০১. বৈশাখ

বৈশাখ

বৈশাখ মাস। নমশূদ্রদের লক্ষ্মী মাস।

কৃষিজীবী নমশূদ্রদের জীবনে বৈশাখ বয়ে নিয়ে আসে আর একটা নতুন বছর। নতুন করে শুরু হয় আর একটি জীবন যুদ্ধ। তাদের বাৎসরিক জীবনচক্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাস হলো বৈশাখ। বৈশাখ বছরের যেমন শুরু, তেমনি তাদের বছরজুড়ে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার কর্মকাণ্ডের শুরুও হয় এই মাসে। বৈশাখে তারা মাঠে মাঠে বপন করে বীজ। সেই বীজ থেকে উৎপাদিত ফসলে হয় তাদের সারা বছরের অন্ন-বস্ত্রের সংস্থান।

বছরের শুরুতেই তাই নমশুদ্ররা করত মা লক্ষ্মীর আবাহন। আড়ম্বরের সাথে পালন করত পহেলা বৈশাখ। সকাল থেকেই শুরু হয়ে যেত সাজসাজ রব। জেগে উঠত বিলের নমশূদ্র গ্রামগুলো। উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ত চারদিকে।

সূর্যের আলো ফোঁটার সাথে সাথে লাঙল-জোয়াল, কাস্তে-কোদাল, খোন্তা কুড়োল সব এক জায়গায় জড়ো করে রাখত তারা। বাড়ির ছেলে-মেয়ে, নারী পুরুষ সবাই কাজে লেগে যেত। পুকুর, ডোবা থেকে ছেলেরা একে একে সব যন্ত্রপাতি ধুয়ে এনে উঠোনে জড়ো করত। সেগুলো মুছে মেয়েরা তেল-সিঁদুর লাগিয়ে একপাশে সাজিয়ে রাখত। ছেলেরা গরু-বাছুর নিয়ে রওয়ানা দিত নদী বা খালের দিকে। স্নান করিয়ে গরু-বাছুরকেও তেল-সিঁদুরে সজ্জিত করা হতো। সবশেষে নিজেরা স্নান সেরে পরত থোয়া-কাঁচা পরিষ্কার পুরনো কাপড়। নতুন কাপড় কেনার সামর্থ্য ছিল না তাদের।

দলবেঁধে নমশূদ্র পুরুষরা রওয়ানা হয়ে যেত তাদের ভূস্বামী জমিদার বাড়ির দিকে। উদ্দেশ্য পুণ্যাহ পালন করা।

জমিদার বাবুর কাচারিতে তিল-তুলশী ও গঙ্গাজলে পুণ্যাহর মঙ্গলঘট সাজিয়ে সিঁদুর রাঙানো নতুন সনের নতুন খাতা নিয়ে বসে থাকত গোমস্তা বাবু পহেলা বৈশাখে। এই খাতায় জমা হতে পুণ্যাহর টাকা। যারা জমিদারের জমি ভোগ করে তারা এক একজন করে মঙ্গলঘটের কাছে যেত। প্রণামের ভঙ্গিতে এক আনা, দুই আনা, সিকি, আধুলি যে যা পারে সিঁদুররঙা খাতায় খাজনা জমা দিয়ে পুণ্যাহ করত। তারপর সযতনে ছোঁয়া বাঁচিয়ে, বাওন-কায়েতদের জাত রক্ষা করে বাইরের উঠোনে এসে পদ্মপাতা বা কলাপাতায় ভরপেট খেয়ে ঘরে ফিরত তারা।

রাতের আয়োজন হতো যার যার নিজের বাড়িতে। বছরের অন্যদিনের তুলনায় ভালো রান্নার চেষ্টা থাকত সবার। চেষ্টা করা হতো পাতে বড় মাছ রাখার। তাদের বিশ্বাস ছিল, বছরের পয়লা দিনে ভালো খাওয়া-দাওয়া হলে সারাটা বছর এমনি ভালো খেয়েই কাটবে তাদের জীবন। তৈরি হতো পিঠা, পায়েস, মিষ্টান্ন।

খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই গিয়ে বসত কাচারি ঘরে। কলকেয় তামাক সেজে আয়েশের সাথে টান দিত কলকেয়। তামাকের মিষ্টি ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ত বাতাসে। শুরু হতো গানের আসর। মনসা মঙ্গল, নিধুবনে কৃষ্ণকলি, রাধিকার মানভঞ্জন ইত্যাদি পালা। মেয়েরাও রান্নাঘরের পাট সেরে আসরে গিয়ে বসত। গানের সাথে গলা মেলাত তারাও। দেখতে দেখতে পরিবেশ আবেগঘন হয়ে উঠত। উথলে উঠত অন্তরের কান্না। উলুধ্বনিতে মুখরিত হতো চারদিক। পুরুষেরা সম্মিলিত কণ্ঠে দিত হরিধ্বনি।

পুণ্যাহর পর থেকে শুরু হতো তাদের অধীর প্রতীক্ষা। কৰে নামবে বৃষ্টি। সেই বৃষ্টিতে খরাপোড়া জমির হৃদয় জুড়াবে। মোমের মতো গলে যাবে মাটি। সেই গলা মাটিতে বীজ ফেলার জোয়ার আসবে। জোয়ার এলেই তেল-সিঁদুর রাঙানো লাঙল, জোয়াল, বলদ, বীজসহ তারা ঝাঁপিয়ে পড়বে মাঠে মাঠে, খেতে খেতে।

খাওয়া-দাওয়া, গান-বাজনা শেষে আলোচনার মুখ্য বিষয় হয়ে পড়ত তাই একটাই। কবে নামবে বৃষ্টি!

নতুন বীজ খেতে ফেলার প্রস্তুতি নিয়ে বৈশাখী বৃষ্টির অপেক্ষায় নমশূদ্র কৃষকরা আকাশ পানে চাতকের মতো চেয়ে বসে থাকত। প্রচণ্ড গরমে গাঁয়ের মেয়ে-বধূরা বারান্দায়, গাছের ছায়ায় বসে নকশিকাঁথা সেলাই করত। রুমালে তুলত ফুল, পাখি, গাছ, লতা-পাতা। চটের ছালায় বুনত নকশি। কৃষকেরা এখানে-সেখানে, গাছতলায় বসে হুকে খেত। নিজেদের সুখ-দুঃখের গল্প করত।

খরা দীর্ঘ হলে, তারা খোল-করতাল নিয়ে নারী-পুরুষ মিলে সারা গ্রামে নগর গেয়ে বেড়াত। নগরে গাইত তারা হরি-কীর্তন। আর গাইত বৃষ্টি নামার নানা রকম প্রার্থনা গীত—

মেঘের ঠাকুর, মেঘ দে রে তুই
জল দে বাবা জল।
জল বিনে, তোর বিল শুখে (শুকায়ে) যায়
বিরিক্ষে (বৃক্ষে) শুকোয় ফল ॥

বগা কাঁদে, বগী কাঁদে
কাঁদে পক্ষিকুল।
কাঁদতে কাঁদতে আছড়ে পড়ে
গাছের তাজা ফুল ॥

শামুক কাঁদে, ঢ্যালার মাঠে
ফড়িং হারায় দল।
মানুষ কাঁদে, বিন্যে কাঁদে
গায় পায় না বল ॥

দেওয়া নামে বিন্দু বিন্দু
উথল (উথলে) পড়ে জল রে
দেওয়া রে অঝোরে নামিয়া পড়…

কানা দেওয়া রে ভাই…
আরও (আর এক) খুটি জল দেও ধানের ভাত খাই
আরও খুঁটি জল দেও চিনের ভাত খাই
আরও খুঁটি জল দেও গমের ভাত খাই
দেওয়া রে অঝোরে নামিয়া পড়…

ওরে দেওয়া নামো রে…
আমার রাধে গেলো ঘামিয়ে
দেওয়া নামো রে…

শুধু এইসব নগর গেয়েই শেষ হয় না পুরো অনুষ্ঠান। পরদিন সারা গ্রামের মানুষ একত্রে মিলে গর্ত খুঁড়ে সেখানে জল ঢেলে কাদামাটির খেড় (খেলা) করত। নমশূদ্র কৃষকদের বিশ্বাস ছিল, এই নগর গাওয়া ও কাদামাটি খেড় করলে মেঘের ঠাকুর অবশ্যই মেঘ দেবে, বৃষ্টি দেবে।

তারপরও যদি বৃষ্টি না নামত, যদি বেড়ে যেত খরার দাবদাহ, না মিলত মেঘের দেখা, মেঘ হলেও যদি না নামত বৃষ্টি, খা খা করত মাঠ-ঘাট, তখন কৃষাণ-কৃষাণী আহ্বান করত বৃষ্টিকে। আয়োজন করে দিত ব্যাঙের বিয়ে।

নমশূদ্র কৃষকরা বিশ্বাস করত, প্রবল খরায় ব্যাঙা-বেঙীর বিয়ে হলে অবশ্যই বৃষ্টি নামবে। তাই নিদাঘ খরা হলে, গ্রামে গ্রামে ধুমধাম করে কৃষাণ কৃষাণী ব্যাঙা-ব্যাঙীর বিয়ের আয়োজন করত। নিজের পুত্র-কন্যার বিয়ে দিলে যেমন আয়োজন হয়, ঠিক তেমনভাবেই মহা ধুমধামের সাথে ব্যাঙা-ব্যাঙীর বিয়ে দিত তারা।

গ্রামবাসী, কখনও এলাকাবাসী মিলে সিদ্ধান্ত নিত ব্যাঙের বিয়ে দেবার। ধরে আনা হতো দুটো ব্যাঙ। গ্রামের কোনো বাড়ির মহিলা সাজত ব্যাঙের মা। একই গ্রামের বা প্রতিবেশী গ্রামের আরেক মহিলা হতো ব্যাঙীর মা। দিন তারিখ ধার্য করে আনুষ্ঠানিকভাবে আয়োজন করা হতো বিয়ের। বিয়ের দিন পাড়ার রমণীরা ব্যাঙা-বেঙীর গায়ে হলুদ মাখাত, স্নান করাত তাদের।

বেঙীর মায়ের উঠোনের মাঝখানে চারকোনায় চারটি কলাগাছ পুঁতে আলপনা আঁকা হতো। মাঝখানে বসানো হতো মঙ্গলঘট। ধান, দূর্বা, সিঁদুর দিয়ে চালন বসাত। ঘট আর চালনের সামনে রাখা হতো দু-খানা কাঠের পিড়ি। পিড়িতে বসত গ্রামের বয়সী দুই নারী। একজনের হাতে থাকত ব্যাঙা এবং আরেকজনের হাতে বেঙী। তাদের সামনে বসত পুরোহিত। পড়ত বিয়ের মন্ত্র। ঠিক যেমন মানুষের বিয়ের সময় পড়ানো হয়। ধান, দূর্বা ছিটিয়ে চলত আনুষ্ঠানিকতা। সবশেষে পড়ানো হতো বেঙীর সিঁথিতে সিঁদুর। সেই সাথে সম্পন্ন হতো বিয়ের অনুষ্ঠান।

তারপর বরণ করে নেবার পালা। বিয়ে শেষে এয়োস্ত্রীরা দলবেঁধে নেচে নেচে, গাইতে গাইতে বরণ করত বর-বধূকে। গ্রামের সমস্ত নারী-পুরুষ, ছেলেমেয়ে মেতে উঠত আনন্দ-উৎসবে।

ব্যাঙা-বেঙীর বিয়ে অনুষ্ঠিত হতো গোধূলিলগ্নে। বর-বধূ বরণ শেষে বেঙীর মায়ের বাড়িতে হতো খাওয়া-দাওয়া। গ্রামের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাই অংশ নিত নিমন্ত্রণে। বিয়ের আগের দিনই নিমন্ত্রণের চাল-ডাল, তেল লবণ সংগৃহীত হতো গ্রামের বাড়ি বাড়ি থেকে। সবকিছু ঠিকঠাকমতো সম্পন্ন হবার পর গভীর প্রত্যয় আর বিশ্বাস নিয়ে নমশূদ্র কৃষকেরা অপেক্ষায় থাকত। ভাবত, ব্যাঙের বিয়ে হয়ে গেছে। বাসররাতে রতিক্রিয়ার আহ্বানে, নয়তো বা রতিসুখের উল্লাসে ডেকে উঠবে ব্যাঙ। সেই ডাকে বৃষ্টিকে নেমে আসতেই হবে মাটির ধরাধামে। এসবই নমশূদ্র কৃষকদের মনের বিশ্বাস মাত্র। যুক্তির ঠাঁই নেই যুগ যুগ ধরে বংশপরম্পরায় চলে আসা সেইসব বিশ্বাসের মধ্যে।

অপেক্ষায় বসে থাকতে থাকতে একদিন ধৈর্যের বাধ ভাঙত তাদের।

কোনো এক বিকেলে আকাশ কালো করে গুড়গুড় শব্দে ডেকে উটত মেঘ। আকাশ ভেঙে নেমে আসত ঝরঝর করে বৃষ্টি। ভরে উঠত খানা-খন্দ, খাল বিল। খেতের খরা-পোড়া মাটি নরম হয়ে মোমের মতো গলে গলে পড়ত। কৃষক-কৃষাণীর চোখে-মুখে ফুটে উঠত ঝলমলে আলো। মনের মধ্যে বয়ে যেত খুশির সরোবর।

মেঘ-বৃষ্টি ভেদ করে কখনও কখনও উঁকি দিত এক চিলতে রোদ। ছেলেমেয়েরা মনের আনন্দে গেয়ে উঠত সাথে সাথে–

রোদ হচ্ছে, বৃষ্টি হচ্ছে
খেঁকশিয়ালের বিয়ে হচ্ছে।

চৈত্র-বৈশাখের প্রচণ্ড তাপদাহে গায়ে দেখা দিত ঘামাচি। বৃষ্টির প্রথম জলে ভিজলে ঘামাচি মরে যায়। সেই বিশ্বাস নিয়ে নেমে পড়ত তারা বৃষ্টির মধ্যে। গা ভিজাত বৃষ্টির নবধারায়। আকাশের কোল ঘেঁষে সমস্ত রং ছড়িয়ে ভেসে উঠত রংধনু। নমশূদ্রদের নিজস্ব উচ্চারণে সেটা হয়ে যেত ‘রাম ধনুক’। তারা বিশ্বাস করত, স্বয়ং ভগবান রাম তার ধনুক নিয়ে বৃষ্টির সাথে নেমে এসেছেন মাটির এই ধরাধামে। গোটা কৃষককূলকে সাহস দিতে, উৎসাহ যোগাতে। যেন তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে চাষবাসে। মা বসুন্ধরার কোল যেন ভরে ওঠে ফুলে-ফলে। সারা মাঠে যেন বান ডেকে যায় ফসলের।

চোখে-মুখে আশা-স্বপ্ন নিয়ে পরদিন সকালেই নমশূদ্র কৃষকরা আসুরিক শক্তিতে নেমে পড়ত মাঠে। সাথে লাঙল-জোয়াল আর আউশ-আমনের বীজ। নাওয়া-খাওয়ার সময় থাকত না আর। থাকত না বিশ্রাম নেবার অবসর। মাঠে মাঠে চলত নতুন বীজ ফেলার মহোৎসব। মেয়েরাও নেমে পড়ত মাঠের কাজে সাহায্য করত পুরুষদের। জমির আগাছা পরিষ্কার করত, কলকোয় আগুন জোগাত। গামছায় খাবার বেঁধে মাঠে নিয়ে যেত। তাদের ভাষায় ‘মাদেনি’। মধ্যাহ্নের আহার।

বিকেলবেলা উত্তরের মেঘ কালো করে বুনো মোষের মতো দাপাদাপি করে আসত কালবৈশাখী। তছনছ করে ফেলত সবকিছু। ঝড়ের সাথে বাতাসে উড়ে বেড়াত ধুলোবালি, খড়, ঘরের চালা। চলত হাঁকডাক, আতঙ্কে ছোটাছুটি, মাঠে গরু-বাছুরের হাম্বা রব। আকাশে থাকত পাখ-পাকুলির সরব উড়াউড়ি। নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে সাদা বক উড়ে উড়ে ডানা ঝাঁপটাত প্রাণপণে। মনে হতো কালো মেঘে সাদা বকের মাখামাখি, যেন ঝড়ের পূর্বাভাস। সাথে কখনও থাকত শিলাবৃষ্টি। শন শন শব্দে ক্রমেই বাড়ত ঝড়ের বেগে। বাতাসের তাণ্ডব আর প্রলয় নাচনে ভয়ে কাঁপত তারা। ভেসে আসত চিৎকার, বাচ্চাদের কান্নাকাটি।

নিরুপায় নমশূদ্র গেরস্থরা তখন স্মরণ করত তাদের পবনদেবকে। ঝড়বৃষ্টির মধ্যেই দেবতার বসার জন্য আসন হিসেবে উঠোনে পেতে দিয়ে আসত বড় কাঠের পিড়ি। তারপর সবাই মিলে গাইত ক্ষমাপ্রার্থনার গান–

পবন গোঁসাই ক্ষ্যামা করো
ঝোড়ো ঠাকুর ক্ষ্যামা করো
কাঙালের ঘর ভ্যান্নার খুঁটি
বিন্নের ছানি বিফলে দিয়ে না।
ক্ষ্যামা চাই, ক্ষ্যামা চাই
বসো কাঙালের ঠাকুর, পিড়েয় বসো
থির (শান্ত) হও, থির হও।

ঝড়-বৃষ্টির সাথে শিলা থাকলে, কয়েক মুঠো ছাই উঠোনে ফেলে দিয়ে তারা প্রার্থনা করত..

ঝড়ো ঠাকুর ছাই করে দ্যাও
শিল ছাই করে দ্যাও
শিল ছাই করে দ্যাও
নয় কাঙাল মরে
তোমার কাঙাল গোল্লায় যায়
গোল্লায় যায়।।

সবকিছু এভাবেই অতিক্রম করে একসময় নরম মোলায়েম মাটিতে বীজ বোনা শেষ হয়ে যেত। বীজ থেকে চারা না গজানো পর্যন্ত মিলত কিছুদিনের বিশ্রাম। সেই অবসরে নমশূদ্র পুরুষরা কাছা এটে খাল, ডোবা-নালা, খানা-খন্দে নেমে যেত নতুন জলে ভেসে আসা মাছ ধরতে। হোঁচা, খ্যাপলা, চারা, দোয়াড়ি যার যা থাকে তাই নিয়ে চলত মৎস্য শিকার। খেতে কাস্তে নিড়ানি না লাগা পর্যন্ত তারা মত্ত থাকত পুঁটি, ট্যাংরা, কই, ভ্যাদা (রয়না বা মেনি), চ্যাং (টাকি) ইত্যাদি মাছ ধরা নিয়ে। সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে হারিকেন বা কেরোসিনের কুপি নিয়ে তারা নেমে পড়ত মাঠে আসা হাঁটুজলে। কাস্তে, কোচ দিয়ে কুপিয়ে মাছ শিকার করত। মাঠে জল আসার সময় স্রোতের বিপরীতে আইল কেটে পেতে দিত গহইর, বানিয়া।

বৈশাখের দিন লম্বা। সারাদিন কাজ শেষে সন্ধ্যায় তালপাখা হাতে তারা। বসত উঠোনে। গরম আর মশার প্রকোপ। উঠোনজুড়ে লাফিয়ে বেড়াত ছোট ছোট কুনো ব্যাঙ থাকত ঘুঘরো পোকার ছড়াছড়ি।

বৃষ্টির নব জলে ডোবা, পুকুরের কচুরিপানা সতেজ হয়ে উঠত। গাদাগাদি করে ফুলে ফুলে ছেয়ে থাকত ডোবা। নীল কমলা মেলানো বাহারি রঙের ফুল। মূল্যহীন এই ফুল। না লাগে কোনো কাজে, না লাগে পুজোয়। দূর থেকে দেখে শুধু মন ভরে।

জল উঠে আসার আগেই নমশূদ্র গেরস্থরা বাড়ি সংলগ্ন খেতের পাকা, আধাপাকা তরি-তরকারি তুলে বাড়িতে নিয়ে আসত। লাউ, কুমড়া, তামাক, মরিচ, পেঁয়াজ-রসুন সব। রোদে শুকিয়ে তা সংরক্ষণ করত সারা বছরের জন্য। উঠানে শুকাতে দিত পাকা লাল মরিচ। বাড়ত কাক-পক্ষীর উৎপাত। সেই উৎপাত থেকে রক্ষা পেতে অনেক সময় উপরে টানিয়ে দিত জাল।

নলবনে, কুমড়ো খেতে আঁকি জাল দিয়ে ধরত বাবুই পাখি। রান্না করে খেত সেই পাখির মাংস।

গাছে গাছে ঝুলত আমের গুটি। বৈশাখের শেষের দিকে কিছু কিছু আম পেকে যেত। তারা বলত ‘বৈশাখী আম’।

বীজ বপনের দশ-পনেরো দিন পর থেকেই আউশ, আমন, পাটের খেতে খেতে শুরু হয়ে যেত নিড়ানির কাজ। দ্রুত সময়ের মধ্যে নিড়ানি শেষ করতে হতো বলে এই কাজে গাঁতা করত তারা। গ্রামের সবাই একসাথে দলবেঁধে এক একদিন এক একজনের খেতে নিড়ানি দিত। রাতে হতো সেই বাড়িতেই খাওয়া-দাওয়া। তারপর মনের সুখে কলকায় টানা। পরদিন আবার গাতা অন্য একজনের জমিতে। রোদের তাপদাহ থেকে বাঁচার জন্য মাথায় দিত টোপা, মাখাল। লাইন ধরে বসে খেত নিড়াতে নিড়াতে সামনের দিকে এগোত। মাঝে মাঝে বয়ে যেত ফুরফুরে হাওয়া। মনের আহ্লাদে গলা ছেড়ে গান গেয়ে উঠত তারা। কখনও গাইত একা। কখনও বা মেতে উঠত গুরু-শিষ্যের পাল্লায়।

শিষ্য গান ধরত–

শুনি দেহে চার চন্দ্রের বিজয়
চার চন্দ্র চার পেয়ালায় রয়
কোন চন্দ্রে মরণ দেখা যায়।
আর চার পেয়ালার চার নাম আছে
পোরকাশ (প্রকাশ) আছে ভুবনময়।
কোন পেয়ালার কোন চন্দ্র কিরণ দেয়
চার পেয়ালার কী কী নাম সভাতে বলো মশায় ॥

অমাবস্যা হলে পরে চন্দ্র থাকে কোন ঘরে
দুই পক্ষ পাঁচে ঘোরে
আবার কোন প্যাঁচেতে জোয়ার আসে
কোন প্যাঁচেতে ভাটা পড়ে
সাধুরা করে সাধন কোন চন্দ্রের
যেদিন চাঁদে পূর্ণিমা লাগে
সেদিন চাঁদ কোথায় আলো করে?

দেহের মোকাম আঠারোটি হয়
কোন মোকামে পবন রয়,
কোন মোকামে ত্রি-বেণীর ঘাট
আবার কোন মোকামে শ্ৰী-খোলার হাট
শব্দ ভারী শোনা যায়।
কোন মোকামে মা জননী নিত্য বারাম দেয়
জানাও মোকামের পরিচয় ৷

তার উত্তরে গুরুপদের মুখ গেয়ে উঠত–

এই দেহেই চার চন্দ্র আছে
আদিচন্দ্র কালেবেতে
সেই চন্দ্র মরণ লিখেছে।
আবার নিজ চন্দ্ৰ আহার করে
পোষ মানা সে রয় শরীরে
গুরুচন্দ্র বৈঠা বহে শুনতে পাই সাধুর কাছে।
অমাবস্যা লাগলে পরে
গো-চন্দ্র থাকে চরণের নিচে ॥

চার চন্দ্র চার পেয়ালায় রয়
সে কথা বলি এই সভায়
শোনেন যত জ্ঞানী মহাশয়।
নরী জহরি জব্বারি আর সত্তারই পেয়ালা হয়।
আদি চন্দ্রে নূর পেয়ালা
নিজে চন্দ্র জহরি হয়
পোষমানা সে জব্বারি ভাই
সত্তারই জ্ঞানে পরিচয় ৷

চন্দ্রগুণে জোয়ার ভাটা বয়
ডান প্যাঁচেতে জোয়ার রে ভাই
বাম প্যাঁচেতে ভাটা বয়ে যায়
আবার আওল মোকামে পবন
হরদমেতে বয়ে যায়।
ওরে চিত্তমেতে ত্রি-বেণীর ওই ঘাট
শ্ৰী-খোলার ওই হাট
সেথায় অষ্টাদশে মা জননী বারাম দেয় ॥

ওদিক থেকে আর একজন গেয়ে ওঠে–

আমি যশোদা নন্দন
জীবরথে আমার আরোহণ
আমি সব দেহেতে বিরাজ করি
বসত মথুরা বিন্দাবন (বৃন্দাবন)
আদি চোখে দ্যাখে যে আমারে
সে আমার পায় দরশন ॥

কারথে মথুরাতে যাই
সেখানে কংস রাজা নাই
দেহে ছয় রিপু কংসের অনুচর
ওরা কেউ না কেরুর (কারো) পর
আমার কাজ কংস নিধন গো
আমি আর কিছু না চাই ॥

বিন্দে রাধে শোনো তোমাদের বলি
মরিস কাম বিরহে জ্বলি
ওরে হৃদয় ব্রজে দ্যাখ না খুঁজে
কৃষ্ণ ঘোরে অলি-গলি
বাঁশির মোহন আছে গোপন
দেখবি সাধন হলি ॥

গোটা বিলজুড়ে এভাবেই আনন্দের মধ্যে দিয়ে চলত নিড়ানি কাজ। নিড়ানি কাজ শেষ হতে না হতেই এসে পড়ত বোশেখি আড়ং।

বড় বটতলা বা অন্য কোনো শতবর্ষী বৃক্ষতলে বসত বৈশাখী মেলা। সন্ধ্যায় মেলা থেকে নমশূদ্র বৌরা ঘরে ফিরত। তাদের হাতে থাকত দা, কাঁচি, বটি, খুন্তি। পুরুষদের কাঁধে থাকত বাঁশের ঝুড়ি, বেতের ধামা, মাটির হাঁড়ি, পিঠে বানানোর ছাঁচ। বাচ্চাদের হাতে থাকত রং করা মাটির পুতুল, হাতি, ঘোড়া, পাখি। বাঁশি বাজাতে বাজাতে পুলকিত হৃদয়ে বাড়ির পথ ধরত তারা। এই মেলা ছিল তাদের প্রাণের মেলা, নাড়ির মেলা। মেলা উপলক্ষে বাড়িতে আসত মেয়ে-জামাই, বোন-ভগ্নিপতি, আত্মীয়-কুটুম।

নমশূদ্র ছেলেদের ছিল আর একটি আনন্দ উৎসব। ঘুন্নি (ঘুড়ি) উৎসব। মাঠে মাঠে এই সময়ে ঘুড়ি ওড়ানোর ধুম পড়ে যেত।

বৈশাখী প্রথম বৃষ্টি ঝরে যাবার পর কৃষকরা যখন ব্যস্ত বীজ বোনায়, ছোটরা তখন ব্যস্ত হয়ে যেত রঙ-বেরঙের কাগজ দিয়ে ঘুন্নি বানানোয়। ঘুড়ি বানানো হতে হতে মাঠে নিড়ানি চালানোর সময় এসে যেত। বড়রা মাঠে নিড়ানি চালাত। ছোটরা মেতে উঠত ঘুন্নি ওড়ানোর প্রতিযোগিতায়। নানা রঙের, নানা ধরনের ঘুন্নি। ফতিং, ডোল, কৌড়, সাপ, চিলে ঘুন্নি। আকার আর চেহারা ভেদে এক এক ঘুন্নির এক এক নাম। কৌড় ঘুন্নির মাথা বাঁকিয়ে চিকন পাতলা করে চেঁছে টানটান করে দুই প্রান্তে বেত বেঁধে দেয়া হতো। বাতাসে সেই বেতের কম্পনে সৃষ্টি হতো পা পা শব্দ। যত জোরে বাতাস বইত, ততই জোর বাড়ত সেই শব্দের। অনেক দূর থেকেও কানে ভেসে আসত সেই সুর।

দুপুরের পরপর বাতাস শুরু হলে ঘুন্নি নিয়ে মাঠে নেমে পড়ত তারা। বৈশাখী কড়া রোদ উপেক্ষা করে সারা মাঠে বাচ্চারা ঘেমে-নেয়ে তাদের ঘুন্নি নিয়ে দৌড়ে বেড়াত। খুশি আর আনন্দের বন্যা বয়ে যেত তাদের মধ্যে।

হতো ঘুন্নি ওড়ানোর পাল্লা। পাল্লায় যে জয়ী হতো, আনন্দে, গর্বে নেচে বেড়াত সে। যে হারতো সে মনের কষ্টে অনেক সময় রাগে-দুঃখে ছিঁড়ে ফেলত ঘুড়ি। পরের দিন সব ভুলে আবার নতুন ঘুড়ি নিয়ে মাঠের পানে ছুটত। কাজের ফাঁকে ফাঁকে বড়রাও মেতে উঠত ঘুন্নি ওড়ানোতে। ঘুড়ি উড়াবার সময় ছোটরা ছড়া কাটত–

চিলে করে ঢিলেমিলে
কৌড় করে টান
ফতিং শালা উঠে বলে
আরও সুতো আন।

এমন আরও অনেক ছড়া কাটত তারা। কখনও দলবেঁধে কোরাস গাইত। ঘুড়ি ওড়াবার আনন্দে ছোট বাচ্চারা প্যান্ট পরার কথা ভুলে যেত অনেক সময়। তাতে অবশ্য লজ্জার কোনো বালাই থাকত না। উলঙ্গ বাচ্চাদের ছুটোছুটিও ছিল দেখার মতো। ঘুন্নি ওড়ানোর আনন্দে তারা নাওয়া-খাওয়া ভুলে যেত। বাবা-মার বকুনি গায়েই মাখত না।

রোদে ছুটোছুটি করতে করতে ঘাম বুকে বসে যেত কখনও কখনও। বাঁধিয়ে ফেলত জ্বর-জারি। তাদের ভাষায় গা গরম। গা গরম নিয়েই তারা পরের দিনও মাঠের দিকে ছুটত ঘুন্নি হাতে।

একসময় নিড়ানির কাজ শেষ হয়ে যেত। তখন তাদের হাতের কাজ কমে যেত। নমশূদ্র পুরুষরা এখানে-ওখানে খেজুরের পাটিতে বসে টোয়েন্টি নাইন খেলত। হুকে খেত, গাল-গল্প করত। রসিকতায় মজে থাকত তারা। কিন্তু সতর্ক দৃষ্টি রাখত মাঠের দিকে। ধান, পাটের চারার বেড়ে ওঠা যেন বিঘ্নিত না হয় কোনোভাবেই। খেতে খেতে কচি আউশ, আমন, পাটের গাছ বাতাসে দোল খেয়ে শিশুর মতো হেসে হেসে মাথা নাড়ত। সেই দৃশ্য কৃষক-কৃষাণীর হৃদয় জুড়াত, অনিন্দ্য পুলকে ভরত মন। এভাবেই দেখতে দেখতে কেটে যেত নমশূদ্রদের জীবন থেকে বছরের প্রথম মাস। বৈশাখ মাস।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *