নাট বল্টু – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
পৃথিবীর নানা রকম প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য সে যে শুধু তার বাবা-মাকে প্রশ্ন করে আর হাতে কলমে পরীক্ষা করে দেখে সেটা সত্যি নয়, সে খাঁটি বিজ্ঞানীর মতো অনেক পড়াশোনা করে। মা তাকে গল্প শোনালে সে চোখ বড় বড় করে মুগ্ধ হয়ে গল্প শোনে। বানিয়ে বানিয়ে গল্প শোনাতে শোনাতে এক সময় রিতুর রসদ ফুরিয়ে গেল। তখন সে বল্টুকে বই থেকে গল্প পড়ে শোনাতে শুরু করল, আর সেটাই হলো সর্বনাশ। বইয়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে গল্পটা শুনতে শুনতে কীভাবে কীভাবে জানি বল্টু পড়া শিখে গেল, সে কোনো অক্ষর চেনে না কিন্তু পড়তে পারে। এর থেকে বিচিত্র ব্যাপার আর কী হতে পারে?
বল্টুর সব সময়ের সঙ্গী নান্টু কখনো রাগে না। তার ভেতর রাগ ক্রোধ-হিংসা এসব কিছু নেই। ছয় বছরের এই ছোটখাটো মানুষটা পুরোপুরি একজন দার্শনিক। যদি ছোট বাচ্চাদের দাড়ি গজানোর উপায় থাকত, তাহলে দেখা যেত কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো নান্টুর লম্বা লম্বা পাকা দাড়ি। নান্টুর পাকা দাড়ি নেই সত্যি, কিন্তু তার কথাবার্তা-ভাবভঙ্গি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে কোনো অংশে কম নয়।
এই দুই ক্ষুদে বিজ্ঞানী আর দার্শনিককে নিয়ে নানা বিস্ময়কর ঘটনায় সাজানো মজার উপন্যাস নাটবল্টু।
.
১. বল্টু নামের বৈজ্ঞানিক
বল্টু বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়েছিল। চোখ দুটো বন্ধ, মুখটা অল্প খোলা। নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে তার ছোট বুকটা ওপরে উঠছে আর নিচে নামছে। মাথায় পাখির বাসার মতো রুক্ষ চুল, কপালের ওপর একগোছা নেমে এসেছে। রিতু কপাল থেকে চুলগুলো সরিয়ে বল্টুর মুখটা একনজর দেখে রাজুকে ডাকল, বলল, “রাজু, দেখে যাও।”
রাজু টেবিলে একটা মোটা বইয়ের ওপর ঝুঁকে বসেছিল, মুখ তুলে বলল, “কী দেখে যাব?”
“তোমার ছেলের মুখটা একবার দেখে যাও।”
রাজু মোটা বইটা টেবিলে উপুড় করে রেখে উঠে এসে রিতুর পাশে দাঁড়াল, ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “কী দেখব?”
“মুখটা কত নিষ্পাপ, দেখেছ?”
রাজু মাথা নাড়ল, বলল “ছোট বাচ্চারা যখন ঘুমায় তখন তাদের মুখ সব সময় এ রকম নিষ্পাপ হয়।”
রিতু মুখটা শক্ত করে বলল, “এই মুখ দেখে কেউ বলতে পারবে, আজকে দুপুরবেলা সে ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল?”
“বলা কঠিন।”
“কেউ কি বলতে পারবে যে সে ফ্রিজের ভেতর একটা ইঁদুরের বাচ্চা ছেড়ে দিয়েছিল?”
রাজু মাথা নাড়ল; বলল, “উঁহু।”
“কেউ বলতে পারবে, নতুন সিডি প্লেয়ারটাতে একটা গান শোনার আগেই সে সেটা টুকরা টুকরা করে ফেলেছে?”
রাজু তখন তার ছেলের পক্ষে একটু সাফাই গাওয়ার চেষ্টা করল, বলল, “ঠিক টুকরা টুকরা না …”
রিতু ঝটকা মেরে রাজুকে থামিয়ে দিয়ে আঙুল দিয়ে তাকে দেখিয়ে বলল, “সব তোমার জন্যে।”
রাজু অবাক হয়ে বলল, “আমার জন্যে! আমি কী করেছি?”
“তুমি বল্টুকে লাই দিয়ে দিয়ে এ রকম করেছ।”
“আমি মোটেও লাই দেই নাই। তোমার ছেলে জন্ম থেকে এ রকম। সত্যি কথা বলতে কি, জন্মের আগে থেকে এ রকম …”
রিতু ভুরু কুঁচকে বলল, “মানে?”
“মনে নাই, যখন তোমার পেটের ভেতর ছিল তখন সে কী রকম ঢুসঢাস মারত? ডাক্তার বলল, চৌদ্দ তারিখ ডেট, সে দুই সপ্তাহ আগেই হাজির! সবাই মাথাটা নিচে দিয়ে বের হয়, সে ঠিক করল ঠ্যাং দুটো আগে বের করবে–কী ঝামেলা …”
রিতু মুখ শক্ত করে বলল, “সব তোমার জন্যে। তোমার ক্রোমোজম। তোমার জিনস …”
“আমাকে দোষ দিচ্ছ কেন? আমি কি সবগুলো ক্রোমোজম দিয়েছি? তেইশটা আমার, তেইশটা তোমার। মনে হয়, তোমার জিনস থেকে পেয়েছে।”
“মোটেই না।” রিতু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ করে থেমে গেল। বল্টুর পকেটের দিকে তাকিয়ে তার চোখ দুটো গোল গোল হয়ে গেল, কাঁপা গলায় বলল, “বল্টুর পকেটে কী?”
“কী?”
“কী যেন একটা নড়ছে। ইয়া মাবুদ …”
রাজু ঝুঁকে পড়ে বল্টুর পকেটে হাত দিল। পিছলে তেলতেলে কী একটা জিনিস হাত গলে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল সে কোনোভাবে টেনে সেটাকে বের করে আনল–মোটামুটি নাদুসনুদুস একটা কোলা ব্যাঙ। রিতু একটা চিৎকার দিতে গিয়ে থেমে গেল। কোনোমতে বলল, “ফেলল, ছুঁড়ে ফেলো, ছুঁড়ে ফেলো এক্ষুণি।”
রাজু ইতস্তত করে বলল, “ছুঁড়ে ফেলব? সকালে উঠে যদি খুঁজে না পায়, আবার না কিছু একটা ঝামেলা করে!”
রিতু আর নিজেকে সামলাতে পারল না, চিৎকার করে বলল, “ছুঁড়ে ফেলো বলছি। ছুঁড়ে ফেলো!”
রাজু জানালার কাছে গিয়ে ব্যাঙটাকে বাইরে ছুঁড়ে দেয়, ব্যাঙটা ঘুরতে ঘুরতে থপ করে গিয়ে নিচে কোথাও পড়ল।
রিতু নাক-মুখ কুঁচুকে একবার বল্টুর দিকে, আরেকবার রাজুর দিকে তাকাল, তারপর মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, “সবার সুস্থ স্বাভাবিক বাচ্চা হয়, আর আমার কপাল এ রকম কেন! আমার এ রকম একটা পাগলা বাচ্চা হলো কেন?”
রিতুকে একটু শান্ত করার চেষ্টা করতে করতে রাজু বলল, “তোমার বাচ্চা মোটেও পাগলা না। তোমার বাচ্চা একটু ছটফটে, কৌতূহল একটু বেশি–তোমার বাচ্চা …”
রিতু ঝাটকা মেরে বলল, “মাত্র আট বছর বয়সে ব্যাঙ নিয়ে ঘুমায়। যখন আঠারো বছর বয়স হবে তখন কী নিয়ে ঘুমাবে? মহিষ?”
রাজু বলল, “আ-হা-হা, মহিষ নিয়ে কেন ঘুমাবে! দেখবে, একটু বড় হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
রিতু মাথা ঝাঁকিয়ে দুই হাতের বুড়ো আঙুল তুলে বলল, “কাঁচকলা ঠিক হবে।”
রিতুর গলার স্বরে বলু একটু নড়েচড়ে উঠে বিড়বিড় করে পাশ ফিরে শেীয়।
ঠিক এই সময় বল্টু একটা স্বপ্ন দেখছিল। সারা দিন সে নানা কাজকর্মে ব্যস্ত থাকে, রাতে ঘুমানোর সময় সে সেসব নিয়ে স্বপ্ন দেখে। আজকে সারা দিন সে একটা ব্যাঙ নিয়ে ব্যস্ত ছিল, তাই তার স্বপ্নটা ছিল ব্যাঙ নিয়ে। সে দেখল, হাতে একটা বড় কোলা ব্যাঙ নিয়ে আইনস্টাইনের সাথে কথা বলছে। আইনস্টাইন তাকে জিজ্ঞেস করছেন, “বল্টু, তোমার হাতে এটা কী?”
বল্টু বলল, “একটা ব্যাঙ, আংকেল।”
বল্টু ভেবেছিল, আইনস্টাইন তাকে জিজ্ঞেস করবেন, কেন সে হাতে একটা ব্যাঙ ধরে রেখেছে–কিন্তু সেটা জিজ্ঞেস করলেন না, মাথা নেড়ে নেড়ে বললেন, “গুড। ভেরি গুড।”
“মশারি আমার ভালো লাগে না। সেই জন্যে ঠিক করেছি ব্যাঙটাকে বিছানার ওপর ছেড়ে দেব। রাতে মশা ধরে ধরে খাবে, আমার আর মশারি লাগবে না।”
বল্টুর কথা শুনে আইনস্টাইন খুব খুশি হয়ে মাথা নেড়ে বললেন, “ভেরি গুড আইডিয়া। ফার্স্ট ক্লাস।”
ঠিক এই সময় বল্টু দেখল, তার আম্মু একটা হাতপাখা উল্টো করে ধরে তার দিকে ছুটে আসছে, নিশানা মোটেও ভালো নয়! বল্টু তখন আইনস্টাইনের পিছনে লুকিয়ে বলল, “আংকেল, আপনি আম্মুকে একটু বুঝিয়ে বলেন না, প্লিজ! প্লিজ!”
আইনস্টাইন আম্মুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “ঠিক হয়ে যাবে! সব ঠিক হয়ে যাবে।”
আম্মু পাখার উঁটিটা ওপরে তুলে বলল, “কাঁচকলা ঠিক হবে।”
এ রকম সময়ে স্বপ্নটা কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে গেল। আইনস্টাইনের জায়গায় কোথা থেকে একটা বিশাল যন্ত্র হাজির হলো। সেটা ঝিকঝিক করে শব্দ করে নড়তে থাকে। ব্যাঙটা পুরোপুরি মানুষের গলায় কথা বলতে থাকে। আকাশে বিদ্যুৎ চমকাতে থাকে, আর আম্মু একটা দুধের গ্লাস নিয়ে তার পিছু পিছু ছুটতে থাকে। সব মিলিয়ে একেবারে উল্টাপাল্টা ব্যাপার। স্বপ্ন দেখার সময় কিন্তু কোনো কিছুকেই উল্টাপাল্টা মনে হয় না, সবকিছুকেই মনে হয় সত্যি। বল্টুর মনে হলো, তার আম্মু তাকে ধরে ফেলে যন্ত্রের হাতে তুলে দিয়েছে। যন্ত্রটা তাকে আঁকাচ্ছে, নাড়াচ্ছে, ওপরে-নিচে করছে, পানিতে চুবিয়ে চুবিয়ে তুলছে–সব মিলিয়ে খুবই জটিল অবস্থা!
বল্টু যখন স্বপ্নে এসব ওলট-পালট বিষয় দেখছে, তখন রিতু তাকে ভিজে টাওয়েল দিয়ে ধুয়েমুছে জামাকাপড় খুলে পরিষ্কার করার চেষ্টা করছিল! ব্যাঙ পকেটে নিয়ে বল্টু ঘুমিয়ে পড়বে, সেটা রিতুর জন্য মেনে নেওয়া সম্ভব নয়।
যে জিনিসটা রিতু আর রাজু জানে না, বল্টুও জানে না, সেটা হচ্ছে যে বল্টুর বয়স মাত্র আট হলে কী হবে, সে একেবারে খাঁটি সায়েন্টিস্ট। ব্যাপারটা এক দিনে হয় নি, ধীরে ধীরে হয়েছে। এর জন্য দায়ী রিতু আর রাজু। দুজনই, যদিও তারা কেউ সেটা জানে না।
ছোট বাচ্চা যখন একটু বড় হয় তখনই তারা প্রশ্ন করা শুরু করে, বেশির ভাগ বাবা-মা দু-একটা প্রশ্নের উত্তর দিয়ে ত্যক্তবিরক্ত হয়ে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া বন্ধ করে দেয়। তার পরও যদি বাচ্চা কোনো প্রশ্ন করে তখন তারা তাদের একটা রাম-ধমক দেয়–দুয়েকটা রাম-ধমক খেয়ে বাচ্চা প্রশ্ন করা বন্ধ করে দেয়। রিতু আর রাজু কখনোই সেটা করে নি, বল্টু যা প্রশ্ন করেছে তারা তার উত্তর দিয়েছে।
যখন ছোট ছিল তখন প্রশ্ন আর উত্তরগুলো ছিল এ রকম :
বল্টু : (দেয়ালে একটা টিকটিকি দেখিয়ে) আব্বু।
রাজু : কী, বাবা?
বল্টু : ওইটা কী?
রাজু : ওইটা হচ্ছে টিকটিকি।
বল্টু : কেন আব্বু?
রাজু : এটা তো টিকটিক করে ডাকে, সেই জন্যে এটার নাম টিকটিকি।
বল্টু : কেন এটা টিকটিক করে ডাকে?
রাজু : তা না হলে কেমন করে ডাকবে? হাম্বা করে তো ডাকতে পারে, কারণ গরু ডাকে হাম্বা করে। ম্যা ম্যা করে ডাকতে পারে না কারণ ছাগল ডাকে ম্যা ম্যা করে। ঘেউঘেউ করেও ডাকতে পারে না, কারণ কুকুর। ডাকে ঘেউঘেউ করে। মিউমিউ করেও ডাকতে পারে না, কারণ বিড়াল ডাকে মিউমিউ করে। তাই এটা ডাকে টিকটিক করে।
বল্টু : (আনন্দে হাততালি দিয়ে গরু কেমন করে ডাকে, আব্বু?
রাজু : (গরুর ডাকের অনুকরণ করে) হাম্বা …
বল্টু : ছাগল কেমন করে ডাকে, আব্বু?
রাজু : ম্যা … ম্যা …
বল্টু : কুকুর কেমন করে ডাকে, আব্বু?
রাজু : ঘেউঘেউ ঘেউঘেউ …
বল্টু তখন পৃথিবীর যত প্রাণীর নাম জানে সবগুলোর নাম একটা একটা করে বলতে থাকে। রাজুকেও তার ডাক শোনাতে হয়। প্রশ্ন করার ব্যাপারে বল্টুর কোনো ক্লান্তি নেই আর তার উত্তর দিতেও রাজু কিংবা রিতুর ধৈর্যের কোনো সীমা নেই।
.
বল্টু যখন আরেকটু বড় হলো তখন তার প্রশ্নগুলো হলো এ রকম :
বল্টু : (আবার সেই টিকটিকি দেখিয়ে) আম্মু, টিকটিকি দেওয়াল থেকে পড়ে যায় না কেন?
রিতু : টিকটিকির পাগুলো খুব স্পেশাল। বইয়ের পাতার মতন ভাঁজ ভাঁজ থাকে, চাপ দিয়ে দেওয়ালে আটকে ফেলতে পারে!
বল্টু : আমাদের পা এরকম হলো না কেন? তাহলে তো আমরাও দেওয়ালে ঝুলে থাকতে পারতাম!
রিতু : টিকটিকির পোকা ধরে খাওয়ার জন্যে দেওয়ালে ঝুলে থাকতে হয়, তোর কি পোকা খাওয়ার দরকার আছে? তোকে ডাইনিং টেবিলে ভাত দেই না?
বল্টু : কিন্তু দেওয়ালে ঝুলে থাকার একটা মজা আছে না!
রিতু : মানুষের মাথায় আছে বুদ্ধি, তারা যদি দেওয়ালে ঝুলে থাকতে চায় সেটা করবে বুদ্ধি দিয়ে। সাপ ব্যাঙ টিকটিকি ওদের তো আর মানুষের মতো বুদ্ধি নাই, তাই ওদের শরীরে ব্যবস্থা করে দেওয়া থাকে!
কথাটা মনে হয় বল্টু খুব গুরুত্ব দিয়ে নিয়েছিল। বুদ্ধি খাঁটিয়ে দেওয়ালে আটকে থাকার জন্য সে সেদিন দুপুরবেলায় ড্রইংরুমের ছবির একটা ফ্রেম ধরে ঝুলে থাকার চেষ্টা করল। ফ্রেম খুলে পড়ে কাঁচ ভেঙে একটা রক্তারক্তি অবস্থা। এটা ছিল বৈজ্ঞানিক কাজকর্ম করতে গিয়ে তার প্রথম অঘটন।
বল্টু যখন আরেকটু বড় হলো তখন তার প্রশ্নগুলো হলো এ রকম :
বল্টু : (তার হাতে টিকটিকির খসে যাওয়া একটা লেজ) আব্লু, আব্বু, দেখো, দেখো।
রাজু : কী দেখব? বল্টু; এই দেখো টিকটিকির লেজ। লেজটা নড়ছে!
রাজু : টিকটিকির লেজটা তুই কোথায় পেলি?
বল্টু : একটা শার্ট গুটি পাকিয়ে দেওয়ালে টিকটিকির ওপরে ছুঁড়ে দিয়েছি, সেটা যখন নিচে পড়েছে তখন সেটাকে ধরতে গিয়েছি, লেজটা খসে গেছে!
রাজু : কাজটা কি ঠিক হলো? তোর যদি একটা লেজ থাকত, সেটা যদি কেউ খসিয়ে ফেলত তাহলে তোর কি ভালো লাগত?
বল্টু : আমি তো ইচ্ছা করে খসাই নাই! একটু দেখতে গিয়েছিলাম আর লেজটা খসে গেল! কেন খসে গেল, আব্বু?
রাজু : এই যে খসে যাওয়া লেজ নিয়ে তুই এত ব্যস্ত হয়ে আছিস, আর সেই ফাঁকে টিকটিকি তার জান নিয়ে পালিয়ে গেছে, সেটাই হচ্ছে কারণ। শত্রুকে ব্যস্ত রাখার জন্যে টিকটিকি তার লেজ খসিয়ে চলে যায়!
বল্টু : কিন্তু আব্বু, টিকটিকিটাই তো নাই–এই এখন লেজটা নাড়াচ্ছে
রাজু : নিজে নিজেই নড়ছে। লেজের ভেতরে ব্যবস্থা করে দেওয়া আছে!
বল্টুদের বাসায় অনেক টিকটিকি, রাজু আর রিতু আবিষ্কার করল, কদিনের ভেতরেই কোনো টিকটিকির পিছনে কোনো লেজ নেই। বল্টুকে জিজ্ঞাসাবাদ করে একটা ছোট কৌটার ভেতর থেকে টিকটিকির খসে যাওয়া লেজগুলো উদ্ধার করা হয়েছিল।
কিছুদিনের ভেতরেই টিকটিকিগুলোর লেজ গজাতে শুরু করল, তখন বল্টুর প্রশ্নগুলো হলো এ রকম :
বল্টু : আম্মু, তুমি একটা জিনিস জানো?
রিতু : কী?
বল্টু : টিকটিকির লেজ খসে যাওয়ার পর যে লেজটা ওঠে, সেটা টেনে আলাদা করা যায় না।
রিতু : (চোখ কপালে তুলে) তুই কেমন করে জানিস!
বল্টু : আমি টেনে দেখেছি আম্মু। খুব টাইট।
রিতু : কী সর্বনাশা কথা! তুই টিকটিকি ধরে তার লেজ টেনে টেনে দেখছিস?
বল্টু : (অধৈর্য হয়ে) আম্মু, আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করতে এসেছি আর তুমি প্রশ্নটাই করতে দিচ্ছ না!
রিতু : (চোখ পাকিয়ে) কী প্রশ্ন?
বল্টু : টিকটিকির লেজ এমনিতে বেশ শক্ত, কিন্তু পড়ে যাওয়ার পর যেটা বের হয় সেটা অনেক লুতুপুতু নরম! কেন আম্মু?
রিতু : তুই কেমন করে জানিস?
বল্টু : আমি টিপে টিপে দেখেছি।
রিতু : (চিৎকার করে) তুই টিকটিকি ধরে তার লেজ টিপে টিপে দেখছিস?
বল্টু : (আরও অধৈর্য) আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করলাম আর তুমি উল্টা আমাকে প্রশ্ন করছ? বলো, কেন টিকটিকির দুই নম্বর লেজটা তুলতুলে নরম?
রিতু : (অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে তার কারণ টিকটিকির দুই নম্বর লেজের ভেতরে কোনো হাড় থাকে না। হাড় থাকে এক নম্বর লেজে।
উত্তর শুনে বল্টুর চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। সে আনন্দে হাতে কিল দেয়। তার বয়সী একটা ছেলে একটা খেলনা পেলে যেটুকু খুশি হয়, বল্টু প্রায় সে রকম খুশি হয় তার কোনো একটা প্রশ্নের উত্তর পেলে।
.
এটা হচ্ছে শুধু টিকটিকি নিয়ে বল্টুর প্রশ্ন করার উদাহরণ। বল্টুর আশপাশে তো শুধু টিকটিকি নেই; ব্যাঙ আছে, তেলাপোকা আছে, ইঁদুর আছে, পিপড়া আছে, ফড়িং আছে, মাকড়সা আছে–সত্যি কথা বলতে কি চারপাশে কী কী আছে সেটা তো আর বলে শেষ করা যাবে না–কাজেই বল্টুর প্রশ্ন শেষ হওয়ার কোনো নিশানাই নেই। প্রশ্নের উত্তর না দিলে বিপদ আরও বেড়ে যায়, কারণ তাহলে সে নিজেই তার উত্তরটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। যেমন একদিন রিতু রান্না করছে–চুলোতে গরম তেল, তার মাঝে বেগুন ছাড়ছে, ঠিক তখন বল্টু জিজ্ঞেস করল, “আম্মু, আগুনে কী কী পোড়ে?”
রিতু হাত দিয়ে ধাক্কা মেরে বল্টুকে পিছনে সরিয়ে বলল, “সবকিছু পোড়ে।”
বল্টু জিজ্ঞেস করল, “তাহলে ডেকচিটা পুড়ছে না কেন?”
“দেখছিস না ডেকচিটা অ্যালুমিনিয়ামের? সেই জন্যে পুড়ছে না।”
“তাহলে সবকিছু পোড়ে না, কিছু কিছু জিনিস পোড়ে?
রিতু একটা বেগুন উদ্ধার করতে করতে বলল, “এখন যা দেখি, বিরক্ত করিস না। দেখছিস না রান্না করছি?”
বল্টু চলে গেল এবং কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা গেল সারা ঘরে ধোঁয়া আর পোড়া গন্ধ। ঠিক ঘরের মাঝখানে খবরের কাগজ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে বল্টু নানারকম জিনিস নিয়ে বসেছে। আগুনে ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিয়ে দেখছে কোনটা পোড়ে আর কোনটা পোড়ে না। তার প্রশ্নের উত্তর না পেলে খাঁটি বিজ্ঞানীর মতো সে হাতে-কলমে পরীক্ষা করে নিয়ে উত্তর বের করে নেয়।
হাতে-কলমে পরীক্ষা করে সে যেসব জিনিস আবিষ্কার করেছে তার তালিকা অনেক লম্বা। সে কোথাও সেগুলো লিখে রাখে নি, কিন্তু যদি লিখে রাখত তাহলে দেখতে এ রকম হতো;
১. দুধ খাওয়ার সময় ঠিক সময়মতো জোরে জোরে হাসতে পারলে দুধটা নাক দিয়ে বের করে ফেলা যায়। তবে হাসি-কান্না-হাঁচি যেটাই চেষ্টা করা যাক, দুধটা কোনোভাবেই কান দিয়ে বের করা সম্ভব নয়।
২. মশার কোনো স্বাদ নেই।
৩. মাছি অত্যন্ত ধুরন্ধর স্বভাবের। তবে একটা মাছি যদি বসে থাকে তাহলে তার ঠিক ওপরে হাততালি দিয়ে মাছিটাকে দুই হাতের মাঝে চ্যাটকা লাগানো সম্ভব।
৪. কাগজের ঠোঙার মধ্যে বাতাস ভরে সেটাকে থাবা দিয়ে ফাটালে বিকট শব্দ হয়। কেউ ঘুমিয়ে থাকলে তার কানের কাছে এই শব্দ করলে তার ঘুম ভাঙে এবং সে খুব রেগে ওঠে।
৫. একটা ছোট মাছ একটা ছোট কৌটার মধ্যে রেখে দিয়ে তিন দিনের মধ্যে পচা গন্ধ তৈরি করা যায়।
৬. বেলুনে বাতাস ভরা থেকে পানি ভরা সোজা। পানি ভরা বেলুন দিয়ে বড় মানুষের সঙ্গে খেলা ঠিক নয়–বিশেষ করে তারা যদি সেজেগুজে থাকে।
৭. একটা ডিম খাড়াভাবে ফেললে ফাটে না, এটা সত্যি নয়। ডিম ফাটে।
৮. ম্যাগনিফাইং গ্লাস জানালায় রেখে দিয়ে পর্দায় আগুন লাগানো সম্ভব।
৯. মাকড়সার পিছন থেকে টেনে টেনে অনেক সুতা বের করা যায়।
১০, ইঁদুরের বাচ্চাকে ফ্রিজে রেখে দিলে সেটা কাবু হয়ে যায়।
এ তালিকা অবশ্য আরও অনেক লম্বা এবং প্রতিদিনই আরও লম্বা হচ্ছে, কাজেই পুরোটা কোনো দিনই কারও পক্ষে জানানো সম্ভব নয়।
পৃথিবীর নানা রকম প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার জন্য সে যে শুধু তার বাবা মাকে প্রশ্ন করে আর হাতে-কলমে পরীক্ষা করে দেখে সেটা সত্যি নয়, সে খাঁটি বিজ্ঞানীর মতো অনেক পড়াশোনা করে। সে পড়তে শিখেছে যখন তার বয়স চার। রিতু যদি জানত এ রকম একটা অঘটন ঘটবে, তাহলে সে কোনো দিনও এটা ঘটতে দিত না! বল্টু যখন ছোট তখন তাকে শান্ত রাখা খুব কঠিন ব্যাপার ছিল। রিতু আবিষ্কার করল, তাকে গল্প শোনালে সে চোখ বড় বড় করে মুগ্ধ হয়ে গল্প শোনে। বানিয়ে বানিয়ে গল্প শোনাতে শোনাতে এক সময় রিতুর রসদ ফুরিয়ে গেল। তখন সে বল্টুকে বই থেকে গল্প পড়ে শোনাতে শুরু করল, আর সেটাই হলো সর্বনাশ। বইয়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে গল্পটা শুনতে শুনতে কীভাবে কীভাবে জানি বল্টু পড়া শিখে গেল, সে কোনো অক্ষর চেনে না কিন্তু পড়তে পারে। এর থেকে বিচিত্র ব্যাপার আর কী হতে পারে?
প্রথম প্রথম রিতু আর রাজু ব্যাপারটা নিয়ে বেশ খুশিই ছিল–এত ছোট ছেলে পড়তে শিখে গেছে, বাবা-মা খুশি হতেই পারে। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যে তাদের খুশিটা উবে যেতে শুরু করল, বল্টু পড়তে পারে সে রকম বইগুলো শেষ করেই সে বড় বড় বই পড়া শুরু করল, তখন প্রতি মুহূর্তে একবার এসে একটা শব্দের অর্থ জিজ্ঞেস করে যায়। মর্কট, চন্দ্র, কুণ্ডলী–এ রকম শব্দের অর্থ চার বছরের ছেলেকে বুঝিয়ে দেওয়া যায়, কিন্তু সে যখন এসে ‘নান্দনিক’, ‘অপরাধবোধ’ কিংবা ‘অভিমান’ শব্দের অর্থ বুঝতে চায় তখন রিতু-রাজুর বারোটা বেজে যায়।
বল্টুর বয়স এখন আট। স্কুলে ক্লাস থ্রিতে পড়ে, তবে চার বছর থেকে। বইপড়া শুরু করায় ক্লাস থ্রির অন্য যে কোনো ছেলে থেকে একশ গুণ বেশি বই পড়ে এসেছে। রিতু আর রাজু মোটামুটি নিঃসন্দেহ হয়ে গেছে, বল্টু এমন কিছু বই পড়ে বসে আছে যে বই তার মোটেও পড়া উচিত হয় নি। আর সে বইগুলো পড়ে তার এমন কিছু জ্ঞান হয়ে আছে, যে জ্ঞান এই বয়সের একটা ছেলের থাকার কথা নয়! যেমন সে বই পড়ে শিখেছে, পৃথিবীর যে কোনো জিনিস যদি ভাঙা যায় তাহলে শেষ পর্যন্ত সেটা প্রথমে অণু, তারপর পরমাণুতে ভাগ হয়ে যাবে। এটা শেখার পর অনেক দিন সে একটা বিশাল হাতুড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াত, হাতের কাছে যেটাই পেত সেটাকেই হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে গুঁড়ো গুঁড়ো করে ভেতর থেকে অণু-পরমাণু বের করার চেষ্টা করত!
একদিন বল্টুর জ্বর হয়েছে, তার বয়সী অন্য ছেলেমেয়ে জ্বরে কাবু হয়ে শুয়ে থাকার কথা, বল্টু মোটেই কাবু হলো না। জ্বলজ্বলে চোখে বিছানায় সোজা হয়ে বসে রইল। একটু পরে দেখা গেল শরীরের এখানে-সেখানে ধরে নিজেকেই নিজে চিমটি কাটছে। রিতু অবাক হয়ে বলল, “বল্টু, কী হয়েছে, চিমটি কাটছিস কেন?
“জ্বর হয়েছে তো, তাই।”
রিতু আরও অবাক হয়ে বলল, “জ্বর হলে চিমটি কাটতে হয়?”
১৮
বল্টু গম্ভীর মুখে বলল, “জ্বর কেমন করে হয় জানো না?”
“কেমন করে?”
“ব্যাকটেরিয়া নাহয় ভাইরাস দিয়ে। আমার শরীরে এখন ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাস কিলবিল করছে। তাই টিপে টিপে মারছি।” এই বলে বলু আবার তার ঘাড়ের চামড়া, পেটের চামড়া টিপে ধরতে লাগল।
রিতু চোখ কপালে তুলে বলল, “তুই এভাবে টিপে টিপে ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাস মারতে পারবি?”
“কেন পারব না?”
“এগুলো কত ছোট জানিস?”
“জানি। ছোট জিনিস মারা অনেক সহজ।”
“তাই?”
“হ্যাঁ, তুমি এক কাজ করো, আম্মু।”
“কী কাজ?”
“পাখার উঁটিটা সোজা করে ধরো। আমি একটা হাঁচি দেব …”
“হাচি দিবি?”
“হ্যাঁ। যখন হাঁচি দেব তখন আমার নাক-মুখ দিয়ে লাখ লাখ ব্যাকটেরিয়া নাহয় ভাইরাস বের হয়ে আসবে। তখন তুমি পাখার উঁটি দিয়ে পিটিয়ে সবগুলো মেরে ফেলবে। পারবে না?”
রিতু বলল, “এইভাবে ব্যাকটেরিয়া মারা যায় না।”
বল্টু জ্বলজ্বলে চোখে তর্ক শুরু করে দিল, “তুমি কেমন করে জানো মারা যায় না? একশবার মারা যায়। তুমি মার।”
বল্টু একটি হাঁচি দিল আর রিতুকে সামনে দাঁড়িয়ে পাখার উঁটি দিয়ে ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাস পিটিয়ে মারতে হলো।
খুব অল্প কথায় এই হচ্ছে বল্টু।