প্রেয়সী – উপন্যাস – নিমাই ভট্টাচার্য
ভারতী দেবী প্রায় ছুটতে ছুটতে ঘরে ঢুকেই খুশির হাসি হেসে বলেন, জানিস শিবানী, আজ নির্মলাদির ওখানে একটা দারুণ ব্যাপার ঘটেছে?
দারুণ ব্যাপার মানে সারাদিন খুব ভাল কাটিয়েছিস তো?
হ্যাঁ, সারাদিন খুব আনন্দে কাটিয়েছি।
নিমালাদির অনেক বন্ধু এসেছিল?
না, না, শুধু জন কয়েক পুরনো ছাত্রী এসেছিল।…
হঠাৎ পুরনো ছাত্রীরা এলো কেন?
নির্মলাদি ইউনিভার্সিটিতে প্রফেসর হয়ে যাচ্ছে, তাই ওরা ওকে ফেলিসিটেড করতে এসেছিল।
ভাল।
ভারতী দেবী হাসতে হাসতেই বলেন, ভাল মানে দারুণ ভাল ব্যাপার করেছিল। মেয়েরা। ওরাই বাড়ি থেকে নানা রকম খাবার-দাবার এনেছিল, নির্মলাদিকে খুব সুন্দর একটা বালুচরী শাড়ি ছাড়াও নির্মলাদির স্বামীর জন্য ফিনলের ধুতি-গরদের পাঞ্জাবি আর চন্দন কাঠের সুন্দর লাঠি দিয়েছে।
বাঃ।
শিবানী দেবী একটু হেসে বলেন, মেয়েরা তো ভালই উপহার দিয়েছে।
মেয়েরা আরো অনেক কাণ্ড করেছে।
আবার কি করলো?
আবৃত্তি, ক্যারিকেচার আর…
ক্যারিকেচার?
হ্যাঁ, হ্যাঁ, ক্যারিকেচার।
ভারতী দেবী মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, ক্যারিকেচার করলো নির্মলাদিকে নিয়েই।
সেকি?
একটা মেয়ে দেখালো, উনি কি করে ক্লাসে পড়ান আর অন্য একটি মেয়ে দখালো, কলেজের করিডর দিয়ে যাতায়াতের সময় নির্মলাদি কি করে ছাত্রী আর অধ্যাপিকাঁদের সঙ্গে…
আচ্ছা!
তাই দেখে নির্মলাদি, ওর স্বামী আর আমরা হাসতে হাসতে পাগল হবার উপক্রম।
ভারতী দেবী একটু থেমে চাপা হাসি হেসে বলেন, এই সব ছাড়াও আরো একটা দারুণ কাণ্ড হয়েছে।
কি আবার দারুণ কাণ্ড ঘটলো?
তোকে কি বলব শিবানী, নির্মলাদির এক পুরনো ছাত্রীকে দেখে আমি চোখের পলক ফেলতে পারি না।
মেয়েটি বুঝি খুব সুন্দরী?
মেয়েটির রঙ খুব ফর্সা না, একটু চাপা কিন্তু তুই বিশ্বাস কর, ওকে দেখে মনে হলো যেন স্বয়ং বিশ্বকর্মা নিজের হাতে খোদাই করে ওকে তৈরি করেছেন।
খুব সুন্দর গড়ন বুঝি?
ওর চোখ-মুখ-নাক আর সুন্দর গড়ন দেখে আমি অবাক হয়ে গেছি।
শিবানী দেবী একটু হাসেন।
ভারতী দেবী একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, তুই বিশ্বাস কর,একে অত সুন্দর দেখতে, তার উপর ওর গান শুনে একেবারে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গেছি।
উনি না থেমেই বলেন, ওকে আমি কিছুতেই হাত ছাড়া করব না।
শিবানী দেবী চাপা হাসি হেসে বলেন, তুই মনে মনে ঠিক করেও ফেলেছিস ওর সঙ্গে বাবাই-এর বিয়ে দিবি?
মেয়েটি যদি তোরও পছন্দ হয়, তাহলে নিশ্চয়ই…
মেয়েটির নাম কি?
দুর্বা।
বাঃ! বেশ সুন্দর নাম।
ভারতী দেবী থামতে পারে না। বলেন, বল, তুই কবে দুর্বাকে দেখতে যাবি?
তুই ওর বাবার নাম, ঠিকানা…
সব লিখে নিয়েছি। তুই বললেই আমি ওদের বাড়ি টেলিফোন করব। বলব, গান শুনতে আসছি।
তুই বোধহয় তোর মনের কথা মেয়েটিকে বলেই দিয়েছিস, তাই না?
না, না, তাই কি বলতে পারি? তোর পছন্দ হবার পরই বলব।
শুধু তোর-আমার পছন্দ হলেই তো হলো না মেয়েটিকে দেখে দাদারও তো পছন্দ হওয়া চাই।
ভারতী দেবী একটু হেসে বলেন, আমি যদি বলি, আমাদের কাজের মেয়েটাকে শিবানীর পছন্দ হয়েছে, তাহলেও আমার ভোলানাথ স্বামী বলবে, হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব ভাল কথা। সরলা মেয়েটি সত্যি খুব ভদ্র সভ্য। সরলাকে বিয়ে করে বাবাই ঠিক সুখী…।
শিবানী দেবী আর হাসি চেপে রাখতে পারেন না। বলেন, তুই দাদাকে কি ভাবিস বলতো?
কি আবার ভাবব? ভাবি, আমার ভোলানাথকে তুই বা আমি যা বলব, উনি বিন্দুমাত্র চিন্তা-ভাবনা না করেই মত দেবে। কোন ব্যাপারেই ও সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
বাজে বকিস না।
শিবানী দেবী না থেমেই বলেন, দাদা তো সংসারের ব্যাপারে তোর উপরই সব দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছেন বলে কোন ব্যাপারেই নাক গলান না।
সেটা কি খুব বাহাদুরীর ব্যাপার?
একশ বার বাহাদুরীর ব্যাপার। স্ত্রীরা যত শিক্ষিতা, যত বুদ্ধিমতীই হোক, তাদের উপর ক’জন স্বামী আস্থা রাখে? সংসারের সব ব্যাপারে নাক না গলালে পুরুষরা স্বামীত্ব ফলাবে কী করে?
তুই তো দাদার ঢোল বাজাবিই।
বাজাবই তো।
শিবানী দেবী ওর একটা হাত ধরে বলেন, দাদার মত স্বামী পেয়েছিস বলেই। তুই এতগুলো বছর কেমন হাসি মুখে কাটিয়ে দিলি বলতো!
ভারতী দেবী উঠে দাঁড়িয়ে বলেন,আর বসব না। এখনও আমি বাড়িতে ঢুকিনি।
সেকি?
.
ক’দিন ধরেই কলেজ যাতায়াতের পথে ভারতী সব সময় একই কথা বলেন শিবানীকে।
বিশ্বাস কর শিবানী, আজকাল সব সময় শুধু দুর্বার কথাই মনে হয়। খুব ইচ্ছে করে ওকে দেখতে, ওর গান শুনতে।
এত যখন ইচ্ছে করছে, তখন ওকে ফোন করছিস না কেন?
ভাবছি, এত তাড়াতাড়ি কি ফোন করা ঠিক হবে?
হ্যাঁ, আরো কয়েকটা দিন যাক, তারপর ফোন করিস।
তাই করব কিন্তু ওর সঙ্গে একটু কথা বলতে এত ইচ্ছে করছে যে কি বলব!
দু’একদিন পর কলেজ থেকে ফেরার পথে শিবানী বলেন, আচ্ছা ভারতী, তুই তো এত বছর ধরে বেথুন কলেজে পড়াচ্ছিস; কলেজের কোন মেয়েকে দেখেই তোর এত ভাল লাগেনি?
হ্যাঁ, অনেক মেয়েকেই ভাল লেগেছে। তাদের অনেকের কথাই এখনও মনে হয় কিন্তু আগে তো বাবাইয়ের বিয়ের কথা ভাবতাম না।
তা ঠিক।
এখন বাবাই এম. টেক পাশ করে ভাল চাকরি করছে তাছাড়া বিয়েরও বয়স হয়েছে। তাই…
বুঝেছি।
আরো একটা সপ্তাহ এইভাবে কেটে গেল।
ভারতী আর ধৈর্য ধরতে পারেন না।
শিবানীর ঘরে ঢুকেই ভারতী বলেন, হারে, আজ এখুনি তোর এখান থেকে দুর্বাকে ফোন করব। আর দেরি করতে পারছি না।
শিবানী এক গাল হেসে বলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, কর। আর তোকে দেরি করতে হবে না।
.
হ্যালো, আমি ভারতী সরকার কথা বলছি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, মাসীমা, বলুন। আমি দুর্বা।
তাই বলি, এত মিষ্টি কণ্ঠস্বর কার।
দুর্বা একটু হাসে। বলে, আপনি এতদিন পর ফোন করলেন কেন? আমি তো কবে থেকে ভাবছি আপনার টেলিফোন আসবে।
ভাবছিলাম, তোমাকে বেশি বিরক্ত করা ঠিক হবে না।
প্লীজ মাসীমা, ওকথা বলবেন না। আপনি রোজ দু’বেলা ফোন করলে আমি। খুশি হবো।
মা, অত লোভ দেখিও না। আমি কিন্তু সত্যি সত্যি দু’বেলা ফোন করা শুরু করে দেব।
হ্যান্ড-ফ্রী সেট। তাই রিসিভার হাতে তুলে নিতে হয়নি ভারতী দেবীর। উনি কথা বলছেন, শুনছেন হাত গুটিয়ে বসে থেকেই। শিবানী দেবী ওদের দুজনের কথাই শুনছেন আর হাসছেন।
মাসীমা, আপনি ফোন করলে সত্যি আমি খুশি হবো।
হ্যাঁ, নিশ্চয়ই ফোন করব কিন্তু কবে তোমার গান শুনতে আসব?
আপনি কাল এলে কালই শোনাবো। কাল না এলে, যেদিন ইচ্ছে আসুন। গান গাইতে, গান শোনাতে আমার ভালই লাগে।
ঠিক আছে, আমি দু’চার দিনের মধ্যেই আসছি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, আসুন।
তবে আমি একলা আসব না। আমি আমার সব চাইতে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও বোন শিবানীকে সঙ্গে নিয়েই আসব।
হ্যাঁ, হ্যাঁ, শিবানী মাসীমাকেও নিয়ে আসবেন।
এবার ভারতী বলেন, দুর্বা, তোমার মা কি কাছাকাছি আছেন?
মা তো এখন বাড়ি নেই। সামনের বাড়ির ঠাকুমার শরীর খারাপ, তাই মা ঠাকুমাকে দেখতে গিয়েছেন।
ও!
উনি মুহূর্তের জন্যে থেমে বলেন, তাহলে মাকে বলল, আমি ফোন করেছিলাম।
সে তো বলবই।
তাহলে এখন রাখি?
হ্যাঁ, রাখুন তবে তাড়াতাড়ি আসবেন।
হ্যাঁ, মা, তাড়াতাড়িই আসব।
ওদের দুজনের কথা শেষ হতেই শিবানী বলেন, দুর্বা তো ভারী সুন্দর কথা বলে।
দুর্বার কথাবার্তার মধ্যে বেশ একটা আন্তরিক ভাব আছে, তাই না?
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছিস।
হাজার হোক সল্টলেক থেকে কক্সবা; দীর্ঘ পথ। সুতরাং ভারতী ঠিক করলেন, রবিবার বিকেলে যাবেন। সে খবর জেনে দুর্বা আর ওর মা–দুজনেই খুশি।
ওদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেই ভারতী হাজির শিবানীর কাছে।
হ্যাঁরে শিবানী, একটু আগেই আমি দুর্বা আর ওর মা-কে বললাম, রবিবার বিকেলে আসছি।
রবিবার কেন? আমি তো ভেবেছিলাম, তুই কাল-পরশুই যাবি।
দ্যাখ শিবানী, হাজার হোক বর্ষা কাল। দু’একদিন বৃষ্টি হচ্ছে না ঠিকই কিন্তু যখন-তখন তো বৃষ্টি হতে পারে।
তা তো পারেই।
রবিবার তো তোর দাদার অফিস নেই। সুতরাং গাড়িটা পাওয়া যাবে।
তা ঠিক।
তাছাড়া আমাদের এখান থেকে কসবা অনেকটা পথ। টাক্সি পাব কি পাবো না, তার তো ঠিক নেই। তাই…
এমনি দিনে পাওয়া গেলেও একটু-আধটু বৃষ্টি হলেই ট্যাক্সি পাওয়া সত্যি…
হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেই জন্যেই তো রবিবার যাবো।
ঠিক আছে।
আমরা চারটে নাগাদ স্টার্ট করব তাহলে পাঁচটা নাগাদ দুর্বাদের ওখানে পৌঁছব। তারপর সুবিধে মতন…
শিবানী একটু হেসে বলে, হ্যাঁ, সেই ভাল।
শুক্রবার।
হারে শিবানী, তুই বল তো কি হাতে করে দুর্বাদের বাড়ি যাব।
দু’জনেই মিষ্টি নেব না।
হ্যাঁ, শুধু মিষ্টি নিয়ে যাওয়ার চাইতে দু’রকম জিনিষ নিয়ে যাওয়াই ভাল।
ভারতী সঙ্গে সঙ্গেই বলেন, বলতে কি কি নিয়ে যাওয়া যায়।
শিবানী একটু ভেবেই বলেন, আচ্ছা ভারতী, যদি আমরা কে. সি. দাশ থেকে কিছু ভাল মিষ্টি নেওয়া ছাড়া পার্ক স্ট্রীটের কোয়ালিটি বা ওয়েসিস থেকে কিছু ভাল কাবাব-টিক্কা-চিকেন পাকৌড়ার মতো কিছু নিয়ে যাই…
খুব ভাল আইডিয়া।
.
দরজা খুলে মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলাকে দেখেই ভারতী হাত জোড় করে বলেন, নমস্কার! আমি ভারতী সরকার আর…
ভদ্রমহিলা একটু হেসে বলেন, উনি নিশ্চয়ই শিবানীদি?
হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন।
আপনারা ভিতরে আসুন।
ভারতী আর শিবানী বারান্দায় উঠতে না উঠতেই দুর্বা লাফাতে লাফাতে এসে হাজির। দুজনকেই পায় হাত দিয়ে প্রণাম করে। সঙ্গে সঙ্গে এক গাল হেসে বলে, আপনারা এসেছেন বলে আমার খুব ভাল লাগছে।
ড্রইংরুমে পা দিয়েই শিবানী ওয়েসিসের প্যাকেটটা দুর্বার হাতে দিয়ে একটু হেসে বলেন, শিল্পী, এই নাও।
ভারতী কে. সি. দাশের প্যাকেটটা তুলে দেন দুর্বার মা-র হাতে। উনি বলেন, কি করেছেন বলুন তো আপনারা! এত কিছু…
দুর্বা বলে, ও মা! মনোরমা মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের দই-মিষ্টি আর সিঙাড়া খেয়ে খেয়ে মুখে আরুচি ধরে গেছে। মাসীমারা কে. সি. দাশ-ওয়েসিসের খাবার দাবার এনে ভালই করেছেন।
ওর কথা শুনে ভারতী আর শিবানী হাসেন।
দুর্বার মা ওদের বলেন, দেখছেন, আমার মেয়ে কি অসভ্য।
দুর্বা সঙ্গে সঙ্গে বলে, মা, কি অসভ্যতার মত কথা বলেছি? সত্যি করে বলল তো, মনোরমার দই-মিষ্টি-নোনতা খাবার খেতে তোমার ভাল লাগে?
ও মুহূর্তের জন্য থেমে বলে, মাসীমারা কি ইনকাম ট্যাক্স অফিসার যে ওদের কাছ থেকে সত্যি কথাটা লুকোতে হবে?
ওর কথা শুনে ভারতী আর শিবানী না হেসে পারেন না।
যাইহোক টুকটাক কথাবার্তা গল্পগুজব করতে করতে চা-টা খাওয়া শেষ হতেই শিবানী দুর্বার দিকে তাকিয়ে বলেন, শিল্পী…
দুর্বা হো হো করে হেসে উঠে বলে, আপনি কি সত্যি আমাকে শিল্পী বলে ডাকবেন?
ভারতীর কাছে তোমার গানের যে প্রশংসা শুনেছি, তারপর তোমাকে শিল্পী বলে না উপায় নেই।
ভারতী ওকে বলেন, মা, গান শোনাবে না?
দুর্বার মা সুনন্দা দেবী বলেন, গান শোনাতে ময়না সব সময় রাজি। ও তো দিনরাত গান গায়। এমন কি খেতে বসেও…
ভারতী আর শিবানী প্রায় একই সঙ্গে বলেন, ও খেতে বসেও গান গায়?
আমাদের মায়া যখনই ওর সামনে ভাতের থালা আর ডালের বাটি রাখবে, তখনই ও গেয়ে উঠবে…
দুর্বা সঙ্গে সঙ্গে শুরু করে–
কত কাল রবে
বল ভারত রে,
শুধু ডাল ভাত জল
পথ্য করে।
দেশে অন্নজলের হল ঘোর
অনটন–
ধর হুইস্কী-সোডা
আর মুর্গি-মটন।…
ভারতী আর শিবানী হো হো করে হেসে ওঠেন।
দুর্বা ওদের দিকে তাকিয়ে বলে, সত্যি, আমি যখন-তখন যেখানে-সেখানে হঠাৎ গান না গেয়ে থাকতে পারি না। এইতো পরশু দিনই ইউনিভার্সিটি গিয়েছিলাম। হঠাৎ দেখি, আমার, তিন-চারটে বন্ধু একটা গাছের ছায়ায় বসে খুব ফিসফিস করছে।
ও হঠাৎ ডান হাতে তুড়ি দিয়েই বলল, ব্যস! আমি হঠাৎ ওদের সামনে হাজির হয়েই গেয়ে উঠি
ওলো সই, ওলো সই
আমার ইচ্ছা করে তোদের মতো
মনের কথা কই।
ছড়িয়ে দিয়ে পা দুখানি
কোনে বসে কানাকানি,
কভু হেসে কভু কেঁদে
চেয়ে বসে রই।
ওলো সই, ওলো সই।
তোদের আছে মনের কথা,
আমার আছে কই।
আমি কী বলিব, কার কথা,
কোন্ সুখ, কোন ব্যথা–
নাই কথা, তবু সাধ
শত কথা কই।
ওলো সই, ওলো সই…
দুর্বার গান শেষ হতেই শিবানী বন্ধুর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলেন, ইন্টারেস্টিং মেয়ে শিল্পী।
হ্যাঁ, তাইতো দেখছি।
ভারতী সঙ্গে সঙ্গেই দুর্বাকে বলেন, এবার হামোনিয়াম বাজিয়ে ভাল করে গান শোনাও।
এবার চলুন আমার ঘরে।
সুনন্দা দেবী বলেন, হ্যাঁ, দিদি, আপনারা ওর ঘরে যান। আপনারা ময়নার গান শুনুন। আমি একটু দোকান থেকে ঘুরে আসি।
দুর্বার ঘরে ঢুকে একবার দৃষ্টি ঘুরিয়ে নিয়েই শিবানী বলেন, হ্যাঁ, শিল্পীর ঘর এই রকমই হওয়া উচিত।
হ্যাঁ, শিবানী, তুই ঠিকই বলেছিস। ভারী সুন্দর রুচিসম্পন্ন করে সাজানো।
মাসীমারা, আপনারা আগে বসুন। অত প্রশংসা করার মতো ঘর আমার না। নিছক একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করি।
হ্যাঁ, ওরা দুজনে দুটো বেতের চেয়ারে পাশাপাশি বসতেই দুর্বা হারমোনিয়াম নিয়ে ওর খাটে বসে। বলে, আপনারা বলুন, কি ধরনের গান শুনতে চান।
দুর্বা সঙ্গে সঙ্গে বলে, আমি কিন্তু শুধু রবীন্দ্রনাথের গানই গাইতে পারি।
সকাল থেকেই মেঘ করেছে। দু’এক পশলা বৃষ্টিও ইতিমধ্যে হয়েছে। এখন আবার মেঘ ডাকতে শুরু করেছে। তাই জানলা দিয়ে একবার আকাশের দিকে তাকিয়েই দুর্বা গেয়ে ওঠে।
এসো হে এসো সজল ঘন
বাদল বরিষনে–
বিপুল তব শ্যামল স্নেহে
এসো হে এ জীবনে।
এসো হে গিরিশিখর চুমি,
ছায়ায়ঘিরি কানন ভূমি
গগন ছেয়েএসো হে তুমি
গভীর গরজনে।…
ভারতী বা শিবানী কোন মন্তব্য করার আগেই দুর্বা আবার শুরু করে–
চিত্ত আমার হারালো আজ
মেঘের মাঝখানে–
কোথায় ছুটে চলেছে সে
কোথায়কে জানে।
বিজুলিতার বীণার তারে
আঘাত করে বারে বারে,
বুকের মাঝে বজ্র বাজে
কী মহাতানে।
চিত্ত আমার হারালো আজ
মেঘের মাঝখানে…
গান শেষ হতেই দুর্বা মুখ তুলে ওদের দুজনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, আপনাদের ভাল লাগছে তো?
ভারতী বলেন, অপূর্ব।
শিবানী বলেন, সাধে কী তোমার নাম রেখেছি শিল্পী।
দুর্বা বলে, এবার কি পূজা বা প্রেম পর্যায়ের গান গাইব?
শিবানী বলেন, তুমি এবার প্রেম পর্যায়ের গান শোনাও।
ব্যস! দুর্বা গেয়ে ওঠে–
আকাশে আজ কোন্ চরণের
যাওয়া-আসা।
বাতাসে আজ কোন্ পরশের
লাগে হাওয়া ॥…
ঐ গান শেষ হতেই দূর্বা আবার শুরু করে–
আসা-যাওয়ার পথের ধারে
গান গেয়ে মোর কেটেছে দিন।
যাবার বেলায় দেব কারে
বুকের কাছে বাজল যে বীণ।।
সুরগুলি তার নানা ভাগে
রেখে যাব পুষ্পরাগে,
মীড়গুলি তার মেঘের রেখায়
স্বর্ণলেখায় করব বিলীন।।
আসা-যাওয়ার পথের ধারে,
গান গেয়ে মোর কেটেছে দিন…
গান শেষ হতে না হতেই সুনন্দা ঘরে ঢুকলেন। জিজ্ঞেস করেন, ময়নার গান আপনাদের কেমন লাগছে?
ভারতী বলেন, আপনার ময়নার গান শোনার লোভেই তো সল্টলেক থেকে কসবা এলাম।
শিবানী বলেন, আমি তো ভাবছি, আপনার মেয়েকে তুলে নিয়ে যাই।
সুনন্দা একটু হেসে বলেন, হ্যাঁ, স্বচ্ছন্দে তুলে নিয়ে যান কিন্তু একটা ভাল ছেলের সঙ্গে ওকে সাতপাক ঘুরিয়ে দিতে হবে।
ভারতী প্রশ্ন করেন, সত্যি কি মেয়ের বিয়ে দিতে চান?
একশ বার চাই।
উনি মুহূর্তের জন্য থেমে বলেন, মেয়ের এম. এ. পড়া হয়ে গেল এবার তো মেয়ের বিয়ে দিতেই হবে।
আপনারা পাত্র দেখছেন না?
আসল কথা হচ্ছে, ময়নার বাবাকে কলকাতার একটা আর ফরিদাবাদ হায়দ্রাবাদের দুটো ফ্যাক্টরি দেখতে হয়। উনি মাসে দশ-বারো দিনের বেশি কলকাতাতেই থাকতে পারেন না। তাছাড়া…
তাছাড়া আবার কি?
ময়নার কোন কাকা-জ্যেঠা বা পিসীও নেই যে তারা ওর পাত্রের খোঁজ…
বুঝেছি।
শিবানী সঙ্গে সঙ্গে একটু হেসে বলেন, সুনন্দাদি, আমি কিন্তু ভাল ঘটকালি করতে পারি।
সুনন্দাও হেসে বলেন, ময়নার জন্য ভাল পাত্র দেখে না দিলে কী করে বুঝব আপনি…
ভারতী হাসতে হাসতে বলেন, সুনন্দাদি, ওকে খেপিয়ে দেবেন না। ও হয়তো কালই পাত্র নিয়ে হাজির হবে।
ওনার কথায় সুনন্দা না হেসে পারেন না।
দুর্বা হাসতে হাসতে শিবানীকে বলে, মাসীমা, আপনি কোন ছেলের হয়ে আমাকে দেখতে বা পরীক্ষা নিতে আসেন নি তো?
এইসব গোপনকথা তোমাকে বলব কেন?
যাইহোক আরো প্রায় ঘণ্টা দুয়েক গল্পগুজব, হাসি ঠাট্টা, খাওয়া-দাওয়ার পর—
সুনন্দা, তুমি ময়নাকে নিয়ে কবে আমাদের ওখানে আসছো?
ভারতীদি, এখন ময়না একদিন তোমাদের ওখান থেকে ঘুরে আসুক। ময়নার বাবা ফিরলে আমি নিশ্চয়ই যাব।
ঠিক তো?
হ্যাঁ, ভারতীদি, সত্যি আমি যাব।
শিবানী বলেন, ভারতী, তোমার মেয়েকে কিন্তু আমাদের ওখানে সারাদিন কাটাতে হবে। সন্ধ্যের পর আমরাই ওকে পৌঁছে দিয়ে যাব।
না, না, তার দরকার হবে না।
দুর্বা একটু হেসে বলে, মাসীমা, আমার দুই বন্ধু সল্টলেকে থাকে। আমি তো একলাই ওদের ওখানে যাতায়াত করি।
ভারতী বলেন, দুর্বা, তুমি কবে যাবে আমাদের ওখানে?
আমি তো এখন বেকার। যেদিন বলবেন, সেইদিনই যেতে পারি কিন্তু উইক ডে-তে তো আপনাদের কলেজ আছে।
সে চিন্তা তোমাকে করতে হবে না। তুমি পরশু যেতে পারবে?
হ্যাঁ, পারবো।
তাহলে ঠিক ন’টার মধ্যে আমি বা শিবানী এসে তোমাকে নিয়ে যাব।
মাসীমা, প্লীজ, আপনাদের কাউকে…
প্লীজ ডোন্ট আর্গু দুর্বা! আমি বা শিবানী এসে তোমাকে নিয়ে যাব, দ্যাটস ফাইন্যাল।
দুর্বা শুধু হাসে।
ওরা দুজনেই সুনন্দার দুটি হাত ধরে বলেন, তোমাদের কাছে এসে সত্যি খুব আনন্দ পেলাম।
তোমাদেরও আমার খুব ভাল লেগেছে।
দুর্বাকে দু’জনেই বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে আদর করলেন, স্নেহচুম্বন দিলেন কপালে।
দুর্বাও ওদের প্রণাম করে।
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে একটু এগুতে না এগুতেই ভারতী এক গাল হেসে বলেন, হ্যাঁরে শিবানী, কেমন লাগলো দুর্বাকে?
এত ভাল লেগেছে যে মুখে বলতে পারব না। তুই ঠিকই বলেছিলি; সত্যি মনে হলো, ঈশ্বর যেন নিজের হাতে খোদাই করে ওকে গড়েছেন।