১
আজাদের মা মারা গেছেন গতকাল বিকালে, পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে আজাদের ধরা পড়ার ঠিক ১৪ বছরের মাথায়, একই দিনে ৷
আজ তাঁর দাফন ৷
আলোকোজ্জ্বল শারদীয় দুপুর ৷ আকাশ ঘন নীল ৷ বর্ষাধোয়া গাছগাছালির সবুজ পাতায় রৌদ্ররশ্মি আছড়ে পড়ে পিছলে যাচ্ছে স্বর্ণলতার মতো ৷ শেওলা-ধরা ঘরবাড়ি দরদালানগুলো রোদে শুকুচ্ছে, যেন তারা বিছানা-বালিশ, বর্ষার আর্দ্রতা তাড়াতে তাদের কে যেন মেলে দিয়েছে রোদে ৷ রাস্তার কারুকার্যময় রিকশাগুলো ঝকমক করছে আলোয় আলোয় ৷ রিকশার ঘন্টির ক্রিং ক্রিং আওয়াজও যেন রোদে ঝিলিক দিচ্ছে ৷ এই চনমনে রোদের নিচে জুরাইন গোরস্তান চত্বরে সমবেত হয়েছেন এক দল শবযাত্রী ৷ তাঁদের মধ্যে অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা ৷ গোরস্তানের সীমানা-প্রাচীরের বাইরে রাস্তায় গাড়িতে বসে আছেন জাহানারা ইমাম ৷
আজাদের মাকে সমাহিত করা হবে একটু পরেই ৷
আজ ৩১শে আগস্ট ৷ ১৯৮৫ সাল ৷ গতকাল, ৩০শে আগস্ট, আজাদের মা মারা গেছেন ৷
১৪ বছর আগে, ১৯৭১ সালের ৩০শে আগস্ট রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা আজাদকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল ৷ আজাদ আর ফিরে আসেনি ৷ এটা শহরের অনেক মুক্তিযোদ্ধারই জানা যে, এই ১৪টা বছর আজাদের মা একটা দানা ভাতও মুখে দেননি, কেবল একবেলা রুটি খেয়ে থেকেছেন; কারণ তাঁর একমাত্র ছেলে আজাদ তাঁর কাছে ১৪ বছর আগে একদিন ভাত খেতে চেয়েছিল; পরদিন তিনি ভাত নিয়ে গিয়েছিলেন রমনা থানায়, কিন্তু ছেলের দেখা আর পাননি ৷ তিনি অপেক্ষা করেছেন ১৪টা বছর, ছেলের আগমনের আশায় পথের দিকে চেয়ে থেকে ৷ অপেক্ষার এই ১৪টা বছর তিনি কোনো দিন বিছানায় শোননি, শানের মেঝেতে শুয়েছেন, কি শীত কি গ্রীষ্ম, তাঁর ছিল একটাই পাষাণশয্যা, কারণ তাঁর ছেলে আজাদ শোওয়ার জন্যে রমনা কি তেজগাঁ থানায়, কি তেজগাঁ ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এমপি হোস্টেলের মিলিটারি টর্চার সেলে বিছানা পায়নি ৷
শহরের মুক্তিযোদ্ধারা, বিশেষ করে যাঁরা ছিলেন আরবান গেরিলা দলের সদস্য, তাঁরা এসেছেন আজাদের মায়ের দাফনে শরিক হতে ৷ আজাদের মা মারা যাওয়ার আগে বুঝতে পেরেছিলেন যে তিনি মারা যাচ্ছেন, তিনি তাঁর ভাগ্নে জায়েদকে বলে রেখেছিলেন যেন আত্মীয়স্বজন কাউকে তাঁর মৃতু্যসংবাদ অবহিত না করা হয়; কিন্তু জায়েদ মুক্তিযোদ্ধাদের খবরটা না দিয়ে পারে না ৷ জায়েদের কোমরে আর উরুতে আছে বুলেট বের করে নেওয়ার ক্ষতচিহ্ন, ১৪ বছর আগে এই ৩০শে আগস্টের রাত্রির শূন্য ঘন্টায় পাকিস্তানি সৈন্যদের ছোড়া বুলেট তার শরীরে বিদ্ধ হয়েছিল, তারপর থেকে সে সারাক্ষণ ভুগে আসছে হাত-পা-শরীরের অস্বাভাবিক জ্বলুনিতে ৷ এই জায়েদ মুক্তিযোদ্ধা কাজী কামালকে ফোন করে আজাদের মায়ের মৃতু্যসংবাদ অবহিত করে ৷ আম্মার মারা যাওয়ার খবরটা-এই খালাকে জায়েদরা ডাকত আম্মা বলে-মিসেস জাহানারা ইমামকে জানানোও জায়েদ অবশ্যকর্তব্য বলে জ্ঞান করে ৷ কারণ জাহানারা ইমাম আর কেউ নন, রুমীর আম্মা; আজাদ দাদার বন্ধু, সহযোদ্ধা, সহ-শহীদ রুমী ভাইয়ের আম্মা ৷ ১৯৭১ থেকে ১৯৮৫-সন্তানের জন্যে নীরবে অপেক্ষা করা, আর পথ চেয়ে থাকা, আর ক্রমশ চারদিক থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার এই ১৪টা অন্ধকার নির্জন করুণ বছরে আজাদের মায়ের কাছে যে অল্প কজন সুহৃদ আসতেন, তাঁর খোঁজখবর নিতেন, তাঁর মনের ভেতরের দুষ্পাঠ্য শিলালিপি পাঠ করতে পারতেন সমবেদনার সঙ্গে, জাহানারা ইমাম তাঁদের একজন ৷
জাহানারা ইমাম অতঃপর রুমীর সহযোদ্ধা বন্ধুদের খবর দিতে থাকেন; শাহাদত চৌধুরী থেকে ফতেহ চৌধুরী, হাবিবুল আলম থেকে নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, রাইসুল ইসলাম আসাদ থেকে চুল্লু ভাই, আবুল বারক আলভী থেকে শহীদুল্লাহ খান বাদল, সামাদ, মাহবুব, হ্যারিস, উলফত, লিনু বিল্লাহ, হিউবার্ট রোজারিও-সবাই খবর পেয়ে যান-আজাদের মা মারা গেছেন, তাঁর দাফন হবে জুরাইন গোরস্তানে ৷ জনা তিরিশেক মুক্তিযোদ্ধার কেউ সরাসরি, কেউবা শাহজাহানপুরে আজাদের মায়ের বাসা ঘুরে এসে জুরাইন গোরস্তান এলাকায় জড়ো হয়েছেন ৷
নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চুর স্মৃতিতে আজাদের মায়ের দাফনের দৃশ্যটাও চিরস্থায়ীভাবে সংরক্ষিত হয়ে যায় ৷ তাঁর মাথায় একটা প্রশ্নবোধক চিহ্নও চিরকালের মতো আঁকা হয়ে যায়-শরৎকালের এ রৌদ্রোজ্জ্বল দিনটায় বেলা ১২টার ঘন নীল আকাশ থেকে বৃষ্টি নামল কীভাবে ৷ আজাদের মায়ের শবদেহ খাটিয়ায় করে বয়ে চলেছেন মুক্তিযোদ্ধারা, জুরাইন গোরস্তানের দিকে ৷ জুরাইন গোরস্তানটা দেখতে অন্য যে-কোনো গোরস্তানের মতোই-কিছু কাঁচা কবর, কিছু পাকা; পাকা কবরগুলোর কোনোটার চারদিকে কেবল ৫ ইঞ্চি ইটের দেয়াল, পলেস্তারাহীন, শেওলা-লাগা, আবার কোনোটা মার্বেল পাথরে ঢাকা, এপিটাফে নামধাম জন্মমৃতু্যসনতারিখ, কোনো কোনো সমাধিসৌধ বেশ জলুসপূর্ণ, তাতে নানা রঙিন কাচ-পাথর বসানো, কোনোটায় টাইলস বসানো, দু-তিন দিন বয়সী কবরের মাটি এখনও ঝুরঝুরে, শিয়রে খেজুরপাতা, একটা কবরের পাশে দাঁড়িয়ে দুহাত তুলে চোখ বন্ধ করে মোনাজাত করছে দুজন টুপি-মাথা শাদা-পাঞ্জাবি তরুণ-এসব দৃশ্যের মধ্যে এমন কিছু নাই যা আলাদা করে চোখে পড়বে ৷ আম্মা, জাহানারা ইমাম, গোরস্তানের মধ্যে মহিলাদের ঢোকা শাস্ত্রসম্মত নয় বলে বাইরে রাস্তায় বসে আছেন গাড়িতে, আর মুক্তিযোদ্ধাদের এ দলটা এগিয়ে যাচ্ছেন যুদ্ধে হারিয়ে যাওয়া এক সহযোদ্ধার মাকে খাটিয়ায় তুলে নিয়ে ৷ সঙ্গে মরহুমার কিছুসংখ্যক আত্মীয়স্বজন ৷ তাদের অনেকের মাথায় টুপি ৷ কবরে নামানো হয় শাদা কাফনে মোড়ানো নাতিদীর্ঘ শরীরটাকে, প্রথম মাটিটা দিতে বলা হয় আজাদের খালাতো ভাই জায়েদকে, জায়েদ কথার মানে বুঝতে পারে না, তাকিয়ে থাকে নির্বাক আর নিষ্ক্রিয়, তখন একজন তাকে ধরে তার হাতে একমুঠো মাটি তুলে দেয়, এবং মাটিটা ফেলে দেওয়ার জন্যে তার আঙুলগুলো আলগা করে ধরে, জায়েদের হাত থেকে মাটি ঝরে যায় ৷ তারপর একজন একজন করে মুক্তিযোদ্ধা গোরে মাটি দিতে থাকেন, ঠিক তখনই নির্মেঘ আলোকোজ্জ্বল আকাশ থেকে ঝিরঝির করে নেমে আসে বৃষ্টি ৷ একই সঙ্গে প্রতিটা মুক্তিযোদ্ধার ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে একটা অজানা মিষ্টি সুগন্ধ হানা দেয়, আর তাঁরা মাথার ওপরে তাকালে দেখতে পান একখণ্ড বিচ্ছিন্ন মেঘ ৷ রোদ আর বৃষ্টি একসঙ্গে পড়াটা এই বাংলায় কোনো অস্বাভাবিক ঘটনা নয়, রোদ হচ্ছে বৃষ্টি হচ্ছে খেঁকশিয়ালির বিয়ে হচ্ছে-ছোটবেলা থেকে এ ছড়াটা কারই বা জানা নাই, কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রতিটা মুক্তিযোদ্ধার মনে হতে থাকে-এই সুগন্ধ, এই সালোক বৃষ্টির অন্য কোনো মানে আছে; তাঁদের মনে হয়-এই শবযাত্রীদলে তাঁদের হারিয়ে যাওয়া শহীদ-বন্ধুরা ফিরে এসেছে, যোগ দিয়েছে ৷ বাচ্চু এর পরে বহু বছর এ আফসোস করবেন যে কেন তাঁরা সেদিন ঘাড় ঘোরাননি, ঘোরালেই তো দেখতে পেতেন যুদ্ধদিনে চিরতরে হারিয়ে ফেলা তাঁর সহযোদ্ধা বন্ধুদের অনেককেই, আবার এই ১৪ বছর পরে; হাতের এতটা কাছে তিনি পেয়ে যেতেন শহীদ জুয়েলকে, পূর্ব পাকিস্তানের সেরা ব্যাটসম্যান জুয়েল, যার হাতে গুলি লেগেছিল বলে ধরা পড়ার রাতেও ডান হাতের আঙুলে ছিল ব্যান্ডেজ, সেই ব্যান্ডেজঅলা আঙুলেই জুয়েল কবরে মাটি দিচ্ছে; দেখতে পেতেন শহীদ বদিকে, স্ট্যান্ড করা ছাত্র বদিউল আলম হয়তো আলবেয়ার কামুর আউটসাইডারটা প্যান্টের কোমরে গুঁজে এক হাতে মাটি দিচ্ছে সমাধিতে; দেখতে পেতেন শহীদ আজাদকে, মরহুমার একমাত্র সন্তান হিসেবে যে এসেছে কর্তব্য পালন করতে, মায়ের শেষকৃত্যে অংশ নিতে; কিন্তু যার পকেটে এখনও আছে জর্জ হ্যারিসনের গানের নিজের হাতে লেখা কপি, মাই ফ্রেন্ড কেম টু মি, স্যাডনেস ইন হিজ আইস…বাংলা দেশ, বাংলা দেশ, সে যেন জর্জ হ্যারিসনের মতোই ভাঙা উচ্চারণে গাইছে ব্যাংলা দেশ, ব্যাংলা দেশ আর গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের মতো মাটি ছিটিয়ে ঢেকে দিচ্ছে কবরখানি ৷ আবুল বারক আলভী দেখতে পান শহীদ আলতাফ মাহমুদকে, যে-কোদাল দিয়ে একাত্তরের ৩০শে আগস্ট ভোরে তিনি তাঁর রাজারবাগের বাসার আঙিনায় লুকিয়ে রাখা অস্ত্র তুলছিলেন মিলিটারির বেয়নটের খোঁচা খেতে খেতে, সেই কোদাল নিয়েই এসে গেছেন আলতাফ মাহমুদ, একটু একটু করে মাটি ঢালছেন গোরে ৷ তাঁর কপালে বেয়নটের একটা খোঁচা লাগায় ভুরুর ওপর থেকে চামড়া কেটে নেমে গিয়ে ঝুলে আছে কপালের ওপর, এখনও, যেমনটা ছিল ১৪ বছর আগের সেই ভোরে ৷ আজ তাঁর মুখে যেন আবার বেজে উঠছে অস্ফুট সুর, তারই নিজের কম্পোজিশন : আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি ৷ হয়তো শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের এই ভিড়ে এসেছে শহীদ বাকের, এসেছে শহীদ আশফাকুস সামাদ, এসেছে আজাদদের বাসায় থাকা পেয়িং গেস্ট মর্নিং নিউজের সাংবাদিক শহীদ বাশার ৷ এসেছে শহীদ আজাদের সহযোদ্ধা আরো আরো শহীদ মুক্তিযোদ্ধারা ৷
আজাদের মাকে সমাহিত করে প্রথানুযায়ী দোয়া-দরুদ পড়ে মোনাজাত সেরে একে একে গোরস্তান ছেড়ে চলে আসেন শবযাত্রীদলের সবাই ৷ জায়েদ কবরের গায়ে মরহুমার একটামাত্র পরিচয় উৎকীর্ণ করে রাখে : শহীদ আজাদের মা ৷ এই তাঁর একমাত্র পরিচয় ৷ তাঁর আর কোনো পরিচয়ের দরকার নাই ৷ এই পরিচয়-ফলক দেখে কেউ কেউ, যেমন আজাদের দূর-সম্পর্কের মামারা, সরোষে এ মত প্রদান করেছিলেন যে কবরের গায়ে মুসলমান মহিলার অবশ্যই স্বামীর নাম থাকা উচিত, কিন্তু জায়েদ নাছোড়, ‘আম্মা মরার আগে আমারে স্পষ্ট ভাষায় কইয়া গেছে, বাবা রে, আমি যাইতেছি, তুমি এইটা এইটা কইরো, এইটা এইটা কইরো না, আম্মার হুকুম, কবরের গায়ে একটাই পরিচয় থাকব, শহীদ আজাদের মা ৷ ব্যস আর কিছু না ৷’
১৯৮৫ সালের শরতেই শুধু নয়, তারও এক দশক দু দশক পরে, যে জিয়ারতকারীরা বা শবযাত্রীরা জুরাইন গোরস্তানে যাবে, যদি লক্ষ করে, তারা দেখতে পাবে একটি কবরের গায়ে এই নিরাভরণ পরিচয়-ফলকখানি: মোসাম্মৎ সাফিয়া বেগম, শহীদ আজাদের মা ৷ কী জানি, তাদের মনে কোনো প্রশ্ন জাগবে কি জাগবে না ৷ কিন্তু জায়েদ জানে, এ ছাড়া আর কোনো পরিচয়েরই আম্মার দরকার নাই, বরং অন্য কোনো পরিচয় কেবল অনাবশ্যক নয়, অবাঞ্ছিত বলে গণ্য হতে পারে ৷
তবু ঢাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কারো কারো মনে হবে, তাঁর পরিচয়টা শুধু শহীদ আজাদের মা-ই নয়, তিনি নিজেও এক অসমসাহসিকা যোদ্ধা, তিনি বীর, তিনি সংশপ্তক, তিনি কেবল জাতির মুক্তিযুদ্ধে ছেলেকে উৎসর্গ করেছেন, তা-ই নয়, সারাটা জীবন লড়ে গেছেন তাঁর নিজের লড়াই এবং সেই যুদ্ধে তিনি হার মানেননি ৷
plz upload other novels of Anisul Hoque which are written on liberation war.