০১. বাংলায় মুসলিম অধিকারের প্রতিষ্ঠা

প্রথম পরিচ্ছেদ – বাংলায় মুসলিম অধিকারের প্রতিষ্ঠা

ইখতিয়ারুদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজী

১১৯২ খ্রিষ্টাব্দে তরাওরীর দ্বিতীয় যুদ্ধে বিজয়ী হইয়া মুহম্মদ ঘোরী সর্বপ্রথম ভারতে মুসলিম রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁহার মাত্র কয়েক বৎসর পরে তুর্কির অধিবাসী অসমসাহসী ভাগ্যান্বেষী ইখতিয়ারুদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজী অতর্কিতভাবে পূর্ব ভারতে অভিযান চালাইয়া প্রথমে দক্ষিণ বিহার এবং পরে পশ্চিম ও উত্তর বঙ্গের অনেকাংশ জয় করিয়া এই অঞ্চলে প্রথম মুসলিম অধিকার স্থাপন করিলেন। বখতিয়ার প্রথমে “নোদীয়হ” অর্থাৎ নদীয়া (নবদ্বীপ) এবং পরে “লখনৌতি” অর্থাৎ লক্ষ্মণাবতী বা গৌড় জয় করেন। মীনহাজ-ই-সিরাজের ‘তবকাৎ-ই-নাসিরী’ গ্রন্থে বখতিয়ারের নবদ্বীপ জয়ের বিস্তৃত বিবরণ লিপিবদ্ধ আছে। বর্তমান গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে ঐ বিবরণের সংক্ষিপ্তসার দেওয়া হইয়াছে এবং তাঁহার যাথার্থ্য সম্বন্ধে আলোচনা করা হইয়াছে।

বখতিয়ারের নবদ্বীপ বিজয় তথা বাংলাদেশে প্রথম মুসলিম অধিকার প্রতিষ্ঠা কোন্ বৎসরে হইয়াছিল, সে সম্বন্ধে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। মীনহাজ-ই সিরাজ লিখিয়াছেন যে বিহার দুর্গ অর্থাৎ ওদন্তপুরী বিহার ধ্বংস করার অব্যবহিত পরে বখতিয়ার বদায়ুনে গিয়া কুলুদ্দীন আইবকের সহিত সাক্ষাৎ করেন এবং তাঁহাকে নানা উপঢৌকন দিয়া প্রতিদানে তাঁহার নিকট হইতে খিলাৎ লাভ করেন; কুলুদ্দীনের কাছ হইতে ফিরিয়া বখতিয়ার আবার বিহার অভিমুখে অভিযান করেন এবং ইহার পরের বৎসর তিনি “নোদীয়” আক্রমণ করিয়া জয় করেন। কুলুদ্দীনের সভাসদ হাসান নিজামীর ‘তাজ-উল-মাসির’ গ্রন্থ হইতে জানা যায় যে ১২০৩ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে কুস্তুদ্দীন কালিঞ্জর দুর্গ জয় করেন, এবং কালিঞ্জর হইতে তিনি সরাসরি বায়ুনে চলিয়া আসেন; তাঁহার বদায়ুনে আগমনের পরেই “ইখতিয়ারুদ্দীন মুহম্মদ বখতিয়ার উদ-বিহার (অর্থাৎ ওদন্তপুরী বিহার) হইতে তাঁহার কাছে আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং তাঁহাকে কুড়িটি হাতি, নানারকমের রত্ন ও বহু অর্থ উপঢৌকনস্বরূপ দিলেন। সুতরাং বখতিয়ার ১২০৩ খ্রীষ্টাব্দের পরের বৎসর অর্থাৎ ১২০৪ খ্রীষ্টাব্দে নবদ্বীপ জয় করিয়াছিলেন এইরূপ ধারণা করাই সংগত।

“নোদীয়হ” জয়ের পরে, মীনহাজ-ই-সিরাজের মতে, “নোদীয়হ্‌” ও “লখনৌতি” জয়ের পরে বখতিয়ার লখনৌতিতে রাজধানী স্থাপন করিয়াছিলেন। কিন্তু বখতিয়ারের জীবদ্দশায় এবং তাঁহার মৃত্যুর প্রায় কুড়ি বৎসর পর পর্যন্ত বর্তমান দিনাজপুর জেলার অন্তর্গত দেবকোট (আধুনিক নাম গঙ্গারামপুর) বাংলার মুসলিম শক্তির প্রধান কর্মকেন্দ্র ছিল।

নদীয়া ও লখনৌতি জয়ের পরে বখতিয়ার একটি রাজ্যের কার্যত স্বাধীন অধীশ্বর হইলেন। কিন্তু মনে রাখিতে হইবে যে বখতিয়ার বাংলা দেশের অধিকাংশই জয় করিতে পারেন নাই। তাঁহার নদীয়া ও লক্ষণাবতী বিজয়ের পরেও পূর্ববঙ্গে লক্ষণসেনের অধিকার অক্ষুণ্ণ ছিল, লক্ষণসেন যে ১২০৬ খ্রীষ্টাব্দেও জীবিত ও সিংহাসনে অধিষ্ঠিত ছিলেন, তাঁহার প্রমাণ আছে। লক্ষণসেনের মৃত্যুর পরে তাঁহার বংশধররা এবং দেব বংশের রাজারা পূর্ববঙ্গ শাসন করিয়াছিলেন। ১২৬০ খ্রীষ্টাব্দে মীনহাজ-ই-সিরাজ তাঁহার ‘তবকাৎ-ই-নাসিরী’ গ্রন্থ সম্পূর্ণ করেন। তিনি লিখিয়াছেন যে তখনও পর্যন্ত লক্ষণসেনের বংশধররা পূর্ববঙ্গে রাজত্ব করিতেছিলেন। ১২৮৯ খ্রীষ্টাব্দেও মধুসেন নামে একজন রাজার রাজত্ব করার প্রমাণ পাওয়া যায়। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষ দশকের আগে মুসলমানরা পূর্ববঙ্গের কোন অঞ্চল জয় করিতে পারেন নাই। দক্ষিণবঙ্গের কোন অঞ্চলও মুসলমানদের দ্বারা ত্রয়োদশ শতাব্দীতে বিজিত হয় নাই। সুতরাং বখতিয়ারকে বঙ্গবিজেতা’ বলা সংগত হয় না। তিনি পশ্চিমবঙ্গে ও উত্তরবঙ্গের কতকাংশ জয় করিয়া বাংলা দেশে মুসলিম শাসনের প্রথম সূচনা করিয়াছিলেন, ইহাই তাঁহার কীর্তি। ত্রয়োদশ শতাব্দীর মুসলিম ঐতিহাসিকরাও বখতিয়ারকে ‘বঙ্গবিজেতা’ বলেন নাই; তাহারা বখতিয়ার ও তাঁহার উত্তরাধিকারীদের অধিকৃত অঞ্চলকে লখনৌতি রাজ্য বলিয়াছেন, ‘বাংলা রাজ্য’ বলেন নাই।

বখতিয়ারের নদীয়া বিজয় হইতে সুরু করিয়া তাজুদ্দীন অর্সলানের হাতে ইজুদ্দীন বলবন য়ুজবকীর পরাজয় ও পতন পর্যন্ত লখনৌতি রাজ্যের ইতিহাস একমাত্র মীনহাজ-ই-সিরাজের ‘তবকাৎ-ই-নাসিরী’ হইতে জানা যায়। নীচে এই গ্রন্থ অবলম্বনে এই সময়কার ইতিহাসের সংক্ষিপ্তসার লিপিবদ্ধ হইল।

নদীয়া ও লখনৌতি বিজয়ের পরে প্রায় দুই বৎসর বখতিয়ার আর কোন অভিযানে বাহির হন নাই। এই সময়ে তিনি পরিপূর্ণভাবে অধিকৃত অঞ্চলের শাসনে মনোনিবেশ করেন। সমগ্র অঞ্চলটিকে তিনি কয়েকটি বিভাগে বিভক্ত করিলেন এবং তাঁহার সহযোগী বিভিন্ন সেনানায়ককে তিনি বিভিন্ন বিভাগের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিলেন। ইহারা সকলেই ছিলেন হয় তুর্কী নাহয় খিলজী জাতীয়। রাজ্যের সীমান্ত অঞ্চলে বখতিয়ার আলী মর্দান, মুহম্মদ শিরান, হসামুদ্দীন ইউয়জ প্রভৃতি বিশিষ্ট ব্যক্তিদের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিলেন। বখতিয়ার তাঁহার রাজ্যে অনেকগুলি মসজিদ, মাদ্রাসা ও খানকা প্রতিষ্ঠা করিলেন। হিন্দুদের বহু মন্দির তিনি ভাঙিয়া ফেলিলেন এবং বহু হিন্দুকে ইসলাম ধর্ম্মে দীক্ষিত করিলেন।

লখনৌতি জয়ের প্রায় দুই বৎসর পরে বখতিয়ার তিব্বত জয়ের সংকল্প করিয়া অভিযানে বাহির হইলেন। লখনৌতি ও হিমালয়ের মধ্যবর্তী প্রদেশে কোচ, মেচ ও থারু নামে তিনটি জাতির লোক বাস করিত। মেচ জাতির একজন সর্দার একবার বখতিয়ারের হাতে পড়িয়াছিল, বখতিয়ার তাহাকে ইসলাম ধর্ম্মে দীক্ষিত করিয়া আলী নাম রাখিয়াছিলেন। এই আলী বখতিয়ারের পথপ্রদর্শক হইল। বখতিয়ার দশ সহস্র সৈন্য লইয়া তিব্বত অভিমুখে যাত্রা করিলেন। আলী মেচ তাঁহাকে কামরূপ রাজ্যের অভ্যন্তরে বেগমতী নদীর তীরে বর্ধন নামে একটি নগরে আনিয়া হাজির করিল। বেগমতী ও বর্ধনের অবস্থান সম্বন্ধে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। বখতিয়ার বেগমতীর তীরে তীরে দশ দিন গিয়া একটি পাথরের সেতু দেখিতে পাইলেন, তাহাতে বারোটি খিলান ছিল। একজন তুর্কী ও একজন খিলজী আমীরকে সেতু পাহারা দিবার জন্য রাখিয়া বখতিয়ার অবশিষ্ট সৈন্য লইয়া সেতু পার হইলেন।

এদিকে কামরূপের রাজা বখতিয়ারকে দূতমুখে জানাইলেন যে ঐ সময় তিব্বত আক্রমণের উপযুক্ত নয়; পরের বৎসর যদি বখতিয়ার তিব্বত আক্রমণ করেন, তাহা হইলে তিনিও তাঁহার সৈন্যবাহিনী লইয়া এ অভিযানে যোগ দিবেন। বখতিয়ার কামরূপরাজের কথায় কর্ণপাত না করিয়া তিব্বতের দিকে অগ্রসর হইলেন। পূর্ব্বোক্ত সেতুটি পার হইবার পর বখতিয়ার পনেরো দিন পার্ব্বত্য পথে চলিয়া ষোড়শ দিবসে এক উপত্যকায় পৌঁছিলেন এবং সেখানে লুণ্ঠন সুরু করিলেন; এই স্থানে একটি দুর্ভেদ্য দুর্গ ছিল। এই দুর্গ ও তাঁহার আশপাশ হইতে অনেক সৈন্য বাহির হইয়া বখতিয়ারের সৈন্যদলকে আক্রমণ করিল। ইহাদের কয়েকজন বখতিয়ারের বাহিনীর হাতে বন্দী হইল। তাহাদের কাছে বখতিয়ার জানিতে পারিলেন যে ঐ স্থান হইতে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে করমপত্তন বা করারপত্তন নামে একটি স্থানে পঞ্চাশ হাজার অশ্বারোহী সৈন্য আছে। ইহা শুনিয়া বখতিয়ার আর অগ্রসর হইতে সাহস করিলেন না।

কিন্তু প্রত্যাবর্তন করাও তাঁহার পক্ষে সহজ হইল না। তাঁহার শত্রুপক্ষ ঐ এলাকার সমস্ত লোকজন সরাইয়া যাবতীয় খাদ্যশস্য নষ্ট করিয়া দিয়াছিল। বখতিয়ারের সৈন্যরা তখন নিজেদের ঘোড়াগুলির মাংস খাইতে লাগিল। এইভাবে অশেষ কষ্ট সহ্য করিয়া বখতিয়ার কোনরকমে কামরূপে পৌঁছিলেন।

কিন্তু কামরূপে পৌঁছিয়া বখতিয়ার দেখিলেন পূর্ব্বোক্ত সেতুটির দুইটি খিলান ভাঙা; যে দুইজন আমীরকে তিনি সেতু পাহারা দিতে রাখিয়া গিয়াছিলেন, তাহারা বিবাদ করিয়া ঐ স্থান ছাড়িয়া গিয়াছিল, ইত্যবসরে কামরূপের লোকেরা আসিয়া এই দুইটি খিলান ভাঙিয়া দেয়। বখতিয়ার তখন নদীর তীরে তাঁবু ফেলিয়া নদী পার হইবার জন্য নৌকা ও ভেলা নির্মাণের চেষ্টা করিতে লাগিলেন কিন্তু সে চেষ্টা সফল হইল না। তখন বখতিয়ার নিকটবর্তী একটি দেবমন্দিরে সসৈন্যে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। কিন্তু কামরূপের রাজা এই সময় বখতিয়ারের স্বপক্ষ হইতে বিপক্ষে চলিয়া গেলেন। (বোধহয় মুসলমানরা দেবমন্দিরে প্রবেশ করায় তিনি ক্রুদ্ধ হইয়াছিলেন।) তাঁহার সেনারা আসিয়া ঐ দেবমন্দির ঘিরিয়া ফেলিল এবং মন্দিরটির চারিদিকে বাঁশ দিয়া প্রাচীর খাড়া করিল। বখতিয়ারের সৈন্যরা চারিদিকে বন্ধ দেখিয়া মরিয়া হইয়া প্রাচীরের একদিকে ভাঙিয়া ফেলিল এবং তাহাদের মধ্যে দুই-একজন অশ্বারোহী অশ্ব লইয়া নদীর ভিতরে কিছুদূর গমন করিল। তীরের লোকেরা “রাস্তা মিলিয়াছে” বলিয়া চীৎকার করায় বখতিয়ারের সমস্ত সৈন্য জলে নামিল। কিন্তু সামনে গভীর জল ছিল, তাহাতে বখতিয়ার এবং অল্প কয়েকজন অশ্বারোহী ব্যতীত আর সকলেই ডুবিয়া মরিল। বখতিয়ার হতাবশিষ্ট অশ্বারোহীদের লইয়া কোনক্রমে নদীর ওপারে পৌঁছিয়া আলী মেচের আত্মীয়স্বজনকে প্রতীক্ষারত দেখিতে পাইলেন। তাহাদের সাহায্যে তিনি অতিকষ্টে দেবকোটে পৌঁছিলেন।

দেবকোটে পৌঁছিয়া বখতিয়ার সাংঘাতিক রকম অসুস্থ হইয়া পড়িলেন। ইহার অল্পদিন পরেই তিনি পরলোকগমন করিলেন। (৬০২ হি. = ১২০৫-০৬ খ্র.)। কেহ কেহ বলেন যে বখতিয়ারের অনুচর নারান-কোই-র শাসনকর্ত্তা আলী মর্দান তাঁহাকে হত্যা করেন। তিব্বত অভিযানের মতো অসম্ভব কাজে হাত না দিলে হয়তো এত শীঘ্ন বখতিয়ারের এরূপ পরিণতি হইত না।

ইজুদ্দীন মুহম্মদ শিরান খিলজী

ইজুদ্দীন মুহম্মদ শিরান খিলজী ও তাঁহার ভ্রাতা আহমদ শিরান বখতিয়ার খিলজীর অনুচর ছিলেন। বখতিয়ার তিব্বত অভিযানে যাত্রা করিবার পূর্বে এই দুই ভ্রাতাকে লখনোর ও জাজনগর আক্রমণ করিতে পাঠাইয়াছিলেন। তিব্বত হইতে বখতিয়ারের প্রত্যাবর্তনের সময় মুহম্মদ শিরান জাজনগরে ছিলেন। বখতিয়ারের তিব্বত অভিযানের ব্যর্থতার কথা শুনিয়া তিনি দেবকোটে প্রত্যাবর্তন করিলেন। ইতিমধ্যে বখতিয়ার পরলোকগমন করিয়াছিলেন। তখন মুহম্মদ শিরান প্রথমে নারান-কোই আক্ৰমণ করিয়া আলী মর্দানকে পরাস্ত ও বন্দী করিলেন এবং দেবকোটে ফিরিয়া আসিয়া নিজেকে বখতিয়ারের উত্তরাধিকারী ঘোষণা করিলেন। এদিকে আলী মর্দান কারাগার হইতে পলায়ন করিয়া দিল্লিতে সুলতান কুত্ৰুদ্দীন আইবকের শরণাপন্ন হইলেন। কায়েমাজ রুমী নামে কুত্ৰুদ্দীনের জনৈক সেনাপতি এই সময়ে অযোধ্যায় ছিলেন, তাঁহাকে কুত্ৰুদ্দীন লখনৌতি আক্রমণ করিতে বলিলেন। কায়েমাজ লখনৌতি রাজ্যে পৌঁছিয়া অনেক খিলজী আমীরকে হাত করিয়া ফেলিলেন। বখতিয়ারের বিশিষ্ট অনুচর, গাঙ্গুরীর জায়গীরদার হসামুদ্দীন ইউয়জ অগ্রসর হইয়া কায়েমাজকে স্বাগত জানাইলেন এবং তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া দেবকোটে লইয়া গেলেন। মুহম্মদ শিরান তখন কায়েমাজের সহিত যুদ্ধ না করিয়া দেবকোট হইতে পলাইয়া গেলেন। অতঃপর কায়েমাজ হসামুদ্দীনকে দেবকোটের কর্তৃত্ব দান করিলেন। কিন্তু কায়েমাজ অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করিলে মুহম্মদ শিরান এবং তাঁহার দলভুক্ত খিলজী আমীররা দেবকোট আক্রমণের উদ্যোগ করিতে লাগিলেন।

এই সংবাদ পাইয়া কায়েমাজ আবার ফিরিয়া আসিলেন। তখন তাঁহার সহিত মুহম্মদ শিরান ও তাঁহার অনুচরদের যুদ্ধ হইল। এই যুদ্ধে মুহম্মদ শিরান ও তাঁহার দলের লোকেরা পরাজিত হইয়া মদা এবং সন্তোষের দিকে পলায়ন করিলেন। পলায়নের সময় তাঁহাদের নিজেদের মধ্যে বিবাদ হইল এবং এই বিবাদের ফলে মুহম্মদ শিরান নিহত হইলেন।

আলী মর্দান (আলাউদ্দীন)

আলী মর্দান কিছুকাল দিল্লিতেই রহিলেন। কুলুদ্দীন আইবক যখন গজনীতে যুদ্ধ করিতে গেলেন, তখন তিনি আলী মর্দানকে সঙ্গে লইয়া গেলেন। গজনীতে আলী মর্দান তুর্কীদের হাতে বন্দী হইলেন। কিছুদিন বন্দীদশায় থাকিবার পর আলী মর্দান মুক্তিলাভ করিয়া দিল্লিতে ফিরিয়া আসিলেন। তখন কুস্তুদ্দীন তাঁহাকে লখনৌতির শাসনকর্ত্তার পদে নিযুক্ত করিলেন। আলী মর্দান দেবকোটে আসিলে হসামুদ্দীন ইউয়জ তাহাকে অভ্যর্থনা জানাইলেন এবং আলী মর্দান নির্বিবাদে লখনৌতির শাসনভার গ্রহণ করিলেন। (আ ১২১০ খ্রী)।

কুলুদ্দীন যতদিন জীবিত ছিলেন, ততদিন আলী মর্দান দিল্লির অধীনতা স্বীকার করিয়াছিলেন। কিন্তু কুল্লুদ্দীন পরলোকগমন করিলে (নভেম্বর ১২১০ খ্রী) আলী মর্দান স্বাধীনতা ঘোষণা করিলেন এবং আলাউদ্দীন নাম লইয়া সুলতান হইলেন। তাঁহার পর তিনি চারিদিকে সৈন্য পাঠাইয়া বহু খিলজী আমীরকে বধ করিলেন। তাঁহার অত্যাচার ক্রমে ক্রমে চরমে উঠিল। তিনি বহু লোককে বধ করিলেন এবং নিরীহ দরিদ্র লোকদের দুর্দশার একশেষ করিলেন। অবশেষে তাঁহার অত্যাচারে অতিষ্ঠ হইয়া বহু খিলজী আমীর ষড়যন্ত্র করিয়া আলী মর্দানকে হত্যা করিলেন। ইহার পর তাঁহারা হসামুদ্দীন ইউয়জকে লখনৌতির সুলতান নির্বাচিত করিলেন। হসামুদ্দীন ইউয়জ গিয়াসুদ্দীন ইউয়জ শাহ নাম গ্রহণ করিয়া সিংহাসনে বসিলেন (আ ১২১৩ খ্রী)।

গিয়াসুদ্দীন ইউয়জ

গিয়াসুদ্দীন ইউয়জ শাহ ১৪ বৎসর রাজত্ব করেন। তিনি প্রিয়দর্শন, দয়ালু ও ধর্মপ্রাণ ছিলেন। আলিম, ফকির ও সৈয়দদের তিনি বৃত্তি দান করিতেন। দূরদেশ হইতেও বহু মুসলমান অর্থের প্রত্যাশী হইয়া তাঁহার কাছে আসিত এবং সন্তুষ্ট হইয়া ফিরিয়া যাইত। বহু মসজিদও তিনি নির্মাণ করাইয়াছিলেন। গিয়াসুদ্দীনের শাসনকালে দেবকোটের প্রাধান্য হ্রাস পায় এবং লখনৌতি পুরাপুরি রাজধানী হইয়া উঠে। গিয়াসুদ্দীনের আর একটি বিশেষ কীর্তি দেবকোট হইতে লখনোর বা রাজনগর (বর্তমান বীরভূম জেলার অন্তর্গত) পর্যন্ত একটি সুদীর্ঘ উচ্চ রাজপথ নির্মাণ করা। এই রাজপথটির কিছু চিহ্ন পঞ্চাশ বছর আগেও বর্তমান ছিল। গিয়াসুদ্দীন বসকোট বা বসনকোট নামক স্থানে একটি দুর্গও নির্মাণ করাইয়াছিলেন। বাগদাদের খলিফা অন্নাসিরোলেদীন ইল্লাহের নিকট হইতে গিয়াসুদ্দীন তাঁহার রাজ-মর্যাদা স্বীকারসূচক পত্র আনান। গিয়াসুদ্দীনের অনেকগুলি মুদ্রা পাওয়া গিয়াছে। তাহাদের কয়েকটিতে খলিফার নাম আছে।

কিন্তু ১৫ বৎসর রাজত্ব করিবার পর গিয়াসুদ্দীন ইউয়জ শাহের অদৃষ্টে দুর্দিন ঘনাইয়া আসিল। দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিস ৬২২ হিজরায় (১২২৫-২৬ খ্র) গিয়াসুদ্দীন ইউয়জ শাহকে দমন করিয়া লখনৌতির দিকে রওনা হইলে গিয়াসুদ্দীন তাঁহাকে বাধা দিবার জন্য এক নৌবাহিনী পাঠাইলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি ইলতুৎমিসের নামে মুদ্রা উৎকীর্ণ করিতে ও খুৎবা পাঠ করিতে স্বীকৃত হইয়া এবং অনেক টাকা ও হাতি উপঢৌকন দিয়া ইলতুৎমিসের সহিত সন্ধি করিলেন। ইলতুৎমিস তখন ইজুদ্দীন জানী নামে এক ব্যক্তিকে বিহারের শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত করিয়া দিল্লিতে ফিরিয়া গেলেন। কিন্তু ইলতুৎমিসের প্রত্যাবর্তনের অল্পকাল পরেই গিয়াসুদ্দীন ইজুদ্দীন জানীকে পরাজিত ও বিতাড়িত করিয়া বিহার অধিকার করিলেন। ইজুদ্দীন তখন ইলতুৎমিসের জ্যেষ্ঠ পুত্র নাসিরুদ্দীন মাহমুদের কাছে গিয়া সমস্ত কথা জানাইলেন এবং তাঁহার অনুরোধে নাসিরুদ্দীন মাহমুদ লখনৌতি আক্রমণ করিলেন। এই সময়ে গিয়াসুদ্দীন ইউয়জ পূর্ববঙ্গ এবং কামরূপ জয় করিবার জন্য যুদ্ধযাত্রা করিয়াছিলেন, সুতরাং নাসিরুদ্দীন অনায়াসেই লখনৌতি অধিকার করিলেন। গিয়াসুদ্দীন এই সংবাদ পাইয়া ফিরিয়া আসিলেন এবং নাসিরুদ্দীনের সহিত যুদ্ধ করিলেন। কিন্তু যুদ্ধে তাঁহার পরাজয় হইল এবং তিনি সমস্ত খিলজী আমীরের সহিত বন্দী হইলেন। অতঃপর গিয়াসুদ্দীনের প্রাণবধ করা হইল (৬২৪ হি = ১২২৬-২৭ খ্রী)।

নাসিরুদ্দীন মাহমুদ

গিয়াসুদ্দীন ইউয়জ শাহের পরাজয় ও পতনের ফলে লখনৌতি রাজ্য সম্পূর্ণভাবে দিল্লির সুলতানের অধীনে আসিল। দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিস প্রথমে নাসিরুদ্দীন মাহমুদকেই লখনৌতির শাসনকর্ত্তার পদে নিযুক্ত করিলেন। নাসিরুদ্দীন মাহমুদ সুলতান গারি নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি লখনৌতি অধিকার করার পর দিল্লি ও অন্যান্য বিশিষ্ট নগরের আলিম, সৈয়দ এবং অন্যান্য ধার্মিক ব্যক্তিদের কাছে বহু অর্থ পাঠাইয়াছিলেন। নাসিরুদ্দীন অত্যন্ত যোগ্য ও নানাগুণে ভূষিত ছিলেন। তাঁহার পিতা ইলতুৎমিসের নিকট একবার বাগদাদের খলিফার নিকট হইতে খিলাৎ আসিয়াছিল, ইলতুৎমিস তাঁহার মধ্য হইতে একটি খিলাৎ ও একটি লাল চন্দ্রাতপ লখনৌতিতে পুত্রের কাছে পাঠাইয়া দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত মাত্র দেড় বৎসর লখনৌতি শাসন করিবার পরেই নাসিরুদ্দীন মাহমুদ রোগাক্রান্ত হইয়া পরলোকগমন করেন। তাঁহার মৃতদেহ লখনৌতি হইতে দিল্লিতে লইয়া গিয়া সমাধিস্থ করা হয়।

নাসিরুদ্দীন মাহমুদ পিতার অধীনস্থ শাসনকর্ত্তা হিসাবে লখনৌতি শাসন করিলেও পিতার অনুমোদনক্রমে নিজের নামে মুদ্রা প্রকাশ করিয়াছিলেন। তাঁহার কোন কোন মুদ্রায় বাগদাদের খলিফার নাম দেখিতে পাওয়া যায়।

ইখতিয়ারুদ্দীন মালিক বলকা

নাসিরুদ্দীন মাহমুদের শাসনকালে হসামুদ্দীন ইউয়জের পুত্র ইখতিয়ারুদ্দীন দৌলৎ শাহ-ই-বলকা আমীরের পদ লাভ করিয়াছিলেন। নাসিরুদ্দীনের মৃত্যুর পর তিনি বিদ্রোহী হইলেন এবং লখনৌতি রাজ্য অধিকার করিলেন। তখন ইলতুৎমিস তাঁহাকে দমন করিতে সসৈন্যে লখনৌতি আসিলেন এবং তাঁহাকে পরাজিত ও বিতাড়িত করিয়া আলাউদ্দীন জানী নামে তুর্কীস্থানের রাজবংশসম্ভুত এক ব্যক্তিকে লখনৌতির শাসনকর্ত্তার পদে নিযুক্ত করিয়া দিল্লিতে প্রত্যাবর্তন করিলেন।

আলাউদ্দীন জানী, সৈফুদ্দীন আইবক য়গানতৎ ও আওর খান

আলাউদ্দীন জানী অল্পদিন লখনৌতি শাসন করিবার পরে ইলতুৎমিস কর্ত্তৃক পদচ্যুত হন এবং সৈফুদ্দীন আইবক নামে আর এক ব্যক্তি তাঁহার স্থানে নিযুক্ত হন। সৈফুদ্দীন আইবক অনেকগুলি হাতি ধরিয়া ইলতুৎমিসকে পাঠাইয়াছিলেন, এজন্য ইলতুৎমিস তাঁহাকে ‘য়গানতৎ’ উপাধি দিয়াছিলেন। দুই-তিন বৎসর শাসনকর্ত্তার পদে অধিষ্ঠিত থাকার পর সৈফুদ্দীন আইবক য়গানতৎ পরলোকগমন করেন। প্রায় একই সময়ে দিল্লিতে ইলতুৎমিসও পরলোকগমন করিলেন (১২৩৬ খ্রী)।

ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পরে তাঁহার উত্তরাধিকারীদের দুর্বলতার সুযোগ লইয়া প্রাদেশিক শাসনকর্ত্তারা স্বাধীন রাজার মতো আচরণ করিতে লাগিলেন। এই সময়ে আওর খান নামে একজন তুর্কী লখনৌতি ও লখনোর অধিকার করিয়া বসিলেন। বিহারের শাসনকর্ত্তা তুগরল তুগার খানের সহিত তাঁহার বিবাদ বাধিল এবং তুগান খান লখনৌতি আক্রমণ করিলেন। লখনৌতি নগর ও বসনকোট দুর্গের মধ্যবর্তী স্থানে তুগান খান আওর খানের সহিত যুদ্ধ করিয়া তাহাকে পরাজিত ও নিহত করিলেন। ফলে লখনোর হইতে বসনকোট পর্যন্ত এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখন তুগান খানের হস্তে আসিল।

তুগরল তুগান খান

তুগান খানের শাসনকালে সুলতানা রাজিয়া দিল্লির সিংহাসনে আরোহণ করেন। তাঁহার অভিষেকের সময়ে তুগান খান দিল্লিতে কয়েকজন প্রতিনিধি পাঠাইয়াছিলেন। রাজিয়া তুগান খানকে একটি ধ্বজ ও কয়েকটি চন্দ্রাতপ উপহার দিয়াছিলেন। তুগাল খান সুলতানা রাজিয়ার নামে লখনৌতির টাকশালে মুদ্রাও উত্তীর্ণ করাইয়াছিলেন। রাজিয়ার সিংহাসনচ্যুতির পরে তুগান খান অযোধ্যা, কড়া ও মানিকপুর প্রভৃতি অঞ্চল অধিকার করিয়া বসিলেন।

এই সময়ে ‘তবকাৎ-ই-নাসিরী’র লেখক মীনহাজ-ই-সিরাজ অযোধ্যায় ছিলেন। তুগরল তুগান খানের সহিত মীনহাজের পরিচয় হইয়াছিল। তুগান খান মীনহাজকে বাংলাদেশে লইয়া আসেন। মীনহাজ প্রায় তিন বৎসর এদেশে ছিলেন এবং এই সময়কার ঘটনাবলী তিনি স্বচক্ষে দেখিয়া তাঁহার গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন।

তুগান খানের শাসনকালে জাজনগরের (উড়িষ্যা) রাজা লখনৌতি আক্রমণ করেন। উড়িষ্যার শিলালিপির সাক্ষ্য হইতে জানা যায় যে, এই জাজনগররাজ উড়িষ্যার গঙ্গবংশীয় রাজা প্রথম নরসিংহদেব। তুগরল তুগান খান তাঁহার আক্রমণ প্রতিহত করিয়া পাল্টা আক্রমণ চালান এবং জাজনগর অভিমুখে অভিযান করেন (৬৪১ হি = ১২৪৩-৪৪ খ্রী)। মীনহাজ-ই-সিরাজ এই অভিযানে তুগান খানের সহিত গিয়াছিলেন। তুগান খান জাজনগর রাজ্যের সীমান্তে অবস্থিত কটাসিন দুর্গ অধিকার করিয়া লইলেন। কিন্তু দুর্গ জয়ের পর যখন তাঁহার সৈন্যরা বিশ্রাম ও আহারাদি করিতেছিল, তখন জাজনগররাজের সৈন্যরা অকস্মাৎ পিছন হইতে তাহাদের আক্রমণ করিল। ফলে তুগান খান পরাজিত হইয়া লখনৌতিতে প্রত্যাবর্তন করিতে বাধ্য হইলেন। ইহার পর তিনি তাঁহার দুইজন মন্ত্রী শফুলমুল আশারী ও কাজী জলালুদ্দীন কাসানীকে দিল্লির সুলতান আলাউদ্দীন মসূদ শাহের কাছে পাঠাইয়া তাঁহার সাহায্য প্রার্থনা করিলেন। আলাউদ্দীন তখন অযোধ্যার শানকর্ত্তা কমরুদ্দীন তমুর খান-ই-কিরানকে তুগান খানের সহায়তা করিবার আদেশ দিলেন। ইতিমধ্যে জাজনগরের রাজা আবার বাংলা দেশ আক্রমণ করিলেন। তিনি প্রথমে লখনোর আক্রমণ করিলেন এবং সেখানকার শাসনকর্ত্তা ফখু-উ-মুল করিমুদ্দীন লাগরিকে পরাজিত ও নিহত করিয়া স্থান দখল করিয়া লইলেন। তাঁহার পর তিনি লখনৌতি অবরোধ করিলেন। অবরোধের ফলে তুগান খানের খুবই অসুবিধা হইয়াছিল, কিন্তু অবরোধের দ্বিতীয় দিনে অযোধ্যার শাসনকর্ত্তা তমুর খান তাঁহার সৈন্যবাহিনী লইয়া উপস্থিত হইলেন। তখন জাজনগররাজ লখনৌতি পরিত্যাগ করিয়া স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করিলেন।

কিন্তু জাজনগররাজের বিদায়ের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তুগরল তুগান খান ও তমুর খানের মধ্যে বিবাদ বাধিল এবং বিবাদ যুদ্ধে পরিণত হইল। সারাদিন যুদ্ধ চলিবার পর অবশেষে সন্ধ্যায় কয়েক ব্যক্তি মধ্যস্থ হইয়া যুদ্ধ বন্ধ করিলেন। যুদ্ধের শেষে তুগান খান নিজের আবাসে ফিরিয়া গেলেন। তাঁহার আবাস ছিল নগরের প্রধান দ্বারের সামনে এবং সেখানে তিনি সেদিন একাই ছিলেন। তমুর খান এই সুযোগে বিশ্বাসঘাতকতা করিয়া তুগান খানের আবাস আক্রমণ করিলেন। তখন তুগান খান পলাইতে বাধ্য হইলেন। অতঃপর তিনি মীনহাজ-ই-সিরাজকে তমুর খানের কাছে পাঠাইলেন এবং মীনহাজের দৌত্যের ফলে উভয় পক্ষের মধ্যে সন্ধি স্থাপিত হইল। সন্ধির শর্ত অনুসারে তমুর খান লখনৌতির অধিকারপ্রাপ্ত হইলেন এবং তুগান খান তাঁহার অনুচরবর্গ, অর্থভাণ্ডার এবং হাতিগুলি লইয়া দিল্লিতে গমন করিলেন। দিল্লির দুর্বল সুলতান আলাউদ্দীন মসূদ শাহ তুগান খানের উপর তমুর খানের এই অত্যাচারের কোনই প্রতিবিধান করিতে পারিলেন না। তুগান খান অতঃপর আউধের শাসনভার প্রাপ্ত হইলেন।

কমরুদ্দীন তমুর খান-ই-কিরান ও জলালুদ্দীন মসূদ জানী

তমুর খান দিল্লির সুলতানের কর্তৃত্ব অস্বীকারপূর্বক দুই বৎসর লখনৌতি শাসন করিয়া পরলোকগমন করিলেন। ঘটনাচক্রে তিনি ও তুগরল তুগান খান একই রাত্রিতে (৯ মার্চ, ১২৪৭ খ্রী) শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁহার পর আলাউদ্দীন জানীর পুত্র জালালুউদ্দীন মসূদ জানী বিহার ও লখনৌতির শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হন। ইনি “মালিক-উশ-শর্ক” ও “শাহ্” উপাধি গ্রহণ করিয়াছিলেন। প্রায় চারি বৎসর তিনি এ দুইটি প্রদেশ শাসন করিয়াছিলেন।

১০

ইখতিয়ারুদ্দীন য়ুজবক তুগরল খান (মুগীসুদ্দীন য়ুজবক শাহ)

জালালুদ্দীন মসূদ জানীর পরে যিনি লখনৌতির শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হইলেন, তাঁহার নাম মালিক ইখতিয়ারুদ্দীন য়ুজবক তুগরল খান। ইনি প্রথমে আউধের শাসনকর্ত্তা এবং পরে লখনৌতির শাসনকর্ত্তার পদে নিযুক্ত হন। ইহার পূর্বে ইনি দুইবার দিল্লির তল্কালীন সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করিয়াছিলেন, কিন্তু দুইবারই উজীর উলুগ খান বলবনের হস্তক্ষেপের ফলে ইনি সুলতানের মার্জনা লাভ করেন। ইঁহার শাসনকালে জাজনগরের সহিত লখনৌতির আবার যুদ্ধ বাধিয়াছিল। তিনবার যুদ্ধ হয়, প্রথম দুইবার জাজনগরের সৈন্যবাহিনী পরাজিত হয়, কিন্তু তৃতীয়বার তাহারাই য়ুজবক তুগরল খানের বাহিনীকে পরাজিত করে এবং য়ুজবকের একটি বহুমূল্য শ্বেতহস্তীকে জাজনগরের সৈন্যেরা লইয়া যায়। ইহার পরের বৎসর য়ুজবক উমর্দন রাজ্য [*এই রাজ্যের অবস্থান সম্বন্ধে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে] আক্রমণ করেন। অলক্ষিতভাবে অগ্রসর হইয়া তিনি ঐ রাজ্যের রাজধানীতে উপস্থিত হইলেন; তখন সেখানকার রাজা রাজধানী ছাড়িয়া পলায়ন করিলেন এবং তাঁহার অর্থ, হস্তী, পরিবার, অনুচরবর্গ–সমস্তই য়ুজবকের দখলে আসিল।

উমর্দন রাজ্য জয় করিবার পর য়ুজবক খুবই গর্বিত হইয়া উঠিলেন এবং আউধের রাজধানী অধিকার করিলেন। ইহার পর তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়া সুলতান মুগীসুদ্দীন নাম গ্রহণ করিলেন। কিন্তু আউধে এক পক্ষ কাল অবস্থান করিবার পর তিনি যখন শুনিলেন যে তাঁহার বিরুদ্ধে প্রেরিত সম্রাটের সৈন্যবাহিনী অদূরে আসিয়া পড়িয়াছে, তখন তিনি নৌকাযোগে লখনৌতিতে পলাইয়া আসিলেন। য়ুজবক স্বাধীনতা ঘোষণা করায় ভারতের হিন্দু-মুসলমান সকলেই তাঁহার বিরূপ সমালোচনা করিতে লাগিলেন।

লখনৌতিতে পৌঁছিবার পর য়ুজবক কামরূপ রাজ্য আক্রমণ করিলেন। কামরূপরাজের সৈন্যবল বেশি ছিল না বলিয়া তিনি প্রথমে যুদ্ধ না করিয়া পিছু হটিয়া গেলেন। যুজবক তখন কামরূপের প্রধান নগর জয় করিয়া প্রচুর ধনরত্ন হস্ত গত করিলেন। কামরূপরাজ য়ুজবকের কাছে সন্ধির প্রস্তাব করিয়া দূত পাঠাইলেন। তিনি য়ুজবকের সামন্ত হিসাবে কামরূপ শাসন করিতে এবং তাহাকে প্রতি বৎসর হস্তী ও স্বর্ণ পাঠাইতে স্বীকৃত হইয়াছিলেন। য়ুজবক এই প্রস্তাবে সম্মত হন নাই। কিন্তু যুবক একটা ভুল করিয়াছিলেন। কামরূপের শস্যসম্পদ খুব বেশি ছিল বলিয়া য়ুজবক নিজের বাহিনীর আহারের জন্য শস্য সঞ্চয় করিয়া রাখার প্রয়োজন বোধ করেন নাই। কামরূপের রাজা ইহার সুযোগ লইয়া তাঁহার প্রজাদের দিয়া সমস্ত শস্য কিনিয়া লওয়াইলেন এবং তাঁহার পর তাহাদের দিয়া সমস্ত পয়ঃপ্রণালীর মুখ খুলিয়া দেওয়াইলেন। ইহার ফলে য়ুজবকের অধিকৃত সমস্ত ভূমি জলমগ্ন হইয়া পড়িল এবং তাঁহার খাদ্যভাণ্ডার শূন্য হইয়া পড়িল। তখন তিনি লখনৌতিতে ফিরিবার চেষ্টা করিলেন। কিন্তু ফিরিবার পথও জলে ডুবিয়া গিয়াছিল। সুতরাং য়ুজবকের বাহিনী অগ্রসর হইতে পারিল না। ইহা ব্যতীত অল্প সময়ের মধ্যেই তাহাদের সম্মুখ ও পশ্চাৎ হইতে কামরূপরাজের বাহিনী আসিয়া ঘিরিয়া ধরিল। তখন পর্বতমালাবেষ্টিত একটি সংকীর্ণ স্থানে উভয় পক্ষের মধ্যে যুদ্ধ হইল। এই যুদ্ধে য়ুজবক পরাজিত হইয়া বন্দী হইলেন এবং বন্দীদশাতেই তিনি পরলোকগমন করিলেন।

মুগীসুদ্দীন য়ুজবক শাহের সমস্ত মুদ্রায় লেখা আছে যে এগুলি “নদীয়া ও অর্জ বদন (?)-এর ভূমি-রাজস্ব হইতে প্রস্তুত হইয়াছিল। কোন কোন ঐতিহাসিক ভ্রমবশত এগুলিকে নদীয়া ও “অৰ্জ বদন” বিজয়ের স্মারক-মুদ্রা বলিয়া মনে করিয়াছেন। কিন্তু নদীয়া বা নবদ্বীপ য়ুজবকের বহু পূর্বে বখতিয়ার খিলজী জয়–করিয়াছিলেন। বলা বাহুল্য, যুজবকের এই মুদ্রাগুলি হইতে এ কথা বুঝায় না যে য়ুজবকের রাজত্বকালেই নদীয়া ও অর্জ বদন (?) প্রথম বিজিত হইয়াছিল। ‘অর্জ বদন’-কে কেহ ‘বর্ধনকোটে’র, কেহ ‘বর্ধমানের, কেহ ‘উমদনে’র বিকৃত রূপ বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন।

১১

জলালুদ্দীন মসূদ জানী, ইজুদ্দীন বলবন য়ুজবকী ও তাজুদ্দীন অর্সলান খান

য়ুজবকের মৃত্যুর পরে লখনৌতি রাজ্য আবার দিল্লির সম্রাটের অধীনে আসে, কারণ ৬৫৫ হিজরায় (১২৫৭-৫৮ খ্রী) লখনৌতি টাকশাল হইতে দিল্লির সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের নামাঙ্কিত মুদ্রা উৎকীর্ণ হইয়াছিল। কিন্তু ঐ সময়ে লখনৌতির শাসনকর্ত্তা কে ছিলেন, তাহা জানা যায় না। ৬৫৬ হিজরায় জলালুদ্দীন মসূদ জানী দ্বিতীয়বার লখনৌতির শাসনকর্ত্তা নিযুক্ত হন। কিন্তু ৬৫৭ হিজরার মধ্যেই তিনি পদচ্যুত বা পরলোকগত হন, কারণ ৭৫৭ হিজরায় যখন কড়ার শাসনকর্ত্তা তাজুদ্দীন অর্সলান খান লখনৌতি আক্রমণ করেন, তখন ইজুদ্দীন বলবন য়ুজবকী নামে এক ব্যক্তি লখনৌতি শাসন করিতেছিলেন। ইজুদ্দীন বলবন য়ুজবকী লখনৌতি অরক্ষিত অবস্থায় রাখিয়া পূর্ববঙ্গ আক্রমণ করিতে গিয়াছিলেন। সেই সুযোগে তাজুদ্দীন অর্সলান খান মালব ও কালিঞ্জর আক্রমণ করিবার ছলে লখনৌতি আক্রমণ করেন। লখনৌতি নগরের অধিবাসীরা তিনদিন তাঁহার সহিত যুদ্ধ করিয়া অবশেষে আত্মসমর্পণ করিল। অর্সলান খান নগর অধিকার করিয়া লুণ্ঠন করিতে লাগিলেন। তাঁহার আক্রমণের খবর পাইয়া ইজুদ্দীন বলবন ফিরিয়া আসিলেন, কিন্তু তিনি অর্সলান খানের সহিত যুদ্ধ করিয়া পরাজিত ও নিহত হইলেন। ইজুদ্দীন বলবনের শাসনকালের আর কোনো ঘটনার কথা জানা যায় না, তবে ৬৫৭ হিজরায় লখনৌতি হইতে দিল্লিতে দুইটি হস্তী ও কিঞ্চিৎ অর্থ প্রেরিত হইয়াছিল-এইটুকু জানা গিয়াছে। ইজুদ্দীন বলবনকে নিহত করিয়া তাজুদ্দীন অর্সলান খান লখনৌতি রাজ্যের অধিপতি হইলেন।

১২

তাতার খান ও শের খান

ইহার পরবর্তী কয় বৎসরের ইতিহাস একান্ত অস্পষ্ট। তাজুদ্দীন অর্সলান খানের পরে তাতার খান ও শের খান নামে বাংলার দুইজন শাসনকর্ত্তার নাম পাওয়া যায়, কিন্তু তাহাদের সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *