০১. বাঙ্গালমুলুক থেকে কাঁচা আম এসেছে

উৎসর্গ

নিনিত হুমায়ূন

আমার কেবলই মনে হচ্ছে পুত্র নিনিত পিতার কোনো স্মৃতি না নিয়েই বড় হবে। সে যেন আমাকে মনে রাখে এইজন্যে নানান কর্মকাণ্ড করছি। আমি ছবি তুলতে পছন্দ করি না। এখন সুযোগ পেলেই নিনিতকে কোলে নিয়ে ছবি তুলি।

এই বইয়ের উৎসর্গপত্রও স্মৃতি মনে রাখা প্রকল্পের অংশ।

 

রাজ্য হলো এমন এক রূপবতী তরুণী
যার ঠোঁটে চুমু খেতে হলে সুতীক্ষ্ণ
তরবারির প্রয়োজন হয়।

(হুমায়ূনের বিদ্রোহী ভ্রাতা মির্জা কামরানের লেখা কবিতা)

 

ভূমিকা

কেউ যদি জানতে চান টবাদশাহ নামদার’ লেখার ইচ্ছা কেন হলো, আমি তার সরাসরি জবাব দিতে পারব না। কারণ সরাসরি জবাব আমার কাছে নেই।

শৈশবে আমাদের পাঠ্যতালিকায় চিতোর রানীর দিল্লীর সম্রাট হুমায়ূনকে রাখি পাঠানো-বিষয়ক একটা কবিতা ছিল। একটা লাইন এরকম: বাহাদুর শাহ্ আসছে ধেয়ে করতে চিতোর জয়। এই কবিতা শিশুমনে প্রবল ছাপ ফেলে বলেই শেষ বয়সে সম্রাট হুমায়ূনকে নিয়ে উপন্যাস লিখতে বসব এরকম মনে করার কোনো কারণ নেই।

সব ঔপন্যাসিকই বিচিত্র চরিত্র নিয়ে কাজ করতে ভালোবাসেন। এই অর্থে হুমায়ূন অতি বিচিত্র এক চরিত্র। যেখানে তিনি সাতারই জানেন না সেখানে সারা জীবন তাকে সাতরাতে হয়েছে স্রোতের বিপরীতে। তার সময়টাও ছিল অদ্ভুত। বিচিত্র চরিত্র এবং বিচিত্র সময় ধরার লোভ থেকেও বাদশাহ নামদার লেখা হতে পারে। আমি নিশ্চিত না।

আমার নিজের নাম হুমায়ূন হওয়ায় ক্লাস সিক্স-সেভেনে আমার মধ্যে শুধুমাত্র নামের কারণে এক ধরনের হীনমন্যতা তৈরি হয়। সেই সময়ের পাঠ্যতালিকায় মোঘল ইতিহাস খানিকটা ছিল, তাতে শের শাহ’র হাতে হুমায়ূনের একের পর এক পরাজয়ের কাহিনী। হুমায়ূনের পরাজয়ের দায়ভার খানিকটা আমাকে নিতে হয়েছিল। ক্লাসে আমাকে ডাকা হতো ‘হারু হুমায়ূন’। কারণ আমি শুধু হারি। আমি কার কাছে হারি? মহান সম্রাট শের শাহ’র হাতে—যিনি ঘোড়ার ডাকের প্রচলন করেন, গ্রান্ডট্রাংক রোড বানান। আমি শুধু পালিয়ে বেড়াই। হায়রে শৈশব!

এমন হওয়া অসম্ভব না যে শৈশবের নাম নিয়ে হীনমন্যতাও বাদশাহ নামদার লিখতে খানিকটা ভূমিকা রেখেছে।

আচ্ছা ঠিক আছে বাদশাহ নামদার লেখার কারণ জানা গেল না, তাতে জগতের কোনো ক্ষতি হবে না। আমি লিখে প্ৰবল আনন্দ পেয়েছি—এটাই প্রথম কথা এবং শেষ কথা।

সম্রাট হুমায়ূন বহু বর্ণের মানুষ। তাঁর চরিত্র ফুটিয়ে তুলতে আলাদা রঙ ব্যবহার করতে হয় নি। আলাদা গল্পও তৈরি করতে হয় নি। নাটকীয় সব ঘটনায় তাঁর জীবন পূর্ণ।

উপন্যাসটি লেখার সময় প্রচুর বইপত্র বাধ্য হয়ে পড়তে হয়েছে। একটি নির্ঘণ্ট দিয়ে নিজেকে গবেষক-লেখক প্রমাণ করার কারণ দেখছি না বলেই নির্ঘণ্ট যুক্ত হলো না।

বাদশাহ নামদারের বিচিত্র ভুবনে সবাইকে স্বাগতম।

হুমায়ূন আহমেদ
দখিন হাওয়া
ধানমণ্ডি

 

০১.

বাঙ্গালমুলুক থেকে কাঁচা আম এসেছে। কয়লার আগুনে আম পোড়ানো হচ্ছে। শরবত বানানো হবে। সৈন্ধব লবণ, আখের গুড়, আদার রস, কাচা মরিচের রস আলাদা আলাদা পাত্রে রাখা। আমের শরবতে এইসব লাগবে। দু’জন খাদ্যপরীক্ষক প্রতিটি উপাদান চেখে দেখেছেন। তাদের শরীর ঠিক আছে। মুখে কষা ভাব হচ্ছে না, পানির তৃষ্ণাবােধও নেই। এর অর্থ উপাদানে বিষ অনুপস্থিত। সম্রাট বাবর নিশ্চিন্ত মনে খেতে পারবেন। গত বছর শীতের শুরুতে সম্রাট বাবরকে বিষ খাইয়ে মারার চেষ্টা করা হয়েছিল। এরপর থেকেই বাড়তি সতর্কতা।

সম্রাট তখন্তু রওয়ানে (চলমান সিংহাসন) আধশোয়া হয়ে আছেন। তাঁর মাথায় রাজস্থানী বহুবর্ণ ছাতি। তাঁর দু’দিকে দু’জন বড় পাখায় হাওয়া দিচ্ছে। প্রধান উদ্দেশ্য মাছি তাড়ানো। এই অঞ্চলে মাছির বড়ই উৎপাত।

রুপার পাত্রে আমের শরবত নিয়ে খিদমতগার সম্রাটের সামনে নতজানু হয়ে আছে। সম্রাট পাত্ৰ হাতে না নেওয়া পর্যন্ত খিদমতগার মাথা উচু করবে না। সম্রাট পাত্ৰ হাতে নিচ্ছেন না। তাকে চিন্তিত মনে হচ্ছে। যদিও চিন্তিত হওয়ার মতো কারণ ঘটে নি। পানিপথের যুদ্ধে তাঁর প্রধান শত্রু ইব্রাহিম লোদী পরাজিত এবং নিহত হয়েছেন। ইব্রাহিম লোদীর মৃতদেহ তাঁকে দেখানো হয়েছে। তবে বিরক্ত হওয়ার মতো কারণ ঘটেছে। তিনি তাঁর প্রথম পুত্ৰ নাসিরুদ্দিন মুহম্মদ হুমায়ূন মীর্জার উপর বিরক্ত। এই ছেলে অলস এবং আরামপ্রিয়। সে ঘর-দরজা বন্ধ করে একা থাকতে পছন্দ করে। পিতাকে লেখা এক পত্রে সে লিখেছে— আমার মানুষের সঙ্গ ভালো লাগে না। আমি একা থাকতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। একাকিতু রাজপুরুষদের মানায় না। হুমায়ূনকে পাঠানো হয়েছে ইব্রাহিম লোদীর রাজধানী এবং কোষাগার দখল করতে। ইব্রাহিম লোদীর কোষাগার আগ্রা দুর্গে। এই কাজ শেষ করতে এত সময় লাগার কথা না। সে নিশ্চয়ই কোনো ভজঘট করে ফেলেছে। দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকার মতো দায়িত্ববান হুমায়ূন মীর্জা না। সম্রাট নিজেই আগ্রার দিকে রওনা হয়েছেন। কাচা আমের শরবত খাওয়ার জন্যে যাত্রাবিরতি।

সম্রাটের সেনাপতির একজন ফিরোজ সারাঙ্গখানি বললেন, বাদশাহ কি কোনো কারণে অস্থির?

বাবর বললেন, আমি অস্থির, তবে অস্থিরতার কারণ জানি না। গতরাতে দুঃস্বপ্ন দেখেছি। দুঃস্বপ্ন অস্থিরতার কারণ হতে পারে।

ফিরোজ সারাঙ্গখানি দুঃস্বপ্ন কী জানতে চাচ্ছেন। কিন্তু সম্রাটের দুঃস্বপ্ন জানতে চাওয়া যায় না। বড় ধরনের বেয়াদবি।

সম্রাট বললেন, দুঃস্বপ্ন কী জানতে চাও? শোনো। আমি দেখলাম আমার তাঁবুতে একটা ভেড়া ঢুকে পড়েছে। ভেড়াটার একটা পা নেই, সে লাফিয়ে লাফিয়ে চলে। ভেড়াটা লাফ দিয়ে আমার কোলে এসে পড়ল এবং আমার পায়ে মুখ ঘষতে লাগল। তখনই ঘুম ভাঙল।

স্বপ্নের ফলাফল অবশ্যই শুভ।

একটা পঙ্গু ভেড়া লাফ দিয়ে আমার কোলে এসে উঠল। এর ফলাফল শুভ কীভাবে হয়? হুজুর মীর আবুবকার-এর কাছ থেকে স্বপ্নের তফসির জানতে হবে।

কথা বলতে বলতেই বাবর তীক্ষ্ণ চোখে তাকালেন। অনেক দূরে ধুলার ঝড়ের মতো উঠেছে। অশ্বারোহীর দল কি ছুটে আসছে? কোনো বিদ্রোহী বাহিনী? হওয়ার তো কথা না। অশ্বারোহীর দল আগ্রার দিক থেকেই আসছে। এমন কি হতে পারে আগ্রার দুর্গে বন্দি গোয়ালিয়রের রাজা বিক্রমাদিত্যের পরিবারকে উদ্ধার করতে সাহায্যকারী কেউ এসেছে?

বাবর ইশারা করলেন। মুহুর্তের মধ্যে যুদ্ধাবস্থার পরিস্থিতি তৈরি হলো। সিঙ্গা বাজানো হলো। বাদশাহের প্রিয় পিতজুচাক ঘোড়া নিয়ে একজন ছুটে এল। বাদশাহ তখন্তু রওয়ান ছেড়ে ঘোড়ায় উঠলেন। দূরে ধুলার ঝড় ঘন হচ্ছে। সৈন্যসংখ্যা আন্দাজ করা যাচ্ছে নাৰী মাঝে মাঝে রোদে ঘোড়ার আরোহীদের শিরস্ত্ৰাণ ঝলসে ঝলসে উঠছে।

বাবরের সংবাদ সরবরাহ দলের চারজন ঘোড়সওয়ার ছুটে যাচ্ছে। তাদের হাতে আয়না, তারা আয়নার আলো ফেলে বোঝার চেষ্টা করবে কারা এসেছে।

সম্রাট বাবরের চোখমুখ শুক্ত-দৃষ্টি তীক্ষ। হঠাৎ তাঁর দৃষ্টি সহজ হলো। তিনি শরবতের গ্রাসের দিকে হাত বাড়ালেন। সৈন্যবাহিনী নিয়ে কে আসছেন তিনি জানেন আসছে পুত্র হুমায়ূন মীর্জা।

যুদ্ধাবস্থার তাতে পরিবর্তন হলো না। সম্রাটদের পুত্র থাকে না, ভাই থাকে না। তাঁরা সবসময়ই একা। হুমায়ূন যে সসৈন্যে তাকে আক্রমণ করতে আসছে না এর নিশ্চয়তা কোথায়? হুমায়ূন মীর্জার অধীনে বিশাল সৈন্যবাহিনী আছে। আগ্রা দুর্গ দখল করার জন্যে পাঁচশ (অশ্বারোহীর একটি বিশেষ দল সম্প্রতি দেওয়া হয়েছে। বাবর বিড়বিড় করে নিজের রচনা চারপদী কবিতা আবৃত্তি করলেন—

সম্রাটের বন্ধু তার সুতীক্ষ্ণ তরবারি
এবং তার ছুটন্ত ঘোড়া আর তার বলিষ্ঠ দুই বাহু
তার বন্ধু নিজের বিচার
এবং পঞ্জরের অস্থির নিচের কম্পবান হৃদয়

হুমায়ূন মীর্জা ঘোড়া থেকে নেমে এগিয়ে আসছেন। তিনি বাবার সামনে এসে নতজানু হয়ে দাঁড়ালেন। তার হাতে নীল রেশমি রুমালে কী যেন লুকানো। বাঁ হাতে রুমাল রেখে ডান হাতে তিনি নিজের কপাল স্পর্শ করে সেই হাতে ভূমি স্পর্শ করলেন। তিনবার এই কাজটি করে কুর্নিশ পর্ব শেষ করা হলো।

বাবর বললেন, পুত্ৰ, তোমার হাতে কী?

হুমায়ূন বললেন, সামান্য উপহার।

পিতার প্রতি পুত্রের উপহার কখনোই সামান্য না।

হুমায়ূন বললেন, অতি মহাৰ্য উপহারও মহাপুরুষের কাছে সামান্য।

বাবর প্রীত হলেন। কবিতার এই চরণটি তাঁর লেখা। পুত্ৰ মনে করে রেখেছে এবং সময়মতো বলতে পেরেছে। বাবর বললেন, উপহার দেখাও।

হুমায়ূন মীর্জা রেশমি রুমাল খুললেন। তাতে হাতে পায়রার ডিমের চেয়েও বড় একটা হীরা। সূর্যের আলো হীরাতে পড়েছে। মনে হচ্ছে হাতে আগুন লেগে গেছে। বাবর মুগ্ধ গলায় বললেন, বাহ্‌!

হুমায়ূন মীর্জা বললেন, এই হীরার নাম কোহিনূর। এর ওজন আট মিস্‌কাল্‌। বলা হয়ে থাকে এই কোহিনূরের মূল্যে সারা পৃথিবীর সকল মানুষ দু’দিন পানাহার করতে পারবে।

এটা কি সেই কোহিনূর যা সম্রাট আলাউদ্দিন খিলজি ভারতে এনেছিলেন?

এটি সেই কোহিনূর। আপনি হাতে নিলে আমি খুশি হব।

সম্রাট বাবর হীরকখণ্ড হাতে নিলেন। মুগ্ধ চোখে কিছুক্ষণ দেখলেন। তারপর বললেন, পুত্র তোমার উপহার পেয়ে আমি খুশি হয়েছি। এতই খুশি হয়েছি যে এই কোহিনূর তোমাকেই আমি উপহার হিসেবে দিচ্ছি। পিতার উপহার গ্রহণ করো।

বাবর লক্ষ করলেন হুমায়ূনের চোখ ছলছল করছে। এ-কী! এত অল্পতে তার ছেলের চোখে পানি আসছে কেন? একদিন সে সমস্ত ভারতবর্ষ শাসন করবে। পৃথিবীর নানান প্রান্ত থেকে রাজদূতরা এসে তাকে কুর্নিশ করে বলবে, বাদশাহ নামদার। তাকে হতে হবে ইস্পাতের মতো কঠিন।

সম্রাট বাবরের দ্রু কুঞ্চিত হলো। তিনি উচু গলায় বললেন, পুত্র শোনো। শুধু এই হীরক খণ্ড না, ইব্রাহিম লোদীর রাজকোষের সম্পূর্ণ অর্থ আমি তোমাকে উপহার দিলাম। বলো, মারহাবা।

মারহাবা।

হুমায়ূন মীর্জা এর চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে অদ্ভুত এক কাণ্ড করলেন। সেনাবাহিনী নিয়ে তাঁর পিতার দিল্লীর কোষাগার দখন করে রাজকোষের সব অর্থ নিয়ে পালিয়ে গেলেন বাদাখশানের দিকে। আগস্ট মাস, ১৫২৭ খ্রিষ্টাব্দ। এই কাজ তিনি কেন করলেন তা এখন পর্যন্ত ঐতিহাসিকদের কাছে রহস্যাবৃত।

সম্রাট বাবর তার স্ত্রী মাহিম বেগমের সঙ্গে খেতে বসেছেন। সম্রাট খাচ্ছেন, মাহিম বেগম একটির পর একটি বাটি এগিয়ে দিচ্ছেন। সব খাবারই পরীক্ষা করা, তারপরেও স্বামীর পাত্রে খাবার দেওয়ার আগে নিজে চোখে দিচ্ছেন। বাবর বললেন, তোমার পুত্র যে আমার রাজকোষ লুট করে পালিয়ে গেছে এটা জানো?

জানি।

কাজটা সে কেন করেছে জানো?

জানি না।

তার কি শান্তি হওয়া উচিত?

উচিত। তবে আপনি দয়ালু পিতা। হুমায়ূন মীর্জা আপনার অতি আদরের প্রথম সন্তান।

বাবর বললেন, সম্রাটের কোনো পুত্র থাকে না। স্ত্রী থাকে না। আত্মীয়-পরিজন থাকে না। সম্রাটের থাকে তরবারি।

আপনার থাকে। কারণ আপনি অন্য সম্রাটদের মতো না। আপনি আলাদা।

আমি প্রধান উজির মীর খলিফার সঙ্গে পরামর্শ করেছি। প্রধান উজির হুমায়ূন মীর্জাকে কঠিন শাস্তি দেওয়ার পক্ষে। কঠিন শাস্তি দেওয়া হলে তার ভাইরা সাবধান হবে। অন্য রাজপুরুষরাও সাবধান হবে।

মাহিম বেগম চুপ করে রইলেন। বাবর বললেন, প্রধান উজির হুমায়ূন মীর্জার মৃত্যুদণ্ড শাস্তির পক্ষে। হাতির পায়ের নিচে পিষ্ট করে মৃত্যু।

মাহিম বেগম বললেন, প্রধান উজির কী বলছেন তা আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ না। আপনি কী ভাবছেন তা গুরুত্বপূর্ণ।

বাবর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে হাসলেন। অদ্ভুত এই হাসি দেখে হঠাৎ মাহিম বেগমের গায়ে কাটা দিয়ে উঠল।

হুমায়ূন মীর্জা বাদাখশানের পথে। এখন যাত্রাবিরতি। রাজকীয় তাঁবু ফেলা হয়েছে। তিনি গরমে অতিষ্ঠ। স্নানের বাসনা প্রকাশ করেছেন। স্নানপাত্রে পানি ঢালা হচ্ছে। গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো হচ্ছে। আট ভাগ পানির সঙ্গে এক ভাগ গোলাপের পাপড়ি মেশানো হবে। পানিতে সামান্য কপূরও দেওয়া হবে। কপূর মেশানো পানিতে দৈত্যাকৃতি পাখা দিয়ে হাওয়া দেওয়া হবে। এই হাওয়ায় কপূর উড়ে গিয়ে পানি দ্রুত শীতল হবে।

 

হুমায়ূন মীর্জার হাতে রঙতুলি এবং চীন দেশ থেকে আনা শক্ত তুলট কাগজ। তিনি আগ্রহ নিয়ে একটা পাখির ছবি আঁকছেন। পাখির পালক ঘন নীল। ঠোঁট এবং পা লাল। পাখিটা মনের আনন্দে তার তাবুর পাশেই ঘুরছে। জনসমাগম দেখে ভয় পাচ্ছে না। কেউ এর নাম-পরিচয় বলতে পারছে না। হুমায়ূন মীর্জার সার্বক্ষণিক সঙ্গী দু’জন চিত্রকর এবং একজন হরবোলা পাখির পরিচয় বের করার চেষ্টায় আছে। চিত্রকরদের একজন হুমায়ূন মীর্জার ভ্ৰাম্যমাণ লাইব্রেরি থেকে পাখি-বিষয়ক বই নিয়ে এসে পাতা ওল্টাচ্ছেন। অন্যজন হুমায়ূন মীর্জার মতোই পাখির ছবি আঁকছেন। যেন পরে ছবি দেখে পাখির পরিচয় পাওয়া যায়। হরবোলা অপেক্ষা করছে। কখন পাখি ডেকে ওঠে। একবার ডাকলেই হরবোলা বাকি জীবন এই ডাক মনে করে রাখবে। পাখি এখনো ডাকছে না।

 

রাত অনেক হয়েছে।

সম্রাট বাবর ঘুমাবার প্রস্তুতি নিয়ে শোবার ঘরে ঢুকেছেন। ইয়েমেন থেকে আনা হালকা সৌরভের আগরবাতি জ্বলছে। হাবশি খোজারা টানাপাখা টানছে। বড় বড় মাটির পাত্রে পানি রাখা আছে। তাদের গায়ে বাতাস পড়ায় ঘর শীতল। হিন্দুস্থানের অতি গরম আবহাওয়া বাবর এখনো সহ্য করে উঠতে পারেন নি। গরমের রাতগুলিতে প্রায়ই তাকে অয়ুম কাটাতে হয়।

মাহিম বেগম ঘরে ঢুকে সম্রাটকে কুর্নিশ করলেন। সম্রাট স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছুই ঘটে না। আল্লাহর ইচ্ছায় আমি তোমাকে একটা সুসংবাদ দিচ্ছি। রাজকোষ লুণ্ঠনের অপরাধে তােমার পুত্রের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলাম। তাকে ধরে আনার জন্যে আমার বিশাল সেনাবাহিনী আগামীকাল প্রত্যুষে যাত্রা করার কথা। কিছুক্ষণ আগে আমি তোমার পুত্রকে ক্ষমা করেছি।

মাহিম বেগম কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, সম্রাট যদি অনুমতি দেন। তাহলে আমি সম্রাটের পায়ে চুম্বন করতে আগ্রহী।

অনুমতি দিলাম।

মাহিম বেগম সম্রাটের পায়ে মুখ ঘষতে লাগলেন। সম্রাট সামান্য চমকালেন। এই দৃশ্যের সঙ্গে কি তাঁর দুঃস্বপ্নের কোনো মিল আছে? স্বপ্নে একটা পঙ্গু ভেড়া এই ভঙ্গিতেই তার পায়ে মুখ ঘষছিল। মাহিম বেগম তার অতি আদরের স্ত্রী। হুমায়ূন মীর্জার মাতা।

মাহিম বেগম বললেন, কাবুলের দুর্গে হুমায়ূন মীর্জার জন্ম হয়। তাকে দেখতে এসে আপনি খুশি হয়ে আমাকে এক শ’ আশরাফি উপহার দেন। তখন আমি আপনাকে কী বলেছিলাম। আপনার কি মনে আছে?

সম্রাট ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, মনে আছে। তুমি বলেছিলে স্বর্ণমুদ্রার আমার প্রয়োজন নাই। আপনি শুধু পুত্রের গায়ে হাত রেখে বলবেন, আপনি তার উপর কখনো রুষ্ট হবেন না। শোনো মাহিম বেগম, আমি সেই প্রতিজ্ঞা কিন্তু করি নাই। যাই হোক অনেকক্ষণ পায়ে মাথা রেখেছ। এখন মাথা তোল।

মাহিম বেগম বললেন, আপনার কিছু বিষয় আমি বুঝি না। আপনার পরম শত্রু ইব্রাহিম লোদী পানিপথের যুদ্ধে পরাজিত এবং নিহত। এই ইব্রাহিম লোদীর মা’কে আপনি রাজ-অন্তঃপুরে স্থান দিয়েছেন। কারণ জানতে পারি?

পার। এই মহিলা কোনো অপরাধ করেন নি। নিহত পুত্রের চেহারা দেখে শোকে অধীর হয়েছেন। আমি তার প্রতি দয়া করব না!

আপনি অবশ্যই করবেন। আপনাকে এই নিয়ে প্রশ্ন করাই আমার অন্যায় হয়েছে।

(ইব্রাহিম লোদীর মা প্রথম সুযোগেই বাবরকে বিষ খাইয়ে মারার চেষ্টা করেন। তাঁর এই অপরাধও ক্ষমা করা হয়।)

 

৪র্থ জিল্‌কদ্‌ ৯১৩ হিজরির (ইংরেজি ৬ মার্চ, ১৫০৮ খ্রিষ্টাব্দ) মঙ্গলবার রাতে নাসিরুদ্দিন মুহম্মদ হুমায়ূন মীর্জা জন্মগ্রহণ করেন। তিনি পিতার দিক থেকে তৈমুরের পঞ্চম অধস্তন এবং মায়ের দিক থেকে চেঙ্গিস খানের পঞ্চদশ পুরুষ।

নাসিরুদ্দিন মোহাম্মদ হুমায়ূন মীর্জা নামের আবজাদ (আরবি অক্ষর থেকে নামের সংখ্যা মান বের করা। অনেকটা নিউমারোলজির মতো।)

আমি বাদশাহ নামদার গ্রন্থে ৯১৩ আবজাদ সংখ্যায় সম্রাট হুমায়ূনের বিচিত্ৰ কাহিনী বর্ণনা করব। এই কাহিনীতে ঔপন্যাসিকের রঙ চড়ানোর কিছু নেই। সম্রাট হুমায়ূন অতি বিচিত্র মানুষ। ভাগ্য বিচিত্র মানুষ নিয়ে খেলতে পছন্দ করে। ভাগ্য তাকে নিয়ে অদ্ভুত সব খেলা খেলেছে।

আসুন আমরা বাদশাহ নামদারের জগতে ঢুকে যাই। মোঘল কায়দায় কুর্নিশ করে ঢুকতে হবে কিন্তু।

নকিব বাদশাহর নাম ঘোষণা করছে—

আল সুলতান আল আজম ওয়াল খাকাল আল মুকাররাম, জামিই সুলতানাত-ই-হাকিকি ওয়া মাজাজি, সৈয়দ আল সালাতিন, আবুল মোজাফফর নাসির উদ্দিন মোহাম্মদ হুমায়ূন পাদশাহ, গাজি জিলুল্লাহ।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *