০১. বিরাট আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে

বিরাট আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে চুল ব্যাক ব্রাশ করতে করতে ক্যাপ্টেন রায় গুনগুন করে সুর আওড়াচ্ছিলেন, এ মণিহার আমায় নাহি সাজে–।

কোন্ মণিহার? আমি অফিসার হয়ে এই এ-ডি-সি-র চাকরি? নাকি মণিকা?

বোধহয় মনে মনেই নিজেকে প্রশ্ন করেন ক্যাপ্টেন রায়। মুখে কিছু বলেন না, শুধু ঠোঁটের কোণায় মিষ্টি হাসির রেখা ফুটে ওঠে। সামনের আয়নায় দেখে চোখ দুটো কেমন যে রোমান্টিক হয়ে নীরব ভাষায় কত কথা বলে।

ব্যাক ব্রাশ করতে করতেই একবার হাতের ঘড়ি দেখে নেন। না, ঠিক আছে। এখনও পঁচিশ মিষ্টি হাতে আছে।

মুখোনা একটু এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখে নেন। ঠিক আছে তো? হ্যাঁ, হ্যাঁ, বেশ দেখাচ্ছে। সকাল বেলায় হট বাথ নেবার পর শরীরের সঙ্গে সঙ্গে মনটাও বেশ সতেজ হয়ে ওঠে। তারপর ইউনিফর্ম পরলে বেশ লাগে।

ব্রাশটা নামিয়ে রাখলেন। এবার একটু পিছিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজেকে আবার ভালোভাবে দেখে নেন। ও-কে!

আবার গুগুন করে কি যেন একটা সুর আওড়াতে আওড়াতে ক্যাপ্টেন রায় ওপাশে একটু এগিয়ে গিয়ে একটা সেন্টার টেবিল থেকে আর্ম ব্যাচটা তুলে নিলেন। স্যাফরন কলারের ব্যাচের মাঝে ভুলে যাওয়া অতীত ভারতের অশোকস্তম্ভ। ওটা এখন ভারতের প্রতীক। আর্ম ব্যাচের ওই অশোক পিলারের প্রতিকৃতি দেখে মুচকি হাসেন ক্যাপ্টেন রায়। হাসবেন না? মনে মনে ভাবেন যদি কোনো মাস্টারমশাই ধরনের লোক জিজ্ঞাসা করেন, ওহে ছোঁকরা, বৈষ্ণবদের। তিলক কাটার মতো সর্বাঙ্গে তো অশোকস্তম্ভের ছড়াছড়ি! বলতে পার সম্রাট অশোক কোথায় জন্মেছিলেন? কবে জন্মেছিলেন? এই অশোকস্তম্ভ কোথায় পাওয়া গিয়েছিল?

এসব কিছু জানে না সে। হয়তো স্বয়ং গভর্নরই…। চাকরি করতে কি জ্ঞান বুদ্ধির দরকার হয়? তাহলে তো প্রায় কারুরই চাকরি বাকরি করা হতো না। ইউনিভার্সিটির একটা চোথা সার্টিফিকেট হলেই সরকারি চাকরি পাওয়া যায়। বিদ্বান, বুদ্ধিমান বা কর্তব্যপরায়ণ হলে চাকরিতে বিভ্রাট হয়।

এই সাত সকালে যত সব আজেবাজে চিন্তা! ক্যাপ্টেন রায় আর্ম ব্যাচটি তুলে হাতে পরেন। বেশ লাগে দেখতে।

চট করে আবার হাতের ঘড়ি দেখে নেন। না, না, আর দেরি নয়। আটটা কুড়ি হয়ে গেছে। মাত্র দশ মিনিট বাকি। ওপাশের টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে পার্সটা পকেটে পুরে নিলেন, পেন, বলপেনটাও তুলে নিলেন।

দরজায় দুবার নক করার আওয়াজ হল।

কাম ইন।

অশোকস্তম্ভ মার্কা সিগারেটের একটা টিন ও একটা দেশলাই হাতে করে আমজাদ আলি ঘরে ঢুকল।

নমস্তে। নমস্তে বলেই হাত বাড়িয়ে সিগারেটের টিন আর দেশলাইটা নিলেন ক্যাপ্টেন রায়।

সব সময় অবশ্য গৌরবে বহুবচন হয় না। গভর্নরের অবর্তমানে বা প্রোটোকলের নিয়মানুসারে অনেক সময় এ-ডি-সি-কেই গভর্নরের প্রতিনিধিত্ব করতে হয়। ভাগ্যক্রমে অনেক সময় সে-সব ছবিও খবরের কাগজের পাতায় পরদিন সকালে দেখতে পাওয়া যায়।

আমজাদ আলি বেড-টি তৈরি করতে করতেই ক্যাপ্টেন রায় দেখে নেন খবরের কাগজের পাতায় নিজের বা অন্য সহকর্মীর ছবি। বেশ লাগে। চীফ অফ দি আমি স্টাফের ছবি নানা কারণে খবরের কাগজে ছাপা হলেও লেফটেনান্ট জেনারেল বা মেজর জেনারেলের ছবি খবরের কাগজে ছাপা হয় না বললেই চলে। অথচ ক্যাপ্টেন রায়ের মতো এ-ডি-সি-দের ছবি হরদম কাগজে ছাপা হচ্ছে।

একটা স্কুল গ্লোবের উপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে নিতে যে সময় লাগে, তার চাইতেও কম সময়ে বিশ্ব সংবাদ পরিক্রমা সমাপ্ত করেন এ-ডি-সি সাহেব। তারপর দেখে নেন গভর্নরের কোনো ছবি আছে কিনা। সত্যিকার কোনো ভি-আই-পি-র আগমন নির্গমন হলেই গভর্নর সাহেবকে যেতে হয় দমদম এয়ারপোর্টে। এক গোছ ফুল তুলে দিতে হয় সেই ভি-আই-পি-র হাতে। অথবা দন্ত বিকশিত করে একটা হ্যাঁন্ডসেক। ব্যাস! সূর্যের আলোকে ম্লান করে দিয়ে জ্বলে উঠবে প্রেস ফটোগ্রাফারদের ফ্ল্যাশ বাম্বের আলো। হাই অফিসিয়াল আর পুলিশের হুড়োহুড়িতে তখন কেউ খেয়াল করেন না, কিন্তু পরের দিন সকালের কাগজগুলিতে ঠিক দেখা যাবে কি একটা অজ্ঞাত কর্তব্য সম্পাদনের জন্য ভি-আই-পি আর গভর্নরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে সোনালি-রূপালী বিচিত্র পোশাক পরা এ-ডি-সি!

সভা-সমিতি, লাঞ্চ-ডিনারে গভর্নর বক্তৃতা দিলেও অনেক সময় ছবি ছাপা হয়। সেখানেও লাটসাহেবের পাশে পাওয়া যাবে এ-ডি-সি-কে।

আমজাদ বেড-টি দিয়ে চলে যায়। আবার আসে ঠিক সাড়ে সাতটায়। প্রায় আড়াই ফুট লম্বা রূপোর ট্রে করে নিয়ে আসে ব্রেকফাস্ট। আর আসে এই আটটা পঁচিশে। সিগারেট-দেশলাই দিতে।

অশোকস্তম্ভ মার্কা সিগারেটের টিনটা পকেটে পুরতে পুরতে আবার হেসে ফেলেন ক্যাপ্টেন রায়। হাসবেন না? অশোকস্তম্ভ মার্কা এই সিগারেট খাদি প্রতিষ্ঠানে তৈরি হয় না। পাক্কা বিলেতি কোম্পানির সিগারেট ডবল মাশুল দিয়ে এই স্বদেশীপনার ন্যাকামি প্রচার করা হয় দেশ-বিদেশের অতিথিদের কাছে। দুষ্টু সন্ন্যাসীরা যেমন কাঁচা বিধবা সেবাইত রেখে ভোগ করেন, অনেকটা সেই রকম আর কি! সাধাসিধে মানুষদের ধোঁকা দেবার জন্য চাই মোটা খদ্দর আর রাতের আবছা আলোয় চাই পাক্কা স্কচ! ইতালিয়ান ভারমুখ বা মার্টিনী হলেও চলবে না।

আমজাদের সঙ্গে সারাদিনে আর দেখা হবেনা। রোজ সকালে মেসিনের মতো তিনবার আমজাদ আসে এ-ডি-সি সাহেবের ঘরে। সাড়ে ছটায় ছোট্ট এক পট চা আর একটা সিঙ্গাপুরী কলা নিয়ে। ওই বেড-টি দেবার সময়ই কলকাতার মর্নিং পেপারগুলো নিয়ে আসে আমজাদ। আমজাদই চা তৈরি করে। আর সেই ফাঁকে এ-ডি-সি সাহেব চোখ বুলিয়ে নেন খবরের কাগজগুলোতে।

আর দেরি করেন না ক্যাপ্টেন রায়। প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে পড়েন ঘর থেকে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে করিডোরে দিতে গিয়ে মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ান লর্ড ওয়েলেসলীর ওই বিরাট পেন্টিংটার সামনে। ওই মুহূর্তের মধ্যেই ক্যাপ্টেন শ্রদ্ধা জানান ওই মহাপুরুষকে যাকে ইংরেজরা ঠাট্টা করে বলত Sultanized Englishman. ইংরেজ হয়েও যিনি সুলতানের মতো প্রমত্ত থাকতে ভালোবাসতেন-যিনি লালকেল্লা-কুতব-মিনার-তাজমহল তৈরি না করলেও ডালহৌসী পাড়ায় লাটসাহেবের ওই প্রাসাদ তৈরি করেছেন, তাকে বড় ভালো লাগে ক্যাপ্টেন রায়ের। ইতিহাসের পাতায় লর্ড ওয়েলেসলীর নাম লেখা থাকলেও ভারতের মানুষ তাকে ভুলে গেছে। আধুনিক যুগের ঐতিহাসিকরা হয়তো নানা অপকীর্তির জন্য লর্ড ওয়েলেসলীর বিদেহী আত্মাকে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করাবে, কিন্তু গভর্নর থেকে শুরু করে রাজভবনের জমাদার পর্যন্ত তাকে লুকিয়ে শ্রদ্ধা করবেই। ক্যাপ্টেন রায় তো তাই ডিউটিতে যাবার আগে ওয়েলেসলীর ওই পেন্টিংটার সামনে থমকে দাঁড়িয়ে শ্রদ্ধা না জানিয়ে পারেন না।

এগজ্যাক্টলি অন্ দি ডট! কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে আটটায় এ-ডি-সি ক্যাপ্টেন রায় আধ ডজন বেয়ারার সেলাম নিতে নিতে অফিসে হাজির। লাটসাহেবের ছাপান প্রোগ্রাম সামনেই রয়েছে।

ছাপান প্রোগ্রাম?

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ছাপান। সোস্যালিস্ট ভারতবর্ষের নাবালক সংবিধানের সাবালক অভিভাবককে কি টাইপ করা কাগজে ডেইলি এনগেজমেন্ট দেখান যায়?

সাধারণত সাড়ে আটটা নাগাদই লাটসাহেবও নিজের অফিসে আসেন। সারা দিনের কাজকর্ম নিয়ে এ-ডি-সি ও সেক্রেটারির সঙ্গে একটু কথাবার্তা বলেন। তারপর তিনি ভিজিটার্সদের সঙ্গে দেখা করতে শুরু করেন।

…লাটসাহেবের দপ্তরের দুটি ভাগ। সেক্রেটারি টু দি গভর্নরই সর্বেসর্বা। তবে সাধারণত তিনি কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের সঙ্গে গভর্নরের যোগসূত্র রক্ষা করেন বা তদারক করেন। প্রতিদিন বেশ কিছু সরকারি ফাইলে ও নথিপত্রে গভর্নরকে অটোগ্রাফ দিতে হয়। ঠিক টপ সিক্রেট কাগজপত্র কিছু নয়। অধিকাংশই মামুলি ধরনের আর আসে ক্যাবিনেটের কাগজপত্তর। মন্ত্রীদের ফরমায়েস মতো চীফ সেক্রেটারি বা হোম সেক্রেটারি মারফত যে সব ফাইলের বাণ্ডিল আসে গভর্নরের সেক্রেটারির কাছে, চটপট গভর্নরকে দিয়ে সই করিয়ে সে-সব ফাইল ফেরত পাঠানই সেক্রেটারির প্রধানতম কাজ। কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকেও টুকটাক চিঠিপত্র আসে। সে-সবের সদগতি করাও ওই সেক্রেটারি সাহেবেরই কাজ।

রাজভবনের দেখাশুনা, অতিথি আপ্যায়ন, সরকারি অতিথিশালা পরিচালনা, গভর্নরের ভ্রমণসূচী ঠিক করা, অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক করা ইত্যাদি সব কাজই আগে দেখাশুনা করতে মিলিটারি সেক্রেটারি। ওটা ইংরেজ আমলের নিয়ম ছিল। বীরপুরুষ ইংরেজ যেকালে মনে করত সব ইন্ডিয়ানদের পকেটেই একটা রিভলভার থাকে, সেকালে মিলিটারি সেক্রেটারি ছাড়া ও সব দায়িত্বকে বহন করতে পারত? জমানা বদল গয়া। এখন একজন মামুলী ধরনের ডেপুটি সেক্রেটারি, মিলিটারি সেক্রেটারির কাজ করেন। সাধারণত যেসব অফিসারকে দিয়ে সেক্রেটারিয়েটের দায়িত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে শান্তি নেই, স্বস্তি নেই অথচ ফালতু মাতব্বরী করতে শিরোমণি, তাদেরই পাঠান হয় রাজভবনে।

রাজভবনে পোস্টিং পাওয়া অবশ্য শাপে বর। যাগগে সেসব কথা।

এ-ডি-সি-দের কাজ হচ্ছে গভর্নরের খিদমদগারি করা। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যাধ্যক্ষের হুকুম যারা তামিল করেন, তাদেরই বলা হতো এইড-ডি-ক্যাম্প। জাপানের সম্রাট, রাশিয়া বা আমেরিকার প্রেসিডেন্টের এ-ডি-সি নেই কিন্তু আমাদের গভর্নরদের তিন তিনজন করে এ-ডি-সি থাকে। আশে পাশে কিছু মোসাহেব বা খিদমার ভ্রমরের মতো গুঞ্জন না করলে জমিদার ইংরেজ ঠিক শান্তি পায় না। নিজের দেশে বৌ বাসন মাজবে, কাপড় কাঁচবে, নিজে গাড়ি চালাবে কিন্তু জমিদারিতে এলেই সব ঠুটো জগন্নাথ। তখন কথায় কথায় সেলাম চাই, সেক্রেটারি চাই, সোফার চাই, আয়া চাই, কুক চাই, চাই এ-ডি-সি আর কত কি!

বেশ লাগে দেখতে। হঠাৎ দেখে বুঝবার উপায় নেই যে এরা রাষ্ট্রপতি ভবন বা রাজভবনের বেয়ারা, চাপরাশী, অর্ডালী বা অন্য কিছু। মনে হবে চিৎপুরের যাত্রা পার্টির মীরমদন, মীরকাশিম বা সিরাজের সৈন্যবাহিনীর অন্য কেউ।

ডালহৌসী পাড়ায় বাঙালির ছেলেরা বিন্দু বিন্দু রক্ত দিয়ে মুখের গ্রাসের জন্য দিবারাত্র সংগ্রাম করছে। জীবন-সংগ্রামের এই অকূল সমুদ্রের মাঝখানে রাজভবন একটি ছোট্ট দ্বীপ। অমরাবতী, অলকানন্দা। ক্লাইভ, কার্জন, ডালহৌসীর আত্মা যেন ওখানে এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর মীরমদন, মীরকাশিমের দল তাদের খিদমারী করছে।

ক্যাপ্টেন রায়ের বেশ মজা লাগে। ইনফ্যান্ট্রি রেজিমেন্টের ওই ব্যারাকের জীবন থেকে রাজভবন। এ যেন আলাদীনের আশ্চর্য প্রদীপ। বেগম নেই, বাদশা নেই, সন্ধ্যাবেলায় নর্তকীর। ঘুঙুরের আওয়াজ নেই, নেই সেতারে দরবারি কানাড়া ও মেঘমল্লারের ঝঙ্কার কিন্তু তবু এ যেন বিংশ শতাব্দীর অচিন দেশ!…

পৌনে নটা নাগাদ ছোট্ট একটা তুড়ির আওয়াজ! মীরমদন, মীরকাশিমের দল সম্ভ্রমে সন্ত্রস্ত হয়ে আর একটু সোজা হয়ে দাঁড়াল। ক্যাপ্টেন রায় সঙ্গে সঙ্গে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ইউনিফর্মটা একটু ঠিক করে নিয়েই বেরিয়ে করিডোরে গেলেন। মুহূর্তের মধ্যেই গভর্নর সাহেব বেরিয়ে এলেন অন্দরমহল থেকে।

স্মার্ট আর্মি অফিসারের মতো ক্যাপ্টেন রায়ের দুটো বুটে একটা ছোট্ট ঠোকাঠুকি আর সঙ্গে সঙ্গে একটা স্যালুট।

গভর্নর সাহেব ডান হাতটা তুলে প্রত্যভিবাদন জানালেন।

তারপর একটু মাথা নীচু করে ক্যাপ্টেন রায় বললেন, গুডমর্নিং! ইওর একসেলেন্সী!

গুডমর্নিং!

সিরাজের সৈন্যবাহিনী করজোড়ে মাথা নীচু করে প্রভুভক্তি দেখাল।

গভর্নর নিজের অফিস কক্ষে গেলেন। ছায়ার মতো তাকে অনুসরণ করলেন এ-ডি-সি ক্যাপ্টেন রায়।

গভর্নর সাহেব চেয়ারে বসে বলেন, আজ কেয়া হ্যায়?

স্যার, সকালে তিনজন ভিজিটার্স আছেন। আফটারনুনে মরক্কোর অ্যাম্বাসেডর আসবেন আর ইভনিং-এ মিস রমলা যোশীর একজিবিশন ওপেনিং আছে।

কোনো গেস্ট আসছেন নাকি আজ?

লেট নাইটে বম্বে থেকে ইউনিয়ন ডেপুটি মিনিস্টার ফর সাপ্লাই আসছেন।

গভর্নর সাহেবের চোখমুখ দেখে মনে হল ডেপুটি মিনিস্টার সাহেবের আগমনের খবর শুনে মোটেও খুশি হলেন না।

হাউ লং উইল হি স্টে হিয়ার?

স্যার, উনি চারদিন থাকবেন।

চা-র-দি-ন?

ইয়েস স্যার।

এ-ডি-সি তো নিজের লোক। গভর্নর সাহেব আর মনের কথা চেপে রাখতে পারেন না। বলেন, বুঝলে ক্যাপ্টেন, আগে এইসব লোক বড়বাজারের গলিতে কোনো কাটা কাপড়ের দোকানদারের বাড়িতে উঠত! একটা ছোট্ট দীর্ঘনিঃশ্বাস না ফেলে পারলেন না হিজ এসেলেন্সী। আর আজ! এরাও গভর্নমেন্ট হাউসে উঠছে!

কথাটা বলেই শাস্তি পেলেন না। সমর্থনের জন্য এ-ডি-সি-র দিকে তাকালেন।

ক্যাপ্টেন রায় কি করবেন? মাথাটা একটু নেড়ে চাপা গলায় বললেন, ইয়েস স্যার!

বুঝলে ক্যাপ্টেন…

গভর্নর সাহেব আরো কি বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। দরজার কোণা থেকে একজন বেয়ারা এ-ডি-সি সাহেবকে কি যেন একটা ইসারা করল।

এক্সকিউজ মি স্যার! আমি এক মিনিটের মধ্যেই আসছি।

ক্যাপ্টেন রায় চটপট বেরিয়ে নিজের অফিসে গিয়েই নামিয়ে রাখা টেলিফোন রিসিভারটা তুলে নিলেন।…ক্যাপ্টেন রয় হিয়ার…।

ওপাশ থেকে কিছু শোনার পর ক্যাপ্টেন রায় বললেন, উনি এসে গেছেন? দ্যাটস অল রাইট। উপরে পাঠিয়ে দিন।

এ-ডি-সি আবার গভর্নরের অফিসে গেলেন।

স্যার, মিঃ জগতিয়ানী আসছেন। এখানেই বসবেন নাকি ড্রয়িংরুমে যাবেন?

আরো তো অনেকে আসছেন। অনেকক্ষণ তো বসতে হবে, সো লেট মি গো টু ড্রইংরুম।

গভর্নর ড্রইংরুমে চলে গেলেন। ক্যাপ্টেন রায় গেলেন নিজের অফিসে।

মিনিট দুয়েকের মধ্যেই বেয়ারা মিঃ জগতিয়ানীকে নিয়ে এল এ-ডি-সি-র ঘরে।

ক্যাপ্টেন রায় উঠে দাঁড়িয়ে ডান হাতটা এগিয়ে দিলেন। করমর্দন করতে করতে বললেন, হাউ ডু ইউ ডু স্যার?

আই অ্যাম ফাইন। হাউ ডু ইউ ডু?

ক্যাপ্টেন সিগারেট কেসটা এগিয়ে দিলেন।

না, না, আমি সিগারেট খাই না।

বাঃ, আপনি তো বেশ বাংলা বলেন।

ভবানীপুরে জন্মেছি, সাউথ সুবার্বন স্কুলে পড়েছি। বাংলা বলব না?

ক্যাপ্টেন রায় খুশি হন। মুখে হাসির রেখা ফুটে ওঠে।

মিঃ জগতিয়ানী মজা করার জন্য বললেন, আমি যা বাংলা বই পড়েছি, তা বোধহয় আপনাদের মতো অনেক অফিসারই পড়েননি।

খুব ভালো কথা।

ক্যাপ্টেন রায় হাতের ঘড়িটা দেখেই বাজার বাজালেন। বেয়ারা ঘরে আসতেই মিঃ জগতিয়ানীর নাম ছাপান স্লিপটা তাকে দিলেন। একটু পরেই বেয়ারা ফিরে এল। ক্যাপ্টেন রায় উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, চলুন।

ড্রইংরুমের দরজায় দুবার নক করেই এ ডি-সি ভিতরে ঢুকলেন।

…স্যার, মিঃ জগতিয়ানী ইজ হিয়ার।

মিঃ জগতিয়ানী ঘরে ঢুকতেই ক্যাপ্টেন রায় বেরিয়ে এলেন। আর প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই একটা বেয়ারা চা আর কিছু নাটস্ নিয়ে ওই ঘরে ঢুকল।

নিজের অফিসে ফিরে এসে ক্যাপ্টেন রায় সিগারেটে একটা জোর টান দিয়ে এক গাল ধোঁয়া ছাড়লেন।

ওই চেয়ারে বসেই একটু কাত হলেন। একটু যেন তলিয়ে গেলেন। এ-ডি-সি-র চাকরিতে মজা অনেক। তবে সব চাইতে বেশি মজা বিচিত্র মানুষের সঙ্গে মেলামেশা করে।

আবার সিগারেটে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লেন ক্যাপ্টেন রায়।

স্কুলে পড়ার সময় মনে হতে কত ছেলের সঙ্গে ভাব। তারপর কলেজে পড়বার সময় মনে হয়েছিল, দুনিয়ার সবার সঙ্গেই আলাপ হয়ে গেছে। মানুষ সম্পর্কে এত অভিজ্ঞতা বোধ করি আর কারুর হয়নি, হতে পারে না। আরো পরে আর্মিতে ঢোকার পর মনে হল, দুনিয়ার বিচিত্র মানুষদের সঙ্গে এই প্রথম পরিচয় হল।…

দেরাদুন ন্যাশনাল ডিফেন্স একাডেমির মেসের একই ঘরে থাকত ওরা দুজনে। ক্যাপ্টেন রায় তখন ক্যাডেট রায়। ক্যাডেট কমল রায়। জেনকিন্সও এই ব্যাচের ছিল। পার্ক সার্কাসের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান পরিবারে জন্ম হলেও মনে মনে পুরোপুরি বাঙালি ছিল। কবিতা লিখতে জানত না বটে তবে ভাব প্রবণতায় বাঙালির ছেলেদেরও হার মানাত। প্রবাসী বাঙালি বলে কমল বরং ওর চাইতে অনেক কম ভাবপ্রবণ ছিল। তবু বড় ভাব ছিল দুজনে।

ছুটির দিনে দুজনে সাইকেলে চেপে প্রথমে যেত এফ-আর-আই-এর ওই ছোট্ট মার্কেটের কোণার নোংরা রেস্তোরাঁয়।

জেনকিন্স বলত, বাঙালি হয়ে নোংরা রেস্টুরেন্টে না খেলে যেন মন তৃপ্ত হয় না।

দুজনে দুকাপ চা খেয়ে চলে যেত শহরে, দেরাদুনে। রাজপুর রোডের ধারে কোনো একটা  সিনেমা হলে ঢুকে পড়ত। কোনো কোনো দিন আবার সিনেমা হলে না ঢুকে ওই রাজপুর। রোড ধরেই আরো এগিয়ে যেত সাইকেলে চড়ে। শহরের ধারে পাহাড়ের কোলে বসে গল্প করত ঘন্টার পর ঘন্টা।

কেন ছুটিতে? কত কি করেছে দুজনে।

একবার ছুটি থেকে ফিরে ক্যাডেট কমল রায় মেসে এসে আর দেখতে পেল না জেনকিন্সকে। একদিন, দুদিন, তিনদিন পর হয়ে গেল। জেনকিন্সের পাত্তা নেই। কমলের মনটা বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে উঠল। কয়েকদিন পরে অফিসে খবর নিয়ে জানল, মার্ডার করার দায়ে জেনকিন্স জেল হাজতে।

জেনকিল মার্ডার করেছে? অনেক চিন্তা ভাবনা করার পরও বিশ্বাস করতে পারল না। মাস কয়েক পরে হঠাৎ জেনকিন্সের ছোট্ট একটা চিটি পেল কমল।

…প্রেসিডেন্সি জেলের একটা সেল থেকে এই চিঠি লিখছি। দুনিয়ার সব চাইতে জঘন্যতম কাজ-মানুষ হত্যা আমি করেছি। কাব্যে, সাহিত্যে, শিল্পীর সৃষ্টিতে যে মাকে মহীয়সীরূপে দেখিয়েছে, যার গর্ভে জন্মে আমি ধন্য হয়েছি সেই তিনি পয়সার জন্য এত নীচে নামতে পারবেন, ভাবতে পারিনি। হাজার হোক নিজের মা। তাইতো রিভলভারটা তার দিকে তুলতে পারলাম, যে পিশাচ মাকে কলুষিত করেছিল, সেই তাকেই একটা গুলিতে শেষ করে দিলাম।…

আর কেউ না হোক, অন্তত তুমি আমাকে বিশ্বাস করো।…

চমকে উঠেছিল ক্যাডেট কমল রায়। এই দুনিয়ায় এও হয়? এ-ডি-সি ক্যাপ্টেন রায় সেদিনের কথা ভেবে আপন মনে হাসে। হাসবে না? মানুষের নিত্য নতুন চেহারা দেখতে দেখতে আজ সে মশগুল হয়ে গেছে। মিঃ সর্বাধিকারীর কথা না হয় বাদই দিল। কেন মিস বিশ্বাস? এই বয়েসে কি কাণ্ডটাই করল?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *