সুখের সন্ধানে
প্রথম পর্ব
১. মানুষ কী কারণে অসুখী হয়?
প্রাণীরা যতক্ষণ সুস্থ থাকে, প্রচুর খেতে পায়, ততক্ষণই সুখে থাকে। মনে হয় মানুষেরও সেরকম থাকা উচিত, কিন্তু আধুনিক বিশ্বে মানুষ সুখী নয়। অন্ততপক্ষে অধিকাংশ মানুষই সুখী নয়। আপনি নিজে যদি অসুখী হন, তাহলে মনে করতে পারেন আপনিও এ ব্যাপারে কোনও ব্যতিক্রম নন। আর আপনি যদি সুখী হয়ে থাকেন তাহলে নিজের কাছেই জানতে চান আপনার ক’জন বন্ধু আপনার মতো সুখী। তারপর আপনি বন্ধুদের জীবন পর্যালোচনা করে মুখ দেখে তাদের রূপ চেনার বিদ্যাটা আয়ত্ত করে নিন। আপনি যাদের প্রতিদিন দেখেন তাদের মনোভাবের সাথে যাতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেন তার জন্যে মনকে তৈরী করুন। কবি ব্লেক বলেছেন :
‘আমি যাকে দেখি তার মুখে দেখি একই চিহ্ন
দুর্বলতার চিহ্ন, বিষাদের চিহ্ন। (১)
এর নানা প্রকার হলেও আপনি সব জায়গায় সেই অসুখীভাবকে দেখতে পাবেন। মনে করুন আপনি নিউইয়র্কে আছেন, যা একটি আধুনিকতম নগর। কর্মব্যস্ত কোনও সময়ে এই নগরের এক জনাকীর্ণ রাজপথের ধারে দাঁড়িয়ে আছেন, অথবা সপ্তাহশেষে কোনও বড় রাস্তায় অথবা কোনও সান্ধ্য নাচের আসরে। এবার মন থেকে অহংভাবটা দূর করে মনটাকে শূন্য করুন, তারপর সেই শূন্যস্থান পূর্ণ করুন একের পর এক অজানা ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব দিয়ে। ঠিক তখন আপনি বুঝতে পারবেন ওদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব ধরনের আলাদা আলাদা সমস্যা রয়েছে। আপনি তাদের মধ্যে খুঁজে পাবেন উদ্বেগ, অতিরিক্ত মনঃসংযোগ, অজীর্ণতা, জীবন সংগ্রামে ব্যাকুলতা ছাড়া অন্য সব বিষয়ে অনীহা, খেলাধুলায় অক্ষমতা, অন্যদের ব্যাপারে সহমর্মিতার অভাব। সপ্তাহ শেষে রাজপথে দেখবেন স্বচ্ছল নারী-পুরুষের ভিড়, যাদের অনেকেই খুব ধনী। যারা চলেছে আনন্দের সন্ধানে। সবারই গতি যেন সমতালে, যে গতি ধীরতম মোটরযানের সাথেই শুধু তুলনীয়। গাড়ির ভিড়ে পথ ঢেকে গেছে। কোনও কিছু দেখার উপায় নেই, চোখ অন্যদিকে ঘোরালেই দুর্ঘটনা।
সব গাড়ির সব যাত্রীরা কী করে অন্য গাড়িকে টপকে যাবে সেই চিন্তাতেই মেতে আছে। কিন্তু ভিড় সামলে তা করার উপায় নেই। এই চিন্তা থেকে যদি তারা মন অন্য দিকে সরিয়ে নেয় কখনও, বিশেষ করে যারা গাড়ির চালক নয় তারা, তা হলে তখন তারা এক অনুচ্চারিত বিরক্তিতে কাতর হয়ে পড়ে। সাথে সাথে তাদের চোখে মুখে ফুটে ওঠে ক্লান্তির ছাপ।
একবার হয়তো গাড়িভর্তি এক দল অশ্বেতাঙ্গ লোক প্রচুর হৈ চৈ করে মাত্রা ছাড়িয়ে যাবে আনন্দে। কিন্তু তাদের ব্যবহারে অন্যরা কষ্ট পাবে এবং শেষ পর্যন্ত তারা কোনও দুর্ঘটনা ঘটিয়ে পুলিশের হাতে পড়বে, কারণ ছুটির দিনে রাজপথে আমোদ-প্রমোদ বেআইনি।
অথবা, আপনি কোনও উৎসবমুখর সন্ধ্যার জনতাকে লক্ষ্য করুন, তারা আমোদ-প্রমোদে ভেসে সুখী হওয়ার জন্যে এসেছে- যেমন ভয়শূন্য মন নিয়ে লোকে দন্তচিকিৎসকের কাছে যায়। তারা মদ্যপান ও প্রমোদে ভেসে যাওয়াকে আনন্দের দরজা মনে করে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা মাতাল হয়ে পড়ে। তাদের সঙ্গীদের মনে কতটুকু বিতৃষ্ণা জেগে উঠছে সেদিকে আর তাকিয়ে দেখে না। তারপর আরো কিছু মদ্যপান করে তারা কাঁদতে আরম্ভ করে। তারা যে কত অপদার্থ এবং নৈতিকভাবে মায়ের স্নেহের অনুপযুক্ত তা নিয়ে অনুতাপ করতে আরম্ভ করে। প্রকৃতিস্থ অবস্থায় তাদের বিচারবুদ্ধি যে পাপবোধকে চেপে রাখে, মদ এসে তাকে তা থেকে মুক্ত করে দেয়।
সমাজ ব্যবস্থা এবং ব্যক্তি মনস্তত্ত্বের মধ্যে এই নানা প্রকার অতৃপ্তির কারণ খুঁজে দেখতে হবে। এই ব্যক্তি-মনস্তত্ত্ব আবার অনেকাংশে সমাজ ব্যবস্থার পরিপূরকের ওপর নির্ভরশীল। কোন কোন পরিবর্তিত সমাজ ব্যবস্থা সুখ ও তৃপ্তির পরিপোষক, তা নিয়ে আমি পূর্বেই উল্লেখ করেছি। যেমন যুদ্ধ-বন্ধ, অর্থনৈতিক শোষণ এবং নিষ্ঠুরতা ও ভয়ের শিক্ষা- এইসব বিষয়ে এই লেখায় কোনও আলোচনা করার ইচ্ছা আমার নেই। যুদ্ধকে এড়ানো কী ভাবে সম্ভব, তা আবিষ্কার করা আমাদের সভ্যতার পক্ষে জরুরী। কিন্তু সেই পথ আবিষ্কৃত হলেও তা কোনও কাজে লাগবে না, কারণ মানুষ যতদিন অসুখী থাকবে, ততদিন সে অবিরাম দিনের আলো সহ্য করার চেয়ে পরস্পরকে উচ্ছেদ করা কম ভীতিকর মনে করবে। যন্ত্রনির্মিত দ্রব্য যাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন, তাদের তা মেটাবার যদি কিছুমাত্র সদিচ্ছা থাকে, তবে দারিদ্রকে ধরে রাখা বন্ধ করতে হবে। কিন্তু ধনবানরা নিজেরাই যদি এমন দুর্দশাগ্রস্ত হয়, তাহলে সকলকে ধনবান তৈরী করে কী লাভ? নিষ্ঠুরতা এবং ভয়ের শিক্ষা খারাপ, কিন্তু যারা নিজেরাই এইসব কুপ্রবৃত্তির দাস তারা আর কী শিক্ষা দিতে পারে? এইসব বিবেচনা থেকে ব্যক্তির প্রসঙ্গ চলে আসে। পুরুষ হোক অথবা নারী, আমাদের এই পিছন ফিরে তাকানো সমাজের মধ্যে বর্তমানে বাস করে, আত্মতৃপ্তির জন্যে এখন, এই মুহূর্তে সে কী করতে পারে? এই প্রশ্ন আলোচনা করতে আমি শুধু তাদের কথা উল্লেখ করব যাদের ব্যবহারিক অর্থে দুঃখ ভোগ করার কোনও চরম হেতু নেই। আমি ধরেই নেব তাদের খাদ্য ও বাসস্থানের জন্যে যথেষ্ট উপার্জন রয়েছে। সাধারণ কায়িক পরিশ্রমের জন্যে উপযুক্ত স্বাস্থ্য রয়েছে, আমি বড় ধরনের কোনও বিপদের প্রসঙ্গ তুলছি না, যেমন সকল সন্তানের মৃত্যু অথবা প্রকাশ্য কোনও গ্লানি। এসব হিসাবের মধ্যে নয়, কিন্তু আমি যা নিয়ে আলোচনা করব তা ভিন্ন ধরনের। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে সভ্য বিশ্বের অনেক দেশের প্রচুর মানুষ দিনের পর দিন যেসব ছোট ছোট অতৃপ্তি ভোগ করে, তার কোনও বাইরের কারণ না থাকাতে, তা থেকে তারা মুক্তির উপায় খুঁজে পায় না, আর সেজন্যে তা আরও বেশি অসহনীয় মনে হয়। আমার মনে হয়, এই অতৃপ্তির মোটামুটি কারণ হচ্ছে পৃথিবী সম্বন্ধে ভুল ধারণা, ভুল নৈতিকতাবোধ এবং জীবনের ভুল উদ্দেশ্য, যার ওপর শেষ পর্যন্ত তাদের তৃপ্তিলাভ নির্ভর করে, যা সেইসব আয়ত্তের পরিধির মধ্যেই থাকে। আমি এমন কিছু পরিবর্তনের পরামর্শ দিচ্ছি যা ঘটাতে পারলে কোনও ব্যক্তি যদি মোটামুটি অভাবী না হয়, তা হলে সে সুখী হতে পারবে।
যে দর্শনবিদ্যার কথা বলতে যাচ্ছি, সম্ভবত আমার নিজের জীবনের কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ করলে তার সাথে প্রকৃত পরিচয় ঘটবে। আমি সুখী হয়ে জন্মাইনি, শৈশবে আমার প্রিয় স্তবগান ছিল ‘পার্থিব বিষয়ে শ্রান্ত এবং আপন পাপে ভারাক্রান্ত। পাঁচ বছর বয়সে আমার অন্তরে প্রতিফলিত হয়েছিল, যদি আমি সত্তর বছর বয়স পর্যন্ত বাঁচি, যা আমার বর্তমান বয়সের মাত্র চৌদ্দ ভাগের এক ভাগ, তা হলে আমার সামনে যে সুবিস্তৃত একঘেয়ে জীবন রয়েছে তা সহ্য করাই অসম্ভব হয়ে পড়বে। কৈশোরে আমি জীবনকে ঘৃণা করেছি এবং ক্রমাগত আত্মহত্যার ইচ্ছা প্রবল হয়েছে। কিন্তু গণিতশাস্ত্রকে বেশি করে জানতে আগ্রহী হওয়ায় আমি সেই ইচ্ছা থেকে দূরে থেকেছি। তার জন্যেই আমি এখন জীবনকে উপভোগ করছি। এখন আমি বরং বলতে পারি, একটি বছর শেষ হচ্ছে আর আমিও জীবনকে আরো বেশি উপভোগ করছি। এটা সম্ভব হয়েছে, কারণ কী আমার চাওয়া, তা জানতে পারার জন্যে। এইভাবে ধীরে ধীরে অনেকগুলি উপভোগ্য বস্তুর দখল প্রতিষ্ঠা করেছি। আর এর জন্যে অংশত দায়ী হচ্ছে কিছু কামনার বস্তুকে সফলভাবে ত্যাগ করতে পারা, যেমন কিছু বিষয়ের নিশ্চিত জ্ঞান লাভ করা যে, সব কিছু অর্জন করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি মুলত যা অসম্ভব বলে মনে করেছি তা-ই ত্যাগ করেছি। আমার এই পরিবর্তনের প্রধান কারণ এই যে, আমি নিজের সম্বন্ধে ভাবনা কমিয়ে দিতে পেরেছিলাম। যেমন যারা পিউরিটানদের শিক্ষা পেয়েছে আমিও তাদের মতো আমার পাপ, বোকামি এবং নানা ভুল-ত্রুটি বিষয়ে ধ্যান করতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম। নিজেকে মনে হত, এবং যথার্থই মনে হত, আমি একটা হতভাগ্য উদাহরণ। ধীরে ধীরে আমার নিজের বিষয়ে, আমার ভুল-ত্রুটির বিষয়ে উদাসীন থাকতে শিখলাম। আমার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু বাইরের বস্তুতে ঘনীভূত করতে আরম্ভ করলাম। যা হচ্ছে চলমান দুনিয়ার অবস্থা, জ্ঞানবিজ্ঞানের নানা শাখা-প্রশাখা আর স্নেহভাজন সহমর্মী ব্যক্তিরা। বাইরের জিনিসে মন দিলে অবশ্য সেসব আবার তাদের নিজস্ব ধরনের সম্ভাব্য মনোবেদনা বয়ে আনে। যেমন বিশ্ব যুদ্ধে মত্ত হয়ে উঠতে পারে, কোনও বিষয়ে বিশেষ জ্ঞানার্জন সাধ্যের বাইরে হতে পারে, প্রিয় বন্ধুরা মারা যেতে পারে। কিন্তু এই রকম মনোযন্ত্রণা জীবনের উৎকর্ষকে নষ্ট করতে পারে না, যেমন পারে নিজের প্রতি ঘৃণাজাত বেদনা। বাইরের প্রত্যেকটি কাজে অনুসন্ধিৎসা যে কোনও কাজে উৎসাহ দেয় এবং সেই অনুসন্ধিৎসা যতদিন সজীব থাকে ততদিন তা সম্পূর্ণভাবে অবসাদকে প্রতিরোধ করার কাজে লাগে। কিন্তু নিজের সম্বন্ধে কৌতূহল অগ্রগতির পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো কোনও প্রেরণার সঞ্চার করে না। নিজের ব্যাপারে উৎসাহ, দিনলিপি লেখার প্রেরণা দিতে পারে। মনোবিজ্ঞানে আগ্রহ জাগতে পারে অথবা সংসারত্যাগী সন্ন্যাসী হতে সাহায্য করতে পারে। তাও আবার আশ্রমের দৈনন্দিন কাজে ডুবে গিয়ে নিজের অহং ভুলে যেতে না পারলে সুখী হওয়া যাবে না। যে তৃপ্তি তিনি ধর্মের করুণায় পেয়েছেন বলে ভাবছেন, তা তিনি একজন ঝাড়ুদার হয়েও পেতে পারতেন, যদি তিনি সেই পদে থাকতে বাধ্য হতেন। যেসব হতভাগ্যের আত্মনিমগ্নতা এমন-ই গভীর যে, অন্য কোনও উপায়ে তা থেকে তাদের উদ্ধার করা যাবে না। তাদের তৃপ্তিলাভের একমাত্র উপায় হচ্ছে বাইরের শৃঙ্খলার ওপর ভরসা।
আত্ম-নিমগ্নতা নানা ধরণের। সাধারণভাবে তিনটি ধরণের ওপর আলোচনা করা যেতে পারে : পাপী, আত্মপ্রেমিক এবং আত্মঅহংকারী।
আমি পাপী, অর্থে যে পাপকাজ করে তাকে বোঝাচ্ছি না। কেন না পাপকাজ সকলেই করে না হলে কেউ করে না। সবকিছু নির্ভর করে পাপ বলতে কী বোঝায় তার ওপর। পাপী বলতে যে ব্যক্তি পাপের চিন্তায় নিমগ্ন তাকে বোঝাতে চাই। এই ব্যক্তি সবসময় নিজের কাজের বিরোধী। যদি তিনি ধার্মিক হন, তবে এই আত্মবিরোধিতাকে ঈশ্বরের ইচ্ছা বলে ব্যাখ্যা করেন। তার নিজের বিষয়ে তার একটা সুস্পষ্ট ধারণা আছে। তার নিজের সম্বন্ধে যে জ্ঞান, তার সাথে সেই ধারণার অবিরাম বিরোধ চলছে। শৈশবে তার জননীর হাঁটুর পাশে বসে যেসব নীতিবাক্য তিনি শুনেছেন যদি তা দীর্ঘদিন যাবৎ তার চেতনা থেকে হারিয়ে যায়, তবে তার জন্যে পাপবোধ হয়তো তার চেতনার গভীরে ডুবে আছে এবং শুধুমাত্র মত্ত অবস্থায় অথবা ঘুমের ঘোরে, তবুও সবকিছুর স্বাদ নষ্ট করে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট। মনের গভীরে কিন্তু তিনি এখনও শৈশবে শেখা নিষিদ্ধ জিনিসকে সেভাবেই মেনে নেন। শপথ করা অন্যায়, মদ্যপান অন্যায়, সাধারণ ব্যবসায়িক চতুরতা অন্যায় এবং সবার ওপরে যৌনতা অন্যায়। তিনি অবশ্য এইসব উপভোগ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখেন না। কিন্তু এর জন্যে তার অধঃপতন হচ্ছে এই ধারণা থেকে সবকিছু তার বিষময় হয়ে ওঠে। একটিমাত্র সুখ যা তিনি অন্তর দিয়ে পেতে চান তা হচ্ছে তার জননীর স্নেহাদর। যা তিনি পেয়েছেন শৈশবে, যা তাকে এখনও উদ্বেলিত করে। কিন্তু সেই আনন্দ তার জন্যে আর উন্মুক্ত নয়। তাই আর কিছুকে তিনি পরোয়া করেন না। যেহেতু পাপ তাকে করতেই হবে, তাই গভীরভাবেই তিনি তাতে ডুবে যেতে চান। যখন তিনি প্রেমে পড়েন তখন তিনি দয়িতার কাছে মাতৃসুলভ কোমল স্পর্শ খোঁজেন, কিন্তু তা পেলেও গ্রহণ করতে পারেন না। কারণ মাতৃমূর্তির আভাসের জন্যে কোনও নারীকে তিনি সম্মান করতে পারেন না, তারা তার যৌনসঙ্গী হয়েছেন বলে। তারপর ব্যর্থতার জন্যে তার মধ্যে জেগে ওঠে এক নিষ্ঠুরতা। তা থেকে জেগে ওঠে অনুশোচনা, আর সেই সাথে নতুনভাবে তিনি আবার কল্পিত পাপবোধ আর প্রকৃত অনুশোচনার স্বাদহীন পথে যাত্রা করেন। এটাই অধিকাংশ দুশ্চরিত্র লম্পটদের মনস্তত্ত্ব। তারা যে পথভ্রষ্ট হন তার কারণ হল তারা একটি অপ্রাপ্যনীয় জিনিসের ওপর নিষ্ঠা রেখে চলেন (তা হচ্ছে মা কিংবা মায়ের প্রতিকল্প)। এ সাথে যুক্ত হয়েছে সেই হাস্যকর নৈতিকতা, যা তার মনে শৈশবে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। প্রথম জীবনের বিশ্বাস ও ভালবাসার অত্যাচার থেকে মুক্তি পাওয়াই এইসব মাতৃসুলভ গুণাবলীর শিকারদের সুখ পাওয়ার প্রথম স্তর।
আত্মপ্রেম, একদিক থেকে, অভ্যাসজাত পাপবোধের বিপরীত-আশ্রয়ী। আত্মপ্রেমের উপাদান হচ্ছে নিজেকে ভালবাসার অভ্যাস এবং অপরের ভালবাসা পাওয়ার কামনা। কিছুদূর পর্যন্ত এটা স্বাভাবিক এবং এর জন্যে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু মাত্রাধিক্য ঘটলে এটা খুবই ক্ষতিকর। অনেক নারীর মধ্যে, বিশেষ করে ধনী-সমাজের মহিলাদের মধ্যে ভালবাসা অনুভবের ক্ষমতা সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায়। তখন তাদের মনে জেগে ওঠে অন্য পুরুষদের ভালবাসা পাওয়ার এক তীব্র কামনা। এই ধরণের নারী যখন সন্দেহমুক্ত হন যে কোনও পুরুষ তাকে ভালবেসেছেন, তখনই সেই পুরুষের প্রয়োজন তার জীবনে শেষ হয়ে যায়। পুরুষদের ক্ষেত্রেও এটা দেখা যায়, কিন্তু এত বেশি নয়। এ প্রসঙ্গে ‘লিয়ে দাঁগেরোসে’ নামক কাহিনীর নায়ক, এ সুবিখ্যাত ধ্রুপদী দৃষ্টান্ত। মিথ্যা অহংকার এত উচ্চতায় ওঠে যে, তখন অন্য কোনও মানুষ সম্বন্ধে তার প্রকৃত কোনও কৌতূহল থাকে না। তাই এরা প্রেম থেকে প্রকৃত কোনও সুখ লাভ করতে পারেন। না। উদাহণস্বরূপ বলা যায়, একজন আত্মপ্রেমিক চিত্রশিল্পীদের প্রচুর শ্রদ্ধা পেতে দেখে নিজে চিত্রশিল্পের ছাত্র হতে পারেন, কিন্তু যেহেতু এই শিক্ষালাভ তার কাছে বিশেষ একটি উদ্দেশ্যসাধনের উপলক্ষ্য, তাই শিল্পের আঙ্গিকে তার কোনও স্বাদ থাকবে না এবং নিজেকে বাদ দিয়ে তিনি অন্য কোনও কিছুর কথা ভাবতেই পারবেন না। এর ফল হবে ব্যর্থতা এবং নৈরাশ্য, অর্থাৎ ঈপ্সিত প্রশংসার পরিবর্তে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ লাভ। যে সব ঔপন্যাসিক তাদের উপন্যাসে আদর্শ নায়িকারূপে নিজেদের তুলে ধরেছেন তাদের ক্ষেত্রেও একথা বলা যায়। যে বিষয়বস্তুর সাথে সম্পর্ক বাইরের তার প্রতি প্রকৃত আকর্ষণ কতটুকু তার ওপর যথার্থ সাফল্য নির্ভর করে। সফল রাজনীতিবিদদের বেলায় দেখা যায় সেই বিয়োগান্ত নাটক। কারণ তাদের নিজের সমাজের প্রতি যে আকর্ষণ এবং যে অব্যবস্থা দূর করবেন বলে তিনি দাঁড়ান, তার পরিবর্তে তার মধ্যে আত্মপ্রেম জেগে ওঠে এবং তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন শুধু নিজের জন্যে। তাই তিনি আর শ্রদ্ধা পাবার যোগ্য থাকেন না, কেউ তাকে শ্রদ্ধাও করে না। যে ব্যক্তির একমাত্র ভাবনা যে পৃথিবীর সব লোক তার প্রশংসা করুক, তার পক্ষে লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। যদি তা সম্ভবও হয় তবুও তিনি পুরোপুরি সুখী হতে পারবেন না, কারণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি কখনো সম্পূর্ণ আত্মকেন্দ্রিক নয়। একজন আত্মপ্রেমিক নিজেকে কৃত্রিমভাবে একটি সীমার মধ্যে ততটুকু আবদ্ধ করেন যেটুকু করেন একজন পাপবোধে তাড়িত ব্যক্তি। আদিম মানুষ ভাল শিকারী বলে হয়তো গর্বিত ছিল, কিন্তু শিকারকে অনুসরণ করার মধ্যে যে উদ্দীপনা তা সে উপভোগ করত। আত্মতৃপ্তি বিশেষ একটা সীমা লঙ্ঘন করলে তার নিজের দোষে সব কাজেই আনন্দকে নষ্ট করে দেয়, যা তখন পৌঁছে যায় উদাসীনতা আর একঘেয়েমিতে। প্রায় ক্ষেত্রে এর মূলে রয়েছে আত্মবিশ্বাসের অভাব যার প্রতিকার রয়েছে আত্মমর্যাদা বৃদ্ধির মধ্যে। কিন্তু এই আত্মমর্যাদা লাভ করার একমাত্র উপায় হচ্ছে সফল কাজের মধ্যে নিজেকে যুক্ত রাখা যার প্রেরণা পাওয়া যাবে বস্তুগত ব্যাপার থেকে।
আত্ম-অহংকারীর সঙ্গে আত্মপ্রেমিকের পার্থক্য হচ্ছে, তিনি আকর্ষণীয় হওয়ার চেয়ে বেশি চান ক্ষমতাবান হতে। তারা চান লোকে তাদের ভালবাসার চেয়ে ভয় করুক বেশি। বহু উন্মাদ এবং ইতিহাস প্রসিদ্ধ অধিকাংশ মহৎ ব্যক্তি এই শ্রেণীতে পড়েন। মিথ্যা অহংকারের মতো ক্ষমতার প্রতি ভালবাসা সাধারণ মনুষ্য-চরিত্রের একটি প্রবল উপাদান এবং তাকে সেইভাবেই গ্রহণ করতে হবে। যখন এর মাত্রা অত্যাধিক বৃদ্ধি পায় অথবা অসম্পূর্ণ বাস্তববোধের সাথে যুক্ত হয়ে যায়, তখন-ই তা মারাত্মক হয়ে ওঠে। আর তা ঘটলে মানুষ অসুখী বা নির্বোধ হয়। যদি দুটো–ও হয়, যে উন্মাদ নিজেকে মুকুটধারী রাজা মনে করছে, একদিক থেকে তিনি অবশ্য সুখী। কিন্তু তা এমন নয় যা কোনও প্রকৃতিস্থ ব্যক্তি ঈর্ষা করবে। মনস্তত্ত্বের দিক দিয়ে ‘আলেকজান্ডার দি গ্রেট’(২) উন্মাদের সমগোত্রীয়, যদিও তিনি উন্মাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার ক্ষমতা রাখতেন। কিন্তু নিজের স্বপ্ন সফল করতে তিনি পারতেন না, কারণ তা তাঁর সাফল্যের সাথে সাথে অতিমাত্রায় বেড়ে গিয়েছিল। যখন এ বিষয়ে আর দ্বিধা ছিল না যে ইতিহাসের পরিচিত কালে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ বিজয়ী, তখন তিনি ভাবলেন যে তিনিও একজন ঈশ্বর। তিনি কী একজন সুখী মানুষ ছিলেন? তাঁর মাদকাসক্তি, উগ্র ক্রোধ, নারীর প্রতি ঔদাসীন্য এবং তাঁর দেবত্বের দাবি, এসব থেকে বোঝা যায় তিনি তা হতে পারেননি। মানব প্রকৃতির অন্যসব উপাদান বাদ দিয়ে কোনও একটি বিশেষ উপাদানের অনুশীলন করলে শেষ পর্যন্ত সুখী হওয়া যায় না। সাধারণত আত্মগর্বী ব্যক্তি হলে, তা সে উন্মাদ হোক বা নামমাত্র প্রকৃতিস্থ হোক, অতিরিক্ত অবমাননা থেকে জাত হীনতাবোধের ফল। স্কুলে নেপোলিয়ন(৩) সহপাঠীদের তুলনায় হীনমন্যতাবোধে ভুগছিলেন। কারণ তিনি ছিলেন দরিদ্র বৃত্তিধারী ছাত্র, আর সহপাঠীরা ছিলেন অভিজাত বংশের। তারপর তিনি যখন দেশত্যাগী রাজানুগতদের ফিরে আসার অনুমতি দিলেন তখন তাঁর প্রাক্তন স্কুল সহপাঠীদের তার সামনে মাথা নত করে অভিবাদন করতে দেখে তৃপ্তি লাভ করেছিলেন। কী স্বর্গীয় আনন্দ! তবুও তিনি জার (রাশিয়ার সম্রাট)-কে পরাজিত করে তা থেকেও একই ধরণের আনন্দ পেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু এই অভিযান শেষ পর্যন্ত তাঁকে সেন্ট হেলেনায় নির্বাসনে নিয়ে যায়। কোনও মানুষই সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হয় না। সেজন্যে যে জীবন ক্ষমাপ্রিয়তার প্রভাবে পড়ে কোনও না কোনও দিন তাকে দুরতিক্রম্য বাধার সামনে পড়তেই হয়। এমনটি যা ঘটতে পারে সে জ্ঞান পাছে চেতনাকে গ্রাস করে, তাই তাকে আটকাতে হয় এক ধরণের পাগলামির সাহায্যে। যদি কোনও ব্যক্তি প্রচুর ক্ষমতার অধিকারী হন, তা হলে যদি কেউ তার ভুল ধরিয়ে দেন তখন তিনি তাঁকে কারাগারে প্রেরণ অথবা মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করতে পারেন। রাজনৈতিক দমন এবং মনোবিকলন অর্থে দমন হাত ধরে চলে। যখনই কোথাও মনোবিকলিক দমন স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তখনও প্রকৃত সুখের অভাব দেখা যায়। ক্ষমতাকে নিজের সীমার মধ্যে আবদ্ধ রাখলে সুখ বৃদ্ধিতে অনেকভাবে সাহায্য করে। কিন্তু তাকে জীবনের চরম লক্ষ্য করলে তার ফল বিপদ ডেকে আনতে পারে, বাইরের দিক থেকে না হলেও অন্তরের দিক থেকে।
এটা স্পষ্ট যে, অতৃপ্তির মনস্তাত্ত্বিক কারণ অনেক এবং নানা ধরণের । কিন্তু তাদের মধ্যেও একটা মিল আছে। জন্ম-অসুখী তাকেই বলা হয় যে প্রথম জীবনে কোনও স্বাভাবিক কামনার সহজ পরিতৃপ্তি থেকে বঞ্চিত হয়েছে। পরে সেই একটিমাত্র কামনার পরিতৃপ্তিকেই অন্য আর সব কিছুর চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। ফলে সে তার জীবনকে একটিমাত্র দিকেই চালিত করেছে। কামনার সাথে প্রস্তুতির ওপরেই অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়েছে, তার সাথে যুক্ত আনুষাঙ্গিক উপকরণসমূহকে অগ্রাহ্য করে। বর্তমানে আর এক নতুন ব্যাপার দেখা যাচ্ছে, কোনও ব্যক্তি নিজেকে কোনও বিষয়ে অতি পরাজিত মনে করার ফলে কোনও পথেই তৃপ্তিকে খুঁজে না পেয়ে খুঁজতে শুরু করেছে চিত্তবিক্ষেপ আর বিস্মৃতিকে। এরপর সে সহজ আনন্দের অনুসারী হয়ে উঠবেই। এর অর্থ হল সে নিজেকে অর্ধমৃত করে জীবনকে সহনীয় করে তোলার চেষ্টা করে। উদাহরণস্বরূপ মাতলামির কথা বলা যায়, যা হল সামাজিক আত্মহত্যা। মাতলামি থেকে যে সুখ পাওয়া যায় তা শুধুই নেতিবাচক, অতৃপ্তিকে সাময়িকভাবে ভুলে থাকা। আত্মপ্রেমী এবং আত্মগর্বী লোক অন্তত বিশ্বাস করে সুখ লাভ করা সম্ভব, যদিও তা পাওয়ার জন্যে তারা ভুল পথ অবলম্বন করে। কিন্তু যে লোক নেশার পথে এগিয়ে যায়, যে নেশাই তা হোক সে সবছির ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে শুধুমাত্র বিস্মৃতি ছাড়া। তার ক্ষেত্রে প্রথম কর্তব্য হচ্ছে তাকে বুঝিয়ে দেওয়া যে, সুখ অবশ্যই প্রত্যেকের কাম্য। নিদ্রাহীন ব্যক্তি যেমন নিদ্রাহীনতার জন্যে গর্বিত, অসুখী ব্যক্তি তেমনি অসুখী হওয়ার জন্যে সবসময় গর্বিত থাকে। দারিদ্রের অহংকার, অতৃপ্তির অহংকার এসব কিছুই মনে হয় সেই লেজকাটা খেকশিয়ালের মতোই অহংকারের। যদি তা সত্যি হয় তাহলে তার প্রতিবিধান হল নতুন লেজ গজানোর শিক্ষা দান করা। যদি তারা সুখের পথ দেখতে পায়, তাহলে আমার বিশ্বাস, খুব কম মানুষই স্বেচ্ছায় অসুখী হওয়ার পথ বেছে নেবে। এমন লোক যে রয়েছে তা আমি অস্বীকার করি না। কিন্তু তাদের সংখ্যা এত বেশি নয় যে তাকে গুরুত্ব দিতে হবে। আমি তাই ধরে নেব যে, পাঠকেরা অসুখী হওয়ার চেয়ে সুখী হতেই চাইবেন। আমি জানি না এ বিষয়ে বুঝতে তাদের কোনও সাহায্য করতে পারব কিনা, কিন্তু এই ধরনের যে কোনও প্রচেষ্টা তাদের কোনও ক্ষতি করবে না।
——–
১. কবি ব্লেক- William Blake (১৭৫৭-১৮২৭) অষ্টাদশ শতকের কবি। যুক্তিবাদকে অস্বীকার করে অতীন্দ্রিয়বাদকে অবলম্বন করে কাব্যসাধনা করেছেন। রাসেলের উদ্ধৃতি “Auguries of Innocence” কবিতা থেকে গ্রহণ করা হয়েছে।
২. আলেকজান্ডার : Alexander the Great (খ্রিঃ পূঃ ৩৫৬-৩২৩)। সম্রাট ফিলিপের পুত্র, বিশ্ববিখ্যাত দিগ্বিজয়ী, দার্শনিক অ্যারিস্টটল তাঁর গৃহশিক্ষক ছিলেন।
৩.নেপোলিয়ন, Napolean Bonaparte (১৭৬৯-১৮২১)। ফরাসী জেনারেল, পরে কনসাল এবং সম্রাট। ইউরোপের ইতিহাসে সুবিখ্যাত এক নাম। শেষ জীবন কাটে বন্দীদশায়-সেন্ট হেলেনা দ্বীপে। সেখানেই মৃত্যু।