০১. মাইজপাড়া গ্রাম

অর্ধেক জীবন – সুনীল গঙ্গোপাধ্যা

.

চান্দ্রেয়ী আর শৌভিককে

.

মুখবন্ধ

ধারাবাহিকভাবে এই রচনা ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশের সময় ও সমাপ্ত হলে অনেকে আমাকে প্রশ্ন ও অভিযোগ করেছেন, আমি ‘অর্ধেক জীবন’ নাম দিয়েছি কেন, আমি কি আমার আয়ুর সীমানা জানি? কিংবা অকস্মাৎ এ রচনা শেষ হয়ে গেল কেন, দ্বিতীয় খণ্ড কি আবার লেখা হবে? অতি সংক্ষেপে এর উত্তর এই যে, নামকরণের সঙ্গে আমার আয়ুর কোনও প্রশ্নই নেই, পুরো জীবনের কথা কেউ কখনও লিখতে পেরেছেন কি না আমি জানি না, তা ছাড়া, শেকসপিয়ারের হ্যামলেটের যে-উক্তিটি আমি উদ্ধৃত করেছি, তার মধ্যেই এই নামকরণের তাৎপর্য নিহিত আছে। এর পরের খণ্ড আর লেখার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ এ রচনা আমি মধ্যপথে সমাপ্ত করিনি, এইটুকুই এর পূর্বপরিকল্পিত নির্দিষ্ট পরিধি। পূর্ব বাংলার এক অখ্যাত গ্রামে জন্ম। বহু বছর পর স্বাধীন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন, এর মধ্যে একটা বৃত্ত আছে। এবং চল্লিশ-পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বিপদসঙ্কুল, কঠিন, ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ের মধ্য দিয়ে জীবন টিকিয়ে রাখা, যাকে বলে জীবনসংগ্রাম, সব কিছুই অনিশ্চিত, তারই মধ্যে নানা রকম আশা, আকাঙক্ষা ও ভালোবাসা, অনেক স্বপ্ন, সেই বয়েসটার কথা লিখতে চেয়েছি। এটাকে ঠিক আত্মজীবনীও বলা যায় না। নিজের অন্তর্জীবনের কথা বলা যায় না কিছুতেই, অনেক সময় মনে হয় তা অকিঞ্চিৎকর, অন্যকে জানাবার মতন নয়, আমার পারিবারিক কাহিনীও যথাসম্ভব সংক্ষিপ্ত, বরং সমসাময়িক স্মৃতিকথাই প্রাধান্য পেয়েছে, কাছাকাছি ইতিহাসের পটভূমিকা এবং উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী।

এর পরবর্তী অংশ না লেখার প্রধান কারণটিও এখানে ব্যক্ত করা যায়। এই অংশে আমি এমন অনেক মানুষের কথা লিখেছি, আমার সেইসব প্রিয় মানুষ আর ইহলোকে নেই, বন্ধুদের মধ্যেও কেউ কেউ চিরবিদায় নিয়েছে, তাঁদের মৃত্যুর কথা লিখতে আমার কলম অক্ষম। আমার এই স্মৃতিকাহিনীতে তাঁরা জীবন্ত হয়েই থাক। শুধুমাত্র আমার বাবার মৃত্যুর কথা লিখতেই হয়েছে প্রসঙ্গক্রমে।

এই লেখা শুরু করার পর পদে পদে বাধার সম্মুখীন হয়েছি, আর সেই বাধা এসেছে আমার নিজেরই কলম থেকে। কোনও লেখকের পক্ষে এক বিষয় নিয়ে বারবার লেখা সম্ভব নয়, তা চর্বিত চর্বণের পর্যায়ে পড়ে। আমি আমার বিস্তর কবিতায় ও গল্প-উপন্যাসে নিজের জীবনকে ব্যবহার করেছি টুকরো টুকরোভাবে। সেইসব ঘটনারই পুনরাবৃত্তি করতে আমার কলম ইতস্তত ও দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে থমকে গেছে। অথচ ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য সে সব একেবারে বাদ দেওয়াও যায় না। সেই জন্যই ওই সব অংশ (যেমন আমার প্রথমবারের প্রবাস জীবন ও মার্গারিটের সঙ্গে বন্ধুত্ব) আগেই অন্যত্র বিস্তৃতভাবে লেখা হয়েছে বলে এখানে শুধু একটু একটু ছুঁয়ে গেছি মাত্র। ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার ইতিহাসও আমি নিজে ছাড়াও আরও অনেকে লিখেছেন, তাই এখানে শুধু কয়েকটি রেখার টানই মনে হয়েছে যথেষ্ট। তবু, আমি স্বীকার করতে বাধ্য, কোথাও কোথাও পুনরুক্তি এসেই গেছে।

আর একটি বিষয়ও উল্লেখযোগ্য। এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন ভি এস নইপাল, তাঁর সম্প্রতি প্রকাশিত গ্রন্থটির নাম ‘হাফ অফ লাইফ”। আমার ‘অর্ধেক জীবন’ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে শুরু হয় প্রায় তিন বছর আগে, তখন নইপালের উপন্যাসটির নাম কিংবা প্রস্তুতিপর্বের কথা কিছুই জানা যায়নি৷ হাফ অফ লাইফ অবশ্য স্মৃতিকথা নয়, জীবন-ঘেঁষা উপন্যাস, তবু এই নামের মিলে আমি কিছুটা অপ্রস্তুত বোধ করেছি। আমি ওই বইয়ের কথা আগে শুনিনি, নইপালও যতদূর মনে হয় বাংলা জানেন না এবং ‘দেশ’ পত্রিকা পড়েন না। তিনিও কি হ্যামলেটের ওই লাইনটির কথা মনে রেখেছেন? তাঁর বইটিতে অবশ্য সে উল্লেখ নেই। যাই হোক, সে জন্য আমার এ রচনার নাম বদলের কোনও যৌক্তিকতা নেই।

ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের সময় প্রথমে যে-পরিচ্ছেদটি ছিল, সেটি এ গ্রন্থ থেকে বাদ দিয়েছি ইচ্ছে করে। সে পরিচ্ছেদে ছিল আমার জীবনের পরিণত বয়েসের কিছু কিছু ঘটনার সমন্বয়, তার পরের এই দীর্ঘ অংশ ফ্ল্যাশ ব্যাক, আঙ্কিক হিসেবে বেমানান। তা ছাড়া তাতে যে কৌতুকের প্রয়াস ছিল, তার রেশ এতদূর ধরে রাখা যায় না। সেই পরিচ্ছেদটি পরিশিষ্ট হিসেবে যুক্ত করার কথা একবার ভেবেও শেষ পর্যন্ত পরিত্যক্ত হয়েছে, পুরনো ‘দেশ’ পত্রিকার পৃষ্ঠাতেই সেটা নিবদ্ধ থাক।

ইতিহাসের উপাদান ও প্রেক্ষাপটের ঘটনাবলী কিছু কিছু বই ও সমসাময়িক পত্র-পত্রিকা থেকে সংগৃহীত হয়েছে, সেগুলির নাম আর আলাদাভাবে উল্লেখিত হল না। আমার নিজের যে-সব বইতে আমার জীবন ছড়িয়ে আছে, সেগুলির তালিকা দিলেও নিশ্চিত বাহুল্য বোধ হবে।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

.

Queen: O Hamlet, thou hast cleft my heart in twain,
Hamlet: O, throw away the worser part of it,
And live the purer with the other half.
Hamlet, Act III, Sc IV
 William Shakespeare.

.

এক

অবিভক্ত বাংলার ফরিদপুর জেলার মহকুমা শহর মাদারিপুর, সেই শহর থেকেও বেশ দূরে মাইজপাড়া একটি অতি সাধারণ গ্রাম। মাইয বা মাইজ মানে খুব সম্ভবত মধ্যম, বাঙাল ভাষায় মেজো ভাইকে বলে মাইজাভাই। আঞ্চলিক অভিধানে মাইজ-এর একটা অন্য অর্থও আছে, মাইজপাতা মানে গাছের কচি পাতা।

শুধু মাইজপাড়া নয়, পূর্ব মাইজপাড়া। তার মানে নিশ্চয়ই একটা পশ্চিম মাইজপাড়াও ছিল বা আছে। অবশ্য এ নিয়মের ব্যতিক্রমও হয়। যেমন, এখন পশ্চিমবঙ্গ নামে একটি রাজ্য আছে, (আগে যাকে প্রদেশ বলা হত) কিন্তু পূর্ববঙ্গ বলে এখন আর পৃথিবীতে কিছু নেই। এই পশ্চিমবঙ্গের আবার উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গ হিসেবেও ভাগ করা হয়, কিন্তু পূর্ববঙ্গ অদৃশ্য।

ওই পুব মাইজপাড়া গ্রামের এক প্রান্তে ছিল একটি ব্রাহ্মণ পল্লী। একটি বেশ বড় আকারের চৌকো উঠোনের চারদিকে চারটি বাড়ি। পঞ্চম একটি বাড়ি এক কোণের দিকে, বোঝা যায় পরের দিকে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে, তাই বর্গক্ষেত্রটির পাশে জায়গা পায়নি। সেই পঞ্চম বাড়িটি আকারেও ছোট, চেহারায় মলিন, তাতে অন্যদের তুলনায় এক দরিদ্র পরিবারের বাস। সেই পরিবারের কর্তার নাম অবিনাশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়, আমার পিতামহ। তিনি ছিলেন সামান্য এক টোলের পণ্ডিত।

সেই সময়ে অবিনাশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় নামে একজন লেখকও ছিলেন। কলকাতায় ইস্কুলের নিচু ক্লাসে আমাদের ‘চাণক্য শ্লোক’ নামে একটি চটি বই পড়তে হত, সেই শ্লোকগুলির পদ্য-অনুবাদক অবিনাশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়, আমি সহপাঠীদের কাছে চাল মেরে বলতাম, ইনি আমার ঠাকুর্দা। একেবারে নির্জলা মিথ্যে কথা। আমাদের বংশে কেউ কখনও লেখালেখির ধার, ধারেননি।

আমার জন্ম অবশ্য ওই গ্রামে হয়নি; এক সময় সন্তানসম্ভবা বধুকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়ার প্রথা ছিল। আমার মাকেও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু বাপের বাড়িতে নয়, কারণ মায়ের কোনও বাপের বাড়ি ছিল না। ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করা দরকার, আমার মায়ের একজন জবরদস্ত বাবা তো ছিলেনই, বরিশাল জেলায় তাঁর বাড়িও ছিল। কিন্তু মা কখনও যেতেন না সেখানে। এর পেছনে আছে কৌলীন্যপ্রথার সুদীর্ঘ করুণ ও হাস্যকর ইতিহাস। চতুর ও লোভী ব্রাহ্মণেরা এই প্রথা চালিয়ে কত যে অসহায় কুমারীর সর্বনাশ করেছে, তার ইয়ত্তা নেই। বিদ্যাসাগর মশাই পূর্ববঙ্গের কুলীন ব্রাহ্মণদের এক একজনের দুশো-আড়াইশো পত্নীরও পরিসংখ্যান সংগ্রহ করেছিলেন। এখন অনেকের ধারণা, কৌলীন্যপ্রথা বুঝি ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্যাপার, তা কিন্তু নয়, বিংশ শতাব্দীতেও অনেকদিন চালু ছিল, আমি নিজেও দেখেছি, আমার পিতৃ ও মাতৃকুল এই প্রথার ভুক্তভোগী।

আমার গরিব ঠাকুর্দা চারখানা বিয়ে করেছিলেন, এবং মাতামহ তিনটি। গল্প শুনেছি, আমার ঠাকুর্দার এক পত্নীর একবার খুব অসুখ হয়। চিকিৎসা করার সঙ্গতি ছিল না, দিশাহারা হয়ে তিনি বাড়ি থেকে চলে যান, কয়েকদিন পর বেশ কিছু টাকাপয়সা নিয়ে ফিরে এলেন। অর্থোপার্জনের একমাত্র উপায় আর একটি বিয়ে করা, তিনি তাই করেছেন, নবোঢ়াকে ফেলে পণের টাকা নিয়ে ফিরে এসে অন্য পত্নীর জন্য ওষুধ-ডাক্তারের খরচ মিটিয়েছেন।

আমার মাতামহ অত গরিব ছিলেন না, অরক্ষণীয়া ব্রাহ্মণ কন্যাদের উদ্ধার করার জন্যই সম্ভবত তিনবার দার পরিগ্রহ করেছিলেন, কিন্তু তিন পত্নীকে এক সংসারে রাখার মতন বোকামি করেননি। আমার মায়ের মা কখনও তাঁর স্বামী-গৃহে থাকেননি, প্রায় সারাটা জীবন তিনি তাঁর এক ভাইয়ের সংসারে আশ্রিতা হয়ে কাটিয়ে গেছেন। আমার মায়ের সেই মামার বাড়িই ছিল কার্যত তাঁর বাপের বাড়ি, আমিও সেই বাড়িকেই মামার বাড়ি বলতাম।

ফরিদপুর জেলাতেই সেই মামার বাড়ির গ্রামের নাম আমগ্রাম বা আমগাঁ, লোকে অবশ্য বলত আমগা; পূর্ববঙ্গের লোকদের কেন যেন চন্দ্রবিন্দুর প্রতি বড়ই অভক্তি। পশ্চিমবঙ্গে আবার বেশি বেশি চন্দ্রবিন্দু। ওরা চাঁদ ও ফাঁদকে বলে চাদ ও ফাদ, এদিকে এরা হাসি ও হাসপাতালের বদলে হাঁসি ও হাঁসপাতাল। আমাদের মাইজপাড়ার তুলনায় আমগাঁ বেশ বর্ধিষ্ণু, অনেক সচ্ছল লোকের বাস, বেশ কিছু পাকা বাড়ি, এমনকী দোতলা-তিনতলা, যা ওই ধরনের গ্রামে তখনকার দিনে খুবই দুর্লভ ছিল।

আমাদের বাবা-ঠাকুর্দার বাড়ির সঙ্গে মায়ের মামাবাড়ির কোনও তুলনাই চলে না। আমাদের বাড়িটি মাটির দেওয়াল, ওপরে টিনের চাল। ছোট্ট উঠোন, তার এক পাশে রান্নাঘর, অন্য পাশে আর একটি ছোট্ট ঘর, সেগুলির চাল খড়ের। সেই ব্রাহ্মণপল্লীতে তিনটি বেশ বড় বড় পুষ্করিণী ছিল, কোনওটাই নিজস্ব নয় আমাদের। যান-বাহনের জন্য আমাদের নিজস্ব নৌকো বা গরুর গাড়িও ছিল না। তবে কয়েক বিঘে জমি ছিল দূরে কোথাও, সেই জমির চাষিরা আমাদের তুলনায় অনেক সম্পন্ন, বছরে একবার সাজগোজ করে আমাদের ধান বিক্রির টাকা দিতে আসত। লুঙ্গির ওপরে ধপধপে সাদা কুর্তা পরা ও গলায় মাফলার জড়ানো একজন মুসলমান প্রজার কথা আমার মনে পড়ে। অত ভালো পোশাক আমার বাপ-ঠাকুর্দা কখনও পরেননি।

আমরা ছাড়াও জ্যাঠামশাইয়ের পরিবার ও দু’জন অবিবাহিত কাকা, সবাই মিলে সেই ছোট বাড়িতে কী করে এঁটে যেতাম জানি না। আমার তিন বছর বয়েসে ঠাকুর্দা মারা যান, তাঁর সম্পর্কে আমার প্রায় কিছুই স্মৃতি নেই। একজন ঠাকুমা, বাবার নিজের মা নন, সৎমা, বেঁচে ছিলেন আরও কিছুদিন।

টিনের চাল দেওয়া মাটির বাড়িতে খুব যে কষ্টে ছিলাম, তা তো মনে হয় না। টিনের চালে কাক লাফালে ক্যাচোর-ম্যাচোর শব্দ হত, কিন্তু বৃষ্টির শব্দ ছিল আচ্ছন্ন করা মন্ত্রের মতন। একটাই অসুবিধে, মাটির ভিত কেটে চোর ঢোকা বেশ সহজ ব্যাপার, তাকে বলা হয় সিঁধ কাটা। কিছু কিছু ফলের গাছ সব বাড়িতেই থাকে, আমাদের উঠোনে ছিল একটা জামরুল গাছ, বাড়ির এক পাশে একটা বাতাবি লেবুর গাছ, ওখানকার ভাষায় বলে জম্বুরা। বাতাবি শব্দটি এসেছে ব্যাটাভিয়া থেকে, জাভার অন্তর্গত একটি স্থানের নাম ব্যাটাভিয়া, ফলটি সেখান থেকেই আনীত। জম্বুরা শব্দটি কোথা থেকে এসেছে জানি না। সেই গাছটিতে প্রচুর ফল হত, অত কে খাবে, সেই বাতাবি লেবু দিয়ে আমরা ফুটবল খেলতাম। একটা পুকুর ধারের এজমালি বাগানে একটা খুব বড় আমগাছ, সে গাছের আমের নাম টিয়াঠুঁটি, যে-ই নাম দিয়ে থাকুক, তার উপমাজ্ঞান দারুণ।

আমগ্রামে মায়ের মামার বাড়ি পাকা, ওখানকার ভাষায় দালান কোঠা। একতলা কিন্তু অনেকগুলি ঘর, সামনে ও পেছনে দীর্ঘ ও প্রশস্ত বারান্দা, এক একটা বারান্দায় পঁচিশ-তিরিশজন লোক পাত পেড়ে বসে খেতে পারে। পেছন দিকে বড় উঠোন, তার দু’পাশেও কয়েকটা ঘর, পাকা না হলেও বেশ মজবুত, দুটি রান্নাঘর। বাড়িটির প্রধান বৈশিষ্ট্য এর সামনের দিকের আটচালা। আটখানা কাঠের থামের ওপর একটি স্থায়ী ছাউনি, তার নীচে শ পাঁচেক লোক বসতে পারে অনায়াসে। ওঁরা ছিলেন ছোটখাটো জমিদার, ওই আটচালার নীচে প্রজারা এসে জমায়েত হত মাঝে মাঝে। এক পাশে একটি পূজামণ্ডপ, সেখানে খুব ধুমধাম করে দুর্গাপুজো হত, এবং লক্ষ্মীপুজো, কালীপুজো, সেই উপলক্ষে যাত্রাপালা ও গানবাজনা। স্থায়ী আটচালার জন্য গ্রীষ্ম, বর্ষা ও শীতে কোনও অসুবিধে হত না।

আমার মায়ের বড়মামাকে বৃদ্ধ অবস্থাতেই দেখেছি, বয়সের তুলনায় তাঁকে বেশি বৃদ্ধ দেখাত, পাতলা, ছোটখাটো চেহারা, তিনিই পরিবারের প্রধান, জমিদারোচিত ভঙ্গিতে রুপো বাঁধানো ছড়ি নিয়ে হাঁটতেন। প্রায় কোনও খাদ্যই হজম করতে পারতেন না, তবু দুপুরবেলা তাঁর ভাতের থালার পাশে দশ-বারোটি বাটিতে মাছ-মাংস ও বিভিন্ন ব্যঞ্জন সাজিয়ে দিতে হত, তিনি সেগুলির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেন, কোনওটা আঙুল দিয়ে শুধু ছুঁতেন। এটা তাঁর লোভের প্রকাশ নয়, তাঁর জন্য অত কিছু রান্না হত বলেই বাড়ির অন্যরা ভালোমন্দ খেতে পেত। খাদ্যের বদলে তিনি দু’বেলা খেতেন আফিমের গুলি। শুনেছি, একবার তাঁকে সাপে কামড়ায়, এবং সাপটিই মারা যায়, আফিমের এমনই গুণ।

মায়ের মেজোমামা কিন্তু ছিলেন খুবই সুপুরুষ। দীর্ঘকায়, সুগঠিত শরীর, অত্যন্ত ফর্সা, চোখের তারা কালো নয়, এক রকম মণির মতন, ইংরেজিতে যাকে বলে ক্যাট্স আই, বেড়াল-চোখো বললে খারাপ শোনায়। সুরেন্দ্রমোহন গঙ্গোপাধ্যায়, সুরেন গাঙ্গুলি নামেই পরিচিত ছিলেন তিনি, অত্যন্ত বিদ্বান ব্যক্তি, তখনকার দিনের ডি এসসি, পি আর এস, অনেক বছর ধরে তিনি ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্ক বিভাগের প্রধান। তিনি গ্রন্থকারও ছিলেন। জ্যামিতি, অ্যালজ্যাবরা, ট্রিগনোমেট্রির টেক্সট বই রচনা করেছিলেন অনেকগুলি, স্কুল ও কলেজের। সেইসব বই এখন আর পাওয়া যায় না, তবে গাঙ্গুলি-মুখার্জি ট্রিগনোমেট্রির বই বিজ্ঞানের ছাত্ররা অনেকদিন পড়েছে। সে আমলে টেক্সট বই বেশি ছিল না, এইসব বইয়ের লেখকরা বেশ ধনী হতেন। আমার মনে হয়, পারিবারিক জমিদারির আয়ের চেয়েও এক সময় আমাদের এই মেজো দাদুর ব্যক্তিগত আয় অনেক বেশি ছিল। তিনি খরচও করতেন যথেষ্ট এবং বহু বছর পতিগৃহ বঞ্চিতা তাঁর বোনকে এবং আরও অনেককে আশ্রয় দিয়েছেন। সেই অবস্থায় প্রায় সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেও আমার দিদিমার আচার ব্যবহারে কখনও তিক্ততার চিহ্ন ছিল না। তিনি যেমন ছিলেন রন্ধনপটীয়সী, তেমনই বাড়ির সকলের অসুখে বিসুখে সেবা-শুশ্রুষায় দিন-রাত অক্লান্ত। কারও অসুখ হলেই দিদিমাকে তার শয্যার পাশে রাত জেগে বসে থাকতে দেখেছি।

দিদিমার নাম আমি জানতাম না, এই কয়েকদিন আগে মাকে জিজ্ঞেস করেছি। তিনি ছিলেন, কারও বোন, কারও পিসি, কারও মাসি, কারও মা। ভালো নাম মনোরমা, ডাকনাম মণি, তাঁর দাদারা ওই নামে ডাকতেন। তাঁর স্বামী বিরাজমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় বছরে কয়েকবার আসতেন এই পত্নী সন্দর্শনে, বেশ হৃষ্টপুষ্ট চেহারা, স্বল্পভাষী, মার্জিত ব্যবহার, তাঁর গায়ের রং লেডিকেনির মতন, কিন্তু তাঁর এই পক্ষের তিনটি ছেলেমেয়েই বেশ ফর্সা। বড় মেয়ের নাম মীরা, পরের মেয়ের নাম কুসুম, ছোট ছেলেটির নাম যতীন। কিশোরী মীরা শুধু সুন্দরীই নয়, লেখাপড়াও শিখেছিল কিছুটা, এবং নিছক গ্রাম্য মেয়েও বলা যাবে না, অল্প বয়েস থেকেই খানিকটা শহুরে আলো-বাতাসেরও স্বাদ পেয়েছিল।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সুরেন্দ্রমোহন বছরের বেশির ভাগ সময় কলকাতাতেই থাকতেন সপরিবারে, তাঁর বোন মণিকেও নিয়ে আসতেন, কারণ, তাঁর স্ত্রীর স্বাস্থ্য ভালো ছিল না, মণিকেই প্রধানত সংসার সামলাতে হত। মণির ছেলেমেয়েরাও থাকত তাঁর সঙ্গে। সেই সুবাদে মীরা কলকাতার আবহাওয়ার সঙ্গে পরিচিত হয়। সুরেন্দ্রমোহনের স্ত্রীর নামটি বেশ গালভারী, ব্রজবাসিনী, ছোট্টখাট্টো চেহারার মহিলা, স্বভাবটি ভারী মধুর, তবে শেষ দিকে হাঁপানি রোগে খুব কাতর হয়ে পড়তেন, শয্যাশায়ী অবস্থাতেও তাঁর মুখের হাসি দেখলে মনে হত, সুহাসিনী নামটি তাঁকে বেশি মানাত।

সুরেন্দ্রমোহন প্রথম দিকে থাকতেন ভাড়াবাড়িতে, পরে দমদম মতিঝিলে বাগান সমেত বিশাল বাড়ি বানিয়েছিলেন। বিভিন্ন ভাড়াবাড়ি থাকার আমলে একবার উত্তর কলকাতার যে বাড়িটিতে থাকতেন, সেই বাড়িরই অপর অংশে বাস করতেন কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত। কিশোরী মীরা ওই কবিকে স্বচক্ষে দেখেছে। এই দেখার স্মৃতি বহু বছর পরেও মীরা অনেককে শুনিয়েছে, অর্থাৎ একজন কবির বিশেষ গুরুত্ব ছিল তার কাছে। যথাসময়ে, অর্থাৎ পনেরো বছর বয়েস হতে না হতেই মীরার বিয়ে হয় এক স্কুল শিক্ষকের সঙ্গে।

মাইজপাড়ার দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে অবিনাশচন্দ্রের সন্তানদের নামকরণের কোনও পদ্ধতি ছিল না। বড় ছেলের নাম বিনয়কৃষ্ণ, মধ্যমের নাম কালীপদ, ছোট ছেলে দেবপ্রিয়। বৈমাত্রিক আর দুটি ভাইয়ের নাম হরিপদ ও তারাপদ, এঁদের মধ্যে হরিপদ পুলিশে চাকরি নিয়ে আত্মহত্যা করেছিল, এ ঘটনা ক্ষীণভাবে শুনেছি। অপর ভাই তারাপদ সন্ন্যাসী হয়ে যায়। সেই অজ পাড়াগাঁ থেকে কালীপদ কলেজে পড়তে এসেছিল কলকাতায়। তৎকালীন গ্রামীণ সমাজে অনেক পরিবারেরই অন্তত একটি ছেলেকে, যদি লেখাপড়ায় একটু মাথা থাকত, কষ্টেসৃষ্টেও পাঠানো হত শহরে, যাতে সে দুটো-একটা পাস দিয়ে কোনওক্রমে একটা চাকরি জোগাড় করতে পারে। পথের পাঁচালীর অপুর মতন হাজার হাজার অপু ভরিয়ে রাখত শিয়ালদা অঞ্চলের মেসবাড়িগুলি। নিজস্ব ধানজমি থেকে সংবৎসরের খোরাকি জুটে যেতে পারে, কিন্তু অন্যান্য অভাব মেটাতে চাকরির নগদ টাকা বিশেষ প্রয়োজনীয়।

গ্রাম্য টুলো পণ্ডিতের ছেলে শহরে এসে শিক্ষকতা শুরু করলে, তা যথেষ্ট পদোন্নতিই বলতে হবে। মেসবাড়িতে থাকা, দেশের বাড়ি থেকে টাকা আসার কোনও সম্ভাবনা নেই, কালীপদকে অর্থের জন্য অনেক উঞ্ছবৃত্তি করতে হত, তাই বি.এ পড়তে পড়তেই তিনি চাকরির সন্ধান করছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাঁর চাকরি পাওয়া ও বিবাহের মধ্যে হয়তো একটি যোগসূত্র ছিল। অধ্যাপক সুরেন্দ্রমোহন বেশ প্রতিপত্তিশালী, অনেক কলেজ ও স্কুল কমিটির সঙ্গে তিনি যুক্ত, কর্নওয়ালিশ স্ট্রিটের টাউন স্কুলের তিনি সভাপতি, সেই স্কুলে তিনি কালীপদ নামে যুবকটিকে চাকরিতে ঢুকিয়ে দেন। তাঁর ভাগনিকে বিয়ে করা ওই চাকরির শর্ত ছিল কি না জানি না, তবে এ রকম প্রায়ই হয়তো হত। তখন বিবাহ ব্যাপারে প্রধান বিবেচ্য জাত-পাত, কুলীন ব্রাহ্মণরা বেশি বেশি স্পর্শকাতর। কৌলীন্যের মধ্যেও কত রকম ভাগাভাগি, রাঢ়ী, বারেন্দ্র, শ্রোত্রীয় (বাঙাল ভাষায় ছুরিত্তির), বৈদিক, ভঙ্গকুলীন ইত্যাদি। বংশে একটি বিয়েও ঠিক-ঠিক স্ববর্ণে না হলে সবাই পতিত হয়ে যেত। উপাধ্যায় যুক্ত পদবিধারী রাঢ়ী ব্রাহ্মণরা নিজেদের মনে করতেন বর্ণশ্রেষ্ঠ। নিজেরাই নিজেদের শ্রেষ্ঠ বানিয়েছিলেন আর কী!

মামাবাড়ির আশ্রিতা না হলে মীরা তার রূপ ও গুণের জন্য যোগ্যতর পাত্র পেতে পারত। কৌলীন্য ছাড়া কালীপদর আর কোনও বংশগৌরব ছিল না, তিনি সুপুরুষও নন, বেঁটেখাটো চেহারা, ভালোমানুষের মতন গোল মুখ, গায়ের রং অবশ্য পরিষ্কার, অল্প বয়েস থেকেই টাক পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। পারিবারিকভাবে খুবই গরিব, এবং চাকরি হিসেবে শিক্ষকতা সবচেয়ে নিকৃষ্ট। অনেক ব্যাঙ্কের বেয়ারার চেয়ে বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকদের বেতন কম ছিল, এবং অনেক স্কুলের শিক্ষকরা প্রতি মাসে প্রাপ্য মাইনের পুরোটাও হাতে পেতেন না।

প্রত্যেক মানুষেরই জন্মের পশ্চাতে আছে এক আকস্মিক ও বিচিত্র রসায়ন। মীরার সঙ্গে কালীপদর বদলে যদি ধরা যাক বিষ্ণুপদ নামে অন্য একজনের বিবাহ হত, কিংবা কালীপদর সঙ্গে মীরার বদলে যদি বিবাহ হত মালতি নামে কোনো কুমারীর, তা হলে তাঁদের সন্তান- সন্ততিরা হত সম্পূর্ণ অন্যরকম । অনেক সময় দেখা যায়, একজন পুরুষের সঙ্গে একজন নারীর বিয়ের কথাবার্তা প্রায় ঠিকাক হয়েও ভেস্তে গেল শেষ মুহূর্তে, বদলে গেল পাত্র-পাত্রী, সঙ্গে সঙ্গে তাদের ভবিষ্যৎ বংশধারাও পরিবর্তিত হয়ে গেল। আমরা সবাই এই আকস্মিকতার সন্তান। পৃথিবীতে আসাটাই আকস্মিক, তবু সারাজীবন আমরা নানারকম যুক্তি দিয়ে এই জীবনটা সাজাবার চেষ্টা করি।

বিয়ের এক বছরের মধ্যেই গর্ভবতী হওয়ায় মীরাকে পাঠিয়ে দেওয়া হয় আমগ্রামে, সেখানেই তাঁর মা ছিলেন তখন। আমগ্রামে শহরের মতন গাড়ি-ঘোড়ার ধুলো নেই, কল- কারখানার ধোঁয়া নেই। বাতাস অতি বিশুদ্ধ। চারদিকে সবুজের সমারোহ, বৃক্ষগুলি ফলবতী, পুকুরগুলি টলটলে জলে ভরা। মীরা ভালো সাঁতার জানে। মামাবাড়িতে প্রচুর শাকসব্‌জি, মাছ, ঢেঁকি-ছাঁটা চালের ফেনা ভাতে খাঁটি ঘি এবং অন্যান্য নানান সুখাদ্যের অভাব নেই। মাইজপাড়ায় তাঁর শ্বশুরবাড়িতে এসব পাওয়া সম্ভব ছিল না। মামাবাড়িতে বইও অনেক, দুপুরে সমবয়েসি মেয়েদের সঙ্গে অনেকক্ষণ সাঁতার কেটে ও অন্য সময় বই পড়ে তাঁর দিন কাটে, গর্ভের সন্তানটিও বাড়তে থাকে ক্রমশ।

সেই উনিশশো চৌত্রিশ সালে সারা পৃথিবীতে কিংবা সারা দেশে, কিংবা কলকাতা শহরে, এমনকী কাছাকাছি ঢাকাতেও কীসব ঘটনা ঘটছে, তার কোনও রেশই আমগ্রাম বা মাইজপাড়ার মতন গ্রামে পৌঁছয় না। ইংরিজিতে যাকে বলে ব্যাক অফ বিয়ন্ড, এইসব গ্রামগুলির সেই অবস্থা। বিদ্যুৎ কেউ চোখে দেখেনি, গ্রাম থেকে যারা শহরে আসে, তারা সুইচ টিপলে আলো জ্বলে আর কল খুললে জল বেরোয়, এই ব্যাপারগুলি ম্যাজিকের মতন মনে করে, তাদের বিস্ময়ের ঘোর কাটতে চায় না। ট্রানজিস্টার রেডিয়ো তখনও আবিষ্কৃত হয়েছে কি না জানি না, অন্তত ভারতে পৌঁছয়নি, খবরের কাগজও আসে না। সুতরাং বিহারে যখন সাঙ্ঘাতিক ভূমিকম্প হয়ে গেল, তখনও পূর্ব বাংলার গ্রামগুলি নিস্তরঙ্গ।

স্মরণকালের মধ্যে এমন মারাত্মক ভূমিকম্প হয়নি। মুঙ্গের ও মজফ্‌ফরপুর একেবারে বিধ্বস্ত, আরও অনেক গ্রাম ও ছোট শহর ধ্বংসস্তূপ, সরকারি এবং বেসরকারি হিসেবে প্রাণহানির সংখ্যায় যথারীতি অনেক ফারাক, তবু বহু সহস্র। প্রচণ্ড ধাক্কা লেগেছিল দার্জিলিঙ ও নেপালেও, নেপালের রাজ পরিবারের কয়েকজনও নিহত হয়।

গাঁধীজি সারা দেশে ঘুরে ঘুরে হরিজনদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করছেন। অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে একক, অহিংস যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছেন বলা যেতে পারে। কেউ তাঁকে মানপত্র দিলে সঙ্গে সঙ্গে সেটা নিলাম করে দিচ্ছেন প্রকাশ্যে। মহিলাদের বলছেন, গা থেকে গয়না খুলে দাও, মা- বোনেরা। তিনি বরাবরই স্বল্পভাজী, কোথাও তাঁকে খাতির করে মূল্যবান সুখাদ্য পরিবেশন করা হলে তিনি ধমকাচ্ছেন উদ্যোক্তাদের। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন ভিন্ন আহার প্রণালী, বাঙালি রান্নার সঙ্গে গুজরাতি রান্নার কোনও মিল নেই, যেমন মিল নেই দাক্ষিণাত্যের সঙ্গে পঞ্জাবের, এ জাতি একতাবদ্ধ হবে কী করে? এ চিন্তাও পীড়িত করে, তিনি সমস্ত ভারতীয়দের একই রকম খাদ্য অভ্যাস করবার জন্য নিজেই এক প্রকার অন্ন ব্যঞ্জনের পরামর্শ দিলেন, সে রান্নায় কোনওরকম ভাজাভুজি বা তেল-ঘি-মশলার স্থান নেই।

বিহারের ধ্বংসস্তূপ পরিদর্শনেও ছুটে এলেন গাঁধীজি, দুর্গতদের সাহায্য করার জন্য ডাক দিলেন দেশবাসীকে। কিন্তু তাঁর মাথায় সর্বক্ষণ ঘুরছে হরিজনদের কথা। তিনি মন্তব্য করে বসলেন, বিহারের এই দুর্বিপাক ও অস্পৃশ্যতার মধ্যে সম্পর্ক আছে, এটা ওই পাপের জন্য ভগবানের অভিশাপ! তাতে আবার অনেকের মনে হল, প্রকৃতির তাণ্ডবের সঙ্গে পাপ ও ভগবানকে জড়িয়ে গাঁধীজি প্রশ্রয় দিচ্ছেন কুসংস্কারের। অর্থদান করতে অবশ্য দেশবাসী সে সময় কার্পণ্য করেনি। এর মধ্যে একটি ঘটনা অতিশয় মর্মস্পর্শী। জিন্নাৎউন্নেসা নামে দক্ষিণ কলকাতার এক যুবতীর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করে মণীন্দ্রনাথ রায় নামে এক ব্যক্তি। তার নামে আদালতে নালিশ করে জিন্নাৎউন্নেসা। এইসব মামলায় উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে দুষ্কৃতকারীরা অনেক সময় ছাড়া পেয়ে যায়। তাই বিচারপতি যুবতীটিকে পরামর্শ দিলেন, আদালতের বাইরে কোনও শর্তে তোমরা মিটিয়ে ফেলতে পারো কি না, আগে চেষ্টা করে দেখো না! অন্যদের মধ্যস্থতায় জিন্নাৎউন্নেসা লোকটিকে ক্ষমা করতে রাজি হল এক শর্তে, ওই মণীন্দ্রকে চারশো টাকা চাঁদা দিতে হবে ভূমিকম্প ফান্ডে।

চিত্তরঞ্জন দাশের মৃত্যুর পর বাংলার রাজনৈতিক নেতৃত্বে খানিকটা শূন্যতা এসে গেছে। প্রধান নেতা সুভাষচন্দ্র বসু বেশ অসুস্থ, তিনি চিকিৎসার জন্য রয়েছেন ভিয়েনায়। তিয়াত্তর বছর বয়সেও রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতীর জন্য টাকা তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন অনলসভাবে। দেশীয় রাজ্য হায়দরাবাদে গিয়ে খানিকটা সফলও হলেন, নিজাম দিলেন এক লক্ষ টাকা, সেখানকার অন্যান্য ধনী ব্যক্তিরাও বাংলার এই বিদ্যালয়টির জন্য অর্থ দিলেন মুক্তহস্তে।

দেশের পরাধীনতা মোচনের জন্য যারা সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী, গাঁধীজির নেতৃত্বে কংগ্রেস যাদের সমর্থন করে না, ব্রিটিশ সরকার যাদের নাম দিয়েছে টেররিস্ট বা সন্ত্রাসবাদী, তাদের তেজ এই সময় একেবারেই হ্রাস পেতে বসেছে, প্রায় সকলেই ধরা পড়ে গেছে, পটাপট ফাঁসি হয়ে যাচ্ছে, কিংবা চালান হয়ে যাচ্ছে আন্দামানে। চট্টগ্রামে সূর্য সেনের ফাঁসি হয়ে গেল।

ভোর থেকেই কলকাতা শহরে লোক চলাচল শুরু হয়। দুধের বালতি হাতে গয়লা ও খবরের কাগজ হাতে হকারদের ছোটাছুটি থেকেই বাড়িগুলির দরজা-জানলা খোলে। পথচারীরা হকারদের থামিয়ে দু’পয়সা দিয়ে একটা কাগজ কেনে। আনন্দবাজার চোদ্দো পাতা, বিলিতি সংবাদপত্রের অনুকরণে প্রথম পৃষ্ঠায় কোনও খবর থাকে না, শুধু চৌকো চৌকো বিজ্ঞাপন। একজন কাগজ কিনলেই আর পাঁচজন পাশে দাঁড়িয়ে উঁকি মারে। সকলেরই আগ্রহ একই বিষয়ে, সবচেয়ে মুখরোচক অংশ এখন ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলার সুদীর্ঘ বিবরণ। পূর্ব বাংলার ভাওয়াল জমিদারির মেজকুমার অসুস্থ অবস্থায় মারা যান দার্জিলিঙে, আত্মীয়- পরিজনরা সেখানেই তাঁকে দাহ করে। অনেক বছর পরে এক সন্ন্যাসীবেশী ব্যক্তি দাবি করে যে সে-ই পুনর্জীবিত মেজকুমার। দার্জিলিঙে সেই রাত্রে খুব বৃষ্টি হয়েছিল, শ্মশানযাত্রীরা নাকি তাঁকে দাহ না করেই ফেলে পালিয়েছিল, এক সন্ন্যাসীর কৃপায় অলৌকিকভাবে সে সুস্থ হয়ে ওঠে। রানি বিভাবতী একেবারেই মানলেন না। তাঁর মতে লোকটি ফেরেববাজ ও জুয়াচোর। ওই লোকটিকে দেখলে বাঙালি বলে মনে হয় না, বাংলায় সে সঠিকভাবে নাম সই করতে পারে না, তার বাংলা উচ্চারণও অবাঙালিদের মতন। আসলে যে এটা বিষয়-সম্পত্তি ঘটিত কুটিল ষড়যন্ত্র, তা সাধারণ মানুষ বুঝতে চায় না, তারা রোমাঞ্চকর, ধারাবাহিক গল্পটিতেই আগ্রহী, এর মধ্যে কিছুটা যৌনতার গন্ধও আছে।

লেবং খেলার মাঠে গভর্নর অ্যান্ডারসনকে হত্যা-প্রচেষ্টার অভিযোগেও ধরা পড়েছে অনেকগুলি যুবক, তাদের মধ্যে রয়েছে উজ্জ্বলা মজুমদার নামে একটি তরুণী, সেই মামলাও চলছে দীর্ঘকাল ধরে। সংবাদপত্রের অর্ধ পৃষ্ঠা, কখনও পূর্ণ পৃষ্ঠা জুড়ে থাকে সাক্ষীদের জেরার বিবরণ। এরই মধ্যে এসে গেল পাকুড় হত্যা মামলা, তা আরও অত্যাশ্চর্য, বিলিতি রহস্যকাহিনীর মতন রোমহর্ষক, হাওড়া স্টেশনের জনারণ্যে প্লেগের জীবাণু ইঞ্জেকশান দিয়ে একজনকে খুন!

ওদিকে হিটলার দখল করে বসেছে জার্মানি, বিরুদ্ধপক্ষকে একেবারে নির্মূল করে ফেলার হুমকি দিচ্ছে। শুরু হয়ে গেছে ইহুদি-বিতাড়ন। নাতসিরা বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করেছে, তিনি স্বদেশ ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছেন আমেরিকায়। সেখানে শ্রমিক অসন্তোষ ও ধর্মঘট হচ্ছে মাঝেমাঝেই, অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো নয়। এর মধ্যে এসে পড়ছে দলে দলে শরণার্থী, ইহুদি। তাদের পুনর্বাসনে অর্থ সংগ্রহের জন্য কনসার্টে বেহালা বাজাচ্ছেন আইনস্টাইন, টিকিটের দাম পঁচাত্তর টাকা। বিজ্ঞানী হিসেবে আইনস্টাইন এদেশে তেমন পরিচিত নন, কিন্তু তাঁর বেহালা-বাদন শোনার জন্য অনেকেই আগ্রহী। সব টিকিট বিক্রি হয়ে যায়। এইসব সংবাদ ছাপা হয় খবরের কাগজের খুব ভেতরের পৃষ্ঠায়, স্বল্প পরিসরে।

সেপ্টেম্বর মাস, মাঝে মাঝেই বৃষ্টি আসে ঝেঁপে ঝেঁপে। আমগ্রামের মতন পল্লীগুলিতে জীবন বয়ে চলে সাদামাঠাভাবে। সূর্যকেন্দ্রিক জীবন, ভোর হতে না-হতেই সকলের ঘুম ভেঙে যায়, সন্ধ্যায় সূর্যাস্তের পর আর বিশেষ কিছু করার থাকে না। কুপি জ্বালালে আলোর চেয়ে ধোঁওয়া ছড়ায় বেশি, হারিকেনের শিখা একটু বাড়াতে গেলেই চিমনি ফেটে যায়। কাছাকাছি বাঁশঝাড়ে তুমুল শেয়ালের ডাক, অন্ধকারে বাড়ির বাইরেই কারও যেতে সাহস হয় না, সাপের উপদ্রব তো আছেই, সন্ধের পর সাপ কথাটা উচ্চারণ করতে নেই, শুনলেই তারা এসে পড়ে, তাই বলতে হয়, লতা, লতা, লতা।

ঋতু পরিবর্তন এখানে স্পষ্ট বোঝা যায়, মেঘের রং একটু একটু সাদা হতে শুরু করেছে, মাঝে মাঝে ঝিলিক দেয় নীলিমা। শিউলি গাছগুলিতে প্রচুর ফুল এসেছে, প্রত্যুষে গাছতলায় শিউলি ঝরে থাকে আলপনার মতন। জলা জায়গাগুলিতে হঠাৎ যেন জাদুবলে ফুটেছে অজস্র কাশফুল। মাঠগুলি আউস ধানে ভরা, কোথাও কোথাও বন্যা হয়েছে, তবে এবারে তেমন প্রবল নয়।

সম্পন্ন হিন্দু পরিবারগুলিতে শুরু হয়ে গেছে দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি। নৌকোয় চেপে কুমোররা আসে, বাড়িতেই হয় প্রতিমা-নির্মাণ, প্রথমে কঞ্চির কাঠামোর ওপরে খড়ের খসড়া, তারপর এক মেটে, দো মেটে ইত্যাদি। গ্রামের অনেক বাড়িরই কিছু কিছু মানুষ থাকে কলকাতায়, পূজা- অবকাশে তারা ফিরে আসবে, সঙ্গে আনবে অনেক জিনিসপত্র, তাতে শহুরে গন্ধ। নতুন শাড়ি- ধুতি, নতুন ডিজাইনের জামা, বিধবাদের জন্যও নতুন থান। লজেন্স ও চকোলেটের সঙ্গে ছোট ও বড় এলাচ নামের অপূর্ব দুর্লভ বস্তু।

সাত তারিখ সকালে যোড়শী মীরার প্রসববেদনা শুরু হল।

তখন ভারতের জনসংখ্যা ঠিক কত? বঙ্কিমচন্দ্র বন্দে মাতরম গানে বাংলায় সপ্ত কোটি কণ্ঠের কলকল নিনাদের কথা লিখেছেন। তখন জনসংখ্যা ও টাকা-পয়সার হিসেবে এক কোটি খুবই বেশি অঙ্ক, এক কোটি জনসংখ্যা বাড়তে বেশ কয়েক বছর সময় লাগত। পরবর্তীকালের একটি গান ছিল এই রকম : ‘তেত্রিশ কোটি মোরা নহি কভু ক্ষীণ, হতে পারি দীন, তবু নহি মোরা হীন, ভারতে জনম, পুনঃ আসিবে সুদিন, ঐ দেখ প্রভাত উদয়…’। সেই সাত তারিখ প্রভাতে আমগ্রামে ভারতের জনসংখ্যা আর একটি বৃদ্ধি পেল। মীরা ও কালীপদর প্রথম সন্তান।

জন্মালেই যে জীবিত থাকবে, তার কোনও স্থিরতা নেই। শিশুমৃত্যুর হার তখন খুবই বেশি। গণ্ডগ্রামে ডাক্তার-বদ্যি ডাকার তেমন সুবিধে নেই, পুরুষ ডাক্তার থাকলেও সন্তানসম্ভবা রমণীদের তাঁরা কোনও সাহায্যই করতে পারে না, সে দায়িত্ব নেয় ধাত্রী বা ধাই, তারা স্বাস্থ্য- বিজ্ঞান শেখে না, বংশানুক্রমিক অভিজ্ঞতাই সম্বল। শিশুদের মধ্যে রোগ সংক্রমণ ছিল অতি সাধারণ ব্যাপার।।

উঠোনে তৈরি হত অস্থায়ী আঁতুরঘর। প্রসূতি ও দাই ছাড়া সেখানে আর কারও প্রবেশ নিষেধ, নবজাতককে স্পর্শ করার আর কারও অধিকারও নেই। নিতান্তই দিদিমা শ্রেণীর কেউ দাইয়ের অনুপস্থিতির সময়টুকু সেবার ভার নিলে তিনি আসতেন স্নান করে, ধৌত বস্ত্রে শুদ্ধ হয়ে। এ সবই ছিল অভিজ্ঞতালব্ধ, গ্রাম্য স্বাস্থ্যবিধি। আঁতুরঘরটির চ্যাঁচার বেড়া, বৃষ্টির সময় ছাঁট আসে, তলা দিয়ে পোকা-মাকড়, এমনকী সাপও ঢুকে পড়তে পারে। আঁতুরঘরের দিনগুলিতে একটি শিশুর বেঁচে থাকাটাই আশ্চর্য ঘটনা। মীরার সন্তানটি এমনই জেদী, ঠিক বেঁচে গেল।

আমার ধাইয়ের নাম ছিল বোঁচার মা। বেশ গাঁট্টাগোঁট্টা, পুরুষালি চেহারা। এ বাড়ির পাশের একটি মস্ত জলাশয়ের ওপারে থাকতেন, আসতেন একাই নৌকা চালিয়ে। ছেলের নাম বোঁচা, তার নিজের নাকটিও খুব বোঁচা ছিল। চক্ষু উন্মীলনের পর সেই রমণীর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার নাকটিও বোঁচা হয়ে যায়। আমার মায়ের অমন সুন্দর টিকোলো নাক, কে বলবে আমি তাঁর সন্তান।

দুই

আমরা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে করতে এগোতে থাকি, আবার ভুলতে ভুলতে যাই। যেন গাছের পাতা ঝরা ও নতুন পাতা। উপমাটা অবশ্য সঠিক নয়, কারণ আমরা সব পুরনো পাতা ঝরিয়ে দিই না। কোনওটা রাখি, কোনওটা ফেলি, তার কোনও রীতি-পদ্ধতি আছে কি? স্মৃতির পৃষ্ঠাগুলি বড় রহস্যময়। শ্যামপুকুর স্ট্রিটের মোড়ে বসা একজন মুচির মুখ আমার স্পষ্ট মনে আছে, কিন্তু আমার এক পিসেমশাইয়ের মুখ আমি কিছুতেই মনে রাখতে পারি না। ‘রূপে তোমায় ভুলাবো না’ গানটি জীবনে প্রথমবার শোনার ক্ষণটি স্মৃতিতে চিরস্থায়ী হয়ে আছে, যদিও সে গানের মর্ম বোঝার বয়েস আমার হয়নি তখনও, তবু। অথচ কত প্রিয় গান হারিয়ে গেছে জীবন থেকে।

মানুষের মস্তিষ্কে দশ বিলিয়ান কোষ আছে, তার অর্ধেকও পূর্ণ হয় না এক জীবনে। এত ঘর খালি থাকতেও অন্যান্য ঘরের অনেক বাসিন্দাদের কেন আমরা বিদায় করে দিই? আসলে কিছুই নাকি হারায় না, স্মৃতিরও নানান স্তর আছে, সব কিছুই আমাদের মনে থাকে, কিন্তু মনে পড়ে না। বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর আড়াই বছর বয়সের স্মৃতির কথাও লিখেছেন। বিট জেনারেশানের প্রসিদ্ধ ঔপন্যাসিক জ্যাক কেরুয়াক আমাকে বলেছিলেন, এক বিশেষ প্রক্রিয়ায় তাঁর মাতৃগর্ভে অবস্থানের স্মৃতিও ফিরিয়ে আনতে পেরেছিলেন। সত্য-মিথ্যা জানি না।

আমার বাল্যস্মৃতি বড়ই এলোমেলো। সাল-তারিখের ঠিক-ঠিকানা নেই। কখনও দেখতে পাই একটি ইজের পরা বালক শহরের গলিতে ছুটছে কোনও ভোঁ-কাট্টা ঘুড়ি ধরার জন্য, কখনও দেখি, পুকুরের জলে দাপাদাপি করছে একটি ন্যাংটো শিশু। এখন গ্রামের ছেলেরাও হাফ প্যান্ট পরে, আমাদের ছেলেবেলায় গরিব বাড়ির ছেলেরা পরত ইজের, সেটা হাঁটু পর্যন্ত হাফ- পাজামার মতন, রঙিন। ইজের শব্দটি এসেছে আরবি ইজারা থেকে। আগরতলায় ইজেরের খুব সুনাম ছিল। ইজেরের মতন একটা সামান্য বস্তু কেন আগরতলাতেই সার্থকতা পাবে, তা কে জানে! যেমন শুনতাম, বাঁদিপোতার গামছা খুব টেকসই হয়। বাঁদিপোতা জায়গাটা কোথায়, আজও জানি না।

এক হিসেবে আমি সৌভাগ্যবান, আমার বাল্য-কৈশোরকাল শহর ও গ্রাম, দু’ জায়গাতেই কেটেছে। একেবারে খাস বাঙাল বাড়ির ছেলে হয়েও আমি পাঠশালার বয়েস থেকেই কলকাতার ঘটি-ভাষা বলতে পারি, আবার গ্রামে গিয়েই সহ-খেলুড়েদের সঙ্গে ঝগড়া করেছি চোস্ত্‌ বাঙাল ভাষায়। ট্রেন থেকে শিয়ালদা স্টেশনে নেমেই খেয়েচি-বলেচি, আর ওদিকে স্ট্রিমার থেকে নেমে খাইসি-বলসি! কলকাতার শান বাঁধানো পথে আছাড় খেয়ে আমার মাথা ফেটেছে, আবার গ্রামের আদিগন্ত পাটখেতের মধ্য দিয়ে ছুটতে ছুটতে আমি চলে গেছি সূর্যাস্তের দিকে।

উত্তর কলকাতায় টাউন স্কুলে বাবার চাকরি, সেই স্কুলের এক-দেড় মাইল পরিধির মধ্যে বিভিন্ন ভাড়াবাড়িতে আমরা থেকেছি। মসজিদ বাড়ি স্ট্রিট, রামধন মিত্র লেন, তেলিপাড়া লেন, দুর্গাদাস মুখার্জি স্ট্রিট, বৃন্দাবন পাল লেন, এইসব রাস্তায় বারবার কেন বাড়ি বদল করতে হয়েছে, তা ঠিক জানি না। দেশ বিভাগের আগে পর্যন্ত কলকাতায় ভাড়াটেদের বেশ খাতির ছিল, অনেক খালি বাড়িতে ঝুলত ‘টু লেট’ লেখা বোর্ড, খুব সম্ভবত আমাদের ভাই-বোনের সংখ্যা যত বেড়েছে, ততই বাবাকে আরও সস্তার ফ্ল্যাট খুঁজতে হয়েছে, সবই একতলায়। উত্তর কলকাতার পল্লীগুলি ঘিঞ্জি, অধিকাংশ বাড়িই গায়ে গায়ে লাগা, একতলার ঘরগুলিতে আলোবাতাস খেলে না, কোনও বাড়িতেই নিজস্ব কোনও বারান্দা ছিল না আমাদের। অবশ্য ছাদ ব্যবহার করা যেত, সেই ছাদে উঠে দেখতে হত আকাশ। গরমকালে ছাদেই শুতাম মাদুর পেতে, চিত হয়ে ঘুম আসবার ঠিক আগের মুহূর্তে হারিয়ে যেতাম গ্রহ-নক্ষত্রপুঞ্জে।

কলকাতায় জুতো পরা, গ্রামে খালি পা। বাটা কোম্পানির নটিবয় শু, সামনের দিকটা ভোঁতা মতন, দেয়ালে লাথি মারলেও ছেঁড়ে না। গ্রামে গিয়ে আমি জুতো লুকিয়ে রাখতাম। সেখানকার বয়স্করাও শুধু কোনও নেমন্তন্ন বাড়িতে যাবার সময় জুতো পরে। সবই তো কাঁচা রাস্তা, বছরের আট মাসই জলকাদা। সেই জন্যই ঢাকার কুট্টিদের চালু রসিকতা ছিল, জুতোর দোকানে খদ্দের গেলে তাকে জিজ্ঞেস করা হত, বাবুর বগলের মাপ কী! গ্রামে ছুটোছুটি করার সময় কখনও কাঁটা ফুটেছে বা শামুকের ভাঙা খোলে পা কেটেছে ঠিকই, তবু আমার ধারণা, খালি পায়ে হাঁটলে অনেক দিন চোখ ভাল থাকে। গ্রামে চশমা একটা বিলাসিতা। অথচ শহরে আমার সঙ্গী অনেক স্কুল-পড়ুয়ার চোখে চশমা দেখেছি। আমার চোখ বরাবরই ভালো, বেশি ভালো, অনেক দূর থেকে বাসের নম্বর বলে দিতে পারি, তাই বন্ধুরা বারবার বিস্ময় প্রকাশ করেছে। প্রায় সিকি মাইল দূরের কোনও সাইনবোর্ড পড়ে দেবার পরীক্ষাও নিয়েছে, আমি বলে দিয়েছি গড় গড় করে, তারা কাছে গিয়ে মিলিয়ে দেখেছে।

শহর ও গ্রামের তফাতের প্রসঙ্গে মনে পড়ে চিল ও শকুনের কথা। কলকাতা শহর চিল- প্রধান। এক সময় কলকাতা হাড়গিলে নামে শকুন জাতীয় বড় বড় পাখিতে ভর্তি ছিল। আমরা হাড়গিলে দেখিনি, তারা নিঃশেষ হয়ে গেছে। শকুন দেখা যায় মফস্বলে ও গ্রামে। শকুনের বিশ্রী ও ভয়াবহ চেহারা হলেও তারা নিরীহ ও অলস, শিকার করতে জানে না, মৃত প্রাণীই তাদের আহার্য, সুতরাং শকুনকে ভয় পাবার কোনও কারণ নেই। কিন্তু চিলের উপদ্রবে যে কতবার চোখের জল ফেলেছি, তার ঠিক নেই। আমাদের খুব প্রিয় খাদ্য ছিল রাধাবল্লভী। যেমন বাহারি নাম, তেমনই অপূর্ব স্বাদ, কচুরি বা লুচির দ্বিগুণ আকারের, বেশ দামি, চার পয়সায় দুটো, অবশ্য সঙ্গে আলুর তরকারি কিংবা হালুয়া ফ্রি। দোকান থেকে শালপাতার ঠোঙায় দিত, কোথা থেকে যমদূতের মতন এসে ছোঁ মারত চিলে। অধিকাংশ সময়ই তারা নিতে পারত না, ঠোঙাটা হাত থেকে ছিটকে যেত, রাধাবল্লভীতে লাগত রাস্তার ধুলো। যেন ফেলে দেওয়াতেই চিলগুলোর আনন্দ। আমি রাগে-অভিমানে ফুঁসছি, রাধাবল্লভী কুড়িয়ে নিয়ে যেত ফুটপাথের কাঙালি ছেলেরা। ওরা ধুলো মাখা খাবার খেয়েও দিব্যি বেঁচে থাকে।

প্রসঙ্গত মনে পড়ে, একবার কাশীতে গিয়ে টানা মাসকয়েক ছিলাম। একদিন ছাদে দাঁড়িয়ে একটা কলা খাচ্ছি, হঠাৎ যেন কিষ্কিন্ধা থেকে এক লাফে একটা গোদা বাঁদর এসে পড়ল আমার ঘাড়ে। কলাটা তো কেড়ে নিলই, সপাটে এক থাপ্পড় কষাল আমার গালে থাপ্পড়টা কেন মেরেছিল, আজও বুঝি না। বাঁদড়ের থাপ্পড় কি কখনও ভোলা যায়?

‘ছিপ নিয়ে গেল কোলা ব্যাঙে, মাছ নিয়ে গেল চিলে!’ মাইজপাড়া গ্রামে মাছ ধরা শিখেছিলাম, বেশ নেশাই ধরে গিয়েছিল। পুকুর-খাল-বিলের তো অভাব নেই, মাছও প্রচুর। প্রত্যেক পল্লীতেই একটি পুকুর বিশেষ যত্নে পরিচ্ছন্ন রাখা হত। সেটার নাম মিষ্টি পুকুর। তাতে গোরু-মোষ নামবে না, সেই পুকুরের জলই একমাত্র পানীয়। টিউবওয়েল কেউ দেখেনি, জল ফুটিয়ে খাবার কথাও কেউ জানে না। ওই মিষ্টি পুকুরটায় প্রচুর পুঁটি মাছ ও ছোট ছোট ট্যাংরা, ছিপ ফেললেই চটাস চটাস করে মাছ ওঠে, কারও কারও মাছ ধরার হাত বেশ ভালো হয়, কেউ শত চেষ্টাতেও ঠিক পারে না। পাশাপাশি দু’জন ছিপ ফেলেছে, একজন পটাপট মাছ তুলছে, আর একজন চেয়ে থাকছে হতাশভাবে। আমার হাত মন্দ ছিল না, অন্য একটা পুকুরে একবার একটা বেশ বড় কালবোস মাছ ধরে যেন লটারিতে প্রথম পুরস্কার জেতার আনন্দ পেয়েছিলাম। রুই ও কাতলার মাঝামাঝি এই প্রজাতির মাছ খুব সুলভ নয়, স্বাদ অপূর্ব। আমার ছিপ কোনও দিন কোলাব্যাঙে নেয়নি, মাছও নেয়নি চিলে। তবে, একবার খুব নাকানিচোবানি খেয়েছিলাম বটে। বঁড়শিতে মাছ গেঁথেছে, ফাতনা ডুবে গেছে, মেরেছি জোরে টান, অথচ কিছুই ওঠে না। ছিপ বেঁকে গেছে, কিন্তু কুলোচ্ছে না আমার গায়ের জোরে। খুব বড় মাছ হতে পারে না, তা হলে তো সুতো ছিঁড়ে যেত। তবে, এটা কোন্ রহস্যময় প্রাণী? টানের চোটে আমি হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেলাম জলে, তবু কিন্তু ছিপ ছাড়ছি না। আশপাশ থেকে দু’তিন জন ছুটে এসে জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল। সম্মিলিত শক্তিতে টেনে তোলার পর দেখা গেল, সেটা একটা বান মাছ। বান মাছ সরু আর অনেকটা লম্বা হয় বলে, জলের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে স্ক্রু-র মতন হয়ে যায়, তাই টেনে তোলা অত শক্ত।

মাছ ধরে বাড়ি ফেরার পর খুব ভাল করে হাত-পা ধোওয়া নিয়ম। যে ছেলে ওই নিয়ম মানে না, সে নির্ঘাত সে-রাতে বিছানায় হিসি করবে। ঠিকই তাই, এই বালকটিও যে-কয়েকবার ওই নিয়মে ফাঁকি দিয়েছে, সেই সেই রাতে সে বিছানা ভিজিয়েছে।

মাছ ধরার পাট চুকিয়ে দিতে হয় বিকেল থাকতে থাকতে। সন্ধে হয়ে গেলেই বিপদ। সন্ধের পর পেত্নীতে মাছ কেড়ে নিতে পারে। অনেক লোক অন্ধকারে বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে মাছের খালুই হাতে আসতে আসতে শুনতে পেয়েছে পেত্নীর গলা, মাঁছ দেঁ, মাঁছ দেঁ। তখন তারা খালুই ফেলে ছুটে পালায়। বাঁশঝাড় পেত্নীদের খুব প্রিয় জায়গা। দিনের বেলাতেও বাঁশঝাড়ের পাশ দিয়ে যেতে হলে দৌড় লাগাতাম আমরা। আমাদের গ্রামে প্রচুর সাপ, শেয়াল, ভূত, পেত্নী, ব্রহ্মদৈত্য ছিল। আমাদের বাড়ির ঠিক পাশের দিকে আর একটা বাড়ি ছিল, বহুদিন পরিত্যক্ত, দরজা-জানলা ভাঙা, আমাদের দূর সম্পর্কের কোনও জ্যাঠামশাইয়ের। তার নাম জানি না। কেউ কেউ বলত, ‘মরা গোরু কি ঘাস খায় জ্যাঠামশাই’! তিনি প্রবাসে চাকরি করতে গিয়েছিলেন, হিল্লি-দিল্লিতে কোথাও, সেখান থেকে প্রচুর আধুনিক ও উদ্ভট চিন্তা নিয়ে ফিরে আসেন। তিনি নিজের বাবার শ্রাদ্ধে পিণ্ডদানে অস্বীকার করেছিলেন, যুক্তি হিসেবে বলেছিলেন, মৃত আত্মাকে খাবার-দাবার দেওয়া হবে কেন, মরা গোরু কি ঘাস খায়? সবাই তা নিয়ে খুব হাসাহাসি করত, নিজের বাবার সঙ্গে গোরুর তুলনা! যাই হোক, তিনিও অনেকদিন আগে দেহরক্ষা করেছেন, ও বংশে আর কেউ নেই। লোকে ধরে নিয়েছে, তিনি নাস্তিক ছিলেন, নাস্তিকের আত্মা পরলোকে ঠাঁই পায় না। সুতরাং তিনি অবশ্যই ব্ৰহ্মদৈত্য হয়েছেন। ওই ফাঁকা বাড়িটার একটা তালগাছের গোড়ায় এক এক দিন গভীর রাত্রে কীসের যেন একটা বিকট আওয়াজ উঠত। সেটা কি ব্রহ্মদৈত্যের হুংকার? তাতে আমাদের অবশ্য ভয়ের কোনও কারণ ছিল না, আমরা তো আত্মীয়, আমাদের কোনও ক্ষতি করবেন না তিনি। বরং এ কথাও বলা যায় যে, পাশেই ওই ব্ৰহ্মদৈত্যের পাহারা ছিল বলে আমাদের বাড়িতে কখনও অন্য কোনও ভূত- পেত্নীর উপদ্রব হয়নি।

আমাকে নিয়ে একবার বাড়ির লোকরা খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। সন্ধেবেলা বাড়ির ঠিক সামনেই দেখি একটা বেশ লম্বা সাপ। তখন আমার ছ’ সাত বছর বয়েস, অবোধের মতন ভয়- ডর ঠিক জন্মায়নি, কাছেই বেড়ার গায়ে গোঁজা ছিল একটা কাটারি (ওখানে বলে দা কিংবা দাও, হিন্দির মতন), সেটা নিয়েই দিলাম এক কোপ। তাতে সাপটার লেজের দিকে খানিকটা অংশ কেটে গেল, বাকি অংশটা পালাল কিলবিলিয়ে। ঘটনাটা শুনে বাড়ির সকলের মুখে দুশ্চিন্তার ছায়া। সাপ অতিশয় প্রতিহিংসাপরায়ণ, ওই কাটা সাপটা কখনও না কখনও ফিরে এসে কামড়াবেই আমাকে। (এখন অবশ্য জানি, সাপ খুবই বোকা প্রাণী, তার স্মৃতিশক্তি বলে কিছু নেই।) কয়েকটা দিন আমাকে রাখা হল অতি সাবধানে, তারপর চালান করে দেওয়া হল কলকাতায়।

ভূতপেত্নী কিন্তু শুধু গ্রামেরই একচেটিয়া নয়। তখন কলকাতাতেও অনেক পরিত্যক্ত বাড়ি, হানাবাড়ি, ভূতের বাড়ি ছিল। প্রতি পল্লীতেই একটি, দুটি। কোনও কোনও দুঃসাহসিক ব্যক্তি সে রকম ভূতুড়ে বাড়িতে রাত কাটাতে গিয়ে ফিরে আসতেন নাকাল হয়ে। আমাদের এক মাস্টারমশাই একবার সে-রকম অভিযানে গিয়েছিলেন, ভূতের দেখা তিনি পেয়েছিলেন, গলা মটকে দেয়নি বটে, কিন্তু সারা গায়ে আঁচড়ে দিয়েছিল। অনেকদিন স্নান না করলে সারা গায়ে খড়ি ওঠে, চুলকোলে সাদা দাগ হয়, সেই দাগ তিনি দেখিয়েছিলেন সবাইকে। ভূতে তাঁর গা চুলকোতে গেল কেন কে জানে!

এ রকম আরও অনেক গল্প শুনেছি, যা সত্য ঘটনা হিসেবেই চালু ছিল। অনেকদিন পর্যন্ত আমার খুব শখ ছিল অন্তত একটা ভূত দেখার, সে শখ মেটেনি। দেশ বিভাগের পর উদ্বাস্তুদের প্রবল জনস্রোত এসে কলকাতা শহরের সব ভূত তাড়িয়ে দেয়। কোনও বাড়িই আর ফাঁকা থাকেনি। পোড়োবাড়িগুলোর রাতারাতি রূপ বদলেছে।

গ্রামে যেমন সাঁতার ও মাছ ধরা, কলকাতায় তেমনই ঘুড়ি ওড়ানোর নেশা। রাস্তা দিয়ে চলার সময়ও চোখ আকাশের দিকে, ঘুড়ির প্যাঁচ খেলা চলছে, দেখতে তো হবেই, তা দেখতে গিয়ে কতবার গাড়ি চাপা পড়তে পড়তে বেঁচে যাওয়া। তারপর কাটা ঘুড়ি ধরার জন্য-দৌড়োনো। হঠাৎ যেন মাটি ফুঁড়ে উঠে আসে আরও কিছু বালক, তাদের মধ্যে যে বেশি লম্বা সেই ঘুড়িটি পায়, কেউ কেউ আঁকশি নিয়েও আসে। আমি ঘুড়ির পেছনে বহুবার দৌড়েছি, কখনও পাইনি। ঘুড়ি ওড়াবার জন্যও কিছুদিন শিক্ষানবিশি করতে হয়, হতে হয় দাদাশ্রেণীর কারও খিদমদগার। ধরাই দেওয়া, লাটাই গোটানো, ছেঁড়া ঘুড়িতে তাপ্পি মারা। এ সব শিখলে নিজের হাতে উড়ান ঘুড়ির সুতো ধরবার অধিকার। ঘুড়ির বিভিন্ন সাইজ, আধ-তে, এক-তে, দেড়-তে, দো-তে। এই ‘তে’ কোন শব্দের ভগ্নাংশ তা কখনও খেয়াল করিনি। বাচ্চাদের পক্ষে আধ-তে ঘুড়িই উপযুক্ত, বড় ঘুড়ির টান বেশি। শুধু বর্ষার কয়েক মাস বাদ দিলে সারা বছরই বিকেলের আকাশ জুড়ে থাকত নানা বর্ণ ও আকারের ঘুড়ি, ‘রঙের কোলাহল’ও বলা যেতে পারে। উত্তর কলকাতার আকাশ, দক্ষিণ কলকাতার কথা তখন কিছুই জানি না।

গ্রে স্ট্রিট-দুর্গাদাস মুখার্জি স্ট্রিটের বাড়িতে যখন থাকতাম, কাছেই ছিল রায়বাড়ি। পুরনো বনেদি বাড়িগুলির অন্যতম, মস্ত বড় লোহার গেট, ভেতরের প্রশস্ত প্রাঙ্গণে কয়েকটি ওয়েলার ঘোড়া, সে বাড়ির কর্তা-গিন্নিরা জুড়ি গাড়িতে বেরোতেন। গত শতাব্দীর বাবু-কালচারের কিছু কিছু রেশ এই শতাব্দীতেও বেশ কয়েক দশক রয়ে গিয়েছিল। বিভিন্ন বাড়িতে পায়রা পোষা ও পায়রা ওড়ানো ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। মোটর গাড়ির চেয়ে জুড়ি গাড়িটির কদর ছিল বেশি, সাধারণ লোকেও ট্যাক্সির বদলে ভাড়া ঘোড়ার গাড়িই ব্যবহার করত সবসময়।পূর্ববঙ্গ থেকে ট্রেনে শিয়ালদা স্টেশনে গেলে আমরা ঘোড়াগাড়ি ভাড়া করেই বাড়ি পৌঁছোতাম। ট্যাক্সি চাপার অধিকার হয় অনেক পরে। রাস্তার ধারে ধারে ঘোড়াকে জল পান করাবার জন্য লম্বা লম্বা লোহার চৌবাচ্চা থাকত। প্রাসাদতুল্য বাড়িগুলির তখনও ঝুরঝুরে অবস্থা হয়নি, অনেক বাড়ির সঙ্গেই সুসজ্জিত বাগান, তাতে ফোয়ারা এবং নগ্ন পরির মর্মর মূর্তি। ঘুড়ি ওড়ানোটাও ছিল বিলাসিতার পর্যায়ে, তবে দরিদ্ররাও এতে অংশ নিতে পারত। বাগবাজারের বোসদের বাড়ির সামনের বিরাট মাঠে হত ঘুড়ি-উৎসব, ময়দানেও হত ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতিযোগিতা। পাড়ায় পাড়ায় ঘুড়ির দোকান, ফড়েপুকুরের নাজির সাহেবের দোকান ছিল বিখ্যাত, সেখানে কত রকমের বাহারি ঘুড়ি, নাজির সাহেবের মাঞ্জাও ছিল অকাট্য। আমি সে দোকানের সামনে দিয়ে সতৃষ্ণ নয়নে অনেকবার ঘোরাফেরা করেছি, কখনও কিছু কিনতে পারিনি।

প্রাগুক্ত রায়বাড়ির ঘুড়ি ওড়ানোর খুবই বিশেষত্ব ছিল। এ ব্যাপারে তাঁরা ছিলেন সে পাড়ার দারুণ প্রতাপশালী রাজা। অন্যরা এক এক দিন এক এক রকম ঘুড়ি ওড়ায়, কিন্তু রায়বাড়ির সব ঘুড়িই সারা বছরই এক, বিশেষ অর্ডার দিয়ে তৈরি করানো বোঝাই যায়। দেড়-তে কালো চাঁদিয়াল। প্রথমে তাদের ঘুড়ি অনেক ওপরে উঠে যায়, তারপর বাজপাখির মতন শোঁ শোঁ করে নেমে আসে, এক একটা ঘুড়ির ওপর পড়ে আর কচাৎ কচাৎ করে কেটে দেয়। আকাশে কালো চাঁদিয়াল দেখলেই আমরা চুনো-পুঁটি ঘুড়ি ভয়ে ভয়ে নামিয়ে নিই। যারা স্পর্ধাভরে তখনও ওড়ায় কালো চাঁদিয়াল তাদের নির্মূল করে দেয়। রায়বাড়ির ছেলেরা সব ফর্সা ফর্সা, সুগঠিত চেহারা, গলায় সোনার মবচেন পরে, এক একটা ঘুড়ি কেটে তারা বিজয়গর্বে সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে, ভোম্মারা! অনেক পয়সাকড়ি আছে বলে তাদের হুংকারও বেশ জোরালো।

সন্ধের আগে রাজ্য জয় করার মতন কালো চাঁদিয়াল আকাশে একাধিপত্য করে। তারপর একটি বিচিত্র ব্যাপার হয়। অন্য কেউ কাটতে না পারলেও রায়বাড়ির ছেলেরা সেই বিজয়ী কালো চাঁদিয়ালকে আর ফেরত নেয় না। অনেক ওপরে তুলে সুতো ছিঁড়ে দেয়। সেটা ভাসতে ভাসতে চলে যায় নিরুদ্দেশে। ওই দৃশ্যটাই আমাকে উদ্দীপিত করত সবচেয়ে বেশি, শুরু হত কল্পনার খেলা। ওই ঘুড়ি কোথায় যায়? আমি কোনওদিন কালো চাঁদিয়াল ধরতে পারিনি, কিন্তু অনেক দূরে কোনও বাড়ির ছাদে আমারই মতন কেউ দাঁড়িয়ে আছে, সে ধরে ফেলবে ওই ঘুড়ির সুতো, কেমন হাস্যোজ্জ্বল হবে তার মুখ! কালো চাঁদিয়াল ছাড়াও কোনও কোনও প্রাক সন্ধ্যায় আবছা আকাশে প্রায় মেঘ ছুঁয়ে কোনও ঘুড়িকে দুলতে দুলতে উড়ে যেতে দেখেছি, সেদিকে তাকিয়ে কেমন যেন একটা রহস্যের শিরশিরানি অনুভব করতাম শরীরে। ওরা আমায় অ-দেখা জগতের একটুখানি ইঙ্গিত দিয়ে যেত।

ঘুড়ি ওড়াবার অত শখ থাকলেও সামর্থ্য ছিল খুবই কম। একটা ঘুড়ি কেটে গেলে আর একটা কেনার পয়সা পাব কোথায়? অনেক বিকেলেই ঘুড়িবিহীন হয়ে শুধু ঘাড় ব্যথা করে দেখতাম অন্যদের প্যাঁচ খেলা। আমাদের ছাদটা নিচু, সেখান থেকে কাটা ঘুড়ি ধরার সম্ভাবনা খুবই কম। পয়সার বড় টানাটানি। আমার দরিদ্র স্কুল শিক্ষক বাবা প্রাণপণে, অতি পরিশ্রমে আমাদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা করতেন ঠিকই, কিন্তু অতিরিক্ত কিছু ব্যয় করার প্রশ্নই ছিল না। মাঝে মাঝে মায়ের কাছে খুব কাকুতি-মিনতি করে দু’-চার পয়সা আদায় করতাম। তখন লোকে কথায় কথায় বলত, কলকাতা শহরের পথে পথে পয়সা ছড়ানো থাকে। এটা আংশিকভাবে আক্ষরিক সত্য ছিল। ধনী পরিবারের কেউ মারা গেলে তার শবযাত্রায় যেমন একদল লোক পিছনে পিছনে হরি বোল ধ্বনি দিত, তেমনই সেই দলের একজন ধামা থেকে মুঠো মুঠো খই ছড়িয়ে ছড়িয়ে যেত, তার মধ্যে খুচরো পয়সা। যত বেশি বড়লোক, তত পয়সাও বেশি। সেই পয়সা কুড়োবার জন্য হন্যে হয়ে পড়ত একদল বাচ্চা ছেলেমেয়ে। ফুটপাথের যারা স্থায়ী বাসিন্দা, তাদের বলে কাঙালি, বস্তির বাচ্চারা তাদের চেয়ে একটু উঁচুতে, এই দু’দলেরই অধিকার ছিল পয়সা কুড়োবার। আমরা তো ভদ্রলোকের বাড়ির ছেলে, আমাদের ওসব করতে নেই। লোভ যে হত না তা নয়, রাস্তা দিয়ে সে রকম কোনও শবযাত্রার মিছিল যাচ্ছে, গড়ানো পয়সাগুলোর দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে থেকেছি, অন্য ছেলেরা এসে টপাটপ কুড়িয়ে নিয়েছে। কোনও কাঙালি ছেলের হাতে এক মুঠো পয়সা দেখে কী যে ঈর্ষা হত! কিন্তু জ্ঞান-উন্মেষের পর থেকেই জানতাম, কাঙালি বা বস্তির ছেলেদের চেয়ে আমরা আলাদা, আমাদের দু’বেলা খাওয়া জুটুক বা না-জুটুক, পরিষ্কার জামা পরে রাস্তায় বেরোতে হবে। কাঙালিদের মতন শবযাত্রায় পয়সা কুড়োলে, চেনাশুনো কেউ দেখলে বাড়িতে বলে দেবেই, তারপর গুরুজনদের কেউ মেরে পিঠের চামড়া তুলে দেবে। বাঙাল পরিবারগুলিতে ছেলেমেয়েদের মারধর করার বেশ প্রচলন ছিল। পরিবারের যিনি অধিপতি, তিনি বাইরে যতই অসহায় বা ক্ষুদ্র জীবিকাশ্রয়ী হোন না কেন, বাড়ির মধ্যে খুদে হিটলার।

একদিন গ্রে স্ট্রিট ও হরি ঘোষ স্ট্রিটের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি, খুব বড় একটা শব-মিছিল যাচ্ছে, মস্ত বড় পালঙ্কে শায়িত মৃতদেহটি ফুলে ফুলে ঢাকা, অনুগামী অনেকেই বেশ সম্ভ্রান্ত চেহারা, মৃত ব্যক্তিটি কেউকেটা ছিলেন বোঝা যায়, আতরের গন্ধ ভুর ভুর করছে, শুভ্র বসন পরা এক ব্রাহ্মণ ছড়াচ্ছেন খই ও পয়সা, যথারীতি কাঙালি ও বস্তির ছেলেরা হুড়োহুড়ি করে কুড়াচ্ছে পয়সা। শব-মিছিলটি চলে গেল রাজা নবকৃষ্ণ স্ট্রিটে, হঠাৎ আমার চোখে পড়ল, রাস্তার পাশের ময়লা জলে চকচক করছে সাদা মতন কী যেন… একটা সিকি? কাঙালিরা ওটা দেখতে পায়নি। গা ঝিমঝিম করে উঠল। এ রকম একটা সিকি দেখে উপেক্ষা করে চলে যাওয়া কারও পক্ষে সম্ভব? এক সিকিতে অন্তত আটখানা ঘুড়ি, যোলো খানা বেগুনি, চার খানা আইসক্রিম, অন্তত পাঁচটা বুড়ির মাথার পাকা চুল, পাঁচটা খাতা, আরও কত কী। এদিক ওদিক তাকিয়ে টপ করে তুলে নিলাম সিকিটা।

যত দূর মনে পড়ে, আমার জীবনে সেটাই প্রথম স্বাধীন উপার্জন।

শবযাত্রায় খই ও পয়সা ছড়ানোর তাৎপর্য কী ছিল আমি ঠিক জানি না। এই প্রথাটি এখন প্রায় উঠেই গেছে, সেটা ঠিক হয়নি। এখনও তো কাঙালি ও বস্তির ছেলেরা একই রকম রয়েছে। ভদ্রলোক সাজা হতদরিদ্রদের সংখ্যাও কিছু কম পড়েনি।

বছরে দু’বার, প্রায় দেড় মাস-দু’-মাসের জন্য যেতাম গ্রামে। গ্রীষ্মের ছুটিতে আমাদের নিজেদের বাড়ি মাইজপাড়া, সেখানকার দিনগুলি প্রায় বৈচিত্র্যহীন, কোনও উৎসব ছিল না। পুজোর ছুটিতে যেতাম আমগ্রামে, মায়ের মামাবাড়িতে। মাইজপাড়ায় আমাদের পল্লীর ধারেকাছে পুজোর আয়োজন ছিল না, আর আমগ্রামে গাঙ্গুলিদের বাড়িতেই খুব ধুমধাম করে হত দুর্গাপুজো। সেখানে সবার জন্যই আগ্রহ ও ব্যকুলতা ছিল খুব বেশি। ভাদ্র মাস শেষ হতে না হতেই দিন গোনা শুরু হত।

শিয়ালদা থেকে ট্রেনে সারা রাত যাত্রার পর খুলনা। সেখান থেকে ভোর ভোর স্টিমারে চাপা, (আমরা বলতাম ইস্টিমার, সেটাই বেশি শ্রুতিমধুর) আমরা ডেকের যাত্রী, অন্যদের সঙ্গে ঠেলাঠেলি করে বসতে হত পোঁটলা-পুটলি নিয়ে। অনেকের কাছেই গোলাপফুল আঁকা টিনের সুটকেস। রেলিং-এর পাশে জায়গা পেলে যে-কোনও বালকের জীবন ধন্য হয়ে যাবে। সারা দিন নদীর দিকে চোখ, ঘন ঘন নব নব আবিষ্কার। যখন-তখন জল থেকে মাথা তুলছে শুশুক, ঠিক যেন মনে হয় কোনও মানুষ, মাছ ধরা নৌকোর জালে ধরা পড়ছে ইলিশ মাছ, এখানে চিলগুলোর রঙ লালচে কেন, ওগুলো শঙ্খচিল, মাঝে মাঝে মধ্য নদীর চরায় পোড়া কাঠের মতন কী পড়ে আছে, হঠাৎ যেন নড়ে উঠল মনে হয়, স্টিমার কাছে যেতেই সেগুলো সরসরিয়ে নেমে গেল জলে, কুমির! কুমির!

চরমুগুরিয়া বা ফতেপুরে নামতে হয় স্টিমার থেকে। তারপর নৌকো। অর্থাৎ কলকাতা থেকে সেই গ্রামে পৌঁছতে যানবাহন লাগে তিন রকম। নৌকো এসে ভেড়ে একেবারে বাড়ির পাশের পুকুরঘাটে। পুকুরে যাত্রী নৌকো ঢোকে কী করে? পুকুরের একটা পাশ কাটা থাকে, তাকে বলে ‘যান’, সেটা বন্ধ রাখা হয়, আবার খোলা যায়। সেখানে একটা সরু খালের সঙ্গে বড় খাল কিংবা নদীর যোগাযোগ।

পর পর নৌকোয় আসে প্রবাসীরা। আমার মায়ের অনেক মামা ও মাসি, তাঁদের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনী যে-যেখানেই থাকুক, দুর্গাপুজোর সময় এ বাড়িতে এসে মিলিত হবেই। বিশাল যৌথ পরিবার। পুজোর আয়োজনও খুব ব্যাপক। আটচালার পাশে স্থায়ী পূজামণ্ডপ, কুমোরের দল ঘুরে ঘুরে এসে সেখানেই প্রতিমা বানায়। প্রধান কুমোরের নাম জলধর, বেঁটেখাটো, শ্যামলা রঙের, স্বল্পবাক, তাকে দেখলেই মনে হয়, সে অন্যদের থেকে আলাদা। সে একজন শিল্পী। প্রতিমা নির্মাণের শেষপর্বে চক্ষুদানের সময় তার শিল্পীসত্তাটি বিশেষভাবে বোঝা যায়। এই পর্যায়ে মণ্ডপটি কাপড় দিয়ে ঘিরে রাখা হয়, অন্যদের প্রবেশ নিষেধ, কারণ এই সময় মূর্তিগুলি সম্পূর্ণাঙ্গ এবং উলঙ্গ। তা দেখতে নেই। কিন্তু ছোট ছেলেমেয়েরা উঁকিঝুঁকি মারবেই। তখনও নগ্নতা সম্পর্কে কৌতূহল বা লজ্জাবোধ জাগেনি। দুর্গা প্রতিমার চোখ দুটি আঁকার আগে জলধর বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে সামনে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন ধ্যানমগ্ন, তারপর জাপানিরা যেমনভাবে হাইকু রচনা করে, সেইভাবেই সে হঠাৎ তুলির একটানে নিখুঁত দুটি চক্ষু সৃষ্টি করে। হয়তো একেই বলে প্রেরণা। যে-কোনও জায়গায় দাঁড়ালেই মনে হয় দুর্গাঠাকুর ঠিক আমারই দিকে তাকিয়ে আছেন।

চারদিন ধরে অবিরাম উৎসব, প্রচুর জনসমাগম, ঢাকের বাজনা, দুই ঢাকীর প্রতিযোগিতা, অত বড় ঢাক কাঁধে নিয়ে তাদের কী লাফালাফি! এবং গণভোজ। হিন্দু ও মুসলমানদের ধর্মীয় রীতিনীতির কী তফাত, সে বোধ তো তখন ছিল না। মুসলমানদের চেনা যেত তাঁদের পোশাকের কিছুটা তফাত কিংবা দাড়ি দেখে। অনেক মুসলমানও এই উৎসবে যোগ দিতে আসতেন এবং বসতেন পঙক্তি ভোজনে। শেষ পাতে কে কটা রসগোল্লা খেতে পারে, এক একজন দিব্যি পঁচিশ-তিরিশটা উড়িয়ে দিতেন।

সপ্তমী থেকে নবমী, এই তিন দিনে চারটি পাঁঠা বলি, দশমীর দিন লাউ-চালকুমড়ো, আখ ইত্যাদি নিরীহ বস্তুর ওপর কোপ। অনেক আগে থেকে কুচকুচে কালো রঙের পাঁঠা কিনে আনতে হয়, তাদের গায়ে একটু সাদা ছোপ থাকলেই অচল। স্নান করিয়ে পরীক্ষা করে দেখতে হয় কোথাও সাদা ছোপের ওপর কালো রং করে দিয়েছে কি না বিক্রেতা। বাড়ির ছোটদের ওপর ভার পড়ত সেই পাঁঠাগুলোকে রোজ ভালো করে ঘাস খাইয়ে নধর করে তোলার। যত নধর হবে, ততই মাংস বাড়বে। পাঁঠাদের ঘাসভর্তি মাঠে নিয়ে চরানো খুব সোজা, ওরা পালাতে জানে না। হাঁড়িকাঠে মাথা দেওয়া কিংবা কসাইয়ের ছুরিই ওদের নিয়তি। গল্প আছে, এক সাহসী ও অভিমানী পাঁঠা সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার কাছে গিয়ে অনুযোগ করেছিল, প্রভু, আর সব জীব-জন্তু, পশু-প্রাণীরই স্বাভাবিক মৃত্যু আছে, শুধু আমাদেরই কেন গলা কেটে মরার বিধান দিয়েছেন? ব্রহ্মা বলেছিলেন, তুমি সরে যাও, শিগগিরই সরে যাও, তোমাকে দেখে আমারই জিভে জল আসছে! অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছিলেন যে, পাখি হিসেবে মুরগি দেখতে খুব সুন্দর, লাল ঝুঁটি মাথায় একটা মোরগ কী দৃপ্ত ভঙ্গিতে দাঁড়ায়, কিন্তু মানুষ অন্যান্য অনেক পাখির রূপের তারিফ করলেও মোরগ-মুরগি দেখলেই খাবার কথা ভাবে!

মানুষ আমিষাশী প্রাণী। কিছু মানুষ সাত্ত্বিক, নিরামিষাশী হলেও বিশ্বের জনসংখ্যার অধিকাংশই মাংসলোলুপ। পছন্দের মাংসের জন্য প্রাণীহত্যা চলবেই, কিন্তু তার সঙ্গে ধর্মের দোহাই জুড়তে হবে কেন? দুর্গাপুজো, কালীপুজোয় পাঁঠা বলি, মোষ বলি অতি বীভৎস প্রথা। মুসলমানরাও গোরু ও উট কোরবানি দেয়। এসব যে ধর্মেরই অপমান, তা কি এত যুগ ধরেও মানুষ বোঝে না?

পাঁঠা-চরানোর কাজটা আমার বেশ পছন্দ ছিল। বেশ রাখাল রাখাল ভাব, শুধু হাতে বাঁশিটাই নেই, এই যা। পুকুর ধারে, জঙ্গলে, মাঠে ওদের নিয়ে ঘুরে বেড়াতাম, একটা করে নামও দিতাম। পাঁঠারা ঘাসের চেয়েও ধান গাছ খাওয়া বেশি পছন্দ করে। ধান গাছের পাতা যে প্রায় ব্লেডের মতন ধারালো হয়, তা শহরের ছেলেরা কি জানে? এক গোছা ধানপাতা টেনে ছিঁড়তে গিয়ে আমার হাতের তালু চিরে রক্ত বেরিয়ে গিয়েছিল। মাঠে-ঘাটে ঘুরে বেড়াবার একটা প্রধান স্বাচ্ছন্দ্য ছিল, পয়সার কোনও চিন্তা থাকত না, শহরে যেমন সব সময় এটা কেনা, সেটা কেনা কিংবা কিনতে না পারার দুঃখ, গ্রামে কেনার কিছুই নেই। নানান রকম ফলের গাছ, গাব কিংবা ডউয়ার মতন ফল শহরে দেখাই যায় না। প্রত্যেক গাব গাছে লাল ওল্লা থাকবেই। হঠাৎ জঙ্গলে কুড়িয়ে পাওয়া যায় হরীতকী, আমলকী গাছ ধরে ঝাঁকালে টুপটাপ খসে পড়ে পাকা আমলকী, সেগুলি মুখে দেবার পর জল খেলে কী মিষ্টি লাগে!

পাঁঠা বলি দিতেন মায়ের ছোটমামা, তাঁর নাম অমূল্যরতন, বিশাল দেহী, কলকাতায় তিনি রেল কোম্পানির অফিসার, গ্রামে তিনি শক্তিশালী পুরুষ হিসেবেই প্রসিদ্ধ। অন্য সময় তিনি স্নেহপ্রবণ ও নরম স্বভাবের, কিন্তু মস্ত বড় একটা খাঁড়া হাতে নিয়ে দাঁড়ালে তাকে বেশ ভয়ঙ্করই দেখাত। সপ্তমীর দিন প্রথম পাঁঠাটিকে পুকুরে চুবিয়ে আনা হত, গলায় পরানো হত গাঁদা ফুলের মালা। তারপর তাকে হাঁড়িকাঠে ফেলে, কয়েকজন মিলে এক দিকে তার মাথা, আর এক দিকে তার শরীরটা জোরে টেনে রাখা হত, তাতে তার গলাটা এমন সরু হয়ে যেত যে তা দু’ভাগ করার জন্য বেশি গায়ের জোর লাগার কথা নয়। পাঁঠাটার মৃত্যু-আর্তনাদ ঢেকে দেওয়া হত প্রবল শব্দে ঢাক-ঢোলকাঁসি বাজিয়ে, কোপ পড়ার পর ফিনকি দিয়ে রক্ত ছিটকে এসে লাগত অনেকের গায়ে। এক কোপে কাটতে না পারলে নাকি অকল্যাণ হয়। মায়ের ছোটমামা কোনওবারই তাতে বিফল হননি, আমরা ছোটরা দিব্যি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম ও হাততালি দিতাম।

কয়েক বছর পর আমি বদলে গেলাম। একটা পাঁঠাকে স্নান করিয়ে টেনে আনা হচ্ছে, তারপর হাঁড়িকাঠে মাথা দিয়ে সেটা ব্যাঁ ব্যাঁ করে করুণ চিৎকার করছে, হঠাৎ আমার গলার কাছে বাষ্প আটকে গেল, জ্বালা করতে লাগল চোখ। এ তো নিছক একটা পাঁঠা নয়, প্রায় পনেরো-কুড়ি দিন ধরে আমি ওকে ঘাস-পাতা খাইয়েছি, আমার পোষা হয়ে গেছে, আমি ওর নাম দিয়েছি ছোট্টু, সেই নাম ধরে ডাকলে আমার মুখের দিকে তাকায়, সেই ছোট্টকে এখন কেটে ফেলবে? তখনই দলের মধ্যে থেকে একটি বালক, নতুন জামা-পরা, এক পা দু’পা করে পিছিয়ে লাগাল দৌড়। পুকুরধার দিয়ে দৌড়ে, ধোপাপাড়ার কাছে এসে একটা গাছতলায় বসে কাঁদতে লাগল ফুপিয়ে। অন্যরা তো কেউ সরে গেল না, সে কাঁদছে বলে তার লজ্জাও হচ্ছে, না কেঁদেও পারছে না। সম্ভবত সেইদিন থেকেই তার পিউবার্টির শুরু। যৌনচেতনা না জাগলে মানুষ যেমন অন্য কারও জন্য চুম্বকটান অনুভব করে না, তেমনই অন্য কারও জন্য চোখের জলও আসে না।

তিন

দূর থেকেই দেখা গেল, স্কুলের সামনের রাস্তায় জটলা বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে ছেলেরা। আজ আর ক্লাস হবে না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মারা গেছেন, সবাই দেখতে যাবে।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কে? তিনি বিশ্বকবি। বিশ্বকবি মানে কী? জানি না। সাত বছর বয়েস, ক্লাস টু-এর ছাত্র। ‘আমাদের ছোট নদী চলে আকে বাঁকে/বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে’, পাঠ্য বইতে পড়েছি, পাঠ্য বইতে আরও অনেক কবিতা থাকে, সেগুলি যাঁরা লিখেছেন, তাঁরা বেঁচে আছেন না মরে গেছেন, তাও তো জানি না, তবে প্রাইজ ডিস্ট্রিবিউশনের দিন অনেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করে, সকলেই আগে বলে নেয়, বিশ্বকবি। এ বছরেই একটি উঁচু ক্লাসের ছেলে ওই দিনে ‘পঞ্চ নদীর তীরে, বেণী পাকাইয়া শিরে, দেখিতে দেখিতে গুরুর মন্ত্রে জাগিয়া উঠিল শিখ’ আবৃত্তি করার সময় মাথার ওপর আঙুল ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বেণী পাকানো দেখিয়ে দিচ্ছিল, আমরা বাচ্চাদের দল তা দেখে খিল খিল করে হেসে উঠেছিলাম, হেডমাস্টারমশাই চোখ পাকিয়ে তর্জনী তুলে ধমক দিয়েছিলেন, সাইলেন্স, সাইলেন্স!

আমাদের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিষয়ে কারুকে আলোচনা করতে শুনিনি। বরং, কয়েক মাস আগেই সুভাষচন্দ্র বসু নামে একজন সাহেব-পুলিশদের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে গেছেন, তিনি সাহেবদের সঙ্গে লড়াই করবেন, সেইসব কথা শুনতাম, পাড়ার লোকরা ওই নামটি উচ্চারণ করত ফিসফিসিয়ে, সভয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে, সেই জন্য ওঁর সম্পর্কে খুব কৌতূহল ছিল।

ছুটি পেয়ে অনেক ছাত্র বাড়ি চলে গেল, কিছু ছাত্র সারিবদ্ধ হয়ে চলল বিবেকানন্দ রোডের দিকে, আমিও কী করে যেন জুড়ে গেলাম সেই মিছিলে। পথে গাড়িঘোড়া নেই। শুধুই মানুষ। বিবেকানন্দ রোড এমনই জম-জমাট যে তার পেছনে দাঁড়িয়ে আমাদের মতন ক্ষুদ্রাকৃতি মানবকদের কিছুই দেখা সম্ভব নয়। বিবেকানন্দ রোডে কোনও একটি ছাত্রের আত্মীয়ের বাড়ি, সবাই হুড়মুড় করে উঠে গেলাম সেই বাড়ির ছাদে। সে রাস্তার সব বাড়িরই ছাদ ও বারান্দা মানুষে মানুষে ছয়লাপ।

বেশ কিছুক্ষণ প্রতীক্ষার পর দেখা গেল, সমুদ্রের ঢেউয়ের মতন এগিয়ে আসছে মানুষ, একটা খাট শুধু ফুলে ভরা, সেটা যেন জনতার মাথার ওপর দিয়ে দুলতে দুলতে চলে যাচ্ছে, সব বাড়ি থেকে আরও ফুল ছোঁড়া হচ্ছে সেই খাট লক্ষ্য করে।

রবীন্দ্রনাথের মরদেহের শেষ যাত্রার বিস্তৃত বর্ণনা আমার লেখা উচিত নয়। সত্যিই কি সেই দিনটির কথা আমার মনে আছে? পরে ওই দিনের বর্ণনা কতবার পড়েছি, ছবি দেখেছি অবনীন্দ্রনাথের আঁকা, অরোরা ফিল্ম কোম্পানি মিছিলের একটি তথ্যচিত্র তুলেছিল, সেটাও দেখার সুযোগ ঘটেছে, সেইসব মিলিয়ে মিশিয়ে আমার লুপ্ত স্মৃতির মধ্যে আমি কি ঢুকিয়ে দিয়েছি একটি চিত্র? অনেক সময় চার-পাঁচ বছর বয়েসের কোনও দৃশ্য যেন হুবহু দেখতে পাই। আসলে তা মা-মাসিদের কাছে গল্প শুনে শুনে পরবর্তী নির্মাণ। এই স্মৃতি সিনথেটিক। সেই বাইশে শ্রাবণে একটি সাত বছরের বালকের পক্ষে একজন অচেনা মানুষের মৃতদেহ দেখার জন্য ব্যাকুল হওয়া মোটেই স্বাভাবিক নয়। অন্যদের সঙ্গে বিবেকানন্দ রোডের এক বাড়ির ছাদ থেকে উঁকি মেরেছিলাম ঠিকই, কিন্তু এমনও হতে পারে, এত দেরি হচ্ছে কেন ভেবে অস্থির হয়েছি, কখন শেষ হবে, কখন পাড়ায় ফিরে গিয়ে খেলাধুলো করব, এই চিন্তাই প্রধান ছিল।

রবীন্দ্রনাথকে চিনতে এবং তাঁর রচনায় মগ্ন হতে আমার আরও পাঁচ-ছ’ বছর সময় লেগেছে। তারও অনেক পরে ভেবেছি, রবীন্দ্রনাথ সঠিক সময়েই এই মর্ত্যধাম থেকে প্রস্থান করেছেন। আরও বেঁচে থাকলে তাঁকে বড় বেশি মর্মযাতনা ভোগ করতে হত। আজীবন যিনি সুন্দরের পূজারী, তিনি কি সহ্য করতে পারতেন, তাঁর প্রিয় এই শহর, তাঁর ভালোবাসার এই সোনার বাংলা, এমনকী গোটা দুনিয়াটারই নরকে পরিণত হওয়ার বাস্তবতা? ‘সভ্যতার সংকট’ তিনি আঁচ পেয়েছিলেন, টের পেয়েছিলেন, ‘নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস,’ কিন্ত তারও পরবর্তী মানবতার বিপর্যয় সম্ভবত তাঁরও কল্পনার অতীত ছিল।

রবীন্দ্রনাথ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শুরুটা দেখে গেছেন, তখনও তা ইউরোপে সীমাবদ্ধ। অচিরকালের মধ্যেই তা দাবানলের মতন ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয়দের কাছে এ এক কিম্ভুত যুদ্ধ। পরাধীন দেশ, সে আবার কার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে, তার কোনও পক্ষ বা বিপক্ষও থাকার কথা নয়। কিন্তু শাসকশ্রেণী ভারতকেও যুদ্ধে জড়িয়ে নিল, কারণ এত বড় উপনিবেশটির সম্পদ যুদ্ধের কাজে লাগাতে হবে। ভারতীয় সৈনিকদের রণক্ষেত্রে পাঠাতে হবে কামানের খাদ্য হিসেবে।

আমেরিকার যুদ্ধে যোগদান ও জাপান সিঙ্গাপুর দখল করার পর কলকাতাতেও সাজ সাজ রব পড়ে যায়। পূর্ব রণাঙ্গনে জাপানিদের হাতে খুব মার খাচ্ছে ইংরেজরা, হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে কলোনিগুলো। রেঙ্গুন পতনের পর মনে হল জাপানিরা এসে গেছে একেবারে ভারতের দোরগোড়ায়, এরপর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর কলকাতা দখলের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়বে। ইংরেজদের সাহায্য করবার জন্য এসে গেছে আমেরিকান বাহিনী, শহরের পথে পথে অনবরত সামরিক গাড়ি ছুটছে। রেড রোডকে রানওয়ে বানিয়ে সেখান থেকে উড়ছে বিমান। সন্ধের পর সারা শহর প্রায় নিস্প্রদীপ, রাস্তার গ্যাসের আলোয় পরানো হয়েছে ঠুলি, সাধারণ নাগরিকরা বাড়ির মধ্যে বাতি জ্বাললেও জানলা খুলতে পারবে না, যখন তখন বিকট শব্দে বেজে উঠছে বিপদসঙ্কেত জানাবার জন্য সাইরেনের মহড়া। ফাঁকা মাঠ আর পার্কগুলিতে কাটা হয়েছে ট্রেঞ্চ, রাস্তার যেখানে সেখানে গাঁথা হয়েছে নতুন পাঁচিল। গোলাগুলি থেকে বাঁচবার জন্য যেগুলিকে বলে ব্যাফল ওয়াল, বাঙালিরা ঠাট্টা করে বলত, বিফল প্রাচীর।

যুদ্ধে অনেক কিছুই বদলায়। সব চেয়ে বেশি বদলায় মূল্যবোধ। প্রশাসনের দৃষ্টি অন্য দিকে থাকে বলে সেই সুযোগ নিয়ে কিছু কিছু মানুষের অবদমিত লোভ, হিংসা, কাম প্রবৃত্তি প্যান্ডোরার বাক্সের ভয়ঙ্কর পতঙ্গগুলির মতন বেরিয়ে আসে৷ খাদ্য, বস্ত্রের মজুতে যখন টান পড়ে, তখন শুরু হয় কালোবাজার। নারীদেহেরও বাজার তৈরি হয়। সৈনিকদের মনোরঞ্জনের জন্য রমণী সরবরাহ সব যুদ্ধেরই অঙ্গ। তাদের প্রকাশ্য বেলেল্লাপনা দেখলেও সরকার মুখ ফিরিয়ে থাকে। কলকাতা শহরে বারাঙ্গনার সংখ্যা কম নয়, তাতেও প্রয়োজন মেটেনি। অর্থের লোভে অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারের সুন্দরী কন্যারা প্রকাশ্যে টমিদের কণ্ঠলগ্না হয়েছে। সমাজ তখন অদৃশ্য। তবে সব সৈনিকই যে শুধু নারী-সম্ভোগের জন্য উন্মত্ত, তা বলা যায় না। বহু দূরে ফেলে আসা স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের জন্যও অনেকের মন কেমন করত, প্রকাশ পেত বাৎসল্যের। ট্রেনের জানলায় বসা কোনও সৈনিকের ব্যথাময় মুখও দেখা যেত, অনুগ্রহ ভিখারি বাচ্চা ছেলেমেয়েদের প্রতি এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। খুলনা স্টেশনে একজন সৈন্য ট্রেন থেকে আমার দিকে একটা চকোলেটবার ছুঁড়ে দিয়েছিল।

রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরের বছর শীতকালে একদিন জাপানিরা কলকাতায় হঠাৎ বোমা ফেলে গেল। ঠিক আক্রমণ বলা যায় না। কেমন যেন অন্যমনস্কভাব। যেন বিমানে চেপে আকাশে বেড়াতে বেড়াতে কলকাতা পর্যন্ত চলে এসে জাপানিরা ভাবল, দু’একটা বোমা ফেলে একটু ভয় দেখানো যাক না! তাতেই শুধু ভয় নয়, দারুণ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল শহরে। এতদিন যুদ্ধ চলছিল দূরে দূরে, এবার বুঝি কলকাতা শহর ধ্বংস হয়ে গেল। প্রায় দুশো বছর আগে সেই যে সিরাজউদ্দোল্লা কলকাতার দিকে কামান দেগেছিল, তারপর থেকে তো আর কলকাতার ওপর কোনও আক্রমণ হয়নি! দিশেহারার মতন নাগরিকরা পালাতে লাগল শহর ছেড়ে, যে সব পরিবারের সঙ্গতি আছে, তারা আশ্রয় নিল মধুপুর, দেওঘর, ঘাটশিলার মতন স্বাস্থ্যকর জায়গায়, অন্যরা পালাল গ্রামে-গঞ্জে। শহর প্রায় ফাঁকা।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অন্যতম শিকার আমার বাবা। স্কুল কলেজ বন্ধ হয়ে গেল অনির্দিষ্টকালের জন্য, বে-সরকারি স্কুলে ছাত্রদের মাইনে থেকেই শিক্ষকদের বেতন হয়। স্কুল বন্ধ, বাবা বেকার হয়ে গেলেন, তখন আর সংসার চালাবেন কী করে, আমাদের পাঠিয়ে দিলেন গ্রামের বাড়িতে।

সেবারে আমি মাইজপাড়া গ্রামের বীরমোহন বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। টিনের চালের ঘর, বেশ পরিচ্ছন্ন, পেছন দিকে টলটলে জলের সুন্দর একটা বড় দিঘি। স্কুলটি আমাদের বাড়ি থেকে অনেকটা দূরে, হেঁটে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। হাঁটতে ভালোই লাগে, শুধু একটা বিশাল অশ্বখ গাছতলায় শ্মশান, সেখান দিয়ে চোখ বুজে যাই, হঠাৎ হঠাৎ সে গাছের কোটর থেকে ডেকে ওঠে তক্ষক সাপ৷ সে সাপকে কখনও চোখে দেখা যায় না। তবু ডাক শুনলেই ছমছম করে বুক। আর একটি বাড়ি, সেটিও গাঙ্গুলিবাড়ি। কিন্তু তাঁরা খুব ধনী, অনেকখানি জায়গা নিয়ে তাঁদের প্রাসাদোপম হর্ম্য, শুনেছি তাঁদের বন্দুক আছে, এবং আছে একটি বিলিতি কুকুর, আমরা বলতাম ডালকুত্তা, তার গম্ভীর ঘেউ ঘেউ শুনলে রক্ত হিম হয়ে যায়। সে বাড়ির গেটের সামনেটা পার হতাম দৌড়ে।

টাউন স্কুলে আমাদের কোনও মুসলমান সহপাঠী ছিল না। গ্রামের স্কুলে হিন্দু-মুসলমান মিশ্র ছাত্র। হেডমাস্টার লস্কর সাহেবকে মনে হত চলন্ত পর্বত, কিন্তু তাঁর ব্যবহার ছিল নরম, তাঁর এক ছেলে হেডমাস্টার-পুত্র হওয়ার যোগ্যতায় বেশ অহংকারী ধরনের। প্রথম প্রথম আমি ছিলাম অন্যদের কাছে কৌতূহলের সামগ্রী। আমার গায়ে শহুরে গন্ধ, আমার মতন চেন লাগানো গেঞ্জি অন্যরা আগে দেখেনি। আমার একটি মাউথ অর্গান ছিল। সেটাও অনেকের কাছে অভিনব। ওই মাউথ অর্গানটি কিছুদিন পরে একটা উঁচু ক্লাসের ছেলে কেড়ে নেয়।

উচু ক্লাসের ছেলেদের জন্মগত অধিকার আছে মাঝে মাঝে ছোটদের চড়-চাপড় মারার। এ নিয়ে নালিশ জানানো আরও বিপজ্জনক। অর্থাৎ র‍্যাগিং সব জায়গাতেই চলে। উঁচু ক্লাসের একটি ষণ্ডামার্কা ছেলে নাদুসনুদুস চেহারার ছোট ছেলেদের গলা জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করত, এই তুই আমার রানি হবি? রানি হওয়া কাকে বলে তখন বুঝতাম না। আমাকে অবশ্য কারুর রানি হতে হয়নি কখনও।

স্কুলে যেতাম গরম গরম ফেনাভাত খেয়ে। ঢেঁকি ছাঁটা লাল চালের ফেনাভাত, অপূর্ব তার স্বাদ, ঘি জোটার প্রশ্ন নেই। ঘি খায় আমগ্রামের মামাবাড়ির ছেলেমেয়েরা, তাতে কী। আলুসেদ্ধ আর পুঁটি মাছ ভাজা, চমৎকার! তবে, যতই সুখাদ্য হোক, দিনের পর দিন তা কি মুখরোচক হতে পারে? কয়েক মাস পরে, শুধু সকালে নয়, প্রতিদিন অন্য বেলাতেও ফেনাভাত।

গ্রামে যুদ্ধের কোনও রেশ নেই, কামান-বন্দুকের শব্দ দূরে থাক, এখানকার আকাশ দিয়ে কোনও বিমানও উড়ে যায় না। তবু যুদ্ধের ধাক্কা লাগে এই নিস্তরঙ্গ গ্রামগুলিতে। প্রথম আঘাত হানে রান্নাঘরে।

আমরা আর যুদ্ধের খবর কী জানি! শহরের তুলনায় গ্রাম্য জীবন অনেক স্বাধীন। কলকাতায় বাড়ি থেকে একা একা বেশি দূরে যাওয়া নিষেধ ছিল। পথ হারাবার ভয়, গাড়ি চাপা পড়ার ভয়। গাড়ি মানে, ট্রাম-বাস-মোটর গাড়ি, ঘোড়ার গাড়ি, গোরুর গাড়ি। প্রথম তিন প্রকার গাড়ি চাপা পড়লে নির্ঘাত মৃত্যু, ঘোড়ার গাড়ি চাপা পড়লে প্রাণটা না গেলেও দারুণ জখম হবার সম্ভাবনা, আর গোরুর গাড়িতে কেউ চাপা পড়লে তাকে কলকাতা থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়, সে শহরে বাস করার যোগ্য নয়। গ্রামে কোনও বাধাবন্ধন নেই, যেখানে খুশি টো টো করে ঘুরে বেড়ানো যায়। বর্ষা এসে গেছে, এখন চতুর্দিকে জল, ধানের খেতগুলিও বিল হয়ে গেছে, রাস্তা এখন নদী। আমি কবে যে সাঁতার শিখেছি, তাই-ই মনে নেই। মানুষ ছাড়া আর কোনও প্রাণীই জলে ডোবে না, গোরু-মোষ, এমনকী হাতিও জন্ম থেকে সাঁতরাতে পারে, মানুষের মাথা তার শরীরের অনুপাতে বেশি ভারী, সহজে ডুবে যেতে চায়, তাই মাথাটাকে জলের ওপর তুলে রাখার জন্য সাঁতার শিখতে হয়। গ্রামে সাঁতার শেখার পদ্ধতিটি অতি সরল। মাসি, পিসি কিংবা দিদি স্থানীয়রা বাচ্চা ছেলেমেয়েদের হাসতে হাসতে পুকুরের জলে ছুঁড়ে দেয়। শিশুটি ভয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে হাত-পা দাপায়, তারপর একটু একটু করে ডুবতে থাকে, একেবারে ডুবলে ওই নারীগণের কেউ জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে কোলে তুলে আনে। শিশুটির কান্না থামতে না-থামতেই আবার জলের মধ্যে ঝপাস। এই রকম প্রতিদিন চার-পাঁচবার, এবং চার-পাঁচদিন পরেই বাচ্চাটা কান্নার বদলে খলখল করে হাসে, হাঁসের মতন ভাসতে শিখে যায়। তারপর যার যার নিজের কৃতিত্ব।

আমি ডুবসাঁতারে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছিলাম। এক ডুবে যেতে পারতাম অনেক দূর। ডুব দিয়েছি, আর উঠছি না, উঠছিই না, অন্য সবাই উদ্বিগ্ন, সেটাই একটা মজা। ডুব দিয়ে আবার উল্টো দিকে ফিরে এসে ঘাটের কাছে অর্ধনিমগ্ন কারুর উরুতে চিমটি কেটে দেওয়া ছিল একটা প্রিয় খেলা। আর একটা প্রতিযোগিতা ছিল, মাঝপুকুরে গিয়ে এক ডুবে তলার মাটি তুলে আনা। অচেনা পুষ্করিণীতে এটা খুব বিপজ্জনকও হতে পারে। এক একবার ডুব দিয়ে তলিয়ে যাবার পর মনে হত, বুক ফেটে যাবে, আর দমে কুলোবে না, ওপরে ফেরা হবে না, কোনও রকমে আকুপাকু করে ভুস করে জলের ওপর মাথা তোলার পর মনে হত, পুনর্জীবন হল।

সাঁতার শেখার পরেই নৌকো চালানোর যোগ্যতা অর্জন করতে হয়। যে সাঁতার জানে না, তার বৈঠা কিংবা লগি হাতে নেওয়ার অনুমতি মেলে না। নৌকো বলতে যা বোঝায় তা আমাদের নিজস্ব ছিল না, কিন্তু কয়েকটা কলাগাছ একসঙ্গে বেঁধে নিলে হয় ভেলা, তা নিয়ে দিব্যি চলাচল করা যায়। জলপথে, এমনকী শুধুমাত্র একটা তালগাছের খোল দিয়েও বানানো হয় ডোঙা। ওই ভেলা বা ডোঙা উল্টে যেতে পারে যখন তখন, ওই দুটিতেই আমার প্রথম বৈঠা চালানোর শিক্ষা।

কখনও সখনও অন্যের নৌকোয় জায়গা পেয়ে মাদারিপুর পর্যন্ত ঘুরে আসা ছিল দারুণ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। এ যেন গণ্ডি পেরিয়ে যাওয়া, বৃত্তটা আরও বিস্তারিত হওয়া। যাওয়ার পথে একটি গ্রামের নাম ধুয়াসার। সে গ্রামটির কথা একটি বিশেষ কারণে মনে আছে। যে নৌকো চালাচ্ছিল, সে ওই গ্রামের একটি বাড়ির সামনে একজন মহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অকারণে সেখানে নৌকো ভিড়িয়ে বলল, মাসিমা, আমাগো খুব তেষ্টা পাইছে, এট্টু জল খাওয়াবেন?

মহিলাটি আমাদের অপেক্ষা করতে বলে বাড়ির ভেতর থেকে নিয়ে এলেন সোনার মতন উজ্জ্বল একটি কাঁসার ঘটি, (একটু বড় ধরনের ঘটিকে বলা হত ‘আকফোরা’) একটি কাঁসার গেলাস এবং একটি রেকাবিতে কিছু মিষ্টি। আমাদের কারুরই জলতেষ্টা পায়নি, তবু খেলাম ওই মিষ্টিগুলোর লোভে, ওগুলোর নাম তক্তি, খাঁটি ক্ষীর ও নারকোল দিয়ে তৈরি, কলকাতায় যাকে বলে বরফি। কী অপূর্ব তার স্বাদ! আবার নৌকো ছাড়ার পর সবাই হাসতে লাগল। জল খেতে চাইলে কোনও বাড়িতেই আপত্তি করে না, অতিথিকে জল না-দেওয়াটা পাপ, অনেক বাড়িতে শুধু জল দেয় না, সঙ্গে কিছু না-কিছু মিষ্টি দিতে হয়, আর কিছু না থাকলে অন্তত কয়েকটা বাতাসা। নৌকোর ছেলেরা ধুয়াসার গ্রামের সেই বাড়িটার নাম দিয়েছিল ‘তক্তি বাড়ি’, যাওয়া- আসার পথে যে-কোনও সময় ওখানে থামলেই বিনা পয়সায় মিষ্টি খাওয়া যায়।

মাদারিপুর একটি গঞ্জ, অনেক দোকানপাট, অনেক খদ্দের ও ব্যাপারি। পাশের নদীটার নাম আড়িয়াল খাঁ। কলকাতায় পাশে গঙ্গা কতবার দেখেছি, আরও কত নদী পার হয়ে আসতে হয় এখানে, তবু আড়িয়াল খাঁ-ই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয়। নামটার মধ্যেই বিশেষ দার্ঢ্য রয়েছে। আগে মনে করতাম, এ নদী বুঝি কোনও ডাকাতের নামে, পরে শুনেছি কোনও ফকিরের। বর্ষার সময় আড়িয়াল খাঁর রূপ কোনও লুঠেরার মতনই দুর্দান্ত, ঢেউ যেন ফুঁসছে, অনবরত পাড় ভাঙছে। নদী যেন কামড়ে কামড়ে খেয়ে নিচ্ছে তটরেখা। এক একটা গাছ উল্টে যাচ্ছে শিকড় সমেত। সে দৃশ্য অন্যদের কাছে ভয়ঙ্কর, কিন্তু একটি বালকের চোখে মোহময়।

নদীতে জাল ফেলে ধরা হচ্ছে ইলিশ মাছ। যেসব মাছের গায়ের রং একেবারে সাদা, তারা সূর্যের আলো সহ্য করতে পারে না। জল থেকে তোলার পরই মারা যায়, তাই জ্যান্ত ইলিশ সচরাচর কেউ দেখতে পায় না। আমরা জালে-ওঠা ইলিশ দু’একবার মাত্র লাফাতে দেখেছি।

এক একটা নৌকো ঘাটে এসে ভিড়লেই ক্রেতারা এসে ভিড় জমায়। ওজন-টোজনের কোনও বালাই নেই, মাছের আকার অনুযায়ী দাম। ক্রেতার তুলনায় মাছ অনেক বেশি, তাই বেশ দরাদরি চলে। একবার আমার কাকা দু’আনা (বারো পয়সা) দিয়ে একটা প্রায় দু’ কিলো সাইজের ইলিশ কিনলেন। দলটির মধ্যে আমিই সর্বকনিষ্ঠ, একজন জেলের হঠাৎ কী খেয়াল হল, একটা ছোট ইলিশ (ছ’সাতশো গ্রাম) আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, এটা দা ঠাউরের জইন্যি মাগনা দিলাম। দা ঠাউর অর্থাৎ দাদাঠাকুর, আমাদের মতন উচ্চবর্ণের বালকদের নিম্নবর্ণের লোকেরা এই নামে সম্বোধন করত। কেন ওই জেলেটি আমাকে দাম না নিয়ে একটি মাছ দিল? অত ছোট মাছ বিক্রি হবার সম্ভাবনা নেই বলে? কিংবা, আমার বয়েসি তার কোনও ছেলে আছে, যার মুখখানি আমারই মতন, হয়তো সে ছেলেটি বেঁচে নেই, কিংবা সে ভেবেছে যে তার মৃত সন্তানটিই আবার বামুনের ঘরে জন্মেছে…। তখন অবশ্য এসব কথা ভাবিনি, পরবর্তীকালের চিন্তা। রোদে পোড়া তামাটে মুখ, রুখু দাড়ি, জ্বলজ্বলে চোখ, সেই খর্বকায় জেলেটির কথা আমার পরিষ্কার মনে আছে।

বর্ষাকালে এমনি এমনি মাছ পাওয়া অভাবনীয় কিছু ছিল না। কোনও এক রহস্যময় কারণে আকাশে মেঘ ডাকলে কই মাছ জল ছেড়ে ডাঙায় উঠে আসে। অন্য কোনও মাছের এই স্বভাব নেই, শুধু কই মাছেরই কেন মেঘ গর্জনের সঙ্গে সম্পর্ক, তা কে জানে! পুকুর থেকে অনেক দূরে, পায়ে চলা পথে কিংবা মাঠের মধ্যেও মেঘলা বিকেলে কানকোয় ভর দিয়ে কই মাছদের চলতে দেখেছি। খপ খপ করে ধরে ফেলা যায়। এইসব বিবাগী কই মাছ নাকি গাছেও চড়তে চায়। গল্পের গাঁজাখুরিত্ব বোঝাবার জন্য ‘গল্পের গোরু গাছেও চড়ে’ বলে একটা কথা আছে। কিন্তু কইমাছের গাছে চড়া বোধহয় গাঁজাখুরি নয়, আমি স্বচক্ষে তা কখনও দেখিনি বটে, তবে প্রত্যক্ষদর্শীদের কাছে শুনেছি৷৷ প্রসঙ্গত বলা যায়, গল্পের গোরু গাছে চড়ার বক্রোক্তি থেকেই সম্ভবত গল্পগাছা কথাটা তৈরি হয়েছে।

মাছের অভাব নেই, কিন্তু টান পড়ল অন্য দিকে। অনবরত ফেনাভাত রান্নার কারণ, চাল বাড়ন্ত। বাঙালিরা সাধারণত শখ করে দু’একদিন ফেনাভাত খায়, অন্য সময় ভাতের ফেন গেলে ফেলে দেওয়া হয়। কিন্তু চাল কম পড়লে ফেন দিয়েই পেট ভরাতে হবে। ক্রমে চাল একেবারেই অদৃশ্য হয়ে গেল।

জাপানিরা আসছে, জাপানিরা আসছে! জাপানের অগ্রগতি ইংরেজরা রুখতে পারেনি। রেঙ্গুন দখল করার পর জাপানি সৈন্যবাহিনী অসম পেরিয়ে নামবে পূর্ববঙ্গে, তাই সরকার থেকে সেখানকার চারটি জেলার সমস্ত ধান-চাল সরিয়ে নেওয়া হয়। যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করার জন্য বাজেয়াপ্ত করা হল বহু নৌকো, কয়েক হাজার নৌকো একেবারে ধ্বংস করেই দেওয়া হল, সেখানকার মানুষগুলি কার্যত গৃহবন্দি, তারা খাবে কী? সে চিন্তা সরকারের নয়। এরকম কৃত্রিম অভাবের সময়ই শুরু হয় কালোবাজারের রমরমা। মজুতদারদের কল্যাণে চালের দর বাড়তে থাকে লাফিয়ে লাফিয়ে। যুদ্ধ পূর্বকালে চালের মন (৪০ সেরে এক মন, এখনকার ৩২- ৩৩ কেজি) ছিল ছয় থেকে সাত টাকা। কোনও বছর আট টাকায় উঠলে লোকে বলত, দেশটার হল কী? তখন সোনার ভরি পঁয়তিরিশ টাকা চার আনা। বেয়াল্লিশ সালের ডিসেম্বরে চালের মন তেরো থেকে চোদ্দো টাকা, পরবর্তী এক বছরের মধ্যে তা পঞ্চাশ-ষাট, চট্টগ্রামে আশি টাকা, ঢাকায় একশো পাঁচ টাকা।

খাদ্যশস্যের প্রকৃত অভাবকে বলে দুর্ভিক্ষ। পরবর্তীকালে গবেষক অমর্ত্য সেন দেখিয়েছেন যে সেই তেতাল্লিশ সালে খাদ্যশস্য ছিল প্রয়োজনের পক্ষে যথেষ্ট, কিন্তু সরকার ও কালোবাজারিরা তার অনেকখানিই সরিয়ে রেখেছিল, সেই জন্যই খোলা বাজারের চালের এমন আকাশছোঁওয়া মূল্যবৃদ্ধি, তা চলে গিয়েছিল সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে। দেশে চাল আছে, তবু দেশের এক অংশের মানুষ অনাহারে ধুকছে।

আমার বাবা সেকালে মাইনে পেতেন পঁয়তাল্লিশ টাকা। স্কুল বন্ধ, তখন তাঁর সে উপার্জনও নেই। কলকাতায় তিনি অন্য চাকরি খুঁজছেন, কী করে টিকে আছেন, আমাদের জন্যই বা কী উপায়ে মাঝে মাঝে কিছু টাকা পাঠাচ্ছেন, সে জ্ঞান আমার ছিল না। এক দু মাস কোনওই চিঠি আসত না তাঁর, কোথায় আছেন জানি না, হঠাৎ হঠাৎ দেখে ফেলতাম, ঘরের এক কোণে, দেয়ালের দিকে ফিরে, মুখে আঁচল চাপা দিয়ে নিঃশব্দে কাঁদছেন মা। শুধু মেয়েরাই বুঝি পারে এভাবে কাঁদতে, শরীরটা কাঁপে, কোনও শব্দ হয় না।

মাদারিপুরে চালের দোকানের সামনে অনেক মানুষ দাঁড়িয়ে আছে ম্লান মুখে। দোকানের মালিক হাত নেড়ে জানাচ্ছেন, চাল নেই, চাল নেই! সন্ধের অন্ধকারে সে দোকানেরই পেছনের দরজা দিয়ে সম্পন্ন গৃহস্থেরা থলে ভরা চাল নিয়ে সরে পড়ছে চুপি চুপি। এ দেশের মানুষ কেড়ে খেতে জানে না, নিজের কপালে হাত চাপড়ায়। সৈন্যদের জন্য প্রচুর খাদ্য গুদামবন্দি রয়েছে, সিংহলে রপ্তানি যাচ্ছে চাল, তবু এখানকার অভুক্ত মানুষরা লুঠতরাজ শুরু করেনি। ‘এই সব মূঢ়, স্নান, মূক মুখে দিতে হবে ভাষা’, কে দেবে সেই ভাষা, সে নেতৃত্ব কোথায়?

আমাদের সম্পূর্ণ অনাহারে পড়তে হয়নি, কোনও এক বিস্ময়কর কারণে সে বছর আলু সস্তা ছিল। আলু খেয়েও মানুষ বেঁচে থাকতে পারে। জাপানিরা কি আলু খায় না? সরকার আলুও সরিয়ে দিল না কেন? আমাদের চাল কেনার ক্ষমতা নেই, বস্তায় ভরে আলু আনা হত। ভাতের হাঁড়িতে সেদ্ধ করা হয় সেই আলু। সকালে আলু, দুপুরে আলু, বিকেলে আলু, রাত্তিরে আলু। একসঙ্গে বেশি আলু খাওয়া যায় না, মুখে রোচে না। তাই একসঙ্গে অনেক আলু সেদ্ধ করা থাকে, আমরা ঘুরে ফিরে একটা-দুটো খাই৷ ইস্কুলেও আলু নিয়ে যাই পুঁটলি বেঁধে, আমার মতন আরও অনেকে, ইস্কুল থেকে নুন আর মরিচ দেবার ব্যবস্থা করা হয়, প্রত্যেক পিরিয়াডের পর দপ্তরি এসে হাইবেঞ্চে একটু একটু নুন আর কয়েকটা কাঁচা লঙ্কা দিয়ে যায়, মাস্টারমশাইরাও পাঞ্জাবির পকেট থেকে আলু বের করেন। মাস্টারমশাইদের অনুপস্থিতিতে খুদে ছাত্রদের মধ্যে হঠাৎ হঠাৎ শুরু হয়ে যায় আলু-যুদ্ধ, কামানের গোলার মতন আলু ছোঁড়াছুঁড়ি চলে, এক পক্ষ ইংরেজ, এক পক্ষ জাপানি।

দিনের পর দিন এই রকম, এক এক রাতে আমরা ধোঁওয়া ওঠা গরম ভাতের স্বপ্ন দেখি। মনে হয় যেন এ-জীবনে আর ভাত খাওয়া হবে না। সহপাঠীদের মধ্যে যে দু’চারজনের বাড়িতে ভাত রান্না হয়, তাদের মুখে আমরা ভাতের গল্প শুনি৷ হেডমাস্টারের ছেলেটি সেইরকম একজন সৌভাগ্যবান, সে অবজ্ঞার সঙ্গে একদিন বলল, তার একথালা ভাতের ওপর একটা আরশোলা (ওখানকার ভাষায় তেলাচোরা) এসে পড়েছিল বলে সে পুরো ভাতটা বাড়ির কুকুরকে খাইয়ে দিয়েছে। তৎক্ষণাৎ সেই কুকুরটির প্রতি আমাদের ঈর্ষা হয়। এ কাহিনী শোনাবার সময় সেই লস্কর-নন্দন জামার পকেট থেকে একটি মূল্যবান লাঠি লজেন্স বার করে দেখিয়ে দেখিয়ে চোষে।

বাজারে আলুও তো অফুরন্ত নয়, একদিন টান পড়বেই, তারপর? এরকম দুঃসময়ে চুরি-ডাকাতি ও অরাজকতাও বাড়ে। আমাদের বাড়িতেও চোর এল এক রাতে। আগেই বলেছি, আমাদের বাড়িটি ব্রাহ্মণপল্লীর অন্য বাড়িগুলির পেছন দিকে, তেমন মজবুতও নয়। মাটির ভিত, ইট-সিমেন্টের কোনও বালাই নেই, সেই মাটির ভিত শাবল দিয়ে খুঁড়ে সিঁধ কেটে ভেতরে তো ঢোকাই যায়। হায়রে চোরের পোড়া কপাল, আমাদের মতন বাড়িতে এসে সে কী পাবে? চোরেরা সাধারণত আগে থেকে খোঁজ খবর নিয়ে আসে, এ নিশ্চিত পেশাদার চোর নয়, পেটের জ্বালায় মরিয়া হয়ে ঢুকে পড়েছে।

শীতের রাত, মেঝেতে লম্বা বিছানা পাতা, কম্বল চাপা দিয়ে মায়ের দু’পাশে শুয়ে ঘুমোচ্ছি আমরা চার ভাইবোন। দিদিমা আমার একটা অন্য নাম দিয়েছিলেন, সনাতন, সেই থেকে ডাক নাম সুনু, পরের ভাই মনু (অনিল), তারপর বাচ্চু (অশোক), ছোট বোনটি কণা (কণিকা)। সে একেবারেই দুগ্ধ পোষ্যা।

চোরটি ঘরের মধ্যে ঢুকে এসে হাতড়ে হাতড়ে কিছুই পায় না। আলনা থেকে পুরনো জামা-কাপড়গুলি নিয়ে পুঁটুলি বাঁধল, কিন্তু শুধু তাতে তার পোষাবে কেন? শেষপর্যন্ত সে আমাদের গা থেকে কম্বল টেনে নিতে লাগল। শীত লাগতেই আমার ঘুম ভেঙে যায়, চেয়ে দেখি আবছা আলোয় প্রেতের মতন এক ছায়ামূর্তি। পরনে শুধু লেংটি, প্রায় উলঙ্গই মনে হয়, ওরা নাকি সারা গায়ে তেল মেখে আসে। কিছু না ভেবেই আমি চেঁচিয়ে ডাকলাম, মা! মা সঙ্গে সঙ্গে এক হাতে আমার মুখ চাপা দিলেন, অর্থাৎ মাও আগে জেগেছেন, কিন্তু সাড়াশব্দ করতে গেলেই যদি চোরটি শাবল দিয়ে মাথায় মারে, কিংবা পেটে ছুরি বসিয়ে দেয়। সন্তানদের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছেলেটির বয়েস ন বছর, মীরা পঁচিশ বছরের তরুণী, তাঁর স্বামী থাকেন অনেক দূরে, রাত্তিরে ঘরের মধ্যে একজন জলজ্যান্ত পুরুষ, তার কাছে কী অস্ত্র আছে জানা নেই, এর চেয়ে অসহায় অবস্থা আর কী হতে পারে?

সেই চোর কম্বল টেনে নিয়ে ধীরে সুস্থে গর্ত দিয়ে নেমে গেল। কাকে ডাকব, কে সাহায্য করবে, এত রাতে চোরের পিছু পিছু ধাওয়া করারও কোনও প্রশ্ন ওঠে না। এবারে মীরার কান্না থামাল তার কোলের মেয়েটি, সে কিছু না বুঝে ভ্যাঁ করে উঠতেই মীরা চোখ মুছে তাকে কোলে তুলে নিলেন।

আমার একটি ছোট টিনের বাক্স ছিল, তাতে ছিল পাঠ্য বইয়ের বাইরের দু’একখানা বই, একটা দু’মুখো লাল-নীল পেন্সিল, কয়েকটা কাচের গুলি, কিছু সোডার বোতলের ছিপি, কয়েক পাতা জলছবি, সবই অকিঞ্চিৎকর, কিন্তু আমার কাছে বিশেষ মূল্যবান। পরদিন পাছ-পুকুরের ওধারের জঙ্গলে সুটকেসটি একেবারে তোবড়ানো ও খালি অবস্থায় খুঁজে পাওয়া যায়। কয়েকদিন পর বাজারের কাছে একটি ছেলেকে আমার চেন বসানো গেঞ্জিটি পরে ঘুরে বেড়াতে দেখি, ওরকম গেঞ্জি আর দ্বিতীয়টি থাকার কোনওই সম্ভাবনা ছিল না, কিন্তু ছেলেটিকে নাকি কিছু বলা যাবে না, প্রতিকারের কোনও উপায় নেই। পল্লীর বয়স্কদের কাছে নালিশ জানাতে তাঁরা চাপা বিষাদের সঙ্গে বলেছিলেন, চুপ করে থাক, ও নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করিস না।

তখন বাংলায় মুসলিম লিগ মিনিস্ট্রি, কিছুদিন আগে ফজলুল হককে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে, প্রধানমন্ত্রী (হাঁ, মুখ্যমন্ত্রী নয়, তখন বাংলার প্রধানমন্ত্রীই বলা হত) এখন খাজা নাজিমুদ্দিন, তিনি দুর্ভিক্ষ সামলাবার কোনও ব্যবস্থাই নিতে পারছেন না, এর মধ্যে হিন্দু-মুসলমানের মাঝখানের ফাটল ক্রমশ বাড়ছে।

চার

উনিশ শো তেতাল্লিশ সালের নভেম্বর মাসের শেষ দিকে তেহরানে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট, সোভিয়েত রাশিয়ার রাষ্ট্রনায়ক স্তালিন এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের এক বৈঠক হল। এমনই সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশ যে মনে হয়, এই তিনজন অনেকদিনের বন্ধু।

রাজনীতিতে শয্যাসঙ্গী পরিবর্তন যখন-তখন ঘটে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হবার আগে স্তালিন ছিলেন অপর দুই ব্যক্তির চক্ষুশূল। লেনিনের নেতৃত্বে রাশিয়ায় সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর ধনতান্ত্রিক দেশগুলিতে চাপা আশঙ্কার স্রোত বইতে শুরু করেছিল, এই বুঝি দিকে দিকে কমিউনিজ্ম ছড়িয়ে পড়বে। যদিও সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজ্ম এক নয়, তবু চলতি কথায় কমিউনিজ্মই বলে, কারণ সোভিয়েত রাশিয়ায় কমিউনিস্ট পার্টিই ক্ষমতাসীন, অন্য অনেক দেশেও কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এমনকী জার্মানিতেও, হিটলারের অভ্যুত্থানের আগের কমিউনিস্ট পার্টি ছিল বেশ শক্তিশালী।

লেনিনের তুলনায় স্ট্যালিন অনেক কঠিন ধরনের মানুষ। চতুর্দিকে শত্ৰুবেষ্টিত সোভিয়েত রাশিয়াকে রক্ষা করার জন্য তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, প্রয়োজনে তিনি চরম নির্মমও হতে পারেন। ট্রটস্কির পলায়নের পর তিনি নিজের আশেপাশে অনেককেই ঘরশত্রু বিভীষণ বলে সন্দেহ করেন, ষড়যন্ত্রের অভিযোগে তিনি নিজের দেশের বহু মানুষকে হত্যা করিয়েছেন। বাইরের দেশগুলি অনেক খবরই ঠিকমতো জানতে পারে না, তাই সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে তাদের চোখে স্তালিন চরিত্রটি রীতিমতো ভয়াবহ।

ধনতন্ত্র ও কমিউনিজ্ম, এই দুইয়ের মাঝখানে হঠাৎ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল ফ্যাসিবাদ, ইতালি ও জার্মানিতে। মুসোলিনি আর হিটলার দু’জনেই ছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সাধারণ করপোরাল, দু’জনেই আহত হয়েছিল। পরে মুসোলিনি হয় একটি বামপন্থী পত্রিকার সম্পাদক, হিটলার যোগ দিয়েছিল ওয়ার্কার্স পার্টিতে। কিন্তু দু’জনেই মনেপ্রাণে স্বৈরাচারী, রক্তলোলুপ ও যুদ্ধবাজ। প্রথম যুদ্ধে পরাজিত জার্মানি অত্যন্ত অপমানজনক শর্তাবলীতে ভার্সাই চুক্তি স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছিল। তারপরেও বিজয়ী দেশগুলির শোষণে জার্মানির অর্থনৈতিক অবস্থা একেবারে বিপর্যস্ত, রাজতন্ত্রের অবসান হয়েছে বটে, সম্রাট কাইজার পলাতক, তাতেও অবস্থার কিছুই উন্নতি হয়নি। এরই মধ্যে হিটলারের চমকপ্রদ অভ্যুদয়। প্রথম যৌবনে এই লোকটি ছবি আঁকিয়ে হতে চেয়েছিল, দু’ দু’বার চেষ্টা করেছিল ভিয়েনার অ্যাকাডেমি অফ ফাইন আর্টসে ভর্তি হতে, কিন্তু অযোগ্য বলে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। একজন ব্যর্থ শিল্পী কী করে একজন সাঙ্ঘাতিক হিংস্র রণোন্মাদে পরিণত হয়, তার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণও অতি দুরূহ।

হিটলার এক অদ্ভুত ধরনের বাগ্মী, কথা বলে ঝড়ের বেগে, তাতে যুক্তির চেয়েও তেজ থাকে প্রচণ্ড, জনসভায় শ্রোতারা মন্ত্রমুগ্ধের মতন হয়ে যায়। হিটলার প্রচার করতে লাগল, জার্মানির এই অধঃপতনের জন্য দায়ী ইহুদিরা। ইহুদি ও বলশেভিকদের ষড়যন্ত্রে দেশটার সর্বনাশ হতে বসেছে। এবং আর্যদের মধ্যে নর্ডিক জার্মানরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, তারা সারা পৃথিবী শাসন করার যোগ্য। জার্মানদের জন্য আরও ভূমির প্রয়োজন, তাই অন্য দেশ দখল করা দোষের কিছু নয়। এবার যে শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হবে, তার আয়ু হবে অন্তত হাজার বছর। হিটলারের এইসব প্রলাপবাক্যে জার্মানির অধিকাংশ মানুষ মোহগ্রস্ত হল। তাদের পরাজয়ের অপমানের ক্ষতে এইসব প্রলাপই হল প্রলেপ। নাতসি বাহিনী গঠন করে বিস্ময়কর দ্রুততায় হিটলার হয়ে উঠল জার্মানির সর্বেসর্বা আর মুসোলিনি ইতালিয়ানদের স্বপ্ন দেখাল যে, আবার রোমান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হবে।

ধনতান্ত্রিক দেশগুলির চোখে কমিউনিজ্ম ও ফ্যাসিবাদের মধ্যে কে বড় শত্রু? ফ্যাসিবাদ পুরোপুরি স্বৈরাচারী, বিরুদ্ধবাদীদের নির্মূল করতে বদ্ধপরিকর হলেও ধনতন্ত্রের সমর্থক। শ্রমিক শ্রেণীর সমস্ত আন্দোলন দমন করে তারা বড় বড় কলকারখানার মালিক ও পুঁজিপতিদের নিজেদের পক্ষে রাখে। হিটলার যদি এতটা অস্থির না হত, সমস্ত আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে একটার পর একটা দেশ দখল করে না নিত, তা হলে ধনতান্ত্রিক দেশগুলি তার সঙ্গে এক ধরনের বোঝাপড়ায় আসতে বোধহয় অনিচ্ছুক ছিল না। হিটলার-মুসোলিনীকে দিয়ে কমিউনিজ্মকে ধ্বংস করার প্রচ্ছন্ন মদত দিত। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেন সেই চেষ্টাই করেছিলেন।

কমিউনিস্টদের চোখেও ধনতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদের মধ্যে কোনটি বেশি বিপজ্জনক? ধনতন্ত্রে তবু খানিকটা উদারতা আছে, বিরুদ্ধ মত কিছুটা প্রকাশ করা যায়, অন্য পার্টি গঠন করে আন্দোলনও চালানো যায়। কিন্তু ফ্যাসিবাদ তো সব বিরুদ্ধবাদীদেরই গলা টিপে মারছে। শ্রমিক-কৃষকদের পদানত রাখাই তাদের নীতি এবং কিছুতেই কমিউনিজ্মের বিস্তার হতে দেবে না। সুতরাং ফ্যাসিবাদ রোখার জন্য আপাতত ধনতন্ত্রের সঙ্গে হাত মেলানোই তাদের পক্ষে বাঞ্ছনীয়।

যুদ্ধের প্রথম থেকেই হিটলারের চমকপ্রদ সাফল্যে সারা ইউরোপ শঙ্কিত। জার্মান বাহিনী যেন অপ্রতিরোধ্য। এখন নিজেদের স্বার্থেই ফ্রান্স-ব্রিটেনের সঙ্গে রাশিয়ার সামরিক চুক্তি করা অতি আবশ্যক। সম্মিলিতভাবেই জার্মানিকে প্রতিহত করা যেতে পারে। স্তালিন এরকম একটা চুক্তির ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন, ফ্রান্স-ইংল্যান্ডের সঙ্গে চিঠি চালাচালিও শুরু হয়েছিল, কিন্তু শর্তের খুঁটিনাটি নিয়ে মতভেদে দেরি হচ্ছিল। এই জন্য ত্রিপাক্ষিক করমর্দনের দিন নির্ধারিত হতে পারছিল না।

আচম্বিতে একদিন বজ্রপাতের মতন শোনা, গেল, হিটলারের সঙ্গে স্তালিন হাত মিলিয়ে ফেলেছেন, জার্মানির সঙ্গে রাশিয়ার অনাক্রমণ চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে দশ বছরের জন্য! কমিউনিস্টরা ফ্যাসিস্তদের সঙ্গে হাত মেলাবে, এও কি সম্ভব? পশ্চিমি শক্তির সঙ্গে রাশিয়ার মৈত্রী আলোচনা তো পরিত্যক্ত হয়নি, মধ্যপথে অসমাপ্ত অবস্থায় ছিল, তারই মধ্যে গোপনে গোপনে জার্মানির সঙ্গে আলোচনা তো বিশ্বাসঘাতকতারই নামান্তর! অবশ্য স্তালিনের পক্ষ থেকেও যুক্তি দেখানো যায় যে, ফরাসি-ইংরেজরা অনাবশ্যক বিলম্ব করে তাঁর ধৈর্যচ্যুতি ঘটাচ্ছিলেন। এই বিলম্বের কারণ কি শর্তাবলি নিয়ে দ্বিধা, নাকি জার্মানি যদি এর মধ্যে রাশিয়া আক্রমণ করে বসে, তার জন্য অপেক্ষা? যাক শত্রু পরে পরে!

শুধু অনাক্রমণ চুক্তি নয়, রুশ-জার্মান বাণিজ্য চুক্তিও হয়ে গেল, জার্মানিকে তোয়াজে রাখার জন্য রাশিয়া থেকে পাঠানো হতে লাগল তুলনায় বেশি বেশি মালপত্র। চুক্তি স্বাক্ষরের দিনে বিশাল পানভোজনের আয়োজন হয়েছিল ক্রেমলিনে, জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী রিবেনট্রপের পাশে দাঁড়িয়ে অত্যুৎসাহী স্তালিন সুরার পাত্র তুলে হিটলারের সঙ্গে স্বাস্থ্যপান করলেন।

স্তালিনের ষাটতম জন্মদিনে বন্ধুভাবাপন্ন সোভিয়েত রাশিয়া ও তার জনগণের উদ্দেশে শুভেচ্ছাবার্তা পাঠাল হিটলার। উত্তরে স্তালিন জানালেন, রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ সোভিয়েত ইউনিয়ন ও জার্মান জনগণের বন্ধুত্ব হবে সুদূরপ্রসারী ও দৃঢ়!

এই চুক্তি সারা বিশ্বের কমিউনিস্টদের খুব ফাঁপরে ফেলে দিয়েছিল। মানব সভ্যতার শত্রু ফ্যাসিস্তদের সঙ্গে মিতালি? বছরের পর বছর তাঁরা ফ্যাসিবাদের মুণ্ডপাত করে এসেছেন, এখন সেসব গিলে ফেলতে হল, জার্মানির বিরুদ্ধে আর কেউ একটি কথাও বলেন না। বরং বলা হতে লাগল, এই অনাক্রমণ চুক্তির ফলে যুদ্ধের সম্ভাবনা দূর হয়ে শান্তির আবহাওয়া ফিরে এসেছে। পশ্চিমি দেশগুলি সাম্রাজ্যবাদী, ওরাই যুদ্ধ চায়।

হিটলার যেমন চতুর, তেমনই তার মিথ্যে কথা বলার অসাধারণ ক্ষমতা। শুধু কমিউনিস্ট নয়, সমগ্র রুশ জাতির প্রতিই তার মনে চরম ঘৃণা জমে আছে, অথচ স্তালিনের সঙ্গে প্রাণের সখা ভাব করে বার্তাবিনিময় চলতে লাগল, ধুরন্ধর স্তালিনও এই ধাপ্পা ধরতে পারেননি। স্তালিনের চেয়েও বেশি দায়ী তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী মলোটভ, যাঁর সম্পর্কে চার্চিল লিখেছেন, ‘আধুনিক কালের নিখুঁত রোবটের মতন এমন মানুষ আমি আর একটিও দেখিনি, যার হাসি সাইবেরিয়ার শীতের মতন, যাঁর প্রতিটি কথা মেপে মেপে বলা, অবশ্য জ্ঞানীর মতোই, এই ভয়ংকর পৃথিবীতে তিনি সোভিয়েত নীতির সুযোগ্য মুখপাত্র’, সেই মলোটভই হিটলারকে বিশ্বাস করে এই মৈত্রীচুক্তির প্রধান উদ্যোক্তা। শুধু তাই নয়, হিটলারের কার্যকলাপের সমর্থনে তিনি এমন কয়েকটি বিবৃতি দিয়েছেন, তা যেন স্রেফ নাতসি তোষামোদ। কমিউনিজমের ঘোষিত আদর্শ এবং বৈপ্লবিক চিন্তাধারার সম্পূর্ণ বিরোধী এইসব কথাবার্তা পরবর্তীকালের সাম্যবাদী ঐতিহাসিকদেরও অস্বস্তিতে ফেলেছে। রুশ-জার্মান চুক্তি স্বাক্ষরের খবর পেয়েই হিটলার আনন্দে লাফাতে লাফাতে দেওয়ালে দু’ হাতে কিল মেরে বলেছিল, এবার পৃথিবীটাকে আমি পকেটে ভরে ফেলেছি!

তার প্রথম পদক্ষেপ পোল্যান্ড আক্রমণ। এর আগে চেকোশ্লোভাকিয়া একেবারে উপঢৌকনের মতন হিটলারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল, পোল্যান্ড আক্রমণে ব্রিটেন ও ফ্রান্স যুদ্ধ ঘোষণায় বাধ্য হল। শুধু যেন ঘোষণাই সার, তেমনভাবে বাধা দেওয়া গেল না, নাতসিবাহিনী বিদ্যুৎ বেগে এগিয়ে দখল করে নিল পোল্যান্ড। এই সুযোগে সোভিয়েত রাশিয়ার লাল ফৌজও ঢুকে পড়ল পোল্যান্ডের অন্য দিক দিয়ে, জার্মানদের কাছ থেকে বাধা পাওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই। পোল্যান্ডের পঁচাত্তর হাজার বর্গমাইল রাশিয়ার অধিকারে চলে গেল, হিটলার যেন সেদিকে তাকিয়ে রইল প্রশ্রয়ের দৃষ্টিতে। বন্ধুকে কেকের একটুখানি ভাগ তো দিতেই হয়। জার্মানির সঙ্গে পা মিলিয়ে পোল্যান্ডের মতন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রকে গ্রাস করার মতন একটি অনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ করতেও সোভিয়েত রাশিয়া দ্বিধা করেনি।

পোল্যান্ডের পর নরওয়ে এবং ডেনমার্ক গেল নাতসিদের কবলে। তারপর তারা মুখ ফেরাল পশ্চিম রণাঙ্গনে। প্রথমে হল্যান্ড, তারপর বেলজিয়াম, এবং দুর্ধর্ষ ফরাসি সৈন্যবাহিনীও রুখতে পারল না জার্মানদের, প্যারিসের পতন হল, ডেনমার্ক থেকে পালাতে হল ইংরেজদের। এতদিনে প্রথম মহাযুদ্ধের পরাজয়ের সত্যি সত্যি প্রতিশোধ নিল জার্মানি, আত্মসমর্পণে বাধ্য হল ফ্রান্স। ১৯১৮ সালে কস্পিয়ন ফরেস্টে একটি রেলের কামরায় বসে পরাজিত জার্মানি মাথা নিচু করে আত্মসমর্পণের চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, বাইশ বছর পরে, সেই সংরক্ষিত রেলের কামরাটিতেই সেই চেয়ারে এসে বসল হিটলার। এবারে বিজয়ী জার্মানি এখানেই ফ্রান্সকে মাথা নিচু করাতে চায়।

এর পর ইংল্যান্ডের পালা। ইংল্যান্ড এখন নিঃসঙ্গ, তাকে বশ্যতা স্বীকার করাতে পারলে জার্মানি হবে ইউরোপের একচ্ছত্র অধিপতি। ইংল্যান্ড দখল নয়, বশ্যতা স্বীকার করানোই হিটলারের উদ্দেশ্য। স্থলপথে হিটলার অসাধারণ রণনৈপুণ্য দেখিয়েছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই, কিন্তু জলপথের যুদ্ধে তার আত্মবিশ্বাস কিছুটা কম। ইংলিশ চ্যানেল পেরুতে হলে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর সম্মুখীন হতে হবে। বিখ্যাত স্প্যানিশ আর্মাডাও ইংল্যান্ডের কূলে ভিড়তে পারেনি, নেপোলিয়নও পার হতে পারেনি ইংলিশ চ্যানেল। হিটলার তাই ঠিক করল, আকাশপথে প্রচণ্ড আক্রমণ চালালে, বিশেষত লন্ডন শহরটাকে ভেঙে-চুরে, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ধ্বংস করে দিতে পারলে ইংরেজরা ভয় পেয়ে আত্মসমর্পণে বাধ্য হবে।

শুরু হল বোমাবর্ষণ।

এর মধ্যে সোভিয়েত ইউনিয়ন ফিনল্যান্ড কুক্ষিগত করে নিয়েছে। যদিও এই ক্ষুদ্র দেশটি জয় করতে অপ্রত্যাশিত প্রত্যাঘাত ও রক্তক্ষয় করতে হয়েছে প্রচুর।

ইংল্যান্ডে এর মধ্যে পরিবর্তন হয়ে গেছে অনেক। প্রধানমন্ত্রী চেম্বারলেনের একচক্ষু হরিণের মতন স্বভাবে, ব্যর্থতার পর ব্যর্থতায় পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীত্বের পদে বসেছেন উইনস্টন চার্চিল। সুরা ও চুরুটে আসক্ত এই স্থূলকায় ব্যক্তিটির বুদ্ধি অতি সূক্ষ্ম এবং অসাধারণ তাঁর মনোবল। সেই মনোবল তিনি চারিয়ে দিলেন দেশবাসীর মধ্যে। ব্রিটেনকে সাহায্য করার আর কেউ নেই, তবু চার্চিল অনমনীয় দৃঢ়তায় ঘোষণা করলেন, কোনওক্রমেই আত্মসমর্পণ করা হবে না। দেশের মানুষের কাছে তিনি আহ্বান জানালেন, ‘আমরা লড়ব, বেলাভূমিতে, আমরা লড়ব অবতরণ ক্ষেত্রগুলিতে, আমরা লড়ব মাঠে মাঠে, রাস্তায় রাস্তায়, আমরা লড়ব পাহাড় চূড়ায়, তবু আমরা কিছুতেই আত্মসমর্পণ করব না।’

বোমারুবিমান পাঠাবার আগে হিটলার হঠাৎ শান্তিবাদী হয়ে উঠল। যুদ্ধ তো প্রায় শেষই হয়ে গেছে, এখন বিজয়ী জার্মানির সঙ্গে ব্রিটেন সন্ধি করলেই সব ঝামেলা চুকে যায়। এই কপট শান্তির আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেন চার্চিল।

প্রথম দফায় উড়ে এল চারশো বিমান, জার্মানরা ভেবেছিল প্রথমেই ব্রিটেনের রয়াল এয়ারফোর্স ও বিমানঘাঁটিগুলো ধ্বংস করে দিতে পারবে। কিন্তু ব্রিটিশরাও তৈরি ছিল, জার্মান মেসারস্মিট্স, হেঙ্কেইল ও জুঙ্কার জঙ্গি বিমানগুলির মুখোমুখি হল ব্রিটিশ বাহিনীর হারিকেন ও স্পিটফায়ার জঙ্গি বিমান, যুদ্ধ চলল আকাশে আকাশে। আকাশচারী বিহঙ্গরা নিজেদের মধ্যে মারামারি করে না, কাজেই সেই তুলনা দেওয়া চলে না, কিন্তু কুকুররা কামড়াকামড়ি করে, তাই এই যুদ্ধের নাম ডগ ফাইট। হিংস্র কুকুররা এখন আকাশে। এই যুদ্ধে ব্রিটিশ পাইলটরা জার্মানদের তুলনায় অনেক বেশি সাহস ও কৃতিত্ব দেখাল, তাদের ক্ষয়ক্ষতিও কম।

ব্রিটেনে দশ লক্ষেরও বেশি গৃহ ধ্বংস বা আংশিক চূর্ণ হল, হতাহত হল প্রায় পঁচানব্বই হাজার মানুষ, লন্ডন শহর অর্ধেক বিধ্বস্ত, তবু ব্রিটিশরা মনোবল হারাল না। লন্ডনের হাউজ অফ কমন্স বিধ্বস্ত হল, বোমাবর্ষিত হল বাকিংহাম প্যালেসে, তবুও রাজা ষষ্ঠ জর্জ তাঁর রানি ও সন্তানদের নিয়ে লন্ডন ছেড়ে যেতে রাজি হলেন না। বোমাবর্ষণ একটু থামলেই কতটা কী ক্ষয়ক্ষতি হল তা নিজের চোখে দেখবার জন্য চার্চিল বেরিয়ে পড়েন রাস্তায়।

প্রথম দফা বোমাবর্ষণে ব্রিটেনকে পর্যুদস্ত করতে না পেরে পরবর্তী প্রস্তুতির জন্য হিটলার থামল কিছুদিনের জন্য। এর পরেই শুরু হল অন্য নাটক।

পশ্চিম রণাঙ্গনে ব্রিটেনের সঙ্গে যুদ্ধরত জার্মানি যে পূর্বেও একটি রণাঙ্গন প্রস্তুত করবে, তা যুদ্ধনীতির সহজ বুদ্ধিতে ধরা পড়ে না। কিন্তু হিটলার ব্রিটিশদের সঙ্গে চুড়ান্ত যুদ্ধে আগ্রহী ছিল না, ব্রিটিশদের প্রতি তার জাতিগত বিদ্বেষও ছিল না। তখনও তার ধারণা, ব্রিটিশরা হার স্বীকার করতে বাধ্য হবে এবং সেটাই যথেষ্ট। প্রাচ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের দেশগুলি দখল করে নেবার জন্য জার্মান সেনাপতিরা যে পরামর্শ দিয়েছিল, তাতেও কর্ণপাত করেনি হিটলার। তার মতে, ইহুদিরা মনুষ্য পদবাচ্যই নয় এবং রাশিয়ানরা অতি নিকৃষ্ট জাতি, এদের ধ্বংস করাই জার্মানদের কর্তব্য। রুশরা পোকামাকড়ের মতন বংশবৃদ্ধি করে, সুতরাং তাদের নির্বংশ করাই উচিত কাজ। সোভিয়েত ইউনিয়ন নামে দেশটাকেই পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে দিতে চায় হিটলার।

মনের মধ্যে এরকম তীব্র ঘৃণা পুষে রেখেও সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে অনাক্রমণ ও বাণিজ্য চুক্তির দৌলতে স্তালিনের সঙ্গে কত শুভেচ্ছা বিনিময় ও মলোটভের সঙ্গে ঘন ঘন বৈঠক। এর মধ্যেই পূর্ব সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ ও যুদ্ধ প্রস্তুতি চলছে গোপনে। কিন্তু যুদ্ধের সময় অনেক কিছুই গোপন রাখা যায় না, চতুর্দিকে গুপ্তচর ও প্রতি-গুপ্তচর গিসগিস করছে, অসম সাহসী সাংবাদিকরাও অনেক খবর ফাঁস করে দেয়, হিটলার অনাক্রমণ চুক্তি ছিঁড়ে ফেলে রাশিয়া আক্রমণে উদ্যত, এসব সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছিল। আশ্চর্যের বিষয়, তখনও স্তালিন তা বিশ্বাস করেনি, এমনকী যুদ্ধ ঘোষণার সাতদিন আগেও স্তালিনের নির্দেশে তাস নিউজ এজেন্সি থেকে প্রবলভাবে রুশ-জার্মান যুদ্ধ সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা হল। স্তালিনের এই বিভ্রান্তির ব্যাখ্যা নেই। মলোটভ যখন ভোরবেলা ক্রেমলিনে জার্মান রাষ্ট্রদূতের মুখে হিটলারের অগুন্তি মিথ্যে অভিযোগ ও আক্রমণের কথা শুনলেন, তখনও যেন বুঝতে পারেননি, কেন এই যুদ্ধ! এই যুদ্ধ কি তাঁদের প্রাপ্য!

রাত তিনটে পনেরো মিনিটে রুশ সীমান্তে একসঙ্গে গর্জে উঠল ছ’ হাজার কামান। সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল মানুষের সভ্যতার ইতিহাসে বৃহত্তম ও নৃশংসতম যুদ্ধ। ন’শা তিরিশ মাইলব্যাপী সীমান্ত এই রণাঙ্গন। পরে তা আরও ছড়িয়ে হয়েছিল দু’ হাজার মাইল। জার্মান পক্ষে ৫৫ লক্ষ সৈন্য, ৪৯৫০টি বিমান, ২৮০০ ট্যাঙ্ক, ৪৮ হাজার কামান, ১৯৩টি রণতরী। আক্রমণের আকস্মিকতায় রুশ বাহিনী দারুণভাবে পর্যুদস্ত হতে লাগল। যদিও তাদের সৈন্য সংখ্যা ও অস্ত্রসম্ভার খুব একটা কম ছিল না, কিন্তু জার্মানরা অনেকগুলি যুদ্ধে জয়ী হয়ে দক্ষতায় অনেক উর্ধ্বে, রুশ অস্ত্রগুলিও আধুনিক নয়। প্রথম চোদ্দো দিনেই দশ লক্ষ রুশ সৈন্য বন্দি হল জার্মানদের হাতে, ১২০০ বিমান ধ্বংস হয়ে গেল প্রায় মাটিতেই, কত নিহত হল তার ইয়ত্তা নেই, কারণ হিটলার ধরা-পড়া সৈন্য ও সাধারণ রুশ নাগরিকদেরও নির্মমভাবে হত্যা করার নির্দেশ দিয়েছিল।

লাল ফৌজের অদম্য বলে যে খ্যাতি ছিল, তা আর বিশ্বাসযোগ্য রইল না, সারা বিশ্বের চোখে স্তালিনও হেয় হয়ে গেলেন। লাল ফৌজের এই ব্যর্থতার জন্যও পরবর্তীকালে স্তালিনকেই দায়ী করা হয়েছিল, কারণ, যুদ্ধ শুরুর দু’বছর আগে পার্জিং বা বিশুদ্ধিকরণের নামে, নিছক সন্দেহের বশে তিনি সেনাবাহিনীর ওপর মহলের বহু অফিসারকে অপসারণ ও মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। সুসংগঠিত ও শক্তিশালী সেনাবাহিনী হিসেবে লাল ফৌজ গড়ে তুলেছিলেন ট্রটস্কি এবং তুখাচেভ্স্কি, এঁদের মধ্যে ট্রটস্কি নির্বাসিত এবং তুখাচেভ্স্কিকে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গুলি করে মারা হয়। স্তালিন ব্যক্তিপূজার অবাধ প্রশ্রয় দিয়েছিলেন, তাঁর সঙ্গে সামান্য মতভেদকেই যড়যন্ত্র বলে গণ্য করা হত, সেনাবাহিনীর প্রায় কুড়ি হাজার অফিসারকে বিচারের প্রহসনে বা বিনা বিচারেও প্রাণ দিতে হয়েছে। এর ফলে, সেনাবাহিনীর মধ্যে নৈরাশ্য ছড়িয়ে পড়েছিল। শূন্য স্থানগুলিতে যেসব নতুনদের নিয়োগ করা হয়, তাদের কোনও যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নেই, ট্যাঙ্ক ও বিমান চালনার ঠিকমতন ট্রেনিংও পায়নি। সেই জন্য জার্মান আক্রমণের শুরুতেই লাল ফৌজকে যেমন পিছু হঠতে হল, তেমনই অস্ত্র-সরঞ্জামের ক্ষয়-ক্ষতিও হতে লাগল প্রচণ্ড।

আর একটি ব্যাপারেও ব্যাখ্যা মেলে না, এ রকম ভয়ংকর, বিধ্বংসী যুদ্ধ শুরু হবার পর বারো দিনের মধ্যেও স্তালিন সম্পূর্ণ নীরব। এ রকম একটা সংকটে, জাতির উদ্দেশে বেতার ভাষণ দিয়ে তাদের নৈতিক বল বজায় রাখা, শত্রুর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক লড়াইতে তাদের উদ্বুদ্ধ করা এবং যুদ্ধের সময় কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত সে সম্পর্কে সজাগ থাকার কথা জানানোই কোনও রাষ্ট্রনেতার প্রধান কর্তব্য। স্তালিন সেসব কিছুই করলেন না। তিনি কি প্রাথমিক আঘাতে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন?

বরং, এই যুদ্ধ শুরুর সঙ্গে সঙ্গে বি বি সি-তে এক ভাষণ দিয়ে তাক লাগিয়ে দিলেন চার্চিল। সুদক্ষ ব্রিটিশ গোয়েন্দাবাহিনী মারফত তিনি আগেই এই যুদ্ধের নিশ্চিত সম্ভাবনার কথা জানতে পেরেছিলেন, স্তালিনকে সাবধান করে দেবার জন্য বার্তাও পাঠিয়েছিলেন, স্তালিন তা গ্রাহ্য করেননি। চার্চিলের বক্তব্যকে মূল্যই বা দেওয়া হবে কেন, মনে করা হয়েছিল, নিজেরা নাতসিদের সঙ্গে যুদ্ধে নাকানি-চোবানি খাচ্ছে, এখন ছলছুতো করে রাশিয়াকেও যুদ্ধে জড়াতে চায়। নইলে সাম্রাজ্যবাদী চার্চিল ও কমিউনিজমের শত্রু চার্চিলের মাথাব্যথা হবে কেন রাশিয়ার এই বিপদে? এ রকম গুজব ছড়াবার জন্য ভর্ৎসনা করা হয়েছিল মস্কোর ব্রিটিশ রাজদূতকে।

দেড় বছর আগে রাশিয়া-জার্মানির অনাক্রমণ চুক্তিতে সারা বিশ্বে যেমন বিস্ময়ের সঞ্চার হয়েছিল, তেমনই বিস্ময়ের ব্যাপার হল চার্চিলের এই বেতার ভাষণ। আবেগমথিত ভাষায় তিনি বিপন্ন রাশিয়াকে সাহায্যের প্রস্তাব দিলেন। শুধু ব্রিটেনের পক্ষ থেকেই নয়, আগেই তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টকে এ ব্যাপার জানিয়েছিলেন, রুজভেল্টও সবরকম সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বক্তৃতার মধ্যেই চার্চিল স্বীকার করলেন, গত পঁচিশ বছর ধরে আমার চেয়ে আর কেউ এমন ক্রমান্বয়ে কমিউনিজ্মের বিরোধিতা করেনি, কিন্তু এখন সে সব প্রশ্ন অবান্তর। আমি দেখতে পাচ্ছি রাশিয়ান সৈন্যরা দাঁড়িয়ে আছে তাদের জন্মস্থানে, তাদের পিতৃপিতামহরা যে জমি চাষ করে গেছে, পাহারা দিচ্ছে সেই ফসল…দেখতে পাচ্ছি সৈন্যরা পাহারা দিচ্ছে তাদের বাসগৃহ, যেখানে তাদের মায়েরা ও বধূরা প্রার্থনা করছে নিরাপত্তার, আমি দেখতে পাচ্ছি হাজার হাজার রাশিয়ান গ্রাম, যেখানে ভূমি থেকে উৎপাদনই বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়, তবুও যেখানে প্রবাহিত হচ্ছে জীবনের প্রাথমিক আনন্দ, যেখানে শিশুরা খেলার মধ্যে হাসে…আমি সেখানে দেখতে পাচ্ছি জার্মান বোমারু বিমান, নির্বিচারে হত্যা ও ধ্বংস করে চলেছে…আমি দেখতে পাচ্ছি একটি ছোট শয়তান গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে সুসংহত হয়ে এই বীভৎস ধ্বংসলীলা চাপিয়ে দিচ্ছে মানবজাতির ওপর…।

চার্চিলকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আপনার মতন একজন ঘোরতর কমিউনিস্ট বিরোধী ভোল পাল্টালেন কেন? এটা কি আপনার মাথা নিচু করার মতন একটা ব্যাপার হচ্ছে না? চার্চিল জবাব দিয়েছিলেন, মোটেই না। আমার একটিই মাত্র উদ্দেশ্য, তা হচ্ছে হিটলারকে ধ্বংস করা! যদি হিটলার নরকে গিয়েও আক্রমণ চালাত, তা হলেও আমি হাউজ অফ কমন্সে শয়তানের সপক্ষে ভালো কিছু বলতাম!

বারো দিন পর স্তালিন তার নীরবতা ভঙ্গ করে ভাষণ দিলেন মস্কো বেতারে। তাতে আবেগ নেই, উদ্দীপনা নেই। শান্ত কঠিন গলায় তিনি দেশবাসীকে জানালেন যে দেশ আজ কত গুরুতর বিপদের সম্মুখীন। লাল ফৌজের সাময়িক পরাজয় ও কিছু কিছু গ্রাম-নগর যে নাতসিবাহিনীর দখলে চলে গেছে, তা স্বীকার করলেন এবং বিস্তারিত প্রতিরোধ-প্রস্তুতির কথাও শোনালেন। ঘোষিত হল পোড়া মাটি নীতি।

এই ভাষণেই স্তালিন চার্চিলের ঐতিহাসিক ঘোষণা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্যদানের প্রস্তাবের উল্লেখ করে ওই দুই দেশের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানালেন। নাতসি বাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে তিন দেশের সংগ্রাম পরিচালিত হবে এক সঙ্গে।

রাজনীতির পাশাখেলা কী বিচিত্র! কয়েক মাস আগেও জার্মানি ও রাশিয়ার মধ্যে সুসম্পর্ক রাখার কত প্রতিশ্রুতি, কত গলা জড়াজড়ি ও খানাপিনা, এখন তারা মারাত্মক শত্রু। কিছুদিন আগেও মলোটভ বলেছিলেন, জার্মানি নয়, ফ্রান্স ও ব্রিটেনই আক্রমণকারী, তারাই যুদ্ধের আগুন জ্বালিয়েছে, এখন সেই ব্রিটেন ও তার সূত্রে আমেরিকাকে সহযাত্রী হিসেবে না পেলে চলবেই না।

হিটলার ভেবেছিল, মাত্র আট সপ্তাহের মধ্যেই রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয় করা যাবে। এত বড় দেশটা অধিকারে রাখা বাস্তবসম্মত নয়, রাশিয়ার মেরুদণ্ডটা ভেঙে দেওয়াই দরকার। লেনিনগ্রাড শহরটাকে ভেঙে, গুঁড়িয়ে মিলিয়ে দিতে হবে ধুলোয়, যাতে সে শহর একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, মস্কো রাখতে হবে নিজেদের দখলে, বড় বড় কল-কারখানা, শস্যভাণ্ডার, তেল ও কয়লাখনি অধিকার করে রেখে এ দেশের মানুষদের মারতে হবে না খাইয়ে রেখে।

প্রথম দিকে পর পর অতি দ্রুত সাফল্যে হিটলারের অহমিকা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেল। নেপোলিয়ান যা পারেনি, সে তা অনায়াসে পারবে ধরে নিয়ে, সেনাপতিদের মতামত উপেক্ষা করে নিজেই নির্ধারণ করতে লাগল রণনীতি। আত্মম্ভরিতার সঙ্গে যুক্ত হল পাগলামি। মস্কো শহরের উপান্তে পৌঁছেও, চরম আঘাত হানার সুযোগ ছেড়ে যুদ্ধের গতি ঘুরিয়ে দিল ইউক্রাইনের দিকে। তাতে ইউক্রাইন দখল হল বটে, ফাঁদে পড়ে রুশ সৈন্যবাহিনীর প্রায় এক-তৃতীয়াংশ শেষও হয়ে গেল, কিন্তু এর মধ্যে এসে গেল শীত। রাশিয়ার প্রধান সেনাপতি এই শীতের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে নেপোলিয়ানও ব্যর্থ হয়েছিলেন, নাতসি বাহিনীও মস্কোর অন্দরে প্রবেশ করতে পারল না। অবশ্য প্রথম দিকের বিহ্বলতা কাটিয়ে রুশ সৈন্যবাহিনী এর মধ্যে মরিয়া সংগ্রামেও প্রস্তুত হয়ে পড়েছে, দুর্জয় জার্মান বাহিনীর বিরুদ্ধে তাদের প্রাণপণ লড়াইও অভূতপূর্ব। যে-কোনও দিন মস্কোর পতন আসন্ন, এই আশঙ্কা সারা মুক্ত দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল, তবু মস্কো টিকে গেল।

মস্কো রক্ষায় বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধে লাল ফৌজের সুনামের কিছুটা পুনরুদ্ধার হয়। স্তালিনের সম্মানও বাড়ে। বেতার ভাষণে স্তালিন ফ্যাসিস্ট জার্মানির সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তির কৈফিয়ত হিসেবে বলেছিলেন, এর ফলে তিনি রাশিয়ার সমর প্রস্তুতির সময় পেয়েছিলেন। এই কৈফিয়ত যুক্তিগ্রাহ্য হয়নি, এই কি সমর প্রস্তুতির নমুনা? তা হলে জার্মানদের হাতে এমন প্রচণ্ড মার খেতে হল কেন? এখন সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, জাতীয়তাবাদ প্রচার করে দেশবাসীর মনোবলও দৃঢ় করার চেষ্টা চলছে, কিন্তু শুধু সৈন্য সংখ্যা ও জাতীয়তাবাদ দিয়ে তো দুর্ধর্ষ জার্মান বাহিনীর সর্বত্র গতিরোধ করা যাবে না। রসদ চাই। রাশিয়ার গাড়ির উৎপাদন খুবই কম, প্লেন বানাবার জন্য যথেষ্ট অ্যালুমিনিয়াম নেই, আরও গোলাগুলি ট্যাঙ্ক ও কাঁচামাল চাই। শীতের পর বসন্ত আসবে, বরফ ও কাদা শুকিয়ে গেলেই জার্মান আক্রমণ আবার তীব্র হবে, তখন যুদ্ধ চালাবার জন্য ওইসব প্রয়োজনীয় রসদ না পেলে রাশিয়ার ভরাডুবির সম্ভাবনা। ওইসব রসদ সরবরাহ করতে পারে একমাত্র আমেরিকা। কিছুদিন আগে প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট এক ভাষণে বলেছিলেন, আমেরিকা হচ্ছে ‘গণতন্ত্রের অস্ত্রাগার’। তিরিশের দশকে মন্দার অবস্থা কাটিয়ে উঠে আমেরিকা এখন ধনসম্পদে অতুলনীয়, এত গাড়ি, এত তেল, এত অর্থ নিয়ে কী করবে, নিজেরাই যেন ভেবে পাচ্ছে না।

রুজভেল্ট রাশিয়াকে সাহায্য করতে আগ্রহী। তিনিই প্রথম প্রেসিডেন্ট হয়ে সোভিয়েত রাশিয়াকে কূটনৈতিক স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। কর্জ ও ইজারা হিসেবে মিত্রপক্ষকে যানবাহন, অস্ত্রশস্ত্র ও কাঁচামাল পাঠাবার জন্য আইন পাস করিয়েছেন, বছরে পঞ্চাশ হাজার বিমান। বানাবার নির্দেশ দিয়েছেন, কিন্তু স্তালিন যদি শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যেতে না পারেন, রাশিয়া যদি পরাজয় স্বীকার করে, তা হলে ভস্মে ঘি ঢেলে লাভ কী? সরেজমিনে অবস্থাটা বোঝার জন্য রুজভেল্টের দূত হপকিন্স দুবার এলেন স্তালিনের সঙ্গে দেখা করতে। স্তালিনের ব্যক্তিত্ব ও রাশিয়ার মানুষদের সম্পর্কে আমেরিকানদের ধারণা ছিল অস্পষ্ট। তারা কমিউনিস্ট জুজু সম্পর্কেই চিন্তা করেছে, কমিউনিস্টরাও যে মানুষ, তা ভেবে দেখেনি।

স্তালিনের সঙ্গে কথা বলে মুগ্ধ হলেন হপকিন্স, বুঝলেন, এ মানুষ এমনই এক ধাতুতে গড়া, পরাজয় স্বীকার করা যে ধাতুতে নেই৷ সাহায্যের প্রয়োজনীয়তা বোঝানো হল জ্যাকসনকে, অত্যুৎসাহে স্তালিন এমনও বলে ফেললেন, আমেরিকা যদি সৈন্যবাহিনী পাঠাতে চায়, তা হলে তিনি রাশিয়ার ভূমিতে তাদের স্বাগত জানাবেন!

কিন্তু আমেরিকা যুদ্ধে যোগদান করেনি, তার সঙ্গে কোনও সমর চুক্তি সম্ভব নয়। আমেরিকার কিছু মানুষ ইউরোপের নিজেদের মধ্যে ঝগড়ায় আমেরিকার নাক গলানোর বিরোধী, আবার প্রগতিশীল কিছু মানুষ, যাঁদের মধ্যে হেমিংওয়ে, ড্রেইজার, সিনক্লেয়ার, পল রোবসন-এর মতন লেখক বুদ্ধিজীবীরা রয়েছেন, তাঁরা এবং আমেরিকান কমিউনিস্ট পার্টি এই সংকটে সোভিয়েত জনগণকে পূর্ণ সমর্থন জানালেন।

তারপর এক ডিসেম্বরের সকালে আচম্বিতে ১৮৯টি জাপানি বিমান পার্ল হারবারে এসে বোমাবর্ষণ করে গেল। সেই খবর শোনার পর চার্চিল বলেছিলেন, সেটাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে আনন্দময় দিন। দেড় বছর ধরে তাঁকে একা যুদ্ধ করতে হয়েছে, এবার আমেরিকাকে দলে পাবেন। এবার ব্রিটেন বাঁচবে, ব্রিটেনের সাম্রাজ্য বাঁচবে।

রেডিয়োতে খবরটি শোনার পরেও চার্চিল তা যাচাই করার জন্য টেলিফোন করলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে। রুজভেল্ট বললেন, হ্যাঁ, যা শুনেছেন তা সত্যি। আমেরিকা এবার যুদ্ধে যোগদান করছে। উই আর অল ইন দা সেম বোট নাউ!

জীবিত অবস্থাতেই স্তালিন একটি শহরের নাম রেখেছিলেন নিজের নামে। সেই স্তালিনগ্রাডের লড়াই যুদ্ধের ইতিহাসে চিরস্মরণীয়। এই যুদ্ধের নৃশংসতা, ও ধ্বংসলীলাও অতুলনীয়। আক্রমণ ও প্রতিআক্রমণ চলে মাসের পর মাস, জার্মানরা শহরটি দখল করে চূর্ণবিচূর্ণ করতে থাকে, যাকে সামনে পায় তাকেই হত্যা করে, রুশ বাহিনীর পাল্টা আক্রমণও একই রকম নির্মম, লড়াই হয় শহরের পথে পথে, শেষ পর্যন্ত নাতসিরা আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। এই প্রথম জার্মানদের দারুণ অপমানজনক পরাজয়। এর পরই সোভিয়েত রাশিয়া অন্যতম প্রধান বিশ্বশক্তি হিসেবে গণ্য হয়।

মিত্রশক্তি হিসেবে জোট বাঁধে রাশিয়া, ব্রিটেন ও আমেরিকা, তার বিরুদ্ধে জার্মানি, ইতালি ও জাপানের অক্ষশক্তি। তেতাল্লিশ সালের শুরুতেই মোটামুটি বোঝা যায়, অক্ষশক্তির পরাজয় অবশ্যম্ভাবী, তার পরেও বিরাট প্রশ্ন থেকে যায়, এ যুদ্ধ কতদিন চলবে, আরও কত ক্ষয়ক্ষতি ও মনুষ্যজীবন বিনষ্ট হবে। মিত্রশক্তির মধ্যে তা নিয়ে শলাপরামর্শ চলে অবিরাম, কিন্তু তিন প্রধানের একবারও বৈঠক হয়নি। সেই কারণেই তেহরানের শীর্ষ সম্মেলন এত গুরুত্বপূর্ণ।

তেহরানে যাবার আগে রুজভেল্ট সদলবলে পৌঁছলেন কায়রোতে। চার্চিল আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত। সেখানে চিনের চিয়াং কাইসেককেও ডেকে আনা হয়েছে। রুজভেল্ট চিয়াং-এর সঙ্গে কিছু কথাবার্তা সেরে নিতে চান। জাপানকে ঠাণ্ডা করতে হলে তাঁর চিনের ভূমি ব্যবহার করা প্রয়োজন। চিনের অর্থনৈতিক অবস্থাও খুব খারাপ, ভয় পেয়ে যদি রণে ভঙ্গ দেয়, তাতেও অনেক মুশকিল। বহু বছর ধরে জাপান জ্বালিয়ে মারছে চিনকে, তাই চিয়াং কাইসেক চান আমেরিকার সহায়তায় জাপানের বিজয় অভিযান রুখে দিতে। বার্মা অভিযানের একটি পরিকল্পনাও তিনি করে এনেছিলেন, কিন্তু তাতে চার্চিলের প্রবল আপত্তি। ব্রহ্মদেশ অভিযানে জল-জঙ্গল-পাহাড়ের অনেক অসুবিধের অজুহাত দেখিয়ে চার্চিল বললেন, সেখানে যথেষ্ট নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীও নিয়োগ করা যাবে না। কারণ, পশ্চিম রণাঙ্গনে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খোলাই এখন সবচেয়ে জরুরি।

চার্চিলের আপত্তির আসল কারণ অন্য। এই ব্যক্তিটি অতিশয় গোঁড়া সাম্রাজ্যবাদী, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এক তিলও তিনি হারাতে রাজি নন। যুদ্ধের সময় এশিয়ার কলোনিগুলোতে স্বাধীনতার দাবি প্রবল হয়ে উঠেছে, তার তিনি তোয়াক্কা করেন না। বিশেষত ভারতের ব্যাপারে তিনি অতিশয় স্পর্শকাতর। রুজভেল্ট ঔপনিবেশিকতাবাদের বিরুদ্ধে। কারণ আমেরিকাই তো ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে ছিন্ন হয়ে স্বাধীন হয়েছে। তিনি সাম্রাজ্যবাদেরও সমর্থক নন, (যদিও পরবর্তীকালে আমেরিকা অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের অধীশ্বর হয়, কিন্তু তখন সে প্রশ্ন ওঠেনি।) এবং ভারতের স্বাধীনতার দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল। চার্চিল সে প্রসঙ্গ উত্থাপনই করতে দিতে চান না। বর্মা যুদ্ধও নিজেরাই লড়ে সেখানে ইংরেজ রাজশক্তির সম্মান রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর।

এরপর চিয়াং কাইসেককে বাদ দিয়ে চার্চিল ও রুজভেল্ট পৌঁছলেন তেহরানে। তেহরান নোংরা ঘিঞ্জি শহর। রাস্তাগুলো সরু সরু, বহু রকম গুপ্তচররা সেখানে গিজগিজ করছে। তিন প্রধানকে হত্যা করারও চেষ্টা হতে পারে। তাই রাশিয়ার পক্ষ থেকে রুজভেল্টকে অনুরোধ জানানো হল রুশ দূতাবাসে আতিথ্য গ্রহণ করার জন্য। রুশ দূতাবাস অনেক বড়, অতিশয় সুরক্ষিত, দাঁত খোঁচাবার খড়কে যে এনে দেয় সেও আসলে পিস্তলধারী গোয়েন্দা।

রুজভেল্ট রাজি হলেন। রাশিয়ার দূতাবাসে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট! এই মহামান্য অতিথির কী খাতির! চার্চিল আসবার আগেই স্তালিনের সঙ্গে দেখা হল রুজভেল্টের। ধনতন্ত্র ও সাম্যবাদের দুই প্রতিভূর এই প্রথম মুখোমুখি সাক্ষাৎকার। পটভূমিকায় হিটলার, তাই দু’জনে এত কাছাকাছি এসেছেন, দু’জনেই সৌজন্য ও আন্তরিকতার প্রতিমূর্তি।

সারা বিশ্বের যুদ্ধ পরিস্থিতি আলোচনা করতে করতে এশিয়ার উপনিবেশগুলির প্রসঙ্গ আসতেই রুজভেল্ট বললেন, খবরদার, ভারতের সমস্যা নিয়ে যেন চার্চিলের কাছে কথা তুলবেন না। স্তালিন মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ, এই বিষয়টা অবশ্যই অস্বস্তিকর। রুজভেল্ট বললেন, একেবারে তলা থেকে ভারতের সংস্কার প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত, স্তালিন বললেন, তলা থেকে সংস্কার মানে বিপ্লব!

এর পর ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে ভারতের প্রসঙ্গ উঠল না, ইউরোপীয় যুদ্ধ পন্থাই গুরুত্ব পেল৷ ভারতে যে কী অবস্থা চলছে, তা কিছুই জানতে পারলেন না দুই শীর্ষ নেতা। সেখানকার গণ-আন্দোলন, সেখানকার দুর্ভিক্ষের কথা চাপা পড়ে রইল।

যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ মানুষ মরে। কেউ সৈনিক হিসেবে প্রাণ দেয়, কেউ দেশ রক্ষার জন্য আত্মদান করে। আর লক্ষ লক্ষ ভারতীয়, যাদের সঙ্গে যুদ্ধের কোনও সংস্রব নেই, যারা কখনও অস্ত্র ধরেনি কিংবা ধরতে জানে না, তারা প্রাণ দিতে লাগল শুধুমাত্র খাদ্যের অভাবে। রাস্তায় রাস্তায় কঙ্কালসার মৃতদেহ। খিদের জ্বালায় মা বিক্রি করে দিচ্ছে ছেলেমেয়ে, স্বামী বিক্রি করে দিচ্ছে স্ত্রীকে। তবু তারা বাঁচবে না। উপবাস ডেকে আনে নানারকম ব্যাধি, তার কোনও চিকিৎসা নেই। অন্তত সাতাশ লক্ষ নারী-পুরুষ-শিশু প্রাণ হারাল তেতাল্লিশ সালের এই কৃত্রিম দুর্ভিক্ষে। অকারণ। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কোনও ইতিহাসে এদের কথা লেখা থাকবে না।

পাঁচ

টাউন স্কুলের শিক্ষক কালীপদ গঙ্গোপাধ্যায় মাইজপাড়া গ্রাম থেকে তাঁর স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের আনিয়ে নিলেন কলকাতায়। সেখানে তারা অনাহারের সম্মুখীন হয়ে পড়েছিল। অনাচারের বিপদের সম্ভাবনাও কম ছিল না।

জাপানি আক্রমণের ভয়ে যেমন বহু মানুষ শহর ছেড়ে পালিয়েছে দূরে, তেমনই হাজার হাজার মানুষ ছুটে আসছে কলকাতার দিকে। এরা সব ক্ষুধার্ত, নিরন্ন নারী-পুরুষ-শিশু। গ্রামে খাদ্য নেই, শহরে কিছু না-কিছু পাওয়া যাবেই, এই আশায়। কলকাতার মতন পরিচ্ছন্ন, শোভন-সুন্দর শহরে এই প্রথম দেখা গেল পথে শুয়ে থাকা এত মানুষ। তাদের সমস্ত রকম জৈবিক প্রক্রিয়া সারা হয় এই পথের সংসারে।

ব্ৰহ্মদেশ বা বার্মা অধিকার করে বসে আছে জাপানিরা। বাঙালিরা বার্মাকে বলে বর্মা। ভীষ্মলোচন শর্মা যখন গান ধরেন, তখন সেই আওয়াজ শোনা যায় দিল্লি থেকে বর্মা। এই বর্মা মুলুক বাঙালিদের কাছে বেশ পরিচিত, সেখানে প্রচুর বাঙালির বসতি, অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্যে গুছিয়ে বসেছিল, জীবিকা বা ভাগ্যসন্ধানী যুবকেরা বর্মায় পাড়ি দিত, যেমন গিয়েছিলেন শরৎচন্দ্র। জাপানি হানার পর ভয় পেয়ে সেখান থেকে পালাতে শুরু করল বাঙালি তথা ভারতীয়রা। শুধু ভয় নয়, ভারতীয়-বিতাড়নও শুরু হয়েছিল। পলাতকদের অনেককেই আসতে হয়েছে পায়ে হেঁটে, বর্মা ও অসমের দুর্গম, বিপদসঙ্কুল পাহাড় ও জঙ্গল পেরিয়ে, বেশ কিছু মানুষ শেষ পর্যন্ত পৌঁছতেও পারেনি। সেই উদ্বাস্তু ও শরণার্থীরাও আশ্রয় নিতে লাগল কলকাতায়।

জাপানিরা সেই যে খেলাচ্ছলে একবার বোমা ফেলে দিয়েছিল, আর তাদের পাত্তা নেই। কলকাতা দখল করতে চায় কি না, সে ব্যাপারে যেন মনস্থির করতে পারেনি। শহরের অবস্থা অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে, কিছু কিছু স্কুল কলেজ খুলেছে, আমার বাবা এর মধ্যে এখানে-সেখানে টুকিটাকি পার্ট টাইম কাজ করে কোনওক্রমে চালাচ্ছিলেন, স্কুলের চাকরিটা আবার ফিরে পেলেন। এবারেই এসে আমরা উঠলাম গ্রে স্ট্রিটের (এখন শ্রীঅরবিন্দ সরণি। অরবিন্দ ঘোষ ওই রাস্তারই একটি বাড়ি থেকে গ্রেফতার হন) একটা উপ-পথ, দুর্গাদাস মুখার্জি স্ট্রিটের একটি বাড়িতে। একতলায় দু’খানা ঘর, আলো-বাতাস প্রায় বর্জিত। পূর্ববঙ্গের লোকেরা দেশের বাড়িটাকে মনে করত আসল বাড়ি, শহরের ভাড়াবাড়িকে বলে বাসা। আমার স্কুলের বন্ধুরা ঠাট্টা করে, তোরা কি পাখি যে বাসায় থাকিস? বাঙাল-ঘটির ঝগড়া নিত্য তিরিশ দিনের, তবে তা সীমাবদ্ধ থাকত রঙ্গ-ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে, কখনও কখনও হাতাহাতিতেও পর্যবসিত হত মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের খেলার মাঠে।

খাঁটি কলকাতার লোকরা বাঙালদের খানিকটা নিচু চোখে দেখত, মনে করত তারা অমার্জিত, যদিও বাঙালদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিতের সংখ্যা এদিককার চেয়ে বেশি। তবু এরকম একটা ধারণা গড়ে ওঠার কারণ, খোলামেলা জায়গায় মানুষ বলে বাঙালরা সাধারণত চেঁচিয়ে কথা বলে, কারুর কারুর অতি তুচ্ছ কথাও ধমকের মতন শোনায়। কলকাতা তথা নদীয়া-কৃষ্ণনগরের ভাষা বাংলা সাহিত্যের স্ট্যান্ডার্ড ভাষা বলে গৃহীত হয়েছে। সেই তুলনায় পূর্ববঙ্গের জেলাগুলির ভাষাকে গ্রাম্য ও অপরিশীলিত মনে হয়। বঙ্কিমবাবু থেকে অনেক লেখকই বোকা বা ভাঁড় ধরনের চরিত্রের মুখে বাঙাল ভাষা বসিয়েছেন। দেশ ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন জেলার ভাষা নিয়ে যাতে কোন্দল শুরু না হয় সেজন্য বিখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক ডক্টর শহীদুল্লা সাহিত্যে প্রচলিত কৃষ্ণনগরের ভাষাকেই সেখানকার স্ট্যান্ডার্ড ভাষা হিসেবে গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিলেন, তাঁর সেই দূরদর্শিতার জন্য খণ্ডিত বাংলার দুই দিকেই সাহিত্যের ভাষা একই বাংলা, বাড়ির বাইরের ব্যবহারিক ভাষাও প্রায় এক।

আমাদের পাশের ঘরে থাকতেন দুই যুবক, অশোকরতন ও প্রফুল্লরতন নামে দুটি কলেজের ছাত্র। এদের পদবি গঙ্গোপাধ্যায় হলেও আমাদের সঙ্গে কোনও পারিবারিক সম্বন্ধ ছিল না, গ্রাম সম্পর্কে আত্মীয়। পূর্ববঙ্গের অজ পাড়াগাঁর ছেলেরা কলেজে পড়ার জন্য চলে আসত কলকাতায়, চেনাশুনো কারুর বাড়িতে পেয়িং গেস্ট হয়ে থাকাই তার বেশি পছন্দ হত, না পেলে অগত্যা মেসে বা হস্টেলে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবেই, এই দৃঢ় জেদে পড়াশুনোয় খুব মনোযোগী হত। দু’জনকে দিনরাত পড়তে দেখতাম। অশোকরতন কৃতবিদ্য হয়েছিলেন, প্রফুল্লরতন হয়েছিলেন ‘যুগান্তর’ পত্রিকার সাংবাদিক এবং ইউনিয়নের কেউকেটা। তখন অবশ্য তাঁর সাংবাদিকতার দক্ষতা কিংবা রাজনীতিপ্রবণতার কোনও প্রমাণ পাইনি, তবে হঠাৎ এক এক দিন তিনি ঘরের আলো নিবিয়ে, জানলার ধারে দাঁড়িয়ে উচ্চৈঃস্বরে গান গাইতেন। বড় করুণ সেই গানের সুর, তাতে ফুটে উঠত গ্রামজীবনে ফিরে যাবার ব্যাকুলতা।

সেবারে কলকাতায় এসে আমারও খুব মন কেমন করত গ্রামের জন্য। খাওয়াদাওয়ার কষ্ট ছিল, চোর-ডাকাতের উপদ্রবে হয়তো আর বেশি দিন টেঁকা সম্ভব হত না, তবু সেই জলাভূমি, পাটখেতে লুকোচুরি, নৌকো ভ্রমণ ও অনেকখানি যখন-তখন রং বদলানো আকাশ মন জুড়ে বসেছিল, ইস্কুলটাও পছন্দ হয়েছিল খুব। একজন সহপাঠীর কথা কোনও দিনই ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়। আমারই পাশে বসত সে, তার নাম ইয়াকুব, সাদামাটা চেহারা, চোখ দুটি জুলজুলে ধরনের, তার মতন মিথ্যেবাদী কেউ কখনও দেখেনি। আমার চেয়ে দু’এক বছরের বড়, অর্থাৎ দশ কি এগারো, ওই বয়েসেই এমন দুর্ধর্ষ মিথ্যেবাদী সারা পৃথিবীতেই দুর্লভ। সে সত্যি কথা বলবেই না যেন প্রতিজ্ঞা করেছে। সে পুঁটি মাছের ঝাল খেয়ে এসে বোয়াল মাছের ঢেঁকুর তোলে। তার স্কুলে আসতে দেরি হয়, কারণ রাস্তায় একটা বুনো ভাল্লুক তাকে তাড়া করে। হাসিমারা নামের কোনও এক সুদূর স্থান থেকে তার চাচা একটা হরিণ এনে বাড়িতে রেখেছে, আমরা সদলবলে দেখতে গিয়ে জানতে পারি, তার এক কাকা হাট থেকে একটি ছাগল কিনে এনেছেন। তাদের পুকুরে কুমিরের উপদ্রব হয়েছে, এ গল্পটাও সে প্রায় বিশ্বাসযোগ্য করে তুলেছিল। মিথ্যে কথা বলার জন্য সে মারও কম খায়নি, শিক্ষকদের হাতে, সহপাঠীদেরও, তবু সে মিথ্যে ছাড়বে না। আমি কিন্তু ইয়াকুবের প্রতি ক্রমশ আকৃষ্ট হয়ে পড়েছিলাম। কোনও এক রহস্যময় কারণে ওই এগারো বছরের ছেলেটি বাস্তবকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে সর্বক্ষণ কল্পনার জগতে থাকতে চায়। আমরা যে-সব স্বপ্ন দেখি, সে তো আমাদের নিজেদেরই রচনা, ইয়াকুব জাগ্রত অবস্থাতেও নতুন নতুন দৃশ্য তৈরি করে। আমরা বর্ষার আকাশে শুধু বৃষ্টিই দেখি, মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলক, ইয়াকুব দাবি করে যে একটা বিদ্যুৎ মাটিতে এসে সাদা রঙের একটা আলোর রেখা হয়ে যায়, উনুনের ধোঁওয়ার মতন সেই আলোটা তাদের বাড়ির পেছনের ছাইগাদায় ঢুকে যায়, তারপরই সেখানে স্পষ্ট শোনা যায় একটা বাচ্চা মেয়ের খিলখিল হাসির শব্দ। ইয়াকুব নিজের কানে অন্তত তিনবার শুনেছে। আমার পাশে বসে সে ফিসফিস করে বলে যায় এইসব কাহিনী। নির্মাণে তার কোনও ক্লান্তি নেই। ইয়াকুবের বাবাকে দেখেছি, পোস্ট অফিসের পিওন, তার মা সাতটি সন্তানকে সামলাতে সারা দিন ব্যতিব্যস্ত। ইয়াকুব একদিন আমাকে বলল, ওঁরা দু’জন ওর আসল বাবা-মা নন। সে সিলেটের এক নবাববাড়ির সন্তান, ডাকাতরা সে বাড়ি আক্রমণ করে অনেক ধনরত্ন সমেত তাকেও সঙ্গে নিয়ে চলে যায়। কিছুদিন তাকে রাখা হয় এক পাহাড়ের গুহায়, সেখানে তাকে পাহারা দিত একটা চিতাবাঘ, তারপর একদিন সাহেব পুলিশরা হানা দেয় সেই ডাকাতদের ডেরায়, চিতাবাঘটা গুলি খেয়ে মরে, ডাকাতরা পালায়, পুলিশরা তাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। তারপর কোনও পরিবারে তাকে রাখা হলে হাজার টাকা ইনাম দেওয়া হবে শুনে বদরু মিঞা তাকে নিয়ে আসে বাড়িতে। এটা গল্পের বইয়ের মতন মনে হওয়ায় আমি সন্দেহ প্রকাশ করতেই সে আমাকে ধমকে দিয়ে বলে, তুই যাদের বাবা-মা বলে ডাকিস, তারা যে তোর সত্যি বাবা-মা, তা কি তুই হল্ফ করে বলতে পারবি? ইয়াকুবের কাছে একটা লকেট আছে, সেটাই প্রমাণ যে সে নবাব বংশের ছেলে, একদিন না একদিন সে ঠিক নিজের অধিকার আদায় করে নেবে। সত্যি হোক বা না হোক, কাহিনীটা আমার মনের মধ্যে গুঞ্জরিত হতে থাকে, স্পষ্ট যেন দেখতে পাই, মশাল নিয়ে হইহই করে ছুটে আসছে দস্যুদল, একটা শিশুকে কোলে নিয়ে ছুটছে, একটা গুহার সামনে গরগর করতে করতে ঘুরছে একটা চিতাবাঘ…..। শুধু তাই নয়, ইয়াকুবের মিথ্যে শুনতে শুনতে আমার কাছেও অনেক মিথ্যে সত্য হয়ে ওঠে, একটা ছাগলছানাকে দেখে হঠাৎ মনে হয় হরিণশিশু, একটা নিস্তরঙ্গ বিরাট দিঘির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে মনে হয়, এই বুঝি এক্ষুনি একটা কুমির ভেসে উঠবে, বিদ্যুৎ চমকের পর মেঘগর্জন হয়, কখনও কানে তালা লাগে, তার মধ্যেই যেন শুনতে পাই কারা যেন খলখলিয়ে হাসছে।

মানুষ বয়েসের সঙ্গে পা ফেলতে ফেলতে অনেক কিছু শেখে। সব মানুষের জীবনেই বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন ব্যাপারে এক একজন দীক্ষাগুরু থাকে। আমার কল্পনা উস্কে দেওয়ার প্রথম দীক্ষাগুরু ওই ইয়াকুব। সারাজীবনে তাকে আর কখনও দেখিনি।

কলকাতায় এসে আমাদের আর আহারের চিন্তা রইল না। শিক্ষকরা হতদরিদ্র শ্রেণীর হলেও তাঁদের একটা সামাজিক সম্মান ছিল। মূল্যবান বেশ-ভূষা সজ্জিত জবরদস্ত ধরনের ব্যক্তিও রাস্তায় মলিন চেহারার প্রাক্তন শিক্ষককে দেখলে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। ছাত্রদের অভিভাবকরা শিক্ষকদের কোনও প্রয়োজনে সাহায্য করে স্বেচ্ছায়। মুদির দোকান ধার দেয় শিক্ষকদের। শিক্ষকের ছেলেমেয়েদের স্কুলে পড়ার মাইনে লাগে না। বাজারদরের চেয়ে কমে বাবা চাল জোগাড় করে আনতেন, প্রায়ই রাত্রিবেলা টিউশানি সেরে তিনি বাড়ি ফিরতেন চালের থলি হাতে নিয়ে। একটা মস্ত বড় মাটির জালা কেনা হল, তাতে জমা হতে লাগল চাল, ভবিষ্যতে আরও কত দুর্দিন আসবে তা কে জানে! তবু গম নামে বস্তুটি এই প্রথম বাঙালির হেঁশেলে প্রবেশ করল। আটা নয়, ময়দা নয়, আস্ত গম, তা নিজেদেরই ভাঙাবার ব্যবস্থা করতে হয়। বিশেষত পূর্ববঙ্গের লোকেরা ভাত ছাড়া অন্য কিছুকে প্রধান খাদ্য মনে করে না। পাঁচখানা রুটি কিংবা দশখানা লুচি বা পুরি খেলেও মনে করে, এ তো জলখাবার, এরপর ভাত খেতেই হবে। কিন্তু অবস্থার বিপাকে এখন একবেলা ভাত, একবেলা রুটি চালু হয়ে গেল। চালের বদলে আস্ত গমের সঙ্গে ডাল মিশিয়ে একরকম খিচুড়িও তৈরি হয়, তার নাম ডালিয়া, তা নাকি খুবই পুষ্টিকর, কিন্তু স্বাদে কী আর আসল খিচুড়ির সঙ্গে তুলনা চলতে পারে!

দুপুরবেলা পিঁড়ি পেতে খেতে বসলেই বাইরে রব শুনতে পাই, মা, দুটি ভাত দাও! মা, একটু ফেন দাও! অন্য সময়েও পথে পথে এই একই রব, সারাক্ষণই, এমনকী গভীর রাত্তিরেও, কিন্তু নিজেরা ভাতের থালার সামনে বসলে এই আর্তচিৎকার বেশি বেশি কানে লাগে, খাদ্য বিস্বাদ হয়ে যায়। ভিখারিরা এখন আর পয়সা চায় না, শুধু ভাত কিংবা ফেন চায়। আমাদের খেতে দেবার আগে মা এক থালা ভাত কোনও একটি ভিখারি পরিবারকে দিয়ে আসেন, অনেক গৃহস্থই এরকম দিয়ে কিছুটা বিবেকের দায় মুক্ত হয়, তারপর বন্ধ রাখতে হয় সব দরজা জানালা, যাতে ওই কাতর স্বর আর কানে না আসে৷

রাস্তায় যদি একজন মানুষকে অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকতে দেখা যায়, তবে তাকে সাহায্য করার জন্য কেউ কেউ এগিয়ে আসে। কিন্তু শত শত ক্ষুধার্ত, বিপন্ন মানুষকে পড়ে থাকতে দেখলে লোকে পাশ কাটিয়ে এড়িয়ে যায়, না দেখার ভান করে। দয়া, মায়া, মমতা এইভাবে শুকিয়ে যেতে থাকে। আমরা স্কুলে যাবার সময় দেখতে পাই, ফুটপাথে শুয়ে কাতরাচ্ছে কত শত কঙ্কালসার নারী ও পুরুষ, প্রথম প্রথম বুকের মধ্যে কী রকম যেন করত, তা কি ভয় না অনুকম্পা, না অপরাধবোধ কে জানে, কিংবা সব মিলিয়ে একটা অনুভূতি। কিছুদিন পর গা-সহা হয়ে যায়। অনেক সময় ওদের ডিঙিয়ে রাস্তা পার হতে হয়। কোনও কোনও গৃহস্থ ঝাঁটা হাতে নিয়ে নিজেদের বাড়ির সদর দরজার সামনে থেকে ভিখিরি পরিবারদের বকে বকে সরিয়ে দেয়।

না খেতে পেয়ে মানুষ জীর্ণ শীর্ণ হয়ে যায়, কিন্তু দেখেছি, শিশুরা মোটা হয়, তাদের হাত-পা ফুলে যায়, পেটটা বেলুনের মতন, চোখ দুটো যেন ঠেলে বেরিয়ে আসছে, শিশুত্ব বলে কিছু থাকে না, অস্বাভাবিক চেহারা। মা কখন মরে গেছে, তার শিশু সন্তানটি তখনও মা মা বলে ডেকে তাকে ঠেলছে, এই দৃশ্যটিকে মনে হতে পারে স্টিরিওটাইপ কিংবা কষ্টকল্পিত, কিন্তু এ দৃশ্য অহরহ দেখা গেছে। চতুর্দিকে মানুষ কাঁদছে, মানুষ মরছে, আর যুদ্ধ চলছে অনেক অনেক দূরে।

চল্লিশের দশক বাংলায় মৃত্যুর দশক। কত মৃত্যু, কত হানাহানি পার হয়ে আসতে হয়েছে। যারা সেই মৃত্যুর দশক পার হয়ে আসতে পেরেছে, সেই আমরা যে কতখানি সৌভাগ্যবান, আমরা যে বেঁচে গেছি কত হত্যার পটভূমিকায়, তা আমরা অনেক সময়ই মনে রাখি না।

স্কুলের সহপাঠীদের মধ্যে আশু অর্থাৎ আশুতোষ ঘোষ আমাদের বাড়ির সবচেয়ে কাছের প্রতিবেশী। এ-ছাদ থেকে ও-ছাদ দেখা যায়, আমাদের গলি থেকে বেরিয়ে দু’পা গেলেই ওদের সদর। বড় রাস্তার ওপর বাড়ি, বনেদি দু’মহলা, দোতলায় দুটি ঝুল বারান্দা। একতলায় অনেক খালি ঘর পড়ে থাকে, দোতলায় ওঠার চওড়া কাঠের সিঁড়ি, কার্পেট পাতা, ইদানীং তা ছিঁড়ে ছিঁড়ে গেছে অবশ্য, দোতলার দীর্ঘ দালানটি সাদা-কালো মার্বেলে চকমেলানো, একটি হলঘরে পুরনো আমলের সোফা সেটি, ঝাড়লণ্ঠন, দেওয়ালে বড় আকারের কয়েকটি ছবি, ইউরোপীয় চিত্রকরদের, আসল নয়, কপি। খাঁটি কলকাতার কায়েত যাকে বলে, ঘোষ-বোস-মিত্তির-দত্ত ইত্যাদি, ইংরেজ আগমনের পর এঁরাই এখানকার অনেক ব্যবসা-বাণিজ্য ও ভূসম্পত্তির মালিক ছিলেন, দূরদর্শিতার অভাবে সেসব ধরে রাখতে পারেননি, অবাঙালি ব্যবসায়ীরা এসে আস্তে আস্তে সব কুক্ষিগত করে নেবার পর এই কায়স্থ কুলতিলকদের সকলেরই অবস্থা তখন পড়ন্ত, এই ঘোষবাড়িটি সেই বিগত-মহিমা সম্প্রদায়েরই অন্তর্গত।

এই বাড়িতে গিয়েই আমি কলকাতা কালচারের প্রথম স্বাদ পাই। আশুরা অনেক ভাই-বোন। একজন স্থায়ী শিক্ষক নিযুক্ত আছেন, তিনি থাকেন ও বাড়িতেই, সব ছেলেমেয়েদের পালা করে পড়ান। ওদের নিজেদেরই জন্য একটি লাইব্রেরি, পাড়ার ছেলেমেয়েরাও বই নিতে পারে সেখান থেকে। আশু ক্লাসের ভালো ছেলে, অনেক গল্পের বইও পড়ে, গান-বাজনার দিকে ঝোঁক আছে, খেলাধুলোও ভালোবাসে। আমাদের মতন গরিব বাড়িতে খাওয়া-পরার চিন্তাই প্রধান, ভবিষ্যতে চাকরি জোটানোর জন্য মন দিয়ে পড়াশুনো করতে হবে, এটাই ছিল পারিবারিক নির্দেশ, সাহিত্য, শিল্প, সঙ্গীত, খেলা এগুলিও যে জীবনযাপনের অঙ্গ, তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাবার সময় পায়নি। এর আগে আমার খেলাধুলো বলতে ছিল ঘুড়ি ওড়ানো, গলির ছেলেদের সঙ্গে ড্যাংগুলি খেলা, (গাংগুলির সঙ্গে ড্যাংগুলির বেশ মিল দেওয়া যায় বলেই বোধহয় ওই খেলাটা আমি ভালোই পারতাম)আর চু-কিত কিত। পেছন দিকের বস্তির ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা নিষিদ্ধ ছিল, তারা সোডার বোতলের ছিপি ও বাটখারা দিয়ে একটা খেলা খেলত, সেটা দেখে প্রলুব্ধ হয়ে আমি গোপনে কয়েকবার তাদের সঙ্গে ওই খেলাতে যোগ দিয়েছি। আশুদের বাড়িতে প্রশস্ত উঠোনে ব্যাডমিন্টন খেলা হয়। কিছুদিন পর ঠাকুরদালানে টেবিল টেনিসের বোর্ড বসেছিল। আশু ভালো সাইকেল চালায় বলে আমিও সাইকেল শিখতে উদ্বুদ্ধ হলাম। আমাদের বাড়িতে গল্পের বই প্রায় ছিলই না, বাবার এদিকে ঝোঁক নেই, সময়ও পেতেন না। আমার মায়ের ছিল বই পড়ার নেশা, এ-বাড়ি ও-বাড়ি থেকে চেয়েচিন্তে বই পড়তেন, আরও দু’-এক বছর পর মায়ের নামে বয়েজ ওন লাইব্রেরিতে মেম্বারশিপ নেওয়া হয়, প্রায় প্রতিদিন মায়ের জন্য দু’খানা করে বই আনতাম আমি। এবং মায়ের নেশার উত্তরাধিকার সূত্রে আমিও সে বই শেষ করি, তথাকথিত বড়দের বই হলেও কিছু যায় আসে না।

তার আগে, আশুদের বাড়ির লাইব্রেরিতে অনেক ছোটদের বই পেয়ে আমি দারুণ ক্ষুধার্তের মতন সেসব বই কামড়ে কামড়ে খেতে শুরু করেছি। আবিষ্কার করি হেমেন্দ্রকুমার রায়কে, শিবরাম চক্রবর্তীকে। দমদম মতিঝিলে আমার মায়ের মামার বাড়িতেও কিছু বই ছিল। সেখান থেকে রবীন্দ্রনাথের সঞ্চয়িতা কি আমি চুরি করে এনেছিলাম? নইলে বইটি আমার সম্পত্তির অন্তর্গত হল কী করে, কেনার তো পয়সা ছিল না! যাই হোক, এতদিন পরে সেই চুরির স্বীকারোক্তি দিয়েই বা লাভ কী!

রবীন্দ্রনাথেরও আগে নজরুল ইসলামের কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। একজন মাস্টারমশাই কেন যেন ধরে নিয়েছিলেন যে আমার মধ্যে একজন সফল আবৃত্তিকার হবার বিরাট সম্ভাবনা আছে। তিনি নজরুলের ভক্ত, আমাকে নজরুলের কবিতা মুখস্থ করাতেন এবং বিভিন্ন পাড়ার জলসায় আমাকে উপস্থিত করাতেন শিশুশিল্পী হিসেবে। অল্পকালের মধ্যেই আবৃত্তিকার হিসেবে আমার বেশ নাম হয়েছিল। একটা গুট্লে মতন ছেলে মাথা নেড়ে নেড়ে নজরুলের লম্বা লম্বা কবিতা মুখস্থ বলছে দেখেই সবাই হাততালি দিত। মনে আছে, একবার ছায়া সিনেমার মঞ্চে একটা বড় ধরনের জলসায় আমার আবৃত্তি শুনে মুগ্ধ হয়ে সামনের সারির একজন দর্শক উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে একটা মেডেল দেবেন বলে ঘোষণা করলেন। (ওই ঘোষণাই সার, সে মেডেল কখনও হাতে পাইনি। সেই সময় অনেক থিয়েটারে, গানের আসরে দর্শকদের মধ্য থেকে হোমরা-চোমরা কেউ এক এক জনের নামে মেডেল ঘোষণা করতেন। সে মেডেল ক’জন সত্যি সত্যি পেতেন, তাতে সন্দেহ আছে।)

কয়েক বছর পর ওই মাস্টারমশাই আমাকে নজরুলের কাছেও নিয়ে গিয়েছিলেন। সেদিন কবির জন্মদিন। নজরুল ইসলাম কী অবস্থায় আছেন, কথা বলতে পারেন কি না তা আমি তো কিছুই জানি না। জন্মদিনে অনেক লোক, প্রচুর ফুল, কেউ কেউ কবিকে নানা কথা জিজ্ঞেস করছে, তিনি কোনও উত্তর দিচ্ছেন না। কবির চোখের দৃষ্টি যে অস্বাভাবিক, তা একটি বালকও বোঝে। মাস্টারমশাইটি আমার পিঠে খোঁচা মেরে বলছিলেন, শোনা, শোনা, কবিকে তোর আবৃত্তি শোনা! আমার ভয় ভয় করছিল, মাস্টারমশাইয়ের তাড়নায় মুখ খুলবার আগেই কবি গলা থেকে ফুলের মালা ছিঁড়ে ছিঁড়ে ছড়াতে লাগলেন রাগত ভঙ্গিতে। ঘরের মধ্যে হুলুস্থূল পড়ে গেল।

নজরুল ইসলামকে সেই একবারই আমি স্বচক্ষে দেখেছি। আমার আবৃত্তিকার হয়ে ওঠার সম্ভাবনারও সেদিনই সমাপ্তি। সেই মাস্টারমশাইয়ের শত অনুরোধেও আমি জেদ ধরে থেকে আর কোনও জলসায় যাইনি।

আশুর বাবা অমিয়নাথ ঘোষ খুব সুপুরুষ ছিলেন। স্বল্পভাষী, দীর্ঘকায়, সঙ্গীতপ্রিয়। প্রতিদিনই বাড়ি ফেরার পথে তিনি কিছু না-কিছু বই কিনে আনতেন। এবং তাঁর মতন মধ্যবয়েসি লোকের পক্ষে যেটা স্বাভাবিক নয়। তিনি স্টল থেকে কিনে আনতেন নতুন নতুন পত্রিকা। এখন যাকে বলে লিট্ল ম্যাগাজিন। ছেলেমেয়েদের জন্য নয়, ওগুলি তিনি নিজেও পড়তেন। ও বাড়িতে যাওয়া-আসা শুরু করে অনেক পত্র-পত্রিকার নাম আমি জানতে পারি। ‘দেশ’ পত্রিকা সেখানেই প্রথম দেখি।

আশুর ঠাকুমা তখনও জীবিত। তাঁকে দেখা ও তাঁর কথা শোনা এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। ঠিক যেন মহারানি ভিক্টোরিয়ার এদেশি সংস্করণ। যেমন ফর্সা রং, তেমনই বড়সড় চেহারা। ভিক্টোরিয়ার কণ্ঠস্বর কেমন ছিল আমি জানি না, এঁর গলার আওয়াজ বাজখাঁই। একটা ধমক শুনলে বুক কেঁপে উঠত। এঁর কথা বলার ভঙ্গি আমার মনে গেঁথে আছে, পরবর্তীকালে ‘সেই সময়’ রচনার সময় কাজে লেগেছিল। এখন অত্যধিক বাঙালদের সংস্পর্শে খাঁটি কলকাতার ভাষা অনেকটা বদলে গেছে। নুচি, নেবু, নঙ্কা এখন আর শোনাই যায় না। বাঙাল ও ঘটিদের মধ্যে চন্দ্রবিন্দুগত পার্থক্য তো ছিলই, তা ছাড়াও ল ও ন এবং চ ও ছ-এর ব্যবহারবিধি বেশ কৌতূহলজনক। এদিকে ল সম্পর্কে দারুণ অনীহা। শুধু নুচি নেবু নঙ্কা নয়, লুকিয়ে হয়ে যেত লুকিয়ে, লাফানোর বদলে নাপানো, লেপ-এর বদলে নেপ৷ স্নানকে বাঙালরা বলে সান, কলকাতায় বলে চান। ছাপার অক্ষরে লেখা থাকে বিছানা, বাঙালরা বলে বিসানা, ঘটিরা বলে বিচ্না। করিচি, খেয়িচি, বলিচি তো আছেই, পালিয়িচি, ফুঁড়েচি, সব ছ-বর্জন। শুধু ছি-ছি করার সময় কেউই চি-চি বলে না।

ছাপার অক্ষর ও মৌখিক উচ্চারণ সম্পর্কে একটি ক্ল্যাসিক গল্প আছে বরিশাল জেলা সম্পর্কে। বরিশালে বেড়ালকে বলে মেকুর। স্কুলের ছাত্রপাঠ্য বই দেখে জোরে জোরে উচ্চারণ করে, ব-এ রস্বই, ড-এ শূন্য রয়ে আকার, আর ল-মেকুর!

মাইজপাড়া থেকে ফেরার পর কয়েক মাস বাদে জাপানিদের আবার কী খেয়াল হল, কলকাতায় কয়েকটা বোমা ফেলে গেল। আমাদের বাড়ির কাছেই হাতিবাগান বাজার, তার পেছনে খাটাল, শোনা গেল, সেই খাটালে একটা বোমা পড়ে পঞ্চাশটা মোষ মারা পড়েছে। এরকম বোমা তো কৌতুকের বিষয় হতেই পারে। বোমা নিয়ে অনেক ছড়া প্রচলিত হয়েছিল, তার মধ্যে একটি হল ‘সা-রে-গা মা-পা-ধা-নি, বোম ফেলেছে জাপানি/বোমের মধ্যে কেউটে সাপ/ ব্রিটিশ বলে বাপরে বাপ! এই ছড়ার ভাবার্থেই প্রকাশ, সাধারণ মানুষ মনে করে জাপানিরা ভারতীয়দের মারতে চায় না, বোমা ফেলে ব্রিটিশদেরই ভয় দেখাতে চায়।

জাপান সারা এশিয়ার গর্ব। জাপান কখনও পরাধীন হয়নি, বরং এই শতাব্দীর শুরুতেই জাপান রাশিয়াকে যুদ্ধে হারিয়ে প্রমাণ করেছে যে শ্বেতাঙ্গ সৈন্যরা অপরাজেয় নয়। বৌদ্ধধর্মের সূত্রে ভারতের সঙ্গে জাপানের একটা আত্মিক সম্পর্কও আছে। বাণিজ্য বিস্তারে জাপান টেক্কা দিয়েছে আমেরিকাকে, ইংরেজদের ঘাঁটি কেড়ে নিয়েছে একটার পর একটা, এতে পরাধীন ভারতীয়দের সুখানুভূতি হয়। কিন্তু এই যুদ্ধে জাপান নাত্সি জার্মানির সঙ্গে হাত মিলিয়ে যেভাবে হিংস্র আগ্রাসী ভূমিকা নিয়েছে, তাতে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তাকে মানব সভ্যতার শত্রু হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত। কিন্তু ভারত সমেত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলি, যেখানে ইংরেজ-ফরাসিরা উপনিবেশ গেড়ে বসে আছে, সেই দেশগুলির অধিকাংশ মানুষের মনোভাব সে রকম নয়। স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাই তাদের কাছে প্রধান। শত্রুর যে শত্ৰু, সে আমার বন্ধু হতে পারে, এই নীতিই অনেকের মনে অনুরণিত হয়। এমনকী রক্তলোলুপ হিটলারকেও ভারতের বহু মানুষ নরদানব মনে করে না, জার্মানরা বোমা মেরে লন্ডন শহর গুঁড়িয়ে দিচ্ছে জেনে তারা খুশি, বেশ কিছু পুরুষ হিটলারি গোঁফ রাখতেও শুরু করেছে।

ভারতের রাজনৈতির অবস্থাও বিভ্রান্তিকর। চার্চিল-সরকার যুদ্ধের প্রয়োজনে ভারতীয় রসদ ব্যবহার করলেও পূর্ণ স্বাধীনতার প্রতিশ্রুতি দিতে কিছুতেই রাজি নয়। অনেক আলাপ-আলোচনা ব্যর্থ হবার পর গাঁধীজি অসহযোগ আন্দোলনে ভারত ছাড়ার ডাক দিয়েছেন। সে-আন্দোলন অহিংস থাকেনি, বহু জায়গায় রেল স্টেশন, ডাকঘর, থানা আক্রান্ত হয়েছে, ইংরেজ রাজশক্তির সরাসরি মুখোমুখি হয়েছে ভারতীয় জনতা। গাঁধীজি সমেত কংগ্রেসের প্রধান নেতারা সবাই নিক্ষিপ্ত হলেন কারাগারে। কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ছিল, তাদের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হল, কারণ তাঁরা অসহযোগ আন্দোলনের বিরোধী, স্তালিন-রুজভেল্ট-চার্চিল হাত মিলিয়েছেন বলে এই যুদ্ধ তাঁদের কাছে ফ্যাসিবিরোধী জনযুদ্ধ এবং ভারতে ইংরেজদের যুদ্ধব্যবস্থার সমর্থক। কমিন্টার্নের প্রভাবে কমিউনিস্ট পার্টি সোভিয়েত রাশিয়ার সব ব্যাপারে সমর্থক, দেশে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের কথা তাঁরা বিবেচনার মধ্যেই আনেননি। কংগ্রেস নেতারা জেলে বন্দি আর কমিউনিস্ট পার্টি মুক্ত, এ যেন ইংরেজদের পরিহাস। অনেক পরে এজন্য কমিউনিস্ট পার্টিকে আত্মসমালোচনা ও ত্রুটি স্বীকার করতে হয়েছিল।

অল্প সংখ্যক হলেও দ্বিতীয়বার জাপানি বোমাবর্ষণে আবার ডামাডোল শুরু হয়ে গেল। আবার স্কুল বন্ধ অনির্দিষ্টকালের জন্য। গ্রামে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এবার বাবা আমাদের পাঠিয়ে দিলেন কাশীতে। সেখানে আমাদের এক পিসিমা-পিসেমশাই ছিলেন, তাঁদের অবস্থা এমন নয় যে তাদের কাছে আশ্রয় নেওয়া যায়, কাছাকাছি একটি বাড়ি ভাড়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। কাশীতে জিনিসপত্রের দাম সস্তা, বাড়ি ভাড়াও সহজলভ্য।

দশাশ্বমেধ ঘাটের কাছেই একটি পুরনো পাথরের বাড়িতে তিনতলায় দেড়খানা ঘর। এসব বাড়ির একতলা এমনই অন্ধকার যে মনুষ্য বাসের অযোগ্য। সরু সিঁড়ি। চৌকো উঠোনের ওপর প্রত্যেক তলায় লোহার শিক দিয়ে ঢাকা। বাড়ির সামনের গলিগুলো গোলকধাঁধার মতন। গলির গলি তস্য গলি। এক একটা গলি সম্পূর্ণ জুড়ে ষাঁড় শুয়ে থাকে, তাদের মেরেধরে সরাবার প্রশ্নই নেই, বিশ্বনাথের এই শহরে ষাঁড়েরা প্রণম্য, ললাকেরা হাত জোড় করে অনুরোধ জানায়, বলীবর্দ প্রভুটি মর্জিমতন উঠে গেলে পথ মুক্ত হয়। এই প্রসঙ্গে একটা রসিকতাও চালু ছিল। এক গলিতে শুয়ে ছিল এক গাধা। গাধাও কৃষ্ণের জীব, তাকে মারা যাবে না। এক ভক্তিমান মাড়োয়ারি ভদ্রলোক গাধাটির সামনে হাত জোড় করে বসেছিলেন, আপ তো আপই হায়, হঠ যাইয়ে! অর্থাৎ অন্য কেউ শুয়ে থাকলে গালাগালি দিয়ে বলতাম, এই গাধা, সরে যা। কিন্তু আপনি তো আপনিই!

সেই আমার প্রথম প্রবাসের অভিজ্ঞতা। অনেক দূরের ট্রেন যাত্রা, প্রকৃতির পরিবর্তন, নরম মাটির বদলে পাথরের দেশ, দিগন্তের পটভূমিকায় প্রথম পাহাড়। ইস্কুল নেই, পড়াশুনোর ধার ধারি না, কাশীর গলিতে গলিতে ঘুরে বেড়াই, বিকেল হলেই গঙ্গার ধারে গিয়ে কথকদের মুখে রামায়ণ পাঠ শুনি।

এই অংশটা লিখতে লিখতে মনে হচ্ছে, পথের পাঁচালীর অপুর সঙ্গে খুব মিলে যাচ্ছে না? সত্যজিৎ রায়ের ফিল্মের দৃশ্য আমি অনুকরণ করছি? তা তো নয়, সত্যিই তো যুদ্ধের সময় কয়েক মাস আমরা কাশীতে ছিলাম। কাশীর পটভূমিকা থাক বা না থাক, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই একটা অপু আছে। আসল অপুর সঙ্গে তফাত এই, দুর্গার মৃত্যুর পর অপুর আর কোনও ভাই-বোন ছিল না। আমরা চার ভাই-বোন। বাবা কলকাতায়, আমিই পরিবারের প্রধান। সকালবেলা বাজার করে আনি। বাজারের খরচ বাঁচিয়ে কিনে আনি দু’পয়সায় এক খুরি রাবড়ি। একই খুরি থেকে চার ভাই-বোন চুমুক দিয়ে খেতে পারে।

মীরার দ্বিতীয় ছেলে অনিল বরাবরই শান্ত প্রকৃতির। তৃতীয় ছেলে অশোক ছটফটে, দুরন্ত। সবাই বিকেলবেলা দশাশ্বমেধ ঘাটে যায়, সন্ধে পার করে ফেরে। দশাশ্বমেধ ঘাটে প্রত্যেক বিকেলেই যেন মেলা বসে যায়, কত রকম মানুষ, কত রকম পসরা, গঙ্গার বুকে ভেসে যাওয়া বজরায় শোনা যায় নৃত্যগীত। বাঙালি কথকরা নাটকীয়ভাবে রামায়ণ পাঠ করেন, হঠাৎ এমন এক জায়গায় থামেন যে দারুণ কৌতূহল নিয়ে পরের দিন আসতেই হবে। মীরা এক কথক ঠাকুরের সামনে আগেভাগে এসে রোজ বসেন, মেয়েটি থাকে তাঁর কোলে। ছেলেরা কেউ কথকতা শোনে, কেউ এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায়। একদিন হঠাৎ দেখা গেল, অশোক ধারেকাছে নেই খোঁজ খোঁজ খোঁজ, ঘাটের কাছে শোনা যাচ্ছে কীসের যেন গোলমাল। দুরন্ত অশোক লাফালাফি করতে গিয়ে জলে পড়ে গেছে।

শীতকাল, কাশীর শীত দারুণ শীত, এ সময় কেউ জলে নামতে চায় না। মীরার বড় ছেলেটি ভাল সাঁতার জানে, ছোট ভাইয়ের প্রায় ডুবন্ত হাত দেখেই সে চিনতে পেরে ঝাঁপিয়ে পড়ে গঙ্গায়। তখন আরও কয়েকজন ধরাধরি করে তুলে আনে অশোককে।

মীরা তখনও তন্ময় হয়ে কথকতা শুনছেন।

ছয়

আমি বারাণসীতে গেছি অনেকবার। অবশ্য জীবনের প্রথম ও দ্বিতীয়বারের মধ্যে তফাত ছিল বেশ কিছু বছরের। পরে যতবারই দেখেছি, প্রথমবারের তুলনায় মনে হয়েছে অন্য রকম, পরিবর্তন অনেকখানি। এমন ঘিঞ্জি, এমন আবর্জনাপূর্ণ, এমন কোলাহলময় তো আগে ছিল না। কিংবা সত্যিই কি বারাণসী শহর অত বদলেছে, না বদলেছে আমার চোখ? প্রথম দেখার স্মৃতিতে বারাণসী কেমন যেন হালকা হালকা, কোনও কিছুতেই বাড়াবাড়ি নেই, সময়ের গতি খানিকটা মৃদু, বাতাস অতি পরিচ্ছন্ন, পথ ও প্রাসাদগুলির কোথাও মালিন্যের চিহ্নমাত্র নেই। এ ছবিটিও কি সত্য, না বালকের টলটলে, অপাপবিদ্ধ চোখে সব কিছুই সুন্দর দেখায়?

বাল্যচক্ষুতে অনেক ক্ষুদ্র জিনিসকেও যে বৃহৎ মনে হয়, সে প্রমাণ পরে অনেকবার পেয়েছি। স্কুলের খেলার মাঠটিকে মনে হত কত বিরাট, আসলে প্রয়োজনের পক্ষে অপ্রতুল। মামাবাড়ির বড় দিঘিটার ওপাশে যেন ছিল নিবিড় অরণ্য, গা ছমছমে অন্ধকার, পরে দেখেছি সেটা কয়েক বিঘের আমজামের বাগান। শৈশবের বড় বড় নদী গুলি সব মাঝারি হয়ে গেছে। যা ছিল দিগন্তবিস্তৃত, এখন তার কাছাকাছি সীমানা স্পষ্ট দেখা যায়। শুধু অল্প বয়েসের দেখা আকাশ এখনও বদলায়নি, বরং অনেক বেশি রহস্যময় মনে হয়।

গ্রামে আমি স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম, কাশীতেও পড়াশুনোর বালাই নেই। নষ্ট হয়ে যাবার অবাধ স্বাধীনতা! ওখানেও ঘুড়ি ওড়ানোর খুব চল, কাছাকাছি ছাদগুলিতে স্থানীয় ছেলেরা দাপটের সঙ্গে চিৎকার করে, তাদের সঙ্গে প্যাঁচ লড়ার শক্তি আমার নেই। উল্লাসের প্রকাশ হিসেবে তারা নানারকম গালাগালি উচ্চারণ করে, অর্থ না জেনে কয়েকটি গালাগাল আমার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল, প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে সেগুলির অর্থ বুঝে শিউরে উঠেছি। কাশীর কিশোররা নানাবিধ গোপন শারীরিক ক্রিয়াকর্ম বিষয়ে হিন্দি গালাগাল নিঃসঙ্কোচে সাবলীলভাবে ব্যবহার করে যায়। আর বেশিদিন থাকলে আমিও ওদের অন্তর্গত হয়ে যেতাম বোধহয়।

কাশীতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের কোনও আঁচ নেই, দুর্ভিক্ষের চিহ্ন নেই, গাঁধীজির ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনেরও কোনও প্রভাব চোখে পড়ে না। মোটামুটি নিস্তরঙ্গ জীবন। মাঝে মাঝে বড়দের মুখে শুনতে পাই এখানকার গুণ্ডাদের এক একটি রোমহর্ষক কাহিনী, সেসবও গল্পের মতন শুধুই শোনা, কখনও চাক্ষুষ নয়। শুধু চোখে পড়ে বাঙালি বিধবাদের করুণ দৃশ্য, যা কোনও বালকের মনেও দাগ কাটে। বাংলা থেকে হাজার হাজার বালবিধবাদের তখন কাশীতে পাঠিয়ে দেওয়া হত, অত দূরে ঠেলে দিয়ে সেইসব বিধবাদের বাবা-কাকা-দাদারা দায়মুক্ত হতেন। মাসোহারা হিসেবে পাঠানো হতে পাঁচ টাকা বা দশ টাকা, ভদ্রলোকের এক কথার মতন বছরের পর বছর সেই টাকার অঙ্ক একই থাকত। যুদ্ধের সময় দ্রব্যমূল্য অনেকগুণ বৃদ্ধি হওয়ায় সেই সামান্য টাকায় তাঁরা কীভাবে গ্রাসাচ্ছাদন চালাবেন, তা নিয়ে মাথা ঘামাতেন না বাংলার অভিভাবকরা। অনেক সম্ভ্রান্ত ঘরের বিধবাদেরও দেখা যেত গলির মোড়ে, দেওয়ালের সঙ্গে মিশে দাঁড়িয়ে অসহায়, লজ্জিত মুখে ভিক্ষে করতে। কেউ কেউ অন্য কোনও অনৈতিক কর্মও গ্রহণ করতেন বাধ্য হয়ে।

ঘুড়ি ওড়ানোর চেয়েও গঙ্গার ধারে কথকতা শোনার টান ছিল বেশি। দুপুরে ঘুড়ি উড়িয়ে বিকেল হলেই ছুটে যেতাম ঘাটের দিকে। কথকদের মুখে সুরেলা ও নাটকীয় উচ্চারণে শুনে শুনে রামায়ণ ও মহাভারতের কাহিনী আমার জানা হয়ে যায়। কাশীতে সেটাই আমার একমাত্র শিক্ষা।

পরবর্তীকালে কাশীতে দশাশ্বমেধ ঘাটে বাঙালি কথকদের আর দেখতে পাইনি। ওই প্রজাতিটি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। প্রথমবার কাশীতে আরও একটি জিনিস দেখেছিলাম, যা এখন নেই। মণিকর্ণিকা ঘাটের ওপাশে বেণীমাধবের ধ্বজা নামে দুটি সুউচ্চ গম্বুজ, কুতুবমিনার কিংবা কলকাতার মনুমেন্টের মতন ওপরে ওঠা যেত। সে দুটি অনেককাল আগেই ভেঙে পড়ে গেছে।

কলকাতা ও কাশীতে দুটি সংসার চালানো অসুবিধাজনক হচ্ছিল বলে বাবা আমাদের কলকাতায় ফিরিয়ে আনলেন। তখনও কলকাতার অবস্থা স্বাভাবিক নয়। রাস্তায় রাস্তায় মৃতদেহ, অনেকদিন ধরে যারা অল্পভুক্ত ও অপুষ্টিতে আক্রান্ত তারাই এই সময় মরছে বেশি। কিছু কিছু লঙ্গরখানা খোলা হয়েছে বটে, কিন্তু অভাবের সমুদ্রে তা গণ্ডূষ মাত্র।

বাবা ঠিক চাল জোগাড় করে আনতেন, আমরা একদিনও না খেয়ে থাকিনি। খেতে বসে শেষপাতে কিংবা থালার বাইরে একটি-দুটি ভাত ফেললেই বাবা ধমক দিয়ে বলতেন, ভাত ফেলছিস? জানিস না, কত লোক না খেয়ে থাকে? এখনও আমি ডাল-ভাত এমন চেটেপুটে খাই যে খাওয়ার শেষে থালাটা ঝকঝক করে, অনেকে ঠাট্টা করে বলে, তোমার এঁটো থালা তো না ধুলেও চলে! নেমন্তন্ন বাড়িতে গিয়ে আমি যতটুকু নিই, তার এক বিন্দু খাবারও নষ্ট করি না। সেই দুর্ভিক্ষের আমলের স্মৃতি! সেই জন্যই আমি এটা খাব না, ওটা খাব না, বলতেও শিখিনি। আমার ছোট ভাইবোনদের অতটা স্মৃতি নেই, তাদের ফেলে-ছড়িয়ে, বাছবিচার করে খাওয়ার স্বাধীনতা আছে।

কী কারণে যেন কলকাতাতেও বিশেষ সুবিধে হল না, এবারে বাবা আমাদের পাঠিয়ে দিলেন মায়ের মামাবাড়ি আমগ্রামে। দুর্গাপূজা আসন্ন, সে সময়ে ওখানে কিছুদিন থেকে যাওয়ার মধ্যে লজ্জার কিছু নেই৷

সেবারেই প্রথম আমার মামাদের মধ্যে দেশাত্মবোধের খানিকটা পরিচয় পাই।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিমণ্ডলে ভারতের স্বাধীনতার দাবি প্রবল হয়ে উঠেছিল। জাতীয়তাবাদী নেতারা মনে করেছিলেন, যুদ্ধে জিতুক বা হারুক ইংরেজরা অনেকখানি হীনবল তো হয়ে যাবেই, সেই সুযোগে স্বাধীনতা আদায় করে নিতে হবে। তখন একটা কথা বেশ চালু হয়েছিল, ইংরেজদের যতই কামান-বন্দুক থাক, তেত্রিশ কোটি ভারতবাসী যদি সবাই মিলে একটা ধাক্কা দেয়, তা হলেই ইংরেজরা হুড়মুড় করে সাগরে হাবুডুবু খাবে।

কিন্তু সবাই তো একসঙ্গে মিলিত হয়নি। কংগ্রেস ও মুসলিম লিগে প্রবল রেষারেষি চলছে। তা ছাড়াও অধিকাংশ মানুষই নিজের পরিবার-পরিজন, খাওয়া-পরা সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের চিন্তাতেই মগ্ন। পরাধীনতার জ্বালাই বা ক’জন বোধ করে? যা চলছে তেমন চলুক, এটাই অনেকে মেনে নেয়। তার ওপরে আছে হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে সর্বনাশা নিয়তিবাদ।

সুভাষ বসু সম্পর্কে অনেক রকম খবর আসছে। অনেক মিথ্যে, গুজব ও অপপ্রচারের কুয়াশার মধ্যেও ফুটে উঠছে কিছু কিছু সত্য। রেডিয়োতে শোনা যাচ্ছে তাঁর কণ্ঠস্বর, বহু লোক দরজা-জানলা বন্ধ করে সেই বেতার-তরঙ্গে কান পাতে। জার্মানি ছেড়ে তিনি দুঃসাহসী অভিযানে সমুদ্রের তলা দিয়ে পৌঁছে গেছেন জাপানে। তারপর সিঙ্গাপুরে ভারতীয় আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক হয়েছেন, জাপানি সৈন্যদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে এগিয়ে আসছে তাঁর বাহিনী, আন্দামান দ্বীপপুঞ্জে উড়েছে তাঁর বিজয় পতাকা, এদিকেও বর্মা সীমান্তে তিনি আক্রমণে উদ্যত।

দেশত্যাগের আগেই সুভাষচন্দ্র কংগ্রেস দলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। তাঁর জার্মানি যাওয়া এবং জাপানের সাহায্য নিয়ে সমরে অবতীর্ণ হওয়া তাঁর নিজস্ব সিদ্ধান্ত। কংগ্রেসের নেতারা সুভাষচন্দ্রের এই ভূমিকা তো সমর্থন করেনইনি, প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। কমিউনিস্টদের কাছেও এটা জনযুদ্ধ, জার্মানি-জাপানের সঙ্গে সহযোগিতার অর্থই বিশ্বাসঘাতকতা।

কিন্তু সুভাষচন্দ্র রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থন না পেলেও ভারতের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের হৃদয়ে বীরের আসন পেয়ে গেছেন। তিনিই যেন একমাত্র সাহস ও শৌর্যের প্রতীক। কল্পনায় এমনও দৃশ্য ভেসে ওঠে, অশ্বারোহণে তরবারি উঁচিয়ে সুভাষচন্দ্র বন্দিনী দেশজননীকে উদ্ধার করতে ছুটে আসছেন ঝড়ের বেগে।

আমার মায়ের মামাতো ভাইরা কেউ কখনও কোনও রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগ দেননি, উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের মতন তাঁরা ইঞ্জিনিয়ারিং, ডাক্তারি বা অর্থনীতি পাঠে মনোনিবেশ করেছিলেন। মায়ের একমাত্র সহোদর ভাইটি তখনও সাবালক হয়নি, তার লেখাপড়ার মাথা ছিল না। তাঁর এক মাসতুতো দাদা, যাকে আমরা টুকটুকি মামা বলতাম, একমাত্র তিনি ছিলেন কিছুটা বাউণ্ডুলে স্বভাবের, কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন, কিছুদিন পার্টির হয়ে কাজও করেছিলেন সম্ভবত। যাই হোক, উচ্চশিক্ষার্থী প্রধান মামাগণও সে সময় সুভাষচন্দ্র বসুর রোমান্টিক মহিমায় আকৃষ্ট না হয়ে পারেননি। সেবারে তাঁরা সপরিবার দুর্গাপ্রতিমা গড়ার এক অভিনব পরিকল্পনা নিয়েছিলেন।

যথাসময়ে সদলবলে জলধর কুমোর উপস্থিত। মূর্তি নির্মাণের ব্যাপারে এমনই গোপনীয়তা অবলম্বন করা হল যে আমাদের মতন বাচ্চাদেরও কাছ ঘেঁষতে দেওয়া হয়নি একটিবারও।

এ বছরই প্রথম দেখি গ্রামোফোন যন্ত্রটি, বাংলায় যার নাম ‘কলের গান’। অমন গ্রামদেশে ওই বস্তুটি খুবই অভিনব। আমাদের মতন বাচ্চাদের অবস্থা হিজ মাস্টার্স ভয়েস-এর কুকুরটিরই মতন, আমরা হাঁটু গেড়ে অবাক বিস্ময়ে শুনতে শুনতে ভাবতাম, ওই বাক্সটির মধ্যে গুটিসুটি মেরে বসে একজন লোক গানগুলি গাইছে। এটা নিশ্চিত সিদ্ধান্ত নয়, এর মধ্যে যথেষ্ট সংশয়ও ছিল, একই লোক বিভিন্ন গান, বিভিন্ন রকম গলায়, এমনকী মেয়েদের মতন গলাতেও গায় কী করে? কমিকগুলিতে চার-পাঁচজন লোকের গলা এক সঙ্গে শোনা যায়, ওই বাক্সের মধ্যে একজনের বেশি মানুষ থাকা তো কোনওক্রমেই সম্ভব নয়!

আমেরিকার কোনও রেড ইন্ডিয়ানের প্রথম গ্রামোফোন রেকর্ড শোনার পর যে বিস্ময়-অনুভূতি, তার সঙ্গে আমাদের অনুভূতির কোনও তফাত ছিল না।

সমসাময়িক বিষয় নিয়ে অনেক গান রেকর্ড করা হত তখন, একটি গানের কয়েকটি লাইন মনে আছে:

ক্যালকাটা নাইনটিন ফরটি থ্রি অকটোবর

এ আর পি, মিলিটারি

পথে পথে ভিখিরি

সব জিনিসের বাড়ল দর

ক্যালকাটা নাইটিন ফরটি থ্রি অকটোবর!…

এ আর পি এখন অপরিচিত, যুদ্ধের সময় এয়ার রেইড পুলিশ নামে আলাদা একটি বাহিনী তৈরি হয়েছিল, বিমান হানা ও সাইরেন বাজার সময় নাগরিকদের সতর্ক করে দেওয়াই ছিল এদের কাজ। স্কুল বন্ধ হবার ফলে বেকার অবস্থায় আমার বাবাও কিছুদিন এই কাজ করেছিলেন। এই গানটির আর একটি লাইনও লক্ষণীয়, ১৯৪৩ সালের আগে কলকাতা শহরে এত ভিখিরির উপদ্রব ছিল না। সেই থেকে শুরু।

আর একটি গান ছিল বেশ মজার। ‘বৃন্দাবন বিলাসিনী রাই আমাদের’। এই বিখ্যাত পদাবলী গানটির প্যারোডি। মূল গানটিতে শুক ও সারি নামে দুই পক্ষী যথাক্রমে কৃষ্ণ ও রাধার পক্ষ নিয়ে সওয়াল করে। যেমন:

শুক বলে: আমার কৃষ্ণের মাথায় ময়ূর পাখা

সারি বলে: আমার রাধার নামটি তাহে লেখা

ওই যে যায় দেখা!

শুক বলে: আমার কৃষ্ণ গিরি ধরেছিল

সারি বলে: আমার রাধা শক্তি সঞ্চারিল

নইলে পারবে কেন!… ইত্যাদি।

এর অনুকরণে যদু ও মধু নামে দুই ব্যক্তি নিজেদের বউয়ের গুণপনার প্রতিতুলনায় মত্ত! যেমন:

যদু বলে: (আমার বউ) টকি দেখতে বড্ড ভালবাসে

মধু বলে: (আমার বউ) সেই টকিতে পেলে

করে আসে

এবার ফিরল বোধহয়!

দুঃখের বিষয় গানটির বাকি পঙ্‌ক্তিগুলি আমার স্মরণে নেই।

সিনেমাকে তখন অনেকেই বলত টকি। মুম্বইয়ের একটি বিখ্যাত চলচ্চিত্র প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল ‘বম্বে টকিজ’। মঞ্চ অভিনেতা শিশির ভাদুড়ি একটি ফিল্মে অভিনয় করেছিলেন। তার নাম ‘টকি অব টকিজ’। আর কিছু লোক বলত বাইস্কোপ। সিনেমা, মুভি, ফিল্ম এই শব্দগুলির বিশেষ প্রচলন ছিল না। সেই দশ বছর বয়সেও আমি একটাও বাইস্কোপ দেখিনি। থিয়েটার-বাইস্কোপ ছিল তখন ছোটদের পক্ষে নিষিদ্ধ জগৎ। আরও কয়েক বছর পর প্রথম আমাকে টারজন-এর সিনেমা দেখার অনুমতি দেওয়া হয়।

ছোট ছোট বাচ্চারা মা-বাবাকে অনেক রকম প্রশ্ন করে। পাখি কেন ওড়ে, গাছে কেন ফুল ফোটে, আগুন কেন গরম আর বরফ কেন ঠাণ্ডা। রাত্তিরে সূর্য ঘুমোয় কিন্তু চাঁদ কেন ঘুমোয় না। এই ধরনের হাজার প্রশ্নে বিরক্ত করে মা-বাবাকে। তাঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছেন কিংবা অন্য কাজে ব্যস্ত, তবু বাচ্চারা জ্বালাতন করবেই, বই পড়ার চেয়েও এই সব কৌতুহলের মধ্য দিয়েই তাদের আসল শিক্ষা হয়। দশ-এগারো বছর বয়েস হয়ে গেলে তারা আর মা-বাবার কাছে যায় না। তখন আরও অনেক বেশি প্রশ্ন থাকে, কিন্তু নিজেরাই উত্তর খোঁজে। অনেক প্রশ্নই প্রহেলিকার মতন থেকে যায় বেশ কিছু দিন। সেই সব প্রহেলিকা বা সংশয় নিয়েই গড়ে ওঠে তার নিজস্ব জগৎ।

সেই বয়সে নারী-পুরুষের সম্পর্ক নিয়ে একটা নিদারুণ সংকটে ভুগেছিলাম বেশ কিছুদিন। ছেলে মেয়েরা জন্মায় মায়ের পেটে, বাবাদের সে ক্ষমতা নেই, এটা জানা হয়ে গেছে। কিন্তু বিয়ে হবার পরেই মেয়েরা মা হয়, বিয়ের আগে কেন হয় না? এর মধ্যে কী যেন একটা রহস্য আছে। কিছুতেই ধরতে পারছি না। তরুণী মেয়েরা যুবা পুরুষদের দিকে যেভাবে তাকায়, ছোটদের দিকে তো তাকায় না সেভাবে? তিনটি তরুণী নিজেদের মধ্যে যেভাবে হাসাহাসি করে, অন্য একজন পুরুষ উপস্থিত হলেই কেন বদলে যায় সেই হাসির ধরন?

ফ্রয়েড সাহেব কীসব লিখে গেছেন তা তো তখন পড়িনি, যৌনচেতনা কাকে বলে তা-ও জানি না। কিন্তু এই বয়েস থেকেই মেয়েদের সম্পর্কে কৌতূহল বা আগ্রহ হঠাৎ বেড়ে গেল। তাদের কথা বলা, হাসি, চলার ছন্দ, বসার ভঙ্গি যেমনভাবে লক্ষ করি, তেমনভাবে তো পুরুষদের দিকে তাকাই না। সামনাসামনির বদলে আড়াল থেকে মেয়েদের দেখতে বেশি ইচ্ছে হয়।

নয়-দশ বছর থেকে তেরো-চোদ্দো বছর পর্যন্ত বালকেরা সমবয়েসি মেয়েদের একেবারে পাত্তা দেয় না। কারণ তখনও পর্যন্ত ছেলে ও মেয়েদের শারীরিক গড়নের তফাত থাকে না বিশেষ। অন্তত বছর দশেকের বড় রমণীরা তাদের চোখে পরিপূর্ণ নারী। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, পঞ্চদশীরা পূর্ণিমায় পৌছোয়। আমার মনে হয় আরও কয়েক বছর বেশি সময় লাগে। বিংশতি বর্ষ পার হবার পরই সাধারণত মেয়েদের স্তনোদগম সম্পূর্ণ হয়, চওড়া হয় উরুদ্বয়, গমন ভঙ্গি বদলায়। দশ-এগারো বছরের ছেলেদের চোখে সেটাই নারীত্ব, তাদের প্রতি মুগ্ধতার দৃষ্টি থেকেই বালকেরা এক সময় কৈশোরের খোলস ভেঙে বেরিয়ে আসে। বাইশ-তেইশ বছরের কিংবা তারও বেশি বয়সের রমণীরা দশ-বারো বছরের ছেলেদের মানুষ বলেই গণ্য করে না। কিন্তু সেই সব ছেলেরা যে তাদের কী চোখে দেখে তা তারা কোনওদিনই জানতে পারে না।

দুর্গাপুজো উপলক্ষে আমগ্রামের সেই মামাবাড়িতে প্রচুর আত্মীয়স্বজনের সমাবেশ হত। তাদের মধ্যে আমার কয়েকজন অপ্সরীতুল্যা মাসি ছিলেন, আমি তাঁদের প্রত্যেকের প্রেমে পড়েছিলাম। সেই প্রেম অনেকটা দেবী-আরাধনার মতন। এক একজনের ফর্সা, নরম পা দেখে মনে হত, আমি মাটিতে শুয়ে থাকব, তিনি যদি অন্যমনস্কভাবে আমার বুকের ওপর দিয়ে হেঁটে যান, তাতেও আমার জীবন ধন্য হবে!

সেবারেই প্রথম আমার অভিনয়েরও অভিজ্ঞতা হল। পূজার কয়েকটি দিনে মণ্ডপের সামনে আটচালায় যাত্রা, থিয়েটার ও গানবাজনার আসর বসে। এই উৎসবের জন্য কলকাতা থেকে কয়েকজন ঠাকুর-চাকর নিয়ে আসা হত, তারা এবং স্থানীয় কর্মচারীরা মিলে আলাদা একটি যাত্রাপালা অনুষ্ঠানের উদ্যোগ নিয়েছিল, এদের মধ্যে কয়েকজন ওড়িশাবাসী, একজনের গানের গলা চমৎকার। পালাটির নাম মনে নেই, তাতে বাচ্চা শ্রীকৃষ্ণের একটা ভূমিকা ছিল, আমার বয়েসি আর কোনও ছেলে নেই, সুতরাং মা-বাবার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে আমাকেই সাজানো হল রাখাল-রাজা কৃষ্ণ। খুব ঝলমলে সাজপোশাক পরানো হয়েছিল, আমি বায়না ধরেছিলাম, আমাকে একটা তরোয়াল দিতেই হবে। শ্রীকৃষ্ণ কখনও তলোয়ার নিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন কি না, সে রকম কোনও বর্ণনা পাওয়া যায় না, কিন্তু আমার তলোয়ারের প্রতি খুব লোভ ছিল। বাঁখারির ওপর রাংতা জড়িয়ে বানানো হয়েছিল একটি তলোয়ার, সেই তলোয়ার সমেত বীর শ্রীকৃষ্ণ একটি আছাড় খেয়েছিল এবং দর্শকদের হাসিয়েছিল। দর্শকদের হাসি মানেই তো সার্থকতা!

পালার শেষে এক মাসি আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন আনন্দে। ছ-সাত বছর বয়েস থেকেই ছেলেরা মায়ের কোলে মাথা দিয়ে শোবার অধিকার হারায়, দশ-এগারো বছরের ধেড়ে ছেলেকে মাসি-পিসিরাই বা জড়িয়ে ধরতে যাবে কেন? সেই আলিঙ্গনে আমার মাসি যে আমাকে কী দিয়েছিলেন, তা তিনি নিজেই জানে না। নারীরা না জেনে অনেক কিছু দেয়।

পরের কথা আগে এসে যাচ্ছে। জলধর যথাসময়ের কিছু আগেই কাজ শেষ করলেন, পঞ্চমীর দিন প্রতিমার আবরণ উন্মোচন করা হল। সকলেই হতবাক। অন্যান্য বছর ছিন্নমুণ্ড মহিষের দেহ ভেদ করে উত্থিত অর্ধেকটা দেখা যায় অসুরকে। এবারে মহিষাসুর সম্পূর্ণ দণ্ডায়মান, পুরোপুরি মিলিটারির পোশাক, বুট জুতো সমেত, এবং তার মুখ অবিকল সাহেবদের মতন। অর্থাৎ ইংরেজ অসুর। আর দুর্গার ছোট ছেলে কার্তিক হচ্ছেন সুভাষ বসু, তিনিও সামরিক বেশে সজ্জিত, তীর-ধনুকের বদলে হাতে রাইফেল, সেটা অসুরের বুকে তাক করা।

প্রাথমিক বিস্ময়ের পর সবাই হাততালি দিয়ে উঠলেন। বাতাসের চেয়েও দ্রুতবেগে রটে গেল এই সংবাদ, হাজার হাজার মানুষ ছুটে এল সেই অভিনব প্রতিমা দর্শনের জন্য। একটা দারুণ হুড়োহুড়ির পরিবেশ। অনেকে সুভাষ বসুর নামে জয়ধ্বনি দিতে লাগল।

থানাতেও পৌঁছে গেল জনরব। বিকেলবেলা দারোগাবাবু কয়েকজন সেপাইকে নিয়ে উপস্থিত হলেন। মামারা বেশি দুঃসাহসের পরিচয় দিয়ে ফেলেছিলেন, ইংরেজ সৈন্যকে হত্যা করার দৃশ্য স্পষ্টতই রাজদ্রোহমূলক, সুভাষ বসু পলাতক আসামি, তাঁকে দেবত্বে উন্নীত করাও শাস্তিযোগ্য, সুতরাং বাড়ির কর্তারা সকলেই গ্রেফতার হতে পারতেন। তখন প্রতি জেলার এস পি-রা হত ইংরেজ, থানা পর্যায়ে বাঙালি বা অন্য ভারতীয়রাই নিযুক্ত হত। এই দারোগাবাবু বাঙালি, ইনি ইংরেজের চাকর হলেও স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতি একেবারে সহানুভূতিশূন্য ছিলেন না বোধহয়। তিনি পরামর্শ দিলেন এস পি সাহেব জানবার আগেই প্রতিমা একেবারে ঢেকে, লুকিয়ে ফেলতে হবে। কিন্তু পূজা তো বন্ধ করা যায় না, শুধু ঘট পূজা হবে। প্রতিমা ভো থাকে প্রেক্ষাপটে, সামনে ঘট রেখে তাতে প্রাণপ্রতিষ্ঠাই তো আসল পূজা।

সেই রকমই হল। আমরা সবাই জানি, প্রতিমা আছে অন্তরালে, বাইরের লোক এসে শুধু ঘট দেখতে পায়। কিন্তু তাতে কী মন ভরে? যতই প্রতীকের কথা বলা হোক, অনেক শতাব্দী ধরে হিন্দুদের মনে সাকার-সংস্কার বদ্ধমূল হয়ে আছে। খানিকটা নিরানন্দ হতে লাগল সব কিছু, যদিও পঙক্তি ভোজ বাদ যায়নি। অষ্টমীর রাতে আরতির উদ্দামতা শিহরন জাগায়, দু’ হাতে দুটি জ্বলন্ত ধুনুচি নিয়ে কয়েকজন প্রায় প্রলয়নৃত্য শুরু করে, ছিটকে ছিটকে পড়ে আগুন,হঠাৎ কারওর শরীর ঝলসে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি। পুরুষের ওই ধরনের নৃত্য আমার কোনওদিনই ভালো লাগেনি। নবমীর দিনে হয় ঢাকের বাজনার প্রতিযোগিতা। এ বাড়িতে জনাচারেক ঢাকি-টুলি তো থাকেই, অন্য পূজামণ্ডপ থেকেও অন্য ঢাকিরা এসে প্রতিযোগিতায় যোগ দেয়, বড় বড় জয়ঢাকের রীতিমতো পোশাক আছে এবং ওপরে পালকের সাজ, সেগুলি বাজাতে বাজাতে ঢাকিদের সে কী উল্লম্ফন! আর কী কানের তালা ফাটানো আওয়াজ! দৃশ্যটির মধ্যে উত্তেজনা আছে বটে, কিন্তু কে যেন বলেছিলেন, ঢাকের বাদ্যি থামলেই মিষ্টি লাগে, কথাটা বর্ণে বর্ণে সত্য।

দশমীর সকাল থেকেই ঢাকের আওয়াজ নরম হয়ে যায়, তার মধ্যে স্পষ্ট শোনা যায়, ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন। বিসর্জনের প্রস্তুতিও দারুণ, বিশাল বিশাল নৌকো আসে, পেট মোটা লম্বা ধরনের নৌকো, এক একটিতে পঞ্চাশ-ষাট জন মানুষ এঁটে যায়। অন্য সময় এই নৌকোগুলি কোথায় থাকে কে জানে! ইংরেজ-অসুর ও সুভাষচন্দ্ররূপী কার্তিকের মূর্তি দুটি বাদ দিয়ে বাকি প্রতিমা সাড়ম্বরেই বিসর্জনের ব্যবস্থা হয়েছিল। এইদিন পরিবারের পুরুষরা ধুতি ও সাদা পাঞ্জাবির সঙ্গে গলায় সরু সোনার হার পরেন, যাকে বলে মফচেন। আমি তখন প্রাপ্তবয়স্ক নই বলে সে রকম হার পরার প্রশ্ন ওঠেনি, পরবর্তীকালেও কোনওদিনই আমার কণ্ঠে হার ধারণ করতে হয়নি। তাগা-তাবিজ-মাদুলির সঙ্গেও আমার সম্পর্ক স্থাপিত হয়নি কখনও।

দুর্গাপূজা শেষ হতে না-হতেই লক্ষ্মী ঠাকরুনের আলাদাভাবে আগমন, তারপর কার্তিক, অল্প দূরত্বেই কালী ও সরস্বতী, পর পর পূজা লেগেই আছে। দেব-সেনাপতি কার্তিকেয় বাঙালিদের কাছে বিশেষ সম্মান পান না। তাঁর পূজা হয় বটে, আবার অনেকে ছড়া বানায়, ‘কার্তিক ঠাকুর হ্যাংলা/একবার আসে মায়ের সঙ্গে, একবার আসে একলা!’ ছড়াটি যুক্তিহীন, কারণ লক্ষ্মী ও সরস্বতীও তো আলাদা পূজা নিতে আসেন, শুধু কার্তিককেই হ্যাংলা দোষারোপ কেন? মেয়েদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব!

শরৎকালের পর হেমন্ত ঋতু গ্রামদেশেই বোঝা যায় স্পষ্ট। বর্ষার উন্মাদনা, শরতের মন ভোলানো রূপের পর হঠাৎ যেন সব কিছু মন্থর হয়ে আসে, জল কমতে থাকে নদীতে, শূন্য পড়ে থাকে ফসলের ক্ষেত, বাতাস আর গাছগুলিকে দোলায় না, সন্ধের পর খোলা জায়গায় বসে থাকলে মাথায় হিম পড়ে। অবশ্য একটার পর একটা পূজা-উৎসব চলতে থাকে বলে আমরা ঋতু পরিবর্তন তেমন খেয়াল করি না। বহু আত্মীয় সমাবেশে সব সময়ই যেন ধারাবাহিক হুল্লোড় চলে, তারপর বিদায় নিতে শুরু করে এক একটি দল। আমাদেরও আর বেশি দিন থাকা মানায় না, এখান থেকে চলে যেত হবে মাইজপাড়ায় নিজেদের বাড়িতে। লক্ষ করেছি, মা তাঁর শ্বশুরবাড়ির চেয়ে এখানেই থাকেন বেশি ফুর্তিতে, মামাতো-মাসতুতো অনেকগুলি ভাই বোনদের মধ্যে তাঁর একটি বিশেষ ভূমিকা আছে। এখানে মেয়েদের সহজভাবে ঘোরাফেরার সীমানাটা অনেক বড়, সেই তুলনায় মাইজপাড়ার পরিবেশ বেশ নিরানন্দ, গণ্ডিটাও ছোট। তবু যেতে তো হবেই।

আমগ্রামে আমি স্কুলে ভর্তি হইনি বটে, কিন্তু কাশীর মতন লাগামছাড়া জীবন ছিল না, প্রতিদিন বই খুলে বসতে হয়। এ বাড়িতে পড়াশুনোর পরিবেশ আছে। ছোটদের তদারকি করে মেজো বয়েসিরা, মেজোদের ওপর নজর রাখেন তাদের যাঁরা গুরুজন। বড়দের আড্ডার সময় সেখানে ছোটদের থাকা নিষেধ, কিন্তু পড়া জিজ্ঞেস করার ছুতো করে সেখানে অনায়াসে যাওয়া যায়। এ রকম বৃহৎ যৌথ পরিবারে বয়ঃসন্ধির পর প্রাথমিক প্রেম প্রেম খেলা হয় মামাতো-মাসতুতো-খুড়তুতো-জ্যাঠতুতো-পিসতুতো ভাইবোনদের মধ্যে। সে রকম কোনও গোপন-নিবিড় পরিবেশে আচমকা ঢুকে পড়ে হকচকিয়ে গেছি।

যেহেতু আমি ঠাকুর-চাকর-কর্মচারীদের প্রযোজনায় যাত্রাপালায় অংশ নিয়েছিলাম, তাই ওদের সঙ্গে আমার বেশ ভাব ছিল। রান্নার ঠাকুর লুকিয়ে মাছ ভাজা খেতে দিত। বাড়ির বাঁধা মাঝি ও জেলেদের কাছে গিয়েও গল্প শুনতাম নানারকম, চলে যেতাম ধোপাপাড়ায়। বড় দিঘিটার এক ধারে নমঃশূদ্ররা থাকে, (সিডিউল্ড কাস্ট, চলতি কথায় সবাই বলত শুধু নমো) সেখানে না যাওয়ার একটা অলিখিত নির্দেশ ছিল, কারণ তারা অচ্ছুত, যদিও তাদের পরিষেবা ও শ্রম নিতে কোনও আপত্তি নেই। নিম্ন বর্ণের অনেকে খ্রিস্টান হয়েছিল, তাদেরও অচ্ছুত মনে করা হত। নিষেধ ছিল বলেই কৌতূহলে আমি তাদের পল্লীতে চলে যেতাম সুযোগ পেলেই। তাদের কারওর বাড়িতে জল চাইলে তারা নিজেরাই দিত না, তাদের ধারণা, আমি ছেলেমানুষ বলে না জেনে পাপ করতে যাচ্ছি, ব্রাহ্মণ সন্তানকে জল দিলে তারাও পাপের ভাগী হবে।

মাঝিদের কাছে একদিন শুনলাম, তারা কয়েকজন দল বেঁধে একটা বিলে যাবে কয়েকদিনের জন্য। এই বিল-অভিযানের গল্প আগেও শুনেছি, দারুণ রোমাঞ্চকর মনে হত। বিল মানে অপরিকল্পিত এক বিস্তীর্ণ জলাশয়, দৈর্ঘ্যে প্রস্থে বেশ কয়েক মাইল হবে, কিন্তু তাকালে মনে হয় অকূল ধু ধু। অথচ সমুদ্রের সঙ্গে তুলনা চলে না, ঢেউ নেই, তেমন গভীরও নয়, অনেক জায়গায় তলার মাটি দেখা যায়, মাঝে মাঝে গাছপালাও আছে, এবং বিন্দু বিন্দু দ্বীপ। বিলে অফুরন্ত মাছ এবং ধরাও সহজ। যারা দল বেঁধে বিলে যায়, তারা নৌকোতেই থাকে তিন-চার দিন, সেখানেই রান্নাবান্না, খাওয়া ও ঘুম, যাযাবরের জীবন।

আমি ওই দলটির সঙ্গে বিলে যাবার আবদার করতেই বাড়ির সকলে প্রবল আপত্তি জানালেন। প্রথম কারণ, ভদ্রসন্তানেরা ওই ভাবে যায় না। দ্বিতীয় কারণটি আরও মারাত্মক, বিলে যেমন লোকে মাছ ধরতে যায়, তেমনই যায় ডাকাতের দল। যখন তখন ডাকাতেরা এসে সব কেড়েকুড়ে নিয়ে যায়, খুন-জখমও বাদ যায় না। আমার দেওয়ালের দিকে মুখ করে বসে কান্নাকাটি, খাওয়া বন্ধ ও কেউ হাত ধরে টানলে খিমচে দেওয়া ইত্যাদির পর এবং কুটিশ্বর নামে এক মাঝি নিজ দায়িত্বে আমার নিরাপত্তার পূর্ণ প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় শেষ পর্যন্ত অনুমতি পাওয়া গেল।

সেই তিন-চারদিনের যাযাবরত্ব যে খুব বেশি উপভোগ্য হয়েছিল, তা বলা যায় না। অন্যরা সব সময় মাছ ধরায় ব্যস্ত। বরফের ব্যবস্থা নেই, তিন-চারদিন মাছ ধরলে পচে যাবার কথা। তাই নৌকোর খোল অর্ধেকটা জলে ভরা, ধরা-পড়া মাছগুলো সেই জলে ছেড়ে দেওয়া হয়, যাতে সেগুলি জ্যান্ত থাকে। যে কটা মরে যায়, সেগুলি সঙ্গে সঙ্গে কেটেকুটে রান্না করে খেয়ে ফেলা হয়। তার মধ্যে ফলি মাছই মরে বেশি, ফলি মাছের বড্ড ছোট ছোট কাঁটা, আমার সুবিধে লাগে না। সন্ধে হতে না হতেই খাওয়াদাওয়া শেষ এবং শুয়ে পড়া। কারণ জাগতে হয় অতি ভোরে এবং চিলের ডাকে। চিল এসে ঘোরে মাথার ওপর। সন্ধে রাতেই ঘুম না এলে চিত হয়ে শুয়ে আকাশ দেখা, নৌকোটা একটু একটু দোলে, খোলের মধ্যে খলবল করে মাছগুলো, অনেক দূরের কোনও নৌকো থেকে ভেসে আসে বেসুরো গান।

একদিনই শুধু একটা দারুণ উত্তেজনার ব্যাপার হল। তখন সবারই ঘুমিয়ে পড়ার কথা, একজন হঠাৎ উঠে বসে ভূত ভূত বলে চেঁচিয়ে উঠল, অন্যরাও জেগে উঠে বলল, আলেয়া। প্রথমে আমি দেখতেই পেলাম না, সবাই আঙুল দেখাচ্ছে, তবু দেখতে পাচ্ছি না। তারপর অনেক দূরে দেখলাম অস্পষ্ট আলো, মনে হয় কেউ পাটকাঠি জ্বেলেছে। ক্রমে আর একটু স্পষ্ট হল, সেই আলোটা স্থির নয়, যেন জলের ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরছে। ইচ্ছে করলে সেটাকে একটা নারীমূর্তি হিসেবে কল্পনা করা যায়। সেদিকে চেয়ে থেকে রোমাঞ্চ বোধে আমার দম বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। সত্যই একটা আলোর মূর্তি লাফাচ্ছে জলের ওপর? অনেকেই ভয় পেয়ে চোখ ঢাকছে, তারা আলেয়াকে প্রেতিনী মনে করে। কুটিশ্বর তার অভিজ্ঞ কণ্ঠে জানাল, তার দীর্ঘ জীবনে সে অনেকবার আলেয়া দেখেছে, কিন্তু সে জানে, আলেয়া কখনও কাছে আসে না।

আলেয়া ব্যাপারটা কী, তার বিজ্ঞানসম্মত ব্যাখ্যা এখন সবাই জানে। যেমন আকাশে কেন রামধনু ফোটে, তার কারণ স্কুলের ছাত্ররাও জেনে গেছে। তবু রামধনুর সৌন্দর্য ও তার প্রতি মানুষের মুগ্ধতাবোধ যেমন একই রকম রয়ে গেছে, তেমনই নির্জন নিশীথে, দিগন্তবিস্তৃত জলাভূমির ওপর নৌকোয় বসে আলেয়া দেখার রোমাঞ্চ একটুও কমে না।

সাত

স্টিমারে কলকাতায় ফেরার সময় খবর পাওয়া গেল, যুদ্ধ থেমে গেছে। হয়তো মাঝপথে কোনও যাত্রী উঠে ছড়িয়েছে এই খবর। কিছু লোক তা নিয়ে বলাবলি করতে লাগল, অনেক লোক এত বড় একটা ঘটনায় ভ্রুক্ষেপও করল না। কেউ কেউ ডেকের রেলিং-এর ধারে বসবার জায়গা দখলের জন্য ঠেলাঠেলির তুলনায় বেশি গুরুত্ব দিল না বিশ্বযুদ্ধকে।

খুলনা শহরেও মানুষের সে রকম কোনও ভাবান্তরের চিহ্ন নেই। স্টিমারঘাটায় যথারীতি বিশৃঙ্খলা ও চেঁচামেচি, মাথার ওপরে ঘুরছে এক-ঝাঁক চিল। পরে শুনেছি, এই উপলক্ষে অনেক স্কুলে মিষ্টি বিতরণ করা হয়েছিল, কিছু কিছু অফিস ও ব্যবসা কেন্দ্রে হয়েছে উৎসব, কিন্তু তা সাধারণ মানুষের দৃষ্টিগোচর নয়। ততদিনে যুদ্ধের রোমাঞ্চকর গল্প শোনার কৌতূহলের বয়েস হয়ে গেছে আমার, কিন্তু তা শোনাবার মতন কেউ ছিল না ধারেকাছে। স্টিমারের ডেকে দাঁড়িয়ে আমি কল্পনা করেছিলাম, কোথাও, বহু দূরে, হাজার হাজার বন্দি সৈনিক মাথা নিচু করে শ্লথ পায়ে হাঁটছে।

যুদ্ধ শেষ হলে জয়ী দেশগুলিতে বয়ে যাবে আনন্দের স্রোত, পরাজিত দেশগুলি মূহ্যমান হয়ে থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। ভারত জয়ীও নয়, পরাজিতও নয়, আবার সুইডেন কিংবা সুইজারল্যান্ডের মতন নিরপেক্ষও বলা যাবে না, কারণ ভারতীয় সৈনিকেরা রণাঙ্গনে প্রাণ দিয়েছে। জাপানের আত্মসমর্পণের আগেই আজাদ হিন্দ ফৌজে ঘটে গেছে শোচনীয় বিপর্যয়। বহু ভারতবাসীর মনে একটাই প্রশ্ন, সুভাষবাবু কোথায়?

২৮ এপ্রিল রাত একটার পর বার্লিনের মাটির নীচের প্রকোষ্ঠে খ্রিস্টীয় আচার-অনুষ্ঠান মেনে হিটলার বিয়ে করল ইভা ব্রাউনকে, যে রমণীটি গত বারো বছর ধরে ছিল হিটলারের প্রণয়িনী ও রক্ষিতা। তারপর এই দম্পতি যোগ দিল ছোটখাটো একটি ভোজ উৎসবে। তখন ওপরে প্রচণ্ড বোমাবর্ষণ চলছে, মার্শাল জুকোভ-এর নেতৃত্বে অসাধারণ বীরত্ব দেখিয়ে এগিয়ে আসছে লাল ফৌজ। আমেরিকান ও ইংরেজদের চেয়েও আগে ধেয়ে এসে রাশিয়ানরা বার্লিন দখলে উদ্যত, শেষ মরিয়া যুদ্ধেও জার্মানরা তাদের প্রতিহত করতে পারছে না।

বিবাহের প্রহসনের পর হিটলার একজন সচিবকে ডেকে রচনা করল তার ইচ্ছাপত্র ও রাজনৈতিক ভাষ্য, যা ঝুরি ঝুরি মিথ্যেয় ভরা। এতকালের দুই প্রধান সহচর গোয়েরিং ও হিমলারকে বরখাস্ত করা হল বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে। নিশ্চিত পরাজয় আসন্ন, তবু শেষ সংবাদটি স্বকর্ণে শুনতে চায়নি হিটলার, ৩০ এপ্রিল দুপুর সাড়ে তিনটের সময় এই নবদম্পতি সকলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ঢুকল একটি ঘরে, বাইরে পাহারায় রইল গোয়েবল্স ও বোরমান। শোনা গেল শুধু একটি রিভলবারের গুলির শব্দ, একটু অপেক্ষা করে সবাই দৌড়ে সে ঘরে ঢুকে দেখল, সোফার ওপর দুটি মৃতদেহ পড়ে আছে, হিটলার গুলি করেছে নিজের মুখের মধ্যে, ইভা বিষ পান করেছে। হিটলারের পূর্ব নির্দেশ মতনই প্রচণ্ড গোলাবর্ষণের এক ফাঁকে সকলে মিলে মৃতদেহ দুটি ওপরে চ্যান্সেলারির বাগানে নিয়ে গিয়ে, পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দিল। বার্লিনের নিয়মমাফিক পতনের আগেই চিরবিদায় নিল মানব সভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্যতম যুদ্ধাপরাধী অ্যাডল্ফ হিটলার।

হিটলার তবু আত্মহত্যা করেছিল এবং তার মৃতদেহও যাতে শত্রুপক্ষের পদদলিত না হয়, সে ব্যবস্থা করে গিয়েছিল। সেই তুলনায় ফ্যাসিস্ত মুসোলিনির শেষ মুহূর্ত ও পরবর্তী ঘটনাবলী চরম অপমানজনক এবং তার উপযুক্তও বটে। ইতালির শেষ দশায় এক জার্মান বাহিনী পশ্চাৎ অপসরণ করছিল উত্তর সীমান্তের দিকে, তার মধ্যে আত্মগোপন করেছিল মুসোলিনি ও তার উপপত্নী ক্লারা পেতাচ্চি। এক সময় তাদের ঘিরে ধরে মুক্তিবাহিনীর একটি দল, তাদের নেতা বেলিনি নামে একটি বাইশ বছরের সম্ভ্রান্ত যুবক। তারা সন্দেহ করেছিল, ওই দলটির মধ্যে কিছু ইতালিয়ান হোমরা-চোমরা রয়েছে, মুসোলিনির কথা তারা কল্পনাও করেনি। জার্মান সৈন্যদলটির সঙ্গে মুক্তিবাহিনী সংঘর্ষে লিপ্ত হতে চায়নি, জার্মানরা ফিরেই যখন যাচ্ছে, তখন আর অনর্থক রক্তক্ষরণে প্রয়োজন কী? শুধু তারা পলাতক ইতালিয়ানদের ফেরত চায়। এদের মধ্যে লুক্কায়িত মুসোলিনিকে হঠাৎ চিনতে পেরে তারা আনন্দে আত্মহারা। জার্মানদের কাছে তখন মুসোলিনির কানাকড়িও মুল্য নেই, বরং একটি বোঝা, তারা স্বেচ্ছায় মুসোলিনিকে পরিত্যাগ করে চলে গেল।

প্রথমে মুসোলিনি ও ক্লারাকে বন্দি করে রাখা হল সীমান্তের একটি গ্রামে। মুসোলিনির নিজের স্ত্রী ও অনেকগুলি রক্ষিতা ছিল। তাদের মধ্যে ক্লারার বয়েস অনেক কম ও অতিশয় রূপসী এবং মুসোলিনির অন্ধ ভক্ত। সে মুক্তিবাহিনীর নেতা বেলিনির কাছে ইনিয়েবিনিয়ে শোনাতে লাগল তাদের প্রেমের কাহিনী এবং এক সময় কাঁদতে কাঁদতে বলল, আপনারা বুঝি ওকে গুলি করে মারবেন? তা হলে ওর শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমাকে ওর পাশে থাকতে দেবেন তো? আমাকেও সেইসঙ্গে গুলি করবেন, কথা দিন! অল্পবয়েসি যুবক বেলিনি এই প্রেমকাহিনীতে বিচলিত হয়ে গিয়ে শপথ করে ফেলল, না, আমি ওকে গুলি করে মারব না, ওর বিচার হবে।

কিন্তু মুসোলিনিকে বাঁচিয়ে রাখা মোটেই নিরাপদ ছিল না। এর আগেও মুসসালিনিকে একবার বন্দি করা হয়েছিল, কিন্তু হিটলার কমান্ডো বাহিনী পাঠিয়ে চমকপ্রদভাবে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। সেই জন্যই মুক্তিবাহিনীর সদর দফতর মিলানে এই অসাধারণ সংবাদটি পৌঁছতেই কমিউনিস্ট নেতা তোগলিয়াত্তি অবিলম্বে দলবলসমেত মুসোলিনিকে শেষ করে দেওয়ার নির্দেশ জারি করলেন। সেই জন্য পনেরো জনের একটি দল দ্রুত চলে এল সীমান্তের গ্রামে। এক চাষির বাড়ি থেকে মুসোলিনি ও ক্লারাকে টেনে বার করা হল, মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে উদ্যত অস্ত্র দেখে ক্লারা জড়িয়ে ধরে রইল মুসোলিনিকে, সরে যাবার নির্দেশ সে কিছুতেই মানল না, তখন গুলি চালিয়ে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হল দু’জনেরই শরীর।

যে মিলান শহরে মুসোলিনি শেষবার ফিরে আসতে চেয়েছিল, সেখানে আনা হল তার মৃতদেহ। তারপর এক প্রকাশ্য স্থানে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা হল মুসোলিনি ও ক্লারার শব, ক্ষিপ্ত সাধারণ নারী-পুরুষ তখন সেই ঝুলন্ত শবের ওপরেই থুতু, লাথি ও অন্যান্য এমন সব প্রক্রিয়া শুরু করল, তার বর্ণনা অত্যন্ত বীভৎস ও অশ্লীল বলে পরিগণিত হতে পারে, তা থেকে বিরত হওয়াই ভাল!

মৃত্যুর সময় হিটলারের বয়েস বাহান্ন বছর দশ দিন, মুসসালিনির বাষট্টি বছর।

এত বড় একটা মহাযুদ্ধে বিজয়ী তিন প্রধান রাষ্ট্রনায়কও জয়ের উল্লাস পুরোপুরি ভোগ করতে পারলেন না।

আমেরিকার সংবিধানে কোনও ব্যক্তিকেই দু’বারের বেশি প্রেসিডেন্ট হবার অধিকার দেওয়া হয়নি। কিন্তু আপৎকালে, সারা দেশের মানুষের এমনই আস্থা অর্জন করেছিলেন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট যে তিনি সমস্ত প্রথা ভেঙে পর পর চারবার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন। প্রচণ্ড মানসিক চাপে তাঁর শরীর ভেঙে পড়ছিল আস্তে আস্তে, চতুর্থবার প্রেসিডেন্ট হবার তিন মাস পর, এক মধ্যাহ্নে, রুজভেল্ট তাঁর জর্জিয়ার পার্বত্য নিবাসে আরামকেদারায় বসলেন বিশ্রাম নেবার জন্য। একজন মহিলা শিল্পী এই সময় তাঁর প্রতিকৃতি আঁকেন, রুজভেল্ট একটা সিগারেট ধরিয়ে তাঁকে বললেন, আমার কিন্তু ঠিক আর পনেরো মিনিট সময় আছে। ঠিক পনেরো মিনিট বাদেই তিনি জ্ঞান হারান এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁর শেষনিশ্বাস পড়ে। আর মাত্র তিন সপ্তাহ পরে জার্মানি আত্মসমর্পণ করে, হিটলারের চরম দুর্গতির কথাও জেনে যেতে পারলেন না রুজভেল্ট।

চার্চিল বেঁচে রইলেন বটে, কিন্তু ইংরেজ জাতির বিচিত্র স্বভাবের জন্য তিনি ক্ষমতাচ্যুত হলেন আকস্মিকভাবে। যুদ্ধ শেষ হতে না-হতেই ব্রিটেনের সাধারণ নির্বাচনে হেরে গেল রক্ষণশীল দল, প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারিত হলেন চার্চিল।

জার্মানির আত্মসমর্পণের পর পটসডামে একদা কাইজারের পল্লীপ্রাসাদে শুরু হয়েছে ঐতিহাসিক সম্মেলন। জার্মানি ও তার অঙ্গ রাজ্যগুলি কীভাবে ভাগাভাগি হবে, তাই নিয়ে আলোচনা চলছে মিত্র শক্তির প্রধানদের মধ্যেই। সম্মেলনের মধ্যপথেই চার্চিল তাঁর চেয়ার ছেড়ে দিতে বাধ্য হলেন ব্রিটেনের নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী এট্লিকে। চার্চিল এই মহাসময়ের অন্যতম প্রধান নায়ক, কিন্তু যুদ্ধের ফলাফল নিয়ে কথা বলার তাঁর আর কোনও সরকারি অধিকার রইল না। অবশ্য রয়ে গেলেন উপদেষ্টা হিসেবে।

একমাত্র স্টালিন তাঁর সাহসে, দৃঢ়তায় এবং সোভিয়েত জনগণের প্রচণ্ড আত্মত্যাগের মধ্যেও মনোবল জাগিয়ে রাখার কৃতিত্বে ক্ষমতায় অবিচল। কিন্তু তিনিও তখন হৃদরোগে আক্রান্ত এবং ফুসফুস দুর্বল, তাঁরও সিগারেট টানার দারুণ নেশা। অবশ্য এর পরেও তিনি আরও কয়েক বছর জীবিত থেকে সোভিয়েত ইউনিয়নকে সুসংহত করে গেছেন।

রুজভেল্ট ছিলেন অনেকটা উদারমনস্ক এবং ব্যক্তিগত ব্যবহারে অমায়িক। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনিই প্রথম সোভিয়েত ইউনিয়নকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেন, এবং তিনি মনে করতেন, অনবরত সংঘর্ষে না গিয়ে ওই দেশের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব। তিনি ছিলেন একনিষ্ঠ মানবতাবাদী, সে জন্য তাঁর দেশের কট্টর ক্যাপিটালিস্টরা তাঁকে কমিউনিস্টদের পক্ষপাতী বলতেও ছাড়েনি। চার্চিল ও স্ট্যালিনের চাপা শত্রুতা প্রশমনে তিনি বরাবর মধ্যস্থতা করে এসেছেন। তাঁর মৃত্যুতে স্ট্যালিন আন্তরিক শোকবার্তা পাঠালেন এবং সুপ্রিম সোভিয়েতের অধিবেশনে সমস্ত সদস্য উঠে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা জানালেন।

ভাইস প্রেসিডেন্ট ট্রুমান হলেন নব্য প্রেসিডেন্ট। ইনি আবার রক্ষণশীল এবং সোভিয়েত রাশিয়ার প্রতি বিদ্বেষ ভাবাপন্ন। প্রথম থেকেই তাঁকে উস্কানি দিতে লাগলেন চার্চিল।

ইউরোপীয় যুদ্ধের পরিণতি দেখে চার্চিল খুশি হতে পারেননি। হিটলারের বর্বরতার অবসান হল বটে, কিন্তু চার্চিল আশা করেছিলেন, এই যুদ্ধের ধাক্কায় সোভিয়েত রাশিয়াও হীনবল হয়ে যাবে, আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু সে রকম তো হল না! বেশ কয়েকটি সম্মেলনে স্ট্যালিনের সঙ্গে চার্চিলকে করমর্দন করতে হয়েছে বটে, কিন্তু তার অন্তরটি যে কমিউনিজম বিদ্বেষে ভরা। সোভিয়েত সৈন্যরা আগেভাগেই এসে বার্লিন দখল করে নিয়েছে, এটা যেন তাঁর ব্যক্তিগত পরাজয়। আমেরিকান সৈন্যরাই যাতে আগে বার্লিনে পৌঁছয় এ জন্য তিনি বহু রকম চেষ্টা করেছেন। কিন্তু জেনারেল আইসেন হাওয়ার তখন রাজনীতি নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। তিনি প্রকৃত সেনাপতির মতন যুদ্ধনীতি মেনে সহযোগী রুশ বাহিনীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে চাননি।

এর পরেও যে সোভিয়েত রাশিয়াকে প্রতিহত করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে, এই মর্মে চার্চিল আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ট্রুমানকে প্ররোচিত করে যাচ্ছিলেন। ট্রুমানের তাতে আদর্শগত আপত্তি না থাকলেও তখনই তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বিষিয়ে তুলতে রাজি হলেন না। তখনও জাপানের সঙ্গে যুদ্ধ শেষ হয়নি, এশীয় রণাঙ্গনে স্ট্যালিনের সহায়তার প্রয়োজন আছে। ট্রুমান সেই জন্যই রুজভেল্ট-নীতি বিশেষ বদলালেন না।

জাপানের পরাজয়ও অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু প্রশ্ন হল, কতদিন পর? উভয় পক্ষেরই ক্ষয়ক্ষতি প্রচণ্ড। এক একটা ছোট ছোট দ্বীপ দখল করতে গিয়ে আমেরিকান বাহিনীকে যত সৈন্যের প্রাণ ও অস্ত্রসম্ভার দণ্ড দিতে হয়, তা কোনও যুদ্ধেরই হিসেবের সঙ্গে মেলে না। জাপানি সৈনিকেরা লড়াই করে উন্মত্তের মতন, তারা প্রাণ দেয়, ধরা দেয় না। মাত্র আট বর্গমাইল আয়তনের একটি দ্বীপ আইও জিমা, সেখানে অবতরণ করে মার্কিন পক্ষে হতাহত হয় কুড়ি হাজারেরও বেশি। জাপানিরা নিহতই হয় একুশ হাজার, আহত অনেক বেশি, বন্দি করা যায় মাত্র দু’শো জনকে।

আমেরিকানদের ঐতিহ্য বলে কিছু নেই, তাদের জোর আত্মনির্ভরতা। জাপানিরা ঐতিহ্যের প্রতি অন্ধভাবে অনুগত, এবং দেশের সম্মান রক্ষায় ব্যক্তি-প্রাণ তুচ্ছ। সংস্কার যখন কুসংস্কারে পরিণত হয়, তখন তার তীব্রতা আরও বাড়ে। মূল জাপান ভূখণ্ড থেকে মাত্র তিনশো বাষট্টি মাইল দূরের ওকিনাওয়া দ্বীপটিও যখন হাতছাড়া হয়ে যায়, তখন জাপানের জঙ্গিগোষ্ঠী মধ্যযুগীয় এক কাহিনী প্রচার করে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে মোঙ্গল সম্রাট কুবলাই খান এক বিশাল নৌবাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসছিল জাপান দখল করতে। জাপান কখনও বিদেশি শক্তির কাছে বশ্যতা স্বীকার করেনি, তাই সে দেশকে রক্ষা করার জন্য সে সময় জাপানিদের আরাধ্য সূর্যদেবতা এক দৈব ঝড় সৃষ্টি করলেন, তাতেই কুবলাই খানের রণতরীগুলি ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল। সেই দৈব ঝড়, জাপানি ভাষায় কামিকাঝি (Kamikaze), একালে সৃষ্টি করবে জীবন্ত মানুষ। এক ঝাঁক ছোট ছোট বিমান নিয়ে পাইলটরা সোজা উড়ে গিয়ে ঝাঁপ দেবে বিপক্ষ সৈন্যদের মধ্যে, নিজেরা ধ্বংস হবে, বিপক্ষেও ধ্বংসের আগুন জ্বালাবে। যে শত্রু নিজের প্রাণ বাঁচাবার চিন্তা করে না কিংবা পশ্চাৎ অপসরণের পথ খোলাই রাখে না, তার সঙ্গে যুদ্ধ করা অতি কঠিন। এই কামিকাঝি পাইলটদের জ্বালায় আমেরিকানরা বিপর্যস্ত।

এদিকে চিনের কুওমিনটাং সরকারের সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির একটা সাময়িক সমঝোতা হয়েছে, গৃহযুদ্ধ তখনকার মতন এড়ানো গেছে। চিয়াং কাইসেকের সঙ্গে আলোচনা ও কিছুটা দরাদরির পর স্ট্যালিন সন্তুষ্ট হলেন এবং জাপানের সঙ্গে নিরপেক্ষতার চুক্তি বাতিল করে দিলেন। চিনে তখনও কুড়ি লক্ষ জাপানি সৈন্য রয়ে গেছে। তাদের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে নামা আমেরিকানদের পক্ষে অসুবিধেজনক, বরং মাঞ্চুরিয়ার দিক থেকে রুশ সৈন্যবাহিনীর চাপ সৃষ্টি করা অনেক বাস্তব সম্মত। সেই সুযোগে মূল জাপান ভূখণ্ডে অগ্নিবৃষ্টি চালিয়ে যাবে মার্কিনরা।

জাপান এখন এই সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে, আত্মসমর্পণ ছাড়া অন্য পথ নেই। জাপানের সম্রাট আত্মসমর্পণের জন্য রাজিও হয়ে আছেন বাধ্য হয়ে। কিন্তু এর মধ্যে, মার্কিন, ব্রিটেন ও চিনের রাষ্ট্রনায়কদের পক্ষে জাপানকে বিনা শর্তে আত্মসমর্পণের জন্য একটি চরমপত্র দেওয়া হয়েছে। আত্মসমর্পণ ও নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মধ্যে তফাত আছে, জার্মানি নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করেছে, তারা করতে পারে, কারণ জার্মানি আগেও যুদ্ধে হেরেছে অপমানজনকভাবে, কিন্তু জাপান তো কারুর কাছে কখনও পরাজিত হয়নি, সুতরাং যুদ্ধ থামাতে গেলে তার সম্মানজনক শর্ত চাই। এই সম্মানের প্রশ্ন নিয়ে টানাটানিতে প্রাণ দিতে লাগল লক্ষ লক্ষ মানুষ। আত্মসম্মান রক্ষার জন্য জাপানিরা যখন-তখন হারাকিরি বা আত্মনিধনে প্রস্তুত, সেই একই কারণে তারা পুরো দেশটাকেই ধ্বংস করে দিতে রাজি।

এর মধ্যেই নির্মিত হয়ে গেল সেই অস্ত্র, মহাভারতের ভাষায় যাকে ব্ৰহ্মাস্ত্র বলা যেতে পারে।

পদার্থের ক্ষুদ্রতম রূপটির নাম পরমাণু। এর গ্রিক নাম অ্যাটম, যার অর্থই হল, যে জিনিস আর ভাঙা যায় না। কিন্তু বিজ্ঞানীদের কৌতূহল অদম্য, তাঁরা কোনও কিছুই চূড়ান্ত শেষ বলে মেনে নিতে চান না। গত শতাব্দী থেকেই কিছু কিছু বৈজ্ঞানিকের মনে প্রশ্ন জেগেছিল, সত্যিই কি পরমাণু আর ভাঙা যায় না? ভাঙলে কী হয়?

বিজ্ঞানীরা যে কোনও আবিষ্কারেরই পরবর্তী ধাপের দিকে এগিয়ে যেতে চান গবেষণার আকর্ষণে। একজন একটা নতুন পথ দেখালে অন্য বিজ্ঞানীরা সন্ধান দেন অজ্ঞাতপূর্ব নানান সম্ভাবনার। যেমন কোপারনিকাস-জিয়োদার্নো ব্রুনো-গ্যালিলিও জীবনের ঝুঁকি নিয়েও প্রচার করলেন, পৃথিবী নিশ্চল নয়, সূর্য পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ভ্রমণ করে না প্রতিদিন। বাইবেলের সৃষ্টিতত্ত্ব নিছক রূপকথা, বহু শতাব্দী ধরে প্রচলিত অ্যারিস্টটলের তত্ত্বও ভুল, সূর্যের আবর্তে পৃথিবীই ঘূর্ণ্যমান। নিউটনের যুগান্তকারী আবিষ্কার মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব তারই পরবর্তী পদক্ষেপ। বিজ্ঞানের এই অগ্রগতি ও সভ্যতার অগ্রগতি সমান্তরাল। বিজ্ঞান মানুষের জীবনযাত্রার অনেক উপকরণ জুগিয়ে দিয়েছে, চিকিৎসা, কৃষি, বাস্তুশাস্ত্র ইত্যাদিতে ঘটিয়ে দিয়েছে অভাবিত পরিবর্তন। আবার বিজ্ঞানীদের গবেষণায় রাষ্ট্রনায়করা অনেক মারাত্মক অস্ত্র নির্মাণেও সক্ষম হয়েছে। বিজ্ঞানীরা সত্যের সাধক, কিন্তু কখনও কখনও তাঁদের কেউ কেউ প্রলোভনের বশে কিংবা শাসকশ্রেণীর হুমকিতে, সৃষ্টির বদলে নিযুক্ত হয়েছেন ধ্বংসের কাজে।

বিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞান-প্রতিভা অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। তিনি মানবতাবাদী ও শান্তির সপক্ষে। মহাত্মা গাঁধীর সঙ্গে শান্তির আন্দোলনেও তিনি সহমর্মিতা জানিয়েছিলেন। কিন্তু পরমাণু বোমার মতন একটি বিরাট বিধ্বংসী অস্ত্র নির্মাণের ব্যাপারে তিনি অনেকটাই দায়ী। পরবর্তীকালে তিনি এ জন্য খুবই অনুতাপ বোধ করেছিলেন, কিন্তু ততদিনে যা হবার তা হয়ে গেছে। সম্ভবত হিটলারের অগ্রগতি রোধ করার একমাত্র চিন্তাই তাঁকে পেয়ে বসেছিল, অন্যভাবে মানব সভ্যতার সর্বনাশের কথা তাঁর মনে আসেনি।

জার্মানরা পরমাণু বিভাজন ঘটিয়ে ফেলেছে এবং তা দিয়ে বোমা বানাচ্ছে, এরকম একটা ফিসফিসানি শোনা যাচ্ছিল যুদ্ধ শুরু হবার আগেই৷ জার্মান বিজ্ঞানীরা আটত্রিশ সালেই বার্লিনে পরীক্ষামূলকভাবে পরমাণু বিভাজন সত্যিই ঘটিয়েছে কিন্তু বোমা তৈরির ব্যাপারে বিশেষ এগোতে পারেনি, এবং আমেরিকানরাও এ ব্যাপারে তেমন গুরুত্ব দেয়নি। উনিশ শো ঊনচল্লিশের ২ অগাস্ট রুজভেল্টকে একটি চিঠি লিখলেন আইনস্টাইন, তাতে তিনি জানালেন যে গত চার মাসে কয়েকজন বিজ্ঞানীর গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে অনেকখানি ইউরেনিয়াম বিভাজনে যে ধারাবাহিক প্রতিক্রিয়া, তাতে যে প্রচণ্ড শক্তির সৃষ্টি হয়, তা দিয়ে অত্যন্ত বিধবংসী বোমা বানানো সম্ভব। এই যে নতুন ধরনের অসম্ভব শক্তিশালী বোমা, তার একটি মাত্র কোনও বন্দরে নিক্ষিপ্ত হলে সেই বন্দরটি তো পুরোপুরি ধ্বংস হবেই, তার আশেপাশের এলাকাতেও আগুন জ্বলবে।

এত বড় একজন বিজ্ঞানীর সুপারিশ অবহেলা করবেন কী করে রুজভেল্ট। তাঁর নির্দেশেই অতি গোপন ও অতি ব্যয়বহুলভাবে শুরু হল সেই বোমা বানাবার প্রক্রিয়া। তিনি অবশ্য শেষ পর্যন্ত সেই বোমা দেখে যেতে পারেননি, তার ধ্বংসক্ষমতাও জেনে গেলেন না।

ইংরেজরাও পরমাণু-অস্ত্র নির্মাণে প্রবৃত্ত হয়েছিল, কিন্তু ইংল্যান্ডে যখন-তখন জার্মান বিমান এসে বোমাবর্ষণ করে, তাদের গবেষণাকেন্দ্র ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, তাই সেই উদ্যোগ বন্ধ করে দিয়ে ব্রিটিশ বিজ্ঞানীরাও আমেরিকানদের সঙ্গে হাত মেলালেন। আইনস্টাইন ছাড়াও ফ্যাসিস্ট ও নাৎসিদের অত্যাচার থেকে বাঁচবার জন্য বহু বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী এসে আশ্রয় নিয়েছেন আমেরিকায়, তাঁদের মধ্যে আছেন ইতালির এনরিকো ফেরমি, ডেনমার্ক থেকে নীল্স বোর, এঁদের পরামর্শও ছিল অতি মূল্যবান। তবে সবচেয়ে বেশি দায়িত্ব নিয়ে যুক্ত হয়েছিলেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী ওপেনহাইমার। শেষ পর্যন্ত তিনিই পরিচিত হয়ে উঠলেন অ্যাটম বোমার জনক হিসেবে।

আশ্চর্য মানুষ এই ওপেনহাইমার। বিজ্ঞানী বলতেই যেমন মনে হয়, চোখে পুরু লেন্সের চশমা, দাড়ি কামালে সময় নষ্ট হয় বলে মুখ ভর্তি দাড়ি, কোলকুঁজো, সর্বক্ষণ হয় মাইক্রোস্কোপে চোখ অথবা অঙ্ক কষছেন, এর সঙ্গে ওপেনহাইমারের কোনও মিলই নেই। তিনি সুপুরুষ ও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর, অধ্যাপক হিসেবে বিখ্যাত তো বটেই, তা ছাড়াও নানা দিকে তাঁর উৎসাহ৷ সাহিত্য ভালবাসেন, জানেন অনেকগুলি ভাষা, তার মধ্যে সংস্কৃত অন্যতম, গীতার বেশ কিছু অংশ তাঁর কণ্ঠস্থ, দর্শনচর্চা করেন, আবার প্রেম-চর্চাতেও সময়ের অভাব হয় না। পদার্থের পরমাণু বিভাজনে যে প্রচণ্ড শক্তি উৎপন্ন হয়, তা একটি তত্ত্ব, তা সত্যি সত্যি উৎপন্ন করা সম্ভব কি না, এটা জানাই যেন বৈজ্ঞানিকের একমাত্র উদ্দেশ্য। পাঁচ বছর ধরে ওপেনহাইমার তিন-চারটি গোপন কেন্দ্রে এই অস্ত্রের প্রস্তুতিপর্ব পরিদর্শন করেছেন অক্লান্তভারে।

অবশেষে পরীক্ষার দিনটি নির্দিষ্ট হল পঁয়তাল্লিশ সালের ষোলোই জুলাই। নিউ মেক্সিকোর মরুভূমিতে সফলভাবে বিস্ফোরিত হল পৃথিবীর প্রথম অ্যাটম বোমা। মানুষ কল্পনা করতে পারে না এমন প্রচণ্ড শব্দ, মানুষ কল্পনা করতে পারে না এমন আলোর বিচ্ছুরণ, পাথর পর্যন্ত গলে গিয়ে আগ্নেয়গিরির লাভার মতন শূন্যে উত্থিত হল, তাতে নানা রকম রং, বিস্ফোরণের পর বিস্ফোরণে তৈরি হল এক ভয়ংকর মেঘ, তা ব্যাঙের ছাতার আকারে ক্রমাগত উঠতে লাগল ওপরে …।

দশ মাইল দূরে, পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রের জানলায় দাঁড়িয়ে ছিলেন ওপেনহাইমার, প্রথম সেই প্রলয়ংকর আলোর ঝলকানি দেখে তিনি অস্ফুট স্বরে আবৃত্তি করলেন গীতার শ্লোক:

দিবি সূর্যসহস্রস্য ভবেদ্ যুগপদুত্থিতা

যদি ভ্যঃ সাদৃশী সা স্যাদ ভাসস্তস্য মহাত্মন্

(যদি কখনও আকাশে একই সঙ্গে সহস্র সূর্যের উদয় হয়, তা হলে সেই দীপ্তি পরমাত্মার জ্যোতির সঙ্গে কিছুটা তুলনা করা যেতেও পারে।)

খানিক বাদে ওপেনহাইমারের মনে অন্য একটি বোধ এল। এ তো শুধু বিজ্ঞানের জয়যাত্রা নয়, মেধার সাফল্য নয়, এ যে অস্ত্র, মানুষের ইতিহাসের ভয়ালতম অস্ত্র, এই একটি মাত্র বোমায় কত মানুষের প্রাণ যাবে? যা ছিল তত্ত্ব, তার যে এমন ভয়ংকরতম রূপ হবে, তা কেন আগে খেয়াল করা হয়নি? বিভ্রান্ত ওপেনহাইমার আবার সান্ত্বনা খুঁজলেন গীতার শ্লোকে:

কালোহস্মি লোকক্ষয়কৃৎ প্রবৃদ্ধ

লোকান্ সমাহর্তুমিহ প্রবৃত্তঃ।

ঋতেহাপি ত্বা ন ভবিষ্যন্তি সর্বে

যেহবস্থিতাঃ প্রত্যনীকেষু যোধাঃ।।

(মহাভারতের যুদ্ধের প্রারম্ভে হঠাৎ অর্জুন বিমর্ষ হয়ে পড়লেন। এই যুদ্ধে কত মানুষের প্রাণ যাবে, তাদের মধ্যে নিজেদের আত্মীয়-স্বজনও রয়েছেন, তবে কেন এই যুদ্ধ? অর্জুন হাত থেকে ধনুক ও শর নামিয়ে রাখলেন। তখন তাঁর সারথি কৃষ্ণ অর্জুনকে বিশ্বরূপ প্রদর্শন করে বললেন,

আমি লোকক্ষয়কারী প্রবৃদ্ধ কাল

এখন লোকসংহারে প্রবৃত্ত হয়েছি

তুমি যুদ্ধ না করলেও এখানে যে সব

বীরগণ রয়েছেন

তাঁরা কেউই আর বেঁচে থাকবেন না)

এরকম একটা পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ সত্যিই ঘটানো যাবে কি না, তা শেষ দিন পর্যন্ত অনিশ্চিত ছিল। প্রেসিডেন্ট ট্রুমান যখন জার্মানির পটসডামে মিত্র শক্তির সম্মেলনে যোগ দিতে গেলেন, তখনও তিনি এর সাফল্যের কথা জেনে যাননি। সেখানে তাঁর কাছে সাঙ্কেতিক বার্তা পৌঁছল। সঙ্গে সঙ্গে তিনি জানালেন চার্চিলকে। দু’জনেই আনন্দে আত্মহারা। এবার জয় তাঁদের হাতের মুঠোয়।

স্ট্যালিন সম্পর্কে তাঁদের মনোভাবও বদলে গেল, কিংবা বলা যায়, আসল মনোভাব প্রকটিত হয়ে পড়ল। স্ট্যালিনকে আর তোয়াজ করার দরকার নেই, কারণ জাপানকে ঠাণ্ডা করতে আর রাশিয়ার সাহায্যের দরকার হবে না। যুদ্ধে অংশ নেবার বদলে জাপানের কিছু অংশ দাবি করেছেন, তা তাঁকে দেওয়া হবে কেন? ইউরোপ ভাগাভাগির প্রশ্নেও আরও কঠোর হওয়া যেতে পারে। রাশিয়া সম্পর্কে রুজভেল্ট-নীতি বজায় রাখার আর কোনও প্রয়োজন নেই।

জাপানে এই পারমাণবিক বোমাবর্ষণের সিদ্ধান্ত নেন ট্রুমান, নিজ দায়িত্বে। আমেরিকার বিজ্ঞানীরা এর বিরুদ্ধে ছিলেন। আমেরিকা এরকম একটি বোমা তৈরিতে সক্ষম হয়েছে। এটা জানিয়ে দেওয়াই যথেষ্ট, বোমা ফেলে জাপানের অজস্র সাধারণ মানুষের জীবননাশ করতে হবে কেন? একদল বৈজ্ঞানিক পরীক্ষামূলক ভাবে বোমাটির বিধ্বংসী ক্ষমতা দেখে আতঙ্কিত হয়ে আইনস্টাইনের কাছে এসে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেছিলেন, এই বোমা যুদ্ধের কাজে ব্যবহার না করার জন্য তিনি প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের কাছে আবেদন করেন। আইনস্টাইন রাজি হয়ে চিঠি লিখেওছিলেন। কিন্তু রুজভেল্ট সে চিঠি পড়ার সময় পাননি, হঠাৎ তাঁর মৃত্যু হয়। রুজভেল্টের টেবিলে অনেক কাগজ পত্রের মধ্যে সে চিঠি না-খোলা অবস্থায় পড়েছিলেন! স্বয়ং জেনারেল আইসেনহাওয়ারও পটসডামের সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন, তিনিও জানালেন যে জাপান হারতে বসেছে, এই অবস্থায় এরকম একটি অস্ত্রাঘাত মানবতাবিরোধী।

কিন্তু ট্রুমান এসব সদুপদেশে কর্ণপাত করলেন না। চার্চিলের সমর্থন অবশ্যই ছিল। তাঁদের যুক্তি এই, জাপানি সেনারা যে-ভাবে মরিয়া হয়ে লড়ছে, তাতে যুদ্ধ শেষ করতে গেলে আরও অন্তত দশ লক্ষ আমেরিকান সৈন্য ও পাঁচ লক্ষ ব্রিটিশ সৈন্যের প্রাণ যাবে। জাপানেও কত মানুষের প্রাণ যাবে তার ঠিক নেই। সে কারণেই দ্রুত যুদ্ধ সমাপ্তির জন্য জাপানকে একবার অন্তত এরকম দৃষ্টান্তমূলক আঘাত করা দরকার।

স্ট্যালিনকে এই ব্রহ্মাস্ত্রের কথা জানানো হবে কি, হবে না? না জানালেই ভাল হয়। অনেকক্ষণ নিভৃতে আলাপ-আলোচনার পর ট্রুমান ও চার্চিল ঠিক করলেন, মিত্রশক্তি এখনও ভেঙে যায়নি, প্রধান ত্রয়ীর অন্যতম স্ট্যালিন, তাঁকে এই ব্যাপারে অন্ধকারে রাখা একেবারেই নীতিবিরুদ্ধ হয়ে যাবে এবং এ জন্য স্বদেশেই তাঁদের সমালোচনা শুনতে হবে। তবে লিখিতভাবে জানাবার বদলে মুখে জানানো যায়, লিখিতভাবে জানাতে গেলে সবিস্তারে জানাতে হয়, মুখে অসমাপ্ত বাক্য দিয়েও কাজ চলে। একদিন সম্মেলনের অধিবেশন শেষে সবাই হোটেলে ফিরছেন, ট্রুমান আড়ালে ডেকে নিয়ে গেলেন স্ট্যালিনকে। অদূরে দাঁড়িয়ে চুরুট ফুঁকতে ফুঁকতে কৌতুকহাস্যময় মুখে অপেক্ষা করতে লাগলেন চার্চিল। এখানে একটি ক্ষুদ্র নাটক অনুষ্ঠিত হল। ট্রুমান জানালেন, তাঁরা একটা অসাধারণ বিধ্বংসী নতুন অস্ত্র আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু ট্রুমান নিউক্লিয়ার বা অ্যাটমিক শব্দ দুটি উল্লেখও করলেন না। কোনও মন্তব্যই করলেন না স্ট্যালিন। তিনি আগে থেকেই জানতেন? তা সম্ভব নয়। কিংবা ক্লান্ত ছিলেন, নিজের কক্ষে ফিরে বিশ্রাম নেবার জন্য উদগ্রীব ছিলেন? ফিরে এসে ট্রুমান চার্চিলকে বললেন, উনি তো কোনও প্রশ্ন করলেন না! চার্চিল এমন একখানি হাসি দিলেন যাতে বোঝা গেল, তিনি সেটাই ধরে নিয়েছিলেন। চার্চিল এরকমই লিখে গেছেন তাঁর আত্মজীবনীতে।

এই ঘটনার ঠিক তেরোদিন পর ৬ অগাস্ট সকাল ৮টা ১১ মিনিটে মার্কিন বিমান থেকে জাপানের হিরোসিমা শহরে প্রথম অ্যাটম বোমা নিক্ষিপ্ত হল। কয়েক মিনিটের মধ্যে ধ্বংস হল শহরের ষাট ভাগ অংশ, ৭৮ হাজার জীবন্ত মানুষ শব হয়ে গেল যেন চোখের নিমেষে। অগ্নিদগ্ধ হয়ে ছটফট করতে লাগল আরও হাজার হাজার মানুষ, বহু গর্ভিণীর গর্ভপাত হয়ে গেল, পুরুষত্ব হারাল বহু পুরুষ, বিকলাঙ্গ হয়ে গেল কত সহস্র, এই ধ্বংসের প্রক্রিয়া চলতেই লাগল। নরকের কল্পনাও এত বীভৎস নয়।

ট্রুমান হয়তো আশা করেছিলেন, এই এক আঘাতেই জাপানে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠবে। আত্মসমর্পণের আর একদিনও দেরি হবে না। কিন্তু জাপানের দিক থেকে কোনও সাড়াশব্দই নেই। নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ? যাঁরা জীবন রক্ষার চেয়েও আত্মসম্মান রক্ষাকে বেশি মূল্য দেয়, তাঁরা করবে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ? সম্রাটের মর্যাদা রক্ষার কোনও শর্ত থাকবে না? জাপানি যুদ্ধ-অপরাধীদের বিচার হবে জাপানের বাইরে? জাপানি সৈন্যদের হাত থেকে অস্ত্র কেড়ে নেবে আমেরিকানরা, সৈন্যরা তা মেনে নেবে?

তা ছাড়া আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেবে কে? প্রধানমন্ত্রী, প্রধান সেনাপতি, উপদেষ্টা পরিষদের কেউই সে দায়িত্ব নিতে রাজি নন। যিনি নেবেন, তিনিই দেশবাসীর চোখে ঘৃণ্য হবেন। একদল উগ্রবাদী যুবক পথে পথে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাঁরা ঘোষণা করেছে, যে আত্মসমর্পণের কথা উচ্চারণ করবে, তাকেই হত্যা করা হবে। সেনাধ্যক্ষদের মধ্যেও অনেকেরই এরকম মনোভাব। একমাত্র এ দায়িত্ব নিতে পারেন সম্রাট, তাঁর কথার প্রতিবাদ করার সাধ্য কারুর নেই। জাপানিদের কাছে তাঁদের সম্রাট স্বয়ং দেবতা, জাপানে যাঁরা আত্মহত্যা করে তারা সম্রাটের প্রাসাদের দিকে মুখ করে বসে পেটে ছুরি চালায়।

তিনদিন অপেক্ষা করার পর ট্রুমান দ্বিতীয় বোমাটি ফেলার আদেশ দিলেন। কোকুরা এবং নাগাসাকি, এই দুটি শহরের মধ্যে বেছে নেওয়া হবে যে-কোনও একটিকে। বিমানটি প্রথমে উড়ে এলো কোকুরাতে, সেখানকার আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, ওপর থেকে শহরটি দেখাই যায় না। বিমানটি চক্রাকারে ঘুরতে লাগল, কিন্তু বিশাল ওজনের বোমাটি নিয়ে বেশিক্ষণ ঘোরা যাবে না, জ্বালানি ফুরিয়ে আসছে, তাই বিমানের মুখ ঘুরে গেল নাগাসাকির দিকে। সেখানকার আকাশেও ঘন মেঘের আবরণ। কিছুই দেখা যায় না। তবে কি ফিরে যেতে হবে? হঠাৎ মেঘ একটু ফাঁক হল, নীচে দেখা গেল পাহাড় প্রান্তের শহরটিকে একঝলক। বৈমানিক আর মুহূর্তও দেরি না করে বোমাটি সেখানে নিক্ষেপ করে চম্পট দিল। আকাশের মেঘ বাঁচিয়ে দিল কোকুরা শহরের মানুষদের, আবার সেই আকাশের মেঘ আচম্বিতে নাগাসাকির লক্ষ লক্ষ মানুষের ওপর নেমে এলো মৃত্যুঝড় হয়ে। এবারের বোমাটি আরও শক্তিশালী, ধ্বংসলীলা আরও প্রচণ্ড।

এর মধ্যে স্ট্যালিন একটা অদ্ভুত কাণ্ড করে বসলেন। হিরোসিমায় পতিত অ্যাটম বোমাটির ধ্বংস করার ক্ষমতা দেখেই বোঝা গিয়েছিল, জাপানের শেষ দশা ঘনিয়ে এসেছে। জাপানের রণতরীবাহিনী আগেই শেষ হয়ে গেছে, আর সে দেশের পক্ষে স্থলযুদ্ধ চালানোও সম্ভব নয়। স্ট্যালিন সোভিয়েত জনগণকে পরমাণু অস্ত্রটির কথা সঠিক জানতেই দিলেন না, সংবাদপত্রগুলিতেও এমন অকিঞ্চিৎকরভাবে ছাপা হল, যাতে কেউ গুরুত্ব না দেয়। এবং হিরোসিমার দু’দিন পর রাশিয়ার পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হল। সঙ্গে সঙ্গে মাঞ্চুরিয়ায় ঢুকে পড়ল রাশি রাশি রুশ সৈন্য। এ কি মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা? নাকি লুঠের মালের বখরা নেবার জন্য হুড়োহুড়ি? কিংবা জাপান জয়ের কৃতিত্ব স্ট্যালিন শুধু আমেরিকাকে দিতে চাননি? দ্বিতীয় বোমায় নাগাসাকি বিধ্বস্ত হবার পরেও যেন তা উপেক্ষা করে মাঞ্চুরিয়ায় রুশ সাফল্যের কথাই বিস্তারিতভাবে জানানো হল তাঁর দেশবাসীকে। এসব তবু বোঝা যায়। প্রত্যেক দেশই নিজের স্বার্থ দেখবে, এতে আর আশ্চর্যের কী আছে! কিন্তু যুদ্ধ শেষে স্ট্যালিনের বিবৃতি বেশ বিভ্রান্তিকর। ১৯০৪-৫ সালে জারের আমলের রাশিয়া জাপানের কাছে যুদ্ধে পরাজিত হয়ে পোর্ট আর্থার ও অন্য কিছু অঞ্চল হারিয়েছিল। এবারে জাপান পরাজিত হল রাশিয়ার কাছে। এতদিন পরে প্রতিশোধ নেওয়া হল সেই পূর্ব-পরাজয়ের। স্ট্যালিন বললেন, ‘আমার মতন বয়স্ক ব্যক্তিরা গত চল্লিশ বছর ধরে এই দিনটিরই অপেক্ষা করছিলাম। আজ সেই দিন এসেছে!’ একজন মার্ক্সবাদীর মুখে সাম্রাজ্যবাদী জারের আমল ও সেই ঐতিহ্যের সমর্থন!

পরপর দুটি অ্যাটম বোমার ধ্বংস ক্ষমতা দেখে জাপানের সমরনায়কদের বোধোদয় হল যে এর পরেও যুদ্ধ চালিয়ে যাবার চেষ্টা করলে জাপান নামের দেশটাই পৃথিবীপৃষ্ঠ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। এরই মধ্যে গুজব ছড়াল যে নাগাসাকির তিনদিন পর খোদ টোকিও’র ওপরেই তৃতীয় অ্যাটম বোমাটি নিক্ষিপ্ত হবে। মাঞ্চুরিয়াতে রুশ আক্রমণের সংবাদেও তাঁদের হতবুদ্ধি করে দিয়েছে। নিরুপায় হয়ে তাঁরা সম্রাটের দ্বারস্থ হল। জাপানের সম্রাট সর্বক্ষণ নিজেকে আড়াল করে রাখেন, দেশের মানুষের সঙ্গে কখনও সরাসরি কথা বলেন না। তবু চরম সর্বনাশ রোধ করার জন্য তরুণ সম্রাট হিরোহিতো দেশবাসীকে আত্মসমর্পণের প্রয়োজনীয়তা জানিয়ে ভাষণ দিতে রাজি হলেন। জাপান সরকারের পক্ষ থেকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ মেনে নিয়ে শুধু একটি আবেদন যুক্ত করা হল, যেন সম্রাটের মর্যাদা অন্তত রক্ষিত হয়।

১৫ আগস্ট বিকেল ৪টে বেজে পাঁচ মিনিটে সেই সংবাদ ঘোষিত হওয়ার পর বিশ্বযুদ্ধের অবসান হল। জাপানে পড়ে গেল আত্মহত্যার হিড়িক।

জাপানে অ্যাটম বোমার আক্রমণের সত্যিই কি কোনও প্রয়োজন ছিল? এমন কথিত আছে যে প্রথম পারমাণবিক অস্ত্রটির বিস্ফোরণের সময় প্রিন্সটনের সেন্টার অফ অ্যাডভান্সড স্টাডিজ-এর গবেষণা কক্ষে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন মাথায় হাত দিয়ে মুখ কালো করে বসেছিলেন। হাহাকার করেছেন অন্য অনেক বৈজ্ঞানিক। কিন্তু তাঁরাই এই অস্ত্র তুলে দিয়েছেন এক রাষ্ট্রনায়কের হাতে। এই অস্ত্র যে মানব সভ্যতার ওপরেই চরম আঘাত করতে পারে, সেটুকু বোঝার মতন দূরদর্শিতা ওপেনহাইমারের মতন বৈজ্ঞানিকদের ছিল না? গীতার শ্লোকের আশ্রয় নেওয়া ছলনা মাত্র। তিন-চার হাজার বছর আগেকার দর্শন দিয়ে বর্তমানকালের বিচার চলে না।

পীত রঙের জাপানিদের হত্যা করার বদলে শ্বেতাঙ্গ জার্মানদের ধ্বংস করার জন্য জার্মানিতে কি অ্যাটম বোমা ফেলা হত? এ প্রশ্ন কিছুটা অবান্তর মনে হতে পারে, কেন না অ্যাটম বোমা নির্মাণ-প্রক্রিয়া শুরুই হয়েছিল হিটলারের রণ-উন্মাদনা থামাবার জন্য। কিন্তু অস্ত্রটির সফল পরীক্ষার আগেই হিটলার ধরাধাম পরিত্যাগ করেছে এবং ইউরোপে যুদ্ধ থেমে গেছে। যদি ইউরোপের যুদ্ধ আরও প্রলম্বিত হত, হিটলার আত্মহত্যা না করত, তা হলেও কি জার্মানিতে নিক্ষিপ্ত হত এই মারণাস্ত্র, যাতে লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের মৃত্যু অনিবার্য? আমেরিকার বহু নাগরিক প্রাক্তন জার্মান, তাঁরা নিশ্চয়ই প্রতিবাদে সরব হত। আড়াইশো কোটি ডলার খরচ করে যে বস্তুটি নির্মিত হল, তার ধ্বংসক্ষমতা পরীক্ষা করে দেখার জন্যই সেটি ফেলা হয় জাপানে। ট্রুমানের আর একটি উদ্দেশ্য, স্ট্যালিনকে তাঁর এই অসাধারণ শক্তি প্রদর্শন করা। অর্থাৎ এক যুদ্ধ শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল ঠাণ্ডা যুদ্ধ। বিশ্বশান্তি স্থাপনের আশা মিলিয়ে গেল শূন্যে।

শুধু মানবিক কারণে নয়, সামরিক কারণেও জাপানে এই পরমাণু বোমাবর্ষণ অপ্রয়োজনীয় ছিল। এই বোমার প্রবল সমর্থক চার্চিল পর্যন্ত স্বীকার করেছেন, ব্রিটেনের মতনই জাপান একটি দ্বীপরাজ্য, নৌবাহিনী না থাকলে এরকম দেশ অচল হয়ে পড়ে। অ্যাটম বোমা ফেলার আগেই জাপানের নৌশক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছিল, সুতরাং জাপানের পতন কিছুদিনের অপেক্ষা মাত্র। পৃথিবীর বহু দেশের সমর-বিশেষজ্ঞগণ, তাঁদের মধ্যে কিছু আমেরিকানও আছেন, জাপানের প্রতি এই অস্ত্রাঘাতের জন্য আমেরিকাকে ভর্ৎসনা করেছেন। যুদ্ধ প্রলম্বিত হবার হিসেব এবং তিরিশ-চল্লিশ লক্ষ সৈন্যের সম্ভাব্য মৃত্যুর পরিসংখ্যান অতিরঞ্জিত। খাদ্য-অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেলে জাপান যুদ্ধ চালাত কী করে?

অস্ত্রটি আদৌ নির্মাণ করারই কি কোনও প্রয়োজন ছিল? শুধু বিজ্ঞানের একটি নতুন তত্ত্বের সাফল্যের জন্যই এতখানি ঝুঁকি? যখন তত্ত্বটি পরীক্ষিত সত্য হিসেবে জানা হয়ে গেল, তখন মধ্যপথে সেই শক্তি ধ্বংসের কাজে না লাগিয়ে জীবনযাত্রার উন্নতির বহু কাজে লাগানো যেত না? কিংবা যুদ্ধের অবসানে ট্রুমান কি ঘোষণা করতে পারতেন না যে আর একটিও অ্যাটম বোমা উৎপন্ন হবে না? কলসি থেকে যে দৈত্যকে বার করা হয়েছে, তাকে আবার কলসিতে ভরে সমুদ্রে ডুবিয়ে দেওয়া হোক, আর যেন কেউ তার সন্ধান না করে! ট্রুমান সে প্রতিশ্রুতি দেননি। একালে বিজ্ঞানের কোনও আবিষ্কারের সংবাদই কোনও একটি নির্দিষ্ট দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না। অন্য দেশের বৈজ্ঞানিকদের এই পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের পদ্ধতি জানতে আর কতক্ষণ লাগে। আমেরিকার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে বাধ্য হয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন, এদিকের পাল্লা ভারী রাখতে যোগ দিয়েছে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স, ওদিকে চিন, তারপর এখন যে-কোনও হেঁজি-পেঁজি গরিব দেশও প্রচুর অর্থসম্পদ জলাঞ্জলি দিয়ে একখানা-দু’খানা বোমা বানিয়ে ফেলতে পারে। নাগাসাকির পর এতগুলি বছরে আর কোথাও একটিও অ্যাটম বোমা ব্যবহৃত হয়নি, অথচ কী বিপুল অর্থের অপচয় হয়েছে অনেকগুলি দেশে এই অস্ত্রের নির্মাণে। মানুষের কি নিদারুণ মূর্খতা! এই বিপুল সম্পদে পৃথিবীর সব দেশের দারিদ্র্য নির্মূল করা যেত, কত মূক-মুখে দেওয়া যেত ভাষা। যে-সম্পদে গোটা মনুষ্যজাতিকে দেওয়া যেত মাথার ওপরে একটি আচ্ছাদন, সেই সম্পদ অস্ত্রে রূপান্তরিত হয়ে এই পৃথিবীকেই যে-কোনও সময় ধ্বংস করার আশঙ্কা নিয়ে মাথার ওপর ঝুলছে।

এই প্রক্রিয়া শুরু করেছে আমেরিকা। সে জন্য ইতিহাস কোনওদিন সে দেশকে ক্ষমা করবে না। সমকালীন অনেক বিজ্ঞানীও ধিক্‌কৃত হবেন।

আট

দেশপ্রেম নামে ব্যাপারটা আমি প্রথম অনুভব করি আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারের সময়। সেই বয়সেই খবরের কাগজের পৃষ্ঠা প্রথম চক্ষু টানে। গল্পের বই পড়ার নেশা এমন জমে উঠেছে যে কোথাও বাংলা অক্ষর দেখলে তা পড়তে হবেই, এমনকী মুড়ির ঠোঙা পর্যন্ত।

ইংরেজরা রেঙ্গুন পুনর্দখল করার পর আজাদ হিন্দ ফৌজ আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। জাপানের নিজেরই তখন অন্তিম দশা, সে আর সাহায্য করবে কী করে? ইংরেজরা সুভাষচন্দ্রকে ধরতে পারল না, তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন, আজাদ হিন্দ ফৌজের অস্ত্র কেড়ে তাদের ভারতে নিয়ে এসে বন্দি করে রাখা হল দিল্লির লালকেল্লায়। তারপরই সরকারি ঘোষণা হল যে তাদের কোর্ট মার্শাল হবে।

এতদিন আমরা আজাদ হিন্দ ফৌজের কীর্তিকলাপ সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতাম না। যুদ্ধের সময় নানারকম বিভ্রান্তিমূলক প্রচার চলতে থাকে, খবরের কাগজে থাকে সেনসরশিপ। এখন যেন অনেক বন্ধ কক্ষ অর্গল মুক্ত হয়ে গেল। হাওয়া বদলও টের পাওয়া যায়। এতদিন বাতাস যেন ছিল বেশ ভারী, এখন অনেকটা ফুরফুরে। দুর্ভিক্ষের দশাও কমে এসেছে, অন্তত শহরে। আজাদ হিন্দ ফৌজের নানারকম বীরত্ব কাহিনী লোকের মুখে মুখে ঘুরছে। সুভাষচন্দ্র ক্রমশ হয়ে উঠছেন এক রোমাঞ্চকর নায়ক। এতদিন তিনি ছিলেন সুভাষ বোস, এখন থেকে হলেন নেতাজি। তাঁর যোদ্ধৃবেশের ছবিও বিক্রি হতে লাগল সর্বত্র।

হাওয়া বদলের আর একটা লক্ষণ, এতবড় একটা যুদ্ধে শেষ পর্যন্ত জয়ী হলেও ইংরেজরা তেমন কোনও সম্ভ্রম আদায় করতে পারেনি ভারতবাসীর কাছ থেকে, বরং তাদের সম্পর্কে ভয় অনেকটা ভেঙে গেছে। চার্চিলের অপসারণ এবং শ্রমিক দলের এটলি প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় অনেকেরই ধারণা হয়ে গেছে যে এবারে আর ভারতবর্ষকে সম্পূর্ণ পরাধীন রাখা যাবে না। স্বায়ত্তশাসন কিংবা কোনও না কোনও ধরনের স্বাধীনতা দিতেই হবে। পত্র-পত্রিকায় সে সব কথাই খোলাখুলি লেখা হতে লাগল।

আজাদ হিন্দ ফৌজের সামরিক বিচারের ঘোষণা যেন ইংরেজ সরকারের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার শেষ মরিয়া প্রচেষ্টা। সঙ্গে সঙ্গে প্রবল প্রতিবাদ উঠেছিল সারা ভারত জুড়ে। এবং সেই প্রতিবাদে মিশেছিল হিন্দু-মুসলমান-শিখের মিলিত কণ্ঠস্বর।

আমাদের স্কুলের লাইব্রেরিটি খুব ছোট, সেখানে শুধু সপ্তাহে একখানা বই পাওয়া যেতে পারে। প্রতি শনিবার। তাও আলাদা কোনও লাইব্রেরিয়ান নেই, যে-শিক্ষক মহাশয় ভারপ্রাপ্ত, তিনি কোনও কারণে এক শনিবার অনুপস্থিত থাকলে সিঁড়ির পাশের গ্রন্থাগারটির আর তালা খোলা হত না সেদিন। সপ্তাহে একখানি বই যেন দাবানলে একটি শুকনো পাতা। ক্লাসের সহপাঠীদের মধ্যেও তখন গল্পের বই বদলা-বদলি হয়। আমি সবচেয়ে বেশি বই পেতাম একটি মাড়োয়ারি ছেলের কাছ থেকে, তার নাম কমল ভাণ্ডারি। কমলের বাংলা কথায় অবাঙালি সুলভ টান ছিল, ‘কিন্তু’র বদলে বলত ‘লেকিন’, অথচ বাংলা পড়তে পারত খুব তাড়াতাড়ি। অনেক সময়, ক্লাসের মাস্টারমশাইয়ের অন্যমনস্কতার সুযোগ নিয়ে হাই বেঞ্চের আড়ালে একই গল্পের বই পড়তাম দু’জনে, আমার শেষ হবার আগেই কমল পাতা উল্টে দিত। বলাই বাহুল্য, আমাদের তুলনায় কমলের বই কেনার ক্ষমতা ছিল অনেক বেশি, নতুন নতুন বই কিনে সে নিজে শেষ করার পরেই বিলিয়ে দিত বন্ধুদের মধ্যে।

আমার সহপাঠী ও প্রতিবেশী আশুদের বাড়ির লাইব্রেরিরও আমি ছিলাম অন্যতম রক্ষক ও ভক্ষক। ঠিক কোথা থেকে মনে নেই, এই সময় আমার হাতে আসে একটি বই, সেটির নাম ‘ফাঁসির মঞ্চে গেয়ে গেল যারা জীবনের জয় গান’, কিংবা এই ধরনের কিছু। তাতে ছিল ক্ষুদিরাম, কানাই, সত্যেন, ভগৎ সিং, সূর্য সেন প্রমুখদের সংক্ষিপ্ত জীবনী। খুব আবেগময় ভাষা, পড়তে গেলে চোখে জল আসবেই। সে বই পড়ে যে কত কেঁদেছি তার ঠিক নেই। শুধু তাই নয়, ভগবানের ওপর খুব রাগ হয়েছিল, কেন তিনি আমাকে আরও অন্তত আট-দশ বছর আগে জন্মাতে দেননি? (আমার জন্মের জন্য মা-বাবা কিংবা ভগবান দায়ী, সে সম্পর্কে সংশয় তখন যায়নি। সে যাই হোক, ভগবানের ওপর দোষারোপ করাই সুবিধেজনক।) আর মাত্র ছ’ সাত বছর আগে জন্মালেও আমি দেশের জন্য ক্ষুদিরামের মতন প্রাণ দিতে পারতাম! আজাদ হিন্দ ফৌজের কত সৈন্য দেশের মুক্তির জন্যই তো লড়াই করতে করতে মরেছে। এখন যারা রয়েছে বিচারের অপেক্ষায়, তারাও হয়তো ঝুলবে ফাঁসির দড়িতে। আর আমি দেশের জন্য কিছুই করতে পারব না?

পরাধীন ভারতে আমার মতন দশ-বারো বছরের ছেলে-মেয়েরা স্বাধীনতা আন্দোলনে কোনও ভূমিকা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। তখন আমরা বালক না কিশোর? গলা ভাঙেনি, নাকের নীচটা পরিষ্কার, হাফ প্যান্ট পরি। কিশোরদের তবু খানিকটা কদর থাকে বিপ্লবীদের কাছে, কিন্তু বালকরা পাত্তা পায় না। ক্ষুদিরাম তো পনেরো-যোলো বছর বয়েস থেকেই যোগ দিয়েছিল বিপ্লবীদের সঙ্গে। ইস, ক্ষুদিরামের বয়েস আমার থেকে মাত্র চার-পাঁচ বছর বেশি।

আমার বয়েসি বালকদের একমাত্র রাজদ্রোহমূলক আচরণ ছিল, পুলিশ দেখলে আওয়াজ দেওয়া, তাও নিরাপদ দূরত্ব থেকে। আমরা বলতাম, বন্দে মাতরম্, পুলিশের মাথা গরম! কিংবা বন্দে মাতরম্ লাল পাগড়ির মাথা গরম! সেপাই বা কনস্টেবল জাতীয় সব পুলিশের মাথায় থাকত লাল পাগড়ি। অফিসারদের মাথায় শোলার হ্যাট। এই গরমের দেশে গরম কালেও সর্বক্ষণ ওরকম পাগড়ি বা টুপি পরে থাকলে এমনিতেই তো মাথা গরম হবার কথা!

পরাধীন আমলে জন্মে আমি সেই বালক বয়েসেও একেবারে ইংরেজ-সংস্পর্শ বর্জিত থাকতে পারিনি। শ্বেতাঙ্গ শাসক শ্রেণীর অত্যাচারের অতি সামান্য একটি নমুনা অঙ্গে ধারণ করার সুযোগ আমার হয়েছিল। সামান্য হলেও খুব জ্বলজ্বলে ভাবে মনে আছে। আমি দাঁড়িয়েছিলাম হাতিবাগান বাজারের সামনে সকালবেলা, হাতে একটা থলি নিয়ে। বাবা এক জায়গা থেকে টিউশানি সেরে আসবেন, আমাকে সঙ্গে নিয়ে বাজার করবেন পনেরো-কুড়ি মিনিটের মধ্যে, তারপর আমার হাতে থলি দিয়ে তিনি দ্রুত চলে যাবেন অন্য টিউশানিতে। সেদিন বাবা তখনও পৌঁছননি, একটা মিছিল আসছে শ্যামবাজারের দিক থেকে। তখন আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার বন্ধ করার দাবিতে শহর উত্তাল। কয়েকদিন আগে পুলিশের গুলিতে মরেছে কয়েকজন, প্রতিদিন প্রতিবাদ মিছিল। আমি মিছিলটা দেখার জন্য কৌতূহলী হয়ে রাস্তার একেবারে ধারে এসে দাঁড়িয়ে উঁকি মারছি আরও অনেকের সঙ্গে। বিপরীত দিক থেকে ঝড়ের বেগে এসে হঠাৎ থামল একটা জিপ গাড়ি, তার থেকে টপাটপ করে লাফিয়ে নামল কয়েকজন পুলিশ, তারা রাস্তার দু’পাশের ভিড় সরাতে লাগল লাঠি উঁচিয়ে। আমি পিছিয়ে আসার আগেই একজন লালমুখো সাহেব পুলিশ তার এক হাতের থাবা আমার মুখে চেপে ঠেলে দিল খুব জোরে। আমি ছিটকে গিয়ে পড়লাম ফুটপাথে, মাথাটা জোরে ঠুকে গেল।

এইটুকুই মাত্র। অন্য ভয়ার্ত লোকজন আমার ওপর দিয়েই ছুটে গিয়ে আমায় পিষে দিতে পারত, সেরকম কিছু হয়নি। আমার মাথা ফাটেনি, রক্তও বেরোয়নি, কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই আমি উঠে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে চম্পট। পুলিশটি খাঁটি ইংরেজ না অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, তা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। পুলিশসুলভ লম্বা-চওড়া চেহারা, শ্বেতাঙ্গ, নির্মম মুখখানি দৈত্যের মতন, তার হাতের পাঞ্জাটা এতই বড় যে আমার মুখখানা প্রায় ঢেকে গিয়েছিল। সত্যি কথা বলতে কী, সেই ঘটনা স্মরণ করলে আজও আমার কিছুটা গর্বমিশ্রিত সুখানুভূতি হয়। ভাগ্যিস পুলিশটা আমাকে ওই ভাবে ধাক্কা দিয়েছিল, তাই এইটুকু অন্তত তো বলতে পারব যে পরাধীন আমলে একেবারে গা বাঁচিয়ে থাকিনি, রাস্তায় মাথা ঠুকে গিয়েছিল। অনেকে প্রাণ দিয়েছে, জেল খেটেছে, নির্বাসনে গেছে, আমি আমার বয়েসের অনুপাতে সহ্য করেছি যৎসামান্য।

যতদূর জানি, আমাদের বংশে, আত্মীয়-কুটুম্বদের মধ্যে কেউ জেল খাটেনি, কেউ স্বদেশী আন্দোলনে যুক্ত হয়নি, রাজনীতিতে যোগ দেয়নি। শুনেছি, ছাত্রাবস্থায় আমার বাবাকে একবার সন্দেহের বশে পুলিশ থানায় নিয়ে যায় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। বাবা তখন একটা মেসে থাকতেন। কোনও পলাতক বিপ্লবীর খোঁজে পুলিশ হঠাৎ এসে সার্চ করে সেই মেস বাড়ি। বাবা সব সময় একটা ছোট নোট বই রাখতেন পকেটে, তাতে রাজ্যের লোকের নাম ও ঠিকানা। যার সঙ্গেই পথে-ঘাটে, বাসে-ট্রামে সামান্য আলাপ হত, ওই নোট বুকে তাদের নাম-ঠিকানা লিখে রাখতেন, বলা তো যায় না কখন কী কাজে লাগে! পুলিশ সেই নোট বইতে কয়েকজন সন্দেহজনক ব্যক্তির নাম দেখতে পায় এবং গোঁফ খাড়া করে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তারা বাবাকে চুনোপুটি জ্ঞানে পরিত্যাগ করে ছুটেছিল রাঘব বোয়ালদের সন্ধানে।

আজাদ হিন্দ ফৌজের মার্চিং সং ‘কদম কদম বঢ়ায়ে যা, খুসিসে গীত গাহে যা—’, কী করে যেন আমরা শিখে গেলাম সবাই। প্রত্যেক পাড়ার ক্লাবে ওই গানটি জনপ্রিয়তায় বন্দে মাতরম্ কিংবা জন-গণ-মন-কে হঠিয়ে দিল। পাড়ায় পাড়ায় নতুন ধরনের ক্লাবও গজিয়ে উঠল হঠাৎ। এই সব ক্লাবে কেট্ল ড্রাম, বিউগ্‌ল, ব্যাগ পাইপ এই সব বাজাতে শেখানো হয়। পয়লা বৈশাখের প্রভাত ফেরি কিংবা দুর্গা প্রতিমার বিসর্জন-শোভাযাত্রা যাই হোক না কেন, আগে আগে যাবে সাদা প্যান্ট, সাদা শার্ট ও সাদা কেড্স জুতো পরা এরকম কোনও ক্লাবের ছেলেরা, ওই সব বিলিতি বাজনা বাজাতে বাজাতে। এসব সরঞ্জাম কিনতে অনেক টাকা লাগে, সে জন্য প্রত্যেক ক্লাবেরই একজন ধনী পৃষ্ঠপোষক দরকার। আমাদের গ্রে স্ট্রিট পাড়ায় অনেক সচ্ছল কবিরাজ ও জ্যোতিষীর বাস। পাশাপাশি দু’জন জ্যোতিষীর সাইনবোর্ডেই লেখা ছিল ‘বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ’। একজন ধনী কবিরাজ মশাই নিজেই একটি ব্যান্ড পার্টির ক্লাব খুললেন, তাঁর বাড়ির পেছনে অনেকটা জমি খালি পড়েছিল, সেখানেই হত বাজনার মহড়া। পি রানা কোম্পানি থেকে তিনি ঝকঝকে সব কেট্ল ড্রাম, বিউগ্‌ল, বিগড্রাম ইত্যাদি কিনে আনলেন তো বটেই, দর্জি ডাকিয়ে প্রত্যেক ক্লাব সদস্যের সাদা জামা, সাদা প্যান্ট তৈরি করিয়ে দিলেন। এবং গলায় নীল রঙের স্কার্ফ। সম্ভবত ওই জামা-প্যান্টের লোভেই আমি ভর্তি হয়েছিলাম সেই ক্লাবে। কেট্ল ড্রাম বাজাতে শিখে গেলাম অবিলম্বে। কেন যেন আমাদের ধারণা হয়েছিল, এই সব বাজনার সঙ্গে যুদ্ধের কোনও সম্পর্ক আছে। প্রত্যেকদিন একবার সেই কবিরাজ মশাই ধুতির ওপর কালো কোট পরে একটা টুলের ওপর দাঁড়াতেন, হাসি হাসি মুখে কপালে দু আঙুল ঠেকিয়ে, আমরা বাজাতে বাজাতে তাঁকে মার্চ পাস্ট করে যেতাম, প্রথমে অল্প বয়েসীরা কেট্ল ড্রাম, তারপর একটু বড়দের ঠোঁটে বিউগ্‌ল, তারপর সবচেয়ে শক্তিশালী যুবকটির বুকে বিগ ড্রাম বা জয় ঢাক। আমাদের ধ্বনি দিতে হত, জয়হিন্দ! জয়হিন্দ! জয় নেতাজি, জয় কবিরাজ মশাই! (নাম মনে আছে। লিখছি না)

মাস ছয়েক কেট্ল ড্রাম শিল্পী থাকার পর আমার বিউগ্‌ল-বাজনদার পদে উত্তীর্ণ হওয়ার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। বিউগ্‌ল জিনিসটা দেখতে কী সুন্দর, যেন সোনার তৈরি। ক্লাব থেকে একটা বিউল আমাকে দিয়ে দেওয়া হল প্র্যাকটিস করার জন্য। কিন্তু বিউগ্‌ল প্র্যাকটিস করা নিয়েই যত ঝামেলা। বিউগ্‌ল থেকে শব্দ বের করা মোটেই সহজ নয়। দু’গাল ফুলিয়ে বাতাস ভরে যতই জোরে চাপ দেওয়া যাক, তবু শব্দ বেরোয় না। তারপর একদিন হঠাৎ প্যাঁ করে ওঠে, সেটা একেবারে বেসুরো। সেই বেসুরো আওয়াজকে সুরে আনতে সময় লাগে বেশ কিছুদিন। আমার ওই বেসুরো পর্যায়ে বাড়ির লোক, পাড়ার লোকদের কাছ থেকে প্রবল আপত্তি আসতে লাগল। ভোরবেলা ছাদে গিয়ে প্র্যাকটিস করি, তাতেও অনেকে রেগে যায়, বিকট আওয়াজে ঘুম ভাঙা তাদের পছন্দ হবে কেন? তা হলে লোকে বিউগ্‌ল বাজানো শেখে কী করে? দু’একজন বলল, গঙ্গার ধারে যা, হাওড়ার দিকে মুখ করে বাজাবি! শেষ পর্যন্ত আমার বিউগ্‌ল-শিল্পী হওয়া হল না অন্য কারণে, একদিন একজন আত্মীয় আমার হাতে ওই যন্ত্রটি দেখে আঁতকে উঠলেন। তাঁর ধারণা, বিউগ্‌ল বাজাতে খুব বেশি দম লাগে এবং সে জন্য যক্ষ্মা হয়। তাঁর সেই ধারণাটি আমার জনক-জননীর কাছে অঙ্গভঙ্গি সহকারে ব্যক্ত করায় তাঁরাও খুব ভয় পেয়ে গেলেন। চল্লিশের দশক পর্যন্ত বাঙালির কাছে সবচেয়ে মারাত্মক রোগ ছিল যক্ষ্মা। ক্যানসার বা হৃদরোগের তেমন রমরমা তখনও হয়নি। অধিকাংশ বাংলা ট্র্যাজিক গল্প উপন্যাসের নায়ক যক্ষ্মারোগগ্রস্ত হবেই, নায়িকার কোলে মাথা দিয়ে কাশতে কাশতে তার ঠোঁটের কোণে রক্ত গড়িয়ে আসবে। যক্ষ্মার এখনকার নাম টি বি, তখন বলা হত থাইসিস, বাংলা নাম সচরাচর কেউ উচ্চারণ করে না।

ঘরে ঘরে নেতাজির ছবি তো স্থান পেয়ে গেছেই, আরও তিনটি ছবি বিক্রি হতে লাগল খুব। আজাদ হিন্দ ফৌজের তিন সেনাপতি শাহ্নওয়াজ, সাইগল এবং ধীলন। এঁদের বিরুদ্ধেই বিচার শুরু হয় প্রথমে। মুসলমান, হিন্দু ও শিখ, ফলে এই তিন সম্প্রদায়ই প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র শুধু বাঙালির নেতা নন, সারা ভারতে তাঁর জনপ্রিয়তা তখন তুঙ্গে। তিনি অনুপস্থিত, বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যুর একটা খবর ছড়ালেও কেউ তা বিশ্বাস করেনি, তিনি ধরা পড়েননি মানেই কোথাও আত্মগোপন করে আছেন, যথা সময়ে আবার প্রকাশিত হবেন। সেই সময় যদি কোনও রকম জনপ্রিয়তার বিচার হতো, তা হলে গাঁধী, নেহরু ও জিন্নার চেয়েও যে সুভাষচন্দ্র ওপরে স্থান পেতেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। আজাদ হিন্দ ফৌজে তিনি এমন চমৎকারভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রয়োগ করেছিলেন, যে-রকম আগে দেখা যায়নি। কোনও রকম সাম্প্রদায়িক গণ্ডি টানা ছিল না। হিন্দু-মুসলমান সৈন্যরা আহার করত পাশাপাশি বসে। যদি বিমান দুর্ঘটনায় তাঁর মৃত্যুসংবাদ মিথ্যে হত, যদি সত্যিই তিনি কোথাও লুকিয়ে থাকতেন এবং পরের বছরে অকস্মাৎ আবির্ভূত হতেন, তা হলে নিশ্চিত অন্যরকম অবস্থার সৃষ্টি হত। ভারতের পরবর্তী ইতিহাসই বদলে যেতে পারত, দেশ ভাগ কিংবা পাকিস্তানের প্রশ্নটিই হয়তো হয়ে যেত অবান্তর।

আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচারের আগে পর্যন্ত কংগ্রেস, মুসলিম লিগ, কমিউনিস্ট পার্টি সুভাষচন্দ্রকে সমর্থন তো করেইনি, বরং ধিক্কার জানিয়েছে। জওহরলাল নেহরু এমন কথাও বলেছিলেন যে, যদি সুভাষচন্দ্র সসৈন্যে ভারতে ঢুকতে চান, তা হলে তিনি নিজে তাদের বাধা দেবেন। কিন্তু আজাদ হিন্দ ফৌজের সৈন্যরা অসহ্য কষ্ট সহ্য করে, দুর্দশার মধ্যে, আহার্য ও ওষুধের অভাব নিয়েও দেশের জন্য প্রাণপণে লড়াই করেছে, এখন তাদের বিচার ও শাস্তির বিরুদ্ধে সারা দেশের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ শুরু হয়ে যায়। সব শ্রেণীর জনসাধারণের এ রকম প্রতিক্রিয়া দেখে কোনও রাজনৈতিক দলের পক্ষেই আর বিমুখ হয়ে থাকা সম্ভব নয়। প্রতিবাদ মিছিলে একে একে যোগ দিল সবাই। কংগ্রেস, মুসলিম লিগ, তাদের প্রতিক্রিয়ায় গড়ে ওঠা হিন্দু মহাসভা, পঞ্জাবের দল এবং কিছুটা দ্বিধার পরে কমিউনিস্ট পার্টিও। সামরিক আদালতে সরকার পক্ষে বাঘা বাঘা উকিল ব্যারিস্টার দাঁড় করানো হয়েছিল, জনসাধারণের পক্ষ থেকেও আজাদ হিন্দ ফৌজের সমর্থনে সমবেত হলেন দেশের প্রখ্যাত আইনজীবীরা। ব্যারিস্টারি পাশ করেও জওহরলাল নেহরু কখনও মামলা-মোকদ্দমা করেননি, তিনিও সামলা এঁটে যোগ দিলেন এই দলে।

আদালতে শাহ্নওয়াজ যে ভাষণ দেন, তা অত্যন্ত মর্মস্পর্শী। তিনি এক বিশাল পরিবারের সন্তান, যে-পরিবারের প্রতিটি সমর্থ পুরুষই ইংরেজদের অধীনে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে বরাবর যোগ দিয়েছেন। তাঁর বাবা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজদের পক্ষ নিয়েই লড়েছেন। এবং এখনও সে পরিবারের অন্তত আশিজন ব্যক্তি ভারতীয় সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন অফিসার পদে যুক্ত রয়েছেন। পারিবারিক প্রথা অনুযায়ী তিনিও ওই সেনাবাহিনীতেই যোগ দিয়েছিলেন। আজাদ হিন্দ ফৌজে চলে আসেন বিবেকের তাড়নায়। তাঁদের বিরুদ্ধে সরকার পক্ষের প্রধান অভিযোগ বিশ্বাসঘাতকতার। অন্যান্য অভিযোগের মধ্যে আছে, এই সব সেনাপতিরা অনেক অনিচ্ছুক ভারতীয় সৈন্যদের জোর করে আজাদ হিন্দ ফৌজে যোগ দিতে বাধ্য করেছেন। এ রকম কিছু কিছু অনিচ্ছুক সৈন্যদের ওপর চরম অত্যাচার, এমনকী হত্যারও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর উত্তরে শাহ্নওয়াজ বলেন:

আই এন এ-তে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েই আমি স্থির করেছিলাম যে আমি আমার সর্বস্ব—আমার জীবন, আমার ঘর সংসার এবং সম্রাটের প্রতি আমার পারিবারিক আনুগত্যের ঐতিহ্য, সব কিছুই উৎসর্গ করব। আমি মনে মনে এমনকী এও ঠিক করে নিয়েছিলাম যে আমার ভাইও যদি আমার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তা হলে তার বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করব এবং ১৯৪৪ সালের পরবর্তী সময়ের যুদ্ধে আমরা যথার্থই পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়াই করি। আমি এবং আমার খুড়তুতো ভাই চিন পাহাড় এলাকায় প্রায় দু’ মাস ধরে প্রতিদিনই পরস্পরের বিরোধিতা করেছি। সে আহত হয়েছিল। সম্রাট না স্বদেশ, কার প্রতি আনুগত্য স্বীকার করা হবে, সেটাই ছিল আমাদের প্রধান প্রশ্ন। আমি দেশের প্রতি অনুগত থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম এবং দেশের জন্য আত্মোৎসর্গ করব বলে আমি নেতাজির কাছে পবিত্র অঙ্গীকার করেছিলাম … এটা বলা বোধহয় ভুল হবে না যে তাঁর ব্যক্তিত্বে এবং তাঁর বক্তৃতা শুনে আমি সম্মোহিত হয়ে পড়েছিলাম। তিনি ভারতবর্ষের প্রকৃত চিত্রটি আমাদের সামনে তুলে ধরেছিলেন, এবং আমার জীবনে সেই প্রথম আমি একজন ভারতীয়ের চোখ দিয়ে ভারতবর্ষকে প্রত্যক্ষ করলাম। দেশের প্রতি তাঁর নিঃস্বার্থ এবং ঐকান্তিক মমত্ববোধ, তাঁর অকপট আচরণ এবং জাপানি অভিসন্ধির কাছে মাথা নোয়াতে তাঁর প্রবল আপত্তি লক্ষ করে আমি রীতিমতো পুলকিত বোধ করেছিলাম।… সেই সব লক্ষ লক্ষ উপবাসী মানুষ, যাদের নির্দয়ভাবে শোষণ করে এবং যাদের ইচ্ছাকৃতভাবে নিরক্ষর ও অজ্ঞ রেখে ব্রিটিশরা নিজেদের শোয়ণ ব্যবস্থাকে অব্যাহত রেখেছিল, তাদের কথা চিন্তা করে আমার মনে ভারতবর্ষের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে একটা তীব্র ঘৃণার বোধ সৃষ্টি হয়েছিল।… আমি আপনাদের এবং আমার দেশবাসীর অবগতির জন্য জানাতে চাই যে আই এন এ যে-দুর্ভোগ সহ্য করেছে, তা কোনও ভাড়াটে কিংবা ক্রীড়নক সৈন্যবাহিনীর পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয়। বস্তুত আমরা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জন করার জন্যই লড়াই করেছিলাম।

অন্য দুই সেনাধ্যক্ষের বিবৃতিও প্রায় একইরকম। তাঁদের বক্তব্যে আরও একটি বিষয় ফুটে উঠেছিল। জাপানকে তাঁরা কেউ প্রকৃত বিশ্বাস করেননি, জাপানের কাছ থেকে বিশেষ কিছু প্রত্যাশাও করেননি। বরং, জাপান যদি কোনওক্রমে ভারতের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়ে, তা হলে জাপানের বিরুদ্ধে লড়াই করারও মানসিক প্রস্তুতি ছিল আজাদ হিন্দ ফৌজের।

ইংরেজ সরকারের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ভয় দেখানো। আজাদ হিন্দ ফৌজের কিছু সৈন্যকে শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন করা। সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যও এটা প্রয়োজনীয়। কিন্তু ফল হল সম্পূর্ণ বিপরীত। হঠাৎ যেন ভয় ভেঙে গেল। এই বিচারের অধিকারেরই বিরুদ্ধতা করে বসল ভারতীয় প্রজারা। এমনকী ইন্ডিয়ান আর্মির অনুগত সৈন্যরাও এই সরকারি সিদ্ধান্ত সমর্থন করেনি, তাদের সহানুভূতি প্রকাশ পেল আজাদ হিন্দ ফৌজের প্রতি।

কলকাতায় প্রথম আন্দোলন শুরু করে ছাত্ররা। দুপুরবেলা একটা মিছিল যাচ্ছে ধর্মতলা স্ট্রিট দিয়ে ওয়েলিংটন স্কোয়ারের দিকে, মাঝপথে আটকাল পুলিশ। লাঠি-সোঁটা, বন্দুকধারী পুলিশ দেখেও কিন্তু ছাত্ররা ছত্রভঙ্গ হল না, সবাই বসে পড়ল রাস্তায়। পুলিশ তাদের এগোতে দেবে না, ছাত্ররাও পিছু হটবে না। দু’পাশের পাড়া থেকে ছুটে এল লোকজন, তারা এবং পথচারীরাও বসে পড়ল ছাত্রদের পাশে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যাচ্ছে, শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসছে আরও বহু মানুষ, কেউ তাদের ডাকেনি। এর মধ্যে একবার লাঠি চার্জ হয়ে গেছে, তবু বেড়েই চলছে মানুষ, মুহুর্মুহু শ্লোগান উঠছে, জয় হিন্দ! কুইট ইন্ডিয়া! ব্রিটিশ সাম্রাজ্য নিপাত যাক! সন্ধের পর ফলপট্টির মুসলমান ছেলেরা ইট মেরে মেরে সব বাল্‌ব ভেঙে দিল। অন্ধকারে এগিয়ে চলল শীতের রাত। কেউ জায়গা ছেড়ে নড়বে না! কলকাতা শহরে এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য!

লাঠি ও গুলি চালাবার আগে পুলিশ থেকে অভিযোগ করা হয় যে জনতা ইট ছুঁড়েছে তাদের দিকে। ইটের বিরুদ্ধে বন্দুকের গুলি! সেদিন লড়াইটা অসম হলেও পরদিন তা হয়নি। ভোরের সংবাদপত্র এই পুলিশি অত্যাচারের খবর পৌঁছে দিল সারা শহরে। কেউ কিছু নির্দেশ দিল না, সব অফিস-কাছারি, স্কুল-কলেজ এমনিই বন্ধ হয়ে গেল। দোকান বন্ধ। হাজার হাজার মানুষ জমা হতে লাগল ওয়েলিংটন স্কোয়ারে। বিভিন্ন দিক থেকে মিছিল আসছে, ওয়েলিংটন স্কোয়ারে আর তিল ধারণের জায়গা নেই, পঞ্চাশ-ষাট হাজারের চেয়েও বেশি মানুষ ছড়িয়ে আছে চারদিকের রাস্তায়। তাদের মধ্যে কংগ্রেসের তে-রঙা পতাকা, মুসলিম লিগের সবুজ পতাকা, কমিউনিস্টদের লাল ঝাণ্ডা, হিন্দু মহাসভার গৈরিক পতাকা। এক একটা গোষ্ঠী আওয়াজ তুলছে, বন্দে মাতরম্, আল্লা হো আকবর, ইনকিলাব জিন্দাবাদ; আবার সমবেতভাবে গর্জন করছে সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক! পুলিশি জুলুম চলবে না, চলবে না। তারপর এক সময় ক্রোধের বিস্ফোরণ হল, শুরু হল পুলিশকে মারা, গাড়ি পোড়ানো। অনেক জায়গায় পুলিশ ভয়ে পালিয়েছে, অনেক জায়গায় গুলি করে মানুষ মেরেছে। ফরাসি বিপ্লব এইভাবেই শুরু হয়েছিল, কলকাতায় হলেও হতে পারত।

ভারতের বড় লাট ওয়াভেল, প্রধান সেনাপতি অকিনলেক। জনসাধারণের এমন উগ্র প্রতিক্রিয়া সরকারকে চিন্তায় ফেলে দিল। এর পরেও কি বিচার চালিয়ে যাওয়া যুক্তিসঙ্গত? ওপরের মহল থেকে ঠিক করা হল, কোর্ট মার্শালে শাস্তি হলেও প্রধান সেনাপতি নিজ অধিকার বলে সে শাস্তি তো মকুব করে দিতেই পারেন। সেই সূত্র অনুসারে শাহ্‌নওয়াজ, সেগল আর ধীলনকে মুক্তি দিয়ে দেওয়া হল। তাতে যেন আরও বেড়ে গেল এঁদের গৌরব, বিভিন্ন শহরে শহরে এই তিনজনকে দেওয়া হল বীরের সংবর্ধনা। সে রকম অনেক সংবর্ধনা সভায় সরকারি ফৌজের ভারতীয় সেনারা উর্দি পরেই হাজির! বছর গড়াতে না গড়াতেই এসে গেল নেতাজির পঞ্চাশতম জন্মদিন। বিপুলভাবে সারা দেশে পালিত হল সেই দিনটি।

কিন্তু ব্রিটিশ সরকার কোর্ট মার্শাল ঘোষণা এবং তা শুরু করে দেবার পরেও জনগণের চাপে তা কি একেবারে বন্ধ করে দিতে পারে? তাতে রাজশক্তির সম্মান থাকে কোথায়! একটা মুখ রক্ষার উপায় বার করা হল। আজাদ হিন্দ ফৌজের অধিকাংশ বন্দিকে মার্জনা করা হবে বটে, তবে যে ক’জনের বিরুদ্ধে সহযুদ্ধবন্দিদের ওপর নির্মম অত্যাচার এবং সভ্যতার পরিপন্থী ব্যবহারের অভিযোগ আছে, তাদের বিচার চলবে। ফেব্রুয়ারি মাসে শোনা গেল, সামরিক আদালতের বিচারে ক্যাপ্টেন রশিদ আলি নামে এক বন্দির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও সরকার দয়া পরবশ হয়ে তা কমিয়ে সাত বছরের সশ্রম দণ্ড দিয়েছেন। আবার ফেটে পড়ল মানুষের ক্ষোভ। মাঝখানের এই কয়েক মাসে নেতাজি ও আজাদ হিন্দ ফৌজ সম্পর্কে মানুষের ভক্তি-শ্রদ্ধা ও আবেগ অনেক বেড়ে গেছে। টানা ছ’দিন ধরে কলকাতায়, শুধু কলকাতায় নয়, আরও অনেক অঞ্চলে চলল সরকার পক্ষের সঙ্গে সাধারণ মানুষের খণ্ডযুদ্ধ। শুধু পুলিশ নয়, মিলিটারি নামিয়ে দেওয়া হল আন্দোলন রুখতে, তাতেও ভয় না পেয়ে আন্দোলনকারীরা পুড়িয়ে দিল অনেক মিলেটারি ট্রাক। রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড সৃষ্টি করে আটকে দেওয়া হতে লাগল পুলিশ-মিলিটারির গতিবিধি। বাংলায় তখন বেশ কিছু আমেরিকান সৈন্য রয়ে গিয়েছিল, তারা তখন দেশে ফেরার মুখে, জনতার রোষে তাদেরও অনেক গাড়ি পুড়ল, আহত হল কিছু আমেরিকান সৈন্য। সে জন্য এখানকার আমেরিকান সৈন্যবাহিনীর কমান্ডার ঘোষণা করে দিলেন, ভারতের অভ্যন্তরে গণ-আন্দোলন দমন করার জন্য আমেরিকান সৈন্যবাহিনীকে ব্যবহার করা চলবে না।

কয়েকদিন আগেও সাধারণ মানুষ রশিদ আলি নামে কারও নামও শোনেনি, তবু তারই মুক্তির দাবিতে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিতে লাগল হিন্দু ও মুসলমান। সংবাদপত্রে আহত-নিহতদের তালিকাটা এই রকম: আলি হোসেন, বঙ্কিম দত্ত, মহঃ ইসমাইল, জানকী সাহা, চন্দর সিং, মেহের খান, রামচন্দ্র, মহঃ শরীফ প্রমুখ। এবারে জয় হিন্দ, জয় নেতাজি, রশিদ আলির মুক্তি চাই ইত্যাদি স্লোগানের সঙ্গে যুক্ত হল, কংগ্রেস-লিগ এক হো! হিন্দু-মুসলিম এক হও! লীগ নেতা সুরাবর্দি ছাত্রদের সামনে এসে বললেন, ‘আমার জীবনের একটা বড় আশা আজ পূর্ণ হয়েছে—কংগ্রেস, লিগ পতাকার নীচে হিন্দু-মুসলমান ছাত্ররা এক হয়ে দাঁড়িয়েছে!’ নাজিমুদ্দিন নামে এক শহীদের মৃতদেহ নাখোদা মসজিদ থেকে মানিকতলায় নিয়ে যাবার পথে প্রায় পঞ্চাশ হাজার হিন্দু-মুসলমান অনুগমন করে, কবর দেবার পর সেই মাটি ছুঁয়ে লিগের এক নেতা বলে ওঠেন, “এই মাটি যেন লিগ ও কংগ্রেসের পতাকাকে শক্ত করে বেঁধে দেয়, শহীদের রক্তে এই বন্ধন চিরদিনের জন্য এক হয়ে যাক!”

কলকাতার ঘটনার দু’দিন পরেই মুম্বইয়ের তলোয়ার জাহাজের নাবিকরা শুরু করে নৌ বিদ্রোহ।

আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার কাহিনী ও তার প্রতিক্রিয়ার বিবরণ বিশদভাবে লিখলাম বিশেষ কারণে। এসব ঘটনা আমার স্মৃতিতে বিশেষ নেই। রশিদ আলি দিবসের একটি মিছিলে স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে গিয়েছিলাম অস্পষ্ট মনে পড়ে, নিছক দৌড়াদৌড়ি ছাড়া আর কিছু করিনি বোধহয়। বইপত্র দেখে সেই সময়কার তথ্য সংগ্রহ করতে হয়েছে। এই পর্বটি বিস্তৃতভাবে লিখলাম শুধু এটাই বোঝাবার জন্য যে মানুষ কী বিচিত্র প্রাণী আর ধর্ম কী বিষম বস্তু! তখন কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে দারুণ মন কষাকষি ও দর কষাকষি চলছে। তিক্ততা ও বিদ্বেষ চলে গেছে চূড়ান্ত পর্যায়ে। এমন একটা ধারণার সৃষ্টি করা হচ্ছে যে হিন্দু আর মুসলমান কিছুতেই আর মিলেমিশে থাকতে পারবে না। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার উপলক্ষে কী করে সাধারণ মানুষের মধ্য থেকে সাম্প্রদায়িকতা ঘুচে গেল? কোনও রাজনৈতিক নির্দেশ ছিল না, সাধারণ মানুষের আবেগ সব দলের ব্যবধানও মুছে দিয়েছিল। হিন্দু ও মুসলমান পাশাপাশি দাঁড়িয়ে সরকারের বিরুদ্ধে লড়েছে, গুলি খেয়ে পাশাপাশি ঢলে পড়েছে। তা হলে, জীবনে ও মরণেও তারা একসঙ্গে থাকতে পারে?

আবার এইসব মানুষই কত তাড়াতাড়ি বদলে যেতে পারে নেতাদের নির্দেশে! আজ যাকে ভাই বলে সম্বোধন করছে, কাল তার বুকে ছুরি বসাতে যাচ্ছে। ব্যবধান কীসের? শুধু ধর্মের। ধর্মের ডাকে মানুষ ভেড়ার পাল হয়ে যায়! ধর্ম যেন মানবিকতা বর্জিত। দয়া, মায়া, স্নেহ, করুণা বর্জিত। মানুষের জন্য ধর্ম, না ধর্মের জন্য মানুষ? ধর্মীয় উন্মাদনায় মানুষ অন্য ধর্মের একটি শিশুকেও ছুরি দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে, কিন্তু রাস্তা থেকে কুকুরছানা বুকে তুলে নিয়ে যায়।

১৯৪৬ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় হিন্দু ও মুসলমানের একসঙ্গে পা মেলানো, হাত মেলানোর মধুর দৃশ্যটি দেখা গিয়েছিল, তার ঠিক আট মাস পাঁচ দিন পর এই কলকাতাতেই আবার যে তাণ্ডব শুরু হল, তা কি আমরা কোনওদিন ভুলতে পারব?

নয়

পাখিদের মধ্যে সবচেয়ে আগে জাগে কে? খুব সম্ভবত মোরগ। শুধু সে নিজে জাগে না, প্রকৃতি যেন তাকে দায়িত্ব দিয়েছে অন্যদেরও জাগাবার। একটু উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে সে ভালো করে আলো ফোটবার আগেই গলা ফুলিয়ে তারস্বরে কোঁকর কোঁ শুরু করে। কতবার কত ডাকবাংলোতে ভোরবেলায় আরাম-ঘুম ভেঙেছে মোরগের চেল্লামেল্লিতে। বিরক্ত হয়ে বাইরে এসেছি। কিন্তু লাল-ঝুঁটি মোরগের দৃপ্ত ভঙ্গিটি দৃশ্যত ভারী সুন্দর।

আমাদের ছেলেবেলায় অবশ্য মোরগ-মুরগি ধারে কাছে ছিল না, গ্রামেও না, শহরেও না। মুরগি তো যবন পক্ষী, হিন্দু পল্লীতে তাদের স্থান নেই। আমিষাশী হিন্দুদের গো-মাংস ভক্ষণ সম্পর্কে আপত্তির তবু কারণ বোঝা যায়, (যদিও প্রাচীনকালে মুনি-ঋষিরা যজ্ঞের আগুনে পুড়িয়ে দিব্যি বিফ কাবাব বানিয়ে খেতেন বোধহয়, অন্তত অতিথি এলে যে তাকে গো-মাংস পরিবেশন করা হত, ‘গোঘ্ন’ শব্দটিতে তার প্রমাণ ও ইতিহাস রয়ে গেছে। মুনি-ঋষিদের অবশ্য চাষ-বাসের দায়-দায়িত্ব ছিল না, পরবর্তী কৃষিজীবী সমাজে গোরু গৃহপালিত প্রাণী, দুগ্ধদাত্রী, ভূমি কর্ষণে অতি প্রয়োজনীয়, সে কারণে গোরুর প্রতি স্নেহ, মমতা, ভক্তি, কৃতজ্ঞতা থাকা স্বাভাবিক।) কিন্তু হাঁসের মাংস ও ডিম খাওয়া যাবে, অথচ মুরগির মাংস-ডিম কেন নিষিদ্ধ, তার কোনও যুক্তি খুঁজে পাই না। নেপালের হিন্দুরা গো-মাংস চক্ষেই দেখতে চায় না, কিন্তু সে দেশে মোষের মাংস বেশ চলে। কৃষিজীবী সমাজে গোরু ও মোষের ভূমিকা একই, গৃহ পালিত মোষের সঙ্গেও স্নেহ মমতার সম্পর্ক হতে পারে। বলীবৰ্দের সঙ্গে মোষের প্রায় কিছুই তফাত নেই, তবু বেচারা মোষ কেন হিন্দুদের কাছে বধযোগ্য, তা বুদ্ধির অগম্য।

হিন্দুদের মতন মুসলমানদেরও খাদ্যাখাদ্যে অনেক বিধি-নিষেধ আছে। শূকর মাংস তাদের কাছে অতি ঘৃণ্য, তা ছাড়াও অন্যান্য প্রাণী ও পাখি হালাল ও হারাম হিসেবে ভাগ করা। যতদূর জানি, কচ্ছপ তাদের কাছে অস্পৃশ্য। একবার কয়েকটি বাংলাদেশি মুসলমান যুবকের সঙ্গে আমি টোকিও শহরের এক বিশাল উদ্যানে বেড়াচ্ছিলাম, সেখানে একটি বিস্তীর্ণ কৃত্রিম সরোবরে কিছু সামুদ্রিক প্রাণী খেলা করছিল, কিছু সিল ও ডলফিন ছিল, একটি চকচকে প্রাণী দেখে একজন যুবক জিজ্ঞেস করল, এটা খাওয়া যায় না? তার সঙ্গী একজন বলল, হালাল কি না দেখতে হবে। তাতেই আমার মনে হয়েছিল, ভক্ষ্যণীয় এবং বর্জনীয় এরকম দুটি তালিকা আছে তাদের ধর্মে। অবশ্য, আরব দেশীয় শাস্ত্রে সব রকম সামুদ্রিক প্রাণীর উল্লেখ থাকা সম্ভব কি না, তা আমি জানি না।

‘আপ রুচি খানা’, এই কথাটাই স্বাভাবিক সত্য। যার যেমন অভিরুচি, স্বাদে সহ্য হয়। কিন্তু রান্নাঘরেও ধর্ম এসে নিষেধের তর্জনী তুলে দাঁড়ায়। একই অঞ্চলের মানুষের যদি খাদ্যরুচি এক রকম না হয়, যদি দুই সম্প্রদায় পরস্পরের খাদ্যবিশেষকে ঘৃণার চক্ষে দেখে, তা হলে তাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক মিলন প্রকৃতপক্ষে কতখানি সম্ভব? খাদ্য বাদ দিয়ে সংস্কৃতি হয়? চিন, জাপানের এই সমস্যা নেই। আমরা ভারতীয়রা অনেক শতাব্দী ধরে এই ব্যাপারে চরম মূর্খতার পরিচয় দিয়ে কতবার যে দাঙ্গায় প্রমত্ত হয়েছি, তার হিসেব রাখাও সম্ভব নয়। হিন্দুদের অন্ধত্ব আরও বেশি। শুধু অপর ধর্ম নয়, নিজেদের ধর্মের মধ্যেও খাদ্যের ব্যাপারে ছোঁয়াছুঁয়ির বিভেদ বজায় রেখেছে, তাই যুগ যুগ ধরে বহু মানুষ অভিমান ভরে বাপ-পিতামহের ধর্ম ত্যাগ করে আশ্রয় নিয়েছে নতুন ধর্মে।

আমি মুরগির মাংসের স্বাদ প্রথম গ্রহণ করি প্রাপ্তবয়স্ক হবার পর। তাও বাড়ির বাইরে, গোপনে। আবার বাবা একবার গ্রাম থেকে ফেরবার পথে গোয়ালন্দ স্টিমার ঘাটায় আমাকে নিয়ে একটা ভাতের হোটেলে ঢুকেছিলেন। সে হোটেলের রান্নার ঠাকুর ব্রাহ্মণ নয়, কায়স্থ। অব্রাহ্মণের হাতের রান্না আমরা বামুন হয়ে খাব কী করে? কিন্তু পাশের বামুনের হোটেলে যে সবেমাত্র উনুন ধরানো হয়েছে, আমাদের স্টিমার একটু বাদেই ছেড়ে যাবে, তাই বাবা বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সেই হোটেলেই খেতে বসে গেলেন এবং আমার দিকে এমন একটা ইঙ্গিত করলেন, যাতে এই ঘটনা আমি বাড়িতে গিয়ে বলাবলি না করি। বাবা মুরগির মাংস সম্ভবত কখনও খাননি, অন্তত তার জীবিতকালে ওই পক্ষী আমাদের বাড়িতে ঢোকেনি। আমি স্কুল বয়স ডিঙোবার পর প্রথম আমিনিয়া হোটেলে বিরিয়ানি ও চিকেন চাঁপ খেয়ে পরমার্থ লাভ করেছিলাম।

মাত্র কয়েক দশকেই কী বিপুল সামাজিক পরিবর্তন ঘটে গেছে! এখন মুরগি হিন্দুর ঘরে ঘরে সমাদৃত। অন্নপ্রাশন থেকে বিয়ের নেমন্তন্নেও মুরগি। তবে, যখন নিষিদ্ধ ছিল, তখন এর স্বাদ ছিল অপূর্ব, এখন বিস্বাদ লাগে। এখন ডাক্তাররাও পাঁঠার মাংসের বদলে মুরগি সুপারিশ করেন বলে পাঠার মাংসের প্রতি ঝোক বেড়েছে। গোরু-শুয়োরের দ্বন্দ্ব অবশ্য আজও মেটেনি।

প্রসঙ্গ শুরু হয়েছিল ঘুম ভাঙা নিয়ে। ছেলেবেলায় মোরগের ডাক শুনিনি, গ্রামে শুনতাম ভোর থেকেই বিভিন্ন পাখির কলকাকলি। ইষ্টকুটুম, বউ কথা কও, গৃহস্থের থোকা হোক, এরকম কত বিচিত্র পাখির নাম। ঘুঘু পাখিটির ডাক নানা রকম, কখনও ওড়ার সময় সে শুধু প্যাঁ-অ্যা-অ্যা শব্দ করে, কখনও এক মনে ডাকে ঘু-ঘু-ঘু-ঘু, কখনও বলতে থাকে, ঠাকুর গোপাল, ওঠো, ওঠো, ওঠো! তারস্বরে রাত্তিরবেলাতেও চিৎকার করে চোখ গেল পাখি। ওই পাখিরই হিন্দি নাম পিউ কাঁহা। ‘চোখ গেল’ কিংবা ‘পিউ কাঁহা’, দুটোই সুন্দর নাম, কিন্তু ইংরিজি নামটি বিকট। ব্রেইন ফিভার’! সাহেবরা মনে করে, মাথায় রোগ আছে বলেই ওই পাখি একটানা অনেকক্ষণ ডেকে চলে।

শহরে এত রকম পাখির বৈচিত্র্য নেই। কাক, চড়াই আর শালিক। এই তিন জাতের পাখি মানুষের কাছাকাছি থাকে, পৃথিবীর সর্বত্র। আমরা ঘরের আনাচে কানাচে এদেরই দেখেছি। আর আততায়ীর মতন চিল তো আছেই। ডালহাউসির কাছে হঠাৎ হঠাৎ দেখা যেত কয়েক ঝাঁক টিয়া। উত্তর কলকাতায় অনেকের পাখি পোষায় শখ ছিল, প্রধানত কোকিল, ময়না ও চন্দনা। খাঁচার কোকিলও ডেকে উঠত বসন্তকালে। ময়না ও চন্দনাকে খুব করে শেখালে বলতে পারত মানুষের মতন দু’-একটি কথা। সেন্ট্রাল এভিনিউতে এক বাড়িতে ছিল বহু রকমের কাকাতুয়া, তাদের বিভিন্ন আকার ও অপূর্ব বর্ণবাহার। মাঝে মাঝে রোদ পোহাবার জন্য তাদের রাখা হত বাড়ির সামনের চাতালে, সে সব কাকাতুয়া দেখার জন্য ভিড় জমে যেত গেটের বাইরে। সেখান থেকে অদূরে ডাক্তার কে কে হাজারির বাড়িতে ছিল পোষা বাঘ।

কাক, চড়াই আর শালিকের মধ্যে কে আগে জাগে, তা জানি না। তবে, সব পাখির আগে জেগে উঠতেন আমার বাবা। ব্রাহ্মণদের নাকি ব্রাহ্ম মুহুর্তেই শয্যা ত্যাগ করা উচিত। বাবাকে কোনও দিনই বেশি বেলা করে ঘুমোতে দেখিনি। ছুটির দিনে একটু দিবানিদ্রা দিতেন বটে, কিন্তু দিন শুরু করতেন সূর্যোদয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। তাঁর অত ভোরে ওঠার আর একটি কারণ ছিল, তিনি সকালের ইস্কুলেও পড়াতেন, তাই তৈরি হয়ে নিতেন তাড়াতাড়ি। পরিবারের যিনি প্রধান, তিনি জেগে উঠবার পর অন্যদের তখনও বিছানায় আরাম করার তো প্রশ্নই ওঠে না। আমি আর আমাদের এক কাকা, বয়সে আমার চেয়ে সামান্যই বড়, ডাক নাম খোকা, ঘুমোতাম এক ঘরে। বাবা সেই ঘরের দরজার কাছে এসে হাঁক ডাক করে আমাদের দু’জনকে জাগাতেন। সময়ের ব্যাপারে অতিশয়োক্তি করা ছিল তাঁর স্বভাব। অর্থাৎ তিনি যখন বলতেন, এই ওঠ, ওঠ, আটটা বেজে গেল, এখনও ঘুমোচ্ছিস, তখন প্রকৃত পক্ষে ঘড়িতে পাঁচটা কুড়ি! এক একদিন সন্ধের সময় খেলাধুলো সেরে সামান্য দেরি করে বাড়িতে ফিরলে তিনি চোখ রাঙিয়ে বলতেন, রাত দশটায় বাড়ি ফেরা হচ্ছে? তখন ঘড়ির কাঁটা সাতটাও পেরোয়নি।

শীতকালের ভোরবেলা সাড়ে পাঁচটার সময় কম্বলের উষ্ণতা ছেড়ে বেরিয়ে আসতে কী কষ্টটাই না হত। অন্তত আর একটা ঘণ্টার জন্য কত অনুক্ত, কাতর আবেদনই না ছিল! ‘ওঠো শিশু মুখ ধোও, পর নিজ বেশ/ আপন পাঠেতে মন করহ নিবেশ’। আমি আর কাকা বই সামনে নিয়ে বসেছি, এই দৃশ্যটি দেখার পর বাড়ি থেকে বেরোতেন বাবা। প্রায়ই পড়তে পড়তে ঘুমে ঢুলতাম। কোনও কোনওদিন বাবা গলির বাঁকে মিলিয়ে যেতেই আবার সুরুৎ করে ঢুকে যেতাম কম্বলের নীচে। সেই রকম কোনও একটি দিনে নস্যির কৌটো নিতে ভুলে যাওয়ায় বাবা দৈবাৎ আবার ফিরে এলে কী অবস্থা হত? না, বাবা মারধোর করতেন না। বাবার হাতে মার খেয়েছি তো বটেই, আমার চেয়েও কাকা অনেক বেশি, তবে তা দুপুরে বা সন্ধের সময়, সকালে কখনও নয়, সম্ভবত এ বিষয়ে তাঁর কোনও নীতি ছিল।

ছুটির দিনগুলির সকালে বাবা বাড়িতে থাকতেন। তিনি সকালে ও দুপুরে স্কুলে পড়ান, তারপর বিকেলে কোচিং ক্লাস, আবার সন্ধের পর টিউশানি, সংসার চালাবার জন্য, আমাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের চিন্তায় তিনি দিনে প্রায় ষোলো-সতেরো ঘণ্টা অক্লান্ত পরিশ্রম করতেন। এত সব ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছেন, কিন্তু নিজের ছেলে-মেয়ে ও ছোট ভাইয়ের লেখা পড়ার দিকে নজর রাখতে পারছেন না, এ জন্য তাঁর মনে বোধহয় মাঝে মাঝে অপরাধ বোধ জাগত, তাই ছুটির দিনেও তাঁর কাছে অনেক লোকজন দেখা করতে এলেও তিনি আমাদের নিয়ে মাঝে মাঝে পড়াতে বসতেন। যেহেতু ধারাবাহিকতা ছিল না, তাই হঠাৎ হঠাৎ পড়াতে গিয়ে তিনি আমাদের বিদ্যার দৌড়, ফঁকিবাজি ও মনঃসংযোগের অভাব দেখে মর্মাহত ও ক্রুদ্ধ হয়ে উঠতেন, আমাকে ভর্ৎসনা করে বলতেন, লেখাপড়া করবি না, বড় হয়ে চায়ের দোকানে বয় হবি! এই কথাটা আমি অনেকবার শুনেছি, এবং সত্যি কথা বলতে কী, চায়ের দোকানে বয় হবার সম্ভাবনাটা আমার কাছে বেশ আকর্ষণীয়ই মনে হত। চায়ের দোকানে কত রকম মানুষ আসে, পাড়ার দোকানে দেখেছি যুবকেরা সেখানে টেবিল চাপড়ে তর্ক করে, বৃদ্ধেরা চোখ উল্টে হাসে, সারাদিন চপ-কাটলেটের গন্ধ, আহ চমৎকার!

বাবা মূলত অঙ্ক ও ভূগোলের শিক্ষক হলেও সংস্কৃত এবং ইংরিজিও ভালো জানতেন। ওঁদের আমলে শিক্ষাই ছিল এরকম। শাস্তি হিসেবে সংস্কৃত শব্দরূপ ও ধাতুরূপ মুখস্ত করতে দিতেন আমায়, ওঃ কী যে কঠিন শাস্তি তা কহতব্য নয়। আশ্চর্য ব্যাপার, এতগুলি বছর বাদেও সেগুলি ভুলিনি। এক একদিন বাথরুমে হঠাৎ আপন মনে বলে উঠি, নদী, নদ্যৌ, নদ্যাঃ! এবং সকাল সকাল জেগে ওঠার অভ্যেসটাও রয়ে গেছে। সকাল ছ’টায় ঘুম ভেঙে যায়। এখন তো স্বাধীন। তবু রাত দেড়টা-দুটোয় শুতে গেলেও বেশি বেলা পর্যন্ত ঘুমোতে পারি না।

এক সকালে বাবার সামনে পড়তে শুরু করেছি, হঠাৎ গলি দিয়ে অনেক লোক ছোটাছুটি করতে লাগল। শোনা গেল সোরগোল। কিছুক্ষণ পরেই তা পরিণত হল প্রবল হই-হল্লায়, তাতে মিশে আছে আতঙ্ক ও উল্লাস। অচিরেই জানা গেল, শুরু হয়ে গেছে দাঙ্গা, লুঠ হচ্ছে দোকানপাট। জানলা দিয়ে দেখতে পেলাম, বহু ছুটন্ত মানুষের হাতেই লুঠের মাল, কেউ কেউ পেয়েছে অনেক কিছু, কেউ পেয়েছে জুতোর দোকানের এক পাটি মাত্র জুতো!

বাবার কঠোর নির্দেশে আমরা বাড়ি থেকে বেরোতে পারলাম না। পাড়ার সমস্ত বয়স্ক ব্যক্তিরা গলিতে সমবেত হয়ে কী সব আলোচনা করতে লাগলেন, তাদের উদ্বিগ্ন মুখ দেখেই বুঝতে পারলাম, সাঙ্ঘাতিক কিছু ঘটছে। তারিখ, ১৬ই অগাস্ট, ’৪৬, ভারতের ইতিহাসে অতি কলঙ্কময় দিন। আমার বয়স তখন বারো বছর, সেই দিনটার স্মৃতি আমার বুকে আজও একটা দগদগে ক্ষত হয়ে আছে। তখন যাদের বয়েস পাঁচ-ছ বছর, তারাও বোধ হয় সেই দিনটির কথা ভুলতে পারবে না।

দাঙ্গায় আমরা আক্রান্ত হইনি শেষ পর্যন্ত, ব্যক্তিগত ক্ষতি কিছু হয়নি, কিন্তু সেই কৈশোর বয়সের মনোজগতে দারুণ একটা ধাক্কা লেগেছিল। কেন এই দাঙ্গা? মাত্র কয়েক মাস আগে রশিদ আলির মুক্তির দাবিতে হিন্দু-মুসলমান পাশাপাশি হাতে হাত ধরাধরি করে আন্দোলনে নেমেছিল, আজ তারা পরস্পরের বিরুদ্ধে ছুরি তুলবে কেন? এর মধ্যে বিভেদের কী এমন কারণ ঘটল? মুসলিম লিগ থেকে সেই দিনটিতে ডাইরেক্ট অ্যাকশান বা প্রত্যক্ষ সংগ্রামের কথা ঘোষণা করা হয়েছিল। সেই প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাকের মর্ম আমি আজও বুঝি না।

বাংলায় তখন মুসলিম লিগের শাসন, প্রধানমন্ত্রী (তখন মুখ্যমন্ত্রী বলা হত না) হুসেন শহিদ সুরাবর্দি। (তাঁর নামের বানান অন্যরকমও লেখা হয়, তখন পত্র-পত্রিকায় সুরাবর্দিই প্রচলিত ছিল।) তিনি বিখ্যাত খানদানি বংশের সন্তান, তার এক বড় ভাই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবী, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের পরিচয়ের আড্ডার বিশিষ্ট সদস্য, এই সুরাবর্দিও কৃতবিদ্য ও বিশিষ্ট নেতা, পরবর্তীকালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ও অধুনা বাংলাদেশেও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়, কিন্তু সেই সময় তাঁর ভূমিকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন থেকে যায়। বিলেত থেকে যে ক্যাবিনেট মিশন এসেছিল, তাদের সঙ্গে আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে, পাকিস্তানের দাবি শূন্যে ঝুলে আছে, মরিয়া হয়ে লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তানের জন্য মুসলিম লিগের এই প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ঘোষণা। কিন্তু এই সংগ্রাম কার বিরুদ্ধে, সংগ্রামের রূপরেখা কী, তা কিছুই বলা হল না। জিন্না অবশ্য ঘোষণা করেছিলেন, লিগ রক্তপাতের পথে যাবে না। দেশে গৃহযুদ্ধের সূচনা করবে না। রক্তপাতহীন ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’ মানে কী?

ওই দিন বিকেলবেলা ময়দানে লিগ এক জনসভার আয়োজন করে। আবুল হাসিমের মতন বিশিষ্ট তাত্ত্বিক নেতাও সেখানে উপস্থিত। প্রচুর গরম গরম বক্তৃতা হয়। আবুল হাসিম হিন্দুদের নাম উচ্চারণ করেননি, দূরের ফোর্ট উইলিয়ামের দিকে আঙুল দেখিয়ে বলেছিলেন, লড়াই ইংরেজদের বিরুদ্ধে। এই বক্তব্য কি দূরদর্শিতার চরম অভাবের পরিচয় নয়? লাঠি-সোঁটা কিংবা ছোরা-ছুরি নিয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ‘প্রত্যক্ষ সংগ্রাম’? তার চেয়ে অনেক সহজ, হিন্দুরাই পাকিস্তান দাবির প্রতিবন্ধক ভেবে তাদের পেটে ছুরি মারা, তাদের দোকান লুঠ করা। গুণ্ডা-বদমাসরা অতিদ্রুত এই সব সুযোগ গ্রহণ করে, অনেক সাধারণ মানুষও এই রকম সময় লোভী ও রক্তলোলুপ হয়ে ওঠে। ইঙ্গিত ছিল স্পষ্ট, বিকেলের ওই মিটিং-এর আগে সকাল থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছিল খুনোখুনি। সুরাবর্দি আগে থেকেই ওই দিনটিকে কেন ছুটির দিন ঘোষণা করেছিলেন, তার ব্যাখ্যা আজও মেলে না। মারামারি করার জন্য সরকারি ছুটি? পুলিশের প্রতি আগে থেকেই নির্দেশ ছিল, তাদের ভূমিকা হবে নীরব দর্শকের। দাঙ্গা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ায় সুরাবর্দি ঘাঁটি গেড়েছিলেন লালবাজারের কন্ট্রোল রুমে। ফজলুল হক পর্যন্ত বলেছিলেন, কন্ট্রোল রুম কিছুই কন্ট্রোল করছে না। বাংলা পত্র-পত্রিকার বিবরণ বাদ দিলেও ইংরেজদের স্টেটসম্যান পত্রিকা মুসলমানদের পক্ষপাতী, তার সম্পাদক পাকিস্তান দাবির সমর্থক, সেই পত্রিকাতেও এই আদিম হিংস্রতার জন্য দায়ী করা হল লিগ মিনিস্ট্রিকে। এ ব্যাপার পূর্ব পরিকল্পিত, পুলিশ নিষ্ক্রিয়, দাঙ্গাকারীরা কোথা থেকে পেল গাড়ি, ঘোড়া, পেট্রল? ভারতের ছোটলাট দিল্লির বড়লাটকে রিপোর্ট পাঠালেন, ‘এ পর্যন্ত যা খবর পাওয়া গেছে, তা স্পষ্টত সাম্প্রদায়িক। কোনওক্রমে ব্রিটিশ বিরোধী নয়, আবার বলছি, ব্রিটিশ বিরোধী নয়।’

প্রথম দু’-একদিন হিন্দুরা প্রস্তুত ছিল না, তারা মার খেয়েছে বেশি। তারপর সঙঘবদ্ধ হয়ে তারাও পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। হিংস্রতায় কেউ কারওর চেয়ে কম যায় না। এই সব সময়ে প্রকটিত হয়ে পড়ে, মানুষই এই পৃথিবীর সবচেয়ে হিংস্র প্রাণী। বিবেক, মনুষ্যত্ব, এসবই যেন অদৃশ্য হয়ে যায়।

প্রথম শুরু হয় কলকাতায়, তার প্রতিক্রিয়া খুনোখুনি ছড়িয়ে পড়ে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, বরিশাল, পাবনা। তার থেকেও ভয়াবহ আকার নেয় নোয়াখালি, কুমিল্লায়, সন্দীপে। আরও প্রবল আগুন জ্বলে বিহারে। আরও ভয়াবহ পঞ্জাবে। শুধু পঞ্জাবেই নিহতের সংখ্যা অন্তত ছ লাখ, অন্তত এক লাখ তরুণীকে পুরুষ পশুরা ছিন্নভিন্ন করেছিল।

এক বছর পরে দেশ স্বাধীন হয়েছিল দু’-টুকরো হয়ে। তবে ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতার ইতিহাসে যে গভীর কলঙ্করেখা আছে, তা স্বীকার করা উচিত। আবেগময় ভাষায় যতই বলা হোক, এই স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে বিদেশি শাসকদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে, আসলে তা সত্যি নয়। এই স্বাধীনতা ত্বরান্বিত হয়েছে লক্ষ লক্ষ ভ্রাতৃহত্যায়, মাতৃহত্যা, পিতৃহত্যা, শিশুহত্যায়। অসংখ্য নিরীহ, নির্দোষ, সাধারণ মানুষের রক্তের ওপর উত্তোলিত হয়েছে ওই দুই দেশের স্বাধীনতার পতাকা। সেই পাপের দগদগে ঘা এখনও ফুটে ওঠে এই উপমহাদেশের যেখানে সেখানে। যেসব কাপুরুষ নেতারা নিজেদের গা বাঁচিয়ে, ব্যক্তি স্বার্থের তাড়নায় তাড়াহুড়ো করে, ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অন্ধ হয়ে ভারত বিভাগে সম্মত হয়েছিলেন, যাঁদের ছবিতে আজও মালা দেওয়া হয়, ক্রমওয়েলের মতন কবর থেকে তুলে এনে তাদের প্রত্যেককে এখন ফাঁসি দিলে হয়তো সেই পাপের স্খলন হতে পারে।

দাঙ্গার বিবরণ আমি দিতে চাই না। এমনিতেই তখনকার বাস্তব অতি নৃশংস, তার ওপরেও গুজবে গুজবে এমন আতঙ্ক ছড়িয়েছিল যে আমরা বাড়ি থেকে এক পা বেরোতে সাহস করতাম না। রাজাবাজার থেকে মুসলমানরা যখন তখন দল বেঁধে এসে আক্রমণ করবে, এই ভয়ে পালা করে রাত জেগে পাহারা দেয় সবাই। এক এক রাতে দূর থেকে আল্লা হো আকবর ধ্বনি শোনাও যায়, তাতে হিম হয়ে আসে বুকের রক্ত। ছাদে অনেক আধলা ইট জড়ো করে রাখা আছে, আর দরজার খিলগুলো খুলে নেওয়া হয়েছে লাঠি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য, মধ্যবিত্ত বাঙালির বাড়িতে আর কোনও অস্ত্র থাকে না। কোনও কোনও বাড়িতে নাকি কড়া ভর্তি গরম তেল রাখা থাকে, আক্রমণকারীদের মাথায় ঢেলে দেওয়া হবে। আত্মরক্ষার হাস্যকর অক্ষম প্রয়াস! কিছু হিন্দু গুণ্ডা মদ খেয়ে, খোলা তলোয়ার হাতে মাঝে মাঝে হুঙ্কার দিয়ে বেড়ায়, তাদের গৃহস্থরা কী খাতিরই না করে!

বড় রাস্তায় প্রথমদিন থেকেই পড়ে আছে সাত আটটি মৃতদেহ। সরাবার কেউ নেই। ক্রমে সেগুলো পচতে শুরু করে। বিকট গন্ধ ছড়ায় চতুর্দিকে। তা সেই গন্ধ চাপা দেবার জন্য ধূপ জ্বালিয়ে রাখা হয় ঘরে। দোকানপাটে যাবার উপায় নেই, খাদ্য শুধু সেদ্ধ ভাত, এরই মধ্যে কারা যেন বাড়ি বাড়ি এসে ধূপ সরবরাহ করে গেল। কয়েকদিন পর ছাদ থেকে উঁকি মেরে দেখি, সেই মৃতদেহগুলি আস্তে আস্তে উঠে বসছে। হ্যাঁ, সত্যি দেখেছি। রাইগার মর্নিশ হয়ে একসময় মৃত শরীর বেঁকতে শুরু করে। সে দৃশ্য দেখার পর বেশ কয়েক রাত ঘুমোতে পারিনি।

শেষ পর্যন্ত মুসলমানরা আমাদের গ্রে স্ট্রিট পাড়ায় আক্রমণ করতে আসেনি। মুসলমান কর্তৃক হিন্দু নিধনের কোনও দৃশ্য দেখিনি আমি। তা অন্যত্র ঘটেছে, বরং উল্টোটাই দেখেছি। আমাদের পাড়ায় কিছু কিছু দোকান ছিল মুসলমানদের, যেমন শালকর, শাল ধোলাই ও সেলাইয়ের কারবার তাদের একচেটিয়া। সেসব দোকান ও তাদের মালিকরা শেষ। ফড়িয়াপুকুরে নাজির সাহেবের ঘুঁড়ির দোকান ছিল বিখ্যাত, আমাদের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয়, সে দোকান লুঠেরারা নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে, অতি সুপুরুষ ও মিষ্টভাষী নাজির সাহেব পালাতে পেরেছেন কি না জানি না। রাজমিস্তিরিরা নব্বই ভাগ মুসলমান, যে জন্য বলা হয় কলকাতার প্রায় সমস্ত দালান কোঠায় মুসলমানের হাতের ছোঁয়া আছে, তারাও অনেকে নিজের হাতে তৈরি করা বাড়ির সামনে প্রাণ দিয়েছে। আরও কত ফেরিওয়ালা ছিল।

আমি স্বচক্ষে শুধু একটিই হত্যাকাণ্ড আংশিক দেখেছি। প্রথমবারের দাঙ্গা কয়েকদিন পর প্রশমিত হলে, মাঝে মাঝেই হঠাৎ আবার শুরু হয়ে যেত। এরই মধ্যে সবাই অফিস কাছারি যেতে শুরু করে, বাজার-হাট খোলে। একদিন সকালে হাতিবাগানে গেছি, কারা যেন বলাবলি শুরু করল, মানিকতলা বাজারে হিন্দুদের খুব মারছে। সত্যি বা মিথ্যে যাই-ই হোক, কেউ যাচাই করে দেখল না, এ বাজারেও শুরু হয়ে গেল হুড়োহুড়ি। আমি কিছু বুঝবার আগেই দেখি যে এক প্রৌঢ় ডিমওয়ালা ডিমের ঝুড়ি হাতে নিয়ে ছুটছে, তাকে তাড়া করে আসছে একদল ক্লীব। ধপা-ধপ করে বাঁশ দিয়ে পেটানো হতে লাগল তাকে, ডিমগুলো ছিটকে পড়ে গেল। সে দু’ হাত দিয়ে মাথা ঢেকে কী যেন বলতে চাইছে কাতরভাবে। একটি লোকও তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে গেল না, আমিও যাইনি, লোকের ঠেলাঠেলিতে ছিটকে পড়েছি, তারপর পালিয়েছি নিজের প্রাণভয়ে।

সেই মানুষটির অসম্ভব ভয়ার্ত দুটি চোখ আর রুগ্ণ দাড়িওয়ালা শুকনো মুখখানা কি কোনওদিন ভুলতে পারব? আজও স্পষ্ট দেখতে পাই।

এই সব দাঙ্গায় যারা মরে, তাদের নিরানব্বই ভাগ মানুষই গরিব, অসহায়, দুর্বল মানুষ। তাদের জীবনে ধর্মের তেমন কোনও ভূমিকাই নেই, জীবিকার তাড়নাতেই তারা অস্থির। একজন মুসলমান ডিমওয়ালা হিন্দুপ্রধান বাজারে এসেছিল নিতান্তই পেটের দায়ে, যারা তার কাছ থেকে ডিম কেনে তারাই তাকে হত্যা করল অকারণে। তাতে কোন ধর্মের কী সুরাহা হল? ওই বয়সে, ওরকম একটি দৃশ্য দেখে, ধর্মের প্রতি আমার দারুণ অভক্তি জন্মে যায়। যারা ওই ডিমওয়ালাকে অকারণে মারল, যারা দূরে দাড়িয়ে সেই হত্যা দৃশ্য প্রত্যক্ষ করল অথবা বাধা দিল না, তারা যদি হিন্দু হয়, আমি তা হলে সেই হিন্দু হতে চাই না। চুলোয় যাক ধর্ম!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *