০১. মইনু মিয়া

আমার বাবার নাম মইনু মিয়া। খুবই হাস্যকর নাম। কাঠ মিস্ত্রি বা দরজিদের এরকম নাম থাকে। আমার দাদাজান দরজি ছিলেন, এবং তিনি তাঁর মতো করেই ছেলের নাম রেখেছেন। তিনি স্বপ্নেও ভাবেন নি, তার ছেলে গিরায় হিসাব না করে, নেনোমিটার, পিকো সেকেন্ডে হিসাব করবে। আমার বাবা মইনু মিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে জীবন শুরু করবেন।

এখন অবশ্য তার নাম মাইন খান। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময়ই তিনি প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে এফিডেভিট করে নাম বদলেছেন। তবে তাঁর রক্তে দরজির যে ব্যাপারটা পৈতৃক সূত্রে চলে এসেছে তা এখনো আছে। আমার বাবা মাইন খান বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দিয়ে গার্মেন্টসের কারখানা দিয়েছেন। গার্মেন্টসের নাম মৃন্ময়ী এ্যাপারোস। মৃন্ময়ী আমার নাম। ভালো নাম মৃন্ময়ী, ডাক নাম মৃ। আমার ভাবতে খুবই খারাপ লাগে যে, বিদেশী লোকজন বাবার গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির শর্ট গায়ে দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের ঘাড়ের সঙ্গে যে স্টিকার লেগে আছে সেখানে লেখা মৃন্ময়ী। অচেনা মানুষের গায়ের ঘামের গন্ধে আমাকে বাস করতে হচ্ছে।

বাবা যেমন ইউনিভার্সিটিতে সেকেন্ড ইয়ারে উঠে এফিডেভিট করে তাঁর নাম বদল করেছেন, আমি নিজেও তাই করব। অন্য কোনো নাম ঠিক করব, যে নাম কেউ ঘাড়ে করে ঘুরে বেড়াবে না। আমি মনে মনে নাম খুঁজে বেড়াচ্ছি। বাবাকেও একদিন বললাম, বাবা, আমাকে সুন্দর একটা নাম দেখে দাও তো। আমি ঠিক করেছি নাম বদলাব।

বাবা বিস্মিত হয়ে বললেন, মৃন্ময়ী তো খুবই সুন্দর নাম।

নামটায় ঘামের গন্ধ বাবা।

ঘামের গন্ধ মানে কী? বুঝিয়ে বলতো। তোর সব কথা বোঝার মতো বুদ্ধি আমার নেই।

পরে একসময় বুঝিয়ে বলব। আজ না।

না এখনই বল। মৃন্ময়ীর সঙ্গে ঘামের সম্পর্ক কী?

বাবা চোখ থেকে চশমা খুলে তাকিয়ে রইলেন। খুব অবাক হলে তিনি এই কাজটা করেন। চোখ থেকে চশমা খুলে ফেলেন। আমার ধারণা তিনি এই কাজটা করেন যাতে অন্যরা তাঁর বিস্মিত দৃষ্টি দেখতে পায়।

 

আমার বাবা খুবই বুদ্ধিমান একজন মানুষ। এক থেকে দশের মধ্যে যদি বুদ্ধির স্কেল করা হয় সেই স্কেলে বাবার বুদ্ধি হবে ১৩, দশের চেয়েও তিন বেশি। বাবাকে বিচার করতে হলে স্কেলের বাইরে যেতে হবে। এটা তিনি নিজে ভালো করে জানেন। তার মধ্যে সূক্ষ্ম একটা চেষ্টা থাকে যেন অন্যরাও ব্যাপারটা চট করে ধরে ফেলে।

মাঝে মাঝে অতিরিক্ত বুদ্ধিমান মানুষকে বোকা বোকা লাগে। বাবাকে আজ সে রকমই লাগছে। তিনি গা দুলিয়ে হাসার চেষ্টা করছেন। হাসিটা মনে হচ্ছে ঠোট থেকে নেমে এসে শূন্যে ঝুলছে। এই হাসির আমি নাম দিয়েছি ঝুলন্ত মাকড়সা হাসি। মাকড়সা যেমন সুতা ধরে নিচে নামতে থাকে, আবার ওপরে ওঠে, আবার খানিকটা নিচে নেমে যায় এই হাসিও সে রকম। মাঝে মাঝে হাসি উঠছে, মাঝে মাঝে নামছে। ব্যাপারটা বাবাও বুঝতে পারছেন। তারপরেও এই বোকা হাসি থেকে বের হতে পারছেন না। আমার ধারণা তিনি নিজের ওপর খানিকটা রেগেও গেছেন। মনের ভেতর চাপা রাগ, মুখে নকল ঝুলন্ত-মাকড়সা হাসি সব মিলিয়ে খিচুড়ি অবস্থা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পদার্থবিদ্যার প্রাক্তন অধ্যাপক মৃন্ময়ী এ্যাপারেলসের এমডি মাইন খান সাহেবকে দেখে আমার খানিকটা মায়াই লাগছে।

বাবার ভেতর এই খিচুড়ি অবস্থা তৈরি করেছেন তার অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আজহার উদ্দিন। প্রায় ছয় ফুটের কাছাকাছি একজন মানুষ। অতিরিক্ত রোগ। লম্বা এবং রোগা মানুষরা সাধারণত খানিকটা কুঁজো হয়ে হাঁটেন। ইনি হাঁটেন বুক টান করে। হাঁটা অবস্থায় তাকে দেখলে মনে হবে একটা সরল রেখা হেঁটে চলে যাচ্ছে। তার ঘাড়েও খানিকটা সমস্যা আছে। তিনি ঘাড় কাত করে পাশের জনকে দেখতে পারেন না। তাকে পুরো শরীর ঘোরাতে হয়। তখন তাঁকে আর মানুষ মনে হয় না। মনে হয় রোবট সিগন্যাল পেয়ে ঘুরছে।

আজহার চাচা নানান ধরনের ব্যবসা করেন। সেইসব ব্যবসার প্রায় সবই দুনম্বরী। বাড়ায় তার একটা কারখানা আছে, সেখানে নকল শ্যাম্পু তৈরি হয়। এবং বিদেশী বোতলে ভর্তি হয়ে বাজারে বিক্রি হয়। একবার তিনি টেলিফোন করে আমাকে বললেন, মৃন্ময়ী মা শোনো, ইংল্যান্ডের একটা শ্যাম্পু আছে পেনটিন না কী যেন নাম। ঐটা কিনবে না।

আমি বললাম, কেন আপনার কারখানায় তৈরি হচ্ছে?

আজহার চাচা বিরক্ত হয়ে বললেন, এত কথার দরকার কী? কিনতে না করেছি কিনবে না।

আজহার চাচী গোপন পথে চালনা পোর্টে বিদেশী সিগারেট আনেন। মদ আনেন। তিনি নিজে মদ সিগারেট কিছুই খান না। অতি আল্লাহ ভক্ত মানুষ। রমজান মাস ছাড়াও প্রতি মাসে তিন চার দিন রোজা থাকেন। বৃদ্ধ বয়সে শরীর নষ্ট হয়ে গেলে রোজা থাকতে পারবেন না। এই কারণেই আগে ভাগে রোজা রেখে ফেলা। তবে বাবার জন্যে প্যাকেট করে বোতল প্রায়ই নিয়ে আসেন। আমাদের ঘর ভর্তি হয়ে গেছে নানান সাইজের বোতলে। এর অনেকগুলোতে পানি ভরে মানিপ্লান্ট লাগানো হয়েছে। বিদেশী মদের বোতলে মানিপ্লান্ট খুব ভালো হয়।

আজহার চাচা উমরা হজ করতে গিয়েছিলেন মক্কা শরীফ। সেখান থেকে বাবার জন্যে একটা উপহার নিয়ে এসেছেন। উপহারের প্যাকেট হাতে নেবার পর থেকেই আমার বুদ্ধিমান বাবা বোকার হাসি হাসছেন। তার চোখ মুখও কেমন যেন বদলে গেছে। উপহারটা হলো কাফনের কাপড়।

আজহার চাচা বাবার দিকে তাকিয়ে খুবই আন্তরিক ভঙ্গিতে বললেন, নবীজীর কবর মোবারক ছোয়ায়ে এনেছি। তিন সেট আনলাম আমার জন্য একসেট, আমার শ্বশুর সাহেবের জন্যে একসেট আর তোমার জন্যে একসেট।

বাবা বললেন, ভালো করেছ। অতি উত্তম করেছ।

আজহার চাচা বললেন, ধর্মকর্মের দিকে তোমার টান তো সামান্য কম, এইজন্যে ইচ্ছা করেই কাফনের কাপড়টা আনলাম। চোখের সামনে এই জিনিস থাকলে কালের চিন্তা মাথায় আসে। তাছাড়া চলে যাবার সময় তো আমাদের হয়েই গেছে। তোমার কত চলছে ফিফটি টু না থ্রি?

টু।

তাহলে তো খবর হয়ে গেছে। সিগনাল ডাউন। আজরাইলকে নিয়ে ট্রেন রওনা দিয়েছে। মেল ট্রেন, পথে থামবে না।

বাবা শুকনা গলায় বললেন, ঠিক বলেছ।

আজহার চাচা বললেন, কাপড়টা পছন্দ হয় কি-না দেখ। সাধারণ মার্কিন লং ক্লথ না। হাইকোয়ালিটি পপলিন। সৌদি রাজপরিবারের সবার এই কাপড়ের কাফন হয়। খোঁজ-খবর নিয়ে কিনেছি।

মনে হয় অনেক ঝামেলা করেছ।

পছন্দ হয়েছে কি-না বল। এইসব গিফট সবাই আবার সহজে নিতে পারে না। আমার শ্বশুর সাহেব তো খুবই রাগ করলেন। আমাকে কিছু বলেন নি। আমার শাশুড়ি আম্মার সঙ্গে গজগজ করেছেন। তুমি আবার রাগ করো নি তো?

বাবা গা দুলিয়ে নকল হাসি হাসতে হাসতে বললেন, রাগ করার কী আছে? তার মুখের হাসি আরো ঝুলে গেল। আজহার চাচা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মা মৃন্ময়ী, তোমার জন্যেও সামান্য উপহার আছে। মক্কার মিষ্টি তেতুল আর একটা তসবি।

আমি বললাম, থ্যাংক ইউ চাচা।

তসবির গুটিগুলা প্লাস্টিকের না, আকিক পাথরের। তুমি জান কি-না জানি না, আকিক পাথর হলো আমাদের নবীজীর খুব পছন্দের পাথর। পবিত্র কোরান মজিদেও আকিক পাথরের উল্লেখ আছে। তেতুল একটু খেয়ে দেখে তো মা। চিনির মতো মিষ্টি। এক বোতল জমজমের পানিও এনেছি। ভালো জায়গায় তুলে রাখে। অসুখ-বিসুখ হলে চায়ের চামচে এক চামচ খাবে। তবে খেতে হবে। খুবই আদবের সঙ্গে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খাবে না। বসে খাবে, এবং বিসমিল্লাহ্ বলে খাবে। ভালো কথা নাপাঁক অবস্থায় খাবে না।

আমি বললাম, আপনি কি চা খাবেন চাচা? আপনার তো মনে হয় ঠাণ্ডা লেগেছে। আদা দিয়ে এক কাপ চা নিয়ে আসি।

নিয়ে আয় এক কাপ চা। সন্ধ্যার পর চা খেলে আমার অবশ্য ঘুমের সমস্যা হয়। ঠিক আছে তুই যখন বলছিস তুই তো জানিস না মা, তোকে অত্যন্ত পছন্দ করি। নবীজীর রওজা মোরকে যে কয়জনের জন্যে দোয়া করেছি তুই আছিস তাদের মধ্যে। চা নিয়ে আয়, খেয়ে বিদায় হই।

আজহার চাচা একটু আগে আমাকে তুমি তুমি করে বলছিলেন। এখন দুই তুই করছেন। এর মানে হলে তিনি এখন আমার প্রতি খুবই মমতা পপাষণ করছেন। বাবাকেও মাঝে মাঝে তিনি তুই বলার চেষ্টা করেন। বাবা পাত্তা দেন না।

আমি বললাম, রাতে খেয়ে যান না চাচা। আপনার প্রিয় তরকারি রান্না হয়েছে।

আজহার চাচা অবাক হয়ে বললেন, আমার যে প্রিয় তরকারি আছে তাইতো জানি না। আমার প্রিয় তরকারি কী?

ছোট মাছ দিয়ে সজনী।

তুই মনে করে বসে আছিস? আশ্চর্য কাণ্ড! কবে তোক বলেছিলাম, আমার নিজেরই তো মনে নাই। মাইন দেখেছ তোমার এই মেয়ে তো বড়ই আশ্চর্য! আচ্ছা ঠিক আছে, রাতের খানা খেয়েই যাই।

বাবা বিরক্ত মুখে তাকাচ্ছেন। আজহার চাচার রাতে ভাত খাবার জন্যে থেকে যাবার ব্যাপারটা তিনি পছন্দ করছেন না। বুদ্ধিমান মানুষ অল্প বুদ্ধির মানুষদের সঙ্গ পছন্দ করে না। অল্প বুদ্ধির মানুষদেরকে দিয়ে অনেক কাজ আদায় করা যায় বলেই তাদের সহ্য করা হয়। ব্যবসা বাণিজ্য বাড়াবার জন্যে। এক সময় আজহার চাচার বুদ্ধি পরামর্শ এবং অর্থের বাবার প্রয়োজন ছিল। এখন প্রয়োজন নেই। আজহার চাচা ব্যাপারটা বুঝতে পারছেন না। তাঁর হয়তো ধারণা হয়েছে বাবা তার হজের গল্প খুবই আগ্রহ নিয়ে শুনছেন। বাবার চোখে মুখে মোটা দাগের বিরক্তি কিছুই আজহার চাচার চোখে পড়ছে না। তিনি বাবার দিকে ঝুঁকে এসে হজের গল্প শুরু করলেন

কাবা তোয়াফের সময় কী ঘটনা ঘটেছে শোনো। আমার পাশাপাশি হাঁটছে এক আফ্রিকান মহিলা। চার পাঁচ মণ ওজন। হাতির মতো থপথপ শব্দ করে হাঁটে। পায়ের ওপর পাড়া দেয়। কনুই দিয়ে তা দেয়, পিঠে ধাক্কা দেয়। আল্লাহর ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে তো আমি মেয়েছেলের সঙ্গে ঝগড়া করতে পারি না। এমন বিপদে পড়লাম! দোয়া টোয়া সব ভুলে যাচ্ছি। কিছুক্ষণ পরে দেখি এই মহিলা আমার দিকে তাকিয়ে মুখ বাঁকা করে বলল, ছেরেং ছেরেং। একটু পর পর বলে, বলে আর মুখ বাঁকা করে হাসে। ছেরেং মানে কী জানি না নিশ্চয়ই কোনো গালাগালি। মই তুমি কি ছেরেং শব্দের মানে জানো?

বাবা গম্ভীর গলায় বললেন, ইদ্দিস ভাষায় ছেরেং মানে হলো সরু, যেমন ধর ছেরেং গা। গা হলো নদী। ছেরেং গা হলো সরু নদী। তোমার রোগা পাতলা চেহারা দেখে রসিকতা করছিল।

চিন্তা করো অবস্থা— কাবা ঘরে এসে ঠাট্টা মশকরা শুরু করেছে। কাবা শরীফের কাছে এসে মানুষ আল্লাহ্‌ ভয়ে ভীত হয়— আমি এক মেয়েছেলের ভয়ে ভীত হয়ে গেলাম।

বাবা বললেন, ভীত হওয়ার কী আছে?

আজহার চাচা বললেন, তুমি কিছু জানো না বলে এমন কথা বলতে পারলে। এই মহিলা যদি একবার ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিত, তাহলে আর আমাকে উঠতে হতো না। হাজার হাজার হাজি আমার গায়ের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে যেত ইনস্টেন্ট ডেথ। বহু মানুষ এইভাবে মারা গেছে। যাই হোক, ঐ মহিলাকে কীভাবে শায়েস্তা করেছি শোনো। ভুল বললাম শায়েস্তা আমি করি নাই। আমাকে কিছু করতে হয় নাই। ব্যবস্থা আল্লাহপাকই নিয়েছেন। আমি

উসিলা মাত্র। সেই ঘটনাও বিস্ময়কর।

আজহার চাচা এই পর্যন্ত বলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মা, তুই এখন একটু অন্য ঘরে যা। গল্পের এই অংশটা তোর শোনা ঠিক না।

আমি বললাম, অশ্লীল না-কি চাচা?

শ্লীল-অশ্লীল কিছু না। সব গল্প সবার জন্যে না। মা তুই যাতত। আমাকে। আদা চা খাওয়াবি বললি – আদা চা কই?

আমি বললাম, স্টোরীর আসল মজার জায়গাটা না শুনে আমি নড়ব না চাচা। আমি একটা আন্দাজ করেছি। দেখি আন্দাজটা মেলে কি-না।

মৃন্ময়ী মা, যা রান্নাঘরে যা।

আমি রান্নাঘরে চলে এলাম। রান্নাঘরে মা নিচু গলায় আমাদের বুয়া তস্তুরী বেগমকে শায়েস্তা করছেন। তস্তুরী কী অপরাধ করেছে বোঝা যাচ্ছে না। মায়ের শাসানি শুনে মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর কিছু করেছে, যদিও তস্তুরী বেগমের ভয়ঙ্কর কোনো অপরাধ করার ক্ষমতাই নেই। সবচে বড় অপরাধ যা সে নিয়মিত করে তা হলো তরকারিতে লবণ বেশি দিয়ে দেয়। তারপর সেই লবণ কমানোর জন্যে কাঠকয়লা দেয়। লবণের তাতে কোনো উনিশ বিশ হয় না। খেতে বসে কৈ মাছের সঙ্গে এক টুকরো কয়লা উঠে আসে। মা আমাকে দেখে বিরক্ত মুখে বললেন, মওলানা গিয়েছে?

আমি বললাম, যান নি।

এখনো যায় নি, মানে কী? ছয়টার সময় এসেছে, এখন বাজে আটটা। বাড়িতে গিয়ে এশার নামাজ পড়বে না? মানুষ এমন বেআক্কেল হয় কীভাবে? আর কতক্ষণ থাকবে?

আরো ঘণ্টা দুই থাকবেন। তুমি দেখা করে এসোনা। আমি কেন দেখা করব?

দেখা করলেই উপহার পাবে। উনি সবার জন্যে উপহার নিয়ে এসেছেন। আমার জন্যে এনেছেন আকিক পাথরের তসবি। আরবের মিষ্টি তেতুল।

তোর বাবার জন্যে কী এনেছে?

বাবার জন্যে খুব ইন্টারেস্টিং জিনিস এনেছেন। তুমি কল্পনাও করতে পারবে না এমন জিনিস। বাবা যা খুশি হয়েছেন। আনন্দে ঝলমল করছেন। উপহার কোলে নিয়ে বসে আছেন। আর দাঁত বের করে আসছেন।

মা উত্তেজিত গলায় বললেন, কার্পেট না-কি? ওখানে খুব ভালো পিরশিয়ান কার্পেট পাওয়া যায়। আমার বান্ধবী রীতা হজ করতে গিয়ে একটা বেড় সাইড কার্পেট এনেছিল। কী যে সুন্দর। উপহার, গিফট এই জাতীয় শব্দগুলি শুনলেই মা কেমন যেন উত্তেজিত হয়ে পড়েন।

আমি বললাম, কার্পেট না। অন্য কিছু। সেটা কী?

পাঁচটা প্রশ্ন করে বের করে নাও হিন্ট দিচ্ছি। এটি একটি পরিধেয় বস্ত্র তবে যে পরিধান করে সে এই বস্ত্ৰ চোখে দেখতে পারে না।

এত কথা পেঁচাচ্ছিস কেন? জিনিসটা কী বল।

জিনিসটা দেখে তোমার চোখ যদি কপালে না উঠে যায় তাহলে আমি ফার্স্ট ক্লাস মেজিস্ট্রেটের কাছে এফিডেভিট করিয়ে আমার নাম বদলে ফেলব। মৃন্ময়ীর বদলে নাম হবে ঘৃন্ময়ী। আমার ডাক নাম তখন মৃ থাকবে না, ডাকনাম হবে ঘৃ।

এত কথা বলিস না তো।

মা কৌতূহল সামলাতে পারছেন না—বসার ঘরের দিকে রওনা হলেন। আমি বললাম, সদ্য হজফেরত মানুষের কাছে যা— স্নীভলেস ব্লাউজ পরে যাওয়া কি ঠিক হবে?

মা রাগী গলায় বললেন, পাগলের মতো কথা বলছিস কেন? এটা স্পীভলেস ব্লাউজ?

হাতা বেশি ছোট তো, এইজন্যেই বললাম।

তোর বাবার সঙ্গে তো তুই এত ফাজলামি করিস না। আমার সঙ্গে কেন করিস? আমি তোর বান্ধবীও না, বয়ফ্রেন্ডও না।

আমি মিষ্টি করে হাসলাম। কেউ যখন হাসে সে বুঝতে পারে না তাঁর হাসি কেমন হচ্ছে। আমি বুঝতে পারি। কারণ আমি আমার সব হাসি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে দিনের পর দিন দেখেছি। এখনো সময় পেলে দেখি। কোন হাসিতে আমাকে কেমন দেখায়, তা আমি জানি। আমি মোটামুটি পাঁচ ক্যাটাগরীর হাসি রপ্ত করেছি।

১. Non commital হাসি। এই হাসিতে কিছুই বোঝা যাবে না।

২. দুঃখময় হাসি। মন কষ্টে ভেঙে যাচ্ছে, কিন্তু মুখে হাসি।

৩. বিরক্ত হাসি। অন্যের বোকামি দেখে বিরক্তির হাসি।

৪. আনন্দের হাসি। এই হাসি খুব সাধারণ। কোনো বিশেষত্ব নেই।

৫. মোনালিসা হাসি। বিশেষ কারোর জন্যে।

মা চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তস্তুরী বেগম বলল, আফা কতবেলের ভর্তা খাইবেন?

আমি বললাম, না।

দিন দশেক আগে একবার কতবেলের ভর্তা খেয়ে বলেছিলাম, বাহ্ খেতে চমৎকার তো! এরপর থেকে রোজই সে দুতিনবার জিজ্ঞেস করে, আফা কতবেলের ভর্তা খাইবেন?

তস্তুরী বেগম আজ রাতের খাবার কী?

ইলিশ মাছের ডিমের ভাজি। ইলিশ মাছ আর পটলের তরকারি। ইলিশ মাছের মাথা আর কাটাকুটা দিয়া লাউ।

ইলিশে ইলিশে দেখি ধূল পরিমাণ। ইলিশের একই অঙ্গে এত রূপ? সজনে দিয়ে ছোট মাছের কোনো তরকারি রান্না হয় নি?

জে না।

রান্না করা যাবে না?

ফিরিজে ছোট মাছ আছে, কিন্তুক সইজনা নাই।

সজনে আনিয়ে দেবার ব্যবস্থা করছি। তুমি অতি দ্রুত ছোট মাছের তরকারি রান্নার ব্যবস্থা কর।

জে আচ্ছা।

তোমার জন্যে একটা উপহার আছে। আকিক পাথরের তসবি। মক্কা শরীফের জিনিস এই নাও।

এখন নিতে পারব না আফা, অজু নাই।

টেবিলের ওপর রেখে দিচ্ছি, অজু করে এসে এক সময় নিয়ে যে।

তস্তুরী বেগম আনন্দিত মুখে ঘাড় কাত করল। আমার পরিচিত খুব কম মানুষকেই আমি পছন্দ করি তস্তুরী বেগম সেই অতি অল্প সংখ্যক মানুষের একজন। তার মধ্যে মাতৃভাব অত্যন্ত প্রবল। সে যখন আমার সঙ্গে কথা বলে। তখন মনে হয় মা তার ছোট মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে। মেয়ের প্রতিটি আন্সার শুনে মজা পাচ্ছে। আবার তস্তুরী বেগম যখন আমার মার সঙ্গে কথা বলে তখন মনে হয় সে তার রাগী বড় মেয়ের সঙ্গে কথা বলছে। বড় মেয়ে অন্যায়ভাবে কথা বলছে তা সে বুঝতে পারছে। বুঝতে পারলেও কী আর করা হাজার হলেও মেয়ে।

সজনে ডাঁটার কী ব্যবস্থা করা যায় অতি দ্রুত ভাবার চেষ্টা করছি। ভাইয়া বাসায় থাকলে কোনো সমস্যা নেই যেখান থেকে হোক সে সজনে ডাঁটা জোগাড় করবে। কাঁচাবাজার বন্ধ থাকলে কোনো সজনে গাছের খোঁজ বের করে, গাছ থেকে পেড়ে আনবে।

মুশকিল হলো এই সময়ে ভাইয়ার বাসায় থাকার কোনোই কারণ নেই। রাত বাজে মাত্র আটটা।

ভাইয়া এখন কী একটা কম্পিউটার কোর্স নিচ্ছে। বাংলাদেশ একেক সময় একেক দিকে ঝুঁকে পড়ে। এখন ঝুঁকেছে ইউনিভার্সিটি এবং কম্পিউটারের দিকে। পাড়ায় পাড়ায় ইউনিভার্সিটি। দুতলা বাড়ি। দুতলায় ইউনিভার্সিটি ক্লাস, এক তলায় এডমিনস্ট্রেটিভ বিল্ডিং। গ্যারেজে ভাইস চ্যান্সেলার সাহেবের অফিস। সেই ঘরে রং জ্বলে যাওয়া কার্পেট আছে। ঘড়ঘড় শব্দ হয় এমন এসি আছে। এসিতে গ্যাস নেই। বাতাস ঠাণ্ডা হয় না। একটা এসি চলছে, বিকট শব্দ হচ্ছে। এটাই যথেষ্ট। ভাইস চ্যান্সেলার সাহেবের ইজ্জত তো রক্ষা হচ্ছে।

একইভাবে শুরু হয়েছে কম্পিউটারের দোকান। যে দোকানের নাম আগে ছিল দিলখোেশ চটপটি হাউস, এখন তার নাম DIL Dot.com Computer Heaven.

ভাইয়া যে কম্পিউটার কোম্পানিতে কাজ শিখছে সেই কোম্পানির নাম International Net. কোর্স শেষ হবার পর এই কোম্পানি ইন্টারনেটের মাধ্যমে সব ছাত্রকে বিদেশে চাকরি যোগাড় করে দেবে। এই কোম্পানির ক্লাশ দুই ব্যাচে হয়। সেকেন্ড ব্যাচের ক্লাস শুরু হয় রাত আটটার পর। ভাইয়ার ফিরতে ফিরতে রাত বারটা একটা বাজে। আগে খাবার টেবিলে তার ভাত ঢাকা দেওয়া থাকত। সে ঠাণ্ডা কড়কড়া ভাত খেয়ে নিঃশব্দে শুয়ে পড়ত। অন্যদের ডিসটার্ব হবে এইজন্যে খাবার ঘরের বাতি পর্যন্ত জ্বালত না। বারান্দার বাতির আলো তার জন্যে যথেষ্ট। ভাত খেয়ে এটো থালাবাসন যে টেবিলে রেখে দিত তা না। সব কিছু ধুয়ে মুছে মিটসেকে তুলে রেখে যেত যাতে বাবা সকালে ঘুম থেকে উঠে বুঝতে না পারেন রাতে কেউ খেয়েছে। গত বুধবার থেকে বাবার হুকুমে টেবিলে ভাত রাখা বন্ধ হয়েছে। বাবা কঠিন গলায় বলেছেন, ভদ্রলোকের বাড়িতে একটা সিস্টেম থাকবে। রাত দুটার সময় বাড়ির বড় ছেলে একা একা ভাত খাবে এসব কী? এটা কি পাইস হোটেল? রাত এগারোটার মধ্যে বাড়ি ফিরলে খাবার আছে। এগারোটার পরে কেউ যদি আসে তাকে বাইরে থেকে খেয়ে আসতে হবে। ফ্ৰীজ খুলে এটা সেটা যে খেয়ে ফেলবে তাও হবে না। ফ্ৰীজ খোলা যাবে না। এই হুকুম আমার জন্যেও প্রযোজ্য। আমি রাত এগারোটার মধ্যে না ফিরলে আমার জন্যেও খাবার থাকবে না।

 

ভাগ্য ভালো ভাইয়া তার ঘরে। দরজা খোলা, বাতি নিভিয়ে সে শুয়ে আছে। আমি ঘরে ঢুকতে সে বলল, বাতি জ্বালাবি না খবরদার।

বাতি নিয়ে ভাইয়ার কিছু সমস্যা আছে। ইলেকট্রিকের আলো তার নাকি চোখে লাগে। চোখ কড়কড় করে। চোখ দিয়ে পানি পড়ে। বেশির ভাগ সময়ই ভাইয়া তার ঘরে বাতি নিভিয়ে রাখে। বারান্দার আলোই না-কি তার জন্যে যথেষ্ট।

আমি বাতি জ্বালালাম। ভাইয়া বিরক্ত মুখে উঠে বসতে বসতে বলল, কী চাস?

আমি সহজ গলায় বললাম, সজনে চাই। ছোট মাছ দিয়ে সজনের তরকারি রান্না হবে। তুমি অতি দ্রুত সজনে কিনে আনবে। এই নাও টাকা। কুড়ি টাকায় হবে না?

শার্ট গায়ে দিতে দিতে ভাইয়া টাকাটা নিল। অন্য যে-কোনো ছেলের সঙ্গে এইখানেই ভাইয়ার তফাত। অন্য যে-কোনো ছেলে বলত, এত রাতে সজনের তরকারি কেন? সজনে এমন কোনো তরকারি না যে রাত দুপুরে খুঁজে এনে রাঁধতে হবে।

ভাইয়াকে কোনো কিছু করতে বললে সে সেই বিষয়ে একটা প্রশ্ন করে না। রাত তিনটার সময় ঘুম ভাঙিয়ে যদি তাকে বলা হয়, দুটা দেশী মুরগির ডিম কিনে আনতে, কোনো প্রশ্ন না করেই সে বের হবে। এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই ডিম হাতে উপস্থিত হবে। একবারও জিজ্ঞেস করবে না, রাত দুটার সময় ডিমের দরকার কেন?

তোমার আজ কম্পিউটার ক্লাশ নেই।

না।

ছুটি না-কি? কম্পিউটারের ইন্সট্রাক্টারদের কেউ কি মারা গেছে?

না, আমিই ছেড়ে দিয়েছি।

কেন ছেড়ে দিয়েছ?

কম্পিউটার স্ক্রীনের আলো চোখে লাগে। চোখ জ্বালা করে। মাথা দপদপ করে। তা ছাড়া কিছু বুঝিও না। সব কিছু আউল লাগে।

কম্পিউটারের পড়াশোনা তাহলে বাতিল?

হুঁ।

ছয় হাজার টাকা ভৰ্তি ফি জলে গেল?

হুঁ গেল।

চোখের জন্যে ভালো একজন ডাক্তার দেখাও না কেন? যত দিন যাচ্ছে। তোমার সমস্যাটা মনে হয় বাড়ছে।

ভাইয়া জবাব না দিয়ে বের হয়ে গেল। তার চোখ লাল হয়ে আছে। চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। চোখ উঠলে যেমন হয় ঠিক সে রকম অবস্থা।

ভাইয়া আমার আপন ভাই না, সৎ ভাই। আমার বাবা ইউনিভার্সিটিতে যখন পড়তেন তখন যে মেয়েটিকে প্রাইভেট পড়াতেন তাকে বিয়ে করে ফেলেন। তাদের একটা ছেলে হয় তার নাম রাখা হয় হাসানুল করিম। বাবা পড়াশোনা শেষ করে কী একটা স্কলারশিপ জোগাড় করে স্ত্রী-পুত্ৰ কেলে ইংল্যান্ড চলে যান।

সেখান থেকেই দু বছরের মাথায় তিনি তাঁর প্রথম স্ত্রীকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দেন। বাবা দেশে ফিরে বিশ্ববিদ্যালয়ে লেকচারের চাকরি পেয়ে যান। আবার বিয়ে করেন। তাদের একটি মেয়ে হয়। মেয়ের নাম রাখা হয় মৃন্ময়ী। আমি সেই মৃন্ময়ী।

আমার যখন পাঁচ বছর বয়স তখন বার তের বছরের একটা ছেলে সুটকেস, ব্যাগ এবং বইপত্র নিয়ে আমাদের বাসায় থাকতে আসে। বাবা গম্ভীর মুখে সেই ছেলের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন এর নাম হাসানুল করিম। ক্লাশ ফাইভে পড়ে। এ আমার ছেলে। আমার প্রথম পক্ষের সন্তান। এখন থেকে এই বাড়িতে থাকবে।

আমার মা চোখ কপালে তুলে হেঁচকির মতো শব্দ করে বললেন, এ-কী! প্রথম পক্ষের সন্তান মানে কী? তুমি কি আরো বিয়ে করেছ না-কি? আমি দ্বিতীয় পক্ষ না তৃতীয় পক্ষ?

বাবা ঠাণ্ড গলায় বললেন, তুমি দ্বিতীয় পক্ষ।

কী সৰ্বনাশ! তুমি কি সত্যি আরেকটা বিয়ে করেছিলে?

বাবা বললেন, হ্যাঁ করেছিলাম। সেটা একটা দুৰ্ঘটনা ছাড়া কিছুই না। দুর্ঘটনা নিয়ে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তোলার কিছু নেই। তোমার যদি কিছু বলার থাকে ঠাণ্ডা গলায়, লজিক্যালি বলো। আমার একটাই ভুল হয়েছে, ব্যাপারটা তোমাদের জানানো হয় নি। I am sorry for that. এখন জানলে, ফুরিয়ে গেল।

মা বললেন, ফুরিয়ে গেল?

বাবা বললেন, হ্যাঁ ফুরিয়ে গেল। তুমি যদি মনে করে এত বড় অন্যায় যে করেছে তার সঙ্গে বাস করবে না–আমি তাতেও রাজি আছি। My door is open.

মা পুরো ঘটনায় এতই অবাক হলেন যে, চিৎকার চেঁচামেচি হৈচৈ করতে পারলেন না। হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলেন। আসলে তিনি বোকা টাইপ বলে বুঝতে পারছিলেন না কী করা প্রয়োজন। আমার ধারণা এই ঘটনায় তিনি রাগ বা দুঃখ যতটা পাচ্ছিলেন, মজাও ঠিক ততটাই পাচ্ছিলেন। মা মজা পেতে পছন্দ করেন। বাংলা সিনেমা তিনি খুবই আগ্রহ করে দেখেন। এই প্রথম নিজের জীবনে বাংলা সিনেমা চলে এল। একঘেয়ে জীবনের মধ্যে বড় ধরনের বৈচিত্র্য। খারাপ কী?

বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, মৃন্ময়ী, একে এক তলার বারান্দাওয়ালা ঘরটায় থাকতে দে। যা, ওকে সঙ্গে করে নিয়ে যা। ও সাথে কী কী এনেছে একটু দেখ। টুথপেস্ট, ব্রাশ না থাকলে জামানকে বল কিনে এনে দিতে। টগর এর ডাক নাম। তুই ভাইয়া ডাকবি। তোর চে বয়সে বড়।

মার মতো আমিও খুবই অবাক হয়েছিলাম। তবে অবাক হবার সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটার জন্যে মায়া লাগছিল। কারণ ছেলেটা আসার পর থেকে নিঃশব্দে কাঁদছিল। ফুটফুটে একটা ছেলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কারো দিকে তাকাচ্ছে না। তার শরীর সামান্য কাঁপছে। বাবা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে কড়া। গলায় বললেন, তুমি কাঁদছ কেন? কাঁদবে না। ছেলেটা কান্না বন্ধ করল না। সে এমনভাবে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়েছিল যে, চোখের জল নাক বেয়ে শিশিরের ফোটার মতো টপটপ করে পড়ছিল। তারপর কতদিন কেটে গেছে, ভাইয়া এখন কত বড় হয়েছে, এখননা তার দিকে তাকালে শৈশবের দৃশ্যটা মনে পড়ে। আমি স্পষ্ট দেখি তার নাক বেয়ে টপটপ করে চোখের পানি পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে মনটা খারাপ হয়ে যায়। চোখের সামনে এই দৃশ্যটা ভাসে বলেই ভাইয়া যে বড় হয়েছে এটা আমার মনে থাকে না। মনে হয় তার বয়স যেন কৈশোরেই থেমে আছে। স্টিল ছবির মতো। ছবির মানুষের বয়স বাড়ে না।

 

রাত বারোটার মতো বাজে।

আমি আমার ঘরের বারান্দায় বসে আছি। পুরো বাড়িতে শুধু এই জায়গাটা আমার নিজের। এখানে কারোর ঢোকার অনুমতি নেই। আমার শোবার ঘরে যে। কেউ আসতে পারে। কিন্তু বারান্দায় না। রেলিং-এর পাশে দুটা ফুলের টবে অপরাজিতা গাছের চারা লাগিয়েছিলাম। শুরুতে চারা দুটির অবস্থা জন্ডিসের রোগীর মতো ছিল, এখন অবস্থা ভিন্ন। বারান্দার রেলিং গাছে ছেয়ে গেছে। অপরাজিতা ফুল যে এত সুন্দর তাও আমার জানা ছিল না। বারান্দায় যখন বসি তখন মনে হয় নির্জন কোনো পার্কের অপরাজিতার বনে বসে আছি। আমাকে ঘিরে ফুলের উৎসব হচ্ছে। ঘুমুতে যাবার আগে আমি কিছুক্ষণ এই বারান্দায় বসি।

অপরাজিতা ফুলের কোনো গন্ধ নেই। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো বারান্দায় যখন বসি তখন অপরাজিতা ফুলের গন্ধ পাই। গন্ধটা অদ্ভুত বেলী ফুলের সঙ্গে লেবু পাতা কচলালে হয়তো এ রকম গন্ধ হয়। ঘুমুতে যাবার আগে এই বিশেষ গন্ধটা আমার নাকে না এলে ঘুম হয় না।

টানা বারান্দায় কে যেন অস্থির ভঙ্গিতে হাঁটছে! অস্থির ভঙ্গিতে হাঁটার মতো মানুষ আমাদের বাড়িতে কেউ নেই। আমরা সবাই খুবই সুস্থির। দ্ৰ বিনয়ী এবং নিচু গলায় কথা বলা টাইপ ফ্যামিলি। বাবা যখন মার সঙ্গে ঝগড়া করেন তখনও তাঁর গলা ভদ্রতার সীমা মেনে চলে। পাশের বাড়ির কেউ তাঁর রাগারাগি শুনে ফেলবে কিংবা রান্নাঘরের কাজের বুয়া শুনে ফেলবে এমন কখনো হবে না। বাবা যখন বাড়াবাড়ি ধরনের রাগ করেন তখন নিজে কথা বলা বন্ধ করে দেন। তার রাগের কঠিন কথাগুলো আমাকে মায়ের কাছে নিয়ে যেতে হয়। আমার ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষার দিনে বাবা-মার মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই হলো। এক পর্যায়ে বাবা খুবই রেগে গেলেন এবং আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে বললেন, তোর মাকে বলতে এ বাড়ি ছেড়ে কিছুদিন তার মায়ের বা বোনের বাড়িতে যেন থেকে আসে। তাকে অসহ্য লাগছে। মুখের দিকে তাকালেই গায়ে আগুন ধরে যাচ্ছে। প্রেসার বেড়ে যাচ্ছে। ঘাড় ব্যথা করছে। শেষে স্ট্রোক ফোক হয়ে বেকায়দা অবস্থা হবে।

আমি মার কাছে গিয়ে বললাম, মা, বাবা বোধহয় তোমার সঙ্গে রাগরাগি করছিল। এখন যে-কোনো কারণেই হোক রাগটা ঝপ করে পড়ে গেছে। বাবা এখন চাচ্ছে পহেলা বৈশাখে তোমাকে যে শাড়িটা কিনে দিয়েছিল তুমি যেন সেই। শাড়িটা পরে বাবার সামনে যাও।

মা থমথমে গলায় বললেন, শাড়ি পরে তার সামনে যেতে বলল? একটু আগে একগাদা কুৎসিত কথা বলেছে, আর এখন বলছে শাড়ি পরে তার সঙ্গে ঢং করতে? আমি কি কাছুয়া না-কি?

কাছুয়া আবার কোন বস্তু?

কোন বস্তু সেটা তোকে বলতে পারব না। আসল কথা তোর বাপের সঙ্গে অনেক ঢং করেছি। আর ঢং করব না।

ঢং করতে হবে না। তুমি সেজে গুজে সামনে যাও। শুধু একটা রিকোয়েস্ট মা–কালচে টাইপ লিপস্টিক ঠোঁটে দেবে না। তোমাকে মানায় না।

ঐ শাড়ি পরব কী করে? ব্লাউজ বানানো হয় নি।

কাছাকাছি কোনো ব্লাউজ নেই?

খুঁজলে হয়তো পাওয়া যাবে।

তুমি খুঁজতে থাক মা। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আজ প্রথম পরীক্ষা, আধা ঘণ্টা আগে যেতে হবে। সীট কোথায় পড়েছে খুঁজে বের করতে হবে।

ঐ শাড়িটাই বা হঠাৎ করে পরতে বলছে কেন?

ঐ শাড়ি নিয়ে তোমাদের মধ্যে নিশ্চয়ই রোমান্টিক কিছু ব্যাপার ট্যাপার আছে। তোমাদের ঝগড়ার ব্যাপারগুলি আমি জানি। রোমান্টিক ব্যাপারগুলিতে জানি না।

আমি মার সামনে থেকে চলে গেলাম। মা গেলেন শাড়ির সঙ্গে ম্যাচিং ব্লাউজ খুঁজতে। তিনি ঠিকই শাড়ি পরে সেজে গুজে বাবার সামনে যাবেন এবং শুকনো গলায় বলবেন, পরলাম তোমার শাড়ি। এখন কী করতে হবে? নাচব?

আমার অতি বুদ্ধিমান বাবা তৎক্ষণাৎ ধরে ফেলবেন ঘটনা কী। তিনি নিজেকে সামলে নেবেন এবং হাসি মুখে বলবেন, বাহু, তোমাকে খুব মানিয়েছে তো। একটু নাচ, খারাপ কী?

আমার মা যে খুবই বোকা টাইপ একজন মহিলা তা বোঝা প্রায় অসম্ভব। যে-কোনো বিষয় নিয়ে তিনি বেশ গুছিয়ে কথা বলেন। তাঁর কথা শুনলে মনে হয় ঐ বিষয়ে তার গভীর জ্ঞান আছে। আসলে তা না, মা জগতের বেশির ভাগ বিষয় সম্পর্কে কিছু জানেন না। জানার আগ্রহও নেই। তবে এই ঘটনা বাইরের কারোর বোঝর সাধ্যও নেই। উদাহরণ দিয়ে বলি, একবার আমাদের ড্রয়িংরুমে বাবার কিছু বন্ধু (বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এদের সঙ্গে বাবার সামান্য যোগাযোগ আছে। দু তিন মাস পরপর দাওয়াত করে খাওয়ান। মিলে আড়া জমিয়েছে। মা-ও আছেন তাদের সঙ্গে। তুমুল আলোচনা চলছে। আলোচনার বিষয় ব্ল্যাক হোল। মাকে দেখে মনে হচ্ছে তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে আলোচনা শুনছেন। এবং ব্ল্যাকহোলের রহস্যময়তায় তিনি চমৎকৃত। স্টিফান হকিং লোকটির মেধায় অভিভূত।

আলোচনার এক পর্যায়ে তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, ব্ল্যাক হোলের মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ভয়াবহ। সে সবকিছুই টেনে নিজের ভেতর নিয়ে নেয়। আচ্ছা, এখন যদি সমান ক্ষমতার দুটা ব্ল্যাক হোল সামনাসামনি চলে আসে তখন কী হবে? দুজনই তো চেষ্টা করবে অন্যজনকে নিজের ভেতর নিয়ে আসতে।

আজ্ঞা কিছুক্ষণের জন্য নীরব হয়ে গেল। তারপর সবাই কথা বলতে শুরু করল মার দেয়া সমস্যা নিয়ে। সবাই মহাউৎসাহী। শুধু বাবা বিরক্ত মুখে মার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কারণ তিনি জানেন মা ভেবেচিন্তে কিছু বলেন নি। মনে একটা কথা এসেছে, বলে ফেলেছেন— এখন আবার যাবেন চা-নাস্তার ব্যবস্থা করতে। দুটা সমান শক্তির ব্ল্যাক হোল মুখোমুখি থাকলে মার কিছুই যায় আসে না। ওরা ওদের মতো দড়ি টানাটানি করুক। দুইজন একটা সময় দুইজনকে গিলে ফেলুক। চায়ের সঙ্গে নাস্তা ঠিকমতে দিতে পারলেই তিনি খুশি।

অস্থির ভঙ্গিতে টানা বারান্দায় বাবা হাঁটাহাঁটি করছেন। আমাকে দেখে এমনভাবে তাকালেন যেন চিনতে পারছেন না। এর একটাই অর্থ কোনো একটা বিষয় নিয়ে বাবা খুব চিন্তিত। আমি বললাম, বাবা ঘুম আসছে না?

বাবা বললেন, এখনো বিছানায় যাই নি। কাজেই ঘুম আসছে কি আসছে না বুঝতে পারছি না।

এনি প্রবলেম?

বাবা গম্ভীর গলায় বললেন, টগরের ঘরে একটা ছেলে এসেছে। ছেলেটাকে আমি চিনি। পুলিশ তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। ছেলেটা মনে হয় রাতে থাকতে এসেছে। আমি নিশ্চিত। আগেও কয়েক রাত এ বাড়িতে কাটিয়েছে।

আমি বললাম, এটা এমন কোননা সমস্যা না। আমি ভাইয়াকে গিয়ে বলছি ছেলেটাকে বিদায় করে দিতে।

ছেলেটির সামনে কিছু বলবি না। এদের ঘটানো ঠিক না। তুই বরং টগরকে ডেকে নিয়ে আয়। যা বলার আমি বলব।

 

ভাইয়ার ঘরের দরজা খোলা। ঘরে বাতি জ্বলছে। ভাইয়া চেয়ারে বসে কী যেন লিখছে। এত রাতে আমাকে ঢুকতে দেখে সে কিছু মাত্র অবাক হলো না। যেন। সে আমার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। লেখা থেকে চোখ না সরিয়ে বলল, কী ব্যাপার।

আমি বললাম, কোনো ব্যাপার না। তোমার কাছে কেউ কি এসেছিল? ভাইয়া অবাক হয়ে বলল, না তো!

বাবার ধারণা কেউ তোমার কাছে এসেছিল। বাবা এটা নিয়ে খুব চিন্তিত। ভাইয়া তুমি খুব খেয়াল রাখবে কেউ যেন তোমার কাছে না আসে। আর যদি এসেও পড়ে, চেষ্টা করবে তৎক্ষণাৎ বিদায় করতে।

তাই তো করি।

বাবার ধারণা তুমি উল্টোটা করে। মাঝে মাঝে তোমার দু একজন বন্ধু তোমার ঘরে রাত কাটায়।

আর কিছু বলবি?

বলব। কথাগুলো শুধু যে বাবার তা না। আমারও কথা। ভাইয়া, সাবধান। থাক। সময়টা খুব খারাপ।

আচ্ছা ঠিক আছে।

তুমি কী লিখছ?

ভাইয়া চট করে খাতা বন্ধ করে বলল, কিছু লিখছি না। তোর কথা শেষ হয়ে থাকলে চলে যা।

কাউকে চিঠি লিখছ না-কি?

ভাইয়া মাথা নিচু করে হাসল। তার হাসি মুখ দেখে আমার আবারো মনে হলো ঢাকা শহরের প্রথম তিনজন রূপবান যুবকের মধ্যে ভাইয়া একজন। শৈশবে যাদের খুব সুন্দর দেখায় যৌবনে তারা কেমন যেন ভোতা টাইপ হয়ে যায়। ভাইয়ার বেলায় ঘটনা অন্যরকম। যত দিন যাচ্ছে, সে ততই সুন্দর হচ্ছে। আমার বুকে ধাক্কার মতো লাগল। প্ৰকৃতি রূপবান পুরুষ পছন্দ করে না। তাদের মধ্যে বড় ধরনের কিছু সমস্যা দিয়ে দেয়। ভাইয়ার ভেতর কোননা সমস্যা দিয়ে দেয় নি তো?

 

বাবা উদ্বিগ্ন গলায় বললেন, টগরকে বলেছিস?

কিছু বলতে হয় নি বাবা। ভাইয়ার ঘর ফাঁকা। মশামাছি পর্যন্ত নেই। দেয়ালে একটা কালো রঙের টিকটিকি ছাড়া কিছু নেই।

ভালো করে দেখেছিস? খাটের নিচে বসে নেই তো?

খাটের নিচে বসে থাকবে কেন?

এরা ডেনজারাস ছেলে। খাটের নিচে বসে থাকবে। বাথরুমের দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে। দরজার আড়ালে থাকবে। যা, আবার যা।

কোনো দরকার নেই বাবা।

দরকার আছে কিনা সেটা আমি বুঝব। তোকে দেখতে বলছি তুই দেখ।

আমি আবারো সিঁড়ির দিকে এগুলাম। ভাইয়ার ঘরে দ্বিতীয়বার যাবার কোনো অর্থ হয় না। একতলার বারান্দায় কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে চলে আসব। বাবা নিশ্চয়ই দোতলার বারান্দা থেকে টেলিস্কোপ ফিট করে বসে থাকবেন না দেখার জন্যে যে আমি দায়িত্ব পালন করছি কি-না।

ভাইয়ার ঘরের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। বাতি নেভানো। আমি নিঃশব্দে দরজার কাছে এগিয়ে গেলাম। কান পাতলাম। ভাইয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। সে যে একা একা কথা বলছে তাও না। যে জবাব দিচ্ছে তার গলার স্বর ভারি। রেডিও-টিভির এ্যানাউনসারদের মতো গলা। কথাবার্তা হচ্ছে খুবই হাস্যকর বিষয় নিয়ে। মোটা গলার মানুষটা বলছে শিউলি ফুলের পাতা দিয়ে এক ধরনের ভাজি হয়। টগর তুই খেয়েছিস কখনো?

ভাইয়া বলল, না।

কচি পাতাগুলি কড়া করে তেলে ভাজা হয়, সঙ্গে থাকে প্রচুর পেয়াজ-রসুন আর শুকনা মরিচ। খেতে অসাধারণ হয়। গ্রামে যখন যাই এটাই হয় আমার প্রধান খাদ্য। দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য কি জানিস?

না।

দ্বিতীয় প্রধান খাদ্য হলো নাইল্যা পাতা ভাজি।

নাইল্যা পাতাটা কী?

পাট শককে বলে নাইল্যা পাতা। পাট শাক রান্নার দুটো পদ্ধতি আছে। একটা ঝোল ঝোল, আরেকটা শুকনা শুকনা। আগুন গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের ওপর শুকনা নাইল্যা পাতা ছড়িয়ে দিয়ে যদি ভাত খাস তাহলে তোর মুখে এই জিনিস ছাড়া কিছুই রুবে না। দেখি একটা সিগারেট দে।

সিগারেট তো নাই।

সর্বনাশ! সিগারেট ছাড়া এত বড় রাত কাটাবো কী করে?

দোকান থেকে নিয়ে আসব?

আরে না। তোর বাসার সামনে পুলিশের দুজন ইনফরমার বসে আছে। তোর বাবা তো সিগারেট খায় তার প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ম্যানেজ করতে পারবি না?

না।

একটা কাগজ দলা পাকিয়ে সিগারেটের মতো বানিয়ে দে। এটাই টানি। কিছু ধোঁয়া যাক। এতে দুটা কাজ হবে সিগারেটের তৃষ্ণা মিটবে। ক্ষুধাটা কমবে।

আমি নিঃশব্দে দোতলায় উঠে এলাম। বাবা বেতের চেয়ারে ঝিম ধরে বসে। আছেন। তার গা থেকে হালকা গন্ধ আসছে। অর্থাৎ তিনি আড়াই পেগ থেকে তিন পেগ হুইস্কি খেয়ে ফেলেছেন। বাংলাদেশে মদ্যপান আইন করে নিষিদ্ধ। তবে বিত্তবানদের জনো আইনের ফাঁক আছে। বিত্তবানদের জন্যে বাংলাদেশ সরকারের আবগারী ডিপার্টমেন্ট মদ খাওয়ার লাইসেন্স ইস্যু করে। সেখানে লেখা থাকে স্বাস্থ্যগত কারণে তাকে এই পরিমাণ মদ্যপানের অনুমতি দেয়া হলো। বাবার এই লাইসেন্স আছে। বাবা বললেন, কী দেখলি?

দেখলাম কেউ নেই।

খাটের নিচ, বাথরুম সব দেখেছিস।

হ্যাঁ।

আমি কিন্তু স্পষ্ট দেখেছি একটা ছেলে বিড়ালের মতো এদিক ওদিক তাকিয়ে ঝাঁ করে ওর ঘরে ঢুকল। স্ট্রাইপ শার্ট গায়ে।

তুমি তো মানসিকভাবে উত্তেজিত এই জন্যে এসব দেখেছ।

মানসিকভাবে উত্তেজিত হব কী জন্যে?

আজহার চাচা তোমাকে কাফনের কাপড় দিয়েছে এরপর থেকেই তুমি মানসিকভাবে অস্থির হয়ে পড়েছ। তোমার চিন্তা কাজ করছে না।

চিন্তা ঠিকই কাজ করছে, আমি শুধু ভাবছি একটা লোক কী করে কাফনের কাপড় উপহার হিসেবে নিয়ে আসে।

উনার কাছে মনে হয়েছে ভালো উপহার। বাবা যাও তুমি শুয়ে পড়। রাত জাগলে তোমার শরীর খারাপ করে।

তুই শুবি না?

আমার সামান্য দেরি হবে।

দেরি হবে কেন?

রাতে ভাত খাই নি। এখন দেখি প্ৰচণ্ড ক্ষিধে লেগেছে। ফ্রীজের ঠাণ্ডা ভাত খাব না। নতুন করে ভাত রাঁধব। তুমি বিড়বিড় করছ কেন?

কাফনের কাপড়টা দিয়ে গাধাটা আমার মেজাজটা খারাপ করে দিয়েছে। আর তোর মার তো বুদ্ধির কোনো সীমা নেই! সে কাপড়টা রেখে দিয়েছে। ড্রেসিং টেবিলের উপরে, যেন ঘরে ঢুকলেই চোখে পড়ে।

এক কাজ করো কাপড়টা তুমি আমার কাছে দিয়ে দাও। আমি ওয়ার্ডডোবে রেখে দেব।

আরে না। তুই বাচ্চা মানুষ। তুই কেন তোর ঘরে কাফনের কাপড় রাখবি।

বাবা তুমি ব্যাপারটা মাথা থেকে দূর করে ঘুমুতে যাও। রাতে না ঘুমালে তোমার খুবই শরীর খারাপ করে। তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তোমার প্রেসার বেড়েছে। প্রেসার মেপে দেব?

দরকার নেই। গাধাটা কী করেছে শোন, কাফনের কাপড়ে আর মাখিয়ে রেখেছে। নাক থেকে আতরের গন্ধটা যাচ্ছে না। সাবান পানি দিয়ে নাক ধুয়েছি, তারপরেও যাচ্ছে না। তুই গন্ধ পাচ্ছি না?

না, পাচ্ছি না।

মানুষের সামান্য সেন্সও থাকবে না।

আমার হঠাৎ ইচ্ছা করল বাবাকে একটা বিপদে ফেলতে। কাজটা ঠিক না, অন্যায়। তারপরেও মনে হলো— আচ্ছা দেখি তো কী হয়। আমি বললাম, বাবা সরু নদীর ইদ্দিস ভাষা কী?

বাবা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। আমি বললাম, আজহার চাচাকে তুমি সরু নদীর ইদ্দিস ভাষাটা বলছিলে।

কী বলেছিলাম?

বলেছিলে মেরাং গা। ছেরাং হচ্ছে সরু, গা হলো নদী।

ঠাট্টা করছিলাম। ইদ্দিস ভাষা আমি জানি না।

তুমি ঠাট্টা করে বলছিলে না। খুবই সিরিয়াসভাবে বলছিলে। আজহার চাচা সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপারটা বিশ্বাস করেছে।

আমি যে এই ছোট্ট মিথ্যাটা বলেছি তার পেছনে ভালো যুক্তি আছে। যুক্তিটা শুনবি?

এর পেছনে তোমার কোনো যুক্তি নেই বাবা। যুক্তিটা তুমি এখন ভেবে ভেবে বের করবে। আমি নিশ্চিত তুমি বেশ ভালো যুক্তিই বের করবে। যাই হোক তুমি ভেবে চিন্তে ভালো একটা যুক্তি বের করো। আমি ভোর বেলা শুনব। এখন দয়া করে ঘুমুতে যাও।

বাবা আমার ওপর বিরক্ত হয়েছেন কি-না ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে তিনি ভুরু কুঁচকে বললেন, আমি লক্ষ করেছি আজহার এলেই তুই খাতির যত্নের একটু বাড়াবাড়ি করি। এটা করবি না।

কেন আমি বললাম। বাবা, তুমি কি আজহার চাচাকে ভয় পাও?

বাবা থমথমে গলায় বললেন, ভয় পাবার প্রশ্ন আসছে কেন?

আমার মনে হচ্ছে তুমি ভয় পাও। আজহার চাচা না হয়ে যদি অন্য কেউ তোমাকে কাফনের কাপড় দিত তুমি তাকে কঠিন কিছু কথা শুনিয়ে দিতে।

আমি ভদ্রতা করেছি। তাটাকে তুই ভেবে বসলি ভয়।

তোমার মধ্যে দ্ৰতার বাইরেও কিছু ছিল।

বাবা বিরক্ত গলায় বললেন, স্মার্ট হওয়া ভালো। কিন্তু নিজেকে অতিরিক্ত স্মার্ট ভাবাটা ভালো না।

আমি স্মার্ট না বাবা। আমি যা করি তা হলো দুই-এর সঙ্গে দুই যোগ করে চার হয়েছে কি-না দেখি। সবার বেলায় তাই হয়। তোমার বেলায় দুই-এর সঙ্গে দুই যোগ করলে চারের কিছু কম হয়। সেই কমটা কোথায় যায় সেটা বুঝতে পারি না।

তুই কী বলতে চাচ্ছিস পরিষ্কার করে বল তো।

আমি শন্তি গলায় বললাম, ভাইয়ার কাছে যে ছেলেটা এসেছে বলে তুমি ভাবছ এই ছেলেটা কে?

আমি কী করে জানব সে কে?

আমার ধারণা তুমি তাকে চেন। তোমার সঙ্গে এই ছেলের কোনো না কোনোভাবে যোগাযোগ হয়েছে। নয়তো তুমি ভয়ে এত অস্থির হতে না।

বাবা কঠিন চোখে তাকিয়ে থাকলেন।

আমি রওনা হলাম রান্নাঘরের দিকে। তস্তুরী বেগমকে ডেকে তুলে গরম ভাত রান্না করতে হবে। তস্তুরী বেগমের শাড়ির আঁচলে আলাউদ্দিনের চেরাগের একটা মিনি সাইজ দৈত্য বাস করে বলে আমার ধারণা। এই দৈত্য রান্নাবান্না ছাড়া অন্য কাজ পারে না। যে-কোনো রান্না এই দৈত্য অতি নিমিষে শেষ করে ফেলতে পারে। আমি আমার নিজের জন্যে রান্না করাচ্ছি না। ভাইয়ার ঘরে যে। ছেলেটি বসে আছে সে ক্ষিধেয় কাতর আছে। গরম ভাত তার জন্যে। অপ্রত্যাশিতভাবে গরম ভাত পেয়ে সে অভিভূত হবে। এই মজার ঘটনাটা সে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনে রাখবে এবং অনেক লোকের সঙ্গে গল্প করবে। এই ছেলে যদি বিয়ে করে তাহলে বাসর রাতে স্ত্রীর সঙ্গে এই গল্পটিও করবে। তার মেয়ে যখন বড় হবে কোনো এক রাতে পিতা-কন্যা ভাত খেতে বসে গল্প করার সময় এই গল্প উঠে আসবে। মেয়ের মা বিরক্ত গলায় বলবে— আচ্ছা এই এক গল্প তুমি কবার করবে? বন্ধ করে তো।

মেয়ে বলবে, বন্ধ করতে হবে না, আমার শুনতে খুবই ইন্টারেস্টিং লাগছে। আচ্ছা বাবা যে মেয়ে তোমার জন্যে খাবার নিয়ে এসেছিল তার নাম কী?

নাম তো মা জানি না। নাম জিজ্ঞেস করা হয় নি।

মেয়েটা দেখতে কেমন?

সেটাও বলতে পারছি না। অন্ধকার ছিল তো। ভালোমতো দেখতে পাই নি।

এই পর্যায়ে মেয়ের মা মহা বিরক্ত হয়ে বলবে ঐ মেয়ে মা রূপবতী ছিল। রূপবতী না হলে এই এক গল্প তোর বাবা পাঁচ লক্ষবার করে।

 

ভাইয়ার ঘরে বসে যে নিচু গলায় গল্প করছিল সে রাতে অবশ্যই ভাইয়ার ঘরে ঘুমুবে না। সে ঘুমুবে ছাদে। ছাদে চিলেকোঠার মতো আছে। চিলেকোঠাটা স্টোর রুম হিসেবে ব্যবহার করা হয়। তারই এক কোণায় চাদর পেতে শোবার ব্যবস্থা আছে। বিপদজনক পরিস্থিতিতে এক ছাদ থেকে লাফিয়ে অন্য ছাদে যাওয়া যায়। এবং অতি দ্রুত পালিয়ে যাওয়া যায়। ভাইয়ার বন্ধুদের অনেকেই এই কাজটা অতীতে করেছে।

ট্রে হাতে আমি চিলেকোঠার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, খেতে আসুন। ছাদ এবং চিলেকোঠা অন্ধকার হলেও সিড়ি ঘরে বাতি জ্বলছে। তার আলোয় কাজ চলার মতো দেখা যাচ্ছে। চিলেকোঠায় বাতি আছে। তার সুইচ বাইরে। ইচ্ছা করলেই আমি বাতি জ্বালাতে পারি। তা না করে আবারো বললাম ভাত নিয়ে এসেছি খেতে আসুন। তিন চার সেকেন্ড কোনো রকম শব্দ হলো না। তারপর হামাগুড়ি দিয়ে ভাইয়ার বয়েসী এক যুবক বের হয়ে এল। তার চোখ ভর্তি বিস্ময়। আমি বললাম, আপনি কি অন্ধকারে খেতে পারবেন, না বাতি জ্বালাতে হবে?

সে কিছুই বলল না। আমি বললাম, ঘরে খাবার কিছু ছিল না। গরম ভাতের ওপর ঘি দিয়ে দিয়েছি। শুকনা মরিচ ভেজে দিয়েছি। বেগুন ভাজা আছে। আর আপনার একটা পছন্দের খাবারও আছে। পাট শাক ভাজি। আমাদের বুয়ার দেশ ময়মনসিংহের ফুলপুর। সে দেশ থেকে টিন ভর্তি করে পাট শাক শুকিয়ে নিয়ে আসে।

টগরের সঙ্গে আমি যখন কথা বলছিলাম তখন আপনি বাইরে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন?

জি শুনছিলাম। বাবার সিগারেটের প্যাকেট থেকে দুটা সিগারেটও আপনার জন্যে নিয়ে এসেছি।

থ্যাংক য়ু।

আমি যদি আপনাকে একটা অনুরোধ করি আপনি রাখবেন?

অবশ্যই রাখব।

ভাইয়ার কাছে কখনো আসবেন না। ভাইয়া বোকা মানুষ। সে কোনো কিছুতে না থেকেও মহা বিপদে পড়ে যাবে।

তোমাকে কথা দিচ্ছি আমি আর এ বাড়িতে আসব না।

আপনি খাওয়া শুরু করুন। আপনার খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি থাকব। কেউ খুব আগ্রহ করে ভাত খাচ্ছে এই দৃশ্য দেখতে আমার খুব ভালো লাগে। হাত ধোয়ার পানি এনেছি। নিন হাত ধোন।

ভাইয়ার এই বন্ধুর নাম আমি জানি না। আগে দেখেছি কি-না মনে করতে পারছি না। সে হাত ধুয়ে খেতে বসেছে। ভাতের দলা মাখিয়ে মুখে দিতে গিয়ে নামিয়ে রেখে তাকাল আমার দিকে।

আমি বললাম, আরাম করে খান তো।

সে খুবই তৃপ্তির সঙ্গে খাচ্ছে। একজন ক্ষুধার্ত মানুষ খুব তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে এই দৃশ্য জগতের মধুর দৃশ্যের একটি কার যেন কথা? বাবাকে জিজ্ঞেস করে জানতে হবে। কথাটা বাবার কাছ থেকে শুনেছিলাম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *