১
মিসির আলি আগ্রহ নিয়ে তাকে দেখছেন। রোগা লম্বা এক জন মানুষ। মুখ দেখা যাচ্ছে না, কারণ লোকটি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। এই গরমেও ফুল হাতা ফ্লানেলের শার্ট, ফুলপ্যান্টটি চকচকে কাপড়ের তৈরী। ছাঁটের ধরন দেখে মনে হয় সেকেণ্ডহ্যাণ্ড মার্কেট থেকে কেনা। এ ধরনের ছাঁটের প্যান্ট ঢাকায় এখন চালু নেই। পায়ের জুতা জোড়া ঝকঝক করছে। মনে হচ্ছে এখানে আসবার আগে জুতা পালিশ করেছে। মিসির আলি লোকটির বয়স আন্দাজ করবার চেষ্টা করলেন। কুড়ি থেকে পঁচিশের মধ্যে হবার কথা। এই বয়সের যুবকদের চেহারায় এক ধরনের আভা থাকে। যৌবনের আভা। এর তা নেই। অল্প বয়সে চুলও পেকেছে বলে মনে হচ্ছে। কানের পাশে রুপোলি ছোঁয়া। মিসির আলি বললেন, ‘আপনি কি আমার কাছে এসেছেন?’
সে জবাব দিতে দেরি করছে। যেন এই প্রশ্নের জবাব তার জানা নেই। মিসির আলি আবার বললেন, ‘আপনি কি আমার কাছে এসেছেন?’
‘জ্বি।’
‘আপনি মনে হয় আগেও কয়েক বার এসেছিলেন?’
‘এক বার একটি চিঠি লিখে গিয়েছিলেন, তাই না? লিখেছিলেন—–সোমবার সন্ধ্যায় আসব।‘
‘জ্বি স্যার।’
‘আমি কিন্তু সোমবার সন্ধ্যায় আপনার জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। আপনি আসেন নি।’
‘একটা কাজ পড়ে গিয়েছিল স্যার।’
লোকটি খুব সহজেই স্যার বলছে। তার মানে ছোট কোনো চাকরি করে। অফিসের প্রায় সবাইকে বোধহয় স্যার বলতে হয়, যে-কারণে এটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। খারাপ অভ্যাস। মিসির আলি বললেন, ‘আপনি কী করেন?’
‘সামান্য একটা কাজ করি। বলার মতো কিছু না।’
‘আসুন। ভেতরে আসুন।’
‘আজ যাই স্যার। আরেক দিন আসব।‘
মিসির আলি অত্যন্ত অবাক হলেন। এই লোকটি বারবার তাঁর খোঁজে আসছে, চিঠি লিখে যাচ্ছে। আজ দেখা হল, কিন্তু সে থাকতে চাচ্ছে না। মনের ভেতর বড় রকমের কোনো দ্বিধার ভাব আছে, যা সে কাটাতে পারছে না। মিসির আলি বললেন, ‘আপনি চলে যেতে চাচ্ছেন, চলে যাবেন। কিছুক্ষণ বসে যান। আমার কাছে কেন এসেছেন, সেটা বলুন।’
‘অন্য আরেক দিন আসব।’
‘সেদিন হয়তো আমাকে পাবেন না। আমি বাসায় খুব কম থাকি। আমার অনেক ঝামেলা।’
লোকটি খুবই অস্বস্তি নিয়ে ভেতরে ঢুকল। জুতা জোড়া নিয়ে একটু চিন্তা করছে। খুলে ফেলবে কি ফেলবে না। মিসির আলি লক্ষ করলেন, লোকটি নিজেই বসার ঘরের দরজা বন্ধ করছে। ছিটকিনি লাগানোর চেষ্টা করছে। এটাও হয়তো তার অভ্যাস। সে খুব সম্ভব তার ঘরে ঢুকেই ছিটকিনি লাগিয়ে দেয়। তাই যদি হয়, তাহলে লোকটি থাকে একা। যে বাড়িতে অনেকগুলি মানুষ থাকে, সে-বাড়ির কেউ ঘরে ঢুকেই ছিটকিনি লাগানোর অভ্যাস করবে না।
মিসির আলি বললেন, ‘এ-বাড়ির ছিটকিনি লাগানোর একটা বিশেষ কায়দা আছে। আপনি পারবেন না। আপনি বসুন, আমি লাগাচ্ছি।’
লোকটি বসল। বসার ভঙ্গি বিনীত। হাত মুঠি করে কোলের উপর রাখা। ঈষৎ কুঁজো হয়ে বসেছে। গায়ের রঙ বেশ ফর্সা। অতিরিক্ত ফর্সা হবার কারণেই বোধহয় চেহারায় খানিকটা মেয়েলি ভাব চলে এসেছে। অবশ্যি এটা জোড়া ভুরু ও পাতলা ঠোঁটের কারণেও হতে পারে। এই ধরনের ছেলেদেরকেই স্কুলে সবাই ‘মেয়ে’ বলে খেপায়। এবং উঁচু ক্লাসের কিছু বখা ছেলে বিশেষ কারণে এদের বন্ধুত্ব কামনা করে।
মিসির আলি বললেন, ‘আপনার নাম কি?’ লোকটি জবাব দিল না। ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল। এখন সে তাকাচ্ছে জানালা দিয়ে। মিসির আলি অবাক হয়ে বললেন, ‘নাম বলতে কি আপনার আপত্তি আছে?’
‘জ্বি-না।’
‘তাহলে নাম বলুন। নাম দিয়েই শুরু করা যাক।’
‘আমার নাম রইসুদ্দিন।’
‘শুধু রইসুদ্দিন! নাকি রইসুদ্দিনের সঙ্গে অন্য কিছু আছে?’
‘মোঃ রইসুদ্দিন।’
দেখুন ভাই, আপনি কিন্তু ঠিক নামটা বলছেন না। মিথ্যা কথা বলায় যারা অভ্যস্ত নয়, তারা যখন মিথ্যা বলে, তখন তাদের গলা কেঁপে যায়। খুব দ্রুত চোখের পাতা পড়ে এবং খানিকটা ব্লাশ করে। আপনার বেলায় এর সব ক’টি হয়েছে।’
‘আমার ভালো নাম মুনির। ডাক নাম টুনু।‘
‘চা খাবেন?’
‘জ্বি স্যার, খাব।’
‘আপনি আরাম করে বসুন, আমি চা বানিয়ে আনছি। ঘরে কাজের কোনো লোক নেই। সব আমাকেই করতে হবে। আপনি আমার কাছে কি জন্যে এসেছেন তা এখন বলবেন? না চা খেয়ে বলবেন?’
‘স্যার আমি খুব বিপদে পড়েছি।’
‘বিপদে পড়লে লোকজন যায় পুলিশের কাছে। আমার কাছে কেন? আমি তো পুলিশ নই।’
‘অন্য রকম বিপদ। আপনি না শুনলে বুঝবেন না। আগে শুনতে হবে।’
‘বেশ শুনছি, তাতে লাভ হবে কি?’
‘আপনি অনেকের অনেক সমস্যার সমাধান করেছেন–আমি অনেক কিছু আপনার সম্পর্কে শুনেছি।’
‘শুনেছেন, খুব ভালো কথা। কী শুনেছেন, জানি না। তবে আপনাকে আগেভাগেই বলে রাখি, আমার দৌড় খুব সামান্য। আমি অ্যাবনরমেল সাইকোলজি নিয়ে কিছু পড়াশোনা করেছি–এই পর্যন্তই।’
মুনির মাথা নিচু করে বসে আছে। কোনো কথা সে শুনছে বলে মনে হচ্ছে না। মিসির আলি বললেন, ‘আপনার বাসা কোথায়?’
মুনির তার জবাব দিল না। মাথা নিচু করে ফেলল। অর্থাৎ সে তার ঠিকানা জানাতে ইচ্ছুক নয়। মিসির আলি চা বানাতে গেলেন। ঘরে কোনো খাবার নেই। বিস্কিট-টিস্কিটজাতীয় কিছু দিতে পারলে ভালো হত। লোকটি ক্ষুধার্ত। হয়তো অফিস শেষ করে সরাসরি চলে এসেছে। কিছু খাওয়া হয় নি। কিংবা বিকেলে কিছু খাবার মতো সামর্থ্য নেই। এটি হওয়াই স্বাভাবিক। নিম্ন আয়ের মানুষরা এ-দেশে পশুর জীবন-যাপন করে।
মিসির আলি চা নিয়ে বসার ঘরে ঢুকে চমকে উঠলেন। কেউ নেই। দরজা ভেজানো। লোকটি এক ফাঁকে উঠে চলে গিয়েছে। নিঃশব্দ প্রস্থান যাকে বলে। মিসির আলি হেসে ফেললেন। এ-জীবনে তিনি অনেক বিচিত্র মানুষ দেখেছেন। তাদের অদ্ভুত আচার-আচরণের সঙ্গে তিনি পরিচিত। এই লোকটির প্রস্থান ঘটনা হিসেবে তেমন অদ্ভুত নয়, তবু বেশ মজার। তবে নিঃশব্দ প্রস্থানের এই ঘটনার ব্যাখ্যা বেশ সরল। লোকটি যে-বিপদের কথা বলতে এসেছিল, শেষ মুহূর্তে ঠিক করেছে তা সে বলবে না। এ-রকম মনে করারও অনেকগুলি কারণ হতে পারে। প্রথম কারণ–সম্ভবত মিসির আলিকে দেখে তার আশাভঙ্গ হয়েছে। মনে হয়েছে, এই লোকটিকে দিয়ে কাজ হবে না। দ্বিতীয় কারণ–বিপদটা এমন শ্রেণীর যা বলার মতো মনের জোর তার নেই।
‘স্যার, আসব?’
মিসির আলি চমকে উঠলেন। লোকটি ফিরে এসেছে। তার চোখে-মুখে অপ্রস্তুত ভঙ্গি। যেন সে বড় ধরনের অপরাধ করে এসেছে। এই অপরাধের জন্যে সে লজ্জিত, অনুতপ্ত।
‘কোথায় গিয়েছিলেন?’
‘আপনার জন্যে এক প্যাকেট সিগারেট আনতে গিয়েছিলাম। বেশি কিছু দেবার সামর্থ্য স্যার আমার নেই। আমি দরিদ্র মানুষ।’
তিনি হাত বাড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেট নিলেন। বেনসন এণ্ড হেজেস, নির্ঘাৎ পঞ্চাশ টাকার মতো খরচ হয়েছে। লোকটি আগের মতো মাথা নিচু করে বসে আছে। চোখের পাতা পর্যন্ত ফেলছে না।
‘আমাকে কী বলতে এসেছেন, বলুন।’
লোকটি কিছু বলল না। মিসির আলি সিগারেট ধরিয়ে হালকা স্বরে বললেন, ‘যদি বলতে না-চান বলার দরকার নেই। আসুন অন্য কোনো বিষয় নিয়ে আলাপ করি। গরম কেমন পড়েছে বলুন।’
‘খুব গরম পড়েছে স্যার।’
‘এই প্রচণ্ড গরমে ফ্লানেলের শার্ট গায়ে দিয়েছেন কেন? আপনার গরম লাগছে না?’
আমার আর কোনো ভালো শার্ট নেই। আমি দরিদ্র।’
‘দরিদ্র হওয়াতে লজ্জাবোধ করার কিছু নেই। ধনী ব্যক্তিদের বরং লজ্জিত হওয়া উচিত। আপনার চা-টা মনে হচ্ছে ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। গরম করে আনব?’
‘জ্বি না।’
লোকটি ঠাণ্ডা চায়ের কাপে চুমুক দিতে লাগল। যেন সে একটি অপ্রিয় দায়িত্ব পালন করছে।
‘আপনি কি আমাকে সত্যি সত্যি কিছু বলবেন?
‘জ্বি স্যার, বলব।’
‘বলুন।’
মুনির চুপ করে আছে। ইনহিবিশন বলে একটা ব্যাপার আছে। এটা হচ্ছে তাই। প্রথম বাধাটি সে কাটিয়ে উঠতে পারছে না। মিসির আলির মনে হল, লোকটি নিঃসঙ্গ প্রকৃতির। একা-একা থাকে। মানুষের সঙ্গে কথা বলার অভ্যেস নেই। যা সে বলতে চায়, তা বলার জন্যে তাকে প্রচুর সাহস সঞ্চয় করতে হবে। মিসির আলি তাকে সময় দিলেন।
বাইরে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে। আকাশ থমথমে। দূরে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঝড় আসবে সম্ভবত। আসুক। এই গরম আর সহ্য করা যাচ্ছে না। ইচ্ছা করছে কোনো একটা পুকুরে গলা পর্যন্ত ডুবিয়ে বসে থাকতে
ঘর অন্ধকার। বাতি জ্বালান দরকার। মিসির আলি বাতি জ্বালালেন না। ইনহিবিশন কাটানোর জন্যে অন্ধকার একটা চমৎকার জিনিস।
মুনির মূর্তির মতো বসে আছে। সে এবার ছোট্ট একটি নিঃশ্বাস ফেলে মৃদু স্বরে কথা বলা শুরু করল। তার গলার স্বর মিষ্টি। শুনতে ভালো লাগে। গলার স্বরে কোথাও যেন একটি ধাতব চরিত্র আছে। মেয়েদের গলার স্বরে তা মানিয়ে যায়। পুরুষদের সঙ্গে ঠিক মানায় না।