বারো ভাই-বোনের সবচেয়ে ছোট বলে বাবা আদর করে নাম রেখেছিল বুড়ি। অবশ্য আদর করে কিনা কে জানে! বুদ্ধি হবার পর থেকেই জেনে এসেছে ওর নাম বুড়ি। নামটা ওর পছন্দ হয়নি। শুনলেই শরীর চিড়বিড়িয়ে ওঠে। ওর ধারণা নাম খুব সুন্দর হওয়া চাই। যেটা শুনলে মন খুশিতে নেচে ওঠে। সাড়া দিতে ভালোলাগে। সেজন্যে বাবার কাছে গিয়ে নাম বদলে দেবার জন্যে অনেক কাদাকাটি করেছে। কিন্তু লাভ হয়নি। বাবা ওর কথা কানেই তোলেনি। খেলার সাথীদের কাছে আবেদন করেছিল, তোরা আমাকে বুড়ি বলে ডাকবি না।
ওরা প্রবলভাবে আপত্তি করে, না, তুই বুড়ি। বুড়ি। বুড়ি।
ওরা এ নামে ডেকেই আমোদ পায়। ওকে খেপানো যায়।
ফলে বুড়ি বুড়িই রয়ে গেলো। একটা পছন্দহীন নাম নিয়ে দিন কাটাতে হয়। ঘন সবুজ কচুপাতার মতো বুড়ির মন। সে পাতায় জলের দাগ পড়ে না। হৃদয়ের সূক্ষ্ম অনুভূতি ওকে আক্রান্ত করে না, বুড়ি নির্বিবাদে সে বেড়ি পেরিয়ে আসে।
হলদী গাঁয়ের এ বাড়ি ছেড়ে আর কোথাও যাবার সুযোগ হয়নি ওর। পশ্চিমে স্টেশনে যাবার বড় রাস্তা। পুবে খালের ধার। উত্তর-দক্ষিণে মাঠের পর মাঠ। এর বাইরে কি আছে বুড়ি জানে না। আশপাশের ঘরের ছেলেমেয়েরা দাদার বাড়ি, নানার বাড়ি যায়। বুড়ির তাও যাওয়া হয়নি। বাবার কাছে কিংবা মার কাছে বায়না ধরে লাভ নেই। উল্টো বকা খেতে হয়। সংসারের ঝামেলায় মা কোথাও বেরুতে পারে না। বাবা কাউকে সঙ্গে নিয়ে কোথাও যায় না। বুড়ি ভীষণ নিঃসঙ্গ। একদল ভাই-বোনের মধ্যে থেকেও বুড়ির মন কেমন করে। সে মনের কথা কেউ বোঝে না। বুঝতে চায় না। যে মনের ডানা অনবরত রঙ বদলায় তাকে বুঝবে কে? খেলতে খেলতে খেলা ছেড়ে ঘরে এসে চুপচাপ বসে থাকে। ওরা ডাকতে এলে রাগ করে। কখনো গালি দেয়। অকারণে ঝগড়া বাধিয়ে তোলে। তারপর একসময় খালের ধারে গিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। বাতাসে থিরথির জল কাঁপে। পানির ওপর মাথা উঁচিয়ে থাকা সবুজ ঘাসের ডগায় কাচপোকা উড়ে বেড়ায়। বুড়ি ঘোলা জলে নিজের মুখ দেখার চেষ্টা করে। কিন্তু দেখা হয় না। আহা জলের স্পর্শে কী ভীষণ সুখ।
একদিন দুরন্ত কৌতূহলে জলিলের সঙ্গে স্টেশনে গিয়েছিল। বুড়ির জিজ্ঞাসু মনের কাছে স্টেশন মানেই রূপকথার জগৎ। সেখানকার কোনো কিছুই ও চেনে না। অথচ চিনে নেবার জন্যে আগ্রহের শেষ নেই। ওরা স্টেশনে পৌছার সঙ্গে সঙ্গে মেল ট্রেন ঝড়ের গতিতে পার হয়ে গেলো। অত ছোট স্টেশনে মেল ট্রেন দাঁড়ায় না। বুড়ির বুকের ধুকধুকানি বেড়ে যায়। উত্তেজনায় জলিলের হাত আঁকড়ে ধরে। রেলটা শেষ বিন্দু হয়ে মিলিয়ে যাবার পরও ঝঝকে লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে ছিল বুড়ি। বুক ভরে শ্বাস নিয়েছিল। কেমন একটা অচেনা গন্ধ ওকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
–গাড়িটা কোথায় যায় রে জলিল?
–অনেক দূর।
–অনেক দূর, কত দূর?
–আর্মিও কি জানি ছাই! একদিন উঠে টুস করে চলে যাব কোথাও। আর ফিরব না।
জলিল চোখ বড় করে বলেছিল—
–আমারও যেতে ইচ্ছে করে। তুই আমাকে নিবি?
–ইশ শখ কতো? তুই আমাকে নিবি? ভাগ।
জলিল ওকে ভেংচি কাটে।
বুড়ির মন খারাপ হয়ে যায়। তবুও আপন মনে বলে, আমিও একদিন কোথাও চলে যাব। কেঁচড় ভর্তি নুড়ি নিয়ে ফিরে এসেছিল সেদিন। জলিল স্টেশন মাস্টারের ঘরের সামনে ঘুরঘুর করছিল বারবার। ট্রেনে চড়ার মতলবে ছিল ও। সুযোগ করে। একদিন ও ঠিকই উঠবে। কিন্তু বুড়ি কিছুই করতে পারে না। মনের মধ্যে হাজারটা ইচ্ছে থাকলেই কি আর সব করা যায়? মেইল ট্রেন আকাঙ্ক্ষার পাখি হয়ে উড়ে চলে যায় একদম বুড়ির নাগালের বাইরে। হলদী গার বাইরের দুনিয়াটা দেখার সাধ্যি বুড়ির। নেই। কিন্তু বড় বিশ্রী এই মনটা। কোন বাধা মানে না, ছুটে চলে যায় দূর-দূরান্তে। সেদিন জলিল ফেরেনি ওর সঙ্গে। ও অন্য কোথায় যেন চলে গিয়েছিল। একা একা ফিরেছিল বুড়ি। কোচড় ভর্তি পাথরের নুড়ি গায়ে লেগে শব্দ করছিল। ভাল লাগছিল না ওর। তৃষ্ণার্ত মনটা বাগ মানাতে না পেরে নুড়িগুলো এলোপাথাড়ি ছুঁড়ে মেরেছিল সারাপথ। লজ্জাবতীর ঝোপে লাথি দিয়ে ব্যথা পেয়েছিল। তবুও ওতেই ছিল আনন্দ। মন খারাপের আনন্দ। ট্রেনের ঐ ঝিকঝিক্ শব্দ বুড়িকে অনেকদিন নেশাগ্রস্ত করে রেখেছিল। বুকের তল থেকে ঐ শব্দ কেবলই ঘুম ভাঙিয়ে দিত। অন্ধকারে চোখ মেলে রেখে বুড়ির রাত শেষ হয়ে যেতো। এর বেশি কিইবা করতে পারে ও। বুড়ির মন বিগড়ে যাওয়া ইঞ্জিনের মতো থমকে থাকে। কেবলই জানতে ইচ্ছে করে খাল কোথায় শেষ হয়। পথ কোথায় ফুরিয়ে যায়। আর তখনই কেমন বিচ্ছিন্ন ভাবনায় বুক মোচড়ায়। মনটা জল থৈ থৈ ঝিলের মতো ছপছপ করে।
হলদী গাঁর ছোট পরিসরে বুড়ি একটু বেশি এগিয়ে গিয়েছিল। সমবয়সী খেলার সাথীরা যেমন ওর নাগাল পেতো না, ওকে বুঝতে গিয়ে হিমশিম খেত–তেমন বড়রাও ওকে কাছে টানতে পারেনি। মায়ের ডাকে ভুল করেও সাড়া দিতে চাইতো না ও। মা মানেই হেঁসেল আর এটা আনো ওটা আনো-র ফাইফরমাস খাটা। তার চাইতে খালের ধার ভাললা, জামরুল গাছের তলা ভালো। আর এ জন্যেই মার কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো ও। বুড়ি কারো জন্যে কোনো বন্ধন অনুভব করে না। কোনদিন। ভাত খেতে ডেকে না পেয়ে মা রেগে গগ করতো, এমন ছিষ্টিছাড়া মেয়ে বাপের জন্মেও দেখিনি বাবা! ওর যে কি হবে?
বুড়ি তখন হয়তো বাগানের স্যাঁতসেঁতে অন্ধকারে বড় বাদাম গাছের তলায় হাত পা ছড়িয়ে বসে জিভে শব্দ তুলে তেঁতুল চাটছে। দুপুরের খাবার কথা ওর মনে নেই। একা থাকতে কি যে ভালোলাগে! বেশি লোকজনের মাঝে ওর কেমন হাঁফ ধরে যায়। এই গাছ-গাছালি কথা বলে না বলেই বুড়ির এত প্রিয়। কোন কারণে বাড়িতে লোকজন বেশি বেড়াতে এলেই বুড়ির সুবিধে। তখন ওর কথা কেউ মনেই করে না। বুড়ির মনের অনুকূলে সব ঘটনা ঘটে বলেই বুড়ি দ্রুত মানসিক পরিণতিতে পৌছে গেল।
কৈশোর ফুরোবার আগেই বাবা মারা যায়। বুড়ি কিছু বুঝতে পারে না। বাবার অভাব ওকে তেমন কষ্ট দেয়নি। বাবাকে কবরে নিয়ে যাবার আগে মুখের কাপড় সরিয়ে যখন সবাইকে দেখতে ডেকেছিল বুড়িও গিয়েছিল। বাবাকে অন্যরকম লাগেনি ওর। ঘুমিয়ে থাকলে যেমন লাগত ঠিক তেমন। অন্য সবাই কেঁদেছিল দেখে ও নিজেও কেঁদেছিল। কিন্তু তীব্র বেদনাবোধ কোথাও ছিল না। কেননা বাবার খুব কাছে ও কোনদিন যেতে পারেনি। বাবাকে কেন্দ্র করে তেমন কোন গভীর অনুভূতি নেই। ভালো একটা স্মৃতিও না। অবশ্য সেজন্য বুড়ির কোন দুঃখ নেই। বরং অনাদর অবহেলায় দিব্যি বড় হচ্ছিল বলে বাবা থাকা না থাকায় বুড়ির কোনো রদবদল হয়নি। মাঠে মাঠে ঘুরে, বৈঁচি কুড়িয়ে, ধানের ছড়ায় কেঁচড় ভর্তি করে, বিলের জলে সাঁতার কেটে বুড়ির অনাদরের দিনগুলো রাতের আকাশে তারার ফুলকি। বাবার প্রয়োজন বুড়ির জীবনে কোনো দাগ কাটেনি। মাঝে মাঝে ভাবত–বাবা হয়তো জানেই না যে বুড়ি নামে তার কোনো মেয়ে আছে। বাবার স্নেহের পরোয়া করেনি ও। তার চাইতে অনেক ভালো বাইরের জগতের হাতছানি। মাঠঘাট, ঝোপঝাড়, পথ-প্রান্তরের ডাক বুড়ির নাড়িতে নাড়িতে। এমনি করে সবার অলক্ষ্যে সংসারের নিয়মের গণ্ডির বাইরে বুড়ি ছিটকে পড়ে।
কৈশোর শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে বিপত্নীক চাচাতো ভাই গফুরের সঙ্গে বিয়ে হলো বুড়ির। গফুরের বয়স নিয়ে মা-র একটু আপত্তি ছিল। কিন্তু পিতার অবর্তমানে অভিভাবক বড় ভাইর কাছে সে আপত্তি টেকেনি।
তোমার ঐ দস্যি মেয়েকে কে সামলাবে মা? এতোদিন ছোট ছিল লোকের চোখে পড়েনি কিন্তু দিন দিন তো ধিঙ্গি হচ্ছে। শেষে একটা কেলেঙ্কারি না হলে বাঁচি!
বড়ভাই রেগে গিয়েছিলেন। মা বুড়ো হয়েছেন। কার কাছেই বা জোর খাটাবেন। তবু বুড়িকে একটু বুঝতে চেয়েছিলেন কিন্তু ক্ষমতা ছিল না তাঁর। মা-র বিষন্ন মুখের দিকে চেয়ে হয়তো খারাপ লেগেছিল তাই বড়ভাই গলা নরম করে বলেছিলেন, গফুরের সঙ্গে বিয়ে হলে খারাপ হবে না মা। তাছাড়া আমাদের চোখের ওপরই তো থাকবে। ভীন গায়ে বিয়ে দিয়ে চিন্তার শেষ থাকবে না। ওর যা স্বভাব! বাপ দাদার মুখে কালি দেবে।
মা চুপ করেই থাকলেন। বড়ভাই নিজের রায় জানিয়ে বেরিয়ে গেলেন। বুড়িকে কোনরকম একটা বিয়ে নামক বন্ধনের মধ্যে ঠেলে দেয়াই ছিল তার লক্ষ্য। বুড়ির স্বভাব এবং আচরণ কোনটাই তার পছন্দ ছিল না। দেখেশুনে বুড়ি নিজেই চুপচাপ ছিল। বড়ভাইর হাতে-পায়ে ধরতে ওর বাধলো। তাছাড়া নিজের মনের কাছে অন্য কারো ঠাই নাই যার তার জীবনে স্বামী আর কতটুকু পরিবর্তন ঘটাতে পারবে? ও খুব একটা উৎসাহ পায় না। তেমন উত্তেজনাও বোধ করে না। শুধু বিয়েকে কেন্দ্র করে একটাই স্বপ্ন ছিল মনে। ভেবেছিল আর কিছু না হোক এক গা ছেড়ে আর এক গাঁয়ে যাওয়া যাবে অন্তত। একটুখানি পাগলা হাওয়া বাইরে যাবার ডাক শোনাত। হলদী গাঁয়ের বেড়িটা ভাঙতে পারবে। নৌকার ছইয়ের ভেতর বসে ঘোমটার ফাঁকের বিমুগ্ধ দৃষ্টি ওকে স্বস্তি দেবে। কোন অপরিচিত জনের লোমশ হাত বুড়ির জীবনের বাঁকবদলের মাইলস্টোন হয়ে দাঁড়াবে। পানখাওয়া লাল দাঁতের হাসি ছাড়া বুড়ির জন্যে আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। কিন্তু কোন ইচ্ছেই পূরণ হয়নি ওর। লাল নটে শাকের ক্ষেত, দোয়েলের লেজ দোলানো, শাপলার চিকন লতা, কচুরিপানার বেগুনি ফুল সব কিছু থেকে বঞ্চিত হয়ে গেছে। এ সব কিছুই ওর জীবনের চারপাশে আছে ঠিকই কিন্তু কারো দৃষ্টির সঙ্গে দৃষ্টি মিলিয়ে নতুন করে দেখা হলো না।
চাচাতো ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ে হওয়ার ফলে উত্তরের ঘর থেকে দক্ষিণের ঘরে যাবার ছাড়পত্র পেয়েছিল মাত্র। তাছাড়া অন্য কোন বৃহৎ পরিবর্তন ওর মধ্যে আসেনি। গফুরের দুই ছেলে। বড়টি ছয় বছরের, ছোটটির বয়স চার। ওদের সঙ্গে বেশ একটা প্রীতির সম্পর্ক ছিল। ওদের কোলেকাখে করে মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়িয়েছে অনেক। বিয়ের পর হঠাৎ করে ওদের মা হয়ে যাবার দরুন ভীষণ কৌতূহল হয়। কেমন অবাক লাগে। কখনো লজ্জা। ধুৎ কি বাজে ব্যাপার। দুটোকে ধরে পুকুরে ফেলে দিতে ইচ্ছে করে। আবার কখনো নিস্পাপ কচি মুখ দুটো ভালো লাগে। তখন এক অস্থিরতায় ছটফটিয়ে ওঠে। এ ছাড়া আর সবই ওর দেখা জগৎ। পরিচিত শ্বশুর-শাশুড়ি, পরিচিত স্বামী, চেনা-জানা ঘরদোর, জানাশোনা পরিবেশ। সুতরাং কাউকেই নতুন করে চিনবার বা জানবার সুযোগ হয়নি। কেবল মাঝরাতে ঘুম ভেঙে গেলে অনুভব করে একটা শক্ত লোমশ হাত ওকে আঁকড়ে ধরে আছে। তখন মনে হয় হ্যাঁ জীবনের কোথায় যেন কি ঘটে গেছে। আস্তে হাতটা সরিয়ে দিয়ে পাশ ফিরে শশায়। কোন দিন চুপচাপ উঠে এসে বারান্দায় বসে থাকে। মনে হয় আরো অনেক কিছু পাওয়ার ছিল, সেটা হয়নি। অন্ধকার বাঁশবনে জোনাক জ্বলে, চাঁদের আলো বারান্দায় এসে পড়ে। বুড়ির বুক ফেটে কান্না আসতে চায়। কাঁদতে পারে না, ভুতুমের ডাক শুনে আবার ঘরে ঢোকে। বিছানায় উঠে আসে। গফুরের পিঠ ঘেঁষে শুয়ে পড়ে। এর বেশি বুড়ির আর কিছু করার নেই। বুড়ি মানসিক দিক দিয়ে যতোই গণ্ডী লাফিয়ে পেরিয়ে যাক শারীরিক সীমাবদ্ধতা ও কিছুতেই ডিঙোতে পারে না।
কোনরাতে গফুর টের পেলে জিজ্ঞেস করে–কোথায় গিয়েছিলে বুড়ি!
–বাইরে।
–কেনো?
–এমনি। ঘুম আসছিল না।
গফুর কথা বাড়ায় না। আবার ঘুমিয়ে যায়। আর বুড়ি বাকি রাত এপাশ ওপাশ করে কাটিয়ে দেয়। কখনো কখনো যখন গফুরের ভীষণ ইচ্ছের কাছে নতি স্বীকার করে না তখন ওর পুলক লাগে। গফুরের নরম মিনতি রেলের ঝিকিমিকি শব্দের মতো মনে হয়। গফুরের বুক আঁকড়ে ধরে একটা আদুরে বিড়ালের মতো মুখ ঘষে। আর গফুরের তীব্র আকাঙ্ক্ষা যখন দীপ্র হয়ে ওঠে তখন অবলীলায় শান্ত হয়ে যায় ও। গফুরের বুড়ি ডাকের সঘন মাদকতায় সাড়া দেবার মতো অবস্থাও নিঃশেষ হয়ে যায়। হারিয়ে যেতে থাকে সেই না দেখা জগতটায়। অনবরত ডুবে যায় ট্রেনের ঝিকিমিকি শব্দের অতল তলে। কেউ আর ওকে ধরতে পারছে না। আর এভাবে সকলের নাগালের বাইরে ছুটে যাওয়ার যে কী সুখ! যে না বোঝে তাকে কীভাবে বোঝাবে বুড়ি।
মাঝে মাঝে গফুর একটু অবাক হয়ে ওর কিশোরী বউকে দেখে। এই মেয়েটি ওর বউ হবে কোনদিন চিন্তা করেনি। কবে যে ও বড় হলো, খেলতে খেলতে কেমন করে ওর ঘরে এসে উঠলো ভাবলে লজ্জা পায় গফুর। বুড়ির মুখের দিকে তাকাতে পারে না। চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নেয়। বুড়ি তখন হেসে গড়িয়ে পড়ে।
–কি দেখ অমন করে?
–তুই সুখী হয়েছিস বুড়ি?
–সুখ কি?
বুড়ি পাল্টা প্রশ্ন করে। এ প্রশ্নের উত্তর গফুর দিতে পারেনা। উত্তর জানেও না। বুড়ির কৌতূহল, জিজ্ঞাসা ইত্যাদির সঙ্গে পাল্লা দেয়ার সামর্থ্য গফুরের নেই। হলদী গাঁয়ের ছোট পরিসরে থেকেও বুড়ি যে কোথা থেকে এমন বেয়াড়া প্রশ্ন করে তা গফুর বুঝে কুলিয়ে উঠতে পারে না। প্রসঙ্গ এড়ানোর জন্যে তাড়াতাড়ি বলে, তামাক আন। বুড়ি। বুকটা কেমন খালি খালি ঠেকছে।
ঘড়ি-ঘড়ি তামাক খেতে না পারলে গফুরের বুক অমন করে। বুড়ি তা জানে। কিন্তু সুখ কি বুড়ি নিজেও তা জানে না। ভাত রাধা, খাওয়া, রাত্রিবেলা স্বামীর সঙ্গে ঘুমোনো–এর নাম কি সুখ? হ্যাঁ এ যদি সুখ হয় তাহলে বেশ আরামেই আছে ও। জীবনের গতানুগতিকতায় একটা স্রোত এসে মিলেছে মাত্র। হয়তো তাও নয়। চলার পথে নুড়ি কুড়িয়ে পাওয়ার মতো। না ঠিক হলো না। ধানের ছড়া কুড়োতে কুড়োতে হাঁসের ডিম পেয়ে গেলে যেমন চিৎকার করে ওঠে তেমনি। ওর জীবনে গফুর ঐ চিল্কারের মতো একটা ধ্বনি। অব্যক্ত বিস্ময়ে, গভীর আনন্দে বুকের অন্তঃস্থল থেকে। বেরিয়ে আসা শব্দ নয়। তেমন করে ওকে ওলোটপালোট করে দেয়নি। আসলে বুড়ি কোনো ঘটনাকেই প্রাধান্য দিতে চায় না। তার গুরুত্বকে আলাদা করে দেখতে বসে না। মনের সঙ্গে খুব গভীরভাবে না মিললে বুড়ি অনায়াসে তা মন থেকে ঝেড়ে ফেলে। অথচ অন্য কোনো মেয়ে হলে জীবনের এ পরিবর্তনকে বাঁক বদলের লগ্ন বলে ধরে নিত।
হলদী গাঁয়ের গ্রামীণ আবহাওয়ায় এমন কোনো কঠিন ধাতু ছিলো না যা বুড়িকে নিরেট করতে পারত। অথচ আশ্চর্য তার মনের জোর। বুড়ি গাঁয়ের সেই সঁাতসেঁতে পরিবেশের মতো এক ভিজে মন লালন করেনি। সে মনের আবহাওয়ায় গ্রীষ্মমণ্ডলীয় উষ্ণতা বিরাজ করেছে সবচেয়ে বেশি। যেদিন বুড়ি কাদতো সেদিন বাড়ির সবাই ভাবতো আজ সাংঘাতিক রকমের কিছু হয়েছে। অল্পে কেঁদে ভাসিয়ে দেবার মতো মেয়ে ও নয়। অথচ কেউ বোঝে না বাহ্যিক কোনো কারণে বুড়ি কাঁদে না। ওর অন্ত রের অন্তর্গত বিষাদ ওকে কাদায়। সে বিষাদ সামগ্রিক জীবনের পারিপার্শ্বিককে কেন্দ্র করে অহরহ আবর্তিত হয়। কোনো সাংঘাতিক ঘটনা হয়তো কখনো ওকে আলোড়িত করে না। অথচ কোনো তুচ্ছ ঘটনা বিষাদের বরফ হয়ে ওকে জমাট করে তোলে। ছেলেবেলায় বুড়ি যখন রামধনু-রঙ পাখিগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মার। ডাকে সাড়া দিতে ভুলে যেতো তখন মা অনুযোগ করতো–এ মেয়েকে নিয়ে কি যে করবো আমি? তোর কপালে অনেক দুঃখ আছে বলে রাখলাম বুড়ি? এই বুড়ি শোন, ফিরে আয়? হতচ্ছাড়া মেয়ে! বুড়ি মার কথায় কানই দিতো না। মাকে ভেংচি কেটে দৌড়ে বেরিয়ে যেতো। মা পিছু ডাকতে ডাকতে দরজা পর্যন্ত আসতেন কিন্তু বুড়ি ততোক্ষণে হাওয়া। মার কথা শোনার মতো সময় ওর নেই। মার কিইবা কথা থাকতে পারে? কেবল ওকে আটকে রাখার চেষ্টা। ও তা বোঝে। আর বোঝে বলে বেড়ি ভাঙতে দুর্বার হয়ে ওঠে। মা কোনদিন ওকে শাসনের বশে আনতে পারেননি। তাই ওর বিয়ে নিয়ে ভীষণ শংকিত ছিলেন। কিন্তু বিয়ের ব্যাপারে বুড়ির নির্বিকারত্ব দেখে হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন।
ছেলেকে বলেছিলেন–ও যে এতো শান্ত থাকবে আমি বুঝতেই পারিনি রে?
ছেলে আত্মপ্রসাদের হাসি হেসেছিল, আমি জানতাম। বিয়ের আগে যতো যাই করুক, বিয়ের পর মেয়েরা একদম সোজা হয়ে যায়। কতো মেয়ে দেখলাম।
আড়াল থেকে ভাই আর মায়ের কথা শুনে বুড়ি মনে মনে হেসেছিল। আসলে বুড়ির যতো জ্বালা মনকে নিয়ে। সেই মন কেউ দেখতে পায় না বলেই বুড়ি কখনো ভালো, কখনো মন্দ। কখনো বিপজ্জনক, কখনো গোবেচারা। তাছাড়া ও নিজের বলয়ে থাকতেই ভালোবাসে। অকারণে যেচে কারো কাছে নিজের কথা বলা ওর একদম
পছন্দ নয়। বুড়ির এই নিজস্ব ক্ষেত্র আছে বলেই তার চাষবাস আছে, ফসল ফলানো। আছে, তার মাড়াই আছে, গোলায় ভরা আছে। অন্য কাউকে ওর প্রয়োজনই হয় না। মা আর ভাই এর বেশি কিইবা ভাবতে পারবে?
নিরীহ গোবেচারা স্বামী বুড়ির। কোন দিন বুড়ির মতের বিরুদ্ধে কথা বলে না। পারতপক্ষে বকে না। ঝগড়া বাধাতেও অপারগ গফুর। বরং সারাক্ষণ বুড়িকে তুষ্ট রাখার আপ্রাণ চেষ্টা পরিলক্ষিত হয় গফুরের সব কাজে। ও যেন কোন অসাধারণ বস্তুর পবিত্রতা রক্ষার্থে সর্বদা ব্যস্ত। তাই পারিবারিক কলহ কখনো দানা বেঁধে ওঠে না। বুড়ি যা বলে সঙ্গে সঙ্গে সেটা মেনে নেয় গফুর। বুড়ির অন্যায় আবদার নেই, হিংসা নেই, খুঁটিনাটি বস্তু নিয়ে কারো সঙ্গে বাধে না। বুড়ির কাছে গফুরের কৃতজ্ঞতা এজন্যেই। মাঝে মাঝে ওকে আদর করতে গিয়ে কেমন থমকে যায় গফুর। ওর মুখটা খুব কাছে টেনে নিয়ে বলে–তোকে বিয়ে করা আমার বোধ হয় ঠিক হয়নি বুড়ি।
–কেনো?
–আমি তোর চাইতে অনেক বড়।
–বয়সে কি? খেতে দাও তো ঠিক মতো।
–কি যে বলিস?
–খারাপ কি? কথায় আছে না পেটে থাকলে পিঠে সয়।
গফুর আর কথা বলতে পারে না। এ বুড়ির অভিমান না অভিযোেগ তাও বোঝা দুষ্কর। ওর সঙ্গে কথা বলতে যাওয়ার এই এক দোষ। বিশেষ জায়গায় এসে হঠাৎ করে থেমে যেতে হয়। আর এগুনো যায় না। ওর সঙ্গে গল্প খুব একটা চলে না। কোথাও না কোথাও এসে বুড়ি এমন করে যতি টানে যে থেমে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। সেটা কাজের কথাই হোক কিংবা এমনি অবান্তর কথাই হোক। হঠাৎ করে, চুপ করে যায়। বেশি কথা বলতে চাইলে হুঁ-হা ছাড়া জবাব দেয় না। তখন গফুর নিরুপায় হয়ে বলে–তামাক আন বুড়ি। বুকটা কেমন খালি খালি ঠেকছে। বুড়ি হাসতে হাসতে উঠে যায়।
তবে গফুরের বয়স নিয়ে কোনো অভিযোগ ছিল না বুড়ির। এই নিয়ে ও একদম মাথা ঘামায়নি। উঠতি বয়সের তরুণ উচ্ছাসের স্বপ্ন ফুটে ওঠার আগেই গফুরের নিরাপদ আশ্রয়ে ছিটকে পড়ে নির্বিবাদ হয়ে গেছে ও। ভেবে আর লাভ কি? বরং এই ভালো। নিজের মনের সঙ্গে খুনসুটি জমে বেশি। ওর কাছে গফুরের দাবি খুব নেই। গফুর ওকে তেমন বিরক্ত করে না। তবুও মাঝে মাঝে যখন গফুরের উপস্থিতি অসহ্য লাগে তখন বুকের ভেতরের দমধরা স্তব্ধতা আকুল হয়ে ওঠে। মনে হয় সবকিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একদম একলা থাকতে। কার্তিক মাসের হিম-পড়া রাতে বাইরে গিয়ে বসে থাকে। বিছানায় কাঁথার নিচে গফুরের বুকের উষ্ণ আমেজ পানসে লাগে। প্রতিদিনের একঘেয়েমীতে সুখ কৈ? বাইরে পাখি ডাকে। তেঁতুল গাছের মাথার ওপর হিম ঝরে। সজনের ডাল নড়ে। বুড়ি পা ছড়িয়ে বসে থাকে। ঠাণ্ডা ঝলক-বাতাস গায়ে ছোঁয়া দিয়ে যায়। যেনো বুড়ির শৈশবের কেউ অনেকদিন পর পথ ভুলে ওর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে এসেছে। ওর বেশ লাগে। নেশার মতো যেনো। সাধ্যি-সাধনা করে টেনে নিয়ে আসে গফুর। গফুরের কণ্ঠে মিনতিই থাকে বেশি। বয়সের অনেকটা পার্থক্যের জন্যে বুড়ির উপর অসীম মমতা গফুরের। বাহুতে জোর থাকলেও গফুর তার অপব্যবহার করেনি কোনদিন। আর সেই নীরব বদান্যে ভালোবাসায় ধরা দেবার মতো যথেষ্ট চতুরতা ছিল বুড়ির আচরণে। কখনো কখনো ভোর রাতের দিকে মাছ ধরতে বেরুতো ওরা। দিনের কড়া আলোয় দেখা পরিচিত গা-টা রহস্যময় মনে হয় বুড়ির কাছে। ঠিক তেমনি অনেক দিনের জানাশোনা ভাই যেমন স্বামী হয়। ভাইকে স্বামী হিসেবে আবিষ্কার করার মতো মনে হয় গাছ-গাছালি, ঘর-বাড়ি আর জলে ডুবে থাকা প্রান্তর। বুড়ির জমাট ধরে থাকা মনের কাঠিন্যে এক পেলব ছোঁয়া দিয়ে যায়। গফুরকে মনে হয় অনেক দূরের। অনেক কালের অদেখা। কাছের মানুষ পর-পর লাগে। বাইরে এলেই বুড়ির অনুভূতি পাল্টে যায়। ও তখন উজ্জ্বল হয়–ওর চোখে-মুখে আনন্দের জ্যোতি ফুটে বেরোয়। ঘরে ও একদম নিজের মধ্যে গুটিয়ে থাকে। বাইরে এলে সে খোলসটা দুম করে ফেটে যায়। বুড়ির কিশোরী চেহারায় প্রকৃতির মাধুর্য প্রতিফলিত হয়। বুড়ি আর বুড়ি থাকে না। ও তখন গফুরের কাছাকাছি আসে।
গফুর হেঁচকা টানে ওকে ডিঙিতে তুলে নেয়। তারপর জোরে একটা ঠেলা দিয়ে নিজে উঠে বসে। জলের বুকে এপাশ-ওপাশ করে ছোট্ট ডিঙি। গফুর ওকে ভয় দেখানোর জন্যে ডিঙির দুলুনি বাড়িয়ে দেয়। এতে ভয় যতো লাগে তার চেয়ে বেশি লাগে মজা। ওতো উদ্দাম বেপরোয়া হতেই চায়। নৌকা ডুবে গেলেই বা কি? ভাসতে ভাসতে ও চলে যেতে পারবে অন্য কোথাও। এখানে ফিরে আসার দায়ভার থাকবে না। গফুর বলে–ভয় লাগে বুড়ি?
–ভয় কিসের তুমি তো আছো?
বুড়ি সজোরে গফুরের হাঁটু জড়িয়ে ধরে। হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে নৌকোর ওপর।
–বাইরে এলে তুই বদলে যাস বুড়ি? ঘরে তুই যেনো কেমন মনমরা থাকিস? মনে হয় আমি তোর পর। ভালো করে কথাই বলিস না?
–বাইরটা আমার ঘর যে। বাইরে এলে আমার প্রাণ ভোমরা ছাড়া পায়।
–এজন্যেই তোকে সঙ্গে নিয়ে আসি।
গফুর আত্মপ্রসাদের হাসি হাসে। এ যাত্রায় বুড়ির সঙ্গে ওকে কথায় ঠকতে হয়নি। ও একটা যুৎসই উত্তর দিতে পেরেছে। গর্বে আনন্দে গফুরের বুক ভরে যায়।
শান্ত পানিতে নৌকা ভাসে। গফুর বৈঠা ছেড়ে দিয়ে বুড়িকে কাছে টেনে নেয়। বুড়ির কিশোরী ঠোঁটে অপূর্ব মাধুর্য। গফুর পাগলের মতো নেশা খোঁজে। দিক ভুল হয়ে যায় গফুরের। কোনো দিশা করতে পারে না। বুড়ি এখন অনেক কাছের–অনেক উষ্ণ অনেক মিনতি ভরা। আঃ বুড়ি কেনো সব সময় এমন থাকে না। নৌকা যখন অন্যদিকে ঘুরে যাবার উপক্রম হয় গফুর তখন আবার বৈঠা নেয়। ও শান্ত মেয়ের মতো চুপচাপ বসে থাকে। তখন ও নিজের মধ্যে থিতিয়ে যায়। বুড়ির ভাই বলে, গফুর বুড়িকে মাথায় তুলেছে। একেই নাচুনে মেয়ে তার উপর পড়েছে ঢোলের বাড়ি। বুড়ি ভাইর কথার জবাব দেয় না। জবাব দিয়ে ঝামেলা বাড়াতে চায় না। মা এ ব্যাপারে বুড়িকে প্রশ্রয় দেয়।
ওরা ওদের মতো থাকুক না। বিয়ের পর বুড়ি যে সব মেনে নিয়েছে এই আমার কপাল। মেয়েটা শান্তিতে থাকলেই আমি বাঁচি।
মা অনেক বুড়িয়ে গেছে। চোখে ঝাপসা দেখে। তবু বুড়ির জন্য উৎকণ্ঠার শেষ নেই। শৈশব থেকেই এ মেয়েটির আচরণ মাকে বড় বেশি ভাবিয়েছে এবং এখনো ভাবায়। পাড়াপড়শি মাঝে মাঝে বুড়িকে মন্দ বলে, মেয়ে মানুষের একি স্বভাব? এইসব। ভাল না বুড়ি।
বুড়ি ঝগড়া করে না। মুখের উপর জবাব দেয় না। সেই জন্য কেউ ওর সঙ্গে তেমন সুবিধে করতে পারে না। বুড়ি চুপচাপ থাকতেই ভালোবাসে। যারা নিজেদের ভালমন্দ বোঝে না তারা ওকে ভালোমন্দের কি বোঝাবে? ও আপন মনে হাসে। এসব কথা শুনতে ওর ভালোই লাগে। কেননা এসব কথায় ওর কিছু যায় আসে না।
গফুরের নৌকা অনেকদূর চলে এসেছে। বুড়ি হাঁটুতে মুখ গুঁজে আপন ভাবনায় মগ্ন। মা-র কথা, ভাই-র কথা, পড়শিদের কথা ওকে আচ্ছন্ন করে রাখে। সরসরিয়ে আঁধার ঝরে যায়। ভোর রাতের হিমেল বাতাস যাদুকরি স্পর্শের মতো মায়াময় লাগে। পড়শিরা যারা ওকে উপদেশ দেয় তারা কি বুঝবে এর মর্ম। বুড়ির ভালোলাগা ধরার সাধ্যি ওদের নেই। এখন এই মুহূর্তে বুড়ির কেবলই মনে হয় এ ডিঙি যদি খাল পার হয়ে অনেকদূর চলে যেতো? যদি বড় গাঙের ডাক শোনা যেতো? এই দেশটার কোথায় কতো কি যে আছে বুড়ির কিছুই দেখা হলো না। দূরের কোনো কুটুম এলে বুড়ি মনোযোগ দিয়ে সে জায়গার কথা শোনে। শহর কি জানে না বুড়ি। সেখানের মানুষ কেমন তাও জানে না। কতো কি যে ওর জানার বাইরে রয়ে গেলো। বুড়ি এক বুক পিপাসা নিয়ে দূরের দিকে তাকিয়ে থাকে। গফুরের ডিঙি তরতরিয়ে বয়ে যায়।
–তুই এতো কি ভাবিস বুড়ি?
–ভাবি? কি আবার ভাবি? ভাবনার কি শেষ আছে?
বুড়ির হাসি খানখান হয়ে ভেঙে গড়িয়ে যায় জলের বুকে। গফুর একটুক্ষণ থেমে সেই পুরোনো প্রশ্ন আওড়ায়; তোকে আমার বিয়ে করা ঠিক হয়নি বুড়ি?
–কেনো? এবার বুড়ি অবাক হয়।
–কেননা আবার, তোর সঙ্গে আমার বয়সের ফারাক যে অনেক।
–তাতে কি, বয়সে কি হয়? ও নতুন ভঙ্গিতে উত্তর দেয়।
–এ জন্যেইতো তোকে বুঝি না। তোর ভাবনা ধরতে পারি না। হতাম তোর বয়সী তাহলে ঠিক হতো।
গফুর একটা নিঃশ্বাস ফেলে।
বুড়ি ঠোঁট উল্টে বলে, বুঝে কি লাভ? যার যার ভাবনা তার তার কাছে। তুমি বুঝলেই বা আমার কি এসে গেলো? আমার অতশত ভালো লাগে না। তাছাড়া আমার। ভাবনা কেউ বেশি বুঝতে চাইলে আমার রাগ হয়।
ও আবার হেসে গড়িয়ে পড়ে। ওর অকারণ উচ্ছাস আজ যেন মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। নিজেও তা রোধ করতে পারছে না। বুড়ির শরীরের ঝাকুনিতে নৌকার দুলুনি বেড়ে যায়! গফুর অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। কখনোই ওকে বুঝতে পারে না। এমন বাধা-ভাঙ্গা হাসিও কদাচিৎ দেখা যায়। গফুর হাসতে হাসতে বলে, এতো হাসিস না বুড়ি? জানিস না যতো হাসি ততো কান্না।
–ছাই। তোমার যেমন কথা। হাসি পেলে হাসবো না বুঝি?
বুড়ির হাসি আর থামে না। গফুরও অকারণে হাসে, ছোঁয়াচে হাসি। জোরে জোরে বইঠা টানে। জলের কোলে নিবিড় সান্নিধ্য খোঁজে ডিঙি এবং সঙ্গে দুটি তৃষ্ণার্ত প্রাণও। গফুরের মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে বুড়ির মতো হয়ে যেতে। বুড়ির বয়সটা ফিরে পেলে গফুর পৃথিবীতে আর কিছুই চাইতো না। জমিজমা, ঘরবাড়ি, মাছ ধরার জাল, ডিঙি নৌকা সব দিয়ে দিতে পারে ও। কোন দিনই হিসেবী লোক ছিল না। এখন বুড়ির সান্নিধ্য ওকে আমূল পাল্টে দিয়েছে। ওকে একটু খুশি করতে পারলে বুক ভরে যায়। যখন বুড়ি মনমরা হয়ে থাকে, হাজার ডাকলেও সাড়া দেয় না, কথা বলতে চায় না তখন ভীষণ খারাপ লাগে গফুরের। কি করবে বুঝতে পারে না। ঘন ঘন হুঁকো টানা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না। প্রথম স্ত্রীকে কেন্দ্র করে এমন কোন ইচ্ছেই গফুরের ছিল না। অথচ তখন দুজনেরই ভরা যৌবন। শারীরিক অনেক মাতাল ইচ্ছে ছিলো, সান্নিধ্যে ছিল উষ্ণতা, ছিল আমেজ। কিন্তু সে বৌ গফুরের চেতনা দখল করতে পারেনি। সে সময় গফুর মাঠে মাঠে বেশি সময় কাটিয়েছে। যাত্রা শুনে রাত কাবার করে ঘরে ফিরেছে। বৌ ওকে কিছু বলেনি। কোনো অনুযোগ করেনি। বরং প্রথম বৌয়ের ভয় ছিল বেশি। সব সময় আড়ষ্ট হয়ে থাকতো। সে সব নিয়ে গফুরের কোনো মাথা ব্যথা ছিল না। দুটো ছেলে হবার পর সম্পর্ক আরো শিথিল হয়ে যায়। গফুরের মনে হতো তখন কোনো বন্ধন ছিল না। কিন্তু এখন ও একটা বন্ধনের মধ্যে আছে। এই বন্ধন ওকে যতদূর টেনে নিয়ে যাবে ততদূর যেতেই ও রাজি। বুড়ি প্রাণবন্ত, সতেজ। সংসারের অনেক কিছুই বোঝে না। তবুও বুড়িকেই বেশি ভালো লাগে। গফুরের। ওর মধ্যে যেনো অতিরিক্ত কিছু আছে। কৈশোরের নোনাগন্ধে ভরপুর ওর। নতুন যৌবন। মিঠে নোনতা তেতো সব মিলিয়ে নতুন কিছু। ত্রিবিধ স্বাদ অথচ একটার সঙ্গে আর একটার অদ্ভুত যোগাযোগ। গফুর ঠিকভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে না। প্রথম যৌবনে গফুর এ স্বাদ পায়নি। তাই বুড়ির জন্যে সব সময় মন টানে। বুকটা চেপে থাকে। সারাক্ষণ একটা হারাই হারাই ভাব পাগল করে রাখে গফুরকে। মন বলে জলের টান কোনদিন বুঝি ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। ডিঙি বাইতে বাইতে গফুর বলে, আজ আর তোকে নিয়ে ঘরে ফিরবো নারে?
–কোনদিকে যাবে?
–যেদিকে দুচোখ যায়।
–বেশ যাও। এই আমি চোখ বুজলাম।
–ডিঙি যদি ডুবে যায়?
–তাতে কি, তুমি তো আছে।
বুড়ি পরম নিশ্চিন্তে খালের পানি গালে মাখে। দূরে তাকিয়ে থাকে।
–আমি যদি ডাঙায় ওঠাতে না পারি?
–বুকে নিয়ে ডুবে মরতে তো পারবে।
বুড়ি হেসে গড়িয়ে পড়ে। গফুর কথা বলতে পারে না। যুৎসই জবাব খুঁজে পায়। বুড়ির এ কথার পর আর উত্তর হয় না। গফুরের হঠাৎ মনে হয় এতটা বছর ধরে এ খালে ও নৌকা বাইছে তবুও কোথায় যেনো কি ওর দেখা হয়নি। বুড়ি সেসব নতুন করে দেখাচ্ছে। কখনো ইশারায় দেখায়, কখনো চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখায়।
–হাঁ করে দেখো কি?
–দেখি তোকে।
–রোজই তো দেখো।
–তাও তো দেখা হয় না।
বুড়ি আবার হেসে গড়িয়ে পড়ে।
–তুই অন্যরকম কেননা বুড়ি?
–কেমন?
–তা তো জানি না।
–তবে যে বললে?
–তাই তো? গফুর মাথা চুলকায়। কেমন তা কি ও নিজেও জানে? আসলে প্রকাশ করতে পারে না। প্রাণটা আইঢাই করে ফেটে গেলেও অনেক কথা বলতে পারে না।
–আমাকে নিয়ে তোমার খুব জ্বালা না?
বুড়ির কণ্ঠে ভিন্ন সুর। গফুর চমকে ওঠে।
–কে বললো?
–মাঝে মাঝে তুমি যে কেমন কথা বল?
গফুর হো-হো করে হেসে ওঠে। দমকা বাতাসের আচমকা ঘূর্ণি যেন।
–তোর জন্যে আমার মরে যেতেও সুখ রে বুড়ি?
পানির উপর ঝুঁকে পড়া তেঁতুল গাছের গোড়ায় নৌকা থামায় গফুর। নৌকা আটকানোর জন্যে লোহার শিকটা গেঁথে দেয় কাদায়। ডালপালার ঝোপঝাপে জায়গাটা চমৎকার। ঘরের নিরাপত্তা পাওয়া যায়। বুড়ির হঠাৎ করে ভালোলাগে।
–এখানে থামলে কেন?
–তোর জন্যে। গফুর বুড়িকে কাছে টেনে নেয়।
–জায়গাটা কি সুন্দর! মনে হয় ঘর।
–তোর ভালো লাগলেই হলো।
–আঃ কি কর! চারদিকে লোকজন।
–কোথায় লোক? এখনো পুরো আঁধার কাটেনি।
গফুর বুড়ির নিষেধ শোনে না। ভোরের হিমেল বাতাস ছুটে এসে গায়ে পড়ে। চমৎকার পরশ দিয়ে উধাও হয়ে যায়। তেঁতুলের ডাল গায়ের ওপর। শিরশির অনুভূতি জাগায়। যতদূর চোখ যায় সব ধােয়াটে দেখায়। বুড়ি অন্য কিছু ভাবতে চায় না। বুড়ি এখন নিজের মধ্যে নিমগ্ন হয়ে পড়ে। কখনো যে জিনিসটা কাথার ভেতর অসহ্য লাগে কখনো নৌকার উদোম হাওয়ায় তা অনবদ্য হয়ে ওঠে। কেননা যে ভালোলাগার রঙ এত ঘনঘন বদলায়! বুড়ি আপনমনে হেসে ওঠে।
–ছাড়ো।
–না। তুই বলেছিলি না বুকে নিয়ে ডুবে মরতে? এখন মরবো। সাধ হয়েছে মরার।
–ইস্ শখ কতো! আমি কি খালের পানি যে ডুবে মরবে?
–এখন তাই।
–তাহলে মর। আমি চোখ বুজলাম।
গফুর বড় নিঃশ্বাস নেয়।
–ইচ্ছে করে তোর ঠোঁটটা কামড়ে ছিঁড়ে নিই। বুড়ি আবার হেসে ওঠে।
মাছ মারতে এলে তুমি কামড়ে কামড়ে শালুক খাও। শালুক না খেলে না কি তোমার মাছ ধরার নেশা জমে না। তুমি শালুক দেখলে পাগল হয়ে ওঠ। আচ্ছা যখন শালুক থাকে না তখন তুমি কি খাও? তোমার নেশা কি দিয়ে আটকে রাখ?
–আঃ বুড়ি। বুড়ি-বুড়ি-বুড়ি–
গফুরের কণ্ঠ জড়িয়ে আসে। গফুরের কণ্ঠ দিয়ে আর শব্দ বেরুতে চায় না। ও এখন কোনো শব্দ চায় না। চায় নীরবতা–প্রকৃতির মায়াময় নিস্তব্ধতা।