নিঃসঙ্গ-সম্রাট – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
.
একনিষ্ঠ শিশিরভক্ত এবং তরুণ লেখক-লেখিকাদের বন্ধু
দেবকুমার বসু-কে
.
লেখকের কথা
এই রচনাটি উপন্যাস, জীবনীগ্রন্থ নয়। যতদূর সম্ভব তথ্যগুলি ঠিক রেখে কল্পনা দিয়ে ভরাট করতে হয়েছে অনেকখানি। উপন্যাসের প্রধান শক্তি তার সংলাপ, কোনও ইতিহাস বা তথ্যগ্রন্থে সংলাপ প্রায় থাকে না, সুতরাং সংলাপগুলি আমাকে গড়ে নিতে হয়েছে চরিত্রগুলির সময়, স্বভাব ও কথা বলার ভঙ্গি অনুসরণ করে। তবে, রবীন্দ্রনাথের কিছু কিছু সংলাপ আমি তাঁর বিভিন্ন রচনা থেকে গ্রহণ করেছি।
কোথাও কোথাও কালাতিক্রমণ ঘটে থাকতে পারে। যেমন সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে শিশিরকুমার ভাদুড়ীর সাক্ষাৎ হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু কোন ফিল্মের অভিনয়ের প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন সত্যজিৎ, সে বিষয়ে সংশয় আছে, এর কোনও লিখিত বিবরণ আমি পাইনি, লোকমুখে শুনেছি মাত্র। আমার মনে হয়েছে, জলসাঘরের জমিদার বিশ্বম্ভর রায়ের চরিত্রটিই শিশিরকুমারের পক্ষে খুব মানানসই হত।
বেশ কয়েক বছর ধরেই প্রকাশক দেবকুমার বসু শিশিরকুমারকে নিয়ে একটি উপন্যাস রচনা করার জন্য আমাকে প্ররোচিত করছিলেন। প্রধানত তাঁর উৎসাহেই আমি এবারে এই কঠিন কাজটি করতে দুঃসাহসী হয়েছি। তিনি এবং প্রবালকুমার বসু অনবরত আমাকে অনেক বইপত্র দিয়ে সাহায্য করেছেন, এঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।
এক
২১ মার্চ, দোল পূর্ণিমা ১৯২৪
মানিকতলার কাছে একটা দোতলা বাড়ির সামনে ঘোড়ার গাড়ি থেকে নামলেন মণিলাল। মধ্যবয়েসি যুবাপুরুষ। বেশ শৌখিন, মাথার চুল টেরিকাটা, চোখে প্যাশ্ন, হলুদ রঙের সিল্কের বেনিয়ান ও কোঁচানো শান্তিপুরি ধুতি পরা, কাঁধে একটি উত্তরীয়। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে সারা সকাল, পথ খানিকটা কাদাকাদা। ধুতির কোঁচা সামলে তিনি এগিয়ে গেলেন বাড়িটির দরজার দিকে, তাঁর পায়ে মরোক্কো চামড়ার সুদৃশ্য চটি, তা কিছুটা কর্দমাক্ত হল।
কয়েকবার কড়া নাড়ার পর দরজা খুলে গেল। একজন ভৃত্য মণিলালকে চিনতে পেরে বলল, আজ্ঞে, আসেন বাবু, আসেন।
বসবার ঘরে এসে মণিলাল জিজ্ঞেস করলেন, তোমার বড়বাবু কোথায়? বেরিয়েছে নাকি?
ভৃত্যটি বলল, আজ্ঞে না। তিনি এখনও ঘুমুচ্ছেন।
বেনিয়ানের ওপর দিকে ঘড়ি রাখার জন্য একটি ছোট্ট পকেট থাকে। মণিলাল সেখান থেকে বার করলেন একটি গোলাকার সোনার ঘড়ি। সময় দেখলেন, প্রায় সাড়ে দশটা।
মণিলাল ভুরু তুলে বললেন, এত বেলা অবধি ঘুমোচ্ছে? মা কোথায়?
ভৃত্য বলল, তিনি ভিতরের ঘরে বসে সুপুরি কুচোচ্ছেন। আপনে দেখা করবেন? মায়ের পুজো সারা হয়ে গিয়েছে।
ভেতরে একটি ছোট উঠোন। তার এক পাশে বাসন মাজার জন্য একটি গঙ্গাজলের কল। সেখানে ডাঁই করা এঁটো বাসন দেখলেই বোঝা যায়, এ পরিবারে জনসংখ্যা অনেক। একজন দাসী সেই বাসন মেজে চলেছে পাকা তেঁতুল আর ছাই দিয়ে।
উঠোনের অন্য প্রান্তে একটি ঘরের মধ্যে পালঙ্কের ওপর বসে আছেন কমলেকামিনী। বিধবা হয়েছেন বছর দশেক আগে। সাদা থান পরা, গতর একটু ভারী হয়েছে, তবু কী অসাধারণ রূপ। ঠিক যেন রাজেন্দ্রাণী। ছেলেরাও আড়ালে বলে, কুইন ভিক্টোরিয়া। এই বয়েসেও রং যেন ফেটে পড়ছে!
কিছুদিন যাবৎ গেঁটে-বাত হয়েছে, বেশি চলাফেরা করেন না। এই ঘরে বসে বসেই তিনি বৃহৎ সংসারটি সামলান। সবকিছু তাঁর নখদর্পণে। পুঁই শাকে কুমড়োর সঙ্গে বড়ি দিয়ে রান্না হবে কি না, সে ব্যাপারেও তাঁর অনুমতি নেওয়া হয়।
সামনে একটা সোনার মতন ঝকঝকে পানের বাটা। একটা খবরের কাগজ পাতা, তার ওপরে সুপুরির স্তুপ। কমলেকামিনী একটা জঁতি দিয়ে সুপুরি কুচোচ্ছেন। মণিলাল আগে যে ক’বার কমলেকামিনীকে দেখেছেন, ঠিক এই একই দৃশ্য। তিনি এই একই কর্মে নিরত। সারাদিনে এ বাড়িতে কত সুপুরি লাগে!
বাইরে চটি খুলে মণিলাল ভেতরে এসে প্রণাম করলেন, কমলেকামিনী চন্দন রঙের পা দু’খানি এগিয়ে দিলেন। এক হাত বাড়িয়ে মণিলালের থুতনি ধরে, সেই হাত ছোঁয়ালেন নিজের ঠোঁটে। অস্ফুট স্বরে বললেন, শতায়ু হও।
তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কী করে এলে গো? আজ তো দোল পুন্নিমে। ছোঁড়ারা গায়ে রং দেয়নি? তোমায় ছেড়ে দিলে?
মণিলাল বললেন, আমি ছ্যাকরা গাড়িতে এসিছি। হুল্লোড়বাজগুলোন এখনও বেরোয়নিকো রাস্তায়। বৃষ্টিও পড়ে চলেছে।
কমলেকামিনী বললেন, বসো, বাবা, বসো। অবনবাবু কেমন আছেন?
মণিলাল দাঁড়িয়ে থেকেই বললেন, তিনি ভালো আছেন। দিব্যি আছেন। তিনি তো সব সময় খোস মেজাজেই থাকেন। মা জননী, শিশির এত বেলা পর্যন্ত ঘুমুচ্ছে শুনলাম, ওর কি শরীর খারাপ নাকি?
কমলেকামিনী বললেন, না গো, শরীর খারাপ কেন হবে? ওর স্বভাব তো জানো। মাঝে মাঝে সারা রাতই ঘুমোয় না, ভোরবেলা বিছনায় যায়। কাল কী হয়েছিল জানি না, বাবা রে বাবা, একেবারে সিংহের মতন গজরাচ্ছিল আর কী সব পদ্য বলছিল ঘুরে ঘুরে। ওপরের ওই বারান্দাটায় যখন পায়চারি করে আর পদ্য বলে, আমি নীচ থেকে সব শুনতে পাই। তবে ইংরিজি বলে, তাই বুঝি নাকো। কাল একবার আমার ঘুম ভেঙে গেল, তখন ঘড়িতে রাত সাড়ে তিনটে, তখনও ঘুরে ঘুরে গজরাচ্ছে। কখন শুতে গেছে কে জানে!
মণিলাল বললেন, ওকে নিয়ে যে একবার বেরুনো দরকার। কেউ ডাকতে পারে না?
আয়ত চক্ষুদুটি বিস্ফারিত করে কমলেকামিনী বললেন, ওরে বাবা, ওর মেজাজ জানো না? কে ডাকতে যাবে? তাকে এমন দাবড়ানি দেবে! মেরেও বসতে পারে!
মণিলাল বললেন, আমি গিয়ে চেষ্টা করব, মা জননী?
সঙ্গে সঙ্গে মুখখানি সহাস্য করে কমলেকামিনী বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, তাই বরং করো গে! তোমার ওপর মুখ করলে তুমিও উচিত মতন জবাব দেবে।
আর একবার ওঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে মণিলাল বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাকে যেন খুঁজলেন।
একজন ভৃত্যকে দেখে হাতছানি দিয়ে কাছে ডেকে মণিলাল জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের বড়বাবু ঘুম থেকে উঠে প্রথমে কী খান? চা না কফি?
ভৃত্যটি সংকুচিতভাবে কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে বলল, উনি এখন উঠবেননি।
মণিলাল গম্ভীরভাবে বললেন, আমি জিজ্ঞেস করছি, কী খান? চা না কফি?
লোকটি এবার বলল, এক একদিন বেলের পানা দিতে বলেন। আর বেশির ভাগ দিন কফি।
মণিলাল বললেন, ঠিক আছে। দু’কাপ কফি তৈয়ের করে নিয়ে এসো ওপরে। জলদি।
সিঁড়ি দিয়ে মণিলাল উঠতে লাগলেন, ওপর থেকে নেমে এল বিশ্বনাথ। ছিপছিপে চেহারা, ধুতি ও গেঞ্জি পরা।
মণিলালকে দেখে হাত তুলে নমস্কার করে বিশ্বনাথ বলল, দাদা তো এখনও জাগেননি৷ ভোরের আলো দেখার পর শুতে গেছেন, উঠবেন সেই দুপুর পার করে।
মণিলাল বললেন, সে আমি দেখছি। তুমি ঠিক সময়ে চলে এসো, না, না, কিছুটা আগেই। চারটের মধ্যে। দেশবন্ধুকে কে আনতে যাবে? ঠিক আছে তো?
বিশ্বনাথ বলল, আজ্ঞে হ্যাঁ। তারা যাবে। দেশবন্ধু বলে দিয়েছেন, গাড়ি নিতে হবে না। উনি নিজের গাড়িতেই আসবেন। শুধু একজন কেউ গেলেই হল।
মণিলাল উঠে গেলেন ওপরে।
একটা টানা বারান্দার এক পাশে কয়েকটি ঘর। অন্য পাশের রেলিংয়ে কয়েকটি পাখির খাঁচা। ঘরগুলিতে মানুষজনের কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে।
বারান্দার একেবারে শেষ প্রান্তের ঘরটির দরজা ভেজানো। এখানে কয়েক ধাপ সিঁড়ির নীচে আর একটি ছোট বারান্দা। পাশের একটি আমগাছ এমনভাবে ঝুঁকে আছে যে ফলের সময় সে বারান্দায় দাঁড়িয়েই হাত বাড়িয়ে আম ছেঁড়া যায়।
এ পরিবারের একজন মানুষ রাত্তিরবেলা ঘুমের মধ্যে সকলের অজান্তে মারা গিয়েছিলেন, সকালবেলা দরজা ভেঙে তাঁর মৃতদেহ বার করতে হয়। সেই থেকে এ বাড়ির কেউ রাত্তিরবেলা ভেতর থেকে দরজায় ছিটকিনি বা খিল দেয় না। ভেজানোই থাকে।
মণিলাল ধাক্কা দিতেই সে দরজা খুলে গেল।
পালঙ্ক নয়, বেশি বড়ও নয়, নারীসঙ্গহীন পুরুষের একলার খাট। তাতে চিত হয়ে ঘুমন্ত এক পঁয়ত্রিশ বছর বয়স্ক যুবাপুরুষ, কমলেকামিনীর জ্যেষ্ঠপুত্র শিশিরকুমার। মায়ের শুধু গায়ের রংটাই সে পেয়েছে, কিন্তু রূপ বা শ্রীর বিচারে অনেকটাই ন্যূন। বলিষ্ঠ শরীর, পরনে একটি সিল্কের লুঙ্গি ও ফতুয়া। শেষ রাতে এখনও একটু একটু ঠান্ডা পড়ে, একটা মুগার চাদর পাশে পড়ে আছে। নিদ্রিত মানুষটি তা গায়ে দেয়নি কিংবা ভুলে গেছে।
মণিলাল ঘরের মধ্যে একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন।
ঘর-ভরতি শুধু বই আর বই। দেওয়ালের র্যাকে উপছে ওঠা বই, মেঝেতে বই, খাটের নীচে বই, বিছানাতেও বই। একাধিক বইয়ের আধখানা ওলটানো।
মণিলাল জানেন, এই মানুষটা যখনই একা, এক মুহূর্তও বই ছাড়া থাকতে পারে না। আড্ডা দিতে খুবই ভালোবাসে, আবার অন্য সময়ে বড় নিঃসঙ্গ, তখন কাব্যসাহিত্যই তার একমাত্র সঙ্গী।
ঘরটির চেহারা দেখলেই বোঝা যায়, এখানে কোনও নারীর হাতের স্পর্শ নেই। গৃহভৃত্যদেরও বইপত্রে হাত দেওয়া নিষেধ।
মণিলালের একবার মনে হল, এই মানুষটাকে গ্রন্থের জগৎ থেকে টেনে এনে রঙ্গালয়ের জগতে নিয়ে আসা ঠিক হয়েছে কি না!
কিন্তু এখন আর উপায় নেই। নিক্ষিপ্ত তির শুধু সামনের দিকেই যায়, লক্ষ্যভেদ করুক বা না করুক।
মণিলালকে ডাকতে হল না। চোখ খুলে গেল শিশিরের। ভালো বাংলায় যাকে বলে ‘রোষকশায়িত নয়নে’, সেইভাবে কর্কশ গলায় বললেন, তুই কে রে হতভাগা? তোকে কে এখানে আসতে বলেছে? কেন আমার ঘুম ভাঙালি?
মণিলালও দৃঢ়তার সঙ্গে উত্তর দিলেন, কেউ বলেনি, আমি নিজেই এসেছি। সারারাত না ঘুমিয়ে দিনেরবেলা ঘুমোনো মোটেই স্বাস্থ্যকর নয়। ওঠ্!
চক্ষু সংকুচিত করে, শুধু মুখের কেন্দ্রবিন্দুটি দেখলেন শিশির।
তারপর ধড়মড় করে উঠে বসে বললেন, মণি? তুই কেন এসেছিস এত ভোরবেলা? কী হয়েছে রে, কেউ মারা গেছে?
মণিলাল বললেন, কেউ মারা যায়নি। আমি ভোরবেলাও আসিনি। এখন পৌনে এগারোটা। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে। আমাদের যেতে হবে না?
শিশির সরলভাবে বললেন, যেতে হবে? কোথায়?
মণিলাল জিজ্ঞেস করলেন, কাল সারারাত জেগেছিস, শুনলাম? কটা বোতল শেষ করেছিস?
দু’হাতে চোখ কচলাতে কচলাতে শিশির বললেন, একটাও না। তুই বিশ্বাস কর, মণি, কাল এক ফোঁটাও মদ খাইনি!
মণিলাল বললেন, এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে! এক্সসেলেন্ট! ব্রাভো! আমি জানি, তোর মনের জোর আছে শিশির। নে, তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নে! এক্ষুনি বেরুতে হবে রে।
শিশির বলল, কোথায় যাব?
মণিলাল বললেন, শিশির, আজকের তারিখটা তোর মনে নেই? সব ঠিকঠাক সাজানো হয়েছে কি না দেখে আসতে হবে। নতুন লাইটগুলো দিয়ে যাবে বারোটার সময়।
শিশির একবার আড়মোড়া ভেঙে নামলেন খাট থেকে। মুখে বিরক্তির ছাপ। দু’দিন দাড়ি কামানো হয়নি, হাত দিয়ে ঘষতে লাগলেন চিবুক।
দেওয়ালের দিকে ফিরে বললেন, বন্ধ করে দে।
মণিলাল চমকে গিয়ে বললেন, কী বন্ধ করে দেব?
শিশির গম্ভীরভাবে বললেন, আজ উদ্বোধন হবে না। ক্যানসেল। সব টিকিট ফেরত দেবার ব্যবস্থা কর।
মুখ না ধুয়েই তিনি একটা চুরুট ধরালেন।
মণিলাল একটা কেদারায় বসে পড়ে বললেন, তুই কী বলছিস শিশির? পাগল হয়েছিস! সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে, এত পোস্টার পড়েছে যে শহরের কোনও দেওয়াল বুঝি বাকি নেই। আজ তোর নিজস্ব দলের প্রথম শো। ওপনিং সেরিমনিতে প্রদীপ জ্বালবেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, আরও কত বিশিষ্ট মানুষজন আসবেন।
জোর ধমকের সুরে শিশির বললেন, এলে তাঁরা কী দেখবেন? আমি কি ধ্যাস্টামো করে লোক হাসাব?
মণিলাল বললেন, না, না, দেখবি, আজকের শো জমে যাবে। কত ভাল ভাল গান আছে। কৃষ্ণচন্দ্র দে-কে ডাকা হয়েছে। তিনি অনেকগুলি গান গাইবেন। নজরুল ইসলাম নামে ছেলেটির খুব নাম হয়েছে। তাকে বলেছি, কবিতা পাঠ করতে।
শিশির বললেন, ধ্যাৎ! লোকে আসবে শিশির ভাদুড়ীর অভিনয় দেখতে, তারপর যখন দেখবে, পুরো শো-তেই আমি নেই, নাটকই নেই, তখন তারা খেপে উঠবে না? ঢিল ছুড়বে, চেয়ার ভাঙবে! আমি কি এই জন্য থিয়েটারে এসেছিলাম? প্যানপ্যানানি গান, ধেই ধেই নাচ আর ফ্যাচফেচে কান্না দেখাতে? দিস ইজ চিটিং! আমি আজ যাবই না। চুলোয় যাক সব কিছু! তুই থিয়েটারের দরজায় নোটিশ সেঁটে দে, শো বন্ধ!
দুই – পশ্চাৎপট
পড়ন্ত জমিদার বংশের ছেলে শিশিরকুমার ভাদুড়ী ছাত্র বয়েস থেকেই তার বন্ধুদের কাছে হিরো। তেজস্বী, রূপবান, ধারালো কথাবার্তা। ছাত্র হিসেবে সে মেধাবী, কিন্তু মনোযোগী নয়। অন্যদের তুলনায় সে অনেক বেশি বই পড়ে, কিন্তু পরীক্ষায় প্রথম-দ্বিতীয় হবার উদ্যম নেই। ইংরেজিতে এম এ পাশ করবার পর সে অধ্যাপনা শুরু করেছিল মেট্রোপলিটান কলেজে। ছাত্রদের মধ্যে জনপ্রিয়, তার শেক্সপিয়ার আবৃত্তি সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শোনে। বাংলা কবিতার আবৃত্তিতেও সে একই রকম দক্ষ।
ছাত্র বয়েস থেকেই শিশিরের অভিনয় করার দিকে ঝোঁক। ইউনিভার্সিটি ইন্সটিটিউটে সে অনেকগুলি শখের থিয়েটারে অভিনয় করেছে, ইংরেজি ও বাংলা নাটকে। একবার ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ দেখতে এসেছিলেন নাট্যকার রবি ঠাকুর, তখন তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি। নাটক দেখার পর বাইরে আসতে আসতে নাট্যকার তাঁর এক সঙ্গীকে বললেন, কেদারের ভূমিকা করল, ওই ছেলেটি কে হে? দেখতে দেখতে আমার ঈর্ষা হচ্ছিল। একদা ওই পার্টে আমার যশ ছিল।
ছ’বছর কলেজে পড়াবার সময়েও শিশিরকুমার প্রায়ই নানা নাটকের মধ্যমণি সাজতেন। তারপর অধ্যাপনা ছেড়ে পাকাপাকি যোগ দিলেন পেশাদারি মঞ্চে। তাঁর আগে এরকম ভদ্র পরিবারের উচ্চশিক্ষিত কোনও যুবক পেশাদারি থিয়েটারে আসেননি, কারণ ওই জগৎটা সম্পর্কে অনেক বদনাম। অভিনেত্রীরা আসে বারাঙ্গনা পল্লি থেকে, অভিনেতারা প্রায় সবাই অশিক্ষিত এবং নানা রকম নেশার দাস। শিশিরের এর মধ্যে আগমনের প্রধান উদ্দেশ্য বাংলার রঙ্গমঞ্চকে পরিচ্ছন্ন করে জাতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ করে তোলা। অন্য অনেক দেশেই একটি জাতির রুচি গঠনের জন্য থিয়েটারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে।
১৯১২ সালে গিরিশচন্দ্র চিরবিদায় নিলেন। তারপর থেকেই বাংলা রঙ্গমঞ্চগুলির বড়ই দৈন্যদশা। গোটা চারেক মঞ্চে টিমটিম করে জ্বলছে পাদপ্রদীপ। দর্শক আকর্ষণ করার মতন নাটকও নেই, অভিনেতাও নেই, শুধু গিরিশবাবুর ছেলে দানীবাবুই একমাত্র স্টার। বাবার মতন পড়াশুনো করেননি দানীবাবু, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে দখল নেই, তবে কণ্ঠস্বর অপূর্ব, সহজেই আবেগ সঞ্চার করতে পারেন, তাঁর কৃতিত্বের অনেকটাই অশিক্ষিত পটুত্ব বলা যায়।
কলেজের ক্লাসরুম ছেড়ে পেশাদারি রঙ্গমঞ্চে পদার্পণ করতে গিয়ে অনেক ঝুঁকি নিতে হয়েছিল শিশিরকুমারকে। বদনাম তিনি গ্রাহ্য করতেন না। কিন্তু তাঁর মেলামেশা ছিল উচ্চশিক্ষিত, রুচিবান ব্যক্তিদের সঙ্গে। এঁরা কি তাঁকে পরিত্যাগ করবেন? তাঁর সহপাঠীদের মধ্যে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, কালিদাস রায় প্রমুখ তাঁকে সমর্থন করেছিলেন, উৎসাহ দিয়েছিলেন কথাসাহিত্যিক শরৎচন্দ্র। সবচেয়ে বড় কথা, প্রথমে কিছুটা আপত্তি জানালেও শেষ পর্যন্ত সম্মতি দিয়েছিলেন তাঁর জননী। মা বেঁকে বসলে শিশিরের ইচ্ছাপূরণ সম্ভব হত না।
ম্যাডান থিয়েটারের কর্নওয়ালিশ মঞ্চে প্রথম দর্শকদের সামনে শিশিরকুমার এলেন আলমগীর-এর ভূমিকায়। শৌখিন অভিনেতা হিসেবে আগেই তাঁর যথেষ্ট সুনাম হয়েছিল, কিন্তু আলমগীর যেন এক অলৌকিক বিস্ময়। সারা শহরে শুধু এই একটাই আলোচনা, এমন অভিনয় কেউ আগে কখনও দেখেনি। গিরিশবাবুর ধারা থেকে এ অভিনয় সম্পূর্ণ অন্য ধরনের। তরুণ সাহিত্যিক অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত প্রথম রাত্রির অভিনয় দেখার পর তাঁর বন্ধুদের বলেছিলেন, জীবনে ভাই তিনটি বিস্ময়কর আবির্ভাব আমি দেখেছি। এক রাত্রে কলকাতায় দারুণ ঝড় উঠেছিল, সে এমনই ঝড়ের দাপট আর বৃষ্টির ঝাপটা, মনে হচ্ছিল বুঝি প্রলয় এসে গেল। ভয়ে অনেকের ঘুমই আসেনি। তারপর ভোরবেলা জানলা খুলেছি, দেখি যে, বৃষ্টি একেবারে থেমে গেছে, পৃথিবী একেবারে শুদ্ধস্নাত, নরম বাতাস, তার মধ্যে পুব আকাশ থেকে উঠে এলেন সূর্য, মনে হল, এরকম সূর্যোদয় আগে কখনও দেখিনি। আর একদিন সকালে জোড়াসাঁকোয় গেছি, একটু অপেক্ষা করতে হচ্ছে, হঠাৎ দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন রবীন্দ্রনাথ। সদ্য স্নান করে এসেছেন। দু’ চোখ ভরে গেল সেই দেবকান্তি মানুষটির বিস্ময়কর আবির্ভাব দেখে। আর, এই কয়েকদিন আগে দেখলাম মঞ্চে শিশিরকুমারের আলমগীরকে। বুকটা ধক করে উঠল। যেন মানুষ নয়, তেজঃপুঞ্জ। সে কী দীপ্তিমান শরীর, প্রশস্ত ললাট, আত্মবিশ্বাসী কণ্ঠস্বর! গিরিশবাবুটাবুর কথা অনেক শুনেছি, কিন্তু কয়েকজন বুড়ো মানুষ বলাবলি করছিল, গিরিশবাবুও কখনও শিশিরকুমারের মতন একক ব্যক্তিত্ব সারা মঞ্চে ছড়িয়ে দিতে পারেননি।
আলমগীরের প্রথম রজনীতে কলকাতার চেহারা ছিল দু’রকম। এক দিক আলোয় ঝলমল করছে, অন্য দিক অন্ধকার। ইংল্যান্ডের রাজকুমার আসছে, তাই শাসক সম্প্রদায় ও তার ধামাধরারা মেতে উঠেছে উৎসবে, আর দেশাত্মবোধে উদ্দীপ্ত বাঙালিরা করছে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ। উত্তর কলকাতায় ঘরে ঘরে নিষ্প্রদীপ, যানবাহন বন্ধ, ডাস্টবিনগুলোকে মাঝ রাস্তায় টেনে এনে রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আগে থেকে বহুল বিজ্ঞাপিত বলে আলমগীরের অভিনয় বন্ধ করা হয়নি। তা ছাড়া এ নাটকও জাতীয়তাবোধের অঙ্গ। বহু মানুষ বিকেল থেকেই রঙ্গালয়ের সামনে এসে বসেছিল, অভিনয়ের সময় প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ। দর্শকদের মধ্যে বসেছিলেন গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দিলীপকুমার রায়, সত্যেন দত্তের মতন অনেকে।
ম্যাডান থিয়েটারের পর পর নাটকগুলি প্রভূত জনপ্রিয় হলেও শিশিরকুমারের সঙ্গে মতবিরোধ হতে লাগল কর্তৃপক্ষের। মঞ্চসজ্জা থেকে আলোর ব্যবহার, দর্শকদের আসন, এই সব কিছু নিয়ে মাথা ঘামান শিশিরকুমার। পশ্চাৎপটে ধ্যাবড়া ধ্যাবড়া ছবি-আঁকা দৃশ্যের বদলে ইতিহাসসম্মত, বাস্তবমুখী দৃশ্যসজ্জার পক্ষপাতী তিনি, যেমন আলমগীর নাটকে রূপনগরের ভুঁইয়া রাজা, নামেই রাজা, আসলে গরিব, চাষবাস করেন, সুতরাং তাঁর প্রাসাদেরও হওয়া উচিত ভগ্নদশা মলিন। সেই জন্যই সেট তৈরি হল ভাঙাচোরা পাথরের বাড়ির মতন। জে এফ ম্যাডানের জামাই রুস্তমজি ধোতিওয়াল একদিন সেট দেখতে এলেন। অমন সাধারণ, আড়ম্বরহীন দৃশ্যপট দেখে তিনি বিরক্ত হয়ে বললেন, এঃ, এত লাখ লাখ রুপিয়া খরচ করছি, লোকে এসে এই দেখবে! পেন্টার হুশেন বেগকে ডেকে ধমক লাগিয়ে বললেন, এসব বদল করো, সোনে লাগাও!
আর একদিন শিশিরকুমার কয়েকজন অভিনেতা-অভিনেত্রীকে নিয়ে মহড়া দিচ্ছেন নতুন নাটকের, হঠাৎ শুনতে পেলেন, একটু দূরে রুস্তমজি কাকে যেন বলছেন, এইসব বাঙালিলোগ বহুৎ ঝুট বাত বলে। এদের বিলকুল বিসওয়াশ করা যায় না।
শুনেই দপ করে জ্বলে উঠলেন শিশিরকুমার। লোকটির দিকে এগিয়ে গিয়ে বললেন, বাঙালিদের সম্পর্কে কী বললেন আপনি? হাউ ডেয়ার ইউ!
রুস্তমজি সঙ্গে সঙ্গে বিনয়ের অবতার হয়ে গিয়ে বললেন, না, না, ভাদুড়ীজি, আপনাকে কিছু বলিনি। আপনি তো বাংগালিদের অ্যাসেট।
শিশিরকুমার হুংকার দিয়ে বললেন, আপনি জাত তুলে কথা বলেছেন। এই বাঙালিদেরই বুকের ওপর বসে রক্তচোষার মতন টাকা রোজগার করবেন, আবার তাদেরই নিন্দে করবেন? আমি আর এখানে একদিনও থাকব না, চললাম।
হনহন করে বেরিয়ে যেতে লাগলেন শিশিরকুমার, তার পেছন পেছন হাত কচলাতে কচলাতে ছুটছেন রুস্তমজি। শিশিরকুমারকে আনার পর থেকে এই ব্যবসায়ে তাঁদের প্রভূত লাভ হচ্ছে, এই সোনার হাঁসটিকে তিনি ছাড়তে চান না। ভাদুড়ীজি, শুনেন, শুনেন, আমি মাফি মাংছি, এইসব বলে অনেক কাকুতি-মিনতি করতে লাগলেন, কিন্তু আর দাঁড়ালেন না শিশিরকুমার। এক কথায় চাকরি ছেড়ে চলে এলেন।
তারপর বেকার অবস্থা। আর অধ্যাপনায় ফিরে যাওয়া যায় না। বন্ধুদের কাছে আফশোস করে বললেন, অবাঙালি ব্যবসাদারদের কথা মান্য করে বাংলা নাটক অভিনয় করতে হবে, এ আমার ধাতে সইবে না। ফ্রি উইল না থাকলে কি কোনও কলা চর্চা করা যায়?
কিছুদিন পর ডাক এল এক ফিলম কোম্পানি থেকে। শরৎচন্দ্রের কাহিনী, ‘আঁধারে আলো’। এর আগেও শিশিরকুমার দু’-একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন, কিন্তু ঠিক স্বস্তি বোধ করেননি। চলচ্চিত্রে বড় বেশি যান্ত্রিকতা, একটানা অভিনয়ের সুযোগ নেই, শুটিংয়ের সময় দু’-তিন মিনিট অন্তর অন্তর কাট, কাট, কাট! এই চলচ্চিত্রের পরিচালনাও করলেন শিশিরকুমার নিজে, আর তাঁর বাল্যবন্ধু নরেশ মিত্র। কিন্তু তাঁর মন জুড়ে রয়েছে রঙ্গমঞ্চ। কে তাঁকে সুযোগ দেবে? তিনি বুঝে গিয়েছেন, কারও অধীনে চাকরি করা তাঁর পক্ষে সম্ভব হবে না। মাঝে মাঝেই প্রকাশ পায় তাঁর আত্মম্ভরিতা। মানুষটাই যে এরকম।
এখন তাঁর আশ্রয় একমাত্র বই।
সাহিত্য তাঁর মন ভরিয়ে রাখে, কিছুক্ষণের জন্য হলেও সব ক্ষোভ ভুলিয়ে দেয়। অনেক সময় বইও লাগে না। বহু কবিতা তাঁর মুখস্থ। বিশেষ করে মাইকেল আর রবীন্দ্রনাথ। অপর দিকে শেকসপিয়ার আর শেলি। জর্জ বার্নার্ড শ’র নাটকের গদ্যও তিনি গড়গড় করে বলে যেতে পারেন স্মৃতি থেকে।
কলেজে পড়াবার সময় সহকর্মীরা বলতেন, শিশির কলেজে আসে সুট-টাই পরে পাক্কা সাহেব সেজে, কিন্তু মনে মনে একেবারে ভেতো বাঙালি। পড়ায় ইংরিজি সাহিত্য আর হাবুডুবু খায় রবিবাবুর কবিতায়।
শিশিরকুমার মাঝে মাঝে অন্যদের থিয়েটার দেখতে যান। মিনার্ভায় চলছে চন্দ্রগুপ্ত, স্টারে কর্ণার্জুন। অহীন্দ্র চৌধুরী, দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, নরেশ মিত্র প্রমুখ খ্যাতি পাচ্ছেন দর্শকদের কাছ থেকে। মনোমমাহন থিয়েটারে দানীবাবু সাজছেন আলেকজান্দার। মঞ্চের সুযোগ থেকে বঞ্চিত শিশিরকুমার এখন বসে থাকেন দর্শকের আসনে।
একদিন খবর পেলেন ফার্স্ট এম্পায়ারে ‘বিসর্জন’ মঞ্চস্থ হচ্ছে, পরিচালনা ও অভিনয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। অলীক নামে এক বন্ধুকে নিয়ে টিকিট কেটে সেই নাটক দেখতে গেলেন শিশিরকুমার।
এখানে সব কিছুই অন্যরকম, পেশাদারি থিয়েটারের সঙ্গে কোনও মিলই নেই। অভিনেতা-অভিনেত্রীরা সবাই সম্ভ্রান্ত পরিবারের, দর্শকরাও অন্যরকম, হুল্লোড়, চ্যাঁচামেচি নেই। ছিমছাম, রুচিশীল মঞ্চসজ্জা, বাষট্টি বছর বয়েসে রবীন্দ্রনাথ নিজে নিয়েছেন জয়সিংহর ভূমিকা, দুর্দান্ত অভিনয় করলেন তো বটেই। সব মিলিয়ে নাটকের সর্বাঙ্গীন প্রয়োগও অসাধারণ।
অপর্ণার ভূমিকায় অভিনয় করছে একটি ফুটফুটে তরুণী, ঠিক যেন ডানাকাটা পরি। শুধু রূপ দিয়েই সে ভোলায়নি, তার উচ্চারণ নিখুঁত, প্রতিটি পদক্ষেপ লীলায়িত। জানা গেল, সে কাশীর এক অধ্যাপকের মেয়ে, কবির বিশেষ স্নেহধন্যা। তার নাম রাণু।
দেখতে দেখতে শিশিরকুমার তাঁর বন্ধুকে বললেন, ইস, এরকম একটি মেয়েকে যদি আমাদের মঞ্চে পেতাম! আমার যদি এরকম একটি নিজস্ব দল থাকত!
অভিনয়ের শেষে বন্ধুটি বলল, চলো, কবির সঙ্গে দেখা করে পায়ের ধুলো নিয়ে আসি।
শিশিরকুমার বললেন, না, আমি যাব না! কী আমার পরিচয়? আমি এখন নোবডি!
বছর ঘুরে যাবার পর শিশিরকুমার একটা সুযোগ পেলেন। তাও কোনও মঞ্চে নয়, মাঠের মধ্যে।
বড়দিনের সময় ইডেন গার্ডেনে এক বিরাট প্রদর্শনী ও মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। সেখানে থাকবে নানাবিধ আমোদ-প্রমোদ এবং খেলাধুলোর ব্যবস্থা। নাটকের অভিনয় থাকলেও ভালো হয়। কমিটির চেয়ারম্যান এক বাঙালি আই সি এস, তিনি কোনও সাধারণ রঙ্গালয়কে আহ্বান করতে চান না, অধ্যাপক হিসেবে শিশিরকুমারকে তিনি চিনতেন, তাঁকে ডেকে ভার নিতে বললেন। চুক্তি হল, নাটক নির্বাচন থেকে অভিনেতা-অভিনেত্রী নিয়োগের স্বাধীনতা শিশিরকুমারেরই থাকবে। দক্ষিণাও মিলবে ভালো।
শিশিরকুমার এবার গড়লেন নিজস্ব সম্প্রদায়। মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, যোগেশচন্দ্র চৌধুরী, রবি রায়, জীবন গাঙ্গুলির মতন কয়েকটি আনকোরা তরুণকে তিনিই অভিনয় শিখিয়ে নেবেন, সঙ্গে তাঁর দুই ভাই বিশ্বনাথ আর তারাকুমারও যুক্ত হয়ে গেল। কিন্তু অভিনেত্রী হিসেবে তো ভদ্রঘরের মেয়েদের পাওয়া যাবে না, তাই পেশাদারি মঞ্চ থেকেই নিয়ে আসা হল প্রভা, নীরদা, শেফালিকাদের। নাটক, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘সীতা’।
আবার জাদুকরের মতন শিশিরকুমার প্রথম দিনেই দর্শকদের হৃদয় জয় করে নিলেন। মাঠের মধ্যে জোড়াতালি দেওয়া অস্থায়ী মঞ্চ, প্রদর্শনীর আর সব কিছু ফেলে হাজার হাজার মানুষ এই নাটক দেখতে ছুটে আসে। একবার দেখেও আশ মেটে না। অনেকেরই মনে হল, বাংলা নাট্যজগতে অনেকদিন পর সত্যিকারের একজন নায়ক এসেছে। Here is the hero at last! রামরূপী শিশিরকুমারকে দেবতা কিংবা মহামানব মনে হয় না, মনে হয় এক যন্ত্রণাবিদ্ধ সাধারণ মানুষ, তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের হারাবার পর তীব্র বেদনার্ত স্বর দর্শকদের মধ্যে অনুরণিত হতে থাকে বহুক্ষণ।
মাত্র তিন দিন অভিনয় করার কথা ছিল। দর্শকদের অনুরোধে চালানো হল বারো দিন। এর মধ্যে মেলা ভেঙে গেছে।
এবারে বন্ধুবান্ধবরা পরামর্শ দিলেন, স্বাধীনভাবে কোনও রঙ্গমঞ্চ ভাড়া নিয়ে শিশিরকুমারের নিয়মিত অভিনয় শুরু করা উচিত। তিনি অন্য কারও অধীনে থাকতে পারবেন না তা তো বোঝাই গেছে! ইডেন গার্ডেনের নাটকে হাতে কিছু পয়সা হয়েছে, বন্ধুরাও সাহায্য করলেন কিছু কিছু। কলেজ স্ট্রিটের আলফ্রেড থিয়েটার হলটা খালি পড়ে আছে, সেটা লিজে পেয়ে গিয়ে শিশিরকুমার তাঁর এই নিজস্ব মঞ্চের নাম দিলেন বাংলায়। নাট্যমন্দির। এতদিন পর্যন্ত সব মঞ্চের নাম হত ইংরেজিতে, যেমন ন্যাশনাল, গ্রেট ন্যাশনাল, বেঙ্গল, রয়াল বেঙ্গল, স্টার, এমারেল্ড, মিনার্ভা, ক্লাসিক, অরোরা ইত্যাদি। এই প্রথম বাংলা নামের নাট্যমঞ্চ হল, শুধু তাই নয়, ইংরেজিতে টিকিট ছাপার বদলে এখানে বাংলায় টিকিট, ভেতরের আসনগুলির সারি এ বি সি ডি’র বদলে ক খ গ ঘ।
‘সীতা’র সাফল্য দেখে ঠিক হল, নাট্যমন্দিরেরও উদ্বোধন হবে ‘সীতা’ মঞ্চস্থ করে। শিশিরকুমার নাটকটির কিছুটা সম্পাদনা করে আবার শুরু করলেন মহড়া। পূর্ণ উদ্যমে সেই মহড়া চলছে, উদ্বোধনের দিনক্ষণও ঘোষিত হয়ে গেছে, এমন সময় হল বিনা মেঘে বজ্রপাত।
পেশাদারি মঞ্চে নাট্যকারের অনুমতি নিয়ে রয়ালটি দিতে হয়। ডি এল রায় বেঁচে নেই, তাঁর উত্তরাধিকারী এখন একমাত্র পুত্র দিলীপ। তিনি গিয়েছেন ইউরোপ পরিভ্রমণে। দিলীপ বন্ধু মানুষ, শিশিরকুমার জানেন, তাঁর কাছ থেকে অনুমতি পাবার কোনও অসুবিধে হবে না। এই সময় এক কদর্য চাল চালল স্টার থিয়েটার কর্তৃপক্ষ। শিশিরকুমার নিজস্ব সম্প্রদায় নিয়ে থিয়েটারে নামছেন, এর মধ্যেই তাঁর খ্যাতি গগনচুম্বী, অন্য নাটকের দলগুলি ঈর্ষায় জ্বলছে। ছলে, বলে, কৌশলে, যে-কোনও উপায়ে শিশিরকুমারকে তারা নিরস্ত করতে চায়।
দিলীপ রায় ফ্রান্স থেকে জাহাজে ফিরলেন দেশে, সেখান থেকে ট্রেনে কলকাতায়। স্টার কর্তৃপক্ষ আগে থেকেই জানতে পেরেছে ফেরার তারিখ, তারা একেবারে হাওড়া স্টেশনে উপস্থিত। দিলীপ ট্রেন থেকে নামতেই তারা তাঁর গলায় মালা পরিয়ে দিল। তারপর ব্যস্তসমস্ত হয়ে ওঁদের মুখপাত্র বললেন, আমরা স্টার থেকে ‘সীতা’ নামাব, সব রেডি, শুধু আপনার অনুমতির অপেক্ষায় রয়েছি। চুক্তি হয়ে গেলে এই শনিবার থেকেই শুরু করতে পারি।
দিলীপ বিস্মিতভাবে বললেন, কিন্তু শিশির, সে যে ইডেনের মেলায় ‘সীতা’ অমন জমিয়ে দিল, সে আর করবে না?
মুখপাত্রটি বললেন, না, না, তিনি তো শুনেছি অন্য নাটক নিয়ে ব্যস্ত। ইডেনের মেলায় তিন দিনের চুক্তি ছিল, অভিনয় চালালেন বারো দিন, আপনি কিছু বলেননি। এখন তেনার আর উৎসাহ নেই। অমন ব্রিলিয়ান্ট নাটক এমনি এমনি পড়ে থাকবে? আমাদের প্রোডাকশন হবে একেবারে এক নম্বর, খরচের কোনও কার্পণ্য নেই।
দিলীপ দেখলেন, সেই দলটার সঙ্গে রয়েছে তাঁরই এক মাসতুতো ভাই, নির্মলেন্দু লাহিড়ী। সেও একটু আধটু অভিনয় করে।
তার দিকে তাকিয়ে দিলীপ জিজ্ঞেস করলেন, তুমিও এই দলে আছ নাকি?
নির্মলেন্দু মাথা নাড়ল। অন্য একজন বলল, উনিই তো রাম সাজবেন, উনিই এখন স্টারের এক নম্বর স্টার।
ওঁরাই নিজেদের গাড়িতে দিলীপকে নিয়ে গেলেন তাঁর বাড়িতে। একজনের পকেটে চুক্তিপত্র তৈরিই ছিল, দীর্ঘ ট্রেনযাত্রার পর বিশ্রাম নেবার আগেই দিলীপ এক বছরের জন্য স্টারকে ‘সীতা’র অধিকার দিয়ে দিলেন সাড়ে চারশো টাকার বিনিময়ে।
রীতিমতন সীতাহরণ হয়ে গেল।
পরদিন সকালেই শিশিরকুমার এসে উপস্থিত। দিলীপকে তিনি বললেন, এ কী করলে তুমি দিলীপ? আমার নতুন দল, নতুন মঞ্চ, ‘সীতা’ দিয়ে উদ্বোধন হবে, সেট, পোশাক সব তৈরি, উদ্বোধনের তারিখও ঘোষণা হয়ে গেছে, এর মধ্যে তুমি স্টারকে ‘সীতা’র রাইট দিয়ে দিলে? আমাকে একবার জিজ্ঞেসও করলে না?
দিলীপ আকাশ থেকে পড়লেন। বললেন, সে কী! ওরা যে বলল, তুমি আর সীতায় ইন্টারেস্টেড নও? স্টারই একেবারে তৈরি হয়ে গেছে, এই সপ্তাহেই নামাতে চায়!
পকেট থেকে একটা হ্যান্ডবিল বার করে শিশির দিলেন দিলীপকে।
নাট্যমন্দির
(প্রাক্তন আলফ্রেড থিয়েটার)
[ফোন নং ১৭৩১ বড়বাজার]
অধিকারী—শিশিরকুমার ভাদুড়ী
দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সৌজন্যে ও শুভাগমনে আমাদের প্রথম অভিনয় উদ্দীপিত ও উদ্বোধিত হইবে। নাট্যমন্দির নূতনভাবে গঠিত, বর্তমান যুগের সমুন্নত নাট্যকলাসম্মত নতুন সাজ-সজ্জায় ভূষিত, ভাব ভাষায় প্রেরণায় অনুপ্রাণিত, সুর সংগীতে মণ্ডিত, নৃত্য-ছন্দে লীলায়িত, নতুন অভিনয় সম্ভার লইয়া বাংলাদেশের নাট্যকলানুরাগী দর্শকবৃন্দকে সাদরে আমন্ত্রণ করিতেছি।
উদ্বোধন রজনী
২১শে মার্চ ১৯২৪ দোল পূর্ণিমা সন্ধ্যায়
দেশবাসীগণের নিকট আমাদের প্রথম অভিনয় উপহার
সীতা
রাম— শিশিরকুমার ভাদুড়ী
পাংশু মুখে হ্যান্ডবিলটি পড়তে পড়তে দিলীপ অস্ফুট স্বরে বললেন, একুশে মার্চ, তার তো আর মাত্র পাঁচ দিন বাকি। ছি ছি ছি ছি।
তারপর গলা তুলে বললেন, ওরা আমাকে মিথ্যে কথা বলেছে। আমার সঙ্গে তঞ্চকতা করেছে। মানুষ এতটা স্বার্থপর হতে পারে? এতটা নীচে নামতে পারে? শিশির, তোমার তো তা হলে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে।
রাগে শিশিরের গৌরবর্ণ মুখখানি অগ্নিভ হয়ে উঠেছে। তিনি আর কথা বলতে পারছেন না। টেবিলের ওপর রাখা একটা কাচের পেপার ওয়েট মুঠো করে ধরেছেন, যেন সেটা গুঁড়িয়েই ফেলবেন।
দিলীপ একেবারে মরমে মরে গিয়ে কম্পিত গলায় বললেন, বন্ধু, বিশ্বাস করো, আমি কিছুই বুঝিনি। অনেকদিন পর দেশে ফিরেছি, কোনও খবর জানি না, ওরা এমনভাবে আর্জেন্সি দেখাতে লাগল, আমার ভাই নির্মলেন্দুকে সঙ্গে এনেছিল, তাই অবিশ্বাস করার কথা আমার মাথাতেই আসেনি। তুমি যদি ভেবে থাকো, আমি অর্থলোভে এ কাজ করেছি, তা হলে, তা হলে… তা হলে এখনই চলো, আমি স্টারে গিয়ে ওদের চুক্তি বাতিল করে দিচ্ছি। এখনই চলে।
স্টারের ম্যানেজার প্রবোধচন্দ্র গুহের ঘরে তখন নাট্যশিক্ষক অপরেশচন্দ্র ও আরও দু’-চারজন মিলে গুলতানি করছেন। গতকাল সীতা হরণের উল্লাসের রেশ এখনও রয়ে গেছে তাঁদের চোখেমুখে। আলোচনার মুখ্য বিষয় শিশিরকুমার। এত খরচপত্র করেও সীতা নামাতে না পারলে শিশিরকুমার যে-গাড্ডায় পড়বেন, তার থেকে আর বোধহয় উঠতে পারবেন না। লোকে তাঁকে দুয়ো দেবে।
স্টার অবশ্য নিজেরা সীতা মঞ্চস্থ করার কোনও উদ্যোগ নেয়নি এখনও।
শিশিরকুমার যে নিজে এসে এখানে উপস্থিত হবেন, তা এঁরা কল্পনাও করেননি। সবাই হকচকিয়ে গেলেন প্রথমে।
শিশিরকুমার পথে আসতে আসতেই দিলীপকে বলে রেখেছিলেন, বেশি কথার দরকার নেই। ইয়েস অর নো। শুধু সেটুকু জেনে নেবে। কথা কাটাকাটি করে আমি মেজাজ গরম করতে চাই না।
বসতে অনুরোধ করা হলেও শিশিরকুমার বসলেন না। দাঁড়িয়ে রইলেন দিলীপের চেয়ারের পেছনে।
দিলীপ বললেন, আপনারা কাল আমাকে ভুল বুঝিয়েছেন, শিশির এই নাটক ইডেন বাগানে সাকসেসফুলি মঞ্চস্থ করেছে, এর অধিকার তারই। তার নতুন নাট্যদলে এই নাটক দিয়ে উদ্বোধনের ব্যবস্থাও পাকা হয়ে গেছে, সে কথাও আপনারা ঘুণাক্ষরে জানাননি আমাকে। আপনারা তো শুরুই করেননি, তবু এত তাড়াহুড়ো করে আমাকে দিয়ে সই করালেন কেন?
ম্যানেজারবাবু বিষয়টি হালকা করে দেবার চেষ্টায় বললেন, প্রফেশনাল স্টেজে তো এরকম হয়ই। আগেও কতবার… গিরিশবাবুর নাটক নিয়ে টানাটানি হয়নি? গিরিশবাবু এক বোর্ডে চাকরি করছেন, ছদ্মনামে অন্য বোর্ডের জন্য নাটক লিখে দিয়েছেন, তাও তো হয়েছে! এ আমাদের নিজেদের ব্যাপার।
দিলীপ বললেন, সে যুগ আর নেই। নাটকের মানুষরা তো শিল্পী, তাদের মধ্যে কোনওরূপ হীনতা, ক্ষুদ্রতা থাকবে কেন? চুক্তিপত্রটা দিন, আমি সেটা ছিঁড়ে ফেলব।
ম্যানেজারবাবু বললেন, চুক্তিপত্র তো আমরা আমাদের অ্যাটর্নির কাছে জমা দিয়ে এসেছি। এখন বাতিল করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
দিলীপ বললেন, আমি টাকা নিয়েই এসেছি। সব টাকা ফেরত দিচ্ছি।
প্রবোধচন্দ্র অতি ধুরন্ধর ব্যক্তি। তিনি কথায় হার মানেন না কারও কাছে। তিনি হাসতে হাসতে বললেন, দিলীপবাবু, থিয়েটারের লোক অনেকের প্রাপ্য টাকা দিতে দেরি করে, অনেক সময় দেয়ও না। কিন্তু একবার দিলে আর ফেরত নেয় না। এই ব্যাপারে আমাদের অনেস্টি আছে।
শিশিরকুমার এবার অধৈর্যভাবে দিলীপের কাঁধে একটা খোঁচা মেরে বললেন, ইয়েস অর নো?
প্রবোধচন্দ্র বললেন, নো। চুক্তি মানতে দিলীপবাবু এখন বাধ্য।
শিশিরকুমার এবার একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেন স্টারকে। তিনি অপরেশচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে বললেন, ঠিক আছে। আপনারাও সীতা নামান, আমরাও নামাচ্ছি। দুই বোর্ডে একসঙ্গে একই নাটক চলুক। ভদ্রভাবে ফেয়ার কমপিটিশন হোক, তারপর দেখা যাক, দর্শকরা কোন্টা পছন্দ করে।
অপরেশচন্দ্র কিছু বলার আগেই তাকে বাধা দিয়ে ম্যানেজারবাবু বললেন, মোটেই সেটা ফেয়ার কমপিটিশন হবে না। আপনারা রিহার্সাল দিয়েটিয়ে অনেকটা এগিয়ে আছেন, আমাদের দেরি হবে। ততদিন আপনারা দর্শকদের নিজের দিকে টেনে নেবেন।
শিশির বললেন, তা হলে এটাই ফাইনাল, নো?
প্রবোধচন্দ্র বললেন, ইয়েস। নো। এমফ্যাটিকালি নো!
শিশির বললেন, আমি তা হলে চলি, দিলীপ।
দিলীপ বিষণ্ণভাবে বললেন, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইছি শিশির। জ্ঞানে বা অজ্ঞানে যাই হোক, তোমার অনেক ক্ষতি করেছি। টাকাপয়সার ক্ষতির চেয়েও তোমার সুনামহানি হবে।
শিশিরকুমার এগিয়ে গেলেন দরজার দিকে।
প্রবোধচন্দ্র গলা তুলে বললেন, একটা যেন ভুল করবেন না শিশিরবাবু। এরপর জোর করে সীতা নামাতে যাবেন না। তা হলে আমি মামলা করব। ইনজাংকশন দিয়ে আপনার প্রথম রজনীর অভিনয়ই বন্ধ করে দেব। তাতে আপনার আরও ক্ষতি বাড়বে।
ঘুরে দাঁড়ালেন শিশিরকুমার। এতক্ষণ বাদে তাঁর ওষ্ঠাধরে হাসি ফুটল। ভয়ংকর সে হাসি।
তিনি প্রবল অহংকারের সঙ্গে বললেন, আমি জমিদার বংশের সন্তান। জমিদারি বলতে যদিও এখন কিছুই নেই, তবু বংশের রক্ত তো গায়ে আছে। মামলার ভয় আমাকে দেখাবেন না। মামলার চেয়ে আমি আগুন বেশি পছন্দ করি। না, না, আপনাদের স্টার থিয়েটারে আগুন ধরাব না। সে চরিত্র আমার নয়। আমার নাট্যমন্দিরেই আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে ঝুড়িয়ে চলে যাব। আপনাদের পথের কাঁটা দূর হবে।
এইরকম সময়ে মাথার মধ্যে যেন সত্যি আগুন জ্বলে। এ আগুনের নিবৃত্তি কীসে হবে তা তাঁর জানা নেই। এখন মদ্যপান করলে যে সে আগুনে ঘৃতাহুতি হবে, তা অবশ্য তিনি বোঝেন। নেশার ঝোঁকে এমন কিছু করে ফেলবেন, যার জন্য পরে অনুশোচনার অন্ত থাকবে না। নাট্যমন্দির তো তাঁর একার নয়, আরও অনেকের ভাগ্য এর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। এই চার-পাঁচ দিনের মধ্যে কোনও নতুন নাটক তৈরি করাও সম্ভব নয়।
কোথায় যাবেন? কার সঙ্গে পরামর্শ করবেন? কারুর কাছে বসে যে মনের ভার হালকা করবেন, তেমনও কেউই নেই। কোনও নারী নেই তাঁর ভুবনে।
পাগলের মতন পথে পথে ঘুরতে লাগলেন শিশিরকুমার। হাঁটতে হাঁটতে শরীরটা ক্লান্ত হয়ে গেলে হয়তো মাথাটা জুড়োতে পারে।
পথ দিয়ে হাঁটছেন, কিন্তু কিছুই দেখছেন না। তাঁর কোনও গন্তব্য নেই। পথের কোনও কোনও মানুষ চিনতে পারছে তাঁকে, তাতে ভ্রূক্ষেপ নেই শিশিরকুমারের। মনে মনে তিনি বলে যাচ্ছেন, O Villainy! — Ho! Let the door be locked: Treachery! Seek it out.
হঠাৎ একবারে সামনে থেকে এগিয়ে এসে এক ব্যক্তি তাঁর বুকে চাপড় মেরে বললেন, শিশির!
শিশিরকুমার চমকে উঠলেন। তাকিয়ে দেখলেন, তাঁর বন্ধু হেমেন্দ্রকুমার রায়।
হেমেন্দ্রকুমার বললেন, কী ব্যাপার? তুমি একেবারে বাহ্যজ্ঞানশূন্য হয়ে কোথায় চলেছ? আমরা কখন থেকে তোমায় ডাকছি। শুনতেই পাও না!
হেমেন্দ্রকুমারের পেছনে দাঁড়িয়ে আছেন আরও কয়েকজন। নরেন্দ্র দেব, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায়। এঁরা সবাই ভারতী পত্রিকার লেখক। ভারতী গোষ্ঠীতে প্রায়ই আড্ডা দিতে যান শিশির, এঁরা সবাই তাঁর বন্ধু শ্ৰেণীর।
নরেন্দ্র দেব জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে শিশির? মুখখানা একেবারে শালপাতার মতন শুকনো!
কারুর কাছ থেকে সহানুভূতি কুড়োনো শিশিরকুমারের স্বভাব নয়। ব্যক্তিগত আবেগও কারুর কাছে প্রকাশ করতে চান না।
তিনি বললেন, কিছু হয়নি তো। অন্যমনস্ক ছিলাম বোধহয়।
সৌরীন্দ্রমোহন বললেন, দোলের দিন তোমার নাট্যমন্দিরের উদ্বোধন হচ্ছে, আমাদের এখনও পাস দিলে না?
শিশিরকুমার শুকনো গলায় বললেন, উদ্বোধন হচ্ছে না। আপাতত বন্ধ।
সকলেই বিস্মিত। মণিলাল বললেন, উদ্বোধন হচ্ছে না? কেন?
এবার সকলে চেপে ধরতে শিশিরকে বলতেই হল স্টার কর্তৃক সীতাহরণের কাহিনী।
হেমেন্দ্রকুমার দুঃখিতভাবে বললেন, ছিঃ! আমাদের থিয়েটারের এইসব নীচতা কবে দূর হবে? এখন উপায়?
শিশির বললেন, আর কোনও উপায় নেই।
মণিলাল বললেন, আলবত উপায় আছে। ওদের কাছে হার মানবে কেন? এ ক’দিনে নতুন নাটক নামানো যাবে না ঠিক। কিন্তু দোলের দিন মানুষ গানবাজনা পছন্দ করে। আমরা কিছু কিছু গান জুড়ে একটা অপেরার মতন তৈরি করে নিতে পারি। সেটা এমন কিছু শক্ত হবে না। ওই একুশ তারিখেই তোমার নাট্যমন্দিরের দ্বার উদঘাটন হবে।
হেমেন্দ্রকুমার বললেন, ধরো, রবীন্দ্রনাথের ‘ওরে ভাই ফাগুন লেগেছে বনে বনে’ দিয়ে শুরু হল। এইরকম পরপর গান গেঁথে গেঁথে, রবীন্দ্রনাথের তো বসন্ত নিয়ে আরও গান আছেই, মাঝে কিছু ফাঁক থাকলে আমরাও নতুন গান লিখে দিতে পারি।
মণিলাল বললেন, চলো, আজই কোথাও গিয়ে আমরা বসি। প্রচলিত গান যা যা আছে, তার মধ্যে মধ্যে বিষয় অনুযায়ী আমরা সবাই দু’-একটা গান লিখব। পালাটার নাম ‘বসন্ত লীলা’ দিলে কেমন হয়?
সবাই মিলে তখনকার মতন সনির্বন্ধ অনুরোধে শিশিরকুমারকে এ প্রস্তাব মেনে নিতে বাধ্য করালেন বটে, কিন্তু তাঁর মনে খুঁতখুঁতুনি রয়েই গেল। এ গানের পালায় তাঁর কোনও ভূমিকাই নেই, কারণ একেবারেই সুর নেই তাঁর কণ্ঠে।
‘বসন্ত লীলা’ তৈরি হয়ে গেল বটে, কিন্তু উদ্বোধনের দিনটিতে শিশিরকুমার আবার বেঁকে বসলেন। উদ্বোধন হয় হোক, তিনি যাবেন না। দর্শকরা যদি কৈফিয়ত চায় কিংবা তাঁর উদ্দেশে টিটকিরি দেয়, তা সহ্য করতে পারবেন না তিনি।
তিন
২১ মার্চ, দোল পূর্ণিমা, ১৯২৪, সন্ধ্যা
মণিলাল একপ্রকার জোর করেই শিশিরকুমারকে নিয়ে এলেন নাট্যমন্দিরে।
এ সম্প্রদায়ের সবাই মিলে মহা উৎসাহে রঙ্গালয়ের ভিতরে ও বাইরে সাজসজ্জায় হাত লাগিয়েছে। বাইরের গেটের দু’দিকে দু’টি চিত্রিত ঘটের ওপর ডাব, পাশে কলাগাছ। ভেতরেও প্রচুর ফুলমালা। ব্যবস্থা হয়েছে মাঝে মাঝে গোলাপ জল ছড়াবার। দেয়ালে নতুন রং করা হয়েছে, ঝকমক করছে চতুর্দিক।
ঠিক সাড়ে ছ’টার সময় একটা রোভার গাড়িতে চেপে এলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। বঙ্গের সর্বজনশ্রদ্ধেয় রাজনৈতিক নেতা। সর্বভারতীয় রাজনীতিতেও তাঁর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কংগ্রেসের মধ্যে থেকে মতিলাল নেহরুর সঙ্গে হাত মিলিয়ে নতুন নতুন দাবি তুলেছেন। গড়েছেন স্বরাজ দল, তাই এঁদের বলা হচ্ছে প্রো-চেঞ্জার, আর গান্ধীজির সমর্থক রক্ষণশীলদের বলা হচ্ছে নো-চেঞ্জার। দেশবন্ধু লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জনের ব্যারিস্টারি ছেড়েছেন, নিজের সব কিছু বিলিয়ে দিয়ে মেতে উঠেছেন দেশসেবায়।
এককালে নাকি যাঁর প্যান্ট-কোট কাচিয়ে আনা হত ফ্রান্সের ধোপাবাড়ি থেকে, তাঁর পরনে এখন সাধারণ ধুতি ও পাঞ্জাবি। কাঁধে একটি উড়ুনি, চোখে গোল নিকেলের চশমা। শিশির এবং আরও অনেকে দাঁড়িয়ে আছেন তাঁকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য।
গাড়ি থেকে নেমে দেশবন্ধু কৌতুক হাস্যে বললেন, দ্যাখো, সেবারে কথা রাখতে পারিনি, আজ ঠিক এসেছি।
সেবারে অর্থাৎ ম্যাডানদের থিয়েটারে শিশিরকুমার প্রথম যেদিন আলমগীর অভিনয় করেন, সেদিনও দেশবন্ধুর উদ্বোধনের কথা ছিল। কিন্তু যুবরাজের আগমন উপলক্ষে প্রতিবাদ আন্দোলনের ডাক দেওয়ায় আগের রাত্রেই তিনি গ্রেফতার হয়ে কারারুদ্ধ হয়েছিলেন। আসবেন কী করে!
বিলিতি কনসার্ট বাজিয়ে অনুষ্ঠান শুরু করাই বাংলা থিয়েটারের প্রথা। শিশিরকুমার ব্যবস্থা করেছেন দেশি রোশন চৌকির। দেশবন্ধু আসন গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে বেজে উঠল শানাই আর মৃদঙ্গ।
দেশবন্ধু সংক্ষিপ্ত বক্তৃতা দিয়ে আশীর্বাদ জানালেন। তারপর কবিতা শোনাতে এলেন তরুণ কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তিনি প্রথমেই শোনালেন ‘বিদ্রোহী’ নামে একটি দীর্ঘ কবিতা। সে কবিতার যেন পঙ্তিতে পঙ্তিতে বিদ্যুৎ ঝলক।
তারপর গান শুরু করলেন অন্ধ গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে। কী অপূর্ব জোরালো তাঁর কণ্ঠস্বর।
নিজের অভিনয়ের সময় শিশিরকুমার কখনও বিচলিত বা উত্তেজিত হন না। কিন্তু আজ উইংসের পাশে বসে আছেন শিরা টানটান করে। দর্শকরা এখনও পর্যন্ত কোনও গোলমাল করেনি, বরং দু’-একটি গানের পর এনকোর এনকোর বলছে। মাঝামাঝি জায়গায় এসে একজন শুধু চেঁচিয়ে উঠল, শিশিরবাবু কোথায়?
সঙ্গে সঙ্গে মণিলাল শিশিরকুমারকে ঠেলে ঢুকিয়ে দিলেন মঞ্চে।
এর আগে অনেক বার শিশিরকুমারকে অনুরোধ করা হয়েছিল, তিনি গান না গাইলেও পথিক বেশে দু’-একবার মঞ্চে অ্যাপিয়ার করবেন। শিশিরকুমার রাজি হননি। সংলাপ নেই, তিনি করবেন কাটা সৈনিকের পার্ট!
শিশিরকুমারকে মঞ্চে দেখেই সমস্ত দর্শক চটাপট হাততালি দিতে লাগল। এতক্ষণে তারা বুঝে গেছে, আজ সন্ধ্যায় গানবাজনাই মুখ্য, অভিনয়ের কেরামতি দেখার প্রশ্ন নেই। শিশিরকুমারকে একবার চোখের দেখাই যথেষ্ট।
সন্ধেটা ভালোভাবেই উতরে গেল।
যাবার সময় দেশবন্ধু বললেন, শিশির, তোমার অভিনয়ের খুব নামডাক হয়েছে শুনেছি। কিন্তু আজ তো অভিনয় দেখা হল না। এরপর যেদিন অভিনয় হবে, সেদিনও আমাকে ডেকো।
পাশ থেকে মণিলাল বললেন, স্যার, শিগগিরই নাট্যমন্দিরে সীতার অভিনয় হবে। সেদিন আপনি আসবেন।
দেশবন্ধু চলে যাবার পর শিশিরকুমার বললেন, মণি, এটা কী হল? তুমি আমাকে ফল্স পজিশনে ফেলতে চাও? সীতার রাইট আমাদের নেই, এক বছরের মধ্যেও পাবার কোনও সম্ভাবনা নেই, তা তুমি জানো না?
মণিলাল বললেন, রাইট নেই তো কী হয়েছে? রামচন্দ্রের কাছে যখন সীতা ছিলেন না, তখন তিনি স্বর্ণসীতার মূর্তি গড়ে তাঁর চোখের সামনে রাখেননি? আমরাও স্বর্ণসীতার প্রতিষ্ঠা করব।
হেমেন্দ্রকুমার হাসতে হাসতে বললেন, আমরা ক’জন আগেই ঠিক করে রেখেছি নাট্যমন্দিরে সীতা হবেই। তখন স্টারের গালে চুনকালি পড়বে।
চার
রবিবার, ১৭ আগস্ট, ১৯২৪
রঙ্গমঞ্চের পেছন দিকে একটা ছোট ঘরে এখন শিশির মাঝে মাঝে রাত্রিবাস করেন। একটা ছোট খাট, দু’টি টিনের চেয়ার ও একটি কাঠের আলমারি ছাড়া সে ঘরে আর কিছু নেই। রাত্রে কোনও সঙ্গিনী বা সাথীও থাকে না।
তাঁর জন্য একটি চব্বিশ ঘণ্টার ভৃত্য নিযুক্ত করা হয়েছে, তার নাম ভিখা। সারাদিন সে মালিকের কাছ থেকে প্রচুর গালমন্দ খায়, আবার দরাজ হাতে বখশিশও পায়। দুপুরবেলা ভিখাই পাড়ার পাইস হোটেল থেকে কিছু খাবার এনে দেয়, শিশিরকুমার ইচ্ছে হলে খান অথবা ভিখাকেই খেতে বলেন। রাত্তিরের দিকে প্রায়ই কিছু মুখে দিতে ইচ্ছে করে না তাঁর।
চা-কফি বানাবার ব্যবস্থা এখানেই আছে। সকাল থেকে তিন কাপ কফি খাওয়া হয়ে গেছে, ভিখা কয়েকটা খাস্তা কচুরি আর মোহনভোগ এনেছিল, তা শালপাতার ঠোঙায় যেমনটি ছিল, তেমনই পড়ে আছে টেবিলের ওপর।
বৃষ্টি পড়ছে সকাল থেকে, বেশ জোর বৃষ্টি। ভাদ্র মাস পড়েছে, এই সময় তো বৃষ্টি হবেই। তবে সকালবেলার বৃষ্টি বেশ ভালো লক্ষণ। সারাদিনও যদি পড়ে, সন্ধেবেলা পরিষ্কার হয়ে যাবে আকাশ। মানুষ নিশ্চিন্তে পথে বেরুতে পারবে।
বিছানা ছেড়ে ওঠেননি শিশিরকুমার, জোরে জোরে পড়ে যাচ্ছেন কবিতা। আজ আর ইংরিজি নয়, আজ তাঁকে রবীন্দ্রনাথে পেয়েছে।
নব নব খেলা খেলে অদৃষ্ট কখনও ইষ্ট, কভু অনিষ্ট,
কখনো তিক্ত কখনো মিষ্ট, যখন যা দেয় তুলিয়া।
সুখের দুখের চক্র মধ্যে কখনো উঠিব উধাও পদ্যে,
কখনো লুটিব গভীর গদ্যে, নাগরদোলায় দুলিয়া।
হাতে তুলি লব বিজয়বাদ্য আমি অশান্ত, আমি অবাধ্য
যাহা কিছু আছে অতি অসাধ্য তাহারে ধরিব সবলে।
আমি নির্মম আমি নৃশংস সবেতে বসাব নিজের অংশ,
পরমুখ হতে করিয়া ভ্রংশ তুলিব আপন কবলে।
মনেতে জানিব সকল পৃথ্বী আমারি চরণ-আসনভিত্তি
রাজার রাজ্য দস্যুবৃত্তি কোনো ভেদ নাহি উভয়ে।…
হঠাৎ থেমে গিয়ে হাঁক দিলেন, ভিখা, ভিখা!
ভিখাকে ধারেকাছে কোথাও দেখা না গেলেও ডাকামাত্র সে যেন আরব্য উপন্যাসের দৈত্যের মতন তৎক্ষণাৎ হাজির হয়!
মাথার চুল কদমছাঁট, চিমসে চেহারা, গায়ের রং খয়েরের মতন, তার বয়েসের গাছপাথর নেই।
সে দরজার কাছে ভক্ত হনুমানের মতন হাত জোড় করে দাঁড়ায়।
শিশিরকুমার বললেন, আলমারি থেকে বোতল আর গ্লাস বার কর। জল দে। ভিখা দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকাল। পৌনে বারোটা, এখন নাওয়া-খাওয়ার সময়। কিন্তু প্রতিবাদ করার সাহস তার নেই।
আলমারি খুলে সে দেখল। স্কচের একমাত্র বোতলটি একেবারে খালি। এক ফোঁটাও নেই।
ভিখা বেশি কথা বলে না। সে খালি বোতলটি শিশিরকুমারের চোখের সামনে এনে বলল, কত্তা
শিশির বললেন, যাঃ! কখন ফুরোলো রে?
তারপর হাসতে হাসতে আবৃত্তি করলেন;
খালি বোতলের পানে চেয়ে চেয়ে চিত্ত
নিশ্বাস ফেলে বলে, সকলই অনিত্য।
সম্ভব হয় যদি এ বোতলটারে।
পূর্ণতা এনে দিতে পারে
দূর হতে তোমার আতিথ্য।
গৌড়ী গদ্য হতে মধুময় পদ্য
দর্শন দিতে পারে সদ্য।
বালিশের তলা থেকে এক মুঠো টাকা বার করলেন, গোনাগুনির ধার ধারলেন না, বললেন, যা, নিয়ে আয়। দৌড়ে যাবি, ছুটে আসবি।
তারপর চুরুট ধরিয়ে, রবীন্দ্রনাথের চিত্রা কাব্যগ্রন্থের পাতা উলটোতে উলটোতে তিনি পড়তে লাগলেন:
চন্দ্র যখন অস্তে নামিল তখনো রয়েছে রাতি,
পূর্বদিকের অলস নয়নে মেলিছে রক্ত ভাতি।
জনহীন এক সিন্ধুপুলিনে অশ্ব থামিল আসি—
সমুখে দাঁড়ায়ে কৃষ্ণ শৈল গুহামুখ পরকাশি।
সাগরে না শুনি জলকলরব, না গাহে ঊষার পাখি,
বহিল না মৃদু প্রভাতপবন বনের গন্ধ মাখি।
অশ্ব হইতে নামিল রমণী, আমিও নামিনু নীচে,
আঁধার-ব্যাদান গুহার মাঝারে চলিনু তাহার পিছে।
ভিতরে খোদিত উদার প্রাসাদ শিলাস্তম্ভ’পরে
কনকশিকলে সোনার প্রদীপ দুলিতেছে থরে থরে।….
শুধু কাব্যের টানেই নয়, বিশেষত অভিনয়ের দিনে শিশির এরকম একটানা কাব্য পাঠ করে চলেন, তাতে উচ্চারণ পরিশীলিত হয়, স্বরের বিস্তার হয়, আর কাব্যের অনুরণনে মন শিল্পমুখী হয়ে থাকে।
আজ ‘সীতা’ অভিনয়ের পঞ্চম রাত। অন্য রঙ্গমঞ্চে।
নাট্যমন্দির উদ্বোধনের পরদিন থেকেই শুরু হয়ে গেছে স্বর্ণসীতা সৃষ্টির প্রক্রিয়া। মণিলালরা জেদ ধরেছেন, নাই বা পাওয়া গেল ডি এল রায়ের সীতা, শিশিরকুমারের জন্য রচিত হবে আর একখানি সীতা নাটক।
কে লিখবে?
প্রথমেই মনে পড়ে হেমেন্দ্রকুমারের কথা। কিন্তু তিনি ‘নাচঘর’ নামে একটি নতুন পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগ নিয়ে খুব ব্যস্ত, এখন সময় পাবেন না। অথচ দেরি করবার উপায় নেই। মণিলাল প্রায়ই বলেন, স্ট্রাইক, হোয়াইল ইট ইজ হট!
কাজ সারতে হবে গোপনে। নামজাদা কেউ এই বিষয় নিয়ে ভাবনা শুরু করলে সে সংবাদ রটে যেতে পারে। তাই শিশিরকুমার বললেন, একটা এক্সপেরিমেন্ট করলে হয়, আমরা ক’জনা মিলে পরামর্শ দেব, নাটকের অবয়ব ঠিক করে দেব, তাতে ভাষা বসাবে নতুন কেউ। এ দলে যোগেশ চৌধুরী নামে একজন অভিনেতা আছে, সে আগে ছিল ইস্কুল মাস্টার, মহড়ার সময় তার কথাবার্তা শুনে মনে হয়, ওর বেশ কাব্যজ্ঞান আছে, তাকে দিয়েই চেষ্টা করা যাক না কেন?
হেমেন্দ্রকুমার, মণিলাল আর শিশিরকুমার প্রতিদিন যোগেশচন্দ্রকে নিয়ে বসতে লাগলেন এক গুপ্তস্থানে, অর্থাৎ মণিলালের শ্বশুরবাড়িতে, আপাতত অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সে বাড়িতে থাকছেন না, কয়েকটা ঘর খালি পড়ে আছে।
শুরু হবে সীতার বনবাস পর্ব থেকে। ডি এল রায়ের নাটকে আছে প্রথমে পরিবেশ রচনার জন্য খানিকটা ভূমিকার মতন, যোগেশচন্দ্রকে বলা হল, শুরুতেই নাট্যপ্রক্রিয়ার মধ্যে ঢুকে পড়তে। বেশ ভালোই অগ্রসর হতে লাগল। ডি এল রায় একসময় রবীন্দ্রনাথকে অযথা আক্রমণ করে ‘আনন্দ বিদায়’ নামে একটি কুরুচিপূর্ণ নাটিকা লিখেছিলেন বলে তাঁর প্রতি ভারতীয় লেখকবৃন্দ খানিকটা ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। এই রচনার মধ্যপথে একদিন মণিলাল বললেন, দ্বিজুবাবুর সীতার রাইট পাওয়া যায়নি, ভালোই হয়েছে, রাম-সীতাকে নিয়ে আর একটি নাটকের সৃষ্টি হচ্ছে, হয়তো এটাই। বেশি উচ্চাঙ্গের হবে।
এক মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ হল নাটক, তারপরেও শিশিরকুমার স্বহস্তে কিছু কাটাকুটি করলেন। এবার শুরু হবে মহড়া। অন্য যে-কোনও নতুন নাটকের চেয়ে এ মহড়া অনেক কঠিন, কারণ এতে আগের সংলাপ মন থেকে মুছে ফেলে মুখস্থ করতে হবে নতুন সংলাপ। শিশিরকুমার নিজেই বারবার ভুল করছিলেন।
ডি এল রায়ের নাটকে রামের প্রথম সংলাপ, অন্য তিন ভ্রাতাকে বলছেন:
কিশোর বয়েসে বনবাসী,
বনে রহিতাম ভাই;
শিখি নাই রাজকার্য;
ধর্ম, রাজনীতি শিখি নাই;
মৃগয়ায় কাটায়েছি দিন;
রাত্রি বিশ্রদ্ধ বিশ্রামে,
আশ্ৰম কুটিরে। প্রতিদিন
সেই ঘন বনগ্রামে…
আর যোগেশচন্দ্রের নাটকে রামের প্রথম উক্তি, পাশে ঘুমন্ত সীতা, দুর্মুখ এনেছে দুঃসংবাদ :
রাম: দেবীর নিকটে
সংকোচের নাই প্রয়োজন,—
জানকীর কাছে অযোধ্যা রাজ্যের
গোপন কিছুই নাই।
কিন্তু দেবী সুপ্তা…
নিজেকে সংশোধন করে শিশিরকুমার বারবার অন্যদের বলেছেন, দেখো, যেন আগের নাটকের একটা লাইনও বলে ফেলো না, তা হলেই স্টারের লোকেরা আমাদের ক্যাঁক করে চেপে ধরবে।
এর মধ্যে রঙ্গমঞ্চ বদল করতে হল।
‘সীতা’ তৈরি করার আগে আলফ্রেড মঞ্চে খরচ চালাবার জন্য অন্য দু’-একটি নাটকের অভিনয়ের ব্যবস্থা হচ্ছিল, কিন্তু ঠিক জমছিল না। বিডন স্ট্রিট থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত আসল থিয়েটার পাড়া, বাংলা থিয়েটারের দর্শকরা সন্ধের পর কলেজ স্ট্রিটে আসতে চায় না।
এদিকে বিডন স্ট্রিটে মনোমোহন থিয়েটারের অবস্থা বেশ খারাপ। দানীবাবুকে নিয়ে পুরনো ধারার অভিনয়ে আর টানা যাচ্ছিল না দর্শকদের। মঞ্চের মালিক মনোমোহন পাঁড়ে ঠিক করলেন, অনবরত ক্ষতি স্বীকার করার বদলে, দল ভেঙে দিয়ে হল ভাড়া দেওয়াই ভালো।
খবর পাওয়া মাত্রই শিশিরকুমার সে হল ভাড়া নিয়ে চলে এলেন আলফ্রেড ছেড়ে। মনোমোহন নামটি সুপরিচিত, তাই এখানে তিনি রঙ্গমঞ্চের নতুন নাম দিলেন মনোমোহন নাট্যমন্দির।
এবারে শিশিরকুমারের নির্দেশে রঙ্গালয়টিকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে ঢেলে সাজানো হল। এ জন্য তিনি সাহায্য নিলেন প্রখ্যাত শিল্পী চারু রায়ের। নাটকের প্রতিটি দৃশ্য, পশ্চাৎপট, সাজপোশাক, সংগীত যাতে যথাযথ হয়, সে জন্য গবেষণা করা হল। আগে এসব যেমন-তেমন ভাবে দায়সারা হত, এখন ‘সীতা’র জন্য সাহায্য করতে এলেন রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার, যামিনী রায়, কাজী নজরুল ইসলাম, নরেন্দ্র দেব, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, নলিনীকান্ত সরকার প্রমুখ। ভারতী গোষ্ঠীর লেখকরা তো আছেনই। এঁরা অনেকেই শিশিরকুমারের সহপাঠী কিংবা বন্ধু, কিন্তু শুধু বন্ধুত্বের টানেই এঁরা আসেননি। সকলেই চেয়েছিলেন বাংলার নাট্যমঞ্চ সুরুচিসম্পন্ন ও উচ্চ স্তরের হোক, সাহেবদের সঙ্গে পাল্লা দিক। সাহেবরা কথায় কথায় ওদেশের আরভিং কিংবা গ্যারিকের কথা বলে, শিশিরের অভিনয়-প্রতিভা ওঁদের চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। বাংলার রঙ্গমঞ্চ আমাদের শিল্প সাহিত্যের সমান অঙ্গ হোক। থিয়েটারের মাধ্যমে জাগ্রত হোক জাতীয়তাবোধ।
নতুন সাজসজ্জার সঙ্গে সঙ্গে বসবার আসনগুলিও নতুনভাবে বিন্যস্ত হয়েছে। মহিলাদের বসবার জায়গা হয়েছে প্রশস্ত। আগে শুধু দোতলায় মহিলারা বসতেন অন্ধকার করা ঘুচিমুচি জায়গায়, এখনও পরদানশীনরা সেখানে ইচ্ছে করলে বসতে পারেন, নীচতলাতেও বসবার ব্যবস্থা হল।
ফুটলাইট বা পাদপ্রদীপের ব্যবহার তুলে দিলেন শিশিরকুমার। শুধুমাত্র তলা থেকে আলো এলে মুখের সব অভিব্যক্তি বোঝা যায় না। এখন টপ লাইট এবং পাশ থেকে মুড লাইটের প্রবর্তন করলেন। শুধু একক অভিনয়প্রতিভা দিয়ে দর্শকদের মুগ্ধ করাই তাঁর উদ্দেশ্য নয়, প্রতিটি অভিনেতা-অভিনেত্রীর ভূমিকাও হবে সমান উপযোগী। বেশ্যাপল্লি থেকে নিয়ে আসা মেয়েগুলিকে দিয়েই স্ত্রী-ভূমিকাগুলি করাতে হয়, কিন্তু মহড়ার সময় কেউ উচ্চারণ ভুল করলে তাকে চড়-চাপড় মারতেও তিনি দ্বিধা করেন না। তবে, কোনও কোনও মেয়ের অতি দ্রুত শিখে নেবার ক্ষমতাও অনস্বীকার্য। মাত্র তিনটি কড়ির বিনিময়ে বিক্রি হয়েছিল যে মেয়ে, সে পরে তিনকড়ি দাসী নামে প্রখ্যাত অভিনেত্রী হয়েছিল। এখন এই দলে প্রভাও যে যথেষ্ট প্রতিভাময়ী, তা এর মধ্যেই। বোঝা গেছে।
সবচেয়ে বড় কথা, দর্শকদের রুচির উন্নতি। এক একটি নাটক নামাতে কত পরিশ্রম করতে হয়। মঞ্চে অভিনয়ের সময় যখন প্রভূত আবেগ জমে থাকে বুকের মধ্যে, তখন অকস্মাৎ কোনও বাধার সৃষ্টি হলে যে কী কষ্ট হয়, তা অন্যে বুঝবে না। দর্শকদের মধ্যে দু’-চারজন থাকে, যারা নিজেদের মধ্যে জোরে কথা বলে, কিংবা হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে একটা বদ রসিকতা করে লোক হাসাবার চেষ্টা করে। শিশির চারজন মারশাল বা পাহারাদার নিযুক্ত করেছেন, তারা সর্বক্ষণ দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকবে, ওই ধরনের কোনও আমোদগেঁড়ে দর্শক চেঁচিয়ে উঠলেই তাকে তৎক্ষণাৎ ঘাড় ধরে বার করে দেওয়া হবে।
নাটকের মহড়া যখন চূড়ান্ত প্রস্তুতির মুখে, তখন মণিলাল বললেন, এসো শিশির, স্টারের আর্ট থিয়েটারের সঙ্গে একটু মজা করা যাক।
পরিকল্পনাটি শুনে শিশির সহাস্যে সম্মতি জানালেন। সংবাদপত্রের মাধ্যমে রটিয়ে দেওয়া হল যে অতি শীঘ্র মনোমোহন নাট্যমন্দিরে মহাসমারোহে শিশির ভাদুড়ির পরিচালনায় মঞ্চস্থ হবে ‘সীতা’। রামের ভূমিকায় পরিচালক স্বয়ং, নামভূমিকায় শ্ৰীমতী প্রভা।
নাট্যকারের নামটি উহ্য রইল।
অমনি টনক নড়ে গেল স্টারের আর্ট থিয়েটারের। তাঁরা সীতার রাইট কুক্ষিগত করে রাখলেও নিজেদের প্রোডাকশান নামাবার কোনও ইচ্ছেই নেই, বরং তাঁরা তখন অহীন্দ্র চৌধুরী, নরেশ মিত্রকে নিয়ে ‘কর্ণার্জুন’ খুব জমিয়ে তুলেছেন। তবু এই ঘোষণার কথা জেনে তাঁরা ভাবলেন, শিশিরকুমার হঠকারিতা করে ফাঁদে পা দিয়েছেন। এইবার মামলা-মোকদ্দমা করে তাঁকে ফাঁসানো যাবে।
তাঁরা অ্যাটর্নির সঙ্গে শলাপরামর্শ করতে লাগলেন। দু’দিন পরেই শিশিরকুমারের কাছে উকিলের চিঠি এল। বন্ধুদের সঙ্গে বসে সেই চিঠি পাঠ করে সবাই উচ্চ হাস্য করলেন প্রাণ ভরে। তারপর চিঠিটা ছিঁড়ে ফেললেন।
দু’দিন পরেই সংবাদপত্রে বেরুল সবিস্তার বিজ্ঞপ্তি। শহরের দেওয়ালও পোস্টারে ছেয়ে গেল। তাতে রয়েছে নাট্যকার যোগেশচন্দ্র চৌধুরীর নাম।
পৌরাণিক বিষয়বস্তুর ওপর কারও আলাদা অধিকার থাকতে পারে না। একই নামে দু’টি নাটক মঞ্চস্থ হতেও কোনও আইনের বাধা নেই, শুধু ভাষা ও আঙ্গিকের মিল না থাকলেই হল।
প্রথমে চুপসে গেলেন স্টার কর্তৃপক্ষ। তারপরেও ক্ষীণ আশা হল, আনকোরা লেখকের নাটক নিয়ে শিশিরকুমার নিশ্চয়ই ধ্যাড়াবেন। তাই প্রথম রাত্তিরে ওঁদের কয়েকজন বিনা আমন্ত্রণে দেখতে এলেন নাটক, সাধারণ দর্শকদের মধ্যে বসে।
প্রথম রাত্রির মঞ্চাভিনয় সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার নাট্যইতিহাসে স্থান পেয়ে গেছে। সারা শহরে এখন এই একটাই আলোচ্য বিষয়। অনেকেরই অভিমত হল এই যে, ইডেন বাগানের প্রোডাকশনের চেয়েও এই অভিনয় অনেক বেশি সার্থক। শিশিরকুমার যেন নিজেকেই ছাড়িয়ে গিয়েছেন, প্রভা অতুলনীয়, ছোটখাটো প্রত্যেকটি ভূমিকা নিখুঁত। বাল্মীকির ভূমিকায় মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য এমনই বিশ্বাসযোগ্য অভিনয় করলেন যে তাঁর ডাক নামই হয়ে গেল মহর্ষি।
দেশবন্ধু এসেছিলেন এ নাটকেরও উদ্বোধন করতে। শরীর ভালো নয়, মুখখানি ম্লান। তবু তিনি দীর্ঘ সাড়ে চার ঘণ্টা বসে বসে দেখলেন সম্পূর্ণ নাটক। শেষ হবার পর তিনি বললেন, শিশির, আগে তো দেখিনি, নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসও করা যায় না। সত্যিই তুমি যুগন্ধর। মঞ্চে নবযুগ এনেছ। শেষ দৃশ্যে আমার মতন কঠোর মানুষকেও তুমি কাঁদিয়ে দিয়েছিলে হে!
শিশিরকুমার বললেন, আপনি কঠোর মানুষ কে বললে? আপনি তো আসলে একজন কবি। তবে আমি শুনেছিলাম, আপনাকে খুশি করা খুব শক্ত।
দেশবন্ধু বললেন, খুশি তো হইনি, অভিভূত! সত্যিকারের আর্ট মানুষকে শুধু খুশি করে না, মুগ্ধ, অভিভূত করে। নাট্যকলার উন্নতির জন্য তোমার নেতৃত্বে অনেক কিছু হতে পারে। মঞ্চে যোগ দিয়ে তুমি কি কিছু কিছু অসুবিধে বোধ করছ?
শিশিরকুমার বললেন, আপনি যখন জিজ্ঞেস করলেন, তখন দু’-একটি কথা বলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এখন অনেক রাত, আপনার তো ফিরতে দেরি হচ্ছে।
শিশিরের পিঠে হাত রেখে ক্লিষ্ট কণ্ঠে দেশবন্ধু বললেন, না, না, হোক একটু দেরি। তুমি বলো, খুলে বলো। আমরা কি কিছু সাহায্য করতে পারি!
শিশির বললেন, আমি কলেজে পড়ানো ছেড়ে মঞ্চে যোগ দিয়েছি, তার কারণ আমি নাটক, অভিনয় এসব ভালোবাসি। ভেবেছিলাম, সত্যিকারের ভালো নাটক দেশের দর্শকদের উপহার দেব, মঞ্চ ব্যবহার থেকে অভিনয়, সব দিকে আধুনিকতার স্পর্শ আনতে পারব। কিন্তু পদে পদে অসুবিধে বোধ করছি, কেন জানেন? পেশাদারি মঞ্চ মানে তো ব্যবসাও বটে। আমি ব্যবসার কিছু বুঝি না। অথচ, একটা মঞ্চ চালাতে গেলে প্রচুর খরচও তো আছে। সেইজন্যই তো গোলা দর্শকদের জন্য নাচ গান ভাঁড়ামি আর চোখের জলের কাণ্ডকারখানা ঘটাতে হয়।
দেশবন্ধু বললেন, তুমি একজন শিল্পী, তোমার ব্যবসাবুদ্ধিনা থাকাটাই তো স্বাভাবিক।
শিশিরকুমার বললেন, প্রথমে ঢুকেছিলাম ম্যাডানদের কোম্পানিতে। তারা ব্যবসার লাভ ছাড়া অন্য কিছু ভাবে না। সে জন্য বাংলা নাটকের পিন্ডি চটকাতেও তাদের আপত্তি নেই। সেখানে আমি টিঁকতে পারিনি। তারপর তাঁবু ফেলেছিলাম ইডেন গার্ডেনে। নিজের দল নিয়ে থিয়েটার চালাতে গিয়ে এর মধ্যে দুটো থিয়েটার হল বদল করতে হয়েছে। এখনও যেন তাঁবুতে তাঁবুতেই ঘুরছি৷
দেশবন্ধু হেসে বললেন, যাযাবর! যাত্রাপাটি! কেন, থিয়েটার হল বদল করতে হয়। কেন?
শিশিরকুমার বললেন, অনেক ভাড়া। নানান ঝঞ্ঝাট। তাই ক’দিন ধরেই মনে হচ্ছে। আমরা পরাধীন জাত হতে পারি, কিন্তু একটা জাতীয় নাট্যশালা কি গড়া যায় না? যেখানে নতুন নতুন ছেলেমেয়েরা অভিনয় কলা শিখবে, সত্যিকারের ভালো নাটক তৈরি হবে, লাভ-লোকসানের চিন্তা মাথায় থাকবে না! একমাত্র সেভাবেই দর্শকদের রুচি তৈরি হতে পারবে।
দেশবন্ধু বললেন, হুঁ! রবিবাবুও একসময় এরকম কথা বলেছিলেন বটে। পরাধীন জাতি… আমরা পূর্ণ স্বাধীনতা দাবি করেছি, গান্ধীজি যতই কিন্তু কিন্তু করুন, সে দাবি আমরা আদায় করে ছাড়বই! মরার আগে আমি স্বাধীন দেশ দেখে যেতে চাই। কিন্তু একটা জাতীয় নাট্যশালা তৈরি করতে তত দেরি করারই বা দরকার কী? নিজেদের এটুকু সামর্থ্য নেই? কী কী লাগে বলো তো?
শিশিরকুমার বললেন, আমি হিসেব করেছি, একটা যদি দোতলা বাড়ি পাওয়া যায়, আর মোটামুটি লাখ চারেক টাকা…
দেশবন্ধু হেসে বললেন, যদি কয়েক বছর আগে বলতে, আমি নিজেই তোমাকে এ টাকাটা দিয়ে দিতে পারতাম। কিন্তু এখন যে আমার আর কোনও রোজগারই নেই। ব্যারিস্টারির ধড়াচুড়ো আর পরব না ঠিক করেছি। বসতবাড়িটাও নেই, পার্টির লোকের ভরসায় থাকি। সে যাই হোক, একটা ভালো কাজের জন্য লাখ চারেক টাকা তুলে দিতে পারব না? শোনো শিশির, আমি কথা দিচ্ছি, বিশেষ কাজে আমাকে কিছুদিন কলকাতার বাইরে থাকতে হবে, ফিরে আসি, তারপর আমি তোমার জন্য অবশ্যই জাতীয় নাট্যশালা গড়ে দেব। তুমি নিশ্চিন্তে সেখানে কাজ করতে পারবে।
দেশবন্ধুর কথার দাম আছে। তারপর থেকেই শিশিরকুমার এই স্বপ্নটি লালন করতে শুরু করেছেন মনে মনে।
আজ ‘সীতা’র পঞ্চম অভিনয়। প্রথম রাতে দর্শকদের প্রবল করতালি ও উচ্ছ্বাসের পরিচয় পেলেও আজই যেন শিশিরকুমারের অগ্নিপরীক্ষা।
আজ রবীন্দ্রনাথ আসছেন।
শিশিরকুমারের মতে রবীন্দ্রনাথই বাংলা ভাষায় শ্রেষ্ঠ নাট্যকার। শুধু তাই নয়, পরিচালন, প্রয়োগ, মঞ্চসজ্জা সব কিছুতেই তিনি আদর্শস্থানীয়। নিজে অভিনেতা হিসেবেও খুব বড়। অন্যদের কাছ থেকে যতই প্রশংসা পাওয়া যাক না কেন, রবীন্দ্রনাথের কাছে কি ‘সীতা’ পাস মার্ক পাবে? কিছুতেই আজ আত্মবিশ্বাস চাঙ্গা করতে পারছেন না শিশিরকুমার।
তা চাঙ্গা করতে কিছু দ্রব্যগুণ লাগে।
ভিখা বোতল নিয়ে এসেছে খবরের কাগজে মুড়ে।
শিশিরকুমার বললেন, এত দেরি করলি হারামজাদা?
ভিখা বলল, হেদোর কাছে দুটো ষাঁড়ে লড়াই লাগিয়েছে, গাড়িঘোড়া সব বন্ধ, এত ভিড় যে একটা বেড়ালও গলতে পারে না।
শিশিরকুমার বললেন, বেড়াল না পারে, ইঁদুর তো পারবে। তুই তো ব্যাটা একটা ইঁদুর। নে, ঢাল।
আলমারি থেকে গেলাস বার করে, বোতলের ছিপি খুলে ঢালতে যেতেই শিশিরকুমার বললেন, থাক! বোতল তুলে রেখে দে! আমি এখন চান করব!
তবু উঠলেন না। শুয়েই রইলেন।
দেওয়ালে একটি শ্রীরামকৃষ্ণের ছবি, আর একটি কবিতা, বড় বড় অক্ষরে লেখা, পাশে লতা-পাতার ছবি আঁকা।
গিরিশচন্দ্র দক্ষিণেশ্বরের ঠাকুরের ভক্ত হবার পর পেশাদারি থিয়েটারের সব মালিক ও নট-নটীর গার্ডিয়ান এঞ্জেল হয়ে আছেন শ্রীরামকৃষ্ণ। সব রঙ্গালয়ে তাঁর ছবি থাকে। প্রত্যেকেই মঞ্চে ঢোকার আগে সেই ছবি ছুঁয়ে ভক্তিভরে প্রণাম করে যায়। এখানেও ছবিটা আগে থেকেই আছে। শিশিরকুমার সরাতে বলেননি, কিন্তু তিনি এসব ভক্তি টক্তির ধার ধারেন না। তিনি ধর্ম কিংবা ঈশ্বর নিয়ে মাথা ঘামান না, যাঁরা তাঁর কাছে কখনও ঈশ্বর প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন, তাঁদের তিনি ঠাট্টা করে বলেন ভগবতিয়া।
বাঁধানো কবিতাটি তিনি মনে মনে পড়তে লাগলেন।
ভারতী গোষ্ঠীর লেখকরা তাঁর বন্ধুস্থানীয়, এখন কল্লোল নামে ছেলেছোকরাদের যে একটি পত্রিকা বেরুচ্ছে, সেটাও তিনি পড়ে দেখেন, কিছু কিছু লেখা তাঁর বেশ পছন্দ হয়। একটু উগ্র ধরনের, তা বেশ তো!
‘সীতা’র দ্বিতীয় রজনীতে কল্লোল-এর সম্পাদক দীনেশরঞ্জন দাশ অভিনয়ের শেষে এক ছোকরা কবিকে নিয়ে এসেছিলেন সাজঘরে। সে কবির নাম অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত, সে বলেছিল, আমি আপনার আলমগীর থেকে সব ক’টি নাটকের অভিনয় দেখেছি। প্রথম রাত্রির সীতা দেখে মনে হয়েছে, আর কোনও জায়গায় যাব না। ‘সীতা’ই বারবার দেখতে হবে!
দীনেশরঞ্জন বললেন, ও আপনাকে নিয়ে একটা কবিতা লিখেছে। সে কথাটা আপনাকে বলতে লজ্জা পাচ্ছে। শোনাও না অচিন্ত্য!
শিশিরকুমার তখন মুখ থেকে রং তুলছেন। তিনি বললেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, শোনান।
অচিন্ত্যকুমারের কণ্ঠস্বর বেশ দানাদার। তিনি পড়তে লাগলেন:
দীর্ঘ দুই বাহু মেলি আর্তকণ্ঠে ডাক দিল, সীতা, সীতা, সীতা
পলাতকা গোধূলি প্রিয়ারে
বিরহের অস্তাচলে তীর্থযাত্রী চলে গেল ধরিত্রী দুহিতা
অন্তহীন মৌন অন্ধকারে।
যে কান্না কেঁদেছে যক্ষ কলকণ্ঠা শিপ্রা-রেবা বেত্রবর্তী তীরে
তারে তুমি দিয়েছো যে ভাষা;
নিখিলের সঙ্গীহীন যত দুঃখী খুঁজে ফেরে বৃথা প্রেয়সীরে
তব কণ্ঠে তাদের পিপাসা।
এ বিশ্বের মর্মব্যথা উচ্ছ্বসিছে ওই তব উদার ক্রন্দনে
ঘুচে গেছে কালের বন্ধন;
তারে ডাকো— ডাকো তারে— যে প্রেয়সী যুগে যুগে চঞ্চল চরণে
ফেলে যায় ব্যগ্র আলিঙ্গন।
বেদনার বেদমন্ত্রে বিরহের স্বর্গলোকে করিলে সৃজন
আদি নাই, নাই তার সীমা;
তুমি শুধু নট নহে, তুমি কবি, চক্ষে তব প্রত্যুষ-স্বপন
চিত্তে তব ধ্যানীর মহিমা।
কবিতাটি শুনতে শুনতে শিশিরকুমার খুবই শ্লাঘা বোধ করেছিলেন। যে-কোনও শিল্পীই তরুণদের সমর্থনের বেশি মূল্য দেয়। এরাই তো অগ্রগামী।
তিনি বললেন, আমাকে ওটা ভালো করে লিখেটিখে দাও, আমি বাঁধিয়ে টাঙিয়ে রাখব এই ঘরে।
পর দিনই দীনেশরঞ্জন সোনার জলে কাজ করা ফ্রেমে বাঁধিয়ে দিয়ে গেছেন কবিতাটি।
শিশিরকুমার সবটা পড়লেন, কিন্তু পড়তে পড়তেও অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছেন, মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথের মুখ। একেবারে স্কুলের ছাত্রের মতন অবস্থা। আজ রবীন্দ্রনাথ পাশ করাবেন তো!
নাঃ, একটুখানি না খেলে চলবে না।
ভিখাকে না ডেকে নিজেই আলমারি থেকে বোতল আর গেলাস বার করলেন।
ঢালার আগেই দরজাটা খুলে গেল। সেখানে দাঁড়িয়ে আছে গোলাপবালা। আসলে তার নাম আন্নাকালী, থিয়েটারের জন্য ওই নাম দিয়েছেন যোগেশচন্দ্র, তিনিই এনেছেন মেয়েটিকে। তার ডাকনাম ঝিঙে।
শিশিরকুমার ডেকে না পাঠালে কোনও অভিনেতা-অভিনেত্রীর এ ঘরে আসার অনুমতি নেই। এ মেয়েটি সীতা নাটকে কোনও পার্ট পায়নি, রিহার্সালের সময় দু’মাস তাকে নিয়মিত এসে বসে থাকতে হয়েছে। এ নাটকে তুঙ্গভদ্রা নামে একটি ছোট চরিত্র আছে, সে ভূমিকায় আছে নীরদাসুন্দরী। তার আবার হুপিং কাশির অসুখ, মাঝে মাঝে খুব বেড়ে যায়। তখন আর সংলাপ বলতে পারে না। শিশিরকুমার ধরে রেখেছেন, যদি নীরদাসুন্দরীর কোনওদিন সে রকম অবস্থা হয়, তা হলে বদলি হিসেবে এই ঝিঙেকে নামিয়ে দেবেন। সে সৌভাগ্য মেয়েটির আজও হয়নি। প্রতিদিনই সে সেজেগুজে এসে বসে থাকে।
মেয়েটি কোনও কথা বলছে না। শুধু নির্বাক হয়ে চেয়ে আছে।
শিশিরকুমার বললেন, কী রে, পথ ভুলে নাকি? এটাকে ফিমেল বাথরুম ভেবেছিস?
মেয়েটি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, বড়বাবু, আমি একটু আপনার পা টিপে দেব?
শিশিরকুমার বলল, পা টিপে দিবি? কেন, আমার পায়ে কি গোদ হয়েছে? না বাত হয়েছে!
মেয়েটি বলল, আমার খুব ইচ্ছে করে একদিন আপনার পা টিপে সেবা করতে।
এই সময়ে শিশিরকুমারের পক্ষে ঝাঁঝিয়ে ওটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু তিনি মিষ্টি করেই জিজ্ঞেস করলেন, তোকে বুঝি কেউ বলেছে, আমার পা টিপে দিলে ভালো পার্ট পাওয়া যায়?
মেয়েটি ভয় পেয়ে কেঁপে উঠে বলল, না, না, না, না, না, না। কেউ বলেনি।
শিশিরকুমার বললেন, শোন ঝিঙে, তোকে তিনটে শব্দ দিচ্ছি। দুষ্প্রবৃত্তি, জগজ্জননী আর প্রলয়ঝঞ্ঝা। এই তিনটে কথা উচ্চারণ প্র্যাকটিস কর। তুই কী বলিস জানিস! দুষ্পবিত্তি, জগঝ্ঝনী আর পোলয়ঝনজা। এই সব উচ্চারণ যেদিন ঠিক পারবি, সেদিন তোকে পার্ট দেব। আর শোন, আর কোনওদিন যেন এ ঘরের চৌকাঠ পেরুবার চেষ্টা করিসনি!
মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে আড়ালে সরে গেল।
শিশিরকুমার শুনতে পেলেন বাইরে ফেঁপানির শব্দ।
এবার শিশিরকুমারকে উঠতে হল। দরজার কাছে এসে উঁকি মেরে দেখলেন, গোলাপবালি ওরফে ঝিঙে দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে। কাছাকাছি আর কেউ নেই।
শিশিরকুমার চুরুট টানতে টানতে কয়েক মুহূর্ত তার কান্না দেখলেন। তারপর সহাস্যে বললেন, বোকা মেয়ে! থিয়েটারের অ্যাকট্রেসরা কক্ষনও কান্নার সময় হাত দিয়ে মুখ ঢাকে না। কান্নার সময়েও মুখের এক্সপ্রেশন দিতে হয়। মুখ ঢেকে রাখলে অডিয়েন্স তা দেখবে কী করে?
মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিল। তার দু’চোখে খাঁটি অশ্রু।
সে ধরা গলায় বলল, বড়বাবু, আমাকে দয়া করুন।
শিশিরকুমার বললেন, এর মধ্যে দয়ার কথা আবার এল কোথ্থেকে? শোন, চুপি চুপি আমার ঘরে এসে পা টিপে দিলে কিংবা এমনি এমনি কেঁদে ভাসালে পার্ট পাওয়া যায় না। একে বলে দুষ্প্রবৃত্তি! কী বললাম, দুষ্প্রবৃত্তি! আর যতই প্রলয়ঝঞ্ঝা হোক, জগজ্জনীকে ডাকবি! আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে প্র্যাকটিস কর। কাল শুনিয়ে যাবি আমাকে।
এই সামান্য ঘটনাতেই আবার মন বদলে গেল শিশিরকুমারের। তিনি আর বোতলটা খুললেন না। আবার শুয়ে পড়লেন।
একটু বাদে যখন হেমেন্দ্রকুমার এলেন, তখন শিশিরকুমার এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন সাদা দেওয়ালের দিকে। বোতলটা রয়েছে টেবিলের ওপর।
হেমেন্দ্রকুমার জিজ্ঞেস করলেন, কী রে, এর মধ্যে খাওয়া শুরু করেছিস?
শিশিরকুমার ঘোর ভেঙে বললেন, হেমেন আয়। না, খাইনি। যদিও খুব ইচ্ছে করছিল।
হেমেন্দ্রকুমার বললেন, খুব ইচ্ছে করলে, একটুখানি খেয়ে নে!
শিশিরকুমার বললেন, আজ কবিগুরু আসবেন।
হেমেন্দ্রকুমার বললেন, তিনি তোর মুখে গন্ধ পাবেন ভাবছিস! তিনি এলে আমরা অভ্যর্থনা করব। তুই তো তখন মেক আপ নিবি। ফার্স্ট সিনেই তোর অ্যাপিয়ারেন্স। আর একেবারে নাটকের শেষে তুই যখন দেখা করবি, ততক্ষণ মুখে গন্ধ থাকবে না।
শিশিরকুমার বললেন, না থাক! এক ঢোঁক খেলেই আমার আরও বেশি খেতে ইচ্ছে করে। শেষে না বাড়াবাড়ি হয়ে যায়!
হেমেন্দ্রকুমার বললেন, থাক তবে। আসবার সময় দেখলুম, টিকিট কাউন্টারের সামনে লম্বা লাইন পড়েছে। একটা ব্যাপার লক্ষ করলুম, যারা এসেছে, তাদের পোশাক-আশাক দেখলে মনে হয়, সবাই ভদ্র ঘরের। এরা চ্যাংড়া দর্শক নয়। আমাদের ছোটবেলায় সখীদের নাচ দেখবার জন্য যত রাজ্যের মদো মাতাল আর গেঁজেলরা এসে জুটত, অভিনয়ে তাদের মন থাকত না।
শিশিরকুমার বললেন, চল তো দেখে আসি। টিকিট কাউন্টারই তো আমাদের লক্ষ্মী। লাইন দেখলে চোখ জুড়োয়।
দু’জনে ফাঁকা হলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গিয়ে বাইরের দরজার একটু আড়ালে দাঁড়ালেন। দর্শকদের লাইন চলে গেছে রাস্তা পর্যন্ত। গোলমাল নেই, ঠেলাঠেলি নেই।
হেমেন্দ্রকুমার বললেন, অনেকেই মনে হচ্ছে কলেজের ছাত্র। ইউনিভার্সিটিরও হতে পারে।
শিশিরকুমার বললেন, একটা মজার কথা শোন। আমার তো ছোটবেলা থেকেই থিয়েটার দেখা অভ্যেস। বাড়ির লোকদের না জানিয়েও নিজে টিফিনের পয়সা জমিয়ে থিয়েটার দেখেছি। একদিন সেই রকম টিকিট কাটতে গেছি, কাউন্টারের পাশে বসেছিলেন অমৃতলাল বোস। ওনার ওরকম অভ্যেস ছিল, একটা চেয়ারে বসে গড়গড়া টানতেন, লোকজনদের সঙ্গে কথা বলতেন। আমাকে দেখে হঠাৎ রেগে গিয়ে বললেন, অ্যাই ছেলে! লেখাপড়া নেই, এই বয়েসে থ্যাটার দেখতে এসছিস! যা, যা, ভাগ! আর কোনওদিন যেন তোকে এখানে না দেখি!
হেমেন্দ্রকুমার অট্টহাস্য করে বললেন, সেই ছেলে যে থিয়েটারের জগতে হুলুস্থুলু কাণ্ড বাধাবে, তা আর তিনি জানবেন কী করে!
শিশিরকুমার বললেন, মানুষটা বড় ভাল ছিলেন।
একটু পরেই হাজির হলেন মণিলাল। ‘সীতা’ নাটকের জন্য হেমেন্দ্রকুমার গান লিখে দিয়েছেন। আর মণিলাল শিখিয়েছেন নাচ। পুরনো আমলের ড্যান্স মাস্টার ন্যাপা বোসকে নিযুক্ত করার পরেও বাদ দিতে হয়েছে, এ নাটকে পুরনো কিছুই চলবে না।
হেমেন্দ্রকুমার আর মণিলাল দু’জনেই ব্যস্ত মানুষ, তবু সব কাজ ফেলে আসেন প্রতিটি শোয়ের দিনে। শো শুরু হবে সন্ধে সাড়ে সাতটায়, অভিনেতা-অভিনেত্রীরা আসতে শুরু করে দুপুর থেকে। একেবারে তৈরি নাটক, তবু শিশিরকুমার প্রভাকে খানিকক্ষণ রিহার্সাল দেওয়ালেন। প্রত্যেককে ডেকে বললেন, আজ সবাই মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে অভিনয় করবে, যেন কোনও ভুল না হয়।
আজও সব টিকিট শেষ। ‘প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ’। অন্যেরা লেখে ‘হাউজ ফুল’ শিশিরকুমার সেটা বদলে দিয়েছেন। তাঁর এখানে সব কিছু বাংলায়।
শরৎচন্দ্র আগের শো দেখে গেছেন। আজ আবার এসেছেন। এসেই বললেন, না এসে পারলুম না হে। চুম্বকের মতন টানছে।
যথাসময়ে এলেন দু’জন সঙ্গীসহ রবীন্দ্রনাথ। তিনি সাধারণ রঙ্গালয়ে অন্যের লেখা নাটক কখনও দেখতে যান না। তবু এসেছেন চতুর্দিকে শিশির ভাদুড়ীর সুনাম শুনে। তিনি বিশ্ববিখ্যাত মানুষ, যেদিন যেখানে যান তা সংবাদপত্রে ছাপা হয়। রবীন্দ্রনাথ পেশাদারি থিয়েটারে আসছেন জেনে অনেকে বেশ বিস্মিত।
ওপরের বক্সে পাশাপাশি বসানো হল রবীন্দ্রনাথ ও শরৎচন্দ্রকে।
অভিনয় হল নিখুঁত। একেবারে শেষ দৃশ্যে শিশিরকুমার যখন আর্তকণ্ঠে চারবার ডাকলেন সীতা সীতা সীতা সীতা, তখন দর্শকদের মধ্যে শোনা গেল রীতিমতন ফোঁপানি। সেই তীব্র হাহাকারে সাধারণ সংসারী মানুষেরও হৃদয় কেঁপে ওঠে। কয়েক মুহূর্তের মতো সকলেই বিহ্বল। তারপর ঝড়ের মতন হাততালি। সে হাততালি আর থামেই না। শিশিরকুমারকে তিনবার ফিরে আসতে হল দর্শকদের সামনে।
শো-এর শেষে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা সাজঘরে এসে শিশিরকুমারকে প্রশস্তি জানিয়ে যান। রবীন্দ্রনাথ তো সেখানে আসবেন না, শিশিরকুমারকেই যেতে হবে। অতি দ্রুত কিছুটা পোশাক বদলে, ভক্তদের ঠেলে সরিয়ে শিশিরকুমার ছুটে গেলেন ওপরতলায়।
রবীন্দ্রনাথ নেই। শরৎচন্দ্র বললেন, কবিগুরু তো লাস্ট ডায়ালগের সঙ্গে সঙ্গে কিছু না বলেই বেরিয়ে গেলেন।
শিশিরকুমারের মুখখানি পাংশু হয়ে গেল। এর একটাই অর্থ হয়। রবীন্দ্রনাথের ভালো লাগেনি। অপ্রিয় কথা বলবেন না বলেই চলে গেলেন?
শিশিরকুমারের অবস্থা দেখে মণিলাল বললেন, গুরুদেবের নিশ্চয়ই ভালো লেগেছে। না হলে কি তিনি শেষ পর্যন্ত বসে থাকতেন? কত রাত হয়েছে! তাই আর অপেক্ষা করেননি।
নরেন্দ্র দেব বললেন, হয়তো কাল ভোরেই শান্তিনিকেতন যেতে হবে, তাই দাঁড়ালেন না।
এতে শিশিরকুমার প্রবোধ মানলেন না। একটা কথাও বললেন না কবিগুরু? আর দু’মিনিটও দাঁড়াতে পারতেন না? ফেল, ফেল, এত উদ্যম সব ব্যর্থ!
কেউ কেউ প্রশংসা জানাতে এলে শিশিরকুমার সব অগ্রাহ্য করে ঢুকে গেলেন নিজের ঘরে। দাম করে বন্ধ করে দিলেন দরজা।
আজকের রাতের মতন আর না ঘাঁটিয়ে ফিরে গেলেন বন্ধুরা।