মুখের দিকে দেখি সম্পর্কে লেখকের ব্যাখ্যা না দেয়াই শ্রেয়; তথাপি দুই/একটা বিষয় পরিষ্কার করা প্রয়োজন। প্রথমত এই উপন্যাসে ব্যবহৃত বাংলাদেশে খ্রিষ্ট ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু ব্যক্তি ও স্থানের নাম, এবং কিছু তথ্য বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাপিডিয়া, কলকাতার প্রভু যীশু গীর্জা কর্তৃক প্রকাশিত এবং লুইস প্রভাত সরকার কর্তৃক রচিত বঙ্গদেশে খ্রীষ্টধর্ম ও খ্রষ্টীয় সম্প্রদায় (প্রথম খণ্ড) এবং ঢাকা থেকে প্রতিবেশী প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত ভক্তি-পুষ্প নামক গ্রন্থসমূহ থেকে নেয়া; তবে, ব্যক্তির নাম ব্যবহারের ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক সময়ক্রম অনুসৃত হয় নাই। রচনায় ব্যবহৃত খ্রিষ্টীয় ধর্মীয় সঙ্গিতের অংশ বিশেষও নেয়া হয়েছে লুইস প্রভাত সরকারের উল্লিখিত বই থেকে। দ্বিতীয়ত, বইয়ে ব্যবহৃত বর্তমান কালের অন্য কিছু নাম কোন বাস্তব। মানুষের নামের সঙ্গে মিলে যেতে পারে, কিন্তু এতে বর্ণিত সকল ঘটনা এবং আনুষঙ্গিক বর্ণনা, বলাইবাহুল্য যে, কাল্পনিক।
শ. জহির
ঢাকা
ফেব্রুয়ারি ২০০৬
————–
০১.
ভূতের গল্লির চানমিঞা হয়তো বান্দরের দুধ খাওয়া পোলা, কারণ যারা এই ঘটনার সাক্ষী, যেমন মামুন মাহমুদের মা মিসেস জোবেদা রহমান, তাদের ২৫নম্বর বাড়িতে বেড়াতে গেলে এবং কথার প্রসঙ্গ চানমিঞার দিকে মোড় নিলে সে এই কথাটা জানাতে ভুলবেই না যে, ওতো বন্দিরের দুধ খাইছিল, এবং এ বিষয়ে সন্দেহ করলে সে অবশই তর্ক করবে এবং প্রয়োজনে ঝগড়া। যেমন ধরা যাক, ফখরুল আলম লেদু, সে মামুনের ছুটুকালের বন্ধু, একসঙ্গে ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে, সে হয়তো মামুনের খোঁজে তাদের বাসায় গেল, কিন্তু তখন হয়তো মামুন বাসায় নাই, এরকম হইতেই পারে, লেদু যেতে পারে এবং মামুন তখন বাসায় না থাকতেই পারে, এবং তখন মামুনের মা ঘর থেকে বের হলে ফখরুল আলম লেদুর সঙ্গে তার দেখা হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তারপর মামুনের মা যদি বলে, আইলি চা খায়া যা, এবং ফখরুল আলম লেদু যদি রাজি হয় তাহলে তখন ঘরের ভিতরে বসে লেদুর সঙ্গে মামুনের মার টুকটাক কথাবার্তা বলার অবস্থা তৈরি হবে; এই আলাপের ভিতর চানমিঞার প্রসঙ্গ চলে আসতে পারে, এবং তখন এই প্রসঙ্গে ফখরুল আলম লেদু বেঁকাতেরা কথা বললে, মামুন/মাহমুদের মা। তাকে অবশ্যই বলবে, তুই কিছুই জানস না!
কিন্তু মামুনুল হাই ওরফে মামুন বাসায় থাকে না কেন? ফলে ফখরুল আলম লেদু মামুনের মাকে জিগাস করে, মামুন কৈ গেছে, যায় কৈ? মামুনের মা হয়তো জানে সে কৈ গেছে, অথবা হয়তো সে জানে না, সে হয়তো বলে, জানি না কৈ যায়, অথবা হয়তো বলে, অয়তো গেছে কাঠের ভুসি আননের লাইগা–মিসেস জোবেদা রহমান কাঠের ভুসির চুলা জ্বালায়।
মামুন হয়তো একদিন তাদের স্কুল বন্ধ থাকায় একটা গমের খালি ছালা নিয়া-যে ছালাটা তার মা অন্য একটা ছালা সেলাই করে জোড়া দিয়া লম্বা করেছে–বাসা থেকে বের হয়া নয়াবাজারের কাঠের গোলার দিকে যায়। হয়তো সে জোড়পুল, লালচান মকিম লেন, মালিটোলার ভিতর দিয়া নয়াবাজারে দি নিউ চন্দ্রঘোনা স মিল এন্ড টিম্বার ডিপোট-এ যায় হাজির হয়, তখন হয়তো বৃষ্টির দিন ছিল এবং সারাদিন চলার পর সন্ধ্যায় করাতকল বন্ধ হয়া গেছিল, সে সেখানে পৌঁছায়া কোন কর্মচারি বা করাতির সঙ্গে ভুসির দরদাম করে, অবশেষে তিন টাকা বস্তা দাম ঠিক হলে সে করাত কলের লোহার-গাছের গোড়ায় ভুসির গর্তের ভিতরে নামে। সারা দিন ধরে চেরাই করা কাঠের ভুসি গর্তে জমা হয়া ছিল, এই গর্তের ভিতরে নেমে ভুসির পাহাড় দেখে আলিবাবার মত হয়তো সে খুশি হয় এবং তখন হয়তো আত্মহারা হয়া অথবা হয়তো অন্য কোন কারণে বস্তায় ভুসি ভরতে যায়া সে নিজেই ভুসির স্তুপের নিচে চাপা পড়ে, কারখানার কর্মচারিরা বিষয়টা খেয়াল করে না, ফলে সে এইভাবে চাপা পড়ে থাকে। সেদিন রাইতের বেলায় স মিলের মালিক আব্দুল মাবুদ চৌধুরির ভাই আব্দুল ওদুদ চৌধুরির পাঁচটনি চাইরটা ট্রাক দি নিউ চন্দ্রঘোনা স মিল এন্ড টিম্বার ডিপোট-এর সামনে এসে থামে এবং আগে থেকে তৈরি হয়া থাকা একদল কুলি গর্তের ভুসি টুকরিতে করে এনে ট্রাকের ভিতরে রাখা সাদা রঙের কতগুলা বস্তার উপরে ঢেলে বস্তা ঢেকে দেয়। কুলিরা ট্রাকের ড্রাইভারদের জিগাস করে, আইজ কি যায়? কিন্তু ট্রাকের ড্রাইভাররা জবাব দেয় না, চোখ কুঁচকায়া তাকায়, লাটসাহেবের ভাব নিয়া স্টিয়ারিং হুইল ধরে বসে থাকে, কিন্তু তাতে কিছু ক্ষতি হয় না, কারণ এই কুলিরা খুবই বুদ্ধিমান, তারা বলে, সার যায়, বার্মায় যাইব। অথবা আসলে হয়তো এই কুলিরা বুদ্ধিমান ছিল না, যাইহোক, ফলে কুলিরা বুদ্ধিমান হলে বা না হলে যে সমস্যা হওয়ার কথা এ ক্ষেত্রে তাই হয়, সার ও ভুসির সঙ্গে মামুন মিঞা ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের পথে চলে যায়। ব্যাপারটা এইভাবে ঘটে। এই চালাক অথবা বোকা কুলিরা ভুসি তোলার সময় অবশ্যই তাকে পায়, সে হয়তো অজ্ঞান হয়া ভুসির স্তুপের মধ্যে পড়ে ছিল, তখন তারা তাকে আবিষ্কার করে, কিন্তু কারখানার ভিতরে অন্ধকার থাকায়, কারণ তারা আলো জ্বেলে কাজ করতে পারছিল না, তারা টুকরির ভিতরে অজ্ঞান মামুনকে গোল করে ভরে একটা ট্রাকের মধ্যে ছুড়ে ফেলে দেয়, তাদের একবার মনে হয়, এটা হয়তো কাঠের একটা টুকরা, এইরকম ভাবা কঠিন কিছু না, তারা কুলির পোলা কুলি, তারা তাই ভাবে যে, কাঠের ভুসির ভিতরে যা পাওয়া যায় তা কাঠই, হয়তো দামি, সেগুন কিংবা গামারি, শিল কড়ই কিংবা গর্জনও হতে পারে, অথবা হাবিজাবি, কদম কিংবা ছাতিম, তথাপি হয়তো কোন কাঠই। অথবা তারা হয়তো এইরকম ভাবে না, তারা হয়তো অতো বোকা ছিল না, হাত দিয়া ভুসি তুলতে যায় তারা যখন সেখানে মামুনুল হাইকে পায়, অন্ধকার হলেও তারা বুঝতে পারে যে, এইটা একটা মানুষ, কাঠ না, কারণ তারা দেখে যে, তার দুই হাত দুই পাও এবং একটা মাথা আছে, এই কুলিরা জানে যে, দুই হাতপাও এবং একটা মাখা থাকে মানুষের, ফলে তখন তারা ভয় পায়া যায়, তাদের মনে হয় যে, এটা হয়তো লাশ, এবং তখন তারা তাদের বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয়, তারা একটা কথাও না বলে মামুনকে টুকরিতে তুলে নিয়া যায়া ট্রাকের ভিতরে ফালায়, কারণ তাদের মনে হয় যে, এই বিষয় নিয়া এখন কথা বললে তারাই পুলিশের ঝামেলায় পড়বে, পুলিশ তাদেরকে এক হাজার একটা কথা জিগাস করবে, হয়তো লাত্থি গুঁতাও মারবে, তার চেয়ে মালিকের ভুসির ভিতরে পাওয়া মাল মালিকের ভাইয়ের ট্রাকের সঙ্গে চলে যাওয়া ভাল!
মামুন হয়তো ভুসির ভিতরে অজ্ঞান হয়া ছিল, গভীর রাইতে ট্রাক যখন চট্টগ্রামের দিকে রওনা হয় সে কিছু জানতে পারে না; সেদিন বৃষ্টি থাকায় ট্রাকগুলা ত্রিপল দিয়া ঢাকা দেওয়া ছিল, এগুলা নায়াবাজার থেকে বের হয় দোলাই খালের রাস্তা দিয়া যাত্রাবাড়ি চৌরাস্তা ঘুরে চিটাগংয়ের পথ ধরে। সেদিন কোনখানে যায় ট্রাকগুলা মাল খালাস করতো তা বলা মুশকিল, হয়তো চট্রগ্রামের ফিরিঙ্গি বাজার, সদর ঘাট কিংবা কালুর ঘাট ব্রিজের গোড়ায় যায়া ট্রলারে অথবা সাম্পানে মাল তুলে দিত, কিন্তু কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামের কাছে ট্রাক টহল পুলিশের কবলে পড়ে, পুলিশ তিনটা ট্রাক আটকায়, একটা ট্রাক থামে না, হৈচৈ এর মধ্যে ঝানু ড্রাইভার এক টানে কোন সাইড় রাস্তা দিয়া বের হয়া যায়। কিন্তু ট্রাকের ড্রাইভার হয়তো ভয় পেয়ে যায় ফলে সে ট্রাক নিয়া সরাসরি আব্দুল ওদুদ সওদাগরের গ্রামের বাড়ি সাতকানিয়ায় যায় হাজির হয়, অথবা হয়তো ফিরিঙ্গি বাজার কিংবা সদরঘাটে ট্রাক পৌঁছালে সওদাগরের কর্মচারিরা যখন পিছনে পুলিশ লাগার কথা শোনে তখন তারা মাল গ্রামের বাড়িতে নিয়া রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। এইভাবে মামুন মিঞা চোরাই ইউরিয়া সারের সঙ্গে সাতকানিয়ার বোয়ালিয়া পাড়ায় আব্দুল ওদুদ চৌধুরির বাড়িতে যায় হাজির হয় এবং তখন তার দেখা হয় আসমানতারা হুরে জান্নাতের সঙ্গে; ফলে ফখরুল আলম লেদুকে একদিন মামুনুল হাইয়ের মা চানমিক্সার গল্প বলে, চানমিঞার মা খৈমনরে যায়া জিগা, চানমিঞা কি খাইছিল, কারণ চানমিঞার ছুটুকালে হয়তো মহল্লায় বান্দর ছিল, মহল্লার বাড়িঘরের ছাদ এবং দেওয়ালের উপর দেখা যেত এই বান্দরদের, তাদের খয়েরি রঙের পিঠ, সাদাটে পেট এবং লাল পশ্চাদ্দেশ; তারা দেওয়ালের উপর দিয়া হেঁটে যেত অথবা কোন বাড়ির কার্নিশে লেঙ্গুর ঝুলায়া শুয়ে থাকতো। তখন হয়তো বান্দরদের এই দলে একটা দুইটা বা অনেকগুলা মাদি বান্দর ছিল, বাচ্চাঅলা বান্দরনিদের পায়ের ফাঁকে বুকের সঙ্গে বাচ্চা ঝুলে থাকতো। হয়তো এইরকম কোন একটা বান্দরনির দুধ চানমিঞা খেয়েছিল, যখন সে শিশু ছিল তখন একদিন তার মা, খৈমন ওরফে মোছা : খৈমন বেগম তাকে ঘরে একা রেখে বাইরে থেকে দরজায় শিকল তুলে দিয়া ৩৬নম্বর বাড়ি থেকে নুরানি বিলকিস ওরফে উপমা বেগমদের ৩৭ নম্বর বাড়িতে যায়, যায় বলে, আফা আমারে এক কাপ চিনি ধার দেন।
নুরানি বিলকিসের স্বামী ফজলুর রহমান রায়সা বাজারে রেশনের দোকান চালায়, তার ঘরে এন্তার চিনি এবং চাল এবং গম, সে থৈমন বেগমের দিকে তাকায়; তখন হয়তো ময়না মিঞা বেঁচে ছিল, অথবা ছিল না, কারণ ময়না মিঞা একাত্তর সনে নিখোঁজ হয়, সে ঠাটারি বাজারে ঝাঁকায় করে লাউ/ঝিঙ্গা/কচুরলতি বেচতো, সে ছিল ঠাটারি বাজারের তরকারি বিক্রেতা, খৈমনের কথা শুনে নুরানি বিলকিস তার দিকে তাকায়া দেখে যে, তার শরীর ফাটিফাটি করে, ফলে সে পুনরায় বিরক্ত হয়, তার মনে হয় যে, নিখোঁজ তরকারি বিক্রেতার না-ঘরের না-ঘাটের বৌ-এর এমন শরীর থাকা ঠিক না, সে বলে, একদিন আহস ত্যালের লাইগা, একদিন আহস চিনির লাইগা, খালি চায়া মাইঙ্গা খাচ, কি তুই!
খৈমন হয়তো লজ্জিত হয়, সে বলে, দেন, আগামী সপ্তায় রেশন উঠাইলে দিয়া দিমু, ঈমানে!
কিন্তু নুরানি বিলকিসের মন এইসব কথায় গলে না, সে খৈমনকে বসায়া রাখে, ভাবে যে বিরক্ত হয়া হয়তো খৈমন একসময় চলে যাবে, কিন্তু সে যায় না, হাতে চিনামাটির একটা আংটা ভাঙ্গা কাপ নিয়া রান্না ঘরে পায়ের পাতার উপর বসে চুপ করে অপেক্ষা করে। নুরানি বিলকিস রান্না করে, ভাতের মাড় গালে, ডাইলে বাগার দেয়, জরুরি কাজের ভান করে উঠে ঘরে যায় আবার ব্যস্তভাবে ফিরা আসে, খৈমন বসেই থাকে, নুরানি বিলকিস আবার তাকে বলে, তুই এমুন ক্যালা?
খৈমন তার হাতের কাপটা একটু আগায়া ধরে বলে, কইলামতো দিয়া দিমু!
নুরানি বিলকিসের খুবই অসহায় লাগে, রাগ হয়, তারপর সে হতাশ হয়া পড়ে, সে বুঝতে পারে যে, সে এই অসভ্য বেহায়া এবং ছোঁচা বেটিরে কোনভাবেই খেদাইতে পারবে না, ফলে সে বলে, আমার গেউ ভাঙ্গায়া দিবি।
খৈমন রাজি হয়, দিমুনে।
নুরানি বিলকিস জিদ করে, না অখনে আগে ভাঙ্গায়া আন, হের বাদে চিনি পাবি।
খৈমন বলে যে, এই দুপুর বেলা গম ভাঙ্গানোর কুল খোলা নাই, বিকালে দোকান খুললে সে গেউ ভাঙ্গায়া দেবে; তখন নুরানি বিলকিসের কিছু করার থাকে না, খৈমনকে চিনি দিতেই হয়। চিনি নিয়া খৈমন ঘরে ফিরা সেদিন দেখে যে, দরজার শিকল নামানো এবং ঘরের ভিতর এক পাল বান্দর কিলবিল করে। বান্দরেরা হয়তো ঘরে ঢুকেছিল কিছু করার জন্য, কলাটা মুলাটা পেলে তারা নিয়া যেত; তখন তারা খৈমনের রান্দা ভাতের হাড়ির খোঁজ পায়, তাকের উপর থেকে হাড়ি নামীয়া ভাত খায়, কিন্তু তখন শিশু চনিমিঞা জেগে উঠে হয়তো চিৎকার জুড়ে দেয়, ফলে বারদের খুবই ঝামেলা হয়, তাদের ভয় হয় যে, চানমিঞার চিৎকারে হয়তো মানুষ এসে যাবে-তখন চানমিঞাকে মাদি বান্দরের দুধ খাওয়ানোর ঘটনা ঘটে। এই চোর বান্দরের দলে হয়তো একটা মা-বান্দরনি ছিল, হয়তো সে খুবই চালক ছিল অথবা সন্তানের মা হওয়ায় তার হয়তো মনটা নরম হয়া ছিল, সে তখন আগায়া যায়া চানমিঞার মুখের মধ্যে তার একটা লোমঅলা বুনি পুরে দেয়, চানমিঞা চুকচুক করে বান্দরের দুধ খায়া ঘুমায়া থাকে। পরে বিকালে খৈমন যখন নুরানি বিলকিসের বাসায় যায় গম ভাঙ্গানোর জন্য তখন সে নিজেই হয়তো এই গল্প করে, বলে, ঘরে যায়া দেখি একপলি বান্দর ঘরের ভিতরে ভাতের হাড়ি নামায়া ভাত খায়, একটা বান্দরের বাচ্চা আমার পোলাটার লগে খেলে; অথবা হয়তো প্রথম দিনই বান্দরেরা শিকল নামায়া ঘরে ঢোকে নাই, খৈমন হয়তো ভুল বলে, অথবা বানায়া বলে, সে যখন নুরানি বিলকিস উপমার বাসা থেকে চিনি নিয়া ফেরে সে হয়তো দেখে, একটাদুইটা কিংবা পাঁচটা বার তার ঘরের কাছে দেওয়ালের উপরে চুপ করে বসে আছে, এর মধ্যে হয়তো বাচ্চাঅলা বান্দরনিটাও ছিল, খৈমন সেদিন দেখে যে, বান্দরনিটার চোখ দুইটা ধূসর ও বিষণ্ণ, হয়তো ছলছল করে, সে জানালার শিকের ভিতর দিয়া ঘরের দিকে তাকায়া আছে। এই বিষয়টা দেখে খৈমনের বুকের ভিতরটা ছ্যাৎ করে ওঠে, সে নিজেকে বলে, কিরে এত্তগুলা বান্দর এইখানে বয়া কি করে, এবং দ্রুত ঘরে ঢুকে দেখে যে, না, চানমিঞা দুই ঠ্যাং দুই দিকে ছড়ায়া দিয়া চিৎ হয়া ঘুমায়; তারপর বিকাল বেলা খৈমন গম ভাঙ্গায়া দেওয়ার জন্য যায় এবং নুরানি বিলকিস তাকে দেখে বলে, এত দেরি কইরা আইলি?
খৈমন বলে, আমারে দুইপট আডা দিবেন!
তার এই কথা শুনে নুরানি বিলকিসের রাগে দম বন্ধ হয়া আসে, সে হাঁসফাঁস করে বলে, তর খাসলত ভালা না, সকালে চিনি দিলাম, কইলি গেট ভাঙ্গায়া দিবি, অখনে কচ দুই পোয়া আটা দেন, তর কিছু করন লাগব না যা!
খৈমন বলে, ফিরায়া দিমুতো, কিন্তু নুরানি বিলকিসের আর কিছু বলতে ইচ্ছা করে না, সে বলে, তুই যা, তর খালি লালচ!
বনগ্রাম লেনে গম ভাঙ্গানোর কলে যায়া খৈমন ৫/৭ সের গম ভাঙ্গায় আনে, নুরানি বিলকিস রবিনসন বার্লির মুখ কাটা একটা মাঝারি সাইজের টিনের পুরানু কৌটা নিয়া এসে বলে, খাড়া মাইপা লই।
খৈমন হাঁটে, বলে, আমি যাই, আপনে মাপেন!
তখন খৈমন তার ঘরের কাছে এসে দেখে যে, দরজায় শিকল তুলে দেওয়া আছে, কিন্তু দেওয়ালের উপর বান্দরেরা চুপ করে বসে; এই বান্দর দেখে খৈমনের পুনরায় বুকের ভিতরে শঙ্কা বাইড়াবাইড়ি করে, কিরে আমি ঘরে না থাকলেই দেখি বান্দর আয়া বয়া থাকে, সে ভাবে, তারপর সে শিকল নামায়া ঘরে ঢুকে দেখে যে, চানমিঞী খেতার উপরে আগের মতই চিৎ হয়া ঘুমায়। তারপরও, বন্দরগুলাকে দেখে প্রথমে খৈমনের তেমন কোন সন্দেহ হয় না, তার কেবল একটু ভয় হয়, হিংস্র জন্তু জানোয়ার, জংলি হয়ওয়াম, যুদি ফাল দিয়া এসে কামড়ায়া দেয়; এবং নুরানি বিলকিস উপমা যখন বলে যে, খৈমনের লালচ বেশি, তখন তা মানাই লাগে, খৈমনের হয়তো এইরকমেরই লোভ, তবে তার কেন এত লালচ তা বলা মুশকিল, হয়তো তার এইসব জন্মগত, হয়তো ছুটুকালে জন্মের পরেই তার এই স্বভাবের বিষয়টা প্রকাশিত হয়া পড়ে, তার মা জরিমনের মোটা পুরু স্ত নের বোটা হয়তো জানোর সাত দশ দিনের মাথায় চুষে চুষে সে ঘাও বানায়া ফালয়, জরিমন হয়তো বলে, এইটা কেমুন মাইয়া হইলো আল্লা, রাক্কোস নিকি!
হয়তো তা না, হয়তো খৈমন ছোট পুটলির মত নিরীহ ফুটফুইটা একটা মেয়েই ছিল; তার বাপ আব্দুল জলিল এবং ভাই রশিদুল তাকে কোলে নিয়া ঘোরে, মাথায় করে নাচে, তারপর সে যখন বড় হয় তারা বলে, তুই বড় হয় গেলি গা, হায় খোদা, অখনে তরে লয়া আমরা কি করি!
খৈমন তখন চুল বান্ধে, সে আব্দুল জলিলের কথা শোনে, সে রশিদুলের কথা শোনে, তারপর হয়তো বলে, যা মনে লয় কর!
আব্দুল জলিল তখন তাকে কোলের ভিতর টেনে নিয়া বলে, তুই আমার মা হচ না?
খৈমনের মনে হয়, আব্দুল জলিলের মাতো সে হয়ই, এবং সে বলে, হইতো!
তারপর সে আরো বড় হয়, তার নিতম্ব প্রশস্ত হয় এবং স্তন উন্নত, এবং তখন আব্দুল জলিল আবার বলে, তুই বড় হয়া গেলি গা মাইয়া, তরে লায়া যে কি করি, কিন্তু এইবার খৈমন কথা বলে না; আব্দুল জলিল হয়তো তাকে পুনরায় কাছে টেনে আনে, দুই কান্ধের উপরে হাত রেখে বলে, তুই আমার মা হচ না? খৈমন আবার চুপ করে থাকে, তখন আব্দুল জলিলের বোধোদয় হয়, রাইতের বেলা সে তার বৌ জরিমনকে বলে, মাইয়া দেখি চুপ মাইরা গেছে, কথা জিগাই, কুনু রী করে না!
তখন জরিমনের পরামর্শে আব্দুল জলিল এবং রশিদুল খৈমনের জন্য। ছেলে খুঁজতে বের হয়, তারা ডাইনে খোজে, বামে খোঁজে, উত্তরে দক্ষিণে খোঁজে, তারপর এত খুঁজে তারা ঠাটারি বাজারে ময়না মিঞাকে পায়। কেউ একজন বলে, হয়তো বাবুল মিঞাই বলে, পোলা এউকগা আছে, সুন্দর, লম্বা, রাজার পোলার মত, বাড়ি বিক্রমপুর উক্রমপুর হইব, ঠাটারি বাজারে দুকান করে, যায়া দেইখা আহগা।
বাবুল মিঞার কথায় আব্দুল জলিলের আগ্রহ হয়, যদিও পোলা দোকানদার; তারপর আব্দুল জলিলের কাছ থেকে শুনে হয়তো জরিমনেরও ভালই লাগে, এবং তখন কোন একদিন রাইতে জরিমন যখন খৈমনকে ময়না মিঞার কথা বলে, খৈমনের দেহে কাঁপুনি ধরে, তার জ্বরের মত লাগে, সে দেখে অরুণ বরুণ কিরণমালা ছবির মত এক সওদাগরপুত্র তার সামনে এসে খাড়ায়, তখন তার চোখ বুজে ঘুম আসে। কিন্তু খৈমনের মনে হয় যে, কোন দোকানদারকে সে বিয়া করবে না, রাজপুত্র হোক, সওদাগরপুত্র হোক, তাও না, সে কোন অফিসের পিয়ন কিংবা দারোয়ান কিংবা কোন স্কুলের দপ্তরিকে বিয়া করবে। তবু তারা একদিন ময়না মিঞাকে দেখতে যায়, সঙ্গে হয়তো বাবুল মিঞা থাকে, তারা ঠাটারি বাজারের বটগাছ পার হয়া কাপ্তান বাজারের দিকে একটু আগায়া গেলে ময়না মিঞাকে পায়, সে ফুটপাতের উপর ঝাকার ভিতরে আলু, পটল এবং বড় সাইজের দুইচাইরদিশটা চুনাঅলা চাল কুমড়া নিয়া খরিদ্দারের জন্য বসে আছে। আব্দুল জলিল বোঝে যে, সে প্রতারিত হয়েছে, ময়না মিঞা ভেসে বেড়াইনা লোক, তার সঙ্গে মেয়ের বিয়া দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না; জরিমনও তার সঙ্গে একমত হয়, সে বলে, বাবুল ভাইয়ে এমুন ঠকবাজি করলো!
কিন্তু তখন খৈমনের মন খারাপ হয়া যায়, সে বুঝতে পারে না যে, এই লোকটাকেই কেন তরকারিঅলা হতে হবে, টুকরিতে করে আর চালকুমড়া নিয়া বাজারে বসে থাকতে হবে ফালতু গ্রাহকের জন্য, ময়না মিঞা কেন তরকারিঅলা না হয় দারোয়ান কিংবা পিয়ন কিংবা স্কুলের দপ্তরি হলো না। তা ভেবে খৈমনের ক্ষুধা মরে যায়, ঘুম কমে আসে, তার ডাগর চোখের কোণ বসে কালা হয়া থাকে। তখন তার মা একদিন দেখে যে, মেয়ের অবস্থা খুব খারাপ, সে বলে, কিরেখৈ কি হইলো তর?
কিন্তু খৈ কোন কথা বলে না, আব্দুল জলিল এবং জরিমন হয়তো বোঝে, তারা বলে, খাড়া না তর লাইগা কত ভাল পোলা আমরা খুঁইজা বাইর করুম! পাত্রের খোঁজে তারা আবার চতুর্দিকে যায়, কিন্তু পানবিড়ি দোকানদার আব্দুল জলিলের মেয়ের জন্য সুপাত্র পাওয়া মুশকিল হয়, অবশেষে পুনরায় বাবুল মিঞা আসে, ঘটকালি বাবুল মিল্লার পেশী না, প্রাণের টানে এইসব করে, সে আব্দুল জলিলকে খুঁজে বের করে খৈমনের বিয়ার আলাপ করে, সে বলে যে, ময়না মিঞা ভাল পোলা, স্বাধীন ব্যবসা করে, খারাপ কি, চালকুমড়া বেচলে কি অসুবিদা, সে চুরিতো করে না, এখন হয়তো চাঙ্গারি নিয়া রাস্তায় বসে, কি দীর্ঘদিন সে নিশ্চয়ই এই জায়গায় বসে থাকবে না, তার নিশ্চয়ই উন্নতি হবে, এক ঝাকায় ত্রিশটা চাল কুমড়া সে যদি সাত/আট টাকায় বেচে, তার হয়তো দিনে দুই টাকা লাভ হবে, নিজের খোরাকি এইসবে সে যদি দিনে আট আনা ব্যয় করে, প্রতিদিন তার সঞ্চয় হবে দেড় টাকা, মাসে পয়তাল্লিশ টাকা এবং এক বছরে পাঁচশ চল্লিশ টাকা-ম্যালা টাকা-তখন বাজার কমিটিকে ঘুষ দিয়া হয়তো শিগগিরই সে ভিতরে তরকারি বাজারের কোন এক চিপায় একটু ঠাঁই করে নেবে, তারপর হয়তো তরকারি বাজারের ভিতর তার একটা স্থায়ী তরকারির দোকানই হয়া যাবে, তারও পরে হয়তো হবে একটা মুদি কিংবা রেশনের দোকান-হইতেই পারে, কে বলতে পারে, কি হবে বা হবে না, জন্ম থেকেই বড়লোক কয়জন? আব্দুল জলিল এই সব কথা শোনে কিন্তু ময়না মিঞার ব্যাপারে তার আগ্রহ দেখা যায় না, তরকারিঅলা তরকারিঅলাই, তার আবার সঞ্চয় কি? হয়তো ফকির একটা; বাবুল মিঞা তখন হুমায়ুন কবিরের কথা বলে, হুমায়ুন কবির দক্ষিণ মৈশুন্দি থাকে এবং শাহসাহেব। লেনে রেশনের দোকান চালায়, পাঞ্চাবিতে সোনার বোতাম পরে, ভাল পোল, খৈমনের লগে ভাল মানাবে। তখন জরিমনের সঙ্গে বিষয়টা আব্দুল জলিল বিস্তারিত ভেবে দেখে, কিসের ভিতরে কি হতে পারে এবং কিসের ভিতরে কি না হতে পারে তা তারা বিশদ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে, তারপর তারা এই বিষয় নিয়া খৈমনের সঙ্গে কথা বলে, শুনে খৈমনের মন কেমন হয়া যায়, তার মনে হয় যে, ময়না মিঞার চাইতে হুমায়ুন কবির সুন্দর নাম, অথবা হয়তো ময়না মিঞাই ভাল—পাখির নামে নাম; কিন্তু হুমায়ুন কবির রেশন দোকানের মালিক হওয়ায় তার মন খারাপ লাগে, সে এই বিষয়টা বুঝতে পারে না যে, তার কাছে কেন তরকারিঅলা, রেশন। দোকানের মালিকেরই খোঁজ আসে! তবু খৈমন তার বাপমায়ের সঙ্গে একদিন দুপুরের পর শাহসাহেব লেনে রেশনের দোকানে হুমায়ুন কবিরকে দেখতে যায়; দল বেন্ধে তাদের আগমনের কারণ হয়তো হুমায়ুন কবির বুঝতে পারে না, সে বলে, আপনেরা কৈখন আইছেন?
আব্দুল জলিল তখন অনেক মিছা কথা বলে, এবং হয়তো সে ধানাইপানাই করে হুমায়ুন কবিরকে বিভ্রান্ত করতে সক্ষম হয়, অথবা হয়তো সে তার চোখে ধূলা দিতে পারে না, হুমায়ুন কবির ব্যাপারটা বুঝে ফেলে; যাইহোক, হুমায়ুন কবির বুঝুক বা না বুঝুক তাদের দেখা তারা দেখে আসে এবং হুমায়ুন কবিরকে তাদের পছন্দ হয় না। রেশন দোকানের মালিক হলেও লোকটার বয়স বেশি, মাথায় চুল কম, এবং খোঁজ নিয়া আব্দুল জন্সিল জানতে পারে যে, হুমায়ুন কবির তৃতীয় বিয়ার জন্য মেয়ের সন্ধানে আছে, তার প্রথম দুই স্ত্রীরই ইন্তেকাল হয়েছে, তবে এই স্ত্রীদের গর্ভে তার কোন সন্তানাদি নাই, সে বিপত্নীক হলেও ঝামেলামুক্ত। বাবুল মিঞা তাকে বোঝায়, খরাপ কি? ফলে আব্দুল জলিল বিষয়টা নিয়া দোনামনা করলেও ও রিমনের মায়ের মন মোচড় খায়, তার এত সোহাগের মাইয়া, সে আবার বলে, বাবুল ভাইয়ে আমাগো লগে এমুন করলো, এমুন একখান পোলা আনলো, বুইড়া দোজবর!
তারপরেও হুমায়ুন কবিরের রেশনের দোকানের মালিক হওয়ার বিষয়টা বড় প্রসঙ্গ হয়া থাকে, তারা এই কথাটা ভুলতে পারে না যে, বিয়া হলে মেয়ে ভালই থাকবে, তখন জরিমন হয়তো এইটা নিয়া খৈমনের সঙ্গে কথা বলে, শুনে খৈমন ধুম মেরে থাকে। একদিন যায়, দুই দিন যায়, পাঁচদিনের দিন জরিমন অস্থির হয়া পড়ে, সে মেয়েকে ডেকে বলে, তুই কতা কচ না ক্যালা?
তখন খৈমন বলে, আমি ময়না মিঞাঁরে বিয়া করুম, ব্যবস্থা করো!
কিন্তু মেয়ে রাজি হলেই এই দেশে একটা মেয়ের বিয়া হয়া যেতে পারে না, এর আগে খৈমন তার বাপমা ভাইকে নিয়া যায়া ময়না মিঞাকে দেখে এসেছে, এবার ময়না মিঞা তাকে দেখতে আসে ভূতের গল্লিতে তাদের বাসায়। ময়না মিঞা ৩৬নম্বর ভূতের গল্লিতে তাদের দুই কামরার বাসায় এক বিকালে এসে হাজির হয়, সে একা আসে, অথবা সঙ্গে হয়তো ঘটক বাবুল মিঞা ছিল; তখন সেদিন সন্ধ্যায় শাড়ি পরা ঘোমটা দেওয়া খৈমন বেগম বাইরের ঘরে এসে কাঠের খালি একটা টুলের উপর বসে, হারিকেন বাতির আলোয় ঘোমটার ফাঁক দিয়া ময়না মিঞাকে খুঁটায়া দেখে এবং তার আফসোসের সীমা থাকে না। ময়না মিঞা কালা, কিন্তু তার খাড়া নাক, পানিতে চুবাইনা দুইটী তরল পাথরের মত চোখ এবং হাতের পাকানো পেশি; খৈমনের পুনরায় মনে হয় যে, এই লোকটা তরকারি বেচে, রাস্তার উপরে ভোদার মত চালকুমড়া নিয়া বসে থাকে, আশ্চর্য! রাইতের বেলা ময়না মিঞার তরুণ অঙ্গের কথা খৈমনের বিশদ মনে পড়ে, তার নিদ্রাহীনতা খারাপের দিকে যায়, তখন জরিমল এবং আব্দুল জলিল আশা করতে থাকে যে, ময়না মিঞার মতামত তারা শিগগির জানতে পারবে, কিন্তু ময়না মিঞা কিছু বলে না, তার কি খৈমনকে পছন্দ হয় নাই, সে কি হারায় গেল? আব্দুল জলিল যায়া বাবুল মিঞাকে ধরে, বাবুল ভাই, কিছুতে কইলা না আর!