ভাদ্র মাসের সন্ধ্যা। আকাশে মেঘ আছে। লালচে রঙের মেঘ। যে মেঘে বৃষ্টি হয় না, তবে দেখায় অপূর্ব। এই গাঢ় লাল, এই হালকা হলুদ, আবার চোখের নিমিষে লালের সঙ্গে খয়েরি মিশে সম্পূর্ণ অন্য রঙ। রঙের খেলা যিনি খেলছেন মনে হয় তিনি সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন।
শফিক চা খেতে খেতে আকাশের রঙের খেলা দেখছে। সে চা খাচ্ছে ধানমণ্ডি দশ নম্বর রোডের মাঝখানে একটা চায়ের দোকানে। অস্থায়ী দোকান ছিল, এখন মনে হয় স্থায়ী হয়ে গেছে। হালকা-পাতলা শিরিষ গাছের পাশে দোকান। শিরিষ গাছের মধ্যে তেজিভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। সে আকাশ স্পর্শ করার স্পর্ধা নিয়ে বড় হচ্ছে।
শফিক চা শেষ করে পকেটে হাত দিয়ে দেখে মানিব্যাগ আনে নি। এরকম ভুল তার সচরাচর হয় না। তার আরেক কাপ চা খেতে ইচ্ছা করছে। চায়ের সঙ্গে সিগারেট। শফিক মনস্থির করতে পারছে না। সঙ্গে মানিব্যাগ নেই—এই তথ্য দোকানিকে আগে দেবে, নাকি চা-সিগারেট খেয়ে তারপর দেবে!
শফিকের হাতে বিভূতিভূষণের একটা উপন্যাস। উপন্যাসের নাম ইছামতি। বইটির দ্বিতীয় পাতায় শফিক লিখেছে—‘অবন্তিকে শুভ জন্মদিন’। বইটা নিয়ে শফিক ব্রিত অবস্থায় আছে। বইটা অবন্তিকে সে দিবে, নাকি ফেরত নিয়ে যাবে? এখন কেন জানি মনে হচ্ছে ফেরত নেওয়াই ভালো।
অবন্তির বয়স ষোল। সে ভিকারুননিসা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়ে। শফিক তাকে বাসায় অংক শেখায়। আজ অবন্তির জন্মদিন। জন্মদিনের অনুষ্ঠানে শফিককে বলা হয় নি। অবন্তি শুধু বলেছে, তের তারিখ আপনি আসবেন না। ওইদিন আমাদের বাসায় ঘরোয়া একটা উৎসব আছে। আমার জন্মদিন।
শফিক বলেছে, ও আচ্ছা!
অবন্তি বলেছে, জন্মদিনে আমি আমার কোনো বন্ধুবান্ধবকে ডাকি না। দাদাজান তার বন্ধুবান্ধবকে যেতে বলেন।
শফিক আবারও বলেছে, ও আচ্ছা।
অবন্তি বলেছে, আপনাকে জন্মদিনে নিমন্ত্রণ করা হয় নি, এই নিয়ে মন খারাপ করবেন না।
শফিক তৃতীয়বারের মতো বলল, ও আচ্ছা। শেষবারে ‘ও আচ্ছা’ না বলে বলা উচিত ছিল ‘মন খারাপ করব না’।
যে উৎসবে শফিকের নিমন্ত্রণ হয় নি, সেই উৎসব উপলক্ষে উপহার কিনে নিয়ে যাওয়া অস্বস্তির ব্যাপার। শফিক ঠিক করে রেখেছে বইটা অবন্তিদের বাড়ির দারোয়ানের হাতে দিয়ে আসবে। সমস্যা একটাই—দারোয়ান সবদিন থাকে না। গেট থাকে ফাঁকা। তবে আজ যেহেতু বাড়িতে একটা উৎসব, দারোয়ানের থাকার কথা।
শফিক দোকানির দিকে তাকিয়ে বলল, মানিব্যাগ আনতে ভুলে গেছি। আপনার টাকাটা আগামীকাল ঠিক এই সময় দিয়ে দিব। চলবে?
দোকানি কোনো জবাব দিল না। সে গরম পানি দিয়ে কাপ ধুচ্ছে। তার চেহারার সঙ্গে একজন বিখ্যাত মানুষের চেহারার সাদৃশ্য আছে। মানুষটা কে মনে পড়ছে না। দোকানির সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলে হয়তো মনে পড়বে। শফিক অস্বস্তির সঙ্গে বলল, আমাকে আরেক কাপ চা খাওয়ান, আর একটা ক্যাপস্টান সিগারেট। আগামীকাল ঠিক এই সময় আপনার সব টাকা দিয়ে দেব।
দোকানি কাপ ধোয়া বন্ধ রেখে শফিকের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে হয় সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। দোকানির চোখের চাউনি দেখে শফিক নিশ্চিত হলো, তার চেহারা আমেরিকান প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনের মতো। আব্রাহাম লিংকন লম্বা, আর এ বেঁটে। বেঁটে আব্রাহাম লিংকন। উইলিয়াম বুথ এই আব্রাহাম লিংকনকে গুলি করলে গুলি লাগত না। মাথার ওপর দিয়ে চলে যেত।
দোকানি বলল, আমার হাত ভিজা, আপনে বৈয়ম খুইলা ছিরগেট নেন।
ভাদ্র মাসের লাল মেঘে বৃষ্টি পড়ার কথা না, কিন্তু বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। ফোটা ঘন হয়ে পড়ছে। আশ্চর্যের কথা, ব্যাঙ ডাকছে। আশপাশে ডোবা নেই যে ব্যাঙ থাকবে। ধানমণ্ডি লেকের কোনো ব্যাঙ কি রাস্তায় নেমে এসেছে? বর্ষায়। কই মাছ পাড়া বেড়াতে বের হয়, ব্যাঙরা কি বের হয়?
শফিক ইছামতি বইটা সিগারেটের বৈয়মের ওপর রেখে চায়ের গ্লাস হাতে নিয়েছে।
দোকানি বলল, আপনে ভিজতেছেন কী জন্যে? চালার নিচে খাড়ান। ভাদ্র মাসের বৃষ্টি আসে আর যায়। এক্ষণ বৃষ্টি থামব। আসমানে তারা ফুটব।
শফিক দোকানির পাশে বসেছে। সিগারেট ধরিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। চায়ের দোকানের সামনে কালো রঙের একটা কুকুর এসে দাঁড়িয়েছে। কুকুরটা প্রকাণ্ড। দেশি কুকুর এত বড় হয় না।
দোকানি বলল, কুত্তার শইলটা দেখছেন? হালা ডোম্বা জোয়ান।
শফিক বলল, হুঁ। বিরাট।
বড়লোকের কুত্তার সাথে দেশি কুত্তি সেক্স করছে বইলা এই জিনিসের পয়দা হইছে। দেখলে ভয় লাগে।
দোকানি বৈয়াম খুলে একটা টোস্ট বিস্কুট ছুড়ে দিল। কুকুর বিস্কুট কামড়ে ধরে চলে গেল। সে মনে হয় টোস্ট বিস্কুটের বিষয়ে আগ্রহী না। কিংবা ক্ষুধা নেই। ক্ষুধার্ত কুকুর এইখানেই কচকচ করে বিস্কুট খেত, আড়ালে চলে যেত না।
দোকানি বলল, প্রত্যেক দিন সন্ধ্যায় এই ডোম্বা কুত্তা আহে। এরে একটা বিস্কুট দেই, মুখে নিয়া চইল্যা যায়। ঠিক করছি কুত্তাটারে ভালোমতো একদিন খানা দিব। গো-ভাত।
শফিক বলল, আপনার চেহারার সঙ্গে অতি বিখ্যাত একজন মানুষের চেহারার মিল আছে। নাম আব্রাহাম লিংকন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ছিলেন।
দোকানি বলল, গরিবের আবার চেহারা কী? আপনার নাম কী?
গরিবের নামও থাকে না। বাপ-মা কাদের বইল্যা ডাকে। আমার নাম কাদের মোল্লা। নামের শেষে ‘মোল্লা’ কেন লাগাইছে আমি জানি না। নামাজের ধারেকাছে নাই। মাকুন্দা মানুষ। থুতনিতে একগাছা দাড়িও নাই, নাম হইছে মোল্লা!
ছাতা মাথায় কে যেন এগিয়ে আসছে। অল্প বৃষ্টিতেই পানি জমে গেছে। লোকটা পানিতে ছপ ছপ শব্দ করতে করতে আসছে। শফিক আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। দূর থেকে মানুষটাকে চেনা চেনা লাগছে, কিন্তু পুরোপুরি চেনা যাচ্ছে না। আজকাল শফিকের এই সমস্যা হচ্ছে, প্রথম দর্শনেই কাউকে সে চিনতে পারছে না।
মাস্টার সাব, এইখানে কী করেন?
অবন্তিদের বাড়ির দারোয়ান কালাম ছাতা মাথায় দোকানের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মনে হয় বিড়ি কিনতে এসেছে। শফিক ব্ৰিত গলায় বলল, বৃষ্টিতে আটকা পড়েছি।
কালাম বলল, ঘরে আসেন। ঘরে আইসা বসেন।
শফিক বলল, ঘরে যাব না। তুমি অবন্তিকে এই বইটা দিয়ে। তার জন্মদিনের উপহার। বই দিতে এসে বৃষ্টিতে আটকা পড়েছি। বইটা সাবধানে নিয়ো, বৃষ্টিতে যেন ভিজে না। তোমার আপার হাতেই দিয়ো।
কালাম গলা নামিয়ে বলল, বই আফার হাতেই দিব। আপনি টেনশান কইরেন না। বলেই সে চোখ টিপ দেওয়ার ভান করল। শফিকের গা জ্বলে গেল। একবার ইচ্ছা করল বলে, ‘চোখ টিপ দিলে কেন?’ শফিকের অনেক কিছু বলতে ইচ্ছা করে, শেষ পর্যন্ত বলা হয় না।
কালাম বই হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যাচ্ছে না। সে দুই শলা সিগারেট কিনতে এসেছে, মাস্টারের সামনে কিনতে পারছে না। শফিক উঠে দাঁড়াল। বৃষ্টি থামার জন্যে অপেক্ষা করা অর্থহীন, এই বৃষ্টি থামবে না।
ভয়ঙ্কর কালো কুকুরটা আবার উদয় হয়েছে। সে যাচ্ছে শফিকের পেছনে পেছনে। শফিক কয়েকবার বলল, এই, যা বললাম, যা! লাভ হলো না। পানিতে ছপ ছপ শব্দ তুলে কুকুর পেছনে পেছনে আসছেই। হঠাৎ ছুটে এসে পা কামড়ে ধরবে না তো? শফিক হাঁটার গতি বাড়াল। কুকুরও তা-ই করল। ভালো যন্ত্রণা তো!
অবন্তির দাদা সরফরাজ খানের হাতে ইছামতি বই। দারোয়ান বইটা সরাসরি তার হাতে দিয়েছে। তিনি প্রথমে পাতা উল্টিয়ে দেখলেন, লুকানো কোনো চিঠি আছে কি না। বদ প্রাইভেট মাস্টারেরা বইয়ের ভেতর লুকিয়ে প্রেমপত্র পাঠায়। অতি পুরনো টেকনিক। চিঠি পাওয়া গেল না। বইটা তিনি ড্রয়ারে লুকিয়ে রাখলেন। আগে নিজে পড়ে দেখবেন। বইয়ের লেখায় কোনো ইঙ্গিত কি আছে? হয়তো দেখা যাবে এক প্রাইভেট মাষ্টারকে নিয়ে কাহিনি। বড়লোকের মেয়ের সঙ্গে তার প্রণয় হয়। বাড়ি থেকে পালিয়ে সেই মেয়ে মাস্টারকে বিয়ে করে। তাদের সুখের সংসার হয়। গল্প-উপন্যাস হলো অল্পবয়েসী মেয়েদের মাথা খারাপের মন্ত্র। তার মতে, দেশে এমন আইন থাকা উচিত যেন বিয়ের আগে কোনো মেয়ে ‘আউট বই পড়তে না পারে। বিয়ের পরে যত ইচ্ছা পড়ুক। তখন মাথা খারাপ হলে সমস্যা নাই। মাথা খারাপ ঠিক করার লোক আছে। স্বামীর সঙ্গে আদর সোহাগে একটা রাত পার করলেই মাথা লাইনে চলে আসবে।
সরফরাজ খান ইজিচেয়ারে আধশোয়া হয়ে আছেন। নাতনির জন্মদিনের নিমন্ত্রিত অতিথিরা এখনো কেউ আসে নি। যেভাবে বৃষ্টি নামছে কেউ আসবে কি
কে জানে! রাতেরবেলা এমনিতেই কেউ বের হতে চায় না। দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি শোচনীয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যে অস্ত্র মানুষের হাতে চলে গিয়েছিল তা সব উদ্ধার হয় নি। দিনদুপুরেই ডাকাতি-ছিনতাই হচ্ছে। যাদের হাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কথা, তাদের কেউ কেউ ডাকাতি-ছিনতাইয়ে নেমেছে। সরফরাজ খানের মনে হলো, ভারতের সেনাবাহিনীকে এত তাড়াতাড়ি বিদায় করা ভুল হয়েছে। এরা থাকত আরও কিছুদিন।
সরফরাজ গলা উঁচিয়ে এ বাড়ির একমাত্র কাজের মেয়ে রহিমাকে ডাকলেন। রহিমা পনের বছর ধরে এ বাড়িতে আছে। কর্তৃত্ব নিয়ে আছে। যতই দিন যাচ্ছে তার কর্তৃত্ব ততই বাড়ছে। এখন সে মুখে মুখে কথা বলে।
রহিমা এসে দাঁড়াল, মাথায় ঘোমটা দিতে দিতে বলল, কী বলবেন ‘তাড়াতাড়ি বলেন। পাক বসাইছি। বুড়া গরুর মাংস আনছে, সিদ্ধ হওনের নাম নাই।
সরফরাজ বললেন, এখন থেকে মাস্টার যতক্ষণ অবন্তিকে পড়াবে তুমি সামনে বসে থাকবে।
এইটা কেমন কথা! আমার কাইজকাম কে করব?
সরফরাজ কঠিন গলায় বললেন, এ বাড়িতে আমি আর অবন্তি এই দুজন মানুষ। এত কাজকর্ম কোথায় দেখলে? শুধু বাড়তি কথা।
রহিমা বলল, দুইজন মানুষ এইটা কী বললেন? আমরারে মানুষের মধ্যে ধরেন না? আমি আছি, ডেরাইভার ভাই আছে, দারোয়ান আছে। সবের পাক এক চুলায় হয়। পাঁচজন মানুষ। আপনের কথা শেষ হইছে? এখন যাব?
অবন্তি কোথায়?
আফা ছাদে।
বৃষ্টির মধ্যে সে ছাদে কী করে?
এইটা আফারে জিগান। আমি ক্যামনে বলব! যে আসামি সে জবানবন্দি দিবে, আমি আসামি না। আমি বৃষ্টির মধ্যে ছাদে যাই নাই।
কথাবার্তা হিসাব রেখে বলবে। এখন যাও, অবন্তিকে আমার কাছে পাঠাও। আর যে কথা প্রথম বললাম, অবন্তি যখন তার মাস্টারের কাছে পড়বে তুমি উপস্থিত থাকবে। প্রতিদিন থাকতে হবে না। মাঝে মাঝে আমি থাকব।
তাদের মধ্যে কোনো ঘটনা কি ঘটেছে?
জানি না। ঘটতে পারে। সাবধান থাকা ভালো। তুমি টেবিলের নিচে তাদের পায়ের দিকে লক্ষ রাখবে। পায়ে পায়ে ঠোকাঠুকি দেখলেই বুঝবে ঘটনা ঘটেছে। এরকম কিছু চোখে পড়লে মাস্টারকে কানে ধরে বিদায় করব। বদ কোথাকার!
অবন্তি ছাদে হাঁটছে, তবে বৃষ্টিতে ভিজছে না। তার গায়ে নীল রঙের রেইনকোট। এই রেইনকোট তার মা ইসাবেলা স্পেন থেকে গত বছর পাঠিয়েছিলেন। জন্মদিনের উপহার। এ বছরের জন্মদিনের উপহার এখনো এসে পৌঁছায় নি। তবে জন্মদিন উপলক্ষে লেখা চিঠি এসে পৌঁছেছে। অবন্তি সেই চিঠি এখনো পড়ে নি। রাতে ঘুমুতে যাওয়ার সময় পড়বে। ইসাবেলা তার মেয়েকে বছরে দুটা চিঠি পাঠান। একটা তার জন্মদিনে, আরেকটা খ্রিসমাসে।
অবন্তিদের ছাদ ঝোঁপঝাড়ে বোঝাই এক জংলি জায়গা। তার দাদি জীবিত থাকা অবস্থায় ছাদে বড় বড় টব তুলে নানান গাছপালা লাগিয়েছিলেন। তিনি নিয়মিত ছাদে আসতেন, গাছগুলির যত্ন নিতেন। তার মৃত্যুর পর অবন্তি ছাদে আসে। কিন্তু টবের গাছে পানি দেয় না। গাছগুলি নিজের মতো বড় হয়েছে। কিছু মরে গেছে। কিছু টবে আগাছা জন্মেছে। একটা কামিনীগাছ হয়েছে বিশাল। বর্ষায় ফুল ফোটে। সেই গা তীব্র। আজ অবশ্যি কামিনী ফুলের গন্ধ পাওয়া যায় না। এমন কি হতে পারে কিছু বিশেষ দিনে কামিনী ফুল গন্ধ দেয় না!
ছাদের রেলিংয়ের একটা অংশ ভাঙা। অবন্তি মাঝে মাঝেই রেলিংয়ের ভাঙা অংশে দাঁড়ায়। সে ঠিক করে রেখেছে, কোনো-একদিন সে এখান থেকে নিচে ঝাঁপ দেবে। ঝাঁপ দিয়ে যেখানে পড়বে সে জায়গাটা বাধানো। কাজেই তার মৃত্যুর সম্ভাবনা আছে। আজ সে ঝাঁপ দেবে না বলেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিচে নেমে এল। রহিমা বলল, আপনেরে দাদা ডাকে। মনে হয় কোনো জটিল কথা বলবে।
অবন্তি তার দাদাজানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, দাদাজান, জটিল কথা কিছু বলবে?
সরফরাজ নাতনির দিকে তাকিয়ে প্রবল দুঃখবোধে আপ্লুত হলেন। মেয়েটা পৃথিবীর সব রূপ নিয়ে চলে এসেছে। অতি রূপবতীদের কপালে দুঃখ ছাড়া কিছু থাকে না। তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস চাপতে চাপতে বললেন, হুঁ, বলব।
উপদেশমূলক কথা? জন্মদিনে উপদেশমূলক কথা শুনতে ভালো লাগে না।
কী ধরনের কথা শুনতে ভালো লাগে?
মজার কোনো কথা।
সরফরাজ বিরক্ত গলায় বললেন, আমি তো মজার কোনো কথা জানি না।
অবন্তি বলল, আমি জানি। আমি বলি তুমি শোনো—
আমার মার নাম স্পেনের রানি ইসাবেলার নামে। রানি ইসাবেলা সারা জীবনে দু’বার মাত্র স্নান করেছেন।
সরফরাজ বললেন, এটা তো মজার গল্প না। নোংরা থাকার গল্প।
অবন্তি বলল, রানি ইসাবেলা যখন দরবারে যেতেন তখন পোশাক পরতেন। বাকি সময় নগ্ন ঘোরাফেরা করতেন। গায়ে কাপড় লাগলে গা কুটকুট করত এই জন্যে।
সরফরাজ হতভম্ব গলায় বললেন, এই গল্প তোমাকে কে বলেছে? মাস্টার।
উনি এই গল্প কেন করবেন? মা চিঠিতে লিখেছেন। মা চিঠিতে মজার কথা লেখেন।
সরফরাজ কঠিন গলায় বললেন, যে চিঠিতে এই গল্প আছে সেই চিঠি আমাকে পড়তে দিবে।
কেন?
আমার ধারণা কোনো চিঠিতে এমন কথা তোমার মা লিখে নাই। এই নোংরা গল্প অন্য কেউ তোমার সঙ্গে করেছে। বুঝেছ?
অবন্তি হাসল।
সরফরাজ বললেন, হাসছ কেন? তোমার এই গল্প আমি সিরিয়াসলি নিয়েছি।
অবন্তি বলল, তুমি সবকিছুই সিরিয়াসলি নাও। আমার বিষয়ে তোমাকে এত ভাবতে হবে না।
তোমার বিষয়ে কে ভাববে?
আমার বিষয়ে ভাবার লোক আছে।
লোকটা কে?
তোমাকে বলব না, তবে রানি ইসাবেলা সম্পর্কে আরেকটা কথা বলব।
ওই নোংরা বেটির কোনো কথা শুনব না।
কথাটা শুনলে অবাক হবে।
তোমার সঙ্গে থাকা মানেই ঘণ্টায় ঘণ্টায় অবাক হওয়া। আর অবাক হতে চাচ্ছি না।
ঘনঘন অবাক হলে লিভারের ফাংশান ভালো থাকে। তোমার লিভার ফাংশান ভালো থাকা দরকার।
সরফরাজ বিরক্ত গলায় বললেন, কী বলবে বলে ঝামেলা শেষ করো।
অবন্তি বলল, আমেরিকার প্রথম ডাকটিকিটে যে ছবি ছাপা হয়েছিল সেই ছবি রানি ইসাবেলার।
সরফরাজ জবাব দেওয়ার আগেই দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। নিমন্ত্রিত অতিথিদের কেউ মনে হয় এসেছেন। অবন্তি গেল দরজা খুলতে।
প্রথম অতিথির নাম খালেদ মোশাররফ। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। অবন্তির বাবার বন্ধু। তারা স্কুলজীবনে একসঙ্গে দাড়িয়াবান্দা খেলতেন। খালেদ মোশাররফের ফুসফুসের জোর ছিল অসাধারণ। কুঁ ডাক দিয়ে তিন মিনিট ধরে থাকা সহজ ব্যাপার না।
অবন্তি মা! কেমন আছ?
ভালো আছি চাচ্চু।
আজ তোমাকে অন্য দিনের চেয়ে একটু বেশি সুন্দর লাগছে। এর কারণ কী মা?
চাচ্চু! আপনি যখনই আসেন এই কথা বলেন।
খালেদ মোশাররফ বললেন, আমি মিলিটারি মানুষ। যা দেখি তা-ই বলি। আমি তো বানিয়ে বানিয়ে বলতে পারি না, অবন্তিকে আজ অন্যদিনের চেয়ে একটু কম সুন্দর লাগছে।
মিলিটারিরা কি সবসময় সত্যি কথা বলে?
না রে মা। যখন যুদ্ধক্ষেত্রে থাকে তখন অবশ্যই বলে। যুদ্ধের সময় মিথ্যা বলার সুযোগ থাকে না। ভালো কথা, তোমার বাবার কোনো খবর কি পাওয়া গেছে?
না।
মানুষটা কি হারিয়েই গেল? আশ্চর্য!
অবন্তি বলল, বাবার বিষয়ে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কিছুদিন পর পর ডুব দেওয়া তার স্বভাব।
সরফরাজ ভেতর থেকে বললেন, কে এসেছে? খালেদ?
অবন্তি বলল, হ্যাঁ দাদাজান। জন্মদিনের পার্টি এখন শুরু হলো।
খালেদ মোশাররফ বললেন, জন্মদিন নাকি? কার জন্মদিন?
অবন্তি অবলীলায় বলল, দাদাজানের।
আগে জানলে তো কিছু-একটা নিয়ে আসতাম।
অবন্তি বলল, এখনো সময় আছে। চট করে কিছু-একটা নিয়ে আসুন। শুধু ফুল আনবেন না। দাদাজান ফুল পছন্দ করেন না।
খালেদ মোশাররফ বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সরফরাজ বললেন, কে এসেছে?
অবন্তি বলল, যে এসেছে সে চলেও গেছে।
সরফরাজ বললেন, তার মানে? ওই শোনো জিপ স্টার্ট দেওয়ার শব্দ। জিপ নিয়ে চলে যাচ্ছেন।
সরফরাজ হতভম্ব গলায় বললেন, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আশ্চর্য!
শফিক তার ঝিগাতলার বাসার বারান্দায় কেরোসিনের চুলায় ভাত বসিয়েছে। দুপুরের ডাল রয়ে গেছে। রাতে ডালের সঙ্গে ডিম ভাজা করা হবে। ডাল থেকে টক গন্ধ আসছে। মনে হয় নষ্ট হয়ে গেছে। গরমে নষ্ট হয়ে যাওয়ারই কথা। শফিক ঠিক করল এখন থেকে বাড়তি কিছু রান্না হবে না। যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই রাঁধবে।
বাজারে চাল পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশের মানুষ একবেলা রুটি খাচ্ছে। শফিক রুটি খেতে পারে না। রুটি বানানোও ঝামেলা। আটা দিয়ে কাই বানাও, বেলুন দিয়ে রুটি বেলো, তাওয়ায় সেঁকো। মেলা দিগদারি।
সবচেয়ে ভালো হয় রাধানাথ বাবুর মতো একবেলা খাওয়ার অভ্যাস করলে। তিনি সূর্য ডোবার সামান্য আগে একবেলা খান। তাতে যদি তাঁর সমস্যা না হয় শফিকের কেন হবে! রাধানাথ বাবু এখন একটা বই লিখছেন—রবীন্দ্রনাথ এবং বৌদ্ধধর্ম। তার নানান রকম অদ্ভুত অদ্ভুত তথ্য দরকার হয়। শফিকের ওপর দায়িত্ব পড়ে তথ্য অনুসন্ধানের। শফিককে তিনি মাগনা খাটান না। প্রতিটি তথ্যের জন্যে কুড়ি টাকা করে দেন। রাধানাথ বাবুর কাছে শফিকের চল্লিশ টাকা পাওনা হয়েছে। রাধানাথ বাবু বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ কোনো-এক জায়গায় জীবন এবং মৃত্যুকে রমণীর দুই স্তন হিসেবে ভেবেছেন। আমার কিছুই মনে পড়ছে না। তুমি খুঁজে বের করতে পারলে চল্লিশ টাকা দেব। রবীন্দ্র রচনাবলী প্রথম পৃষ্ঠা থেকে পড়া শুরু করো।
শফিক আজই খুঁজে পেয়েছে। কাল সকালে যাবে, টাকাটা নিয়ে আসবে। তার হাত একেবারেই খালি। হাত খালি থাকলে তার অস্থির লাগে। মনে হয় পায়ের নিচে মাটি নেই, চোরাবালি। চোরাবালিতে সে ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছে। যাই হোক, কাল টাকা পাওয়া যাবে। চোরাবালি থেকে মুক্তি।
রাধানাথ বাবুর কবিতার লাইন দুটি আছে নৈবেদ্য কাব্যগ্রন্থে। কবিতার নাম মৃত্যু।
স্তন হতে তুলে নিলে কাদে শিশু ডরে,
মুহূর্তে আশ্বাস পায় গিয়ে স্তনান্তরে।
ভাত হয়ে গেছে। ডিম ভাজা গেল না। একটাই ডিম ছিল, সেটা পচা বের হয়েছে। শফিক টকে যাওয়া ডাল দিয়ে খেতে বসল। কয়েক নলার বেশি খাওয়া গেল না। শরীর উল্টে আসছে। আজকের ডালমাখা ভাত অবশ্যি নষ্ট হবে না। বিশাল কুকুরটা তার পেছনে পেছনে এসে মেঝেতে থাবা গেড়ে বসে আছে। সে নিশ্চয় ক্ষুধার্ত। এত বড় শরীরের জন্যে প্রচুর খাদ্য দরকার।
শফিক ডাল মাখানো ভাত উঠানে ঢেলে দিল। কী আগ্রহ করেই না কুকুরটা খাচ্ছে! ঘরে একটা টিনের থালা থাকলে থালায় ভাত দেওয়া যেত। পশুপাখিরাও তো কিছুটা সম্মান আশা করতে পারে। শফিক বলল, এই তোর নাম কী?
কুকুরটা মাথা তুলে তাকিয়ে আবার খাওয়ায় মন দিল।
শফিক বলল, আমি তোর নাম দিলাম কালাপাহাড়। ঐতিহাসিক চরিত্র। নাম পছন্দ হয়েছে?
কুকুর এইবার ঘেউ শব্দ করল। মনে হয় নাম পছন্দ হয়েছে।
শফিক বলল, খাওয়াদাওয়া করে চলে যা। আমি খুবই গরিব মানুষ। ডালটা নষ্ট না হলে আমিই খেতাম। তোকে দিতাম না। আমার অবস্থান তোর চেয়ে খুব যে ওপরে তা কিন্তু না।
কালাপাহাড় আরেকবার ঘেউ করে শুয়ে পড়ল। তার ডিনার শেষ হয়েছে। ঝড়বৃষ্টির রাতে সে আর বের হবে না। এখানেই থাকবে। একজন প্রভু পাওয়া গেছে, এই আনন্দেও সে মনে হয় খানিকটা আনন্দিত। মানুষ এবং পশু শুধু যে বন্ধু খোঁজে তা না, তারা প্রভুও খোঁজে।
অবন্তি মায়ের চিঠি নিয়ে শুয়েছে। খাম খুলেই সে প্রথমে গন্ধ শুকল। তার মা চিঠিতে দু’ ফোঁটা পারফিউম দিয়ে খাম বন্ধ করেন। গন্ধের খানিকটা থেকে যায়।
আজকের গন্ধটা অদ্ভুত। চা-পাতা চা-পাতা গন্ধ। মা’র কাছ থেকে এই পারফিউমের নাম জানতে হবে। অবন্তি চিঠি পড়তে শুরু করল–
শুভ জন্মদিন অবন্তি মা,
তুমি তোমার যে ছবি পাঠিয়েছ, এই মুহূর্তে তা আমার লেখার টেবিলে। আমি প্রবল ঈর্ষা নিয়ে ছবিটির দিকে তাকাতে তাকাতে তোমাকে লিখছি। তুমি আমার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর হয়ে পৃথিবীতে এসেছ। তোমার মতো বয়সে সবাই আমাকে ডাকত ‘Flower’। তোমার নাম আমি দিলাম ‘স্বর্গের পুষ্প’। একটাই ক্রটি–তোমার চোখ আমার চোখের মতো নীল হয় নি। তুমি তোমার বাবার কালো চোখ পেয়েছ। ভালো কথা, তোমার বাবার সঙ্গে কি তোমার কোনো যোগাযোগ হয়েছে। আশ্চর্যের ব্যাপার, মানুষটা কি শেষ পর্যন্ত হারিয়েই গেল?
তুমি চিঠিতে তোমার এক গৃহশিক্ষকের কথা লিখেছ। তুমি কি এই যুবকের প্রেমে পড়েছ? চট করে কারও প্রেমে পড়ে যাওয়া কোনো কাজের কথা না। অতি রূপবতীদের কারও প্রেমে পড়তে নেই। অন্যেরা তাদের প্রেমে পড়বে, তা-ই নিয়ম।
এখন আমি তোমার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা জানতে চাচ্ছি। তুমি কি আসবে আমার এখানে?
যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি হতদরিদ্র দেশে পড়ে থাকার কোনো মানে হয় না। তোমার বৃদ্ধ দাদাজানকে সঙ্গ দেওয়ার জন্যে দেশে পড়ে থাকতে হবে—এটা কোনো কাজের কথা না। তোমার জীবন তোমার একারই। এক বৃদ্ধকে সেখানে জড়ানোর কিছু নেই। সে বরং একটা কমবয়সী মেয়ে বিয়ে করুক। একজন বৃদ্ধের সঙ্গে তোমার বাস করাকেও আমি ভালো চোখে দেখছি না। সেক্স-ডিজাইভড় বৃদ্ধরা নানান কুকাণ্ড করে। আমি তোমাকে নিয়ে চিন্তায় আছি।
লুইসের সঙ্গে আমার ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। আমি একা বাস করছি। লুইসের কারণে আমি অনেক টাকার মালিক হয়েছি। ঠিক করেছি সমুদ্রের কাছে একটা ভিলা কিনে বাস করব। তুমি আমার সঙ্গে এসে থাকতে পারো। মা-মেয়ে সুখে জীবন পার করে দেব।
তোমার জন্মদিন উপলক্ষে পারফিউমের একটা সেট পাঠালাম। তোমার ষোল বছর হয়েছে বলে যোলটা পারফিউম। এর মধ্যে তোমার কাছে সবচেয়ে ভাললাটার নাম আমাকে লিখে পাঠাবে। যদি আমার পছন্দের সঙ্গে মিলে যায় তাহলে পুরস্কার আছে।
মা, তুমি ভালো থেকো। প্রায়ই তোমাকে নিয়ে আমি ভয়ংকর স্বপ্ন দেখি, আমার অস্থির লাগে।
ইসাবেলা
মেঘ কেটে আকাশে চাঁদ উঠেছে। ভাদ্র মাসে চাঁদের আলো সবচেয়ে প্রবল হয়। চারদিকে পানি জমে থাকে বলে চাঁদের আলো প্রতিফলিত হয়ে ভাদ্রের চন্দ্র-রাত আলোময় হয়।
শফিক বারান্দায় কাঠের বেঞ্চে বসে আছে। বৃষ্টিভেজা উঠান চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে। এই রূপ শফিককে স্পর্শ করছে এরকম মনে হচ্ছে না। সে ক্ষুধায় অস্থির। ক্ষুধার সময় দেবতা সামনে এসে দাঁড়ালে তাঁকেও নাকি খাদ্যদ্রব্য মনে হয়।
কালো কুকুরটা এখনো আছে। শফিক বেঞ্চে বসামাত্র সে উঠে এসে বেঞ্চের নিচে ঢুকে পড়ল। একথালা টকে যাওয়া ডালমাখা ভাত খেয়ে সে কৃতজ্ঞতায় অস্থির হয়ে আছে।
শফিক ডাকল, কালাপাহাড়! এই কালাপাহাড়!
কালাপাহাড় সাড়া দিল। বেঞ্চের নিচ থেকে মাথা বের করে তাকাল শফিকের দিকে। শফিক বলল, কুকুর হয়ে জন্মানোর একটা সুবিধা আছে। খুব ক্ষুধার্ত হলে ডাস্টবিন ঘাটাঘাটি করলে কিছু-না-কিছু পাওয়া যায়। মানুষের এই সুবিধা নেই।
কালাপাহাড় বিচিত্র শব্দ করল। শফিকের কেন জানি মনে হলো কুকুরটা তার কথা বুঝতে পেরে জবাব দিয়েছে। শফিকের হঠাৎ করেই গায়ে কাঁটা দিল।
শফিকের মা জোবেদা খানমের একটা পোষা কুকুর ছিল। জোবেদা খানম কুকুরটাকে ‘কপালপোড়া’ বলে ডাকতেন। কেউ তার গায়ে গরম ভাতের মাড় ফেলে কপাল পুড়িয়ে দিয়েছিল। কুকুরটা জোবেদা খানমের সঙ্গে কথা বলত এবং ভদ্রমহিলার ধারণা তিনি কুকুরের সব কথা বুঝতে পারতেন।
শফিক দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ভাবল, আমার মা স্ফিজিওফ্রেনিয়ার রোগী ছিলেন। এইসব রোগীর ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটে।
আসলেই কি তাই? নাকি অন্যকিছু? জগৎ অতি রহস্যময়। হয়তো তার মা সত্যি সত্যি পশুপাখির কথা বুঝতেন।
এক শ্রাবণ মাসের কথা। গভীর রাত। ঝুপ ঝুপ করে বৃষ্টি পড়ছে। জোবেদা শফিককে ডেকে তুলে বললেন, বাবা! হারিকেন আর ছাতি নিয়ে একটু আগা তো।
শফিক অবাক হয়ে বলল, কোথায় যাব?
ঈশ্বরগঞ্জ থেকে তোর বাবা আসছে। কাঠের পুলের কাছে এসে ভয় পাচ্ছে। তোর বাবাকে একটু কষ্ট করে নিয়ে আয়।
শফিক বলল, বাবা এসেছেন—এই খবর তুমি কোথায় পেয়েছ?
কপালপোড়া আমাকে বলেছে।
কুকুরটা তোমাকে বাবার সংবাদ দিয়েছে?
হুঁ।
শফিক শীতল গলায় বলল, এক কাজ করো, কুকুরের গলায় হারিকেন ঝুলিয়ে দাও। সে বাবাকে পুল পার করে নিয়ে আসুক।
জোবেদা খানম ক্ষীণ গলায় অনুনয়ের ভঙ্গিতে বললেন, বাবা! যা-না। মায়ের অনুরোধটা রাখ। মার কথাটা শোন।
শফিক বলল, মা, তোমার কথা আমি এক শ’বার শুনব। কুকুরের কথা শুনব। কুকুরের কথায় ঝড়-বৃষ্টির রাতে কাঠের ব্রিজের কাছে যাব না।
জোবেদা বলল, মানুষটা ভূতের ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। কাঠের ব্রিজ পার হতে পারছে না।
ভূত বলে কিছু নেই মা। ভূত গ্রামের দুর্বল মানুষের কল্পনা। মাথা নেই একটা ভূত কাঠের পুলে বসে থাকে। নিশিরাতে কেউ পুল পার হতে গেলে ধাক্কা দিয়ে নিচে ফেলে দেয়। এইসব হলো গল্প।
জোবেদা বললেন, বাবারে! কয়েকজন তো মারা গেছে।
কয়েকজন না, দুজন মারা গেছে। তারা পা পিছলে খালে পড়ে মরেছে। আমি নিশিরাতে অনেকবার পুল পার হয়েছি। আমি মাথাকাটা ভূত দেখি নাই।
ভূত-প্রেত সবার কাছে যায় না। কারও কারও কাছে যায়।
মা! ঘুমাও তো।
শফিক কাথার নিচে ঢুকে বাক্যালাপের ইতি করল। সেই রাতে তার ভালো ঘুম হলো। ঘুম ভাঙল লোকজনের হইচই চিকারের শব্দে। তার বাবার মৃতদেহ কাঠের পুলের নিচে পাওয়া গেছে। তার হাতে চটের ব্যাগ। ব্যাগে একটা শাড়ি। নিশ্চয়ই তার স্ত্রীর জন্যে কেনা। আর একটা হারমোনিকা।
হারমোনিকা তিনি কেন কিনেছিলেন, কার জন্যে কিনেছিলেন, এই রহস্য ভেদ হয় নি। শফিকের বাবা হারমোনিকা কেনার মানুষ না। তিনি মাওলানা মানুষ।
কিছু রহস্য মানুষ মৃত্যুর সঙ্গে নিয়ে চলে যায়। সেইসব রহস্যের কখনোই কোনো কিনারা হয় না।
হারমোনিকা শফিকের কাছে আছে। কখনো এই বাদ্যযন্ত্রে ফু দেওয়া হয় নি। শফিক ঠিক করে রেখেছে তার জীবনে যদি কখনো গাঢ় আনন্দের ব্যাপার ঘটে, তাহলে সে হারমোনিকায় ফুঁ দেবে।
রাত অনেক হয়েছে। অবন্তি ঘুমাতে গেছে। রহিমা, অবন্তির ঘরে মেঝেতে বিছানা করেছে। অবন্তি একা ঘুমাতে চায়, সরফরাজ খানের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।
রহিমার নানান সমস্যা আছে। সে ঘুমের মধ্যে কথা বলে, হঠাৎ হঠাৎ বিকট শব্দে তার নাক ডাকে। তারচেয়েও বড় সমস্যা হলো, মাঝে মাঝে রহিমা জেগে বসে থাকে। তাকে দেখে তখন মনে হয় সে কাউকে চিনতে পারছে না। এই সময় সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে।
রহিমা বলল, পান খাইবেন আফা?
অবন্তি বলল, না।
রহিমা বলল, জর্দা দিয়া পান খাইলে মেয়েছেলের শইলে সুঘ্রাণ হয়।
অবন্তি বলল, জর্দা খেয়ে শরীরে সুঘ্রাণ করার কিছু নাই। গায়ে পারফিউম দিলেই হয়।
রহিমা হাই তুলতে তুলতে বলল, আমি খোয়াবে একটা জিনিস পাইছি, বলব?
না। কথা বলাবলি বন্ধ। এখন ঘুম।
রহিমা বলল, খোয়বে পাইছি মাস্টার সাবের সাথে আপনার শাদি হবে।
অবন্তি কঠিন গলায় বলল, আমি আর একটা কথাও শুনব না।
রহিমা বলল, আমি নিজের মনে কথা বলি। শুনলে শুনবেন, না শুনলে নাই। আপনার আর মাস্টার সাবের বিবাহ হবে গোপনে। আপনার দাদাজানের অমতে। মামলা মোকদ্দমা হবে। শেষমেষ মিটমাট হবে। আমি খোয়বে পাইছি। আমার খোয়ব বড়ই কঠিন। একবার কী হইছে শুনেন, খোয়বে পাইলাম…
রহিমা কথা বলেই যাচ্ছে।
অবন্তি দুই হাতে কান চেপে ধরে মনে মনে গান করছে-‘আমার এই হেসে যাওয়াতেই আনন্দ খেলে যায় রৌদ্র ছায়া, বর্ষা আসে সুমন্দ।
মনে মনে গান করলে বাইরের কোনো শব্দ কানে ঢোকে না। এই আবিষ্কার অবন্তির নিজের।
আগে দেয়াল উপন্যাসের প্রথম পর্বে এই ওয়েবসাইটে একটা গল্প না উপন্যাসের অংশবিশেষ ছিলো। ওই গল্প বা উপন্যাসের নাম জানানো যাবে?
কার লেখা মনে আছে?