ্ট্রনৈতিক পদ্ধতি এবং সামাজিক জীবনধারার মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে। তা সম্ভব হলে ঝাঁঝালো বক্তা, বই ব্যবসায়ী, ধর্মযাজক এবং অন্যান্য যারা মানুষের অযৌক্তিক বিশ্বাসকে ভিত্তি করে বেঁচে থাকে, মানুষের ইহ-পরকালের সৌভাগ্যের জন্য কিছুই করে না, তাদের আয় যে সাংঘাতিকভাবে : কমে যাবে সে ব্যাপারেও আমি আত্মসচেতন (যা আরো বেশি বিপজ্জনক)। অনেক প্রতিকূল মারাত্মক যুক্তি থাকা সত্বেও আমি মনে করি, আমার অপ্রিয় মতবাদ সম্পর্কে বলবার মতো অনেক কিছু রয়েছে এবং বলতে আমি চেষ্টাও করবো।
প্রথমতঃ, আমি নিজেকে চূড়ান্তবাদী করে তোলার বিপক্ষে- আত্মসংযম বজায় রাখার ইচ্ছা পোষণ করি। আমি একজন বৃটিশ হুইগ, সেজন্য আমার মধ্যেও বৃটিশ আপোষমূলক এবং উদারনৈতিক মনোভাব বর্তমান। পিরহোনিজমের (pyrrohonsim) প্রবর্তক পিরহো সম্বন্ধে একটি গল্প প্রচলিত আছে। (পিরহোবাদ বা পিরহোনিজম হলো সংশয়বাদের পুরনো নাম।) এক ধরণের কর্মপন্থা যে অন্য ধরণের কর্মপন্থা অপেক্ষা নিশ্চিতভাবে বিজ্ঞোচিত একথা তিনি বিশ্বাস করতেন না। একদিন বিকেল বেলায় যখন তিনি তার প্রাত্যহিক ভ্রমণ সারছিলেন, দেখতে পেলেন তার দর্শনের অধ্যাপক একটি খানার মধ্যে পড়ে মাথাসমান ডুবে আছেন। (এই অধ্যাপকের কাছ থেকেই তিনি দর্শন শিখেছিলেন। কোনরকমেই বেরিয়ে আসতে পারছেন না। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর চলে গেলেন। তিনি চিন্তা করলেন যে এই বুড়োকে টেনে তুলে তিনি যে ভালো কাজ করবেন তার কোন প্রমাণ নেই। যাঁরা কম সংশয়বাদী ছিলেন তারা তাকে উদ্ধার করে পিরহোর হৃদয়হীনতার নিন্দা করলেন। কিন্তু তার অধ্যাপক ছিলেন নীতিতে অটল বিশ্বাসী, তিনি পিরহোর নীতিনিষ্ঠার প্রশংসা করলেন। কিন্তু বর্তমানে আমি ততখানি বাহাদুরিপূর্ণ সংশয়বাদের ওকালতি করছি না। থিয়োরি হিসেবে না হলেও বাস্তবে আমি সাধারণজ্ঞানের সাধারণ বিশ্বাসরাজীর প্রতি সংশয়ের দৃষ্টি দিতে প্রস্তুত। আমি বিজ্ঞানের কোন প্রতিষ্ঠিত ফলাফলকে সত্য বলে না স্বীকার করে যুক্তিগত কর্মের অধিকতররা সম্ভাব্য ভিত্তি বলে মেনে নিতে প্রস্তুত। যদি বলা হয় অমূক তারিখে চন্দ্রগ্রহণ হবে আমার মনে হয় গ্রহণ হচ্ছে কি না দেখা অবশ্যই উচিত। পিরহো হলে অবশ্য অন্যরকম চিন্তা করতেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমি মধ্যমপন্থার কথা বলছি, একথা দাবি করা যুক্তিসঙ্গত বলে আমার ধারণা।
এমন অনেক ব্যাপার আছে, সে সব ব্যাপারে যারা পরীক্ষা করে দেখেছেন,তারা একমত হয়েছেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে গ্রহণের তারিখের কথা বলা যায়। এমনও অনেক বিষয় আছে, যে ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা একমত হতে পারেন না। আবার বিশেষজ্ঞরা একমত হলেও ভুল করতে পারেন। মধ্যাকর্ষণে আলোকের প্রতিসরণের যে গুরুত্ব আইনস্টাইন আবিস্কার করেছিলেন, বিশেষজ্ঞরা তার সঙ্গে বিশ বছর আগে একমত হন নি, কিন্তু তারপরেও তা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। তা সত্বেও বিশেষজ্ঞরা যখন মতামতের ব্যাপারে একই মনোভাব পোষণ করেন, তখন বিরুদ্ধ কোন মতামতের চাইতে তাদের মতামতই সত্য হবে এটা আশা করা যায়। যে সংশয়বাদের পক্ষে আমি ওকালতি করতে চাই, তাহলো (১) যখন বিশেষজ্ঞরা একমত তখন বিরুদ্ধ মতামতকে নিশ্চিত বলে গ্রহণ করা হবে না। (২) যখন বিশেষজ্ঞরা একমত নন তখন অবিশেষজ্ঞের কোন মতামতকেই সত্য বলে গ্রহণ করবো না, এবং (৩) যখন নির্দিষ্ট কোন মত গ্রহণ করার পক্ষে প্রচুর যুক্তি থাকবে না তখন সাধারণ মানুষ কোন মতামত না দিলে ভালো করবে।
আপাতদৃষ্টিতে এ সকল প্রস্তাব খুবই নাজুক বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তা সত্বেও যদি গ্রহণ করা হয়, তাহলে সামাজিক জীবনকে তা ব্যাপকভাবে বিপ্লবায়িত করবে।
যে সকল কারণে মানুষ যুদ্ধ করতে ইচ্ছুক হয় এবং অত্যাচার করে, উপরোক্ত শ্রেণীর যে কোন এক শ্রেণীর অন্তর্গত-সংশয়বাদ তাদেরকে তীব্রভাবে সমালোচনা করে। কোন মতামতের যুক্তিগত ভিত্তি থাকলে পরে মানুষ সেগুলোকে তুলে ধরে সন্তুষ্ট থাকে এবং কাজে প্রয়োগ করা পর্যন্ত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে। এসব ক্ষেত্রে মানুষ মতামতের সঙ্গে আবেগকে জড়ায় না এবং শান্তভাবে মতামতকে তুলে ধরে এবং ধীরস্থিরভাবে পেছনের যুক্তির সাহায্যে বিশ্লেষণ করে। যে সকল মতামতের সঙ্গে আবেগের খুবই ঘনিষ্ট সম্পর্ক, সেগুলো সাধারণতঃ যুক্তির সুদৃঢ় ভিত্তির উপর সুপ্রতিষ্ঠিত নয় এবং আবেগের আধিক্যের সাহায্যেই যুক্তির অক্ষমতা প্রমাণ করা যায়।
ধর্ম এবং রাজনীতির ক্ষেত্রে প্রায় সবসময় এমন সব মতামত গ্রহণ করা হয় যার সঙ্গে আবেগের সুগভীর অন্বয় বর্তমান চীনদেশ ছাড়া অন্যান্য দেশে এসব বিষয়ে জোরালো বক্তব্য যদি কোন মানুষের না থাকে তাহলে তাকে খুবই হতভাগ্য মনে করা হয়। মানুষ তাদের বিপরীত মনের আবেগবান সমর্থকদের যত বেশি ঘৃণা করে, তারও চেয়ে বেশি ঘৃণা করে সংশয়বাদীদের। এসব ব্যাপারে বাস্তব জীবনের দাবিতে যে সকল মতামতের প্রয়োজন হয় তা অতিযুক্তিবাদী হয়ে গেলে সামাজিক জীবন অসম্ভব হয়ে পড়বে। আমি বিশ্বাস করি এর বিপরীতে বিশ্লেষণ করলে, আমার এ মতামতকে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করা হবে।
১৯২০ সালের বেকার সমস্যার কথা ধরা যাক। এক পার্টির মতে ট্রেড ইউনিয়নের অন্যায়ের ফলে তা হয়েছে, অন্য পার্টির মতে মহাদেশের বিশৃঙ্খলার কারণেই তা ঘটেছিল। তৃতীয় পার্টি এ সকল কারণ মেনে নিয়ে অধিকাংশ দোষ ইংল্যাণ্ডের ব্যাঙ্কের ঘাড়ে চাপিয়েছিল, যেহেতু ইংল্যাণ্ডের ব্যাঙ্ক পাউণ্ডের মান বৃদ্ধি করেছিল। আমি জানতে পেরেছি যে এই তৃতীয় পার্টির মধ্যে সকলেই ছিলেন বিশেষজ্ঞ, আনাড়ি কেউ ছিলেন না। পার্টির বক্তৃতায় যে মতামতকে প্রকাশ করা যায় না, সে মতামতে রাজনৈতিক ব্যক্তি কোন আগ্রহ পোষণ করেন না। যে সকল মতামত বিরুদ্ধপক্ষীয়দের দুর্ভোগের কারণ হয়ে থাকে, সে সকল মতামতকেই সাধারণ মানুষ পছন্দ করে বেশি। ফলতঃ মানুষ অসার মতামতের পক্ষে-বিপক্ষে সংগ্রাম করে। পক্ষান্তরে আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না বলে অল্পসংখ্যক মানুষ, যাঁদের যুক্তিনিষ্ঠা রয়েছে, তাদের কথার কেউ কর্ণপাত করে না। মতে দীক্ষিত করতে গেলে ইংল্যান্ডের ব্যাঙ্ক যে খারাপ এ কথা বোঝাতে হবে। শ্রমিক দলীয়দের আস্থা অর্জন করতে গেলে ব্যাঙ্ক অব ইংল্যাণ্ডের ডিরেক্টরদের ট্রেড ইউনিয়নের বিরুদ্ধবাদী বলে দেখাতে হবে। লণ্ডনের ধর্মাধ্যক্ষের সমর্থন পাওয়ার জন্য এ সকল কাজকে নৈতিকতাবিরোধী দেখাতে হবে। মুদ্রা সম্পর্কে তাদের যে মতামত সত্য নয়, এমন মতবাদেও বিশ্বাস করতে হবে।
আর একটা দৃষ্টান্ত দেয়া যাক। অনেক সময় বলা হয়ে থাকে, সমাজতন্ত্রবাদ মানবপ্রকৃতির পরিপন্থী। আবার সমাজতন্ত্রবাদীরাও তাদের বিরুদ্ধবাদীর বিপক্ষে এই উত্তপ্ত অভিযোগ করে থাকেন। পরলোকগত ড. রিভার্স (Dr. Rivers) বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের একটি বক্তৃতায় এ প্রশ্নের আলোচনা করেছেন, যা পরে তার মূল্যবান বই ‘মনোবিজ্ঞান এবং রাজনীতিতে (Psychology and Politics) প্রকাশিত হয়েছে। আমার জানামতে এটিই হচ্ছে একমাত্র আলোচনা, যা বৈজ্ঞানিক বলে দাবি করতে পারে। কতিপয় নৃতাত্ত্বিক উপাদানের উপর নির্ভর করে দেখাতে চেয়েছিলেন যে মেলানেশিয়াতে (Melanesia) সমাজতন্ত্রবাদ মানবপ্রকৃতির পরিপন্থী নয়। পরে তিনি অবশ্য বলেছেন যে মানুষের প্রকৃতি মেলানেশিয়াতে যেমন ইউরোপেও তেমন কি না আমরা জানিনা। উপসংহারে তিনি মন্তব্য করেছেন যে ইউরোপের মানুষ প্রকৃতির পরিপন্থী কিনা আবিষ্কার করার চেষ্টা হলো এটি : এটি খুবই কৌতূহলপ্রদ যে এই উপসংহারের উপরই ভিত্তি করে তিনি শ্রমিকদলের প্রার্থী হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার সঙ্গে তিনি রাজনৈতিক বিতণ্ডার মধ্যে যে পরিমাণ উত্তাপ এবং আবেগ জড়িত থাকে নিশ্চিতভাবে তা ঘটতে দেন নি।
এখন আমি এমন একটি বিষয়ে আলোচনা করার দুঃসাহস করছি যা মানুষ নিরুত্তপ্ত আবেগে দেখতে অধিকতর অসুবিধার সম্মুখীন হয়। সে বিষয়টি হলো বিবাহরীতি। প্রতিটি দেশের অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করে যে নিজের দেশের বিবাহপদ্ধতি ছাড়া আর সবরকমের বিবাহপদ্ধতি নীতিসম্মত নয়। যারা এ মতামতের বিরোধিতা করে, সাধারণতঃ আপনাপন অনিশ্চিত জীবনের খাতিরেই করে থাকে। ভারতে বিধবাদের পুনরায় বিবাহের কথা চিন্তা করাই হলো জঘণ্য অপরাধ। ক্যাথলিকপ্রধান দেশে বিবাহ বিচ্ছেদকে খুবই মন্দ কাজ বলে গণ্য করা হয়, তবে অন্ততঃ পুরুষের ব্যাপারে যৌথজীবনের সততা বজায়ের কিছু অক্ষমতাকে বরদাশত করা হয়। আমেরিকাতে বিবাহ বিচ্ছেদ খুবই সহজ, কিন্তু বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ভয়ঙ্করভাবে নিন্দিত হয়। মুসলমানেরা বহুবিবাহে বিশ্বাসী, অথচ আমরা চূড়ান্ত নিন্দনীয় মনে করি। এ সকল বিপরীত মতামতকে অপ্রতিরোধ্য এবং চূড়ান্ত বলে ধরে নেয়া হয় এবং যারা এর বিরোধিতা করেন, তাদের উপর নির্মম নির্যাতন করা হয়। কিন্তু বিভিন্ন দেশের কেউ প্রমাণ করতে চেষ্টা করে না যে তাদের আচারপদ্ধতি অন্যদের আচারের চাইতে মানুষের সুখ সমৃদ্ধির খাতিরে নতুন কিছু দান করেছে।
এ বিষয়ে যখন আমরা বৈজ্ঞানিক আলোচনা (উদাহরণস্বরূপ) ওয়েস্টার ম্যাক (Westermack) এর মানবজাতির বিবাহের ইতিহাসের (History of Human Marriage) এর মতো বইয়ের পাতা খুলে দেখি, আমরা এমন একটি আবহাওয়ার সাক্ষাৎ পাই যা সম্পূর্ণভাবে প্রচলিত কুসংস্কার থেকে ভিন্নরকম। আমরা দেখতে পাই যে যত রকমের আচার-পদ্ধতি প্রচলিত আছে, তার মধ্যে অনেকগুলো মানবপ্রকৃতির পক্ষে ক্ষতিকর বলে অনেকসময় আমরা মনে করে থাকি। বহুবিবাহ বলতে আমরা মনে করি পুরুষেরা জোর করে নারীদের উপর এ অত্যাচারের বোঝ চাপিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তিব্বতীয়দের আচার-ব্যবহার সম্বন্ধে কি মনে করবো। তিব্বতীয় রীতি অনুসারে একজন নারীর অনেকগুলো স্বামী থাকতে পারে। তিব্বতে যারা ভ্রমণ করেছে, তারা নিশ্চিত ভাবে এ কথাই বলেছে যে সেখানে পারিবারিক শান্তি শৃঙ্খলা অন্ততঃ ইউরোপের মতো আছে। এরকম কিছু পড়াশোনার পরে যে কোন সরলমনা মানুষই সংশয়বাদীতে পরিণত হবেন, কারণ এক জাতীয় বিবাহ যে অন্য জাতীয় বিবাহের চেয়ে ভালো বা মন্দ, হাতের কাছে তার প্রমাণ করবার মালমশলা নেই। নিজেদের বিধিনিষেধের প্রতি যারা অশ্রদ্ধেয় মনোভাব পোষণ করে, সাধারণত তাদের প্রতিশোধ গ্রহণ করার সবটুকুতেই নির্মমতা এবং অসহনশীলতা বর্তমান। অন্যথা তাদের মধ্যে কোনকিছুরই মিল নেই। এ থেকে মনে হয় মানুষের পাপ ভৌগোলিক। এই উপসংহার থেকে একপদ অগ্রসর হয়ে নতুন উপসংহারে পৌঁছলে বুঝতে পারবো যে মানুষের পাপের সেই কাল্পনিক পাপীকে শাস্তি দেওয়ার জন্য যে নির্দয়তা নির্মাতা এখনো প্রচলিত আছে, তার প্রয়োজন নেই। এই উপসংহারটি অনেকের মনে তেমন আনন্দ দেবে না, কারণ সুস্থ বিবেকে নির্দয়তার চর্চা করা নীতিবাগীশদের জন্য খুবই আনন্দদায়ক। সে জন্যে তারা নরক আবিষ্কার করেছে।
সন্দেহজনক সবকিছুকে সত্য বলে জোরালোভাবে বিশ্বাস করার চূড়ান্ত নজির হলো জাতীয়তাবাদ। আমার মনে হয় এখন একজন দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বৈজ্ঞানিক ইতিহাস লেখক যে মতামত প্রদান করতে বাধ্য হবেন, যুদ্ধের সময়ে একই মন্তব্য করলে যুদ্ধলিপ্ত যে কোন দেশ তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করতে বাধ্য হতো। চীনদেশ ছাড়া আর কোন দেশ নেই, যে দেশের জনসাধারণ নিজেদের সম্বন্ধে সত্য কথা বললে সহ্য করে। সাধারণতঃ সত্যকে অপ্রিয় ভাবা হয়, কিন্তু যুদ্ধের সময়ে সত্য বলা ভয়ঙ্কর গর্হিত কাজ। বিপরীতধর্মী যে বিস্ফোরক বিশ্বাসের সৃষ্টি করা হয়েছে, এসকল বিশ্বাসের মূলে যে ভ্রান্তি ছাড়া কিছু নাই, তা তখনই ধরা পড়ে যখন দেখা যায় জাতীয়তাবাদীরা ছাড়া কেউ তাকে বিশ্বাস করে না। বিশ্বাসের এ সমস্ত পদ্ধতির মধ্যে বিচার বুদ্ধির প্রয়োগকে আগেকার যুগে ধর্মবিশ্বাসের ক্ষেত্রে বিচার বুদ্ধির প্রয়োগের মতো মন্দ ভেবে থাকে মানুষ। সংশয়বাদ এ সকল ব্যাপারে কেননা মন্দ হবে, এ ব্যাপারে যদি চ্যালেঞ্জ করা হয়, তারা বলে যে পৌরাণিক বিশ্বাস যুদ্ধজয়ে সাহায্য করে অথচ একটা জাতি হত্যা করার চাইতে হত হয় বেশি। সমস্ত বিদেশীদের নিন্দা করে নিজেদের মুখরক্ষা করার মধ্যে যে নিন্দনীয় কিছু আছে তা একমাত্র কোয়েকার (Quaker) শ্রেণী ছাড়া পেশাদার নীতিবাগিশদের মধ্যে তার কোন সমর্থন পাওয়া যায় না। যখন বলা হয় যে একটি যুক্তিবাদী জাতিকে যুদ্ধে জড়িয়ে না পড়ার পন্থা আবিষ্কার করতে হবে, তাহলে উত্তরে জুটবে তিরস্কার।
যুক্তিবাদী সংশয়বাদের প্রসারের কী প্রতিক্রিয়া হতে পারে? আবেগ থেকেই মানুষের কর্মের উৎপত্তি এবং তার ফলে কতেক অন্ধবিশ্বাস জন্মলাভ করে। মনঃসমীক্ষা স্বীকৃত এবং অস্বীকৃত উন্মাদের মধ্যে এর বহিঃপ্রকাশ নিরীক্ষণ করেছে। যে মানুষ লাঞ্ছিত হয়েছে, অনেক সময় একটা থিয়োরি আবিস্কার করে যে সে ইংল্যাণ্ডের রাজাধিরাজ এবং তার সপক্ষে এমন সব যুক্তি ও ব্যাখ্যা খাড়া করে তোলে যে মর্যাদা তার পাওয়া উচিত সে ততটুকু মর্যাদা পাচ্ছে না। এ ব্যাপারে তার এমন এক ধরণের চিত্তবিভ্রম ঘটেছে, যা তার প্রতিবেশীরা সহানুভূতির সঙ্গে বিচার করে দেখেন, সেজন্য তারা তাকে তালাবদ্ধ করে রাখেন। যদি শুধু নিজের মহত্ব না বাড়িয়ে জাতি, ধর্ম ঐতিহ্য ইত্যাদির মহত্ব বর্ধিত করে তাহলে সে তার আশপাশের মানুষের সমর্থন অর্জন করে এবং রাজনৈতিক অথবা ধর্মীয় নেতা বনে যায়। যদিও নিরপেক্ষ বিদেশীর কাছে তার মতামত পাগলাগারদের রোগির মতো মনে হয়, তাতে কিছু আসে যায় না। এভাবেই সমষ্টিগত পাগলামির স্বভাব গড়ে ওঠে যা ব্যক্তি-পাগলামির সমস্ত নিয়ম-কানুন মেনে চলে। সকলেই জানে যে, লোক নিজেকে ইংল্যাণ্ডের রাজা মনে করে, তার মতো উন্মাদের সঙ্গে বিবাদ করা অর্থহীন, কিন্তু তাকে বিচ্ছিন্ন করে অতিরিক্ত শক্তিশালী করা হয়। সমগ্র জাতি যখন একটা উন্মাদ স্বপ্নে মেতে ওঠে, তখন জাতির ক্রোধ অনেকটা পাগলে ক্রোধের মতো বাধা পেলে সহস্র শিখায় জ্বলে উঠে। কোনরকমের প্ররোচনাই তাকে যুক্তির কাছে নতি স্বীকার করাতে পারে না।
বুদ্ধিবাদী উপাদান মানুষের আচরণে কী কী ভূমিকা গ্রহণ করে থাকে, সে সম্বন্ধে মনস্তত্ববিদদের মধ্যে প্রচুর মতভেদ রয়েছে। তার মধ্যে দু’রকমের মতভেদই প্রধান। (১) কাজের কারণ হিসেবে ধরে নিয়ে বিশ্বাসগুলো কতদূর ক্রিয়াশীল? (২) বিশ্বাসগুলো কতোদূর যুক্তিসঙ্গত প্রমাণ থেকে উদ্ভূত অথবা কতোদূর পরিমাণ তা সম্ভব এ দু’প্রশ্নেই মনস্তত্ববিদেরা সাধারণ মানুষ বুদ্ধিবৃত্তিক উপাদানকে যতটুকু স্থান দিয়ে থাকে, তার চাইতে যে কম প্রয়োজনীয় সে সম্বন্ধে একমত। কিন্তু সাধারণ ঐক্যের অভ্যন্তরে লক্ষণীয় অনেকগুলো। বৈপরীত্য রয়ে গেছে। আমরা তার মধ্যে পরপর দু’টোকেই তুলে ধরছি। (১) কাজের কারণ হিসেবে বিশ্বাসগুলো কতোদূর ক্রিয়াশীল? থিয়োরিগতভাবে প্রশ্নটা আলোচনা করা যাক। সে জন্যে একজন সাধারণ মানুষের একটি মামুলি দিনের জীবনকে নেয়া যাক। সকালে ঘুম থেকে উঠে তিনি জীবন শুরু করেন, এতে তার বিশ্বাসের কোন প্রভাব নেই। তিনি সকালে নাস্তা করেন, ট্রেন ধরেন, পত্রিকা পড়েন, অফিসে যান-এ সকল অভ্যাসবশেই করে থাকেন। তার জীবনে অতীতে এমনও এক সময় ছিল যখন তিনি এ অভ্যাসগুলোকে গঠন করেছেন এবং অন্ততঃ তার অফিস পছন্দের ব্যাপারে তার বিশ্বাসের প্রয়োজনীয় ভূমিকা ছিল। চাকুরি গ্রহণ করার সময়ে তিনি হয়ত ভেবেছিলেন, নিজের জন্য যা ভালো মনে করেন, ঐ চাকুরিতে যোগ দিলেই তার সব কিছু পেতে পারেন। অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে মৌলিকভাবে বৃত্তি নির্বাচন করার বেলায় বিশ্বাস অসামান্য ভূমিকা পালন করে থাকে। সুতরাং পছন্দ থেকেই মানুষের সকল রকমের বিশ্বাসের উৎপত্তি।
অফিসে তাকে যদি পরের অধীনে কাজ করতে হয়, তাহলে কোন সক্রিয় সংকল্প অথবা বিশ্বাসের কোন প্রকাশ্য বাধার সম্মুখীন না হয়ে অভ্যাসবশে কাজ করে যেতে পারেন। যদি তিনি অঙ্কের সঙ্গে অঙ্ক বসিয়ে স্তম্ভ তৈরি করেন, তাহলে বলতে হবে তিনি যে গাণিতিক নিয়ম প্রয়োগ করেন, তাতে বিশ্বাস করেন;কিন্তু তা করলে এক বিরাট ভুল করা হবে, নিয়মগুলো টেনিস খেলোয়ারের স্বভাবের মতো তার শরীরের স্বভাবমাত্র। যৌবনে ওগুলোকে আয়ত্ব করা হয়েছিল, সংশ্লিষ্ট কোন বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্বাসের বশে নয়। কুকুর যেমন পেছনের পায়ের উপর উপবেশন করে খাবার খেতে শিক্ষা করে, তেমনি ওসব স্বভাবও স্কুল শিক্ষকদের সন্তুষ্ট করার জন্য আয়ত্ব করা হয়েছিল। আমি বলতে চাই না যে সকল শিক্ষা এক রকম, কিন্তু নিশ্চিতভাবে প্রত্যেক শিক্ষা প্রাথমিক স্তরে ঐরকম।
সে যা হোক, যদি আমাদের কোন অংশীদার অথবা ডিরেক্টার বন্ধু থেকে থাকে, তাহলে জটিল কোন নীতি নির্ধারণের বেলায় তাকে ডাকা হতে পারে। এ সমস্ত সিদ্ধান্তের বেলায় তার বিশ্বাসের কিছু প্রতিক্রিয়া অবশ্যই থাকবে। কোনকিছুর দাম বাড়বে এবং কোনকিছুর দাম কমবে। অমুক অমুক ভালো মানুষ দেউলিয়া হওয়ার আগে এই এই করতে হবে, এসবে তিনি বিশ্বাস করেন। এ সকল বিশ্বাস অনুসারেই তিনি কাজ করেন। অভ্যাস ব্যতিরেকে বিশ্বাসের বলে তিনি কেরানির বদলে আরো শক্তিশালী মানুষ হলে কাজ করতে পারেন। যদি তার বিশ্বাসগুলো সত্য হয়, তিনি বেশি টাকা রোজগার করতে পারেন।
পারিবারিক জীবনে বিশ্বাস যদি কাজের কারণ হয়ে থাকে, তাহলে এরকম সুযোগের ঘন ঘন পুনরাবৃত্তি ঘটে থাকে। সচরাচর, তার স্ত্রী এবং সন্তানের প্রতি ব্যবহার অভ্যাস অথবা অভ্যাস দ্বারা শোধিত প্রবৃত্তির বশেই নিয়ন্ত্রিত হয়। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে তিনি বিয়ের প্রস্তাব করেন, যখন তিনি ছেলেকে কোন স্কুলে পাঠাবেন ঠিক করেন এবং যখন তিনি স্ত্রীর চরিত্রে সন্দেহের কারণ খুঁজে পান তখন তার কাজ সম্পূর্ণভাবে স্বভাবের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। বিয়ের প্রস্তাব করার সময়ে তিনি প্রবৃত্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হন, অথবা ভদ্রমহিলার ধনী হওয়ার কারণেই আকৃষ্ট হন। যদি তিনি প্রবৃত্তি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হন, তিনি নিঃসন্দেহে বিশ্বাস করেন যে, ভদ্রমহিলার সকল গুণ রয়েছে এবং তা তার কাছে প্রস্তাব করার কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। প্রকৃতপ্রস্তাবে প্রবৃত্তিকে কাজের একমাত্র ভিত্তি মনে করা, প্রবৃত্তিরই আরেক রকম প্রতিক্রিয়া। তার ছেলের জন্য একটা স্কুল পছন্দ করার জটিল ব্যাপারে যেমন চিন্তা করেন, তেমনিভাবে চিন্তা করে দেখেন। সাধারণতঃ এখানে তার বিশ্বাসের সবল ভূমিকা বর্তমান। যদি প্রমাণ পান যে তার স্ত্রী তার প্রতি বিশ্বাস ত্যাগ করেছে, তাহলে তিনি প্রবৃত্তিগতভাবেই ব্যবহার করবেন। কিন্তু প্রবৃত্তির নিয়মকে পরিচালিত করে আমাদের বিশ্বাস এবং বিশ্বাসই হচ্ছে প্রবৃত্তিকে চালিত করার প্রথম কারণ।
যদিও বিশ্বাসগুলি প্রত্যক্ষভাবে আমাদের কর্মের সামান্য ভগ্নাংশের সঙ্গে মাত্র। সংযুক্ত, যে সকল কাজের জন্য আমরা বিশ্বাসের কাছে দায়ী, সেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং আমাদের জীবনের সাধারণ ছক নির্ধারিত করে। বিশেষভাবে আমাদের ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক কাজগুলো আমাদের বিশ্বাসের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
(২) আমি এখন আমাদের দ্বিতীয় প্রশ্ন সম্বন্ধে আলোচনা করছি যার দুটো স্তর। (ক) আদতে আমাদের বিশ্বাসসমূহ কতদূর প্রমাণের উপর নির্ভরশীল এবং (খ) তাদের পক্ষে কতদূর প্রমাণনির্ভর হওয়া সম্ভব অথবা উচিত?
(ক) বিশ্বাসসমূহ প্রমাণের উপর যে পরিমাণ নির্ভরশীল, তা বিশ্বাসীরা যতো মনে করে তার চেয়ে অনেক কম। যে সকল কাজ যুক্তিসঙ্গত কাজের কাছাকাছি, সেগুলোর কথা বলা যেতে পারে; যেমন একজন ধনী কিছু টাকা খাটালেন। উদাহরণস্বরূপ আপনি দেখতে পাবেন ফ্রাঙ্কের মূল্য বাড়বে কি কমবে সে সম্বন্ধে তার যে ধারণা, তা তার রাজনৈতিক সহানুভূতির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু তা সত্ত্বেও তার বিশ্বাস এত প্রবল যে তিনি এত টাকা লোকসানের ঝুঁকি গ্রহণ করতে প্রস্তুত।
যদি কোন কারণে তিনি দেউলিয়া হয়ে যান, অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, কতেক আবেগপূর্ণ আকাঙ্খই তার ধ্বংসের মূল কারণ। রাজনৈতিক মতামত প্রমাণের উপর প্রায়ই নির্ভরশীল নয়। সরকারি কর্মচারীদের প্রমাণের উপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু নীতি সম্বন্ধে তাদের কথা বলার কোন অধিকার নেই। অবশ্য তার ব্যতিক্রম রয়েছে। দ্রব্যমূল্য সংস্কারের ব্যাপারে পঁচিশ বছর আগে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল তাতে অনেক শিল্পপতি যে পক্ষে গেলে তাদের ব্যক্তিগত আয় বৃদ্ধি পাবে, সে পক্ষই সমর্থন করেছিলেন এবং তাদের আয় বৃদ্ধির কথাটা যতই ঢাকা-চাপা দিয়ে রাখার চেষ্টা করা হোক না কেন, যে কোন লোক তা ধরতে পারবে। এখানে একটা জটিলতার সৃষ্টি হয়েছে। ফ্রয়েডিয়রা আমাদেরকে সকল কিছু যুক্তিসম্মত করতে অভ্যস্ত করে তুলেছেন। তার মানে হলো, যে অযৌক্তিক বিশ্বাস এবং মতামতসমূহকে যুক্তিসম্মত মনে করি, তা সত্যি কি না যাচাই করার একটা পদ্ধতি আবিষ্কার করা। বিশেষতঃ ইংরেজি ভাষাভাষী জগতে তার সম্পূর্ণ বিপরীত একটা পদ্ধতি প্রচলিত আছে, তা হলো সবকিছুকে অযৌক্তিক ছাঁচে ঢালাই করা। একজন চালাক-চতুর মানুষ কমবেশি সচেতনভাবে তার স্বার্থের স্বপক্ষে একটি বিষয়ের খুঁটিনাটি সংগ্রহ করেন। (নিঃস্বার্থ বিবেচনা অবচেতনভাবে নিজের ছেলে ছাড়া অন্য কোন ক্ষেত্রে খুবই কম হয়ে থাকে)। অবচেতন মনে, একটা সোহংবাদী নির্ভুল সিদ্ধান্ত খাড়া করে, একজন মানুষ কতকগুলো উচ্চনিনাদিত শ্লোগান আবিষ্কার করে, অথবা অন্যের কাছ থেকে ধার করে দেখান যে কিভাবে জনগণের কল্যাণের জন্য তিনি আত্মোৎসর্গ করেছেন। এ সব শ্লোগানে যে মানুষ বুদ্ধি দিয়ে বিশ্বাস করে, যতক্ষণ পর্যন্ত কল্পিত জনগণের কল্যাণ তার কাজের মাধ্যমে আসবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে প্রমাণের সাহায্যে যাচাই করা যাবে না। এ সকল বিষয়ে মানুষ যতো অনুসন্ধিৎসার বশে চলে, ততো যুক্তির অনুসরণ করে না। তার মনের সচেতন স্তর অযৌক্তিক এবং অবচেতন স্তরে যুক্তিগত বিশ্বাস বর্তমান থাকে। চরিত্রের এই বেশিষ্ট্যই হলো ইংরেজ এবং আমেরিকানদের সাফল্যের কারণ।
চালাকি যখন প্রধান হয়ে উঠে, তখন আমাদের প্রবৃত্তির অবচেতনের চাইতে সচেতন স্তরের প্রভাবেই চালিত হয় বেশি। উদাহরণস্বরূপ ব্যবসায়ে সাফল্য লাভ করতে হলে যে প্রধান গুণগুলোর প্রয়োজন, তার কথাই ধরা যাক। নৈতিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে সবসময়ে স্বার্থপর বলে তা খুবই নমনীয় গুণ, তা সত্বেও মানুষকে তা গুরুতর অপরাধ থেকে বিরত রাখবার জন্যে যথেষ্ট। জার্মানদের যদি এ গুণটি থাকত তাহলে তারা সীমাহীন সাবমেরিন অভিযান করত না। ফরাসিদের এ গুণটি থাকলে তারা রহুরে যেমনটি করেছিল। তেমন আচরণ করত না। নেপোলিয়ন এ গুনের অধিকারী হলে এ্যামিয়েনের সন্ধির পর আবার যুদ্ধ করতে যেতেন না। যেখানে মানুষ তাদের স্বার্থ কোথায় বোঝে না, সেখানে সে পথকে তারা সত্য বলে গ্রহণ করে, ভ্রান্ত হলেও তার বিরুদ্ধে আসল পথটি দেখিয়ে দেয়া যে আরো ক্ষতিকর তা নিয়ম হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। সুতরাং মানুষের নিজের স্বার্থের কল্যাণের পক্ষে-যা মানুষকে বিচারশীল করে তোলে, তা কল্যাণকর। ভাগ্যের পথ প্রশস্ত করার অসংখ্য দৃষ্টান্ত রয়েছে। তার কারণ নৈতিকভাবে তারা এমন কিছু করেছে, যা তারা নিজের স্বার্থের বিপরীত বলে বিশ্বাস স্থাপন করেছে। উদাহরণস্বরূপ প্রাথমিক কোয়েকারদের সময়ে কিছু সংখ্যক দোকানদার তাদের যে পরিমাণ দাবি তার চাইতে বেশি না-চাওয়ার নীতি গ্রহণ করে। অন্যান্য দোকানদারের মতো দরাদরি না করে সকলে একদরে মাল বিক্রয় করতে থাকেন। তারা এ নীতি গ্রহণ করেছিলেন, কারণ তাদের বিশ্বাস ছিল যা ন্যায্য দাবী, তার চাইতে বেশি চাইতে গেলে মিথ্যা বলা হবে। কিন্তু গ্রাহকদের সুবিধা এত বেড়ে গেল যে সকলে তাদের দোকান থেকে সওদা নিতে লাগল এবং তারা ধনী হয়ে গেলেন। (এটা আমি কোথায় পড়েছি তা ভুলে গেছি, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে কোন বিশ্বাসযোগ্য বইতেই পড়েছিলাম।) চালাকির থেকেও একই পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছিল বলা যেতে পারে, কিন্তু তাদের কেউ অতিরিক্ত চালাক ছিলেন না। সচেতন বিশ্বাস আমাদের যে পরিমাণ ভালো করে তার চেয়ে বেশি ঈর্ষাপরায়ণ করে তোলে। সুতরাং মানুষ যে সকল কাজ স্বতঃস্ফূর্তভাবে করে সেগুলো নিজের স্বার্থের প্রতিকূলে। যে সকল মানুষ সচেতন বুদ্ধি দিয়ে যতটুকু সম্ভব আবেগ থেকে বিচ্ছিন্ন করে চিন্তা করে, আসে তাদের কথা। তৃতীয়তঃ তাদের কথা আসে, যারা অপরের ধ্বংস সাধন করতে গিয়ে নিজেদেরকে ধ্বংস করে। ইউরোপের শতকরা ৯০ জন মানুষ এই শেষোক্ত শ্রেণীর অন্তর্ভূক্ত।
সে যাহোক আমি আমার আসল বক্তব্য বিষয় থেকে কিছুদূর সরে পড়েছি; কিন্তু অচেতন যুক্তি চালাকিকে সচেতন চিন্তা-বৈচিত্র থেকে আলাদা করার প্রয়োজন ছিল। মামুলি শিক্ষাপদ্ধতি আমাদের সচেতন মনোবৃত্তির উপর কোন প্রতিক্রিয়া করতে পারে না, বর্তমান পদ্ধতির সাহায্যে চালাকি শিক্ষাও দেয়া যায় না। নৈতিকতা যেখানে স্বভাবের মধ্যে প্রোথিত নয়, সেক্ষেত্রে বর্তমান পদ্ধতির সাহায্যে শিক্ষা দেয়া যায় না। যারা সদাসর্বদা পরামর্শের আলোচনা করে থাকে তাদের মধ্যে কোথাও আমি কল্যাণকর প্রতিক্রিয়া দেখতে পাই নি। সুতরাং আমাদের বর্তমান ধারা অনুসারে সকল প্রকারের স্বতঃস্ফূর্ত প্রচেষ্টা বুদ্ধিবৃত্তিক পন্থার মাধ্যমে সুসম্পন্ন করতে হবে। মানুষকে ধার্মিক অথবা চালাক করার কোন পন্থা আছে বলে আমাদের জানা নেই, কিন্তু কিছুদূর পর্যন্ত তাকে যুক্তিবাদীতা কিভাবে শিক্ষা দিতে হয় তা আমরা জানি। প্রত্যেকটি বিষয়ে শিক্ষাবিভাগীয় কর্মকর্তারা যা করেন তার বিপরীতে কিছু করতে শিক্ষা দেয়া হলেই তা করা হবে। তারপরে আমরা তার সনালী গ্রন্থিগুলোর ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ অথবা বৃদ্ধি করে তার মধ্যে গুণের বিকাশ ঘটাতে পারি। কিন্তু বর্তমান মুহূর্তে গুণের সৃষ্টি করার চাইতে যুক্তিবাদীতার সৃষ্টি করা অধিকতর সহজ, সে যুক্তিবাদীতার অর্থ হলো, মনের এক প্রকার বৈজ্ঞানিক স্বভাব, যা আমাদের কাজের প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারে।
(খ) মানুষের কাজ কতটুকু যুক্তিবাদী হতে পারে অথবা কতটুকু তার যুক্তিবাদী হওয়া উচিত, এখন আমি সে প্রশ্ন আলোচনা করছি। কতটুকু যুক্তিবাদী হওয়া উচিত, তাই প্রথম আলোচনা করা যাক। আমার মতে মনের নির্দিষ্ট গণ্ডীর মধ্যে বিচারবুদ্ধি সীমিত থাকা প্রয়োজন। বিচার-বুদ্ধির আক্রমণে জীবনের কতকগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ধ্বংস হয়ে গেছে। লাইবনিজ বুড়ো বয়সে একবার খবরের কাগজের একে প্রতিনিধিকে বলেছিলেন যে তিনি পঞ্চাশ বছর বয়সে এক ভদ্রমহিলার কাছে বিয়ের প্রস্তাব করতে কিছুদিন সময় চাইলেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি বিবেচনা করে দেখে প্রস্তাব বাতিল করলেন। তার আচরণ যে বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন তাতে সন্দেহ করবার কোন হেতু নেই। কিন্তু আমি প্রশংসা করি তা বলতে পারব না।
শেক্সপিয়র পাগল, প্রেমিক এবং কবিদেরকে এক সূত্রে সম্পূর্ণভাবে কাল্পনিক জীব বলে অভিহিত করেছেন। এখন প্রশ্ন হলো, কিভাবে উন্মাদদের বাদ দিয়ে পাগল এবং প্রেমিকদেরকে নেয়া যেতে পারে। আমি তার একটা দৃষ্টান্ত দিচ্ছি।
ওল্ডভিক নাট্যমঞ্চে ১৯১৯ সালে ট্রোজান উ’ম্যান নাটকের অভিনয় দেখি। সে নাটকে অস্ট্রান্যাক্স দ্বিতীয় হেক্টর হয়ে যেতে পারে, সে আশঙ্কায় তাকে হত্যা করার একটি মর্মান্তিক দৃশ্য আছে। থিয়েটারে কোন দর্শকের চোখ শুষ্ক ছিল না। তবু দর্শকেরা যে গ্রিক নির্মমতা দেখেছিল, তা তাদের কাছে মোটেই বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। তা সত্বেও যে সব লোক থিয়েটারে কেঁদেছিল, সে মুহূর্তে এমন এক হৃদয়হীনতাকে প্রত্যক্ষ করেছিল, যা ইউরিপিডিসের কল্পনায় অসহনীয় হয়ে উঠেছিল। যা জার্মানিকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। এ সকল বিচ্ছিন্নকরণের ফলে অসংখ্য শিশুর যে মৃত্যু হয়েছে, তাতো সকলের জানা কথা। কিন্তু তারা অনুভব করেছিল তার ফলে শত্রুদেশের জনসংখ্যা হ্রাস পাবে। তা তাদের পিতৃপুরুষের গর্ব ধ্বংসকারী অস্ট্রান্যাক্সকে ধ্বংস করার মতো। ইউরিপিডিস দর্শকদের কল্পনায় প্রেমিককে জাগিয়েছিলেন কিন্তু তাদের কল্পনা থেকে প্রেমিক কবির স্মৃতি থিয়েটার হলের দরজাতেই মুছে গিয়েছিল। উন্মাদেরা (নরহত্যার রোগে যারা ভুগছে) যে সকল মানুষ নিজেদেরকে দয়ালু এবং ধার্মিক মনে করে সে সকল নরনারীর রাজনৈতিক কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রিত করেছিল।
উন্মাদসত্তাকে বাদ দিয়ে কবি এবং প্রেমিকসত্তাকে কি অটুট রাখা সম্ভবপর? আমাদের সকলের মধ্যে এ তিন সত্তা বিভিন্নভাবে বর্তমান। কিন্তু সেগুলো কি এতই অবিচ্ছিন্ন যে, একটাকে নিয়ন্ত্রণের অধীনে আনলে অন্যটা ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি তা বিশ্বাস করি না। আমি বিশ্বাস করি আমাদের মধ্যে কিছু শক্তি রয়েছে, যা বুদ্ধিবৃত্তির সাহায্যে অনুপ্রাণিত নয়-এমন সব কাজের মধ্য দিয়ে প্রকাশ পেতে পারে। অবস্থাভেদে শিল্পকলা আবেগময় ভালোবাসাও আবেগময় ঘৃণার মধ্যে তার প্রকাশ ঘটাতে পারে। পরস্পরা নিয়মানুবর্তিতা এবং সময়সূচি হলো আধুনিক শিল্পব্যবস্থার লৌহশৃঙ্খল, যা আমাদের ভালোবাসাকে অকেজো করে ফেলেছে, যাতে করে তা সৃজনশীল এবং প্রধান না হয়ে একদেশদর্শী হয়ে উঠেছে। যে জিনিশ সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন এবং মুক্ত হওয়া উচিত ছিল, তার উপর বিধি-নিষেধের আরোপ করা হয়েছে। পক্ষান্তরে সমস্ত যাজকদের আশীর্বাদের এত হিংসা-দ্বেষ ঘৃণা এবং অত্যাচারকে মুক্ত করা হয়েছে। আমাদের প্রবৃত্তিগত প্রক্রিয়ার দুটি অংশ। একটি আমাদের জীবনকে আমাদের বংশধরের মধ্যে দীর্ঘতর করে, অন্যটি আমাদের কল্পিত শত্রুদের জীবনকে ধ্বংস করতে চায়। প্রথমটির মধ্যে আছে জীবনের আনন্দ ভালোবাসা এবং শিল্পচেতনা, যা আমাদের ভালোবাসার মনস্তাত্ত্বিক প্রকাশ। দ্বিতীয়টির মধ্যে আছে প্রতিযোগিতা দেশপ্রেম এবং যুদ্ধ। প্রচলিত নৈতিকতা প্রথমটাকে অবদমন করে দ্বিতীয় প্রবৃত্তিকে ত্বরান্বিত করে। কিন্তু সত্যিকারের নৈতিকতার ক্রিয়া হবে এর বিপরীত। আমরা যাদেরকে ভালোবাসি তাদের সঙ্গে আমরা প্রবৃত্তিগতভাবে আচরণ করতে পারি এবং যাদেরকে ঘৃণা করি তাদের বেলায় আমাদের যুক্তিসম্মত আচরণ করা উচিত। আধুনিক বিশ্বে যাদেরকে আমরা সক্রিয়ভাবে ঘৃণা করি তারা হলো দূরবর্তী মানুষ, বিশেষ করে বলতে গেলে বিদেশী জাতিসমূহ। আমরা তাদের সম্বন্ধে বিমূর্তভাবে ধারণা পোষণ করি এবং যেসব কাজ ঘৃণ্য এবং জঘণ্য সেগুলোর বিচারে প্রেম অথবা তেমন উচ্চাদর্শের বশবর্তী হয়ে তাদের ক্ষতি করে নিজেদেরকে প্রতারিত করি। একমাত্র অধিকমাত্রায় সংশংয়বাদই, যে-আবরণের অন্তরালে সত্য লুকিয়ে থাকে তা দূরীভূত করে আমাদের চোখে সত্যকে জাজ্বল্যমান করে তুলতে পারে। তাতে সফলতা অর্জন করতে পারলে আমরা নতুন নৈতিকতার জন্ম দিতে পারব, যার ভিত্তি প্রতিবন্ধকতা এবং হিংসার মধ্যে প্রোথিত নয়, বরং তা সম্পূর্ণ জীবনের আকাক্ষার রূপায়নে দেদীপ্যমান। হিংসার রোগ থেকে আরোগ্যলাভ করলে মানুষকে তার পথের বাধা মনে না করে সহায়ই মনে করবে। এটা কোন কাল্পনিক আকাক্ষা নয়, রাণী প্রথম এলিজাবেথের যুগে অংশতঃ এর বাস্তবায়ন হয়েছিল ইংল্যাণ্ডে এবং যদি মানুষ অন্যের ক্ষতি না করে নিজের আনন্দ খুঁজে নিতে পারে তাহলে আগামীকাল তার বাস্তবায়ন সম্ভব। এটা, আয়ত্ব করা অসম্ভব-এমন কোন নৈতিকতা নয়। কিন্তু তা গৃহীত হলে আমাদের পৃথিবীর স্বর্গরাজ্যে পরিণত হবে।