০১. মা, কেমন আছো তুমি?

নেই, কিছু নেই – আত্মজীবনী ষষ্ঠ খণ্ড – তসলিমা নাসরিন
প্রথম প্রকাশ : জানুয়ারি ২০১০
পরিমার্জিত দ্বিতীয় সংস্করণ : নভেম্বর ২০১১

.

মা,

কেমন আছো তুমি?

কতদিন তোমার সঙ্গে আমার কথা হয় না। কত দীর্ঘদিন! তুমি কি হিসেব করছে দিনগুলো! চিরকালই তো তুমি দিন হিসেব কর, আঙুলের কড়ায় গোনো দিন। এতগুলো দিন এখন কি তুমি গুনতে পারছো? এখন তো দিন বা মাসের হিসেবে কুলোবে না। তোমাকে বছর হিসেব করতে হবে। বছর! ভাবলে কেমন গা কাঁপে। একসময় তো ঘণ্টা হিসেব করতে। ক’ ঘণ্টা ক’ মিনিট ঘরে ফিরছিনা, কোথায় কাটাচ্ছি, খেয়েছি কিনা, কোনও অসুবিধে হল কিনা কোথাও, এসব ভাবতে। বারান্দায় বসে থাকতে যতক্ষণ বাড়ি না ফিরি। তারপর তোমাকে ছেড়ে অন্য শহরে যখন চলে গেলাম, তখন কি আর ঘণ্টা হিসেব করে কুলোতেপারতে! তখন তোমার দিন হিসেব শুরু হল। আমি ফিরেছি তোমার কাছে, আমাকে দেখেই সঙ্গে সঙ্গে বলতে কতদিন পর এলাম আমি। তেতাল্লিশ দিন পর নাকি সাতাত্তর দিন পর। তুমি প্রতিদিন মনে রাখতে দিন কটা গেল। কী করে পারতে মা! তখন তোমাকে খুব বোকা ভাবতাম। বলতামও তোমার কি আর খেয়ে দেয় কাজ নেই, এসব হিসেব করো কেন বসে বসে! ’ হিসেব করা কিন্তু মোটেও সহজ ব্যাপার নয়। যে করে, সে খেয়ে দেয়ে কাজ থাকলেও করে। যেকরে না, তার অখণ্ড অবসরেও সে করে না। আমি কোনওদিন কোনও কিছুর হিসেব করিনি, তোমার সঙ্গে দেখা না হওয়ার কোনও কিছু। না ঘণ্টা, না দিন, না মাস, না বছর। এক দুই তিন করে বছর চলে গেছে শুধু নিজের চারদিকে আবর্তিত হতে হতে, বুঝিওনি যে চলে গেছে।

তোমার কি কিছু ছিল না আর অপেক্ষা ছাড়া? ছিলই তোনা! কী ছিল তোমার যে কারও জন্য অপেক্ষা না করলেও চলবে তোমার! সংসারটা ছিল, যেটাকে সবচেয়ে আপন ভাবতে তুমি। সংসারে স্বামী আর চারটে সন্তান। বাবাকে আসলে তোমার স্বামী বলে কোনওদিন আমার মনে হয়নি। মানুষটাকে বাবা হিসেবেমানাতো। পুত্র, পৌত্র, প্রপৌত্র, ভাইপো, বাবা, কাকা, জ্যাঠা, মামা সবকিছুতেই মানাতো। শুধু ওই স্বামীটা মানাতো না। বিশেষ করে তোমার স্বামী। তোমার কি কোনওদিন তা মনে হয়েছে, মা? মনে নিশ্চয়ই হয়েছে। কোনওদিন বলোনি কাউকে। একসময় মনে হত, তুমি বুঝি সব কথা বলো। যেহেতু ভাবতাম তুমি বেশি কথা বলো। পরে বড় হয়ে, আরও অনেক বড় হয়ে বুঝেছিসব কথা তুমি কোনওদিনই বলোনি। তোমার অনেক কথা ছিল, যেসব কেউ কখনও জানেনি। শুধু তুমিই জানতে নিভৃতে। তোমার ভেতরে তোমার নিজস্ব কিছু কথা, কষ্টের কথা, একান্ত তোমারই কথা, তা জানার, আমার মনে হয় না কারও কখনও কোনওদিন কোনও উৎসাহ ছিল। সংসারে তুমি ছিলে, যেহেতু ওই সংসারটা ছাড়া কিছু ছিল না তোমার। ভাবলে শিউরে উঠি। গোটা একটা জীবনে আর কিছু নেই, শুধু খাঁ খাঁ করা ফাঁপা একটা সংসার পড়ে আছে, ইচ্ছে না হলেও এই ফাঁপা ফাঁকা জিনিসটা নিয়ে বাকি জীবন পার করতে হবে।

তুমি তো কোনওদিন শিউরে ওঠোনি! বরং শুরু থেকে শেষ অবধি এই সংসারটাই চেয়েছিলে যেন তোমার হয়। তোমার নিজের হয়। যে সংসারে তোমার জন্য কারওর কোনও ভালোবাসা ছিল না, সেই সংসারটাকে ভালোবাসা দিতে দিতে তুমি নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলে। নিঃস্ব রিক্ত সর্বস্বান্ত। সব হারিয়ে সব ফুরিয়ে তুমি আমার পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে। কেন যে তোমার মনে হতো, নির্বাসন থেকে আমি ফিরতে পারবো কখনও বা ফিরবো কখনও। মা, আমি কি তোমার কাছে ফেরার কথা ভেবেছিলাম কখনও? মনে হয় না। আমি চেয়েছিলাম দেশে ফিরতে। আমার ঘরে, আমার সংসারে। আমার বন্ধুদের কাছে। আমার শিল্প সাহিত্যের জগতে। আমার শৈশব কৈশোর যৌবনের স্মৃতির কাছে। চেনা বাড়িঘর, মাঠ মাটি, গাছ নদীর কাছে। স্বজনের কাছে। স্বজন বলতে কত কারও মুখ ভাসতো। তোমার মুখ কি আমার মনে পড়েছে কখনও? কখনও পড়েছে বলে তো মনে পড়ে না। তোমাকে, তুমি খুব ভালো করেই জানতে, যে, ভালো আমি বাসিনি। অভিযোগ করোনি কোনওদিন। ভালোবাসা দাবি করোনি। দাবি কি কারও কাছেই করেছিলে! স্বামীর ভালোবাসা দাবি করারও তোমার স্পর্ধা হয়নি কোনওদিন। শুধু ঘৃণা অবজ্ঞা অবহেলার বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে অনুযোগ করতে। যাদের ভালোবাসো, তাদের কাছে কাঁদতে। কাঁদার সময় কখনও বলতে না যে স্বামী ভালোবাসে না বলে তোমার মনে কষ্ট। মনে কষ্ট কারণ স্বামী অপমান করছে প্রতিদিন, কেউ তার ক্রীতদাসীর সঙ্গেও এমন ব্যবহার করে না, যে ব্যবহার তোমার স্বামী তোমার সঙ্গে করে। স্বামী যদি ঘৃণাটা কমাতো, যদি বিষ চোখে না তাকাতো তোমার দিকে, যদি দূর দূর করে না তাড়াতো, তাহলেই যেন ভালো ছিলে তুমি। আর কিছুর আশা তুমি করোনি। সত্যি, ভালোবাসা আশা করার সাহস তোমার হয়নি। ভালোবাসা, তুমি, আমার মনে হয় কারও কাছ থেকেই আশা করোনি। না তোমার ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে, না স্বামীর কাছ থেকে।

ভালোবাসা ছাড়াকীকরে বাঁচতে! এখন ভাবলে কী রকম যেনহুহু করে ওঠে বুকের ভেতরটা। একটা মানুষ অন্যকে কেবল দিয়েই যাচ্ছে, দিয়েই যাচ্ছে, চোখ বুজে, মুখ বুজে কেবল দিয়েই যাচ্ছে। কারও কাছে কিছু চাইছে না। কেউ কিছু দিতে চাইলে বা দিলে নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে নিচ্ছে। নিয়ে তোমার অভ্যেস ছিল না মা। তাই গুটিয়ে নিতে। লজ্জা পেতে। পেতে কিন্তু ভেতরে ভালো লাগার বীণা বেজে উঠত তোমার, গোপনে গোপনে অহংকার হত খুব। দাদা কোনও শাড়ি এনে দিলে সেই শাড়ির কথা তুমি অনেককে বলতে। নানিবাড়িতে ছুটে গিয়ে বলে আসতে সবাইকে। শাড়িটা সস্তা হলেও বলতে দামি। শাড়িটা যেন তেন হলেও নানাভাবে বোঝাতে চাইতে যে শাড়িটা আসলে টিকবে অনেকদিন, শাড়ির জমিন খুব ভালো। যদিশাড়িটা পরতে বলা হত তোমাকে, পরতে পারতে না। পরতে লজ্জা হত তোমার। নয়তো চোখে জল চলে আসতো খুশিতে। শাড়িটা আমাকে দিয়ে দিতে, নয়তো ইয়াসমিনকে। তুমি তোমার পুরোনো মলিন ছেঁড়া শাড়ি পরেই থাকতে। ওই যে অহংকার করতে, ওই অহংকারটাও করতে তোমার সংকোচ হত। অহংকার করেও তো তোমার অভ্যেস ছিল না। তোমাকে কেউ ভালোবাসছে, ভালোবেসে কেউ দিচ্ছে, তোমাকে নিয়ে ভাবছে, এটা কী যে অসম্ভব ঘটনা ছিল আমাদের বাড়িতে! কী করে ছিলে বাড়িটায়? আমি তোমার জায়গায় হলে বিয়ের পর দিনই হয় স্বামীকে বাড়ি থেকে বের করে দিতাম, নয়তো কোনও এক সময় নিজেই বেরিয়ে যেতাম। বেরোতে কি তুমি কম চেয়েছিলে! পারোনি। কে তোমাকে আশ্রয় দেবে, তোমার বাবা মা ভাই বোনরা তখন তো ধারণাই করতে পারতো না যে মেয়েরা স্বামীকে ত্যাগ করতে পারে! আবার তোমার ওই অশান্তির সংসারে এক এক করে সন্তান জন্ম নিল, সন্তানদের মুখ চেয়েও সংসার ছাড়তে তুমি পারোনি। ভেবেছিলে, ওরাই তোমার দুঃখ ঘোচাবে কোনও একদিন। সন্তান জন্ম দিলে আমিও হয়তো তোমার মতোই ভাবতাম! বিশেষ করে তোমার মতো যদি কপর্দকশূন্য হতাম বা যদি কোথাও আশ্রয় পাওয়ার কোনও সম্ভাবনা না থাকতো। তুমি বলতে কোনও বড় বা মাঝারি চাকরি তুমি নিতে পারো না, কারণ তোমার আইএ বিএ পাশ হয়নি। আবার খুব ছোট চাকরি, যেমন লোকের বাড়িতে রান্না করা কাপড় ধোয়া বাসন মাজা, সেটাও তুমি নিতে পারো না, কারণ ও-কাজও তোমাকে দেবে না কেউ, কারণ তুমি খুব গরিব ঘরে জন্ম নাওনি, তোমার আত্মীয় স্বজন কেউ রাস্তায় ভিক্ষে করে না। তোমার কোনও উপায় ছিল না মা। উপায় থাকলে তুমি চলে যেতে। একবার বছর দশেকের ছোটদাকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা চলে গিয়েছিলে চাকরি খুঁজতে। ঢাকা গিয়েছিলে কারণ ময়মনসিংহে তোমার চাকরি পাওয়া সম্ভব নয়। নামি দামি ডাক্তারের বউ ছোটখাটো কোনও চাকরি করতে চাইছে, এ কেউ মানবে না। আবার বাড়ি থেকেও তোমাকে বাইরে চাকরি করতে যেতে কেউ দেবে না। ঢাকার হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরেছো নার্সের চাকরি পেতে। কেউ তোমাকে সে চাকরি দেয়নি। দেয়নি কারণ তারাও কোনও না কোনওভাবে জেনে গেছে তোমার স্বামী একজন ডাক্তার। ডাক্তারের স্ত্রীর তো এত চাকরির প্রয়োজন নেই, দেবে কেন! আর সংসার ফেলে তুমি চাকরি করবে, তাই বা আমাদের সমাজের কর্তারা মানবে কেন। তুমি মোটেও বলতে চাওনি যে তোমার স্বামী ডাক্তার, কিন্তু খুঁচিয়ে তোমার সবকিছু জেনেও নিয়েছে ওরা। মিথ্যেও বলতে পারোনি। মিথ্যে বলতে তুমি জানতে না। স্বামী ডাক্তার, সে তো স্বামী, তুমি তো নও। টাকা পয়সা সে তো স্বামীর, তোমার তো নয়। এ কথা যত বোঝাতে চেয়েছো, তত ব্যর্থ হয়েছে। নিরাশ হয়ে ফিরে এসেছিলে ময়মনসিংহে। বাড়িতে ছোট কাজই করতে, কিন্তু মাইনে ছাড়া বিনে পয়সার কাজ। তুমি চলে গেলে কোনও একদিন কোনও এক সৎ মা এসে আমাদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলবে, এই দুশ্চিন্তাও তোমার ছিল, কোথাও শেষ পর্যন্ত তোমার যাওয়া হয়নি। শৈশব কৈশোর জুড়ে শুনেছি, তুমি কোথাও চলে যাবে। খুব ছোট যখন ছিলাম, ভয় হত, তুমি চলে গেলে আবার কী না কী হয় আমাদের। তুমি চলে গেলে তোমার কী হবে ভাবিনি। ভেবেছি, আমাদের কে খাওয়াবে, কে নাওয়াবে, আদর যত্ন করবে কে। ভয় ছিল, আবার রাগও হত তোমার ওপর। আরেকটু বড় হয়ে, আরেকটু বুদ্ধি হওয়ার পর তোমাকে জিজ্ঞেস করতাম, গেলে ঠিক কোথায় যাবে তুমি। তোমার মুখে দ্রুত কোনও উত্তর ফুটতো না। ভাবতে তুমি। ঠিকই তো, কোথায় যাবে! আসলে তুমি বুঝতে যে পৃথিবীর কোনও বাড়ি নেই যেখানে তোমার থাকার জায়গা হবে, পৃথিবীতে মানুষ কেউ নেই যে তোমাকে আশ্রয় দিতে পারে। ‘কোথায় আর, কোনও জঙ্গলে টঙ্গলে’, বলতে। খুব দূরের কোনও জঙ্গলের ইঙ্গিত করতে তুমি, যেখানে কেউ পৌঁছোতে পারে না সহজে, আর যেখান থেকে কেউ কোনওদিন ফিরেও আসতে পারে না। মনে মনে তুমি কোন জঙ্গলের কথা ভাবতে? চোখের সামনে তোমার যে ভেসে উঠবে কোনও জঙ্গল, সে কোন জঙ্গল! তুমি তো দেখনি কোনও জঙ্গল, শহরের কাছেই যে মধুপুরের জঙ্গল, সে জঙ্গলও তোমার দেখার সৌভাগ্য হয়নি। ওসব জঙ্গলে তো বড় হয়ে কত আমরা চলে গেছি, ঘুরে বেড়িয়েছি, কোনওদিন তো ভুলেও তোমাকে নেওয়ার কথা ভাবিনি। আত্মীয় স্বজনকে নিয়ে যেতাম গাড়িতে, বন্ধু বান্ধব খুঁজতাম কাকে নিয়ে বেড়াতে যেতে পারি। তোমার কথা কোনওদিন মনে হয়নি মা। এখন প্রশ্ন করি নিজেকে, কেন মনে হয়নি। আসলে মনে হওয়ার মতো করে তোমাকে ছোটবেলা থেকে দেখিনি, বড়বেলায় যে বোধ জাগতে হয়, সেই বোধটা জাগেনি। ঘরে বসে, আমরা যারা হৈহুল্লোড় করে মধুপুর জঙ্গলে বেড়াতে যাবো, তারা কখন ফিরে আসবো তার অপেক্ষা করবে তুমি। নানা রকম সুস্বাদু খাবার তৈরি করে আমাদের জন্য দরজায় বা জানালায় দাঁড়িয়ে অস্থির অপেক্ষা করবে। দেরি হতে থাকলে তুমি বিড়বিড় করে সুরা পড়তে থাকবে যেন সব অমঙ্গল অতিক্রম করে ফিরতে পারি ভালোয় ভালোয়। জঙ্গলটাও বোধহয় তুমি কল্পনা করেই নিয়েছিলে। সিনেমায় দেখা কোনও জঙ্গলের কথা মনে করতে সম্ভবত। রাজাদের গল্পে মানুষকে বনবাস দেওয়া হত, অথবা সব হারিয়ে কেউ কেউ দুঃখে শোকে একা একা জঙ্গলে চলে যেত। তোমার কল্পনার জঙ্গলটি ঠিক কী রকম গভীর ছিল, জানি না। আমি আমার মতো করে তোমার জঙ্গলটি ভেবে নিতাম, যেখানে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। একবার কেউ সে জঙ্গলে হারিয়ে গেলে, জন্মের মতো হারিয়ে যায়। তোমার জন্য কী আমার ভয় হত? মনে হয় না। বরং রোমাঞ্চকর গল্পের মতো মনে হত সবকিছু। তোমার দিকে লাফিয়ে বাঘ আসছে, সাপ তোমাকে পেঁচিয়ে ধরেছে, তুমি চিৎকার করে বাঁচতে চাইছো, পারছে না। তোমার জন্য খুব মায়া হত বলেও আমার মনে হয় না। জিজ্ঞেস করতাম, কী খাবে জঙ্গলে? বলতে, আল্লাহর এই এত বড় দুনিয়ায় খাওয়ার অভাব হবেনা। আরও চাপ দিয়ে কথা বের করতে চাইলে বলতে যে ফলফলান্তি খেয়েই তোমার কেটে যাবে। আমি ভাবতে চেষ্টা করতাম, নানারকম ফল খাচ্ছো। ফল খেতে আসলেই তুমি খুব ভালোবাসতে। বাড়িতে কত ফলের গাছ লাগিয়েছিলে। কিছু কি খেয়েছে কোনওদিন? হঠাৎহয়তো গোপনে কামড় দিতে কোনও ফলে। গোপনেই। তুমি কি আর প্রকাশ্যে কিছু খেতে পারতে! বাবা লজ্জা দিত বলে খেতে না। খেতে আমাদের ফেলে রাখা আধ-খাওয়া কোনও ফল। নিজে গোটা একটা ফল কখনও খেয়েছো দেখিনি। খেলে চেখে দেখার জন্য খেয়েছে। ফলটা মিষ্টিকী না, রসালো কী না, ভালো জাতের কী না বোঝার জন্য। সবকিছু ছিল তোমার ছেলেমেয়েদের জন্য, ছিল বাবার জন্য, কাজের মানুষের হক আছে বলে তাদেরও দিতে। তোমার নিজেরহকের কথা তুমি নিজে কখনও বলেনি। হয়তো জানতেও না যে তোমার আদৌ কোনও হক আছে, জানলেও ভুলে গিয়েছিলে। আর, আমরাও স্মরণ করিয়ে দিইনি।

সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলে, হয়তো তারাই কোনও একদিন তোমার দুঃখ ঘোচাবে, কিছুই ঘোচায়নি কেউ। দাদা তোমাকে চাকরি পাওয়ার পর ঈদের সময় বছরে একটা সস্তা শাড়ি দিত। তাই পেয়েই কী ভীষণ খুশি হতে তুমি। এই দেওয়াটাও বন্ধ হয়ে গেল দাদাবিয়ে করারপর। দেওয়া বন্ধ হলেও কথা ছিল, কী ভীষণ অশান্তি আর অসুখ তোমাকে দিত দাদা আর তার বউ মিলে। ছোটদা তো অল্প বয়সেই বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করলো। তোমার কোল খালি করে চলে গেল তোমার আদরের ছেলে। তার হিন্দু মেয়ে বিয়ে করাটাও মেনে নিলে তুমি। ছেলেকে বউসহ বাড়ি ফিরিয়ে আনলে। গীতাকে বড় আদর করে আফরোজা বলে ডাকতে। না, নামটা তুমি দাওনি। ওদেরই দেওয়া। কিন্তু ওইযে ঘেমে নেয়ে রান্নাঘরে সারাদিন পড়েপড়ে খাটতে দুই বউকে খাওয়ানোর জন্য, ওদের মুখে হাসি ফোঁটানোর জন্য, যেন তোমার ছেলেদের মুখে হাসি ফোটে, কী হল শেষ অবধি! ওরাও তোমাকে দাসীই মনে করেছে। দাসীর মতো খাটতে বলে দাসীরা যেমন ব্যবহার পায়, তেমন ব্যবহার পেয়েছে। আমরা চার ভাই বোন যেমন ব্যবহার করেছি, ওই দুই বউএর কাছ থেকে তেমনই পেয়েছে ব্যবহার। ছোটদার ছেলে হল, আর সেই ছেলে পোষার ভারপড়লো তোমার ওপর। তুমি পাগল হয়ে গেলে। সত্যি বলতে কী, পাগলই হয়ে গেলে তুমি। ওভাবে কেউ দেবশিশু পুষতে পারে, মানুষ নয়। দিন রাত্তির ব্যস্ততা তোমার। কী থেকে আবার কী হয়ে যায়, তটস্থ ছিলে তুমি। তোমার ঘুম হারাম হয়ে গেল। নাওয়া খাওয়ার কোনও ঠিক নেই। ভয়ে কাঁপতে। এদিকে আবার মায়াও তৈরি হল। ছেলেটার জন্য কী ভীষণ মায়া, কী অসম্ভব ভালোবাসা। তুমি পারোও ভালোবাসতে। পুষতে বলে ছোটদাও দেওয়া শুরু করলোপরবে উৎসবে তোমাকে শাড়ি পরব বলতে তো ওই একটাই। ঈদ। নতুনপরবহল, তার ছেলের জন্মদিন। তুমি খাটছো, তার ছেলেকে জন্মের পর থেকে মানুষ করছে। বিনিময়ে তোমাকে একটা সুতির শাড়ি। ঘরে পরার। তুমি ফিরেও তাকাতে না সে শাড়ির দিকে। দিনমান তাকিয়ে থাকতে দেবশিশুর দিকে না তাকিয়ে থাকলে ও যদি হাঁটতে গিয়ে পড়ে যায়, দৌড়োতে গিয়ে কোথাও লাগে। অসাবধানে কিছু যেন না হয়। হাত সাতবার গরম জলে ধুতে ওকে ছুঁতে গেলে, ওর দুধের বোতল, ওর থালা বাটি ফুটন্ত জলে সাতবার ডোবাতে পারলে নিজের সারা গা ডেটলে ডুবিয়ে রাখতে। পেট যেন খারাপ না হয় ছেলের। হঠাৎহঠাৎ ঢাকা থেকে লং ড্রাইভে ছোটদা আর তার বউ চলে আসতো, বেড়ানোও হল, ছেলে দেখাও হল। তুমি তটস্থ হয়ে থাকতে। যত্ন আত্তিতে আবার কোনও ত্রুটি ধরাপড়ে গেল কীনা। তোমার জীবনে বোধহয় অত কঠিন মানসিক চাপ আর কখনও আসেনি। সবচেয়ে বড় কোনও পরীক্ষার প্র্যাকটিক্যাল দেওয়ার মতো। ছোটদারা এলে ওদের সামনে ছেলেকে নিয়ে তুমি দেখাতে যে কত হাসছে, খেলছে। মা বলতে শিখছে। আরও বড় হলে বলতে হাঁটতে শিখছে, পড়তে শিখছে, আঁকতে শিখছে। ছোটদারা দেখে যেত কতটা শিখেছে। তাদের কোনও পরিশ্রম ছাড়াই ছেলে বড় হয়ে যাচ্ছে, বেস্ট বয় হচ্ছে, এতে খুশি হবেনা তোঅবকাশে এলেই গীতা মুখবিষকরে রাখতো। যেন তুমিমানুষ করছে ঠিকই, ঠিকমতো করছোনা। আচ্ছাওরকনুইয়ের কাছে আবার কিসের দাগ? পড়ে গেছলোনাকি? যেন এক্সামিনার প্রশ্নকরছেন। তোমার মুখ কেমন ফ্যাকাসে হয়ে যেত। দূরে গিয়ে কাঁদতে। আঁচলে মুছতে চোখের জল। একসময় এসে খন্ডন করতে গীতার অভিযোগ। আলোয় এনে দেখাতে সুহৃদের কনুইয়ে কোনও দাগ নেই। জামা জুতো খুলে সারা শরীর দেখিয়ে দিতে। নিটোল নিখুঁত। ওদের মুখে হাসি ফোঁটাবার জন্য কী রকম যে আকুল ছিলে, মা। দাসী ছিলে তুমি। কিন্তু তুমি তো মা, তুমি দাসী হবে কেন? দাসীরা তো মাইনেপায়, দাসীদের স্বাধীনতা থাকে বাড়ি বদল করার। ক্রীতদাসী ছিলে।

তোমাকে ভালোবাসার কোনও চল আমাদের বাড়িতে কখনও ছিলো না। বাবাকে যমের মতো ভয় পেতাম। বাবা ছিল আমাদের শিক্ষক। আমাদের নীতি আদর্শ বোঝাতো। সকাল সন্ধে কেবল জ্ঞান দিত। বড় হবার, ভালো হবার, সৎহবার, মানুষের মতো মানুষ হবার। বাবার টাকায় আমাদের খাওয়া হত। বাবা কিনে দিলে কাপড় জামা পেতাম। বাবাইস্কুলে ভর্তি করাতো, বইখাতা কিনে দিত, মাস্টার রেখে দিত। বাবা কলেজে পড়াতো, কলেজে যাবার রিক্সাভাড়া দিত। বাবার বাড়ি। বাবার টাকা। বাবার সব। বাবা ভালোবেসে কাছে টানতো। রাগ হলে পেটাতো। জন্মেরপর বাবাকেই দেখেছি পরিবারের সবচেয়ে বড় একজন মানুষ। যেসবচেয়ে বেশি বিদ্বান। যার আদেশে যার উপদেশে সংসার, সন্তান চলে। তুমি ক্রীতদাসী, পড়ে থাকতে রান্নাঘরে, দৌড়ে দৌড়ে বাবার আদেশ মতো কাজ করতে। বাবার ধমক খেতে। বাবাকে খুশি করার জন্য তোমার পরিশ্রমের শেষ ছিল না। সেই ছোটবেলায় বাবার প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে তোমার প্রতি হব কেন বলো তো! যমের মতো ভয় পেতাম, আবার মানুষটিকে ভালোবাসতাম। তার অপকর্মের জন্য যত ক্ষমা তাকে করেছি, তার সামান্যও তোমাকে করিনি। অপকর্ম না করলেও তোমার পান থেকে চুন খসলেই গর্জে উঠেছি, বাবা যেমন গর্জে উঠতো। বাবা যেমন তোমাকে মানুষ বলে মনে করতে না, আমরাও করতাম না মা। বাবা ছিল আমার, আমাদের শিক্ষক। তুমি চাইতে বাবার কথা শুনি, বাবার উপদেশমানি, আবার তোমাকেও একেবারে হেলা না করি। শিক্ষক তোমাকে হেলা করতো, তাই হেলা করতে শিখেছি। শিক্ষক যা বলে, তাই কি শুধু শুনেছিলাম, শিখেছিলাম; শিক্ষক যা করে, তাও করেছিলাম! পুরোটা শৈশব, কৈশোর, যৌবন জুড়ে শিখেছি। তোমাকে হেলা করতেই শিখেছি। আসলে মানসিকতা ওই শৈশব কৈশোরেই গড়ে ওঠে। সেটি নিয়েই আমরা বাকি জীবন কাটাই। খুব বড় কোনও পরিবর্তন পরবর্তী জীবনে আসে বলে মনে হয় না। তা না হলে তোমার একাকীত্বের দিকে কখনও আমি তাকাইনি কেন? আমি তো কত কারও কষ্টে কেঁদেছি, তোমার কষ্ট আমাকে স্পর্শ করতে পারেনি কেন? তোমাকে ক্রীতদাসী ভেবেছিলাম, ভাবতে শিখিয়েছিল বাবা, তোমার স্বামী, তোমার প্রভু। আমি জানি না বাবার দোষ দিয়ে আমি একরকম পার পেতে চাই হয়তো। নিজের দায়িত্ব বলে কিছুকি ছিল না আমার, যখন বড় হলাম? তোমার প্রতি কোনও দায়িত্ব আমি বোধ করিনি। তুমি মা। তাতে কি? যখন আঘাত পেতে, বারবার বলতে ‘আমি তো মা, আমি তো মা’। তুমি যে মা সে কথা ভুলে থাকি বলে অভিযোগ করতে। হয়তো অভিযোগও করতে না, একা একা কষ্ট পেতে পেতে স্বগতোক্তি করতে! তোমার সঙ্গে অত জঘন্য আচরণ করি কেন, তুমি তো মা। মা বলে তুমি ভালোবাসা আশা করতে না, না পেতে পেতে তোমার অভ্যেস ছিল না পাওয়ার, শুধু চাইতে তোমাকে অত বিচ্ছিরিভাবে অপমান যেন না করি। যেন অন্তত এই একটি ক্ষেত্রে বাবার মতো না হই। বাবারমতোহওয়ার স্বপ্নই তো ছিল আমার জীবনভর। বাবার মতো আদর্শবান, পর্বতের মতো উঁচু, ভেঙে না পড়া, মচকে না যাওয়া, পরোয়া না করা, দৃঢ়, ঋজু। বাবার মতো বস্তুবাদী, বিজ্ঞানমনস্ক, কুসংস্কার-না-মানা, ধর্ম-না-মানা, কর্মঠ, নিষ্ঠ। এই গুণগুলোকে না ভালোবাসার কোনও কারণ ছিল না। বাবার সঙ্গে আমার নানা বিষয়ে মতবিরোধ হওয়ারপরও বাবা হতে চাওয়া থেকে আমি বিরত থাকিনি। বাবার মতো সবল, সাহসী, সত্যবদ্ধ আর সুশৃঙ্খল আমরাও যেন হই, চাইতে। কিন্তু বাবার চেয়েও মানুষ হিসেবে বড় হই, সহিষ্ণু হই, বিনম্র হই, নিরহংকার হই, উদার হই, এও চাইতে। তুমি কি তোমার নিজের জন্য অপমানিত না হওয়া চাইতে! নিজেকে ভালো লাগা দিতে! আসলে আমাদের জন্যই চাইতে। যেন আমরা কাউকে ঘৃণা না করে, কাউকে অশ্রদ্ধা না করে মানুষ হই, বড় মানুষ। বাবাও চাইতো আমরা যেন মানুষ হই। তোমাদের চাওয়ায় কোনও কার্পণ্য ছিলো না। শুধু মানুষ বলতে দুজনে দুরকম বুঝতে।

দাদা, ছোটদা, ইয়াসমিন কাউকে দেখি না এখন আক্ষেপ করতে যে, যে শ্রদ্ধা তোমার প্রাপ্য ছিল, তুমি তা পাওনি। তোমার প্রতি কোনও কর্তব্য বা দায়িত্ব পালনে তাদের কোনও ত্রুটি ছিল, এমন কথা ভুলেও কেউ উচ্চারণ করে না। সবাই অবিশ্বাস্য রকম শীতল, ভারমুক্ত, তৃপ্ত। অথচ আমি জানি মা, কতটা ভুল আমার মতো তারাও করেছে। আক্ষেপ আমার হয়, অনুতাপ আমার হয়। আমি খুব ভালো করেই জানি যে তোমাকে যত অবজ্ঞা করেছি, তত অবজ্ঞা আমি কাউকে করিনি। তত অসম্মান পৃথিবীর কাউকে আমি করিনি। যত ঘৃণা করেছি আমি তোমাকে, সত্যি বলতে কী, তত আর কাউকে করিনি। আমার মাঝে মাঝে মনে হয়, অনুশোচনা আমি কেন করি এখন? তুমি নেই বলেই তো! তুমি যদি থাকতে, এই অনুশোচনাটা করতাম বলে মনে হয় না। যেমন তোমাকে ভুলে ছিলাম, তেমনই থাকতাম। কারও বোধোদয় হওয়ার জন্য যদি অন্য কারও মৃত্যুর প্রয়োজন হয়, তবে সেই বোধোদয়ের মূল্য কি সত্যিই কিছু? আমার এই বোধের জন্য, বিশ্বাস করো বা না করো, আমারই লজ্জা হয়।

তোমার একাকীত্ব নিয়ে কোনওদিন সামান্যও ভাবিনি। ছোটবেলায় না হয় ভাবিনি। বড়বেলাতেও কেন একবারের জন্যও মনে হয়নি, কী দুঃসহ জীবন তুমি কাটিয়েছো তোমার সারাজীবন। কেন একবারও ভাবিনি কী ভীষণ একা তুমি। বুদ্ধি হবার পর কোনওদিন দেখিনি বাবা আর তুমি এক বিছানায় ঘুমোচ্ছো। বাবা তো তোমার সঙ্গে শুতো না। তার মেয়ে ছিল শোয়ার। তুমি কেঁদে কেটে বুক ভাসিয়ে, চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করে, বাবাকে ফেরাতে চেয়েছো, পারোনি। তুমি ব্যর্থতার আরেক নাম। বাবা তোমার সামনে দিয়ে গটগট করে বেরিয়ে যেতে। মেয়েমানুষের অভাব বাবার থাকবে কেন, দেখতে অসম্ভব সুন্দর ছিল, তার ওপর ডাক্তার, আবার নামকরা ডাক্তার, রোগীতে ভরে থাকতো চেম্বার, হয় বাবা বড় সিভিল সার্জন, নয় মেডিকেল কলেজের প্রফেসর। এমন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, গুণে জ্ঞানে ভরপুর পুরুষ শহরের কজন দেখেছে! মেয়েরা বাবার প্রেমেপড়তো। তবে বাবার কপালও যে খুব ভালো ছিল, তানয়। কোন এক ফর্সা বিবাহিত মহিলার সঙ্গে বাবা সেই যৌবনেই এমন ভিড়ে গিয়েছিল যে সেই মহিলা তার স্বামীর কাছ থেকে তালাক নিয়ে বাবাকে চাপ দিয়ে বিয়ে পর্যন্ত করিয়ে নিয়েছিল। এসব আমরা কেউ জানতাম না। হঠাৎহঠাৎ লোকমুখে শুনতাম। লোকের কথা বিশ্বাস হত না। বাইরের প্রেম ভালোবাসা, সোহাগ সম্ভোগের খবর বাবা কোনওকালেই বাড়িতে আনেনি। বাবার না হয় শরীর জুড়োতো, তোমার কী হত! তোমাকে স্পর্শ করার কোনও প্রাণী তো কোথাও ছিল না। আমাণুদ্দৌলা কদিন তোমার সঙ্গে সম্ভবত গল্প করার ছুতোয় তোমার হাত ছুঁয়েছে, কিন্তু সে যে খুব বেশিদূর যেতে পেরেছিল, মনে হয় না। আমিই তো তোমার একটা বন্ধু সম্বোধন করে লেখা চিঠি কোত্থেকে আবিষ্কার করে বাড়ির সবার সামনে একদিন চিৎকার করে জানিয়ে দিয়েছিলাম। ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল তোমার মুখখানা। আমরা সবাই খাওয়ার টেবিলে বসে খাচ্ছিলাম, বাবা, দাদা, ছোটদা, আমি … ওইসময়ই ঘৃণা ছুঁড়তেছুঁড়তে বলেছিলাম সে কথা, যে, তুমি একটা প্রেমপত্র লিখেছো কাউকে, কী লিখেছো তাও বলেছি, অল্প বয়সে মস্তিষ্কের ঘর বারান্দা বড় তকতকে থাকে, দাঁড়ি কমাও মুখস্ত হয়ে যায়। সেই চিঠিটা কাকে লিখেছো, তা যে অনুমান করতেপারছি, এবং সেই অনুমানটিও সবাইকে আরও দ্বিগুণ চেঁচিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলাম, তা ওই ঘৃণার জন্য। তোমাকে, সত্যি কথা বলতে কী মা, আমি ঘৃণা করতাম। তোমার কিছুই আমার পছন্দ হতো না। তোমার অসহায়তা আমার ভেতরে কোনও করুণা সৃষ্টি করতো না। পৃথিবীর সব নির্যাতিত অসহায় মানুষের জন্য আমার মায়া হত, কিন্তু তোমার জন্য হত না। কেন আমি সেদিন ছোট একটা চিঠি, তোমার দুঃখ বুঝতে চাইছে বা পারছে, এমন কাউকে সমমর্মী মনে করে লিখেছো, পড়ে তোমাকে ছিছি করেছিলাম! আজ আমার ভাবতে লজ্জা হয় সেই কথা মনে করে যে পরিবারের সবার সামনে তোমাকে ওভাবে নির্লজ্জের মতো লজ্জা দিয়েছিলাম, তোমার জগৎ এক কুঁয়ে ধসিয়ে দিয়েছিলাম। ভাবতে লজ্জা হয় তোমার জন্য বাইরের মানুষের সহানুভূতি ছিল, আমার ছিল না। শুধু লজ্জা নয়, নিজের ওপর ঘৃণাও হয়। আমাকে হয়তো অনেকে সান্ত্বনা দেবে এই বলে যে, আমার মানসিকতাও আর সব মেয়ের মতোপুরুষতান্ত্রিক সমাজে থেকে থেকে পুরুষতান্ত্রিক হয়েই গড়ে উঠেছিলো, এ দোষ তাই আমার নয়। দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাবার অভ্যেস নেই আমার। দোষ আমারই। এ কথা সম্পূর্ণই ঠিক যে, আমি আসলেই ভেতরে ভেতরে বিশ্বাস করতাম মেয়েদের নিজের কোনও জীবন থাকতে নেই, তাদের জন্মই হয়েছে স্বামীসেবার জন্য, জন্মই হয়েছে পুরুষের দাসত্ব করার জন্য। পুরুষের অধিকার আছে স্ত্রীর বাইরে যে কারও সঙ্গে মানসিক বা শারীরিক সম্পর্ক করার, কোনও মেয়ের সে অধিকার নেই। ভালো মেয়ে হতে চাইলে একনিষ্ঠ হতে হয়, পতিব্রতা হতে হয়। আমার পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা তোমাকে একা পেয়ে, নিরীহ পেয়ে, শক্তিহীন পেয়ে চরম আঘাত করেছে।

ছোটবেলায় তুমি আমার মাথায় নারকেল তেল দিয়ে চুল আঁচড়ে দিতে। উকুন হলে উকুন বেছে দিতে, জামা কাপড় নিজে সেলাই মেশিনে তৈরি করে দিতে, নোংরা হলে কেচে দিতে। আমার বিছানা, আলনা, আলমারি, কাপড়চোপড়, বইপত্র গুছিয়ে রাখতে। দিন রাতপড়ছি, মাথাটা যেন ভালো কাজ করে, মাথাটা যেন পড়া মনে রাখে, সে কারণে আমার যে একটু ডিম দুধ খাওয়া দরকার, মাছ মাংস খাওয়া দরকার, একটু যে ফল দরকার –এগুলো বাবার কাছে কতভাবে যে বলতে। আমরা তো সবাই বাবার ওপরই নির্ভর ছিলাম, এরকম তোনয় যে তোমার সাধ্য ছিল কিছু কেনার। সাধ্য থাকলে কী না করতে তুমি! তোমার হাতে যখনই কিছু টাকা এসেছে, তখনই তুমি কারও না কারও জন্য কিছু কিনেছে। নিজের জন্য কিছুই কোনওদিন কেনননি। যখন নানি বাড়ি বা তোমার বোনের বাড়ি যেতে, সেই যাওয়াররিক্সাভাড়াটাও, দুটাকা কী তিন টাকা, তোমাকে চেয়ে চেয়ে নিতে হত বাবার কাছ থেকে। বেশির ভাগ সময়ই বাবা দিত না। তুমি তোমার ভাই বোনের কাছ থেকে চাইতে। সংকোচ হত তোমার। কিন্তু উপায়ই বা কী ছিল। তোমার ভাই বোনকে, তোমার বাবা মাকে তুমি অনেক কিছু, সামান্য কিছুহলেও উপহার দিতে চাইতে। কাউকে কিছু দিতে পারার ক্ষমতা ছিল না তোমার। তোমার মতো নিঃস্ব কী জগতে দ্বিতীয় কেউ ছিল! চাকরি করাকালীন আমি জানি না কখনও তোমার হাতে কোনও টাকা দিয়েছি কিনা। যদি দিয়েও থাকি কোনওদিন, টাকাটা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ওই সামান্য কটা টাকা নিয়েই চলে যেতে আমার জন্য আমার ভালো লাগে এমন কিছু কিনে আনতে। মা, আমার আজ মনে হয়, তুমি বোধহয় তোমাকে ভালোবাসতে না। স্বামী সন্তানকে ভালোবাসলে যে নিজেকে ভালোবাসতে হয় না, কে তোমাকে শিখিয়েছিলো!

তোমার একাকীত্বের কথা মনে হলেই মনেপড়ে শীতের সন্ধেগুলোর কথা। ডাল পাতা খড় যোগাড় করে কোনও কোনও রাতে উঠোনে আগুন জ্বালাতে। সেই আগুনে মাঝে মাঝে দেখতাম তুমি হাত পা তাপাতে। জ্বলন্ত কয়লার দুপাশে পা রেখে তুমি দাঁড়াতে। তাপটা নিতে ঊরুতে, ঊরুসন্ধিতে। ওই তাপ কি তোমাকে কোনও সুখ দিত? তোমার মুখটায় লজ্জা, ভয় আর কীসব যেন মিশে থাকতো। শীতে তোমাকে খুব কাবু করতো, নাকি মাঝে মাঝে যৌন তৃষ্ণাও? এত ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিলো তোমার শরীর, একটু আগুন দরকার ছিলো তোমার। মা জাতীয় মানুষদের আবার ওইসব নোংরা জিনিসের কোনও উপদ্রব থাকে এ আমার কখনও মনে হতো না। পুরুষহীন জীবনই তো কাটিয়েছে, প্রায় সবটা জীবনই। যতই তোমাকে দাসী বা ক্রীতদাসীর মতো রাখুক, বাবাকে ভালোবাসতে তুমি। প্রচণ্ড ভালোবাসতে। অতভালোবেসেও বাবার সামান্য ভালোবাসাও

তুমি পেতে পারোনি। বাড়ির বাইরে বাবা যার তার সঙ্গে মিশতে, কোনও বাছবিচার ছিল না। তোমার বেলাতেই ছিল নাক সিটকানো। দশ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল তোমার। পরের বছরেই দাদাকে পেটে ধরেছো। ঋতু দেখেছো কী দেখনি, গর্ভবতী হলে। আমার চেয়ে বড়জোর কুড়ি একুশ বছরের বড় ছিলে বয়সে। তুমি যখন তোমার যৌবন জুড়ে একা, বাবা তখন তার ফর্সা ফর্সা রোগিণীদের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। একাকীত্ব কী, আমি জানি। আমারও তো সারা শরীরে একাকীত্ব। জীবনে আমিও সত্যিকার কোনও প্রেমিক পাইনি। সত্যিকার বলছি এই জন্য যে, ‘তোমাকে ভালোবাসি’ ইত্যাদি বলার লোকের অভাব ছিল না, ও শুধু মুখের বলা, হৃদয়ের নয়। সত্যিকার ভালোবাসা, সে কারওরই ছিল না। তোমার কষ্ট অনুভব করার জন্য বোধহয় জীবন আমাকে এক-জীবন একাকীত্ব উপহার দিয়েছে। –বাবা ইওরোপে আমার কাছে এসেছিলো। বাবাকে ডেনমার্ক, জার্মানি, ইংলন্ডে নিয়ে গেছি। আমাকে দেওয়া বিদেশিদের অনেক সম্মান, সংবর্ধনা দেখেছে বাবা। দাদাও এসেছিলো, দাদা অবশ্য আমার ওপর বিদেশের বড় বড় কোনও অনুষ্ঠানই দেখেনি। কিন্তু দাদাকে আমি স্পেন আর পর্তুগাল বেড়াতে নিয়ে গিয়েছিলাম। ছোটদাও এসেছিল। চাইতাম সবাই আসুক আমার কাছে। দেশে যদি না-ই যেতে পারি এখন, আমার সঙ্গে দেখা যোক আমার স্বজনদের সবাইকে তো আমার কাছে আসতে বলতাম। কিন্তু কখনও তোমাকে আসতে বলিনি। আর যার কথাই মনে আসুক, তোমার কথা আসে না। তোমাকে তো কোনওদিন কোথাও বেড়াতে নিইনি দেশে থাকাকালীনও। বিদেশে কেন আসতে বলবো। তুমি নিজে থেকেই আসতে চেয়েছে অনাহুতের মতো। হঠাৎ করে তুমি জানালে যে তুমি আসছো আমার কাছে। আমি অবাক হয়েছিলাম। তুমি যখন আসবে বললে, সুইডেনের উপলান্ডস ভিয়েসবি, চার নম্বর মুনিনভ্যাগেনে মস্তিষ্কে-মনে একশ ভাগ সুইডিশ ভদ্রলোক সুয়েনসনের শহরতলির ঘোর নির্জন বাড়ি আমার ঠিকানা। এমনিতে সুইডেন দেশটাই ফাঁকা, ওই উপলান্ডস ভিয়েসবি তারও চেয়ে বেশি ফাঁকা। পরের বাড়িতে উঠতে রুচিতে আমার চিরকালই বাধে। নিজের দেশে নিজের বাড়ি রেখে পরের দেশে পরের বাড়িতে থাকা, নিজের দেশে নিজের গাড়ি রেখে পরের দেশে পরের গাড়ি চড়া যে খুব স্বস্তির নয়, সুখের নয়, তা আমার মতো আর কে জানে মা। সুয়েনসন মানুষটা কেমন, মানুষটা কী, তার কতই আর জেনেছি। দেখা হয়েছে সাকুল্যে চারবার। সুয়েনসনের বাড়িতে উঠেছিলাম জার্মানি থেকে ফিরে এসে। বিদেশে কোথাও চাকরি করি না। ইওরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে বের হওয়া বইয়ের রয়্যালটি আর কিছু পুরস্কার পাওয়ার টাকা আমার সম্বল। বসে খেলে রাজার ধনও ফুরিয়ে যায়, আমার ধনও ফুরোবে, এই আশংকা আমার ভেতর বাসা বেঁধেছে। তোমাকে তো জীবনের কোনও গল্পই বলিনি মা। অনেককে বলেছি, তোমাকে বলার কোনও প্রয়োজন বোধ করিনি। কখনও যদি ফোনে তোমার সঙ্গে কথা বলেছি, তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে চেঁচিয়ে তোমাকে কাঁদিয়েছি। তুমি কেঁদেছো। শরাফ মামা আমার বাড়িতে কেন এল, তুমি কেন ঢুকতে দিলে? আমার পুরোনো দুটো সালোয়ার কামিজ, গায়ে আমার আঁটে না, দিয়েছিলে বড় মামার দুই মেয়ে শিপ্রা আর শুভ্রাকে। বড়মামার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়, মেয়েদুটো অভাবে থাকে, তাই। আমি তোমাকে ধমকে বললাম, ‘আমার অনুমতি ছাড়া কেন তুমি আমার জিনিস অন্যকে দেবে? ’ ‘তুমি তো অনেক বছর ধরে ওগুলো আর পরো না মা।‘ তুমি খুব মোলায়েম স্বরে বলেছো। তোমার মোলায়েম স্বর আমাকে সামান্যও মোলায়েম করতে পারেনি। আমি চিৎকার করি, আমি পরি কী নাপরি সে আমি বুঝবোনাপরি, ওগুলো থাকবে, যেভাবে ছিল। আমি যখন ফিরবো দেশে, তখন দেখবো আমার পুরোনো ছোট হয়ে যাওয়া কাপড়গুলোও। যেভাবে যা রেখে এসেছি, সেভাবেই যেন সব থাকে। তুমি বললে, ‘আমি ভেবেছিলাম গরিব দুঃখীকে সাহায্য করলে বোধহয় তোমার ভালো লাগবে। মনে আছে কী রকম রুক্ষ কণ্ঠে তোমাকে বলেছিলাম, কোনও গরিব দুঃখীকে আমার দেওয়ার দরকার নেই। তুমি টাকা দিয়ে বরং ওদের কাপড় চোপড় কিনে দাও। আমার স্মৃতি তুমি নষ্ট করো না। তুমি ওদের জামা কাপড় যা দান করেছিলে, ফেরত নিয়ে এসেছিলে মা। সম্ভবত ওদের গা থেকে খুলে নিয়ে এসেছিলে। এখন যখন ভাবি তোমার কেমন লেগেছিল কাজটা করতে, বুক ফেটে যায়। মাথা তোমার কতটুকু নত হয়েছিলো বড়মামার সামনে, শিপ্রা আর শুভ্রার সামনে, বুঝি। তুমি তো গুছিয়ে রাখতে যা আমি রেখে এসেছিলাম সব, নিজের শাড়ি নেই, তবু আমার বড় কাঠের আলমারিগুলোর পাঁচশ শাড়ির একটিতেও তুমি হাত দাওনি। যেন পোকা না কাটে, যেন নষ্ট না হয়ে যায়, বারান্দায় শীতলপাটি বিছিয়ে রোদে দিতে শাড়িগুলো, রোদে দিয়ে পাশে বসে থাকতে। দেখতে শাড়িগুলো, যেন আমাকে দেখতে। স্পর্শ করতে, যেন আমাকে স্পর্শ করতে। তোমার চোখের জল টুপ টুপ করে পড়তো, বার বার মুছে নিতে হত জল তোমার, যেন শাড়ির ওপর পড়ে শাড়ি নষ্ট না হয়। এভাবেই তো যত্ন করেছিলে আমার সবকটা জিনিস। আঁচল দিয়ে মুছে মুছে রাখতে আমার পড়ার টেবিল, আমার বই, কাগজপত্র। ফ্রেমে বাঁধানো আমার ছবিগুলো। মুছতে আর কাঁদতে। কবে আমি ফিরে আসতে পারবো, জিজ্ঞেস করতে সবাইকে। কেউ তোমাকে কোনও উত্তর দিত না। কেউ বলতো, খালেদা গিয়ে হাসিনা এলেই ফিরতে পারবো। কেউ বলতে, বিশেষ করে ছোটদা, জীবনেও আমি ফিরতেপারবো না। শুনে তুমি হাউমাউ করে কাঁদতে। একবার ব্যারিস্টার কামাল হোসেনের কাছে যেতে বলতে। একবার সারা হোসেনকে আমাকে যেন দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করে বলতে বলতে। কেউ কারও কাছে যেত না। তুমি দাদাকে অনুরোধ করতে, ছোটদাকে করতে। চোখের জল ফেলে ফেলে করতে। কে শোনে তোমার কথা! তুমি তো অশিক্ষিত। তুমি যে অশিক্ষিত, এ কথা বাবা আমাদের ছোটবেলা থেকেই বোঝাতো। আমরাও মাথার খুলি খুলে ঢুকিয়ে নিতাম বাবার দেওয়া জ্ঞান। তুমি নিজেও অবশ্য বলতে তুমি ইস্কুল পার হতে পারোনি, কলেজেও পড়া সম্ভব হয়নি, তাই অনেক কিছু জানো না বা বোঝো না। আমার বিষয়ে বাবা বা দাদারা কেউ যদি কোনও কথা বলতো, কোনও গুরুত্বপূর্ণ কথা, তোমাকে শুনতে দিত না, তুমি বুঝবে না বলে। তুমি জানতে চাইলে বাবা চোখ ইশারা করে দাদাদের মুখ বন্ধ রাখতো। এর মানে হচ্ছে, ও কিছু বুঝবে না, অকারণে ওকে বলে কী লাভ, বরং ও আবার মৌলবাদীদের কাছে খবর পৌঁছে দিতে পারে। হ্যাঁ এই দোষ তোমাকে দেওয়া হত, যে, তুমি বোধহয় কাউকে জানিয়ে দেবে আমার সম্পর্কে কোনও তথ্য। কারণ কী? কারণ তুমি বোকা। তুমি মূর্খ। তোমাকে কোনওদিনই তাই আমার কোনও ঠিকানা বা ফোন নম্বর দেয়নি ওরা। আরও না দেওয়ার কারণ তুমি আমার যোগাযোগের ঠিকানা বা নম্বর তোমার ভাইবোনদের দেবে, ওরা আমাকে ফোন করে নিজেদের দুঃখ দুর্দশার কাহিনী বলে আমার কাছে টাকা চাইবে। একটা জিনিসই ওরা খুব ভালো বুঝতো, সে হলো টাকা। দেশে আমার টাকা ছিল, বিদেশে আমার আরও টাকা, টাকার ওপর যেন গড়াগড়ি খাচ্ছি। এসব সত্য অনেক পরে জেনেছি মা। ফোনে তাই আমার কাছেও তুমি জানতে চাওনি আমি কোথায় থাকি, আমার ফোন নম্বর বা ফ্যাক্স নম্বর কী। কারণ, ওসব চাইতে তোমার ভয় হত। ভয় হত, কারণ আমি যদি তোমাকে সন্দেহ করি। ওদিকে আমি ভাবতাম, কেউ তো একটা চিঠিও আমাকে লেখে না। মা হয়ে তুমিও তো লেখো না। চোখের জলে ভিজিয়ে কত কত চিঠি তুমি আমাকে লিখে তোশকের তলায় রেখে দিয়েছো মা। পরে ওসব চিঠি আমি পেয়েছি, পেয়েছি যে, তুমি জানতেও পারোনি। জানবে কী করে, তুমি তো ছিলে না যে জানবে।

দেশ ছেড়ে চলে আসার দিন থেকে চার চারটে বছর তুমি আমার পথের দিকে চেয়ে কাটিয়েছিলে। উড়োজাহাজের শব্দ শুনে দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতে। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবতে হয়তো আমি এসেছি। তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ তোমার ভিজে উঠতো! কত কেউ দেশে ফেরে, কেবল আমি ফিরি না। বাড়ির দরজায় আর সবাই কড়া নাড়ে, কেবল আমিই নাড়ি না। তোমার শরীরটাও, তুমি টের পাচ্ছো, যে, ভালো যাচ্ছে না। কেন ভালো যাচ্ছে না? জিজ্ঞেস করলে ফোনে তুমি উত্তর দিতে না। আসলে তুমি জানো না মা, আমি ভাবতাম তুমি মিথ্যে বলছে। ওই যে সেই কত আগে থেকেই বলতে যে তোমার কী নাকি একটা অসুখ, রক্ত যাওয়ার অসুখ আছে, নাম পাইলস। বাবা বলতো ও কিছু না। আমরাও বলতাম ও কিছুনা। আমি তো ও কিছুনাতে থেমে থাকিনি বলতাম, ‘শুধু শুধু কমপ্লেইন করবে না তো! তোমার শরীর খুবই ভালো আছে, চমৎকার আছে। আমি জানিনা কেন বিশ্বাস করতাম সবাইকে বিরক্ত করতেই শুধু অভিযোগ নিয়ে আসো, এখানে ব্যথা, ওখানে কষ্ট। অথচ বাবার সামান্য অসুখেই আমি বিচলিত বোধ করতাম। জানি তার রক্তচাপ বেশি, একবার ছোটখাটো একটা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশান হয়েছে শুনেছি। জানি তার ডায়বেটিস। জানি যে কোনও সময় বাবার দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাই বাবা নিয়েই আমার রাজ্যির দুর্ভাবনা, দুশ্চিন্তা। মা, তুমি যখনই তোমার অসুখের কথা বলতে, আমি বলতাম, ‘অসুখ যদি থাকে সে বাবার, তোমার নয়। তখন হার্ট মানে কী, হার্টের অসুখ মানে কী, এনলার্জড় হার্ট মানে কী, মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশান মানে কী তা বেশ জোরে সোরেই তোমাকে বুঝিয়ে দিতাম। তুমি হাঁ হয়ে শুনতে। এরপর আর কষ্ট পেলেও কষ্টের কথা বলতে না পাছেমিছে অভিযোগ মনে করে ধমক দিই। হ্যাঁ বরাবরই আমার উদ্বেগ বাবাকে নিয়ে। বাবার সেবা যত্ন ঠিকমতো হচ্ছেনা। সারাদিন চেম্বারে বসে রোগী দেখছে, বাড়ি বাড়ি রোগী দেখতে যাচ্ছে, বাজারে যাচ্ছে বাবা কখন খাবে, কী খাবে, কখন বিশ্রাম নেবে, কতক্ষণ নেবে, বাবার দেখাশোনা কে করবে ময়মনসিংহে! দুশ্চিন্তার মুঠোর ভেতর বন্দি হয়ে ছটফট করি। বাবাকে ফোন করে বাবার কথা জিজ্ঞেস করি, তোমাকে ফোন করে ওই বাবার কথাই জিজ্ঞেস করি। না গো মা, তুমি কেমন আছো, এ কথা জিজ্ঞেস করি না। করি না কারণ, জানি, আগেও যেমন জানতাম, এখনও জানি যে, ভালো আছো তুমি। বাবা ভালো নেই বলে আমার উৎকণ্ঠা এবং উদ্বেগ দিন দিন এমনই বাড়ে যে প্রবল ভাবনায় থাকি বাবা যে প্রতিদিন অবকাশ থেকে নতুন বাজারে চেম্বারে যায়, রাতে চেম্বার থেকে বাড়ি ফেরে, গ্রামের জমি দেখতে মাঝে মাঝে নান্দাইল যায়, সব যাওয়া আসা যেন পায়ে হেঁটে, রিক্সায়, বাসে না হয়ে গাড়িতে হয়। আমার নিজের গাড়ি পড়ে আছে ঢাকায়। ছোটদা সেটা ব্যবহার করে। ছোটদাকে অনেক বলেছি গাড়িটা যেন বাবাকে ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়। যতবারই ছোটদাকে গাড়ি পাঠানোর কথা বলি, ছোটদা বলে, বাবা গাড়ি নেবে না। নেবে না আবার কী, গাড়ি তুমি ময়মনসিংহে চালিয়ে নিয়ে গিয়ে বাড়িতে রেখে ট্রেনে করে ঢাকা চলে এসো। ছোটদা অবশ্য বলে যে হ্যাঁ ঠিক আছে তাই করবো। সম্ভবত দূরের একটা গর্দভকে শান্ত করার জন্যই বলে। এক দুই করে মাস যেতে থাকে, খবর নিয়ে দেখি ছোটদা বাবাকে গাড়ি দেয়নি। আমার নিজের গাড়ির ওপর আমার কোনও অধিকার নেই, অধিকার ছোটদার। গাড়ি সে কাউকে দেবে না, কারণ গাড়ি সে ব্যবহার করে। ছোটদা একবার আমাকে গাড়ি কিনে দেবে বলে টাকা নিয়ে গিয়েছিল, আর ফেরত দেয়নি। অনেকদিন সেই টাকার জন্য অপেক্ষা করে পরে নিজেই একটি গাড়ি কিনি, ভেতরে দামি সিট কভার, মেঝেয় ম্যাট, পারফিউম, জানালার রোদপর্দা ইত্যাদি কত কিছু দিয়ে গাড়িটি সাজানোর পরপরই আমাকে দেশ ছাড়তে হলো। গাড়িটি ব্যবহার করতে শুরু করলো একা ছোটদা। তুমি যে ঢাকায় বেরোতে, তোমাকেও তো কোনওদিন আমার গাড়ি ব্যবহার করতে দেয়নি। তুমি বাজারে যেতে, বড় মামার বাড়ি যেতে, ঝুনুখালার বাড়ি যেতে, সবখানেই রিক্সায় যেতে। আমার গাড়ির ওপর তোমারও কোনও অধিকার ছিল না, কোনও অধিকার দাবি করার কথাও কোনওদিন কল্পনাও করোনি। ছোটদা তার বান্ধবীদের নিয়ে গাড়ি নিয়ে ঘুরবে, যেন সেটাই নিয়ম ছিল। ওই নিয়মের বাইরে অন্য কোনও কিছু যে হতে পারে, খুব স্বাভাবিক কিছু, তা ভুলেই গিয়েছিলে বা ছোটা তোমাকে ভুলিয়ে দিয়েছিলো। বাবা ঢাকায় এলেও তাই হতো। বাসে ঢাকায় আসতো, ঢাকায় যদি কাজ থাকতো কোথাও, বিক্সায় যেত। আর দেশ থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে বসে এক গর্দভ বাবার রিক্সায় চলার বিরুদ্ধে চেঁচাতো। আমার চেঁচানোর কোনও মূল্য ছোটদার কাছে কখনও ছিল না। শেষপর্যন্ত আমি সিদ্ধান্ত নিই যে বাবাকে গাড়ি কেনার জন্য টাকাঁপাঠাবো। বাবা বলে দিল কোনও টাকা পাঠানোর দরকার নেই। কিন্তু বললেই তো হবে না, আমাকে তো দুশ্চিন্তামুক্ত হতে হবে, বাবা কৃপণ বলে আমি তো কৃপণনই। আমি ভুল ভেবেছিলাম, ভেবেছিলাম বাবা কৃপণ বলে নিজের টাকা খরচ করে না, সম্ভবত অন্যের টাকা খরচ করবে। কিন্তু যে নিজের টাকা খরচ করে না, সে যে অন্যেরটাও করে না, তা আমার বোঝা উচিত ছিল। বাবা কিছুতেই তার ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নম্বর আমাকে জানাবে না। আগেও তো জানায়নি। তখন তোমার অ্যাকাউন্টে আমি বাবার জন্য টাকা পাঠিয়েছিলাম। নিজের অ্যাকাউন্ট নম্বর আমাকে জানাবেই না, শেষ পর্যন্ত দাদার অ্যাকাউন্ট নম্বর নিয়ে ওখানে বাবার গাড়ি কেনার জন্য টাকা পাঠালাম। সাড়ে চার লাখ বা পাঁচ লাখ টাকা। দাদা বললো রেজিস্ট্রেশনের জন্য তো টাকা লাগবে। তাও পাঠালাম। দাদাকে পই পই করে বলে দিই যেন বাবার নামে গাড়ির রেজিস্ট্রেশন হয়। গাড়ি কেনা হচ্ছে কিনা, কবে কেনা হবে, এসব আমি প্রতিদিনই বাবা আর দাদাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করি। তাগাদা দিই তাড়াতাড়ি করার জন্য। সব কিছুর কারণ ছিল, বাবা যেন ভেবে মনে সুখ পায় যে গাড়িটা তার, গাড়িটা তাকে তার সুযোগ্য কন্যা উপহার দিয়েছে। গাড়িটা যেন বাবা তার নিজের চলাফেরার জন্য ব্যবহার করে। গাড়ি কেনা হল, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন হল, সব আমিই ফোন করে করে খবর নিয়েছি। এরকম নয় যে দাদা বা বাবা নিজে থেকে আমাকেকিছু জানিয়েছে। গাড়ির রেজিস্ট্রেশন বাবার নামে হয়েছে তো, বারবার জিজ্ঞেস করি। দাদা বললো বাবার নামেই হয়েছে। গাড়ি কেনার পরও আমার প্রতিদিনের ফোন করায় কোনও ছেদ পড়ে না। কী হল, বাবা গাড়ি চড়ছে তো! বাবা সুন্দর বলে দিল, চড়ছি। দাদাকে জিজ্ঞেস করি, দাদা বললো, ড্রাইভার এখনও রাখা হয়নি। ড্রাইভার রাখা হলে আবারও খবর নিই। তোমার কাছে ফোন করে জানতে চাই বাবা গাড়ি চড়ছে কি না। তুমি বললে, ”গাড়ি তো শুধু নোমান চড়ে, আর নোমানের বউ ছেলেরা চড়ে, তোর বাবা তো চড়ে না। রেগে আগুন হই আমি। ওই আগুনে আমি একা একাই পুড়ি। আমি টাকা পাঠাতে পারি, কিন্তু টাকা দিয়ে যা করা হবে, তা তো আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। সে শক্তি আমার নেই। আমার শুধু টাকার শক্তি। আমার শুধু যার আছে, তাকে দেওয়ার উৎসাহ।

তুমি ঢাকা ময়মনসিংহ দৌড়োদৌড়ি করো, বাসে করো, তুমি যে ময়মনসিংহে গিয়ে এর বাড়ি ওর বাড়ি যাও, রিক্সায় যাও। কোনওদিন গাড়ি চড়োনি। না মা, তুমি চড়োনি। তুমি তো ভালো আছো। তুমি চড়বে কেন। কিন্তু ভালো থাকা তুমি একদিন শুনি আমাকে দেখতে সুইডেনে আসবে। শরীরটা নাকি ভালো নেই। শরীর ভালো না থাকার কথা বলা তোমার নতুন নয়। ও আমাকে মোটেও উদ্বিগ্ন করে না। ছোটদাকে ঘন ঘন ফোন করি, বাবাকে আসতে বলো। ছোটদা জানালো, বাবা আসতে চাইছে না, মা আসবে। আমার সাফ কথা, মা যখন আসতে চাইছে আসুক, সবচেয়ে ভালো হয় বাবা এলে। কারণ বাবা তো অসুস্থ। এ সময় তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত বিদেশ থেকেপরীক্ষা করিয়ে নেবো, অসুখ বিসুখ থাকলে বিদেশেই চিকিৎসাটা হবে। বাবা আসবে না, কারণ তার কাজের চাপ। অবসরপ্রাপ্ত ডাক্তার, তার কী এমন কাজ যে মেয়েকে দেখতে আসতে পারবে না! খুব মন খারাপ হয়ে যায়। বাবাকেই বেশি চাই দেখতে। তোমার আসায় না আসায়, সত্যি বলছি, কিছু যায় আসে না আমার।

বাবাকে রাজি করাতে না পেরে ছোটদা আমাকে জানিয়ে দিল তুমি একা আসছে। বিমানে চাকরি করার কারণে নিজের বাবা মার জন্য ছোট দা ফ্রি টিকিট পায়, সেই টিকিট ব্যবহার করে ব্রাসেলস অবধি তোমাকে আনতে তার কোনও অসুবিধে নেই। ব্রাসেলস থেকে তোমাকে তুলে নেওয়ার দায়িত্ব আমার। চার বছর পর তোমাকে দেখার উত্তেজনা ছিল। বাড়ির কারও সঙ্গে দেখা। তুমি না হয়ে যে কেউ হলেই উত্তেজনাটা থাকতো বোধহয়। ওরকম নির্জন নির্বাসনে বছরের পর বছর একা পড়ে থাকলে আত্মীয় বা বন্ধু কাউকে পাওয়ার অর্থ যে কী তোমাকে বোঝাতে পারবো না। আত্মীয় বন্ধুর কথা ছেড়ে দাও। চেনা কেউ, চেনা না হলেও দেশের কেউ, বাংলা ভাষায় কথা বলে কেউ, তাকেই কত আপন মনে হয়। শুধু তাই নয়, ভারত, পাকিস্তান, এমনকী শ্রীলঙ্কার লোকদেরও আপন মনে হয়। বিদেশি কোনও লোক বাংলাদেশ বা ভারত ঘুরেছে শুনলে তাকেও মনে হয় ঘরের লোক। ব্রাসেলস বিমান বন্দরে আমাকে নিতে এসেছিল ছোটদা। সে যে কী আনন্দ আমার ছোটদাকে দেখে। ছোটদাকে তো চারবছরে আরও কয়েকবার দেখেছি। একবার সেই আমস্টারডাম গিয়ে। ওকে স্টকহোমেও নিয়ে গিয়েছিলাম। অক্সফোর্ডে এসেছিল বাবাকে আমার কাছে তুলে দিতে। এরপর একবার নিয়ে এসেছিলাম বার্লিনে। তারপরও ছোটদাকে দেখে খুশিতে জড়িয়ে ধরি। মাকে নিয়ে এলে না কেন এয়ারপোর্টে? ছোটদা বললো, মা শীতে কাঁপছে, তাই বার করিনি বাইরে। শহর ছাড়িয়ে একটি মাঝারি গোছের হোটেলে বিমানের ক্রুরা থাকে। সেই হোটেল নভোটেলের নিচতলার একটি ঘরে তখন তুমি। তোমাকে দেখে আমি চমকে উঠি প্রথম। এ কাকে দেখছি! যে মাকে শেষ দেখেছিলাম, এ তো সে মা নয়। তোমাকে অমন চেহারায় এর আগে দেখিনি কোনওদিন। যতই বলছি এ কেমন শরীর হয়েছে তোমার! তুমি বলছো, ডায়বেটিস। ডায়বেটিসে জানি শরীর শুকিয়ে যায়। কিন্তু তোমাকে কি এতটাই ডায়বেটিস ধরেছে! ছোটদা বললো তুমি নাকি ইনসুলিন নাও, তাও আবার নিজে নিজে।

উফ, এর মতো মর্মান্তিক আর কিছু আছে কী! তোমার সঙ্গে বাংলাদেশের শেষ কটা মাস ভাববাচ্যে কথা বলতাম। এতগুলো বছর ফোনেও ভাববাচ্যে চালিয়েছি। যখন দেখা হল বিদেশ বিভুইএ, তখনও ভাববাচ্যে। নিজের মা, তার সঙ্গে ভাববাচ্যে কথা! সারা জীবন যদি নিজের বাবার সঙ্গে ভাববাচ্যে কথা বলি, নয় কেন! শুধু কি বাবার সঙ্গেই! নানিবাড়ির প্রায় সবার সঙ্গেই তো। আমার মনে হয় এত লোকের সঙ্গে ভাববাচ্যে কথা চালানো আমি ছাড়া জগতের আর কেউ পারেনি। কী করে যেপারি, ভাবলে বিস্ময় জাগে। কোনও এক সময় কিছু একটা করেছিলে, বকেছিলে বা কিছু, যে কারণে তোমাকে তুমি বলে সম্বোধন করা বন্ধ করেছি। তোমাকে কতগুলো বছর দেখিনি, কত দূরের দেশে একলা পড়ে আছি, তারপরও তোমাকে আমি ক্ষমা করি না। জানিনা তোমার কোন ভুলের জন্য দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে নির্বাসিত আমি তোমাকে ক্ষমা করতে পারিনা। তুমি শুধু আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদো কাঁদোই। আমি বলতে থাকি, কী ব্যাপার শরীরের এই অবস্থা কেন? না, তুমি তোমার শরীর নিয়ে একটুও ভাবছো না। ভাবছো আমাকে নিয়ে। আমি ততদিনে ফুলে ঢোল, সুতরাং তোমার বলার কোনও উপায় নেই যে আমি ঠিকমতো খাচ্ছিনা। শরীরের দিকে নজর যেন আমি দিই, বলছে না। আমার মুখে পিঠে বুকে হাতে পায়ে তুমি হাত বুলিয়ে দিচ্ছ। কতদিন আমাকে না ছুঁতে পারার কষ্ট তোমার আঙুলে, আমাকে দীর্ঘ কাল না দেখতে পারার কান্না তোমার চোখে। আমার চোখে জল ছিল না। আমি হাসছিলাম। অনেকদিন পর ফ্যামিলি গেট টুগেদারের যে আনন্দ, সেই আনন্দ উথলে উঠছিলো। যথারীতি বাবার অসুখ নিয়ে আমার দুশ্চিন্তা এবং তার আরোগ্য নিয়ে তার যে উদাসীনতা সে নিয়েও আমার শেষ না হওয়া উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেতে থাকে আমার কথাবার্তায়। কথা বেশি বলছিলাম ছোটদার সঙ্গে। ছোটদার সঙ্গে আমার ভাববাচ্য চলে না। বলছিলাম দেশের কথা, দশের কথা। ওসব তো তোমার সঙ্গে আলোচনার কথা নয়। ছোটদাই বললো তুমি উমরাহ করে এসেছে। উমরাহ। ছি ছি। এ নিয়ে চললো আমার ছিছিককার। কেন উমরাহ করতে গেলে! এ কোনও কাজের কাজ! ছোটদার ফ্রি টিকিট ছিল, তাই যেতে পেরেছো তুমি। তোমার স্বপ্ন ছিল কোনওদিন আরব দেশে যাবে, সে স্বপ্ন বা শখ মিটেছে। আমি মনে করিয়ে দিয়েছি তোমার আমিরুল্লাহ পীরের কথা, যে বলেছিল তোমাদের নাকি আল্লাহর অলৌকিক বাহনে করে উড়িয়ে আরব দেশে নিয়ে যাবে। ওভাবে উড়ে যে যাওয়া তোমার হল না, মানুষের তৈরি উড়োজাহাজে যেতে হল–তাই বলে বলে আমি হাসছিলাম। শ্লেষের হাসি। তুমি কেবল আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলে আর চোখের জল ফেলছিলে। ফেলছিলে আমাকে দেখার আনন্দে। আর আমার নাস্তিকতার প্রমাণ আমি দিচ্ছিলাম তোমাকে আঘাত করে করে। নাস্তিকরা কি খুব নিষ্ঠুর হয়? হয় বোধহয়। নাকি আমিই নিষ্ঠুর! জগতে এক আমিই নিষ্ঠুর। যে মা আমার সঙ্গে জন্মের পর থেকে যতদিন দেশে ছিলাম, পাশে ছিল, তার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে চার চারটে বছর পার হওয়ার পর যখন তাকে প্রথম দেখি তার ধর্মবিশ্বাস নিয়ে ব্যঙ্গ করছি আমি, তার অন্ধ বিশ্বাসের কারণে সে যেন নুয়ে থাকে, লজ্জা পায়, তার চেষ্টা আমি করছি। আমি থামছিনা। আমি তাকে আঘাত করছি জেনেও আঘাত করছি। তোমার কষ্ট দেখে আমার অভ্যেস আছে। তোমার ধর্মবিশ্বাস নিয়ে চিরকালই আমি কটুক্তি করেছি। এ নতুন কিছু নয়। আমি যে সেই আমিই আছি, তা বোঝানোও হয়তো গেল কিছু। দেশ থেকে মৌলবাদীদের উৎপাতে নির্বাসন হলেও আমি যে আমার আদর্শ থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হইনি তাও বোঝানো গেল। আর, এও আমি বোঝাতে চাইলাম যে বিদেশের সংস্কৃতিতে বেশ অভ্যস্ত হয়ে গেছি আমি, জানি অনেক, বুঝি অনেক। মা দেশি লোক। বিদেশে প্রথম। আরব দেশকে আর বিদেশ বলি না। সাদাদের ইওরোপ আমেরিকাকেই সত্যিকার বিদেশ বলি। মাকে আমার শেখাবার অনেক কিছু আছে। শেখাতে শুরু করে দিই তড়িঘড়ি। শীতকাল। শীতকালে ইওরোপে দেখার কিছু নেই। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় জমে যেতে হবে। সবচেয়ে ভালো হল সামার। আমি গরমকাল কে আর গরমকাল বা গ্রীষ্মকাল বলি না। সামার বলি। তোমাকে গরম কাপড় পরতে হবে। স্যান্ডেল চলবে না, জুতোপরতে হবে। খুব পাতলা মোজাপরলে চলবে না। উলেন মোজা চাই। ইনার চাই, থারমাল চাই। মাথায় টুপি চাই। তুমি বিস্ময় চোখে দেখতে লাগলে আমাকে। কী দেখছিলে? আমি যে বিদেশের কত কিছু শিখে গেছি? আমি যে অনেক বিদেশি হয়ে গেছি, দেখছিলে? আমি তোপরে এসেছিলাম ওভারকোট, মাথায় টুপি, পায়ে ছেলেদের জুতোর মতো বুটজুতো। আমি বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম, ছেলেদের মতো দেখতে তোমার মনে হতে পারে, কারণ দেশে তো মেয়েরা এরকম জুতো পরে না, কিন্তু এ জুতো মেয়েদের জুতো। তুমি বুঝলে; কিন্তু জুতোয়, জামায়, কোটে, ওভারকোটে, টুপিতে তোমার কোনও কৌতূহল নেই। কৌতূহল আমাকে নিয়ে। কী করছি, কী খাচ্ছি, মন কেমন, শরীর কেমন, কবে দেশে ফিরতে পারবো, দেশে ফিরতে যা যা করতে হয় তা কি করছি? যদি না করি, কেন করছিনা? তোমার কৌতূহল মেটাতে আমার মোটেও ইচ্ছে হয় না। আমি তোমার রাজনৈতিক নির্বুদ্ধিতা নিয়ে আবারও বিদ্রূপ করি। কোনও চেষ্টা করলেও যে কোনও লাভ হবে না, দেশে যে আমাকে ফিরতে দেওয়া হবে না, এ যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, যে তুমি বোঝো না, তা যে কেবল আমি বুঝি আর ছোটদা বোঝে, সেটাই তোমাকে বোঝাই। আমাকে দেশে ঢুকতে দিলে সে যে সরকারই হোক, ধর্মবাদীদের ভোট পাবে না বলে ভয়ে আমাকে ঢুকতে দেয় না। তুমি কী বুঝলে কতটুকু বুঝলে কিছুই বলল না, শুধু বলো, যেন চেষ্টা করি দেশে ফেরার। যেন ফিরি। একটা মানুষ কী করে চেষ্টা করতে পারে, কী করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্তকে টলিয়ে ফেলতে পারে, মৌলবাদে ছেয়ে যাচ্ছে দেশ, রাজনীতিবিদরা মৌলবাদেরপক্ষে যাবে, নাকিআমার পক্ষে গিয়ে বিপদ ডেকে আনবে নিজেদের, এসব জিজ্ঞেস করি তোমাকে। তোমার পক্ষে তো এসবের উত্তর দেওয়া সম্ভব হয় না, শুধু বলো, দেশে ফেরো দেশে ফেরো। একসময় বলল, তোমাকে না নিয়ে আমি দেশে ফিরবো না। তোমার বালখিল্য কথা আবারও হাস্যরসের যোগান দেয়। তুমি জগতের দুর্বলতম মানুষ, তুমি কিনা আমাকে দেশে ফিরিয়ে নেবে! না হেসে কী করবো। তোমার মুখে হাসি নেই। সারা মুখে আমাকে দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংকল্প, একই সঙ্গে কষ্টে ডুবে থাকা চোখ। তোমার ভেতর এমন দৃঢ়তা আগে কখনও দেখেছি বলে মনে করতেপারি না। তোমার ওজন অস্বাভাবিক কমে যাওয়া, চিরকালের দুর্বল মনের মানুষটির সবল হওয়া দুটোই আমার কাছে নতুন। তুমি ঠিক আগের তুমিনও। সামান্য হলেও কিছুপরিবর্তন তোমার মধ্যে ঘটেছে। কিন্তু তোমার আর কত, সবচেয়ে বেশি পরিবর্তন যে ঘটেছে আমার মধ্যে। আমি শীত গ্রীষ্ম জানি, বিদেশের পথে একা একা হাঁটতে জানি। কোন দোকানে কী পাওয়া যায়, কী জিনিস দিয়ে কী করতে হয় জানি। এমনকী এক দেশ থেকে আরেক দেশে চলে যেতে জানি। এসব কিছুই তুমি জানো না মা। তুমি দেশে পড়ে থাকা আটপৌরে শাড়ি পরা অবুঝ অশিক্ষিত মা। বিদেশে আমাকে নিয়ে কী সব কাণ্ড হয়েছে তোমাকে বলি। কত কাণ্ড। বাবা কি কিছু গিয়ে বলেছে? না বলেনি। আমি যে ছোটদার হাতে এত এত ভিডিও ক্যাসেট পাঠিয়ে দিয়েছি, এত এত বই, অ্যালবাম! না তুমি কিছু দেখনি।

তোমাকে দেখতে দেওয়া হয়নি। সব নাকি গুছিয়ে রাখা হয়েছে, কেউ যেন স্পর্শ না করে তার ব্যবস্থা হয়েছে। তুমি দেখনি! পড়োনি। বোঝোনি। আমাকে নিয়ে বিশ্ব তোলপাড়, এ নিয়ে বাবা আর দাদার প্রচণ্ড আগ্রহ, তোমার নেই। তুমি চাও ঘরের মেয়েকে ঘরে ফেরাতে, তুমি চাও সে নিজের দেশে, নিজের বাড়িতে ফিরুক, আত্মীয় স্বজনের মধ্যে থাকুক, নিজের ভাষায় কথা বলুক, ভাত মাছ খাক, তুমি চাও আগের মতো। কিন্তু কিছু যে আগের মতো নেই তা বুঝতে চাও না। তোমার একটাই অনুরোধ, আমি যেন ঘোষণা করে দিই, ইসলামের বিরুদ্ধে আমি কিছু আর লিখবো না, সুতরাং আমাকে যেন দেশে ফিরতে দেওয়া হয়। তোমাকে যত বলি, যে, এটা আমি লিখবো না, তাহলে আমি আর আমি থাকি না। তুমি বোঝো না। তুমি এমনকী বলো, যেন ক্ষমা চাই। আমি বলে দিই কোনও দোষ তো আমি করিনি। তোমার তারপরও ইচ্ছে, আমাকে না নিয়ে দেশে তুমি একা একা ফিরবে না।

ছোটদাদের নোভোটেল হোটেলে ছোটদাই শুধু খেতে পারবে নাস্তা। তাতে কী! আমার কি টাকা ছিল না তোমার আর আমার জন্য নাস্তা কিনে আনা? না একে ফাঁকি দেওয়ার একটা ব্যবস্থা ছোটদা বার করলো। আমাকে নিয়ে নাস্তা খেতে গেল হোটলের ব্রেকফাস্ট রুমে, আর তোমার জন্য পকেটে করে দু চাক রুটি আর একটা সেদ্ধ ডিম নিয়ে এল। তুমি হলে বাড়তি, বুঝলে মা, তোমাকেও আমরা বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম তুমি হলে বাড়তি একটা মানুষ যার নাস্তার টেবিলে বসে আর সবার মতো কোলের ওপর ন্যাপকিন রেখে চামচে করে ওটমিল, বা ব্রেডের ওপর বাটার আর চিজ বা জ্যাম লাগিয়ে খাওয়ার উপায় নেই। কেউ লুকিয়ে কিছু খাবার দিলে তোমার পক্ষে খাওয়া সম্ভব হতো না। তুমি অপরাধবোধে ভুগতে। তুমিও ভয়ে লুকিয়ে রাখতে ওই দু চাকু রুটি বা ডিম বা কলা। অবৈধ জিনিস তুমি কোনওদিন খাওনি। এখনই বা খাবে কেন? কিন্তু উপায় না দেখে ক্ষিধেয় তুমি কামড় দিয়েছো ওসবে। স্বস্তি ছিল কি ওই কামড়ে? ছিল না মা। বিদেশে ওই ছিল তোমার নাস্তা। আর আমি? তোমাকে ঝকঝকে জগৎ দেখাবো বলে নিয়ে গিয়েছি ব্রাসেলস শহরে। গ্র্যান্ড প্লাজার সামনে দাঁড় করিয়েছি, দূর দূরপথ তোমাকে হাঁটিয়েছি। হাঁটতে তোমার কষ্ট হতো। তুমি পিছিয়ে পড়লে তিরস্কার করেছি। কেন দ্রুত হাঁটতে পারছে না? তুমি তোপঙ্গু নও বা এমন কিছু বুড়ো হয়ে যাওনি। এই মুশকিল তোমাদের নিয়ে। এখানে সবাই হাঁটে। হাঁটাটা স্বাস্থ্যের জন্য খুব ভালো। আমি তো দশ মাইল কুড়ি মাইল দিব্যি হাঁটি, প্রতিদিনই হাঁটি। তোমাকে বললাম হাঁটা শিখতে। বলেছিলে ঢাকার রমনায় প্রতিদিন হাঁটতে যেতে। তোমার হাঁটার নমুনা দেখে আমার মনে হয় না রমনায় কোনওদিন হেঁটেছে। বেদনাকে কী প্রাণপণে আড়াল করেছো, বুঝিনি তখন যে আড়াল করেছো। আড়াল তুমি করেই চলতে। স্বাস্থ্য ভালো হবে, আমি, তোমার ডাক্তার মেয়ে ভরসা দিচ্ছি, তুমি তাই যে করেই হোক হাঁটছে। পিছিয়ে না পড়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। তবুআমার বিরক্তি প্রকাশে কোনও বিরতি ছিল না। না হাঁটলে তোমার ডায়বেটিস ভালো হবে না, বারবার সতর্ক করে দিই। আমার উপদেশ মতো ডায়বেটিস দূর করার চেষ্টাও হয়তো করেছিলে। কিন্তু শেষপর্যন্ত পারোনি, কোনও ট্যাক্সি ডাকা যায় কিনা জিজ্ঞেস করেছে। ছোটদা বলেছে, ওতে প্রচুর টাকা। এরপর তুমি আর ট্যাক্সির কথা বলোনি। তুমি চাও না তোমার জন্য কারও টাকা খরচ হোক। রাস্তায় মানুষ হাঁটছে, সব বয়সের মানুষ, বিদেশের মানুষের বুদ্ধি আছে বলে হাঁটে, তাদের স্বাস্থ্যও তাই ভালো থাকে। এদেশের মানুষ আমাদের দেশিদের মতো গণ্ডমূর্খ নয়, এই জ্ঞান দিতে দিতে তোমাকে হাঁটালাম। গ্র্যান্ড প্লাজা থেকে ধমকে টাউন হলের পাশ দিয়ে কয়েকশ মিটার তোমাকে হাঁটিয়ে মানেনকেন পিস নামের বিখ্যাত ন্যাংটো একটা বাচ্চার পেচ্ছাব করা মূর্তির কাছে আনলাম। ষোলোশা আঠারো সালে মূর্তিটি ওখানে বসানো হয়েছিল, নানারকম গল্প আছে মূর্তি নিয়ে। কিছু গল্প তোমাকে বলি। মানেনকেন পিস দেখে আমি যে খুশি হচ্ছি, তাই দেখে বোধহয় তোমার আনন্দ হচ্ছিল, যদি হওয়া সম্ভব সামান্য আনন্দ আদৌ। ব্রাসেলসের বড় বড় প্রাসাদ দেখে তুমি মুগ্ধ হও, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করো, চাইছিলাম। এমন ভাবে সব দেখাচ্ছিলাম যেন শহরটা আমার। দেশটা তোমার, বিদেশটা আমার, যেন এমন। দেশের অভাব, অশিক্ষা, অসুন্দর, অজ্ঞতা সব তোমার। বিদেশের বৈভব, বিত্ত, বিশালতা, বিলাসিতা, বিচিত্রতা, বিজ্ঞতা আমার। তোমাকে রেস্তোরাঁয় নিয়ে গেলাম, যে রেস্তোরাঁর খাবার আমি আর ছোটদা খেতে পারলেও তুমি পারোনি। ওসব কাঁচা বা প্রায় কাঁচা মাছ তুমি খেতে পারো না। ঝিনুক নিলাম। ইচ্ছে করেই। দেখাতে যে যে খাবারগুলোকে অসম্ভব ভাবো-খাওয়া, সেগুলো খাওয়া কত সম্ভব। ছোটদা কিছু ঝিনুক খেল, আমিও কি আর ওসব খুব খেতে পারি! তোমাকে দেখানোর উদ্দেশ্যটাই ছিল আসল। খুব যে উৎসাহী চোখে তুমি খাবার দেখলে, তা নয়। তুমি প্রায় কিছুই খেতে চাইলে না। স্বাদ পেতে পারো, এমন কিছু খাবারও দেখলাম খেলে না। রেস্তোরাঁর বিল বেলজিয়ান ফ্রাঁয়ে দিয়ে টাকায় কত হয়, তাও তোমাকে বলতে ভুলোম না। তোমার মুখ সঙ্গে সঙ্গেই খুব মলিন হয়ে উঠলো। কেন শুনিয়েছিলাম তোমাকে টাকার অংক, আমি খুব ধনী তা বোঝাতে, নাকি বিদেশের রকম সকম বোঝাতে! আমার একবারও মনে হয়নি টাকার অংক শোনারপর তুমি এমনই সতর্ক হয়ে উঠবে যে রেস্তোরাঁয় আর খেতে চাইবে না। তার চেয়ে না খেয়ে থাকবে।

এই বেলজিয়ামে কত যে উৎসব হয়েছে আমাকে নিয়ে। এই ব্রাসেলসএর রাস্তায় ছিল আমার বুলেটপ্রুফ গাড়ির সামনে পেছনেপুলিশের গাড়ি, রেড কার্পেট রিসেপশান। ছিল প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণ। ব্রাসেলস বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিসমাসের ছুটি হয়ে যাওয়ার পরও আমার বক্তৃতা শুনবে বলে সবারই বসে থাকা, গেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমার ডকটর অনোরিস কোজা’ বা ডক্টরেট পাওয়া, সঙ্গে আমি ছাড়া যাঁরা পেয়েছিলেন, সবাই আগে নোবেলপুরস্কার পেয়েছেন। বেলজিয়ামের এয়ারলাইনস সাবেনা ভয় পেয়ে আমাকে, ফতোয়া আক্রান্ত লেখককে, উড়ানে নেয়নি বলে প্রেস কনফারেন্সে সাংবাদিকদের ক্ষোভে ফেটে পড়া, আমাকে বিপুল সমর্থন জানানো। জনগণ আমাকে দুদণ্ড দেখার জন্য উতলা। সেই একই আমি ব্রাসেলসএর রাস্তায় যখন হাঁটছি, আমি নিতান্তই বাদামি রঙের এক মেয়ে, সম্ভাব্য ইমিগ্রেন্ট, ইললিগ্যাল। টুরিস্ট নই। বাদামি রঙের মেয়েরা সাধারণত গরিব দেশের, পর্যটক হওয়ার সামর্থ্য তাদের নেই। যত তোমাকে আমার সেই ঝলমলে দিনের কথা বলেছি, তুমি তত বোধহয় অবাক হয়েছে। কারণ তুমি এসে যা দেখছো, তার সঙ্গে আমার গল্পের কিছু মিলছে না। আমি এখন রাস্তার যে কোনও মানুষের মতো। কেউ চিনতে পারছেনা আমাকে। আমার গল্প তুমি শোনো, কিন্তু এ নিয়ে তুমি আরও শোনার আরও জানার কোনও আগ্রহ দেখাও না। আর যদি দেখতেইমহোৎসব, খুব কিপুলকিত হতে! মনে হয় না আমার। তুমি ওই ঘরের মেয়ের ঘরে ফেরার কথাই ভাবতে।

.

ছোটদাকে ব্রাসেলসে রেখে, তোমাকে নিয়ে সুইডেনে ফিরি। যে বাড়িতে তোমাকে ওঠালাম সুইডেনে, বাড়িটা বড়, আধখানা মাটির তলায়, আধখানা ওপরে, বাড়িটার সামনে পেছনে মাঠ আছে, মাঠে গাছগাছালি আছে, কিন্তু বাড়িটা আমার নয়, বাড়িটা অন্যের। গোপনে তুমি কি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলে? হয়তো ফেলেছিলে। কেন নয়! আমি তো কোনও পুরুষের বাড়িতে আশ্রিতা হিসেবে থাকার মানুষ কোনওদিনই ছিলাম না। দেশে থাকাকালীন যুদ্ধ করেছি একা থাকার জন্য! ঢাকা শহরে আর কোনও মেয়ে কি একা থাকতে পেরেছিলো আমার মতো! নোংরা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সঙ্গে কী ভীষণ লড়াই করেই না শুধু মনের জোরে আমি একা থাকতে শুরু করেছিলাম। একা দাঁড়িয়েছি। একা বেঁচেছি। সেই আমিই কিনা একশ বছর পিছিয়ে গেলাম। একটা লোকের সঙ্গে আমার বাস। লোকটাকে আমি মানিয়ে চলি। হ্যাঁ মা, মানিয়ে চলি। আমি যতই তোমাকে বোঝাতে চেয়েছি, আমরা বন্ধু, যে যার মতো থাকি, আমার যেমন ইচ্ছে তেমন চলি, তার যেমন ইচ্ছে সে তেমন চলে। কিন্তু তোমার চোখ তো মা, মায়ের চোখ, মায়ের চোখ বোধহয় এমনই হয়, কিছু বলার দরকার হয় না। তোমার চোখকে ফাঁকি দেওয়ার উপায় নেই। আমার মানিয়ে চলাটা আমার চোখে না পড়লেও তোমার চোখে পড়ে। চারদিক অন্ধকার হয়ে আসতো। আমরা ঘরবন্দি পড়ে থাকতাম। তোমাকে নিচের তলায় একটা ছোট ঘরে জায়গা করে দিয়েছিলাম মা। ঘরটা সম্ভবত বারো বাই দশ ফুটের একটা ছোট ঘর। তুমি আসার আগেই ঘরটাকে একটুখানি গুছিয়েছিলাম, একটা ছোট টেবিল আর একটা বুকসেল্ফ পেতে, বিছানায় ভালো চাঁদর পেতে। পুরো বাড়িটা কাঠের। সুইডেনের চিরাচরিত লাল বাড়ি, জানালাদরজার সাদা বর্ডার। ওপরতলায় একটা শোবার ঘর, সে ঘরের সঙ্গে একটা স্নানঘর, পাশে লন্ডি। শোবার ঘরে ঢুকতে হয় বাঁদিকে রান্নাঘর আর খাবার ঘর রেখে। খাবার ঘরের মাঝখান দিয়ে নিচের তলায় চলে গেছে সিঁড়ি। ওপরে সিঁড়ির দুকিনারে দুটো ঘর, একটা ছোট, আরেকটা খানিকটা বড়। ছোটটায় সুয়েনসনের বইপত্তর, বড়টায় আমার ডেস্ক, বইয়ের আলমারি, যাবতীয়। মা তুমি তো এসেই দেখেছো এসব। দেখেছো আমার আর সুয়েনসনের শোবার ঘর একই। আমরা এক বিছানায় শুই। তোমাকে এত যে রক্ষণশীল বলে ধমক দিই, তুমি কিন্তু একবারও প্রশ্ন করোনি ওর সঙ্গে আমি শুই কেন। যে সম্পর্ক হলে শুতে হয়, সম্ভবত সম্পর্কটা সেই সম্পর্ক, তুমি ভেবে নাও। আগেও দেখেছো কায়সারের সঙ্গে বিয়ে না হয়েও একটা সম্পর্ক ছিল আমার। এই সম্পর্ক নিয়েও তুমি মাথা ঘামাও না। মাথা ঘামাও আমি কেমন আছি, তা নিয়ে। তখন কি আমি প্রাণপণে প্রমাণ করতে চাইছিলাম না যে খুব ভালো আছি? হ্যাঁ চাইছিলাম। বিদেশ বিভুইএ যে একাকীত্বে ভুগছি না, সঙ্গে যে একটা সঙ্গী আছে, সে সঙ্গী যেমনই হোক, শরীরের চাওয়া পূরণ করার জন্য কেউ যে আছে, তা তোমাকে দেখিয়ে দিই যেন তুমি স্বস্তি পাও। তুমি কি স্বস্তি পেয়েছিলে মা? আমার মন বলে, পাওনি। পাওনি বলে বারবার তুমি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছো। বুঝেছিলে, লোকটি, যে লোকটির সঙ্গে আমি ঘুমোই রাতে, তার সঙ্গে আমার লক্ষ যোজন ব্যবধান। এই ব্যবধান নিয়ে আর যাই গড়া যাক, কোনও সম্পর্ক গড়া যায় না। আমিই কি আর তা জানি না? কিন্তু তোমাকে বলিনি যে আমার আর উপায় নেই। দেশে যেমন ছিলাম আমি, যে তেজ, যে আগুন, যে জোর নিয়ে আমি বাঁচতাম, দেখেছো নেই। তলোয়ারের ঘায়ে দেশ আমাকে শত টুকরো করতে চাইলেও এমনশক্তিময়ী ছিলাম যে আমাকে স্পর্শ করতে পারতো না। আমার ধারের কাছে এসে ধারালো তলোয়ারও ভেঙেপড়তো। দেখলে, আমার সব গেছে। শরীরের সেই অসাধারণ সৌন্দর্যও আর নেই। সেই তন্বী সুন্দরী এখন মেদবহুল পিপে। একটার পর একটা সিগারেট ফুকছে। তুমি টিকতে পারছে না দুর্গন্ধে। কিন্তু এ তোমার প্রাণের চেয়ে প্রিয় মেয়ের মুখ থেকে বেরোচ্ছে, তার সারা শরীর থেকে কাপড় চোপড় থেকে, তার বিছানা বালিশ থেকে–তুমি কী করে দূরে সরো, তোমাকে ওই দুর্গন্ধে অভ্যস্ত হতেই হবে। এ ছাড়া তোমার করারই বা কী ছিল। না, গন্ধ সইতে তোমার ভালো লাগছেনা বলে নয়, বারবার তুমি আমাকে সিগারেট ছাড়তে বলো আমার ভালোর জন্য। সিগারেট খাওয়া শরীরের জন্য ক্ষতিকর। সে তো আমি জানিই, তারপরও বলো। বলো মুখে কিছুলবঙ্গ বা এলাচ রাখতে, নয়তো চুইংগাম রাখতে, কিছু একটা রাখতে বলো যেন সিগারেট ছাড়া যায়। আমি তোমাকে বিষম হেসে সিগারেটের নানাবিধ উপকারিতা বর্ণনা করি। বাপ ভাইরাই যেখানে সিগারেট খায়নি কোনওদিন, সেপরিবারে মেয়ে হয়ে সিগারেট খাচ্ছি, সংস্কার টংস্কার সব গুঁড়িয়ে দিয়েছি, রীতি নীতিরপরোয়া করি না। কার সাধ্য আছে এত সাহসী হয় আমার মতো!

নিচতলায় তোমার ওই ঘরের লাগোয়া কোনও বাথরুম নেই। তোমার ঘরের সামনে একটা ঘর পড়ে আছে যেখানে একটা চেয়ার, নড়বড়ে একটা হলুদ আর কাঠের পুরোনো একটা লম্বা সোফা। টেলিভিশন। একটা বেঢপ কাঠের তাক। তাকে পুরোনো গানের রেকর্ড। এটাকে বৈঠকঘরই হয়তো বলতে হয়, কিন্তু এত করুণ বৈঠকঘর তুমি কি আমার কোনও বাড়িতে দেখেছো? দেখনি। আমার রুচি ছিল, সৌন্দর্য বোধ ছিল। কোনও কাঠখোট্টা অসামাজিক পুরুষের বাড়িতে রুচির আশা করা নিতান্তই বৃথা। ওই বৈঠকঘরের পেছনে একটা আয়তক্ষেত্রর মতো ঘরে হাবিজাবি জিনিস রাখা। ভাঙা টেবিল চেয়ার, মাল নেওয়ানেওয়ির কাগজের বাক্স। কায়ক্লেশে ওসব ডিঙিয়ে গিয়ে এক কোণে ছোট্ট একটি ঘর আছে, ওই ঘরটি প্রথম দিনই তোমাকে দেখিয়ে এনেছি। কাঠের দু সারি বেঞ্চ, সামনে আগুন জ্বালানোর জিনিস। ওই সওনায় বসে লোকে আগুন তাপায়। তারপর ঠাণ্ডা জলে স্নান করে নেয়। কেউ কেউ আবার বাইরের বরফে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সওনার ব্যাপারটি নিশ্চয়ই তোমার কাছে অদ্ভুত লেগেছিলো। দেশের বীভৎস গরমে বছর বছর তোমার ত্বকে ঘামাচি বেরোয়, তুমি তিষ্ঠোতে পারো না। আর এদেশে লোকে কিনা গায়ে গরম লাগাতে চায়শখ করে! বুঝতে তোমার অসুবিধে হয়। শীতের দেশের বরফের কথা শুনেছো, বরফ যে ঠিক কী জিনিস, তুমি নিজের চোখে দেখলে একদিন। সেদিন কী যে আনন্দ তোমার। কী যে বিস্ময় তোমার চোখে, কী যে মুগ্ধতা। দেখে আমার খুব ভালো লাগলো। আর কিছু না দেখাতে পারি, আমাকে নিয়ে কোনও উৎসব বা মহোৎসব, অন্তত তোমাকে এ দেশের বরফ দেখাতে পারলাম। কিছু একটা দেখলে জীবনে, যা জীবনে দেখনি কোনওদিন। শুধু কী বরফ, যা তুমি আগে কখনও দেখনি, তাও তো দেখলে, দেখলে ঝাঁক ঝাঁক অন্ধকার। আলোর মুখ দেখছো না তুমি। দুপুরের দিকে একটু আবছা আলো যাও আসে, ঝুপ করে আঁধার নেমে যায় ওর ওপর। দেখলে আমরা জানালায় বাতি জ্বালিয়ে রাখি শীতকালে। কত নতুন কিছু দেখছো, বোঝালে বুঝছও। কিন্তু তোমার যে বিদেশের নাড়ি নক্ষত্র জানার আদৌ কোনও আগ্রহ আছে, তা আমি টের পাই না। যতটুকু দেখ, আমাকে খুশি করতেই দেখ। যা শোনো, আমাকে আনন্দ দেবার জন্যই শোনো। তোমার আগ্রহ আমাকে নিয়ে। আমি ডানে গেলে তুমি ডানে যাবে, বাঁয়ে গেলে বাঁয়ে। পেছনে হীরের খনি পড়ে থাকলেও ফিরে তাকাবে না তুমি।

কেমন ছিলে মা তুমি ওই ছোট্ট ঘরে? ওপরে আমি, আমার শোওয়ার ঘর, ওপরে খাবার টেবিল রান্না ঘর, ওপরে সব। আর তুমি নিচে। তুমি একা। কেমন ছিলে মা? তুমি হয়তো ভেবেছিলে আমার সঙ্গে রাতে শোবে তুমি, আমার সঙ্গে ঘুমোবে প্রতিরাতে। গায়ে হাত বুলিয়ে দেবে, চুলে বিলি কেটে দেবে। সেই পুরোনো দিনের মতো রূপকথার সেই প্রিয় প্রিয় গল্পগুলো শোনাবে, গান শোনাবে। শুনতে শুনতে একসময় ঘুমিয়ে পড়বো, ছোটবেলার মতো। এরকম নিশ্চয়ই ভেবেছিলে যখন দেখতে আসছে আমাকে। একটি রাতও তো ওইনিচের ঘরে তোমার সঙ্গে ঘুমোইনি আমি। খুব একা লাগতো তোমার? কাঁদতে? একাই তো ছিলে সারাজীবন, আমার কাছে এসেও সেই একাই রয়ে গেলে। যে তোমার একাকীত্ব কোনওদিন অনুভব করেনি, হঠাৎ করে সে কেন এখন অনুভব করতে যাবে! বিদেশ বলে? দেশ আর বিদেশে হাজার ফারাক থাকুক, চুরানব্বই সাল আর সাতানব্বই সালের ব্যবধান থাকুক, আমি সেই আমিই ছিলাম। বয়স বেড়েছে, শরীরে পাল্টেছে, মন পাল্টায়নি। তোমাকে না বোঝার মন।

তুমিও এলে, আর আমারও বই লেখার শখ হলো। এমন লেখা নিয়ে পড়েছিলাম যে দিন রাত আর কিছুর ভাবনা ছিল না আমার। সেই চুরানব্বইয়ে এসেছিনির্বাসনে। চুরানব্বইপঁচানব্বই ছিয়ানব্বই চলে গেল সামান্য কিছু কবিতা ছাড়া লিখিনি কিছু, সাতানব্বইএর নভেম্বর থেকে আদাজল খেয়ে লিখতে আরম্ভ করলাম। সাহিত্যিক হয়ে উঠলাম হঠাৎ। যে সেবইনয়, রীতিমত আত্মজীবনী। আত্মজীবনী লেখার ভাবনা কোত্থেকে এলো, কেন এলো জানি না। সম্ভবত তুমি আমার সেই ছোটবেলার কথা স্মরণ করছিলে বলে। পুরোনো দিনের কথা তুমি বলছো, আর আমি পরিকল্পনা করছি ওই স্মৃতি নিয়ে বই লেখার। বই যখন লিখছি, বইই লিখছি, আর কিছু করার আমার সময় নেই মোটেও। তুমি অসুখ শরীরে আমাকে চা বানিয়ে দিতে, রান্না করতে, আমাকে খাওয়াতে, বাসন কোসন মাজতে, ঘরবাড়ি গুছিয়ে রাখতে। কাউকে নেমন্তন্ন করতাম তো তাদের সবার জন্যই রাঁধতে, সবারই এঁটো বাসন মাজতে। আমার চুল আঁচড়ে দিতে। গায়ে লোশন লাগিয়ে দিতে। বসে থেকে থেকে পা ফুলে গেলে সেই পা মালিশ করে করে ফোলা কমিয়ে দিতে। সারাদিন তুমি আমার যত্ন করতে, যেমন করতে দেশে। তোমার দিকে ফিরে তাকাতাম না আমি, দেশেও যেমন তাকাতামনা। যেমন একা কাটাতে, তেমনই একাই কাটিয়েছো আমার সঙ্গে। তবে তোমাকে যে সবসময় দূরে সরিয়ে রাখতাম তা নয়। তোমাকে কাছে ডাকতাম তথ্যের জন্য। নানা নানি, দাদা দাদি, তোমার ইস্কুল, তোমার বিয়ে হওয়ার কাহিনী, তোমার শ্বশুর বাড়ির লোকজন, তোমার বাপের বাড়ির সবাই কে কেমন ছিল, কী কী ঘটতে দেখেছো, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতাম সব। তুমি বলতে, তবে বুঝে পেতে না এত অজরুরি তথ্য আমার কেন এত প্রয়োজন। এমন অভিজ্ঞতা আগে তোমার হয়নি। তোমার জীবন নিয়ে এত উৎসাহ আগে কখনও দেখাইনি। আমার এই উৎসাহ তোমাকে আনন্দ দিত, নিজেকে খুব মূল্যবান কিছু মনে হয়েছিলো কি তোমার? আসলে আমার কাছে তোমার চেয়ে তোমার তথ্যের গুরুত্ব ছিলো বেশি। তুমি নির্দ্বিধায় আমাকে তথ্য দান করেছে। নিজের পরিবারের দারিদ্র্য, দুঃখ, দুর্দশা কিছু বাদ দিয়ে বলোনি। তুমি তো মিথ্যে বলতে জানতে না মা। তোমার বাবার আর্থিক অবস্থা স্বচ্ছল হওয়ার আগে, তুমি যখন খুব ছোট, তোমার মা নারকেলের বরফি বানিয়ে দিত, সেই বরফির বাক্স নিয়ে গিয়ে তোমার বাবা বাজারে বিক্রি করতো, এই সত্য তোমার ভাই বোনেরা গোপন করলেও তুমি কোনওদিন করোনি। দরিদ্রের প্রতি তোমার কোনওদিনই কোনও অশ্রদ্ধা ছিলো না। সত্যকে, সে যত অপ্রিয়ই হোক না কেন, স্বীকার করতে তোমার কোনও সংকোচ হতো না। তুমি অকপটে বলেছো তোমার ভাই বোনদের ভালো মন্দ। তোমার নিজের দুঃখ সুখ। আমাকে এত বিশ্বাস করেছিলে কেন মা? তুমি তো জানতে আমি সব লিখছি। একবারও তোমার কিছু লুকোতে ইচ্ছে করলো না কেন?

জানতে লিখছি, জানতে না যে যা বলোনি, তাও লিখেছি আমি। একদিন কোথাও বোধহয় গিয়েছি বাড়িতে তোমাকে একলা ফেলে। ফিরে দেখি তুমি খুব মন খারাপ করে বসে আছে। কমপিউটার থেকে লেখার কিছু প্রিন্ট আউট বের করেছিলাম, ওগুলো টেবিলের ওপরই ছিলো। হয়তো তুমি আমার লেখার ঘরটা গুছোতে গিয়ে দুএকটা কাগজপড়ে ফেলেছো, তোমার নিন্দা তো পাতায় পাতায় ছিল। ফজলি খালা সম্পর্কে যা লেখা হয়েছে, তা পড়ে খুব মন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো তোমার। তুমি বাড়ি থেকে রান্না করা খাবার বা বাড়ির ফলমূল লুকিয়ে নিয়ে যেতে পীরবাড়িতে, নিজের ভালো ভালো শাড়ি দিয়ে দিতে ফজলিখালাকে, ফজলিখালা আর তার মেয়েরা সেগুলো কেটে ওড়না বানিয়ে পরতো। তোমাকে হয়তো ভালোবাসিনি মা, কিন্তু চাইনি তুমি ওসব পড়ো, চাইনি তুমি কষ্ট পাও। তোমার মন খারাপ দেখে, সত্যি বলছি, আমারও মন খারাপ হয়েছে। ছোটবেলায় সেই যে বিশ্বাস জন্মেছিলো তুমি বোধহয় সব ঢেলে দিচ্ছো পীরবাড়িতে, সেই বিশ্বাসের কথাই আমি লিখেছি। বিশ্বাসটা জন্মাতে বাবাই বোধহয় সাহায্য করেছিলো, আর তোমার ঘন ঘন পীরবাড়ি যাওয়াকে বাড়ির কেউই তো আমরা ভালো চোখে দেখিনি। তোমার মন যেন খারাপ না হয়, বাড়ির জিনিসপত্র লুকিয়ে, পালিয়ে বিয়ে করে ছোটদা যে নতুন সংসার গড়েছিলো, ওই সংসারে দিয়েছে, তা আমার লেখার আরেকটা অংশ থেকে জোরে জোরেপড়ে শুনিয়েও দিই। এ থেকে অবশ্য কিছু প্রমাণ হয়নি যে, ফজলিখালাকে দাওনি। তোমাকে বোকা বানাতে চেয়েছিলাম। তুমি শুধু একটা অনুরোধই আমাকে করেছিলে, ফজলিখালার নামটা যেনপাল্টেদিই। তুমি বুঝেছিলে, ঘটনাপাল্টবো না। কোনওদিন ফজলিখালা যদি পড়ে বইটা, কষ্ট পাবে। ফজলিখালাকে তুমি কষ্ট দিতে চাওনি। তোমার নিজের কষ্ট হয় হোক। তোমার কথা রেখেছিলাম মা, ফজলিখালার নামটা পাল্টে দিয়েছিলাম। কিন্তু প্রথম সংস্করণেই। দ্বিতীয় সংস্করণ থেকে ফজলিখালা ফজলিখালা নামেই রয়ে গেছে। নাম পালে কি মানুষ পাল্টে যায়!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *