ষাট কেজি ওজনের একটা টিপিক্যাল স্তন্যপায়ীর মস্তিষ্কের আয়তন হয় বড়জোর ২০০ সিসি। অথচ আড়াই মিলিয়ন বছর আগেই মানুষের মস্তিষ্কের আয়তন ছিল ৬০০ সিসি’র মত। কালের বিবর্তনে সেটা আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে ১৩শ’ কি ১৪শ’ সিসি।
এই বিরাট আয়তনের মস্তিষ্ক কিন্তু খুব কাজের কিছু না। বিশেষ করে যেখানে শরীরের সমস্ত ক্যালরির ২৫ পার্সেন্ট সে একাই খরচ করে। এর ফলে মানুষকে দু’ভাবে মূল্য দিতে হয়েছে। এক, মস্তিষ্কের এই খাই খাই মেটানোর জন্য তাকে বেশি বেশি খাদ্যের সন্ধানে বেরোতে হয়েছে। আর মস্তিষ্ককে বেশি খাওয়াতে গিয়ে হাত-পায়ের মাংসপেশীর ভাগে খাবার পড়েছে কম।
ফলে, দিনে দিনে মানুষের মস্তিষ্ক প্রখর হয়েছে বটে। কিন্তু হাত-পা হয়ে গেছে দুর্বল। আমাদের বাপ-দাদাদের তুলনায় আমরা যে শারীরিকভাবে দুর্বল—এতে আর আশ্চর্য কী!
আজকাল না হয় আমরা বড় মস্তিষ্কের সুবিধা ভোগ করছি। মস্তিষ্ক খাটিয়ে বন্দুক আবিষ্কার করেছি। সেই বন্দুক দিয়ে জিম করবেটরা বাঘ-ভাল্লুক মারছেন। কিন্তু ইতিহাসের দীর্ঘ সময় জুড়ে তো আমাদের কাছে তীর-ধনুকের চেয়ে বেশি কিছু অস্ত্রপাতি ছিল না। মস্তিষ্কের খুব কমই আমরা ব্যবহার করেছি সেই সময়টায়। এই বিরাট মস্তিষ্ক তাই এক রকম বোঝাই ছিল আমাদের জন্য। তারপরও ক্রমাগত দুই মিলিয়ন বছর জুড়ে মস্তিষ্কের সাইজ কেন বেড়ে চললো? ফ্র্যাঙ্কলি, এর উত্তর আমারা জানি না।
স্তন্যপায়ীদের সাথে আমাদের আরেকটা পার্থক্য তৈরি হয় আমরা যখন শিরদাঁড়া সোজা করে দু’পায়ে দাঁড়াতে শিখি। এই দাঁড়ানোর ফলে আমরা কিছু এ্যাডেড বেনিফিট প্পাই। দাঁড়াতে শেখায় আমরা দূর থেকেই শত্রুকে সনাক্ত করতে শিখি। সেই সাথে হাত দিয়ে পাথর ছুঁড়ে শত্রুকে ঘায়েল করতে শিখি।
এটা একটা পজিটিভ ফিডব্যাক লুপের মত। হাত দিয়ে কাজের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় হাতের শিরায় শিরায় নার্ভের পরিমাণ বেড়ে যায়। আর নার্ভের পরিমাণ বাড়তে থাকায় হাত দিয়ে আমরা আরো আরো কমপ্লেক্স কাজ করতে শিখি। পাথর ছোঁড়া ফেজ পেরিয়ে আমরা তীর-ধনুকের মত সফিস্টিকেটেড হাতিয়ার ডিজাইন করা শিখি।
কিন্তু সবকিছুরই একটা উলটো দিক আছে। দাঁড়াতে শেখার ফলে মানুষের পিঠে ভালো প্রেশার পড়ে। দেখা দেয় মেরুদন্ড ও ঘাড়ের ব্যথার মত অভূতপূর্ব সমস্যা । বলা বাহুল্য, এতো ভারী একটা মাথাকে বহন করা কিন্তু সহজ কাজ নয়। মানুষের মাথার ওজন সমস্ত শরীরের ওজনের ২-৩%। শুনে কম মনে হচ্ছে তো? কিন্তু আমাদের ভাই-বেরাদরদের সাথে তুলনা করলে বুঝবেন, এটা কতো বেশি! যেখানে গরিলার ক্ষেত্রে এর মান মাত্র ০.২% আর শিম্পাঞ্জীর ক্ষেত্রে ০.৮%।
একে তো মাথার ভার বেশি। সেই ভার বহন করা মুশকিল, তার উপর সেটা যদি দাঁড়ায়ে বহন করতে হয়। আমরা এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি দেখে ব্যাপারটা গায়ে লাগে না। কিন্তু একটু চোখ বন্ধ করে ভেবে দেখুন। এতো ভারী একটা জিনিস আপনি অনন্তকাল ধরে দাঁড়িয়ে বহন করছেন। নিজের সামর্থ্যের প্রতি একটা অন্যরকম শ্রদ্ধা চলে আসবে।
দাঁড়াতে শেখায় সবচেয়ে বেশি মূল্য দিতে হয়েছে নারীদের। এর ফলে নারীদের শ্রোণীদেশ দিন দিন সরু হয়ে যাচ্ছিল। সেটা সমস্যা না। সমস্যা হল, এর ফলে বাচ্চা জন্মাবার রাস্তাও দিন দিন সরু হয়ে যাচ্ছিল। এদিকে বাচ্চাদের মাথার সাইজ জেনারেশন থেকে জেনারেশনে বড় হচ্ছে। মাথার সাইজ বাড়ছে, কিন্তু সেই মাথা বের হবার রাস্তা দিনকে দিন ছোট হচ্ছে। প্রসবকালীণ শিশু ম্ত্যুর ব্যাপকতা তাই মানব জাতির জন্য একটা বিরাট কনসার্ন হয়ে দেখা দিল।
