ধ্বনিটা অতি–পরিচিত, শব্দগুলোও বহু–পরিচিত, চেয়ার থেকে উঠে জানলার ধারে না গেলেও বোঝা যেত কারা চলেছে মিছিল করে, আর কী বলে চলেছে তারা। মিছিল তো চন্দ্র–সূর্যের মতই নিত্য ঘটনা। কানের পর্দায় যেন লেগেই থাকে ধ্বনিটা—চলবে না! চলবে না! যেন অহরহই মস্তিষ্কের কোযে কোষে ধাক্কা মারে, মানতে হবে, মানতে হবে, আমাদের দাবী মানতে হবে।
তবু হাতের কলম নামিয়ে রেখে জানলায় এসে দাঁড়ালেন অনামিকা দেবী!
কিন্তু কেন দাঁড়ালেন?
মিছিলের ওই উচ্চরোলে লেখার ব্যাঘাত ঘটছিলো বলে? নাকি নেহাৎই অকারণ কৌতূহলে? হয়তো তাই। অকারণ কৌতূহলেই। শুধু জেনে নেওয়া, নতুন কোন অন্যায় বা অত্যাচারের বিরুদ্ধে আজকের এই প্রতিবাদ। নইলে রাস্তার গোলমালে লেখার ব্যাঘাত ঘটলে চলে না।
কলকাতা শহরের এমন একটি জনবহুল রাস্তার একেবারে মোড়ের ধারের বাড়িতে যাদের আজন্মের বাস, এই কোলাহলের মাঝখানে বসেই যার কলম ধরার শুরু, তার কি করে এ আবদার করা সম্ভব–নিঃশব্দে নির্জনতার গভীরে মগ্ন হয়ে লিখতে চাই আমি!
বিচিত্র শব্দ, বিরক্তিকর কোলাহল আর অগণিত মানুষের আনাগোনার মধ্যে থেকেই তো সাধনা করে যেতে হয় শহরে সাহিত্যিকদের। প্রতিক্ষণই করতে হয় প্রতিকূলতার সঙ্গে সংগ্রাম; কিন্তু একেবারে স্তব্ধ শান্ত স্তিমিত পল্পীজীবনের পরিবেশই কি সাধনার নিতান্ত অনুকূল? তেমন পরিবেশ পেলেই অনামিকা দেবী আরো অধিক লিখতে পারতেন? অধিকতর উচ্চমানের? অধিকতর মননশীল?
অপরাপর শহরবাসী কবি সাহিত্যিকরা কী বলেন, কী মনোভাব পোষণ করেন, অনামিকা দেবীর জানা নেই, মনের কথার আদান–প্ৰদান হবে এমন অস্তরঙ্গ তাই বা কার সঙ্গে আছে? তবে নিজে তিনি তা বলেন না। তা ভাবেন না।
তাঁর মনে হয়—শহরের মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তনশীল উত্তাল জীবনরসের মধ্যেই সাহিত্যের তীব্ৰ তপ্ত জীবনীরস। শহরের অফুরন্ত বৈচিত্র্যের মধ্যেই সাহিত্যের অফুরন্ত উপাদান।
নির্জনতার শাস্তিতে গতিবেগ কোথায়? শহরের নাড়ি সর্বদাই জ্বর–তপ্ত চঞ্চল। সেই জ্বর ছাড়াবার ওষুধ জানা নেই কারো, তবু একথা সবাই জানে ওই জুরাটাই প্রেরণা দিচ্ছে শিল্পকে, সাহিত্যকে, জীবন–চিস্তাকে। এই জুরাটাই বরং রোগীকে চাঙ্গা করে রেখেছে।
তাই কোলাহলকে কখনো বাধা স্বরূপ মনে হয় না। অনামিকা দেবীর। তিনি সর্বদা এই কথাই বলেন, আমি জনতার একজন। আমি জনতার সাহিত্যিক। কোলাহল থেকেই রস আহরণ করে নেওয়া আমার কাজ।
কিন্তু অনামিকা দেবীর সেই কবি সেজদি? তিনি কিন্তু অন্য কথা বলেন; তিনি বরং বলেন, ধন্যবাদ দিই তোকে। এই কলরবের মধ্যে লিখিস!
তা তিনি একথা বলবেন সেটাই স্বাভাবিক। অনামিকা দেবী যদি জনতার তো তিনি নির্জনতার।
তিনি কবি।
ইচ্ছের কবি।
তিনি তাঁর সেই মফঃস্বলের বাড়িটিতে নিঃসঙ্গতায় নিমগ্ন হয়ে বসে সেই ইচ্ছার ফুলগুলি ফোঁটান। সেইগুলিই হয়তো তার সঙ্গী।
অনামিকা দেবীর ভূমিকা আলাদা।
এ যুগের আরো সকলের মতই–অহরহ পরের ইচ্ছের বায়না মেটাতে হয় তাঁকে! পরের ইচ্ছেয় পরিচালিত হতে হয়।
মনের মধ্যে ওই মিছিলের ধ্বনি উঠলেও মেটাতে হয়।
জানলার ধারে এসে দাঁড়ালেন অনামিকা দেবী, নীচের দিকে তাকালেন, মানুষের প্রাচীর এগিয়ে চলেছে একটা অখণ্ড মূর্তিতে, আর যান্ত্রিক একটা শব্দ উঠছে তা থেকে চলবে না! চলবে না!
হঠাৎ অদ্ভুত একটা কৌতুক বোধ করলেন অনামিকা দেবী।
একদিক থেকে অবিরাম প্রতিবাদ উঠবে চলবে না চলবে না, আর একদিকে অব্যাহত গতিতে চলেই চলবে সেই অসহনীয়।
কোটি কল্পকালের পৃথিবীর বুকে কোটি কোটি বছর ধরেই চলেছে এই লীলা। পাশাপাশি চলেছে। অন্যায় আর তার প্রতিবাদ। আজকের মিছিলটা যে বিশেষ একটা কিছু তা বোঝা যাচ্ছে তার দৈর্ঘ্যে, শেষ হয়েও শেষ হচ্ছে না। একবার স্তিমিত হয়ে আসছে আওয়াজ, আবার পিছন থেকে আসছে নতুন আওয়াজের ঢেউ।
অবশেষে, অনেকক্ষণের পর হালকা হয়ে এল দল, ফিকে হয়ে এল ধ্বনি, যারা পিছিয়ে পড়েছিল তারা ছুটে ছুটে আসছে, তাদের ফাঁকে ফাঁকে অন্য অন্য পথচারীর চেহারা দেখা যাচ্ছে।
দূরে এগিয়ে যাওয়া আওয়াজটা নিয়মমাফিক কমে কমে আসছে।
জানলা থেকে আবার ফিরে এলেন অনামিকা দেবী। চেয়ারে এসে বসলেন, কলামটা হাতে তুলে নিলেন। কিন্তু চট করে যেন মনে এল না কি লিখছিলেন? অন্যমনস্কের মত সম্পূর্ণ অবান্তর একটা কথা মনে এল। লেখার কথা নয়, ওই মিছিলের কথা নয়, দেশের বহুবিধ অন্যায় অনাচার দুর্নীতি আর রাজনীতির কথাও নয়, মনে এল। এই বাড়িটা যখন তৈরী হয়েছিল তখন এপাশে–ওপাশে ফাঁকা ফাকা মাঠ পড়ে ছিল।
এখন সমস্ত রাস্তাটা যেন দম আটকে দাঁড়িয়ে আছে।
কিন্তু বাড়িটা কি আজ তৈরী হয়েছে? কত দিন মাস বছর পর হয়ে গেল তার হিসেব করতে হলে বুঝি খাতা পেনসিল নিয়ে বসলে ভাল হয়।
অনামিকা দেবী ভাবলেন, আমি এর শৈশব বাল্য যৌবন আর এই প্রৌঢ়াবস্থা সব অবস্থার সাক্ষী। অথবা এই বাড়িটাই আমার সমস্ত দিন মাস বছরের সাক্ষী। এর দেওয়ালে দেওয়ালে লেবা আছে আমার সব কথা।
আচ্ছা, দেওয়াল কি সত্যি সাক্ষ্য দিতে পারে? সে কি সব কথা ধরে রাখতে পারে অদৃশ্য কোনো অক্ষরে? বিজ্ঞান এত করছে, এটা করতে পারে না কোনো দিন? মৌন মূক দেওয়ালগুলোকে কথা কইয়ে ইতিহাসকে পুরে ফেলবে হাতের মুঠোয়! নির্ভুল ইতিহাস!
টেলিফোনটা ডেকে উঠলো ঘরের কোণ থেকে। আবার চেয়ার ছেড়ে উঠলেন অনামিকা দেবী, রিসিভারটা তুলে নিলেন হাতে।
টেলিফোনটা লেখার টেবিলে রাখাই সুবিধে, সময় বঁচে, পরিশ্রম বাঁচে, তবু কোণের ওই ছোট্ট টেবিলটার উপরেই বসিয়ে রাখেন সেটা অনামিকা দেবী। এটা তার এক ধরনের শপ। বার ব্যার উঠতে হলেও।
থেমে থেমে কেটে কেটে বললেন, হ্যাঁ, আমি কথা বলছি, বলুন কি বলছেন?..নতুন পত্রিকা বার করছেন? শুনে খুশি হলাম। শুভেচ্ছা জানাচ্ছি, সাফল্য কামনা করছি।…লেখা? মানে গল্প? পাগল হয়েছেন?…কী করবো বলুন? অসম্ভব, সম্পূর্ণ অসম্ভব।. উপায় থাকলে না করতাম না।…বেশ তো চলুক না কাজ, পয়ে হবে। কী বলছেন? আপনি বলব না? বয়সে আপনি আমার থেকে অনেক ছোট? ঠিক আছে, না হয় তুমিই বলা যাবে। কিন্তু গল্প তো দেওয়া যাচ্ছে না।…কী? কী বলছেন? কথা দিয়ে রাখবো?…না না। ওইটি পারবো না, কথা দিয়ে বসে থাকতে থারবো না। সে আমাকে বৃশ্চিক–যন্ত্রণা দেবে।...তা বটে। বুঝছি তোমার খুব দরকার, কিন্তু উপায় কি?
উপায় কি? অপর অর্থ নিরুপায়। তা সত্ত্বেও ও-পক্ষ তার নিজের নিরুপায়তার কথা ব্যক্ত করে চলে এবং কথার মাঝখানে এমন একটু কমা সেমিকোলন রাখে না, ফাঁকিটুকুতে ফুলস্টপ বসিয়ে দিতে পারেন অনামিকা দেবী।
অতএব শেষ পর্যন্ত বলতেই হয়, আচ্ছা দেখি।
ও–পক্ষের উদ্দণ্ড কণ্ঠের ধ্বনি এ ঘরের দেওয়ালে ধাক্কা মারে, না না, দেখিটেখি নয়। আমি নাম অ্যানাউন্স করে দিচ্ছি।
ছেড়ে দিলো এবার।
অনামিকা দেবীকে আর কিছু বলবার অবকাশ না দিয়ে।
অনামিকা দেবী জানেন, এরপর যদি তিনি সময়ে লেখা দিয়ে উঠতে না পারেন, তাহলে ওই ভাবী সম্পাদক ভদ্রলোক এখানে সেখানে সকরুণ গলায় বলে বেড়াবেন, কী করবো বলুন, কথা দিয়ে যদি কথা না রাখেন! এই তো আমাদের দেশের অবস্থা। কেউ একটু নাম করলেন কি অহঙ্কার! আমাদেরও হয়েছে শাঁখের করাত। ওনাদের লেখা না নিলেও নয়–।
বলেন বটে না নিলেও নয়, কিন্তু আসল ভরসা রাখেন তঁরা সিনেমাস্টারদের ছবির উপর। তারা কী ভাবে হাঁটেন, কী ভাবে চলেন, কোন ভঙ্গীতে কলা ছাড়িয়ে মুখে ফেলেন, কোন ভঙ্গীতে দোলে আবীর ছড়ান, ইত্যাদি প্রভৃতি সব! ওই ভঙ্গীগুলিই ওদের পত্রিকার মূল জীবনীরস, তা ছাড়া তো আছে ফিচার। তথাপি গল্প–উপন্যাসও আবশ্যক, সব শ্রেণীর পাঠককেই তো মুঠোয় পুরতে হবে। আর সেক্ষেত্রে ওই নাম করে ফেলা লেখকদের লেখা নেওয়াই নিরাপদ, পাণ্ডুলিপিতে চোখ বোলাতে হয় না, সোজা প্রেসে পাঠিয়ে দেওয়া যায়। নতুন কাগজের সম্পাদকও এ ছাড়া নতুন কিছু করবেন কি?
আগে নাকি সাংবাদিকতার একটি পবিত্র দায়িত্ব ছিল। সম্পাদকেরা নাকি লেখক তৈরী করতেন, তৈরী করতেন পাঠকও। অনামিকা দেবী যে সে বস্তু দেখেননি তা নয়। তাঁর জীবনেই তিনি একদা সেই উদার আশ্রয় পেয়েছেন।
কিন্তু কদিনের জন্যেই বা?
সেই মানুষ চলে গেলেন।
তারপর কেমন করে যেন অনামিকা দেবী এই হাটে দাঁড়িয়ে গেছেন, চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলা দেশের পাঠক–পাঠিকারা অনামিকা দেবীকে ভালবাসে।
রিসিভার নামিয়ে রেখে আবার এসে কলম নিয়ে বসলেন অনামিকা দেবী, আর ওর ভাইঝি। শম্পার কথাটা আবার নতুন করে মনে এল।
আচ্ছা পিসি, তত্বার ওঠা উঠি করতে হয়, ওটাকে তো তোমার লেখার টেবিলে রেখে দিলেই পারে।
অনামিকা দেবী নিজের উত্তরটাও ভাবলেন, নাঃ! টেবিলে টেলিফোন বসানো থাকলে, ঘরটাকে যেন অফিস ঘর অফিস ঘর লাগে।
হ্যাঁ, এই কথাই বলেন বটে, কিন্তু আরও কারণ আছে। আর হয়তো সেটাই প্রকৃত কারণ। মাঝে মাঝেই একটি তাজা আর সপ্ৰতিভ গলা কথা কয়ে ওঠে, শম্পাকে একটু ডেকে দিন তো!
ডেকে দেন অনামিকা দেবী।
শম্পা আহ্লাদে ছলকাতে ছলকাতে এসে ফোন ধরে। পিসির দিকে পিঠ আর দেওয়ালের দিকে মুখ করে গলা নামিয়ে কথা বলে মিনিটের পর মিনিট, ঘণ্টায় গিয়ে পৌঁছয়।
টেবিলে রাখলে অসুবিধে উভয় পক্ষেরই। শম্পার জীবনে এখন একটি নতুন প্রেমের ঘটনা চলছে। এখন শম্পা সব সময় আহ্লাদে ভাসছে।
অনামিকা দেবী সঠিক খবর জানেন না, সত্যি কিছু আর সব খবর রাখেনও না, তবু যতটুকু ধারণা তাতে হিসেব করেন, শম্পার এ ব্যাপারে এই নিয়ে সাড়ে পাঁচবার হলো। সাড়ে অর্থে এটা এখনও চলছে, তার মানে অর্ধপথে।
প্রথম প্রেমে পড়েছিল শম্পা ওর দূর–সম্পর্কের মামাতো দাদা বুবুলের সঙ্গে। শম্পার তখন এগার বছর বয়েস, বুবুলের বছর সতেরো।
মফঃস্বলের কোনো স্কুল থেকে স্কুল ফাইনাল পাস করে, জায়গার অভাবে এই দূর সম্পর্কের পিসির বাড়িতে থেকে কলেজে পড়তে এসেছিল বুবুল।
চাঁদের মত ছেলে, মধুর মত স্বভাব, নিঃস্বও নয়। বাপ টাকা পাঠায় রীতিমত। কার আর আপত্তি হবে? পিসিরও হল না। মানে অনামিকার ছোটবৌদির।
কিন্তু জোরালো আপত্তি হল তার ভাইপোর সঙ্গে মেয়ের প্রেমে পড়ায়, তিনি প্রথমে বিনিপয়সায় বাড়িতে এসে–পড়া (যেগুলোর জন্যে অনামিকা দেবী দায়ী) রাশি রাশি সিনেমা পত্রিকার দোষ দিলেন, অনামিকা দেবী রচিত প্ৰেমকাহিনীগুলির প্রতি কটাক্ষপাত করলেন, তারপর মেয়েকে তুলে ধুনলেন এবং ভাইপোকে পথ দেখতে বললেন।
এগারো বছরের মেয়ের উপর এ চিকিৎসা চালানো গেল, অনামিকা দেবীর ছোটবৌদি ভাবলেন, যাক, শিক্ষা হয়ে গেল। আর প্রেমে পড়তে যাবে না মেয়ে।
কিন্তু কী অলীক সেই আশা!
সাড়ে বারো বছরেই আবার প্রেমে পড়ল। শম্পা, পাড়ার এক স্টেশনারী দোকানের সেলসম্যান ছোকরার সঙ্গে। খাতা পেনসিল রবার আলপিন চকোলেট ইত্যাদি। কিনতে গিয়ে আলাপের শুরু, তারপর কোন ফাঁকে আলাপ গিয়ে প্ৰেমালাপের পর্যায়ে উঠে বসলো। বিনা পয়সায় চকোলেট আসতে লাগলো।
এটা বেশ কিছুদিন চাপা ছিল, উদ্ঘাটিত হলো একদিন পাড়ার আর একটি ছেলের দ্বারা। হয়তো নিজে সে প্রার্থী ছিল, তাই বলে দিয়ে আক্রোশ মেটালো।
খবরটা বাড়িতে জানাজানির পর দিনকতক শম্পার গতিবিধির দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা হলো, শম্পার প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে এনে দেওয়ার ভার নিলো তার বাবা। কিন্তু প্রয়োজন তো শম্পার জিনিসের নয়, প্রেমের।
অতএব কিছুদিন মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়ালো শম্পা, তারপর আবার নতুন গাছে বাসা বাঁধলো। এবারে এক সহপাঠিনীর দাদা।
এ খবরটা বাড়িতে এসে পৌঁছবার কথা নয়। কারণ সহপাঠিনী সহায়িকা। সে তার বান্ধবীকে এবং দাদাকে আগলে বেড়াতে যত রকম বুদ্ধিকৌশল প্রয়োগ করা সম্ভব তা করতে ত্রুটি করেনি।
কিন্তু খবরটা তথাপি এলো।
এলো অনামিকা দেবীর কাছে।
প্ৰণয়ভঙ্গের পর।
শম্পা নিজেই তার লেখিকা পিসির কাছে বাক্ত করে বসলো। কারণ শম্পার তখন বয়স বেড়েছে, সাহস বেড়েছে। একদিন অনামিকা দেবীর এই তিনতলার ঘরে এসে বললো, পিসি, একটা গল্পের প্লট নেবে?
তারপর সে দিব্যি একখানি প্ৰেমকাহিনী ব্যক্তি করার পর প্রকাশ করলো প্লটের নায়িকা সে নিজেই। এবং স্বচ্ছন্দ গতিতে সব কিছু বলার পর হেসে কুটিকুটি হয়ে বলতে লাগলো, বল তো পিসি, এরকম বুদ্ধমার্কা ছেলের সঙ্গে কখনো প্রেম চালানো যায়? না তাকে সহ্য করা যায়?
অনামিকার নিজের গল্পের অনেক নায়িকাই দুঃসাহসিকা বেপরোয়া, মুখরা প্রখরা। তথাপি অনামিকা তার নিজের দাদার মেয়ে, নিজের বাবার নাতনীর এই স্বচ্ছন্দ বাকভঙ্গীর দিকে তাকিয়ে রইলেন অভিভূত দৃষ্টি মেলে।
শম্পা বললো, লিলি তো আমার ওপর মহা খাপপা, ওর দাদার নাকি অপমান হয়েছে।
তা সেটাই স্বাভাবিক।
বলেছিলেন অনামিকা দেবী।
শম্পা হেসে হেসে বলেছিল, তা কি করা যাবে? উনিশ বছর এখনো পার হয়নি, সবে থার্ড ইয়ারে ঢুকেছে, বলে কি না তোমার পিসিকে বলে–কয়ে—হি হি হি,—বিয়ের কথাটা পাড়াও!
অনামিকা দেবী মৃদু হেসে বলেছিলেন, তা তুমিও তো এখনো স্কুলের গণ্ডি ছাড়াওনি, সবে পনেরো বছরে পা দিয়েছ—
তা আমি কি, হি হি, বিয়ের চিন্তা করতে বসেছি?
প্রেম করছো!
শম্পা লেশমাত্র অপ্রতিভ না হয়ে বলেছিল, সে আলাদা কথা। ওটা হচ্ছে একটা চার্ম। একটা থ্রিলও বলতে পারো। তা বলে বিয়ে? হি হি হি!
তা সেই বুদ্ধুটাকে ত্যাগ করার পর শম্পা অন্ততঃ মন–মরা হয়ে বেড়ালো না। সাঁতার ক্লাবে ভর্তি হলো, আবদার করে সেতার কেনালো।
মা পিসি বাপ ঠাকুমা সরাই ভাবলো, এটা মন্দ নয়, বেটা ছেলেদের সঙ্গে হৈ–চৈ করে বেড়ানোর থেকে ভাল। দাদা তখন নিজের ব্যাপারেই মগ্ন, একটা স্কলারশিপ যোগাড় করে বিলেত যাবার তাল করছে, তুচ্ছ একটা বোন আছে কিনা তাই মনে নেই। তাছাড়া শম্পার মাও মেয়ের ব্যাপারটা সাবধানে ছেলের জ্ঞানগোচর থেকে তফাতেই রাখতে চেষ্টা করতেন। যা কিছু শাসন চুপি চুপি।
কিন্তু শম্পা চার্ম চায়।
তাই শম্পা তাদের ওই সাঁতার ক্লাবের এক মাস্টার মশায়ের প্রেমে হাবুড়ুবু খেতে শুরু করলো। বোধ করি তিনিও এর সদ্ব্যবহার করতে লাগলেন।
সাঁতারের ঘণ্টা বেড়েই চলতে লাগল এবং বেড়ে চলতে লাগলো। শম্পার সাহস।
অতএব ক্রমশঃ মা বাবা শাসন করবার সাহস হারাতে লাগলো। দাদা তো তখন পাড়ি দিয়েছে সমুদ্রপারে। শম্পার বাড়ি আরো বেড়ে যায়। শম্পাকে এক কথা বললে,—একশো কথা শুনিয়ে দেয়, বাড়ি ফিরতে রাত হয়েছে বলে রাগারাগি করলে পরদিন আরো বেশী রাত্তির করে, বেরোতে হবে না বললে তৎক্ষণাৎ চটি পায়ে গলিয়ে বেরিয়ে যায়। বলে, হারেমের যুগে বাস করছে নাকি তোমরা?
বাবা রাগ করে বললো, মরুকগে। যা খুশি করুকগে।
অনামিকা দেবী বললেন, ভালো দেখে একটা বর খোজো বাপু, সব ঠিক হয়ে যাবে। সময়ে বার না পেয়েই মেয়েগুলো আজকাল বর্বর হয়ে উঠছে। লেখিকার মতো নয়। অবশ্য কথাটা, নিতান্তই মাসি–পিসির মত কথা।
শম্পার মা কথাটা নস্যাৎ করলেন। বললেন, সবে ফাস্ট ইয়ারে পড়ছে, এক্ষুনি বিয়ে দিতে চাইলে লোকে বলবে কি? তাছাড়া কৃতী ছেলেই বা পাবো কোথায় বয়সের সঙ্গে মানানো? আমাদের আমলের মতো দশ–বারো বছরের বড় বর তো আর ধারে দিতে পারি না?
কি আর করা। তবে?
শম্পাই ছেলে ধরে বেড়াতে লাগলো। সাঁতারুকেও ত্যাগ করলো একদিন লোকটার কথাবার্তা বড় একঘেয়ে বলে।
তারপর কিছুদিন খুব উঠে পড়ে লেগে লেখাপড়া করলে শম্পা, মনে হলো এইবার বুঝি বুদ্ধি থিতিয়েছে।
কিন্তু নিজে মুখেই স্বীকার করে গেল একদিন শম্পা পিসির কাছে, একটা প্ৰেম–ট্রেম থাকবে না, কেউ আমার জন্যে হাঁ করে বসে থাকবে না, আমায় দেখলে ধন্য হবে না, এ ভালো লাগে না, বুঝলে পিসি? কিন্তু সত্যি প্রেমে পড়তে পারি এমন ছেলে দেখি না!
তা যখন সত্যি প্রেমের প্রশ্ন নেই, তখন আজেবাজেতেই শুধু চার্ম খুঁজলে বা ক্ষতি কি? সেই সময়টায় শম্পা একজন ক্যাবলী–মার্কা প্রফেসরের প্রেমে পড়লো।
প্রফেসারটি যদিও বিবাহিত।
কিন্তু তাতে কি? শম্পা বললে, আমি তো আর তাকে বিয়ে করতে চাইছি না! শুধু একটু ঘোল খাওয়ানো নিয়ে কথা।
সেই ঘোল খাওয়ানো পর্বটার পর কলেজ–লাইব্রেরীর লাইব্রেরীয়ান ছোকরার সঙ্গে কিছুদিন এখন শম্পার আর একটি চলছে।
অনামিকা আর একবার লেখায় মন দেবার চেষ্টা করেছিলেন, ফোনটা আবার বেজে উঠলো।
একটি তাজা সপ্রতিভ কণ্ঠ বলে উঠলো, শম্পাকে একটু ডেকে দিন তো।
ডেকে দিলেন।
শম্পা উঠে এল।
বললে, বাবাঃ, তোমার এই তিনতলায় উঠতে উঠতে গেলাম! কই দেখি আবার কে বকবকাতে ডাকছে!…এই নাও, নীচে তোমার একটা চিঠি এসেছিল—
টেবিলের ওপর খামের চিঠিটা রেখে পিসির দিকে পিঠ আর দেওয়ালের দিকে মুখ করে দাঁড়ালো শম্পা রিসিভারটায় কান–মুখ চেপে।
অনামিকা দেবী খামের মুখটা না খুলেই হাতে ধরে নাড়াচাড়া করতে লাগলেন। সেজাদির চিঠি।
অনেক দিন পরে এসেছে। সেজদি আর চিঠিপত্র লেখে না।
কিন্তু অনামিকাই বা কত চিঠি দিচ্ছেন! শেষ কবে দিয়েছেন মনেও পড়ে না। অথচ কত চিঠিই লিখে চলেছেন প্রতিদিন রাশি রাশি। আজেবাজে লোককে। সেজদি বড় অভিমানী। কাজে সারা চিঠি চায় না সে।
মল্লিকা সেনগুপ্তর লেখা কবির বৌঠান বইটি দেওয়ার অনুরোধ রইলো।
এটা দেয়া হয়েছে।