বাবা খকখক করছেন।
এই খকখক অন্যদিনের মতো নয়। আজকেরটা ভয়াবহ যেন তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করছেন ফুসফুসের খানিকটা অংশ কাশির সঙ্গে বের করে ফেলতে পারছেন না। আমি মনে মনে বললাম, আরে যন্ত্রণা! বলেই খানিকটা অনুশোচনা হল। যাকে বলে জন্মদাতা পিতা! বেচারা কাশতে কাশতে ফুসফুস বের করে ফেলছেন। এই সময় সহানুভূতিতে পুত্রের হৃদয় আর্দ্র হওয়া উচিত। হাওয়াটাওয়া করা উচিত কিংবা ছুটে যাওয়া উচিত একজন ডাক্তারের কাছে। তা করতে পারছি না, কারণ এখন বাজছে ছটা তিরিশ। আমি ঘুমুতে গেছি রাত তিনটায়। আমার পক্ষে মমতা দেখানো সম্ভব না। তবু দেখাতাম—দেখাচ্ছি না, কারণ, বাবার এই খকখক সাময়িক ব্যাপার, কিছুক্ষণের মধ্যে থেমে যাবে। আবার শুরু হবে রাতে ঘুমুতে যাবার আগে আগে। শিয়াল প্রহরে প্রহরে ডাকে, আমার বাবা ডাকেন সকালে এবং সন্ধ্যায়। বাকি সময়টা তিনি মোটামুটি সুস্থ।
আমি চাদর দিয়ে পুরোপুরি নিজেকে ঢেকে ফেললাম। মন থেকে সমস্ত চিন্তা-ভাবনা দূর করে ফেললাম। ঘুমটা আবার শুরু করা যায় কি না তার জন্যে প্রাণপণ চেষ্টা। সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। রাতের ঘুম ভাঙলে জোড়া লাগে, ভোরবেলারটা লাগে না।
বীরু, ওই বীরু।
মার গলা। মটকা মেরে পড়ে থাকলে কোন লাভ হবে না। মা কিছুক্ষণ গা ঝাঁকাবেন, টান দিয়ে চাদর ফেলে দেবেন, আদুরে গলায় ডাকাডাকি করতে থাকবেন। এবং ঘুম ভাঙানোর জন্যে গায়ে মাথায় হাত বোলাবেন। একটা বিশেষ বয়সের পর পুত্ররা মার এই জাতীয় আদর খুব একটা পচ্ছন্দ করে না, কিন্তু আমার মা এই খবরটা জানেন না।
বীরু ও বীরু।
শুনছি। কি ব্যাপার?
তোর বাবার তো দম আটকে আসছে। শেষরাত থেকে কাশছে।
বল কী?
ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপছে। তুই একটু যাবি?
কোথায় যাবো?
ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে আয় না লক্ষ্মীসোনা!
মা আবার তার শুকনো হাত আমার বুকে-পিঠে বোলাতে লাগলেন। আমি বিরক্ত গলায় বললাম, সুড়সুড়ি দিও না মা, যাচ্ছি। চা দিতে বল, ঘুমটা কাটুক।
মা ছুটে গেলেন। এক্ষুনি কুৎসিত খানিকটা গরম জিনিস কাপে ঢেলে নিয়ে আসবেন। তার না আছে স্বাদ না আছে কিছু। জিনিসটা গরমও হবে না, আবার ঠাণ্ডাও না। অতিরিক্ত মিষ্টির জন্যে মুখে দেওয়া যাবে না এবং অবধারিতভাবেই দুধের সর ভাসবে। ত্রিশ-চল্লিশ বছর ধরে মা চা বানাচ্ছেন—এখনো তিনি জিনিসটা শিখতে পারলেন না। শুধু চা কেন—এই জীবনে তিনি কিছুই শিখতে পারেন নি। আমি যখন। ক্লাস ফোরে পড়ি, তখন সূচিকর্মে তাঁর প্রবল উৎসাহ দেখা গেল। অনেক রাত্রি জাগরণের পর কী একটা জিনিস যেন তৈরি হল। সেইটি গোপনে বাঁধিয়ে বসার ঘরে ঝোলানো হল—উদ্দেশ্য বাবাকে অবাক করে দেওয়া। বাবা সেই শিল্পকর্ম দেখে গম্ভীর গলায় বললেন, এটা কি? মা ক্ষীণ গলায় বললেন, তাজমহল। বাবা আরো গম্ভীর হয়ে বললেন, আমার বাড়িতে তাজমহল কেন? আমি কি শাহজাহান? এক্ষুনি নামাও।
তাজমহল অবশ্যি নামানো হল না। রবীন্দ্রনাথ এবং নজরুল—এই দুই কবির মাঝখানে তাজমহল হাইফেনের মতো বসে রইল। এখনো আছে, তবে রবীন্দ্রনাথের ছবিটা নেই। একাত্তরের যুদ্ধের সময় বাবা রবীন্দ্রনাথকে বিসর্জন দেন। নজরুলের ছবিটা এখনো আছে। ছবিটার দিকে তাকালে মনে হয় কবি নজরুল মুগ্ধ চোখে মার তৈরি তাজমহল দেখছেন। মার শিল্পকর্ম একজন বড় কবিকে মুগ্ধ করেছে, এটাই বা কম
কী? বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই আবার বাবা নতুন-উদ্যমে কাশি শুরুকরলেন। খকখক। খরখকখক খর। সমস্ত ব্যাপারটার মধ্যে বেশ একটা তালের ভাব আছে। এটাকে হয়তো ত্রিতাল কাশি বলা যাবে কিংবা কে জানে এটা হয়তো ঝাঁপতাল। প্রতিভাবান ব্যক্তিদের কাশি সাধারণ মানুষদের মতো হবে কেন? একটু অন্যরকম হবে।
আমার বাবাকে একজন প্রতিভাবান ব্যক্তি বলা চলে। তাঁর ডিগ্রিগুলি এরকমবি এ (অনার্স), এম এ (ডাবল), এল এল বি। নানান ধরনের ডিগ্রি অর্জন ছাড়াও অন্যান্য প্রতিভার স্ফূরণও তাঁর মধ্যে দেখা গেছে যেমন কবিতা, নাটক এবং যন্ত্রসঙ্গীত। পড়াশোনা শেষ করবার পর চাকরিবারির মতো তুচ্ছ ব্যাপারে তাঁর কোনো আগ্রহ দেখা যায় নি। তিনি শিল্প-সাহিত্যের চর্চায় উৎসাহী হয়ে ওঠেন। অতি অল্প সময়ে প্রায় হাজারখানেক কবিতা, দেড়টা নাটক এবং একটা পুরো উপন্যাস লিখে ফেলেন। নেত্রকোণায় আমার দাদাজানের আদি বাড়িতে প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় সাহিত্য আসর বসতে থাকে। গেটের কাছে একটা সাইনবোর্ড টানানো হয়—আলতা সাহিত্য বাসর। তাঁর গানের গলা না-থাকায় তিনি বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র নিয়ে প্রবল চেষ্টা চালান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে তবলা এবং বেহালা। নেত্রকোণায় বেহালা শেখানোর মতো তেমন কোন শিক্ষক ছিলেন না বলে তবলার উপর চাপটা একটু বেশি পড়ে। গ্রীষ্মের দুপুরগুলিতে দরজা-জানালা বন্ধ করে ঘামতে ঘামতে তিনি তবলায় বোল তুলতে থাকেন—তেরে কেটে ধিনতা। তেরে কেটে ধিনতা ধিনাক ধিনাক ধিন।
এই সময় তাঁর বয়স প্ৰায় তিরিশ। টাকাপয়সা উপার্জনের মতো মামুলি বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাবার মতো সময় বা মানসিকতা কিছুই নেই। প্রতিভাবান ব্যক্তিরা এইসব ছোটাখাটো ব্যাপার নিয়ে চিন্তা করতে পারেন না। তাঁদের অনেক বড় জিনিস নিয়ে ভাবতে হয়। মহৎ চিন্তা করতে হয়। এইসব মহৎ জিনিস নিয়ে ভাবতে ভাবতে বাবা আরও একটি মহৎ কাজ করে ফেলেন। ত্রিশ বছর বয়সে তের বছরের এক বালিকার প্রেমে পড়ে যান। বাবার দেড় হাজার কবিতার প্রায় সব কটি এই বালিকাকে নিয়ে লেখা। এই বালিকার সঙ্গে বাবার বিয়ের কোনো প্রশ্নই ওঠে না, কারণ বালিকাটি সরকারী হাসপাতালের এক হতদরিদ্র কম্পাউন্ডারের মেয়ে। কম্পাউডার সাহেবের বাঁ পা ডান পায়ের চেয়ে ইঞ্চিখানেক ছোট বলে নেংচে নেংচে হাঁটেন। তাঁর বহুল পরিচিত নাম হচ্ছে নেংড়া কম্পাউন্ডার। শারীরিক অসুবিধা ছাড়াও কম্পাউন্ডার সাহেবের আরো সব অসুবিধা ছিল। স্পিরিট এবং ধেনো মদ খেয়ে তিনি মাঝেমধ্যেই নেশা করতেন। নেত্রকোণার একটি বিশেষ পাড়ার সামনে তাঁকে সেজেগুজে প্রতি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় উদাস নয়নে হাঁটাহাঁটি করতে দেখা যেত।
আমার প্রেমিক-বাবা এইসব তুচ্ছ জ্ঞান করলেন এবং এক সন্ধ্যায় আমার দাদাকে গিয়ে বললেন, এই মেয়েটিকে বিয়ে না করতে পারলে তাঁর জীবন নষ্ট হয়ে যাবে। ইত্যাদি ইত্যাদি।
দাদাজান একটি কথাও না-বলে বাবার বক্তব্য শুনলেন। ফরসি হুক্কায় টান দিতে দিতে পা নাচাতে লাগলেন। বাবার বয়ান শেষ হলে গম্ভীর গলায় বললেন, তোমার মতো একজন জ্ঞানী মানুষের জীবন নষ্ট হওয়াটা কোনো কাজের কথা না। তোমার এত মূল্যবান জীবন বজায় থাকাই ভালো। যাও, বিবাহ কর। এবং বৌকে নিয়ে ঢাকায় গিয়ে থাক। ভয় নেই, চাল-ডাল, মশলাপাতি এখান থেকে পাঠাব। মাসে মাসে হাতখরচও পাবে। তবে আমি যত দিন জীবিত আছি, ততদিন তুমি এবং তোমার বৌ কেউই আমার সামনে পড়বে না। এখন আমার সামনে থেকে বিদায় হও।