বীতে হুয়ে দিন
বহু, বাবুজি, চুনারের টাঙ্গাওয়ালা লাম্পু আমাকে বলেছিল, সব কুছ দেতা হ্যায়। জান ভি দে সকতা। লেকিন কান্ধা নেহি দেতা।
নভেম্বর, ১৯৭০। বিয়ের পর, কাশী থেকে একদিনের ট্যুরে আমরা গিয়েছিলাম চুনার ফোর্ট দেখতে। একটা গোটা পাহাড় জুড়ে লম্বায়-চওড়ায় সে এক এলাহি ব্যাপার। মৌলিক এবং অনন্য।
এক সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র দুর্গ-ঘরানা।
সব দুর্গেই যেমন, চুনারেরও প্রবেশদ্বার একটি মাত্র। এরও চারিদিকে পরিখা ও প্রাচীর অন্তত, যেতে যেতে, প্রায় শেষ পর্যন্ত এমনটাই ধারণা হয়, যে তাই। এরও তো সর্বত্র ছড়িয়ে সেই ভাঙা গম্বুজ, পড়ে-থাকা খিলান, ও জাফরিহারা গবাক্ষ। প্রহরীবিহীন,অনর্গল বন্দিশালা। এ আর নতুন কী। কিন্তু, একেবারে শীর্ষে উঠে এ ভুল ভাঙে। দেখা যায়, চার নয়, এর মাত্র তিনদিক জুড়ে ছিল প্রাচীর ও পরিখা; এবং দক্ষিণে, যেদিকে হাজার হাজার ফিট নিচে পড়ে আছে, শীতের পাতলা রোদে, ভূপাতিত গঙ্গার মাইল-মাইল জলছবি, সেই একটা দিক অবারিতভাবে সম্পূর্ণ উন্মুক্ত!এ অবাক উন্মােচনের মুখোমুখি হয়ে সহসা, স্তম্ভিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। অপরিসর, কোথাও একজনের মতো পথ ও সিঁড়ি ধরে উঠে এসে আগাগোড়া গুমোটের পর এই হু-হু হঠাৎ হাওয়া–শুধু এইখানে শুধু এই দুর্গচূড়াটিকে ঘিরে!
দুটি ভাঙাচোরা আটপৌরে কবর শুধু। এখানে।
বস্তুত, এমন দুর্গও আমার এখনও দেখতে বাকি, যার ক্রমোচ্চ রাজপথ, দুই পাশে রেখে শত শত হৰ্ম, খিলান ও গম্বুজের ধ্বংস; এভাবে, ক্রমাগত, না থেমে, শুধু উঠেই গেছে এবং দুর্গের শীর্ষবিন্দুতে উঠে পেয়েছে পরিণতি, যেখানে পাশাপাশি শুয়ে আছে দুটি জরাজীর্ণ কবর, যাদের কেন্দ্র থেকেই হয়ত, যা আগে বলেছি, সেখানে হঠাৎ এমন অবোধ হওয়া। চাপা গুমোট-গরম ঠেলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ক্রমাগত ওপরে উঠে, নিচের পাতাল-গঙ্গা থেকে চোখ তু®, ঊর্ধ্বে স্বর্গ-নীলিমার দিকে প্রথমবার তাকালে যখন পায়ের কাছে দু-দুটি কবর–এরকম মনে হতেই পারে এবং আমারও হয়েছিল, যে, অতীতে ওই অন্তরীক্ষের সঙ্গে এই দুর্গ-স্থাপত্য নিশ্চিত একটা সুসম্পর্ক পাতাতে চেয়েছিল (নইলে আর চড়চড় করে ওভাবে উঠে এসেছিল কেন আকাশের দিকে), এমনকি পাতিয়েও ছিল–যে সম্পর্ক শের শাহরও ঢের পূর্বে, সেই প্রাক-মধ্যযুগ থেকে, যত ভেঙেচুরেই যাক, আজও একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। অবশ্য, শুধুই মনে হওয়াহয়ির ব্যাপার এ যে; তাও নয়। পৃথিবীর সমস্ত রকম আবহাওয়া-প্রহৃত ভাস্কর্য বা স্থাপত্যের সঙ্গে মহাজগৎ তথা ব্রহ্মাণ্ড-চেতনার একটা পরোক্ষ সম্পর্কের কথা কখনই অস্বীকার করা হয়নি। এ-তত্ত্ব চুনারের ক্ষেত্রেই বা প্রযোজ্য হবে না। কেন?
ফোর্ট দেখা শেষ হতে সকাল থেকে দুপুর, দুপুর গড়িয়ে বিকেল। ঘোরাঘুরি আমিই করলাম বেশি, সঙ্গে লালু। দীপ্তি ওপরে কবরের পাশে বসে রইল। একবার ঘণ্টাখানেক পরে ফিরে দেখি, কবরে মাথা রেখে বেচারা ঘুমিয়েই পড়েছে।
হাতে তখনও ঘণ্টা-দুই সময়। ফেরার ট্রেন সাড়ে সাতটায়। স্টেশনের পথে লালু বলল, জিন্দা পিরকা দরগা দেখিয়ে গা বাবুজি?
জিন্দা পির?
হ্যাঁ, বাবুজি। জিন্দা!
বলতে বলতে একটা ন্যাড়া ছোট পাহাড়ের ধারে সে টঃ-টঃ-টঃ-টঃ শব্দে টাঙ্গার অশ্বক্ষুরধ্বনি থামায়। পিরের কবর দেখতে হলে পাহাড়ে উঠতে হবে, সে আমাদের জানাল।
একবেলায় চুনারের যেটুকু দেখা বা বোঝা গেছে, তাতে একটা বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ হয়েছি। যে, গ্রামে নিঃসন্দেহে আলাদা করে কোনও গোরস্থান নেই। যে জন্যে, গোটা গ্রামটাই এভাবে, দিনে দিনে, একটা কবরখানার চেহারা নিয়েছে। দুর্গের মধ্যে তো বটেই, ফোর্টে ঢোকার আগে, পাহাড়ি পাকদণ্ডীর ধারে ধারে দুদিকে সারবন্দী কবর, পাহাড় ধরে গঙ্গার তীর পর্যন্ত নেমে গেছে। ফোর্টের বাইরে গ্রাম জুড়ে বাড়ির সামনে ও খিড়কিতে কবর। খেতের মধ্যে ও ধারে ধারে, গাছতলায়, কুয়োর ধারে–গ্রাম ছাড়িয়ে পথের পাশে–এখানে কবর নেই কোথায় যে। নুড়ির মত যত্রতত্র ছড়িয়ে।
বিয়ের প্রথম বছরটা দীপ্তি বোধহয় আমাকে অবজার্ভেশনে রেখেছিল। পিরের কবর দেখতে আমি আর লালু পাহাড়ে উঠলাম, সে বিশেষ আপত্তি করল না। না না, যাও না তুমি, দেখে এস, বলে অদূর অতীতের সেই রণ-ধর্ষিত প্রান্তরে, টাঙ্গার ওপর, একা বসে রইল। জোত খুলে লালু ঘোড়ার মুখে ঝুলিয়ে দিল জাবনার লম্বাটে থলে।
জিন্দা পিরের নাম পির সুলেমান। পিরের কবর একেবারে সেই পাহাড়ের টঙে।
টিলার ওপর সাঁই-সাঁই হাওয়া। পশ্চিম দিগন্ত জুড়ে পৃথিবীর একমাত্র নতজানু পর্বতমালা: বিন্ধ্য। সূর্য এদিকেই অস্ত যাবে। দক্ষিণে, নদীর বিশাল বাঁক দিয়ে পেঁচানো দুর্গের গম্বুজগুলো… ঐতিহাসিক স্থানগুলি, এরকম অস্তরাগের আলোয়, দূর থেকে দেখতেই ভাল লাগে। বিমূর্ত দেখায়।
নিচে পথের ধারে বাচ্চাদের খেলনা-গাড়ির মতো লাল্লুর টাঙ্গা, পাশে এখন কুকুর-ছানা সাইজের ঘোড়াটা। ইতিহাস বইয়ের পাতায় একটা সাদাকালো ছবি যেন।
ভাবতে বেশ মজা লাগে যে ওই ছোট্ট খেলনা-গাড়ির মধ্যে দীপ্তি এখন একা বসে আছে। অলীক মনে হয় এখান থেকে। অবিশ্বাস্য! ওইটুকু গাড়ির মধ্যে? কিন্তু, সত্যিই তো তাই। দীপ্তি এখন ওই খেলনা-গাড়ির সঙ্গে মানানসইভাবে এই এতটুকু হয়ে ওরই মধ্যে বসে, যদিও, তার প্রমাণ সাইজের অস্তিত্ব-সহ।
যাই হোক, দরগা না ছাই। বেকার আসা এতদূর, আলো দিতে, এই বাঁশঝাড়ে! ভাগ্যিস, দীপ্তি আসেনি।
নীলবড়ি দিয়ে রঙ করা আয়তাকার সিমেন্টের বেদি একটা। তাকে ঘিরে শুকনো কঞ্চির বেড়া—এক থোকা ধূপ জ্বলে জ্বলে ছাই হয়ে উড়ে গেছে কখন। শুধু ধূপের গোড়াগুলো মাটির ডেলায় গাঁথা। নষ্ট ফুল।
একে ঘিরেই, লালু জানায়, হর সাল জানবারি মাসের প্রথম চাঁদের দিন হয় উর্স–জিন্দা পিরের মেলা, তখন এই দরগার মাথায় চাঁদোয়া লাগে। তখন এই ছোট্ট পাহাড় ঘিরে লোকে লোকারণ্য। সিনিমার তাম্বু পড়ে তখন। উর্স কমিটি এইসান ভারী ভারী হাণ্ডা লিয়ে আসে। খিচুড়ি বানায়। মেলা চলে সাত রোজ। সাত রোজই গোরের মধ্যে বসে মৃত পির আমজনতার সঙ্গে তিন দফে নমাজ আদায় করেন। কোনও কোনও রাতে বাজনার শব্দ ভেসে আসে। কবরের ভেতর থেকে।
বহুৎ সা আদমি শুনা হ্যায়, লাল্লু নামতে নামতে বলতে থাকে, হামারা বাপ-চাচা দোনো শুনা হ্যায়। হাম? মেরা নসিব মে তো আভিতক … লেকিন বাবু, খুদাকা রহম গিরেগা–তব না শুনেগা?