দেখা গেলো, যেসব মা বাচ্চা জন্ম নেবার নরমাল সময়ের আগেই বাচ্চা ডেলিভারী দিচ্ছেন, তাদের বাচ্চা বেঁচেবর্তে উঠছে। দেরি করলেই মা-শিশু দু’জনই মারা খাচ্ছে। কাজেই, ন্যাচারাল সিলেকশন বলে—তাড়াতাড়ি বাচ্চা মায়ের পেট থেকে বের হওয়াই ভালো।
তাড়াতাড়ি বাচ্চা বের হতে গিয়ে আরেক সমস্যা দেখা দিল। এই শিশুদের শরীরের বেশ কিছুত গুরুত্বপূর্ণ অংশই তখনো আন্ডার-ডেভেলপড। অন্য প্রাণীদের বাচ্চারা যেখানেই জন্মের পরপরই মোটামুটি হাঁটতে-দৌড়ুতে পারে, মানব শিশু সেখানে নেহাতই বোকাচ্চো।
এতে অবশ্য আমাদের একটা লাভ হয়েছে। মা যেহেতু একা শিশুটির খাবারের সংস্থান করতে পারছে না, সেই খাবার যোগাড়ের জন্য একজন বাবা’র প্রয়োজন দেখা দিচ্ছে। বায়োলজিক্যাল বাবা না, সামাজিক বাবা। যে মা ও শিশুটার জন্য বনেবাদাড়ে যুদ্ধ করে খাবার নিয়ে আসবে। আবার শিশু জন্মের পর পর মা-বাবা দু’জনের পক্ষেও অনেক সময় সেই দুর্বল শিশুটার সব প্রয়োজন মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য তাদের আশেপাশের মানুষের সাহায্য প্রয়োজন। এই সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে তাদের বন্ধুবান্ধব, পরিচিতজন। এইভাবে একটা শিশুকে মানুষ করার জন্য যে সোশ্যাল নটটা গড়ে উঠছে—তাই পরবর্তীতে গোত্র বা গোষ্ঠী গঠনে সাহায্য করবে। আর মানুষকে এগিয়ে দেবে বহুদূর।
আমরা যখন নিজেদের মানুষ বা হোমো সেপিয়েন্স হিসেবে পরিচয় দিই, তখন নিজের অজান্তে আমরা স্বীকার করে নিই যে, আমরা ছাড়াও এ প্থিবীর বুকে আরো নানা প্রজাতির মানুষ ছিল। কেননা, Homo মানে মানুষ আর Sapiens মানে জ্ঞানী। আমরা হলাম গিয়ে জ্ঞানী মানুষ। আমরা যদি জ্ঞানী মানুষ হই, তবে তো কিছু মূর্খ, জ্ঞানহীন মানুষের অস্তিত্ব্বও এ প্থিবীর বুকে ছিল। তারা তবে কই?
এই গল্পের শুরু দেড় লাখ বছর আগে। প্থিবীতে তখন রাজত্ব করছে কমসে কম ছয় রকমের মানুষ। এর মধ্যে তিন রকমের মানুষ সংখ্যায় ভারী। একদল—আমরা, মানে হোমো সেপিয়েন্সরা বসতি গড়েছি আফ্রিকার এক পূর্ব কোণে। নিয়েন্ডারথাল মানুষেরা ইউরোপে শীতের বিরুদ্ধে লড়ছে। আর এশিয়ার পূর্বকোণে হোমো ইরেক্টাস মানুষেরা সুখে শান্তিতে দিন গুজরান করে চলেছে।
আমরা মানে হোমো সেপিয়েনসরা আর আমাদের ভাই-বেরাদররা প্রত্যেকেই তখন আগুন ব্যবহার করতে শিখেছি। আমাদের মস্তিষ্কের সাইজও বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। অথচ এই মস্তিষ্ক নিয়েই আমরা আফ্রিকার এক পূর্ব কোণে পড়ে রয়েছি।
এই করে কেটে গেছে বহু বছর।
সত্তর হাজার বছর আগে একদল হোমো সেপিয়েন্স প্রথমে মধ্যপ্রাচ্যে, সেখান থেকে ইউরোপে ঢুকে পড়লো। এইখানে তাদের মোলাকাত হল নিয়েন্ডারথাল মানুষদের সাথে।
একে তো এরা ছিল আমাদের চেয়ে অধিক পেশীবহুল, অন্যদিকে এদের মস্তিষ্কও আমাদের চেয়ে সাইজে বড় ছিল। এমনকি টেকনোলজির দিক দিয়েও এরা এগিয়ে ছিল। এদের হাতিয়ার ছল উন্নতমানের। কাজেই, এরা বেটার শিকারী ছিল।
সামাজিক মূল্যবোধের দিক দিয়েও এরা আমাদের চেয়ে উঁচু মেন্টালিটির ছিল। ব্দ্ধ, অথর্বদের সেবাযত্নের কোনরকম ত্রুটি করতো না এরা। প্রত্নতাত্ত্বিকরা দিনরাত খোঁড়াখুঁড়ি করে এর সপক্ষে প্রমাণ হাজির করেছেন। তারা এমন কিছু নিয়েন্ডারথাল হাড়গোড় পেয়েছেন, যা কিনা ঐ লোকের শারীরিক ত্রুটিগস্ত হবার এবং সেই সাথে ঐ ত্রুটি নিয়েই বহু দিন বেঁচে থাকার প্রমাণ বহন করে।
যাই হোক, এরপর কী ঘটে? নিয়েন্ডারথালরা কি এই আগন্তুকদের সাদরে বরণ করে নেয় না বহিরাগত বলে যুদ্ধ ঘোষণা করে?
ফ্র্যাংক্লি, এর উত্তর আমরা জানি না।
তবে পরবর্তী ঘটনা ব্যাখ্যা করার জন্য দুটো হাইপোথেসিস আছে। একদল বলেন, সেপিয়েন্সরা আর নিয়েন্ডারথালরা একে অপরকে ভালবেসে সুখে-শান্তিতে বংশব্দ্ধি করিতে লাগিলো। আজকে আমরা যে লালমুখো ইউরোপিয়ানদের দেখি, তারা এই সেপিয়েন্স আর নিয়েন্ডারথালদের ভালবাসারই ফসল।
সেপিইয়েন্সরা যে খালি ইউরোপেই ভালবাসার বার্তা নিয়ে গেছে, তা কিন্তু নয়। এরা ছড়িয়ে পড়েছিল এশিয়ার পূর্বভাগেও। আজ আমরা যে চাইনিজ, কোরিয়ানদের দেখি তারা সেপিয়েন্স আর ঐ অঞ্চলে আগে থেকেই বসবাসরত হোমো ইরেক্টাসদের ভালবাসাবাসির ফল।
এটা যথেষ্ট অপ্টিমিস্ট থিওরি। এর বিপরীত থিওরিও আছে। এই থিওরী বলে, নিয়েন্ডারথাল রোমিও আর সেপিয়েন্স জুলিয়া যদি একে অপরের প্রেমে পড়েও, তাদের জেনেটিক দূরত্ব এতোই বেশি যে তাদের দ্বারা সন্তান উৎপাদন সম্ভব নয়। এই কারণেই হোক কিংবা অন্য কোন কারণেই হোক, দুই দলের মধ্যে এক রকম বৈরীভাব দেখা দিল। তার ফলস্বরূপ যুদ্ধ। যে যুদ্ধের মেয়াদ শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার আগ পর্যন্ত জারি থাকে।
মজার ব্যাপার হল, টেকনোলজিক্যালী নিয়েন্ডারথালরা এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও এই অস্তিত্বের যুদ্ধে তারা সেপিয়েন্সদের কাছে হেরে গেলো। এরপর থেকে ৭০ হাজার বছর ধরে সেপিয়েন্সরাই মানুষের ট্যাগ নিয়ে প্থিবী দাপিয়ে বেড়াতে লাগলো।
এই প্যাটার্ণটা প্থিবীর অন্য জায়গাতেও লক্ষ করা যায়। হোমো সেপিয়েন্সরা যেখানেই পৌঁছেছে, সেখানেই অন্য প্রজাতির মানুষেরা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এখন এটা গণহত্যার কারণে হয়েছে না কোন অন্য কোন কারণে হয়েছে—সেটা গবেষণার বিষয়। ইউরোপীয়রা যেমন আমেরিকান রেড ইন্ডিয়ানদের কেবল কামান দেগেই হত্যা করেনি, ইউরোপীয়রা নিজেদের শরীরে যে রোগবালাই’র জীবাণু সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল, রেড ইন্ডিয়ানদের মধ্যে সেইসব জীবাণুর বিরুদ্ধে কোন রকম প্রতিরোধ ক্ষমতা না থাকাতেও এরা কাতারে কাতারে মরেছে। নিয়েন্ডারথাল আর হোমো ইরেক্টাসদের ক্ষেত্রেও এমন কিছু ঘটা বিচত্র নয়।
তবে যদি গণহত্যা থিওরী সত্যি হয়ে থাকে, তবে বলতে হয়—ইতিহাসের প্রথম গণহত্যার নায়ক চেঙ্গিস খান বা হালাকু খান নয়, নায়ক আমরা এই হোমো সেপিয়েন্সরা। যার জন্য আমাদের আজও কোন কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়নি। আমাদের মধ্যে যে হিংস্র, খুনে মানসিকতা বসত গেড়ে আছে, তা মধ্যযুগ বা কোন আধুনিক অস্ত্রের দান নয়। সত্তর হাজার বছর ধরে এই খুনে উল্লাস আমাদের ধমনীতে বয়ে চলেছে। শিক্ষা, সংস্ক্তি, ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় ভয়ভীতি দিয়ে আমরা সেই খুনে সত্তাকে ঢেকে রাখি মাত্র।
একটা প্রশ্ন থেকেই যায়। নিয়েন্ডারথালরা যদি হোমো সেপিয়েন্সদের তুলনায় টেকনোলজিক্যালী এগিয়েই থাকে, তবে ওরা কেন নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল? নিশ্চিহ্ন তো হয়ে যাবার কথা আমাদের। প্থিবীর ইতিহাস তো তাই বলে। এই প্রশ্নের উত্তর না হয় আরেকদিন দেব (যদি আদৌ লেখা হয় আর কি।)
আগের দিন বলেছিলাম, নিয়েন্ডারথাল মানুষেরা হোমো সেপিয়েন্স মানুষদের চেয়ে শারীরিক শক্তিতে এগিয়ে আর টেকনোলজিক্যালী সমানে সমান থাকার পরও তারা এই সেপিয়েন্সদের হাতেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। কিন্তু কেনো? আজ সেই গল্পটাই বলবো।
নিয়েন্ডারথালদের সাথে সেপিয়েন্সদের প্রথম মোলাকাত হয় এক লক্ষ বছর আগে। মজার ব্যাপার হল, সেই মোলাকাত সেপিয়েন্সদের জন্য কোন সুখবর বয়ে আনেনি। উলটো নিয়েন্ডারথালদের দাপটে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। নিয়েন্ডারথালরা তাদের ভূমিতে, এখনকার মধ্যপ্রাচ্যে বউ-বাচ্চা নিয়ে সুখে-শান্তিতে বসবাস করতে থাকে।
এরপর কেটে গেলো তিরিশ হাজার বছর। আজ থেকে সত্তর হাজার বছর আগে সেপিয়েন্সরা তাদের দ্বিতীয় এ্যাটেম্পট নেয়। আবারও দলবল নিয়ে আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে পড়ে। অল্প সময়ের মধ্যেই এরা ইউরোপ আর এশিয়ার পূর্বভাগ দখল করে নেয়। নিয়েন্ডারথাল থেকে শুরু করে হোমো ইরেক্টাস—যতো রকম মানুষ ছিল, সবাইকে প্রথিবীর বুক থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। ৪৫ হাজার বছর আগে এদের একটা দল প্রথমবারের মত অস্ট্রেলিয়ায় পা রাখে। এই সময়কালেই এরা ডিজাইন করে নৌকা, তীর-ধনুক আর সুইয়ের মত চমৎকার সব যন্ত্রপাতি।
কথা হল—হঠাৎ করে মানুষের বুদ্ধি এতো বেড়ে গেলো কীভাবে?
হিস্ট্রি চ্যানেলের যে কোন প্রোগ্রামে দেখবেন, এই ব্যাপারটাকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ভিনগ্রহীদের আগমন দ্বারা। মিশরের পিরামিড থেকে শুরু করে পেরুর নাজকা লাইন পর্যন্ত সবকিছুই এই ভিনগ্রহীদের দান। তো এই ভিনগ্রহীরা এসে এইখানে বিয়েশাদি করছে। যেহেতু তারা আমাদের চেয়ে উন্নততর মগজের অধিকারী ছিল, সন্তান হিসেবে তাদের মগজের কিছু অংশ আমরা পেয়ে গেছি। কাজেই, আমরা হঠাৎ করে এতো বুদ্ধিমান হয়ে উঠেছি।
যে কোন ধর্মেই পুরাণে দেখবেন, দেবতার সাথে মানুষের বিয়ে হওয়ার একটা বেশ রেওয়াজ চালু ছিল। ধর্ম বলেন, রাষ্ট্র বলেন-সব জায়গাতেই দেবতার ঔরসজাত না হলে আপনি পাত্তাই পাবেন না—এমন অবস্থা। অনেক ক্ষেত্রে বিয়েতে রাজি না হলে দেবতাটি ছলে-বলে-কৌশলে শারীরিক সম্পর্ক আদায় করে নিতেন। জিউস যেমন। এখন কথা হচ্ছে, ভিনগ্রহীরা যদি সত্যিই এসে থাকে, তবে পুরাণে বর্ণিত এই দেবতারাই সেই ভিনগ্রহী নয় তো?
ভিনগ্রহী তত্ত্ব এখন পর্যন্ত মেনস্ট্রীম বিজ্ঞানের বাইরের জিনিস। মেইনস্ট্রীম বিজ্ঞানে আসি। বিজ্ঞান বলে, মানুষের হঠাৎ এই বুদ্ধি বেড়ে যাবার ব্যাপারটি নেহাতই জেনেটিক দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনা নিয়েন্ডারথালদের সাথেও ঘটতে পারতো। সেক্ষেত্রে হয়তো আজ নিয়েন্ডারথালরা আমাদের ফসিল নিয়ে ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করতো।
যাই হোক, এর ফলে একটা ভয়ংকর ব্যাপার ঘটে। আমাদের মস্তিষ্কের সা্র্কিটগুলো একেবারে বদলে যায়। আমাদের চিন্তা করার ক্ষমতা বেড়ে যায় অস্বাভাবিক ভাবে। চিন্তা হচ্ছে অনেকটা ফার্টের মত। চাইলেও একে বেশিক্ষণ আটকে রাখা যায় না। এখন এই নতুন নতুন চিন্তাকে, মনের ভেতরকার ভাবনাকে প্রকাশ করার জন্য তো একটা মাধ্যম প্রয়োজন। সেই মাধ্যমটাই হল ভাষা। সাংকেতিক ভাষা না। একেবারে আদি ও অক্ত্রিম মুখের ভাষা।
এই মুখের ভাষা যে মানুষের একক আবিষ্কার, তা কিন্তু না। আমাদের দূর সম্পর্কের ভাই বানরও কিন্তু স্বল্প পরিসরে হলেও ভাষার ব্যবহার করে। গ্রীন মাঙ্কি নামক একটা প্রজাতির উপর গবেষণা করে বিজ্ঞানীরে দেখেছেন, এরা সিংহ দেখলে সব সময় একটা নির্দিষ্ট আওয়াজ করে। যার মানে, দ্যাখ, দ্যাখ। সিংহ মামা। ঈগল দেখলে সম্পূর্ণ অন্য রকম আওয়াজ করে। যার মানে সম্ভবত, দ্যাখ। দ্যাখ। ঈগল খালা।
মানুষ তাহলে ভাষা আবিষ্কার করে কী বিশেষ সুবিধাটা পেলো? সুবিধাটা এই যে, মানুষের যেহেতু বহু সার্কিটওলা একটি চমৎকার মস্তিষ্ক আছে, সে শব্দের পর শব্দ জোড়া লাগিয়ে সবকিছু অনেক ডিটেইলস বলতে পারে। আমাদের বানর বন্ধু যেখানে বলবে, দ্যাখ, দ্যাখ, সিংহ, সেখানে আমরা বলবো—“পালা মামা, পালা। তোর দশ হাত পিছনে সিংহ।”
তারপর যদি সে বেঁচেবর্তে ফিরতে পারে, সারা জীবন তার জ্ঞাতিগোষ্ঠীর কাছে এই গল্প করে বেড়াবে। কোথায়, কখন সে সিংহটিকে দেখেছিল, সিংহটির গায়ের রঙ কী ছিল, কীভাবে সে বেঁচে ফিরেছে—সব। আর এই করে সেই গোষ্ঠীতে জন্ম নিবে একটি কমন মিথের। এই মিথগুলোই জন্ম দেবে ধর্ম আরা জাতীয়তাবাদের মত মজবুত প্রতিষ্ঠানের।
অনেকে অবশ্য ভাষা আবিষ্কারের পেছনে অন্য একটা গল্পের কথা বলেন আমাদের। ইশারা-ইঙ্গিতে ভাব বিনিময় আমরা মোটামুটি চিরকালই করতে পারতাম। হালকা পাথর ছুঁড়ে শিকার করার যুগে ধরা যাক আপনার সাথে আপনার দলের একজনের দেখে হয়ে গেলো। আপনারা দূর থেকে হাত দিয়ে ওয়েভ করলেন। তাতেই আপনাদের ভাব বিনিময় হয়ে গেলো। সমস্যাটা দেখা দিল মানুষের হাতে যখন ভারী আর সফিস্টিকেটেড অস্ত্র উঠে এলো। তার হাত দুটো অস্ত্র সামলানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। এখন অনতিদূরে তার সহচরের সাথে যোগাযোগের উপায় কী? সে তখন তার ভোকাল কর্ডের সাহায্য নিল। মুখ দিয়ে বিচিত্র শব্দ করে বুঝিয়ে দিল—সে এইখানে আছে। তার ছোট্টবন্ধুর ভয়ের কোন কারণ নেই। ধীরে ধীরে এই বিচিত্র শব্দগুলোই একটা স্ট্যান্ডার্ড প্লাটফর্মে এসে ভাষার রূপ নিল।
এই ব্যাপারটাই নিয়েন্ডারথালদের বিরুদ্ধে আমাদের এগিয়ে দিয়েছে। ওদের ভাষা ছিল খুবই প্রিমিটিভ গোছের। দ্যাখ, দ্যাখ, সিংহ আইলো টাইপ। আমরা ততোদিনে কিছুটা সফিস্টিকেটেড ভাষা রপ্ত করে ফেলেছি। আর আপনি যতো কমপ্লেক্স ভাষা রচনা করতে পারবেন, আপনার পক্ষে প্ল্যান-প্রোগ্রামও করা ততো সুবিধা হবে। দ্বিতীয়বার যখন হোমো সেপিয়েন্সরা নিয়েন্ডারথালদের মোকাবেলা করে, সেই মোকাবেলা শুধু অস্ত্রের মোকাবেলা ছিল না। সেটা ছিল ভাষা নামক নতুন টেকনোলজির অস্তিত্বের জন্য এক বড় রকমের পরীক্ষা।
নিয়েন্ডারথালরা যেখানে তাদের বেসিক ইন্সটিংক্ট দিয়ে আমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, আমরা সেখানে যথেষ্ট হোমওয়ার্ক করে ময়দানে গিয়েছি। হয়তো একজন দলছুট হয়ে বিপদে পড়েছে। সে চিৎকার করে ডাক দিয়েছে—“ওরে রাম, শ্যাম, যদু, মধু—এই আমগাছের তলায় আয়। আমারে বাঁচা।” সঙ্গে সঙ্গে রাম, শ্যাম, যদু, মধু তাঁকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে। আর এইখানেই নিয়েন্ডারথালরা পিছিয়ে পড়েছে। নিজেদের মধ্যে কম্যুনিকেশন স্যাটেলাইট গড়ে তুলতে না পারায় তারা বহুদিনের অধিক্ত ইউরোপ তো হারিয়েছেই, সেই সাথে নিজেরাও হারিয়ে গেছে।
ভাষার উত্থানের পেছনে আরেকটা থিওরি আছে। আর এটাই সবচেয়ে জোরালো থিওরি। এই থিওরি বলে, মানুষের বেঁচে থাকার জন্য সিংহ আইলো কি আইলো না—এটা জানা যতোটা জরুরী, তার চেয়ে অনেক বেশি জরুরী তার পাশের মানুষটা তার আড়ালে কী করছে, কী ভাবছে, কার সাথে শুচ্ছে—এইসব জানা। এইসব খবর সংগ্রহের জন্য তাকে ত্তীয় আরেকটা মানুষের সাথে কথা বলতে হবে; সোজা কথায় পরচর্চা করতে হবে। পরচর্চা থেকেই সে জানতে পারবে—তার দলের কোন লোকটা ভাল মানুষ আর কোন লোকটা দুই নম্বর। কাকে বিশ্বাস করা যায় আর কাকে করা যায় না।
শুনতে অদ্ভূত শোনালেও তথ্যপ্রমাণ এটাই বলে, পরচর্চাই আদিম মানুষের ভাষার বুনিয়াদ গড়ে তুলেছে। ছোট ছোট দল বা গোষ্ঠীকে একত্র করে গড়ে তুলেছে স্থায়ী, বড় সমাজ। এমনকি আজকের যুগেও এটা সত্য। পাঁচজন প্রফেসর যখন কোথাও ডিনার করতে যান, তারা যে সবসময় বিজ্ঞান নিয়েই কথা বলেন—তা কিন্তু না। ডিপার্টমেন্টের হেড নতুন জয়েন করা সেক্রেটারিরি সাথে শুচ্ছে কিনা—এটাও তাদের আলোচ্য বিষয়বস্তুতে থাকে।
সম্ভবত, নিয়েন্ডারথালদের সমাজে হায়ারার্কি বা জটিলতা সব কিছুই অনেক কম ছিল। একে অন্যের পিঠে কথা বলার রেওয়াজ তাদের মধ্যে চালু হয়নি। ফলে, তাদের ভাষাও সেভাবে ডেভেলপ করেনি। যার মূল্য তাদের দিতে হয়েছে নিজেদের অস্তিত্ব দিয়ে। আহারে বেচারারা! সময় থাকতে পরচর্চা করলে আজ ওদের এই দুর্দিন দেখতে হত না।
গল্প বলা খুব কঠিন একটা কাজ। খুব কম মানুষই এটা পারেন।
মানুষ যখন ভাষা আবিষ্কার করলো, মোটামুটি সেই মুহূর্ত থেকেই সে গল্প বলতেও শুরু করলো। আর এই গল্প বলার মধ্যে দিয়ে সে এক নতুন রিয়েলিটি তৈরি করলো তার চারপাশে। এই রিয়েলিটির নাম সাবজেক্টিভ রিয়েলিটি। এতোদিন সে অবজেক্টিভ রিয়েলিটির কারাগারে বন্দী ছিল। ভাষা তাকে হঠাৎ মুক্তির স্বাদ এনে দিল।
আমরা সাধারণ মানুষ যখন একটা গাছ, পাথর কিংবা লতাপাতা দেখি, সেটা আমাদের কাছে গাছ, পাথর কিংবা লতা-পাতাই। কিন্তু বিভূতিভূষণ যখন ঠিক সেই একই গাছপাতা দেখেন, তখন সেটা হয়ে যায় স্বপ্ন ও বাস্তবতার মাঝামাঝি এক অসাধারণ গল্প।
আমরা একটা বেকার, ভবঘুরে ছেলেকে প্রতিদিনই দেখি চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে, একা একা রাস্তায় হেঁটে বেড়াতে। সেই ছেলেটিকেই যখন হুমায়ূন আহমেদ দেখেন, সেটা হয়ে যায় সমাজ বাস্তবতার এক রুদ্ধশ্বাস গল্প। গল্পকাররা এভাবেই চিরকাল অবজেকটিভ রিয়েলিটি-কে সাবজেক্টিভ রিয়েলিটিতে- নিয়ে যাবার কাজটি চমৎকারভাবে করে যাচ্ছেন।
কথা হচ্ছে, গল্প বলে লাভটা কী? আধুনিক গল্পকাররা না হয় গল্প লিখে দুটো টাকাপয়সা পান। ঈশপ বা হোমাররা তাও পেতেন না। তাদের সম্বল ছিল গল্প বলে পাওয়া খ্যাতিটুকু। শ্রোতা কিংবা পাঠকরাও না হয় গল্প শুনে ক্ষণিকের আনন্দ পায়। কিন্তু গল্পের ভূমিকা কি এই ক্ষণিকের আনন্দ দানেই শেষ?
উহুঁ। আমাদের আজকের অস্তিত্বের পেছনেই এই গল্পের একটা বড়সড় ভূমিকা আছে।
আমরা যখন গল্প বলি, সেটা আমাদের অজান্তে আমাদের মধ্যে একটা মিথের জন্ম দেয়। এই মিথই আমাদের মধ্যে সামাজিক বন্ধন বাড়ায়। আপনি যদি ছোটবেলায় আপনার দাদী কিংবা নানীর কাছে থেকে ভূতের গল্প শুনে থাকেন, আপনি ব্যাপারটা রিলেট করতে পারবেন। দাদী বা নানীর কিছুই হয়তো আপনার মনে নেই, কিন্তু তার মুখে শোনা ঐ গল্পগুলো মনে আছে। আপনার নানু কোন ব্র্যান্ডের পান কঝেতো, আপনার মনে নেই। কিন্তু যখনই ঐ গল্প বলা সন্ধ্যের কথা মনে পড়ে, অজান্তে আপনার গলা ভারী হয়ে আসে। আপনি যখন একজন মুক্তিযোদ্ধার কাছে অপারেশনের কাহিনী শুনবেন, অজান্তেই আপনার রোমকূপগুলো দাঁড়িয়ে যাবে। মনে হবে, এখনই যুদ্ধে চলে যাই।
গল্পের নানী কিংবা মুক্তিযোদ্ধার ঐ গল্প কেবল যে মিথের জন্ম দিচ্ছে, তা না। জন্ম দিচ্ছে সমাজ ও প্রতিষ্ঠানের। নানীর মুখে বলা গল্প আপনাকে আপনার মায়ের সাথে আরো ঘনিষ্ঠ করছে। আপনারা দু’জন গল্প করার একটা কমন প্লাটফর্ম খুঁজে পাচ্ছেন। মুক্তিযোদ্ধার ঐ গল্প আপনাকে বাংলাদেশী হিসেবে গর্বিত করছে। শত সমস্যার মধ্যেও এই দেশটা যে আপনার, আবারো কোনদিন বর্গী এলে আপনাকেই যে অস্ত্র হাতে দাঁড়াতে হবে—এই বোধে উদ্দীপ্ত করছে। গল্প বা মিথ অচেনা দু’জন মানুষকে এক প্লাটফর্মে এনে দাঁড় করায়। এই প্লাটফর্মকেই আমরা দেশ, কাল, জাতীয়তাবোধ—নানা নামে আখ্যায়িত করি।
ধর্ম বলেন, সমাজ বলেন, প্রতিষ্ঠান বলেন—অবজেক্টিভ প্থিবীতে এদের কোন অস্তিত্ব নেই। এদের অস্তিত্ব পুরোটাই আমাদের মনে। আমরা গল্প আর মিথ মিলিয়ে আমাদের চারপাশে একটা সাবজেক্টিভ রিয়েলিটি তৈরি করেছি। সেই রিয়েলিটি-তে যখন আমাদের মত আরো হাজার কিংবা লাখখানেক মানুষ বিশ্বাস স্থাপন করেছে, তখন সেটা পরিণত হয়েছে ইমাজিনড রিয়েলিটি-তে।
শুনে হাসতে পারেন, বাংলাদেশ বলে কোন দেশ কিন্তু আসলে নেই। দেশ আছে আমাদের ষোল কোটি মানুষের ইমাজিনড রিয়েলিটি-তে। একইভাবে, ব্র্যাক বলে কোন প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব কিন্তু বাস্তবে নেই। এটা পুরোপুরিই ফজলে হাসান আবেদের তৈরি একটা মিথ। ভদ্রলোক মিথ তৈরি করেই থেমে থাকেননি। সেই মিথকে নিজ কর্মের মাধ্যমে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছেন দিনে দিনে। তার তৈরি করা সাবজেক্টিভ রিয়েলিটি এক সময় অংশ হয়ে গেছে আমাদের দৈনন্দিনতার। আমরা নিজের অজান্তে হয়ে গেছি একটি ব্হৎ ইমাজিনড রিয়েলিটির অংশ। আর মানুষের স্বভাবই হচ্ছে এই যে—সে নিজেকে ইমাজিনড রিয়েলিটির অংশ ভাবতে ভালোবাসে। কেউ তাই মুসলিম পরিচয়ে গর্ববোধ করে, কেউ বাংলাদেশী পরিচয়ে আর কেউ কানাডা-অস্ট্রেলিয়ায় পিআর পেলে।
আপনার বর্তমানেও এই গল্পগুলো একটা ভূমিকা রেখে চলে। আপনি হয়তো ব্র্যাক বা বাংলালিঙ্কে জব করেন। আপনার টিম লীডার সপ্তাহের শুরুতে আপনাদের একটা গল্প বলেন। এইভাবে এইভাবে কাজ করলে আমরা প্রজেক্টটা পাব কিংবা প্রবলেমটা সল্ভ করতে পারবো। টিম লীডারের কাজ আপনাদের চারপাশে একটা মিথ তৈরি করা। প্রজেক্টটা পেলে বা প্রবলেমটা সমাধান হলে সমাধান হলে আমরা সবাই হয়তো একদিন ব্যাটন রুজে খেতে যাবো। কিংবা আমাদের কারো কারো প্রমোশন হবে। আমরা একটা ফ্ল্যাট বুকিং দিতে পারবো। কিংবা গাড়ির জন্য লোন নিতে পারবো। এই ব্যাপারগুলো ইমপ্লিসিট থাকে। কিন্তু টিম লীডার লোকটা যদি একজন ভালো গল্প বলিয়ে হন, তিনি আপনার মধ্যে এই স্বপ্নগুলো ঢুকিয়ে দিতে পারবেন। আপনি আর আপনার কলিগেরা মিলে তখন জীবন যৌবন ভুলে প্রজেক্টের জন্য কাজ করবেন। আর এইভাবেই একটা ভালো গল্প বা মিথ আমাদের মধ্যে স্বার্থের হলেও একটা বন্ধন তৈরি করে দিবে।
পশুরা এমনকি স্তন্যপায়ীরাও এই মিথ তৈরি করতে পারে না বলে তাদের সমাজে কোন দ্রুত কোন পরিবর্তন আসে না। শিম্পাঞ্জীরা যেমন একজন আলফা মেইলের নেত্ত্বে জীবনযাপন করে। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তারা তাই করে আসছে। মানুষ কিন্তু এমন না। কেবল গল্প বলেই তারা সমাজের খোলনলচে পালটে দিতে পারে। রুশো ভলতেয়াররা জাস্ট গল্প বলেই ফ্রেঞ্চ বিপ্লবের মঞ্চ প্রস্তুত করে দিয়েছিলেন। যুগের পর যুগ ধরে ফ্রেঞ্চ জনগণ বিশ্বাস করতো—সম্রাটই সকল ক্ষমতার উৎস। রুশো, ভলতেয়ারের গল্প পড়ে তাদের মনে হল, রাজা নয়, তারা, সামান্য মানুষেরাই আসলে সকল ক্ষমতার উৎস। ফলাফল? মাস তিনেকের ব্যবধানে তারা রাজতন্ত্রকে ছুঁড়ে ফেলে দিল ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে।
মানুষের এই এক অদ্ভূত ক্ষমতা। মানুশ স্রেফ গল্প বলেই হাজার বছরের প্রথা ও সংস্কার ভেঙে দিতে পারে। শিম্পাঞ্জীদের সমাজে কখনো দেখবেন না আলফা মেইলের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে কেউ গণতান্ত্রিক সমাজের প্রবর্তন করেছে। ওদের যে গল্প বলার কেউ নেই।
এই ব্যাপারটাই নিয়েন্ডারথালদের বিরুদ্ধেও আমাদের এগিয়ে দেয়। নিয়েন্ডারথালরা যেখানে একা একা কিংবা ছোট ছোট গ্রুপে শিকার করতে যেতো, আমরা যেতাম বড়সড় দল বেঁধে। তারপর টার্গেটকে চারপাশ থেকে ঘিরে ধরতাম। একা একটা নিয়েন্ডারথালের সাথে আমাদের পারার কথা না। সেই আমরাই যখন দল বেঁধে এগোতাম, কোন শক্তিই আমাদের দাবায়ে রাখতে পারতো না।
নিয়েন্ডারথালরা হয়তো একে অন্যকে বলতে পারতো—শত্রুর অবস্থান কোথায়। কিন্তু আমরা জানতাম গল্প বুনতে। সেই গল্প আমাদের ধমনীতে প্রবাহিত হয়ে আমাদের এক ‘ইউনিটি’র স্বাদ দিত। যুদ্ধের ময়দানে চিরকালই অস্ত্রের চেয়ে এই ইউনিটি-টাই বেশি কাজ দিয়েছে। তা সে ভিয়েতনাম যুদ্ধই হোক কিংবা নিয়ান্ডারথালদের বিরুধে হোমো সেপিয়েন্সদের লড়াই।
মানবজাতির এই দীর্ঘ ইতিহাসে আমাদের ডিএনএ’র তেমন কোন পরিবর্তন হয়নি, অথচ আমাদের ভেতরে বহু ওলট-পালট হয়ে গেছে। মানুষ এই ওলট-পালটে দিশেহারা হয়ে পড়ে না। কেননা, সে নিজেকে বদলে নিতে জানে। আরেকজনের বোনা মিথের সাথে সে অতি দ্রুত নিজেকে রিলেট করতে জানে।
ক্যাথলিক যাজকদের কথাই ধরুন না। এরা ধর্মের সেবায় চিরকুমার থাকার ব্রত নেন। অথচ মানুষের শরীরে ‘কুমার’ থাকার কোন জিন নেই। বরং শরীর জুড়ে কুমার না থাকার জিন আর হরমোনের ছড়াছড়ি। টেস্টোস্টেরন, ডোপামিন, সেরোটোনিন। ক্যাথলিক যাজকরা তবে কীভাবে এইসব জিন আর হরমোনের ফাঁদ এড়িয়ে চলেন? এর উত্তরও আমাদের খুঁজতে হবে ক্রিশ্চান মিথের মধ্যে। মিথের শক্তি অনেক সময় আমাদের জিন আর হরমোনের চেয়েও অনেক বেশি।
গল্প বলার আর মিথ তৈরি করার এই অদ্ভূত ক্ষমতা আছে বলেই মানুষ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এমন একটা লোকের কথা ভাবুন যার ১৯১৫ সালে জন্ম আর ২০১৫ সালে ম্ত্যু। এই লোক ব্রিটিশ আমলে পাকিস্তানের জন্য আন্দোলন করেছে, আবার পাকিস্তান আমলে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য আন্দোলন করেছে। সে হয়তো নব্বইয়ের গণআন্দোলনেও অংশ নিয়েছে। প্রতিবারই তার চারপাশে নতুন নতুন মিথ তৈরি হয়েছে। সেই মিথে সে বিশ্বাস করেছে বলেই একটা বড় ইমাজিনড রিয়েলিটির অংশ হতে পেরেছে সে। প্রতিবারই সে মিছিলে গিয়েছে। আরো হাজারটা মানুষকে মিছিলে দেখেছে। মিছিলের অংশ হতে পারাটাও কিন্তু এক ধরনের এ্যাচিভমেন্ট।
কাজেই, হোমার আর হুমায়ূন আহমেদরাই যে কেবল গল্প বলেন —তা না। প্রতিটা সফল মানুষই আমাদের গল্প বলে চলেছেন। মুহম্মদ আমাদের বলেন, এক ভাই অন্য ভাইয়ের উপকার করতে। তবেই পরকালে মুক্তি মিলবে। বঙ্গবন্ধু আমাদের একটা সুখী, সম্দ্ধ বাংলাদেশের গল্প বলেন। সেই গল্পই একদিন আমাদের স্বাধীনতা এনে দেয়। স্টিভ জবস আমাদের বলেন—আইফোন ব্যবহার করতে। তবেই জগতের যাবতীয় সুখ মিলবে। আমরা তার গল্পে মুগ্ধ হয়ে এ্যাপল স্টোরের সামনে রাতভর লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকি।
দিনশেষে ধর্ম বলেন, রাজনীতি কিংবা ব্যবসা—সকল ক্ষেত্রেই সফল মানুষেরা একজন বড় গল্পকার। আমাদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন বর্ণহীন, গন্ধহীন, স্বাদহীন কোন গ্যাস নয়, আমাদের বেঁচে থাকার অক্সিজেন এই গল্পগুলোই।