০১. বাস থেকে নেমে

ভূমিকা – শঙ্খনীল কারাগার (১৯৭৩)

সোমেন চন্দের লেখা অসাধারণ ছোট গল্প ইন্দুরা পড়ার পরই নিম্ন মধ্যবিত্তদের নিয়ে গল্প লেখার একটা সুতীব্র ইচ্ছা হয়। নন্দিত নরকে, শঙ্খনীল কারাগার ও মনসুবিজন নামে তিনটি আলাদা গল্প প্ৰায় সঙ্গে সঙ্গেই লিখে ফেলি। নিজের উপর বিশ্বাসের অভাবের জন্যেই লেখাগুলি দীর্ঘদিন আড়ালে পড়ে থাকে। যাই হোক, জনাব আহমদ ছফা ও বন্ধু রফিক কায়সারের আগ্রহে নন্দিত নরকে প্রকাশিত হয় মাস ছয়েক আগে। এবারে প্রকাশিত হল শঙ্খনীল কারাগার।

নন্দিত নরকের সঙ্গে এই গল্পের কোনো মিল নেই। দুটি গল্পই উত্তম পুরুষে বলা এবং নিম মধ্যবিত্তের গল্প এই মিলটুকু ছাড়া। নাম ধাম দুটি বইতেই প্রায় একই রেখেছি। প্রথমত নতুন নাম খুঁজে পাই নি বলে, দ্বিতীয়ত এই নামগুলির প্রতি আমি ভয়ানক দুর্বল বলে। কার্যকরণ ছাড়াই যেমন কারো কারো কিছু কিছু দুর্বলতা থাকে, এও সেরকম।

আন্তরিক চেষ্টা থাকা সত্ত্বেও কিছু কিছু ছাপোর ভুল রয়ে গেছে। ভুলগুলি অন্যমনস্ক পাঠকের চোখ এড়িয়ে যাবে এইটুকুই যা ক্ষীণ আশা।

হুমায়ূন আহমেদ

 

০১.

বাস থেকে নেমে হকচকিয়ে গেলাম। বৃষ্টিতে ভেসে গেছে সব। রাস্তায় পানির ধারাস্রোত। লোকজন চলাচল করছে না, লাইটপোস্টের বাতি নিভে আছে। অথচ দশ মিনিট আগেও যেখানে ছিলাম, সেখানে বৃষ্টির নামগন্ধ নেই। শুকনো খটখট করছে চারদিক। কেমন অবাক লাগে ভাবতে, বৃষ্টি এসেছে, রূপ রূপ করে একটা ছোট্ট জায়গা ভিজিয়ে চলে গেছে। আর এতেই আশৈশব পরিচিত এ অঞ্চল কেমন ভৌতিক লাগছে। হাঁটতে গা ছমছম করে।

রাত নটাও হয় নি, এর মধ্যেই রশীদের চায়ের স্টল বন্ধ হয়ে গেছে। মডার্ণ লন্দ্ৰিও বীপ ফেলে দিয়েছে। এক বার মনে হল হয়তো আমার নিজের ঘড়িই বন্ধ হয়ে আছে। রাত বাড়ছে ঠিকই, টের পাচ্ছি না। কানের কাছে ঘড়ি ধরতেই ঘড়ির আওয়াজ ছাপিয়ে মন্টুর গলা শোনা গেল।

রাস্তার পাশে নাপিতের যে-সমস্ত ছোট ছোট টুলকাঠের বাক্স থাকে, তারই একটায় জড়সড় হয়ে বসে আছে। আলো ছিল না বলেই এতক্ষণ নজরে পড়ে নি। চমকে বললাম, মন্টু কী হয়েছে রে?

কিছু হয় নি।

স্পঞ্জের স্যাণ্ডেল হাতে নিয়ে মন্টু টুলবাক্স থেকে উঠে এল। কাদায় পানিতে মাখামাখি। ধরা গলায় বলল, পা পিছলে পড়েছিলাম, স্যাণ্ডেলের ফিতে ছিঁড়ে গেছে।

এত রাতে বাইরে কী করছিলি?

তোমার জন্যে বসে ছিলাম, এত দেরি করেছ কেন?

বাসায় কিছু হয়েছে মন্টু?

না, কিছু হয় নি। মা আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে, বলেছে ভিক্ষে করে খেতে।

মন্টু শার্টের লম্বা হাতায় চোখ মুছতে লাগল।

টুলুদের বাসায় ছিলাম, টুলুর মাস্টার এসেছে। সে জন্যে এখানে বসে আছি।

কেউ নিতে আসে নি?

রাবেয়া আপা এসে চোর আনা পয়সা দিয়ে গিয়েছে, বলেছে তুমি আসলে তোমাকে নিয়ে বাসায় যেতে।

মন্টু আমার হাত ধরল। দশ বছরের একটা বাচ্চা ছেলে সন্ধ্যা থেকে বসে আছে বাইরে, এর ভেতর ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে, বাতিটাতি নিভিয়ে লোকজন ঘুমিয়েও পড়েছে। সমস্ত ব্যাপারটার ভেতরই বেশ খানিকটা নির্মমতা আছে। অথচ মাকে এ নিয়ে কিছুই বলা যাবে না। বাবা রাত দশটার দিকে ঘরে ফিরে যখন সব শুনবেন, তখন তিনি আরো চুপ হয়ে যাবেন। মুখ কালো করে ঘুরে বেড়াবেন এবং একদিন ক্ষতিপূরণ হিসেবে চুপি চুপি হয়তো একটি সিনেমাও দেখিয়ে আনবেন।

দাদা, রুনুকেও মা তালা বন্ধ করে রেখেছে। ট্রাঙ্ক আছে যে ঘরটায়, সেখানে।

রুণু কী করেছে?

আয়না ভেঙেছে।

আর তুই কী করেছিলি?

আমি কিছু করি নি।

ঝুনু বারান্দায় মোড়া পেতে চুপচাপ বসেছিল। আমাদের দেখে ধড়মড় করে উঠেজ দাঁড়াল।

দাদা, এত দেরি করলে কেন? যা খারাপ লাগছে।

কী হয়েছে, ঝুনু?

কত কি হয়েছে, তুমি রাবেয়া আপনাকে জিজ্ঞেস কর।

গলার শব্দ শুনে কুশবেয়া বেরিয়ে এল। চোখে ভয়ের ভাবভঙ্গি প্রকট হয়ে উঠেছে। চাপা গলায় বলল, মার ব্যথা শুরু হয়েছে রে খোকা, বাবা তো এখনো আসল না, কী করি বল তো?

কখন থেকে?

আধা ঘণ্টাও হয় নি। মার কাছ থেকে চাবি এনে দরজা খুলে দেব রুনুর, সেই জন্যে গিয়েছি–দেখি এই অবস্থা।

ভেতরের ঘরে পা দিতেই রুনু ডাকল, ও দাদা, শুনে যাও। মারা কী হয়েছে দাদা?

কিছু হয় নি।

কাঁদছে কেন?

মার ছেলে হবে।

অ। দাদা তালাটা খুলে দাও, আমার ভয় লাগছে।

একটু দাঁড়া, রাবেয়া চাবি নিয়ে আসছে।

এখান থেকে মায়ের অস্পষ্ট কান্না শোনা যাচ্ছে। কিছু কিছু কান্না আছে, যা শুনলেই কষ্টটা সম্বন্ধে শুধু যে একটা ধারণাই হয় তাই নয়, ঠিক সেই পরিমাণ কষ্ট নিজেরও হতে থাকে। আমার সেই ধরনের কষ্ট হতে থাকল।

রাবেয়া এসে রুনুর ঘরের তালা খুলে দিল। রাবেয়া বেচারি ভীষণ ভয় পেয়েছে।

তুই এত দেরি করলি খোকা, এখন কী করি বল? ওভারশীয়ার কাকুর বউকে খবর দিয়েছি, তিনি ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে আসছেন। তুই সবাইকে নিয়ে খেতে আয়, শুধু ডালভাত। যা কাণ্ড সারা দিন ধরে, রাধব কখন? মার মেজাজ এত খারাপ আগে হয় নি।

হড়বড় করে কথা শেষ করেই রাবেয়া রান্নাঘরে চলে গেল। কলঘরে যেতে হয় মার ঘরের সামনের বারান্দা দিয়ে। চুপি চুপি পা ফেলে যাচ্ছি, মা তীক্ষ্ণ গলায় ডাকলেন, খোকা।

কি মা?

তোর বাবা এসেছে?

না।

আয় ভেতরে, বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?

ব্যথাটা বোধহয় কমেছে। সহজভাবে নিঃশ্বাস নিচ্ছেন। মার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম আর ফ্যাকাশে ঠোঁট ছাড়া অসুস্থতার আর কোনো লক্ষণ নেই।

খোকা, মন্টু এসেছে?

এসেছে।

আর রুনুর ঘর খুলে দিয়েছে রাবেয়া?

দিয়েছে।

যা, ওদের নিয়ে আয়।

রুণু ঝুনু আর মন্টু জড়সড় হয়ে দাঁড়াল সামনে। কিছুক্ষণ চুপ থেকেই মা বললেন, কাঁদছ কেন রুনু?

কাঁদছি না তো।

বেশ, চোখ মুছে ফেল। ভাত খেয়েছ?

না।

যাও, ভাত খেয়ে ঘুমাও গিয়ে।

মন্টু বলল, মা, আমি বাবার জন্যে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকব?

না-না। ঘুমাও গিয়ে। রুনু মা, কাঁদছ কোন তুমি?

কাঁদছি না তো।

আমার কিছু হয় নি, সবাই যাও, ঘুমিয়ে পড়। যাও, যাও।

ঘর থেকে বেরিয়েই কেমন যেন খারাপ লাগতে লাগল আমার। আমাদের এই গরিব ঘর, বাবার অল্প মাইনের চাকরি। এর ভেতরে মা যেন সম্পূৰ্ণ বেমানান।

বাবার সঙ্গে তাঁর যখন বিয়ে হয়। তিনি ৩ খন ইতিহাসে এম. এ. পরীক্ষা দেবেন। আর বাবা তাঁদের বাড়িরই আশ্রিত। গ্রামের কলেজ থেকে বি. এ. পাশ করে চাকরি খুঁজতে এসেছেন শহরে। তাঁদের কী-যেন আত্মীয় হন।

বিয়ের পর এই বাড়িতে এসে ওঠেন দু জন। মার পরীক্ষা দেওয়া হয় নি। কিছু দিন কোনো এক স্কুলে মাস্টারি করেছেন। সেটি ছেড়ে দিয়ে ব্যাঙ্কে কী-একটা চাকরিও নেন। সে চাকরি ছেড়ে দেন। আমার জন্মের পরপর। তারপর একে একে রুণু হল, ঝুনু হল, মন্টু হল–মা গুটিয়ে গেলেন নিজের মধ্যে।

সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে মা আমাদের গরিব ঘরে এসেছেন বলেই তাঁর সামান্য রূপের কিছু কিছু আমরা পেয়েছি। তাঁর আশৈশব লালিত রুচির কিছুটা (ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ হলেও) সঞ্চারিত হয়েছে আমাদের মধ্যে। শুধু যার জন্যে ভূষিত হয়ে আছি, সেই ভালোবাসা পাই নি কেউ। রাবেয়ার প্রতি একটি গাঢ় মমতা ছাড়া আমাদের কারো প্রতি তার কোনো আকর্ষণ নেই। মারি অনাদর খুব অল্প বয়সে টের পাওয়া যায়, যেমন আমি পেয়েছিলাম। রুনু ঝনুও নিশ্চয়ই পেয়েছে। অথচ আমরা সবাই মিলে মাকে কী ভালোই না বাসি।

উকিল সাহেবের বাসায় টেলিফোন আছে। সেখান থেকে ছোট খালার বাসায় টেলিফোন করলাম। ছোট খালা বাসায় ছিলেন না, ফোন ধরল কিটকি।

কী হয়েছে বললেন খোকা ভাই?

মার শরীর ভালো নেই।

কী হয়েছে খালার?

কী হয়েছে বলতে গিয়ে লজ্জায় মাথা কাটা যাচ্ছিল, এদিকে উকিল সাহেব আবার কান খাড়া করে শুনছেন কী বলছি। কোনো রকমে বললাম, মার ছেলে হবে কিটকি।

আপনাদের তো ভারি মজা, কতগুলি ভাই-বোন। আমি একদম একা।

কিটকি, খালাকে সকাল হলেই বাসায় এক বার আসতে বলবে।

হ্যাঁ বলব। আমিও আসব–।

 

মার বাড়ির লোকজনের ভেতর এই একটিমাত্র পরিবারের সঙ্গে আমাদের কিছুটা যোগাযোগ আছে। ছোট খালা আসেন মাঝে মাঝে। কিটকির জন্মদিন, পুতুলের বিয়ে–এই জাতীয় উৎসবগুলিতে দাওয়াত হয়। রুনু-ঝুনুর।

বাসায় ফিরে দেখি বাবা এসে গেছেন। ওভারশীয়ার কাকুর বউ এসেছেন, ধাই সুহাসিনীও এসেছে। রান্নাঘরে বাতি জ্বলছে। রাবেয়া ব্যস্ত হয়ে এঘর-ওঘর করছে। বাবা ভেতরের বারান্দায় ইজিচেয়ারে শুয়ে ঘন ঘন সিগারেট খাচ্ছেন। আমাকে দেখে যেন একটু জোর পেলেন। তোর ছোটখালাকে খবর দিয়েছিস খোকা?

জ্বি দিয়েছি। আপনি কখন এসেছেন? আমার একটু দেরি হয়ে গেল। তোর আজিজ খাঁকে মনে আছে? ঘড়ির দোকান ছিল যে, আমার খুব বন্ধুমানুষ। সে হঠাৎ মারা গেছে। গিয়েছিলাম তার বাসায়।

বাবা যেন আমার কাছে কৈফিয়ৎ দিচ্ছেন, এমন ভাব-ভঙ্গি করতে লাগলেন, আজিজ খাঁর বউ ঘন ঘন ফিট হচ্ছে। এক বার মনে করলাম থেকেই যাই। ভাগ্য ভালো থাকি নি, নিজের ঘরে এত বড়ো বিপদ।

বিপদ কিসের বাবা?

না। বিপদ অবশ্যি নয়। কিন্তু রাতে এমন একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছি। যতবারই মনে হয়, হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে। কিছুক্ষণ আগে রাবেয়াকে বলেছি সে-কথা।

কী স্বপ্ন?

না-না, রাতের বেলা কেউ স্বপ্ন বলে নাকি রে? যা তুই, রাবেয়ার কাছে গিয়ে বস একটু।

 

ঘরে যদিও অনেকগুলি প্ৰাণী জেগে আছি। তবু চারদিক খুব বেশিরকম নীরব। রান্নাঘরে দু-একটি বাসনকেশন নাড়ার শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। বাবা অবশ্যি মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে কী যেন বলছেন। তাঁর একা একা কথা বলার অভ্যাস আছে। মাঝে মাঝে যখন মেজাজ খুব ভালো থাকে, তখন গুনগুন করে গানও গান। কথা বোঝা যায় না, ও মন মন রে এই লাইনটি অস্পষ্ট শোনা যায়। রাবেয়া বলে, বাবার নৈশ সংগীত। রাবেয়াটা এমন ফাজিল।

রান্নাঘরে গিয়ে দেখি একটা মস্ত এলুমোনিয়ামের সসপ্যানে পানি ফুটছে। রাবেয়ার ঘুম ঘুম ফোলা মুখে আগুনের লাল আঁচ এসে পড়েছে। সে আমার দিকে তাকিয়ে কি ভেবে অল্প হাসল। আমি বললাম, হাসছিস যে?

এমনি। সুহাসিনী মাসির আমি কী নাম দিয়েছি জানিস?

কী নাম?

কুহাসিনী মাসি। ওর হাসি শুনলেই আমার গা জ্বলে। একটু আগে কী বলেছে। छोनिन?

কী বলেছে?

থাক, শুনে কাজ নেই।

বল না?

বলে, আজ তোমার মার জনো এসেছি, এক দিন তোমার জন্যেও আসব খুকি।  বলতে বলতে রাবেয়া মুখ নিচু করে হাসল। সে মনে হল কথাটা বলে ফেলে বেশ লজ্জা পেয়েছে। হঠাৎ করে ব্যস্ত হয়ে কী খুজতে লাগল মিটসোফে। আমি বললাম, ৩োর ভাবভঙ্গি দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ খুশিই হয়েছিস শুনে।

তুই একটা গাধা।

লজ্জায় ব্রাবেয়া লাল হয়ে উঠল। আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললাম লজ্জা পাওয়ার কী হয়েছে?

যা! লজ্জা পেলাম কোথায়, তোর যে কথা! যাই, দেখে আসি রুনু-ঝনুরা মশারি ফেলে ঘুমিয়েছে কি না, যা মশা!

 

রাবেয়া আমার পাঁচ বৎসরের বড়ো। এই বয়সে মেয়েরা খুব বিয়ের কথা ভাবে। তাদের অন্তরঙ্গ সখীদের সাথে বিয়ে নিয়ে হাসাহাসি করে। রাবেয়ার একটি বন্ধুও নেই। আমিই তার একমাত্র বন্ধু। সুহাসিনী মাসির সেই কথাটি হয়তো এই জন্যেই বলেছিল আমাকে। আর আমি এমন গাধা, তাকে উন্টো লজ্জা দিয়ে ফেললাম। মেয়েরা লজ্জা পেলে এত বেশি অপ্রস্তুত হয় যে, যে লজ্জা দিয়েছে তার অস্বস্তির সীমা থাকে না।

ঘরে খুব হৈহৈ করে বেড়ালেও রাবেয়া ভীষণরকম লাজুক। কলেজে যাওয়া বন্ধ করার ব্যাপারটিই ধরা যাক। তিন বছর আগে হঠাৎ এক দিন এসে বলল, বাবা, আমি আর কলেজ করব না।

বাবা অবাক হয়ে বললেন, কেন মা?

এমনি।

মা বললেন, রাবেয়া, তোমাকে কি কেউ কিছু বলেছে?

না মা, কেউ কিছু বলে নি।

কোনো চিঠিফিটি দিয়েছে নাকি কোনো ছেলে?

না মা। আমাকে চিঠি দেবে কেন?

তবে কলেজে যাবে না কেন?

এমনি।

না, এমনি না। বল তোমার কী হয়েছে?

রাবেয়া হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল, মা, ছেলেরা আমাকে মা কালী বলে ডাকে।

আমাদের ভেতর রাবেয়াই শুধু মার রং পায় নি। যতটুকু কালো হলে মায়েরা মেয়েদের শ্যামলা বলেন, রাবেয়া তার চেয়েও কালো। কিন্তু ছেলেরা শুধু গায়ের রংটাই দেখল?

 

ও ছেলে।

তাকিয়ে দেখি সুহাসিনী মাসি। ধবধব করছে গায়ের রং, ফোলা ফোলা চোখে এক বেমানান চশমা। আমি উঠে দাঁড়ালাম।

খামাখা তোমার বাবা আমার ঘুম ভাঙিয়ে এনেছে, এখনো অনেক দেরি। নটার আগে নয়।

আমি চুপ করে রইলাম। সুহাসিনী মাসি বললেন, মেয়েটি কই? লম্বামতো মেয়েটি?

আসবে এক্ষণি, কেন?

এক কাপ চা করে দিতে বলতাম।–এই যে, ও খুকি, মাসিকে চা করে দাও না এক কাপ।

রাবেয়া হাসিমুখে বলল, দিই, আপনি বসবেন এখানে?

না, আমি একটু শোব ভেতরের ইজিচেয়ারে।

রাবেয়া তাকাল আমার চোখে চোখে, তোর লাগবে নাকি এক কাপ?

দে।

তাহলে পাঁচ কাপ দি। বাবাকে এক কাপ, আমার নিজের দু কাপ।

রাবেয়া চায়ের সরঞ্জাম সাজাতে লাগল। অভ্যস্ত নিপুণ হাত, দেখতে ভালো লাগে। আমি বললাম, মাসির বয়স কত রে?

অনেক। আমি ছাড়া সবাই তো তার হাতে। দেখলে মনে হয় না, তাই না?

হুঁ। মার ব্যথাটা একটু কম মনে হয়।

ছ বার মা এমন কষ্ট পেলেন। তোরা তো সুখে আছিস, কষ্ট যা তা তো মেয়েদেরই। পেটে ছেলে-মেয়ে আসা মানেই এক পা কবরে রাখা।

আমি বললাম, কষ্টটা যদি পুরুষরাও পেত, তাহলে তুই খুশি হতি?

জানি না।

বলেই রাবেয়া হঠাৎ কী মনে করে হাসতে লাগল। হাসির উচ্ছাসে পেয়ালার দুধ গেল উন্টে, অচল খসে পড়ল মেঝেয়।

অবাক হয়ে বললাম, হাসির কী হয়েছে? এত হাসছিস কেন?

একটা গল্প মনে পড়ছে, তাই হাসছি।

কী গল্প?

বাজে গল্প, তবে খুব মজার। শুনলে তুই নিজেও হাসবি। শুনবি?

বল।

একদল মেয়ে আল্লাহর কাছে নালিশ করল। তাদের বক্তব্য ছেলেমেয়ে হওয়ার ব্যথাটা শুধু মেয়েদেরই হবে কেন? এবার থেকে ছেলেদেরও হতে হবে, ব্যথার ভাগও সমান সমান। আল্লাহ বললেন, ঠিক আছে, তাই হবে। তারপর হল কি শোন। মেয়েদের এই দলটির যিনি প্রেসিডেন্ট ছিলেন তাঁর ব্যথা শুরু হল। কিন্তু কি আশ্চর্য স্বামী বেচারা দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কোনো ব্যথা-ফ্যতা নেই। এদিকে তাদের গাড়ির ড্রাইভার ছুটির দরখাস্ত করেছে, তার নাকি হঠাৎ ভীষণ ব্যথা শুরু হয়েছে পেটে।

তারপর?

তারপর আবার কি? মেয়েরা বলল, আল্লাহ তোমার পায়ে পড়ি। ব্যথার ভাগাভাগি আর চাই না। আমাদের কষ্ট আমাদেরই থােক। তুই হাসলি না একটুও, আগে শুনেছিস নাকি?

না।

তবে?

নোংরা গল্প, তাই হাসলাম না।

ওঃ।

রাবেয়া চায়ের পেয়ালা হাতে বেরিয়ে গেল। সে খুব অপ্রস্তুত হয়েছে। চোখ লজ্জায় ভিজে উঠেছে। আমার খারাপ লাগতে লাগল। অন্য সময় হলে ঐ গল্পেই প্রচুর হাসতাম। আজ পারিনি। হয়তো মায়ের কথা ভাবছিলাম বলে। চায়ের পেয়ালা হাতে বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই দেখি মন্টু গুটিগুটি পায়ে বেরিয়ে এসেছে।

কিরে মন্টু?

ঘুম আসছে না। দাদা।

কেন?

রুনু ঝুনু ঘুমিয়ে পড়েছে, আমার একা একা ভয় লাগছে।

কিসের ভয়?

ভূতের।

রাবেয়া রান্নাঘরে ফিরে যাচ্ছিল, মন্টু ডাকল, আপা, আমি চা খাব।

এক ফোঁটা ছেলের রাত তিনটের সময় চা চাই। সিগারেটও লাগবে নাকি বাবুর? দিই বাবার কাছ থেকে এনে?

আপা, ভালো হবে না বলছি।

ও ঘর থেকে কাপ নিয়ে আয় একটা। দেখিস, ফেলে দিয়ে একাকার করিস না।

ভোর হয়ে আসছে, কাক ডাকছে। মুরগির ঘরে মুরগিগুলি সাড়াশব্দ দিচ্ছে, চাঁদের আলোও ফিকে হয়ে এসেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভোর হওয়া দেখছি। ভেতরের ঘর থেকে বাবা বেরিয়ে এলেন, ভীত গলায় ডাকলেন, খোকা।

জ্বি,

তোর মাকে মনে হয়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়াই ভালো।

কেন? হঠাৎ করে?

না, মানে সুহাসিনী বলল। এখন বয়স হয়েছে কিনা। তা ছাড়া–

তা ছাড়া কী?

না, মানে কিছু নয়। আমার কেন যেন খারাপ লাগছে স্বপ্নটা দেখার স দেখলাম যেন আমি একটা ঘরে…।

একটা ঘরে কী?

না না, রাতের বেলায় স্বপ্ন বলে নাকি কেউ।

বাবা থতমত খেয়ে চুপ করলেন। মায়ের সেই ভয়-ধরান চিৎকার আর শোনা যাচ্ছে না। কোথা থেকে দুটি বেড়াল এসে ঝগড়া করছে। অবিকল শিশুদের কান্নার আওয়াজ। বাবা বললেন, খোকা আমি হাসপাতালে গিয়ে অ্যাম্বুলেন্সকে খবর দিই।

আপনার যেতে হবে না, আমি যাই। বরঞ্চ পাশের বাড়ি থেকে ফোন করে দিই।

না-না, ফোন করলে কাজ হবে না। আসতে দেরি করবে, বাসা চিনবে না।–অনেক ঝামেলা। তুই থাক।

বাবা চাদর গায়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। এত রাতে রিক্সাটিক্সা কিছু পাওয়া যাবে না, হেঁটে হেঁটে যেতে হবে। আমি ইজিচেয়ারে চুপচাপ বসে রইলাম। যে শিশুটি জন্মাবে, সে এত আয়োজন, এত প্রতীক্ষ্ণ ও যন্ত্রণার কিছুই জানছে না, এই জাতীয় চিন্তা হতে লাগল। অন্ধকার মাতৃগর্ভের কোনো স্মৃতি কারোর মনে থাকে না। যদি থাকত, তবে কেমন হত সে-স্মৃতি কে জানে। জন্মের সমস্ত ব্যাপারটাই বড়ো নোংরা।

রাবেয়া এসে দাঁড়াল আমার কাছে। নিচু গলায় বলল, খোকা, বাবা কি হাসপাতালে গেছেন?

হ্যাঁ।

বাবা খুব ভয় পেয়েছেন, নারে?

হুঁ, পেয়েছেন।

আমারো ভয় লাগছে খোকা।

ভয় কিসের?

আমি কিছুতেই বিয়ে করব না, দেখিস তুই। মাগো কী কষ্ট!

মায়ের কাছে গিয়েছিলি রাবেয়া?

হ্যাঁ!

মা কী করছে?

চিৎকার করছেন না। চিৎকার করার শক্তি নেই। খুব কষ্ট পাচ্ছেন।

কী বাজে ব্যাপার।

হুঁ।

মাসি কী করছে?

ঘুমাচ্ছে। বাজনার মতো নাক ডাকছে। মেয়েমানুহ্মেব নাক ডাকা কী বিশ্ৰী। বাঁশির সরু আওয়াজের মতো তালে তালে বাজছে। ঘেন্না লাগে।

মসজিদ থেকে ফজরের আজান হল, ভোর হয়ে আসছে। অ্যাম্বুলেন্স এল ছটার দিকে। ড্রাইভারটা মুশকো জোয়ান। সঙ্গের হেল্লার দুটিরও গুণ্ডার মতো চেহারা। ২ৈচৈ করে স্ট্রেচার বের করল তারা! সাত-সকালেই অনেক লোকজন জড়ো হয়ে গেল। পাড়ার মেয়েদের প্রায় সবাই এসেছে। উকিল সাহেবের বউ আমাকে ইশারায় ডাকলেন, খোকা, তোর মোর অবস্থা নাকি খুব খারাপ? হেড ক্লার্কের বউ বললেন।

না, তেমনি কিছু নয়। দেখে আসুন না গিয়ে।

এই যাচ্ছি বলে তিনি অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরটা দেখতে চেষ্টা করতে লাগলেন। হেড ক্লার্কের বউও এসেছেন, তাল সঙ্গে একটি সুন্দর মতো মেয়ে। কমবয়সী। কয়েক জন ছেলেমেয়ে দেখি হৃষ্টচিত্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মন্টু ভীষণ ভয় পেয়েছে, আমার একটা হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। মাঝে মাঝে সে যে কাঁপছে, তা বুঝতে পারছি। রুনু আর ঝুনুকে দেখছি না। রাবেয়া উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। একা।

মন্টু বলল, দাদা, তোমাকে ডাকছে।

কে?

ওভারশীয়ার কাকু।

মন্টুর হাত ধরে ওপাশে গেলাম। হয়তো হাজারো কথা জিজ্ঞেস করবেন। পুরুষ মানুষের মেয়েলি কৌতূহলে বড়ো খারাপ লাগে। ওভারশীয়ার কাকু খালি পায়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন।

আমাকে দেখে বললেন, খোকা, তোমাকে একটু ডাকছিলাম।

কী জন্যে চাচা?

না, মানে তেমন কিছু নয়, ঘুম থেকে উঠেই অ্যাম্বুলেন্স দেখে…..মানে। ইয়ে…… ধর তো খোকা। মাসের শেষ, কতরকম দরকার হয়, লজ্জা করো না সোনা, রাখি।

কথা বলবার অবসর না দিয়ে চাচা সরে গেলেন। ঐদিকটায় হৈচৈ হচ্ছে। ষ্টেচারে করে মাকে তুলছে গাড়িতে, ছুটে গেলাম।

বাবা, সঙ্গে কে যাচ্ছে?

আমি আর তোর সুহাসিনী মাসি।

রাবেয়াকে নিয়ে যান।

না না, ও ছেলেমানুষ। খোকা, তোর ছোটখালাকে খবর দিস।

গাড়ি স্টার্ট নিতেই বাবা আবার ডাকলেন, খোকা, ও খোকা, তোর মা ডাকছে, আয় একটু।

গাড়ির ভেতর আবছা অন্ধকার। গলা পর্যন্ত চাদর জড়িয়ে মা পড়ে আছেন। সারা শরীর কেঁপে উঠছে এক-এক বার। মা নরম স্বরে বললেন, খোকা, আয় এদিকে।

অস্পষ্ট আলোয় চোখে পড়ল। যন্ত্রণায় তাঁর ঠোঁট কেঁপে কেঁপে উঠছে। অদ্ভুত ফর্সা মুখের অদৃশ্য নীল শিরা কালো হয়ে ফুলে উঠছে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে সারা মুখে।

মা, কী জন্যে ডেকেছেন? কী?

মা কোনো কথা বললেন না। বাবা বললেন, দেরি হয়ে যাচ্ছে, খোকা তুই নেমে যা।

আমিও সঙ্গে যাই বাবা?

না-না, তুই থাক। বাসায় ওরা একা। নেমে যা, নেমে যা।

মাসি গলা বাড়িয়ে বললেন, পানের কীেটা ফেলে এসেছি, কেউ আসে তো সঙ্গে দিয়ে দিও।

গাড়ি ছেড়ে দিল। মন্টু গাড়ির পেছনে পেছনে বড়ো রাস্তা পর্যন্ত গিয়ে ফোঁপাতে ফোঁপাতে ফিরে এল। রুনু-ঝনুকে নিয়ে আমি বসে রইলাম বারান্দায়। জন্ম বড়ো বাজে ব্যাপার। মৃত্যুর চেয়েও করুণ।

বুকের উপর চেপে থাকা বিষন্নতা দেখতে দেখতে কেটে গেল। আবহাওয়া তরল হয়ে এল ঘণ্টাখানেকের মধ্যে। ছোট খালা এলেন নয়টায়। তাঁর মস্ত কালো রঙের গাড়িতে করে, সঙ্গে মেয়ে কিটকি। রাবেয়া ঢাউস এক কেটলি চায়ের পানি চড়িয়ে দিল। রুনু ঝুনু স্কুলে যেতে হবে না। শুনে আনন্দে লাফাতে লাগল।

সারা রাত নিঘুম থাকায় মাথা ব্যথা করছিল। চুপচাপ শুয়ে রইলাম। ইউনিভার্সিটিতে এক দফা যেতে হবে। স্যার কাল খোঁজ করেছিলেন, পান নি। আতিক কি জন্যে যেন তার বাসায় যেতে বলেছে। খুব নাকি জরুরী। চার্লি চ্যাপলিনের দি কিড ছবিটি চলছে গুলিস্তানে। আজ দেখব কাল দেখব করে দেখা হয় নি। দু দিনের ভেতর দেখতে হবে? সামনের হস্তায্য কী একটা বাজে ছবি যেন।

কিরে খোকা, শুয়ে?

মৃদু সেন্টের গন্ধ ছড়িয়ে খালা ঢুকলেন। খালার সঙ্গে মায়ের চেহারার খুব মিল। তবে খালা মোটাসোটা, মা ভীষণ রোগা। খালা পাশের চেয়ারে বসলেন, জ্বর নাকি রে?

জ্বি না, এই শুয়েছি। একটু।

দেখি?

খালা মাথায় হাত রাখলেন।

না, মোটেও জ্বর নেই। ডাক্তারের বউ হাফ-ডাক্তার হয় জান তো?

জানি। জ্বরটির নয়, এমনি শুয়ে আছি।

খারাপ লাগছে? তা তো লাগবেই। বুড়ো বয়সে মায়েদেব যদি মেটারনিটিতে যেতে হয়।

আমি চুপ করে রইলাম। দরজার আড়াল থেকে কিটকি উঁকি দিল। খালা ডাকলেন, আয় ভেতরে।

কিটকি লজ্জিতভাবে ঢুকল। যখন অন্য কেউ থাকে না তখন আমার সঙ্গে কিটকির ব্যবহার খুব সহজ ও আন্তরিক। বাইরের কেউ থাকলেই কিটকি সংকোচ ও লজ্জায় চোখ তুলে তাকায় না। শৈশবের একটি ছোট্ট ঘটনা থেকেই কিটকির এমন হয়েছে।

সে তখন খুব ছোট, ছ-সাত বৎসর বয়স হবে। মায়ের সঙ্গে বেড়াতে এসেছে বাসায়। রুনু-বানুর সঙ্গে সারা দুপুর হৈচৈ করে খেলল, তখন মা যখন সবাইকে খেতে ডাকলেন, তখন কী খেয়াল হল কি জানি মাকে গিয়ে বলল, খালা, আমি আপনাকে একটা কথা বলব, কাউকে বলবেন না তো?

না মা, বলব না।

আল্লার কসম বলুন।

আল্লার কসম।

তা হলে মাথা নিচু করুন, আমি কানে কানে বলি।

মা মাথা নিচু করলেন এবং কিটকি ফিসফিস করে বলল, বড়ো হয়ে আমি খোকা ভাইকে বিয়ে করব। আপনি কাড়কে বলবেন না তো?

মা কিটকির কথা রাখেন নি। সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে বলে দিয়েছেন। যদিও সুদূর শৈশবের ঘটনা, তবু স্থানে—অস্থানে এই প্রসঙ্গ তুলে বেচারিকে প্রচুর লজ্জা দেওয়া হয়। মা তো কিটকির সঙ্গে দেখা হলে এক বার হলেও বলবেন, আমার বউমেয়েকে কেউ দেখি যত্ব করছে না?

কিটকি তার মায়ের পাশে বসল। সে আজ হলুদ রঙের কামিজ পরেছে, লম্বা বেণীতে মস্ত বড়ো বড়ো দুটি হলুদ ফিতের ফুল। অল্প হাসল কিটকি। আমি বললাম, কি কিটকি, আজ কলেজ নেই?

আছে, যাব না।

কেন?

এমনি। কলেজ ভীষণ বোরিং। তা ছাড়া খালার অসুখ।

থাকবি আজ সারা দিন?

হ্যাঁ। আজ রাতে আপনাকে ভূতের গল্প বলতে হবে।

ভূতের গল্প শুনে কাঁদবি না তো আবার?

ইস, কাঁদব? ছোটবেলায় কবে কেঁদেছিলাম, এখনো সেই কথা।

ছোটবেলা তো তুই আরো কত কি করেছিস।

ভালো হবে না কিন্তু।

বলতে বলতে কিটকি লজ্জায় মাথা নিচু করল। খালা বললেন, আমি হাসপাতালে যাই খোকা। কিটকি, তুই যাবি আমার সঙ্গে?

না মা, আমি থাকি এখানে।

খালা চলে যেতেই রাবেয়া চায়ের টে। হাতে ঢুকল। বেশ মেয়ে রাবেয়া। এর ভেতর সে গোসল সেরে নিয়ে চুল বেঁধেছে। রানা শেষ করেছে, এক দফা চা খাইয়ে আবার চা এনেছে। রাবেয়া হাসতে হাসতে বলল, কি কিটকি? না-না ভিটাকি বেগম, এই ঘরে কী করছ? পূর্বরাগ নাকি? সিনেমার মতো শুরু করলে যে?

যান। আপা, আপনি তো ভারি ইয়ে.মা ডাকলেন তাই।

বেশ বেশ, তা এমন গলদা চিংড়ির মতো লাল হয়ে গেছ যে! গরমে না হৃদয়ের উত্তাপে?

যান। আপা, ভাল্লাগে না।

নিন, নিন, ভিটকি বেগম–চা নিন।

কি সব সময় ভিটকি ডাকেন, জঘন্য লাগে।

কিটকির কি কোনো মানে আছে? তাই ভিটকি ডাকি।

যেন তিটিকির কত মানে আছে।

আছেই তো। ভিটকি হচ্ছে ভেটকি মাছের স্ত্রীলিঙ্গ। অর্থাৎ তুই একটি গভীর জলের ভেটকি ফিশ, বুঝলি?

বেশ, আমি গভীর জলের মাছ। না, চা খাব না।

কাঁদো কাঁদো মুখে উঠে দাঁড়াল কিটকি। কাউকে কিছু বলার অবসর না দিয়ে ঝড়ের মতো বেরিয়ে গেল। রাবেয়া হেসে উঠল হো হো করে। বলল, বড়ো ভালো মেয়ে।

হুঁ।

একটু অহংকার আছে, তবে মনটা ভালো।

তাই নাকি?

হ্যাঁ, আমার জীষণ ভালো লাগে। আর আমার মনে হয় কি জানিস?

কী মনে হয়?

মনে হয় মেয়েটির শৈশবে তোর দিকে যে টান ছিল, তা যে এখনো আছে তাই নয়।–চাঁদের কলার মতো বাড়ছে!

তোর যত বাজে কথা।

রাবেয়া বলল, মেয়েটির কথা ছেড়ে দিই, তোর যে ষোল আনার উপর দু আনা, আঠারো আনা টান তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কান-টান লাল করে একেবারে টমেটো হয়ে গেছিস, আচ্ছা গাধা তো তুই!

রাবেয়া হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ল। রুনু এসে ঢুকল খুব ব্যস্তভাবে, হাতে একটা লুড়ুবোর্ড।

কিরে রুনু?

কিটকি আপার কী হয়েছে?

কেন?

চুপচাপ বসে আছে। আগে বলেছিল লুড়ু খেলবে, এখন বলছে খেলবে না।

রাবেয়া উঁচু গলায় হাসল আবার। রুনুকে বললাম, রুনু, মন্টু কোথায়? মন্টুকে দেখছি না তো।

মন্টু হাসপাতালে গেছে।

হাসপাতালে কার সঙ্গে গেল, খালার সঙ্গে?

না, একাই গেছে। তার নাকি খুব খারাপ লাগছিল। তাই একা একাই গেছে।

কোন হাসপাতালে, চিনবে কী করে?

চিনবে। তার স্কুলের কাছেই।

চা-টা খেয়ে গিয়েছে?

না, খায় নি।

রাবেয়া শুয়ে শুয়ে পা দোলাচ্ছিল; হঠাৎ কি মনে করে উঠে বসিল, খোকা তুই বাজি রাখতে চাস আমার সঙ্গে?

কী নিয়ে বাজি?

মায়ের ছেলে হবে কি মেয়ে হবে, এই নিয়ে।

রাবিশ।

আহ, রাখি না একটা বাজি। তোর কি মনে হয় ছেলে হবে?

আমার কিছু মনে হয় না।

আহ, বল না একটা কিছু।

ছেলে।

আমার মনে হয় মেয়ে। যদি ছেলে হয়, তবে আমি তোকে একটা সিনেমা দেখার পয়সা দেব। আর মেয়ে হলে তুই কী দিবি আমাকে?

কি বাজে বকিস। ভাল্লাগে না। আহা, বল না। কী দিবি? প্লীজ বল।

 

ক্লাস শেষ হল দেড়টায়।

আতিক ছাড়ল না, টেনে নিয়ে গেল তার বাসায়। একটি মেয়ে নাকি প্রেমপত্র লিখেছে তার কাছে। সত্যি মেয়েটিই লিখেছে, না কোনো ছেলে ফাজলামি করেছে, তাই ভেবে পাচ্ছে না। তার আসল সন্দেহটা আমাকে নিয়ে, আমিই কাউকে দিয়ে লেখাই নি তো। যত বার বলছি, আজ ছেড়ে দাও, আরেক দিন কথা হবে। আমার একটু কাজ আছে। ততই সে চেপে ধরে। উঠতে গেলেই বলে, কী এমন কাজ বল? কী যে কাজ, তা আর বলতে পারি না লজ্জায়। অস্বস্তিতে ছটফট করি। বাসায় ফিরতে ফিরতে বিকেল! আমাকে দেখেই ওভারশীয়ার কাকু দৌড়ে এলেন, খোকা, তোমার মারি অবস্থা বেশি ভালো নয়। সবাই হাসপাতালে গেছে। তুমি কোথায় ছিলে? যাও, তাড়াতাড়ি চলে যাও! রিক্সাভাড়া আছে?

আমার পা কাঁপতে লাগল। আচ্ছন্নের মতো রিক্সায় উঠলাম। সমস্ত শরীর টলমল করছে।

কালোমতো একটি মেয়ে কাঁদছে। কী হয়েছে তার কে জানে। রাবেয়া বাবার হাত ধরে রেখেছে। রুনু-খুনুকে দেখছি না। বাচ্চা বোনটা কাঁদছে ট্যাট্যা করে। খালা কোলে করে আছেন তাকে? খালা বললেন, দেখ খোকা, কি সুন্দর ফুলের মতো বোন হয়েছে।

 

হ্যাঁ, খুব সুন্দর ফুলের মতো বোন হয়েছে একটি। আর আমাদের আশ্চর্য ফর্সা, ভীষণ রোগা মা হাইফোরসেপ ডেলিভারিতে অপারেশন টেবিলে চুপচাপ মারা গেছেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *