বৈদিক যুগে নারী
‘বৈদিক যুগ’ বলতে যদি আমরা ঋগ্বেদ ও বেদাঙ্গসূত্র-এর মধ্যবর্তী সময়কাল বুঝি, এবং যথাযথ বৈদিক যুগের সময়সীমা যদি সেটাই হয় তাহলে তার ব্যাপ্তি সতেরো থেকে আঠারোটি শতক।[১] অবশ্যই এই সময়ে নারীর অবস্থান আগাগোড়া এক ছিল না। ঋগ্বেদ-এর প্রাচীন অংশে আমরা দেখি, গ্রামকেন্দ্রিক যাযাবর পিতৃতান্ত্রিক সমাজে যতটুকু প্রত্যাশা করা যায়, নারী সেই মাত্রাতেই স্বাধীনতা ভোগ করছে।[২] নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি নানা চিত্রকল্পের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। ঊষস অর্থাৎ ভোর এক রূপসী, সুসজ্জিতা রমণী; তাঁকে সম্পূর্ণ বাধাহীন ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে: ‘শুচি ও সুন্দর ঊষস, রক্তবস্ত্রে সজ্জিতা যেন সদ্যস্নাতা, মায়ের হাতে স্নেহভরে প্রসাধিতা এক কন্যা।’[৩] ‘হাস্যমুখী বধূ যেমন স্বামীর সামনে নিজের রূপ উন্মোচিত করে তেমনি ঊষা তার রূপ উন্মোচিত করেন।’[৪] এ ছাড়া তাঁকে নির্লজ্জাও বলা হয়েছে। এর থেকেই নারীর স্বাধীন বিচরণ বিষয়ে সমাজের বিরূপ মনোভাব প্রকাশ পায়। কিন্তু এই অংশটি ঋগ্বেদ রচনার অর্বাচীন সময়কার। ‘অগ্নি মানুষের স্তুতি তেমন ভাবেই উপভোগ করেন, যেমন ভাবে প্রেমিক পতি স্ত্রীকে উপভোগ করেন।’[৬] ‘আমাদের স্তুতি তোমাকে তেমনি ভাবে স্পর্শ করুক, যেমন ভাবে স্বামীর স্পর্শে স্ত্রীর কামনা জেগে ওঠে।’[৭] ‘অগ্নি স্বামীর দ্বারা সম্মানিতা স্ত্রীর মতোই পবিত্র।’[৮] লক্ষ্য করা যেতে পারে, দেবতার পবিত্রতা মর্ত্য নারীর পবিত্রতার সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। একের পর এক চিত্রকল্পে নারীর প্রতি প্রেম নিবেদনকারী পুরুষের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে ভক্তের ইষ্টদেবতার প্রতি আবেদনের।[৯] সূর্য ঊষার পিছনে পিছনে যান, যেমন পুরুষ যায় নারীর পিছনে। এমনকী পুরুষের প্রতি নারীর কামনাকেও খোলাখুলি ভাবে বর্ণনা করা হয়েছে।[১০] সূর্য ঊষার উপপতি; ‘জারোন’— বারে বারে ব্যবহৃত এই অংশটির মধ্যে অবৈধ প্রণয়ের চিত্র বহুবার পাওয়া গেছে। পিতা ও কন্যার মধ্যে অবৈধ সম্পর্ক নাভানেদিষ্ঠ সূক্তের বিষয়।[১১] ভাইবোনের মধ্যে এই সম্পর্ক বিখ্যাত যম-যমী সংবাদ সূক্তের বিষয়।[১২] ‘নদীগুলি বিশ্বামিত্রের দিকে যায়, যেমন নারী নত হয় চুম্বনোদ্যত পুরুষের দিকে।’[১৩] ‘যেমন প্রিয়া পত্নী প্রেমিক স্বামীর মধ্যে আনন্দ পায়, হে ভক্ত, তুমিও যেন আমার মধ্যে সেই আনন্দ পাও।[১৪] আবার ভক্ত ও ইষ্ট দেবতার তুলনা করা হচ্ছে মনুষ্যমিথুনের সঙ্গে। ‘ঘৃতের ধারা সোমের দিকে যায়, যেমন সুসজ্জিতা সুন্দরী তরুণী যায় স্বামীর কাছে।[১৫] অবিবাহিতা নারী তার স্বামী বেছে নিতে পারে।[১৬] গৃহে তার কী কর্তব্য সে সম্বন্ধে প্রাচীন সাহিত্যে স্পষ্ট ভাবে কিছু বলা নেই, শুধু বলা হয়েছে সে জল আনত এবং ক্ষেতের দেখাশোনা করত।[১৭] শতপথ ব্রাহ্মণ-এ বলা হয়েছে, সে পশম পাকাত (এবং হয়তো বুনতও)।[১৮] অবশ্যই বাড়িতে আরও অনেক কাজ তাকে করতে হত। ঋগ্বেদ-এ নারীদের যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই করারও সাক্ষ্য আছে। তাই আমরা শুনি, মুদ্-গলিনীর যুদ্ধ জয়ের বৃত্তান্ত।[১৯] বিশৃপলা যুদ্ধে একটি পা এবং বধ্রিমতী একটি হাত হারান। বধ্রিমতী এবং শশীয়সী তাঁদের বীরত্বের জন্যও উল্লিখিত হয়েছেন। এর থেকে প্রাচীন বৈদিক যুগে নারীর কিছুটা সাম্য ভোগ করার সাক্ষ্য মেলে। দেবগণ ও পিতৃগণকে দৈনন্দিন জল দেওয়ার প্রসঙ্গে এমন তিন নারীর নাম পাই যাঁদের উদ্দেশ্যেও জল দেওয়া হত। তাঁরা হলেন গার্গী বাচক্নবী, বাড়বা আত্রেয়ী এবং সুলভা মৈত্রেয়ী।[২০] তাছাড়া বেদের ছয় অধ্যয়নের অন্তে উৎসর্গ দিবসে একটি অনুষ্ঠান হত; অন্যান্য শ্রদ্ধাহদের মধ্যে বশিষ্ঠপত্নী অরুন্ধতীকে আসন দেওয়া হত।
বিবাহের সময়ে বধূর মধ্যে পাঁচটি আকাঙ্ক্ষিত গুণ ছিল: বিত্ত, রূপ, শিক্ষা, বুদ্ধি এবং সদ্বংশ।[২১] কিন্তু মেয়েদের শিক্ষার অধিকার এক বিতর্কিত বিষয়। বহু অর্বাচীন একটি গ্রন্থে বলা হয়েছে, প্রাচীন কালে নারীর যজ্ঞোপবীত দিয়ে দীক্ষা হত; তাঁর বাবা, কাকা বা দাদা তাঁকে বেদাধ্যাপনা করাতেন; তিনি গৃহেই আনুষ্ঠানিক ভিক্ষা করতেন এবং মৃগাজিন, বল্কল বা জটা ধারণ করতেন না।[২২] কিন্তু এই গ্রন্থ অনেক পরবর্তীকালের, এবং অনুমান হয় দ্বিতীয় প্রকারের নারী অর্থাৎ ব্রহ্মবাদিনীদের জন্য যমসংহিতা-র নিয়মের উপর ভিত্তি করে রচিত। অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য ধারণা বলে যা মনে হয়, তা হল, আর্য বসবাসের প্রথম কয়েকটি দশকে নারী তার উপনয়ন ও স্বাধ্যায়ের অধিকার হারায়নি, কিন্তু আর্যরা যখন অনার্য পত্নী গ্রহণ করতে শুরু করল, তখন সমাজ নারীর উপনয়ন ও স্বাধ্যায়ের অধিকার কেড়ে নিল। অতএব সাধারণ ভাবে নারী শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হল। তবে এর ব্যতিক্রম অবশ্যই ছিল: দয়াল পিতারা বালবিধবা কন্যাদের শিক্ষা দিতেন; বিবাহের পূর্ব পর্যন্ত কুমারীদেরও শিক্ষা দিতেন। এই ব্যতিক্রমগুলির কথাই আমরা মাঝে মাঝে শুনি; তাদের মধ্যে আছেন বিশ্ববারা, ঘোষা, গোধা, অপালা। যাজ্ঞবল্ক্য বিদুষী কন্যা লাভের জন্যও একটি অনুষ্ঠানের নিয়ম বলেছেন।[২৩] ঋগ্বেদ একাধিক ঋষিকার বিষয়ে অবহিত; আমরা অস্তূণের কন্যা বাক্-এর কথা জানি, যিনি বিখ্যাত ‘সোহহম’ তত্ত্বের ঋষি, যে তত্ত্ব উপনিষদের শিক্ষা ও বেদান্তের বীজ। গার্গী এবং মৈত্রেয়ীও এর নিদর্শন। কিন্তু যে নারী যুক্তিসঙ্গত ভাবে তর্ক করতে পারে ও লব্ধপ্রতিষ্ঠ ঋষিকে তর্কে কোণঠাসা করে ফেলতে পারে, তার বিষয়ে সমাজের রক্ষণশীলতা প্রতিফলিত হয় গার্গীর প্রতি যাজ্ঞবল্ক্যের অযাচিত তিরস্কারে: ‘আর প্রশ্ন কোরো না তোমার মাথা খসে পড়ে যাবে।[২৪]
পরবর্তীকালে ব্যাকরণ গ্রন্থে একটি স্ত্রী প্রত্যয় যোগ করার নিয়ম করা হয়েছে যার ফলে শিক্ষয়িত্রীকে শিক্ষকের স্ত্রীর থেকে ভিন্ন করা যায়। ফলে আমরা কাশাকৃৎস্না আপিশলার সঙ্গে পরিচিত হই, যিনি মীমাংসা ও ব্যাকরণে পারদর্শী ছিলেন। আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, কবে শিক্ষার অধিকার এমন ভাবেই কেড়ে নেওয়া হল যে নারীর শিক্ষার উচ্চাকাঙ্ক্ষা সম্পূর্ণ লোপ পেয়ে গেল; কেন এবং কবে উপনয়নের অধিকার কেড়ে নেওয়া হল, স্বাধ্যায় নারীর কাছে অগম্য হয়ে গেল এবং যে ব্যতিক্রম পাওয়া যায় তা প্রাদেশিক বংশগত মাত্ৰ।[২৫] আমরা শুনতে পাই যে শিক্ষিতা নারী আসলে পুরুষই, যদিও শিক্ষিতা বধূর আকাঙ্ক্ষা ছিল। এ থেকে স্পষ্টই নারীর শিক্ষা বিষয়ে সমাজের দৃঢ় আপত্তির প্রতিফলন পাওয়া যায়।
ধীরে ধীরে, কিন্তু নিশ্চিত ভাবেই নারীর নির্বাসন হচ্ছিল গৃহকর্মে; সে বন্দি হচ্ছিল অন্তঃপুরে। যদিও ঋগ্বেদ-এর একটি সূত্রে নববধূকে আশীর্বাদ করা হয়েছে ‘তোমার শ্বশুর কুলের সবার সম্রাজ্ঞী হও।’[২৬] তা সত্ত্বেও অথর্ববেদ-এ বলা হয়েছে, ‘সূর্যোদয়ের সময়ে তেমনি ভাবেই প্রেতেরা পালায়, যেমন ভাবে পুত্রবধূ শ্বশুরের কাছ থেকে পালায়।’[২৭] ঋগ্বেদ-এর আশীর্বাদ সদিচ্ছামাত্র, বাস্তবতার বিরোধী বলেই তাকে এ ভাবে প্রকাশ করা হয়েছে; বাস্তব জীবনে নারী তার স্বাধীনতা আগেই হারিয়েছে এবং অথর্ববেদের পরিস্থিতির দিকে চলেছে। এও আবার এক প্রহেলিকা; কেমন করে, কেন এবং কবে এই বিবর্তন ঘটল; এর পিছনে সামাজিক-অর্থনৈতিক, ধার্মিক-সাংস্কৃতিক কী কী শক্তি কাজ করছিল তা অনুসন্ধানের বিষয়।
শোনা গেছে, নারীর স্থান গৃহে। বাইরের জীবন বলতে যা কিছু সে এক সময়ে ভোগ করেছে, ভারতীয় মাটিতে আর্যেরা বসতি করার পর আনুমানিক দুই শতক অবধি সেই স্বাধীনতাটুকু তার ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের সব অধিকারের সঙ্গেই সে হারিয়েছে। তার মনের উপর কোনও অধিকার নেই, এমনকী নিজের শরীরের উপরেও না।[২৮] সে যেহেতু শিক্ষার অধিকার হারিয়েছে, তার জীবন দুটি ভাবে বিভক্ত: প্রথম, পিতৃগৃহে কয়েক বছর, এবং দ্বিতীয়, বয়ঃসন্ধির পর (পরবর্তীকালে বয়ঃসন্ধির পূর্বেই) যখন তাকে সম্প্রদান করা হত এবং বাকি জীবনটা শ্বশুরালয়ে কাটত। বিবাহিতা নারী কোনও অবস্থাতেই পিতৃগৃহে ফিরে সেখানে থাকতে পারত না, কারণ তাতে কলঙ্ক হয়। বেদাঙ্গের গ্রন্থকাররা কঠোর ভাবে তার ফিরে আসার নিন্দা করেছেন।[২৯] অবিবাহিতা নারীদেরও নিচু চোখে দেখা হত, সম্ভবত সামাজিক ভাবে তাদের একঘরে করে রাখা হত। এমনকী ঋগ্বেদ-এও বয়স্কা কুমারীদের উল্লেখ আছে, ‘যারা পিতৃগৃহে বৃদ্ধা হয়ে যায়।’[৩০] এর সাক্ষ্য বহন করে ‘কুলপা’— গৃহে পালিতা, ‘অমাজু’, ‘অমাজুরা’—যে গৃহে বৃদ্ধা হয়ে যায়, ‘বৃদ্ধকুমারী’ এবং ‘জরৎকুমারী’— আইবুড়ি, ইত্যাদি। সুতরাং পরে বিবাহ যেমন আবশ্যিক হয়ে উঠেছিল, ততটা তখন ছিল না। মেয়েদের শরীরে কোনও খুঁত থাকলে যৌতুকের প্রয়োজন হত।[৩১] এর থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, নারী এর মধ্যেই এক দায় বলে গণ্য হয়েছে। বৃদ্ধ বয়সী কুমারীত্ব যুগের সঙ্গে অপ্রচলিত হয়ে পড়ে।
ঋগ্বেদ-এর যুগে সম্ভবত বিধবারা বেঁচে থাকত, কখনও কখনও তাদের দেবরের সঙ্গে বিবাহ হত। একটি সূক্ত থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, যেখানে স্বামীর মৃত্যুর পর এক নারী তার পাশে শুয়ে থাকে, তখন এক পুরুষ (সম্ভবত দেবর, ভাষ্যে বলা হয় গুরু বা প্রাচীন দাস) তার হাত ধরে জীবিতের রাজ্যে প্রবেশ করে বংশবৃদ্ধি করতে অনুরোধ করে।[৩২] এখানে দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, স্বামীর চিতায় মত্যুর ইচ্ছা অনুকরণ করে তাকে সেখান থেকে আবার জীবনে ফিরিয়ে আনা। গ্রন্থের পটভূমিকা থেকে মনে হয়, সতীদাহের রেওয়াজ জানা ছিল এবং সম্ভবত কোথাও কোথাও তা অনুষ্ঠিতও হত। অথর্ববেদের একটি সূত্রে এর সাক্ষ্য পাওয়া যায়: ‘জীবিতা নারী মৃতের বধূরূপে গৃহীত হচ্ছে,’ অথবা ‘এই নারী তার স্বামীর দেশে চলেছে, সে প্রাচীন রীতিই অনুসরণ করছে।[৩৩] এই রীতি কত প্রাচীন ছিল? কোথায় কখন এবং কেন তা প্রচলিত ছিল? দেওরালার ঘটনা যে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় সে কথা বোঝার আগে এ বিষয়ে গবেষণা প্রয়োজন। ইন্দো-ইউরোপীয়রা সতীদাহ করত না; হোমার, ভার্জিল, নিবেলুঙ্গলিয়েড ও বীরগাথা থেকে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। একি তবে দেশীয় রীতি, সিন্ধুসভ্যতার রীতি? কিন্তু বিধবা বেঁচে থাকলেও তার জীবন খুব সুখের ছিল না; একটি মন্ত্রে বলা হয়েছে, ‘আমি যেন ইন্দ্রাণীর মতো অবিধবা থাকতে পারি।[৩৪] এ শুধু তার পতি প্রেমের অভিব্যক্তি নয়; কিন্তু কোনও পুরুষের বিপত্নীক না হওয়ার প্রার্থনার নিদর্শন কোথাও পাওয়া যায় না।
নারীর বহুবিবাহও একেবারে অজ্ঞাত ছিল না; অথর্ববেদে বলা হয়, ‘যে নারীর পূর্বে স্বামী ছিল, সে যদি দ্বিতীয় পরিগ্রহ করে, তাহলে তাকে পঞ্চোদন অর্থদান করতে হয়।[৩৫] অথবা, ‘যে নারীর দশ স্বামী আছে, সেও যখন ব্রাহ্মণ স্বামী গ্রহণ করে, সেই ব্রাহ্মণই তখন তার প্রকৃত স্বামী, রাজন্য ও বৈশ্য স্বামীরা নয়।[৩৬] গ্রন্থগুলিতে বিধবা বিবাহের বিকল্প অর্থ দেওয়া হয়েছে, কিন্তু নারীর বহু বিবাহ এবং বিধবা বিবাহ— দুটি ক্ষেত্রেই এই অংশগুলিতে নারীর যে অধিকারের ইঙ্গিত আছে, তা সে পরে হারিয়েছিল। তা কবে এবং কেন?
গণিকাবৃত্তিকে বলা হয় পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন পেশা এবং বেদে নানা নামে গণিকার পরিচয় মেলে: হস্ত্রা, অগ্রূ,[৩৭] সাধারণী ও সামান্যা,[৩৮] পুংশ্চলী,[৩৯] রজয়িত্রী,[৪০] অতিস্কদ্বরী, অপস্কদ্বরী।[৪১] পরে নামগুলির সংখ্যা আরও বেড়েছে, এবং এদের অধিকার, কর্তব্য এবং সামাজিক অবস্থান আরও স্পষ্ট ভাবে চিহ্নিত হয়েছে।[৪২]
নারীহরণের উল্লেখও পাওয়া যায়। ঋগ্বেদের একটি সূত্রে জনৈক পুরুষ তার প্রেমিকার আত্মীয়দের মতের বিরুদ্ধে— তবে অনুমান করা যায় তার নিজের মতানুসারে— প্রেমিকাকে অপহরণ করার সময়ে প্রার্থনা করে যেন সমস্ত পরিবার প্রেমিকার ভাইয়েরা, তার আত্মীয়েরা এমনকী কুকুরগুলো পর্যন্ত গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে পড়ে, যাতে সে নির্বিঘ্নে প্রেমিকাকে নিয়ে পালাতে পারে।[৪৩] পুরুমিত্রের কন্যাকে নিয়ে বিমদের পালানোর কথা জানা যায়।[৪৪] নারীর বহুবিবাহ যদিও সংখ্যায় কম এবং ব্যতিক্রমী চরিত্রের— অন্তত লিখিত নিদর্শন যেটুকু পাওয়া যায়— কিন্তু পুরুষের বহুবিবাহ সাধারণ ব্যাপার। পুরুষের দুটি বিবাহের সমর্থনে এক যজ্ঞীয় অনুষ্ঠানের ছদ্মযুক্তি পাওয়া যায়: ‘যেহেতু দুটি বস্ত্রখণ্ড একটি দণ্ডকে বেষ্টন করে থাকে, বিপরীতটি হয় না, অতএব নারীর দুই স্বামী থাকতে পারে না, কিন্তু পুরুষের দুই স্ত্রী হয়।’[৪৫] রাজা বৈধ ভাবেই চারটি মহিষী রাখতে পারতেন।[৪৬] তার পরেও যত খুশি বিবাহ করতে পারতেন এবং তাঁর অন্তঃপুরে নানা প্রকৃতির উপপত্নীও রাখতে পারতেন। ইন্দ্রিয়গুলি দিয়ে দ্বিতীয় পত্নীকে ভোগ করা যায়— তাই প্রত্যেক পুরুষের দুটি করে পত্নী ভোগ করার ক্ষমতা আছে।[৪৭] ‘যদিও গুরুষের একাধিক পত্নী থাকে, এক নারীর পক্ষে এক স্বামীই যথেষ্ট।[৪৮]
একটি অত্যন্ত ইঙ্গিতবহ অংশে বলা হয়, ‘সমৃদ্ধি সেই পুরুষেরই যার পশুপালের চেয়ে স্ত্রীরা সংখ্যায় কম।[৪৯] লক্ষণীয় যে, ধনের অর্থে পশুপাল ও স্ত্রীর কথা এক নিঃশ্বাসে বলা হয়েছে। ধনীর পশুপালের সঙ্গে যখন তুলনা হচ্ছে, তখন তার স্ত্রীর সংখ্যা যে কত তা কল্পনাতীত। এক পুরুষের অনেক স্ত্রী থাকত।[৫০] এমনকী ঋগ্বেদেও পুরুষের বহুবিবাহের কথা শুনি।[৫১] মৈত্রায়ণী সংহিতা-য় মনুর দশ পত্নীর উল্লেখ আছে। তৈত্তিরীয় সংহিতা-য় সাতাশ পত্নীর স্বামী চন্দ্রের রোহিণীর প্রতি পক্ষপাতের জন্য শাস্তির বিবরণ আছে।[৫২] বলা বাহুল্য, সাতাশটি পত্নীর বিবরণ সমাজের অতি পরিচিত বাস্তব চিত্রের একটি পৌরাণিক প্রতিফলন মাত্র। সাধারণ ভাবে নারীর তপস্যা করার কথা নয়; একমাত্র স্বামীলাভের জন্য তপস্যা তার ব্যতিক্রম।[৫৩]
বিবাহ অধিকাংশ নারীর পক্ষে আবশ্যিক; এক বিবাহে নারীকে শুধু এক ব্যক্তির হাতে দেওয়া হয় না, দেওয়া হয় ‘পরিবারকে’,[৫৪] ফলে গোটা পরিবারেরই তার উপর অধিকার জন্মায়। বিবাহে বধূ বরের তুলনায় নিকৃষ্ট; স্বামীর পরিবারের প্রতি তার প্রচুর কর্তব্য; কিন্তু তার পরিবারের প্রতি স্বামীর কোনও কতর্ব্য নেই। সে শুধু স্বামী ও সন্তানদের সেবা করে না, শ্বশুরবাড়ির সব আত্মীয়দেরই সেবা করে। তাকে অন্তঃপুরে অবরুদ্ধ থাকতে হবে, না হলে তার শক্তিক্ষয় হয়।’[৫৫] প্রশ্ন করার বাসনা হয়, এ কোন শক্তি যা শুধুমাত্র অবরোধে থাকলেই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়? ‘সতী স্ত্রী সে-ই যে স্বামীকে তুষ্ট করে, পুত্রসন্তানের জন্ম দেয় এবং স্বামীর মুখের উপর জবাব দেয় না।’[৫৬] ‘পুরুষের সম্মুখে স্ত্রীর ভোজন উচিত নয়।’[৫৭] শোনা যায়, স্ত্রী যজ্ঞের উত্তরার্ধ,[৫৮] কিন্তু ধর্মাচরণে ‘স্ত্রীর স্বাতন্ত্র্য নেই’,[৫৯] স্ত্রী মন্ত্রোচ্চারণ করতে পারে না। তার উপস্থিতি যজ্ঞে আবশ্যক, কিন্তু সে সেখানে পুতুলমাত্র।[৬০] ‘সে যজ্ঞে আহুতি দিতে পারবে না।[৬১] সে সভায় উপস্থিত থাকতে পারত না,৬২] মধুপান করতে পারত না। ‘সে মধু খায় না, বলে— আমি আমার পুত্রদের জন্য এই ব্রতপালন করলাম।’[৬৩] তার প্রধান কর্তব্য পুত্রের জন্ম দেওয়া এবং সে যদি তা না পারে তবে তাকে ত্যাগ করা যায়।[৬৫] অন্যান্য গ্রন্থে বলা হয়, স্ত্রী কলহপরায়ণা, অশুচি, ধর্ষিতা বা চৌর গৃহীতা হলেও ‘তাকে ত্যাগ করা যাবে না।[৬৬] ‘যে স্ত্রী ভ্রষ্টা, সেও প্রায়শ্চিত্তের দ্বারা পবিত্র হতে পারে।’[৬৭] ‘যে স্বামী স্ত্রীকে ত্যাগ করে তার কঠোর দণ্ড হতে পারে, কিন্তু যে স্ত্রী স্বামীকে ত্যাগ করে, প্রায়শ্চিত্তের দ্বারা তার শুদ্ধি হয়।[৬৮] ‘যে স্বামী স্ত্রীর প্রতি কটুভাষণ করে, তাকে উপবাস ও প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়।[৬৯] বন্ধ্যা নারী দশ বছর পরে আইনত পরিত্যাজ্য হত, যে নারী মৃতবৎসা বা শুধু কন্যাসন্তানের জন্ম দেয়, সে বারো বছর পর পরিত্যাজ্য হত, এবং কলহপরায়ণা তৎক্ষণাৎ পরিত্যাজ্য।[৭০] লক্ষণীয় যে বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র অনুসারে কলহপরায়ণা স্ত্রীও অপরিত্যাজ্য।[৭১] সেখানে যে স্বামী ধর্ষিতা স্ত্রীকেও ত্যাগ করে, তার জন্য কঠোর দণ্ডের বিধান আছে। কিন্তু মহাকাব্য বা পুরাণে যে রকম নিদর্শন পাওয়া যায়, তাতে দেখা যায়, স্ত্রীর কোনও রকম চারিত্রিক বিচ্যুতি থাকলে, বা সে বিষয়ে সন্দেহ থাকলেও তাকে অবশ্যই ত্যাগ করা হত। সমাজে কন্যাসন্তানের পরিস্থিতি অতিরিক্ত প্রকট হয়ে পড়ে, শুধুমাত্র কন্যাসন্তানের জননীর কঠিন শাস্তি পাওয়ার বিষয়ে নিয়মগুলি থেকে। একটি সোমযাগে কয়েকটি যজ্ঞপাত্র মাটিতে রাখা হয়, কয়েকটি উপরে তুলে ধরা হয়: ‘সুতরাং সদ্যোজাত কন্যাসন্তান মাটিতে রাখা হয়, পুত্রসন্তান উপরে তুলে ধরতে হয়।[৭২] অতএব নারীকে সামাজিক ভাবে নিচু করে দেখার যে সহজাত প্রবণতা, সেটা জন্মক্ষণ থেকেই পরিস্ফুট এবং একটি কু-তর্কের সাহায্যে তার একটি ব্যাখ্যাও দেওয়া হয়েছে। বিবাহেও সে তার দাম্পত্যজীবন শুরু করে নিচু হয়েছে; পরিচিত বিবাহের মন্ত্রে স্বামী বলেন, ‘তোমার হৃদয় আমার ব্রতে নিহিত হোক, তোমার চিত্ত আমার চিত্তকে অনুসরণ করুক।[৭৩] লক্ষণীয় যে, তাকে তার ব্যক্তিত্ব স্বামীর ব্যক্তিত্বে সম্পূর্ণরূপে ডুবিয়ে দিতে হতে। ‘স্বর্গ ধ্রুব, পৃথিবী ধ্রুব… স্ত্রী যেন স্বামীর পরিবারে ধ্রুব হয়।’[৭৪] যে জিনিসটা খুব প্রকট ভাবে অনুপস্থিত, তা হল তার প্রতি ধ্রুব হওয়ার, তার মানসিক ভাবগত প্রয়োজনগুলি মেটাবার বিষয়ে তার স্বামীর কোনও প্রতিশ্রুতি। তাকে ব্যবহার করা হয় একটি অসাড়, চিত্তহীন পদার্থ হিসেবে, যার অস্তিত্বে একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে তার স্বামীর তুষ্টিসাধন করা। ‘স্ত্রী স্বামীর অনুগামী হবে।[৭৫] ‘নারী তার স্বামীর পথে চলবে।’[৭৬] ‘নারীকে শৈশবে পিতা রক্ষা করেন, যৌবনে স্বামী রক্ষা করে, বার্ধক্যে পুত্র রক্ষা করে; স্ত্রীর স্বাতন্ত্র্যের অধিকার নেই।[৭৭] অগ্নিপত্নীবৎ— অনুষ্ঠানে যেমন হবিকে লাঠি দিয়ে পেটানো হয়, ‘ঠিক তেমন ভাবেই পত্নীকে প্রহার করা উচিত, যাতে তার নিজের শরীরের উপর বা সম্পত্তির উপর কোনও অধিকার না থাকে।[৭৮] তার যে সম্পত্তির অধিকার ছিল না, অন্য
অনেক গ্রন্থ থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়— এবং এখান থেকে এবং অন্য আরও গ্রন্থ থেকে— পরিষ্কার হয় যে, তার নিজের দেহ তার নিজের নয়। মান্যবর যাজ্ঞবল্ক্য বলেছেন, ‘স্ত্রী যদি স্বামীর সম্ভোগ কামনা চরিতার্থ করতে অস্বীকার করে, তাহলে স্বামী প্রথমে কোমল ভাবে তাকে বোঝাতে চেষ্টা করবে, তার পরে উপহার দিয়ে তাকে কিনে নিতে চেষ্টা করবে (অবক্রীণীয়াৎ) এবং তারও পরে স্ত্রী রাজি না হলে হাত দিয়ে বা লাঠি দিয়ে মেরে তাকে বশ করবে।[৭৯]
বরুণপ্রঘাস যজ্ঞে যজমানের পত্নীকেই প্রকাশ্য ভাবে তার ব্যভিচারের বৃত্তান্ত স্বীকার করতে হত।[৮০] যজমান নিজে যজ্ঞের জন্য দায়ী হলেও তাকে কোনও লজ্জাকর প্রশ্ন করা হত না। বস্তুত যজমানকে দীক্ষার দিনটুকুই শুধু গণিকার সঙ্গে এড়িয়ে চলতে বলা হয়েছে। পরের দিন তাকে পরস্ত্রীর সঙ্গ এড়িয়ে চলতে বলা হয়েছে, এবং যজ্ঞের দিন তার নিজের স্ত্রীর সঙ্গ তাকে এড়াতে বলা হয়েছে।[৮১] পুরুষের যৌনজীবনে বিচ্যুতিগুলির বিষয়ে সমাজের ক্ষমাশীল মনোভাব লক্ষ্য না করে উপায় নেই। কিন্তু সেই সমাজ বিবাহিত নারীর বিচ্যুতির বিষয়ে অবিশ্বাস্যরকম নিষ্ঠুর; তার জন্য বিহিত শাস্তি অত্যন্ত বীভৎস, জুগুপ্সাজনক এবং তা উচ্চারণ করার পক্ষে বড় বেশি নির্মম।[৮২] এবং এটি যে প্রয়োগ করা হত না, এ রকম মনে করার আমাদের কোনও কারণ নেই, সাহিত্যে এর অনুল্লেখের কারণ, স্পষ্টতই এর মধ্যে অন্তর্নিহিত হয়ে আছে যে কুৎসিত অত্যাচার স্পৃহা, তাই। গৃহে স্ত্রীর স্থান স্বামীর নিচে,[৮৩] সে সব সময়ে স্বামীর অনুগামিনী হবে।[৮৪] স্বামীকে বলা হয়েছে, খাবার পরে স্ত্রীকে উচ্ছিষ্টটি দিতে।[৮৫] এই স্পষ্ট উক্তির কোনও ভাষ্য প্রয়োজন হয় না, এবং তার মধ্যে দিয়ে অনেক কথা বলা হয়েছে। পুংসবন নামে গর্ভধারণের যে অনুষ্ঠানটি আছে, তার উদ্দেশ্য পুত্রসন্তান লাভ করা। অথর্ববেদে পুত্রসন্তানের জন্মের জন্য একটি মন্ত্র আছে।[৮৬] স্পষ্টতই সমাজ সম্পূর্ণ গুরুত্ব দিত পুত্রসন্তানের উপর। ‘স্ত্রী সঙ্গিনী, কন্যা অভিশাপ, পুত্র স্বর্গে আলো।[৮৭] প্রথম অংশটি কিছুটা বিভ্রান্তিকর, এর ফলে আমাদের বিশ্বাস করতে স্পৃহা হয় যে স্ত্রীকে সঙ্গী হিসেবে দেখা হত। অপর একটি অনুরূপ অংশে আছে, ‘স্ত্রী পুরুষের অপরাধ।’ এটিও সমাজের নারী সম্বন্ধে মনোভাবের বিষয়ে আমাদের আশঙ্কাকে শান্ত করে, কিন্তু এর পরে বলা হয়েছে, ‘সুতরাং যতদিন কারও স্ত্রী সংগ্রহ না হয়, তার সন্তান আসে না।[৮৮] অতএব পুত্রসন্তান লাভের প্রয়োজনেই স্ত্রীর মূল্য। একের পর এক গ্রন্থে তার মানবিক অধিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। উপরন্তু ‘যার স্ত্রী নেই সে যজ্ঞে অনধিকারী।[৮৯] পুরুষের অধিকার আছে একাধিক পত্নীকে বিবাহ করার, অসংখ্য উপপত্নী রাখার এবং গণিকার কাছে যাওয়ার, স্ত্রীর কিন্তু উপপতি রাখার অধিকার নেই; স্ত্রীর উপপতিকে ধ্বংস করার জন্য উপচার ক্রিয়ার বিধান আছে। কিছু কিছু গ্রন্থে অবশ্য স্ত্রীকে প্রতারণা করে অপর রমণীর কাছে যাওয়ার জন্য স্বামীর নিন্দা করা হয়েছে: ‘সে গর্দভের চামড়া দিয়ে নিজেকে ঢেকে ভিক্ষা করবে এবং নিজের অপরাধের কথা ঘোষণা করে ঘুরে বেড়াবে।[৯১] কিন্তু সাহিত্যে এ রকম প্রায়শ্চিত্তের একটি ঘটনাও বর্ণনা করা হয়নি, যদিও অসতী বা আপাত অসতীর কঠোর— কখনও নির্মমভাবে শাস্তি পাওয়ার নিদর্শন আছে।
নারী নিজেই পাপ। কতটা? ‘অনৃতকে দেখবে না, অর্থাৎ নারী, কুকুর ও কালো পাখি দেখবে না; অন্যথায় পুণ্য ও পাপ জ্যোতি ও অন্ধকার সত্য ও মিথ্যা মিশে যাবে।’[৯২] ‘স্ত্রীলোক রাত্রে তার স্বামীকে মুগ্ধ করে নিজের ইষ্ট সিদ্ধি করে নেয়।’[৯৩]
এমনকী যজুর্বেদ-এর সময়েও শুনি, ‘নারী মিথ্যা, দুর্ভাগ্য, সে মদ বা জুয়ার মতো ব্যসন মাত্র।’[৯৪] গর্ভাবস্থার পূর্বে নারীর জন্য কোনও যজ্ঞকর্মের বিধান নেই, এখনও পুত্রসন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য এবং তার জন্মের পূর্বে ও পরে তার মঙ্গল কামনায় পুংসবন অনুষ্ঠান। যে যজ্ঞে তার উপস্থিতি থাকে, সেখানেও মন্ত্র ছাড়াই তার কাজ অনুষ্ঠিত হয়। বৈদিক সমাজের নারীর প্রতি মনোভাব সবচেয়ে পরিস্ফুট ভাবে প্রমাণিত হয় একটি বেদাঙ্গ সূত্রে ‘(মাত্র একদিনের কৃচ্ছ্রসাধন) কালো পাখি, শকুনি, নেউল, ছুঁচো, কুকুর, শূদ্র ও নারী হত্যার জন্য প্রায়শ্চিত্ত।’[৯৫] সামগ্রিক ছবিটা ঊনমানব এবং সম্পূর্ণ ভাবে পাপের। তাই তাকে যে নিম্নশ্রেণির জীব বলে গণ্য করা হয় তা কিছু বিচিত্র নয়। অতএব, ‘সর্বগুণসমন্বিতা নারীও অপকৃষ্টতম পুরুষের চেয়ে নিকৃষ্ট।[৯৬]
সমাজে নারীর স্থান ঊনমানবীর, তাকে শুধু ভোগের সামগ্রীরূপে দেখা হত। তার দেহ, তার শ্রম তার প্রভুর ভোগের জন্য। তাই তাকে বন্ধক রাখা যেত, কেনা যেত, বিক্রি করা যেত; যজ্ঞের দক্ষিণা হিসাবে, যৌতুক হিসাবে বা অতিথির উপহার হিসাবে দানও করা যেত। শাস্ত্রে স্পষ্টই বলা হয়েছে, ‘নারী সম্ভোগ আনে।’[৯৭] তাছাড়া, পশু, ভূমি ও নারীর অতিভোগ নয়।[৯৮] সারস্বতস্বস্তয়ন নামক যজ্ঞের দক্ষিণা একটি ঘোটকী এবং একটি সন্তানবতী দাসী।[৯৯] অন্য অনেক যজ্ঞেই নারী দক্ষিণা হত, মহাকাব্যে যার প্রমাণ পাওয়া যায়। এই নারীদের শ্রেণিভাগ ছিল কুমারী, সধবা, সন্তানবতী বা নিঃসন্তানরূপে। কারা পেত তাদের? পুরোহিতেরা। তারা এত নারী নিয়ে কি করত? তাদের মধ্যে কারওকে গ্রহণকর্তা ভোগ করত, বাকিদের মধ্যে কারওকে দান করত, কারওকে বিক্রি। কেউ কেউ আবার সমাজের নানা অন্ধকার এলাকায় আঁকাবাঁকা পথে ঘুরে শেষ পর্যন্ত উপস্থিত হত বেশ্যালয়ে।
এর থেকে নারীর যে দ্ব্যর্থহীন চিত্র বেরোয় তাতে নারীকে মূলত ঊনমানবী হিসাবে দেখা হয়, যার জীবনে একমাত্র উদ্দেশ্য পুরুষকে তার যৌবন, রূপ, লাস্য এবং গৃহকর্মে তার শ্রম দিয়ে তুষ্ট করা। সেই পুরুষ ও তার আত্মীয়স্বজনকে তার নম্র হয়ে সেবা করতে হবে, কাজে বা কথায় তাদের কোনও প্রতিবাদ না করে। নিজের শরীরের উপরে তার কোনও অধিকার নেই; তার সম্পত্তি অর্জন বা ভোগ করার অধিকার নেই, এমন কি স্বামীর সম্পত্তিতে ও অধিকার নেই।[১০০] সে তো নিজেই একটি সম্পত্তি, কি করে সে কোনও রকমের সম্পত্তি অর্জন বা ভোগ করবে? অবশ্যই কিছু কিছু ব্যতিক্রম ছিল। অবশ্যই এমন স্বামী ছিল যারা স্ত্রীকে সম্মান করে, ভালবাসে, তার যত্ন নেয়।[১০১] কিন্তু তা তো ব্যতিক্রম; এবং ব্যতিক্রমই নিয়মকে প্রমাণ করে। এবং এই নিয়ম পূর্ণমাত্রায় নারীর মানুষ হিসাবে গণ্য হওয়া ও মানবিক অধিকার পাওয়ার বিরোধী।
বলা হয়েছে, ‘সুন্দরী নারী স্বামীর প্রিয় হয়।’[১০২] প্রথমত সব নারী সুন্দর নয়; সাধারণ চেহারার নারী কি স্বামীর প্রেম পেত না? আবার সুন্দরী বধূ যখন বয়স, বহু-প্রসব এবং সাংসারিক শ্রমের ফলে তার রূপ হারিয়ে ফেলত, তখন কী হত? এর উত্তরের ইঙ্গিত আছে বিবাহ অনুষ্ঠানে বরের উচ্চারিত একটি মন্ত্রে: ‘এস আমরা মিলিত হই, যেন পুত্রসন্তান উৎপন্ন হয়, যে সন্তানদ্বারা সম্পত্তিবৃদ্ধি হবে।’[১০৩] এই মন্ত্রেই বলা হয়েছে, ‘আমি যেন পুত্ৰ, পৌত্র, দাস, শিষ্য, বস্ত্র, কম্বল, ধাতু, বহু ভার্যা, রাজা, অন্ন ও নিরাপত্তা লাভ করি।’ যখন চিন্তা করি যে, এই মন্ত্র দম্পতির নতুন জীবন শুরুর প্রতীক, এবং নববধূর উপস্থিতিতেই তা উচ্চারিত হচ্ছে, তখন ‘বহু ভার্যার’ জন্য এই প্রার্থনা প্রয়োজনে বিনিময়যোগ্য ভোগ্যবস্তু হিসাবে নববধূর স্থান খুব প্রকট করেই তোলে। পরিস্থিতির চাপে যখন তার রূপ বা প্রয়োজনীয়তার অভাব ঘটত, তখন সহজেই তার জায়গায় অন্য কাউকে আনা যেত। তার সন্তানেরা বড় হয়ে যাওয়ার পরও তা ঘটতে পারত; তাদের পিতা একটি তরুণী ও অধিকতর সুন্দরী সপত্নীকে এনে তাদের মা-কে অপমান করতে পারত। ঋগ্বেদ থেকে শুরু করে আমরা সপত্নী বশ করার মন্ত্র পাই। পুরুষের সামাজিক সমৃদ্ধি বিচার হত তার পত্নীর সংখ্যা দিয়ে, যেমন তার পশু বা দাস তার সমৃদ্ধির প্রতীক। যে পুরুষেরা বহু পত্নী রাখার মতো সমৃদ্ধ ছিল না তারা বেশ্যালয়ে যেত; প্রাচীনতম যুগ থেকে সমাজে বেশ্যার উপস্থিতির প্রমাণ সাহিত্যে মেলে। পরিত্যক্তা পত্নী, ধর্ষিতা কুমারী, ক্রীতদাসী এবং লুণ্ঠিতা মেয়েরা তাদের সংখ্যা বাড়িয়ে তুলেছিল। প্রাচীন ভারতে তারাই ছিল নারী সমাজের একটিমাত্র শ্রেণি যারা সরকারি খরচে শিক্ষালাভ করত। নানা সুকুমার কলায় শিক্ষালাভ করে তারা তাদের খদ্দেরদের এমন ভাবে আনন্দ দিত যা তাদের শিক্ষা-বঞ্চিতা পত্নীরা পারত না। নিজের বাড়ির বাইরে পুরুষদের আনন্দ দেওয়ার ব্যবস্থা করে সমাজ পত্নীকে এমন এক অন্ধকার কোণে ঠেলে দিয়েছিল, যেখানে সে তার কর্তব্য পালন করত বিনা কৃতজ্ঞতায়, এবং যেখানে তার সামান্যতম ত্রুটির কঠোর শাস্তি মিলত। কখনওই ভুলে গেলে চলবে না যে, ‘সতী’ শব্দটির বিশিষ্ট অর্থে কখনও পুংলিঙ্গ পর্যায় শব্দ নেই। সতীত্ব পুরুষের কাছ থেকে প্রত্যাশা করা হত না; তা শুধু নারীর একার বিশেষ কর্তব্যকর্ম।
যে প্রশ্নগুলি উত্তর দাবি করে, তা হল: কবে, কেমন ভাবে এবং কেন নারী তার মানবিক অধিকার ও সামাজিক সম্মান হারাল? কারণ বৈদিক যুগের প্রারম্ভে তার কিছুটা সম্মান ছিল। ঋগ্বেদে ঊষসকে সূর্যের পত্নী বলা হয়েছে, সে স্বামীর আগে আগে যায়।[১০৪] এ নিশ্চিত ভাবে বাস্তব সমাজের প্রতিবিম্ব। তবে কি করে সে স্বামীর ছায়ারূপে তার অনুসরণ করে, কোনও রকম ব্যক্তিত্বের লেশমাত্র রহিত হয়ে? এর উত্তর দিতে হলে বৈদিক মানুষের সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে পরিবর্তনের মধ্যে অনুসন্ধান করতে হবে। তারা যাযাবর ও পশুপালক জাতি থেকে কৃষিতান্ত্রিক জীবনে স্থিতিলাভ করল, সেখানে উন্নততর প্রযুক্তি ও লোহার লাঙলের ব্যাপক ব্যবহার— যা অর্বাচীন বৈদিক যুগে দেখা যায়— তার ফলে, এবং মধ্যপ্রাচ্য, গ্রিস ও রোমের সঙ্গে নৌবাণিজ্য সূত্র পুনর্ভুক্ত হওয়ার ফলে সংখ্যালঘু এক শ্রেণির হাতে প্রচুর উদ্বৃত্ত ধন সংগৃহীত হল। এই সংখ্যালঘু শ্রেণির আকাঙ্ক্ষা ছিল এই উদ্বৃত্ত তার প্রকৃত সন্তান-সন্ততির হাতে, অর্থাৎ যে পুত্রদের সে তার পত্নীর গর্ভে উৎপন্ন করেছে, তাদের হাতে দিয়ে যাওয়ার। সন্তানপরম্পরা নির্দিষ্ট করতে এবং পুত্রদের তার উরসপুত্র বলে চিহ্নিত করতে স্ত্রীর অন্য পুরুষ সঙ্গ নিবৃত্ত করা আবশ্যক ছিল। এটি সুনিশ্চিত করা যেত শুধুমাত্র আত্মীয় পুরুষের সঙ্গে স্ত্রীর সাক্ষাৎ নিষিদ্ধ করে। একটি আনুষ্ঠানিক আপাতযুক্তি অবরোধের কারণস্বরূপ দেখানো হয়েছে: ‘পত্নীকে পুরুষসঙ্গ করা থেকে নিরুদ্ধ করতে হবে, কারণ পরলোকে শুধুমাত্র জন্মদাতাই পিণ্ড-তর্পণাদি লাভ করে, স্বামী নয়।’ আসল কারণ অবশ্যই ইহলৌকিক। পিতা পুত্রকে সম্পত্তি দান করার আগে অবশ্যই নিঃসন্দেহে জানবে, সে তার নিজেরই পুত্র, অপর কারও নয়। এরই ফলে নারী বন্দি হল অবরোধে, যেখানে অনাত্মীয় পুরুষের প্রবেশাধিকার নেই।
এই সব ঘটার আগেই নারী তার শিক্ষার অধিকার, জীবিকার অধিকার, সম্পত্তির অধিকার, এমনকী নিজের শরীরকে আপন বলার অধিকার থেকেও বঞ্চিত হয়েছে। নারী হয়ে দাঁড়িয়েছে তার স্বামীর সম্পত্তি। আহার বেশভূষা এবং আচ্ছাদনের বিষয়ে সে তাকে নিয়ে যা খুশি করতে পারে। মনে রাখতে হবে, ‘ভার্যা’ ও ‘ভৃত্য’ শব্দ দুটি একই ‘ভৃ’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন (অর্থাৎ ভরণ করা), এবং মূলগত ভাবে তাদের বিষয়ে একই ধারণা। নিছক জীবিকার প্রয়োজনে স্বামীর উপর নির্ভরশীল নারীর অর্থনৈতিক মূল্য এখন কোনও ভাবেই আর্থিক দিক থেকে নির্ধারণ করা যায় না, কারণ অর্থনৈতিক দিকে তার গৃহকর্ম কোনও উপার্জন আনে না, তার ভূমিকা এখন শুধুই প্রজননমূলক ও সহায়কের। এর ফলে তাদের অবনমন তাদের নিজের কাছে এবং সাধারণ ভাবে সমাজের কাছে যুক্তিসিদ্ধ হয়েছে। উৎপাদনের প্রক্রিয়া থেকে নারীকে সরিয়ে দেওয়ার ফলে তাকে সহজেই বোঝানো যেত যে, তার স্বামীই তার ভরণপোষণ যোগায়। তার গৃহকর্ম প্রচলিত অর্থে ‘কাজ’ নয়, যদিও তা পুরুষের বেঁচে থাকার জন্য আবশ্যক। বিবাহের সময়ে যেহেতু তাকে দান করা হয়েছে ‘সমগ্র পরিবারের’ হাতে, সে সমগ্র পরিবারের দয়ায় আছে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে, কারণ প্রায়ই তাকে আরও কমবয়সি, আরও সুন্দরী সপত্নীর সঙ্গে বাস করতে হয়েছে।
দাম্পত্য জীবনে আনুগত্যের একপেশে ব্যাখ্যা ছিল; স্ত্রী বিবাহের শপথের প্রতি অনুগত থাকবে, কিন্তু শাস্ত্রানুসারে পুরুষ তা বিনা শাস্তিতে অবহেলা করতে পারে। নারীর বিবাহের কর্তব্যের অংশবিশেষ হচ্ছে পুত্র সন্তানের জন্ম দেওয়া, এবং সে যদি এই কর্তব্য পালন করতে না পারে তবে সমাজের অনুমোদন নিয়েই তাকে ত্যাগ করা যায়— শাস্ত্রের অনুশাসন মতে। ধর্মগ্রন্থে এমনও বলা হয়েছে, অসতী স্ত্রীকেও ত্যাগ করা উচিত নয়। অন্যান্য শাস্ত্রে বলা হয়েছে, স্বামী পরিত্যক্তা মায়ের জন্যও পুত্র তর্পণাদি করবে। এখানে এবং অন্যান্য অনেক শাস্ত্রগ্রন্থে স্বামী পরিত্যক্তা নারীর বিষয়ে প্রমাণ পাওয়া যায়। অশিক্ষিতা, স্বামী পরিত্যক্তা নারীর একমাত্র গতি দাসী বৃত্তি করা অথবা বেশ্যা হওয়া; কোনও ক্ষেত্রেই সম্মান বা সামাজিক নিরাপত্তার কোনও অবকাশ নেই। যদিও স্বামী বা পিতার উদারতায় কিছু কিছু নারী শিক্ষা পেয়েছে, সাধারণ ভাবে তারা শিক্ষা থেকে বঞ্চিতই ছিল। অতএব তারা স্বাধীন ভাবে উপার্জন করার মতো জীবিকা থেকেও বঞ্চিত ছিল। তাছাড়া দক্ষিণ ও পূর্বদিকে আর্যদের আক্রমণের ফলে বিস্তার ঘটায় অনেক বন্দি দাস হয়ে এসেছিল— তারাই অধিকাংশ গৃহকর্মের ভার নেয় এবং চাষবাস ও পশুপালনে সাহায্য করে। এখন আমরা দুটি মাত্র শ্রেণি পাচ্ছি, ‘অজ্জব ‘ এবং ‘পেসবন্ন’, হেরেনভোক ও হেলট, প্রভু ও ভৃত্য। এর প্রমাণ খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের জৈন গ্রন্থ অংগবজ্জা তে পাওয়া যায়। সুতরাং উচ্চতর শ্রেণির নারীরা খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতক থেকেই উৎপাদনমূলক শ্রম থেকে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে, যে শ্রম ধনমূল্যে পরিণত করা যায়। এতে তাদের এক অবনমনের অবস্থায় নিয়ে আসা হয়। তারা তখন পুরুষের অধীন: পিতা, ভ্রাতা, স্বামী বা পুত্র, যে আহার্য সংগ্রহ করে, যাকে তাদের তুষ্ট রাখতে হয়। নিশ্চয়ই ব্যতিক্রম ছিল, কিন্তু ব্যতিক্রমই নিয়মের প্রমাণ। অর্থনৈতিক অবনমন, যা শিক্ষাগত বিভেদের সঙ্গে যুক্ত, একাধারে নারীর সামাজিক অবস্থানকে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করেছিল।
পত্নী যখন স্বামীর আগে চলত, তার থেকে সমাজ অনেক দূরে চলে এসেছে। মনে পড়ে, কার্টিয়ামা ভারতবর্ষে নারীযোদ্ধার উল্লেখ করেছেন (আনুমানিক ৩২৭ খ্রি.পূ.); এটি অর্বাচীন বৈদিক বা সূত্র যুগের সঙ্গে খাপ খায়। এর কয়েক শতাব্দীর মধ্যেই নারী সম্পূর্ণ ভাবে তার মানবিক সম্মান হারিয়েছে। যদিও ভান করা হয় যে তার সম্মান ছিল, লিখিত তথ্য অন্য রকম প্রমাণ দেয়। সে কুমারী হিসাবে সাহিত্যে উপস্থিত নেই, বিধবা হিসাবে তাকে এক বিষণ্ণ অন্ধকার অস্তিত্বে ঠেলে দেওয়া হয়, তাকে নাগরিক বা সমাজের দায়িত্বশীল অংশ হিসাবে দেখা যায় না; কন্যা বা ভগ্নি হিসাবেও তাকে তত দেখা যায় না। তাকে একটি মাত্র ভূমিকাই দেওয়া হয়, পত্নী ও মাতা রূপে, বিশেষ পুত্রসন্তানের মাতা। সেখানেও তার অস্তিত্ব না থাকারই মতো, কারণ তার ব্যক্তিত্ব স্বীকার করা হয় না, তার চিন্তা ও অনুভূতি, তার আশা ও স্বপ্ন সমাজ সম্পূর্ণরূপে অবহেলা করে। সে বেঁচে আছে শুধু তার স্বামীকে তুষ্ট করতে এবং তার শ্বশুরবাড়ির লোকেদের সেবা করতে। আমাদের সামনে এই পরিণতির অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং দার্শনিক পটভূমিকা অনুসন্ধান করার কাজ রয়েছে। নিঃসন্দেহে খ্রিস্টপূর্ব শেষ সাহস্রাব্দের শেষ কয়েকটি শতক এবং খ্রিস্টিয় প্রথম সাহস্রাব্দের প্রথম কয়েকটি শতাব্দীতে বিদেশি অক্রমণে এ বিষয়ে কিছুটা অবদান আছে। জাতিগত সংকর এবং বর্ণপ্রথার বেড়ে ওঠা জটিলতাও বৈদিক ভারতে নারীর অবস্থার অবনমন ঘটাতে সাহায্য করেছে। আমাদের প্রয়োজন সার্বিক ভাবে প্রত্যেকটি গঠনমূলক বিষয়ে গবেষণা এবং পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ, যাতে ছবিটা আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে ওঠে।
সূত্রাবলি
১. ভারতের মাটিতে ঋগ্বেদের রচনা শুরু হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব দ্বাদশ শতাব্দীর আশপাশে, এবং সর্বাপেক্ষা অর্বাচীন বেদাঙ্গসূত্রের কাল আনুমানিক খ্রিস্টিয় পঞ্চম শতাব্দী।
২. আর্যমণ্ডলে, ২য় থেকে ৭ম মণ্ডল।
৩. ঋগ্বেদ :১২৩:১,
৪. ঐ ১:১২৪:৭,
৫. ঐ ১:৪৬:৪,
৬. ঐ ৩:৬২:৮,
৭. ঐ ১:৬২:১,
৮. ঐ ১:৭৩:৩,
৯. আদর্শ উদাহরণের জন্য ঋগ্বেদ ১:১১৫:২ দ্রষ্টব্য।
১০. দ্রষ্টব্য: মৰ্যো ন যোষামভোতি পশ্চাৎ—একটি সাধারণ উপমা অন্যতম, ঋগ্বেদ ৭:৮০:২ দ্রষ্টব্য।
১১. ঋগ্বেদ ১০:৬১:৫,৭।
১২. ঐ ১০:১০।
১৩. ঐ ৩:৪৫:১।
১৪. তৈত্তেরীয় ব্রাহ্মণ ২:৪:৫:৫৬।
১৫. ঋগ্বেদ ৪:৫৮:৯।
১৬. দ্র. স্বয়ং সা মিত্রং বুনতে জনে চিৎ; ঋগ্বেদ ১০:২৭:১২।
১৭. ঐ ৪:৫:৫।
১৮. শতপথ ব্রাহ্মণ ১২:৭:২:১।
১৯. ঋগ্বেদ ১০:১০২:২।
২০. সাংখ্যায়ন গৃহ্যসূত্র ৪:১০:৩; আপস্তম্ব গৃহ্যসূত্র ৩:৪:৪; কৌষীতকী গৃহ্যসূত্র ১:২৮:২২।
২১. মানব গৃহ্যসূত্র ১:৭৬; বরাহ গৃহ্যসূত্র ১০:৫।
২২. স্মৃতিচন্দ্রিকা, মাইসোর জি আই এস সংস্করণ, পৃ. ৬২।
২৩. বৃহদারণ্যকোপনিষদ ৬:৪:১৩।
২৪. ঐ ৩:৬:১।
২৫. তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ১:১১:৪।
২৬. ঋগ্বেদ ১০:৮৫:৪৬।
২৭. অথর্ববেদ ৮:৬:২৪।
২৮. মনুসংহিতা ১:১০, ১১; ৩:৬; ৪:৬।
২৯. তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ১-৫; ২-৩১; ভরদ্বাজগৃহ্যসূত্র ১:২২; আপস্তম্ব গৃহ্যসূত্র ১:৩:৩।
৩০. ঋগ্বেদ ১;১১৭:৭; ১-০:৩৯:৩; ৪০:৫।
৩১. ঐ ৬;২৮:৫; ১০:২৭:১২।
৩২. দ্র. উদীর্ধ নার্যভি জীবলোকম্ ইত্যাদি, ঋগ্বেদ ১৫:১৮:৮।
৩৩. অথর্ববেদ (০. ১৮:৩:৩:১)।
৩৪. তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ৩:৪:১১:১।
৩৫. অথর্ববেদ ৯:৫:২৭।
৩৬. ঐ ৫:১৭:৮:৯।
৩৭. ঋগ্বেদ ৪:১৬:১৯, ৩০; ৪:১৯:৯।
৩৮. ঐ ১;১৬৭:৪; ২:১২:১২, ১৫, ১৬।
৩৯. অথর্ববেদ ১৫:১:৩৬; ২০:১৩৬:৫।
৪০. বশিষ্ঠ সংহিতা ৩:১।
৪১. তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ৩:৪:১১:১।
৪২. এই গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত ‘প্রাচীন ভারতে গণিকা’ দ্রষ্টব্য।
৪৩. ঋগ্বেদ ৭:৫৫:৫-৮।
৪৪. ঐ ১:২১২:৭; এবং ১:১১৬:১।
৪৫. তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬:৬:৪:৩; তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ১:৩:১০:৫৮।
৪৬. মহিষী, বাবাতা, পরিবৃত্তি (বা পরিবৃত্তি) এবং পালাগলী
৪৭. তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ ১:৩:১০:৫৮।
৪৮. ঐ ৩:৫:৩:৪৭।
৪৯. শতপথ ব্রাহ্মণ ২:৩:২:৮।
৫০. ঐ ৯:৪:১:৬।
৫১. ঋগ্বেদ ৭:২৬:৩।
৫২. তৈত্তিরীয় সংহিতা ২:৩:৫:১৩।
৫৩. অথর্ববেদ ১১:৫:১৮।
৫৪. দ্র. কুলায় হি স্ত্রী প্রদীয়তে— ধর্মসূত্র ২:১০:২৭:৩।
৫৫. বা. ব্রা. ১৪:১:১৩১।
৫৬. ঐ ৩:২৫:২৭; আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১:১০:৫১-৫৩।
৫৭. শতপথ ব্রাহ্মণ ১:০:২:২; ৩:৪:২২; ৫:২:১-১০।
৫৮. গৌতম ধর্মসূত্র ১৮:১।
৫৯. সীতার হিরণ্ময় প্রতিকৃতিই মাত্র রামের যজ্ঞের পক্ষে যথেষ্ট ছিল, এই তথ্যই এর সমর্থন করে।
৬০. মনুসংহিতা, ৪:৭:৪।
৬১. আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ২:৭:১৫:১৭।
৬২. আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১:১০:৫১-৫৩।
৬৩. শতপথ ব্রাহ্মণ ৫:২:৩:১৩।
৬৪. বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র ২৮:২-৩।
৬৫. ঐ ২১:৮:১০।
৬৬. বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র ২১:৮-১০।
৬৭. বৌধায়ন গৃহ্যসূত্র ২:২:৬৩, ৬৪ এগুলি যে সাধারণ সদিচ্ছামূলক উক্তি প্রমাণিত হয় রামের আচরণে এগুলির প্রতি সামগ্রিক অবহেলা, অহল্যার প্রতি গৌতমের এবং রেণুকার জমাগ্নির আচরণ থেকে এই মানবিক রীতিগুলি যে অনুসরণ করা হত না তার অসংখ্য প্রমাণ পাওয়া যায়।
৬৮. আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১:১০-১৯, ২৮।
৬৯. বৌধায়ন ধর্মসূত্র ২:২:৬৩, ৬৪
৭০. বৌধায়ন ধর্মসূত্র ২:৪:৬; আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ২:৫:১৪; সমর্থন করে মনুসংহিতা ৯:৪।
৭১. বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র ২১:৮-১০।
৭২. তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬:৫:১০:৩।
৭৩. ওঁ মম ব্ৰতে তে হৃদয়ং দধাতু মম চিত্তমনু চিত্তং তে….
৭৪. ধ্রুবো দ্যৌধুবা পৃথিবী… ধ্রুবা স্ত্রী পতিকুলে ইয়ম্।
৭৫. বৃহদারণ্যকোপনিষদ ১:৯:২:১৪।
৭৬. শতপথ ব্রাহ্মণ ১৩:২:২৪ বশিষ্ঠ ধর্মসূত্র ৫:১-২, ২:২, ৩, ৪৪, ৪৫।
৭৭. মৈত্রায়নী সংহিতা ১:১০:১১; ৩:৬:৩।
তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬:৫:৮:৭।
৭৮. শতপথ ব্রাহ্মণ ৪:৪:২:১৩।
৭৯. বৃহদারণ্যকোপনিষদ ৬:৪:৭।
৮০. তৈত্তিরীয় সংহিতা ২:৫:২:২০।
৮১. ওই ৬:৬:৮:৫।
৮২. আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ২৩:৪; হিরণ্যকেশী গৃহ্যসূত্র ১:৪:১৪:২।
৮৩. বৃহদারণ্যকোপনিষদ ১:৯:২:১৪।
৮৪. শতপথ ব্রাহ্মণ ১৩:২:২৪।
৮৫. ভুক্তোচ্ছিষ্টং উবেব দদ্যাৎ খাদির গৃহ্যসূত্র ১:৪:১১: ক্রিয়াপদে বিধিলি লক্ষণীয়।
৮৬. অথর্ববেদ ৬:৩:৭:১৩।
৮৭. তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬:৫:১০:৩; মৈ. সং. ৪:৬:৪।
৮৮. ঐ ৬:১:৮:৫।
৮৯. আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১:১০:২৮:২৯।
৯০. বৃহদারণ্যকোপনিষদ ৪:৪:১২, ১৩; হিরণ্যকেশী গৃহ্যসূত্র ১:৪:১৪:৭।
৯১. কৃষ্ঠক সংহিতা ১:১০:১১:৩:৬:৩।
৯২. শতপথ ব্রাহ্মণ ১৪:১:১:৩১।
৯৩. কৃষ্ঠক সংহিতা ৩১:১।
৯৪. মৈত্রায়ণী সংহিতা ১:১০:১১; ৩:৬:৩।
৯৫. আপস্তম্ব ধর্মসূত্র ১:৯:২৩, ৪৫।
৯৬. তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬:৫:৮:২।
৯৭. ঐ ২:৩:১০:৭।
৯৮. গৌতম ধর্মসূত্র ১২:৩৯।
৯৯. শাঙ্খায়ন শ্রৌতসূত্র ১২:২৯:২১।
১০০. মনুসংহিতা ৩:৬:৩; ৪:৬:৭; ৪:৭:৪।
১০১. ১০:১; তৈত্তিরীয় সংহিতা ৬:৫:৮:২।
১০২. শতপথ ব্রাহ্মণ ১৩:১:৯:৬।
১০৩. হিরণ্যকেশী গৃহ্যসূত্র ১:৬:১২:১৪।
১০৪. উষো যাতি স্ব সরস্য পতনী; ঋগ্বেদ
Uttor টি chai
কিসের উত্তর চান আপনি?
Ata ki history project
অসাধারন লেখা। তবে একটি মাত্র প্রশ্ন রেফারেন্স কি ভুল দেওয়া হয়েছে? কারণ আপনি যে রেফারেন্স দিয়েছেন সেখানে আমি সেই তথ্য পাইনি। হয়তো আপনি কোনো বই থেকে দেখে রেফারেন্স সংগ্রহ করেছেন। তাই সেগুলোর সত্যতা আপনার যাচাই করা উচিত। আর যদি পারেন সংস্কৃতেই মূল পরবেন অথবা ভাষ্য অযথা ভূলভাল ইংরেজি অনুবাদ দেখে চেচামেচি করবেন না। আর একটি কথা বৈদিক যুগে আপনি যেখানেই নারীরা অবহেলিত দলিত বলে প্রতিপাদন করেছেন সেখানেই স্মৃতি-প্রমাণ কেন দিয়েছেন? আর যা বৈদিক প্রমাণ দিয়েছেন সেগুলোর অর্থ ভিন্ন। সময় থাকলে চেক করবেন। আপনার উত্তরের অপেক্ষায় রইলাম……….