০১. বাড়ির কাছে আরশিনগর

সুখীজীবন ও কাজের সন্ধানে
ডেল কার্নেগি

প্রসঙ্গ-কথা

আমাদের সুখ-দুঃখ আশা-নিরাশায় পূর্ণ জীবনের বেশিরভাগ সময় অতিবাহিত হয় কর্মের চিন্তায়। আসুন, এই কর্মজীবনকে সুখী, সমৃদ্ধ ও শান্তিময় করে তোলার চেষ্টা করি। হয়তো আপনি ব্যস্ত কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজে, যার সাথে মিলে আছে আরো অনেক লোকের স্বার্থ, তখন আপনার মুহূর্তের ভুল আপনাকে এবং সেইসব মানুষদের। সকলকেই ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও ব্যতিব্যস্ত করে তুলবেই। ফলে সারাদিন অজস্র পরিশ্রম করেও দিনের শেষে অত্যন্ত ক্লান্ত, শ্রান্ত, বিমর্ষ হয়ে পড়বেন। এই হতাশার হঠাৎ আঘাতে আপনার কাছে জীবন হয়ে উঠবে হয়তো দুর্ভাবনার। কর্মজীবন হয়ে উঠবে বৈচিত্রহীন, আনন্দহীন। তখন একটু অবসরের জন্যে মনটা আপনার তৃষ্ণার্ত হয়ে। উঠবে।

নিঃসন্দেহের মনের বিজ্ঞানী ডেল কার্নেগির এই রচনা আপনাকে ওই হতাশ, অন্ধকার জীবনে আলোর সন্ধান দেবে! কারণ এই মানুষটির এই অমূল্য রচনা পাঠ করে পৃথিবীর সব প্রান্তের কোটি কোটি মানুষ পেয়েছে জীবনের আকাঙ্ক্ষিত সফলতা। ডেল কার্নেগির এই বইটি তার কল্পনপ্রসূত অন্তঃসার শূন্য উপদেশ নয়। এটি তার আয়াসলব্ধ অভিজ্ঞতার ফসল। এটি তার সংগ্রামী চেতনালব্ধ জীবনদর্শন। মনে করুন, আমরা আজ থেকেই সমস্ত দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে, ডেল কার্নেগির প্রদর্শিত পথে চলতে শুরু করি। পাকা ডুবুরীর মতো বিস্তীর্ণ এই সংসার সমুদ্রের অতল থেকে যিনি তুলে এনেছেন অসংখ্য অভিজ্ঞতার রত্নসম্ভার, তার সেই অমূল্য সঞ্চয় মুদ্রিত এ গ্রন্থে।

এ বই আপনাকে দেবে হাজার আনন্দের রোশনাই। এমন বন্ধু, এমন স্বজনের সান্নিধ্য আপনি লাভ করতে পারবেন, যা পাখির কূজনের মতো মধুর, সূর্যের রশ্মির মতো দৃপ্ত, চাঁদের আলোর মতো স্নিগ্ধ। আপনি পেয়ে যাবেন সফল কর্মজীবনের চাবিকাঠি, জনচিত্ত জয় করবার জাদুকাঠি। কুসুমের মতো কোমল ও বজ্রের মতো কঠিন ব্যক্তিত্ব।

কর্মময় জীবনকে নিত্য নতুনভাবে সাজিয়ে নেয়ার সফলতা ছড়ানো আছে আপনার চারপাশে, শুধু চাই সঠিক ও নিষ্ঠ পরিশীলন। যা ডেল কার্নেগি শিখিয়েছেন, চিনিয়েছেন, আপনাকে-আমাকে-সকলকে।

আপনার কর্মজীবন সমৃদ্ধ হোক। সুখের ছোঁয়া লাগুক আপনার জীবনে এটুকুই আমার আন্তরিক কামনা। এসব বই আপনি কেন পড়বেন? এসব বই আপনাকে কীভাবে উপকার করবে? নিজেকে খুঁজুন। মনে রাখবেন, পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় আপনার কাছে আপনার নিজের সত্তা।

অনুসরণ নয়। অনুকরণ নয়। নিজেকে জানুন, সফলতার উপায় অর্জন করুন। নিজের পথে চলুন। সুন্দর, নিটোল, ছিমছাম কাজের চারটে উপায় আছে। তাহল : প্রথমত, কাজের টেবিল সবসময় পরিষ্কার রাখুন। অপ্রয়োজনীয় কাগজপত্র সরিয়ে ফেলুন। দ্বিতীয়ত, গুরুত্ব অনুযায়ী পরপর সাজিয়ে নিয়ে কাজ করুন।

তৃতীয়ত, সমস্যা যখনি আসবে তখনি তার সমাধানে সচেষ্ট হোন, তবে তড়িঘড়ি করে কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন।

চতুর্থত, ক্লান্ত বা অবসন্ন করে এমন কোনো বিশৃঙখল কাজ করবেন না। সফল ও সুন্দর কাজের জন্যে সবচেয়ে জরুরি সংগঠন, শৃঙ্খলী আর নিয়ন্ত্রণ।

ক্লান্তি, বিষণ্ণতা, হতাশা আর দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হবার সহজ কিছু পন্থা আছে, তাহল :

প্রথমত, সঠিক সঙ্গী নির্বাচন। জানেন তো, প্রিয়তমা তরুণীর সাথে দশ মাইল হেঁটে গেলেও আপনি ক্লান্ত হবেন না, কিন্তু একান্ত আপনজন হলেও বিরক্তিকর স্ত্রীর সঙ্গে দশ পা হাঁটতেও আপনার কষ্ট হবে। এর কারণ খুঁজে বের করা ও সমাধান করা।

দ্বিতীয়ত, এই আত্মবিশ্বাস সর্বদা জাগরূক রাখা যে, আপনার যা আছে তার দাম লক্ষ টাকারও বেশি।

তৃতীয়ত, সস্তা ও অকারণ সমালোচনার প্রশয় দেবেন না। কারণ তা আপনার ব্যক্তিসত্তাকে ছোট করবে। অতি প্রশংসা আপনার ব্যক্তিত্বকে খর্ব করবে। আপনি হতাশ হবেন।

চতুর্থত, কখনোই কাজে ফাঁকি দেবেন না। নিষ্ঠা ও আত্মরক্ষার ক্ষমতাই আপনাকে নিশ্চিন্ত করবে। ছদ্ম। প্রশংসায় আপ্লুত হলে, আপনি কাজ করবেন কেমন করে।

পঞ্চমত, আপনার চারপাশে ছড়িয়ে আছে অজস্র সুযোগ। তাকে হেলায় হারাবেন না। মধু আহরণে আপনি যদি ব্যর্থ হোন তার জন্যে মৌচাককে দায়ী করতে পারেন না। মধু আহরণের সহজ পন্থা কি, খুঁজে নেয়া। আশাবাদী হওয়া।

ষষ্ঠত, জনসংযোগের কয়েকটি সহজ রাস্তা ডেল কার্নেগি দেখিয়েছেন এ বইতে, যা আপনাকে প্রফুল্ল রাখবে।

সপ্তমত, কর্মই জীবন, এ কথা মনে রাখবেন। যে কর্মঠ সে বিশ্ব জয় করতে পারে। অলস কর্মহীন মানুষকে সবাই বর্জন করে। একাকী নির্জন পথে তাকে চলতে হয় বিষণ্ণ ও হতাশ হয়ে।

স্বজনশূন্য মানুষ অসহায়। জীবনে খুশি ও সহায়তায় আশ্বাস দেয় প্রিয়জন, স্বজন। সেই স্বজনের বন্ধুত্ব লাভ করার কয়েকটি সরল পথ ডেল কার্নেগি দেখিয়েছেন এই পর্যায়ে। জনচিত্ত জয় করার গুরুত্বপূর্ণ গুণটি কীভাবে আয়ত্ত করা যায় তার মূল্যবান চাবিকাঠি কেমন করে পাওয়া যাবে সে পথ দেখিয়েছেন ডেল কার্নেগি।

সংকলক

.

০১. বাড়ির কাছে আরশিনগর

দক্ষিণ ক্যারোলিনা থেকে এক মহিলা আমাকে একটি চিঠি লিখে তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের কিছু সমস্যা জানিয়েছেন। আত্মগৌরবের অভাব কীভাবে মানুষের জীবনকে ব্যথাতুর ও বিফল করে তোলে, তা দেখাবার জন্য এবং আত্মবিশ্বাসের জোর যে কত প্রয়োজন, সেই বিফল মানুষকে আবার সফলতার লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে পারে তা জানাবার জন্যে আমি এই চিঠির কিছু অংশ তুলে ধরছি :

‘ছোট থেকে আমি লাজুক ও মুখচোর। মা আমাকে সর্বদা নিজের মতো বুঝিয়েছিল যে, সুন্দর পোশাক পরে সাজসজ্জা করা ঠিক নয়। তা মানুষকে বোকা ও অহংকারী করে তোলে। আমি তাই সাজতাম না। কোনো পার্টিতেও যেতে চাইতাম না মুখচোরা স্বভাবের জন্যে। মাও আমাকে বাইরে কারো সাথে মিশতে দিতেন না। স্কুলজীবন এভাবেই কাটল। আস্তে আস্তে আমি অসামাজিক হয়ে উঠলাম। একাঁদেরে এবং হীনম্যতার জন্য নিজের মধ্যে গুটিয়ে গেলাম। কেমন যেন ম্যাড়মেড়ে–স্যাঁৎসেঁতে বিরক্তিকর হয়ে উঠল আমার অস্তিত্ব।

‘আমার বিয়ে হল। আমার স্বভাব বদলাল না। আমার ননদেরা যথেষ্ট আলোকপ্রাপ্তা, আধুনিকা। তাদের পাশে নিজেকে ভীষণ বিবর্ণ লাগতে লাগল। আমার মনে ভয় এল, এবার আমার স্বামীও আমাকে করুণা করবেন। বিরক্ত হবেন। আমি যতই তাঁদের সঙ্গে মিলেমিশে চলতে চাইলাম, ততই যেন খাপ খাওয়াতে না পেরে দূরে সরে আসতে লাগলাম। নিজের সীমিত গণ্ডিতেই আমি আবদ্ধ থাকলাম।

‘কখনো ভীষণ আবেগ আমাকে নাড়া দিত। আবার কখনো থাকতাম চুপ করে। দিনগুলো বিশ্রী নিরানন্দতায় কাটতে লাগল। নিজের অস্তিত্ব এবার আমার কাছে অর্থহীন হয়ে গেল। আমি আত্মঘাতী হবার চিন্তা করলাম।‘

কেন একটি নিরপরাধ মেয়ের জীবন এমন বিষাদে ভরে গেল জানেন? স্রেফ আত্মবিশ্বাস আর আত্মানুসন্ধানের অভাবে। কারণ মেয়েটি নিজের সত্তাকে সবচেয়ে বড় বলে তখনো বুঝতে পারে নি।

এবার আর একটি অংশ তুলে ধরছি : তিনি আরো লিখেছেন–একটি কথায় আমার জীবনের ধারা বদলে গেল। আমার শাশুড়ি মায়ের একটি কথা। তিনি বললেন–যা ঘটে গেছে তাকে নিয়ে না ভেবে যে দিনগুলো সামনে আসছে তাকেই তিনি সারাজীবন যত্নের সঙ্গে ব্যবহার করেছেন ছেলেদের মানুষ করতে গিয়ে। তিনি নিজে আত্মশক্তির মূল্য যেমন বুঝতেন তেমনি তার সন্তানদের বোঝাতেন। এভাবে তাদের চরিত্রগঠনে তিনি সাহায্য করেছিলেন। এবং সফল হয়েছিলেন। নিজের সত্তার ওপর তার সুগভীর শ্রদ্ধা তিনি বাঁচিয়ে রেখেছেন।

‘আমার শাশুড়ির ওই কথা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিল। নিজেকে নিয়ে সেই থেকে আমি ভাবতে শুরু করলাম। নিজের ব্যক্তিত্ব নিয়ে চিন্তা করলাম, শুরু হল আমার আত্মসমীক্ষা। আমি বন্ধু খুঁজতে শুরু করলাম। সামাজিক হতে চাইলাম। ছোট সংগঠনে যোগ দিলাম। ভয় কেটে গিয়ে আমার চরিত্রে ফিরে এল চমকার সাবলীলতা। ছেলেমেয়েদের মধ্যে সেই সপ্রতিভ আত্মবিশ্বাস সঞ্চারিত করলাম আমি। আত্মোপলব্ধির আলোয় বুঝলাম-যা ঘটে গেছে তার জন্যে দুঃখ না করে ভবিষ্যৎকে ভালোভাবে তৈরি করে নিতে হয়।’

দেখলেন তো-কীভাবে মেয়েটি নিজেকে খুঁজে পেলেন। আসলে গভীর আত্মবিশ্বাসই শেষপর্যন্ত মেয়েটিকে মৃত্যুর চিন্তা থেকে জীবনের আলোয় আলোকিত করল। আত্ম-অন্বেষণ পৌঁছে দিল সফলতার শীর্ষে।

এবার বলছি আমার আর একটি অভিজ্ঞতার কথা।

‘ডক্টর জিভাগো’ এবং ‘ফল হুম দি বেল টোলস’-এর সুবিখ্যাত পরিচালকেরও একটা বিশেষ সমস্যা ছিল। তিনি নিজে এই ছবির জগতে আসবার আগে ছিলেন একজন ব্যবসায়ী তখন তাঁর একমাত্র লক্ষ্য ছিল বিক্রির পরিমাণ বাড়ানো। কিন্তু বাণিজ্য আর অভিনয় শিল্প এক নয়। এখানে চটজলদি একজনকে পাখি পড়ানো যায় না। তার কিছু প্রতিভা থাকা অবশ্যই দরকার। কিন্তু বেশি তাড়াতাড়ি কাজ পাবার তাড়নায় তিনি নবাগতদের বেশি রকম উৎসাহ দিতেন। ফলে অভিনয় কিছু না জেনেও পরিচালকের উৎসাহে তারা নিজেদের দ্বিতীয় গ্রেটা গার্বো ভাবতে শুরু করে দিতেন। আর ওইসব অন্তঃসারহীন অভিনেতাদের আত্মম্ভরিতায় তিতো বিরক্ত হয়ে শেষপর্যন্ত পরিচালক বুঝতে পারলেন, মানুষকে দিয়ে

সুখীজীবন ও কাজের সন্ধানে বাঁদরের অভিনয় করানো, বা তোতাপাখির মতো বুলি শেখানো যাবে না। তিনি বুঝলেন, নিষ্ঠাহীন, প্রতিভাহীন মানুষ যা নয় তাই ভান করে। সুতরাং তাদের বাহবা না দিয়ে বিদায় দেয়াই সঠিক সিদ্ধান্ত।

দেখলেন তো আত্মসমীক্ষা, অন্বেষণ শেষপর্যন্ত বিখ্যাত পরিচালকটিকে সঠিক মানুষ চিনতে সহায়তা করল কীভাবে।

একজন বিখ্যাত চিকিৎসক এ সম্পর্কে একটি দারুণ মন্তব্য করেছেন–নিজেকে অন্বেষণ করার পদ্ধতিটি ইতিহাসের মতোই প্রাচীন আর মান জীবনের মতোই সার্বজনীন।

এবার আর একটি সমস্যার কথা শুনুন। যে ব্যক্তি নিজেকে নিঃসঙ্গ মনে করতে বাধ্য হয়, তার চেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর হয় না। এবং মনস্তাত্ত্বিক এই জটিলতার কথা অ্যানজেলো প্যাটরি প্রমুখ লেখকেরা তাঁদের বিভিন্ন রচনায় প্রকাশ করেছেন। এই বোধ মানুষকে কমজোরী করে। হতাশ, অসফল করে। এই হতাশাকেও জয় করা যায় সঠিক বন্ধুর আন্তরিক পরামর্শে। একটা ঘটনা বলি–শুনুন :

এক কন্ডাক্টরের একটি মেয়ে ছিল। পেশায় ছিল সে গায়িকা। সে দেখতে ভালো ছিল না। দাঁত উঁচু পুরু ঠোঁটের জন্যে তার মধ্যে একটা হীনমন্যতার ভাব ছিল। তাই প্রথম দিকে সে হোটেলে নাইট ক্লাবে গাইতে এসে হাত দিয়ে তাঁর উঁচু দাঁতটাকে ঢেকে রাখতে চাইত। তাঁর এই নিজের ত্রুটিকে ঢেকে রাখার প্রয়াসকে নিয়ে সবাই কিন্তু ভীষণ ঠাট্টা করত। অথচ তার গানের গলা ছিল খুব মিষ্টি। তাও সে সফল হতে পারছিল না। সকলের উপেক্ষা, তামাশায় সে নিজের বিশ্বাস, জোর সব হারিয়ে ফেলে, বড় বেশি হতাশ হয়ে পড়ছিল। কেউ তাকে ভালোবাসে না। এই হতাশ চিন্তার মধ্যে একজন ভক্তকে সে পেল, যে সহানুভূতির সঙ্গে তার ভুলটা তাকে ধরিয়ে দিল। সে তার বলল, নিজের দৈহিক ত্রুটিকে ভুলে গিয়ে তার উচিত তার প্রতিভাকে কাজে লাগানো, আত্মশক্তিকে প্রতিষ্ঠা করা। মেয়েটা এবার দাঁত-মুখ খোলা রেখে আন্তরিক নিষ্ঠায় তার সুরেলা গলায় গান গাইতে শুরু করল। কালক্রমে দর্শক সাধারণ তার অপূর্ব সুরের মায়ায় আপ্লুত হয়ে গেল। মেয়েটি জনসাধারণের মন জয় করে জনপ্রিয় গায়িকা হয়ে উঠল।

দেখা গেল মানসিক শক্তির জোর এবং বন্ধুর সস্নেহ পরামর্শে মানুষ অসাধ্য সাধন করতে পারে। কিন্তু সবসময় তার করে না বলেই সব মানুষ সফল হয় না।

প্রখ্যাত মনোবিশ্লেষক জোসেফ হেওয়ার্থ বলেছেন যে, মানুষ তার সুপ্ত মানসিক শক্তির শতকরা দশভাগ মাত্র পারে উন্মোচিত করতে। অর্থাৎ সে যা করতে পারে তার অনেকখানি করা হয়ে ওঠে না। অর্থাৎ আমরা যেন অর্ধেক মাত্র জেগে আছি। আমাদের দৈহিক ও মানসিক শক্তির সবটাই থাকে সুপ্ত। সে প্রচণ্ড শক্তিকে জাগানো যথেষ্ট কঠিন। তবুও জাগরণ দরকার।

আসুন, আমরা জেগে উঠি। এখন থেকে যেন একটুও সময় নষ্ট না হয়। মনে রাখবেন, আপনি হলেন এই পৃথিবীর এক মূল্যবান সৃষ্টি। আপনার জীবনের শুরু থেকে আজ অবধি ঠিক আপনার মতো আর কেউ কখনো আবির্ভূত হয় নি। ভবিষ্যতেও আর কেউ আসবে না। এই বোধই হবে আপনার শক্তি।

আপনার জানা দরকার অবশ্যই যে বংশানুক্রমের (genetics) আধুনিক বিজ্ঞান এই অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার করেছে যে, আপনি হলেন ৪৮টি ক্রোমোজমের সমন্বয়ে গঠিত জীবন। এর ২৪টি এসেছে আপনার বাবার কাছ থেকে আর বাকি ২৪টি এসেছে আপনার মায়ের কাছ থেকে। আপনি যা কিছু উত্তরাধিকারসূত্রে বহন করছেন তা এই ৪৮টি ক্রোমোজমের মধ্যেই নিহিত আছে। আবার এই ৪৮টি ক্রোমোজমের মধ্যে রয়েছে হাজার হাজার জিন। এই জিনের এক আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে একটি মাত্র জিন একজন মানুষের সমগ্র জীবনধারা আমূল বদলে দিতে পারে।

তাই আমরা নিশ্চয়ই বলতে পারি, আমাদের জীবন সৃষ্টি এক অত্যাশ্চর্য পদ্ধতি।

আপনার বাবা মায়ের যে মিলনের ফলে আপনার জন্ম তা কিন্তু তিন লক্ষ বিলিয়নে মাত্র একবার। এই তিন লক্ষ্য বিলিয়নে প্রত্যেকটি যাদের জন্ম হতে পারত সেই মানুষের স্বভাব হতে পারত আপনার থেকে একদম আলাদা। ভীষণ অবাক করা ব্যাপার নয় কি?

মজার কথা হচ্ছে, এটা কোনো খেয়ালী কল্পনা নয়, সম্পূর্ণ বিজ্ঞানসম্মত সিদ্ধান্ত।

নিজের ত্রুটি, অসম্পূর্ণতা, যোগ্যতা, বিশেষত্ব সম্পর্কে মানুষ যদি যথার্থ অবহিত না হয়, তাহলে তার দ্বারা কোনো কাজই সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা সম্ভব হতে পারে না। সে শুধুই অপরকে অনুকরণ করতে গিয়ে নিজের সৃষ্টিকে তালগোল পাকিয়ে নষ্ট করে ফেলে–এই কথাটা আমাকে অনেক ঠকে শিখতে হয়েছিল।

ঘটনাটা বলছি :

আমি গ্রামের ছেলে। চিন্তায়, অভ্যাসে, ব্যবহারে স্বাভাবিকভাবে রয়েছে গ্রাম্যতা। অথচ শহরে এসে আমি আমার স্বপ্ন সফল করতে চাইলাম, অর্থাৎ অভিনেতা হতে চাইলাম শহরের প্রতিষ্ঠিত নামকরা অভিনেতাদের মতো। তখন আমার মনে হত সহজে নাম কেনার উজ্জ্বলতম পথ অভিনয় জীবন। ভর্তি হলাম আমেরিকায় ইনৃস্টিটিউট অব ভিজুয়াল আর্টকে। মন দিয়ে পড়তে লাগলাম পল রজার্স, ওয়াটার হাম ডেন, গ্রেট গার্বোর মতো কিংবদন্তী নায়কদের জীবনী। প্রচণ্ড উৎসাহে ভাবতাম কেন যে হাজার হাজার মানুষ অভিনেতা হবার চেষ্টা করে না। অর্থাৎ আমার মনে হয়েছিল যে-কেউই ইচ্ছে করলে এ জগতে নাম করতে পারে।

আমি ওই সুবিখ্যাত অভিনেতাত্রয়ের শ্রেষ্ঠ গুণগুলি অনুসরণ ও অনুকরণ করার চেষ্টায় মেতে উঠলাম। জীবনের অনেকগুলো বছর আমি শুধু অন্যের অনুকরণ করে বাজে খরচ করে ফেললাম। একবারও আত্ম-অনুসন্ধান করলাম না। বুঝতে চেষ্টা করলাম না–আমার গ্রাম্য মোটা মাথায় ওইসব অনুসরণ ঢুকবে কিনা আদৌ। আমার অভিনেতা হবার সাধ অপূর্ব রয়ে গেল। আমি হতাশ হলাম।

এবার ভাবলাম লিখব। প্রথমে আমি যখন আমার নিজস্ব ভাবনায় লিখতে শুরু করলাম–সেইগুলি সমাদৃত হল। এমন সব বই লিখতে শুরু করলাম যা বিশ্বের দরবারে শ্রেষ্ঠতা পেতে পারে। কিন্তু অনুসরণ ও অনুকরণের পোকা ছিল আমার মাথায়। তাই একালের সফল লেখকদের চিন্তা-ভাবনা ধার করে লিখতে চাইলাম। ফল হল উল্টো, লেখা হয়ে গেল জগাখিচুড়ি। যা কারুর কাছে গ্রহণযোগ্য হবে বলে আমারই সন্দেহ হল।

অবশেষে সম্বিত ফিরল আমার। বুঝলাম অন্যের চিন্তাধারা আমার কলমে এসে তালগোল পাখিয়ে দুর্বোধ্য হয়ে গেছে এমনই, যা কোনো প্রকাশকই গ্রহণ করবে না।

আমি এক বছরের পণ্ডশ্রম বাজে কাগজের ঝুড়িতে নিক্ষেপ করে শুরু করলাম নতুন করে। বিবেক বলল, তুমি ডেল কার্নেগি। তোমার নিজস্ব ত্রুটি, অসম্পূর্ণতা আছে। তুমি তো অন্য কারো ভূমিকায় সফল হতে পার না।’

পাঁচমিশালি বই লেখার পরিকল্পনা ছেড়ে নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা শুরু করলাম এবং অচিরেই আমার নিজস্ব অভিজ্ঞতায় জনসংযোগের ওপর লিখে ফেললাম। আমার মনে হল, এতদিনে আমি আমার কথা

সকলকে পৌঁছে দিতে পেরেছি। এ সম্পর্কে আমার অক্সফোর্ডের অধ্যাপক স্যার ওয়াল্টার রালফের কথা। মনে পড়ছে। উনি মন্তব্য করেছিলেন, শেক্সপিয়ারের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে এমন কোনো বই তো লিখতে পারি না, তবে আমি আমার মতো বই লিখেছি।

নিজেকে খুঁজুন। মনে করুন, ইরডিন বার্লিনের সেই অমূল্য উপদেশ যা তিনি দিয়েছিলেন জজ গেরেস উইনকে। যখন বার্লিন আর গেরেস উইনের মধ্যে প্রথম দেখা হয় তখন বার্লিন ছিলেন বিখ্যাত মানুষ, আর গেরেস উইনের টিম প্যাম আলেতে সপ্তাহে পঁয়ত্রিশ ডলারের বিনিময়ে গান লেখার কঠিন সংগ্রামরত এক যুবক।

গেরেস উইনের ক্ষমতায় অভিভূত বার্লিন তাকে নিজের সংগীত বিভাগের সম্পাদক করে দেয়, মাইনে দেন প্রায় তিনগুণ। তারপর বলেন, দু’নম্বর বার্লিন হয়ো না। চেষ্টা করলে একদিন তুমি প্রথম শ্রেণীর গেরেস উইন হতে পারবে। বার্লিনের এই মন্তব্য গেরেস উইনের সুপ্ত প্রতিভাবে জাগিয়ে দিতে সমর্থ হয়েছিল। গেরেস উইন নিজের মতো করে নিজেকে পরিচালিত করে কালক্রমে হয়েছিলেন–আমেরিকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংগীত পরিচালক, সংগীতকার। অর্থাৎ গেরেস উইন নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলেন।

এবার আমি সমস্যা থেকে কীভাবে মানসিক ক্ষমতা, মুক্তি দিতে পারে, কোন্ সে শক্তি যা শান্তি দিতে মানুষকে, তা পৃথিবীর সফল বিখ্যাত মানুষদের উপলব্ধি সত্য বোধ থেকে বিবৃত করছি এই অধ্যায়ে।

চার্লি চ্যাপলিন, উইল রজার্স, মেরি মার্গারেট ম্যাকব্রাইড, জিনে আউট্রি প্রমুখ বহু মানুষের অভিজ্ঞতা এই কথাই প্রমাণ করেছে যে, আত্মানুসন্ধানই সবচেয়ে বড় উপায় জীবনে সফল হতে গেছে।

চার্লি চ্যাপলিন, যিনি তাঁর অভিনয় ও পরিচালনায় সিনেমাজগতে আলোড়ন তুলেছিলেন। জয় করেছিলেন পৃথিবীর লক্ষ-কোটি মানুষের মন, তিনি যখন রুপালি পর্দায় প্রথম পায়ে ছাপ রাখেন তখন পরিচালক তাঁকে সেকালের এক বিখ্যাত জার্মান কৌতুক শিল্পীকে অনুকরণ করবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কিন্তু চার্লি অনুকরণে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাঁর আত্মশক্তি ছিল প্রখর। তাই তিনি তাঁর নিজের মতো করেই চলতে থাকেন, এবং পরিণত হন আজকের চার্লিতে।

বব হোপরোর অভিজ্ঞতাও এমনই। বহু বছর অন্যের অনুকরণ করে। তিনি হঠাৎ উপলব্ধি করেন, নিজের মতো করে চলাটাই সফলতার পথ।

মেরি মার্গারেট নিউইয়র্কের সবচেয়ে বড় বেতার শিল্পী হবার আগে বহু বছর এক আইরিশ অভিনেত্রীকে অনুকরণ করে বিফল হন।

জিনে আউট্রি তাঁর টেক্সাস ভাষা ত্যাগ করে শহুরে পোশাক পরে নিজেকে নিউইয়র্কবাসী বলে জাহির করতে গিয়ে সকলের কাছে হাস্যাস্পদ হয়েছিলেন। শেষে আত্মোপলব্ধি তাকে সঠিক পথ দেখায়। তিনি নিজে যেমন, তেমনি পোশাক অর্থাৎ গ্রাম্য কাউবয়দের পোশাকে সহজ মেঠো গান গেয়ে পৃথিবীতে জনপ্রিয় হয়েছিলেন।

ওপরে আলোচিত সমস্ত বিখ্যাত মানুষই কিন্তু বুঝেছিলেন যার যার নিজের নিজের ক্ষেত্রে তারা সকলেই এক এবং সম্পূর্ণ একক এক সঙ্ঘ।

আপনাকে মনে রাখতে হবে যে, আপনি এই পৃথিবীতে এক এবং একাই একটি সম্পূর্ণ সঙ্, আপনার স্ব-কর্মক্ষেত্রে, জীবনপথে। প্রকৃতি আপনাকে যে শক্তি দান করেছে, তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করুন, নিজের ক্ষমতার বাইরে কখনো পা রাখবেন না। আপনাকে আপনার পরিবেশ, আপনার বংশ পরিচয় যা দিয়েছে তাই নিয়ে তৃপ্ত হোন, অন্যের অন্ধ অনুকরণ করে নিজের সত্তাকে ছোট্ট করবেন না।

কবি ডগলাসের একটা চমৎকার কবিতা শুনুন, কত সহজসরল ভাষায় কী গভীর উপলব্ধির প্রকাশ এ কবিতায় রয়েছে :

যদি হতে না-ই পারো বড় পাইন,
উপত্যকায় হও ছোট গাছ।
তা-ও যদি না পারো তো হয়ে যাও
সবুজ নরম এক ঝোঁপঝাড়।
মন্দ কি যদি হও দূর্বা
বৃক্ষের থেকে কত দূর বা।
তুমি তো তুমিই আছ তোমাতেই
লজ্জা কি, সাহস তো দূর্বার।
নাইবা ফুটলে হয়ে পদ্ম
না-হয় ফুটলে বনফুলটি।
কি লাভ সজ্জা ধরে ছদ্ম
প্রকৃতির কানে দোলো দুলটি।
সবাই গায়ক যদি হতে চাও
নীরব শ্রোতাটি হবে কে তবে
সেই ভালো, যার যার তার মতো হয়ে যাও
সেই হওয়াতে ব্যথা নেই জানবে।
বড় বেশি বড়ো হতে যদি লাজ
হয়ে যেয়ো ছোট এক সলতে
সূর্যের খরতাপ নাই হও
তারার মতন শিখো জ্বলতে।‘

আবার বলছি–অনুকরণ নয়, অনুসরণ নয়, নিজের পথে চলুন, নিজেকে জানুন, নিজেকে খুঁজুন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *