মেট্রিক পরীক্ষার ফরম পুরণ করে জমা দেবার পর বাংলার মাস্টার চারফুট এক ইঞ্চি বেড়ালচোখি দ্য ভিঞ্চি কল্যাণী পাল বলে দিলেন তোমার পরীক্ষা দেওয়া হবে না। কী কারণ, না তোমার বয়স কম, চৌদ্দ বছরে পরীক্ষায় বসা যায় না, পনেরো লাগে। তা হঠাৎ করে পুরো এক বছর আমি যোগাড় করি কোত্থেকে? মন খারাপ করে বাড়ি ফিরে সবাইকে জানিয়ে দিলাম এবছর আমার পরীক্ষা দেওয়া হচ্ছে না। কেন দেওয়া হচ্ছে না? বয়স কম বলে হচ্ছে না। বয়স বেশি বলে তো শুনি অনেক কিছু হয় না, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া হয় না, চাকরি বাকরি হয় না—মা ভাবতে বসেন। তা হয়ত হয় না কিন্তু মেট্রিকে উল্টো—বয়স কম তো ভাগো, বাড়িতে বসে বয়স বাড়াও, ষোল হলে পরে এসো পরীক্ষায় বসতে। সন্ধের দিকে মা এশার নামাজ পড়ে দু রাকাত নফল নামাজও পড়লেন, আল্লাহর দরবারে মাথা নুয়ে চোখের জল নাকের জল ফেলতে ফেলতে জানালেন তাঁর কন্যার এবার পরীক্ষা দেওয়া হচ্ছে না, কিন্তু আল্লাহতায়ালা চাইলে বয়সের এই বিশ্রি বিপদ থেকে কন্যাকে উদ্ধার করতে পারেন এবং ভালয় ভালয় পরীক্ষা দেওয়াতে এবং ভালয় ভালয় পাশ করাতে পারেন।
আল্লাহতায়ালা আমাকে কতটুকু উদ্ধার করেছিলেন জানি না, তবে বাবা করেছিলেন, তিনি পরদিনই আমার ইশকুলে গিয়ে আমার ফরমে বাষট্টি সাল কেটে একষট্টি বসিয়ে দিয়ে আমাকে জানিয়ে দিলেন এহন থেইকা যেন পড়ার টেবিলের চেয়ারে জিগাইরা আঠা লাগাইয়া বইসা যাই, আড্ডাবাজি আর শয়তানি পুরাপুরি বন্ধ কইরা ঠাইস্যা লেখাপড়া কইরা যেন মেট্রিকে চাইরটা লেটার লইয়া ফার্স্ট ডিভিশন পাই, না পাইলে, সোজা কথা, বাড়ি থেইকা ঘাড় ধইরা বাইর কইরা দিবেন।
বয়স এক বছর বাড়াতে হয়েছে আমার, কচি খুকি আমি বড়দের সঙ্গে বসে পরীক্ষা দেব, আমার খুশি আর ধরে না। আমার সেই খুশি মাটি করে দিয়ে দাদা বললেন কেডা কইছে তর জন্ম বাষট্টিতে?
বাবা কইছে।
হুদাই। বাবা তর বয়স কমাইয়া দিছিল।
তাইলে একষট্টি সালেই আমার জন্ম?
একষট্টি না, তর জন্ম ষাইট সালে। মনে আছে চৌদ্দই আগস্ট পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে সার্কিট হাউজে কুচকাওয়াজ দেখলাম। তার পর পরই তুই হইছস।
ছোটদা লুঙ্গির গিঁট বাধঁ তে বাঁধতে কালো মাড়ি প্রসারিত করে বললেন দাদা তুমি যে কি কও, ষাইট সালে ওর জন্ম হইব কেন? ও তো ফিফটি নাইনে হইছে।
আমি চপু সে যাই। মাকে গিয়ে ধরি আমার সত্যিকার জন্মের সালডা কও তো!
মা বললেন রবিউল আওয়াল মাসের বারো তারিখে হইছস। বছরডা খেয়াল নাই।
এইসব রবিউল আওয়াল ইশকুলে চলে না। ইংরেজি সালডা কও। তারিখটা কও।
এতবছর পর সাল তারিখ মনে থাকে নাকি! তর বাপেরে জিগা। তার হয়ত মনে আছে।
বাবার এনাটমি বইয়ের প্রথম পাতায় দুটো জন্মতারিখ লেখা আছে, দাদার আর ছোটদার। আমার আর ইয়াসমিনের জন্ম কবে, কোন সালে, তার কোনও চিহ্ন এনাটমি বইয়ের বারোশ পাতার কোনও পাতার কোনও কোণে লেখা নেই, এমন কি বাড়ির আনাচ কানাচের কোনও ছেঁড়া কাগজেও নেই। মার জন্ম হয়েছিল ঈদে, কোনও এক ছোট ঈদে। কোন সালে, না জানা নেই। বাবার জন্মের সাল তারিখ নিয়ে বাবাকে প্রশ্ন করার বুকের পাটা আজ অবদি কারও হয়নি। যখন বয়স নিয়ে বিষম চিন্তিত আমি, যোগ বিয়োগ করে এর ওর বয়স বার করছি সারাদিন, দাদার বয়সের সঙ্গে বারো বছর যোগ দিলে যে বয়স দাঁড়ায়, সে বয়স মার বয়স আর দশ বছর বিয়োগ দিলে বেরোয় আমার বয়স ইত্যাদি মা বললেন এইসব থইয়া পড়াশুনা কর। বয়স পানির লাহান যায়, মনে হয় এই কয়দিন আগে চুলে কলাবেণী কইরা দৌড়াইয়া ইশকুলে যাইতাম, আর আজকে আমার ছেলে মেয়েরা বি এ এম এ পাশ করতাছে।
বয়স নিয়ে মার কোনও ভাবনা না হলেও আমার হয়। নানিবাড়ি থেকে মামা খালা যাঁরাই অবকাশে আসেন জিজ্ঞেস করি কেউ আমার জন্মের সাল জানেন কি না। কেউ জানেন না। কারও মনে নেই। নানিবাড়িতে বেড়াতে গিয়ে নানিকে ধরি, এক মখু পানের পিক চিলমচিতে ফেলে নানি বলেন, ফেলু জন্মাইল শ্রাবণ মাসে, ওই বছরই তুই হইলি কাত্তিক মাসে।
ওই বছর কোন বছর?
কোন বছর কার জন্ম হইল এত কেডা হিশাব রাখে!পুলাপান বছর বছর জন্মাইছে এই বাড়িত, একটা দুইডা পুলাপান হইলে সাল তারিখের হিশাব থাকত।
জন্মের বছরের মত তুচ্ছ একটি জিনিস নিয়ে আমি পড়ে আছি, ব্যাপারটি অবকাশের সবাইকে যেমন হতাশ করে, নানিবাড়ির লোকদেরও করে। যেদিন আমি জন্মেছি, সেদিন নানিবাড়ির পুকুরে কই মাছের পোনা ছাড়া হয়েছিল নানির মনে আছে, রুনু খালার মনে আছে সেদিন টুটুমামা ঘর থেকে দৌড়ে পেচ্ছাবখানায় যাওয়ার সময় সিঁড়িতে পা পিছলে ধপাশ, কিন্তু কোন সাল ছিল সেটি, তা মনে নেই। হাশেম মামার মনে আছে সেদিন উঠোন থেকে চারটে সোনাব্যাঙ তুলে তিনি কুয়োর ভেতর ফেলেছিলেন, কিন্তু সেদিনের সাল তারিখ কিছু জানেন না।
নিজের জন্মের বছর জানার ইচ্ছে আগে কখনও এমন করে হয়নি। বাবা বাষট্টির জায়গায় একষট্টি বসিয়ে দিয়ে পরীক্ষার ব্যবস্থা পাকা করে এসেছেন তা ঠিক, এখন কেউ বয়স কমের অভিযোগ করবে না সুতরাং নো চিন্তা ডু ফুতির্, আদা জল খেয়ে লেখাপড়ায় নেমে যাওয়ার ফুতির্, কিন্তু মন পড়ে থাকে একটি না -জানা বয়সে, যেন আমার বয়সই আমার চেয়ে মাইল মাইল দূরে, যার সঙ্গে আমার দেখা হয় দেখা হয় করেও দেখা হচ্ছে না, অথচ দেখা হওয়া বিষম জরুরি। যখন বিদ্যাময়ী ইশকুলে মাত্র ভর্তি হয়েছি, মাকে আমার বয়স জিজ্ঞেস করেছিলাম, মা বললেন সাত। নতুন ক্লাসে ওঠার পরও জিজ্ঞেস করেছিলাম তিনি তখনও সাত বললেন, কেন সাত কেন, আট হবে তো! মা আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে দুপাশে ধীরে মাথা নেড়ে বলেছিলেন, আট বেশি হইয়া যায়, সাতই। পরের বছর বললেন এগারো। এগারো কেন? দেখতে নাকি আমাকে এগারো লাগে তাই। দিন দিন এমন কলাগাছের মত লম্বা হচ্ছি, এগারো না হয়ে যায় না, মার ধারণা। মার কাছে বয়স না পাওয়া গেলেও বাবার কাছে পাওয়া যাবে এরকম বিশ্বাস তখন থেকেই আমার ছিল, ছিল কারণ বাড়ির সবচেয়ে বিজ্ঞ মানুষটি ছিলেন বাবা। তিনি সবার চেয়ে বেশি লেখাপড়া করেছেন, তিনি জ্ঞানের আধার, তিনি এ বাড়ির কর্তা তাই। বাবা যখন আমার বয়স জানিয়ে দিলেন নয়, তার মানে নয়। এই বাবাও আমার বয়সের হিশেব রাখেননি, সে স্পষ্ট বোঝা যায়, রাখলে এনাটমি বইয়ের পাতায় দাদা আর ছোটদার জন্মতারিখের পাশে আমার তারিখটিও থাকত। নেই। নেই। এই নেইটি আমাকে সারাদিন ঘিরে রাখে, এই নেই আমাকে বারান্দায় উদাস বসিয়ে রাখে, এই নেইটি উঠোন ঝাঁট দিতে থাকা জরির মার বয়স জানতে চায়। প্রশ্ন শুনে জরির মা খিল ধরা কোমর টান করে দাঁড়ায়, যে দাঁড়িয়ে থাকাটুকুই তার সারাদিনের বিশ্রাম, প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে জরির মা আকাশের দিকে তাকায় ভাবতে, যে ভাবনার সময়টুকুই তার কেবল নিজের, ভেবে আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে উবু হতে হতে আবার উঠোন-ঝাঁটে, ঘাড় নেড়ে বলে, উনিশ। বিকেলের শেষ আলো আলতো আঙুল বুলিয়ে দিচ্ছে উঠোনের গায়ে, জরির মার কালো শরীরেও।
মা বারান্দায় এসে বসেন, জরির মার উনিশ-উত্তর পছন্দ হয়নি বলে মাকে জিজ্ঞেস করি জরির মার বয়স।
চল্লিশ বিয়াল্লিশ তো হইবই। মা তেরচা করে জরির মার ঝুলে থাকা শরীরের ঝুলে থাকা বুকের দিকে তাকিয়ে বলেন, পঁয়তাল্লিশও হইতে পারে।
জরির বয়স কত জরির মা?
জরির বয়স বলতে এবারও জরির মা কোমর টান করে দাঁড়ায়। মা ধমকে বলেন তাড়াতাড়ি কর, উঠান ঝাঁট দিয়া তাড়াতাড়ি খাইতে যাও। খাইয়া বাসন মাইজা রাইতের ভাত চড়াইয়া দেও।
দুপুরের খাওয়া আমাদের দুপুরেই শেষ। কেবল জরির মারই বাকি। কেবল জরির মার জন্যই রান্নাবান্না শেষ করে সবাইকে খাইয়ে দাইয়ে বাসন মেজে ঘর দোর ধুয়ে মুছে উঠোন ঝাঁট দিয়ে তবে খাওয়া।
জরির বয়সের কথা ভাবতেও জরির মাকে আকাশের দিকে তাকাতে হয়। লালচে আকাশ জুড়ে পাখির দল নীড়ের দিকে যাচ্ছে, জরির মার কোনওদিন কোনও নীড়ে ফেরা হয়নি তার জরিকে নিয়ে। জরির জন্মের পর থেকেই এ বাড়ি ও বাড়ি বাঁধা কাজে বাধাঁ পড়ে আছে।
কত আর, বারো !খালা, বারো হইব না জরির বয়স?
জরির মা অসহায় তাকায় মার দিকে।
বারো কও কি, ওর তো মনে হয় চোদ্দ পনর হইব।
মা জানেন না কবে জরির জন্ম হয়েছে, জরিকে মা জন্মাতে দেখেননি, মাত্র বছর দুই আগে জরিকে নিয়ে জরির মা এ বাড়িতে উঠেছে। জরির মাকে এ বাড়ির জন্য রেখে জরিকে নানিবাড়িতে দিয়ে এসেছেন মা নানির ফুটফরমাশ করতে। বয়স নিয়ে মা যা বলেন, সবই অনুমান। মা শরীর দেখে বয়স অনুমান করেন। মার এই অনুমান জরির মা সানন্দে মেনে নেয়, জরির বয়স এখন থেকে জরির মা জানে যে চোদ্দ পনর, আর তার নিজের চল্লিশ বিয়াল্লিশ, অথবা পঁয়তাল্লিশ।
জরির মা উঠোনে পড়া ঝরা পাতা ঝরা ডাল ঝরা পালক জড়ো করে পুকুর ধারে আবর্জনার স্তূপে ঢেলে দিয়ে রান্নাঘরে কুপি জ্বেলে ভাত আর বেগুনের তরকারি যখন খাচ্ছে, বারান্দায় বসে হাঁস মুরগির খোপে ফেরার দিকে উদাস তাকিয়েছিলেন মা, মার পায়ের কাছে সিঁড়িতে পা ছড়িয়ে বসে মাথার ওপরে চক্রাকারে ঘুর্ণি খেতে থাকা সন্ধ্যাৎসবে নৃত্যরত মশককূলের সঙ্গীত আর ডলি পালের বাড়ি থেকে ভেসে আসা উলু ধ্বনির শব্দ শুনতে শুনতে দেখতে থাকি কি করে বিষণ্ন কিশোরির ভেজা চুল বেয়ে টপু টুপ করে জল ঝরার মত আকাশ থেকে অন্ধকার ঝরে আমাদের ঝাঁট দেওয়া মেটে উঠোনটিতে।
টিনের ঘরের পেছনের সেগুন গাছটির দিকে তাকিয়ে মাকে মিহি স্বরে জিজ্ঞেস করি, সেগুন গাছটার বয়স কত মা?
মা অদ্ভুত চোখে গাছটির দিকে তাকিয়ে বলেন, মনে হয় তিনশ বছর।
মা কি করে সব মানুষ আর গাছপালার বয়স অনুমান করেন, আমি বুঝে পাই না।
মানুষ কেন তিনশ বছর বাঁচে না মা?
মা কোনও কথা বলেন না। আমি ফিরি মার দিকে, নৈঃশব্দের জলের ওপর গাঙচিলের মত উড়তে থাকা মার মুখটি তখন আর আমি দেখতে পাচ্ছি না। বাদুড়ের ডানার মত ঝটিতে এক অন্ধকার উড়ে এসে মখু টি ঢেকে দিয়েছে।
বয়স-ভাবনা সেই থেকে আমাকে ছেড়ে এক পা কোথাও যায়নি। মেট্রিকের ফরমে লেখা তারিখ মত নিজের একটি জন্মদিন করার ইচ্ছে জাগে আমার হঠাৎ, বাবার মন ভাল ছিল বলে রক্ষে, চাইতেই একটি কেক, এক খাঁচা মালাইকারি, এক প্যাকেট চানাচুর, এক পাউন্ড মিষ্টি বিস্কুট, এক ডজন কমলালেবু চলে আসে বাড়িতে। কেকের ওপর মোম জ্বেলে বিকেলে বাড়িতে যারা ছিল তাদের আর একজনই সবেধন নীলমণি অতিথি চন্দনাকে নিয়ে এক ফুঁয়ে মোম নিবিয়ে বাড়িতে ছুরি নেই কি করি রান্নাঘর খুঁজে কোরবানির গরু কাটার লম্বা ছুরি এনে এক পাউন্ড ওজনের কেকটি কাটি। কেকের প্রথম টুকরোটি আমাকে কে মুখে তুলে দেবে গীতা না কি ইয়াসমিন,ইয়াসমিন বলে ইয়াসমিন, গীতা বলে গীতা, গীতা এগিয়ে এলে যেহেতু গীতা এ বাড়ির বউ, বাড়ির বউএর সাধ আহলাদের মূল্য ইয়াসমিনের সাধ আহলাদের চেয়ে বেশি, ইয়াসমিন গাল ফুলিয়ে কেকের সামনে থেকে সরে যায় আর ক্যামেরা আলো জ্বলার আগে গীতা নিজের মুখে মিষ্টি একটি হাসি ঝুলিয়ে আমার মুখে কেকের টুকরো তুলে দেয়, চোখ ক্যামেরায়। কেক কাটা, হাততালি, ক্যামেরার ক্লিক, আর মালাইকারির রসে ভিজিয়ে বিস্কুট আর কেকের ওপরের শাদা ক্রিম জিভে চেটে খেয়ে আমার জন্মদিন পালন হল এবং এ বাড়িতে প্রথম কারও জন্মদিন হল এবং হল সে আমার এবং সে আমার নিজের উদ্যোগেই। চন্দনা তিনটে কবিতার বই উপহার দিয়েছে। রাজা যায় রাজা আসে, আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি আর না প্রেমিক না বিপ্লবী। দাদা দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের গল্পগুচ্ছ। জীবনে ওই প্রথম কিছু উপহার পাওয়া আমার জন্মদিনে। বই থেকে হাত সরে না, চোখ সরে না, মন সরে না। অনেক রাতে মা শুকনো মুখে বললেন, মিষ্টির একটা কোণা ভাইঙ্গা জরির মার হাতে দিলে পারতি। কোনওদিন মিষ্টি খায় নাই। দেখত কিরকম লাগে খাইতে। হঠাৎ খেয়াল হয়, কেবল জরির মা নয়, মার ভাগেও জন্মদিনের খাবার জোটেনি। মা অবশ্য বলেন, এসব না খেলেও মার চলে। কখনও কোনও বিস্কুট বা এক মুঠো চানাচুর মার দিকে বাড়ালে মা বলেন, আমি ত ভাতই খাই। তরা পুলাপান মানুষ, তরা খা। তরা ত পাখির দানার মত ভাত খাস, তগর এইডা ওইডা খাইতে হয়।
আমার জন্মদিন পালন করা দেখে ইয়াসমিনেরও নিজের জন্মদিন পালনের ইচ্ছে হল খুব। কোন মাসে তার জন্ম, কোন তারিখে তা জানতে সে বাবাকে ধরল। বাবা ওকে আজ বলেন তো কাল বলেন, ইয়াসমিনও ঝুলে রইল। মাস দুয়েক ওকে ঝুলিয়ে রাখার পর বাবা একদিন বলে দিলেন নয়ই সেপ্টেম্বর। ব্যস,সেপ্টেম্বরের নয় তারিখ আসার আগেই ইয়াসমিন বাবার কাছে একটা লম্বা লিস্টি পাঠিয়ে দিল, তিনরকম ফল আর দুরকম মিষ্টি, সঙ্গে চানাচুর আর বিস্কুট। ইশকুলের মেয়েদের প্রায় সবাইকে ওর নেমন্তন্ন করা হয়ে গেছে। লিষ্টি পেয়ে বাবা বললেন, জন্মদিন আবার কি? এইসব জন্মদিন টন্মদিন করতে হইব না। লেখাপড়া কইরা মানুষ হও। আমার বাড়িতে যেন কোনওরকম উৎসবের আয়োজন না হয়। মা আবদারের ঝুড়ি উপুড় করেন বাবার সামনে, নিভৃতে। জন্মদিন করতে চাইতাছে, করুক না! মেয়েরা হইল লক্ষ্মী, ওদেরে মাইরের ওপর রাখা ঠিক না। শখ বইলা ওদেরও কিছু আছে। আবদার করছে, আবদারটা রাখেন। মা অনেকদিন থেকেই বাবাকে আপনি বলতে শুরু করেছেন, তুমি থেকে আপনিতে নামার বা ওঠার এত বেশি কারণ যে মার এই আপনি সম্বোধন শুনে বাবা যেমন চমকে ওঠেন না, আমরাও না। তবে তুমি বা আপনিতে, লঘু বা গুরু স্বরে, কেঁদে বা হেসে যে আবদারই করুন না কেন মা, মার আবদারের মূল্য বাবার কাছে যে একরত্তি নেই, এ বাবা যেমন জানেন, মাও জানেন।
আজাইরা ফুর্তি ফার্তা বাদ দেও। মেয়ে নাচে, সাথে দেখি মাও নাচে। যত্তসব বান্দরের নাচ।
বাবার ভ্রুকুটিতে মা দমে যান না। বাবার সর্দি লাগা শরীরের বুক পিঠ গরম রসুনতেল দিয়ে মালিশ করতে করতে আবদার করে যান। মেয়েরা ত বিয়া দিলেই পরের বাড়িতে চইলা যাইব। মেয়েদের সাধ আহলাদ যা আছে তা তো বাপের বাড়িতেই পূরণ করতে হয়। রসুন তেল বাবার ত্বক নরম করলেও মন নরম করে না। ইয়াসমিন মন খারাপ করে বসেছিল, জন্মদিনের কোনও উৎসব শেষ অবদি হচ্ছে না। কিন্তু বাড়ির সবাইকে অবাক করে দিয়ে সেদিন দুপুরে বাবা খাবার পাঠিয়ে দিলেন ইয়াসমিনের লিস্টি মত। পুলকে নাচে মেয়ে। পিরিচে খাবার সাজিয়ে সেজেগুজে কালো ফটকের দিকে চোখ ফেলে অতিথিদের অপেক্ষায় সারা বিকেল বসে থাকে। কারও দেখা না পেয়ে অগত্যা শেষ বিকেলে গোল্লাছুট খেলার সঙ্গী পাড়ার তিনজন মেয়ে মাঠে খেলতে এলে ওদের ঘরে ডেকে জন্মদিনের খাবার খেতে দেয় ইয়াসমিন।
সন্ধেয় বাড়ি ফিরে রকমারি খাবার দেখে ছোটদা অবাক,কি রে কিয়ের উৎসব আজকে?
ইয়াসমিন লাজুক হেসে বলল আমার জন্মদিন।
কেডা কইছে এই তারিখে তর জন্ম হইছিল?
বাবা কইছে। বাবা কওয়ার পর আর কারও মুখে টুঁ শব্দ মানায় না। কারণ বাবা যা কন, বাড়ির সবাই জানি যে তা খাঁটি,কারণ বাবার চেয়ে বেশি জ্ঞান বুদ্ধি কারও নেই। হ বুঝছি, একটা জন্মদিনের দরকার, তাই তুই চাইলি একটা জন্মদিন, আর বাবাও বানাইয়া কইয়া দিল।
ছোটদার স্পর্ধা দেখে ইয়াসমিন থ হয়ে গেল।
সেদিনও যার ভাগে ইয়াসমিনের জন্মদিনের কোনও কেকের টুকরো পড়েনি, সে মা। মা সেই যে দুপুরের পর বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন, ফিরলেন সন্ধেয়। হাতে বাদামি রঙের একটি কাগজের মোড়ক, ভেতরে ইয়াসমিনের জন্য লাল একটি জামার কাপড়। মা নিজেই এই কাপড় দিয়ে কুচিঅলা একটি ফ্রক বানিয়ে দেবেন ওর জন্য। হাতে টাকা ছিল না বলে হাশেমমামার কাছ থেকে টাকা ধার করে নিজে গৌরহরি বস্ত্রালয়ে গিয়ে তিন গজের এই কাপড়টি কিনেছেন।
আমি হায় হায় করে উঠি,কিন্তু আজকে ত ওর জন্মদিন না!
কেডা কইছে জন্মদিন না?
ছোটদা কইছে।
কি হইল তাতে! মা ধমকে ওঠেন। না হোক জন্মদিন। একটু আমোদ করতে চাইছে মেয়েটা, করুক।
ঈদ উৎসব ছাড়া কোনও জামা আমাদের জোটে না। বছরে বাবা একবারই আমাদের জামা দেন, সে ছোট ঈদে। পরের বছর ছোট ঈদ আসার আগেই আমাদের জামা হয় ছিঁড়ে যায় নয় ছোট হয়ে যায়। বাবার কাছে নতুন জামার আবদার করলে বাবা দাঁত খিঁচিয়ে বলে দেন,জামা দুইটা আছে না? একটা পরবি,ময়লা হইলে ধইয়া দিয়া আরেকটা পরবি। দুইটার বেশি জামা থাকার কোনও দরকার নাই। মা আমাদের ছেঁড়া আর ছোট হয়ে আসা জামা শাড়ির পাড় বা বাড়তি কোনও টুকরো কাপড় লাগিয়ে বড় করে দেন, ছেঁড়া অংশ সেলাই করে দেন। ইশকুলের মেয়েদের ঘরে পরার আর বাইরে পরার দুরকমের জামা থাকে। কোনওদিন কোনও ঈদের জামাকে বাইরে পরার জামা হিসেবে রেখে ঘরে পরার জামা চাইলে বাবা বলেন,বাইরে তর যাইতে হইব কেন? ঘরের বাইরে যদি কোথাও যাস, সেইডা হইল ইশকুল। ইশকুলের জন্য ইশকুলের ইউনিফর্ম আছে। ইশকুলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান বা বনভোজনের আয়োজন হলে মেয়েদের স্বাধীনতা দেওয়া হয় ইউনিফর্মের বাইরে অন্য জামা পরে যাওয়ার। মেয়েরা নানান রকম জামা পরে সেসব অনুষ্ঠানে যায়, আর আমি প্রতিটি অনুষ্ঠানে একটি জামাই পরে যাই বলে ক্লাসের এক মেয়ে একবার প্রশ্ন করেছিল, তোমার কি আর জামা নাই? লজ্জা আমাকে সেদিন এমনই তাড়া করেছিল যে দৌড়ে বড় একটি থামের আড়ালে গিয়ে অনেকক্ষণ লুকিয়ে রেখেছিলাম নিজেকে। ইশকুলের ইউনিফর্ম বানিয়ে দিতে বাবা কোনওদিন না করেননি। নিজে তিনি আমাদের সঙ্গে নিয়ে গৌরহরি বস্ত্রালয় থেকে কাপড় কিনে গাঙ্গিনার পাড়ের দরজির দোকানে যান, দরজি যখন গায়ের মাপ রাখে, দরজিকে বারবার বলে দেন, যেন বড়সড় করে বানায়, যেন অনেকদিন যায়। জুতোর দোকানে গিয়েও বাবা বলেন, এই মেয়েদের পায়ে জুতা দেন তো। একটু বড় দেইখা দিবেন, যেন অনেক দিন যায়। মাপের চেয়ে বড় জামা জুতো পরেও দেখতাম, আমাদের জামা জুতো ছোট হয়ে যায় দ্রুত। মা বলেন, জামা জুতা ছোট হয় না, তরা বড় হস। আমরা গায়ে বড় হতে থাকি বলে, আমার ভয় হয়, বাবা রাগ করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় দাদা মাসোহারার টাকা বাঁচিয়ে আমাকে আর ইয়াসমিনকে দুটো সিল্কের জামা কিনে দিয়েছিলেন। ফুটপাত থেকে কেনা বিদেশি পুরোনো জামা, সস্তার মাল, লান্ডির মাল। ও পেয়েই খুশির শেষ ছিল না।
মার কিনে আনা লাল কাপড়টি গায়ে জড়িয়ে ইয়াসমিন মহা আহলাদে বাড়িময় লাফাচ্ছিল যখন, অন্ধকার বারান্দায় চুল খুলে বসে ঘরের উজ্জ্বল আলোয় লাল টুকটুকে ইয়াসমিনকে বড় সুন্দর লাগছে, দেখছিলেন মা।