আধাআধি নেমে, পাহাড়ের একটা বাঁক নিতে, নিচে দীপ্তিকে স্পষ্ট দেখা যায়।
টাঙ্গা থেকে রাস্তায় নেমে সে হাত নেড়ে তাড়াতাড়ি নেমে আসতে বলছে। তার অতি ক্ষীণ কণ্ঠস্বরও এখানে ভেসে আসে। অবশ্য, সে নিরাপদ এটা বেশ বোঝা যাচ্ছে। এখনও যথেষ্ট আলো রয়েছে। ঘোড়া ছাড়া ওর ধারেকাছে কেউ বা কিছু নেইও। হয়ত সাপটাপ। দেখেছে বড়জোর।
আমার মুখ জুড়ে তবু আশঙ্কার ছায়া ঘনিয়ে আসে।
জলদি আ-ও লাল্লু।–আমি বলি।
হাঁ! হাঁ, বাবুজি। চলিয়ে।
তারপর পাহাড় থেকে দ্রুত পায়ে নামতে নামতে, ঘোড়ার রাগী ছপটি দিয়ে ভেঙে একটা আকন্দের ডাল, হঠাৎ, কেন কে জানে, আমার উদ্দেশে লালু ওই বাক্য কটি বলে। যে, বহু, বাবুজি.. লেকিন কান্ধা নেহি দেতা।
ও যা বলতে চায় তার ভাবার্থ শোনামাত্র টের পাইনি, এমন কথা বলব না। কিন্তু, কান্ধা শব্দটি ইতিপূর্বে শোনা না থাকায় আমি খুব নিশ্চিত হতেও পারছিলাম না।
কান্ধা?
আমি দাঁড়িয়ে পড়ে ওর কাছে জানতে চাই।
কান্ধা বাবুজি?
উত্তরে বাঁহাতের তর্জনী দিয়ে বাম কাঁধে টোকা মেরে সে ইঙ্গিত করে। তারপর কাঁধের পাশে হাতের মুঠি রেখে, হাসতে হাসতে, যেন হাতে কিছু ধরে আছে এমন ভাবে, একটা কিছু দোলায়। আমার চোখের সামনে চুনারের যুবক টাঙ্গাওয়ালা মুহূর্তের জন্য রূপও পোশাক বদল করে যেন এই মুর্দা-গাঁওয়ের এক শববাহকে পরিণত হয়। (ইয়ে তো মুর্দা গাঁও হ্যায় বাবুজি, কিতনা ফাইট হুয়া হ্যায় হিয়া পে, ইস চুনার মে। আপ তো সব কুছ জানতে হোঙ্গে।) কালো পাথর থেকে কুঁদে বের করা তার মুখের অগণন বসন্তক্ষতের মধ্যে সর্বজ্ঞ বৃদ্ধের দন্তহীন আবিল হাসি জমা হতে আমি দেখি।
আমি বেশ ভয় পাই। তাকে দেখে।
দীপ্তি রাগ করেছে। কিন্তু রাগ করে, না বুঝে, সে বসে পড়েছে এ কোথায়? না, একটি চারকোণা পাথরের ওপর। এটাও কি একটা কবর হতে পারে না?
যদি পুরুষের কবর হয়, এর স্ত্রীও শবানুগমন করেনি। কান্ধা দেয়নি। আমার মনে হল।
সেবার কাশীতে আমরা উঠেছিলাম পাড়ে হৌলিতে। সে অনেক বছর আগের কথা। তখনও আমাদের বিয়ের বছর ঘোরেনি।
বাঙালি ভদ্রলোকের আটপৌরে হোটেল। নাম সেন লজ। জানালার নিচে দিয়ে চৌষট্টি যোগিনী ঘাটের সিঁড়িশ্রেণী নেমে গেছে। দুদিকে বাড়িঘর, দেওয়াল। তার মধ্যে দিয়ে এক চিলতে প্রায়ান্ধকার গঙ্গা দেখা যায়। পাল-তোলা একটি বজরা গেলে, বোঝা যায়। ওপারে রামনগরের আলো।
ব্রিজে একটা মালগাড়ি ঢুকেছে। যাচ্ছে তো যাচ্ছেই। জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আমি বলি, ওই যে টাঙ্গাওয়ালাটা, চুনারের। মুখটা আজ আমাকে কি বললে জানো দীপু?
দিনের তুলনায় রাতে এখানে দিব্যি শীত। হোটেল থেকে কম্বল ও খেশ দুই-ই দিয়েছে। অর্থাৎ রাতে খেশ, ভোরে কম্বল। যদি ভোরে ভুলে যায়, দীপ্তি এখন থেকেই কিছুটা কম্বল টেনে নিয়েছে।
দু-দুটান ধোঁয়া ছেড়েও উত্তর এল না দেখে আমি স্বতঃপ্রণােদিত হয়ে বাকিটা বলে ফেলি।
ওই পিরের কবর দেখে নামছি যখন। ব্যাটার হাজার পাঁচেক বছরের ভারতীয় মুণ্ডু বলে কিনা, বহু বাবুজি, মানে বৌ আর কী…
বৌ আর কী?
বললে, স্ত্রীরা সব দিতে পারে স্বামীর জন্যে। এমনকি জানও দিতে পারে। কিন্তু তারা কান্ধা দেয় না।
তার মানে?
কান্ধা মানে, ওই কাঁধ আর কী!
মানে? কী বলতে চাইছে ও?
হায় রে অভিমানিনী নারী! এরও মানে? এখনও প্রাঞ্জল হল না? দীপ্তি কি কখনও নিজে কিছু ভাববে না! ভাববার যা, ফ্রয়েড আর ইয়ুং, ম্যাকদুগাল আর টিচনার, আগেই ওর হয়ে ভেবে রেখেছে।
তবে, অশিক্ষিত খোট্টা টাঙ্গাওয়ালা কী-আর এমন বলে থাকতে পারে যা না জানলে দীপ্তির চলবে না। আমি বুঝিয়ে বলতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু, আমাকে বাধা দিয়ে সে বলল, উহুহু।অর্থাৎ, শীত। তারপর বলল, তোমার সিগারেট খাওয়া হল?
অর্থাৎ, রাতের মেলামেশা করার যদি ইচ্ছা থাকে, ঝটপট এস। জলদি কর। লাল্লু কী ছাই-পাঁশ তোমাকে বলেছে, সেগুলো শোনানোর মতো কোনও কথা নয়। ভাববার মতো ভাবনা নয়। এখন ভাবনার বিষয় হল, আমার ঘুম। এবং, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। জীবনে
যে যত বেশি ঘুমোতে পেরেছে, তার তত জিত। এবং যার ঘুমে যত কম স্বপ্ন।
ব্লাউজের পিঠের দিকের হুক খোলায় তার সঙ্গে দাম্পত্য সহযোগিতা করার ফাঁকে আমি সাদা বাংলায় ওকে, একটু দেরিতে হলেও, এবার পুরোটা শুনিয়ে দিই, মানে হল গিয়ে, স্ত্রীরা। আর কি, স্বামীর শবযাত্রার সঙ্গী হয় না। লাল্লু বলছিল। তারা শ্মশানে যায় না।
তাদের কাজ শুধু স্বামীর বেঁচে থাকাটুকু নিয়ে বলতে বলতে কোমর জড়িয়ে ধরে আমি তাকে বুকে টেনে নিই।
দার্শনিকতা পুরুষদের ব্যাপার। কৃষ্ণ থেকে শঙ্করাচার্য, ডায়োজেনিস থেকে দেকার্ত–সবাই পুরুষ মানুষ। নইলে তো এক-আধটা মেয়ে থাকত। দীপ্তি কখনও কোনওপ্রকার দার্শনিকতার ফাঁদে পা দেয় না। সে মেয়েমানুষ।
তবু, এত তাড়াতাড়ি সে উত্তর দেবে, ভাবতে পারিনি।
তার রূঢ় স্তনবৃন্ত আমার বুকে খরখর শব্দ তুলে নিচু স্বরে জানায়, লাল্লু ঠিকই তো বলেছে।