০১. মানুষরা কেন?

অধ্যায় ১: মানুষরা কেন?

একটি গ্রহে বুদ্ধিমান জীবন এর প্রাপ্তবয়স্কতা অর্জন করে যখন প্রথমবারের মত এটি সেখানে এর অস্তিত্বের কারণ সংশ্লিষ্ট প্রশ্নগুলো সমাধান করে উঠতে পারে। যদি আমাদের চেয়েও বুদ্ধিমত্তায় অগ্রসর কোনো প্রাণীরা মহাশূন্য থেকে কখনো পৃথিবীতে ভ্রমণ করতে আসে, আমাদের সভ্যতাটি ঠিক কোন স্তরে অবস্থান করছে সেটি নিরুপন করার লক্ষ্যে প্রথম যে প্রশ্নটি তারা জিজ্ঞাসা করবে, সেটি হলো: এরা কি এখনও বিবর্তনের বিষয়টি আবিষ্কার করতে পেরেছে? কোনো কারণ জানা ছাড়াই এই পৃথিবীতে প্রায় তিন হাজার মিলিয়ন বছর ধরে জীবের অস্তিত্ব ছিল, অবশেষে তাদেরই একজনের কাছে এই সত্যটি স্পষ্ট হয়েছিল। তার নাম ছিল চার্লস ডারউইন। নিরপেক্ষভাবে বলতে হলে, অনেকেই সত্যটা সম্বন্ধে খানিকটা আভাস পেয়েছিলেন, কিন্তু ডারউইনই ছিলেন সেই ব্যক্তি, যিনি আমাদের অস্তিত্বের কারণ সম্বন্ধে প্রথমবারের মত সঙ্গতিপূর্ণ আর প্রমাণযোগ্য একটি ব্যাখ্যা প্রস্তাব করেছিলেন। ডারউইনের কারণে, সেই কৌতূহলী শিশুটির প্রশ্ন, যা এই অধ্যায়ের শিরোনাম, তার একটি বোধগম্য উত্তর দেয়া আমাদের পক্ষে এখন সম্ভব। যখন গভীর সমস্যাগুলোর মুখোমুখি হই, আমাদের আর এখন কোনো কুসংস্কারের আশ্রয় নিতে হয়নাঃ জীবনের কি কোনো অর্থ আছে? আমরা কিসের জন্য এখানে? মানুষ কি? এই প্রশ্নগুলোর শেষ প্রশ্নটি জিজ্ঞাসা করে বিখ্যাত প্রাণিবিজ্ঞানী জি. জি. সিম্পসন (১) মন্তব্য করেছিলেন এভাবে: ‘এখন আমি যে প্রস্তাবনাটি করতে চাই সেটি হচ্ছে, ১৮৫৯ সালের আগে এই প্রশ্নটির উত্তর দেবার সকল প্রচেষ্টাই ছিল অর্থহীন, আর আমাদের জন্য মঙ্গলজনক হবে, যদি আমরা সম্পূর্ণভাবে সেগুলো উপেক্ষা করতে পারি।(২)

বর্তমানে সূর্যের চারপাশে পৃথিবী ঘুরছে এই তত্ত্ব নিয়ে যতটুকু সন্দেহ করা হয়, বিবর্তন তত্ত্বটি নিয়ে ঠিক ততটুকুই সংশয় প্রকাশ করার অবকাশ রয়েছে। কিন্তু ডারউইনের বিল্পবটির পূর্ণ তাৎপর্য এখনও ব্যাপকভাবে বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রাণিবিজ্ঞান এখনও গুরুত্বহীন একটি বিষয়, এবং যারা এটি অধ্যয়ন করার জন্য বেছে নেন, তারাও প্রায়শই সেই কাজটি করেন এর গভীর দার্শনিক গুরুত্বটি অনুধাবন না করেই। দর্শন এবং অন্যান্য বিষয়গুলো যারা পরিচিত হিউম্যানিটিস বা মানববিদ্যা হিসাবে, সে বিষয়গুলো শিক্ষা দেয়া হচ্ছে এমনভাবে যেন ডারউইনের কোনো অস্তিত্ব কখনোই ছিলনা। কোনো সন্দেহ নেই সময়ের সাথে এর পরিবর্তন হবে। তবে কোনোভাবেই, এই বইটির উদ্দেশ্য ডারউইনবাদের সপক্ষে সাধারণ কোনো গুণকীর্তন নয়, বরং একটি বিশেষ প্রসঙ্গের ক্ষেত্রে বিবর্তন তত্ত্বের পরিনামগুলো এটি অনুসন্ধান করবে। স্বার্থপরতা আর পরার্থবাদের একটি জৈববৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান করাই আমার উদ্দেশ্য।

প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও গবেষণায় কৌতূহল ছাড়াও, এই বিষয়টির মানবিক গুরুত্ব খুবই স্পষ্ট। আমাদের সামাজিক জীবনের পরিমণ্ডলে প্রতিটি ক্ষেত্র এটি স্পর্শ করে, আমাদের ভালোবাসা এবং ঘৃণা করা, দ্বন্দ্ব এবং সহযোগিতায়, কোনো কিছু দান করা এবং চুরি করায়,আমাদের লোভ এবং দয়াপরায়নশীলতায়। এই সব দাবীগুলো লরেঞ্জের (৩) “অন অ্যাগ্রেসন’ (৪), আর্ডের (৫) “দ্য সোস্যাল কনট্রাক্ট’ (৬), আইবল-আইবেসফেল্টের (৭) “লাভ অ্যান্ড হেট’ (৮) বইগুলোর উপরেও করা যেতে পারতো। কিন্তু এই বইগুলোর সমস্যা হলো, এই লেখকরা বিষয়টিকে চূড়ান্তভাবে ভুল বুঝেছিলেন। তারা ভুল বুঝেছিলেন, কারণ বিবর্তন কিভাবে কাজ করে, সেই বিষয়টি তারা আসলে ভুল বুঝেছিলেন। তারা ভ্রান্ত একটি ধারণা করেছিলেন, ভেবেছিলেন একক কোনো সদস্যের (অর্থাৎ জিনের) জন্য নয় বরং প্রজাতির (অথবা গ্রুপের) কল্যাণই হচ্ছে বিবর্তন প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ব্যপারটিকে বক্রাঘাতই মনে হতে পারে, যখন কিনা অ্যাশলে মনটে (৯) ‘একেবারে উনবিংশ শতাব্দীর “দাঁতে ও নখরে হিংস্র বন্য প্রকৃতির” (১০) সরাসরি উত্তরসূরি চিন্তাবিদ…’ আখ্যা দিয়ে বরং লরেঞ্জকেই বিদ্রূপ করেছিলেন। বিশিষ্ট চিন্তাবিদ লরেঞ্জের বিবর্তন সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি বলতে আমি যতটুকু বুঝি, তিনি নিজেও মনটের সাথে টেনিসনের (১১) বিখ্যাত এই বাক্যটির নিহিত্যার্থ প্রত্যাখ্যান করতে খুব বেশী মাত্রায় একমত পোষণ করবেন। তাদের দুজনের ব্যতিক্রম, আমি মনে করি, “দাঁত ও নখরে হিংস্র প্রকৃতি’ মোটামুটি প্রশংসনীয় উপায়ে প্রাকৃতিক নির্বাচন সম্বন্ধে আমাদের আধুনিক ধারণাটির সার্বিক সংক্ষিপ্ত একটি রুপ উপস্থাপন করছে।

আমার মূল যুক্তিটি শুরু করার আগে আমি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করতে চাই, এটি কোন ধরনের প্রস্তাব এবং এটি কোন ধরনের প্রস্তাব নয়। আমাদের যদি বলা হয় কোনো একজন ব্যক্তি, যিনি শিকাগোর অপরাধ জগতে দীর্ঘ এবং সফল জীবন কাটিয়েছেন, তাহলে সেই ব্যক্তিটির চরিত্র কেমন ছিল, সেই বিষয়ে আমরা কিছু অনুমান নির্ভর ধারণা করার অধিকার রাখি। আমরা হয়তো আশা করতে পারি যে, তার নিশ্চয়ই সেই সব গুণাবলী ছিল, যেমন, সাহসী, দৃঢ়, আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে দক্ষতা, প্রায়শই যে দক্ষতাটি সে ব্যবহার করেছে এবং এছাড়াও আছে তার বিশ্বস্ত বন্ধুদের আকর্ষণ করার যোগ্যতা। এই সব ধারণাগুলো যে একেবারে নির্ভুল অনুমান হবে তা কিন্তু না, তবে কোনো মানুষের চরিত্র সম্বন্ধে কিছু ধারণা আপনি অবশ্যই অনুমান করতে পারবেন যদি আপনি খানিকটা জানতে পারেন, কি পরিস্থিতিতে সফলতার সাথে সেই মানুষটি টিকে ছিল। এই বইটির প্রস্তাবিত যুক্তি হচ্ছে যে, আমরা এবং অন্য সকল জীবরা, আসলে যন্ত্র, যাদের তৈরী করেছে আমাদের বহন করা জিনগুলো। অত্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ পৃথিবীতে সফল শিকাগো গ্যাঙ্গস্টারদের মত আমাদের জিনগুলো টিকে গেছে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বহু মিলিয়ন বছর। আমাদের জিনগুলোর সুনির্দিষ্ট কিছু বৈশিষ্ট্য প্রত্যাশা করার জন্য এটি আমাদের অধিকার দেয়। আমি যুক্তি দেবো যে, একটি সফল জিনের প্রধানতম যে গুণটি আমরা আশা করতে পারি, সেটি হচ্ছে এর নিষ্ঠুর স্বার্থপরতা। এই জিনগত স্বার্থপরতা সাধারণত একক সদস্যের আচরণেও স্বার্থপরতার জন্ম দেয়। যদিও, আমরা পরে বিষয়টি যেমন দেখবো, বিশেষ কিছু পরিস্থিতি আছে যেখানে একটি জিন একক জীবের স্তরে খানিকটা সীমিত আকারের পরার্থবাদিতা বা আলট্রইজম লালন করার মাধ্যমে তার স্বার্থপর লক্ষ্যটি অর্জন করতে পারে। বিশেষ” এবং “সীমিত’– আগের বাক্যটিতে ব্যবহৃত দুটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। যতই আমরা অন্য কিছু বিশ্বাস করতে চাই না কেন, সর্বজনীন ভালোবাসা আর সার্বিকভাবে প্রজাতির কল্যাণ আসলেই হচ্ছে সেই সব ধারণাগুলো, বিবর্তনীয় ব্যাখ্যাই যা কোনভাবেই অর্থবহ হয় না।

এটি আমাকে সেই প্রথম বিষয়টিতে নিয়ে আসে, যা আমি প্রস্তাব করতে চাইছি এই বইটি কি ‘বিষয়ে নয়’ সে প্রসঙ্গে। আমি কোনো নৈতিকতা নির্ভর বিবর্তনের সপক্ষে প্রস্তাবনা উপস্থাপন করছি না (১২)। আমি বলছি কিভাবে এসব কিছু বিবর্তিত হয়েছে, আমি বলছি না, মানুষদের নৈতিকভাবে কিভাবে আচরণ করা উচিৎ। আমি বিষয়টির উপর জোর দিচ্ছি, কারণ জানি আমাকে ভুল বোঝার সম্ভাবনা আছে সেই সব মানুষদের, তারা সংখ্যায় অগণিত, যারা, কোনো একটি বিষয় বা পরিস্থিতি সম্বন্ধে বিশ্বাস নির্ভর একটি বক্তব্য কি বলছে আর বিষয় ও পরিস্থিতিটি কি হওয়া উচিৎ তার পক্ষে ওকালতি করার মধ্যে পার্থক্য করতে পারেন না। আমার নিজস্ব অনুভূতি হচ্ছে যে, কোনো একটি মানব সমাজ যা শুধুমাত্র জিনের নিষ্ঠুর স্বার্থপরতার সার্বজনীন সূত্রের উপর প্রতিষ্ঠিত, নিঃসন্দেহে বাস করার জন্য সেটি খুবই জঘন্য একটি সমাজ হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে, আমরা কোনো কিছুকে যতই ঘৃণা করিনা কেন, সত্য হওয়া থেকে কিন্তু তা বিরত থাকে না। মূলত এই বইটির উদ্দেশ্য কৌতূহলোদ্দীপক বিষয়ের অবতারণা করা, কিন্তু আপনি যদি কোনো নৈতিকতা এখান থেকে সংগ্রহ করতে চান, তাহলে বইটি একটি সতর্ক সংকেত হিসাবে পড়ন। সতর্ক থাকুন যদি আপনি চান, যেমনটি আমি চাই, এমন একটি সমাজ সৃষ্টি করতে, যেখানে প্রতিটি সদস্য উদারতার সাথে একে অপরের সাথে সহযোগিতা করে এবং সবাই নিঃস্বার্থভাবে একটি সর্বজনীন কল্যাণের জন্য কাজ করছে; তাহলে তাদের জৈববৈজ্ঞানিক প্রকৃতির কাছে আপনি বেশী কিছু আশা করতে পারবেন না। আসুন আমরা উদারতা এবং পরার্থবাদ বা পরোপকারিতা শিক্ষা দিতে চেষ্টা করি, কারণ আমরা জন্মগতভাবেই স্বার্থপর। আসুন আমরা বোঝার চেষ্টা করি, আমাদের স্বার্থপর জিনগুলো আসলে কি পরিকল্পনা করছে, কারণ হয়তো তখনই অন্ততপক্ষে তাদের পরিকল্পনা ভেস্তে দেবার জন্য আমাদের একটা সুযোগ থাকবে, আর কোনো প্রজাতি কখনোই এমন কিছু করার উচ্চাকাঙ্খ বোধ করেনি কোনোদিনও।

এই শিক্ষা দেবার ব্যাপারে উল্লেখিত মন্তব্যগুলোর অনুসিদ্ধান্ত হিসাবে, এটি আসলেই একটি ভ্রান্তি– ঘটনাচক্রে খুব সাধারণ একটি ভ্রান্তি– এমন কিছু মনে করা যে জিনগত উত্তরসুরি হিসাবে প্রাপ্ত কোনো বৈশিষ্ট্যাবলী হচ্ছে তাদের সংজ্ঞানুযায়ী স্থির এবং অপরিবর্তনযোগ্য। স্বার্থপর হবার জন্য আমাদের জিন হয়তো আমাদের নির্দেশ দেয়। কিন্তু আবশ্যিকভাবে সারা জীবনের জন্য সেই সব নির্দেশ পালনের জন্য আমরা আদৌ বাধ্য নই। হয়তো পরার্থবাদিতা শেখাটাই শুধু কঠিন একটি বিষয়ে রূপান্তরিত হয় মাত্র যদি না জিনগতভাবে পরার্থবাদ শেখার জন্য আমরা আগে থেকেই প্রোগ্রাম করা না থাকি। সব জীবদের মধ্যে, মানুষরা অনন্যভাবে সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত, বংশ পরম্পরায় হস্তান্তর হওয়া শিক্ষা এবং নানা কিছু করে ও দেখে শেখার দ্বারা প্রভাবিত। কেউ হয়তো বলতেই পারেন যে জিনের চেয়ে আমাদের উপর সংস্কৃতির প্রভাব অনেক বেশী, সেই জিন স্বার্থপর হোক কিংবা না হোক, জিন মানুষের প্রকৃতি বোঝার জন্য কার্যত অপ্রয়োজনীয়। অন্যরা হয়তো দ্বিমত পোষণ করবেন। পুরোটাই নির্ভর করবে ‘প্রকৃতি বনাম প্রতিপালন’ এই বিতর্কে আপনি কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন, মানবীয় বৈশিষ্ট্যের নিয়ামকগুলো চিহ্নিত করার প্রসঙ্গে। বিষয়টি আমাকে নিয়ে আসে, এই বইটি আসলে কি নয় তার দ্বিতীয় প্রসঙ্গটিতে: প্রকৃতি/প্রতিপালন বিতর্কে কোনো একটি অবস্থানের পক্ষে সমর্থন জানানো এই বইটির উদ্দেশ্য নয়, খুব স্বাভাবিকভাবে এই বিষয়ে আমার একটি মতামত আছে, কিন্তু আমি সেই মতামতটি এখানে প্রকাশ করবো না, শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যতটুকু নিহিত আছে, সেটাই আমি শেষ অধ্যায়ে উপস্থাপন করবো। যদি জিনরা আসলে আধুনিক মানুষের আচরণের নির্ণায়ক হিসাবে সম্পূর্ণভাবে অপ্রাসঙ্গিক হয়, যদি আমরা আসলেই এই ক্ষেত্রে সব জীবদের মধ্যে অনন্য ব্যতিক্রম হয়েও থাকি, তারপরও, অন্তত কৌতূহদ্দেীপক এই বিষয়টির নিয়ম সম্বন্ধে আমাদের জানার আগ্রহ থাকা উচিৎ, খুব সম্প্রতি যে নিয়মের ব্যতিক্রম হয়েছি আমরা। আর যদি আমাদের প্রজাতি আমরা যতটুকু ভাবি ততটুকু ব্যতিক্রম না হয়ে থাকে, তাহলে আরো বেশী জরুরী আমাদের সেই নিয়ম সম্পর্কে গবেষণা করা।

তৃতীয় যে জিনিসটি এই বইটি নয় তাহলো, মানুষের বা কোন জীব প্রজাতির বিস্তারিত আচরণের বর্ণনা। আমি শুধুমাত্র দৃষ্টান্তমূলক প্রমাণের জন্য বাস্তব কিছু উদাহরণ দেবো। আমি এমন কিছুই বলবো না যেমন, যদি আপনি কোনো একটি বেবুনের আচরণ লক্ষ্য করেন, আপনার কাছে মনে হবে তারা আসলেই স্বার্থপর, আর সেহেতু মানুষের আচরণও সেরকমই হবার সম্ভাবনা আছে। আমার শিকাগো গ্যাংস্টারে প্রস্তাবের যুক্তি কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেটা হচ্ছে এরকম: মানুষ আর বেবুনরা প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে বিবর্তিত হয়েছে; আর আপনি যদি লক্ষ করেন কিভাবে প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ করে, মনে হবে যে এমন কিছু যা কিনা বিবর্তিত হয়েছে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের সব স্বার্থপর হবার কথা। সুতরাং আমাদের সেটাই অবশ্যই আশা করতে হবে যখন আমরা বেবুন, মানুষ আর অন্যান্য সব জীবিত প্রাণীদের আচরণ অনুসন্ধান করতে যাবো, আমরা তাদের আচরণ দেখবো স্বার্থপরের মত। আমরা যদি আবিষ্কার করি, আমরা যা আশা করেছিলাম, সেটি ভুল, আমরা যদি লক্ষ করতে পারি মানুষের আচরণ সত্যিকারভাবেই পরার্থবাদী, তাহলে আমাদের একটা ধাঁধার মুখোমুখি হতে হবে, এমন একটি প্রশ্ন যার ব্যাখ্যার প্রয়োজন আছে।

আলোচনায় আরো অগ্রসর হবার আগে, আমাদের একটি সংজ্ঞা নির্ধারণ করা প্রয়োজন। একটি সত্তা, যেমন একটি বেবুন, তাকে আমরা পরার্থবাদী বলতে পারবো, যদি এটি এমন ভাবে আচরণ করে যে তার আচরণ এরকমই আরেকটি সত্তার কল্যাণ বৃদ্ধি করে তার নিজের ক্ষতি করে। স্বার্থপর আচরণের পরিণতি ঠিক এর বিপরীত। কল্যাণ বা ওয়েলফেয়ার-এর অর্থ এখানে হচ্ছে ‘বেচে থাকার সুযোগ’, এমন কি যখন সত্যিকারের বাঁচা মরার সম্ভাবনার উপর এর প্রভাব এত সামান্য যেন মনে হতে পারে অগ্রাহ্য। ডারউইনীয় তত্ত্বের আধুনিক সংস্করণের একটি বিস্ময়কর ফলাফল হচ্ছে যে টিকে থাকার উপর আপাতদৃষ্টিতে খুব তুচ্ছ ক্ষুদ্র কোনো প্রভাবও বিবর্তনের উপর বড় প্রভাব ফেলতে পারে। আর এর কারণ, এ ধরনের কোনো প্রভাবগুলো তাদের উপস্থিতি টের পাইয়ে দেবার জন্য পায় সুবিশাল সময়।

যে বিষয়টি অনুধাবন করা জরুরী, উপরের পরার্থবাদ আর স্বার্থপরতার সংজ্ঞাগুলো “আচরণগত, এটি আত্মগত অনুভুতি নির্ভর কোনো বিষয় নয়। এখানে আমি উদ্দেশ্য-সংশ্লিষ্ট মনোবিজ্ঞান নিয়ে চিন্তিত নই। আমি এমন কোনো তর্ক করবো না, যে মানুষগুলো, যারা পরার্থবাদী আচরণ করে তারা আসলেই তাদের অবচেতন বা গোপন কোনো স্বার্থপর উদ্দেশ্যে সেটি করছে। হয়তো তারা সেটি করছে বা হয়তো করছে না, এবং হয়তো আমরা কখনোই কখনো তা জানতে পারবো না, যাই হোক না কেন, এই বইটির বিষয় কিন্তু সেটি নয়। আমার সংজ্ঞাটি সীমাবদ্ধ শুধুমাত্র কোনো একটি আচরণ বা ক্রিয়ার ‘প্রভাব’ একজন সম্ভাব্য পরার্থবাদী এবং তার পরার্থবাদী আচরণের দ্বারা লাভবানকারীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করে, নাকি হ্রাস করে।

 দীর্ঘমেয়াদী বেঁচে থাকার সম্ভাবনার উপর কি প্রভাব পড়ছে তা পরীক্ষা করে দেখানো খুবই জটিল একটি বিষয়। ব্যবহারিকভাবে প্রায়োগিক ক্ষেত্রে যখন আমরা সত্যিকারের আচরণগুলোর উপর সংজ্ঞাগুলো প্রয়োগ করি, আমাদের সেই শব্দটিকে গুণগতভাবে পরিবর্তন করতে হবে ‘আপাতদৃষ্টিতে’ শব্দটি ব্যবহার করে। আপাতদৃষ্টিতে পরার্থবাদী কোনো কাজ বা পরোপকারী কোনো কাজ হচ্ছে সেটি, যেটি উপরিদৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে, সেই কাজটির কারণে পরার্থবাদী খুব সম্ভবত ( যতই সামান্য হোক না কেন সেই সম্ভাবনা), মারা যাবে এবং পরার্থবাদী কাজটির উপকার-গ্রহীতার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়বে। প্রায়শই যেটা দেখা যায়, খুব ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলে কোনো আপাতদৃষ্টি পরার্থবাদী কাজগুলো আসলে ছদ্মবেশে স্বার্থপরতা। আরো একবার, আমি কিন্তু বোঝাতে চাইছি না যে, তাদের সেই কাজটির অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য কোনো গুপ্ত স্বার্থপরতা কিন্তু বেঁচে থাকার সম্ভাবনার উপর এর সত্যিকারের প্রভাব আমরা প্রথমে যা ভেবেছিলাম, তার বিপরীতমুখী।

আমি কিছু উদাহরণ উপস্থাপন করবো, যাদের কোনোটি আপাতদৃষ্টিতে স্বার্থপর এবং কোনটি আপাতদৃষ্টিতে পরার্থবাদী; খুবই কঠিন আসলে আত্মগত চিন্তার অভ্যাসটিকে দমিয়ে রাখা যখন আমরা আমাদের প্রজাতি নিয়ে আলোচনা করি, সুতরাং আমি অন্য প্রাণীদের থেকেই উদাহরণগুলো দেব, প্রথমে কিছু প্রাণী প্রজাতির একক সদস্যদের বিবিধ স্বার্থপরমূলক আচরণের উদাহরণ।

ব্ল্যাকহেডেড গালরা (Blackheaded gull) বড় আকারের কলোনী হিসাবে তাদের নীড় বানায়। সাধারণত এই সব বাসাগুলো পরস্পর থেকে অল্প কয়েক ফুট দূরত্বে অবস্থান করে। যখন ডিম ফুটে প্রথম বাচ্চা বের হয়, তারা আকারে খুব ছোট আর নিজেদের সুরক্ষা করার কোনো উপায় থাকে না, খুব সহজেই তাদের আস্ত গিলে খাওয়া যায়। এই গাল পাখিদের মধ্যে খুব প্রচলিত একটি আচরণ দেখা যায়, সেটি হচ্ছে, তারা অপেক্ষা করে কখন তাদের প্রতিবেশী গাল অন্যদিকে তাকাবে বা নিজের বাসা ছেড়ে বের হবে, তখনই তারা ছো মেরে প্রতিবেশীর কোন একটি পাখির ছানা আস্ত গিলে খেয়ে নেয়। এভাবেই সেই পাখিটি মাছ ধরার জন্য কোনো ঝামেলা না করে এবং নিজের বাসাটিকে অরক্ষিত অবস্থায় ফেলে যাওয়া ছাড়াই বেশ ভালো একটি পুষ্টিকর খাদ্যের ব্যবস্থা করে নেয়।

অপেক্ষাকৃতভাবে স্ত্রী প্রেইং মানটিসদের (praying mantise) অদ্ভুত স্বজাতি ভক্ষণ করার আচরণটি আরো সুপরিচিত। মানতিসরা বড় আকারের মাংসাশী কীট। তারা সাধারণত অপেক্ষাকৃত ছোট পোকামাকড় যেমন, মাছি খায়, কিন্তু তাদের নড়াচড়া করে এমন প্রায় সব কিছুকেই আক্রমণ করার স্বভাব আছে। তারা যখন প্রজননের জন্য মিলিত হয়, পুরুষ মানতিসরা সন্তর্পনে হামাগুড়ি দিয়ে তাদের স্ত্রী সদস্যদের উপরে ওঠে আসে, তারপর সঙ্গম করে, যদি স্ত্রী সদস্যটি সুযোগ পায়, সে তাকে খেয়ে ফেলে। প্রথমে এক কামড়ে তার মাথাটি খেয়ে ফেলে, এই কাজটি সে করতে পারে, যখন কোনো পুরুষ মিলিত হবার জন্য তার দিকে অগ্রসর হচ্ছে, অথবা তার উপর উঠেছে এবং সঙ্গমরত অবস্থায়, কিংবা সঙ্গমের পর পর তারা পথক হলে। মনে হতে পারে পুরুষটির মাথা ছিঁড়ে খাবার জন্য সঙ্গম শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করা স্ত্রী মানতিসের জন্য বুদ্ধিমানের কাজ হতো। কিন্তু দেখা গেছে পুরুষের মাথাটি খেয়ে নেবার পরও পুরুষটির বাকী শরীরের সঙ্গম অব্যাহত রাখতে কোনো সমস্যা হয়না, আসলেই বরং ভাবা হয়, যেহেতুটি পতঙ্গটির মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রে ইনহিবিটরী বা দমিয়ে রাখার কেন্দ্র থাকে, সম্ভাবনা আছে, স্ত্রী মানতিসরা তাদের পুরুষদের মাথা চিবিয়ে খেয়ে আসলে তাদের যৌন দক্ষতাকেই বাড়িয়ে দেয় (১৩)। যদি তা হয়ে থাকে তবে সেটি বাড়তি উপকারিতা, প্রথমটি হচ্ছে সে ভালো একটি খাদ্যের ব্যবস্থা করা।

‘স্বার্থপর’ শব্দটি এধরনের কোনো চূড়ান্ত ক্যানিবালিজম বা স্বজাতিভক্ষণের ক্ষেত্রে উনোক্তি মনে হতে পারে। আমাদের সংজ্ঞায় যদিও এটি খুব ভালোভাবে মানানসই। হয়তো আমরা সমব্যথী হতে পারি এমপেরর পেঙ্গুইনদের আপাতদৃষ্টিতে ভীরু কাপুরুষোচিত আচরণ লক্ষ করে। তাদেরকে দেখা গেছে কোনো সমুদ্রের সীমানায় দল বেধে দাঁড়িয়ে থাকতে, পানিতে ঝাঁপ দেবার আগে তাদের মধ্যে ইতস্ততা দেখা যায়, তাদের ভয় সীলের আক্রমণ ও তাদের খাদ্য পরিণত হওয়া থেকে নিজেকে যেন বাঁচানো যায়। যদি তাদের একজন পানিতে ঝাঁপ দেয়, বাকী সবাই কিন্তু সাথে সাথেই জেনে যায়, পানিতে সীল অপেক্ষা করছে, নাকি কোনো সীল সেখানে নেই। খুব স্বাভাবিকভাবে কেউ চায় না গিনিপিগ হতে, সুতরাং তারা অপেক্ষা করে, মাঝে মাঝে তারা নিজেদের মধ্যে ধাক্কা ধাক্কি করে একে অপরকে পানিতে ফেলে দেবার জন্য।

আরো সাধারণভাবে, স্বার্থপর ব্যবহার হতে পারে শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারযোগ্য উপাদান ভাগাভাগি করতে অস্বীকার করা, যেমন খাদ্য, বাসস্থান ও শিকার করার এলাকা অথবা যৌনসঙ্গী। এবার কিছু আপাতদৃষ্টিকে পরার্থবাদী কাজের উদাহরণ লক্ষ করি।

কর্মী মৌমাছিদের হুল ফোটানোর আচরণ যারা মৌচাকের মধু চোরদের বিরুদ্ধে কার্যকরী একটি প্রতিরোধ ব্যবস্থা। কিন্তু যে মৌমাছিরা এই কাজটি করে, তারা আসলে কামিকাজি (১৪) যোদ্ধা, বা আত্মঘাতী। কারণ এই হুল দিয়ে তাদের এই দংশনের কাজটি করতে হলে, তাদের শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ আসলে বাইরে ছিঁড়ে চলে আসে আর আক্রমণকারী মৌমাছিও মারা যায় এই কাজটি শেষ করার পরে। তার এই আত্মঘাতী মিশন হয়তো তার কলোনীর গুরুত্বপূর্ণ খাদ্যমজুদের সুরক্ষা করে ঠিকই, কিন্তু সে নিজে বেঁচে থাকে না সেই সুবিধাটি নেবার জন্য। আমাদের সংজ্ঞা অনুযায়ী একটি একটি পরার্থবাদী আচরণ। মনে রাখবেন আমরা কিন্তু এখানে কোনো সচেতন উদ্দেশ্য নিয়ে কথা বলছিনা, সেটি থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে, এখানে কিংবা স্বার্থপরতার উল্লেখিত অন্য উদাহরণেও, কিন্তু তারা আমাদের সংজ্ঞার জন্য প্রাসঙ্গিক নয়।

বন্ধুদের জন্য কারো নিজের জীবন উৎসর্গ করা অবশ্যই পরার্থবাদী একটি কাজ, কিন্তু একইভাবে তাদের জন্য সামান্য ঝুঁকি নেয়াটাও পরার্থবাদের উদাহরণ হতে পারে। অনেক ছোট পাখিরা, যখনই তারা উড়ন্ত কোনো শিকারী পাখিকে, যেমন, বাজ পাখি, কাছাকাছি দেখে, তারা সাথে সাথে একটা বৈশিষ্ট্যসুচক একটি ‘সতর্ক সঙ্কেত দিয়ে বাকীদের জানান দেয়, যা শুনে ছোট পাখিদের ঝাক দ্রুত আত্মরক্ষামূলক একটি ব্যবস্থা গ্রহন করে শিকারী প্রাণী থেকে বাঁচতে। পরোক্ষ প্রমাণ আছে যে পাখিটি এই সতর্কতা মূলক ডাকটি দেয়, সে তার নিজেকে বিশেষ ঝুঁকির মুখে ফেলে দেয়, কারণ তার সেই ডাকটি শিকারী প্রাণীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিশেষ করে তার প্রতি; এটি শুধুমাত্র সামান্য একটু বাড়তি ঝুঁকি নেয়া, কিন্তু তা সত্ত্বেও, এটি প্রথম দৃষ্টিতে আমাদের সংজ্ঞা মোতাবেক একটি পরার্থবাদী কাজ হিসাবে গণ্য হতে পারে।

প্রাণীদের মধ্যে সবচেয়ে সাধারণতম ও সবচেয়ে বেশী চোখে পড়ার মত পরোপকারী কাজটি পিতা-মাতার দ্বারা সম্পাদিত হয়, বিশেষ করে জন্মদানকারী মায়েরা– তাদের সন্তানের প্রতি; তারা তাদের নীড়ে বা তাদের নিজেদের শরীরে সন্তানকে জন্ম দেবার আগ অবধি প্রতিপালন করেন, তাদের জন্মের পর নিজেদের বিশাল আত্মত্যাগের মাধ্যমে তাদের খাদ্য সরবরাহ করেন, এবং শিকারী প্রাণীদের হাত থেকে সন্তানদের বাঁচাতে বিশাল ঝুঁকি নেন। একটি সুনির্দিষ্ট উদাহরণের কথা ধরা যাক, মাটিতে নীড় বানানো অনেক পাখিরা একটি প্রদর্শনী আচরণ করে, যা পরিচিত মনোযাগ বিক্ষিপ্ত করার জন্য প্রদর্শনী বা ‘ডিসট্রাকশন ডিসপ্লে। যখন কোনো শিকারী প্রাণী যেমন শিয়াল আক্রমণ করে, পিতা কিংবা মাতা পাখিটি তখন তার নীড় ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসে তাদের শুধু একটি ডানা প্রশস্ত করে ধরে রেখে, এমনভাবে যেন মনে হয় তাদের একটি ডানাটি ভেঙ্গে গেছে; শিকারী প্রাণীটি সেই ডানা ভাঙ্গা পাখিটিকে সহজ শিকার ভেবে নেয় আর তার নজর পাখির বাসায় থাকা নবজাতক পাখির চেয়ে সেই পাখির প্রতি নিবদ্ধ হয়। অবশেষে পাখিটি তার ভান করা নাটকটি ত্যাগ করে, শিয়ালের মুখে ধরা পড়ার আগে বাতাসে উড়ে যায়। যদিও এটি তার নীড়ের অন্যদের রক্ষা করে, কিন্তু তাকে ঝুঁকি নিতে হয়।

গল্প বলে আমি কোনো বিশেষ কিছু বোঝাতে চাইছি না, বাছাই করা উদাহরণ কখনোই গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ হতে পারে না যা দিয়ে কার্যকরী কোনো একটি সাধারণীকরণ সম্ভব।এই গল্পগুলো বলা হচ্ছে শুধুমাত্র উদাহরণ হিসাবে যে, প্রজাতির একক সদস্যদের পর্যায়ে পরার্থবাদীতা আর স্বার্থপরতা বলতে আসলে আমি কি বোঝাতে চাইছি। এই বইটি পরবর্তীতে দেখাবে কিভাবে ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা ও ব্যক্তিগত পরার্থবাদীতা দুটোই একটি মৌলিক সূত্র বা আইন দিয়ে বোঝানো সম্ভব, যাকে আমি বলছি “জিন স্বার্থপরতা’ (gene selfishnes); কিন্তু তার আগে আমাকে অবশ্যই পরার্থবাদীতার একটি বিশেষ ভ্রান্তিপূর্ণ ধারণা নিয়ে আলোচনা করতে হবে, কারণ এটি ব্যাপকভাবে পরিচিত এবং এমনকি ব্যাপকভাবে এটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেও পড়ানো হয়ে থাকে।

এই ব্যাখ্যাটি একটি ভুল ধারণার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত যা আমি আগেই উল্লেখ করেছিলাম, তা হলো জীবিত সব জীবরা ‘প্রজাতির কল্যাণে’ বা ‘কোনো গ্রুপ বা গোষ্ঠীর কল্যাণে কোনো কিছু করার জন্যবিবর্তিত হয়। খুবই সহজ কিন্তু দেখা কিভাবে এই ধারণাটির জন্ম হয়েছে জীববিজ্ঞানে। কোনো একটি জীবের জীবনের বেশীর ভাগ অংশই ব্যয় হয় প্রজননের জন্য এবং পরার্থবাদী আত্মত্যাগের বেশীর ভাগ ক্রিয়া যা আমরা প্রকৃতিতে দেখি, সেগুলো সন্তানদের প্রতি তাদের পিতামাতারা করে থাকে। প্রজাতির ধারা অব্যহত রাখা’ প্রজননের একটি খুব প্রচলিত সুভাষণ এবং এটি সন্দেহাতীতভাবে প্রজননেরই একটি পরিণতি। সামান্য একটু সম্প্রসারিত যুক্তির প্রয়োজন হয় সেই উপসংহারে উপনীত হতে যে, প্রজননের কাজ হচ্ছে প্রজাতির ধারা অনন্তকালের জন্য ‘অব্যহত রাখা। এখান থেকে আরো একটি ছোট মিথ্যা পদক্ষেপ নিলেই সেই উপসংহারে পৌঁছানো যায় যে, প্রাণীরা সাধারণত এমনভাবেই আচরণ করে যা প্রজাতির ধারা অব্যহত রাখার বিষয়টি বিশেষ সুনজর পায়। প্রজাতি বা গ্রুপের অন্যান্য সদস্যদের প্রতি পরার্থবাদী আচরণ মনে করা হয় এখান থেকেই এসেছে।

এই চিন্তার সূত্রটি হালকাভাবে ডারউইনীয় ভাষায় ব্যাখ্যা করা যায়। বিবর্তন কাজ করে প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে, আর প্রাকৃতিক নির্বাচনের অর্থ হচ্ছে সবচেয়ে উপযুক্ত বা ‘ফিটেষ্টদের’ বৈষম্যমূলকভাবে বেঁচে থাকা (প্রজাতির ফিটেস্ট সদস্যদের তুলনামূলকভাবে বেশী বেঁচে থাকাটা নিশ্চিৎ করে) (১৫)। কিন্তু আমরা কি নিয়ে কথা বলছি, সবচেয় ফিট একক সদস্য, নাকি সবচেয়ে ফিট জনগোষ্ঠী, রেস বা বর্ণ নাকি সবচেয়ে ফিট প্রজাতি অথবা কি? কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটি তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় না। কিন্তু যখন আমরা পরার্থবাদীতা নিয়ে কথা বলবো এটি অবশ্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদি এটি প্রজাতি হয়, যারা ডারউইনের ভাষায় টিকে থাকার সংগ্রামে প্রতিদ্বন্দিতা করতো, তাহলে প্রজাতির সদস্যরা সেই খেলায় দাবার ‘পন’ বা সৈন্য গুটির মত হতো, যাদের যখন খুশী বিসর্জন দেয়া যেতো, যখন প্রজাতির বৃহত্তর স্বার্থে সেই কাজটি করার দরকার পড়তো; ব্যপারটাকে কিছুটা সম্মানজনক উপায়ে বলতে চাইলে, কোন একটি গ্রুপ, যেমন একটি প্রজাতি বা কোনো একটি জনগোষ্ঠী সেই প্রজাতির মধ্যে, যাদের প্রতিটি সদস্য পুরো গ্রুপটির কল্যাণে নিজেদের বিসর্জন দেবার জন্য প্রস্তুত থাকে, হয়তো তাদের বিলুপ্ত হবার সম্ভাবনা কম, অন্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপদের তুলনায়, যে গ্রুপের সদস্যরা তাদের নিজেদের স্বার্থ গ্রুপের স্বার্থের উপরে স্থান দেয়। সুতরাং পৃথিবী সেই সব গ্রুপদের দ্বারা পূর্ণ হয় যাদের গ্রুপে আত্মত্যাগী সদস্যরা আছে। এটাই ‘গ্রুপ সিলেকশন’ তত্ত্ব। বহুদিন ধরেই বিজ্ঞানীরা একে সত্য হিসাবে ধারণা করে এসেছেন, বিশেষ করে সেই সব জীববিজ্ঞানীরা যারা বিবর্তন তত্ত্বটির বিস্তারিত অনেক কিছুই জানেন না। যে ধারণাটিকে ব্যাপকভাব পচার করেছিল ভি, সি ওয়াইন-এডওয়ার্ডের একটি বিখ্যাত বই (১৬) ও রবার্ট আর্ডে তার “দি সোস্যাল কনট্রাক্ট” বইটির মাধ্যমে এটি জনপ্রিয় করেছিলেন। এর প্রচলিত বিকল্পটি সাধারণত বলা হয়, “ইন্ডিভিজুয়াল সিলেকশন’, যদিও আমি ব্যক্তিগতভাবে বলতে চাই ‘জিন’ সিলেকশনের কথা।

যে যুক্তিটি এই মাত্র উল্লেখ করা হলো, সেই যুক্তির ‘ইন্ডিভিজুয়াল সিলেকশনবাদী’ কোনো দ্রুত উত্তর যা বলা হলো তা হয়তো এরকম হতে পারে। এমনকি পরার্থবাদীদের গ্রুপে, সেখানে অবশ্যই কিছু সংখ্যালঘু ভিন্ন মতাবলম্বী থাকবে, যারা কোনো ধরনের আত্মত্যাগ করতে রাজী হবে না, যদি সেখানে একজন স্বার্থপর বিদ্রোহী থাকে, সে বাকীদের পরার্থবাদী আচরণ ব্যবহার করতে পারবে নিজের স্বার্থে। তাহলে সে, সংজ্ঞানুযায়ী বাকীদের চেয়ে বেশী দিন বেঁচে থাকবে এবং সন্তানের জন্ম দেবে। তার প্রতিটি সন্তানও এই স্বার্থপর বৈশিষ্ট্যটি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়ার প্রবণতা থাকবে। এবং বেশ কিছু প্রজন্মান্তরে, এই প্রাকতিক নির্বাচনের ফলাফলে ‘পরার্থবাদী’ গ্রুপটি স্বার্থপর সদস্যদের সংখ্যাধিক্যের মুখোমুখি হবে, এবং যাদের আসলে কোনো স্বার্থপর গ্রুপ থেকে আলাদা করা সম্ভব হবেনা। এমনকি যদি আমরা সেই অসম্ভাব্য ঘটনাচক্রে এমন কোনো গ্রুপের অস্তিত্ব মেনে নেই, যে গ্রুপের প্রতিটি সদস্য বিশুদ্ধভাবেই পরার্থবাদী, যেখানে কোনো স্বার্থপর ভিন্নমতাবলম্বী বিদ্রোহীর কোনো অস্তিত্ব নেই, তারপরও চিন্তা করা খুবই কঠিন, এমন কি আছে যা স্বার্থপর কোনো গ্রুপ থেকে কোনো স্বার্থপর সদস্য এসে তাদের মধ্যে ভিড়ে যাওয়া থেকে বাধা দিতে পারে, এছাড়া আন্তঃগ্রুপ সম্পর্ক স্থাপন যেমন, বিয়ে তো আছেই, তার দ্বারাও কোনো বিশুদ্ধ পরার্থবাদী গ্রুপের বিশুদ্ধতাও নষ্ট হতে পারে।

ইন্ডিভিজুয়াল সিলেকশনবাদীরা স্বীকার করবেন যে গ্রুপ আসলেই বিলুপ্ত হয় এক সময় এবং কোনো একটি গ্রুপ বিলুপ্ত হবে, কি হবে না, সেটি সেই গ্রুপের একক সদস্যদের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। তিনি হয়তো এটাও স্বীকার করবেন যে, যদি শুধুমাত্র কোনো গ্রুপের সদস্যরা ভবিষ্যতে কি হতে পারে সেটি দেখার জন্য প্রয়োজনীয় দূরদর্শিতার গুণে আশীর্বাদপুষ্ট হতেন, তারা হয়তো দেখতে পেতেন ভবিষ্যতে তাদের নিজেদের স্বার্থের জন্য ভালো হবে তাদের স্বার্থপর লোভ সংবরণ করা, যা তাদের পুরো গ্রুপটি ধ্বংস হওয়া থেকে প্রতিরোধ করবে। ব্রিটেনের শ্রমজীবি জনগণকে কতবার এই কথাটি আবশ্যিকভাবে বলা হয়েছে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে? কিন্তু কোনো গ্রুপের বিলুপ্তি খুবই মন্থর একটি প্রক্রিয়া যদি আপনি একক সদস্যদের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মারমুখী দ্বন্দ্ব আর রক্তপাতের সাথে তুলনা করেন। এমনকি যখন কোনো গ্রুপ ধীরে এবং অবশ্যম্ভাবীভাবে পতন অভিমূখে থাকে, স্বার্থপর মানুষরা স্বল্প সময়ের জন্য পরার্থবাদীদের কল্যাণে বেশ ভালো থাকে; ব্রিটেনের নাগরিকরা দুরদর্শিতার আশীর্বাদপুষ্ট হতে পারেন আবার নাও পারেন কিন্তু বিবর্তন ভবিষ্যতের প্রতি অন্ধ।

যদিও গ্রুপ নির্বাচন তত্ত্ব এখন খুব সামান্যই সমর্থন আদায় করতে পারে সেই সব জীববিজ্ঞানীদের শিবিরে, যারা বিবর্তন বোঝেন, কিন্তু তত্ত্বটির আমাদের সহজাত বোধের কাছে এখনও খুবই আবেদনময়। ধারাবাহিক প্রজন্মের প্রাণিবিজ্ঞানের ছাত্ররা বিস্মিত হয়, যখন তারা স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় আসেন, যখন তারা আবিষ্কার করেন এটি আসলে জীববিজ্ঞানের প্রচলিত বা অর্থোডক্স ধারণা নয়। এর জন্য আসলেই তাদের দোষ দেয়া সম্ভব নয়, কারণ নাফিল্ড বায়োলজি টিচার্স গাইড, যা উচ্চতর শ্রেণীর জীববিজ্ঞানের পাঠ্য হিসাবে লেখা হয়েছে ব্রিটেনের স্কুল শিক্ষক শিক্ষিকাদের জন্য, সেখানে আমরা এই বাক্যটিকে দেখতে পাই: “উচ্চতর প্রাণীদের মধ্যে, আচরণ রুপ নিতে পারে যেমন আত্মহননেরও প্রজাতির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য। এই গাইডটির বেনামী লেখক অত্যন্ত আনন্দের সাথে অজ্ঞ সেই বাস্তব সত্যটি সম্বন্ধে, তিনি এই বাক্যে এমন কিছু বলেছেন যা বেশ বিতর্কিত একটি বিষয়। অবশ্য এই ক্ষেত্রে তিনি নোবেল জয়ী বিজ্ঞানীদের সংসর্গে অবস্থান করছেন। কনরাজ লরেঞ্জ, তার ‘অন অ্যাগ্রেসন’ বইটিতে, আলোচনা করেছেন, আগ্রাসী আচরণের ‘প্রজাতি সংরক্ষণ’ সংশ্লিষ্ট কাজের বিষয়ে, যাদের একটি কাজ হচ্ছে নিশ্চিৎ করা যে শুধু মাত্র যে সবচেয়ে উপযুক্ত বা ফিট, সেই সদস্যরাই সুযোগ পায় প্রজননের। এটি সার্কুলার বা আবদ্ধ যুক্তির একটি আদর্শ উদাহরণ। কিন্তু আমি যে বক্তব্যটি বোঝাতে চাইছি এখানে সেটি হলো যে গ্রুপ সিলেকশন এর ধারণাটি চিন্তার এত গভীরে প্রোথিত যে, লরেঞ্জ, নাফিল্ড গাইডের লেখকের মতই স্পষ্টতই অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন, তার বক্তব্য মূলধারা ডারউইনীয় তত্ত্বেরই বিরোধিতা করছে।

খুব সম্প্রতি আমি একই বিষয়ে একটি চমৎকার উদাহরণ শুনেছিলাম, আর বাকী সব দিক দিয়ে বিচার করলে অস্ট্রেলীয় মাকড়শাদের নিয়ে বিবিসির একটি সুনির্মিত টেলিভিশন প্রামাণ্যচিত্রে। এই প্রোগ্রামে বিশেষজ্ঞ লক্ষ করেন যে বিশাল সংখ্যক শিশু মাকড়শারা অন্য প্রজাতিদের খাদ্যে পরিণত হয়, এরপর তিনি এ বিষয়ে মন্তব্য করেন, হয়তো এটাই তাদের অস্তিত্বের কারণ, কারণ অল্প কিছু সদস্যের শুধুমাত্র বেঁচে থাকতে হবে প্রজাতির ধারা সুরক্ষা করার জন্য। রবার্ট আর্জে, তার “দি সোস্যাল কনট্রাক্ট’ বইটিতে পুরো সামাজিক বিন্যাসকে সাধারণভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য এই গ্রুপ সিলেকশন’ তত্ত্ব ব্যবহার করেছিলেন। তিনি খুব স্পষ্টভাবে মানুষকে প্রজাতি হিসাবে দেখেছেন, যারা পশুর নৈতিকতার পথ থেকে সরে এসেছে; অন্তত আর্সে তার গবেষণা ঠিক মত করেছিলেন, প্রচলিত মূলধারা তত্ত্বের সাথে তার ভিন্ন মত পোষণ করার সিদ্ধান্ত একটি সচেতন সিদ্ধান্ত এবং এর জন্য তিনি কৃতিত্বের দাবী রাখেন।

গ্রুপ সিলেকশন তত্ত্বে বিশেষ আবেদনের একটি কারণ হয়তো এটি আমাদের অধিকাংশের ধারণকৃত নৈতিক ও রাজনৈতিক আদর্শের সাথে পুরোপুরিভাবেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। হয়তো আমরা একক ব্যক্তি হিসাবে প্রায়শই স্বার্থপরের মত আচরণ করি কিন্তু আমাদের আদর্শবাদী মুহূর্তগুলোতে আমরা সম্মান ও বিশেষভাবে প্রশংসা করি সেই সব মানুষদের যারা অন্যদের কল্যাণ নিজেদের কল্যাণের আগে স্থাপন করে থাকেন। আমরা যদিও খানিকটা গুলিয়ে ফেলেছি কত বিস্তৃতভাবে আমরা আসলে অন্যদের সংজ্ঞায়িত করবো। প্রায়শই কোনো গ্রুপের অভ্যন্তরের পরার্থবাদীতা বিভিন্ন গ্রুপের প্রতি স্বার্থপরতার সাথে বিদ্যমান। এটাই ট্রেড ইউনিয়নবাদের মূল ভিত্তি, কোনো একটি ভিন্ন পর্যায়ে জাতি হচ্ছে আমাদের পরোপকারিতা বা পরার্থবাদী আত্মত্যাগের মূল সুবিধাভোগী এবং প্রায়শই দেশের সন্মানের জন্য তরুণরা তাদের নিজেদের জীবন উৎসর্গ করবে এমনটাই আশা করা হয়; উপরন্তু, তাদের উৎসাহিত করা হয়। অন্যদের হত্যা করার জন্য, যাদের সম্বন্ধে তারা কিছুই জানে না শুধুমাত্র তারা অন্য একটি দেশের নাগরিক এই তথ্যটি ছাড়া। (কৌতূহলোদ্দীপক একটি মজার ব্যপার হচ্ছে, শান্তির সময় নিজেদের জীবনের মান উন্নয়নের জন্য সামান্য কিছু আত্মত্যাগের আহবান যুদ্ধের সময় জীবন উৎসর্গ করার আহবানের চেয়ে অনেক কম কার্যকরী।)।

সম্প্রতি বর্ণবিদ্বেষ আর দেশপ্রেমের বিরুদ্ধে একটি প্রতিক্রিয়া আমরা লক্ষ করেছি এবং একটি প্রবণতা, যা সমস্ত মানব প্রজাতিকে আমাদের সবার ভাতৃপ্রেমের নিশানা হিসাবে প্রতিস্থাপিত করার চেষ্টা করছে। আর আমাদের পরার্থবাদের নিশানার এই মানবতাবাদী সম্প্রসারণ একটি কৌতূহলোদ্দীপক অনুসিদ্ধান্ত, যা আবারো বিবর্তনের প্রজাতির জন্য কল্যাণকর ধারণাটিকে জোরালো করে। রাজনৈতিকভাবে উদারপন্থী যারা সাধারণত প্রজাতির নৈতিকতা নিয়ে সবচেয়ে বেশী মাত্রায় আত্মবিশ্বাসী মূর্খপাত্র, এখন তারা প্রায়শই তাদের প্রতি সবচেয়ে বেশী ঘৃণা পোষণ করে, যারা তাদের পরার্থবাদের সীমানা আরো প্রশস্ত করে সামনে এগিয়ে গেছে এমনভাবে যাদের মধ্যে অন্য প্রজাতিরাও অন্তর্ভুক্ত। যদি বলি মানুষের বাসস্থানের উন্নতি করার চেয়ে আমি বেশী আগ্রহী তিমি মাছ হত্যা প্রতিরোধ করা করার জন্য, কোনো সন্দেহ নেই আমার অনেক বন্ধুকে তা হতবাক করবে।

নিজেদের প্রজাতির সদস্যরা অন্য প্রজাতির সদস্য অপেক্ষা বিশেষ নৈতিক বিবেচনার যোগ্য এই অনুভূতিটা খুবই প্রাচীন আর মনস্তত্ত্বের অনেক গভীরে প্রোথিত। যুদ্ধের প্রেক্ষাপটের বাইরে মানব হত্যাকে সাধারণত সংঘটিত হতে পারে এমন অপরাধের মধ্যে সবচেয়ে ঘৃণিত আর ভয়ঙ্কর হিসাবে বিবেচিত। আমাদের সংস্কৃতিতে নরহত্যার চেয়ে আর একটি কাজ কঠোরভাবে নিষিদ্ধ সেটি হচ্ছে নরমাংস ভক্ষণ (এমনকি যখন তারা মত); যদিও আমরা অন্য প্রজাতির সদস্যদের হত্যা করে খেতে উপভোগ করি। আমাদের অধিকাংশই এমনকি কোনো ভয়ঙ্কর মানব অপরাধীকে বিচারিক প্রক্রিয়ায় হত্যা করার ঘটনাতেও আৎকে উঠি, অথচ আমরা খুব আনন্দের সাথে বিনা বিচারে বেশ মৃদু স্বভাবের প্রাণীদের বিনা বিচারে হত্যা করাকে সমর্থন করি। আসলেই আমরা শুধু খেলা হিসাবে আনন্দ লাভের জন্য নীরিহ প্রজাতিদের হত্যা করি। একটি মানব ভ্রূণ, কানো একটি অ্যামিবার চেয়ে যার বেশী কিছু অনুভব করার ক্ষমতা নেই, সেটি যে সন্মান আর আইনীর সুরক্ষার সুফল ভোগ করে, তেমন কোনো কিছু প্রাপ্ত বয়স্ক শিম্পাঞ্জির ভাগ্যেও জোটে না। অথচ শিম্পাঞ্জিরা অনুভব করতে পারে, তারা চিন্তাও করতে পারে এবং সাম্প্রতিক কালের কিছু গবেষণা অনুযায়ী এমনকি তারা একধরনের মানুষের ভাষা শিখতেও সক্ষম। মানব ভ্রূণ আমাদের প্রজাতির সদস্য এবং তাই সেটি সাথে সাথেই বিশেষ সুবিধা পাবার যোগ্য ও সেটা পাবার অধিকারও রাখে সেই কারণেই। প্রজাতিবাদের এই নৈতিকতাটিকে আমরা, রিচার্ড রাইডারের শব্দ ‘স্পেসিসিজম’ ব্যবহার করে বর্ণবাদের মত একই পরিমান যৌক্তিক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান দেয়া যায় কিনা, আমি জানি না। আমি যা জানি সেটা হচ্ছে বিবর্তন জীববিজ্ঞানে এর কোন সঠিক ভিত্তি আছে।

ঠিক কোন স্তরে পরার্থবাদ কাঙ্খিত সেই মানবিক নৈতিকতার জটিলতা আর বিশৃঙ্খলায়– পরিবার, জাতি, বর্ণ, প্রজাতি বা সমস্ত জীবিত প্রাণী– এর প্রতিবিম্ব আমরা একই সমান্তরালে দেখতে পাই জীববিজ্ঞানেও, সেই একই সংশয়ে, ঠিক কোন স্তরে পরার্থবাদ আমরা আশা করতে পারি বিবর্তনবাদের তত্ত্ব অনুযায়ী; এমনকি গ্রুপ সিলেকশনবাদীরা খুব একটা অবাক হবেন না বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপ নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দেখে: এভাবে, ট্রেড ইউনিয়নবাদীদের মত বা সৈন্যদের মত, তারা নিজেদের গ্রুপের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে যাচ্ছেন সীমিত সুযোগের মধ্যে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার সংগ্রামে। কিন্তু তারপরও জিজ্ঞাসা করাটা অর্থহীন না, কিভাবে গ্রুপ সিলেকশনবাদীরা আসলে ঠিক করেন, ‘কোন’ স্তরটি আসলে গুরুত্বপূর্ণ। যদি কোনো একটি প্রজাতির নানা গ্রুপে, এবং প্রজাতিগুলোর মধ্যে নির্বাচন কাজ করে, তাহলে সেটা কেনই বা বড় বড় গ্রুপের মধ্যে কাজ করবে না? প্রজাতির গ্রুপ করা হয়েছে গণ বা জেনেরায়, জেনেরারা বর্গ বা অর্ডারে, বর্গ বা অর্ডাররা ক্লাস বা শ্রেনীতে, সিংহ আর অ্যান্টেলোপ কিন্তু স্তন্যপায়ী হিসাবে একই গ্রুপে, দুটোই স্তন্যপায়ী শ্রেণীর সদস্য, যেমন আমরা। তাহলে কি উচিৎ হবে সিংহদের অ্যান্টেলোপদের হত্যা করা থেকে বিরত থাকা, ‘স্তন্যপায়ীদের কল্যাণে’? নিশ্চয়ই তারা এর বদলে পাখি বা সরীসৃপদের শিকার করতে পারে, তাদের নিজেদের শ্রেণীর বিলুপ্তি ঠেকাতে; কিন্তু তাহলে,পুরো মেরুদণ্ডী প্রাণীদের পর্বটির টিকে থাকার ব্যাপারে কি করা যেতে পারে?

আমার জন্য পুরো ব্যাপারটার বিরুদ্ধে রিডাকটিও এড অ্যাবসার্ডাম (reductio ad absurdum) যুক্তি (১৭) ব্যবহার করে তর্ক এবং গ্রুপ সিলেকশন তত্ত্বের সমস্যাগুলোর দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে খুব সহজ হয়তো। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে ব্যক্তিগত স্তরে পরার্থবাদের অস্তিত্ব তারপরও ব্যাখ্যা করা বাকী থেকে যায়। আর্সে এমনকি বলেছেন, গ্রুপ সিলেকশনই হচ্ছে একমাত্র সম্ভাব্য ব্যাখ্যা এমন সব আচরণের যেমন থমসন গ্যাজেলদের ‘স্টটিং’ আচরণ (১৮)। এই বিশেষ উৎসাহী এবং দৃষ্টি আকর্ষণ করা লম্ফ ঝম্প করা কোনো শিকারী প্রাণীর সামনে কিন্তু মিল আছে পাখিদের সতর্ক সংকেতের সাথে, এখানে তার এই আচরণে সে তার সঙ্গীদের বিপদ সম্বন্ধে সতর্ক করছে, এবং একই সাথে তার নিজের দিকে শিকারী প্রাণীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছে স্টার গ্যাজেলটি। আমাদের দ্বায়িত্ব এই লক্ষ্য ঝম্পরত গ্যাজেল এবং এধরনের একইরকম প্রাকৃতিক প্রপঞ্চগুলো ব্যাখ্যা করা। এবং এই বিষয়গুলোর মোকাবেলা আমি করবো পরবর্তী অধ্যায়গুলোতে।

কিন্তু তার আগে আমাকে আমার বিশ্বাসের সপক্ষে যুক্তি দিতে হবে, যা দাবী করছে বিবর্তনকে ভালোভাবে লক্ষ করার সবচেয়ে সেরা উপায় হচ্ছে একেবারে সর্বনিম্ন স্তরে ঘটা নির্বাচনকে বোঝার চেষ্টা করা। এই বিশ্বাসে জি. সি. উইলিয়ামসের দারুণ বই, Adaptation and Natural Selection দ্বারা আমি গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছি। যে মূল ধারণাটি আমি ব্যবহার করবো আমার যুক্তিতে, সেটির পুর্বাভাস দিয়েছিলেন এ. ভাইজম্যান (১৯) এই শতাব্দীর শুরুর দিকের প্রাক-জিন দিনগুলোয়– তার ‘জার্মপ্লাজমের অব্যাহত ধারা’ বা continuity of the germ-plasm মতবাদে। আমি যুক্তি দেবো প্রাকৃতিক নির্বাচনের মৌলিক একক– এবং সেই অর্থে আত্ম স্বার্থবাদের– প্রজাতি নয়, কোনো গ্রুপও নয়, কঠোরভাবে প্রজাতির একক সদস্যও নয়। আসল একক হচ্ছে জিন, বংশগতি বা হেরেডিটির একক (২০)। কোনো কোনো জীববিজ্ঞানীর কাছে প্রথমে মনে হতে পারে এটি চরমতম একটি অবস্থান।আমি আশা করি যখন তারা দেখবেন ঠিক কি অর্থে আমি সেটা বোঝাতে চাইছি, তারাও একমত হবেন যে এটি মূলত প্রচলিত ধারণা, এমনকি যদিও এটি প্রকাশ করা হয়েছে অপরিচিত একটি উপায়ে। এই যুক্তিটি তার আকার নেবে বেশ কিছুটা সময় নিয়ে এবং আমাদের শুরু থেকেই শুরু করতে হবে, জীবনের সেই মূল উৎপত্তি থেকে।

.

নোটস (অধ্যায় ১)

(১) জর্জ গেলর্ড সিম্পসন (১৯০২-১৯৮৪) যুক্তরাষ্ট্রের জীবাশ্মবিদ, বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রভাবশালী জীবাশ্মবিদ, এবং মডার্ন ইভেন্যুশনারী সিনথেসিস এর একজন গুরুত্বপূর্ণ অগ্রদূত।

(২) বহু মানুষ, এমনকি ধার্মিক নন এমন মানুষরাও জর্জ গেলর্ড সিম্পসনের এই উদ্ধৃতিটি পড়ে মর্মাহত হয়েছেন। আমি স্বীকার করছি, যখন আপনি এটি প্রথমবারের মত পড়বেন, আপনার এটিকে খুব অমার্জিত আর কাণ্ডজ্ঞানহীন আর অসহিষ্ণু বলেই মনে হবে, কিছুটা হেনরী ফোডের সেই উদ্ধৃতির মত: ‘ইতিহাস কম বেশী ধাপ্পাবাজী ছাড়া আর কিছুই না। কিন্তু ধর্মীয় উত্তরগুলো বাদে (আমি সেই উত্তরগুলো সম্বন্ধে অবগত আছি, দয়া করে আমাকে ডাকে চিঠি পাঠিয়ে আপনার ডাকটিকিট নষ্ট করবেন না), সত্যিকারভাবে যদি আপনি, ‘মানুষ কি?” “জীবনের কি কোনো অর্থ আছে?” “আমাদের এই অস্তিত্বের কারণই কি? এই প্রশ্নগুলোর প্রাক-ডারউইন উত্তরগুলো ভাববার একটি চ্যালেঞ্জ গ্রহন করেন, আপনি কি পারবেন, সত্যিকারভাবে এমন কোনো উত্তর ভেবে বের করতে যা কিনা এখন অর্থহীন নয়, শুধুমাত্র তাদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব ছাড়া? এমন কিছু জিনিস আছে যা একেবারেই স্পষ্টভাবেই ভুল, এবং ১৮৫৯ সালের আগে, এই প্রশ্নগুলোর সব উত্তরই হচ্ছে ঠিক সেটাই। উল্লেখ্য, ১৮৫৯ সালে চার্লস ডারউইন তার দি অরিজিন অব স্পিসিস বইটি প্রকাশ করেছিলেন।

(৩) কনরাড যাকারিয়াস লরেন্দ্র (১৯০৩-১৯৮৯) অষ্ট্রিয়ার প্রাণিবিজ্ঞানী, প্রাণি-আচরণবিদ এবং পক্ষীবিশারদ। তিনি ১৯৭৩ সালে নিকোলাস টিনবার্গেন ও কার্ল ভন ফ্রিশ-এর সাথে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন। তাকে আধুনিক প্রাণীআচরণবিদ্যা বা ইথথালজীর একজন জনক হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।

(8) On Aggression (German: Das sogenannte Böse zur Naturgeschichte der Aggression) ১৯৬৩

(৫) রবার্ট আর্সে (১৯০৮-১৯৮০) যুক্তরাষ্ট্রের নৃতত্ত্ববিদ।

(৬) The Social Contract: A Personal Inquiry into the Evolutionary Sources of Order and Disorder, 1890

(৭) ইরেনাউস আইবেল-আইবেসফেল্ট (জন্ম ১৯২৮) হিউমান ইথোলজী বিষয়টির প্রতিষ্ঠা। কর্মক্ষেত্র অষ্ট্রিয়া ও জার্মানী।

(৮) Love and Hate: The Natural History of Behavior Patterns. (১৯৭০)।

(৯) অ্যাশলে মনটেণ্ড (১৯০৫-১৯৯৯) বৃটিশ আমেরিকান নৃতত্ত্ববিদ।

(১০) Who trusted God was love indeed/ And love Creation’s final law
Tho’ Nature, red in tooth and claw/ With ravine, shriek’d against his creed./(Alfred Lord Tennyson’s In Memoriam A. H. H. ১৮৫০)

(১১) আলফ্রেড টেনিসন (১৮০৯-১৮৯২) ইংলিশ কবি।

(১২) স্বার্থপরতাকে বেঁচে থাকার একটি মূলনীতি হিসাবে গ্রহন করা উচিৎ এমন মতবাদের পক্ষে ওকালতি করার করছে বলে সমালোচকরা কখনো কখনো ‘দ্য সেলফিশ জিন’ বইটিকে ভুল বুঝেছেন,! অন্যদের ক্ষেত্রে, হয়তো তার কারণ, তারা বইটার শুধু শিরোনামই পড়েছেন বা প্রথম এক দুই পাতার বেশী আর তারা অগ্রসরই হননি; তারা ভেবেছেন, আমি বলছি যে, আমরা পছন্দ করি বা না করি, স্বার্থপরতা ও অন্যান্য নোংরা আচরণ আমাদের প্রকৃতির অপরিহার্য অংশ। এই ভুলের ফাঁদে পড়াটা খুব সহজ, যদি আপনি ভাবেন, যেমন বহুমানুষই অকারণেই মনে করেন, জিনগত ‘ডিটারমিনেশন’ বা পূর্বনির্ধারণ চিরকালের জন্য, অমোচনীয়– চূড়ান্ত, অপ্রতিবর্তনযোগ্য। কিন্তু বাস্তবিকভাবে জিন শুধুমাত্র পরিসংখ্যানগতভাবে কোনো আচরণ নির্ধারণ করে (মূল বইয়ের পৃষ্ঠা ৪৬-৫০ দ্রষ্টব্য); একটি ভালো সমতুল্য উদাহরণ হতে পারে যেমন: ব্যাপকভাবে যে সাধারণীকরণকে মেনে নেয়া হয়েছে, “রাতের বেলায় লাল আকাশ মেষপালকের জন্য আনন্দ। হয়তো পরিসংখ্যানগতভাবেও এটি বাস্তব সত্য হতে পারে যে, ভালো লাল কোনো সুর্যাস্ত পরের দিনটিও সুন্দর হবে এমন ভবিষ্যদ্বাণী করে। কিন্তু আমরা সেই ভবিষ্যদ্বাণীর উপর অনেক পরিমান টাকা বাজী রাখবো না কখনোই। আমরা খুব ভালো করে জানি আবহাওয়া খুবই জটিল একটি প্রক্রিয়ায় নানা উপাদানের পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রভাবিত হয়। যেকোনো আবহাওয়ার পূর্বাভাসের ভুল হবার সম্ভাবনা আছে। এটি একটি পরিসংখ্যানগত পূর্বাভাস মাত্র। আমরা কিন্তু দেখি না লাল সুর্যাস্ত কোনো রকমের ব্যতিক্রম ছাড়াই বা অনিবার্যভাবে এর পরের দিনের ভালো আবহাওয়া নিশ্চিৎ করে এবং আমাদেরও এমন কোনো কিছু ভাবা উচিৎ না যে জিনও অনিবার্যভাবে কিছু নির্ধারণ করতে পারে। কোনো কারণই নেই কেন জিনের প্রভাব সহজেই অন্য কিছুর প্রভাবে বাতিল বা ভিন্ন হবে না। জিনগত ডিটারমিনিজম নিয়ে এবং ভুল বোঝার বিষয়টি কেন এখানে ঘটে, সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য The Extended Phenotype বইটির দ্বিতীয় অধ্যায় ও আমার 69777, Sociobiology: The New Storm in a Teacup দেখুন; আমাকে এমন কি অভিযুক্ত করা হয়েছে যে আমি নাকি দাবী করেছি সব মানুষই মূলত শিকাগো গ্যাঙ্গস্টার! কিন্তু আমার শিকাগো গ্যাঙ্গস্টারের তুলনামূলক উদাহরণটির (প্রথম অধ্যায়, মূল বইয়ের পৃষ্ঠা ২ এ বর্ণিত) মূল বক্তব্যটি অবশ্যই যা ছিল: ‘কি ধরনের পৃথিবীতে কোনো একটি মানুষের বিশেষ ভালো করছে, সেই বিষয়ে আমাদের জ্ঞান কিন্তু আপনাকে সেই মানুষটি সম্বন্ধে কিছু ধারণা দেয়। এটি সেই শিকাগো গ্যাঙ্গস্টারের কোনো বিশেষ গুণাবলীর সাথে এর কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। এই উদাহরণটায় আমি অনায়াসে ব্যবহার করতে পারতাম এমন কোনো মানুষের কথা, যিনি চার্চ অব ইংল্যান্ডের শীর্ষস্থানে আরোহন করেছেন বা কোন অ্যাথিনিয়ামে (কোনো প্রাচীন বিদ্যামন্দিরে) নির্বাচিত হয়েছেন। যাই হোক না কেন, কোনো ক্ষেত্রেই এটি মানুষটি নয় বরং জিনরা হচ্ছে আমার অনুরুপ উদাহরণের বিষয়।

এই বিষয়টি এবং অন্যান্য কিছু অতিমাত্রায় আক্ষরিকভাবে গ্রহন করার কারণে উদ্ভূত ভুল বোঝাবুঝির বিষয়গুলো আমি আলোচনা করেছিলাম আমার পেপার in defence of selfish genes এ, যেখান থেকে উপরের উদ্ধৃতিটি নেয়া হয়েছে।

এখানে আমি অবশ্যই যোগ করবো, এই অধ্যায়ে বর্ণিত আকস্মিক রাজনৈতিক পাশ্বমন্তব্যের কারণ ১৯৮৯ সালে বইটি পুনপাঠ করা আমার জন্য বেশ অস্বস্তিকর ছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রিটেনের শ্রমজীবি মানুষের প্রতি কতবার অবশ্যই এটি বলতে হবে (পুরো গ্রুপকে ধ্বংস হওয়া থেকে বাঁচাতে স্বার্থপর লোভ সংবরণ করার প্রয়োজনীয়তা); এটি পড়লে আমাকে মনে হতে পারে টরি বা রক্ষণশীলদের মত কথা বলছি (মূল বইয়ের পৃষ্ঠা ১০)! ১৯৭৫ সালে, যখন এটি লেখা হয়েছিল, তখন একটি সমাজতান্ত্রিক সরকার, যাদের ক্ষমতায় আনতে আমি ভোট দিয়ে সাহায্য করেছিলাম, ২৩ শতাংশ মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে হতাশাজনকভাবে টিকে থাকার সংগ্রাম করছিল এবং অবশ্যই তারা বেশী বেতনের দাবী সামলাতে চিন্তিত ছিল। আমার মন্তব্য পড়ে মনে হতে পারে যে সেই সময়ের যে কোন শ্রমমন্ত্রীর ভাষণ থেকে সেটি সংগ্রহ করা হয়েছে। এখন ব্রিটেনে একটি সরকার আছে, যা নতুন ডানপন্থী, যারা নিজেদের সংকীর্ণতা আর স্বার্থপরতাকে আদর্শের পর্যায়ে উন্নীত করেছে। আমার শব্দগুলো সংশ্লিষ্টতার কারণে একটি নতুন ধরনের কদর্যতা অর্জন করেছে, যে কারণে আমি আক্ষেপ প্রকাশ করছি। এমন না যে আমি কথাগুলো ফিরিয়ে নিচ্ছি; স্বার্থপর হ্রস্বদৃষ্টিতা এখনও অনাকাঙ্খিত পরিণতির কারণ যা আমি উল্লেখ করেছিলাম। কিন্তু ইদানীং, যদি কেউ ব্রিটেনে স্বার্থপর হ্রস্বদৃষ্টি উদাহরণ সন্ধান করতে চান, কারোরই উচিৎ হবে না প্রথমে কর্মজীবি শ্রেণীর দিকে তাকানো। আসলেই সম্ভবতই এটাই ভালো হবে কোনো একটি বৈজ্ঞানিক লেখাকে রাজনৈতিক মন্তব্য দিয়ে ভারাক্রান্ত করা থেকে পুরোপুরি বিরত থাকা। কারণ বিস্ময়করভাবে এই সব মন্তব্যগুলো তার সময় উপযোগিতা হারায় খুব দ্রুত। ১৯৩০ এর দশকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন বিজ্ঞানীরা –জে. বি. এস. হলডেন, ল্যান্সেলট হগবেন, যেমন– তাদের লেখায় বহু সময়-অনুপযোগী মন্তব্যে পূর্ণ।

(১৩) পুরুষ পতঙ্গ সংক্রান্ত এই অদ্ভুত তথ্যটি, আমি শুনেছিলাম ক্যাডিস ফ্লাই নিয়ে গবেষণা করছেন এমন একজন সহকর্মীর লেকচারে, তিনি বলেছিলেন যে তিনি চাইছেন ক্যাডিস মাছিদের বন্দীদশায় প্রজনন করানোর জন্য কিন্তু তিনি যতই চেষ্টা করছিলেন না কেন তিনি তাদের প্রজনন করতে প্ররোচিত করতে পারছিলেন না। এটি শুনে সেখানে সামনের সারিতে বসা এক কীটতত্ত্ববিদ্যার অধ্যাপক গর্জন করে উঠেছিলেন, যেন সবচেয়ে আবশ্যিক সুস্পষ্ট একটি বিষয় এখানে উপেক্ষা করা হয়েছে, “আপনি কি তাদের মাথাগুলো কেটে দিয়ে চেষ্টা করে দেখেননি?”

(১৪) কামিকাজি (স্বর্গীয় বাতাস) জাপানী আত্মঘাতী বোমারু বিমান চালকরা এই নামে পরিচিত ছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে মিত্র নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজের বিরুদ্ধে জাপানী সেনাবাহিনী এই পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন প্রথাগত যুদ্ধ কৌশলের ব্যতিক্রম একটি পন্থা হিসাবে।

(১৫) জীববিজ্ঞানে ‘ফিটনেস’ শব্দটির ভিন্ন অর্থ আছে। বিবর্তন আর যৌন নির্বাচন তত্ত্বে এটি প্রধান একটি ধারণা। এটি জেনোটাইপ কিংবা ফেনোটাইপ উভয় ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা যেতে পারে কোনো একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে। উভয় ক্ষেত্রে এটি একক সদস্যের প্রজনন সাফল্যের বিষয়টি ইঙ্গিত করে। কোনো একটি সুনির্দিষ্ট জেনোটাইপ বা ফেনোটাইপসহ গড়পড়তা কোনো সদস্য পরবর্তী প্রজন্মের জিন সম্ভারে গড়ে যে অবদান রাখে সেটা ফিটনেসের সমান। ডারউইনীয় ফিটনেস শব্দটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে শারীরিক বা ফিজিকাল ফিটনেসের সাথে এর পার্থক্য করতে। যেখানে ফিটনেস কোনো একটি জিনের অ্যালিলদের কোনো জিনের বা জিন লোকাসের বিভিন্ন বিকল্প রুপের একটি) মধ্যকার পার্থক্যকে প্রভাবিত করতে পারে। কোনো জিনপুলে এই অ্যালিলগুলোর উপস্থিতির হার বদলে যেতে পারে প্রজন্মান্তরে প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। কোনো একক সদস্যদের ফিটনেসের উপর যে অ্যালিলগুলো বেশী ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে তাদের সংখ্যাই জিনপুলে ক্রমশ বাড়তে থাকবে, এই প্রক্রিয়াটির নামই প্রাকৃতিক নির্বাচন। ফিটনেস মানে জীবন কতটা দীর্ঘ সেটার পরিমাপ নয়। সুপরিচিত বাক্য Survival of the fittest কে আমরা ব্যাখ্যা করতে পারি, সেই ফর্ম বা রুপটির ( জিনোটাইপিক অথবা ফিনোটাইপিক) টিকে থাকা, যা পরবর্তী প্রজন্মগুলোয় তার বেশী সংখ্যক কপি বা প্রতিলিপি রেখে যাবে।

(১৬) ভেরো কপনার ওয়াইন-এডওয়ার্ডস (১৯০৬-১৯৯৭) ইংলিশ প্রাণিবিজ্ঞানী। তিনি সুপরিচিত গ্রুপ সিলেকশন মতবাদটি প্রচারের জন্য, যা দাবী করে প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ করছে গ্রুপ স্তরে।

(১৭) রিডাকশন অ্যাড আবসার্ডাম বা রিডাকশন টু অ্যাবসার্ডিটি, যুক্তি তর্কের একটি সাধারণ যুক্তি, যা প্রদর্শন করতে চায় কোন একটি প্রস্তাবনা সত্যি কারণ মিথ্যা, অপ্রমাণযোগ্য অথবা অসম্ভব ফলাফল হবে এটি অস্বীকার করলে অথবা প্রদর্শন করা কোনো একটি স্টেটমেন্ট মিথ্যা, কারণ এটি গ্রহন করলে মিথ্যা, অপ্রমাণযোগ্য অথবা অসম্ভব ফলাফল হবে।

(১৮) “স্টটিং’ চতুষ্পদী প্রাণী বিশেষ করে গেজেদের মধ্যে দৃশ্যমান একটি আচরণ, যখন তারা লাফ দিয়ে শূন্যে ভেসে ওঠে, মাটি থেকে চার পা তুলে একসাথে, সাধারণ পাগুলো শক্ত সোজা হয়ে থাকে, ধনুকের মত বাঁকানো পিঠ এবং মাথা নীচের দিকে মুখ করে দেখে।

(১৯) ফ্রিডেরিখ লিওপোল্ড অগাস্ট ভাইজমান (১৮৩৪-১৯১৪): জার্মান বিবর্তন জীববিজ্ঞানী। আর্নস্ট মায়ার তাকে ডারউইনের পর উনবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিবর্তন তাত্ত্বিক বলে উল্লেখ করেছিলেন।

(২০) জিন নির্বাচনের আমার এই ম্যানিফেস্টোটি লেখার পর, আমার পরবর্তীতে ভিন্ন একটি ভাবনা হয়েছিল– আরো কি কোনো ‘ধরনের উচ্চতর পর্যায় আছে যেখানে প্রাকৃতিক নির্বাচন কাজ করে কিনা বিবর্তনের দীর্ঘ সময় জুড়ে। আমি দ্রুত সেটা যোগ করার চেষ্টা করলাম, যখন আমি বলি “উচ্চতর পর্যায়, আমি কিন্তু সেটি বলতে কোনো ‘গ্রুপ সিলেকশন বা নির্বাচন’ বোঝাচ্ছি না। আমি কথা বলছি আরো সূক্ষ্ম আর আরো বেশী কৌতূলদ্দেীপক একটি বিষয় নিয়ে। আমার এখন মনে হয় শুধুমাত্র কিছু একক সদস্য অন্যদের চেয়ে বেশী ভালোভাবে টিকে থাকেই না, পুরো একটি শ্রেণীর জীবরাও অন্যদের চেয়ে বেশী দক্ষতার সাথে বিবর্তিত হতে পারে। অবশ্যই যে বিবর্তিত হবার কথা নিয়ে আমরা আলোচনা করছি এখানে সেটা সেই একই বিবর্তন প্রক্রিয়া, যা ঘটে নির্বাচনের মাধ্যমে, আর নির্বাচনটি হয় জিন পর্যায়ে। মিউটেশনগুলো বিশেষ সহায়তা পায় এখনও কারণ একক সদস্যদের উপর বেঁচে থাকা আর তাদের প্রজনন সাফল্যের উপর তাদের প্রভাব আছে। কিন্তু কোনো একটি বড় নতুন মিউটেশন, মূল জণতাত্ত্বিক পরিকল্পনায় আরো অসংখ্য নানামুখী বিবর্তন ঘটার পথটি উন্মুক্ত করে দেয় ভবিষ্যত বহু মিলিয়ন বছর ধরে। সুতরাং একধরনের উচ্চ পর্যায়ের নির্বাচন ঘটতে পারে ভ্রূণতত্ত্বে যা নিজেদের উন্মুক্ত করে দেয় বিবর্তনের জন্য: কোনো একটি নির্বাচন বিবর্তনশীলতার পক্ষে, যা বিবর্তন হবার সপক্ষে কাজ করে। এই ধরনের নির্বাচন এমনকি হতে পারে পুঞ্জীভূত এবং সেকারণের ধাপে ধাপে অগ্রসর এমনভাবে যা গ্রুপ সিলেকশনে দেখা যায় না। এই ধারণাটি আরো বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে আমার The Evolution of Evolvability শীর্ষক একটি প্রবন্ধে, যেটি লেখার জন্য আমি অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম Blind Watchmaker নিয়ে কম্পিউটারে কাজ করার সময়। Blind Watchmaker একটি কম্পিউটার প্রোগ্রাম যা বিবর্তনের বিশেষ ক্ষেত্রগুলোর মত কাল্পনিক পরিস্থিতি তৈরী করতে পারে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *