রাত্ৰিতে তাঁর ভালো ঘুম হয় নি।
বার বার ঘুম ভেঙেছে–তিনি ব্যস্ত হয়ে ঘড়ি দেখেছেন। না, এখনো রাত কাটে নি। এক বার হিটার জ্বালিয়ে কফি বানালেন, কিছুক্ষণ পায়চারি করে এলেন ছাদে। আবার বিছানায় ফিরে গিয়ে ঘুমুতে চেষ্টা করলেন। ছাড়া-ছাড়া ঘুম, অর্থহীন এলোমেলো স্বপ্ন দেখে আবার ঘুম ভাঙল।
ভোর হতে আর কত দেরি? আকাশে সামান্য একটু আলোর রেখা কখন ফুটবে? কা-কা করে কাক ডাকছে। অন্ধকার একটু যেন ফিকে হয়ে গেল। আর হয়তো বেশি দেরি নেই। তিনি এই শীতেও ঘরের দরজা-জানালা সব খুলে দিলেন। জানালার সমস্ত পর্দা গুটিয়ে ফেললেন। অন্ধকারে কিছুই নজরে আসছে না। কিন্তু তিনি বাতি জ্বালালেন না; হাতড়ে-হাতড়ে ইজিচেয়ারটি খুঁজে বের করলেন। এখানে শুয়ে থেকেই রেডিওগ্রামে, সুইচ নাগাল, পাওয়া যায়। রেডিওগ্রামে সানাইয়ের তিনটি লং-প্লেইং রেকর্ড সাজান আছে। সুইচ টিপলেই প্রথমে বেজে উঠবে। বিসমিল্লাহ খাঁর মিয়া কি টোড়ি। তিনি সুইচে হাত রেখে ভোরের প্রতীক্ষ্ণ করতে লাগলেন। তাঁর বহু দিনের স্বপ্র জরীর বিয়ের দিনের ভোরবেলায় সানাইয়ের সুর শুনিয়ে সবার ঘুম ভাঙাবেন! ঘুম ভাঙতেই সবাই যেন বুঝতে পারে।–জরী নামের এ বাড়ির একটি মেয়ে আজ চলে যাবে।
বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ তার চোখে জল এল। বয়স হবার পর থেকে এই হয়েছে। কারণ্যে-অকারণে চোখ ভিজে ওঠে। সুখ এবং দুঃখের অনুভূতি বড়ো তীব্র হয়ে বুকে বাজে।
একতলায় কার যেন পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। ঘটাং ঘটাং শব্দে টিউবওয়েলে কেউ এক জন পানি তুলছে। মোরগ, ডাকছে। ভোর হল বুঝি। তিনি সুইচ টিপলেন।
সানাই শুনলে এমন লাগে কেন? মনে হয় বুকের মাঝখানটা হঠাৎ ফাঁক হয়ে গেছে। তাঁর অদ্ভুত এক রকমের কষ্ট হতে লাগল। তিনি ঘর ছেড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। হুঁ-হু করে শীতের হিমেল বাতাস বইছে। এবার বড়ো আগেভাগে শীত পড়ে গেল। খুব শীত পড়লেই তাঁর ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। স্পষ্ট দেখতে পান, কমলালেবু হাতে সাত-আট বছরের একটি বাচ্চা ছেলে বারান্দায় বসে হুঁ-হু করে কাঁপছে। আজও তাঁর ছেলেবেলার কথা মনে পড়ল। আহ পুরানো কথা ভাবতে এত ভালো লাগে। তিনি মনে মনে বললেন, ভাগ্যিস জন্তু-জানোয়ার না হয়ে মানুষ হয়ে জন্মেছি।
জরী কি এখনো ঘুমুচ্ছে? আজ ঘুম ভাঙলে তার কেমন লাগবে কে জানে? তাঁর খুব ইচ্ছে হচ্ছে জরীকে ঘুম ভাঙিয়ে নিয়ে আসেন। সে আজ তাঁর সঙ্গে ছাদে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় দেখুক। দেখুক, খুব ভোরে চেনা পৃথিবী কেমন অচেনা হয়ে পড়ে। হালকা কুয়াশায় ঢাকা শীতের সকালে কী অপরূপ সূর্যোদয় হয়।
কিন্তু জরাটা বড্ড ঘুমকাতুরে। তিনি কত চেষ্টাই না করেছেন সকালে জেগে ওঠার অভ্যাস করাতে! সে বরাবর আটটার দিকে উঠেছে। বিছানা না ছেড়েই চিৎকার, ও মা চা দাও, ও মা চা দাও! বাসিমুখে চায়ে চুমুক দিতে দিতে সে উঠে এসেছে দোতলায়। তিনি হয়তো ততক্ষণ রেওয়াজ শেষ করে উঠবেন উঠবেন। করছেন। জরী হাসিমুখে বলেছে, বড়োচাচা, আজ। আপনার গান শুনতে পারলাম না।
তিনি বিরক্ত হয়ে বলেছেন, দশটায় ঘুম ভাঙলে কী গান শুনবে জরী? আমার গান শুনতে হলে রাত কাটার আগে উঠতে হবে।
কাল ঠিক উঠাব বড়োচাচা। এই আপনার সেতার ছুঁয়ে বলছি।
বলতে বলতেই সেতারের তারে টোকা দিয়েছে জরী। গাঁও করে একটি গম্ভীর আওয়াজ উঠেছে। শুনে জরীর সে কি হাসি।
তিনি মনে মনে বললেন, আজ শুধু জরীর কিংবা ভাবব। তিনি জরীর মুখ মনে করতে চেষ্টা করলেন। আশ্চৰ্য, মনে আসছে না তো? এ রকম হয়। খুব ঘনিষ্ঠ লোকজন, যারা সব সময় খুব কাছাকাছি থাকে, হঠাৎ করে তাদের মুখ মনে করা যায় না। তিনি ভ্রূকুঞ্চিত করে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে ছাদে উঠে গেলেন।
এ বাড়ির ছাদটি প্রকাণ্ড। ছাদের চারপাশে বড়ো বড়ো ফুলের টবে অযত্নে কিছু গোলাপ-চারা বড়ো হচ্ছে। তিনি ছাদের কাৰ্ণিশে ঝুঁকে অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে সামনে হাত বাড়ালেন। ছাদের এ দিকটায় দুটি প্রকাণ্ড আমগাছ দিনের বেলাতেও অন্ধকার করে রাখে। চারদিকে অন্ধকার ফিকে হয়ে এলেও এখানে কালো রঙ জমাট বেঁধে আছে। কেমন একটা মিষ্টি গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। শীতকালে আমের মুকুল হয় নাকি?
বড়ো চাচা!
তিনি চমকে পিছনে ফিরলেন। আশ্চর্য! জরী দাঁড়িয়ে আছে তাঁর পেছনে। ঘুমজড়ান ফোলা ফোলা মুখ। মেয়েটিকে আজ বড়ো অচেনা মনে হচ্ছে। এত রূপসী তো জরীকে কখনো মনে হয় নি। বিয়ের আগের দিন সব মেয়ে নাকি গুটিপোকার মতো খোলস ছেড়ে প্রজাপতি হয়ে বেরিয়ে আসে। তিনি হাসি-হাসি মুখে তাকিয়ে রইলেন।
বড়োচাচা, কী করছেন একা একা?
সানাই শুনছি।
আজ আমি খুব ভোরে উঠেছি। আপনি খুশি হয়েছেন চাচা?
তিনি হাসলেন। জরী একটা হলুদ রঙের চাদর গায়ে জড়িয়েছে। একটু একটু কাঁপছে শীতে?
জরী, তোর শীত লাগছে?
উহ। আপনি আজ রেওয়াজ করবেন না চাচা?
না মা। আজ আমার ছুটি।
দু জনে খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। জরী অঙ্কুট স্বরে বলল, ইস, কী কুয়াশা পড়েছে। বাবা!
তিনি একসময় বললেন, সানাই শুনতে ভালো লাগছে জরী?
লাগছে।
কে বাজাচ্ছে জান?
জানি না, কে বাজাচ্ছে।
বিসমিল্লাহ্ খাঁ, এখন বাজছে মিয়া কি টোড়ি।
জীরী আরো কাছে সরে এসে কাণিশে ভর দিয়ে দাঁড়াল। মৃদু গলায় বলল, কী সুন্দর লাগছে! আগে জানলে রোজ ভোরে উঠতাম।
তিনি জরীর দিকে তাকিয়ে সস্নেহে হাসলেন। জরী বলল, একটা হালকা সুবাস পাচ্ছেন বড়োচাচা?
পাচ্ছি।
বলুন তো কিসের?
তিনি ভাবতে চেষ্টা করলেন। শিউলি ফুলের নাকি? বাগানে একটি শিউলিগাছ আছে। কিন্তু সে-ফুলের গন্ধ তো হালকা।
এতক্ষণে সূর্য উঠল। গাছে গাছে কাক ডাকছে। কিচির-মিচির করতে করতে দুটি শালিক এস বসল ছাদে। জরী হাত বাড়িয়ে দুটি আমের পাতা ছিঁড়ে এনে গন্ধ শুকল। তিনি দেখলেন জরী কাঁদছে। তিনি চুপ করে রইলেন। আহা একটু কাঁদুক। এমন একটি সময়ে না। কাঁদলে মানায় না। তাঁর ভীষণ ভালো লাগল। তিনি কোমল গলায় বললেন, জরী, দেখ সূৰ্য উঠেছে। এমন সুন্দর সূর্যোদয় কখনো দেখেছিস?
জরী চোখ মুছে ধরা গলায় বলল, সন্তাহার যাবার সময় এক বার টেনে দেখেছিলাম।
দেখ, আজকে আবার দেখ।
জরী ফিসফিস করে বলল, কী সুন্দর।
বলতে বলতে জরী আবার চোখ মুছল। তিনি নরম গলায় বললেন, বোকা মেয়ে, আজকের দিনে কেউ কাঁদে? ঐ দেখ দুটি শালিক পাখি। দুই শালিক দেখলে কী হয় মা?
জরী ফিসফিস করে বলল, ওয়ান ফর সরো, টু ফর জয়।
ঠিক তখনি জরীর বন্ধুরা নিচ থেকে জরী জরী করে চেঁচাতে লাগল। জারী নিঃশব্দে নিচে নেমে গেল।
তিনি একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। ভোরের এরকম অচেনা আলোয় মন বড়ো দুর্বল হয়ে যায়। আপনাকে ক্ষুদ ও অকিঞ্চিৎকর মনে হয়। বড়ো বেশি মনে পড়ে, দিন ফুরিয়ে গেল। তিনি সুর করে পড়লেন–ফবিআয়ে আলা। রাব্বিকুমা তুকাজ জি বান।