০১. বাপটা খায়

ফজল আলী আসছে – উপন্যাস – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

০১.

বাপটা খায়। রোজ নয়, মাঝে মাঝে। দুদিন ফাঁক দিয়ে হয়তো তিন দিনের দিন সাঁঝবেলায় এক পেট ঝঝ খিদে নিয়ে হাজির। সবদিন তা বলে ভরপেট দেওয়া যায় না। বায়নাক্কা নেই অবশ্য। রুটি গুড় দিল তো তা-ই সই। নইলে আধভাঙা গম আর কুখিক-লাইয়ের খিচুড়ি, নয়তো গম ভাজা, নিদেন কিছু আটা জলে গুলে ছাতু মাখার মতো খেয়ে ওঠে।

ছেলে হরিপদ ভাবে, বাপ আমারটা খায়। তার আগের পক্ষের বউও ভাবে, শ্বশুর আমাদেরটা খায়। ভাবলেই হল। মানুষ যা-ই ভাবে তার কাছে দুনিয়াটা সেইমতো।

বাপ হরিদেব নিজে কিন্তু ভেবে পায় না যে সে কারটা খায়। কোথায় খায়, হাগে, মোতে, কোথায় শোয়, এ তার মনেও থাকে না তেমন।

কারটা সে খায় এইটে হরিদেব আজ ভাবছিল। ভাবত না যদি না ছোট ছেলে নিত্যপদ দশ পয়সার মুড়ি লজেফুস কিনে বাপকে বলত, একটু খাবে বাবা? ভিতরে মৌরি দেওয়া আছে। ওপরের মিষ্টিটা চুষে খেলে মৌরিটা বেরিয়ে পড়ে। তখন চিবিয়ে।

হরিদেব ভারী অবাক হয়ে দেখে জিনিসটা। হাত পেতে নেয়ও। মুড়ি লজেশই বটে। এক্কেবারে হুবহু মুড়ির মতো দেখতে, তবে নানা রঙের। হাতে নিয়েও খেল না, নিত্যকে ফিরিয়ে দিয়ে বলল, তুই খা। পয়সা পেলি কোথায়?

চুরি করিনি, মা দিয়েছে।

তোর মা এয়েছিল আজ?

আসবে না তো কী! আজ দাদার বিয়ে না? দুপুর থেকে এসে বসে আছে।

 তা বটে, হরিদেবের মনে পড়ে গেল। তাই তো! আজ তার ছেলে হরিপদর বিয়ে। মনে থাকে না। মনের আর দোষ কী? হরিপদ এত ঘন ঘন বিয়ে করে যে তাল রাখা মুশকিল। কপালটাই। খারাপ ছেলেটার। বউ থাকে না। গত চার বছরে এই নিয়ে–

কতবার হল রে নেত্য?

কী?

বিয়ে?

তিন।

কোন বউটা সবচেয়ে ভাল ছিল?

গেলবারেরটা। ফটর ফটর কথা কইত খুব, ফরসা ছিল।

সেইটেই সবচেয়ে বেশি দিন ছিল, না?

না, প্রথম মাগিটাই বেশি দিন ছিল।

ন’ বছরের ছেলের মুখে মাগি শুনে হরিদেব ভাবল, একটা ধমক দেয়! তারপর ভাবে, যাক গে, যাক গে, যাক গে বাবা! মুখ ফসকে কত ওরকম বেরোয়।

এই দেখো মৌরি।—বলে নিত্য জিভ বের করে দেখায়।

হরিদেব দেখে, বাস্তবিকই ছেলের জিভে তিন চারটে চোপসানো মৌরি। ফোকলা মুখে হরিদেব হাসে। বলে বাঃ বাঃ!

হরিদেব ভাবল, আজ আমার ছেলের বিয়ে। অা? ছেলের বিয়ে ভেবে সে বেশ একটু দেমাক বোধ করে। ছেলের বিয়ে’ কথাটার মধ্যে একটা ভারভাত্তিক ব্যাপার আছে।

বিয়েতে অবশ্য হরিদেবের নেমন্তন্ন হয়নি। তা সে আগেরবারে বা তার আগেরবারেও হয়নি। প্রথমবারের বিয়েতে টুনি বালব জ্বেলে বাহার দিয়ে আসর সাজিয়েছিল ছেলে। জনা পঞ্চাশেক লোক খেলা হরিদেবকে বলেনি বলে সে গদাধরবাবুদের বাড়ির চালাঘরের গুদামে খাটিয়া বিছানায় গুম হয়ে পড়েছিল। অনেক রাতে হরিপদ নিজেই কলাপাতায় মুড়ে ভাত, মাংস, চাটনি আর দরবেশের একটা দলা নিয়ে বাপকে ঠেলে তুলে বলল, বলি কোনওদিন শুনেছ ছেলের বিয়েতে বাপের নেমন্তন্ন হয়? তাহলে নিজের বিয়েতেও নেমন্তন্ন না হলে যাওয়া আটকায়। খেয়ে নাও তো।

খেয়েছিল হরিদেব। ভাত, মাংস, চাটনি, দরবেশ মিশে গিয়ে খুব খারাপও লাগেনি।

দ্বিতীয় বারেরটায় অত ঘটা হয়নি। তবে কারবাইডের আলো জ্বেলে রিকশা সাজিয়ে বউ এনেছিল। সেবারে ছিল ঘুগনি, কচুরি আর একটা করে শোনপাপড়ি।

এবারে কী হবে রে? খাওয়াবে তো বিয়েতে?

ধুস! নেত্য পথের ধারে একটা টিভির দোকানের সামনে ফস করে দাঁড়া হয়ে বলে, নারায়ণের ভোগ লাগিয়েছে। তারই প্রসাদ পাবে সবাই! বাতাসা, নাড়ু, আমের টুকরো, শিন্নি আর মিলক পাউডারের পায়েস। এক আঁজলায় খাওয়া হয়ে যায়। বাবা, ওই যে সমীরণবাবু যাচ্ছে। তোমাকে দেখেছে কিন্তু।

হরিদেব দেখে সমীরণবাবুই বটে। ঠান্ডা, সুস্থির লোক। গদাধরবাবুদের নীচের তলায় ভাড়া থাকে। স্টোভ জ্বেলে নিজে রান্না করে খায়।

নিত্য বলে, কেরোসিনের পয়সা কী করলে? মেরে দিয়েছ?

 কিছু মনে পড়ে না। হরিদেব বলে, কোন পয়সা?

পণ্ডিতের দোকান থেকে কেরোসিন আনতে গেলে যে? সমীরণবাবু পাঁচ লিটারের দাম দিল না সেদিন? কাল আমাকে বলছিল, তোর বাবা আমার টাকাও মারল, তেলের টিনটাও গেল।

ওঃ! সে টিন টাকা সব পণ্ডিতের দোকানেই পড়ে আছে। ভুলে গিয়েছিলাম।

সে জানি! পণ্ডিত বলল, তুমি ত্রিশ পয়সা কম দিয়েছ পাঁচ লিটারের দামের চেয়ে।

মারিনি। খরচ হয়ে গেছে বোধহয়।

 দেবে এখন সমীরণবাবু। ওই আসছে।

 নিত্যপদ দোকানের টিভি সেট-এর দিকে চেয়ে থাকে।

সমীরণ সোজা এসে হরিদেবকে বলে, তেলটা এনে দিলে না যে বড়? কোথায় থাকো, খুঁজে পাই না।

খুব মোলায়েম হেসে হরিদেব বলে, আজ আমার ছেলের বিয়ে কিনা বাবু!-বলে বেশ একটা দেমাক বোধ করে।

ভ্রু কুঁচকে সমীরণ বলে, কাল সকালে এনে দিয়ো তবে। স্টোভে যা তেল আছে তাতে আজ হয়ে যাবে। কাল কিন্তু চাই।

দেব।

সমীরণ চলে যেতেই নিত্য বলে, আর একটু হলে টাকাটা ঠিক মেরে দিতে তুমি।

হরিদেব অবাক হয়ে বলে, মেরে দিলেই হল! মেরে তখন যাব কোথায়? ধরবে না?

শিউলির মা যে গম বেচতে দিয়েছিল তা সে বিক্রির পয়সা দিয়েছ ফেরত? আমাকে দেখলেই শিউলির মা বলে, তোর চোর বাপটা কই রে?

কই রে!—–হরিদেব ছেলেকে ভেঙিয়ে বলে, কাপড়ের তলায় লুকিয়ে আছি নাকি? কাকে বেচলাম সেইটেই তো মনে নেই। তা বলে কি চোর!

হরিদেব উদাস চোখে রাস্তা দেখে।

নিত্য ঠেলা দিয়ে বলে, টিভি দেখেছ বাবা? ঠিক সিনেমার মতে, না?

হু।

বিকেলের দিকে শহরতলির দোকানপাট একে একে খুলছে। চালপট্টির মুখে গরম তেলে আলুর চপ ছাড়ল গণশা। বেড়াতে বেড়াতে ছেলের পিছু পিছু চলে এসেছিল হরিদেব।

নিত্যটা চুরি শিখেছে। নইলে অত পয়সা পায় কোথায়? যেখানে সেখানে ঠেক খাচ্ছে আর জিনিস কিনছে।

নিত্য তিনটে চপ কিনে একটা বাপকে দিয়ে বলল, আর চাইবে না বলে দিচ্ছি!

আমি চাই? তুই তো দিলি!

নইলে তো নজর দেবে!

নিয়ে নে না। তুই খা।

 নিত্যর একটু মায়া হয় বোধহয়। বলে, আচ্ছা খাও।

বাপটা খায়। কিন্তু ভেবে পায় না, সে আসলে কারটা খায়।

.

০২.

রায়বাবু আর আচার্যিবাবু কেউই কলকাতায় নেই। তারা দু’জন না থাকলে সমীরণের ছুটি। কিংবা ছুটিও ঠিক নয়। আসলে কথা হয়ে আছে, রোজ অফিস খুলে বসতে হবে। পার্টি এলে কথাবার্তা বলতে হবে। গোটা পাঁচেক পার্টিকে তাগাদা দিতে বেরোতে হবে। কিন্তু এসব হল কথার কথা। নজরদার না থাকলে দিনমান ভূতের মতো কে অন্ধকার অফিসঘরটায় বসে থাকে।

নজরদার অবশ্য একজন আছে। সে হল সুখন বেয়ারা। বেয়ারা কে বেয়ারা, অফিসঘরের বাইরে একটা খুদে উনুন জ্বেলে সে আবার পাঁচটা খুদে অফিসের বাবুদের চা দেয় বলে চা-ওয়ালাও বটে, আবার সকালে সে-ই ঝাড় লাগিয়ে জমাদারের কাজ করে বলে জমাদার কে জমাদার। তার আরও রোজগার আছে। রাতে ফাঁকা অফিসঘরগুলোয় সে তার দেশওয়ালি ঠেলাওয়ালা, রিকশাওয়ালা, কুলি-মজুরদের শোওয়ার ব্যবস্থা করে, মাথা পিছু প্রতি রাতে বিশ পঞ্চাশ পয়সা নেয়। প্রথম প্রথম সুখন সমীরণের ওপর খুব মেজাজ নিত। তারপর ক্রমে এখন সুর নরম হয়েছে। কিন্তু নজর সে রাখে ঠিকই। কবে সমীরণ এল, কবে এল না, এসব টুকে রাখছে। রায়বাবু আচার্ষিবাবু ফিরলেই লাগাবে।

তবে সমীরণের সুবিধে হল, তার চাকরিতে আউটডোর আছে। সিনেমার শুটিং-এর মতো। মাঝে মাঝে শহরে ভো চক্কর মারতে হয়। আজকাল ক’দিন সারাবেলা গড়িমসি করে কাটিয়ে বিকেলে অফিসে ফিরে সুখনকে বলে—আউটডোরে কাজ ছিল রে। চা দে বাবা। বড্ড ঘেমে গেছি।

রোজ ঠিক ঠিক মতো বাসে বা ট্রামে ভাড়া দিলে মাসে বিশ-ত্রিশ টাকার ধাক্কা। তাই সুবিধে পেলেই ট্রাম বাসের ভাড়াটা ফঁকি দেয় সমীরণ। আজও দিল। তবে কিনা খুব ভাল ফাকিবাজ হতে গেলে বাস বদল করে করেই যাওয়া ভাল। সময় একটু বেশি লাগে। কিন্তু একনাগাড়ে বেশি দূর গেলে ভাড়া কঁকি দেওয়ার সুযোগ কম। আর অসুবিধে হয় ফাকা বাসে। কিন্তু ভগবানের অসীম দয়ায় আজকাল আর কলকাতায় ফাকা বলে কিছু নেই। গড়িয়াহাটায় একবার নেমে, কিছুটা হেঁটে, তারপর ট্রামে চেপে ওয়েলিংটনের মোড়ে পৌছে গেল সে।

সুরেন ব্যানার্জি স্ট্রিটে তার অফিস। খানিকটা হাঁটতে হয়। হাঁটতে হাঁটতে উদাস চোখে আকাশটা দেখে নেয় সমীরণ। ভারী নিচু মেঘ থম ধরে আছে, ঝলসাচ্ছে মাঝে মাঝে ঢালবে।

মোড়ে একটা ভুজাওয়ালার দোকান থেকে রোজ ত্রিশ পয়সার মুড়ি কেনে সমীরণ। স্বাস্থ্য সম্পর্কে সে খুবই সচেতন। বাইরের আজেবাজে জিনিস, ভাজা বা বড়া, খোলা খাবার, কার্টা ফল, দোকানের কাপে বা গ্লাসে জল বা চা সে কখনও খায় না। ভুজাওয়ালা তার জন্য ভেজা ছোলা, আদা, গোলমরিচের গুঁড়ো আর বাদাম দিয়ে মুড়ি বানিয়ে দেয়, তেল দেয় না। অফিসে সমীরণের নিজস্ব গ্লাশ আছে, তাইতে চা খাবে মুড়ির পর।

বলতে কী সমীরণের স্বাস্থ্য খুবই ভাল। সচরাচর এত ভাল স্বাস্থ্য দেখা যায় না। হায়ার সেকেন্ডারি ক্লাসে পড়ার সময়েই সে বুঝতে পেরে গিয়েছিল যে লেখাপড়ার মাথা তার তেমন ভাল কিছু নয়। কোনওক্রমে পাশ করে সে যখন কলেজে ভরতি হল তখন তারা দু’চারজন বন্ধু মিলে ভবিষ্যতের পরামর্শ করত। চাকরির বাজার খারাপ, ব্যাবসা হওয়ার নয়, সুতরাং লাইন ধরতে হবে। বিভাস বলেছিল, খেলোয়াড়-টেলোয়াড় হতে পারলে চাকরি বাঁধা।

সমীরণ ইস্কুলে ফুটবল খেলত। কথাটা তার মনে ধরল। আর ধরতেই সে আবার একটা ক্লাবে ভরতি হয়ে ফুটবল খেলতে লাগল। সে খেলার পিছনে একটাই উদ্দেশ্য ছিল। চাকরি। তাই খেলাটা হয়ে দাঁড়াল জুয়াখেলার মতো। সব সময়ে মনে মনে ভাবত এই বুঝি মাঠের বাইরে থেকে বড়সড় কোনও ক্লাবের কর্মকর্তা তাকে দেখছে। কিংবা কোনও বড় অফিসার-টফিসার। খেলা চোখে লাগলেই নিয়ে গিয়ে চাকরিতে বসিয়ে দেবে। অনবরত এসব ভাবত বলে তার খেলা ভাল হত না। বলের পিছনে ছুটে, ল্যাং মেরে আর ল্যাং খেয়ে বৃথাই বড় খেলোয়াড় হওয়ার কপট চেষ্টা করত সে। ক্লাবের বড় খেলা থাকলে তাকে বাদ দিয়ে টিম হত। ফুটবলে কিছু হল না।

বিভাস আর-একদিন বলল, স্বাস্থ্য ভাল করলে পুলিস বা সিকিউরিটিতে চাকরি হয়ে যায়। সেই পরামর্শমতো দুজনেই ব্যায়াম করতে শুরু করে। ব্যায়ামের সুফল তো আছেই। স্বাস্থ্য ভাল হতে লাগল। কিন্তু স্বাস্থ্যবান বা ব্যায়ামবীরের দুর্ভিক্ষ নেই। চাকরিও সস্তা হয়নি। কাজেই ব্যায়ামই সার হল। একদিন সমীরণ হতাশ হয়ে বলল, ধুস!

বিভাস এর পরেও হাল ছাড়েনি। সাঁতারু কুস্তিগীর এইসব হওয়ার জন্য এবং হয়ে চাকরি পাওয়ার জন্য বিস্তর চেষ্টা চালায়।

একদিন বিভাসই এসে খবর দিল, একটা লাইন পেয়েছি, বুঝলি। রায়বাবু নামে একজন বড় ব্যাবসাদার আছে, তার একজন গুন্ডা দরকার।

গুন্ডা! বলে খুব বিস্ময় প্রকাশ করেছিল সমীরণ।

বিভাস বলল, আমিই কাজটা নিতাম। কিন্তু একটা ভাল মোটর গ্যারাজে আমি মেকানিকের কাজ পেয়ে গেছি। তিনশো পঁচিশ টাকা প্লাস টিফিনের জন্য রোজ চল্লিশ পয়সা।

সমীরণ ভীষণ অবাক হয়েছিল। বিভাস কবে যে মোটর মেকানিকের কাজ শিখল! জিজ্ঞেস করতে বিভাস দুঃখের সঙ্গে বলল, আর বলিস না ভাই। দু’বছর আগে সরকারি চাকরির বয়সটা পেরিয়ে যাওয়ার পর মরিয়া হয়ে ড্রাইভিং শিখতে থাকি। মেকানিকের কাজ জানা থাকলে সফারের চাকরিও খারাপ নয়। তাই সবটাই শিখতে লাগলাম। এখন আমি একজন খুদে এক্সপার্ট। স্বাস্থ্য ভাল বলে খাটতেও পারি অসুরের মতো।

কিন্তু আমি যে কখনও গুন্ডামি করিনি।

গুল্ডা বলতে সেরকম ব্যাপার নয়। রায়বাবুর আসলে দরকার একজন বডিগার্ড গোছর লোক। অনেক ক্যাশ টাকা নিয়ে চলাফেরা করতে হয়। তাছাড়া কয়েকটা তঁাদড় পার্টি আছে, তাদের মাঝে মাঝে ভয় দেখানো দরকার। রিস্ক নেই। শোন সমী, চুঁচিবায়ু-টায়ু ছাড়। শুনছিস তো দেশের জন্য যেমন প্রয়োজন তেমনভাবে সবাইকে তৈরি হতে বলা হচ্ছে। দেশের যখন ডাক্তার দরকার তখন বেশিরভাগ ছেলেকে ডাক্তারিতে শিক্ষিত করতে হবে, যখন উকিল দরকার তখন ওকালতি বাড়াতে হবে, যখন দেশে যেটার প্রয়োজন দেখা দেবে তখন আমাদেরও সেইভাবে তৈরি হতে হবে। যখন ইঞ্জিনিয়ার দরকার নেই তখন খামোকা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে দেশের বেকার সমস্যা বাড়ানো ঠিক নয়। কেমন, একথাটা মানছিস?

মানছি।

তবে আর বেগরবাই করছিস কেন? এখন বডিগার্ডের নেসেসিটি দেখা দিয়েছে। তোর স্বাস্থ্য ভাল। সুতরাং খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। দেশের প্রয়োজন, তুইও তৈরি।

সমীরণের রাজি না হয়ে উপায় ছিল না। তিন বছর হল সরকারি চাকরির বয়স পার হয়ে গেছে। আর বয়স হলে কেউ বডিগার্ডও রাখবে না। তবে শুধু গায়ের জোরে যে বডিগার্ড বা গুন্ডা হওয়া যায় না এটা তার জানা ছিল।

কিন্তু রায়বাবু তাকে পছন্দ করলেন। বললেন, দেখো বাপু, মারপিট আমি পছন্দ করি না। ছোরাছুরি বা রক্তপাত এসবের প্রশ্নই ওঠে না। শুধু আওয়াজ দিয়ে কাজ সারবে।

এই বডিগার্ড রাখার ব্যাপারটা রায়বাবুর পার্টনার আচার্যিবাবু বেশি পছন্দ করেননি। বার বার বার রায়বাবুকে বলছিলেন, তোমার মাথাটাই খারাপ হয়েছে দেখছি।

রায়বাবু বললেন, চারদিকে কত চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই দেখছ তো! নেসকো, শিবু পান্ডা, কাতুচরণ এইসব পাটি বিল মেটাতে গোলমাল করছে, এদেরও একটু ভয় খাওয়ানো দরকার। আবার সেদিন তো দেখলে পুজোর চাঁদা বলে এ পাড়ার মস্তান ছেলেরা কেমন তিনশো টাকা আদায় করে নিয়ে গেল। কিছু করতে পেরেছিলে তার? একজন ডাকাবুকো লোক থাকলে এইসব এলিমেন্ট ঢিট থাকে। তবে মারপিটে নয়, শুধু হুম হাম।

আচার্যিবাবু খুশি হননি বটে তবে ব্যাবসাতে রায়বাবুর টাকাই বেশি খাটে, তার প্রভাবও, সুতরাং সমীরণ বহাল হল।

দুশো টাকা মাইনে, যাতায়াত আর জলখাবার বাবদ আরও পঁচিশ টাকা। ছুটি নেই, ইনক্রিমেন্ট বা বোনাসের প্রশ্ন নেই। তবে রায়বাবু ভরসা দিয়েছিলেন, কাজে খুশি করতে পারলে প্রোমোশন দেব। কিন্তু এ অফিসে প্রোমোশনই বা কী করে হবে তা ভেবে পায় না সমীরণ। রায়বাবু আর আচার্যিবাবু, এই দু’জনকে নিয়েই বলতে গেলে ব্যাবসা। বাইরের দু-চারজন আড়কাঠি কী সব খবরটবর এনে দেয়, কিছু সাব কনট্রাক্টর আছে, এ ছাড়া পাকা চাকরির লোক কেউ নেই। একা সারাদিন সমীরণ অফিস আগলে থাকে। বডিগার্ড বা গুন্ডার কাজ তাকে এখনও তেমন কিছু করতে হয়নি। খুব বড় কোনও পেমেন্ট থাকলে রায়বাবু তাকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাংকে যান। বারবার বলে দিয়েছেন, যখন আমি ক্যাশ টাকা নিয়ে চলাফেরা করি তখন আমার গা শুকে এঁকে চলবে। কেউ কাছে ঘেঁষার চেষ্টা করে কি না খুব লক্ষ রাখবে। তেমন বুঝলে আমার পিঠে আঙুলের খোঁচা দিয়ে সজাগ করে দেবে। আর কেউ ছিনতাই করবার তাল করছে দেখলে লাফিয়ে পড়ে কোমর পেঁচিয়ে ধরে বলটান মেরে পেড়ে ফেলবে। এই উপদেশ সমীরণ অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলে।

মুড়ি খেতে খেতে হাটছিল সমীরণ। কিন্তু অফিসের পথটা পেরোবার আগেই চিড়বিড়িয়ে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ভারী পাজি বৃষ্টি। দেখতে তেমন কিছু নয়। কিন্তু দশ পা হাঁটলে ভিজিয়ে চুপসে দেবে।

সামনেই ফুটপাতের ওপর একটা ত্রিপল টাঙাননা, ত্রিপলের নীচে চৌকি পেতে কারা শুয়ে বসে আছে। লাল শালুতে কী সব যেন সাদা অক্ষরে লেখা। পড়ার সময় ছিল না, সমীরণ কোলকুঁজো হয়ে ত্রিপলের তলায় ঢুকে গা বাঁচায়। হাতে মুড়ির ঠোঙা। এক গাল মুড়ি মুখে দিয়ে প্রবল চোয়ালে চিবোতে চিবোতে হঠাৎ তার বিবেকে ঘা লাগল। দেখল, ত্রিপলের গায়ে দেয়ালে খবরের কাগজের পোস্টার সাঁটা। তাতে লাল কালিতে লেখা চাকুরিতে পুনর্বহালের দাবিতে রুবি আয়রন ফাউন্ড্রির কর্মীদের আমরণ অনশন।

সামনের দিকে একটা চৌকি অনেকটা খালি পড়ে আছে দেখে সমীরণ বসে পড়েছিল। ছ্যাচড়া বৃষ্টিটা অনেকক্ষণ চলবে। বসাই ভাল। কিন্তু বসার পর পোস্টারগুলো দেখে মুড়ি খেতে এখন তার সত্যিই লজ্জা করছে। একটা বড় সাদা কাগজে লেখা অনশনের আজ ৩ দিন। তিন দিনই হবে। গত পরশুও সমীরণ এই ত্রিপলটা টাঙানো দেখেছে, তখন অত শত লক্ষ করেনি।

বড় খিদে পেয়েছিল সমীরণের। খুব লজ্জার সঙ্গে প্রায় মুখ লুকিয়ে আর এক মুঠো মুখে পুরতে গিয়ে হঠাৎ তার নজরে পড়ল একটা বুড়ো মতো অনশনকারী খুব জ্বলজ্বলে চোখে তাকে দেখছে। তাই মুড়িটা আবার ঠোঙার মধ্যে ছেড়ে দেয় সে। ঠোঙাটা মুড়ে হাতে ধরে রাখে।

অনশনকারীদের সংখ্যা জনা আষ্টেক হবে। তার মধ্যে পাঁচজন কাত বা উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে। খুবই দুঃস্থ চেহারা সবার। যে বুড়ো মানুষটা তার দিকে চেয়ে ছিল সে খুব যত্নের সঙ্গে একটা বিড়ি ধরাল, তারপর মাথায় হাত দিয়ে বসে বিড়ি খেতে লাগল।

সমীরণের হাতের আঁজলায় ত্রিশ পয়সার মুড়ি হাতের ঘেমো ভাপে, ভেজা ছোলার সংস্পর্শে আর বাদলার বাতাসে মিইয়ে যাচ্ছে ক্রমে। পেট থেকে খিদেটা দু’হাত বাড়িয়ে আরও মুড়ি চাইছে, জিভটা কাঙালের মতো মুখের শূন্য অভ্যন্তরের আনাচ কানাচ থেকে এক-আধটা ছোলা মুড়ি বা বাদামের দানা খুঁজে খুঁজে হয়রান হচ্ছে। কিন্তু আটজন অনশনশিল্পীর সামনে বসে সে খায় কী করে?

বাইরে একদম জলপ্রপাতের মতো বৃষ্টি হচ্ছে এখন। রাস্তায় জল দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, রাস্তা থেকে বৃষ্টির ছাট কাদার ছিটে নিয়ে গায়ে আসছে। ভিতরবাগে একটু সরে বসে সমীরণ। শুয়ে থাকা একটা লোকের পা তার গায়ে লাগে। লোকটা পা টেনে নেয়, তারপর একটু কোঁকানোর শব্দ করে উঠে বসে। বসেই বলে, শালার মলয়বাবু আজও এল না। ধুস! তারাপদদা, একটা বিড়ি দাও।

সেই বুড়ো লোকটা খুব কৃপণের মতো একটা বিড়ি শতরঞ্চির তলা থেকে বের করে দেয়।

সমীরণ পিছু ফিরে চেয়ে লোকটার বিড়ি ধরানো দেখছিল। লোকটা বিড়ি ধরিয়ে তার দিকে চেয়েই বলে ওঠে, সমীদা, না গো?

সমীরণও চিনতে পারে। পলাশির ফজলু। মীরাবাজারের হাইস্কুলে সমীরণ যখন নাইন টেন-এর ছাত্র ফজলু তখন সেভেন এইটে পড়ে। শেষ পর্যন্ত ফজলু অবশ্য পড়া ছেড়ে দিয়েছিল।

সমীরণ বলে, তুই কী করছিস এখানে?

 ফজলু বিড়িটা লুকিয়ে ফেলে দিয়ে বলে, আর কী! দেখছ তো। মলয়বাবু ছাটাই করেছে।

তাই বলে অনশন! মরে যাবি যে!– সমীরণ খুব চিন্তিত হয়ে বলে। সে নিজে অনশনের কথা ভাবতে পারে না। ভাল স্বাস্থ্যের দরুন তার খিদেটাও বেশি পায়। দেশের ছেলে ফজলু এরকম না খেয়ে থাকবে, সেটা সহ্য করে কী করে? বেফঁসে সে হাতের ঠোঙাটা বাড়িয়ে দিলে বলল, দুটো খা। এখনও তেমন মিইয়ে যায়নি।

ফজল আলী আঁতকে উঠে বলল, বলো কী! খাবার এখন আমার হারাম। তাছাড়া কষ্ট হয় না। এর আগেও বারকয়েক করেছি তো! একবার টানা সাত দিন অবধি।

সমীরণ ভারী অবাক হয়ে বলে, সাত দিন!

এবার বোধ হয় আরও বেশি হয়ে যাবে। মলয়বাবু খুব বেঁকে বসেছে। কারখানাই বেচে দিতে ঢাইছে। এর আগেও বেচে দিয়েছিল কয়েকবার। তবে সে ছিল বেচার নামে হাত বদল। মলয়বাবু আর নিলয়বাবু দুই ভাই। দুই ভাইয়ের দুটো কারখানা। যে যখন গোলমালে পড়ে তখনই সে তার। কারখানা আর একজনকে বেচে দেয়। মাঝখানে আমাদের যত দুর্দশা। কিন্তু এবার আর ভাইয়ে ভাইয়ে বেচাবেচি নয়, মায়োয়াড়ি পার্টি ধরেছে।

বৃষ্টি ধরে এসেছে। সমীরণ উঠে পড়ল। যাওয়ার আগে ফজলুকে বলে গেল, তোর বাড়িতে চিঠি লিখব। চাচাকে জানানো দরকার যে তুই না খেয়ে আছিস।

ফজলু হাসল। গরিব চাষি ঘরের ছেলে। খুব একটা ভাল খাওয়া-পরা জোটেনি কোনওদিন। তবে সানকি ভরা ভাত নুন লংকা দিয়ে হলেও পেট পুরে খেয়েছে। হাসিটা দেখে বড় কষ্ট হল সমীরণের।

তিনতলার অফিসঘরের দরজাতেই সুখন দাঁড়িয়ে। তার চোখে মুখে আতঙ্কের ভাব। সমীরণকে দেখেই বলে ওঠে রায়বাবুর মেয়ে সব ফাইল-টাইল দেখছে। আপনার খোঁজ করছিল। সামালকে বাতচিত করবেন।

সমীরণের বুকটা একটা ডিগবাজি খেল। ভয়ে নয়, উত্তেজনায়। রায়বাবুর মেয়েকে সে দেখেছে। একটু রোগা, একটু শ্যামলা, দোষের মধ্যে ওইটুকুই। তাছাড়া গোটাগুটি ভারী লোভনীয় মেয়ে। বড় বড় চোখ, উড়োখুড়ো চুল, ফাঁক হয়ে থাকা দুটি আঙুলের মতো টসটসে ঠোঁট, দাত সাদা এবং ঝকঝকে, কথাবার্তা খুব মোলায়েম এবং গলার স্বর ইস্পাতের মতো ঠান্ডা। সে এমনভাবে সাজে যাতে তাকে একটু রোগে-ভোগা রোগে-ভোগা দেখায়। কাউকে পাত্তা দেয় না। বহু ছেলে-ছোকরার সঙ্গে ঘোরে। হোটেলে গিয়ে নাচে। সারাদিন গাড়ি দাবড়ে বেড়ায়, অজস্র অদরকারি জিনিস কেনে। নাম মন্দা।

সমীরণ জানে, এ মেয়ের সঙ্গে তার ভাব ভালবাসা হওয়ার নয়। কিন্তু যতক্ষণ খাস, ততক্ষণ আশ। তার বুকটা তাই ডিগবাজি দিল।

অফিসের ঘরটা বেশ বড়। সেই বড় ঘরের মধ্যে আবার পার্টিশন করে দুটো ছোট ঘর বানানো হয়েছে। একটা রায়বাবুর, অন্যটা আচার্যিবাবুর। রায়বাবুর ঘরটাই ভাল। তাতে এয়ারকুলার আছে, কার্পেট আছে, ঘষা কাঁচের শার্সি আছে। রায়বাবু না থাকলে ঘরটা তালাবন্ধ থাকে।

সমীরণ ঘরে ঢুকে দেখে, মন্দার বাঁ হাতে ফোন, মুখে খিলখিল হাসি। কথাবার্তা সব চোখা ইংরিজিতে হচ্ছে। সেন্টের গন্ধে ম ম করছে বাতাস। মন্দা ছাড়া ঘরে আর একটা লোকও আছে। লম্বা, ফরসা, চালাক-চালাক চেহারা, লম্বা চুল, গোঁফ, সামান্য দাড়ি। বসে একটা ম্যাগাজিনের পাতা ওলটাচ্ছে গম্ভীর মুখে। বয়স চব্বিশ-পঁচিশের বেশি নয়।

মেয়েরা ফোন ধরলে সহজে ছাড়ে না। মন্দাও ছাড়ছে না। সমীরণ দাঁড়িয়ে থাকে। থেকে থেকে। পা ধরে যায়। খেয়াল করে একবার সে রুমাল বের করে ঠোঁট থেকে মুড়ির গুঁড়ো মুছল, ঘাম মুছল। তাতে তাকে কতটা সুন্দর দেখাল কে জানে। মন্দা তার দিকে মাঝে মাঝে অবাক হওয়া চোখে তাকাচ্ছিল বটে, কিন্তু সে তাকানোর মধ্যে দৃষ্টি নেই। মন্দা এখন ফোনের অপর পারের লোকটিকে দেখছে। ছোকরাটা একবার ম্যাগাজিন থেকে মুখ তুলেছিল বটে কিন্তু সেও সমীরণকে দেখল না ভাল করে।

এই দেখা না-দেখার ব্যাপারটা সমীরণ ভালই বোঝে। তার অভিজ্ঞতা হয়েছে যে, প্রতিদিন যারা তার দিকে তাকায় তারা সবাই তাকে সবসময়ে দেখে না। তাকানো আর দেখা দুটো আলাদা ব্যাপার।

মন্দা টেলিফোনে বলল, ওঃ, আই ফিল সো জামপি। নট দ্যাট আম স্কেয়ারড… ওঃ, নোঃ হিঃ হিঃ… নটি নটি…

সমীরণ কান ভরে শোনে। কী নিখুঁত ইংরিজি উচ্চারণ! শুনতে শুনতে ঢোক গিলল সে। মনে হল চমৎকার ওইসব ইংরিজি শব্দ তার পেটের মধ্যে চলে গেল।

মন্দা একটা ছাপা তাঁতের শাড়ি পরেছে। সমীরণ বোকা নয়। সে জানে তাঁতের হলেও শাড়িটার ছাপা একসকুসিভ। মেরেকেটেও দু’-তিনশো টাকা দাম হবে। হালকা জাম রঙের ওপর হলুদ সবুজ সব নকশা। নানা রঙের ছিটে ছড়িয়ে আছে। ঝলমল করছে। দেখে দেখে ঢোক গেলে সমীরণ। সবটাই তার পেটে চলে যায়। শাড়ির নকশা, রং, ইংরিজি উচ্চারণ। গোটা মন্দা।

মানুষ তো শুধু শরীরটা নয়। তার শব্দ ভাব-ভঙ্গি চোখের দৃষ্টি গায়ের রং পোশাকের বাহার এইসব মিলিয়ে এক-একটা মানুষ নিজের চারধারেও অনেকটা জায়গা দখল করে নিতে পারে। আসলে বাহার চাই। যার বাহার যত কম সে নিজের চারধারে তত কম জায়গা দখল করতে পারে। মানুষে মানুষে এই জায়গা দখলের জব্বর লড়াই চলেছে। সমীরণ দেখতে পায়, মন্দা অনেকখানি জায়গা নিয়ে ফেলেছে।

সমীরণের নিজের চারধারে জায়গাই নেই। বলতে গেলে সে নিজের শরীরটুকুতেই শেষ। তার বাইরে তার আর তেমন কোনও প্রভাব নেই।

মন্দা টেলিফোনে কি ভূতের গল্প বলছে? এমনিতেই সমীরণ ইংরিজিটি খুব ভাল বোঝে না, তাতে আবার সাহেবি উচ্চারণ। তবু আন্দাজ পায় মন্দা ভূতের কথাই বলছে, ওঃ, ইট ওয়াজ সো ঘ্যাস্টলি! আই হ্যাড আনক্যানি ফিলিং। সামওয়ান ওয়াজ শ্যাডোয়িং মি অল অ্যালং…

ভূতই। তাছাড়া কীই বা হবে। এ ব্যাপারে মন্দার সঙ্গে তার নিজের একটা মিল আছে। যখন সে পলাশিতে থাকত, তখন রাত-বিরেতে কত গাঁ গঞ্জে ঘুরে বেড়িয়েছে একা একা, রাতের মাঠ পেরিয়ে গেছে, মাঝরাতে জ্যোৎস্নায় গিয়ে বসেছে দাওয়ায়, তখনও ভূতে বিশ্বাস ছিল প্রবল, কিন্তু ভয় ছিল না। তারপর কলকাতায় এসে নানাজনের পাল্লায় পড়ে সে শিখেছে যে ভূত-টুত কিছু নেই। এই বিজ্ঞানের যুগে ভূত থাকতেই পারে না। সে কথাই সে আজকাল বিশ্বাস করে। কিন্তু যত সে ‘ভূত নেই’ বলে বিশ্বাস করে ততই তার মধ্যে আজকাল ভূতের ভয় দেখা দেয়। এই কদিন আগে দিনদুপুরে একটা বোেঝাই বাসের ঠাসাঠাসি ভিড়ে বসে সে অফিসে আসছিল। হঠাৎ তার মনে হয় ভিড়ের ভিতর থেকে ইঁদুরপানা মুখের একটা লোক খুব খোঁচানো দৃষ্টিতে তাকে অপলক দেখছে। সে দেখা যেন গিলে খাওয়া, ভস্ম করে ফেলা, ঘেন্নার কাদা ছিটিয়ে দেওয়া। সমীরণ লোকটাকে যে স্পষ্ট দেখেছে তাও নয়। কেবল মনে হয়েছে রড ধরে কাটা পাঁঠার মতো ঝুলছে যেসব নরদেহ তাদেরই ভিতরে কেউ যেন! অথচ স্পষ্ট বুঝতে পারেনি কে। যখন টের পেল তখন খুব ভাল করে সকলের মুখ নজর করে দেখেও কিছুতেই সেই মুখটাকে চিনতে পারল না। সেদিন ভারী কাটা দিয়েছিল গায়ে। অনেকক্ষণ ধরে চামড়ার নীচে যেন সরষেদানা গড়িয়ে যেতে লাগল। সেই বলতে গেলে প্রথম ভূতের ভয় হল তার। গদাধরবাবুর বাড়ির একতলায় সে একটা ছোট ঘরে থাকে। পুরনো বাড়ি, নোনায় দেয়ালের পলেস্তারা পাঁচড়ার মামড়ির মতো উঠে আসছে। দগদগে ঘা বেরিয়ে আছে ঘরটার সর্বাঙ্গে। সেই ঘরে এক ছুটির দুপুরে চৌকিতে চিতপাত হয়ে শুয়ে সে আকাশ-পাতাল ভাবছিল। এমন কিছু নির্জনও ছিল না। দুপুরটা। পাশের ঘরেই রেডিয়োতে নাটক হচ্ছে। উঠোনের কলতলায় গদাধরবাবুদের তরুণী ঝি বাসন মাজতে বসলেই ভাড়াটে সত্য গাঙ্গুলির মেজো ছেলে প্রায়দিনই হাতে আয়না আর ছোট কাচি নিয়ে গিয়ে রোদে বসে সাবধানে গোঁফের জঙ্গলে কাচির ডগা ঢুকিয়ে পাকা গোঁফ গোড়া থেকে কেটে ফেলে। মেজো ছেলে সীতাংশুর চুল দাড়ি অল্প বয়সেই পেকেছে, একটু মাথা-পাগলা মতে। বিয়ের জন্য হন্যে। গদাধরবাবুর তরুণী ঝির সঙ্গে নানা কথা বলে মনের দুঃখ ভোলে। সেই দুপুরে তাদের প্রেমালাপও কানে আসছিল। এর মধ্যে হঠাৎ তার মনে হল, ঘরের দেয়ালের একটা জায়গায় যেন ঠিক হুবহু একটা মানুষের আকৃতির ছাপ। যেন জলে ভেজা কোনও মানুষ খানিকক্ষণ দেয়ালের সঙ্গে সেঁটে দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেছে। সেই দেখে আঁতকে উঠল হঠাৎ সে। কেবলই মনে হতে লাগল, নিশ্চয়ই কখনও কাউকে খুন করে এই দেয়ালের মধ্যে গেঁথে দেওয়া হয়েছিল। এতদিন বাদে সেই লোকটার শরীর দেয়াল চুইয়ে ভেসে উঠেছে। ধারণাটা এমনই বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল তার যে সে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছিল। খুব ভয়ে ভয়ে ছিল ক’দিন। নিজের পয়সায় চুন কিনে এনে শেষ পর্যন্ত জায়গাটা চুনকাম করে সে। আজকাল সে ভূতের ভয় পায়।

মন্দা যখন টেলিফোন নামাল তখন সমীরণ ঘোর অন্যমনস্ক হয়ে ভূতের ভয়ের কথা ভাবছে।

মন্দা বলল, আপনি এতক্ষণ অফিসে ছিলেন না?

সমীরণ চমকে উঠে বলে, না, আউটডোরে যেতে হয়েছিল।

ও। কিন্তু অফিস ফাঁকা রেখে যাওয়াটা ঠিক নয়। আমি চারটের সময় এসে দেখেছি দু’জন ভদ্রলোক বসে ছিলেন। পার্টি এসে ফিরে যাওয়া কি উচিত?

মন্দা কিছুমাত্র রাগ দেখাচ্ছে না, খুব ভালমানুষের মতো কথাটথা বলছে আর তার মুখের দিকে মনোযোগ দিয়ে দেখছে। ভারী ঠান্ডা আর নিষ্ঠুর চোখ মন্দার। একটু অস্বস্তি বোধ করে সমীরণ। দুপুরে টেনে ঘুম দিয়েছিল, মুখচোখ নিশ্চয়ই রসস্থ আর ভাব-ভার। দুপুরে ঘুমোলে সেটা মুখের চেহারায় ধরা পড়বেই! তাছাড়া রোদে জলে ঘোরা চেহারাও তার এখন নয়।

মন্দা অবশ্য ঘাটাল না। বলল, আমি যাচ্ছি। আপনি অন্তত ছ’টা পর্যন্ত দেখে অফিস বন্ধ করবেন। আই মে নিড ইউ। টেলিফোনের কাছে থাকবেন। সুব্রত, লেটস গো।

ফরসা লম্বা ছেলেটার সঙ্গে মন্দা বেরিয়ে গেল।

একটা বড় শ্বাস ছেড়ে বাইরের অফিসে বসে রইল সমীরণ। রায়বাবুর ঘর বন্ধ করে চাবি নিয়ে গেছে মন্দা।

.

০৩.

সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে সুব্রত বলল, আমি আলিয়স ফ্রঁসে যাব। তুমি?

মন্দা বলল, বিকেলটা ভারী বিচ্ছিরি! বিকেলবেলাটায় আমার একদম একা থাকতে ভাল লাগে না।

এইটুকুই মন্দা বলল। কিন্তু কথাটার মধ্যে একটু হ্যাংলাপনা আছে, আর আছে আমন্ত্রণ।

সুব্রত তার সুন্দর দাঁতে আর ঠোঁটে অদ্ভুত একটু হেসে বলে, সেই বেলা বারোটা থেকে দু’জনে গা ঘষাঘষি করছি। আমার আরও একটু কমপানি দিতে আপত্তি নেই।

বলে সুব্রত তার ডান কজিতে ঘড়ি দেখল। ঘড়িটা একটু বিটকেল রকমের। ওপরে কেবল ঘোর লাল রঙের কাচ, একটা ছোট্ট বোতাম টিপলেই সেই লাল কাচের ভিতর আলোর অক্ষরে ঘন্টা আর মিনিট ফুটে উঠেই মিলিয়ে যায়। ঘড়ি দেখে সুব্রত বলল, সাড়ে ছ’টায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট। আরও ঘন্টাদেড়েক আছে।

মন্দা অভিমান করল না। কিছুটা অসহায় ভাবে বলল, আ হ্যাভ ফিনিশড এভরিথিং। পড়াশুনো, নাচগান, ল্যাংগুয়েজ–অল সর্টস অফ থিংস। আর কী করার আছে বলো তো? কী নিয়ে এনগেজড থাকা যায়?

সুব্রতর বদ অভ্যাস হল, কথায় কথায় সে নিজের নাকটা ধরে মোচড় দেয়। এখনও দিল। মুখে সেই হাসি। বলল, গো সামহোয়্যার, বিলাতে বাপ্পার এগজিবিশন হচ্ছে। যাও না!

দেখা হয়ে গেছে।

তাহলে বিজিতকে একটা টেলিফোন করো। চলে আসবে।

বিজিত বড় সিরিয়াস টাইপের হয়ে গেছে। ওর রিসেন্ট প্রবলেম কী জানো?

কী?

 হাউ টু বি এ মার্কসিস্ট উইদাউট বিয়িং এ কমিউনিস্ট। তাছাড়া হিজ জব ইজ ইটিং হিম। প্রায়ই সন্ধে সাতটার আগে বেরোতে পারে না।

তাহলে কী করবে?

ভাবছি গাড়িটা থাকলে হত।

সুরেন ব্যানার্জি রোডে বেশ ভিড় এখন! ভেজা রাস্তা থেকে চটির সঙ্গে কাদা ছিটকে আসছে। সুব্রত গ্রাহ্য করে না। কিন্তু মন্দা পিছন দিকে পায়ের কাছে নিজের দামি শাড়িটার অবস্থা ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখে নিয়ে বলল, নইসেন্স! গাড়িটা থাকলে

গাড়িটা কী হয়েছে?

একটা কপট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মন্দা বলে, অয়েল ইজ সো ডিয়ার! সো ড্যাড ডিক্লেয়ারস, নো কার। দেখো শাড়িটার অবস্থা।

সুব্রতর গলার স্বর ভীষণ ভদ্র। সবসময় একটা বিশেষ পর্দায় বাঁধা গলা। সেই মলমের মতো গলায় বলে, সবাই সাফার করছে, তুমি একলা নয়। তোমাকে অনেক শাড়ি আছে।

তা তো বলবেই!

সর্বাণীকে টেলিফোন করলে কেন? ওর সঙ্গে তো তোমার কাট হয়ে গেছে।

ওঃ আই হেট হার সো মাচ! আমি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে সুবীরের কথা জানতে চাইছিলাম। সুবীর আমাকে ফ্রাংকফুর্ট আর লন্ডন এয়ারপোর্ট থেকে চিঠি দিয়েছে। ওয়াশিংটনে পৌছেই চিঠি দেবে লিখেছে। সর্বাণীকে শুধু লন্ডন থেকে দিয়েছে। আমি জানি সুবীর ওকে বেশি কিছু লেখেনি! ও অনেক কথা বাড়িয়ে বলল!

কী করে বুঝলে?

ট্রুথ ইজ লাইক এ ফ্র্যাগরান্ট ফ্লাওয়ার। গন্ধ পাওয়া যায়। ও বলল, সুবীর নাকি ওকে মিস করছে। উড ইউ বিলিভ?

সুব্রত হেসে বলে, নয় কেন? আমি তো সব সময়ই কাউকে না কাউকে মিস করছি বলে মনে হয়।

মন্দা খুব গম্ভীর হয়ে বড় বড় বিখ্যাত চোখে সুব্রতর দিকে তাকিয়ে বলল, এখন কাকে মিস করছ?

অল দি অ্যাবসেন্টিজ। যারা কাছে নেই তাদের সবাইকে। যেমন তুমি সুবীরকে মিস করছ।

 মন্দা গম্ভীর হয়ে বলে, ইউ আর জেলাস।

আরে না। জেলাসি ইজ অল বলস! ওসব নয়। ঠাট্টা করছিলাম। সুবীর হয়তো সত্যি সত্যিই সর্বাণীকে মিস করছে, তোমাকেও মিস করছে, এমন কি হতে পারে না?

হবে না কেন? আমি তো তা বলিনি। কিন্তু সর্বাণীকে কি সুবীর সিরিয়াসলি নেয়? সর্বাণী তো বোঝে না যে সুবীর ওকে কত বোকা ভাবে।

সুব্রত আর একবার বোম টিপে তার ঘড়িতে উদ্ভাসিত সময় দেখে নেয়। একটু উদাস হয়ে বলে, আমি যখন প্রথম জার্মানিতে যাই তখন আমি আমার বাড়ির বেড়ালটাকেও মিস করতাম। ইট হ্যাপেনস।

মন্দা জেদবশত বলে, কিন্তু আমি খুব ভাল জানি, সুবীর সর্বাণীকে মোটেই মিস করছে না।

 সুব্রত মৃদুস্বরে বলে, নাউ ইউ আর বিয়িং জেলাস।

মন্দা রাগের গলায় বলে, জেলাসি ইজ অল

বলেই হেসে ফেলে। কথাটা শেষ করে না।

সুব্রতই বলে দেয়, বলস অল বলস। তুমি কি সুবীরকে মিস করছ মন?

 এ লিটল। দিস মাচ

বলে মন্দা ডান হাতের বুড়ো আঙুল আর তর্জনী দিয়ে সরষের মাপ দেখায়।

 দেন ইউ আর নট জেলাস।

থ্যাংক ইউ।

 কিছু খাবে নাকি? অনেকক্ষণ হেঁটেছ।

না, ময়দানে গিয়ে বসা যেত, কিন্তু যা জল!

সুব্রত আবার তার আলো-ঘড়ি দেখে বলে, সময়ও নেই। সরি।

ইউ আর অ্যাভয়ডিং মি!

আরে না। ফাদার সাইমন কালই মাদ্রাজে চলে যাচ্ছেন। ইটস এ ফেয়ারওয়েল ডিনার। আফটার অল আই অ্যাম গ্রেটফুল টু হিম। না গেলেই নয়।

যাবে যাও। কিন্তু ডোন্ট লেট মি ফিল অ্যাবানডনড! আ অ্যাম সোপজেজড বাই বোরডম।

তুমি সর্বাণীকে একটা আনক্যানি ফিলিং-এর কথা বলছিলে। ইজ ইট টু অর জাস্ট এ গিমিক?

 মন্দা হেসে বলে, ওসব বলতে হয়। ওকে একটু নার্ভাস করে দিচ্ছিলাম।

ইউ ডিডনট সাউন্ড লাইক জোকিং।–সুব্রত গভীর হয়ে বলে।

মন্দার চোখদুটো হঠাৎ জ্বালা করে। চোখের পাতা ভিজে আসে। কান্না-টান্না নয়। খুব রাগ হলেও মন্দার এরকম হয়। সে জবাব দিল না।

সুব্রত কথা বাড়াল। খুব সান্ত্বনার স্বরে বলল, চলো একটু কফি খাই। এখনও সময় আছে একটু।

চৌরঙ্গিতে পড়ে ওরা এদিক ওদিক একটু তাকাল। তারপর মাদ্রাজি কাফের দিকে হাঁটতে লাগল।

কাফেতে প্রচন্ড ভিড়। বসবার জায়গা নেই। ভেতরে ভ্যাপসা গরমে গায়ে গায়ে লোকের আনাগোনা। কেউ কাউকে পাত্তা দিচ্ছে না।

সুব্রত মৃদুস্বরে বলল, অলওয়েজ পপুলেশন ইজ দি প্রবলেম!

মন্দা এক ঝাকিতে তার চুল পিছনের দিকে সরিয়ে দিয়ে বলে, ইউ আসকড ফর ইট। তুমি সব সময়ে এত চিপ জিনিস খোঁজো কেন বলল তো! সেলের জিনিস কিনবে, চিপ রেস্টুরেন্টে খাবে, গাড়ির বদলে স্কুটার চড়বে!

আমি পাক্কা প্রলেতারিয়েত।

দেশের সব প্রলেতারিয়েত যদি তোমার মতো বাইশশশা টাকা মাইনে পেত তাহলে কী ভালটাই না হত!

তুমি কী বুঝবে মন? তোমার ওল্ড ম্যান কিছুটা হয়তো বুঝবে হোয়্যার ট্যাকসেশন পিনচেস! শুনতে বাইশশশা, কিন্তু আফটার অল ডিডাকসনস—

মন্দা ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়েই বেশ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলে, ডোন্ট ন্যাগ। তোমার পঞ্চাশ হাজার টাকার লাইফ পলিসি আছে, কিইমুলেটিভ ডিপোজিড আছে, আরও কী আছে কে জানে বাবা! তুমি পাক্কা অ্যালিগেটর একটি। তাও তো বিয়ে করোনি!

করব বলেই তো!

করো না! বিয়ে করে একদম বদমেজাজি খিটখিটে কৃপণ বুড়ো বনে যাও! আই উইশ ইউ গেট টেন চিলড্রেন।

সুব্রত মৃদু হাসি মাখানো মলম গলায় বলে, তাহলে গভর্নমেন্ট কাঁচি নিয়ে আমাকে সেনসর করতে তেড়ে আসবে। অ্যান্ড আ উইল লুজ এ ভাইটাল লিম্ব।

তোমার তাই হোক। আই উইশ

সুব্রত মোলায়েম গলায় বলে, টেন ডিলড্রেন নয়, আ অ্যাম ইন্টারেস্টেড ইন টেন ওয়াইভস।

ইস রে! তাহলে বুঝি আর কাঁচি নিয়ে তেড়ে আসবে না? আর মেয়েরা কি অত সস্তা নাকি?

ধুস! তুমি ওয়ারলড পপুলেশনের স্ট্যাটিস্টিক্স জানো না। দেয়ার ইজ এ গ্রেট ইমব্যালেন্স। পৃথিবীতে পুরুষের চেয়ে মেয়েদের সংখ্যা ঢের বেশি। দেখো কয়েক বছর পরে বহুবিবাহের ওপর থেকে রেসট্রিকশন তুলে নেওয়া হবে।

আই শ্যাল র‍্যাদার স্টে অ্যালোন দ্যান ম্যারি এ ম্যারেড ম্যান।

 তুমি জেলাস।

আবার?

সুব্রত হাসতে হাসতে হঠাৎ মন্দার কোমর ধরে ঠেলে ভিতরে নিয়ে যেতে যেতে বলল, কুইক, ওই একটা টেবিল খালি হয়েছে।

বসেই মন্দা বলল, তুমি কৃপণ।

 সুব্রত বলে, না, আমি প্রলেতারিয়েত। মন, বলল তো তুমি ক’টা বাচ্চার মা হতে চাও!

একটারও না, আই হেট

সুব্রত হাত তুলে বাধা দিয়ে বলে, বোলো না। মেয়েরা ভীষণ মুখোশ পরে কথা বলে। আসলে তারা খুব মা হতে চায়। আমি একজনকে জানি

তুমি আমাকে জানোনা।

আই অ্যাডমিট। কিন্তু জেনারেলি মেয়েরা বাচ্চা পছন্দ করে।

 মোটেই না। বাচ্চার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি ন্যাগ করে ছেলেরা। বিকজ দে ডোন্ট সাফার ফ্রম দি পেইন অফ ডেলিভারিং এ চাইল্ড।

কিছু কিছু ব্যথা আছে যা খুব উপভোগ্য। প্রসবযন্ত্রণা তাদের মধ্যে পয়লা নম্বরের।

থাপ্পড় উঁচিয়ে মন্দা বলে, মারব।

গাল এগিয়ে দিয়ে সুব্রত বলে—মারো। দি পেইন উইল বি সুইট।

মন্দা মারল। চটাস শব্দ হল। সুব্রতর হালকা দাড়ির ভেতরে ফরসা গালে টকটকে রাঙা কয়েকটা লম্বা রেখে ফুটে উঠল। আশপাশের টেবল থেকে দু-একজন ফিরে দেখল।

সুব্রত বলল, আ উইশ ইট ওয়াজ এ কিস।

মন্দা বড় বড় স্থির চোখে চেয়ে ওকে দেখছিল। তার নাকের পাটা ফুলে ফুলে উঠছে। জোরে খাস বইছে। বুকে সুস্পষ্ট ওঠা নামা।

সুব্রত হাত বাড়িয়ে তার কোমর ধরল। কষির কাছে আলতো আঙুল বুলিয়ে আদর করে বলল, জেলাস মেয়েরা খুব ভাল বউ আর মা হয়। জানো?

আই অ্যাম নট জেলাস।

 ইউ আর।

মন্দা হেসে ফেলল। কফি খেতে খেতে বলল, এর পর বোধহয় তুমি আমাকে বিয়েও করতে চাইবে। একই সঙ্গে একটা ভাল বউ আর বাচ্চা-কাচ্চার মা কাকে পাবে বলো।

আমি পপুলেশন বাড়াতে চাই না মন। পপুলেশন যত বাড়ছে, যত ভিড় বাড়ছে, ততই মানুষ লোনলি হয়ে যাচ্ছে।

ইউ আর নট লোনলি।

আই অ্যাম। আমার মনে হয় বিয়ে করলে আমি বোধহয় আরও লোনলি হয়ে যাব! জার্মানিতে একটা মেয়ের সঙ্গে আমার বিয়ের প্রায় ঠিকঠাক হয়ে গিয়েছিল। আমরা মাসখানেক একসঙ্গে ছিলাম বেশ। আর তখনই আমার ভীষণ লোনলি লাগত। একসঙ্গে আছি তো, নানারকম অ্যাডজাস্টমেন্ট করছি, লাভ মেকিং হচ্ছে, বেড়ানো হচ্ছে কিন্তু কেবলই টের পাচ্ছি যে আমার স্বাধীন ইচ্ছেগুলো সব গরাদবন্দি হয়ে গেল। সবসময়ে আর একটা লোকের ওজন যেন আমার সত্তার ওপর চেপে বসে আছে। অনেক সময় মেয়েটাকে আমার হারামজাদি’ বলে গাল দিতে ইচ্ছে করত, গায়ে থুতু দিতে ইচ্ছে করত…ওঃ তুমি ব্যাপারটা সহ্য করতে পারতে না, না?

মন্দার চোখ স্থির, মুখ লাল, আর দাতে দাত ঘষছে। চাপা ঘেন্নার স্বরে বলল, ব্রুট!

সুব্রত হেসে বলল, আসলে অতটা নয়। কিন্তু মানুষের ভিতরে কতগুলো স্বাধীন ইচ্ছা থাকেই। কেউ হয়তো কোনও মেয়েকে জেনুইন ভালবাসে, ধরো রোমিও-জুলিয়েটের মতো, তখনও কিন্তু সেই লোকটার মেয়েটির প্রতি ঘৃণা, আক্রোশ, জিঘাংসা আসতে পারে।

দ্যাট ইজ স্যাডিজম।

অ্যান্ড দ্যাটস অলসো ভেরি মাচ দি ট্রুথ।

 চুপ করো। আমি শুনতে চাইছি না।

সুব্রত তার আলোর ঘড়ি দেখে বলল, আমিও আর বেশি বলছি না। ইটস অলমোস্ট দি টাইম। উঠি। তোমার কী হবে?

আমার জন্যে ভাবতে হবে না।

তুমি রেগে যাওনি তো!

মন্দার মুখভাবে রাগই ছিল। থমথম করছে।

বাইরে এসে সুব্রত সিগারেট ধরিয়ে বলল, তোমাকে একটু এগিয়ে দেব কোনও দিকে?

না।

তা হলে তুমি রেগেছ। আমার ওরকম করে বলা ঠিক হয়নি।

 হঠাৎ ফিক করে হেসে মন্দা বলল, বোকা। কেন? তুমি বোকা।

 জানো না মেয়েরা অনেক সময় ওইসব স্যাডিজম পছন্দ করে।

 আমিও তা জানি।–বলে সুব্রত দাতে ঠোঁট কামড়ে খুব চালিয়াতের মতো হাসে।

 জানো?

জানি। আর এও জানি যে তুমি হচ্ছে সেই ধরনের মেয়ে যারা ফিজিক্যাল টর্চার পছন্দ করে। দে ওয়ান্ট টু বি বিটন, সাফোকেটেড, ইভন রেপড়!

রুদ্ধশ্বাসে ‘ফের মার খাবে!’ বলে মন্দা তেড়ে গেল।

সুব্রত হাসতে হাসতে একটা দারুণ ভিড়ের বাসে চুম্বকের মতো সেঁটে উঠে গেল চোখের পলকে।

আর তারপর থেকে ভারী একা লাগতে লাগল মন্দার। ভীষণ একা।

একা গায়ে গায়ে ভিড়ের মধ্যে উদাস হাঁটতে হাঁটতে মন্দা ভাবে, ঠিকই বলেছিল সুব্রত। যত ভিড় বাড়ছে, তত যেন একা হয়ে যাচ্ছে মানুষ। শুধু যে একা তা-ই নয়, মন্দার সব সময়ে মনে হয় কেউ তার দিকে লক্ষ রাখছে, পিছু নিচ্ছে, সুযোগের অপেক্ষায় আছে।

বিকেলটা বড্ড মন-খারাপের সময়। আলো মরে যায়, মন মরে যায়, শ্বাসের বাতাসে কম পড়ে। চারপাশে যেন এক অদৃশ্য গরাদ চেপে ধরে।

অস্থির মন্দা একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে ফোন করল। ফোন করার আগে অনেকগুলো নম্বর মনে মনে মুখস্থ বলল। নম্বরের সঙ্গে নাম। কিন্তু কারও মুখই চোখে ভেসে ওঠে না যে! বাধ্য হয়েই সে প্রথম ফোনটা করল তার বাবার অফিসে।

কে? সমীরণবাবু?

হ্যাঁ।

আপনি আর একটু অফিসে থাকুন। হয়তো আপনাকে আমার দরকার হবে। আমি আবার ফোন করব।

আচ্ছা।

এবার মন্দা ফোন করল মৃদুস্বরে অফিসে। মৃদুল ছোট কোম্পানির অ্যাকাউন্টসের বড় কর্তা। অনেকক্ষণ অফিসে থেকে কাজ করে। পাওয়া গেল।

আসবে? ফ্রি আছ?

 মৃদুল হেসে বলে, আমি তো ফরগাটন মন!

কে বলল?

নই? অনেকদিন খোঁজ নাওনি।

তুমিও নাওনি।

 পাল্টি দিচ্ছো?

বিরক্ত হয়ে মন্দা বলে, আসবে কি না বলো। আমার ভীষণ লোনলি লাগছে।

আমি আজকাল অফিসের পর একটু ককটেল করি। তোমার চলবে?

কেন, আমি কি খুকি নাকি? শুধু দুধ খাই বুঝি!

মৃদুল মৃদু হেসে বলে, জানি। কিন্তু আমার সঙ্গে কয়েকজন লোক থাকবে, অল বিজনেস পিপল। অ্যান্ড দেয়ার উইল বি সিরিয়াস ড্রিংকিং। পারবে তো তাল রাখতে?

অপমানে মন্দার মাথা ঝাঁ করে উঠল। রুদ্ধশ্বাস উত্তেজনায় সে বলল, ইউ আর অ্যাভয়ডিং…অ্যাভয়ডিং…স্কাউড্রেল।

চটছ কেন মন? জানো তো আমাদের চাকরি শুধু অফিসের মধ্যে নয়। সারাদিনই আমরা চাকরি করি—অফিসে, ক্লাবে, রেস্তোরাঁয় পার্টিতে, ইভন সামটাইমস ইন বেডরুমস। আমাদের চাকরি বড্ড ছড়ানো, বড় সর্বনেশে। আজ বিকেলের ককটেলটাও ওই চাকরিই। নইলে কি তোমার সঙ্গে একা হতে লোভ হয় না? রাগ কোরো না মন।

মন্দা উদ্যত চোখের জল গোপনে রুমালে মুছল। ফিস ফিস করে বলল, তোমাকে অস্বস্তিতে ফেলতে চাই না। পোপোজাল উইথড্র করে নিচ্ছি।

তোমার গলার স্বরটা পাল্টে গেল কেন মন? তুমি সিরিয়াসলি দুঃখ পাওনি তো? আরে, আমি সত্যি বলছি আজ তুমি এলে একটুও অসুবিধে হবে না। তুমি কোথায় আছো বলল, আমি গিয়ে তোমাকে তুলে নিচ্ছি।

না। আমি তোমাকে একা চেয়েছিলাম।

মৃদুল খুব দ্বিধায় পড়ে বলল, একা? সেইটিই তো গোলমাল হচ্ছে মন।

আচ্ছা, ছাড়ছি।

আমি কি ভাল লোক মন?

হঠাৎ একথা কেন?

সত্যি বলো তো আমি কেমন!

 মন্দা হাসল, বলল, ভাল নও।

 মৃদুল খুব দুঃখের গলায় বলে, আমারও তাই মনে হয়। আমি বোধহয় একটা স্কাউড্রেল!

মন্দার খুব লজ্জা করছিল। ফোনে সে একটু আগে যে উত্তেজিতভাবে কথা বলেছিল সেটা দোকানের লোকটা লক্ষ করেছে। তাই সে সাবধান হল। বলল, না। তুমি, তোমরা সবাই বোধহয় খুব ভাল। আসলে আমিই শেমলেস।

ওকথা বোলো না মন। তোমার একটুখানি সঙ্গ পাওয়ার জন্য কত ছেলে পাগল!

তুমি তো তাদের দলে নও।

আমি তাদের দলপতি।

বাজে বোকো না। ছাড়ছি।

তা হলে কবে বলো?

 কী কবে?

তোমার সঙ্গে একা!

তোমার তো সময় নেই। বেডরুমেও চাকরি করতে হয় বলছ।

একদিন চাকরি করব না। কবে বলো।

মন্দা রুদ্ধকণ্ঠে বলে, জানাব। একদিন জানাব।

ফোন রেখে দিল। আবার রিসিভার তুলল। মন্দার পিছনে কে যেন সামান্য একটু বিরক্তির শব্দ করল, ইস। মন্দা ঘাড় ফিরিয়ে তার বিখ্যাত বড় বড় চোখে ছেলেটাকে দেখল। ফোন করবে বলেই বোধহয় দাঁড়িয়ে আছে। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে পিছনে কে জানে? হয়তো শুনছিল কথাবার্তা।

মন্দার রাগ হল না। বরং খুব ভাল মানুষের মতো রিসিভার এগিয়ে দিয়ে বলল, আপনি ফোন করবেন? করে নিন না! আমার তাড়া নেই।

ছেলেটা ভীষণ লজ্জা পেয়ে বলল, না না। আপনি বরং

বেশ ছমছমে কাচা ছেলে। তেমন লম্বা নয়, খুব বড়লোকের ছেলেও নয়। একটু নার্ভাস প্রকৃতির কি? মন্দা চেয়ে দেখল, তারপর মৃদু হেসে বলল, নিন।

ছেলেটা আপত্তি করল না। মন্দা ততক্ষণ চারদিকে চেয়ে লোকজন দেখতে লাগল।

 ছেলেটা ফোন নামিয়ে বলল, লাইন পাচ্ছি না। আপনি করে নিন।

মন্দা টেলিফোন তুলেই ভাবল, এই বিকেলে বৌধায়ন কি বাড়িতে থাকবে? বৌধায়ন অবশ্য

অবশ্য চাকরি করে না, কিন্তু বেকাররাই তো সবচেয়ে বেশি বাইরে ঘোরে।

বৌধায়ন ছিল এবং সে-ই ফোন ধরে বলল, ডাকছ? আয় হায় রে পরান সখী, পাখি নউ তার। ঠাই উড়ি যাই।

তার মানে?

ডানা ছাড়া যাওয়ার উপায় নেই মন। গত রোববার বাস থেকে পড়ে গিয়ে ডান পায়ে সিরিয়াস স্পেইন। কাস্টিং করা পা নিয়ে পড়ে আছি। মাথার কাছে রেডিয়ো, পাশে টেলিফোন আর কোলের ওপর গুচ্ছের ম্যাগাজিন আর বই। দিনগুলো রবারের মতো টেনে কে যেন লম্বা করে দিয়েছে।

কী কাণ্ড! ভাবলাম তোমার সঙ্গে বিকেলটা কাটাব!

কাটাও না। চলে এসো। আমার ঘরটা তো ভারী স্যুটেবল। নির্জন, নিরিবিলি।

ধুস। এই অফিসভাঙা ভিড়ে কে যাবে বাবা মানিকতলায়!

তুমি কষ্ট করতে শেখোনি কেন বলল তো! কেষ্টদের হয়রান করতে তো খুব ওস্তাদ। এই আহত মানুষটির জন্য কি মায়া হয় না?

হয়। কিন্তু শুধু মায়াই হয়। বেচারা বলে চোখের জল মুছতে ইচ্ছে করে। ছাড়ছি।

আরে দাঁড়াও দাঁড়াও, এক্ষুনি ছেড়ো না। আমি কী ভীষণ একা বুঝতে পারছ না। তোমার ভয়েসটা অন্তত কিছুক্ষণ শুনতে দাও।

না বাপু, আমি এক দোকান থেকে ফোন করছি, বেশিক্ষণ রিসিভার আটকে রাখা যাবে না। তুমি বরং নয়নাকে ফোন করে তার ভয়েস শোনো। ইয়োর মিসট্রেসেস ভয়েস।

নয়নার ট্রুপ আজ চিত্রাঙ্গদা করছে মহাজাতি সদনে।

টেলিফোনে মৃদু কিন্তু স্পষ্ট একটা ফুটবল খেলার ধারাবিবরণী শোনা যাচ্ছিল। হঠাৎ সে শব্দটা জোরালো হল।

মন্দা বলল, তাহলে মধুপর্ণীকে

বৌধায়ন বলল, দাঁড়াও দাঁড়াও! এ লাস্ট মোমেন্টে একটা গোল ঢুকে গেল রে!…হা কী বলছিলে?

মন্দা বলল, ফুটবল শুনছিলে?

হ্যাঁ। এইমাত্র খেলা শেষ হয়ে গেল।

আমাদের সবার খেলা শেষ হয়ে যাচ্ছে বৌধায়ন।

 তার মানে?

মন্দা একটু লোকদেখানো দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে, দি গেম ইজ ওভার।

বৌধায়ন হেসে বলে, ফিলজফি হচ্ছে? মাইরি, ওসব বোলো না, খেলা শেষ হলে বাঁচব কী নিয়ে? ভয় দেখাচ্ছ অড্রে হেপবার্ন?

আমি মোটেই হেপবার্নের মতো দেখতে নই। অত রোগা নাকি আমি?

চোখদুটো অবিকল।

যাঃ। মন্দা খুশি হয়ে বলে। বরাবর তাকে অড্রে হেপবার্ন বলে, কমপ্লিমেন্ট দেয় বৌধায়ন। রোগা বলে কি না কে জানে! তবে তার চোখ সুন্দর এটা সে নিজেও জানে।

আসবে?–বৌধায়ন চাতকের গলায় বলে।

মন্দা বলে, না গো। আজ নয় লক্ষ্মীটি। এর মধ্যে একদিন যাব।

আচ্ছা। ভাল থেকো। এখন কোথায় আছ?

 চৌরঙ্গি।

 ভাল জায়গা। সঙ্গে কে?

 কেউ নেই। সুব্রত ছিল, কেটে পড়েছে।

আনওয়াইজ অফ হিম। তুমি একদম একা?

 একদম একা। ছাড়ছি।

 মন্দা ফোন ছেড়ে আবার ফোন করল। এবারও সমীরণকে।

 আপনি আছেন তো?

আছি।

থাকবেন। আমার হয়তো দরকার হবে।

আচ্ছা।

মন্দা টেলিফোনের পয়সা দিয়ে বেরিয়ে আসে।

এদের কার সঙ্গে কবে পরিচয় হয়েছিল তা কিছুতেই মনে পড়ে না মন্দার। সুবীর, সুব্রত, বৌধায়ন, মৃদুলকার সঙ্গে তার আগে বা পরে চেনা হয়েছিল? কে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল? কিছু মনে পড়ে না। একজন বন্ধু থেকে আর একজন, তারপর তার থেকে আর একজন, এমনিই এক রিলে রেসের মতো পরিচয় থেকে পরিচয়। একটা সিগারেট থেকে আর একটা ধরিয়ে নেওয়ার মতো।

আজ একা বলে এই সব ভাবল মন্দা। কাউকেই সে কখনও গভীর ভাবে ভাবেনি।

আজ ভাবতে লাগল।

.

০৪.

পা সরাতে বৌধায়ন মুখখানা যথেষ্ট বিকৃত করে। না, তেমন কোনও ব্যথা নেই পায়ে, তবু ব্যথার স্মৃতি আছে, ভয় আছে। আসলে ব্যথা-বেদনার চেয়ে ব্যথা-বেদনাব ভয় বা স্মৃতিই তো মানুষের বেশি।

ইনজেকশন, টিকা, স্টেথােস্কোপ বা থার্মোমিটার সে বরাবর ভয় পায়। এমনকী কেটেকুটে গেলে ডেটল লাগাতেও সে চেঁচামেচি করবেই। এই সব কিছুর সঙ্গে রোগ ও দুর্ঘটনার আবহ মিশে থাকে। আর ও দুটোকেই তার ভয়।

তা বলে কি সে চলন্ত বাসে ওঠে না? বিপজ্জনকভাবে রাস্তা পেরোয় না? দাড়ি বা নখ কাটে না? আর বোগের ওপর তো হাত নেই, তাই ভোগেও। এগিয়ে আসে থার্মোমিটার, স্টেথােস্কোপ, মাঝে মাঝে ইনজেকশনের ছুঁচ। সবই সহ্য করতে হয়, কিন্তু এসব পছন্দ করে না সে। তার মনপ্রাণ প্রত্যাখ্যান করে স্টেথোস্কোপ, থার্মোমিটার, ইনজেকশন এবং ডেটলকে। সে ভুগতে চায় না, আহত হতে চায় না। কিন্তু এও জানে, বেঁচে থাকতে গেলে এসব কিছু না কিছু হবেই।

খুব বিকৃত মুখে বৌধায়ন তার খাট থেকে ভাল পা-খানা বাড়ায়, কাস্টিং আর ব্যান্ডেজে বাঁধা আহত পায়ের দিকে ভয়ের চোখে খানিক চেয়ে থাকে। ব্যথা লাগবে না তো?

খাটের নীচেই একটা প্ল্যাকসোর কৌটো রয়েছে পেচ্ছাপ করার জন্য। সেই কৌটোটার দিকে খুব ঘেন্নার চোখে চায় সে। তার পেটে প্রচুর জল জমে যায়। এত জমে যে প্রায় সময়েই ওই টিনটা ভরেও খানিক উপচে পড়ে। সে এক ঘিনঘিনে অবস্থা। ঘরের মেঝেয় সেই ঘৃণ্য তরল গড়ায়। পরে ঝি বা চাকর কিংবা মা এসে চট চাপা দেয়। সমস্যাটা একটা আরও বড় কৌটোর। কিন্তু কেউ সেই সমস্যাটা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না।

খাটের ধারে ত্রিশঙ্কুর মতো বসে সে অপেক্ষা করে কিছুক্ষণ। এভাবে বেঁচে থাকার মানেই হয়। গতকাল এক্স-রে হয়েছে। ডাক্তার বলেছে, স্পেইন, তবে কিনা বেশ জটিল স্পেইন। পেশির কিছু তন্তু ছিড়েছে হয়তো, শিরা কেটে গেছে। কে জানে কী! ডাক্তাররা এক রহস্যময় জাতি, তারা কখনও স্পষ্ট করে কিছু বলে না। মন্ত্রগুপ্তিতে তাদের পাকা ট্রেনিং দেওয়া হয় বোধহয়। মন্ত্রীদের মতো তারাও কি মন্ত্রগুপ্তির শপথ নিয়ে তবে চিকিৎসা শুরু করে? বছরখানেক আগে জ্বর আর কাশিতে কাহিল বৌধায়ন ধরেই নিয়েছিল, টি বি। ডাক্তারকে যত বলে স্পষ্ট করে বলুন কী হয়েছে, ডাক্তার ততই মৃদু হেসে বলেন, “অত ভাবছেন কেন? আমি তো আছি।’

ডাক্তাররা ওইরকম ঈশ্বরের মতোই কথা বলে। কিন্তু স্পষ্টভাষী তারা নয়। গোটা চিকিৎসা পদ্ধতিটাই রহস্য রোমাঞ্চে ভরা। বৌধায়নের দৃঢ় ধারণা, তার গোড়ালির হাড় চুরমার হয়ে গেছে, গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গেছে, চামড়া কাটলে হাড়গুলো ট্যালকম পাউডারের মতো ছড়িয়ে পড়বে। গতকাল থেকে সে এক্স-রে প্লেটটা মোনালিসার ছবির মতো মনোযোগ দিয়ে দেখেছে লক্ষবার। নেগেটিভ ছবির মতো সেই গোড়ালির নকশাও বড় রহস্যময়। কিছু বুঝবার উপায় নেই। তবু তার মনে হয়েছে ছবির মধ্যে তার গোড়ালির হাড়ে বেশ কয়েকটা ফাটল আর চিড় দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ডাক্তার তা দেখেনি, বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে বলেছে, তেমন কিছু নয়। একটু ভুগবেন!

বৌধায়নের আতঙ্ক যায়নি। কখনও এক্স-রে প্লেট, কখনও ব্যান্ডেজে বাঁধা পায়ের দিকে সে কুট চোখে চেয়ে ঠোঁট কামড়াচ্ছে সারা দিন।

খুব সাহসের সঙ্গে বাঁ পা মেঝেয় নামিয়ে দিল বৌধায়ন, তারপর আহত ডান পাটা খুব আস্তে আস্তে হাত দিয়ে তুলে ধরে শিশুর মতো খাটের ধারে আনল। আর তা করতে গিয়ে যেন ব্যথায় নীল হয়ে যাচ্ছিল সে। আসলে ব্যথা লাগছিল না। ব্যথার ভয়, ব্যথার স্মৃতি।

এ বাড়িতে একজন ভারী লজ্জার মানুষ আছে। সে হল তার মেজদার বউ। নতুন বউ। সারাদিন সারা বাড়িতে ছলবল করে ঘুরে বেড়ায়, যখন তখন তার ঘরে এসে হানা দেয়, বুধবা, কেমন আছ? এঃ মা গোদা পা! বলে বসে পড়ে। মাঝে মাঝে ব্যান্ডেজের ওপর চিমটি কাটার চেষ্টা করে। ফাজিল। কিন্তু সেটা তেমন বিপজ্জনক নয়। আসল বিপদ হল নতুন বউটা যদি হুট করে তার পেচ্ছাপের সময় এসে ঘরে হাজির হয়। বৌধায়নের সাধ্য নেই উঠে গিয়ে ঘরের দরজাটা বন্ধ করে আসে।

বৌধায়ন আতঙ্কে আর সন্দেহে খোলা দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে খানিকক্ষণ। পাতলা পর্দা হাওয়ায় উড়ছে। জয়তী কি এই বিকেলে বাড়িতে আছে? বেরোয়নি?

কিন্তু ভাববার উপায় নেই। তলপেট ভারী হয়ে ঝুলে পড়ছে। যন্ত্রণার মতো। মেঝেয় ডান পাটা সটান করে রেখে বাঁ পায়ের ওপর হাঁটু গেড়ে বসল সে। বড্ড কষ্ট হয় বসতে এইভাবে। ব্যথা-বেদনায় ভয়ংকর বিকৃত করল মুখ। কৌটোটা মুহূর্তে ভরে উঠল ঘৃণ্য তরলে। এইবার উপচে পড়বে। পড়ল… ইস ছিঃ ছিঃ…।

ঘর ভাসিয়ে উঠে পড়ল বৌধায়ন। বাঁ হাঁটু ভিজে গেছে, ডান পায়ের ব্যান্ডেজেরও খানিকটা ভেজা। কিছু করার নেই।

বিছানায় ক্লান্ত ভাবে শুয়ে সে সিগারেট ধরায়। সারা ঘরের মেঝেয় গড়ানো তরল পদার্থের কথা ভুলবার জন্য সে একটা ভাল কিছু চিন্তা করবার চেষ্টা করতে যাচ্ছে। এতকাল সবচেয়ে প্রিয় চিন্তা ছিল কোনও একটি, যে কোনও একটি মেয়েকে নিয়ে। অজস্র মেয়ে, যখন যাকে ইচ্ছে ভাবতে পারত সে। একটু আগে মন ফোন করেছিল।

মন তো জানে না ওকে নিয়েও কত দিন ভেবেছে বৌধায়ন। পাশবালিশ আঁকড়ে ধরে মনকে ভেবে ভালবাসার চুমু দিয়েছে তুলোয়। কিন্তু সে সব চিন্তা আজকাল ফকিকারী হয়ে গেছে কেন যে! ভাল কিছু ভাবতে গেলে কিছুতেই মেয়েদের কথা মনে আসে না।

চোখ বুজলেই আজকাল সে একটা ঘোেলা জলের স্রোত দেখতে পায়। নদীটা খুব চওড়া নয়। দু’পাড়ে মাইল মাইল জুড়ে নির্জনতা আর গরান গাছ, বাবলা বন। একদিকে ভাঙা পাড়ের মাটির মধ্যে খাঁজে খাঁজে ইট। কোনও এক স্থাপত্যের ধ্বংসস্তৃপা পাখি ডাকছে। নৌকো চলেছে ধীরে, উজান ঠেলে। জোয়ারের জল তীরের ঘাসপাতা ড়ুবিয়ে ছলাৎ ছল শব্দে ভাঙছে। গোসাবার পর ওই নির্জনতা আর নির্জনতা ছাড়া কিছু নেই। সে এক গহিন প্রাকৃত জগৎ।

একবারই গিয়েছিল বৌধায়ন ওইখানে। আজকাল বার বার সেই নদীটা তার মনে পড়ে। আর খুব স্নিগ্ধ হয়ে যায় মন। কে যেন মলম মাখিয়ে দেয় তার হৃদয়ের ঘেঁড়া খোঁড়া ক্ষতস্থানে। মায়ার কাজল পরিয়ে দেয় চোখে।

পাশ ফিরে বালিশে অস্থিরভাবে কপাল ঘষে বৌধায়ন। সে কেন মেয়েদের কথা ভাবতে পারছে না? তার বদলে বরং তার হঠাৎ মনে পড়ে, সেবার শংকরের নতুন কেনা গাড়ির টায়ার ফসল ধলভূমগড় থেকে ফেরার পথে। শংকর জ্যাক লাগিয়ে চাকা বদল করছিল। স্টেপনি লাগাতে তাকে কিছুটা সাহায্য করল বৌধায়ন, তারপর চুপচাপ রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে খেতে তাকিয়েছিল একটা প্রকাণ্ড পোড়ো মাঠ আর ঢেউ ঢেউ টিলার দিকে। শীতের তখন সবে শুরু। ভোরবেলা ছিল। নীল আলোয় মাখামাখি আকাশ, লুটোপুটি অঢেল নরম রোদ। মুহূর্তের মধ্যে সে যেন গলে গেল, মিশে গেল চারধারের সঙ্গে। সেই যে স্তম্ভিত মুগ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল বৌধায়ন, সেই থেকে আজও সে সেইখানেই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। কোনওদিনই পুরোপুরি ফিরে আসতে পারেনি। হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে, মনে হয়, দেখে, একটা বিশাল শালগাছের ছায়ায় সে দাঁড়িয়ে, চারদিকে ঢাউস ঘুড়ির মতো বড় বড় পাতা খসে পড়ছে শীতের বাতাসে, আর আলোর পুকুর থেকে উঠে আসছে পৃথিবীর টিলার ঢেউ, আর অকাজের পোড়ো মাঠ চিত হয়ে শুয়ে আছে নিশ্চিন্তে।

বাইরের বারান্দা থেকে একটা নকল ঘুঘুর ডাক শোনা গেল! উৎকর্ণ হয়ে শুনল বৌধায়ন। তারপর সভয়ে চেয়ে রইল ঘরের মেঝের দিকে। ওপচানো ঘৃণ্য তরলে থই থই।

একটু ভাবুক বলে বন্ধুরা তার খ্যাপানো নাম দিয়েছে, ভাবের ঘুঘু। বৌধায়নের এই নামটা কী করে যে তার বাড়িতেও জানাজানি হয়ে গেছে কে জানে। পা ভাঙার পর লম্বা একঘেয়ে দুপুরে মাঝে মাঝে তাকে সঙ্গ দিতে মা এসে পাশে শুয়ে থাকে। কদিন আগে দুপুরবেলায় সে শুয়ে শুয়ে মাকে বলছিল, জানো মা, আমার মাঝে মাঝে মনে হয় আর জন্মে আমি ছিলাম লেবুগাছ। এই যে আমার হাত দেখছ, পা দেখছ, এসব ছিল ডালপালা, আর এই কনুই কবজি, কণ্ঠা, বুক পিঠ ছিল তাজস্র কাটা। কান নাক হাতে, তেলো ছিল সবুজ সুগন্ধী পাতায় ছাওয়া। তখন আমার শরীর জুড়ে সাদা সুঘ্রাণ ফুল ফুটত। আর ফুল ঝরে গিয়ে কচি কচি সবুজ তাজা লেবু ফলত। মনে হয় কী জানো? মনে হয়, আমি যখন লেবু গাছ ছিলাম তখন তুমি ছিলে এত্তোটুকু ফুটফুটে একটা মেয়ে, আর বোজ গিয়ে লেবু ছিড়তে আমার ডালপালা থেকে। আমার খুব দুঃখ ছিল যে আমার ঘর নেই, দালান নেই, শীতে গ্রীষ্মে বর্ষায় রোদে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয় এক জায়গায়, কোথাও যাওয়ার জো নেই। আর তখনই তোমাকে দেখে আমি মনে মনে ভাবতাম, এবার একদিন আমি মরে যাব। তখন এই ফুটফুটে মেয়েটার বিয়ে হবে আর আমি ওর কোলে আসব ছেলে হয়ে।

এসব কথা সে তার মাকে বরাবরই বলে। মাও খুব মন দিয়ে শোনে আর চোখ ছলছল করে ওঠে। কিন্তু সেদিন মা এক গালের পান আর এক গালে নিয়ে বলল, তোর মাথায় আবার সেই ঘুঘু ডাকছে।

ভারী রাগ হয়েছিল বৌধায়নের। বলল, আজকাল তুমি এরকম খিটখিটে হয়ে গেছ কেন বলো তো?

মা হেসে বলল, তা তুই অত ভেবে মরিস কেন? তোর বাবাও তো বলে, বুঘোটা বড় ইমপ্র্যাকটিক্যাল আর তাই ওর কোনও কাজেকর্মে মন নেই।

মায়ের এই বিশ্বাসঘাতকতায় হতবাক হয়ে গিয়েছিল সে। মাকে ছাড়া আর কাকেই বা সে বলতে যাবে এসব কথা?

তবু না হয় মায়ের ব্যাপারটা সহ্য করা গিয়েছিল, কিন্তু সবচেয়ে অসহ্য বাড়ির নতুন বউটা যখন তার পিছনে লাগে। বাইরে যে ঘুঘুর ডাক শোনা যাচ্ছে তা আর কারও নয়, নতুন বউ জয়তীর।

বৌধায়ন কনুইয়ে ভর দিয়ে উঠে তীক্ষ্ণ চোখে দরজার দিকে চেয়ে হেঁড়ে গলায় বলল, এখন এ ঘরে আসবে না বলে দিচ্ছি জয়তী!

বাইরে থেকে সরু গলা এল, আসব।

বৌধায়ন বালিশে হতাশ মাথাটা ফেলে দিয়ে বলল, ঠিক আছে। এসে নিজেই লজ্জা পেয়ে দৌড়ে পালাবার পথ পাবে না।

জয়তী এ কথার পর অবশ্য ঘরে ঢুকবার সাহস পেল না, কিন্তু বাইরে থেকে বলল, ঘুঘু পাখিটা কি ডাকছে এখন?

বৌধায়ন বিড় বিড় করে বলে, ডাকলে তোমার বাবার কী?

জয়তী বাইরে থেকে বলে, চা-টা কি ফিরিয়ে নিয়ে যাব?

মাকে দিয়ে পাঠাও। তুমি আসবে না।

মাকে ডাকতে ডাকতে ঠান্ডা হয়ে যাবে যে!

যাক। তোমার লজ্জা করে না? কাঁচা বয়সের দেওরের ঘরে হুটহাট এসে ঢোকো যে বড়!

একশোবার ঢুকব।

তা হলে তোমার মনে পাপ আছে।

আমার নয়, তোমারই আছে। লজ্জা করে না বুড়ো ছেলে ঘর ভাসিয়ে পেচ্ছাব করেছ! অকাজ ঢাকতে চোখা চোখা কথা ছাড়া হচ্ছে।

বৌধায়নের কান-ফান গরম হয়ে গেল। সে বালিশটাকে দুমড়ে মাথা আর কান ঢেকে চোখ বুজে শক্ত হয়ে পড়ে রইল। ছিঃ ছিঃ। দেখেছে উঁকি দিয়ে। এইসব মেয়েদের চুলের মুঠি ধরে…।

ঠিক তার মুখটার কাছে বিছানার ওপর একটা খবরের কাগজ ঝটকা মেরে রাখল জয়তী। খবরের কাগজের বাতাসটা পর্যন্ত বৌধায়নের মুখে লাগে। খবরের কাগজের ওপর চায়ের কাপ রেখে জয়তী পায়ে করে দরজার কাছ থেকে ভাজ করা চট টেনে এনে ঘরের মেঝেয় বন্যা রোধ করার চেষ্টা করে। চটটা এখানে সেখানে টেনে নিয়ে বেড়ায়। বলে, আবার বলে মনে পাপ আছে। এ পাপটা কে করেছে শুনি। এ বাড়ির লোকগুলোও কিস্তৃত। একটা বড় কৌটো রাখতে পারে না!..তোমার অবশ্য কৌটোয় হবে না। একটা জালা দরকার।

বৌধায়ন রক্তচোখে চেয়ে বলে, গেট আউট।

 চোখ রাঙাবে তো ভাঙা পা মুচড়ে দেব।

বৌধায়ন খুব হতাশার সঙ্গে উঠে বসে। তারপর হেসে বলে, আজকালকার মেয়েরা এত বেহায়া কেন বলো তো!

ভাল করলেও আজকাল লোকের গাল ওঠে না।

এঃ ভাল! নতুন নতুন সব বউই ভাল থাকে। কয়েকদিন পরই তাদের স্বরূপ বেরোয়। তাছাড়া নাচুনি মেয়েগুলোই বাজে।

জয়তী সুন্দরী নয় মোটেই। রং কালো তবে দীঘল এবং চাবুকের মতো নমনীয় তার শরীর। সে খুবই ভাল নাচত একসময়। একাডেমিতে সেই নাচ দেখেই মেজদা বুধাদিত্য কৌতূহলী হয়ে ওঠে, কমপ্লিমেন্ট পাঠায় এবং সবশেষে বিয়েও করে। নইলে মার্কিন দেশ থেকে ইনজিনিয়ারিং-এর ডিগ্রি নিয়ে আসা বুধাদিত্য অনেক ভাল পাত্রী পেয়ে যেত।

জয়তী একটা কৃট কটাক্ষ হেনে বলে, নাচুনি মেয়েরা যাই হোক, তাদের পেছনে ল্যালার মতো ঘুরে বেড়ানোর লোকের অভাব নেই। তোমার নয়নাটি কী?

নয়না আমার পোষা ময়না নয়। ঠিক উড়ে যাবে।…চা-টা খুব বাজে করেছ। এই চায়েই বোঝা যায় কোন মেয়ে কতখানি অ্যারিসটোক্র্যাট। তোমার বাবা ভুখখা পার্টি নাকি জয়তী?

জয়তী খাটের একধারে বসে খুব আলতোভাবে ডান হাতখানা বৌধায়নের ডান পায়ের ওপর রাখে, মুখখানা করুণ করে বলে, জানোই তো আমি গরিবের মেয়ে!

উঃ! হাত সরিয়ে নাও।

 লাগছে? কোনখানে বলো তো?…এইখানে?— বলে জয়তী ঠিক গোড়ালির কাছটায় আস্তে আস্তে চাপ বাড়ায়।

লাগছে.এই বউদি, মাইরি কী হচ্ছে…অ্যাই.আবার ডিজলোকেশন হয়ে যাবে…মাইরি মা কালীর দিব্যি লাগছে…

জয়তী হাত সরিয়ে নিয়ে ভাল মানুষের মতো তার বেণী ঠিক করতে করতে বলে, আভিজাত্য তুলে কথা বলা আর ছোটদের মুখে বড়দের নাম ধরে ডাকা আমি পছন্দ করি না।

বৌধায়নের হাতের কাপ থেকে চা চলকে পড়েছিল। সে কাপ রেখে জামা আর বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে বলে, মেজদা একদিন ঠিক বুঝতে পারবে কী ভুলটাই করেছে। এঁটো কাপটা নিয়ে কেটে পড়ো তো!

কেটে পড়ব কী গো! মা যে আমাকে পাঠাল তোমাকে একটু কম্প্যানি দিতে।

 তোমার চেয়ে গোখরো সাপের কম্প্যানি ভাল।

ও বুঝেছি। তোমার ভাবের গাছে এখন ঘুঘু ডাকছে।…ঘুঘু-ঘুঘু-ঘু …তবে বেশিক্ষণ তোমাকে জ্বালাব না। আমরা বেরোচ্ছি।

বৌধায়ন মুখ বিকৃত করে বলে, বাঁচলাম।

কোথায় যাচ্ছি জানো? চিত্রাঙ্গদা। নয়না কার্ড দিয়েছে।

 গো টু হেল।

তুমি কার্টসি জানো না। মেয়েদের সামনে ‘হেল’ কথাটা বলতে নেই, তোমার মেয়ে বন্ধুরা তোমাকে কী করে সহ্য করে বলো তো?

বৌধায়ন হেসে ফেলে বলে, বরং আমি ওদের কী করে সহ্য করি সেইটেই প্রশ্ন হওয়া উচিত। নয়না তোমাদের কার্ড দিল কেন বলো তো?

চোখ বড় বড় করে জয়তী বলে, শুধু কার্ড? নিত্যি এসে শাশুড়িকে মা আর শ্বশুরকে পরিষ্কার বাবা বলে ডাকছে। তোমার ঘরেও তো দবজা বন্ধ করে প্রায়ই এক-দেড় ঘণ্টা কাটায়। কী চায়

জানো না? ন্যাকা কোথাকার!

ঠোঁট উল্টে বৌধায়ন বলে, ওঃ, ওরকম অনেকেই চায়। চাইলেই পাওয়া যায় নাকি?

জয়তী সামান্য ধারালো গলায় বলে, তুমি চাও না? তা হলে এক বাড়ি লোকের সামনে একটা কুমাবী মেয়েকে নিয়ে ঘরের দরজা দাও কেন? তোমার এথিক্স নেই?

বেশি বোকো না। বিয়ের আগে তোমারও বুধাদিত্য চাটুজ্যের সঙ্গে ফিজিক্যাল কন্ট্যাক্ট ছিল। সব জানি।

জয়তী প্রচণ্ড রেগে গিয়ে বলে, ছিল তো কী হয়েছে? আমরা শেষ পর্যন্ত বিয়ে করেছি।

বৌধায়ন হেসে বলে, সাব্বাস। দারুণ সৎ ও সতী তো তোমরা!

মানে?

তুমি তো জানো না, বুধাদিত্য চাটুজ্যে আমেরিকায় কটা মেয়ের সঙ্গে কী কী করেছে! আর সেও জানে না বিয়ের আগে তোমারই বা ক’জন ছেলেবন্ধু ছিল। আমাকে বেশি এথিক্স দেখিয়ো না।

জয়তী বেশি ঘাঁটাল না। ঠান্ডা গলায় বলল, তোমার মনে কী আছে জানি না। তবে যদি সত্যিই নয়নাকে রিজেক্ট করতে চাও তবে এক্ষুনি তা করো। নইলে ও কিন্তু এনট্রি নিয়ে নেবে। নেবে কেন, অলরেডি নিয়েছে।

বৌধায়ন চিত হয়ে শুয়ে উদাস গলায় বলে, মেয়েদের কথা আজকাল আমি ভাবি না। আমি বাউল হয়ে যাচ্ছি। জলে নামব, জল ছিটাব, জলে সাঁতার কেটে যাব, কিন্তু বেনি ভিজাব না। নয়না পারবে না। তুমি যাও তো, ভাল করে এক কাপ চা তৈরি করো, বাবুদের বাড়ির মেয়ের মতো কোরো, বস্তির ব্র্যান্ড নয়। যাও।

জয়তী তার চুল ধরে খুব জোরে একটা মোচড় দেয়। বৌধায়ন জয়তীর পিঠে একটা চড় কষায়। বলে, কেমন?

চড়টা জোর লেগেছে। জয়তীর চোখে জল এসে যায়। করুণ স্বরে বলে, মারলে তো! আচ্ছা দেখব।

বৌধায়ন পাশ ফিরে শোয়। চোখ বুজে থাকে। জয়তী কাপ তুলে নিয়ে দুম দুম করে পা ফেলে চলে যায়।

বৌধায়ন পাশ ফিরে নরম বালিশের মধ্যে মুখ ড়ুবিয়ে দেয়, প্রাণপণে চেপে রাখে নিজেকে বালিশের মধ্যে। বিড়বিড় করে বলে, হ্যাকনীড, হ্যাকনীড, জঘন্য, কুৎসিত…

রাগটা কার ওপর তা বুঝতে পারে না সে। সব কিছুই ভয়ংকর কুৎসিত, জঘন্য, হ্যাকনীড। কেন মেয়েদের কথা বারবার বলে সবাই? ক্যাতক্যাতে কাদার মতো শরীর, একঘেয়ে ঘাটাঘাটি, চুমু খাওয়া এবং ক্লান্তিকরভাবে ভালবাসা শেষ হওয়া—এ সবের মধ্যে কী আছে? সবচেয়ে হ্যাকনীড পোশাক খুলে মেয়েদের ব্যবহার করা। তবে ভাল কী? কিছু নয়। সবচেয়ে কুৎসিত এই পা ভেঙে পড়ে থাকা। নয় নম্বর বাস থেকে একটা লোক ঝুলছিল হাতল ধরে। এমন কেড়ে ঝুলছিল, এত অসহায় আর নশ্বর লাগছিল লোকটাকে যে বৌধায়ন দৌড়ে গিয়ে তাকে বাসের মধ্যে গুঁজে দিতে চেষ্টা করে। আর সেইসময়ে বাসটা তাকে চিমটি দিয়ে ধরে খানিকদূর হেঁচড়ে নিয়ে যায়। প্রথম তার মনে হয়েছিল, বাসটাই তাকে চেপে ধবেছে, পরে বুঝল আসলে পাদানির ভিড়ের ভিতরে তার হাত ঢুকে গিয়ে আটকে গিয়েছিল। সেই থেকে এই অবস্থা, কিন্তু এই মুহূর্তে তার লাফিয়ে উঠে রে রে করে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। বেরিয়েই সে লাফিয়ে বাসে উঠবে, বিপ্লব করবে, খোলা মাঠের মধ্যে দৌড়ে ভোঁ হয়ে যাবে।

কাতর শব্দ করে সে আবার পাশ ফেরে। চিত হয়, কাত হয়, উপুড় হয়। কোনও ভাবেই ভাল লাগে না। মাথার কাছে টেবিলের ওপর গুচ্ছের পেপারব্যাক থ্রিলার। একটা টেনে ঠিক দু’পাতা পড়ে রেখে দিল। কলিং বেল নেই, কাউকে ডাকতে হলে চেচিয়ে ডাকতে হবে। ডাকবেই বা কাকে। মা আর বউদি বেরোল বোধহয়, ছোট বোন শিঞ্জিনী একটা গিদধরের সঙ্গে জমিয়ে নিয়েছে। এ সময়টায় দু’জনে কোথায় যেন আশনাই করতে যায়। কদাচিৎ দাদার খোঁজ নেয় সে।

আসলে তার কেউ নেই। এই ভেবে সে চুপচাপ দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে রইল।

টেলিফোনটা বাজল অনেকক্ষণ বাদে। কতক্ষণ বাদে তা সঠিক জানে না বৌধায়ন। সে বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছিল।

টেলিফোনে একটা আর্ত স্বর বলে ওঠে, বৌধায়ন!

বলছি। কী হয়েছে?

আমি মন্দা, ভীষণ বিপদ!

 কী বিপদ?

আঃ…আমি ভীষণ মুশকিলের মধ্যে…আসবে?

আমি? আমার তো পা ভাঙা! কোথায় তুমি?

আমার বাবার অফিসে। অনেক লোক আমাকে ঘিরে ধরেছে। দে আর গোয়িং টু…গোয়িং টু…রেপ…মলেস্ট…বৌধায়ন! কী করব?

কী বলছ মন?

এসো শিগগির! নইলে কাউকে খবর দাও। আমি…আমি…

.

০৫.

মন্দা সেই সন্ধেবেলায় টেলিফোন করেছিল, তারপর থেকে টেলিফোনের কাছে বসে বসে মাছি তাড়িয়েছে সমীরণ। দু’বার চা খেয়ে খিদে মেরেছে। তারপর সুখনকে দিয়ে একটা পোড়া ভুট্টা আনিয়ে অনেকক্ষণ ধরে প্রতিটি সুস্বাদ দানা চিবিয়ে খেয়েছে। কিন্তু কিছুই আর করার নেই। আসলে রায়বাবু আর আচার্যিবাবুর অফিসে এমনিতেও তার করার কিছু থাকে না। প্রায়দিনই চুপচাপ বসে থাকতে হয়। টেলিফোনের দুটো এক্সটেনশন আছে, একটা রায়বাবুর ঘরে, একটা আচার্যিবাবুর ঘরে। টেলিফোন এলে দুটোই বাজে। কেউ না থাকলে সমীরণ গিয়ে ফোন ধরে। ওরা কেউ না থাকায় এখন আচার্যিবাবুর ফোনটা বাইরে রাখা আছে। সে অফিসে এসে আজকাল কেবল টেলিফোন এলে জবাব দেয়। রায়বাবু আর আচার্যিবাবু থাকলে এটুকুও তার করতে হয় না।

অনেকক্ষণ বসে থেকে থেকে মাজা রসস্থ হয়ে গেল, পিঠ টনটন করতে লাগল। রায়বাবুর মেয়ের নাকি তাকে দরকার। সেটাও চাকরি মনে করে সমীরণ বসেছিল।

যখন ভুট্টা খাচ্ছিল তখনই আবার ফজলুর মুখটা মনে পড়ে গেল। আহা, ফজলুই না খেয়ে আছে। বরাবরই গরিব ছিল ওরা। একবেলা ভাত জোটে তো অন্যবেলা মুড়ি। জমিজমা যা ছিল তারও খানিকটা ইদানীং ওর বাপ বেচে দিয়েছে। ফজলু কিছুদূর লেখাপড়া শিখে কী একটু টুকুরমুকুর মেশিনপত্রের কাজ শিখল গিয়ে বহরমপুরে। তারপর বড় শহরে বড় সুযোগের আশায় কলকাতায় চলে আসে কঁাটালের গন্ধে মাছির মতো। অনেকদিন বাদে সমীরণের সঙ্গে এই আজ দেখা।

ফজলুর জন্য মনটা বড় খারাপ লাগছিল। সমীরণ নিজে কখনও না খেয়ে থাকতে পারে না।

ঘড়িতে যখন প্রায় পৌনে আটটা তখন সমীরণ ওঠে। না উঠে উপায়ও নেই। সুখনের রাতের অতিথিরা দু-চারজন এসে উকিঝুকি দিয়ে যাচ্ছে। ঠেলাওয়ালা, রিক্সাওয়ালা, মালের কুলি, কি দেশওয়ালি ভাই। গামছা বা কাপড়ের টুকরো পেতে ঘরময় শোবে সব। আবার ভোর ভোর কাজের ধান্ধায় বেরোবে। সারাদিন কলকাতাকে খুঁটবে, হাজারও পিপড়ে যেমন মোয়া খোঁটে।

রায়বাবুর মেয়ের বোধহয় আজ আর তাকে দরকার হবে না। রাত তত কম হল না। এই ভেবে সে অফিস থেকে বেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সোজা ফজলুর কাছে চলে আসে।

ফজলু!

ত্রিপলের তলায় আলো নেই। রাস্তার আলোও এখানে কমজোরি। শুধু দোকান-পাটের আলোয় ভিতরটা আবছা দেখা যায়। সেই অন্ধকারে একটা বিড়ির আগুন ধিইয়ে ধিইয়ে ওঠে।

ফজলু আছিস নাকি! বলে মাথা নিচু করে সমীরণ ভিতরে ঢুকে চৌকিতে বসে।

ভারী কষ্টের একটা শব্দ করে ফজলু শোয়া থেকে উঠে বসে বলে, সমীদা নাকি?

 হ্যাঁ। কেমন লাগছে রে?

ভাল আর কী বলল! না খেলে বড় একঘেয়ে লাগে। খেলে সময়টা কেটে যায়।

 দূর বুরবক! সময় কাটানোর জন্য লোকে খায় নাকি?

মাইরি বলছি, আমার আর তেমন কোনও কষ্ট নেই। এর আগেও তো অনশন করেছি। শুধু এই নাগাড়ে না খেয়ে থাকলে মনটা কেমন ম্যাদাটে মেরে যায়। সময় কাটে না। মালিক শালাও এল না। এবার ঠিক কোম্পানি হাতবদল হয়ে যাবে সমীদা।

তোর পেটের মধ্যে গোঁতলানো দিচ্ছে না?

প্রথম প্রথম দেয়। তারপর পিত্তিটিত্তি পড়ে কেমন অসাড় হয়ে যায় ভেতরটা। খুব জলতেষ্টা পায়। আবার জল খেলে বমিবমি লাগে।

এ ভাল হচ্ছে না রে ফজলু। চাচাকে লিখে জানাই, চাচা এসে বরং তোকে নিয়ে যাক।

নিয়ে যাবে কোথায়? ডাগর ছেলে হয়ে তো ঘরে বসে খেতে পারি না। আব্বা খাওয়াবেই বা কী? আমি যা দু’-দশ টাকা পাঠাতুম তাইতে খানিক সুসার হত।

অন্য কোম্পানি তোকে নেবে না?

অন্ধকারেও ফজলুকে বেশ কাহিল দেখাচ্ছিল। রোগা মুখে হেসে নিজের কপালটা চেপে ধরে বলল, আমার মতো এলেম নিয়ে হাজার হাজার ঘুরছে।

আরও একটু ভিতরদিকে, আরও আবছায়াতে কে যেন ককিয়ে উঠে পাশ ফিরল। বলল, ওঃ শালা উপোসি শরীরে আর কত রক্ত আছে বাবা। ছারপোকা শালারা তবু ছাড়ে না। মদনা, বিড়ি আছে?

আর একটা বিড়ি জ্বলে। লোকটা বিড়ি ধরিয়ে বলে, দাদা কি খবরের কাগজের লোক?

সমীরণ বলে, না।

লোকটা বলে, খবরের কাগজে আমরা চিঠি দিয়ে এসেছি। তবু আমাদের অনশনের খবরটা ছাপছে না কেন বলুন তো? মিনিস্টার বা এম এল এ-ও কেউ এল না।

ফজলু মাথাটা টিপে রেখেই বলে, অমন কত অনশন করছে লোক, ক’জায়গায় যাবে?

সমীরণ লক্ষ করল, এদের সকলের কথাতেই একটু খোনাসুর এসে গেছে। অনেকটা ভূতের স্বরের মতো।

রাস্তা দিয়ে কিছু লোক শ্লোগান দিতে দিতে মিছিল করে আসছে। বলছে, রুবি আয়রন ফাউন্ড্রির শ্রমিক আন্দোলন জিন্দাবাদ। বে-আইনি ‘টাই চলবে না। শ্রমিক ঐক্য জিন্দাবাদ। কারখানা হাতবদলের চক্রান্ত ব্যর্থ করো।

মিছিলটা বড় নয়। রোগাভোগা দরিদ্র চেহারার জনা ত্রিশ লোক। লাল শালুর ফেস্টুন তাদের হাতে। তাতে লেখা স্বস্তিকা লক কোম্পানি শ্রমিক সংঘ। তারা এসে ফজলুদের ত্রিপলের বাইরে জড়ো হল। একজন ধুতি আর শার্ট পরা লোক মাঝখানে দাঁড়িয়ে চড়া গলায় হাতের মুঠো তুলে তুলে বলতে লাগল, রুবি আয়রন ফাউন্ড্রির শ্রমিক ভাইয়েদের আন্দোলন সারা ভারতের শ্রমিকদের আন্দোলন। পুঁজিবাদ ও ধনতন্ত্রের শিকার ভারতের শ্রমিকরা এ লড়াইতে মদত দেবে…ইত্যাদি।

সমীরণ অস্বস্তি বোধ করে। কারণ, তার বেরোবার রাস্তা বন্ধ। যতক্ষণ না ওদের বক্তৃতা শেষ হয় ততক্ষণ এইখানে আটক থাকতে হবে তাকে।

অন্ধকার থেকে একটা লোক সামান্য খুশির গলায় বলল, এতক্ষণে সব আসতে লেগেছে। বিড়ি-ফেঁাকা লোকটা বলে, কাল আরও আসবে। খবরটা রটেছে। কিন্তু খবরের কাগজওলারা খবরটা স্রেফ চেপে গেল।

শেষ পর্যন্ত ছাপবে।

আর মিনিস্টাররা?

আসবে। একজন ভরসা দেয়।

ফজলু খোনাসুরে বলে, সমীদা, তোমার অফিসে কিছু হয়?

না রে। আমাকেই কবে বলবে কেটে পড়তে।

 ফজলু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে খানিকক্ষণ বক্তৃতা শুনল। তারপর বলল, মাথাটা কেমন করছে। সমীদা, আমি বরং শুয়ে শুয়ে তোমার সঙ্গে কথা কই।

কথা কওয়ার দরকার কী? চুপচাপ শুয়ে থাক। বিড়ি-টিড়ি কিছু খাবি?

 ফজলু হেসে বলে, যাঃ, তোমার সামনে খাই নাকি?

ওসব দেশের ভাই, পাড়ার দাদা সম্পর্ক রাখ তো! বিড়ি খেলে যদি শরীরটা ভাল লাগে বুঝিস তবে খা। আমি বরং মুখ ফিরিয়ে বসি।

তাই বসে সমীরণ। ফজলু বিড়ি ধরায়।

সমীরণ বসে বসে ভাবে, সে যে ভূতের ভয় পায় তা এমনি নয়। কলকাতায় আসার পর থেকেই তার ভিতরটায় নানারকম ভূত উকিঝুকি দেয়। তার মধ্যে সবচেয়ে পাজি ভূত হল চাকরি যাওয়ার ভয়। কাজকর্ম কিছু নেই, কবে যে রায়বাবু কেটে পড়তে বলবেন!

সমীরণ ভাবে, এবার থেকে যেমন করেই হোক কাজ দেখাতে হবে।

.

শেষ পর্যন্ত বলু। একটা শেষ চেষ্টা করতে বলুর গ্যারেজে ফোন করেছিল মন্দা।

ফোনটা গমগম করে উঠে প্রায় মন্দার কানের পর্দা ফাটিয়ে দিল, মন? আরে মন, তুমি তো স্রেফ হাওয়া হয়ে গেছো।… যেতে বলছ? আর বোললা না, হরিয়ানা থেকে আমার চারটে ট্রাক এল এইমাত্র। গৌহাটি যাবে। দুটোর টায়ার পাংচার।…টায়ারের দাম জানো মন?

আমার চেয়ে বেশি?

আরে তুমি তো লাখপত্তির হিরোইন। আমি শুখা গরিব, আমার মগজে এখন পাংচার টায়ার হাওয়া ছাড়ছে।..তুমি শুঃ-এর দোকানে চলে যাও আমি জিপ নিয়ে তুরন্ত আসছি।

কতক্ষণ?

হাফ অ্যান আওয়ার।

বার-এ আমি একা বসতে পারব না।

তবে রেস্টুরেন্টে বসে যাও। আমি আসছি। দুটো ড্রাইভার কিছু মাল টেনেছে, দুটোকে কয়েকটা লাথ জমিয়ে আসছি।

মন্দা ফোন ছেড়ে রেস্টুরেন্টের টেবিলে গিয়ে বসল। একা এবং ভীষণ একা।

বলু অর্থাৎ বলবীরকে তার যে খুব পছন্দ তা নয়। ওর সূক্ষ্ম অনুভূতি বড্ড কম। একসময়ে যখন কলেজে পড়ত তখন দুর্দান্ত হকি খেলত, ভাল ডিবেটার ছিল, ছাত্রও খারাপ ছিল না। তারপর আস্তে আস্তে পারিবারিক ব্যাবসাতে নেমে লরিওয়ালা হয়ে গেল! আজকাল লরিওয়ালাদের ভাষাতেই কথা বলে। তার গোটা দশেক হেভি ডিউটি ট্রাক হরিয়ানা, দিল্লি থেকে গৌহাটি ডিব্ৰুগড় ট্রিপ মারে। দেদার টাকা। প্রতি বছর দুটো-চারটে করে ট্রাক কেনে। আগে মাতৃভাষা পাঞ্জাবি বলতে পারত না, তার চেয়ে ঢের ভাল বলত বাংলা। ওর জন্ম কলকাতার ভবানীপুরে, বাঙালি পাড়ায়, বাঙালি বন্ধুদের সঙ্গে বড় হয়েছে। কিছুদিন শান্তিনিকেতনে ছিল। ভরাট গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে পারত।

কফি শেষ করার আগেই বলু চলে এল। পেল্লায় চেহারা হয়েছে। হাতে বালা, গালে কিছু দাড়ি, নাকের নীচে গোঁফ, মাথায় বাহারি মেরুন পাগড়ি। ঢুকেই উদভ্রান্তের মতো চারদিকে চাইতে লাগল। সবাই ওকে দেখছে। চেহারাটা দশাসই বটে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি দেখবার জিনিস ওর পোশাক। এই গরমেও বলু পুরো সুট পরে আছে, গলায় বিশাল চওড়া টাই। এদিক ওদিক তাকিয়ে মন্দাকে দেখে বিশাল গলায় বলল, হাই!

মন্দা ওকে ভাল করে মেপে নিচ্ছিল। কাছে এসে উলটোদিকে বসতেই বলল, ষাঁড় কোথাকার!

মোটা বলছ? কিন্তু ফ্যাট নেই। শুধু মাংসের ডায়েট। নাথিং এলস। পেটটা দ্যাখো। বলে কোটের বোতাম খুলে বলল, নাও, খিমচে ধরে দেখো, নো ফ্যাট।

এটা প্রকাশ্যে জায়গা বলু। ভালগারিটি একদম নয়।

খুব খোলা হাসি হেসে বলু বলে, ইন ক্যালকাটা এভরিবডি ইজ ড়ুয়িং এভরিথিং ইন পাবলিক। যাকগে মন, সন্ধের পর আমি জলীয় জিনিস বলতে একটাই বুঝি। চলল।

কোথায়?

চলো না!

মন্দা উঠল এবং গেল। লালরঙা ধূলিমলিন জিপগাড়িটা যথেষ্ট জোরে চালিয়ে এবং ঝাকুনি দিয়ে তাকে বলু সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউয়ের ওপর একটা বারে নিয়ে গিয়ে বসে। এবং তক্ষুনি মন্দা বুঝতে পারে, বিকেলটা তার নষ্টই হল আজ।

বলু বার দুই তার দুটো ট্রাকের জন্য দুশ্চিন্তার কথা বলতে শুরু করল এবং ফাঁকে ফাঁকে চার পেগ রাম খেয়ে নিল। মন্দা এক পেগ ব্ল্যাকনাইট নাড়াচাড়া করছিল। জমছিল না। বলু অনেক দূরের জগতে চলে গেছে। সবাই দূরে চলে যাচ্ছে। আজকাল মন্দার কাউকেই তেমন ভাল লাগে না। যেমন ভাল লাগছিল না চিলি চিকেন বা প্রন কাটলেট।

বলুর সঙ্গে কবে কীভাবে পরিচয় হয়েছিল তা কিছুতেই মনে পড়ল না মন্দার। এমনিতেই আজকাল কিছু মনে পড়তে চায় না, তার ওপর ব্লাক নাইট পেটে গিয়েই খ্যাপা কুকুরের মতো তার মগজে কামড়ে ধরেছে।

বলু হঠাৎ বলে, আমি কি নষ্ট হয়ে গেছি মন?

নষ্ট হবে কেন? তুমি টাকা কামাচ্ছাে।

সেইটেই তো নষ্ট হয়ে যাওয়া। আজকাল গলায় সুর খেলে না, লাইট ফুর্তি করতে ইচ্ছে করে, খুব টাকার নেশায় পেয়েছে।

মন্দা ক্ষীণ গলায় বলে, পুরুষে তো টাকা কামাবেই।

আই ওয়াজ নট দ্যাট টাইপ। আমার সঙ্গে তিলকের খুব জমত। আমার আর ওর টাইপ একরকমের। কিন্তু তিলক ওর টাইপ বহাল রাখল, আমি বিজনেসম্যান হয়ে গেলাম।

আর খেয়ো না, তোমার নেশা হচ্ছে।

 চার পেগ আমার মাপা। এক ফোটা বেশি খাই না। এতে যা হওয়ার হয়। না মন, নেশা-ফেশা নয়। তিলকটা ভেঙ্গে পড়ল চাষবাস করতে। আমি পারলাম না কেন?

মন্দা চুপ করে গ্লাসের গায়ে তার লম্বাটে প্রতিবিম্ব দেখল। মেন বিকৃত, লম্বা, শাকচুন্নির মতো ছায়া পড়েছে তার।

তিলককে তুমি ভালবাসতে মন?

মন্দা মাথা নেড়ে বলল, বলতে পারব না। বলু, আমার কিন্তু একটু নেশা হচ্ছে।

 ভেবো না। পৌঁছে দেব। আর এক পেগ নেবে?

না। আমার তো সহ্য হয় না। তোমাদের মতো মাতাল বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে খাই।

ঘোমটা দাও কেন বলো তো! খেলে প্রাণখুলে খাবে, কিন্তু ততক্ষণই খাবে যতক্ষণ বুঝবে যে একা বাড়ি ফিরতে পারবে।

বোকো না।

আর একটু খাও। অল্প খেলে মজাও আসে না, শরীরেও কষ্ট হয়।

সুতরাং মন্দা আর আধপেগ নিল। আসলে সে বুঝতে পারছিল, বলুনয় এই ব্ল্যাক নাইটই তাকে আজ যা কিছু সঙ্গ দিচ্ছে।

আমি কি বুড়িয়ে যাচ্ছি বলু?

 বলু খুব হাসে। হোঃ হোঃ করে। বলে, আমি নষ্ট তো তুমি বুড়ি! বাঃ বাঃ।

মন্দা ধমক দিয়ে বলল, মাতলামি নয় বলু!

 খামোক ধমকাচ্ছ ভাই। মাতাল বনে কোন বেওকুফ? আমাকে গিয়ে এখন দুটো ট্রাকের তদারকি করতে হবে। আজ রাতে রওনা করিয়ে দিয়ে তবে শান্তি। মাতাল হলে আমার চলবে? চিকেন খাচ্ছাে না? ফ্যাট হওয়ার ভয়? আরে গোস্ত খেলে ফ্যাট হয় না। দাও বরং আমাকে।

হুইস্কিটাও নাও। ভাল লাগছে না।

দেবে? আমার ডোজের বেশি হয়ে যাবে যে! তবু পয়সার মাল নষ্ট করে কী লাভ? তোমার এঁটোও বহুকাল খাই না। দাও। তিলকের কথা তুমি আজকাল আর কিছু ভাবো না, না?

না।

 আমার খুব মনে পড়ে। বড় বেশি সাত্ত্বিক হয়ে গেল শালা।

আমাদের কি অন্য কোনও কথা নেই বলু?

আছে। অনেক কথা আছে। আমি তো কথার বস্তা হয়ে আছি। কিন্তু সেসব কথা তোমার ভাল লাগবে না। টায়ার ফঁসবার কথা, লম্বা ট্রিপের কথা, লাইট জোকস, আমি নষ্ট হয়ে গেছি মন। কেন চোখের জলে ভিজিয়ে দিলেম না’ গানটার সব কথা মনে পড়ে না।

মন্দার চোখ ঝিকিয়ে ওঠে। বলে, আমাকে অ্যাভয়েড করছ?

 তোমাকে?— হোঃ হোঃ করে হেসে ওঠে বলবীর।

ঠিক এইসময়ে বেয়ারা এসে বলে, আপকা ফোন সাব।

বলু অস্পষ্ট ‘এক্সয়ুজ মি’ বলে তাড়াহুড়ো করে উঠে যায়। একটু বাদে ফিরে এসে কপালের ঘাম পাঁচটাকার রুমালে মুছে বলে, ফিট হয়ে গেছে।

মন্দা বড় বড় চোখে চেয়ে বলে, তুমি তোমার গ্যারাজে এখানকার ফোন নম্বর দিয়ে এসেছিলে?

হু। দোষ হয়নি তো?

তার মানে তোমার মন আমার ওপর নেই।

বিজনেস ইজ বিজনেস মন।

মন্দা চুপসে এতটুকু হয়ে যায় অভিমানে। ব্ল্যাক নাইটও তার মনটাকে সজল করেছে, নরম কাদার মতো মেখে ফেলেছে। তাতে এখন সহজেই গভীর ছাপ পড়ে। সে গুম হয়ে বসে থাকল খানিক, তারপর বিনা নোটিশে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, আমি যাচ্ছি।

আরে দাঁড়াও! তোমাকে পৌঁছে দেব।

 না বলু। আমি একজনকে বসিয়ে রেখে এসেছি। সে আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

কাকে মন? নতুন কেউ?

 যা ভাবছ তা নয়। আমাদের অফিসের একজন কর্মচারী। সে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে।

 তোমাকে পৌঁছে দেবে? কেন, আর ইউ ইন ডেঞ্জার?

মন্দা সামান্য অস্বস্তি বোধ করে। এতে ঠিকই যে তার পক্ষে একা বাড়ি ফেরাটা কোনও সমস্যা হওয়া উচিত নয়। কিন্তু আজকাল তার কেন যে একটা বিচিত্র শিরশির করা ভয়ের ভাব হয়। কেবলই মনে হয়, এই বুঝি কেউ পিছনে আসছে, লক্ষ করছে, সুযোগ খুঁজছে। তার ভয়, একদিন বুঝি কোনও সুযোগে ধর্ষণকারীরা ঘিরে ধরে তাকে তুলে নিয়ে যায়। কিংবা হঠাৎ কোনও খুনি ইস্পাত ভরে দেয় হৃৎপিণ্ডে। কোনও মানে নেই, তবু হয় ওরকম।

মন্দা তার খাটো চুল ঝাপটা মেরে সরিয়ে দিয়ে বলে, বলু যাও। তোমার বিজনেস ওয়েট করছে। আমাকে দিয়ে তোমার কী হবে?

ওরকম বোলো না মন। শোননা, আমি শিগগিরই জাহাজ কিনব। আই অ্যাম গোয়িং ইনটু ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড। আমার ইচ্ছে জাহাজের প্রথম ট্রিপে তোমাকে নিয়ে অস্ট্রেলিয়া যাব।

কী সুন্দর প্রস্তাব!

বিশ্বাস করছ না?

করছি। এখন যাও।

খুবই ফাঁকা আর একা লাগছিল মন্দার। এরকম ছাইয়ের মতো বিকেল সে অনেককাল কাটায়নি। বিকেলটা কেটে গেছে। রাত হতে চলল। ব্ল্যাক নাইট অনেকটা একঘেয়েমি কাটিয়ে দিয়েছে। তবে টিপ টিপ করছে মাথাটা। বলু তাকে জিপে তুলে সুরেন ব্যানার্জি রোডের ভিতরে বাবার অফিসের সামনে নামিয়ে দিয়ে যাওয়ার সময়ে বলে গেল, জাহাজের কথাটা ভুলো না। আই অ্যাম সিরিয়াস।

মন্দা ফিরে তাকাল না। আস্তে আস্তে সিড়ি ভেঙে তেতলায় উঠল। খুব অন্যমনস্ক। অন্যমনস্কতায় সিড়ির মুখে, করিডোরে ছায়া ছায়া কিছু লোককে দেখতে পেল। তাকে দেখে দু-চারজন দ্রুত সরে গেল এদিক ওদিক।

মন্দা তার বাবার অফিসঘর পর্যন্ত উঠতে যথেষ্ট হাঁফিয়ে পড়েছিল। ব্ল্যাক নাইট রক্তে ঘোড়া ছুটিয়েছে এতক্ষণে। তার ঘাম হচ্ছে, হাঁসফাস লাগছে, মাথাটা বেতাল, হাঁটু অবশ, বুক সামান্য জোরে ঢিপ ঢিপ করছে চোখে একটা কুয়াশার পর্দা পড়ে দৃষ্টি অস্বচ্ছ।

বড় ঘরটায় ঢুকেই সে থমকে গেল। পর মুহূর্তেই শিউরে উঠে ভাবল, সে ভুল জায়গায় এসেছে। এ নিশ্চয়ই তার বাবার অফিস নয়। বড় ঘরের মেঝেয় অন্তত দশ বারোজন লোক শুয়ে বা বসে আছে। প্রত্যেকের চেহারাই কালো, বেশির ভাগই আদুড় গায়ে। সামনের বড় একটা সেক্রেটারিয়েট টেবিলের ওপর যে লোকটা আধশোয়া হয়ে হা করে তার দিকে চেয়ে আছে সে লোকটার মুখে বসন্তের দাগ, কপালে একটা গভীর ক্ষতচিহ্ন আর ওরকম বদমাইশের মতো মুখ জন্মে দেখেনি মন্দা। ঘরে তীব্র বিড়ির গন্ধ। না, বিড়ির সঙ্গে আরও কিছু আছে। মুখ ফেরাতেই মন্দা দেখে আচার্যিকাকুর অফিসঘরের বন্ধ দরজায় ঠেস দিয়ে বসা একটা বিশ্রী চেহারার মাঝবয়সী লোক মুখ থেকে একটা বোতল নামিয়ে গামছায় আড়াল করল। একসময়ে মন্দার পুরুষ বন্ধুদের কেউ কেউ সিগারেটের মশলা ফেলে গাঁজা ভরে খেত। গাঁজার গন্ধটা চেনে মন্দা। এত গন্ধের মধ্যে সে কি গাঁজার গন্ধও পাচ্ছে একটু?

চারদিকে পাথরের মতো স্তব্ধতা। একঘর লোক স্ট্যাচু হয়ে তাকে দেখছে। মন্দাও নড়তে পারছে না। ভুল, সম্পূর্ণ ভুল ঠিকানায় এসেছে সে। এক্ষুনি চলে যেতে হবে, পালাতে হবে। কিন্তু আবার সে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে, দুটো ছোট অফিসঘরের দবজায় প্ল্যাস্টিকের নামের ফলকে লেখা, বি রায় আর এ আচার্য। এ তো তার বাবারই অফিস। সমীরণ নেই।

সুখন! সুখন!—ডাকল মন্দা।

 কেউ সাড়া দিল না। টেবিলের ওপর লোকটা ধীরে ধীরে উঠে বসে। তার চোখ জ্বলছে। মন্দা ঘরের একটু ভেতরে ঢুকে দাঁড়িয়েছিল। শুনতে পেল, তার পিছনে দরজার পাল্লা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তেলহীন কবজার ককিয়ে ওঠা শব্দ করে। চকিতে ঘাড় ঘোরায় সে। দেখে, ভেজানো দরজার গায়ে লতিয়ে আছে একটা আধন্যাংটা লম্বা কালো মানুষ।

মন্দা জানত এরকম কিছু তার জন্য অপেক্ষা করছে। এই লোকগুলো কী করবে মন্দাকে? কেড়ে নেবে? সর্বনাশ করবে কিছু? খুন করবে?

কিছু একটা করবে। পাথরের মতো স্থাণুভাব ঝেড়ে ফেলে মেঝে থেকে একে একে উঠে দাঁড়াচ্ছে তারা। কালো, কুৎসিত, নোংরা মানুষ। ভয়ংকর মানুষ। কারা এরা? কোত্থেকে এল?

বুদ্ধি হারিয়ে যাচ্ছে। শরীরে ভয়ের রিমঝিম। মন্দা তবু দু পা এগোল। আবার এক পা। বাবার অফিসের দরজাটা পেয়ে গেল হাতের নাগালে। সিড়িতে উঠবার সময়ে চাবি বের করে রেখেছিল হাতে। কাঁপা হাতে চাবিটা বাড়াল দরজার দিকে।

এখন একমাত্র সামনে এগোনোরই পথ আছে। কিন্তু পারবে কি মন্দা ছোট অফিসঘরটায় ঢুকতে? তার আগেই কি ওরা তাকে ধরবে না চেপে?

কিন্তু মন্দা পারল। কীভাবে পারল তা বুঝল না। কিন্তু দরজাটা খুলে গেল, গ্রাস করল তাকে, তারপর নিরাপদে বন্ধও হয়ে গেল।

রিভলভিং চেয়ারটায় বসে, হাতের নাগালে টেলিফোন পেয়ে মন্দা ভারী অবাক হয়ে যায়। ওরা যদি লুটই করবে তাকে তবে এ ঘরে ঢুকতে দিল কেন? ওরা কি জানে না এ ঘর থেকে মন্দা পুলিশ ডাকতে পারে?

টেলিফোনটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে যে নম্বরটা প্রথম মনে পড়ে তা ডায়াল করতে থাকে। বিড়বিড় করতে থাকে, বৌধায়ন। ওর তো পা ভাঙা! তবু কেউ না কেউ তো জানবে।

ফোন করে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে মন্দা। কী করবে? সারা শরীরে কাঁটা দিচ্ছে। শিউরে উঠছে সে৷ বাইরে চাপা স্বরে কথা বলছে ওরা। দরজায় ছিটকিনি দেওয়ার শব্দ হল না? অনেক পায়ের শব্দ খসখস করে ঘুরছে, ফিরছে। কে যেন বলল, মালকিন বাটে!

মন্দা ঘেমে ঘেমে অবসন্ন হয়ে যাচ্ছিল। এয়ার কন্ডিশনারটা সম্পূর্ণ নিজের অজান্তে চালিয়ে দেয় সে। তারপর অমোঘ নিয়তির জন্য অপেক্ষা করে।

সময় কাটে। বৌধায়ন আসবে না সে জানে। কিন্তু আর কাকে ফোন করা যায়? বাড়িতে তা হলে মা জানবে, সবাই জানবে।

খানিকক্ষণ ঠান্ডা ঘরে বসে জুড়িয়ে গেল সে। মাথাটা কিছু পরিষ্কার। উঠল। পা টিপে দরজার কাছে এল। বাইরে এখনও চাপা গলায় কথা হচ্ছে। ষড়যন্ত্র? আজ রাতটা মন্দার বোধহয় কাটল না। কাল হয়তো সে সমীরণকে ছাঁটাই করবে। কেন, কোন সাহসে লোকটা অপেক্ষা করেনি?

পর মুহূর্তেই বিদ্যুৎ খেলল মাথায়। যদি সমীরণকেও ওরা খুন-টুন করে থাকে? হয়তো আচার্যিকাকুর ঘরে তার লাশটা ফেলে রেখেছে।

চিন্তাটা সহ্য হল না মন্দার। এক টানে দরজাটা খুলে প্রচণ্ড চেঁচিয়ে বলল, খবরদার! আমি পুলিশে ফোন করেছি।

সামনে আবার পাথরের মতো স্তব্ধতা। টেবিলের লোকটা উঠে ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। মুখটা হতভম্ব। হঠাৎ সেই লোকটা হাতজোড় করে বলে, নমস্তে মেমসাব। মাফি মাঙে। আমরা রাতে এইখানে লেটে যাই। শুতনেকো জাঘা কুথা পাব, গরিব আদমি সব। মাফি মাঙে।

মন্দার কথাটা প্রথমে বিশ্বাস হয় না। তারপর হয়। তাই তো! এরা রিকশা বা ঠেলা চালায়, সারাদিন খাটে। রাতে যাবে কোথায়? কলকাতায় তো এত লোকের শোওয়ার জায়গা নেই!

সব লোকই দাঁড়িয়ে গেছে, বেশিরভাগই জোড় হাতে বিনয় করে বলে, নমস্তে মালিক। বাকি যারা তারা কথা বলতেও সাহস পায় না। মুখ লুকিয়ে রাখে।

এরা যেতে দেবে তাকে?

মন্দা আঁচলটা ঘুরিয়ে মুখ মুছে শরীরটা ঢাকা দিয়ে নেয়। মনটা নরম লাগে। আস্তে করে বলে, আমি পুলিশে খবর দিইনি। তোমরা থাকতে পারো।

চোঁয়াড়ে লোকটা ভারী খুশি হয়ে বলে, চোরওর নেহি মালিক, গরিব গাঁওয়ার লোক সব। মাফি মাঙে।

একজন বলে, বুঢ়া কুছু নেহি মালিক। স্রেফ লেটে যাই। সবেরে ফিন মাল ঢুতে চলিয়ে যাব।

মন্দা আর শোনে না। তার পেটের ভিতর যেটুকু ব্ল্যাক নাইট ছিল সব করুণাধারা হয়ে গেল এইমাত্র। চোখে জল হয়ে বয়ে এল রক্তের ভিতরে মিশে থাকা সেই ঘোড়সওয়ার।

মন্দা বলল, থাকো, থাকো। আমি কিছু মনে করিনি। কী ভাল লোক এরা! কী সুন্দর মানুষ সব।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *