০১. বিনয়াধিকারিক – প্রথম অধিকরণ

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্র – রাধাগোবিন্দ বসাক অনুবাদিত
বিনয়াধিকারিক – প্রথম অধিকরণ
রাজবৃত্তি – প্রথম অধ্যায়

ওঁ শুক্রাচার্য্য ও আচার্য্য বৃহস্পতিকে নমস্কার জানাইতেছি। পৃথিবীর (মনুষ্যব্রতী ভূমির) লাভ ও ইহার (লব্ধ ভূমির) রক্ষণবিষয়ে পূর্ব্বাচার্য্যগণ যতগুলি অর্থশাস্ত্র রচনা করিয়া প্রবর্ত্তিত করিয়া গিয়াছেন, প্রায়শঃ সেগুলি সংগ্রহ করিয়া, এই অর্থশাস্ত্রখানি (আমরা) প্রণয়ন করিয়াছি।
এই অর্থাশাস্ত্রখানির প্রকরণ (খণ্ড বিষয়-বিভাগের) ও অধিকরণের (বৃহত বিষয়-বিভাগের) সংক্ষিপ্ত নির্দ্দেশ করা হইতেছে।
(এই স্থলে বলা আবশ্যক যে, নিম্নলিখিত অধিকরণ ও প্রকরণের যে যে নাম মূলগ্রন্থে দেওয়া আছে, তাহার অবিকল বঙ্গানুবাদ এখন সন্নিবেশিত করা কঠিন। দ্বিতীয় অধ্যায় হইতে আরম্ভ করিয়া গ্রন্থের শেষ পর্য্যন্ত সব বিষয়গুলির বিস্তৃত নিরূপণ ও বিবরণ জানা হইয়া গেলে এই সব অধিকরণ ও প্রকরণের সামের সম্যক ব্যাখ্যা হৃদয়াঙ্গম হইবে। কাজেই বাধ্য হইয়া আমাকে এই অধ্যায়ে মূলগ্রন্থের শব্দগুলিকেই অধিকাংশ স্থলে রক্ষা করিয়া সংক্ষিপ্ত ভাবেই বঙ্গানুবাদ লিপিবদ্ধ করিতে হইয়াছে।)
(বিনয়াধিকরণ-নামক প্রথম অধিকরণে নিম্নলিখিত ১৮টি প্রকরণ নিরূপিত হইয়াছে, যথা–)
(১) বিদ্যাসমুদ্দেশ (অর্থাৎ আম্বীক্ষিকী, ত্রয়ী, বার্ত্তা ও দণ্ডনীতি এই চার বিদ্যার নিরূপণ)। (২) বৃদ্ধ-সংযোগ (অর্থাৎ জ্ঞানবৃদ্ধদিগের সহিত বিদ্যার্থী রাজকুমারের সংযোগ)। (৩) ইন্দ্রিয় জয়। (৪) অমাত্যোৎপত্তি (অর্থাৎ অমার্ত্যবর্গের নিয়োগ)। (৫) মন্ত্রী ও পুরোহিতের নিয়োগ। (৬) উপধা বা ছলরীতিতে অমাত্যগণের শৌচ ও অশৌচ পরীক্ষা। (৭) গূঢ়পুরুষদিগের নিয়োগ। (৮) গূঢ়পুরুষদিগের প্রণিধি বা কার্য্যে ব্যাপৃতি। (৯) স্বরাজ্যে কৃত্যপক্ষ ও অকৃত্যপক্ষের রক্ষণ। (১০) শত্রুরাজ্যে কৃত্যপক্ষ ও অকৃত্যপক্ষের সংগ্রহ। (১১) মন্ত্রাধিকার। (১২) দূতপ্রণিধি (অর্থাৎ দূতের কর্ম্ম সম্প্রধারণ)। (১৩) রাজপুত্ররক্ষণ (অর্থাৎ রাজপুত্রগণ হইতে রাজার আত্মরক্ষা)। (১৪) অবরুদ্ধ রাজপুত্রের (পিতার প্রতি) ব্যবহার। (১৫) অবরুদ্ধ রাজপুত্রের প্রতি পিতার ব্যবহার। (১৬) রাজপ্রণিধি বা রাজার কার্য্যব্যবপৃততা। (১৭) নিশান্তপ্রণিধি বা রাজভবনের অনুষ্ঠান। (১৮) আত্মরক্ষা।
বিনয়াধিকরণ-নামক প্রথম অধিকরণে এই অষ্টাদশ প্রকরণ বিরচিত হইয়াছে।

[পরের ৩টি পেজ মিসিং। এখানে অধ্যক্ষপ্রচার-নামক দ্বিতীয় এবং ধর্ম্মস্থীয়-নামক তৃতীয় অধিকরণের প্রকরণগুলো কথা বলা হয়েছিল। তাতে যথাক্রমে ৩৮ এবং ১৯টি প্রকরণ থাকার কথা। পেজগুলো উদ্ধার করতে পারলে এই প্রকরণের লিস্ট পরে টাইপ করে দেয়া হবে। এটা অবশ্য জরুরী কিছু নয় আপাতত।]

(কণ্টকশোধন-নামক চতুর্থ অধিকরণে ব্যাখ্যাত ১৩টি প্রকরণের নাম প্রদত্ত হইতেছে, যথা–)
(১) কারুকদিক হইতে রক্ষণ। (২) বৈদেহক বা বাণিজকদিক হইতে রক্ষণ। (৩) উপনিপাত বা দৈবী বিপদের প্রতিকার। (৪) গূঢ়ভাবে জীবিকাকারীর প্রতীকার। (৫) সিদ্ধবেশধারী গূঢ়পুরুষদ্বারা দুষ্টজনের প্রকাশন। (৬) শঙ্কা, চুরির মাল ও কর্ম্মদ্বারা চোরধরা। (৭) আশু বা অকাণ্ডে মৃত জনের পরীক্ষা (৮) বাক্য ও কর্ম্মস্বারা অনুযোগ (বা তদন্ত-করণ)। (৯) সর্ব্বপ্রকার অধিকরণের রক্ষণ বা নিয়ন্ত্রণ। (১০) একাঙ্গবধ ও ইহার নিষ্ক্রয়। (১১) শুদ্ধ ও চিত্র দণ্ডের বিধান। (১২) কন্যাপ্রকর্ম্ম। (১৩) অতিচারের দণ্ড।
কণ্টকশোধন-নামক চতুর্থ অধিকরণে এই ত্রয়োদশ প্রকরণ বিরচিত হইয়াছে।

(এখানে যোগবৃত্ত-নামক পঞ্চম অধিকরণে, অর্থাৎ যাহাতে সত্রিপ্রভৃতি গূঢ়পুরুষদিগের অনুষ্ঠান বর্ণিত আছে তাহাতে ব্যাখ্যাত ৭টি প্রকরনের নাম লিপিবদ্ধ করা হইতেছে, যথা–)
(১) দণ্ড প্রয়োগের বিধি। (২) কোষের অত্যধিক সংগ্রহ। (৩) ভৃত্যদিগের ভরণ। (৪) রাজোপজীবিগণের বৃত্তি বা ব্যবহার। (৫) সময় বা ব্যবস্থার আচরণ। (৬) রাজ্যের প্রতিসন্ধান (অর্থাৎ রাজব্যসনের উৎপত্তিতে মন্ত্রীদিগের করণীয়-চিন্তন)। (৭) একৈশ্বর্য্য (অর্থাৎ এক রাজপুত্রের ঐশ্বর্য্যে স্থাপন)।
যোগবৃত্ত নামক পঞ্চম অধিকরণে এই সাতটি প্রকরণ নির্দ্ধারিত হইয়াছে।

(সম্প্রতি মণ্ডলযোনি-নামক ষষ্ঠ অধিকরণে ব্যাখ্যাত ২টি প্রকরণের নাম প্রদত্ত হইতেছে, যথা–)
(১) রাজাকি প্রকৃতির সম্পৎ। (২) শম ও ব্যায়াম (বা উদ্যোগ)।
মণ্ডলযোনি-নামক ষষ্ঠ অধিকরণে এই দুই প্রকরণ নিরূপিত হইয়াছে।

(এখন ষাড্‌গুণ্য-নামক সপ্তম অধিকরণে ব্যাখ্যাত ২৯টি প্রকরনের নাম সন্নিবেশিত হইতেছে, যথা–)
(১) ষাড্‌গুণ্যের সংক্ষিপ্ত পরিচয়। (২) ক্ষয়, স্থান, (তদবস্থতা) ও বৃদ্ধির নিশ্চয় (অর্থাৎ ইহাদের স্বরূপ-নিরূপণ)। (৩) সংশ্রয়-বৃত্তি। (৪) সম, হীন ও অধিকের গুণস্থাপনা। (৫) হীনের করণীয় সন্ধি। (৬) বিগ্রহ করিয়া আসন (স্বদেশে অবস্থান)। (৭) সন্ধি করিয়া আসন। (৮) বিগ্রহ করিয়া অভিযান। (৯) সন্ধি করিয়া অভিযান। (১০) হীনাদির সহিত মিলিত হইয়া একসঙ্গে প্রয়াণ। (১১) যাতব্য ও অমিত্রের প্রতি অভিগ্রহ বা অভিযানের চিন্তন। (১২) প্রকৃতিবর্গের ক্ষয়, লোভ ও বিরাগের হেতু। (১৩) সামবায়িক রামগণের গুরু-লঘু-ভাব বিচার। (১৪) সন্ধিবদ্ধ (শত্রু ও বিজিগীযু) রাজার প্রয়াণ। (১৫) পরিপণিত, পরিগণিত ও অপসৃত সন্ধি। (১৬) দ্বৈধীভাবসম্বন্ধীয় সন্ধি ও বিক্রম (বা বিগ্রহ)। (১৭) যাতব্য-বৃত্তি (অর্থাৎ যাতব্য বিজিগীয়ুর সামবায়িকদিগের প্রতি ও শেষোক্তদিগের যাতব্যের প্রতি বৃত্তি)। (১৮) অনুগ্রাহ্য মিত্র-বিশেষগণ। (১৯) মিত্র-সন্ধি, হিরণ্য-সন্ধি, ভূমি-সন্ধি ও কর্ম্ম-সন্ধি। (২০) পাষ্ণিগ্রাহচিন্তা। (২১) হীনশক্তির পূরণ। (২২) প্রবলশত্রুর সহিত বিগ্রহ করিয়া উপরোগের (দুর্গপ্রবেশের) হেতু। (২৩) দণ্ডোপনতের বৃত্তি। (২৪) দণ্ডোপনায়ীর বৃত্তি। (২৫) সন্ধিকর্ম্ম। (২৬) সন্ধিমোক্ষ। (২৭) মধ্যমের প্রতি বৃত্তি। (২৮) উদাসীনের প্রতি বৃত্তি। (২৯) মণ্ডলের প্রতি বৃত্তি।
ষাড্‌গুণ্য-নামক সপ্তম অধিকরণে এই উনত্রিশ প্রকরণ আলোচিত হইয়াছে।

(সম্প্রতি ব্যসানাধিকারিক-নামক অষ্টম অধিকরণে ৮টি প্রকরণের নাম প্রদত্ত হইতেছে, যথা–)
(১) প্রকৃতিসমূহের ব্যসনবর্গ। (২) রাজা ও রাজ্যের ব্যসনসম্পর্কীয় চিন্তা। (৩)পীড়নবর্গ। (৫) স্তম্ভবর্গ (অর্থাৎ বিঘ্নের কথাদ্বারা রাজকার্য্যের উপরোধের হেতুনির্ণয়। (৬) কোষসঙ্গবর্গ (অর্থাৎ রাজার্থের অপ্রদানের হেতুচিন্তা)। (৭) বল বা সৈন্যের ব্যসনবর্গ। (৮) মিত্রব্যসনবর্গ।
ব্যসনাধিকারিক নামক অষ্টম অধিকরণে এই আট প্রকরণের ব্যাখ্যা করা হইয়াছে।

(এখন অভিযাস্যৎকর্ম-নামক নবম অধিকরণে ১২টি প্রকরণের নাম দেওয়া হইতেছে, যথা–)
(১) শক্তি, দেশ ও কালের বলাবলজ্ঞান। (২) যাত্রার কালনির্ণয়। (৩) সেনার উদ্যোজনকাল। (৪) সন্নাহ-গুণ। (৫) প্রতিবলের উত্থাপন। (৬) পশ্চাৎকোপের চিন্তা। (৭) বাহ্য ও আভ্যন্তর প্রকৃতিবর্গের কোপ প্রতীকার। (৮) ক্ষয়, ব্যয় ও লাভের বিচারণ। (৯) বাহ্য ও আভ্যন্তর আপৎ। (১০) দুষ্য ও শত্রুসংসযুক্ত আপৎ। (১১) অর্থ, অনর্থ ও সংশয়সম্বন্ধীয় আপৎ। (১২) আপৎসমূহের প্রতীকারার্থ উপায়-সমূহের প্রয়োগভেদজনিত সিদ্ধি।
অভিযাস্যৎকর্ম-নামক নবম অধিকরণে এই দ্বাদশ প্রকরণ নিরূপিত হইয়াছে।

(সম্প্রতি সাংগ্রামিক-নামক দশম অধিকরণে ১৩টি প্রকরণের নাম সন্নিবেশিত হইতেছে, যথা–)
(১) সন্ধাবারনিবেশ। (২) স্বন্ধাবারের প্রয়াণ। (৩) বলব্যসন ও অবস্কন্দনকাল হইতে সেনারক্ষণ। (৪) কূটযুদ্ধের ভেদসমূহ। (৫) স্বসৈন্যের উৎসাহ প্রদান। (৬) শত্রুসেনা অপেক্ষায় নিজ সেনার বিশেষ ব্যবস্থা। (৭) যুদ্ধভূমি। (৮) পদাতি, অশ্ব, রথ ও হস্তীর কর্ম্ম। (৯) পক্ষ, কক্ষ ও উরস্যের বলপরিমাণানুসারে ব্যূহ-বিভাগ। (১০) সার ও ফল্গু সেনার বিভাগ। (১১) পত্তি, অশ্ব, রথ, ও হস্তীর যুদ্ধ। (১২) দণ্ডব্যূহ, ভোগব্যূহ। মণ্ডলব্যূহ ও অসঙ্ঘতব্যূহসমূহের রচনা। (১৩) পূর্ব্বোক্ত ব্যূহাদির প্রতিব্যূহ-সংস্থাপন।
সাংগ্রামিক-নামক দশম অধিকরণে ত্রয়োদশ প্রকরণ ব্যাখ্যাত হইয়াছে।

(এখন সঙ্ঘবৃত্ত-নামক একাদশ অধিকরণে ২টি প্রকরণ ব্যাখ্যাত হইতেছে, যথা–)
(১) সঙ্ঘভেদের প্রয়োগ। (২) উপাংশুদণ্ড (বা নিগূঢ়বধ)।
সঙ্ঘবৃত্ত-নামক একাদশ অধিকরণে এই দুইটি প্রকরণ সন্নিবেশিত হইয়াছে।

(সম্প্রতি আবলীয়স-নামক দ্বাদশ অধিকরণে, অর্থাৎ যাহাতে দুর্ব্বলতর বিজুগীষু রাজার করণীয় বর্ণিত আছে তাহাতে ৯টি প্রকরণের নাম প্রদত্ত হইতেছে, যথা–)
(১) দূতকর্ম। (২) মন্ত্রযুদ্ধ। (৩) সেনামুখ্যদিগের বধ। (৪) মণ্ডলপ্রোৎসাহন। (৫) শস্ত্র, অগ্নি ও বিষের গূঢ়প্রয়োগ (৬) বিবধ (ধান্যদি পর্য্যাহার), আসাব (সুহৃদ্বল) ও প্রসাবের (বনাদি হইতে আহৃত ইন্ধনাদির) নাশ। (৭) যোগ বা কপটোপায়-দ্বারা অতিসন্ধান (প্রবঞ্চন)। (৮) দণ্ডদ্বারা অতিসন্ধান। (৯) একবিজয় (অর্থাৎ অসহায় বিজিগীষুকর্তৃক শত্রুর অতিভব)।
আবলীয়স-নামক দ্বাদশ অধিকরণে এই নয় প্রকরণ ব্যাখাত হইয়াছে।

(এখন দুর্গলম্ভোপায়-নামক ত্রয়োদশ অধিকরণে ৬টি প্রকরণের নাম দেওয়া হইতেছে, যথা–)
(১) উপজাপ। (২) যোগ বা গূঢ়পুরুষ-প্রয়োগ দ্বারা বামন (অর্থাৎ নিষ্ক্রামণ)। (৩) অপসর্প বা গূঢ়পুরুষদিগের (শত্রুদেশে) নিবাসবিধি। (৪) পর্য্যুপাসনকর্ম (অর্থাৎ সেনাদ্বারা শত্রুদুর্গের বেষ্টনকার্য্য)। (৫) অবমর্দ্দ (অর্থাৎ শত্রুদুর্গ গ্রহণ)। (৬) লব্ধপ্রশমন (বিজিত শত্রুদুর্গাদিতে শান্তিস্থাপন)।
দুর্গলম্ভোপায়-নামক ত্রয়োদশ অধিকরণে এই ছয় প্রকরণ সন্নিবেশিত আছে।

(সম্প্রতি ঔপনিষদ-নামক চতুর্দ্দশ অধিকরণে ৩টি প্রকরণের নাম বলা হইতেছে, যথা–)
(১) শত্রুঘাতের উপায়-প্রয়োগ। (২) প্রলম্ভন (অর্থাৎ মন্ত্রৌষধীপ্রয়োগ-দ্বারা শত্রুবঞ্চন)। (৩) স্বসেনার উপর শত্রু-প্রযুক্ত উপঘাতের প্রতীকার।
ঔপনিষদ-নামক চতুর্দ্দশ অধিকরণে এই তিন প্রকরণ আলোচিত হইয়াছে।

সর্ব্বশেষে তন্ত্রযুক্তি-নামক পঞ্চদশ অধিকরণে ১টি প্রকরণের নাম করা হইতেছে, যথা–)
(১) তন্ত্রযুক্তি (অর্থাৎ এই অর্থশাস্ত্ররূপ তন্ত্রের ব্যাখ্যান্যায়সমূহ)।
তন্ত্রযুক্তি-নামক পঞ্চদশ অধিকরণে এই এক প্রকার প্রকরণ ব্যাখ্যাত হইয়াছে।

এই শাস্ত্রের বিষয়সূচী আছে এইরূপ :–ইহাতে ১৫টি অধিকরণ, ১৫০টি অধ্যায় ও ১৮০টি প্রকরণ এবং ৬০০০টি শ্লোক আছে (অর্থাৎ ইহাতে সন্নিবেশিত অক্ষর-সমূহদ্বারা ৬ হাজার ৩২ অক্ষর-বিশিষ্ট শ্লোক বা গ্রন্থের রচনা সম্ভবপর হইতে পারে)।
গ্রন্থবাহুল্য বর্জ্জন করিয়া কৌটিল্য এই শাস্ত্র প্রণয়ন করিয়াছেন; ইহা সুকুমার-বুদ্ধি লোকেরাও সহজে বুজিতে পারে, এবং ইহাতে এমনভাবে তত্ত্ব (অর্থশাস্ত্রের বিষয়), ইহার অর্থ ও অর্থোপযোগী পদ প্রযুক্ত হইয়াছে যদ্দারা নিশ্চয় জ্ঞান-বিষয়ে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নাই।।১।।

কৌটিনীয় অর্থশাস্ত্রে বিনয়াধিকারিক-নামক প্রথম অধিকরণে রাজবৃত্তি-নামক প্রথম অধ্যায় সমাপ্ত।

.

দ্বিতীয় অধ্যায়
১ম প্রকরণ—বিদ্যাসমুদ্দেশ
; আম্বীক্ষিকী—স্থাপনা

বিদ্যা চারি প্রকার—যথা, (১) আম্বীক্ষিকী (অধ্যাত্মবিদ্যা; মতান্তরে, হেতুবিদ্যা), (২) ত্রয়ী (ঋক্, যজুঃ ও সাম-বেদাত্মক বিদ্যা), (৩) বার্তা (কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্যাত্মক বিদ্যা) ও (৪) দণ্ডনীতি (বা রাজনীতি বিদ্যা)। I

মানব বা মনুশিষ্যদিগের মতে বিদ্যা তিন প্রকার, যথা—ত্রয়ী, বার্ত্তা ও দণ্ডনীতি। কারণ, আম্বীক্ষিকী বিদ্যা (ত্রয়ী বিদ্যার অ–বিচারকারিণী বলিয়া) ত্রয়ীরই অন্তর্গত বলিয়া ধরা যায়।

বাৰ্হস্পত্য বা বৃহস্পতি শিষ্যদিগের মতে বিদ্যা দুই প্রকার, যথা—বার্তা ও দণ্ডনীতি। কারণ, লোকযাত্রাবিৎ (অর্থাৎ বাৰ্ত্ত ও দণ্ডনীতিতে অভিজ্ঞ) জনের পক্ষে ত্রয়ী আবরণ-মাত্র (অর্থাৎ নাস্তিকতাদি-জনিত নিন্দা হইতে রক্ষা পাওয়ার উপায় মাত্র, তাই ইহার বিদ্যাত্র-স্বীকারের প্রয়োজন বড় একটা নাই বলিলেই চলে)।

ঔশনস বা শুক্র শিষ্যদিগের মতে বিদ্যা কেবল একটি মাত্রই হইতে পারে এবং তাহা দণ্ডনীতি। কারণ, এই বিদ্যাতেই অন্যান্য সব বিদ্যার (যোগক্ষেমরূপ) ক্রিয়াকলাপ প্রতিষ্ঠিত আছে। (অর্থাৎ দণ্ডনীতিই অপর তিন বিদ্যার যোগক্ষেম সাধন করিতে পারে)।

কিন্তু, কৌটিল্যের মতে উক্ত চারিটিই বিদ্যা বলিয়া পরিগণিত হইবার যোগ্য আম্বীক্ষিকী কারণ, সবগুলি বিদ্যারই সেই জন্য বিদ্যাত্ৰ আছে মনে করিতে হইবে, যে-জন্য সেই সবগুলি দ্বারাই লোকের ধৰ্ম্ম ও অর্থের বেদন বা জ্ঞান হয়।

(এখন আম্বীক্ষিকী বিদ্যার স্বরূপ বলা হইতেছে—) সাংখ্য-শাস্ত্র, যোগশাস্ত্র ও লোকায়ত-শাস্ত্র—এই তিনটি শাস্ত্রই আম্বীক্ষিকীর অন্তর্ভুক্ত। ত্রয়ীতে ধর্ম ও অধৰ্মই প্রধানতঃ প্রতিপাদিত আছে। বার্তাতে অর্থ ও অনর্থ প্রতিপাদিত আছে। এবং দণ্ডনীতিতে নয় ও অপনয় প্রতিপাদিত আছে। ত্রয়ী প্রভৃতি তিনটি বিদ্যার বল (প্রাধান্ত) ও অবল (অপ্রাধান্ত) হেতুদ্বারা নিৰ্দ্ধারণ করে বলিয়া আল্পীক্ষিকী-বিদ্যা লোকের উপকার করিয়া থাকে) ইহা ব্যসন ও অদ্ভু্যদয়ের উৎপত্তিতে (মানুষের) বুদ্ধিকে অবিচলিত রাখে, এবং ইহা (মানুষের) প্রজ্ঞা (জ্ঞান), বাক্যপ্রয়োগ ও কৰ্ম্মকরণ বিষয়ে পটুতা উৎপাদন করিয়া থাকে।

এই আম্বীক্ষিকী বিদ্যা (অপর) সব বিদ্যার প্রদীপ-স্বরূপ, সৰ্ব্বকর্মের উপায় বা সাধন-স্বরূপ, এবং সৰ্ব্বপ্রকার (বৈদিক ও লৌকিক) ধর্মের আশ্রয়-স্বরূপ বলিয়া সৰ্ব্বদাই বিবেচিত হয় ॥১।।

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে বিনয়াধিকারিক-নামক প্রথম অধিকরণে বিদ্যাসমুদ্দেশনামক প্রকরণে আম্বীক্ষিকী-স্থাপনা-নামক দ্বিতীয় অধ্যায় সমাপ্ত।

.

তৃতীয় অধ্যায়

১ম প্রকরণ—বিদ্যাসমুদ্দেশ; ত্রয়ী স্থাপনা

সামবেদ, ঋগবেদ ও যজুৰ্ব্বেদ—এই তিন বেদের নাম ত্রয়ী। অথৰ্ব্ববেদ ও (মহাভারতাদি) ইতিহাসও বেদপৰ্য্যায়ে পতিত হয়। শিক্ষা (বর্ণের উচ্চারণাদির উপদেশক শাস্ত্র), কল্প (যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান-সম্বন্ধে উপদেশক শাস্ত্র), ব্যাকরণ (শব্দানুশাসন), নিরুক্ত  (শব্দনিৰ্ব্বচনের উপদেশক শাস্ত্র), ছন্দোবিচিতি (ছন্দ নিরূপণের শাস্ত্র) ও জ্যোতিষ—এই ছয়টিকে (বেদের) অঙ্গ বলিয়া নির্দেশ করা হয়।

এই ত্রয়ীতে উপদিষ্ট বা প্রতিপাদিত ধৰ্ম্ম, (ব্রাহ্মণাদি) চারি বর্ণের ও (ব্রহ্মচৰ্য্যাদি) চারি আশ্রমের নিজ নিজ ধৰ্ম্মে (কর্তব্যে) সকলকে নিয়ন্ত্রিত করিয়া রাখে বলিয়া, (লোকের) পরম উপকার সাধন করিয়া থাকে।

(সম্প্রতি চারি বর্ণের নিজ নিজ ধৰ্ম্ম বলা হইতেছে)। অধ্যয়ন (বেদাদিপঠন), অধ্যাপন (বিদ্যা-বিতরণ), যজন (যজ্ঞকরণ), যাজন (যজ্ঞ করান), দান ও প্রতিগ্ৰহ (দানগ্রহণ) এইগুলি ব্রাহ্মণের স্বধৰ্ম্ম বলিয়া গৃহীত হয়।

অধ্যয়ন, যজন, দান, শাস্ত্রদ্বারা জীবিকার্জন ও প্রাণীদিগের রক্ষণ—এইগুলি ক্ষত্রিয়ের স্বধৰ্ম্ম। অধ্যয়ন, যুজন, দান, কৃষিকাৰ্য্য, (গবাদি) পশুপালন ও বাণিজ্যকরণ–এইগুলি বৈশ্যের স্বধৰ্ম্ম।

(ব্রাহ্মণাদি) দ্বিজগণের শুশ্রূষা (সেবা), বার্তা (অর্থাৎ কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য) এবং কারুকৰ্ম্ম (শিল্পীর কার্য্য) ও কুশীলব কৰ্ম্ম (গীতিবাদিত্রাদি কৰ্ম্ম ও ভাটচারণদিগের কৰ্ম্ম) এইগুলি শূদ্রের স্বধৰ্ম্ম। (সম্প্রতি চারি আশ্রমের স্ব স্ব ধৰ্ম্ম বলা হইতেছে)। (সৰ্ব্ববর্ণের অন্তভুক্ত) গৃহস্থের স্বধৰ্ম্ম হইল— নিজ বর্ণের জন্য ব্যবস্থিত কৰ্ম্মদ্বারা জীবিকানিৰ্বাহ, নিজকুলের সমান কুলে জাত, অথচ অসমাপ্ত ঋষির গোত্রে সম্ভূত ব্যক্তিদিগের মধ্যে বিবাহ সম্পাদন, ঋতুরক্ষার্থ স্ত্রী-গমন-শীলতা, দেবতা, পিতৃলোক, অতিথি ও ভৃত্যাদিকে (খাদ্যাদি—) দান ও তদ্দত্তাবশিষ্টের ভোজন।

ব্রহ্মচারীর স্বধৰ্ম্ম হইল—স্বাধ্যায় (স্ববেদের অধ্যয়ন), অগ্নিকাৰ্য্য ও স্নান ও ভিক্ষাচর্য্যা, (আর নৈষ্টিক ব্রহ্মচারীর পক্ষে) জীবন পৰ্য্যন্ত আচাৰ্য্য-সমীপে অবস্থান এবং আচার্য্যের অভাবে গুরুপুত্র-সমীপে, অথবা সমানশাখাধ্যায়ী বৃদ্ধসমীপে অবস্থান।

বানপ্রস্থের স্বধৰ্ম্ম হইল—নিজের ব্রহ্মচৰ্য্যব্রতরক্ষা (অর্থাৎ উর্দ্ধরেতাঃ হইয়া থাকা), ভূমিতে শয়ন, জটা ও অজিন (মৃগচৰ্ম্ম) ধারণ, অগ্নিহোত্র ও (ত্রিকাল) স্নান এবং বনজাত (কন্দমূলাদি) দ্রব্যের আহার।

পরিব্রাজক বা সন্ন্যাসীর স্বধৰ্ম্ম হইল—নিজের ইন্দ্রিয়গুলিকে সংযত রাখা, কোন কৰ্ম্মেই প্রবৃত্ত না হওয়া (নৈক্য), কোন বস্তুতেই স্বত্ব রক্ষা না করা, লোকসঙ্গ ত্যাগ করা, অনেক স্থানে যাইয়া ভিক্ষান্ন সংগ্রহ, অরণ্যে নিবাস এবং বাহ্য ও আভ্যন্তর শৌচ বা শুচিভাব (অর্থাৎ কায়, মন ও বাক্য বিষয়ে শুদ্ধভাব রাখা)।

সকল বর্ণের ও সকল আশ্রমের পক্ষে সাধারণ ধৰ্ম্ম হইল—অহিংসা, সত্যবচন, শৌচ বা শুদ্ধতা, অসূয়ার অভাব (অর্থাৎ গুণপক্ষপাতিত্র), অনিষ্ঠুরতা ও ক্ষমা।

(বর্ণাশ্রমবর্গের) স্বধৰ্ম্ম পালিত হইলে, ইহা স্বর্গ ও আনন্ত্যের (অনন্তসুখ বা মোক্ষের) সাধন হইতে পারে। স্বধৰ্ম্মের উল্লঙ্ঘন ঘটিলে, লোকসকল কৰ্ম্মসংকর ও বর্ণসংকরবশত: উচ্ছেদ প্রাপ্ত হয়। অতএব রাজার উচিত কাৰ্য্য হইবে সমস্ত ভূতগণকে (প্রাণিবর্গকে) স্বধৰ্ম্ম হইতে ভ্ৰষ্ট হইতে না দেওয়া। যে রাজ (সকলকে) স্বধৰ্ম্ম আচরণ করাইতে পারেন, তিনি ইহলোকে ও পরলোকে সুখী হইতে পারেন ॥১।।

যে প্রজা-লোকের আর্য্যমর্যাদা (সদাচারনিয়ম) ব্যবস্থিত আছে, যে প্রজালোক বর্ণ ও আশ্রমের নিয়মাদি মানিয়া চলে, এবং যে প্রজা-লোক ত্রয়ীর বিধান দ্বারা রক্ষিত হয়, সে প্রজা-লোক প্রসন্ন (মুখসমৃদ্ধ) থাকে এবং কখনই নষ্ট হয় না।।২৷৷

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে বিনয়াধিকারিক-নামক প্রথম অধিকরণে বিদ্যাসমুদ্দেশ প্রকরণে ত্রয়ীস্থাপনা-নামক তৃতীয় অধ্যায় সমাপ্ত।

.

চতুর্থ অধ্যায়

১ম প্রকরণ—বিদ্যাসমুদ্দেশ; বার্তা ও দণ্ডনীতি স্থাপনা

কৃষি, (গবাদি) পশুপালন ও বাণিজ্য—এই তিন বিষয়ই বার্তা-নামক বিদ্যাদ্ধারা প্রতিপাদিত হয় এবং এই বিদ্যা, ধান্য, পশু, হিরণ্য, কুপ্য (স্বর্ণরৌপ্যাতিরিক্ত তাম্রাদি তৈজস ও সারদারু প্রভৃতি অতৈজস দ্রব্য), ও বিষ্টি (কৰ্ম্মকর) প্রদানে সহায়তা করে বলিয়া সমাজের উপকার সাধন করিয়া থাকে। (রাজা) এই বিদ্যার প্রভাবে উৎপাদিত কোষ ও দণ্ড (সেনা) দ্বারা স্বপক্ষ ও পরপক্ষকে বশে রাখিতে পারেন।

আধীক্ষিকী, ত্রয়ী ও বার্তা—এই তিন বিদ্যার যোগ ও ক্ষেম সাধন করিতে দণ্ডই সমর্থ হয় (অর্থশাস্ত্রে সামাদি উপায়-চতুষ্টয়ের অন্যতম উপায়ের নামও দণ্ড ও দণ্ডধর রাজাও দণ্ডস্থানীয় বলিয়া কল্পিত হয়)। এই দণ্ড-নামক বিদ্যার যাহা নীতি বা স্বরূপের প্রতিপাদনকারী তত্ত্ব তাহার নাম দণ্ডনীতি (বা রাজনীতি) শাস্ত্র। এই দণ্ডনীতি অলব্ধ বস্তুকে লাভ করায়, লব্ধ বস্তুকে রক্ষা করায়, রক্ষিত বস্তুকে বৰ্দ্ধিত করায় এবং বৃদ্ধিপ্রাপ্ত বস্তুকে উপযুক্ত পাত্রে বিনিযুক্ত করায়। লোকযাত্রা (সমাজ-ব্যবহার) এই দণ্ডনীতির উপরই নির্ভর করিয়া থাকে। অতএব, যে রাজা লোকযাত্রার সম্যক্ অনুষ্ঠানে তৎপর, তিনি নিত্যই উদ্যতদণ্ড অর্থাৎ দণ্ডপ্রণয়নে উদ্যুক্ত রহিবেন।

(কৌটিল্যের নিজ) আচার্য্যের মত এই যে, দণ্ড ব্যতিরেকে অন্য কোন প্রকার সাধন তেমন কার্য্যকর হইতে পারে না—যাহা দ্বারা সকলকে বশে রাখা যায়। কিন্তু, কৌটিল্য (দণ্ডমাত্রকেই তেমন সাধন) বলিয়া মনে করেন না। কারণ, তাহার মতে, যে রাজা তীক্ষ্ণদণ্ড (অর্থাৎ যিনি অল্পাপরাধে উগ্ৰ দণ্ড প্রণয়ন করেন), তিনি সকল প্রাণীরই উদ্বেগ উৎপাদন করেন। আবার যে রাজা মৃদুদণ্ড (অর্থাৎ যিনি মহাপরাধে মৃদু দণ্ড প্রণয়ন করেন), তিনি স্বয়ং পরাভব প্রাপ্ত হয়েন। কিন্তু, যে রাজা যথার্হদণ্ড (অর্থাং যিনি অপরাধাতুরূপ উচিত দণ্ড প্রণয়ন করেন), তিনি সকলের পূজা লাভ করেন। কারণ, যে দণ্ড শাস্ত্র হইতে উত্তমরূপে জ্ঞাত হইয়া প্রণীত বা প্রযুক্ত হয়—তাহা প্রজাজনকে ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কাম এই ত্রিবর্গ দ্বারা যুক্ত করিতে পারে। কাম ও ক্রোধবশঃ কিংবা অজ্ঞানবশতঃ যে দণ্ড দুষ্প্রণীত (অর্থাৎ অযথাবৎ প্রযুক্ত) হয়—তাহা বানপ্রস্থ ও পরিব্রাজকদিগেরও কোপ উৎপাদন করে—সুস্থগণের ত কথাই নাই। আবার, যদি দণ্ড অপ্রণীত বা অপ্ৰযুক্তই রহে, তাহা হইলে ইহা মাৎস্যন্যায় উৎপাদন করে (অর্থাৎ বড় বড় মৎস্য যেমন ছোট ছোট মৎস্যগুলিকে গ্রাস করিয়া ফেলে—তেমন তখন সবল লোকের দুর্বল ও অবল লোকদিগকে গ্রাস করিয়া ফেলে)। কারণ, দণ্ডধর বা দণ্ডপ্রণেতা রাজার অভাবে, বলবান লোক বলশূন্য লোককে গ্রাস করিয়া থাকে (অর্থাৎ কষ্ট দিয়া থাকে)। (অতএব), দণ্ডদ্বারা গুপ্ত বা রক্ষিত (রাজা) প্রভাববিশিষ্ট হইয়া থাকেন। (কেহ কেহ ‘দণ্ডদ্বারা রক্ষিত দুর্বল প্রজা বা সমাজ সবল হয়’ এরূপ ব্যাখ্যাও করেন)।

চারি বর্ণ ও চারি আশ্রমের লোকেরা রাজাদ্বারা দণ্ডের প্রভাবে পালিত হইলে, নিজ নিজ ধর্ম্মে ও কৰ্ম্মে অভিরত থাকিয়া স্বগৃহে (বর্ত্মসু-পাঠে স্ব স্ব পথে) সুখে থাকিতে পারে ॥১৷৷

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে বিনয়াধিকারিক নামক প্রথম অধিকরণে বিদ্দাসমূদ্দেশনামক প্রকরণে বার্তা ও দণ্ডর্নীতি স্থাপন নামক চতুর্থ অধ্যায় সমাপ্ত।

.

পঞ্চম অধ্যায়

২য় প্রকরণ—বৃদ্ধ (জ্ঞানবৃদ্ধ) জনের সহিত সংযোগ

অতএব, (আম্বীক্ষিকী, ত্রয়ী ও বার্তারূপ) তিন বিদ্যার মূলই হইল দণ্ড বা দণ্ডনীতিজ্ঞান। প্রাণধারীদিগের (অর্থাৎ প্রজাবর্গের) যোগ ও ক্ষেমসাধনকারী দণ্ড, বিনয় বা শিক্ষারূপ মূলের উপর প্রতিষ্ঠিত।

বিনয় দুই প্রকার—কৃতক (অর্থাৎ পরিশ্রমপুৰ্ব্বক ক্রিয়ার দ্বারা প্রাপ্ত) ও স্বাভাবিক (বাসনাবশতঃ স্বতঃসিদ্ধ)। কিন্তু, ক্রিয়া, দ্রব্যের বা উপযুক্ত পাত্রের উপর বিহিত হইলেই তাহাকে (সেই পাত্রকে) বিনীত বা শিক্ষিত করিতে পারে; কিন্তু, ইহা অদ্রব্য বা অপাত্রের উপর বিহিত হইলে তাহাকে বিনীত বা শিক্ষিত করিতে পারে না। যে ব্যক্তির বুদ্ধি—শুশ্রুষা (গুরুজনের উপদেশশ্রবণে ইচ্ছা), শ্রবণ, গ্রহণ, (শ্রাতবিষয়ের অর্থবোধ), ধারণ (উপদিষ্ট বিষয়ের স্মৃতিতে রক্ষণ), বিজ্ঞান (ধারিত বিষয়ের বিশিষ্ট জ্ঞান), উহ। (অল্প ক্র বিষয়ের অন্তমান), অপোহ (অন্যের তর্কনিরসন জন্য বিপরীত তর্ক) ও তত্ত্বে (বিষয়েব যাথার্থ্যজ্ঞানে), অভিনিবিষ্ট থাকে, সেই যোগ্য ব্যক্তিকেই বিদ্যা বিনীত বা শিক্ষিত করিতে পারে, অন্যকে পারে না।

বিদ্যাসমূহের প্রামাণ্য বিভিন্ন আচাৰ্য্যগণের উপর নির্ভর করে বলিয়া, শিষ্যগণ সেই সেই আচার্য্যের অনুশাসনক্রমেই বিনয় (শিক্ষা)-গ্রহণ ও নিয়ম পালন করিবে।

চৌলকৰ্ম্ম (মুণ্ডন সংস্কার) সম্পাদিত হইলে (রাজ বা রাজপুত্ৰ) লিপি (অক্ষর লেখা) ও সংখ্যান (অঙ্ক-গণনা) নিয়মপূর্ব্বক অভ্যাস করবেন। উপনয়ন (বা গায়ত্রীর উপদেশ) প্রাপ্ত হওয়ার পর (তিনি) ত্রয়ী ও আল্পীক্ষিকী বিদ্যা শিষ্টগণ (অর্থাং ততদ্বিদ্যাভিজ্ঞ আচাৰ্য্যগণ) হইতে, বার্তা-বিদ্যা (সীতাধ্যক্ষাদি) বড় বড় অধ্যক্ষগণ হইতে এবং দণ্ডনীতি প্রবচনকুশল ও প্রয়োগকুশল নীতিবিদ আচার্শ্যগণ হইতে নিয়মপূর্ব্বক শিক্ষা করিবেন।

(তিনি) ষোড়শ বৎসর পর্য্যন্ত ব্রহ্মচৰ্য্য পালন করিবেন। তৎপর তাহার গোদান বা কেশাস্ত-কৰ্ম্ম ও দারকর্ম বা বিবাহ হইবে। তাঁহার (কৃতদার রাজার বা রাজপুত্রের) বিনয় বৃদ্ধির জন্য তাঁহাকে নিত্যই বিদ্যাবৃদ্ধ আচাৰ্য্যগণের সহিত সংযোগ রক্ষা করিতে হইবে। কারণ, বিনয়ের মূলই হইল ইহা (অর্থাৎ বিদ্যাবৃদ্ধসংযোগ)।

দিনের প্রথমভাগে (রাজা) হস্তিবিদ্যা, অশ্ববিদ্যা, রথবিদ্যা ও অস্ত্রশস্ত্রবিদ্যাতে শিক্ষা গ্রহণ করিবেন এবং শেষভাগে ইতিহাস-শ্রবণ বিষয়ে (শিক্ষা গ্রহণ করিবেন)। ইতিহাস শব্দ দ্বারা আমরা পুরাণ, (রামায়ণাদি) ইতিবৃত্ত, (দিব্যমানুষাদির চরিতকথারূপ) আখ্যায়িকা, উদাহরণ (প্রকৃতবিষয়ের উপপাদক দৃষ্টান্ত, মতান্তরে, মীমাংসাদি ন্যায়োপন্যাসবিষয়ক শাস্ত্র), (মানবাদি) ধৰ্ম্মশাস্ত্র ও (বার্হস্পত্যাদি) অর্থশাস্ত্র বুঝিব। অবশিষ্ট দিন ও রাত্রিভাগে (তিনি) নূতন নূতন বিষয়ের জ্ঞানলাভে ও গৃহীত জ্ঞানের পরিচয়ে (মনন ও চিন্তন) অভ্যাস করিবেন এবং যাহা (সম্যক্) গৃহীত হয় নাই তদ্বিষয়ে পুনঃ পুনঃ শ্রবণ করিবেন। কারণ, (পুনঃ পুঃ) শ্রবণ হইতেই প্রজ্ঞা (জ্ঞানবিকাশ) সম্ভাবিত হয়, প্রজ্ঞা হইতে যোগ (বা শাস্ত্রোক্ত বিষয়ের অনুষ্ঠান-শ্রদ্ধা), আবার যোগ হইতে আত্মবত্তা বা মনস্বিতা উপজাত হয়—এবং এই ভাবেই বিদ্যালাভের সামর্থ্য বা শক্তি উৎপাদিত হয়।

কারণ, বিদ্যাদ্ধারা বিনীত ও প্রজাদিগের বিনয়ে বা শিক্ষাতে রত রাজা সৰ্ব্বভূতের হিতে রত থাকিলে রাজান্তর-শূন্যা (অর্থাৎ একাতপত্রা) পৃথিবী ভোগ করিতে পারেন।। ১৷৷

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে বিনয়াধিকারিক-নামক প্রথম অধিকরণে
বৃদ্ধসংযোগ-নামক পঞ্চম অধ্যায় সমাপ্ত

.

ষষ্ঠ অধ্যায়
৩য় প্রকরণ—ইন্দ্ৰিয়জয়
; কামাদি ছয় রিপুর বর্জন

কাম, ক্ৰোধ, লোভ, মান (নিজ বুদ্ধির অনুপমত্রবিষয়ে অভিমান), মদ (গর্ব) ও হর্ষের (ইষ্টপ্রাপ্তিতে মুখামুভবের) বর্জন দ্বারা ইন্দ্ৰিয়জয় লাভ করিতে হইবে—এবং এই ইন্দ্ৰিয়জয় বিদ্যাজনিত বিনয়ের (শিক্ষার) কারণ হয়। কর্ণ, ত্রক, নেত্র, জিহ্বা ও নাসিকা—এই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের (যথাক্রমে) শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধরূপ বিষয়-পঞ্চকের প্রতি (স্বভাবতঃ) অবিরোধসহকারে প্রবৃত্তির নাম ইন্দ্রিয়জয়। শাস্ত্রে প্রতিপাদিত বিষয়ের অনুষ্ঠানকেও ইন্দ্রিয়জয় বলা যায় (অর্থাৎ তারাও ইঞ্জিয়জয় লব্ধ হয়)। কারণ, এই শাস্ত্রটি সম্পূর্ণই ইন্দ্রিয় জয় বলিয়া অভিহিত হইতে পারে (অর্থাৎ এই শাস্ত্রে প্রতিপাদ্য সব বিষয়ই ইন্দ্রিয়জয়ের কারণ হইতে পারে।

যে রাজা শাস্ত্রবিহিত কর্ত্তব্যের বিরুদ্ধ অনুষ্ঠান করেন এবং যিনি নিজ ইন্দ্রিয়বর্গকে স্ববশে আনিতে পারেন নাই, তিনি চাতুরন্ত হইলেও (অর্থাৎ চতুসমুদ্রান্ত পৃথিবীর অধীশ্বর হইলে) তৎক্ষণাৎ বিনষ্ট হয়েন। যথা—ভোজবংশীয় দাণ্ডক্য নামক রাজা ও বিদেহাধিপতি করাল-নামক রাজা—উভয়েই কামবশতঃ ব্রাহ্মণের কন্যাকে পাইতে ইচ্ছুক হইয়া (তাহাদের পিতাদ্বারা অভিশপ্ত হওয়ায়) নিজ বান্ধব ও রাষ্ট্রসহ বিনাশ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। কোপবশতঃ জনমেজয় রাজা ব্রাহ্মণের উপর বিক্রম প্রকাশ করিতে যাইয়া (তদীয় শাপে) ও তালজঙ্ঘ রাজা ভৃগুদিগের উপর সেরূপ কাৰ্য্য করিয়া বিনাশপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন। লোভের বশবৰ্ত্তী হইয়া ইলানন্দন (পুরূরবাঃ) এবং সৌবীর দেশের রাজা অজবিন্দুও পীড়াদানপূর্ণক (ব্রাহ্মণাদি) চারি বর্ণ হইতে অতিমাত্রায় ধনাপহরণ করায় (তাহাদের কোপেই) বিনষ্ট হয়েন। অভিমানবশতঃ রাবণ পত্নীকে (রামপত্নী সীতাদেবীকে) না ফিরাইয়া দিয়া ও দুৰ্য্যোধন স্বরাজ্য হইতে অংশমাত্রও (পাণ্ডবদিগকে) প্রত্যর্পণ না করিয়া বিনাশপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন। মদ বা গর্ব্বের বংশগত হইয়া সমস্ত প্রজাদিগকে অপমানিত করিয়া ডম্ভোদ্ভব রাজ (নরনারায়ণের হস্তে) এবং হেয়য় দেশের অধিপতি অর্জুন (কীৰ্ত্তবীর্য্যার্জ্জুন পরশুরামের হস্তে) নাশ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। এবং হর্ষের বশীভূত হইয়া বাতাপি-নামক (অসুর) অগস্ত্য ঋষিকে অতিমাত্রায় আক্রমণ করিয়া এবং দ্বৈপায়ন ঋষিকে (ব্যাসদেবকে) তেমনই আক্রমণ করিয়া বৃষ্ণিসঙ্ঘও (যাদবসংঘও) নাশপ্রাপ্ত হইয়াছিলেন।

এই রাজার ও অন্যান্য বহু রাজা (কামাদি) শক্ৰষড়্‌বর্গের বশীভূত হইয়া ইন্দ্রিয়জয়ে অসমর্থ হওয়াতে বান্ধব ও রাষ্ট্রসহ বিনাশপ্রাপ্ত হইয়াছেন ॥১৷৷

আবার এই শক্ৰষড়্‌বর্গকে বিসর্জন করিয়া জিতেন্দ্রিয় হওয়ায় জমদগ্ন্য (পরশুরাম), অম্বরীষ ও নাভাগ চিরকাল পৃথিবী ভোগ করিতে পারিয়াছিলেন।৷২৷৷

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে বিনয়াধিকারিক নামক প্রথম অধিকরণে ইন্দ্ৰিয়জয় নামক প্রকরণে অরিষড্‌বর্গত্যাগ-নামক ষষ্ঠ অধ্যায় সমাপ্ত

.

সপ্তম অধ্যায়
৩য় প্রকরণ—ইন্দ্ৰিয়জয়
; রাজর্ষির ব্যবহার

পূৰ্ব্বোক্ত কারণে (সমস্ত শ্রেয়োবস্তুর সাধন বলিয়া) রাজর্ষি (কামাদি) অরিষড্‌বর্গের বর্জন দ্বারা ইন্দিয়জয় করিবেন; (বিদ্যা-) বৃদ্ধদিগের সহিত সংযোগ দ্বারা নিজের প্রজ্ঞা বিকশিত করিবেন; চার বা গূঢ় পুরুষগণের নিয়োগ দ্বারা চক্ষুর কার্য্য (অসৎ স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রের সমস্ত ব্যবস্থার প্রতি দৃষ্টি রক্ষা) করিবেন; নিজের উথান বা কাৰ্য্য-তৎপরতা দ্বারা (প্রজাবর্গের) যোগ ও ক্ষেমসাধন করিবেন; কৰ্ত্তব্য বিষয়ে নিজের অতুশাসন বা আজ্ঞাবিধান দ্বার। (প্রজাদিগকে) স্বধৰ্ম্মে স্থাপিত করবেন; বিদ্যার উপদেশ দ্বারা (নিজেকে ও প্রজাবৰ্গকে) বিনীত বা শিক্ষিত করিবেন; (বিশিষ্ট কার্য্যে) অর্থবিনিয়োগদ্বার জনপ্রিয়ত্র লাভ করিবেন; এবং (প্রজার প্রতি) হিতাচরণ দ্বারা নিজের বৃত্তি বা ব্যবহার চালাইবেন।

এইভাবে ইন্দ্রিয় গুলিকে স্ববশে রাখিয়া (তিনি) পরস্ত্রীতে কামনা, পরদ্রব্যে লোভ ও পরহিংসা বর্জন করিবেন এবং (অনুচিত) নিদ্রা, চাঞ্চল্য, মিথ্যাবচন, উদ্ধত ও অবিনীত বেশধারণ, ও আনর্থের সহিত সংযোগ (অর্থাৎ অনর্থ কার্য্য ও অনর্থকারী পুরুষের সহিত সম্পর্ক) ত্যাগ করিবেন, এবং অধৰ্ম্ম-সংযুক্ত ও অনর্থসংযুক্ত ব্যবহারও (তিনি) পরিত্যাগ করিবেন।

ধৰ্ম্ম ও অর্থের সহিত বিরোধ না ঘটাইয়া (তিনি) কামের সেবা করিবেন। কেবল যে (তিনি) সুখ-রহিত হইয়াই থাকিবেন তাহা নহে। জুথবা, (তিনি) পরস্পর-সংস্থঃ ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কামরূপ ত্রিবগের সমানভাবে সেবা করিবেন। কারণ, ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কামের মধ্যে একটি যদি অত্যধিকভাবে (ব্যসনরূপে) সেবিত হয়, তাহা হইলে ইহা নিজকে ও অপর দুইটিকেও কষ্ট প্রদান করে (অর্থাৎ ধৰ্ম্ম, অর্থ ও কামকে; অর্থ, ধৰ্ম্ম ও কামকে; ও কাম, ধৰ্ম্ম ও অর্থকে পীড়িত করে)।

কৌটিল্যের মতে (ত্রিবর্গের মধ্যে) অর্থ-ই প্রধান বস্তু। কারণ, ধৰ্ম্ম ও কাম অর্থের উপরই নির্ভর করিয়া থাকে। অথবা, (তিনি) আচাৰ্য্যগণকে ও অমাত্যগণকে নিজ কাৰ্য্যের সীমারূপে (অর্থাৎ অনুল্লঙ্ঘিত-শাসন বলিয়া) স্থাপিত বা নিয়োজিত করিবেন, কারণ, তাহারাই তাহাকে (রাজাকে) অনর্থস্থান হইতে (অর্থাৎ অনিষ্টকর অনুষ্ঠান হইতে) নিবারিত রাখিবেন, কিংবা রাজা প্রমাদী হইলে তাহাকে মনঃকষ্টদায়ী প্রতোদ বা অঙ্কুশরুপী ছায়া প্রমাণ ও নালিক প্রমাণের নিবেদন দ্বারা (এই অধিকরণের ১৯শ অধ্যায় দ্রষ্টব্য) আঘাত করিবেন (অর্থাৎ তাহারা তাহাকে প্রমাদে সময়পাত করা হইতে রক্ষা করিয়া স্বকাৰ্য্য-তৎপর করিবেন)।

রাজত্র-কাৰ্য্য সহায় পাইলেই সাধিত হইতে পারে,(অর্থাৎ একাকী রাজার পক্ষে দুরূহ রাজকাৰ্য্য সম্পাদন সম্ভবপর নহে বলিয়া সহায়ের প্রয়োজন হয়), (কারণ,) (শকটাদির) একটিমাত্র চক্র (চক্রান্তরের সহায়ত ব্যতিরেকে) চলে না (অর্থাৎ রাজারা ও সেইরূপ অমাত্যাদির সহায় ব্যতিরেকে একাকী রাজকাৰ্য্য পরিচালনে সম্যক সমর্থ হয়েন না)। অতএব, (রাজা সহায়ভূত) সচিবদিগকে নিযুক্ত করিবেন এবং তাহাদের মত শ্রবণ করিবেন ॥১৷৷

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে পিনয়াধিকারিক-নামক প্রথম অধিকরণে ইন্দ্ৰিয়জয়-নামক প্রকরণে রাজর্ষি-বৃত্ত-নামক সপ্তম অধ্যায় সমাপ্ত।

.

অষ্টম অধ্যায়
৪র্থ প্রকরণ—অমাত্যগণের নিয়োগ

আচার্য্য ভারদ্বাজের (দ্রোণাচার্য্যের) মতে (রাজী) নিজের সহাধ্যায়ী (সহপাঠী)-দিগের মধ্য হইতেই নিজের অমাত্যগণকে নিযুক্ত করিবেন, কারণ, তাহাদের শোঁচ বা মনের শুদ্ধভাব ও কাৰ্য্য-সামর্থ্য-সম্বন্ধে তিনি (সহপাঠের সময়েই) সব অবগত হইয়া থাকিবেন। সেই কারণে, তাহারা (অমাত্যেরা) তাহার (রাজার) বিশ্বাসের পাত্রও হইতে পারিবেন।

(কিন্তু), আচাৰ্য্য বিশালাক্ষ এই মত পোষণ করেন না। কারণ, তাহার মতে এই (সহাধ্যায়ী) অমাত্যেরা (সহপাঠের সময়ে) তাহার সহিত একত্র ক্রীড়া করিতেন বলিয়া তাহাকে (রাজাকে) অবহেলা করিতে পারেন। সুতরাং রাজা তাহাদিগকেই অমাত্য নিযুক্ত করিবেন, যাঁহারা (চরিত্রের) গুহ বা গুপ্ত বিষয়ে (রাজার সহিত) সমান-ধৰ্ম্ম-বিশিষ্ট; কারণ, তাহারা শীল (গুণময় স্বভাব) ও বাসন (দোষ) বিষয়ে (রাজার সহিত) সমান। সেই কারণে, রাজা তাঁহাদের সব ধৰ্ম্ম অবগত আছেন বলিয়া তাহারা স্বকাৰ্য্য-নিম্পাদনে কোন অপরাধ করিবেন না।

আবার, আচাৰ্য্য পরাশর মনে করেন যে, এই দোষ ত (রাজা ও অমাত্যগণের) উভয়ের পক্ষে সমান। অমাত্যেরাও রাজার সব ধৰ্ম্ম অবগত আছেন এই ভয়ে, (রাজা) তাহাদের স্ব ও অস্বস্তৃভাবে কৃত সৰ্ব্ব কৰ্ম্মেরই অনুসরণ করিবেন।–

রাজা অবশ হইয়া যে যে লোকের কাছে নিজের গুপ্ত কথা বলিবেন, সেই কাৰ্য্য দ্বারাই তিনি তাহাদের বশগামী হইয়া পড়িবেন ॥১

সুতরাং, তিনি তাঁহাদিগকেই অমাত্য নিযুক্ত করিবেন, যাঁহারা প্রাণের উপর আশঙ্কাপ্রদ বিপদেও তাহার উপকার সাধন করিয়া থাকেন, কারণ, রাজা নিজের প্রতি তাঁহাদের অনুরাগের পরিচয় পাইয়াছেন।

(কিন্তু), আচাৰ্য্য পিশুন (নারদ) এই মতাবলম্বী নহেন। (তিনি মনে করেন যে,) ইহা তো রাজভক্তি মাত্ৰ—ইহা তাঁহাদের বুদ্ধিপ্রকাশের পরিচায়ক নহে। তিনি তাঁহাদিগকেই অমাত্যপদে নিযুক্ত করিবেন, যাহারা যে কৰ্ম্মসমূহ হইতে অর্থাগমের ইয়ত্ত হইয়াছে, তাহাতে নিযুক্ত হইয়া, যথাদিষ্ট অর্থ উৎপাদন করিতে, বা তাহা হইতে অধিক পরিমাণ অর্থ উৎপাদন করিতে সমর্থ হয়েন। কারণ, এইরূপ কাৰ্য্য দ্বারাই তাহাদের (বুদ্ধি-) গুণ কেবল পরীক্ষিত হইতে পারে।

আবার, আচাৰ্য্য কৌণপদন্ত (ভীষ্ম) এই মত মানেন না। তিনি মনে করেন যে, তাহারা অন্যান্য অমাত্যগুণ-বিরহিত। (সুতরাং) যাঁহারা পিতা ও পিতামহ-ক্রমে আগত, তেমন ব্যক্তিদিগকে অমাতারূপে (রাজা) নিযুক্ত করিবেন, কারণ, তাহারা অনেক অপদান (অবদান বা কৰ্ম্মবৃত্ত, অর্থাৎ প্রশস্তকৰ্ম্ম) পূর্ব্ব হইতেই লক্ষ্য করিয়া আসিতেছেন। (রাজা) তাহাদের প্রতি অপচার বা অন্যায় আচরণ করিলেও তাহারা কখনই তাহাকে পরিত্যাগ করিতে পারিবেন না,—যে-হেতু, তাহাদের সহিত রাজার সম্বন্ধ বা পরিচয় প্রতিষ্ঠিত আছে। এমন কি, এইরূপ ব্যবহার মামুষ ব্যতিরিক্ত পশু প্রভৃতির মধ্যেও দেখা যায়। কারণ, গরুরাও অপরিচিত গোসমূহ ছাড়িয়া পরিচিত গোগণের নিকটই অবস্থান করে।

(কিন্তু,) আচার্য্য ব্যাভব্যাধি (উদ্ধব) এই মত অবলম্বন করিতে প্রস্তুত নহেন। কারণ, (তাঁহার মতে) তাঁহারা (অর্থাৎ কুলক্রমাগত অমাত্যেরা) রাজার সৰ্ব্ব বিষয় নিজ অধীন করিয়া, নিজেরাই রাজার ন্যায় স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন করিয়া চলিবেন। অতএব, রাজার পক্ষে নীতিশাস্ত্রবিৎ নুতন লোককেই অমাত্যপদে নিযুক্ত করা উচিত, কারণ, এই নবীন লোকেরা দণ্ডধর রাজাকে যমের পদে প্রতিষ্ঠিত মনে করিয়া কোন প্রকার অপরাধ করিতে সাহসী হইবেন না।

(কিন্তু), আচাৰ্য্য বাহুদন্তীপুত্র (ইন্দ্র) এই মত পোষণ করেন না। (তাঁহার মতে) কেবল নীতিশাস্ত্রে নিপুণ ব্যক্তি, শাস্ত্রার্থের অনুষ্ঠানকৰ্ম্মে অপরিচিত থাকায়, সৰ্ব্ব কৰ্ম্মেই বিষাদগ্ৰস্ত হইবেন, অর্থাৎ সফল হইবেন না। সুতরাং, রাজা এমন লোককেই অমাত্যরূপে নিযুক্ত করিবেন, যিনি সদ্বংশজাত, প্রজ্ঞাবান, (উপধা-) শুদ্ধ, শূর ও স্বামীর প্রতি ভক্তিমান, কারণ, গুণের প্রাধান্তই সৰ্ব্বতেভাবে প্রয়োজনীয়।

কৌটিল্য স্বয়ং মনে করেন যে, পূৰ্ব্বোক্ত আচাৰ্য্যগণের অনুমোদিত সব বিষয়গুলি যুক্তিযুক্ত মনে হইতে পারে, তবে পুরুষের সামর্থ্য (অর্থাৎ তৎ-তৎ অধিকারস্থানের যোগ্যতা) তাহার সর্বপ্রকার কার্য্যনিস্পত্তিল শক্তি দ্বারা ও (শাস্ত্র-জ্ঞানাদিলন্ধ) সামর্থ্য দ্বারাই নিৰ্দ্ধারিত—(অতএব),

(বিশ্বাস্যত্র প্রভৃতি) অমাত্যগুণ-সমূহ বিবেচনা করিয়া, এবং উচিত দেশ, উচিত কাল ও কৰ্ম্মের স্বরূপ বুঝিয়, (রাজা) (সহাধ্যায়িপ্রভৃতি) সৰ্ব্বপ্রকার লোকদিগকে অমাত্য বা কৰ্ম্মসচিবের পদে নিযুক্ত করিতে পারেন, কিন্তু, মন্ত্রী বা ধীসচিবের পদে নহে (অর্থাৎ মন্ত্রী তিনিই হইবেন যিনি সৰ্ব্বপ্রকার অমাত্যগুণোপেত হইবেন) ॥২

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে বিনয়াধিকারিক-নামক প্রথম অধিকরণে অমাত্য-নিয়োগ-নামক অষ্টম অধ্যায় সমাপ্ত।

.

নবম অধ্যায়
৫ম প্রকরণ—মন্ত্রী ও পুরোহিতের নিয়োগ

এখন প্রধান অমাত্য বা মন্ত্রীর গুণসম্পদের কথা বলা হইতেছে—যথা, তিনি হইবেন (১) জনপদ, অর্থাৎ রাজার সহিত একদেশোদ্ভব, (২) অভিজাত, অর্থাৎ উচ্চকুলসস্তুত, (৩) স্ববগ্রহ, অর্থাৎ যিনি নিজেকে ও অপরকে অনুচিত কাৰ্য্য হইতে নিবারণ করিতে সমর্থ, (৪) কৃতশিল্প, অর্থাৎ রথচৰ্য্যা—গান্ধৰ্ব্ববিদ্যা প্রভৃতিতে নিপুণ, (৫) চক্ষুষ্মান, অর্থাৎ চক্ষুরূপী অর্থশাস্ত্রে অভিজ্ঞ, (৬) প্রাজ্ঞ, অর্থাৎ তীক্ষীসম্পন্ন, (৭) ধারয়িষ্ণু, অর্থাৎ পূৰ্ব্ববৃত্তাস্তাদি সম্বন্ধে স্মরণশক্তিযুক্ত, (৮) দক্ষ, অর্থাৎ কাৰ্য্যসম্পাদনে ক্ষিপ্রকারী, (৯) বাগ্মী, অর্থাৎ বাক্যকথনে কুশল, (১০) প্ৰগলভ, অর্থাৎ যে কোন বিষয় সম্যক ব্যক্ত করিতে সাহসযুক্ত, (১১) প্রতিপত্তিমান, অর্থাৎ যুক্তিতৰ্কদ্বারা প্রবোধনকারী, (১২) উৎসাহমুক্ত, অর্থাৎ পুরুষকার-সমন্বিত, (১৩) প্রভাবযুক্ত, অর্থাৎ প্রভূশক্তিসম্পন্ন, (১৪) ক্লেশসহ, অর্থাৎ ক্লেশ সহ করিতে সমর্থ, (১৫) শুচি, অর্থাৎ উপধা-চতুষ্টয় বিষয়ে শুদ্ধবৃত্ত, (১৬) মৈত্র, অর্থাৎ সকলের প্রতি মিত্রভাবাপন্ন, (১৭) দুঢ়ভক্তি, অর্থাৎ রাজা বা স্বামীর প্রতি অবিচাল্য অনুরাগবিশিষ্ট, (১৮) শীলযুক্ত, অর্থাৎ সদাচরণকারী, (১৯) বলসংযুক্ত, অর্থাৎ দৈহিক বলযুক্ত, (২০) আরোগ্য-সংযুক্ত, অর্থাৎ স্বস্বাস্থ্যবশতঃ নীরোগ, (২১) সত্ত্বসংযুক্ত, অর্থাৎ ধৈর্য্যশালী, (২২) স্তম্ভবর্জিত, অর্থাৎ গৰ্ব্বরহিত, (২৩) চাপল্যবর্জিত, অর্থাৎ চাঞ্চল্যরহিত, (২৪) সংপ্রিয়, অর্থাৎ সৌম্যাকৃতি এবং (২৫) শক্রতার অনুৎপাদক ও ইহার উপশময়িত। (এই গুণরাজি সমগ্রভাবে যাঁহার থাকিবে তিনিই প্রথম শ্রেণীর অমাত্য বলিয়া গৃহীত হইবেন।) এই গুণগুলির এক-চতুর্থাংশ যাহার কম আছে, তিনি মধ্যম শ্রেণীর অমাত্য বলিয়া পরিগণিত হইবেন, এবং গুণগুলির অৰ্দ্ধাংশ যাহার কম আছে, তিনি অবর বা অধম শ্রেণীর অমাত্য বলিয়া গণ্য হইবেন।

উক্ত গুণগুলির মধ্যে (অথবা, উক্ত তিনপ্রকার অমাত্যদিগের) জনপদ (জন্মস্থান) ও অবগ্রহ (আত্ম-পর-সংযমন শক্তি), আপ্ত বা বিশ্বাস্যজনের নিকট হইতে (রাজা) পরীক্ষা করিয়া জানিবেন; সমান বিদ্যাবিদগণের নিকট হইতে তাঁহাদের শাস্ত্ররূপনেত্রবত্তা অর্থাৎ শাস্ত্র নৈপুণ্য জানিবেন। কৰ্ম্মানুষ্ঠানসময়ে তাঁহাদের প্রজ্ঞা, ধারণশক্তি ও দক্ষতার বিচার করিবেন; কথাপ্রসঙ্গে তাহাদের বাগ্মিত্র, প্ৰগলভত ও নব নব প্রজ্ঞার উন্মেষশালিত্র বুঝিয়া লইবেন;”আপংকালে তাঁহাদের সাহস, প্রভাব (প্রভূশক্তি) ও ক্লেশসহত্র পরীক্ষা করিবেন; সংব্যবহার (রাজকাৰ্য্যের সম্পাদন, অথবা আচার-ব্যবহার) হইতে তাঁহাদের শুদ্ধতা, মৈত্রীভাব ও দৃঢ়ভক্তিতা জানিয়া লইবেন; সহবাসী জনের নিকট হইতে তাঁহাদের শীল (চরিত্র), বল (দৈহিক শক্তি), আরোগ্য (নীরোগত), সত্ত্বযোগ (ধৈৰ্য্যযোগ) ও নির্গৰ্ব্বতা ও অচাঞ্চল্য জানিবেন; এবং প্রত্যক্ষভাবে অর্থাৎ নিজ দর্শন দ্বারা তাহাদের সৌম্যাকুতিত্র ও অবৈরিত্র (অন্যের সহিত শক্রত্বের অভাব) বুঝিয়া লইবেন।

কারণ, রাজবৃত্তি (রাজার ব্যবহার) প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ ও অল্পমেয় এই তিন প্রকারের হইয়া থাকে (অর্থাৎ এইজন্যই পূৰ্ব্ববৰ্ত্তী অমাত্য-গুণ পরীক্ষায় রাজা এই তিন প্রকার প্রমাণই ব্যবহার করিবেন বলিয়া উক্ত হইয়াছে)। যাহা নিজেই দেখিয়া লওয়া হয়, তাহাই প্রত্যক্ষ জ্ঞান; যাহা পর (বা আপ্তজন) দ্বারা উপদিষ্ট হয় তাহাই পরোক্ষ জ্ঞান; এবং কৰ্ম্মসম্বন্ধে সম্পাদিত কাৰ্য্যাংশ দ্বারা অসম্পাদিত কাৰ্য্যাংশের ঈক্ষণ বা বোধই হইল অনুমেয় জ্ঞান। যেহেতু, রাজকাৰ্য্যসমূহের মধ্যে এক সময়েই অনেক কার্য সম্পাদন করার আবখ্যক হয়, কৰ্ম্মও অনেক প্রকারের হইতে পারে এবং এক এক কৰ্ম্ম এক এক স্থানে করণীয় হইতে পারে, সুতরাং দেশ ও কালের অতিক্রম না ঘটে, এইজন্য রাজ (স্বপক্ষে সব কাৰ্য্য নিজের সম্পাদন করা সম্ভবপর নহে বলিয়া) অমাত্যদিগের দ্বারা তাহা সম্পাদন করাইবেন। এই পৰ্য্যন্ত অমাত্যাদির কৰ্ম্ম আলোচিত হইল।

রাজা সেইপ্রকার ব্যক্তিকে পুরোহিত নিযুক্ত করিবেন, যিনি অতি সমৃদ্ধ কুল ও শীল-বিশিষ্ট, যিনি ষড়ঙ্গ সহিত বেদবিদ্যায়, দৈব বা জ্যোতিষশাস্ত্রে, নিমিত্তশাস্ত্ৰে (শকুনশাস্ত্রে) ও দণ্ডনীতিশাস্ত্রে অত্যন্ত শিক্ষিত এবং যিনি দৈব (দেবকৃত) ও মানুষ (মানুষকৃত) বিপদের—অথর্ব-মন্ত্রের প্রয়োগ ও অন্যান্য উপায়দ্বারা প্রতীকার করিতে সমর্থ। শিস্য যেমন আচার্য্যের, পুত্র যেমন পিতার ও তৃত্য যেমন স্বামীর অনুবর্তন করে, (রাজাও) তেমন সেই পুরোহিতের অনুবৰ্ত্তন করিবেন।

এমন ব্রাহ্মণ (পুরোহিত) দ্বারা সংবৰ্দ্ধিত, মন্ত্রিগণের মন্ত্রণাদ্বারা সংস্কৃত ও শাস্ত্রোক্ত বিধানের অনুষ্ঠানপর হইলে ক্ষাত্রধৰ্ম্ম বা ক্ষত্রিয়কুল, শস্ত্র-সাহায্য ব্যতিরেকেও, একান্তভাবে অজেয় (অলভ্য) বস্তুও জয় করিয়া লইতে পারে ॥১

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে বিনয়াধিকারিক-নামক প্রথম অধিকরণে মন্ত্রী ও পুরোহিতের নিয়োগ-নামক নবম অধ্যায় সমাপ্ত।

.

দশম অধ্যায়
৬ষ্ঠ প্রকরণ—উপধা বা ছলরীতিতে অমাত্যগণের শৌচ ও অশৌচ পরীক্ষা

অমাত্যদিগকে সামান্য অধিকরণে (অধিকারপদে) নিযুক্ত করিয়া, (রাজা) মন্ত্রী ও পুরোহিতের সহিত যুক্ত হইয়া তাহাদিগকে (অমাত্যগণকে) (বক্ষ্যমাণ) উপধা বা ছলদ্বারা (শৌচাশৌচ সম্বন্ধে) পরীক্ষা করিয়া লইবেন।

(রাজা) পুরোহিতকে অযাজ্য (অর্থাৎ যজ্ঞকরণে অযোগ্য নীচকুলোস্তব) জনকে যজ্ঞ করাইতে ও (বেদাদি) পড়াইতে নিযুক্ত করিবেন এবং সেই পুরোহিত তজ্জন্য (রাজার প্রতি) রুষ্ট হইলে, তিনি (রাজা) তাহাকে নিজের অধিকারপদ হইতে অপসারিত করিবেন। সেই তিরস্কৃত পুরোহিত (তখন) (বক্ষ্যমাণ) সত্রি-নামক গূঢ়পুরুষগণের সহায়তায়, শপথপূর্ব্বক প্রত্যেক অমাতাকে (নিম্নবর্ণিত উপায়ে) উপজাপিত (অর্থাৎ রাজা হইতে ভেদযুক্ত) করিবেন। তিনি এইরূপ বলিবেন—“আমাদের এই রাজা অধাৰ্ম্মিক। আমাদের উচিত হইবে তাঁহার স্থানে অন্য এক ধাৰ্ম্মিক ব্যক্তিকে নিবেশিত করা–(এখন) সেই (নব নিবেশ্বমান) ব্যক্তি রাজার নিজ বংশসস্তৃত কেহই হউন, বা তাহার কোন অবরুদ্ধ (পুত্রাদিই) হউন, কিংবা উচ্চকুলোস্তব কোন সৰ্ব্বজন-পূজিত সামন্তরাজই হউন, অথবা কোন অটবীপতিই হউন, বা আমাদের সকলের বিবেচনায় উপযুক্ত বলিয়া সমর্থিত অন্য কোন ব্যক্তিই হউন। এই মত অন্য সকলেরই অন্সমোদিত, এখন এই বিষয়টি আপনার কেমন লাগে?” যদি সেই উপজাপিত অমাত্য এই প্রকার মত প্রত্যাখ্যান করেন, তাহা হইলে তাহাকে (অর্থাৎ রাজভক্তিযুক্ত) মনে করা হইবে। ইহার নাম ধর্ম্মোপধা (অর্থাৎ ধৰ্ম্মবিষয়ক কথাদ্বারা ছলনাপূর্ব্বক পরীক্ষণরীতি)।

সেনাপতিকে (রাজা) কোন অপূজ্য ব্যক্তির প্রতি সৎকার প্রদর্শন করিতে বলিবেন, এবং সেনাপতি তাহা করিতে অস্বীকৃত হইলে (তিনি) তাহাকে পদচ্যুত করিবেন—এইভাবে (অপমানিত হইয়া সেনাপতি) সত্রি দ্বারা (তন্নামক গঢ়পুরুষগণদ্বারা) এক একটি অমাত্যের নিকট লোভনীয় অর্থ উপস্থাপিত করিয়া, রাজার বিনাশের জন্য উপজাপিত করিবেন (অর্থাৎ পূৰ্ব্বোক্ত উপায়ে মতামত জিজ্ঞাসা করিয়া রাজবিনাশে অমাত্যকে প্রবর্তিত করিবেন)। তিনি এইরূপ —“অন্য সকলেরই এই বিষয়ে অনুমোদন আছে। আপনার মত কি?” সেই অমাত্য এই মত প্রত্যাখ্যান করিলে তাহাকে শুচি বলিয়া ধরিতে হইবে। ইহারই নাম অর্থোপধা (অর্থাৎ ধনলাভবিষয়ক কথাদ্বারা ছলনাপূৰ্ব্বক পরীক্ষণরীতি)।

কোন পরিব্রাজিক (ভিক্ষুকী)—যিনি রাজার অন্তঃপুরে মহিষীগণের বিশ্বাসের পাত্রী ও তাঁহাদের দ্বারা সম্পূজিতা-—এক এক জন মহামাত্রকে (প্রধান অমাতাকে) উপজাপিত করিবেন। তিনি এইরূপ বলিবেন—“রাজমহিষী আপনাকে কামনা করেন এবং তিনি আপনার সমাগমের সব উপায় ও স্থির করিয়াছেন। আপনার অনেক অর্থলাভও হইবে।” সেই মহামাত্র যদি এই প্রকার বাক্য প্রত্যাখ্যান করেন, তাহা হইলে তিনি শুচি বলিয়া বিবেচিত হইবেন। ইহারই নাম কামোপধ। (অর্থাৎ কামবিষয়ক কথাদ্বারা ছলনাপূৰ্ব্বক পরীক্ষণ-রীতি)।

প্রবহণ (নৌকাবিশেষ বা কর্ণীরথ নামক পালকী) ব্যবহার করিয়া গোষ্ঠীকৌতুক সম্পাদন করার জন্য (রাজার বিশ্বাসভাজন) কোন এক অমাত্য অন্যান্য সব অমাত্যকে একত্র মিলিত করিবেন। তন্নিমিত্তক উদ্বেগে রাজা তাহাদিগকে (অর্থ ও মান হইতে অপসারিত করিয়া) অবরুদ্ধ করিবেন। রাজাস্বারা ইতিপূৰ্ব্বে অপমানিত ছাত্রবৃত্তিধারী কাপটিক নামক গূঢ়পুরুষ সেই অমাত্যগণের মধ্যে যাঁহারা অর্থ ও মান হইতে রাজকর্তৃক চ্যুত হইয়াছেন তাহাদের প্রত্যেককে এইভাবে উপজাপিত করিবে—“এই রাজা অসৎ মার্গে প্রবৃত্ত। আমরা তাঁহাকে সহসা হত্যা করিয়া অন্য একজনকে রাজপদে বসাইব। এই বিষয়ে সকলেরই মৃত আছে, আপনার অভিমত কি?” যে অমাত্য এইরূপ বাক্য প্রত্যাখ্যান করিবেন তাহাকে শুচি বলিয়া বুঝিতে হইবে। ইহার নাম ভয়োপদা (অর্থাৎ ভয় প্রদর্শনপূর্ব্বক ছলনা দ্বারা চরিত্র-পরীক্ষা)।

এই চারি প্রকার উপধাদ্বারা শোধিত অমাত্যগণের মধ্যে যাঁহারা ধৰ্ম্মোপধাবিষয়ে শুদ্ধ বলিয়া পরিজ্ঞাত হইয়াছেন তাহাদিগকে ধৰ্ম্মস্থীয় (তৃতীয় অধিকরণ দ্রষ্টব্য) ও কণ্টকশোধন (চতুর্থ অধিকরণে দ্রষ্টব্য)-বিষয়ক কার্য্যে নিযুক্ত করবেন। যাহারা অর্গোপধাবিষয়ে শুদ্ধ তাহাদিগকে সমাহৰ্ত্ত (রাজকরসংগ্রহকারী অধ্যক্ষবিশেষ) ও সন্নিধাভা (রাজকোষ নিধানকরণে ব্যাপৃত অধ্যক্ষবিশেষ) এই উভয় অধ্যক্ষের ধনসংগ্রহ ও ধননিধানকার্য্যে নিযুক্ত করিবেন। যাঁহারা কামোপধা-বিষয়ে শুদ্ধ তাহাদিগকে (রাজার) বাহ ও আভ্যন্তর বিহারসাধনভূত স্ত্রীলোক ও মহিষীদিগের রক্ষাকার্ধ্যে নিযুক্ত করিবেন। এবং যাঁহারা ভয়োপধাবিষয়ে শুদ্ধ তাহাদিগকে (তিনি) নিজ সমীপবৰ্ত্তী (অর্থাৎ শরীররক্ষাদি) কাৰ্য্যকলাপে নিযুক্ত করিবেন। (কিন্তু,) যাহারা উক্ত চারিপ্রকার উপধাবিষয়ে শুদ্ধ বলিয়া সিদ্ধ হইয়াছেন তাহাদিগকে (তিনি) মন্ত্রিপদে নিযুক্ত করিবেন। আবার যাঁহারা সর্বপ্রকার উপধাবিষয়ে অশুচি বলিয়া সিদ্ধ হইয়াছেন, তাহাদিগকে খনি, দ্রব্যবন, হস্তিবন ও নানাপ্রকার কৰ্ম্মাস্তে বা কারখানায় (অর্থাৎ সেইরূপ শারীর আয়াসবহুল কার্য্যে) নিযুক্ত করিবেন।

পূৰ্ব্বাচার্য্যগণেরই এইরূপ ব্যবস্থা যে ধৰ্ম্ম, অর্গ ও কাম এই ত্রিবর্গ ও ভয় —এই চারি প্রকারের উপধাদ্বারা পরীক্ষিত হইয়া শুদ্ধ বলিয়া যে যে অমাত্য সিদ্ধ হইবেন, তাহাদিগকে তাঁহাদের শুদ্ধির অনুরূপ নিজ নিজ উপযোগী কার্য্যে রাজা নিয়োজিত করবেন ॥১

কিন্তু, কৌটিল্যের এই সিদ্ধান্ত যে, রাজা অমাত্যগণের শৌচ পরীক্ষায় যেন কখনই নিজেকে বা দেবীকে (পটমহিষীকে) লক্ষ্য বা বিষয়ীভূত করিবেন না (অর্থাৎ টানিয়া আনিবেন না) ॥২

দোষরহিত আমাত্যের উপধাদারা পরীক্ষার্থ বঞ্চনকার্য্যে রাজা কখনও হস্তক্ষেপ করিবেন না, ইহা শুদ্ধ জলকে বিষমিশ্রিত করার ন্যায় অন্যায় কাৰ্য্য হইবে। কারণ, ইহাই অধিকতর সম্ভব যে, একবার কোন অমাত্য (এইপ্রকার ছলনাদির ফলে) দুষ্টবুদ্ধি হইয়া উঠিলে, তাঁহার প্রতীকারের ঔষধ আর পাওয়৷ যাইবে না ॥৩

সত্ত্ববান (অমাত্যদিগের) ধুতিতে অবস্থিত বুদ্ধিকে যদি চারি প্রকার উপধাদ্বারা কলুষিত করা যায়, তাহা হইলে তাহাদের সেই চতুবিধা বুদ্ধি (অকল্যাণুের) শেষ সীমা পর্য্যন্ত না যাইয়া নিবত্তিত হইবে না (অর্থাৎ সেই অমাত্যেরা তাহাদের কলুষিত বুদ্ধির প্রয়োগে রাজার অহিত সাধন করিতেও পারেন) ॥৪

অতএব, রাজা উক্ত চতুবিধ উপধার আচরণে কোন বাহ বস্তুকেই লক্ষ্য করিয়া সত্রি নামক গূঢ়পুরুষদ্বারা অমাত্যগণের শৌচ ও অশৌচ পরীক্ষা করিয়া লইবেন ॥৫

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে বিনয়াধিকারিক-নামক প্রথম অধিকরণে উপধাদ্বারা অমাত্যগণের শৌচাশৌচ পরীক্ষা-নামক দশম অধ্যায় সমাপ্ত।

.

একাদশ অধ্যায়
৭ম প্রকরণ–গূঢ়পুরুষদিগের নিয়োগ

(রাজা) প্রাগুক্ত প্রকরণে বর্ণিত উপধা-চতুষ্টয়দ্বারা অমাত্যবর্গের শুদ্ধত উপলব্ধি করিয়া গূঢ়পুরুষদিগকে নিযুক্ত করিবেন। এই গূঢ়পুরুষ বা গুপ্তচরগণ নানাবিধ হইতে পারে, যথা—(১) কাপটিক (কপটবৃত্তি ছাত্র), (২) উদাস্থিত (উদাসীন সন্ন্যাসী), (৩) গৃহপতিক (কর্তৃভূত গৃহস্থ), (৪) বৈদেহক (বণিক্‌) ও (৫) তাপসের (তপস্যাকারীর) বেষধারী এবং (৬) সত্ৰী (নানাশাস্ত্রের অধ্যয়নকারী বলিয়া পরিচিত গুপ্তচর), (৭) তীক্ষ্ণ (শরীরনিরপেক্ষ অতিসাহসী ব্যক্তি), (৮) রসদ (বিষপ্রদায়ী লোক) ও (৯) ভিক্ষুকী (পরিব্রাজিকা—প্রভৃতি)।

অন্যের ছিদ্রজ্ঞাত, প্ৰগলভ ছাত্রবেষী জনকে কাপটিক বলা হয়। তাহাকে অনেক ধন ও সম্মানদ্বারা উৎসাহিত করিয়া রাজমন্ত্রী (অর্থাৎ প্রধান অমাত্য) এইরূপ বলিবেন—“রাজাকে ও আমাকে সৰ্ব্ববিষয়ে প্রমাণভূত মনে করিয়া তুমি যাহার (অর্থাৎ যে সব অমাত্যাদির) যাহা অকুশল (অন্যায় কাৰ্য্য) দেখিবে, তাহা তখনই আমাদিগকে জানাইবে।”

প্রাজ্ঞ ও শুচিযুক্ত, (কিন্তু,) প্রব্রজ্যা বা সন্ন্যাস হইতে চ্যুত (মতান্তরে, সন্ন্যাসে দীক্ষিত) ব্যক্তিকে উদাস্থিত বলা হয়। প্রচুর নগদ টাকা ও অনেক শিস্য লইয় এই ব্যক্তি বাৰ্ত্তাকর্মের জন্য নিৰ্দ্ধারিত ভূমিতে যাইয়া (শিষ্যগণদ্বারা) বাৰ্ত্তাকৰ্ম্ম (অর্থাৎ কৃষি, বাণিজ্য ও পশুপালন-কর্ম) করাইবে। সেই বাৰ্ত্তাকৰ্ম্মলন্ধ আমদানীদ্বার, সৰ্ব্বপ্রকার প্রব্রজিতদিগের (অর্থাৎ বৌদ্ধ-জৈন-পাশুপতাদি সন্ন্যাসীদিগের) গ্রাসাচ্ছাদন ও নিবাসের ব্যবস্থা করিবে। এইপ্রকার (গ্রাসাচ্ছাদন ও নিবাসের) বৃত্তি যাহারা কামনা করে তাহাদিগকে (এই উদাস্থিত) উপজাপিত করিবে (অর্থাৎ ফুসলাইয়া স্ববশে রাখিবে) এবং এইরূপ বলিবে—“তোমরা পরিগৃহীত (বৌদ্ধাদি-) বেষেই রাজার প্রয়োজন অনুষ্ঠান করিবে, এবং ভক্ত (ধান্যাদি) ও বেতনের সময় উপস্থিত হইলে আমার নিকট আসিবে।” সৰ্ব্বপ্রকার প্রব্রজিতেরা তাহাদের নিজ নিজ বর্গকে উপজাপিত করিয়া নিজ বশে রাখিবে

কৃষিবৃত্তিতে ক্ষয়প্রাপ্ত (দরিদ্র) অথচ প্রজ্ঞ ও শৌচযুক্ত কর্ষককে গৃহপতিব্যঞ্জন বলা হয়। এই ব্যক্তি কৃষিকর্মের জন্য নির্দ্দিষ্ট ভূমিতে যাইয়া উদাস্থিতনামক গূঢ়পুরুষের মতই পূৰ্ব্ববৎ কাৰ্য্য করিবে (অর্থাৎ গ্রাসাচ্ছাদন ও নিবাসের ব্যবস্থাপূর্ব্বক অন্যান্য কর্মকবেষধারী পুরুষদিগকে স্ববশে রাখিবে)।

বাণিজ্যবৃত্তিতে ক্ষয়প্রাপ্ত (দরিদ্র), অথচ প্রজ্ঞ ও শৌচযুক্ত বাণিজককে বৈদেহকব্যঞ্জন বলা হয়। এই ব্যক্তি বাণিজ্যকর্মের জন্য নির্দ্দিষ্ট ভূমিতে যাইয়। পূৰ্ববং সমান কাৰ্য্য করিবে (অর্থাৎ উক্তরূপ ব্যবহারদ্বারা অন্যান্য বাণিজকবেষধারী পুরুষদিগকে স্ববশে রাখিবে)।

মুণ্ডিতমস্তক (বৌদ্ধভিক্ষুক ও ক্ষপণকাদি) বা জটাধারীর (শৈবপাশুপতাদির) বেষে অবস্থানকারী ব্যক্তি যদি নিজের জীবিকার জন্য রাজকাৰ্য্য করিতে কামনা করে, তাহা হইলে তাহাকে তাপসব্যঞ্জন বলা হয়। সেই ব্যক্তি নগরের নিকটে (উপকণ্ঠে) বহুসংখ্যক মুণ্ড ও জটিল, শিস্যগণসহ বাস করিয়া শাক বা তৃণমুষ্টি একমাস বা দুইমাস অন্তর প্রকাশ্যভাবে খাইবে (যেন লোকেরা তাহাকে নিরাহার তাপস বলিয়াই জানিতে পারে, কিন্তু, সে গোপনভাবে অভীষ্ট আহাৰ্য্য দ্রব্য খাইতে পারিবে এবং পূৰ্ব্বোক্ত বৈদেহকব্যঞ্জন গূঢ়পুরুষের শিষ্যেরা এই তাপসব্যঞ্জন গূঢ়পুরুষকে তদীয় সমিল্কযোগের জন্য (অর্থাৎ তাহার তপস্যাপ্রভাবে অন্যকে ধনাদি দ্বারা সমৃদ্ধিযুক্ত করিতে পারেন—এই হেতু) তাহাকে খুব পূজা সৎকার দেখাইবে। এবং এই তাপসের শিষ্যেরা এইরূপ আবেদন করিবে —“এই সিদ্ধ পুরুষটি সামেধিক অর্থাৎ তিনি ভাবী সম্পত্তি প্রভৃতির কথা সকলকে বলিয়া দিতে পারেন।” সমেধা অর্থাৎ ভবিষ্যৎ সম্পদবিষয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার অভিলাষে তৎসমীপে আগত ব্যক্তিদিগের অঙ্গস্থ চিহ্নাদি পরিদর্শন করিয়া, (মতান্তরে, শুভাশুভপ্রতিপাদক জ্যোতিষাঙ্গবিদ্যাদ্ধার) ও শিষ্যগণের (নেত্ৰবিলাসাদি) ইঙ্গিত বুঝিয়া, তিনি (সেই সামেধিক তাপস) তাহাদিগের নিজকুলে নিম্পন্ন কাৰ্য্যাদির আদেশ জানাইবেন অর্থাৎ তাহা ব্যক্ত করিবেন। আবার (প্রশ্নকৰ্ত্তার) কাৰ্য্যলাভের অল্পতা, তাহার গৃহে অগ্নিদাহ ও চোরভয়ের সম্ভাবনাবিষয়ও (তিনি) বলবেন, এবং দুৰ্য বা রাজদ্বেষকারীর বধ, রাজসস্তোষে বৃহৎ দান, বিদেশে সস্তুত বৃত্তান্তের জ্ঞান, ‘তোমার অদ্য বা আগামীকল্য এই প্রকার ঘটনা ঘটিবে? অথবা ‘অদ্য বা কল্য রাজ তোমার সম্বন্ধে এইরূপ বিধান করিবেন’ ইত্যাদি বিষয়সমূহ (প্রশ্নোত্তরে) ব্যক্ত করিবেন।

এই তাপসের সেই আদেশবাক্য গূঢ় সত্রীরা যাথার্থ্যে পরিণত করিবে (অর্থাৎ তাপসের আদিষ্ট অগ্নিদাহাদি ঘটাইয়া তাপসের কথার যথাযথত্র প্রমাণিত করিবে)।

যদি প্রশ্নকৰ্ত্তারা সত্ত্ব, প্রজ্ঞা ও বাগিত্রশক্তিসম্পন্ন হয়েন, তাহা হইলে তাহদিগকে রাজার নিকট হইতে সম্ভাব্য (ধনলাভাদি) ও মন্ত্রীর সহিত সংযোগের কথাও আদেশরূপে বলিয়া দিবেন। (মন্ত্রীর সহিত সাক্ষাৎকার ঘটিলে) সেই মন্ত্রী ও তাহাদিগের (সত্ত্ব-প্রজ্ঞাদির অনুরূপ) বৃত্তি ও কৰ্ম্ম পরিকল্পনা-বিষয়ে যত্নবান হইবেন। যাহারা (কাপটিকাদি গূঢ়পুরুষ হইতে পরিজ্ঞাত) কোন কারণবশতঃ ক্রুদ্ধ বলিয়া বিজ্ঞাত, তাহাদিগকে (মন্ত্রী) অর্থ ও সম্মানদ্বারা শান্ত করিবেন। আর যাহারা অকারণে ক্রুদ্ধ ও রাজার দ্বেষকারী তাহাদিগকে (তিনি) গোপনে বধ করাইবেন।

অর্থ ও সম্মানদ্বারা রাজকর্তৃক পূজিত গূঢ়পুরুষগণ (অমাত্যাদি) রাজোপজীবীদিগের শৌচ পরীক্ষা করিয়া জানিবে। কাপটিকাদি পাঁচ প্রকার গূঢ়পুরুষদিগকে সংস্থ-নামে প্রকীৰ্ত্তিত করা হয়। (রাজপ্রয়োজনে তাহারা একস্তানে অবস্থান করিয়াই গুপ্তচরের কার্য্য করে বলিয়া ইহাদের নাম সংস্থ) ॥১

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে বিনয়াধিকারিক-নামক প্রথম অধিকরণে গূঢ়পুরুষের উৎপত্তি নামক একাদশ অধ্যায় সমাপ্ত।

.

দ্বাদশ অধ্যায়
৮ম প্রকরণ–গূঢ়পুরুষদিগের প্রণিধি বা কার্য্যে ব্যাপৃতি

যাহারা রাজার সহিত সম্বন্ধযুক্ত বলিযা তাহার অবশ্বপোষ্য, তাহারা যদি সামূদ্রিকাদি লক্ষণশাস্ত্র, অঙ্গবিষ্ঠ (শিক্ষাব্যাকরণাদি ষড়ঙ্গশাস্ত্র, অথবা অঙ্গপরিদর্শনদ্বারা শুভাশুভ-জ্ঞাপনবিদ্যা), জন্তুকবিদ্যা (বশীকরণ ও অন্তৰ্দ্ধানাদিবিদ্যা—ইন্দ্ৰহত এক দানবের নাম ছিল জস্তক), ইন্দ্রজালবিদ্যা, আশ্রমধৰ্ম্ম (মল্লাদিশাস্ত্রে প্রতিপাদিত আশ্ৰমধৰ্ম্ম), নিমিত্ত বা শকুনশাস্ত্র ও অন্তরচক্রবিদ্যা (নানাদিকে শকুনিকৃজন হইলে ইহার ফলাফল কি হইতে পারে তদবিজ্ঞাপক শাকুনশাস্ত্রাস্তভুক্ত অধ্যায়বিশেষের নাম অন্তরচক্র—বরাহমিহিরকৃত বৃহৎসংহিতাগ্রন্থের ৮৭তম অধ্যায় দ্রষ্টব্য)—প্রভৃতি এবং অন্যান্য সংসত্তশাস্ত্রের, (যথা— কামশাস্ত্র ও ইহার সহিত সম্পত্তি গীতবাদ্যাদিশাস্ত্রের) অধ্যয়নকারী হয়, তাহা হইলে তাহাদিগকে সত্ৰী বলা হইয়া থাকে।

যাহারা নিজ জনপদে শরীরনিরপেক্ষ হইয়া নিজের শৌর্য্যে নির্ভর করিয়া হস্তী বা (ব্যভ্রাদি হিংস্ৰজন্তুর সহিত দ্রব্যলাভের লোভে যুদ্ধাদি করে তাহাদিগকে তীক্ষ্ণ বলা হয়।

যাহারা আত্মীয়-স্বজনের প্রতি স্নেহ-বিহীন, অত্যন্ত ত্রুরস্বভাব ও অলস (অনুৎসাহী) তাহাদিগকে রসদ বলা যায় (রস বা বিষপ্রয়োগ করিতেও তাহারা সংকোচ বোধ করে না, এইজন্যই তাহাদের এইপ্রকার নাম)।

জীবিকার ভোগার্থিনী দরিদ্র, প্ৰগলভ বিধবা ব্রাহ্মণী যদি রাজন্তঃপুরে সৎকার লাভ করিয়া (প্রায়শ:) মহামাত্ৰগণের কুলে বা গৃহে যাতায়াত করে, তাহা হইলে তাহাকে পরিত্রাজিক (অর্থাৎ তদ্রপিণী গুপ্তচর) বলা যায়। এই ভাবে মুণ্ডা (বৌদ্ধভিক্ষুকী) ও বৃষলী (শূদ্র) নামে পরিচিতাদিগকেও বুঝিতে হইবে। এই পৰ্য্যন্ত সঞ্চার-নামে আখ্যাত সত্রিপ্রভৃতির লক্ষণ বলা হইল (তাহারা সৰ্ব্বত্র সঞ্চরণ করিয়া রাজপ্রয়োজনে চার বা গুপ্তবার্তা সংগ্রহ করে বলিয়া তাহাদের এই সঞ্চার নাম)। রাজা তদীয় নিজ রাজ্যে উক্ত সঞ্চারনামক গূঢ়পুরুষদিগকে, তাহাদিগের ভক্তি (রাজ-ভক্তি) ও সামর্থ্য (কাৰ্য্যসম্পাদনপঢ়তা) পৰ্য্যালোচনা করিয়া, এবং সকলের বিশ্বসনীয় তাহাদিগের দেশ, বেষ, শিল্প, ভাষা ও আভিজাত্যের ছলনা নির্দ্দিষ্ট করিয়া দিয়া, নিম্নলিখিত অষ্টাদশ মহামাত্র (মহামাত্য বা তীর্থ)-গণের উপর চার সংগ্রহে নিযুক্ত করিবেন। এই অষ্টাদশ মহামাত্রের নাম—যথা, (১) মন্ত্রী (প্রধান অমাত্য), (২) পুরোহিত (রাজপুরোহিত), (৩) সেনাপতি (সেনাবিভাগের প্রধান অমাত্য; মতান্তরে, মহাসেনানায়ক), (৪) যুবরাজ (যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত রাজপুত্র), (৫) দেীবারিক (রাজকুলের প্রধান প্রতিহার), (৬) অন্তৰ্ব্বংশিক (অন্তঃপুরাধিকৃত প্রধানপুরুষ), (৭) প্রশাস্তা (কারাগারের প্রশাসনকারী: এই তালিকার এই শব্দটির স্থানে মহাভারতে ‘কারাগারাধিকারী’ ও রামায়ণে “বন্ধনগারাধিকৃত’ শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়), (৮) সমাহৰ্ত্ত (রাজকরাদির সংগ্রহকারী প্রধান অধ্যক্ষ), (৯) সন্নিধাতা (রাজভাণ্ডারে সঞ্চিত ধনাদির নিধানকারী), (১০) প্রদেষ্ট (কণ্টকশোধনাধিকৃত ফৌজদারীর প্রধান বিচারক), (১১) নায়ক (কেহ কেহ শব্দটি দ্বারা সেনানায়ক বুঝেন। অষ্টাদশ তীর্থের তালিকায় রামায়ণ ও মহাভারতে এই স্থানে নগরাধ্যক্ষ শব্দের ব্যবহার দেখা যায়। তবে কি শব্দটির পাঠ মূলে নাগরিক হইবে?), (১২) পৌরব্যবহারিক (পুরবাসীদিগের ব্যবহার বা আইন প্রয়োগ-সম্বন্ধে আদালতের প্রধান বিচারক, অর্থাৎ ধৰ্ম্মাধ্যক্ষ), (১৩) কৰ্ম্মান্তিক (কৰ্ম্মান্ত বা খনি ও অন্যান্য কারখানার প্রধান পৰ্য্যবেক্ষক), (১৪) মন্ত্রিপরিষদধ্যক্ষ (অর্থাৎ যিনি অমাত্যপরিষদের অধ্যক্ষ বা সভাধ্যক্ষ), (১৫) দণ্ডপাল (সেনারক্ষার অধিপতি), (১৬) তুর্গপাল (দুৰ্গরক্ষার প্রধান পৰ্য্যবেক্ষক), (১৭) অন্তপাল (রাজ্য-সীমারক্ষক), (১৮) আটবিক (অষ্টবীপাল)।

(মন্ত্রি প্রভৃতি অষ্টাদশ) মহামাত্যদিগের বাহ সমাচার, তীক্ষ্ণ-নামক সঞ্চারের তাহাদিগের ছত্র, ভৃঙ্গার, ব্যজন, পাদুকা, আসন, যান ও (অশ্বাদি) বাহনাদির উপগ্রহণদ্বারা সেবাপরায়ণ হইয়া সব সমাচার জানিয়া লইবে এবং সত্রীরা সেই সমাচার সংস্থদিগের নিকট নিবেদন করিবে।

তাহাদিগের আভ্যন্তর সমাচার, রসদ নামক সঞ্চারেরা—পাচক আরালিক (পকভক্ষ্যকার বা পঞ্চমাংসাদি বিক্রেতা), স্নানকারক, সংবাহক (অঙ্গমৰ্দ্দক), আস্তরক (শয্যার আস্তরণকারী), কল্পক (নাপিত), প্রসাধক (প্রসাধন বা অলঙ্কারাদি বিধানকারী) ও জলহারকের বেষধারী হইয়া, এবং কুজ, বামন, কিরাত, মূক (বোবা), বধির, জড় (বোকা) ও অন্ধের বেষধারী হইয়া এবং নট (অভিনেতা), নৰ্ত্তক, গায়ন (গানকারী), বাদক (বাদ্যকারী), বাগ জীবন (পুরাবৃত্তের কথক, অথবা নানারূপ কৌশলময় শব্দাদি উচ্চারণ করিয়া তামাসা প্রদর্শনকারী) ও কুশীলব (লঙ্ঘনপ্লবনাদিদ্বারা উপজীবিকাকারী খেলক বা চারণ) সাজিয়। এবং স্ত্রীলোকেরাও (অর্থাৎ যে স্ত্রীলোকেরা গুপ্তচরের কাৰ্য্যে নিযুক্ত তাহারাও) সব সংবাদ জানিয়া লইবে এবং ভিক্ষুকীরা (রসদাদিদ্বারা বিজ্ঞাত) সেই আভ্যন্তর সংবাদ সংস্থদিগের নিকট অর্পণ করিবে।

সংস্থদিগের শিষ্যেরা তাহাদের (রচিত) সাংকেতিক লিপিসংযোগে তাহাদের পরিজ্ঞাত চারসমূহ (রাজসমীপে) সঞ্চারিত বা প্রেরিত করিবে। (কিন্তু সর্তকতা এইভাবে অবলম্বন করিতে হইবে) যেন সংস্থের বা সঞ্চারীরা নিজেদের মধ্যেই একে অন্যকে চিনিতে না পারে (কারণ, তাহা হইলে তাহারা একের প্রাপ্ত সমাচারই নিজেরও প্রাপ্ত বলিয়া জানাইয়া রাজাকে বঞ্চিত করিতে সমর্থ হইয়৷ রাজ-প্রয়োজন নষ্ট করিতে পারে)।

যদি (অমাত্যাদির অন্তঃপুরে) ভিক্ষুকীদের প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকে, তাহা হইলে দ্বারপালের পরম্পরায় (অর্থাৎ প্রথম দ্বারপাল দ্বিতীয়কে, দ্বিতীয়টি তৃতীয়কে—এইভাবে) ভিতরের সংগৃহীত চার বা গুপ্তসমাচার বাহির করিয়া ফেলিবে (অর্থাৎ রাজাস্তিকে প্রেরণার্থ সংস্থদিগের নিকট অর্পণ করিবে);–- (এই উপায় অবলম্বিত না হইতে পারিলে) অন্তঃপুরের পরিচারকদিগের মাতা বা পিতা সাজিয়া গূঢ়পুরুষেরা সমাচার বাহির করিবে; অথবা, (অন্তঃপুরস্থ রমণীদিগের কেশসংস্কারাদি) শিল্পকর্মের রচয়িত্রীরা কিংবা গানকারিণীর বা অন্যপ্রকার দাসীজনের সমাচার বাহির করিবে; অথবা (ভিতরের অন্যান্য গূঢ়পুরুষেরা গানরচনা, শ্লোকরচনা, (সাংকেতিক) বাদ্যবাদন ও ভাওদ্রব্যের সহিত লুকায়িত লেখ বা অন্তপ্রকারের সংকেত প্রকাশদ্বারা সমাচার বাহির করিবে। অথবা (গূঢ়পুরুষেরা) দীর্ঘকালের রোগ বা উন্মাদের ছলনা করিয়া, কিংবা (ভিতরে) অগ্নি লাগাইয়া ও বিষদান করিয়া (সংক্রম উপস্থিত হইলে) দঢ়ভাবে সেইস্থানের সব সমাচার লইয়া বাহিরে নির্গত হইয়া আসিবে।

তিনজন গূঢ়পুরুষ (কোন সমাচার সম্বন্ধে) সমান কথা বলিলে তাহা বিশ্বাসযোগ্য বলিয়া গৃহীত হইবে। বার বারই যদি তাহারা পরস্পরবিরোধী সমাচার আনয়ন করে, তাহা হইলে তাহাদিগকে গোপনে দণ্ড দিতে হইবে, অথবা কাৰ্য্য হইতে বিতাড়িত করা হইবে।

(উক্ত গূঢ়পুরুষগণ ছাড়াও) কণ্টকশোধন-নামক অধিকরণে উক্ত অপসর্প বা গূঢ়পুরুষগণকে এইভাবে নিযুক্ত করিতে হইবে, যেন তাহারা শত্রুদিগের রাজ্যেও তাহাদের নিকট হইতে বেতন পাওয়ার ব্যবস্থা করিয়া সেখানেই (তাহাদিগের সেবার্থ) বাস করিবে। তাহা হইলেই তাহারা সেখান হইতে অনায়াসে গুপ্ত সমাচার বাহির করিয়া পাঠাইতে পারিবে। এইরূপ গূঢ়পুরুষদিগকে উভয়বেতন বলা হয় (যেহেতু, তাহারা বিজিগীষু ও তাঁহার শক্র—এই উভয়ের নিকট হইতে বেতনগ্রাহী হয়)।

(রাজা) উভয়বেতন গূঢ়পুরুষদিগকে নিযুক্ত করার সময়ে তাহাদিগের স্ত্রী ও পুত্রদিগকে নিজ অধীনে রাখিবেন এবং শক্রদ্বারা প্রেরিত উভয়বেতন চরদিগকেও উত্তমরূপে জানিয়া রাখিবেন এবং তাহাদের শুদ্ধিসম্বন্ধে জ্ঞাতব্য বিষয় তৎপ্রকার চরদ্বারাই (অর্থাৎ উভয়বেতন চরদ্বারাই) জানিবেন ॥১

এইভাবে (রাজা) শক্র, মিত্র, মধ্যম ও উদাসীন রাজাদিগের উপর ও তাহাদিগের (মন্ত্রি-সেনাপতি প্রভৃতি) অষ্টাদশ তীর্থ বা মহামাত্রদিগের উপর গুপ্তচর নিযুক্ত করিবেন ॥২

(সেই শক্র প্রভৃতির) গৃহমধ্যে গুপ্তচরের কার্য্য সম্পাদন করিবার জন্য (তিনি) কুজ, বামন ও নপুংসক, শিল্পজ্ঞ স্ত্রীলোক, বোবা ও অন্ত নানাবিধ ম্লেচ্ছজাতীয় পুরুষদিগকে নিযুক্ত করিবেন ॥৩

 (তিনি তাহাদিগের দুর্গসমূহে চারসংগ্রহের জন্য) বণিক্‌ (বা বৈদেহকব্যঞ্জন) পুরুষদিগকে, দুৰ্গসীমায় সিদ্ধ তাপসদিগকে (বা তাপসব্যঞ্জনদিগকে), রাষ্ট্রে বা জনপদে কর্ষক (বা গৃহপতিব্যঞ্জন) ও উদাস্থিতদিগকে এবং তাহাদিগের জনপদসীমাতে ব্ৰজবাসীদিগকে (গোপালকদিগকে) সংস্থ-নামক গূঢ়পুরুষরূপে নিযুক্ত করিবেন ॥৪

(তিনি) শত্রুদিগের কার্য্যকলাপ জানিবার জন্য তাহাদিগের বনে, ক্ষিপ্রকারী বনচর, (বৌদ্ধজৈনাদি সম্প্রদায়ভুক্ত) শ্রমণ ও আটবিক প্রভৃতিকে চারশ্রেণীরূপে নিযুক্ত করিবেন ॥৫

এই প্রকারে (তিনি) শত্রুর নিযুক্ত তাদৃশ অগূঢ় বা অচ্ছন্ন বেষাদিধারী সঞ্চারী ও সংস্থ-নামক গূঢ়পুরুষদিগকে তজ্জাতীয় অন্য গূঢ়পুরুষদ্বারা জানিয়া লইবেন ॥৬

যে রাষ্ট্রমুখ্যের অরুত্য (অর্থাৎ লাভবশতঃ শত্রুর পক্ষে যোগদানে বিমুখ), তাঁহাদিগকে (রাজ), (শত্ররাজ্যের) ক্লত্যদিগকে (অর্থাৎ উপজাপ প্রভৃতিদ্বারা যাহাদিগকে তাঁহার সবশে আনিবার সম্ভাবনা আছে তাহাদিগকে) স্বপক্ষে আনিবার উপায় বুঝাইয়া দিয়া, শত্রুর অপসৰ্প বা গুপ্তচরদিগের প্রবৃত্তি বা বৃত্তান্ত অবগত হওয়ার জন্য রাষ্ট্রসীমাতে (বাস) করাইবেন ॥৭

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে বিনয়াধিকারিক নামক প্রথম অধিকরণে গূঢ়পুরুষ-প্রণিধি-নামক দ্বাদশ অধ্যায় সমাপ্ত।

.

ত্রয়োদশ অধ্যায়
৯ম প্রকরণ—স্বরাজ্যে কৃত্যপক্ষ ও অকৃত্যপক্ষের রক্ষণ

(রাজার নিজের রাজ্যস্থিত যে সমস্ত অতুষ্ট প্রজা শক্রর উপজাপবশতঃ ভেদ্য হইতে পারে তাহারা কৃত্য, এবং যে সমস্ত তুষ্ট প্রজারা সেরূপ হইতে পারে না তাহারা অকৃত্য—এই দুই প্রকার প্রজাকে কি ভাবে রক্ষা করা যায়—তাহাই এই প্রকরণে নির্ণীত হইয়াছে।) (মন্ত্রি-প্রভৃতি) মহামাত্যদিগের উপর অপসর্পণ বা গুপ্তচরের কাৰ্য্যের ব্যবস্থা করিয়া (রাজা) পুরবাসী ও জনপদবাসীদিগের উপরও অপসর্পণের ব্যবস্থা করিবেন (অর্থাৎ তাহার প্রতি প্রজাদিগের অনুরাগ ও অপরাগের বিষয় গোপনে জানিবার জন্য গূঢ়পুরুষদিগকে নিযুক্ত করিবেন)।

সত্রি-নামক গূঢ়পুরুষেরা পরস্পরের মধ্যে কলহ উপস্থাপিত করিয়া তীর্থস্থান, সভাগৃহ, (খাদ্য পানীয়াদির) গৃহ (অর্থাৎ দোকান), পূর্গ (বা দলবদ্ধ কৰ্ম্মকরসমূহ) ও অন্যান্য জনসঙ্ঘে নিম্নলিখিতভাবে বিবাদ উত্থাপন করিবে, যথা— “(কেবল) শুনাই গিয়াছে যে, এই রাজা সৰ্ব্বপ্রকার-গুণসম্পন্ন। কিন্তু তাহার কোন গুণই লক্ষ্য করা যায় না। বরং তিনি পৌর ও জনপদদিগকে দণ্ড দিয়া ও তাহাদের উপর কর বসাইয় পীড়িত করেন।”

উক্ত তীর্থাদি স্থানে যাহারা (উপরি উক্ত রাজনিন্দর) অনুমোদন করিবে, তাহাদিগকে ও প্রথম নিন্দককে অন্য একজন সত্ৰী নিম্নোক্ত ভাবে বারণ করিবে। সে তাহাদিগকে এইরূপ বলিবে—“মাৎস্তষ্ঠায়ে অভিভূত হইয়া (অর্থাৎ বৃহৎ বৃহৎ মৎস্য যেমন ক্ষুদ্র মৎস্যগুলিকে গিলিয়া খায়, তেমন অরাজকতার অবস্থায় সবলের দুৰ্ব্বলকে সংপীড়িত করে—এই অবস্থায় পতিত হইয়া) প্রজার বৈবস্বত মন্তকে নিজেদের রাজা নিৰ্ব্বাচিত করিয়াছিল। এবং তাহারা এইরূপ নিয়ম করিল যে, রাজা তাহাদের নিকট হইতে ধান্যের ষষ্ঠাংশ ও পণ্যের (বিক্রয়দ্রব্যের) দশমাংশ ও হিরণ্য (নগদ টাকা) ভাগধেয় বা কররূপে পাইবেন। এই ভাগধেয় ভূতিরূপে পাইয়া রাজারা প্রজাদিগের যোগ ও ক্ষেমের ভার বহন করেন। তাহাদের উপর প্রযোজ্য দণ্ড ও কর তাহাদিগের পাপ নষ্ট করে এবং তাহাদিগের যোগ ও ক্ষেমের সাধক হয়। এই কারণে (অর্থাৎ রক্ষা-কার্য্যেরভূতিরূপে ভাগধেয় এবং দণ্ড ও কর রাজার প্রাপ্য বলিয়া), আরণ্যক ঋষিরাও তাহাদিগের উন্থ (বা কণায় কণায় সংগৃহীত ধান্যাদি) হইতেও ষাংশ রাজাকে প্রদান করেন, (এবং তাহারা ভাবেন যে,) ইহা সেই রাজার জন্য ভাগধেয় বা কর, যিনি আমাদিগকে রক্ষা করেন। রাজারা ইন্দ্র ও যমস্থানীয়, কারণ, তাহারা প্রত্যক্ষেই (প্রজাদিগের) অনুগ্রহ ও নিগ্ৰহ করিয়া থাকেন। এই রাজাদিগকে যে অবমাননা করে, তাহাকে দৈব দণ্ডও স্পর্শ করিয়া থাকে। অতএব, রাজাদিগকে কখনই অবমানিত করা উচিত নহে। এই প্রকার যুক্তিদ্বারা (সেই সত্ৰী রাজনিন্দক) নীচ লোকদিগকে বারণ করিবে”।

(সত্ৰী গূঢ়পুরুষেরা) সব কিংবদন্তী বা জনশ্রুতি জানিবে। (প্রজাদিগের মধ্যে) যাহারা জীবিকা-নিৰ্ব্বাহের জন্য রাজার দত্ত ধান্ত, পশু ও হিরণ্যের উপর নির্ভর করে, অথবা, যাহারা এই সমস্ত দ্রব্য রাজাকে তাহার বিপদ ও সম্পদের সময়ে প্রদান করিয়া তাহার উপকার করে, অথবা যাহার রাজার প্রতি কুপিত তদীয় বান্ধব বা জনপদকে সেই কোপ হইতে নিবৰ্ত্তিত করে, অথবা যাহারা রাজার অমিত্র ও আটবিককে (অটবীপালকে) শত্রুভাব হইতে নিবারিত করে, তাহাদের তুষ্টভাব ও অতুষ্টভাব মুণ্ড ও জটিলের বেষধারী গুপ্তচরেরা জানিবে।

যাহার রাজার প্রতি তুষ্টভাবাপন্ন তাহাদিগকে (রাজা) অত্যধিকভাবে সৎকার প্রদর্শন করিবেন। আর, যাহারা তাহার প্রতি অতুষ্ট বা অপ্রসন্ন তাহাদের তুষ্টির জন্য (তিনি) তাহাদিগকে অর্থদান ও সাম বা সাম্ববাদদ্বারা প্রসাদিত বা সন্তুষ্ট করিবেন। অথবা, (তিনি) তাহাদিগকে (অর্থাৎ অতুষ্টজনদিগকে) পরস্পর হইতে (ভেদনীতির প্রয়োগ দ্বারা) ভিন্ন করাইবেন এবং তাহারা যাহাতে সামন্ত, আটবিক, রাজকুলসস্তৃত ব্যক্তি ও অবরুদ্ধ রাজপুত্রাদির উপর উপজাপ (ভেদ) চালাইতে না পারে, তজ্জন্য তাহাদিগকে সেই সামন্তাদি হইতেও ভিন্ন করাইবেন। ইহাতেও যদি তাহারা অতুষ্টই থাকিয়া যায়, তাহা হইলে (রাজা) তাহাদিগকে দণ্ড ও কর সাধনবিষয়ক অধিকারে নিযুক্ত করিয়া, তাহাদিগের উপর জনপদের বিদ্বেষ উৎপাদন করাইবেন। এইভাবে তাহারা জনপদের বিদ্বেষ-ভাজন হইয়া উঠিলে, (তিনি) তাহাদিগকে গুপ্তহত্যা দ্বারা বা জনপদের (অর্থাৎ জানপদজনের) কোপোৎপাদনস্বারা দমিত করিবেন। পাছে বা (এই অতুষ্টজনেরা) শক্রর পক্ষভূত আশ্রয়স্থল হইয়া পড়ে—এই ভয়ে, তাহাদিগের স্ত্রী-পুত্রের রক্ষাভার নিজের উপর লইয়া, (রাজা) তাহাদিগকে আকরের কৰ্ম্মান্ত সমূহে (কারখানাগুলিতে) নিযুক্ত করিয়া তথায় বাস করাইবেন। প্রজাবর্গের মধ্যে যাহারা ক্রুদ্ধ-স্বভাব, লোভী, ভীত ও অবমানিত তাহারাই শত্রুর কৃত্য বা ভেদ্য হইতে পারে (অর্থাৎ তাহারাই শত্রুর উপজাপে পড়িয়া তাহার বশগামী হইতে পারে)।

কীৰ্ত্তান্তিক (দৈবজ্ঞ), নৈমিত্তিক (শুভাশুভ শকুনজ্ঞতা), ও মোহূৰ্ত্তিকের (ত্রিকালজ্ঞ জ্যোতিষিকের) বেষধারী গূঢ়পুরুষেরা উক্ত ক্রুদ্ধাদি অতুষ্ট-জনদিগের পরম্পরের মধ্যে স্থাপিত সম্বন্ধ ও শক্রর সহিত আবদ্ধ সম্বন্ধ বিষয়ের সব তথ্য জানিবে।

তুষ্টদিগকে (রাজা) অর্থদান ও সম্মানপ্রদর্শন দ্বারা সৎকৃত করিবেন। এবং (তিনি) অতুষ্টদিগকে (অবস্থা-ভেদে) সাম, দান, ভেদ ও দও এই উপায়চতুষ্টয় দ্বারা বশে রাখিবেন।

ও অকৃত্য (তুষ্ট অর্থাৎ শক্রর অভেদ্য) প্রধান (মুখ্য) ও ক্ষুদ্রক (অমুখ্য) পুরুষদিগকে শক্র-প্রযোজ্য উপজাপ (বা ভেদ) হইতে রক্ষা করিবেন ॥১

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে বিনয়াধিকারিক-নামক প্রথম অধিকরণে স্বরাজ্যে

কৃত্যপক্ষ ও অকৃত্যপক্ষের রক্ষণ-নামক ত্রয়োদশ অধ্যায় সমাপ্ত।

.

চতুর্দশ অধ্যায়
১০ম প্রকরণ—শত্রুরাজ্যে কৃত্যপক্ষ ও অকৃত্যপক্ষের সংগ্ৰহ

(রাজার) স্বরাজ্যে কৃত্য (অতুষ্ট) ও অরুত্য (তুষ্ট) পক্ষের পুরুষদিগের সংগ্রহ (পূর্ব্ব অধ্যায়ে) ব্যাখ্যাত হইয়াছে। সম্প্রতি (তাহার) শত্রুর রাজ্যে কৃত্য ও অকৃত্যপক্ষের লোকদিগের সংগ্রহ (বা স্বায়তীকরণের বিষয়) নিরূপিত হইবে।

(পূর্ব্ব অধ্যায়ে ক্রুদ্ধাদি কৃত্যচতুষ্টয়ের বিষয় বলা হইয়াছে,) তন্মধ্যে কাহারা কাহারা ক্রুদ্ধবর্গে অন্তভূক্ত হইতে পারে তাহা এখন বলা হইতেছে — (১) (রাজা) যাহাকে অর্থদানের প্রতিশ্রুতি দিয়াও তাহা না দিয়া বঞ্চিত করিয়াছেন, সে ব্যক্তি; (২) কোন শিল্পবিষয়ে বা উপকারজনক কার্য্যে সমানভাবে দুইজন কাৰ্য্যকারীর মধ্যে যে অন্ততর ব্যক্তিকে অবমানিত করা হইয়াছে, সে ব্যক্তি; (৩) যাহাকে রাজার প্রিয়জনের রাজকুলে প্রবেশ* বিষয়ে অবরুদ্ধ বা প্রতিষিদ্ধ করিয়াছেন, সে ব্যক্তি; (৪) যাহাকে ডাকিয়া আনিয়া পরাজিত বা তিরস্কৃত করা হইয়াছে (মতান্তরে, যাহাকে সমাহ্বয়ে অর্থাৎ দূতক্রীড়াদিতে ডাকাইয়া হতধন করা হইয়াছে), সে ব্যক্তি; (৫) (রাজাদেশে) সুদীর্ঘকালস্থায়ী প্রবাসজনিত দুঃখে যে উপতাপযুক্ত হইয়াছে, সে ব্যক্তি; (৬) যে (উৎকোচাদি দিয়া) অনেক ব্যয় করিয়াও নিজ কাৰ্য্য উদ্ধার করিতে পারে নাই, সে ব্যক্তি; (৭) যাহাকে নিজ ধৰ্ম্ম বা আচারানুসারে কাৰ্য্য করিতে বা নিজের দায়ভাগ পাইতে মানা করা হইয়াছে, সে ব্যক্তি; (৮) যাহাকে সম্মানের পদ ও অধিকার বা নিয়োগপদ হইতে ভ্ৰষ্ট করা হইয়াছে, সে ব্যক্তি; (৯) যাহাকে (রাজার) স্বকুলসভূত লোকেরা (গুণের অপলাপ দ্বারা) অপ্রকাশিত রাখিয়াছে (অর্থাৎ যাহার খ্যাতি চাপিয়া রাখিয়াছে), সে ব্যক্তি; (১০) যাহার স্ত্রীকে বলাৎকার-সহকারে ধর্ষণ করা হইয়াছে, সে ব্যক্তি; (১১) যাহাকে কারারুদ্ধ করা হইয়াছে, সে ব্যক্তি; (১২) (বিনা বিচারে) যাহাকে পরের কথা শুনিয়াই দণ্ডিত করা হইয়াছে, সে ব্যক্তি; (১৩) মিথ্যা যুক্তিস্বারা যাহাকে সৎকর্মচারণে নিবারিত করা হইয়াছে, সে ব্যক্তি; (১৪) যাহার সর্বস্ব অপহরণ করা হইয়াছে, সে ব্যক্তি; (১৫) যাহার কার্য্য বাধিয়া দিয়া অর্থাৎ যাহাকে কাৰ্য্য-বিষয়ে অযথা নিয়ন্ত্রিত করিয়া ক্লেশ দেওয়া হইয়াছে, সে ব্যক্তি; এবং (১৬) যাহার (পুত্রাদি) বান্ধবজনকে স্বদেশ হইতে নিষ্কাসিত করা হইয়াছে, সে ব্যক্তি। উক্ত ব্যক্তিরাই ক্রুদ্ধবর্গে অন্তভূক্ত হইতে পারে (এবং তাহারাই শক্রদ্বারা সহজে ক্লত্য হইতে পারে)।

সম্প্রতি যাহারা ভীতবর্গে অন্তভূক্ত হইতে পারে, তাহাদের কথা বলা হইতেছে —(১) যে ব্যক্তি (নৃশংস কৰ্ম্মাদি করিয়া) নিজেকে দূষিত করিয়াছে; (২) যে ব্যক্তিকে (কোন বিষয়ে) অপমানাদি দ্বারা অত্যাচারিত করা হইয়াছে; (৩) যে ব্যক্তির পাপকৰ্ম্ম (নিন্দার্থ) প্রকাশ করিয়া দেওয়া হইয়াছে; (৪) যে ব্যক্তি সমান দোষকারীর উপর দণ্ড পতিত হইতে দেথিয়া উদ্বিগ্ন হইয়াছে; (৫) যে ব্যক্তি অন্যের ভূমি জোর করিয়৷ নিজ অধিকারভুক্ত করিয়াছে; (৬) যে ব্যক্তিকে দণ্ডদ্বারা উপহত বা কশিত করা হইয়াছে, (৭) যে ব্যক্তি সৰ্ব্বপ্রকার অধিকরণের (রাজকাৰ্য্য বিভাগের) অধিকারে অবস্থিত; (৮) যে ব্যক্তি সহসা অনেক অর্থ সঞ্চয় করিতে পারিয়াছে; (৯) যে বৃক্তি রাজকুলের ন্ধোকদিগকে (নিজ স্বার্থের জন্য) আশ্রয় করিয়াছে; (১০) যে ব্যক্তিকে রাজা দ্বেষ করিয়া থাকেন (অর্থাৎ রাজা যাহার প্রতি অন্তগ্রহ-দৃষ্টি রাখেন না); এবং (১১) যে ব্যক্তি রাজাকে দ্বেষ করিয়া থাকে। এই প্রকার ব্যক্তিরাই ভৗতবর্গে অন্তর্ভুক্তিহইতে পারে (এবং তাহারাই শক্রদ্বারা সহজে কৃত্য বা ভেদ্য হইতে পারে)।

সম্প্রতি লুব্ধবর্গে অন্তভূক্ত লোকদিগের কথা বলা হইতেছে —(১) ষে ব্যক্তির সমস্ত অর্থাদি বৈভব ক্ষয়প্রাপ্ত হইয়া গিয়াছে; (২) যাহার ধনসম্পত্তি অত্যধিকভাবে (রাজকর্তৃক দণ্ডকররূপে) গৃহীত হইয়াছে; (৩) যে ব্যক্তি কদৰ্য্য বা কূপণ; (৪) যে ব্যক্তি (স্ত্রীপানাদিরূপ) ব্যসনে আসক্ত; এবং (৫) যে ব্যক্তি জীবনের অনপেক্ষী কৰ্ম্মস্বারা (ধনাদিনিমিত্ত ব্যবহার বা কারবারাদি ক্রিয়াতে তৎপর)। এই প্রকার ব্যক্তিরাই লুন্ধবর্গে অন্তভূক্ত হইতে পারে (এবং তাহারাই শক্রদ্বারা কৃত্য বা ভেদ্য হইতে পারে)।

এখন মানিবর্গে অন্তভূক্ত লোকদিগের কথা বলা হইতেছে —(১) যে ব্যক্তি নিজেকে অত্যন্ত (বিদ্বান বা শূরাদিরূপে) বড় বলিয়া মনে করে; (২) যে ব্যক্তি নিজের প্রতি অন্যের সম্মান কামনা করে; (৩) যে ব্যক্তি নিজ শত্রুর প্রতি অন্যের প্রদর্শিত পূজা সহিতে পারে না; (৪) যে ব্যক্তি নীচজনদ্বারা প্রোৎসাহিত হইয়া কোন কাৰ্য্যে অভিনিবেশিত হইয়াছে; (৫) যে ব্যক্তি স্বয়ং তীক্ষ্ণ অর্থাৎ নিজের জীবনকেও গণনা করে না; (৬) যে ব্যক্তি সাহসিক অর্থাৎ সহসা কোন কার্য্যে বা কোন সাহসের কার্য্যে প্রবৃত্তিশীল; এবং (৭) যে ব্যক্তি ভোগ্যবস্তুর প্রাপ্তিতে অসন্তুষ্ট (‘ভাগেন’—পাঠ ধৃত হইলে, নিজের প্রাপ্য ভাগ পাইয়াও অসন্তুষ্ট, এইরূপ ব্যাখ্যা)। এই প্রকার ব্যক্তিরাই মানিবর্গে ভূক্ত হইতে পারে (এবং তাহারাহ শত্রুর দ্বারা ক্লত্য বা ভেদ্য হইতে পারে)। এই চারিবর্গের লোকদিগের মধ্যে, কুত্যপক্ষীয় যে ব্যক্তি যাহা পাইতে অভিলাষী তাহাকে সেই দ্রব্যাদির দানসহকারে রাজা মুণ্ড ও জটিলধারী গঢ়পুরুষগণ দ্বারা উপজাপিত করিবেন (অর্থাৎ শত্রু হইতে তাহাদিগকে ভিন্ন করিয়া স্ববশে আনিতে চেষ্টা করিবেন)।

(ক্রুদ্ধবর্গের উপর উপজাপের প্রকার বলা হইতেছে —) পূৰ্ব্বোক্ত গঢ়পুরুষেরা তাহাদিগকে বলিবে —“প্ৰমাদী হস্তিপকদ্বারা চালিত মদ-জনিত বিকার বশতঃ প্রমত্ত হস্তী যেমন সম্মুখে যাহা পায় তাহা সবই নষ্ট করে, তেমন এই অন্ধ রাজা রাজনীতিশাস্ত্ররূপ চক্ষু হারাইয়া, (শাস্ত্রজ্ঞানবিহীন) অন্ধ মন্ত্রী-দ্বারা পরিচালিত হইয়া, পুরবাসী ও জনপদবাসীদিগের নাশের জন্যই উদ্যত হইয়াছেন। তাঁহার প্রত্যৰ্থী শত্রুরাজদিগকে তাঁহার বিরুদ্ধে প্রোৎসাহিত করিয়া তাঁহার অপকার করা যাইতে পারে, অতএব, আপনারা তাহার প্রতি প্রকোপ উৎপাদন করুন।” এইরূপ বলিয়া, তাহারা (গূঢ়পুরুষেরা) ক্রুদ্ধবর্গকে উপজাপিত করিবে।

(ভীতবর্গের উপর উপজাপের প্রকার বলা হইতেছে :—) পূৰ্ব্বোক্ত গূঢ়পুরুষেরা তাহাদিগকে বলিবে—“সৰ্প যেমন ভীত হইলে যাহার নিকট হইতে ভয়ের আশঙ্কা লক্ষ করে, তাহার উপরই (নিজের) বিষ উদগীরণ করে, তেমন এই রাজা আপনাদের দিক হইতে দোষের আশঙ্কা করিয়া আপনাদের উপরই ক্ৰোধরপ বিষের উৎসর্গ করিবেন। (অতএব), আপনারা (তাঁহার রাজ্য ছাড়িয়া) অন্য কোন স্থানে চলিয়া যাউন।” এইরূপ বলিয়া তাহারা (গূঢ়পুরুষেরা) ভীতবর্গকে উপজাপিত করিবে।

(লুব্ধবর্গের উপর উপজাপের প্রভাব বলা হইতেছে —) পূৰ্ব্বোক্ত গূঢ়পুরুষেরা তাহাদিগকে বলিবে—“চণ্ডালদিগের ধেনু যেমন কুকুরদিগকেই দুগ্ধ দেয়, ব্রাহ্মণদিগকে নহে, তেমন এই রাজা, যাহারা সত্ত্ব, প্রজ্ঞা ও বাক্যশক্তিহীন সেই সব পুরুষদিগকেই ধনাদি ফল দান করেন, কিন্তু, যাহারা আত্মগুণসম্পদে সমৃদ্ধ তাহাদিগকে তাহা দেন না। কিন্তু অমুক রাজা পুরুষবিশেষদিগকে (অর্থাৎ উপযুক্ত বিশিষ্ট পুরুষদিগকে) বেশ চিনিয়া লইতে পারেন। (অতএব,) আপনারা তাহার সেবায় প্রবৃত্ত হউন।” এইরূপ বলিয়া তাহারা (গূঢ়পুরুষেরা) লুব্ধবর্গকে উপজাপিত করিবে।

(মানিবর্গের উপর উপজাপের প্রকার বলা হইতেছে —) পূৰ্ব্বোক্ত গূঢ়পুরুষেরা তাহাদিগকে বলিবে—“চণ্ডালদিগের কূপ যেমন চণ্ডাল দিগেরই উপভোগের যোগ্য হইয়া থাকে, অন্য লোকের জন্য নহে, তেমন এই নীচ রাজা নীচজনদিগেরই উপযোগের বা মুখসাধনের যোগ্য, আপনাদের ন্যায় আর্য্যদিগের স্বখসাধনের জন্য নহে। অমুক রাজা পুরুষবিশেষের তারতম্য বেশ বুঝেন। (অতএব) আপনারা তৎসমীপে চলিয়া যাউন।” এইরূপ বলিয়া—তাহারা (গূঢ়পুরুষেরা) মানিবৰ্গকে উপজাপিত করিবে (অর্থাৎ তাহাদের রাজা হইতে ভিন্ন করিবার চেষ্টা করিবে)।

যাহারা এই প্রকার উপজাপের ফলে নিজ স্বামী বা রাজা হইতে ভিন্ন হইবার জস্য স্বীকার করিবে, তাহাদিগুকে (সত্যশপথাদি) পণকৰ্ম্মম্বারা সন্ধিতে আবদ্ধ করিয়া (রাজা) তাহাদিগকে তাহাদের শক্তি পর্যালোচনাপূর্ব্বক নিজ নিজ কার্ঘ্যে নিযুক্ত করিবেন, কিন্তু তাহাদিগের উপর দৃষ্টি রাখার জন্য অপসৰ্প বা গূঢ়পুরুষও নিয়োজিত করিবেন ॥১

শত্রুর ভূমিতে যাহারা কৃত্য (অর্থাৎ ভেদযোগ্য,) তাহাদিগকে সাম ও দান এই দুই উপায় দ্বারা (রাজা) লাভ করিবেন, এবং যাহারা অকৃত্য (অর্থাৎ ভেদসাধ্য নহে) তাহাদিগকে ভেদ ও দণ্ড এই উভয় উপায় দ্বারা লাভ করিবেন এবং (তাহাদিগের নিকট) শত্রুরাজার দোষগুলি দেখাইয়া দিবেন ॥২

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে বিনয়াধিকারিক-নামক প্রথম অধিকরণে শত্রুরাজ্যে কৃত্য ও অকৃতপক্ষের সংগ্রহ নামক চতুর্দশ অধ্যায় সমাপ্ত।

.

পঞ্চদশ অধ্যায়
১১শ প্রকরণ—মন্ত্রাধিকার

স্বদেশে ও পরদেশে কৃত্য ও অকৃত্য পুরুষদিগকে স্ববশে সংগ্রহ করার পর, (বিজিগীষু রাজা) রাজ্যশাসনসম্বন্ধীয় সৰ্ব্বপ্রকার কাৰ্য্যের আরম্ভ (মন্ত্রণাদ্বারা) বিবেচনা করিবেন। কারণ, সৰ্ব্ব কার্য্যের আরম্ভই মন্ত্রপূর্ব্বক করিতে হয় (অর্থাৎ করণীয় কৰ্ম্মবিষয়ে পূর্বে মন্ত্রণা করিয়া, পরে তাহা আরম্ভ করিতে হয়)।

মন্ত্রণার স্থান চারিদিকে আবৃত থাকিবে ও সেখান হইতে কোন কথাবাতাঁর শব্দও বাহিরে নিঃশ্রুত বা নিস্ক্রান্ত হইতে পারিবে না, এবং সেই স্থান পক্ষীদিগেরও দৃষ্টিগোচর হইবে না। কারণ, এমনও শুনা যায় যে, শুক ও শারিকারা (রাজার) মন্ত্রণা ভিন্ন বা প্রকাশিত করিয়া দিয়াছে, এবং কুকুর ও অন্যান্য নীচ জন্তুরাও তদ্রুপ করিয়াছে। অতএব, (মন্ত্রণাকার্য্যে) নিযুক্ত না হইয়া, কেহই মন্ত্রণাস্থানে যাইতে পারিবে না। যে ব্যক্তি মন্ত্রণার ভেদ বা প্রকাশ করিবে, তাহার উচ্ছেদ করিতে হইবে।

কারণ, দূত, অমাত্য ও স্বয়ং স্বামীর (রাজার) ইঙ্গিত ও আকার হইতেও মন্ত্রভেদ সম্ভবপর হয়।

মানুষের স্বাভাবিক কাৰ্য্যকরণের চেষ্টা হইতে ভিন্নপ্রকার চেষ্টার নাম ইজিভ। মানসিক ভাবাদি জানিবার সাধনভূত অঙ্গসংস্থান বা আকৃতিকে আকার বলা হয়।

যতক্ষণ মন্ত্রিত কাৰ্য্য সম্পাদনের কাল উপস্থিত না হইবে, ততক্ষণ পৰ্য্যন্ত ইঞ্জিত ও আকার গোপন করিয়া রাখিতে হইবে; এবং মন্ত্রণাকার্ষ্যে ব্যাপৃত (অমাত্যাদি) পুরুষদিগকেও মন্ত্রণাভেদের সম্ভাবনা হইতে রক্ষা করিতে হইবে। কারণ, তাহাদিগের প্রমাদ (অনবধানতা,) মদ বা মদ্যপানাদিজনিত চিত্তবিকার, নিদ্রিত অবস্থায় প্রলাপ ও কাম (বিষয়াভিলাষ) প্রভৃতি, এবং তাহাদের গৰ্ব্ব নিণাত মন্ত্রপ্রকাশে সহায়তা করে। (গৃহভিত্তিমধ্যে) প্রচ্ছন্ন থাকিয়া শ্রোতা, ও (মূর্ধাদি বলিয়া) অবজ্ঞাত লোকও গুপ্ত মন্ত্র প্রকাশ করিয়া দিতে পারে। (অতএব,) রাজা (প্রমাদাদি হইতে) মন্ত্র রক্ষা করিবেন।

যেহেতু, মন্ত্রভেদ (অর্থাৎ মন্ত্রের আদেশকালেই প্রকাশ) রাজার ও তাঁহার আযুক্ত পুরুষদিগের (অর্থাৎ মন্ত্ৰাধিকারাদিতে নিযুক্ত রাজপাদোপরিগণের) যোগ ও ক্ষেমের নাশ করিয়া থাকে। অতএব, আচাৰ্য্য ভারদ্বাজের (দ্রোণচার্য্যের) মতে, রাজার পক্ষে একাকীই মন্ত্রবিচার করা উচিত (অর্থাৎ রাজা মন্ত্রীকেও তাহা জানিতে দিবেন না)। কারণ, মন্ত্রীদিগেরও নিজ নিজ মন্ত্রী থাকে (অর্থাৎ নিজ মন্ত্রণাসহায়কদিগের সহিত মন্ত্রীরাও মন্ত্রণার আলাপ করিতে পারেন)। আবার, সেই মন্ত্রীদিগেরও অন্য মন্ত্রী থাকে। (কাজেই,) এই মন্ত্রিপরম্পরার (মন্ত্রণার) ফলে, তাঁহারা মন্ত্র প্রকাশিত করিয়া ফেলেন।

অতএব, বিজিগীষু রাজার চিকীর্ষিত কোন কৰ্ম্মই অন্যেরা যেন না জানিতে পারে। কেবল যাহারা সেই কৰ্ম্ম সম্পাদন করিবে, তাহারাই সেই কৰ্ম্ম আরদ্ধ হইলে জানিবে, অথবা সেই কৰ্ম্ম সমাপ্ত হইলে জানিবে ॥১

কিন্তু, আচাৰ্য্য বিশালাক্ষ এইরূপ মনে করেন যে, একাকী কাহারও মন্ত্রবিচারদ্বারা মন্ত্রের সিদ্ধি ঘটে না (অর্থাৎ রাজা একাকী মন্ত্র বিচার করিবেন না)। কারণ, রাজকাৰ্য্য প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ ও অনুমান প্রমাণের উপরই নির্ভর করে (অর্থাৎ রাজকাৰ্য্য সহায়সাধ্য)। যে সব (মন্ত্রাদি) বিষয়ের সম্যক উপলব্ধি হয় নাই তাহার জ্ঞান, জ্ঞাত বিষয়ের নিশ্চয়বলদ্বারা দৃঢ়ীকরণ, কোন বিষয়ে দ্বৈধীভাব উপস্থিত হইলে সেই সংশয়ের ছেদন, এবং কোন বিষয়ের একাংশের উপলব্ধি হইতে অবশিষ্টাংশের অল্পমান—এই সব কাৰ্য্য মন্ত্রিগণের দ্বারা সাধ্য।

অতএব, (রাজা) জ্ঞানবৃদ্ধগণের সহিত মন্ত্ৰণ করিতে বসিবেন। তিনি কাহাকেও অবজ্ঞা করিবেন না এবং সকলেরই মত শ্রবণ করিবেন। বালকের বাক্যও যদি যুক্তিমৎ হয়, তাহা হইলে পণ্ডিতজন তাহাও স্বীকার করেন ॥২

পরাশরের (অর্থাৎ আচাৰ্য্য পরাশরের মতাবলম্বীরা) বলেন যে, (বিশালাক্ষোক্ত মতানুসারে) কেবল মন্ত্রের জ্ঞানই সম্ভাবিত হয়, কিন্তু, মন্ত্ররক্ষা ঘটে না। তাঁহার (রাজার) যে কাৰ্য্য অভিপ্রেত, সেই কার্য্যের তুল্য অন্য কোন কাৰ্য্যের কথা (উত্থাপন করিয়া) (তিনি) মন্ত্রীদিগকে জিজ্ঞাসা করিবেন— “এই কাৰ্য্য (পূৰ্ব্বে) এইরূপ ভাবে করা হইয়াছিল; (আচ্ছা) যদি ইহা (এখন) এইরূপভাবে দাড়ায়, তাহা হইলে কি ভাবে ইহা করা উচিত হইবে?” এইভাবে জিজ্ঞাসিত হইলে মন্ত্রীরা যেমন বলিবেন (রাজ।) তেমনই তাহা করিবেন। এইরূপ করা হইলে, মন্ত্রের জ্ঞানও হইল, মন্থের সংবরণ বা গোপনও হইল।

 (কিন্তু,) আচাৰ্য্য পিশুনের (নারদের) মতে এই উপদেশ গ্রাহ হইতে পারে না। কারণ, (তাহার মতে) প্রকারান্তরে উপস্থাপিত কোন সংঘটিত বা অসংঘটিত বিষয় জিজ্ঞাসিত হইলে, মন্ত্রীরা তৎসম্বন্ধে (নিজদিগকে রাজার অবিশ্বস্ত মনে ভাবিয়া) অনাদর-সহকারে আলাপ করিবেন; অথবা তাহা প্রকাশ করিয়া ফেলিবেন। ইহা দোষের কথা বটে; অতএব, যে-যে কাৰ্য্য যাহারা (অনুষ্ঠানপটু বলিয়া রাজার) অভিমত ব্যক্তি, তাহাদিগের সহিত (তিনি) মন্ত্রণা করিবেন। তাহাদের সহিত মন্ত্রণা করিলে রাজার পক্ষে মন্ত্রবুদ্ধি ও মন্ত্রগুপ্তি—এই উভয়ই লব্ধ হইতে পারে।

(কিন্তু,) কৌটিল্য এই মত যুক্তিযুক্ত মনে করেন না। কারণ, (তাহার মতে) উক্তরূপ মন্ত্রণকার্মোর ব্যবস্থ করা হইলে, অনবস্থা দোষ আপতিত হইবে (অর্থাৎ মন্ত্রণার বিষয়ীভূত কৰ্ম্মের বহুত্রবশতঃ অধিক সংখ্যক মন্ত্রীর প্রয়োজন হইবে—এবং তাঁহাদের প্রত্যেকের সঙ্গে মন্ত্রণার ব্যবস্থা কখনই সম্ভবপর নহে)। তিন বা চারিজন মন্ত্রীর সঙ্গেই রাজা মন্ত্রণা করিবেন। কারণ, একজন মন্ত্রীর সহিত মন্ত্রণা করিলে রাজা কষ্ট্রনিৰ্দ্ধাৰ্য্য বিষয় উপস্থিত হইলে (অর্থাৎ কাৰ্য্যসঙ্কট উপস্থিত হইলে), কাৰ্য্যনিশ্চয় করিতে পারিবেন না। মন্ত্রী একজন হইলে, তিনি প্রতিদ্রন্দ্বিরহিত হইয়া স্বেচ্ছায় কার্য চালাইতে পারেন। দুইজন মন্ত্রীর সহিত মন্ত্রণা করিলে, তাঁহারা উভয়ে একমত হইয়া রাজাকে আপন বশে আনিতে পারেন। এবং তাহারা পরম্পর বিপরীত মতাবলম্বী হইলে, রাজার (কাৰ্য্যহানি) ঘটাইতে পারেন। তিন বা চারিজন মন্ত্রী থাকিলে, সেরূপ কোন মহান দোষ নিয়তই উৎপন্ন হয় না, হইলেও তাহা অনেক কষ্টে ঘটে (অর্থাৎ হঠাৎ ঘটে না)। এবং (মন্ত্রণার বিষয়ীভূত কৰ্ম্মও) উপপত্তিযুক্ত হয় (অর্থাৎ অবাধে তাহা সম্পন্ন হয়)। এই সংখ্যার (অর্থাৎ চারিজনের) অধিক মন্ত্রী থাকিলে, অর্থ বা বিষয়ের নিশ্চয়নিরূপণ অতি ক্লেশে সম্পন্ন হইতে পারে, অথবা মন্ত্রও অতি ক্লেশে রক্ষিত হইতে পারে।

দেশ, কাল ও কার্য্যের বশে, (রাজা) এক বা দুইটি মন্ত্রীর সহিতও মন্ত্রণা করিতে পারেন, অথবা নিজের সামর্থ্যানুসারে একাকীও মন্ত্রবিচার করিতে পারেন।

মন্ত্র পঞ্চাঙ্গ-বিশিষ্ট, (অর্থাৎ মন্ত্রের অঙ্গ পাচটি) যথা—(১) কার্য্যের আরম্ভ করার উপায় (অর্থাৎ যথা—স্বরাজ্যে দুর্গাদি নিৰ্ম্মণবিষয়ে এবং পররাজ্যে সন্ধিবিগ্রহ ও দূতাদি প্রেরণবিষয়ে), (২) পুরুষ বা কাৰ্য্যকুশল লোকজন ও রত্ন সুবর্ণাদি দ্রব্যসম্পত্তি, (৩) (কার্য্যনিম্পাদনের উপযোগী) দেশ ও কালের বিভাগ বিচারণ, (৪) কাৰ্য্যমধ্যে বিস্নাদি উপস্থিত হইলে, তাহার প্রতীকার বা প্রশমনের চিন্তা, এবং (৫) কাৰ্য্যসিদ্ধিবিষয়ক বিবেচনা (অর্থাৎ কার্য্যের ফলে—ক্ষয়, স্থান বা বৃদ্ধির কোনটা ঘটিবে—তচ্চিস্তা)। (রাজা) মন্ত্রিগণের প্রত্যেককে পৃথক্ভাবেও মত জিজ্ঞাসা করিতে পারেন এবং তাহাদিগকে একত্র মিলিত করিয়াও সমস্ত মন্ত্রীদিগকেও জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। তাহাদিগের মতবিভিন্নতাও যুক্তিপূর্ব্বক বুঝিয়া লইবেন। অর্থ বা বিষয়ের নিশ্চয় বা মতনিৰ্দ্ধারণ পাইয়া, (তিনি) তাহা কাৰ্য্যে পরিণত করিতে সময় অতিক্রাস্ত হইতে দিবেন না। রাজার পক্ষে কোন বিষয়ে মন্ত্রণাও দীর্ঘকাল পর্য্যন্ত করা উচিত নহে। যাহাদের সম্বন্ধে (রাজাকে) কোনপ্রকার অপকার করিতে হইতে পারে, তাহাদের পক্ষভুক্ত লোকদিগের সহিতও (তিনি) কোনরূপ মন্ত্রণা করিবেন না।

(ইতিপূৰ্ব্বে কৌটিল্যের মতে চারিজনের অধিক মন্ত্রী নিযুক্ত করা রাজার উচিত নহে ইহা বলা হইয়াছে—তাঁহারা, কিন্তু রাজার ধী-সচিব বা মতি-সচিব। সম্প্রতি কৰ্ম্ম-সচিবগণের সংখ্যা বিচারিত হইতেছে এবং তাহাদের দ্বারা রচিত যে অমাত্যপরিষৎ, তাহাকেই সম্ভবতঃ মন্ত্রিপরিষৎ, এই পারিভাষিক, নাম দেওয়া হইয়াছে। সে যাহা হউক—) মানবদিগের অর্থাৎ মন্তশিষ্যদিগের মতে রাজা দ্বাদশ জন অমাত্য লইয়া মন্ত্রিপরিষৎ গঠিত করিবেন। বার্হস্পভ্যদিগের অর্থাৎ বৃহস্পতি-শিষ্যদিগের মতে এই পরিষদের অমাত্য সংখ্যা ষোল হইবে। ঔশনসদিগের অর্থাৎ শুক্রাচার্যের শিষ্যদিগের মতে এই সংখ্যা হইবে বিংশতি। (কিন্তু,) কৌটিল্যের মত এই যে, (কাৰ্য্যামৃষ্ঠানকারী আযুক্ত পুরুষদিগের) সমর্থ্য অনুসারে এই সংখ্যা নির্দ্দিষ্ট করা উচিত হইবে। অমাতাগণ (অর্থাৎ এই কৰ্ম্ম-সচিবগণ) রাজার স্বপক্ষগত ও পরপক্ষগত কার্য্যের অন্সষ্টানবিষয়ক চিন্তা করিবেন। (রাজা) যে কৰ্ম্ম আরব্ধ হয় নাই তাহার আরম্ভ, যাহা তারন্ধ হইয়াছে তাহার অনুষ্ঠান, যাহা অন্তষ্ঠিত হইয়াছে তাহারও বিশেষসম্পাদন এবং তৎ তৎ কর্মের অনুষ্ঠানে অধিকৃত পুরুষদিগের নিয়োগ সম্বন্ধে প্রকর্ষসাধন (অর্থাৎ তাহাদের গুণবত্তাদি-বিচার) করাইবেন। যে অমাত্যের (রাজার) সন্নিধানে আছেন তাহাদিগের সহিত মিলিত হইয়া (রাজা) কাৰ্য্য দেখিবেন, এবং যাঁহারা নিকটে নাই তাহাদিগের সহিত পত্রপ্রেরণ দ্বারা মন্ত্রণা করিবেন। ইন্দ্রের মন্ত্রিপরিষৎ এক সহস্ৰ ঋষি লইয়া গঠিত ছিল এবং তিনি (ইন্দ্র) তাহাদিগকে দিয়া কাৰ্য্য পরিদর্শন করাইতেন বলিয়া তাঁহারা তাঁহার চক্ষুর্ভূত ছিলেন। সেই জন্যই এই দ্বিনয়ন দেবতাকে সহস্রাক্ষ অর্থাৎ (সহস্ৰনেত্র-সমন্বিত) বলিয়া পণ্ডিতেরা বর্ণনা করিয়া থাকেন।

কোন অত্যয়িক কাৰ্য (অর্থাৎ শীঘ্র করণীয় সমস্তাপূর্ণ কঠিন কাৰ্য্য) উপস্থিত হইলে, রাজা পূৰ্ব্বোক্ত মন্ত্রিগণকে (মতিসচিবদিগকে) ও মন্ত্রিপরিষৎকে (অর্থাৎ কৰ্ম্মসচিবদিগের সভ্যগণকে) একত্রে ডাকাইয়া সৰ্ব্ব বিষয় তাঁহা দিগকে বলিবেন। সেই সভায় বহুসংখ্যক সচিবেরা যাহা করিতে মত দিবেন, অথবা, (অল্পসংখ্যক সচিবেরাও) যাহা কাৰ্য্যসিদ্ধিকর উপায় বলিয়া নিৰ্দ্ধারিত করিবেন, (রাজা) তাহাই করিবেন।

এই প্রকার কার্য্যকারী রাজার গুহা (মন্ত্রাদি) বিষয় অন্য লোকেরা জানিতে পারিলে না, বরং তিনিই অন্যের (বা শত্রুর) ছিদ্র বা দোষ জানিতে পারিবেন। কচ্ছপ যেমন নিজ অঙ্গগুলিকে সঙ্কুচিত করিয়া রাখে, রাজাও তাঁহার গোপনীয় বিষয় লুকাইয়া রাখিবেন (অর্থাৎ তাহার আস্তরিক ভাব অন্যকে জানিতে দিবেন না) ॥১

যেমন কোন অশ্রোত্রিয় (বেদবিদ্যারহিত) ব্রাহ্মণ সজ্জনের শ্রাদ্ধ ভোগ করিবার যোগ্য নহেন, তেমন যে মন্ত্রী (রাজনীতি) শাস্ত্রের অর্থ বা অভিপ্রায় কখনও শুনেন নাই (ও জানেন নাই) তিনিও মন্ত্রণাবিষয়ক কথা শুনিবার যোগ্য নহেন ॥২

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে বিনয়াধিকারিক-নামক প্রথম অধিকরণে মন্ত্রাধিকার-নামক পঞ্চদশ অধ্যায় সমাপ্ত।

.

ষোড়শ অধ্যায়
১২শ প্রকরণ—দূতপ্রণিধি

মন্ত্রণার বিষয় নিৰ্দ্ধারিত হইলে পরই দূতপ্রেষণ কাৰ্য্য বিবেচিত হওয়া উচিত। দূত তিন প্রকারের হইতে পারে—যে দূত পূৰ্ব্বোক্ত সৰ্ব্বপ্রকার অমাতা-গুণযুক্ত, তাহাকে নিষ্কণ্ঠীর্থ দূত বলা হয়; যে দূতের সেই সব গুণের এক চতুর্থাংশ কম থাকিবে, তাহাকে পরিসিভার্থ দূত বলা হয়; আর যে দূতের সেই সব গুণের অৰ্দ্ধাংশ কম থাকিবে, তাহাকে শাসলহর দূত বলা হয়। দূত তখনই শত্রুরাজার দেশে প্রস্থান করিবেন, যখন তিনি দেখিবেন যে, তাঁহার যান, (অশ্বাদি) বাহন, (কৰ্ম্মকরাদি) পুরুষ ও তাঁহার (শয্যাস্তরণ প্রভৃতি) সরঞ্জাম সবই সম্যগ ভাবে ব্যবস্থিত হইয়াছে। “শত্রুরাজার নিকট স্ব-স্বামীর শাসন এইভাবে বলিতে হইবে; শত্রু রাজা তৎসম্পর্কে এইরূপ বলিবেন; তাহার প্রতি এইরূপ উত্তর দিতে হইবে; তাহাকে এইভাবে নিজের বশে আনিতে হইবে”—এবং জাতীয় বিষয় উত্তমরূপে বুঝিয়া শুনিয়া দূত পরদেশে গমন করিবেন। তাহাকে (শত্রুর) অটবীপাল, অন্তপাল, পূরমুখ্য ও রাষ্ট্রমুখ্যদিগের সহিত বন্ধুত্র স্থাপন করিতে হইবে। দূত নিজ (প্রভুর) ও শত্রুর অর্থাৎ উভয়ের সৈন্তনিবেশস্থান, যুদ্ধ করার যোগ্য ভূমি ও যুদ্ধ হইতে অপসরণের অনুকূল ভূমি (তুলনা করিয়া) অবেক্ষণ করিবেন। (দূত) আরও উপলব্ধি করিবেন, (শক্রর) দুর্গ ও জনপদের ইয়ত্ত কতখানি, ও (তদীয় রাজ্যে) (সুবর্ণ-মণ্যাদির উৎপত্তিজনিত) সার দ্রব্য কত আছে, (লোকের) বৃত্তি বা জীবিকার্জনের উপায় কেমন আছে, (রাজ্যের) রক্ষাকার্য্য কেমন বিহিত আছে, এবং (রাজা ও রাজ্যের) ছিদ্র বা দেধজনিত রন্ধ কতটা আছে। (দূত) শক্রর অধিষ্ঠানে (রাজধানীতে) তাহার অনুমতি লইয়া প্রবেশ করিবেন।

প্রাণের আশঙ্কা দৃষ্ট হইলেও, (দূত) নিজ প্রচুর দ্বারা যথাকথিত শাসন বা বার্তা (শত্রুরাজার নিকট) উপস্থাপিত করিবেন। শত্রুরাজ যদি (দূতসমাগমে) নিজ কথায়, মূখে ও নয়নে প্রসন্নতার ভাব ব্যক্ত করেন, দূতের বাক্য সমাদরপূর্ব্বক শুনেন, (দৃতের প্রভুর) কুশলাদি ইষ্টসম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করেন, (প্রভুর) গুণকথা বলিলে তাহাতে আসক্তিপ্রদর্শন করেন, নিজ সমীপে (দূতকে) আসন প্রদান করেন ও তাহাকে সম্মান প্রদর্শন করেন, ইষ্টকাৰ্ষ্যে অর্থাৎ উৎসব বা (ভোজনাদিতে) দূতকে স্মরণ করেন এবং দূতের দৌত্যে বিশ্বাস করেন, তাহা হইলে এই সব লক্ষণ দেখিয়া তিনি বুঝিবেন যে, সেই শত্রুরাজা তুষ্ট অবস্থায় আছেন। ইহার বিপরীত লক্ষণ দেখিলে তাহাকে অতুষ্ট বলিয়া বিবেচনা করিবেন। এই প্রকার অতুষ্ট রাজাকে দূত এইরূপ বলিবেন—“আপনি ও অন্ত সকল রাজারাই দূতমুখ অর্থাৎ দূতের মুখেই নিজ কথা অপর রাজাকে শুনান। এই হেতু দূতগণের উপর শস্ত্র উত্তোলিত হইলেও তাহারা (নিজ নিজ প্রভুদ্বারা) যাহা উক্ত হইয়াছে তাহাই ব্যক্ত করিয়া বলিবেন। দূতগণের মধ্যে যদি কেহ অস্তাবসায়ী বা চণ্ডালজাতীয়ও হয়েন, তথাপি তাহারা বধ্য নহেন। আর ব্রাহ্মণ জাতীয় দূতগণের ত কথাই নাই। (আমার প্রযুক্ত বাক্য আমার নহে)—পরের বাক্য ইহা। ইহাই দূতের ধৰ্ম্ম।”

বিদায় না পাওয়া পৰ্য্যন্ত (দূত) পরাধিষ্ঠানেই বাস করিবেন এবং শত্রুর পূজা বা সৎকার পাইলে গৰ্ব্ব অনুভব করবেন না। শত্রুসকাশে থাকা সময়ে (তিনি) নিজকে বলবান মনে করিবেন না; তাহার বাক্য অনভিমত হইলেও তাহা (তিনি) সহ করিবেন; (সেখানে) স্ত্রীলোকের সঙ্গ বা মদ্যাদিপান (তিনি) বর্জন করিবেন; (তিনি) একাকী শয়ন করিবেন, কারণ, এমনও দেখা যায় যে, সুপ্ত ও মদমত্ত ব্যক্তি (নিদ্রা ও মত্ততার অবস্থায়) নিজের মনোভাব প্ৰলাপ-সহকারে ব্যক্ত করিয়া ফেলে। (দূত) তাপসব্যঞ্জন (তাপসের বেষধারী) ও বৈদেহকব্যঞ্জন (বণিকের বেষধারী) গূঢ়পুরুষগণ দ্বারা শত্রুরাজার কৃত্যপক্ষে (এই অধিকরণের ১৪শ অধ্যায় দ্রষ্টব্য) উপজাপ বা ভেদসাধন কাৰ্য্য, অকৃতপক্ষের উপর (তীক্ষরসদাদি) গঢ়পুরুষের নিয়োগ এবং (অমাত্যাদি) প্রকৃতিবর্গের স্বপ্রভূর উপর অনুরাগ ও বিরাগ, ও তাহাদের দোষরূপ ছিদ্র—এই সমস্ত বিষয় জানিয়া লইবেন। অথবা, সেই তাপসব্যঞ্জন ও বৈদেহকব্যঞ্জন গূঢ়পুরুষদিগের শিষ্যগণ দ্বার ও চিকিৎসকবেষধারী ও পাষণ্ডবেষধারী পুরুষগণ দ্বারা কিংবা উভয়বেতন-নামক গূঢ়পুরুষ দ্বারা (অর্থাৎ যে-সব গুপ্তচরেরা স্ব ও পররাজার বেতনভোগী হইয়া কাৰ্য্য করে তাহাদিগের দ্বারা) শত্রুর আচরণ জানিয়া লইবেন। যদি এই সব গূঢ়পুরুষদিগের কাহারও সঙ্গে কথাবাৰ্ত্ত করার সম্ভাবনা উপস্থিত না হয়, তাহা হইলে (তিনি) ভিক্ষুক, (মদ-) মত্ত, উন্মত্ত ও সুপ্ত ব্যক্তিদিগের প্রলাপ দ্বারা, কিংবা (তীর্থ ও আশ্রমাদি) পুণ্যস্থান ও দেবালয়ে গূঢ়পুরুষ দ্বার, এবং (ভিত্তিতু প্রদশিষ্ঠ) চিত্র ও বিশেষ অক্ষর লেখার সংজ্ঞ দ্বারা শত্রুর সব সমাচার উপলব্ধি করিবেন। উপলব্ধ বৃত্তান্তানুসারে (তিনি) উপজাপ বা ভেদরূপ উপায় অবলম্বন করিবেন। শত্রুরাজ দ্বারা জিজ্ঞাসিত হইলেও (তিনি) নিজ রাজার (অমাত্যাদি) প্রকৃতির ইয়ত্ত বা ঠিক অবস্থা প্রকাশ করিবেন না। “আপনি (নিজেই) সব জানেন”—এইরূপ (তিনি) বলিবেন। অথবা (তিনি তাহাতে সন্তুষ্ট না হইলে) (দূত) ততখানি বলিবন, যাহাতে তাঁহার দৌত্যকাৰ্য্য সিদ্ধলাভ করিতে পারে (অর্থাৎ সমগ্র কথা বলিবেন না)।

কাৰ্য্য সিদ্ধ হইয়া গেলেও যদি শত্রুরাজ তাহাকে উপরোধ করেন অর্থাৎ ফিরিয়া যাইতে অনুমতি না দেন, তাহা হইলে তিনি (দূত) উপরোধের কারণ নিম্নলিখিত ভাবে মনে মনে ভাবিবেন—“তবে কি এই রাজা আমার নিজ প্রভুর কোন আসন্ন বিপদ দেখিয়া আমাকে উপরুদ্ধ রাখিতেছেন; অথবা, তিনি (আমার প্রত্যাবর্তনের পূর্বেই) তাঁহার নিজের কোন ব্যসন বা বিপদের প্রতীকার করিবার ইচ্ছা করিয়া, অথবা, (তদীয় মিত্রভূত) পার্কিগ্রাহ রাজাকেও (সেই পার্ষি গ্রাহের মিত্রভূত) আসার-নামক রাজাকে আমার নিজ প্রভূর বিরুদ্ধে উদ্যোজিত করিবার ইচ্ছা করিয়া, কিংবা আমার প্রভুর রাজ্যে (অমাত্যাদি প্রকৃতিজনের মধ্যে) অন্তঃকোপ অর্থাৎ আভ্যন্তরীণ স্বামিদ্রোহ, বা কোন আটবিক রাজাকে তাহার বিরুদ্ধে যুদ্ধে উদ্যোজিত করিবার ইচ্ছা করিয়া, অথবা আমার প্রভূর মিত্ররাজাকে বা তদীয় আক্ৰন্দ (পৃষ্ঠমিত্র) রাজাকে হনন করিবার ইচ্ছা করিয়া, অথবা তাহার শত্রু হইতে সম্ভাব্যমান নিজের উপর কোন বিগ্রহ বা যুদ্ধ, নিজ রাজ্যের অন্তঃকোপ, বা নিজ আটবিক রাজার কোপ প্রতীকার করিবার ইচ্ছা করিয়া, অথবা আমার নিজ প্রভুর সুখোপনত অভিযানকাল নষ্ট করিবার ইচ্ছা করিয়া অথবা (যুদ্ধসময়ে উপযোগী) নিজের শস্য, কুপ্য ও পণ্যের সংগ্রহ, দুর্গসংস্কার কৰ্ম্ম, বা নিজ সৈন্যের বৃদ্ধি করিবার ইচ্ছা করিয়া, অথবা নিজের সৈন্যসমূহের ব্যায়ামের যোগ্য দেশ ও কালের জন্য আকাঙ্ক্ষা করিয়া, অথবা নিজের উপর আপতিত কোন পরিভব বা অনাদর ও প্রমদ বা প্রীতির জন্য, অথবা আমার প্রভূর সহিত সংসর্গের সাতত্যপ্রার্থী হইয়া (অথবা তেমন সংসর্গে দোষোৎপত্তির কথা জানাইবার উদ্দেশ্য করিয়া) আমাকে উপরুদ্ধ রাখিতেছেন?” এইভাবে তর্ক করিয়া বুঝিয়া তিনি সেখানেই বাস করিবেন, অথবা সেখান হইতে অপসরণ করিবেন। স্বপ্রভুর অতীষ্ট প্রয়োজনের প্রতি তিনি দৃষ্টি রাখিয়া চলিবেন। স্বপ্রভুর প্রদত্ত, শত্রুর অনভীষ্ট শাসন বা বার্তা (শক্রসমীপে) বলিয়া (তিনি) নিজের বন্ধন ও বধের ভয়ে, শক্রদ্বারা অবিসজ্জিত (অর্থাৎ অনঙ্গমতগমন) হইলেও ফিরিয়া আসিবেন।

অন্যথা, তাহার নিয়মন বা শক্র কর্তৃক আবদ্ধ হওয়া সম্ভবপর হইয়া উঠিতে পারে।

দূতকৰ্ম্ম বা দূতের কার্য্যগুলি এইরূপ হইবে –(স্বামিসন্দেশ শত্রুর নিকট প্রদানজন্য ও শত্রুর প্রদত্ত শাসন নিবেদন করার জন্ম) প্রেরণ, পূর্ব্বকৃত সন্ধিরক্ষণ, (অবসর প্রাপ্তিতে) নিজ রাজার প্রতাপপ্রদর্শন, মিত্রসংগ্ৰহ-করণ, (রুত্যাদির উপর) উপজাপ বা ভেদচালন, (শক্রর) সুহৃদগণের মধ্যে ভেদব্যবস্থা, (শত্রুর) সেনা ও গূঢ়পুরুষদিগকে বিতাড়িত করণ, (শত্রুর) বন্ধু ও রত্বের অপহরণ, গূঢ়পুরুষদিগের সংবাদ-সংগ্রহের পরিচয়, (শত্রুর ছি এ পাইলে) পরাক্রমের ব্যবস্থা, সমাধি বা সন্ধিবিশ্বাসার্থ রাজকুমারাদিরূপ আহিত বস্তুর মোচন ও (ঔপনিষদিক প্রকরণে উক্ত) মারণাদি যোগের আশ্রয়গ্রহণ ॥১-২

উপরি উল্লিখিত কাৰ্য্যাবলী (রাজা) নিজের দূতগণদ্বারা সাধন করাইবেন এবং শক্রদূতগণের কার্য্যাবলী লক্ষ্য করার জন্য প্রতিদূত ও অপসৰ্প বা গূঢ়পুরুষ নিযুক্ত করিয়া এবং (স্বদেশস্থিত) দৃশু ও (পরদেশে প্রচ্ছন্নভাবে স্থিত) অদৃশ্য রক্ষিপুষিগণ নিযুক্ত করিয়া তাহাদের নিকট হইতে আত্মরক্ষা করিয়া চলিবেন (অর্থাৎ যাহাতে পরদুতেরা কোন মিত্রসংগ্ৰহাদি কাৰ্য্য করিতে না পারেন, তৎপ্রতি তিনি সজাগ দৃষ্টি রাখিবেন) ॥৩

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে বিনয়াধিকারিক নামক প্রথম অধিকরণে দূতপ্রণিধি-নামক ষোড়শ অধ্যায় সমাপ্ত।

.

সপ্তদশ অধ্যায়
১৩শ প্রকরণ—রাজপুত্ৰগণ হইতে রাজার আত্মরক্ষা

(স্ববান্ধব প্রভৃতি) যাঁহারা রাজার সমীপে অবস্থান করেন তাহাদের হস্ত হইতে যে রাজা রক্ষিত হইতে পারেন, তিনিই রাজ্য রক্ষা করিতে সমর্থ হয়েন। সৰ্ব্বপ্রথম দারগণ ও পুত্ৰগণ হইতেই (তিনি আত্মরক্ষা করিবেন)।

কি প্রকারে রাজ স্বদারগণ হইতে আত্মরক্ষা করিবেন সে-সব উপায় নিশান্তপ্রণিধিনামক (১৭শ) প্রকরণে বলা হইবে।

সম্প্রতি পুত্ৰগণ হইতে রাজার আত্মরক্ষা উক্ত হইতেছে। রাজপুত্রদিগকে তাঁহাদের জন্ম হইতেই (রাজা) রক্ষা করিবেন (অর্থাৎ তাহাদিগকে স্বতন্ত্র থাকিতে দিবেন না—তাহাদের প্রতি তীক্ষ দৃষ্টি রাখিবেন)। কারণ, রাজপুত্রেরা কর্কটকের সমানধৰ্ম্মবিশিষ্ট বলিয়া নিজ জনককে ভক্ষণ করিতে পারেন, অর্থাৎ কুলীরকেরা যেমন পিতাকে ভক্ষণ করিয়া জীবিত থাকে, রাজপুত্রেরাও স্ব-পিতাকে বিনষ্ট করিয়া নিজেরা ঐশ্বর্যভোগী হইতে পারেন।

আচাৰ্য্য ভারদ্ধাজের (দ্রোণাচার্য্যের মতে)—যে সব পুত্র জন্মলাভ করিলে পিতা তাহাদের প্রতি স্নেহে আকৃষ্ট হয়েন না, তাহাদিগকে গোপনে বধ করা উচিত।

আচাৰ্য্য বিশালাক্ষের মতে এই (নিরপরাধ শিশুমারণরূপ) কাৰ্য্য নিষ্ঠুরতার লক্ষণ, কারণ, ইহাদ্বারা অদৃষ্ট বা অপরীক্ষিত রাজপুত্রের বধ করা হয় এবং ক্ষত্রিয়বংশের বীজও নষ্ট করা হয়। অতএব, (তাহার মতে) সেই পুত্রকে এক স্থানেই (অর্থাৎ পিতার সমীপেই) অবরুদ্ধ রাখা উচিত হইবে।

কিন্তু, পরাশরের (অর্থাৎ পরাশর আচার্য্যের মতাবলম্বীরা) মনে করেন ষে, এই প্রকার ব্যবহার অহিভয়তুল্য অর্থাৎ সপকে নিজ ঘরে রাখা যেমন বিপত্তিজনক, রাজপুত্রকে নিজ ঘরে অবরুদ্ধ রাখাও তেমন বিপত্তিজনক। কারণ, কুমার মনে করিবে “আমার বিক্রমের অর্থাৎ আক্রমণের ভয়েই পিতা আমাকে আটক করিয়া রাখিয়াছেন,” এবং এইরূপ ভাবিয়াই সেই কুমার বিক্রমকেই অবলম্বন করিবে। অতএব, তাহাদিগের মতে, (স্বসমীপে না রাখিয়া যদি রাজা) তাহাকে (নিজরাজ্যের) কোন অন্তপালের (দূরস্থিত) দুর্গে রাখেন, তাহা হইলে ইহা অধিকতর মঙ্গলের কার্য্য হইবে।

আচাৰ্য্য পিশুনের (নারদের) মতে ইহা উরভ্র বা মেষভয়তুল্য অর্থাৎ কোন মেষের অন্য মেষের প্রতি আক্রমণসময়ে ইহা যেমন প্রথমতঃ দূরে সরিয়া যাইয়া আক্রমণ করে, তেমন রাজপুত্রের দূরস্থিত দুর্গে অপসরণও পিতার প্রতি অধিকতর বিক্রমে আক্রমণের হেতু হইতে পারে। কারণ, পিতার মনে পুত্র হইতে আক্রমণের ভয়ই তাহার নিৰ্ব্বাসনের কারণ, ইহা জানিয়া সে অন্তপালের সহায়তা লইয়া (পিতার উপর বিক্রম প্রদর্শন করিতে পারে)। অতএব, নিজ রাজ্য হইতে দূরবর্তী কোন সামন্তরাজের দুর্গে সেই কুমারের বাস নির্ণীত করাই অধিকতর শ্রেয়স্কর।

কিন্তু, আচাৰ্য্য কৌণপদন্তের (ভীষ্মের) মতে, ইহা গোবৎসের বন্ধনস্থানতুল্য হইবে। কারণ, এই সামস্তদুর্গে রক্ষিত পুত্রকে বৎসতুল্য মনে করিয়া সামন্তরাজ তদীয় পিতাকে ধেন্ততুল্য বিবেচনায় সেই বৎসরূপী পুত্রদ্বারা পিতার ধনদোহন করিবেন। অতএব, কুমারকে মাতৃবান্ধবীদিগের নিকট বাস করানই প্রশস্ততর।

আচাৰ্য্য বাতব্যাধির (উদ্ধবের) মতে, ইহা ধ্বজতুল্য ব্যাপার। কারণ, এই ধ্বজতুল্য কুমারদ্বারা তাহার মাতৃবান্ধবেরা অদিতি (অর্থাৎ নানা প্রকার দেবতার প্রতিকৃতি প্রদর্শনপূর্ব্বক যে ভিক্ষকী ভিক্ষা করে) ও কৌশিকের (সর্পপ্রদর্শনপূর্ব্বক ভিক্ষণকারী ব্যালগ্রাহী সাপুড়ের) ন্যায় অর্থসংগ্ৰহ করিবে। অতএব, তাহাকে (স্ত্রীসেবাদি) গ্রাম্যজনোচিত ধৰ্ম্মে যথেচ্ছসঞ্চার জন্য ছাড়িয়া দিতে হইবে। কারণ, বিষয়মুখের জন্য অবরুদ্ধ রাজপুত্রের পিতার প্রতি দ্রোহাচরণ করে না।

কৌটিল্যের মতে,–এই প্রকার ব্যবহার পুত্রের জীবন্মরণতুল্য অর্থাৎ তাহাকে অবিনীত অবস্থায় রাখিয়া গ্রাম্যমুখে প্রবর্তিত করিয়া রাখিলে, তাহাকে জীবদ্দশাতেই যেন মারিয়া ফেলা হইল। কারণ, (তাহার মতে) যে রাজকুলে পুত্রেরা অবিনীত বা অশিক্ষিত থাকিয়া যায়, তাহারা শক্রদ্বারা আক্রান্তমাত্র হইক্সেই, ঘূণজঙ্ক (ঘূর্ণচর্বিবত) কাঠের ন্যায় স্পর্শমাত্রেই ভাঙ্গিয়া পড়ে। অতএব, (রাজা এইরূপ বিধান করিবেন যেন) মহিষী ঋতুমতী হইলে ঋত্বিক পুরুষেরা গর্ভাধানে সুপুত্র লাভার্থ ইন্দ্র ও বৃহস্পতি দেবতাদ্রয়ের উদ্দেশ্যে তাঁহারা কবি-সাধন (অর্থাৎ পুত্রের ঐশ্বর্যাদির জন্য ইন্দ্রের ও তাহার বিদ্যাবুদ্ধি প্রভৃতির জন্য বৃহস্পতির উদ্দেশ্যে তাঁহারা যেন হবিৰ্দান) করেন। মহিষী গর্ভবতী হইলে, কৌমারভূত্য (শিশুচিকিৎসক) তাহার গর্ভপোষণ ও প্রসব-সম্বন্ধে বিশেষভাবে যত্র নিবেন। মহিষী পুত্র প্রসব করিলে পর, রাজপুরোহিত পুত্রের যথোচিত সংস্কার করিবেন। (তৎপর) পুত্র সমর্থ হইলে (অর্থাৎ বিদ্যার গহণ-ধারণাদিবিষয়ে পঢ় হইলে) তাহাকে তত্তং বিদ্যায় অভিজ্ঞ শিক্ষকগণ বিনীত করিবেন (অর্থাৎ শিক্ষা দিবেন)।

সত্রিনামক গূঢ়পুরুষদিগের মধ্যে অন্যতম, সেই (বিনীত) কুমারকে মৃগয়া, দূত (জুয়াখেলা), মদ্যপান ও স্ত্রীসঙ্গের প্রলোভন দেখাইবে; এবং তাহাকে বলিবে—“পিতার প্রতি আক্রমণপূর্ব্বক রাজ্য নিজ হস্তে গ্রহণ কর”। তাহাদের মধ্যে অন্য একজন সত্ৰী তাঁহাকে (এইরূপ কাৰ্য্য করিতে) প্রতিষেধ করিবে। ইহা আম্ভিনামক আচার্য্যের মতানুযায়ী নীতিবিদগণের মতবাদ (মতুান্তরে, অস্তিনামক যে এক ভারতীয় রাজ তক্ষশিলাতে আলেকজাণ্ডারের দরবারে উপঢৌকন হস্তে উপস্থিত ছিলেন, সেই নীতিবিৎ রাজার মতাবলম্বীদিগের ইহা মতবাদ)। কিন্তু, কৌটিল্যের মতে ইহা উপাদেয় উপদেশ নহে, কারণ, তিনি মনে করেন যে, (পিতৃদ্রোহরূপ) অজ্ঞাত বিষয়ের উপদেশ, (পুত্রের) মহান অনর্থ ঘটাইতে পারে। কারণ, যেমন (মৃদ্ভাণ্ডাদি) কোন নূতন দ্রব্য, (তৈলাদি) যে যে বস্তুদ্বারা লিপ্ত হয়, ইহা সেই সব বস্তুই চুষিয়া লয়, তেমন এই নূতনবুদ্ধিবিশিষ্ট (অর্থাৎ সদসদবিবেকবুদ্ধিহীন) রাজপুত্র, তাহাকে যাহা বলা হইবে তাহাই শাস্ত্রের উপদেশ বলিয়া জানিয়া লইবে। অতএব, তাহার প্রতি (আচাৰ্য্যগণ) যাহা প্রকৃত ধৰ্ম্ম ও অর্থ তাহাই উপদেশ করিবেন, (পিতৃদ্রোহাদিরূপ) যাহা অধৰ্ম্ম ও (মৃগয়াদিরূপ) যাহা অনর্থ, তাহা কখনই উপদেশ করিবেন না।

(বরং) সত্রীরা (তন্নামক গূঢ়পুরুষের)—“আমরা তোমারই সেবক” এই বলিয়া তাহাকে (রাজপুত্রকে) পালন করিবে। যৌবনমদ বৃদ্ধি পাইলে কুমার যদি পরস্ত্রীতে মনোনিবেশ করে, তাহা হইলে তাহারা তাহাকে অtখ্যার বেষধারিণী অশুচি স্ত্রীলোক দ্বারা রাত্রিতে শূন্ত গৃহে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন করিয়া তুলিবে (অর্থাৎ সে যেন ভবিষ্যতে আর পরস্ত্রীলোভী না হয়)। যদি সে মদ্যপান *ীমন করে, তাহা হইলে (সত্রীরা) তাহাকে যোগপান (অর্থাৎ বিরস দ্রব্যযুক্ত মদ) দ্বারা উদ্বিগ্ন করিবে (অর্থাৎ সে যেন ভবিষ্যতে আর মন্তকামী না হয়)। যদি সে দৃতে (অর্থাৎ জুয়াখেলাতে) মনোনিবেশ করে, তাহা হইলে সত্রীরা কাপটিক (তন্নামক গূঢ়পুরুষবিশেষ অথবা কপট ক্রীড়াশীল জুয়ারী) পুরুষগণ দ্বারা তাহাকে উদ্বিগ্ন করিবে (অর্থাৎ সে যেন ভবিষ্যতে আর দৃতিকামী না হয়) (যদি সে মৃগয়াকামী হয়, তাহা হইলে (সত্রীর) প্রতিরোধকারী চোরের বেষধারী পুরুষগণদ্বারা তাহাকে ত্রাসধুক্ত করিবেন (অর্থাৎ সে যেন ভবিষ্যতে আর মৃগয়া করিতে কামনা না করে)। পুত্র পিতার উপর আক্রমণ করিতে মনন করিলে, (সত্রীরা)—“আচ্ছ, তাহাই করা হইবে” এইরূপ বলিয়া তাহার সঙ্গে মিল করিয়া (ক্রমশ:) তাহাকে সেই কাৰ্য্য হইতে নিবষ্ঠিত করিবে। (তাহারা তাহাকে) এইরূপ বলিবে—“রাজার প্রতি আক্রমণ-প্রার্থনা অর্থাৎ আক্রমণের চেষ্টা করাই উচিত নহে। কারণ, তুমি যদি ইহাতে বিফল হও, তাহা হইলে তোমার বধ নিশ্চিত, এবং তোমাকে সেইজন্য লোকনিন্দ ভোগ করিতে হইবে, ও এমনও হইতে পারে যে, জনতার প্রত্যেকে এক এক খণ্ড লোষ্ট্রপাত দ্বারা তোমার বধও সাধন করিতে পারে।”

রাজ (তাহার প্রতি) অনাকৃষ্ট, প্রিয়, একমাত্র পুত্রকেও বন্ধনে রাখিবেন। আর, তিনি যদি বহু পুত্রের পিতা হয়েন, তাহা হইলে সেই অনাকৃষ্ট পুত্রকে তেমন প্রত্যন্ত দেশে (অর্থাৎ রাজ্যের সীমাপ্রান্তে), অথবা অন্য রাজার দেশে পাঠাইয়া দিবেন—যেখানে (রাজোচিত) খাদ্যদ্রব্য ও পণ্যবস্তু (ভোগার্থে) বিদ্যমান নাই; অথবা যেখানে তাহার উদ্যোগে কোন প্রকার ডিম্ব বা বিপ্লবের সম্ভাবনা নাই। যে পুত্র উপযুক্ত আত্মগুণসম্পন্ন তাহাকে (রাজা) সেনাপতি বা যুবরাজের পদে স্থাপিত করিবেন।

বুদ্ধিমান, আহাৰ্য্যবৃদ্ধি ও দুর্ব্বুদ্ধি–রাজপুত্রদিগের এই তিন প্রকার ভেদ হইতে পারে। (তন্মধ্যে) আচাৰ্য্য দ্বারা শিষ্ট হইয়া যে পুত্র কেবলমাত্র ধৰ্ম্ম ও অর্থ উপলব্ধি করে তাহা নয়, তাহার আচরণও করে, তাহাকে বুদ্ধিমান পুত্র বলা হয়। যে পুত্র (ধৰ্ম্ম ও অর্থ) উপলব্ধি করিয়াও তাহার আচরণ করে না, তাহাকে আহাৰ্য্যবুদ্ধি বলা যায়। যে পুত্র সর্বদা প্রমাদপরায়ণ এবং যে ধৰ্ম্ম ও অর্থের দ্বেষ করে, তাহাকে দুর্ব্বুদ্ধি বলা যায়।

সেই দুর্ব্বুদ্ধি পুত্র যদি রাজার একমাত্র পুত্র হইয়া থাকে, তাহা হইলে রাজা (রাজ্য করার জন্য উপযুক্ত অধিকারী পাওয়ার উদ্দেশ্বে) তাহার (সেই দুর্ব্বুদ্ধি পুত্রের) পুত্রোৎপত্তি-বিষয়ে যত্নবান হইবেন। অথবা (তিনি) নিজ পুত্রিকার পুত্র উৎপাদিত করিবেন (অর্থাৎ নিজ কন্যাকে-—“তাহার পুত্রোৎপত্তি হইলে সেই পুত্র আমার পুত্র হইবে” এইরূপ চুক্তিতে বরের হস্তে সমর্পণ করিবেন)। কিন্তু, রাজা যদি বৃদ্ধ বা ব্যাধিগ্রস্ত হয়েন, তাহা হইলে তিনি মাতৃকুলের কোন বন্ধু (বান্ধব), বা স্বকুলজাত কোন পুরুষ, বা গুণবান কোন সামন্ত নৃপতিদ্বারা স্বক্ষেত্রে (স্বমহিষীতে) (নিয়োগদ্বারা) পুত্র উৎপাদন করাইতে পারেন। (তথাপি) অবিনীত (অশিক্ষিত) একমাত্র পুত্রকে রাজ্যে স্থাপিত করিবেন না। রাজার বহু পুত্রের মধ্যে যে-টি (দুর্ব্বুদ্ধি) তাহাকে (প্রত্যস্তাদি দেশে) তিনি অবরুদ্ধ রাখিতে পারেন। (পুত্র হইতে) কোন আপদের সম্ভাবনা না–থাকিলে, রাজা পুত্রের হিতে রত থাকিবেন। কিন্তু, (অনেক প্রিয় পুত্র থাকিলেও) রাজৈশ্বৰ্য্য জ্যেষ্ঠপুত্রে সমৰ্পিত হইলে তাহাই প্রশস্ত কাৰ্য্য বলিয়া গৃহীত হয় ॥ ১ ॥

অথবা, রাজ্য সমগ্র কুলের হস্তেও সমৰ্পিত থাকিতে পারে (অত্রস্থ ‘কুল’-শব্দ দ্বারা রাজার বহু পুত্রের সঙ্গাকে, অথবা পুত্র না থাকিলে কুলবৃদ্ধদিগকেও বুঝাইতে পারে)। কারণ, এইরূপ কুলসঙ্ঘ দুৰ্জয় হইয়া (অর্থাৎ শত্রর আক্রমণ নিরাকৃত করিয়া) এবং রাজব্যসনজনিত আবাধ (প্রজাপীড়ন)-বিহীন হইয়া নিরন্তর পৃথিবীতে অধিষ্ঠান করে। ২।

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে বিনয়াধিকারিক-নামক প্রথম অধিকরণে রাজপুত্র হইতে রাজার আত্মরক্ষণ-নামক সপ্তদশ অধ্যায় সমাপ্ত।

.

অষ্টাদশ অধ্যায়
১৪শ-১৫শ প্রকরণ—পিতার প্রতি অবরুদ্ধ রাজপুত্রের ব্যবহার ও
অবরুদ্ধ রাজপুত্রের প্রতি পিতার ব্যবহার

(অবরুদ্ধ) রাজপুত্র নিজের পক্ষে অযোগ্য কোন কাৰ্য্যে পিতাদ্বারা নিযুক্ত হওয়ায়, অতি কষ্টে জীবনযাত্রা নিৰ্বাহ করিতে থাকিলেও, পিতার অনুবর্তন করিয়া চলিবেন; কিন্তু, তাহাকে নিজের প্রাণসংশয়কর কোন কাৰ্য্য, (অমাত্যাদি) প্রকৃতির কোপোৎপাদন, বা কোনরূপ পাতকের (ঘোর পাপের) কার্য্য করিতে বলা হইলে, তাঁহার পক্ষে (পিতার অন্তবর্তন) না করিলেও চলিবে। কোনও পুণ্যকৰ্ম্মে নিযুক্ত হইলে, (রাজপুত্র) সেই কার্য্যে সাহায্য করার জন্য পিতার নিকট একজন অধিষ্ঠাতা বা কৰ্ম্মনেতা পুরুষ চাহিয়া লইবেন। সেই পুরুষদ্বারা অধিষ্ঠিত হইয়া, (তিনি) রাজার আদেশ সবিশেষভাবে পালন করিবেন। (তিনি সেইকার্য্যে) অন্তরূপ ফল লাভ করিলেও (প্রজা-জন হইতে) কোনরূপ উপায়নদ্রব্য (উপঢৌকনদ্রব্য) পাইলে, তাহা পিতৃসমীপে পাঠাইয় দিবেন (অর্থাৎ স্বয়ং তাহা উপভোগ করিবেন না)।

এই প্রকার ব্যবহার-প্রাপ্তি সত্তেও পিতা যদি তাহার প্রতি অতুষ্টই থাকেন এবং অন্য পুত্র ও (স্বমাতৃব্যতিরিক্ত) অন্য কোন মহিষীর প্রতি স্নেহপরায়ণ থাকেন, তাহা হইলে তিনি পিতার নিকট অরণ্যে গমনের অল্পমতি জিজ্ঞাসা করিবেন। অথবা, যদি পিতা হইতে তাঁহার বন্ধন বা বধপ্রাপ্তির ভয় থাকে, তাহা হইলে তিনি, যে সামন্ত নৃপতি ন্যায়পূর্ব্বক ব্যবহার করেন এবং যিনি ধাৰ্ম্মিক, সত্যবাদী, অবঞ্চক এবং শরণাগতজনের আশ্রয়দাতা ও তাহাদের প্রতি সম্মানপ্রদর্শক, তেমন এক সামন্তের আশ্রয় লইবেন। সেই সামন্তের আশ্রয়ে থাকিয়া, (রাজপুত্র) কোষ ও সৈন্যদ্বারা উত্তমরূপে যুক্ত হইয়া কোন প্রবীর (প্রকৃষ্ট বীর) পুরুষের কন্যাকে বিবাহ কবিতে পারেন, কিংবা (পিতার) আটবিকগণের সহিত মিত্রতা-সম্বন্ধ স্থাপন করিতে পারেন, অথবা (পিতার) কৃত্যবর্গের (অর্থাৎ অতুষ্ট অমাত্যদিগের) সহিত (নিজ সহায়ের বৃদ্ধিজন্য) মিলিত হইতে পারেন।

যদি (উক্তরূপ কোষদণ্ডের সহায় না পাইয়া) রাজপুত্রকে একাকীই থাকিতে হয়, তাহা হইলে তিনি সুবর্ণপাক (অর্থাৎ রসতন্ত্রের প্রয়োগে লৌহাদিকে স্ববর্ণে পরিণত করার বিদ্যা), (হীরকাদি) মণি, রাগ (লাক্ষাদিরঞ্জন দ্রব্য), সোনা ও রূপার পণ্যদ্রব্যের ব্যাপার ও আকর-দ্রব্যের কারখানার ব্যাপার অবলম্বন করিয়া নিজের জীবিকা উপার্জন করিবেন। অথবা, (তিনি) পাষগুদিগের (বিধৰ্ম্মীদিগের) ও সংঘের (বৌদ্ধ সংঘের) দ্রব্য, শ্রেক্রিয় ব্রাহ্মণ যাহা ভোগ করে না এমন দেব-দ্রব্য, এবং ধনসমৃদ্ধ বিধবার দ্রব্য গূঢ়ভাবে তাহাদিগের গৃহে প্রবেশ করিয়া অপহরণ করিবেন এবং সার্থ বা বণিক সংঘের (পণ্যযুক্ত) যানপাত্রে (পোতাদিতে) মদকর-রসাদি (বিষাদি) প্রয়োগ করিয়া, তাহাদিগকে বঞ্চিত করিয়া লুট বা অপহরণ করিয়া লইতে পারেন। অথবা, (তিনি) (ত্রয়োদশ অধিকরণের) পারগ্রামিক (শক্রর প্রাসাদ অধিকারবিষয়ক) প্রকরণে উক্ত উপায়াবলীও অবলম্বন করিতে পারেন। অথবা, (তিনি) নিজ মাতার সেবকজনগণের আন্তকুল্যবিধানপূর্ব্বকও (স্ববৃদ্ধির জন্য) চেষ্টমান হইতে পারেন। অথবা, (তিনি) তক্ষণদি কারু, (চিত্রকরাদি) শিল্পী, কুশীলব, চিকিৎসক, বাগ জীবন ও পাষণ্ডের বেষে ছদ্মবেষয়ুক্ত হইয়া, নিজ স্বরূপ লুকাইয়া, তৎ-তৎপুরুষের বেষধারী গূঢ়পুরুষদিগের সহিত মিলিত হইয়া, রাজার ছিদ্রে (অর্থাৎ অপকার স্থানে) প্রবেশ করিয়া, তাহাকে শস্ত্র ও বিষদ্বারা প্রহার করিয়া (অর্থাৎ মারণার্থ আক্রমণ করিয়া) (অমাত্যদিগকে) বলিবেন,—“আমিই সেই রাজকুমার; আমার সহিত একত্র হইয়া যে রাজ্য (পিতার) ভোগ্য, তাহা (পিতা) একাকী ভোগ করিবার অধিকারী হইতে পারেন না, এইরূপ অবস্থায় আপনার যাহারা (অমাত্যাদি পদের) কাৰ্য্যভার চালাইতে চাহেন, তাহাদিগকে দ্বিগুণ ভক্ত (ভাত) ও বেতন দিয়া (আমি) সম্মানিত করিতে পারি।” এই পৰ্য্যন্ত অবরুদ্ধ পুত্রের ব্যবহার বর্ণিত হইল।

অপর পক্ষে, (অমাত্যাদি) মূখ্যগণের পুত্রের গুপ্তচরের বেষে উপস্থিত হইয়া, অবরুদ্ধ পুত্রকে বুঝাইয়। বলিয়া (অর্থাৎ তিনি যদি পিতার প্রতি অনুকুলবৃত্তি হয়েন, তাহা হইলে, যৌবরাজ্যপ্রাপ্তির সম্ভাবনা আছে ইত্যাদিরূপ প্রবোধবাক্য বলিয়া) তাহাকে (পিতৃসমীপে) আনিতে চেষ্টা করিবেন, কিংবা রাজসম্মানিত তাঁহার মাতাও তাহাকে বশে আনিতে পারেন। অবিধেয় পুত্রকে রাজা পরিত্যাগ করিলে, তাহাকে গূঢ়পুরুষেরা শস্ত্র ও রস (বিষ) প্রয়োগদ্বারা হত্যা করিতে পারে। আর যদি তেমন পুত্র অপরিত্যক্তই থাকেন, তাহা হইলে (গূঢ়পুরুষেরা) তাহাকে নিজের সমানস্বভাব স্ত্রীদ্বারা, মদ্যপানদ্বারা বা মৃগয়াদ্বারা আসক্ত করিয়া রাত্রিতে বাধিয়া রাজান্তিকে আনিতে পারে।

(অবরুদ্ধ পুত্র রাজাস্তিকে) উপস্থিত হইলে, রাজা তাহাকে “আমার উত্তরকালে রাজ্য তোমারই হইবে”—এইরূপ বলিয়া, রাজ্যনিমিত্ত তাঁহাকে সান্ত্বনা দিবেন। যদি সেই পুত্র একরূপ অবস্থায়ই অবিনীত থাকিয়া যায়, তাহা হইলে রাজা তাহাকে কারারুদ্ধ করিয়া রাখিবেন। অথবা, তিনি বহু পুত্রের পিত হইলে এমন পুত্রকে (রাজ্য হইতে) নির্বাসিত করিতে পারেন ॥১

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে বিনয়াধিকারিক-নামক প্রথম অধিকরণে পিতার প্রতি অবরুদ্ধ পুত্রের ব্যবহার ও অবরুদ্ধ পুত্রের প্রতি পিতার ব্যবহার নামক অষ্টাদশ অধ্যায় সমাপ্ত।

.

উনবিংশ অধ্যায়
১৬শ প্রকরণ—রাজপ্রণিধি বা রাজার কার্য্যব্যাপৃততা

রাজা যদি উত্থানযুক্ত (অর্থাৎ কর্তব্যকার্য্যে উদ্যোক্তা) থাকেন, তাহা হইলে, (অমাত্যাদি) ভৃত্যবর্গও কাৰ্য্যে উত্থানযুক্ত হইয় পড়ে। আবার রাজা যদি প্রমাদযুক্ত (অর্থাৎ কর্তব্য কার্য্যে অনবধানযুক্ত) হয়েন, তাহা হইলে ভৃত্যবর্গও প্রমাদী হয় এবং তাহারা তাহার (রাজার) কাৰ্য্যসমূহ নষ্ট করে। এবং তিনি (রাজা) শক্রদ্বারা অতি-সংধিত বা বঞ্চিত হয়েন। অতএব, (রাজা) নিজের উত্থান বা উদ্যোগবিষয়ে সমাহিত থাকিবেন।

(রাজা) নালিকাদ্বারা (এক নালিকার সময় পরিমাণে ২৪ মিনিট) পরিমাপ করিয়া দিবাভাগকে অষ্টধা এবং রাত্রিভাগকে অষ্টধা বিভক্ত করিবেন (এক অষ্টভাগে এক পাদ কম ৪ নালিকা অর্থাৎ ৩.৭৫ নালিকা হয় অর্থাৎ দেড় ঘণ্টাকাল পরিমিত হয়)। অথবা, তিনি পুরুষের ছায়ামানদ্বারা দিবসের প্রথম চারিটি অষ্টভাগ কল্পনা করিবেন, যথা (১) সূর্য্যোদয় হইতে তিন পুরুষ পরিমাণের ছায়া পৰ্য্যন্ত প্রথম অষ্টভাগ, (২) একপুরুষ পবিমাণের ছায়া পৰ্য্যন্ত দ্বিতীয় অষ্টভাগ, (৩) চারি অঙ্গুলী পরিমাণের ছায়া পৰ্য্যন্ত তৃতীয় অষ্টভাগ ও (৪) মধ্যাহ পৰ্য্যন্ত চতুর্থ অষ্টভাগ। এই চারিটি অষ্টভাগ দ্বারা দিবসের পশ্চিম বা চারিটি অষ্টভাগ ব্যাখ্যাত বুঝিতে হইবে, অর্থাৎ (৫) চতুরঙ্গুলা ছায়া, (৬) পৌরুষী ছায়া, (৭) ত্রৈপৌরুষী ছায়া ও (৮) দিনান্ত (সৰ্ব্বসাকল্যে প্রত্যেকের দেড় ঘণ্টা পরিমিত করিয়া দিবসের আটটি ভাগ কল্পিত হইল)।

(রাজা) দিবসের এই আটটি ভাগের প্রথমটিতে (গত রাত্রির) রক্ষা-বিধান কাৰ্য্য ও (গত দিনের) আয়-ব্যয়ের বিষয় শ্রবণ করিবেন। দ্বিতীয় ভাগে (তিনি) পুরবাসীদিগের ও জনপদবাসীদিগের কার্য্য নিরীক্ষণ করিবেন। তৃতীয় ভাগে (তিনি) স্বান ও ভোজন করিবেন এবং স্বাধ্যায় (বেদাধ্যয়ন) সম্পাদন করিবেন। চতুর্থ ভাগে (তিনি) হিরণ্যের (বা নগদ টাকার) প্রতিগ্রহ করিবেন এবং অধ্যক্ষদিগকে (কার্য্যবিশেষে) নিযুক্ত করিবেন। পঞ্চম ভাগে (তিনি) মন্ত্রিপরিষদের সহিত পত্রব্যবহারদ্বারা মন্ত্রণা চালাইবেন এবং গুপ্তচরগণের প্রতি গুহবিষয়ে উপদিপ্তমান কাৰ্য্যাবলী অবগত হইবেন। ষষ্ঠ ভাগে (তিনি) স্বচ্ছন্দে বিহার, অথবা মন্ত্রণা করিবেন। সপ্তম ভাগে (তিনি) হস্তী, অশ্ব, রথ ও আয়ুধসমূহ পর্য্যবেক্ষণ করিবেন। অষ্টম ভাগে (তিনি) সেনাপতিকে সঙ্গে করিয়া (যুদ্ধাদি-) বিক্রমের বিষয় আলোচনা করিবেন। দিবাভাগের অবসান হইলে (তিনি) সায়ংকালীন উপাসনা করিবেন।

(আবার) রাত্রির প্রথম অষ্টভাগে (তিনি) গূঢ়পুরুষদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিবেন। দ্বিতীয় ভাগে (তিনি) স্নান ও ভোজন এবং স্বাধ্যায় সমাপন করিবেন। তৃতীয় ভাগে তিনি তুর্য্য বা গীতবাদিত্রাদির শ্রবণমুখ অনুভব করিয়া শুইবেন এবং চতুর্থ ও পঞ্চম ভাগে নিদ্রা যাইবেন। ষষ্ঠ ভাগে (তিনি) তুর্য্যঘোষদ্বারা জাগরিত হইয়া (অর্থাদি) শাস্ত্র ও (পরদিনে) যাহা কৰ্ত্তব্য হইবে তদ্বিষয়ের চিন্তা করিবেন। সপ্তম ভাগে (তিনি) মন্ত্র বিচার করিবেন এবং গূঢ়পুরুষদিগকে যথাবিষয়ে প্রেরণ করিবেন। অষ্টম ভাগে (তিনি) ঋত্বিক (যাজক) আচাৰ্য্য (বিদ্যার উপদেশকার) ও পুরোহিতকে সঙ্গে কবিয়া স্বস্তিবচনযুক্ত আশীৰ্ব্বাদ গ্রহণ করিবেন এবং চিকিৎসক, মাহানসিক (পাকশালার অধিকৃত পুরুষ) ও মৌহুক্তিকের (দৈবজ্ঞ বা শুভাশুভ গ্রহচিস্তকের)সঙ্গে সাক্ষাৎ করিবেন। (তৎপর) বৎস সহিত ধেন্ত ও বৃষভকে প্রদক্ষিণ করিয়া উপস্থানে বা আস্থানমণ্ডপে যাইবেন।

অথবা, (তিনি) নিজের বল বা শক্তির আন্তকুল্য চিন্তা করিয়া, রাত্রি ও দিন (অন্যপ্রকারে) বিভক্ত করিয়া, স্বকাৰ্য্যের অনুষ্ঠানও করিতে পারেন।

উপস্থানে (সভাগুহে) উপস্থিত হইয়া (তিনি) কাৰ্য্যার্থিগণের দ্বার-নিরোধ বন্ধ করাইবেন, অর্থাৎ যাহাতে আগত কাৰ্য্যার্থীরা সহজে রাজসমীপে স্বকাৰ্য্যনিবেদনার্থ উপস্থিত হইতে পারে তিনি সেই প্রকার ব্যবস্থা করাইবেন। কারণ, ষে রাজা দুর্দশ (অর্থাৎ কাৰ্য্যার্থীরা সহজে যাহার সাক্ষাৎ করিতে পারে না), তিনি অস্তিকসেবকগণদ্বারা কাৰ্য্যাকার্য্যের বিপৰ্য্যাস বা বৈপরীত্য ঘটান (অর্থাৎ রাজা স্বয়ং তাদশ সাক্ষাৎকারদ্বারা যেরূপ কাৰ্য্যনিষ্পত্তি করিতে পারিবেন, আসন্নচারী তাহা করিতে পারিবে না বলিয়া কাৰ্য্যাবলী উলট-পালট হইয়া যাইতে পারে)। তাহা হইলে অর্থাৎ কাৰ্য্যাকার্য্যের বিপৰ্য্যাস ঘটিলে, (তিনি) অমাত্যাদি প্রকৃতির কোপ উৎপাদন করিবেন, অথবা শক্রর বশগামী হইয়া পড়িবেন। অতএব, (তিনি) দেবতা, আশ্রম, পাষণ্ড (বিধৰ্ম্মী), শ্রোক্রিয় (গবাদি) পশু ও পুণ্যস্থান সম্বন্ধীয় এবং বালক, বৃদ্ধ, ব্যাধিত, ব্যসনী (বিপদগ্ৰস্তজন), অনাথ জন ও স্ত্রীলোক সম্বন্ধীয় কাৰ্য্যাবলী যথাক্রমে পর্য্যবেক্ষণ বা বিচার করিবেন। অথবা, (তিনি) কাৰ্য্যের গুরুত্র বুঝিয়া, কিংবা কাৰ্য্যের অতিপাতিত্বের আশঙ্কায় (অর্থাৎ কোন কার্য্যের বিচার কালবিলম্বদোষে স্থগিত থাকিলে, তাহা শীঘ্রবিচাৰ্য্য বলিয়া বিবেচিত হইলে) অন্যথা কাৰ্য্যদর্শন করিতে পারেন, অর্থাৎ উপরি বর্ণিত কাৰ্য্যক্রম তিনি রক্ষা না করিতেও পারেন।

(গুরুই হউক, আর লঘুই হউক) সব অত্যয়িক (জরুরি) কাৰ্য্যই রাজা শ্রবণ করিবেন এবং সেই কাৰ্য্য অতিক্রান্ত হইতে দিবেন না। (কারণ,) অতিক্রাস্ত বা অতিপাতিত কার্য্য (পরে) কষ্টসাধ্য হইয়া দাড়ায়, অথবা, ইহা অসাধ্যও হইয়া উঠে ॥১

(রাজা) অগ্নিগৃহে উপস্থিত হইয়া, পুরোহিত ও আচাৰ্য্যকে সঙ্গে করিয়া প্রত্যুথান ও অভিবাদনপূর্ব্বক বৈষ্ঠ (বেদবিৎ পণ্ডিত) ও তপস্বীদিগের কার্য্য দর্শন করিবেন ॥২

পাছে বা কোন কোপ উপস্থিত হয় এই কারণে, (রাজা) কিন্তু, তপস্বীদিগের ও মায়াপ্রয়োগে অভিজ্ঞজনদিগের কার্য্য ত্রৈবিদ্য অর্থাৎ ত্রয়ীবিদ্যাবিং পণ্ডিতগণকে সঙ্গে লুইয়া পৰ্য্যবেক্ষণ করিবেন, কখনই একাকী তাহা করিবেন না ॥৩

মনে রাখা উচিত যে, রাজার পক্ষে উখাল বা উদ্যোগ (অর্থাৎ সৰ্ব্বকালে কাৰ্য্য-ব্যাপৃতত ব্ৰত বলিয়া গণ্য, কাৰ্য্য বা ব্যবহারের নির্ণয় তাহার পক্ষে যজ্ঞসদৃশ; (শক্রমিত্ৰাদিতে) ব্যবহারসমতা তাহার পক্ষে দক্ষিণা বা দানস্বরূপ; এইভাবে কার্ষ্যে দীক্ষিত রাজারই (বাস্তবিক) অভিষেচন বা অবতৃথ-স্নান (সম্পন্ন বলিয়া বিবেচিত হওয়ার যোগ্য) ॥৪

প্রজার সুখ উপস্থিত হইলেই রাজার স্বখ হয়, এবং প্রজার হিত হইলেই তাহা রাজার হিত বলিয়া বিবেচ্য। যেটা রাজার নিজের প্রিয় সেটা তাহার হিত নহে, কিন্তু, প্রজাবর্গের যেটা প্রিয় সেটাই রাজার হিত ॥৫

অতএব, নিত্য উখিত বা উত্থানযুক্ত হইয়া, রাজা অৰ্থ বা কাৰ্য্যের নির্ণয় করিবেন। অর্থের (রাজকাৰ্য্যের) মূলই হইল উত্থান, এবং ইহার বিপৰ্য্যয় অর্থাৎ অনুখান অনর্থের মূল (এ স্থলে অর্থ শব্দের সম্পৎ অর্থ গ্রহণ করা সমীচীন মনে হয় না) ॥৬

অনুত্থানের ফলে, (অতীতে) প্রাপ্ত কাৰ্য্যের এবং ভবিষ্যতে প্রাপ্তিযোগ্য কার্য্যের নাশ নিশ্চিত। উত্থানের ফলে (রাজা) (সদ্যঃ) ফল বা কাৰ্য্যসিদ্ধি প্রাপ্ত হইতে পারেন এবং তিনি কাৰ্য্যের পূর্ণ সম্পাদনও লাভ করিতে পারেন ॥৭

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে বিনয়াধিকারিক-নামক প্রথম অধিকরণে রাজপ্রণিধি-নামক উনবিংশ অধ্যায় সমাপ্ত।

.

বিংশ অধ্যায়
১৭শ প্রকরণ—নিশান্তপ্রণিধি বা রাজভবনের অনুষ্ঠান

(রাজা) বাস্তুবিদ্যাবিং লোকদিগের মতে যে স্থান প্রশস্ত সেখানে প্রাকার, পরিখা ও দ্বারযুক্ত এবং অনেক প্রকোষ্ঠবিশিষ্ট অন্তঃপুর নিৰ্ম্মাণ করাইবেন।

(সন্নিধাতুনিচয়কৰ্ম্ম-নামক প্রকরণে উক্ত) কোষগৃহনিৰ্ম্মাণের যে সমস্ত বিধান আছে সেই বিধানানুসারে, তিনি (অন্তঃপুরের) মধ্যে নিজের বাসগৃহ নিৰ্মাণ করাইতে পারেন। যে গৃহের ভিত্তির মধ্যে সঞ্চরণপথ লুকায়িত আছে এমন মোহনসংজ্ঞক গৃহও (অর্থাৎ মার্গ-ব্যামোহকারক গৃহ) হইতে পুরে,—এমন মোহনগুহের মধ্যেও (তিনি) নিজের বাসগৃহ নিৰ্ম্মাণ করাইতে পারেন। অথবা, নিকটবৰ্ত্তী দিকে প্রতিষ্ঠিত কোন চৈত্য বা দেবায়তনে যে দেবতার মূৰ্ত্তি আছে সেই দেবতার মূৰ্ত্তিদ্বারা ইহার দ্বার আচ্ছাদিত করিয়া এবং একাধিক স্বরঙ্গদ্বারা সঞ্চরণপথ ইহাতে নিবেশিত করিয়া ভূমিগৃহ (ভূমিগর্ভস্থ গৃহ) নিৰ্ম্মিত হইতে পারে,—তন্মধ্যে (রাজা স্ব-বাসগৃহ রচনার ব্যবস্থাও করাইতে পারেন)। অথবা, যাহাতে ভিত্তির মধ্যে সোপান লুকায়িত আছে, কিংবা যাহার প্রবেশ বা অপসরণমার্গ স্থষির (ছিদ্রযুক্ত) স্তম্ভের মধ্যে আছে এমন প্রাসাদও নির্মিত হইতে পারে, এবং তন্মধ্যে রাজা নিজ বাসগৃহ রচনা করাইতে পারেন। (কিন্তু,) এই বাসগৃহ শত্রু হইতে প্রাপিত আপদের প্রতীকারার্থ এমন ভাবে নিৰ্ম্মিত হইবে যে, (অবসর উপস্থিত হইলে) ইহাকে তল পর্য্যন্ত পাতিত করিবার উদ্দেশ্যে ইহা যন্ত্রবদ্ধ থাকিবে (অর্থাৎ সেই যন্ত্রের সংস্রনে সমস্ত বাসগৃহ অবসরমত পাতিত করা যাইতে পারিবে)। (পূৰ্ব্বে নিৰ্ম্মিত না থাকিলেও) আপদ উপস্থিত হইলে (রাজ) এই প্রকার বাসগৃহ নিৰ্ম্মাণ করাইতে পারেন। (শক্ররাজাও তাঁহার মত তুল্যশাস্ত্রবেত্ত হইতে পারে—এই ভয়ে) উক্তরূপ বাসগৃহ রচনা না করাইয়া (তিনি) নিজের বুদ্ধিবিবেচনায় অন্যপ্রকার বাসগৃহও নিৰ্মাণ করাইতে পারেন।

(নিশান্তমধ্যে অগ্নিভয় নিবারণের উপায় বলা হইতেছে, যথা—) যে অন্তঃপুর, বাম দিকে রক্ষিত হইয়া, তিন বার (বেণুদ্বারা মথিত হওয়ায়) মানুষের অস্থি হইতে উৎপন্ন অগ্নিদ্বারা (মন্ত্রাদির উচ্চারণপূর্ব্বক) পরিগত হয়, সেই অন্তঃপুরকে অন্য কোন অগ্নি দহন করিতে পারে না। (এমন কি,) এখানে অন্য অগ্নি জলিতেই পারে না। এবং যদি করক বা বর্ষশিলার জলসহ মিশ্রিত করিয়া (বল্মীক-) মুক্তিকাযুক্ত বৈদ্যুত ভস্ম (অর্থাৎ বিদ্যুৎপাতে দগ্ধ বৃক্ষাদির ভষ্ম) দ্বারা সেই অন্তঃপুর অবলিপ্ত করা হয়, তাহা হইলেও (ইহাকে) অন্য কোন অগ্নি দহন করিতে পারে না, বা সেখানে অগ্নি জলিতেই পারে না।

(এখন বিষপ্রতীকারের উপায় বলা হইতেছে, যথা—) জীবন্তী (গুড়চী), শ্বেতা (শঙ্খিনী), মুদকের (লোধ দ্রুমবিশেষের) পুপ ও বন্দাকা-নামক বুক্ষোপরি জাত লতাবিশেষ দ্বারা, অথবা অক্ষীব বৃক্ষে (শিগ্র, বা সজিনা বৃক্ষে) জাত অশ্বখের প্রতানদ্বারা সুরক্ষিত অন্তঃপুরের উপর সৰ্পের বা অন্যপ্রকারের বিষের প্রভাব থাকিবে না। গৃহে মার্জার, ময়ূর, নকুল ও পৃষতযুগ ছাড়িয়া দিলে, ইহারা সর্পগুলিকে ভক্ষণ করে। সর্প ও অন্য বিষশঙ্কা উপস্থিত হইলে, শুক, শারিক, কিংবা ভৃঙ্গরাজ (অলিবিশেষ) চীৎকার করিয়া থাকে। বিষ নিকটে উপস্থিত হইলে, ক্ৰৌঞ্চ পক্ষী বিহবল হয়, জীবঞ্জীবকে পক্ষী গ্রানিযুক্ত হয় (হৰ্ষরহিত হয়), মত্ত কোকিল মরিয়া যায়, এবং চকোরের অক্ষিদ্রয় লাল হইয়৷ উঠে। উক্ত প্রকারে (রাজা রাজভুবনে) অগ্নি, বিষ ও সর্প হইতে রক্ষার বিধান করিবেন।

(নিশাস্তের) পশ্চাদ্ভাগে বিভিন্ন কক্ষ্যাতে রাজস্ত্রীদিগের নিবাসস্থান ও গর্ভসংস্থা (গৰ্ভিনী অবস্থায় বাসযোগ্য স্থান), ব্যাধিসংস্থা (ব্যাধির অবস্থায় তাঁহাদের বাসযোগ্য স্থান) ও বৈদ্যপ্রত্যাখ্যাত-সংস্থা (অর্থাৎ অসাধ্য রোগে রুগ্ন স্ত্রীদিগের বাসযোগ্য স্থান) নিৰ্ম্মাণ করাইতে হইবে এবং সেখানে বৃক্ষস্থান (উদ্যা নাদি) ও উদকস্তান (তড়াগাদি) থাকিবে। (উক্ত স্থানগুলির) বাহিরে কন্যাপুর (অবিবাহিত রাজকন্যাগণের বাসস্থান) ও কুমারপুর (অপ্রাপ্তব্যবহার রাজকুমারগণের বাসস্থান) রচিত থাকিবে। (নিশান্তের) অগ্রভাগে (বিভিন্ন কক্ষ্যাতে) অলঙ্কারভূমি (বিচিত্র শোভাযুক্ত মহল), মন্ত্রভূমি (মন্ত্রণার সভাগৃহ), উপস্থান (আস্থানমণ্ডপ অর্থাৎ দরবার-স্থান) এবং কুমারগণের অধ্যক্ষের জন্য নির্দ্দিষ্ট স্থান থাকিবে (কুমারাধ্যক্ষ শব্দটি পরবর্তিকালের প্রস্তর ও তাম্রলিপিতে প্রাপ্ত ‘কুমারামাতা’ শব্দের সহিত তুলনীয়। এ স্থলে কুমারদিগের ও সন্নিধাতু প্রভৃতি অধ্যক্ষগণের স্থান বলিয়া অনুবাদ করিলে ইহা সমীচীন বোধ হইবে না, কারণ, ইতিপূৰ্ব্বেই কুমারপুর উল্লিখিত হইয়াছে)। অন্যান্য কক্ষ্যাতে অন্তঃপুরাধিকৃত প্রধান পুরুষের রক্ষা-সৈন্য বা রক্ষিপুরুষেরা থাকিবে।

গৃহমধ্যে উপস্থিত হইয়া (রাজা) বিশ্বস্ত বৃদ্ধ পরিচারিকা দ্বারা পরিশুদ্ধ (অর্থাৎ দেবীদর্শনে কোন প্রকার বাধাবিপত্তির সম্ভাবনা নাই বলিয়া জানিয়া) মহিষীকে দর্শন দিবেন। তিনি (একাকী, বৃদ্ধ পরিচারিকা সঙ্গে না নিয়া) কখনও দেবীসমীপে উপস্থিত হইবেন না। কারণ; (দেবীগৃহে রাজার একাকী গমনে কিরূপ দোষ হইতে পারে, এখানে প্রাচীন ইতিহাস হইতে কতকগুলি দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত হইতেছে;) দেবী বা পট্টমহিষীর গৃহে লুক্কায়িত থাকিয়া (বীরসেননামক) ভ্রাতা, (রাজা) ভদ্রসেনকে হত্যা করিয়াছিলেন; এবং নিজ মাতার শয্যার নীচে প্রচ্ছন্ন থাকিয়া (রাজ-) পুত্র, কারূশ রাজাকে হত্যা করিয়াছিলেন। মধুচ্ছলে বিষ দিয়া তাহাতে লাজ (বা খই) মিশ্ৰিত করিয়া (রাজাকে তাহা খাওয়াইয়া) কাশিরাজকে, বিষদ্বারা উপলিপ্ত নৃপুরের (আঘাতে) বৈর ন্ত রাজাকে, (বিষদিগ্ধ) মেখলামণির স্পর্শদ্বারা সোঁবীর রাজাকে, এবং (বিষদিগ্ধ) আদর্শ বা মুকুরের স্পর্শদ্বারা রাজা জালুথকে এবং নিজের বেণীতে গূঢ়ভাবে শস্থ লুকাইয়া রাখিয়া তদ্দ্বারা রাজা বিডুরথকে তাঁহাদের নিজ নিজ মহিষীরা মারিয়া ফেলিয়াছিলেন।

(রাজা) মহিষীদিগকে কখনই মুণ্ড (মুণ্ডিতমস্তক বৌদ্ধ ভিক্ষুক প্রভৃতি), জটিল (জটাধারী শৈবপাশুপতাদি) ও কুহক বা মায়াপ্রয়োগকারীদিগের সহিত সংসর্গ বা পরিচয় রাখিতে দিবেন না এবং বাহিরের দাসীদিগের সহিতও তাহা করিতে দিবেন না। দেবীদিগের বান্ধবেরাও (পূৰ্ব্বোক্ত) গর্ভসংস্থা ও ব্যাধিসংস্থা ব্যতীত অন্যস্থানে তাহাদিগের সহিত সাক্ষাৎকার লাভ করিতে পারিবে না (অর্থাৎ তাহাদের সন্তানপ্রসব ও ব্যাধিসময়ে সেই দুই স্থানে তাঁহাদিগকে বান্ধবেরা দেখিতে অনুমতি পাইতে পারেন)। রূপাজীবা বা বেশ্বারা স্বান ও (দেহমলাদির) ঘর্ষণদ্বারা শুদ্ধদেহ হইয়া এবং নিজ বস্ত্র ও অলঙ্কার পরিবর্তিত করিয়া (অর্থাৎ পূৰ্ব্ব পরিহিত বস্থাদি ত্যাগ করিয়া পরিশুদ্ধ বস্থাদি পুনরায় পরিয়া) (রাজার পরিচর্য্যার্থ রাজসমীপে) দর্শন দিবে। অশীতিবর্ষবয়স্ক পুরুষেরা ও পঞ্চাশদ্রর্ষবয়স্ক স্ত্রীগণ যথাক্রমে পিতা ও মাতার বেষধারী ও বেষধারিণী থাকিয়া, এবং রাজবাড়ীতে কাৰ্য্যকারী স্থবির ও নপুংসকেরা অন্তঃপুরস্থ রাজস্ত্রীগণের শৌচ ও অশৌচ জানিয়া রাখিবে এবং স্বামী বা রাজার হিতার্থ (রাজসমীপে) তাহা নিবেদন করিবে।

(রাজকুলের) সকল লোকই (অর্থাৎ দেবীগণ ও তৎপরিচারকগণ) নিজ নিজ নির্দ্দিষ্ট স্থানেই বাস করিবে, পরভৃমিতে সঞ্চরণ করিবে না, এবং অভ্যন্তরের কেহই বাহিরের কাহারও সঙ্গে সংসর্গ রাখিতে পারিবে না ॥১

কিঞ্চ, সকল দ্রব্যই—ইহাদের বাহির হইতে আগমন ও ভিতর হইতে নিগমের বিষয় নিবন্ধপুস্তকে লিপিবদ্ধ হইলে এবং সেগুলি সম্যক্ পরীক্ষিত হইলে—বাহিরে যাইতে পারিবে এবং ভিতরে অসিতে পারিবে। কিন্তু প্রত্যেক দ্রব্যের আধারভাণ্ডে মুদ্রা বা মোহর অঙ্কিত থাকা চাই (অর্থাৎ বিনা মোহরে কোন দ্রব্য বাহিরেও যাইবে না, ভিতরেও আসিবে না।

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে বিনয়াধিকারিক-নামক প্রথম অধিকরণে নিশান্তপ্রণিধি-নামক বিংশ অধ্যায় সমাপ্ত।

.

একবিংশ অধ্যায়
১৮শ প্রকরণ—আত্মরক্ষা

(প্রাতঃকালে) শয্যা হইতে উখিত হওয়ার পর, (রাজা) ধতুষ্পাণি স্ত্রীগণদ্বারা পরিবৃত হইবেন। দ্বিতীয় কক্ষ্যাতে কষ্ণুক ও উষ্ণৗষধারী হইয়। (অর্থাৎ শরীরে কুর্ত ও মাথায় পাগড়ী পরিয়া) বর্ষবরেরা (নপুংসকের) ও অন্যান্ত গৃহকাৰ্য্যাধিকৃত পুরুষেরা (রাজাকে বেষ্টন করিবে)। তৃতীয় কক্ষ্যাতে, (তিনি) কুজ, বামন (খৰ্ব্বাকৃতি পুরুষ) ও কিরাতজাতীয় পুরুষগণদ্বারা (পরিবৃত থাকিবেন)। (তিনি) চতুর্থ, কক্ষ্যাতে, মন্ত্রিগণ, সম্বন্ধিগণ (অর্থাৎ আত্মীয়বান্ধবগণ) ও হস্তে প্রাস-নামক (কুম্ভ-নামক) অস্থধারী দৌবারিকগণ (দ্বারপালগণ) দ্বারা (পারিবেষ্টিত থাকিবেন)।

রাজা এমন জনকে আসন্নচারী (অর্থাৎ স্বদেহরক্ষাকারী) নিযুক্ত করিবেন, যাহারা পিতৃপৈতামহ (অর্থাৎ বংশপরম্পরাপ্রাপ্ত), মহাকুলীনদিগের সহিত সম্পর্কযুক্ত, শিক্ষিত, অতুরক্ত (রাজভক্ত) ও কৃতকৰ্ম্মা (অর্থাৎ কৰ্ম্মকরণে অভিজ্ঞতাযুক্ত)। যাহার প্রতি কোনও প্রকার ধনাদি দান বা সম্মানপ্রদর্শন করা হয় নাই এমন অন্যদেশবাসীকে, অথবা, পূৰ্ব্বে যাহার অপকার করা হইয়াছিল এবং যে পরে আবার স্বীকৃত হইয়াছে এমন স্বদেশবাসী জনকেও (তিনি আসন্নচারী নিযুক্ত করিবেন না)। অন্তর্বংশিকের (অর্থাৎ অন্তঃপুরে অধিকৃত প্রধান পুরুষের) সৈন্য রাজাকে ও অন্ত:পুরস্থিত স্ত্রীগণকে রক্ষা করিবে।

সুগুপ্ত প্রদেশে (রাজার) মহানসিক (পাকশালাধিকৃত প্রধান পুরুষ) সৰ্ব্বপ্রকার খাদ্যদ্রব্যের পাককৰ্ম্ম, স্বাদাধিক্যের প্রতি লক্ষ্য করিয়া সম্পাদন করাইবে। রাজা সেই সব (সাধিত) খাদ্যদ্রব্য প্রথমে অগ্নিদেবকে ও পক্ষিগণকে বলিস্বরূপ প্রদান করিয়া, সেইভাবেই (অর্থাৎ নবপ্রস্তুত দ্রব্য হিসাবেই) আহার করিবেন।

(অগ্নিতে খাদ্যপ্রক্ষেপ ও পক্ষীকে খাদ্যবলি প্রদানের হেতু বলা হইতেছে, যথা—) বিষময়খাদ্যযুক্ত অগ্নির জালা ও ধুম নীলবর্ণ হইয়া পড়ে (অর্থাৎ বিষদিগ্ধ অন্নাদি অগ্নিতে প্রক্ষিপ্ত হইলে অগ্নির প্রভা ও ধূম নীলাকার ধারণ করে); ইহাতে (চটচট্ট) শব্দ স্ফোটিত হয় এবং সেইরূপ খাদ্য পক্ষীরা খাইলে তাহাদেরও মরণ ঘটে। বিষমিশ্র অন্নের বাষ্প ময়ূর-কণ্ঠের ন্যায় বর্ণযুক্ত হয়, ইহা শীঘ্র ঠাণ্ডা হয়, (কর-) সংপিষ্ট দ্রব্যের ন্যায় ইহা বিবর্ণ হয়, ইহা জলযুক্ত হইয়া পড়ে উবং ইহা অক্লেদযুক্ত অর্থাৎ শুষ্কও হইয়া যাইতে পারে। (বিষমিশ্র) ব্যঞ্জন (স্পাদি দ্রব্য) শীঘ্র শুষ্ক হইয়া যায়, তাহাতে কাৰ্থ হয় অর্থাৎ অগ্নিযোগেও অপক্ক থাকে, ইহাতে সংজাত খামবর্ণের ফেনপটল বিচ্ছিন্ন ভাব ধারণ করে (অর্থাৎ ব্যঞ্জন হইতে ফেনপটল পৃথক হইয়া যায়), এবং ইহার (স্বাভাবিক) গন্ধ, স্পর্শ ও রসের (আস্বাদনের) নাশ ঘটে। দ্রববস্তু অর্থাৎ তরল পদার্থ (বিষমিশ্র হইলে), ইহাতে প্রতিফলিত (নিজের) ছায়া হীন (ছোট) বা অতিরিক্ত (বড়) দেখা যায় এবং ইহার ফেনপটলে বিভাগ দৃষ্ট হয়, ও ইহার উদ্ধে রেখা দৃষ্ট হয়। (ঘৃতাদি রসদ্রব্য বিষমিশ্র হইলে) ইহার মধ্যে নীলবর্ণের রেখা, দুগ্ধ (বিষমিশ্র হইলে) ইহার মধ্যে তাম্রবর্ণের রেখা, মদ্য ও জল (বিষমিশ্র হইলে) ইহাদের মধ্যে কাল বর্ণের রেখা, দধি (বিষমিশ্র হইলে) ইহার মধ্যে স্যামবর্ণের রেখা এবং মধু (বিষমিশ্র হইলে) ইহার মধ্যে শ্বেতবর্ণের রেখা দৃষ্ট হয়। (আম্র প্রভৃতি) আর্দ্র দ্রব্যসমূহ (বিষমিশ্র হইলে) শীঘ্র শুকাইয়া যায়, অতি পকভাব ধারণ করে এবং বিশেষভাবে পাকিলে নীল ও কপিশবর্ণ হইয়া উঠে। শুষ্ক দ্রব্যসমূহ (বিষমিশ্র হইলে) শীঘ্রই চূর্ণিত হইয়া যায় এবং বিবর্ণ হইয় উঠে। কঠিন দ্রব্যসমূহ (বিষমিশ্র হইলে) মৃদু হইয়া যায়, এবং মৃদু দ্রব্য (বিষমিশ্র হইলে) কঠিন হইয়া যায়। বিষমিশ্র দ্রব্যসমূহের নিকট সঞ্চরণশীল (পিপীলিকাদি) ক্ষুদ্র প্রাণীরা প্রাণ হারায়। আস্তরণ (বিছানার কম্বলাদি) ও প্রাবরণ (উর্ণা-বস্ত্রাদি) (বিষমিশ্র হইলে) ইহাদের স্থানে স্থানে শু্যামবর্ণের মণ্ডল দুষ্ট হয় এবং ইহাদের স্বত্ব ও রোমসমূহের পক্ষ্মগুলি (সূক্ষ্মাংশগুলি) খসিয়া পড়ে। লোহ (স্বর্ণাদি ধাতু) ও মণিময় দ্রব্যসমূহ (বিষমিশ্র হইলে) ইহাদের উপর পঙ্কমলের লেপ পতিত হয় এবং ইহাদের স্নেহ (চাকচিক্য), রাগ (রঙ,), গৌরব (গুরু ওজন), প্রভাব (স্বকাৰ্য্যকরণশক্তি), এবং বর্ণ ও স্পর্শগুণের নাশ ঘটে। এই পৰ্য্যন্ত বিষযুক্ত দ্রব্যসমূহের চিহ্ন নিরূপিত হইল।

যে ব্যক্তি অন্যের উপর বিষ প্রদান করে, তাহার মুখ শুষ্ক ও কপিলবর্ণ হইয়া যায়, তাহার (কথাবাৰ্ত্তাকালে) বাক্যপ্রতিবন্ধ উপস্থিত হয়, (শরীরে) ঘৰ্ম্ম দেখা দেয়, মুখে বিজম্ভন বা হাই উঠা লক্ষিত হয়, (শরীরে) অত্যধিক কম্প উপস্থিত হয়, (পথ পরিষ্কার থাকিলেও ইহাতে) তাহার পদস্খলন ঘটে, কেহ কথা বলিলে (“আমার সম্বন্ধেই কথা হইতেছে’ ইহা মনে করিয়া) সেই দিকে তাকাইয়া থাকে, (এক চিন্তায়ই) তাহার মন আবিষ্ট থাকে, এবং এক কৰ্ম্মে ও এক স্থানে সে লাগিয়া থাকিতে পারে না।

অতএব, রাজা স্বসমীপে বিষবৈদ্য ও (অন্যান্য) চিকিৎসক (নিযুক্ত) রাখিবেন।

রাজার ভিষক (গৃহচিকিৎসক) ঔষধশালা হইতে নিজ আস্বাদনৰ্দ্ধারা বিশুদ্ধ বলিয়া পরীক্ষিত ঔষধ লইয়া, (ঔষধের) পাচক ও পেষককে (পেষণকারীকে) তাহা খাওয়াইবে এবং নিজেও তাহা খাইয়া, পরে তাহা রাজাকে (ব্যবহারার্থ) দিবেন। এতদ্দ্বারা ঔষধের ন্যায় মদ্য ও জল শোধিত করিয়া তাহা রাজাকে ব্যবহার করিতে দিতে হইবে—তাহাও ব্যাখ্যাত হইল।

কল্পক (নাপিত) ও প্রসাধক (বস্বালঙ্কারাদি প্রসাধনের বিধানকারী সেবক) স্বয়ং স্নানপূর্ব্বক শুদ্ধবস্ত্র পরিধান করিয়া, শুদ্ধ হস্তে মুদ্রাযুক্ত (ক্ষুরবস্ত্রাদি) অন্তর্বংশিকের (অন্তঃপুরস্থ প্রধান অধিকারীর) হস্ত হইতে লইয়া (রাজার) পরিচর্য্যা কাৰ্য্যে-ব্যাপৃত হইবে।

(রাজভবনে) দাসীরা (রাজার সম্বন্ধে) স্বাপক (স্নানকরানের পরিচারক), সংবাহক (অঙ্গমৰ্দ্দনকারী), আস্তরক (আসন ও শয্যাদির রচনাকারী), রজক ও মালাকারের কার্য্য নিজেরা সম্পাদন করিবে; অথবা, দাসীগণদ্বারা অধ্যক্ষিত হইয়া তৎ তৎ শিল্পীরাও রাজার সম্বন্ধে নিজ নিজ কাৰ্য্য করিতে পারে। তাহারা নিজ নিজ চক্ষুতে বস্ত্র ও মাল্য নিবেশিত করিয়া (পরে রাজাকে) দিবে এবং স্বানে ব্যবহর্তব্য অনুলেপন (চন্দনাদি), প্রঘর্ষ (গাত্রঘর্ষণদ্রব্য), চূর্ণবাস (স্বগন্ধ চূর্ণাদি—আধুনিক কালের পাউডার ইত্যাদি) ও স্বানীয় (মস্তকাদিতে স্নানসময়ে দেয় সুগন্ধি তৈলাদি) তাহারা নিজ নিজ বক্ষঃস্থলে ও বাহুতে স্পর্শ করাইয়া—(রাজাকে) দিবে। ইহা দ্বারা পরদেশ হইতে প্রাপ্ত ভোগ্যবস্তুর উপযোগ ব্যাখ্যাত হইল—বুঝিতে হইবে।

(রাজসমীপে) কুশীলবেরা (নটনৰ্ত্তকাদি শিল্পীরা), সঙ্গে শস্ত্র, অগ্নি ও বিষ না লইয়া নৰ্ম্মক্রীড়া (খেলাদি) দেখাইবে। এবং তাহাদের ক্রীড়াদির সাধনস্বরূপ যে সব বাদ্যভাণ্ডের প্রয়োজন হইবে সেগুলি রাজবাড়ীর মধ্যে থাকিবে এবং অশ্ব, রথ, হস্তী ও (বিভিন্ন) অলঙ্কারও সেখানে থাকিবে (অর্থাৎ, বিষযোগাদির আশঙ্কানিরাকরণার্থ সে সব দ্রব্য, রাজবাড়ী হইতেই, তাহারা ক্রীড়া দেখাইবার সময়ে পাইবে)।

(রাজা) আগু প্রধানপুরুষদ্বারা অধিষ্ঠিত যানে (শিবিকাশকটাদিতে) ও বাহনে (অশ্বাদিতে) আরোহণ করিবেন এবং বিশ্বস্ত নাবিকদ্বারা অধিষ্ঠিত নৌকা ব্যবহার করিবেন। অন্য নৌকা সহ প্রতিবদ্ধ নৌকা ও বায়ুবেগের বশগামিনী নৌকা (তিনি) ব্যবহার করিবেন না। (রাজা নৌকাতে চলিতে থাকিলে) জলের উভয় পার্থে (রক্ষার্থ) সৈন্য থাকিবে।

মৎস্য ও অন্যান্য (কুম্ভীরাদি) জলজন্তুশুদ্ধ অর্থাৎ তদ্বিহীন জলে (তিনি) স্নানার্থ অবগাহন করিবেন (মৎস্তগ্রাহ-শব্দদ্বারা মৎসগ্রহণশীল ধীবরকেও বুঝা যাইতে পারে—অর্থাৎ ধীবরের তিমিনক্রাদি শূন্য বলিয়া জলের নির্দেশ দিলে রাজা তাহাতে স্নান করিতে পারেন)। উদ্যান সপাদি হিংস্ৰজন্তগ্রাহীদিগের নির্ণয়দ্বারা পরিশুদ্ধ বলিয়া জানিলে, (তিনি) সেই উদ্যানে যাইবেন।

যে মৃগবনে ব্যাধ ও চণ্ডালগণস্বারা চোর ও হিংস্ৰজন্তু হইতে আশঙ্কনীয় উপদ্রবের ভয় দূরীকৃত হইয়াছে, চঞ্চল মুগাদির প্রতি লক্ষ্যের অভ্যাস করার জন্য (তিনি) সেই মৃগবনে যাইতে পারেন।

বিশ্বস্ত শস্ত্রধারী দ্বারা অধিষ্ঠিত হইয়া (রাজা নবাগত) সিদ্ধপুরুষ ও তপস্থিজনের সহিত দেখা করিবেন এবং মন্ত্রিপরিষৎ দ্বারা অধিষ্ঠিত হইয়া (তিনি) সামন্তরাজগণের দূতের সহিত দেখা করিবেন।

শিরস্ত্রাণ ও কবচাদিদ্বারা সজ্জিত হইয়া, অথবা, অশ্ব, হস্তী বা রথে আরোহণ করিয়া (রাজা) যুদ্ধসজ্জা ও সেনা দর্শন করিবেন।

রাজা (নগর হইতে) বাহিরে নিস্ক্রমণ ও (নগরমধ্যে) প্রবেশ করার সময়ে, এমন পথ দিয়া যাইবেন যাহার উভয় পার্শ্বে রক্ষিপুরুষেরা রক্ষাকাৰ্য্যে ব্যাপৃত আছে এবং যাহাতে দণ্ডধারী পুরুষেরা, শস্ত্রপাণি লোককে, সন্ন্যাসীকে ও অঙ্গবিহীন জনগণকে দূরে অপসারিত রাখিয়াছে। (রাজা) জনসঙ্কল প্রদেশে প্রবেশ করিবেন না। (তিনি) দশবগিক (অর্থাৎ দশজন ভটের নায়ক) দ্বারা অধিষ্ঠিত হইয়া যাত্র (দেবতাদিগের রথযাত্রা প্রভৃতি শোভাযাত্রা), সমাজ (আনন্দার্থ বহুলোকের মিলনসভা), উৎসব (বসন্তে।ৎসবাদি) ও প্রবহণে (শকটাদি আরোহণে, মতান্তরে, উদ্যানভোজদিতে) যোগ দিবেন।

রাজা যেমন কাপটিক গূঢ়পুরুষগণদ্বারা অন্য নৃপতিদিগের বাধা উপস্থিত করেন, তেমন তিনি নিজে ও প্রযত্নবান হইয়া অন্য নৃপতিদিগের উৎপাদ্যমান উপদ্রব হইতে নিজেকে রক্ষা করিবেন ॥ ১ ॥

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে বিনয়াধিকারিক-নামক প্রথম অধিকরণে আত্মরক্ষা-নামক একবিংশ অধ্যায় সমাপ্ত। প্রথম অধিকরণ সমাপ্ত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *