০১. বংশ-পরিচয়

প্রথম খণ্ড – পটভূমি

অধ্যায় এক – বংশ-পরিচয়

. জন্মস্থান

পাঠকগণ, ভুল বুঝিবেন না। এ বংশ-পরিচয় মানে কোনো ডাইনেটি বা শরিফ খান্দানের কুরসিনামা বা বংশলতা নয়। এ বংশ-পরিচয় পাড়াগাঁয়ের একটি সাধারণ নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কৃষক-পরিবারের অতি সাধারণ জীবনমানের ও দিনযাপনের সুখ-দুঃখের কথা। বর্তমান লেখক এমনই একটি কৃষক-পরিবারের সন্তান। সেজন্য তার আত্মজীবনী লেখার মধ্যে তার বংশের এবং আত্মীয়-স্বজনের কথা অমনি আসিয়া পড়ে। সব আত্মজীবনী-লেখকের বেলাতেই এটা সত্য। দুনিয়ার সব দেশের সর্ব শ্রেণীর আত্মজীবনী লেখকেরাই যে নিজেদের বংশ-পরিচয় দিয়া আত্মজীবনী শুরু করিয়াছেন, সেটা এই কারণেই। আত্মজীবনীকার অভিজাত বংশের সন্তানই হউন, আর সমাজের নিচের তলার সাধারণ মানুষের সন্তানই হউন, সবাই একই ধরনের বাপ-মার ঘরেই জন্মগ্রহণ করিয়াছেন। নিতান্ত এতিম না হইলে বাপ-মার সংসার ও পরিবেশেই তিনি লালিত-পালিতও হইয়াছেন। অভিজাত বংশের সন্তান ও কৃষক-শ্রমিক বংশের সন্তানের মধ্যে সাধারণত গর্ব-অহংকার ও লজ্জা-সংকোচের যে একটা কমপ্লেক্স থাকা খুবই স্বাভাবিক, আত্মজীবনী লেখার অধিকারীদের অধিকাংশের মধ্যে ঐ বয়সে তেমন কোনো কমপ্লেক্স আর থাকে না। কৌলীন্যবোধ ও হীনম্মন্যতার উর্ধ্বে যারা উঠিতে পারেন, সাধারণত তাঁদের মধ্যেই আত্মজীবনী লেখার অধিকার ও ইচ্ছার উন্মেষ লাভ ঘটে। যে বয়সে আত্মজীবনী লেখার অধিকার ও বাসনা জন্মে, সেটা প্রায় জীবন-সন্ধ্যা। সে বয়সে বংশের উচ্চতা ও নীচতার কথা চিন্তা করার মত মনের অবস্থা অনেকেরই থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে তারা হন নিজেরাই এক একটি বংশের প্রতিষ্ঠাতা।

তাছাড়া প্রকৃত আত্মজীবনী শুধু একটি ব্যক্তির জীবনকথা নয়। আমার মত নগণ্য ব্যক্তির ত নয়ই। আত্মজীবনী-লেখক যে শ্রেণীর লোকই হউন না কেন, তার জীবনকথা মানেই তার শৈশবের পরিবেশের কথা। বংশ ও পরিবারের পরিবেশটাই ব্যক্তি-জীবনে সবচেয়ে গুরুতর প্রভাবশালী পরিবেশ। এ বিষয়ে আমি এই পুস্তকের ভূমিকায় আরো বিস্তৃত আলোচনা করিয়াছি। এখানে এইটুকুর উল্লেখই যথেষ্ট যে, ভূমিকায় যে ব্যক্তিত্ব, শখছিয়াত বা পার্সনালিটির কথা বলিয়াছি, তার অর্ধেক বাপ-মা পূর্বপুরুষের উত্তরাধিকার, আর অর্ধেক পরিবেশের দান। কাজেই ব্যক্তিমাত্রেই পিতৃ-পুরুষ ও পরিবেশের নিকট সমভাবে ঋণী–সে ঋণের আনুপাতিক হার যা-ই হোক না কেন। কাজেই আত্মজীবনী বুঝিতে হইলে যার জীবনী সে ব্যক্তিটিকে বুঝিতে হইবে। ব্যক্তিটিকে বুঝিতে হইলে ঐ দুইটিও বুঝা দরকার। তাই সবাই এ কাজটা করেন। আমিও করিলাম।

ময়মনসিংহ জিলা। ত্রিশাল থানা। ধানীখোলা গ্রাম। এই গ্রামই আমার জন্মভূমি। বর্তমানে এটা বিশাল গ্রাম, একই গ্রামেই একটা ইউনিয়ন। ধানীখোলার উত্তরে গোপাল নগর, দক্ষিণে ত্রিশাল, পূর্বে বৈলর ও পশ্চিমে রাধাকানাই। এই চারটা গ্রামও এক-একটি ইউনিয়ন। এই চৌহদ্দির মধ্যে ধানীখোলা ইউনিয়নের আয়তন কমবেশি পঁচিশ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা প্রায় বিশ হাজার। দুইটি নদী। একটির নাম সুতোয়া। অপরটির নাম নাগুয়া। সুতোয়াই বড়। বেগুনবাড়ি রেলস্টেশনের নিকট ব্ৰহ্মপুত্র হইতে বাহির হইয়াছে। ধানীখোলার পূর্ব সীমার আগাগোড়াই এই নদী। দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হইয়া অন্য নদীর সহিত মিশিয়া অবশেষে শীতলক্ষ্যাতে পড়িয়াছে। এই দৈর্ঘ্যে ইহার উভয় তীরে বহু বাজার-বন্দর আছে। কিন্তু শুধু সুতোয়া নামেই ইহার দৈর্ঘ্য বিশ মাইলের বেশি। আমাদের ছেলেবেলা এই নদীতে বছরের বার মাস বড় বড় নৌকা চলিত। তার মধ্যে পাঁচ শ মণ হইতে হাজার মণের পালওয়ালা নৌকাও অনেক থাকিত। এখন এই নদীর উপর চারটা পাকা ব্রিজ হইয়া যাওয়াতে আগের মত বড় নৌকার আর যাতায়াত নাই।

অপর পক্ষে নাগুয়া খুব ছোট নদী। উত্তর দিকে ধলি বিল নামক একটি বিল হইতে বাহির হইয়া ধানীখোলাকে উত্তর-দক্ষিণে সমান দুই ভাগে ভাগ করিয়া ক্ষীরো নদীতে পড়িয়াছে। ইহার দৈর্ঘ্য দশ মাইলের বেশি হইবে না। আমাদের ছেলেবেলায় এই নদীতেও বার মাস পানি থাকিত। মালবাহী নৌকাও চলাচল করিত। এখন অনেক জায়গাতেই তীরবর্তী সব গাছপালা কাটিয়া ফেলায় এবং নদীর ঢালুতে ফসলাদি আবাদ শুরু হওয়ায় নদীটি অতিশয় ক্ষীণ হইয়া পড়িয়াছে।

ধানীখোলা গ্রামে মৌযার সংখ্যা বাইশটি। একই গ্রামে দুইটা হাই স্কুল, দুইটা মাইনর স্কুল ও ছয়টি প্রাইমারি স্কুল আছে। এছাড়া একটি ডাক্তারখানা, সরকারি কৃষি ফার্ম, কমিউনিটি সেন্টার, মিলন সমাজ, পাবলিক পাঠাগার, তাঁতের স্কুল, তহসিল কাছারি, বাজার ও পোস্টাফিস আছে।

কিন্তু এক শ বছর আগে ধানীখোলা এর চেয়েও উন্নত ছিল। এর মর্যাদা আরো উঁচা ছিল। তখন ধানীখোলা ছিল ময়মনসিংহ জিলার পাঁচটি উল্লেখযোগ্য শহরের একটি। এ সম্পর্কে তৎকালীন সরকার প্রকাশিত প্রামাণ্য পুস্তক স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্টস-অব-বেঙ্গলএর উল্লেখ করা যায়। পুস্তকের লেখক বিখ্যাত স্ট্যাটিসটিশিয়ান ও ঐতিহাসিক ডবলিও ডবলিও হান্টার। বইখানা প্রকাশিত হয় ১৮৭৫ ইংরেজি সনে। তার আগের বছর মানে ১৮৭৪ সালের বিবরণ এতে আছে। এই পুস্তকের ৪১৪ পৃষ্ঠায় ময়মনসিংহ জিলার পাঁচটি বৃহত্তম শহর’ এই শিরোনামার যে তালিকা দেওয়া হইয়াছে তাতে যথাক্রমে নাসিরাবাদ, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর ও ধানীখোলার নাম আছে। দেখা যায় অধিবাসী-সংখ্যার ভিত্তিতেই শহরগুলির মান নির্ণীত হইয়াছিল। এই পাঁচটি শহরের মধ্যে নাসিরাবাদ শহর সারা জিলার ও সদর মহকুমার, জামালপুর শহর জামালপুর মহকুমার, কিশোরগঞ্জ শহর কিশোরগঞ্জ মহকুমার হেডকোয়ার্টার ছিল। কেবল শেরপুর ও ধানীখোলাই ছিল বেসরকারি শহর। সরকারি শাসনক্ষেত্রে শহর গড়িয়া উঠা খুবই স্বাভাবিক নিশ্চিত ব্যাপার। কিন্তু বেসরকারি জায়গায় শহর গড়িয়া উঠা কম কথা নয়। হান্টার সাহেবের হিসাবমত দেখা যায়, ঐ সময়ে ধানীখোলা শহরে মোট বাসেন্দা ছিল ছয় হাজার সাত শ ত্রিশ। তার মধ্যে মুসলমান ছিল চার হাজার ছয় শ পঁয়ত্রিশ, হিন্দু ছিল দুই হাজার পঁচানব্বই, খৃষ্টান বা অন্য কোনো ধর্ম সম্প্রদায়ের লোক ধানীখোলায় ছিল না। অধিবাসী সংখ্যা সামান্য নয়। কারণ জিলার হেডকোয়ার্টার নাসিরাবাদ শহরের লোকসংখ্যা ছিল তখন দশ হাজার আটষট্টি জন মাত্র।

এই সময় ময়মনসিংহ জিলার মাত্র চারটি মহকুমা ছিল–সদর, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ ও আটিয়া। বর্তমানের নেত্রকোনা মহকুমা তৎকালে সদর মহকুমার এলাকাভুক্ত ছিল। আটিয়া মহকুমাই পরে টাঙ্গাইল মহকুমা ও আরো পরে টাঙ্গাইল জিলা হয়। আটিয়া শহরই আটিয়া মহকুমার প্রধান নগর ছিল। কিন্তু একটি মহকুমার হেডকোয়ার্টার হইয়াও আটিয়া উল্লেখযোগ্য শহরের তালিকাভুক্ত হইতে পারে নাই। কারণ আটিয়া মহকুমা ও তার হেডকোয়ার্টার স্থাপিত হয় মাত্র ১৮৬৯ সালে। তার আগে পর্যন্ত আটিয়া মহকুমা জামালপুর মহকুমার এলাকাভুক্ত ছিল। জামালপুর মহকুমাই এই জিলার সর্বপ্রথম মহকুমা। এটি স্থাপিত হয় ১৮৪৫ সালে। জামালপুর মহকুমা স্থাপিত হওয়ার আগে পর্যন্ত সারা জিলা নাসিরাবাদ হইতেই শাসিত হইত। নাসিরাবাদ শহরে জিলার হেডকোয়ার্টার স্থাপিত হয় ১৭৬৮ সালে।

হান্টার সাহেবের বর্ণনায় দেখা যায়, তৎকালে এই জিলার ফরাযীদের প্রাধান্য ছিল। এ সম্পর্কে স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাকাউন্টস-অব-বেঙ্গল-এর ৪০৯ পৃষ্ঠায় হান্টার সাহেব লিখিয়াছেন :

In Farazis centre much of the wealth and influence of the district some of its members being large landlords. Many of the poorer of the Farazis were formerly known as sympathisers of the Whabi’s disaffection and a small number went from Mymensingh to the rebel camp beyond our North Western frontiers for the purpose of co-operating with the fanatics of that part of the country.

অর্থাৎ ফরাযীদের হাতেই এখন এ জিলার ধনসম্পদ ও প্রভাবের অনেকখানি কেন্দ্রীভূত। তাদের কয়েকজন বড় বড় জমিদার। ফরাযীদের মধ্যকার অপেক্ষাকৃত গরীব শ্রেণীর অনেকেই ওহাবি বিদ্রোহের সমর্থক ছিল বলিয়া জানা যায়। এদের মধ্যে অল্প কয়েকজন সীমান্তপারের ধর্মান্ধদের সাথে সহযোগিতা করিবার উদ্দেশ্যে ময়মনসিংহ হইতে উত্তর-পশ্চিম পারের বিদ্রোহী শিবিরে যোগ দিয়াছিল।

হান্টার সাহেবের বর্ণিত এই ‘অল্পসংখ্যক লোক আসলে কতজন ছিলেন, তা আজও জানা যায় নাই।

বাংলাদেশের ঐতিহাসিক গবেষকেরা একদিন সে খবর দেশবাসীকে দিতে পারিবেন, তাতে সন্দেহ নাই। ইতিমধ্যে এই অহংকার আমি কিছুতেই গোপন। করিতে পারিতেছ না যে, আমার পূর্বপুরুষের একজন ছিলেন তাঁদের অন্যতম। তিনি ছিলেন আমার দাদাজীর জ্যেষ্ঠ সহোদর গাজী আশেক উল্লা সাহেব।

.

. পূর্বপুরুষ

সম্ভবত ১৮২৭-২৮ সালের কাছাকাছি কোনো এক সময়ে মওলানা সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরেলভীর চার খলিফার অন্যতম মওলানা এনায়েত আলী স্থানীয় খলিফা মওলানা চেরাগ আলীসহ তবলিগ উপলক্ষে ধানীখোলা তশরিফ আনেন। তাদের প্রচারকালে আমার দাদার বাবা আছরউদ্দিন, আমার নানার বাবা মহব্বত উল্লা ও তার বেহাই খোদাবখশ এবং সোনাখালী মৌযার জাবু নামক এক ব্যক্তি, এই চারজন মওলানা সাহেবের হাতে শরা কবুল করেন। এটাকে মুরিদ হওয়া বলা হইত না। কারণ এঁরা পীর-মুরিদির বিরোধী ছিলেন। এই চারজন পূর্বেকার বংশ পদবির স্থলে ফরাযী’ পদবি লাভ করেন। স্বভাবতই সামাজিক ক্রিয়াকলাপে এরা পরস্পরের খুব ঘনিষ্ঠ। হইয়া পড়েন। পরবর্তীকালে মহব্বত উল্লা ফরাযীর পুত্র মেহের উল্লা ফরাযীর এক মেয়েকে আমার বাবা আবদুর রহিম ফরাযী বিবাহ করেন। খোদা বখশ ফরাযীর পুত্র জলিল বখশ ফরাযী মেহের উল্লা ফরাযীর এক বোনকে বিবাহ করেন এবং জাবু ফরাযীর পুত্র আবদুল গফুর ফরাযী আমার দাদার বড় ভাই গাজী আশেক উল্লার মেয়েকে বিবাহ করেন।

যা হোক, মওলানা এনায়েত আলী ও মওলানা চেরাগ আলীর হাতে শরা গ্রহণের সময় আছরউদ্দিন ফরাযীর তিন পুত্র ছিলেন : জ্যেষ্ঠ আশেক উল্লা, মধ্যম আরয উল্লা, কনিষ্ঠ আরমান উল্লা। জ্যেষ্ঠ আশেক উল্লার বয়স তখন অনুমান আঠার-উনিশ। সবেমাত্র মুখ ভরিয়া দাড়ি-মোচ উঠিয়াছে। তিনি তখন। স্থানীয় মাদ্রাসায় পড়িতেন। মওলানাদ্বয়ের প্রেরণায় আশেক উল্লা সাহেব সৈয়দ আহমদ শহীদের মোজাহিদ দলে ভর্তি হন এবং তাঁদের সঙ্গে সরহদ্দে চলিয়া যান। দাদাজী আরমান উল্লার বয়স তখন মাত্র আট-দশ বছর।

এই ঘটনার সময়কাল ১৮২৭-২৮ সাল অনুমান করা হয় এই জন্য যে আমাদের পারিবারিক প্রবাদ মোতাবেক আশেক উল্লা সাহেবের মোজাহিদ বাহিনীতে যোগ দেওয়ার পাঁচ বছর পরেই বালাকোটের যুদ্ধ হয়। বালাকোটের যুদ্ধ হয় ১৮৩১ সালের মে মাসে। বড় ছেলে ইসলামের জন্য জান দিয়া শহীদ হইতে অথবা গাজী হইতে গিয়াছে, এই জন্য আছরউদ্দিন ফরাযীর মর্যাদা প্রতিবেশীদের কাছে এবং আলেম-ওলামাদের কাছে বাড়িয়া যায়। তিনি স্থানীয় ফরাযীদের মাতব্বর হন।

হান্টার সাহেবের কথা অন্তত আমাদের বংশ সম্বন্ধে মাত্র অংশত সত্য। প্রথমত আমাদের পারিবারিক পদবি ফরাযী ছিল সত্য; কিন্তু আমার মুরুব্বিরা কেউ হাজী শরিয়ত উল্লা বা তার পুত্র দুদু মিয়া সাহেবের মুরিদ ফরায়েযী’ ছিলেন না। দ্বিতীয়ত, তারা নিজেদের ওহাবি বলিয়াও স্বীকার করিতেন না। আমার দাদা আশেক উল্লা সাহেব যে মোজাহিদ বাহিনীতে যোগ দিয়াছিলেন, সেটাকেও তারা ওহাবি আন্দোলন বলিয়া মানিতেন না। তৃতীয়ত, আমার দাদা গাজী আশেক উল্লার সাথে এ জিলার আরো যারা জেহাদে গিয়াছিলেন, তাদের কয়েকজনের পরিবারের সাথে পরবর্তীকালে আমাদের বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হইয়াছে। তাঁরা কেউই হাজী শরিয়ত উল্লার ফরায়েযী জমাতের লোক নন। তবে হান্টার সাহেবের উক্ত-মত আমাদের পূর্বপুরুষেরা সত্যিই গরীব কৃষক শ্রেণীর লোক ছিলেন। বস্তুত, আমার শৈশবে মুরুব্বিদের ফরায়েযী’ ও ‘ফরাযী’ শব্দ দুইটার পার্থক্য সম্বন্ধে অতিশয় সচেতন দেখিয়াছি। কেউ তাদের ফরায়েযী’ বলিলে তারা মুখে আপত্তি করিতেন, মনে কষ্ট পাইতেন এবং অনেক সময় চটিয়াও যাইতেন। এই ভুল আমাদের সমাজের বা আত্মীয়-স্বজনদের কেউ করিতেন না। আমাদের স্কুল-মাদ্রাসায় শিক্ষকতা ও মাঠে-মসজিদে ওয়ায-নসিহত করিতে বরিশাল, নোয়াখালী এবং ঢাকা হইতে অনেক আলেম-ওলামা আসিতেন এবং আমাদের বাড়িতে মেহমান হইতেন। ঢাকা হইতে যেসব আলেম আসিতেন, তাঁদের সবাই আমাদের জমাতি ছিলেন। নোয়াখালী হইতে আগত আলেমরা সবাই ছিলেন হানাফি জমাতের। একমাত্র বরিশাল জিলা হইতে আগত আলেমরা আধাআধি হানাফি এবং আধাআধি মোহাম্মদী, মানে আমাদের জমাতের লোক ছিলেন। মোহাম্মদী আলেমদের কেউই আমাদের ‘ফরায়েযী’ বলিতেন না। ফরাযীই বলিতেন। কোনো হানাফি আলেমও আমাদেরে ‘ফরায়েযী’ বলিয়া সম্বোধন করিতেন না। হানাফি আলেমদেরেও আমাদের অঞ্চলে খুবই তাজিম ও সম্মান করা হইত। বস্তুত, আমাদের বাড়ির মাদ্রাসায় শিক্ষকদের বেশির ভাগ হানাফি ছিলেন। তারা আমাদেরে উর্দু-কি পহেলি কিতাব পড়াইবার পরই নামাজ-রোযা-হালাল-হারাম শিখাইবার জন্য রাহে-নাজাত ও মিফতাহুল জান্নাত পড়াইতেন। তবে পড়াইবার সময় তারা তাহরিমা বান্ধা, জোরে আমিন কওয়া, রেকাতে-রেকাতে বসা, রুকুতে নিচা ও উঁচা হওয়ার সময় রফাদায়েন করা ইত্যাদি ব্যাপারে হানাফি মোহাম্মদী মতের পার্থক্য বুঝাইয়া দিতেন। এঁদের মধ্যেই কেউ কেউ প্রথম প্রথম আমাদের পরিবারকে যখন ফরায়েযী পরিবার বলিতেন, তখনই আমার মুরুব্বিরা আপত্তি করিতেন। তর্কও হইত। কিন্তু আমি তখন ওসব কিছুই বুঝিতাম না। তার অনেক পরে আমি যখন শহরের ক্লাস সেভেন-এইটে পড়ি, তখন সিটি স্কুলের আরবি-ফারসি টিচার জনাব মৌ. মাসুম আলী সাহেব আমাদের মেসের সুপারিনটেন্ডেন্ট ছিলেন। তিনিই প্রথম আমাকে এলমা করিয়া ফরায়েযী’ ও ‘ফরাযী’ শব্দ দুইটির পার্থক্য বুঝাইবার চেষ্টা করেন। কারণ তিনি নিজেও একজন ফরাযী ছিলেন। তাকে কেউ ফরায়েযী বলিলে তিনি কঠোর প্রতিবাদ করিতেন। তিনি আরবি ব্যাকরণের বিভিন্ন সংজ্ঞার উল্লেখ করিয়া আমাকে বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। আমি নিজে তখন ফারসি পড়িতাম বলিয়া তার সব কথা বুঝিও নাই, যাও বুঝিয়াছিলাম তাও মনেও নাই সব। তবে যেটুকু মনে আছে এবং বাড়িতে গিয়া যতটুকুতে চাচাজীর অনুমোদন পাইয়াছিলাম তা এই যে ফরিযা’ শব্দটার বহুবচন ফরায়েয হইতে ফরায়েযী’ শব্দটির উৎপত্তি হইয়াছে। কিন্তু ফরাযী’ শব্দটা আসিয়াছে সোজাসুজি ফরয ইতে। বিশেষত ফরায়েযী’ শব্দটা পদবি হিসাবে ব্যবহারের অসুবিধাও ছিল। মুসলমান উত্তরাধিকার আইন মোতাবেক শরিকদের প্রাপ্য অংশের হিসাবকেও ফরায়েয করা বলা হইত জনগণের স্তরেও। সেজন্য ফরায়েযী শব্দটার একাধিক অর্থবোধক বিভ্রান্তির আশঙ্কা ছিল। তাছাড়া হাজী শরিয়তুল্লা সাহেবের অনুসারী ফরায়েযীরা গ্রামে জুম্মা ও ঈদের জমাত করা নাজায়েয মনে করিতেন। অথচ আমাদের জমাতের লোকেরা গ্রামে জুম্মা ও ঈদের নামাজ পড়া অবশ্যকর্তব্য মনে করিতেন। আমাদের বাড়িতেই জুম্মার মসজিদ ছিল। তাতে সারা গায়ের ছেলে-বুড়া জুম্মার নামাজ পড়িতেন। ছেলেবেলায় দেখিয়াছি আশপাশের তিন-চার গাঁয়ের লোকেরা এ অঞ্চলের অন্যতম প্রধান মাতব্বর ইউসুফ আলী মৃধা সাহেবের বাড়ির সামনের বিশাল মাঠে খুব বড় ঈদের জমাতে শামিল হইত। দাদাজীর মুখে শুনিয়াছি তিনি বাপের আমল হইতেই ঐ ঈদগাতেই ঈদের জমাত করিয়া আসিয়াছেন। আজকাল অবশ্য সে ঈদের মাঠ ভাঙ্গিয়া চার-পাঁচটা মাঠ হইয়াছে। যা হোক আমাদের পরিবারের ‘ফরাযী’ পদটি যে হাজী শরিয়তুল্লা-দুদু মিয়া সাহেবদের অনুসারী ফরায়েযী নয়, আশা করি এতেই তা পরিষ্কার হইল। তবে প্রশ্ন। থাকিয়া যায়, আমাদের পরিবারের ফরাযী’ পদবিটি আসিল কোথা হইতে? এ সম্পর্কে কোনো লিখিত দলিল প্রমাণ নাই। সবই দাদাজী ও তার সমবয়সী লোকজন ও তৎকালীন আলেম-ফাযেলদের মুখে শুনা কথা। তাঁদের কথা হইতে বুঝা যায় যে, সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরেলভীর অন্যতম খলিফা মওলানা এনায়েত আলী, মওলানা চেরাগ আলী ও তাদের স্থানীয় সহকর্মী দেলদুয়ারের মওলানা মাহমুদ আলী তরিকায়ে-মেহাম্মদিয়ায় তবলিগ কাজে এই অঞ্চলে আগমন করেন। তারা অনেক সময় আমাদের বাড়িতেই রাত কাটাইতেন। এঁদের প্রচারের ফলেই এ অঞ্চলের লোকেরা ক্রমে-ক্রমে শরা কবুল করেন। শরা কবুল করা মানে ইসলাম গ্রহণ নয়। কারণ আগে হইতেই এ অঞ্চলের বিশেষত ধানীখোলা গ্রামের বিপুল মেজরিটি মুসলমান ছিলেন। কাজেই উপরিউক্ত আলেমরা এ অঞ্চলে ‘শরা’ জারি করিতে আসিতেন, ইসলাম প্রচারে আসিতেন না। তাঁদের প্রচারকালে ধানীখোলা গ্রামের প্রায় আধাআধি লোক কালক্রমে শরা’ কবুল করেন। এঁরা সকলেই মোহাম্মদী জমাতভুক্ত। পরবর্তীকালে ১৮৩১ সালে সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরেলভী ও তাঁর অনেক সহকর্মী এবং খলিফাঁদের কেউ-কেউ বালাকোটের যুদ্ধে শাহাদতবরণ করিলে আহমদ শহীদের পাঁচ খলিফার অন্যতম মওলানা কেরামত আলী জৌনপুরী সাহেব নিজে এবং তার উত্তরাধিকারীদের মধ্যে প্রধান মওলানা আবদুল আউয়াল সাহেবানের তবলিগের ফলে এতদঞ্চলের অনেক মুসলমান শরা কবুল করেন। তবে এঁরা প্রায় সকলেই হানাফি মযহাবভুক্ত।

মওলানা এনায়েত আলী ও মওলানা চেরাগ আলীর তবলিগে এ অঞ্চলের যাঁরা শরা কবুল করিয়াছিলেন, তাঁদেরও সকলের ফরাযী পদবি নাই। তারা আগের মতই শেখ, খা, সর্দার, মণ্ডল, তরফদার, তালুকদার ইত্যাদি পারিবারিক পদবি লইয়াই থাকিতেন। শুধু আমাদের পরিবারেরই ফরাযী’ পদটি আসিল কোথা হইতে? এ অঞ্চল হইতে একমাত্র আমাদের পরিবার থনেই একজন মোজাহিদ বাহিনীতে ভর্তি হইয়াছিলেন, সে কারণেই কি উক্ত আলেমগণ আমাদের পরিবারকেই ‘ফরাযী’ লকব দিয়াছিলেন? তাও নয়। আমাদের পরিবার ছাড়াও এ অঞ্চলে আরো তিন-চার ঘর ‘ফরাযী আছেন, অথচ তাদের পরিবার হইতে কেউ জেহাদে যান নাই।

প্রচলিত প্রবাদ অনুসারে প্রকৃত ব্যাপার এই যে মওলানা এনায়েত আলী ও মওলানা চেরাগ আলী সাহেবদের হাতে ও মওলানা মাহমুদ আলী সাহেবের সাক্ষাতে এ অঞ্চলের যে চারটি পরিবার সর্বপ্রথম শরা কবুল করিয়াছিলেন, শুধু তাদেরেই ফরাযী লকব দেওয়া হইয়াছিল। এই চারি পরিবারের মধ্যেই পরবর্তীকালে বিবাহ-শাদির সম্পর্ক স্থাপিত হইয়াছিল। আমার দাদার পিতা আছরউদ্দিন সাহেবের সাথে একই সময়ে যে তিনজন শরা গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাঁদের একজন মহব্বত উল্লা, দ্বিতীয়জন খোদা বখশ, তৃতীয়জন জাবু। শরা কবুল করিয়া এঁরা যথাক্রমে আছরউদ্দিন ফরাযী, মহব্বত উল্লা ফরাযী, খোদা বখশ ও জাবু ফরাযী নামে পরিচিত হন। আছরউদ্দিন ফরাযীর কনিষ্ঠ পুত্র আরমান উল্লা ফরাযীর জ্যেষ্ঠ পুত্র আমার পিতা আবদুর রহিম ফরাযী সাহেব পরবর্তীকালে মহব্বত উল্লা ফরাযীর পুত্র মেহেরুল্লা ফরাযীর কন্যা মীর জাহান খাতুনকে বিবাহ করেন। ইনিই আমার মা। খোদা বখশ ফরাযীর পুত্র জলিল বখশ ফরাযী আমার নানা মেহেরুল্লা ফরাযীর পিতা মহব্বত উল্লা ফরাযীর এক কন্যাকে বিবাহ করেন। জাবু ফরাযীর জ্যেষ্ঠ পুত্র আবদুল গফুর ফরাযীর নিকট বহুকাল প্রায়, ষাট বছর, পরে গাজী আশেক উল্লা সাহেব তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যাসন্তান ফাতেমা খাতুনকে বিবাহ দেন। এইভাবে গোড়ার চার ফরাযী পরিবারের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপিত হইয়াছিল।

শরা কবুল করিয়া আমার প্রপিতামহ আছরউদ্দিন সাহেব ‘ফরাযী’ হইবার আগে তাদের পারিবারিক পদবি ছিল মাদারী। তাঁর বাবার নাম ছিল ফালু মাদারী। দাদাজীর কথিত মতে তাদের এই পদবি বংশানুক্রমিক। নয় পুরুষের নাম তিনি জানিতেন। গড়গড় করিয়া একদমে নয় পুরুষের নামও বলিতেন। সকলের নাম আজ আমার মনে নাই। কোনো কাগজপত্রেও লেখা নাই। তারা কেউ লেখাপড়া জানিতেন বলিয়া মনে হয় না। দাদাজীর কওয়া এবং তার সমবয়সী বুড়াদের সমর্থিত মাত্র চারটি নাম আমার মনে আছে। তদনুসারে ফালু মাদারীর বাপ ছিলেন কালু মাদারী, তার বাপ ছিলেন ছাবু মাদারী ও তাঁর বাবার নাম লেদু মাদারী। এঁদের ধারাবাহিকতারও গ্যারান্টি আমি দিতে পারিতেছি না। ছেলেবেলার শোনা কথা আশ্চর্য রকম স্মরণ থাকে। এই দাবিতেই নামগুলি বলিতেছি, কিন্তু দাদাজীর কওয়া নয়টি নামের মধ্যে মাত্র চারটির উল্লেখ করিতেছি বলিয়া আমার নিজের মনেও সন্দেহ আছে, পূর্বপুরুষদের পারম্পর্য ঠিকমত উল্লিখিত হইল কি না। তবে তাদের সকলের পদবি যে মাদারী ছিল, তাতে সন্দেহ নাই। মাদারী পদবি ছিল কেন, সে বিষয়ে দাদাজী ও গ্রামের বুড়া মুরুব্বিরা একই কথা বলিতেন। তাই এখানে তার উল্লেখ করিতেছি।

.

. শরা কবুলের আগে

শরা জারি হইবার আগে আমাদের অঞ্চলে মুসলমানদের মধ্যে পীরপূজা, গোরপূজা ইত্যাদি যেসব বেশরা প্রথা প্রচলিত ছিল তার মধ্যে ‘মাদার পূজা’ ছিল প্রধান। এবং এটা বার্ষিক মচ্ছব। হিন্দুদের মহোৎসবেরই এটা অপভ্রংশ নিশ্চয়। পূজা কথাটাও মুসলমানদের মধ্যে সাধারণভাবে প্রচলিত ছিল। কালু গাজীর মত মাদার গাজীও মুসলমানদের কিংবদন্তির ‘হিরো’ ছিলেন। তবে ‘মাদার পূজা’ বা কোনো পূজাতেই কোনো মূর্তিপূজা হইত না।

প্রতিবছর ধান মাড়াই হইবার পরই, সাধারণত মাঘ মাসে এই ‘মাদার পূজার মচ্ছব’ হইত। খুব লম্বা সোজা একটা আস্ত বাঁশ খাড়া করিয়া গাড়া হইত। বাঁশটির আগাগোড়া নিপিস করিয়া চাছিয়া-ছুলিয়া সুন্দর করা হইত। শুধু আগার দু’ একটা কঞ্চি পাতা-সুদ্ধা রাখিয়া দেওয়া হইত। ঐ কঞ্চির নিচেই একগোছা পাট বাঁধা হইত। এই পাটের গোছাটি কোনো বছর মেজেন্টর লাগাইয়া লাল রং করা হইত। কোনো বছর নীল লাগাইয়া নীল রঙা করা হইত। এই রং বদলানোর কোনো ধর্মীয় কারণ ছিল, না একটার অভাবে আরেকটা লাগানো হইত, দাদাজী তা বলিতে পারিতেন না। যা হোক, বাঁশের আগায় ঐ লাল-নীল রঙের একগোছা পাট ঝুলানো হইত এবং বাঁশটির আগাগোড়া চুন-হলুদ ও গোড়ায় হলুদ ও সিন্দুরের ফোঁটা দেওয়া হইত। বাঁশের গোড়ায় অনেকখানি জায়গা জুড়িয়া উঁচা ভিটি বানানো হইত এবং তা লেপিয়া-পুঁছিয়া ফিটফাট করা হইত। তিন দিন ধরিয়া এই বাঁশটি খাড়া থাকিত। এই তিন দিন ধরিয়াই এই বাশ ঘিরিয়া ঢাল-তলোয়ারসহ নাচিয়া কুঁদিয়া ঢোল-ডগর যোগে মাদারের গান, গাজীর গান ও জারিগান গাওয়া হইত। এই তিন দিনই, বিশেষত প্রথম দিন এই বাঁশের চারদিক মেলা বসিত। মেলায় অনেক জিনিস বিকিকিনি হইত।

‘মাদার পূজার’ পুরোহিতকে মাদারী বলা হইত। তিনি ছিলেন গ্রামের ধর্মীয় গুরু। তিনি ছুঁইয়া না দেওয়া পর্যন্ত বাঁশ খাড়া হইত না। তিনি আবার চুঁইয়া না দেওয়া পর্যন্ত বাঁশ নামানো হইত না। মাদার বাঁশ খাড়া করিবার পর মাদারী সাহেব বাঁশের গোড়ায় ভিটিতে লাল রঙের নয়া গামছা পাতিয়া বসিয়া থাকিতেন। দর্শকেরা সেই গামছায় যার-তার নজর দিত। তৎকালে টাকা আধুলির প্রচলন খুব কমই ছিল। অধিকাংশেই কড়ি, আধলা, পয়সা, ডবল পয়সা ও বড়জোর আনী-দুআনী ব্যবহার করিত। মাদারীর নজরেও কাজেই তা-ই ফেলিত। কিন্তু ঐরূপে যে পয়সা জমা হইত, তাতেই মাদারী সাহেবের সম্বৎসর চলিয়া যাইত।

মাদারীর পূজা ও মেলার সুস্পষ্ট চিত্র আমাদের চোখের সামনে তুলিয়া ধরিবার জন্য দাদাজী ওটাকে হিন্দুদের চড়কপূজার সহিত তুলনা করিতেন। তত্ত্বালে আমাদের বাড়ির অদূরেই হিন্দুপাড়া ছিল। প্রতিবৎসর চৈত্র মাসে সংক্রান্তির দিনে তাদের চড়কপূজা হইত। গ্রামের বাজার-সংলগ্ন খোলা মাঠে, তদভাবে চাষের জমিতে পূজা হইত ও মেলা বসিত। খুব লম্বা ও বেশ মোটা। একটা শাল-গজারি কাঠ খাড়া করিয়া গাড়া হইত। তার আগায় থাকিত একটা আড়ি কাঠ। আড়ি কাঠের দুই মাথা হইতে দুইটা মযবুত রশি মাটিতক ঝুলিয়া থাকিত। আড়ি কাঠটা খাড়া কাঠের সঙ্গে এমন কেড়কি কৌশলে লাগানো হইত যে আড়ি কাঠের রশি ধরিয়া খাড়া কাঠের চারপাশে দৌড়াইলে আড়ি কাঠও ভনভন করিয়া ঘুরিত। আমরা যখন দেখিয়াছি, তখন আড়ি কাঠের দুই পাশের রশি ধরিয়া লোকেরা মাটির উপরেই দৌড়াদৌড়ি করিত। কিন্তু আমরা বুড়াদের কাছে শুনিতাম যে আগেরকালে দুইজন লোক ঐ দুই রশি ধরিয়া শূন্যে ঝুলিয়া ঝুলিয়া চড়কগাছের চারিদিকে ঘুরিত। কিন্তু নিজ চক্ষে ওটা আমরা কোথাও কোনো দিন দেখি নাই। যা হোক ঐ চড়কপূজায় পূজা-পালি ছাড়া একটা মেলা বসিত। এই মেলায় চিনি-বাতাসা, খই-মুড়ি চিড়া, কদমা-জিলাপি-মিসরি, বাঁশি ও খেলনা ইত্যাদি ছেলেমেয়ের প্রিয় জিনিস পাওয়া যাইত। এছাড়া দাও, কুড়াল, কোদাল, লাঙলের ঈষ ও ফাল ইত্যাদি কৃষকদের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যাইত। মোট কথা, এই বার্ষিক মেলা সকল দিক দিয়া জাতি-ধর্মনির্বিশেষে ছেলে-বুড়া-পুরুষ-নারী সকলের জন্যই বহু আকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ছিল। দাদাজী আমাদেরে বুঝাইতেন মাদারীর মেলা অবিকল এই রকম ছিল। তিনি বলিতেন, ‘মাদার পূজা’ছিল বেশরা। মুসলমানদের চড়কপূজা। তার বয়স যখন সাত-আট বছর, তখন হইতেই আমাদের বাড়িতে ঐ ‘মাদার পূজা’ও মেলা বসার প্রথা বন্ধ হয়। তিনি বলিতেন যে, ঐ মেলা বন্ধ হওয়ায় প্রথম-প্রথম স্থানীয় হিন্দু-মুসলমান জনসাধারণ অসন্তুষ্ট হইয়াছিল। তাঁর নিজেরও খুবই খারাপ লাগিয়াছিল, তাও তিনি স্বীকার করিতেন।

.

. সামাজিক অনাচার

শরা জারির আগে আমাদের অঞ্চলে মুসলমানদের মধ্যে যেসব আচার ব্যবহার প্রচলিত ছিল, সে সম্বন্ধে দাদাজী ও তার সমবয়সীদের মুখে এইরূপ শুনিয়াছি :

তৎকালে নামাজ-রোযা খুব চালু ছিল না। ওয়াকতিয়া ও জুম্মার নামাজ বড় কেউ পড়িত না। এ অঞ্চলে কোনো মসজিদ বা জুম্মার ঘর ছিল না। বছরে দুইবার ঈদের জমাত হইত বটে, কিন্তু তাতে বড়রাই শামিল হইত। কাজেই জমাতে খুব অল্প লোক হইত। ঈদের মাঠে লোক না হইলেও বাড়ি বাড়ি আমোদ-সামুদ হইত খুব। সাধ্যমত নূতন কাপড়-চোপড় পরিয়া লোকেরা বেদম গান-বাজনা করিত। সারা রাত ঢোলের আওয়াজ পাওয়া যাইত। প্রায়ই বাড়ি-বাড়ি ঢোল-ডগর দেখা যাইত। বা ঈদের গরু কোরবানি কেউ করিত না। কারণ জমিদারদের তরফ হইতে উহা কড়াকড়িভাবে নিষিদ্ধ ছিল। খাশি-বকরি কোরবানি করা চলিত। লোকেরা করিতও তা প্রচুর।

তরুণদের ত কথাই নাই, বয়স্কদেরও সকলে রোযা রাখিত না। যারা রোযা রাখিত, তারাও দিনের বেলায় পানি ও তামাক খাইত। শুধু ভাত খাওয়া হইতে বিরত থাকিত। পানি ও তামাক খাওয়াতে রোযা নষ্ট হইত না, এই বিশ্বাস তাদের ছিল। কারণ পানি তামাক খাইবার সময় তারা রোযাটা একটা চোঙার মধ্যে ভরিয়া রাখিত। কায়দাটা ছিল এই : একদিকে গিরোওয়ালা মোটা বরাক বাশের দুই-একটা চোঙা সব গৃহস্থের বাড়িতেই আজও আছে, আগেও থাকিত। তাতে সারা বছর পুরুষেরা তামাক রাখে। মেয়েরা রাখে লবণ, সজ, গরমমসলা, লাউ-কুমড়ার বিচি ইত্যাদি। আগের কালে এ রকম চোঙার অতিরিক্ত দুই-একটা বাড়ি-বাড়িই থাকিত। রোযার মাসে মাঠে যাইবার সময় এই রকম এক-একটা চোঙা রোযাদাররা সঙ্গে রাখিত। পানি-তামাকের শখ হইলে এই চোঙার খোলা মুখে মুখ লাগাইয়া খুব জোরে দম ছাড়া হইত। মুখ তোলার সঙ্গে সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি গামছা, নেকড়া বা পাটের টিপলা দিয়া চোঙার মুখ কষিয়া বন্ধ করা হইত, যাতে বাতাস বাহির হইয়া না আসে। তারপর আবশ্যকমত পানি-তামাক খাইয়া চোঙাটা আবার মুখের কাছে ধরা হইত। খুব ক্ষিপ্রহস্তে চোঙার ঢিপলাটা খুলিয়া মুখ লাগাইয়া মুখে চুষিয়া চোঙার বন্ধ রোযা মুখে আনা হইত এবং সেঁক গিলিয়া একেবারে পেটের মধ্যে ফেলিয়া দেওয়া হইত। খুব ধার্মিক ভাল মানুষ দু’একজন এমন করাটা পছন্দ করিতেন না বটে, কিন্তু সাধারণভাবে এটাই চালু ছিল।

আছরউদ্দিন ফরাযী ও তার তিনজন সাথি শরা কবুল করার পরেও জনসাধারণের মধ্যে বহুকাল যাবৎ ঐ আচার প্রচলিত ছিল। ঐ চারি বন্ধুর প্রচারে ক্রমে ক্রমে আরো অনেক লোক শরা কবুল করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু সারা গ্রামবাসীর তুলনায় তাঁরা ছিলেন নগণ্য মাইনরিটি।

.

. ধুতি বনাম তহবন্দ

তৎকালে তহবন্দ পরা খুবই শরমের ব্যাপার ছিল। সবাই কাছা দিয়া কাপড় পরিত। শরা জারির আগে ত বটেই, শরা জারির পরেও এটা চালু ছিল। ঈদের জমাতেও লোকেরা কাছা দিয়া ধুতি পরিয়াই যাইত। নামাজের সময় কাছা খুলিতেই হইত। সে কাজটাও নামাজে দাঁড়াইবার আগে তক করিত না। প্রথম প্রথম নামাজের কাতারে বসিবার পর অন্যের আগোচরে চুপি চুপি কাছা খুলিয়া নামাজ শেষ করিয়া কাতার হইতে উঠিবার আগেই আবার কাছা দিয়া ফেলিত। শরম কাটিবার পর অবশ্য নামাজের কাতারে বসিবার আগে ত বটেই, অযু করিবার আগেই কাছা ভোলা চালু হইয়াছিল। পক্ষান্তরে শরা কবুল করিবার পর আছরউদ্দিন ফরাযী ও তাঁর সঙ্গীদের পরিবারের তরুণদের সকলে না হইলেও অন্তত বয়স্করা নামাজ বন্দেগির সময় ছাড়াও চব্বিশ ঘণ্টা তহবন্দ পরিয়া থাকিতেন। এটা নাকি তাঁদের পীরের হুকুম ছিল, শরা কবুলের অন্যতম শর্ত ছিল। সাদা লুঙ্গিকেই আগে তহবন্দ বলা হইত। দাদাজীর আমলে রঙিন লুঙ্গি কেউ দেখেন নাই। রঙিন লুঙ্গির প্রথম প্রচলন হয় বার্মা হইতে। লুঙ্গির প্রচলন হওয়ার আগে পর্যন্ত সকলেই তহবন্দ পরিত। সাড়ে চার হাত লম্বা মার্কিন (অধোলাই লংক্লথ) বা নয়ানসুখ (ধোলাই লংক্লথ) কাপড়ের দুই মাথা একত্র জুড়িয়া সিলাই করিলেই তহবন্দ হইত।

ফরাযীদের জন্য এই তহবন্দ পরা বাধ্যতামূলক ছিল। হান্টার সাহেব এ সম্বন্ধে তাঁর বইয়ের ১৯৫ পৃষ্ঠায় লিখিয়াছেন :

Farazis can be distinguished by their dresses. They do not wear dhuti. He dresses differently from other Musalmans and wraps his dhuti or waiste cloth round his body without crossing it between his legs.

অর্থ : ফরাযীদের তাদের পোপাশাক দেখিয়াই চিনা যায়। অন্যান্য মুসলমানদের থনে তারা ভিন্ন রকমের পোশাক পরে। তারা তাদের ধুতি বা তহবন্দ শরীরের চারিদিকে পঁাচাইয়া পরে, দুই পায়ের ভিতর দিয়া কাপড় পার করায় না অর্থাৎ কাছা দেয় না। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, আজকাল যেমন শুধু পাড়ওয়ালা কাপড়কেই ধুতি বলা হয়, আগের কালের রেওয়াজ তা ছিল। না। কাছা দিয়া কাপড় পরাকেই তখন ধুতি পরা বলা হইত। আজকাল হিন্দুরা ধুতি পরাকেই কাপড় পরা’ বলিয়া থাকেন। তাদের বিচারে প্যান্ট পাজামা পরা আর কাপড় পরা আলাদা ব্যাপার।

আছরউদ্দিন ফরাযী সাহেব ও তার সঙ্গীরা নিজেদের মধ্যে তহবন্দ পরা চালু করিলেও প্রতিবেশীদের মধ্যে তা চালু করিতে পারেন নাই। আছরউদ্দিন সাহেব শুধু মুখে-মুখেই এ বিষয়ে প্রচার করিতেন। কাউকে যবরদস্তি করিতেন না। দাদাজীর কাছে শুনিয়াছি তাঁর বাবা আছরউদ্দিন ফরাযী তার নিতান্ত বাধ্য অনুগত এক লোককে বলিয়া-কহিয়া তহবন্দ পরিতে রাজি করিয়াছিলেন। একদিন তহবন্দ পরিয়াই সে তোক তহবন্দ ফেলিয়া আবার ধুতি পরিয়া আছরউদ্দিন সাহেবের কাছে আসেন এবং মাফ চান। ফরাযী সাহেব তাঁকে তম্বি করিলে জবাবে সে লোক কাঁচুমাচু হইয়া বলেন, তহবন্দ পরিয়া রাস্তা চলিতে আমার ভারি শরম লাগে। কারণ কাছা না দিলে মনে হয় আমি কাপড়ের নিচে ন্যাংটা রহিয়াছি।’ ফরাযী সাহেব হাসিয়া তহবন্দ পরা হইতে তাকে রেহাই দেন।

আছরউদ্দিন সাহেব তহবন্দ পরার তাকিদ করিলে সাধারণত লোকেরা এই ধরনের জবাব দিত, ‘আমরা শরা কবুল করিয়াছি বটে, কিন্তু ফরাযী হই নাই। তহবন্দ পরা শুধু ফরাযীদের কর্তব্য। সব মুসলমানের কর্তব্য নয়। অর্থাৎ জনসাধারণের রায় এই ছিল যে গোড়াতে যে চারজন মওলানা এনায়েত আলী সাহেবের হাতে শরা কবুল করিয়াছিলেন, তাঁরাই ফরাযী এবং তহবন্দ পরা শুধু তাদেরই জন্য বাধ্যতামূলক। যারা পরে ঐ ফরাযীদের হাতে শরা কবুল করিয়াছেন, তাঁরা ফরাযীও নন, তহবন্দ পরাও তাঁদের জন্য বাধ্যতামূলক নয়। শুধু তহবন্দ পরার মত শরমের কাজ এবং কারো-কারো মতে শাস্তি হইতে রেহাই পাইবার আশাতেই জনসাধারণ ফরাযী শব্দের এরূপ সংকীর্ণ ব্যাখ্যা করিয়াছিল, তাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু কালক্রমে এটাই চালু হইয়া গিয়াছিল। এতদঞ্চলে শুধু এই চার পরিবারই ফরাযী বলিয়া পরিচিত। আর কোনো পরিবার এই পারিবারিক পদবি লাভ করে নাই। কোনো বেনামাজি বাবু-কেসেমের লোক হঠাৎ নামাজ ধরিলে, দাড়ি রাখিলে এবং সাদা লুঙ্গি ও লম্বা কোর্তা ধরিলে আজ পর্যন্ত লোকেরা বলাবলি করে, ‘লোকটা একেবারে ফরাযী হইয়া গিয়াছে।’ এতে মনে হয় ফরাযীরা ধর্মে কর্মে চালে-চলনে এবং পোশাক-পাতিতে গোঁড়া মুসলমান, এ ধারণা তকালেও ছিল।

আছরউদ্দিন ফরাযী ও তাঁর সঙ্গীরা তহবন্দ পরার জন্য লোকজনকে পীড়াপীড়ি না করিলেও লোকজনেরা কিন্তু ফরাযী সাহেবদের অত সহজে ছাড়িয়া দেয় নাই। শরমের খাতিরে লোকেরা নিজেরা ত তহবন্দ পরিতই না, অপরে তহবন্দ পরিয়া রাস্তাঘাটে চলাফেরা করিলেও বোধ হয় তাদের শরম লাগিত। কাজেই ফরাযীরাও যাতে তহবন্দ পরিয়া রাস্তাঘাটে চলাফেরা না করেন, তার চেষ্টা তারা সর্বদাই করিত। তহবন্দ পরাকে তারা নানা প্রকার মুখরোচক, অনেক সময় অশ্লীল রসিকতার দ্বারা আক্রমণ করিত। তহবন্দকে তারা কাপড় না বলিয়া ‘চারা গাছের খাঁচা’, ‘বালিশের ওসার’ ইত্যাদি কবিত্বপূর্ণ আখ্যায়িত করিত। ফরাযীরা কাপড়ের নিচে বিলাইর বাচ্চা পোষে’, শুনাইয়া-শুনাইয়া এই ধরনের আশালীন রসিকতাও করিত। অপেক্ষাকৃত মুখপোড়া লোকেরা বলাবলি করিত, ‘অঙ্গবিশেষ বড় হইয়া যাওয়াতেই ফরাযীরা কাছা দিতে পারে না।’

এসব ত গেল মৌখিক যুলুম। এর উপর ছিল শারীরিক যুলুম। এই যুলুমের সুপ্রচলিত একটা ট্যাকটিকস ছিল এইরূপ : খুব লম্বা সরু বাঁশের আগায় কলকাঠি বাধিয়া লোকেরা রাস্তার ধারের ঝোপে-জঙ্গলে বসিয়া থাকিত। কোনো তহবন্দ-পরা ফরাযী ঐ রাস্তায় চলিবার সময় পিছন হইতে ঐ কলকাঠি তহবন্দের নিচের পারে আটকাইয়া হেঁচকা টান মারা হইত। তাতে ফরাযী সাহেব একেবারে উলঙ্গ হইয়া পরিতেন। দুষ্কৃতকারীরা অট্টহাস্য করিতে করিতে জঙ্গলে লুকাইয়া পড়িত। এসব কথা গ্রামের মাতব্বরদের কানে গেলে তারা বলিতেন যে দুষ্ট ছেলেরাই এসব অন্যায় কাজ করিয়া থাকে, তাদেরে শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা হইবে। কিন্তু কোনো দুষ্ট ছেলেই শাস্তি পাইত না। কাজেই বুঝা যাইত, তলে তলে মুরুব্বিদের সমর্থনেই দুষ্ট ছেলেরা এসব দুষ্টামি করিতেছে। স্বয়ং আছরউদ্দিন ফরাযী সাহেবকেও অনেক সময় এসব যুলুমের শিকার হইতে হইয়াছে। কাজেই ফরাযীরা সাবধানতা হিসাবে কোমরে গিরো দিয়া তহবন্দ পরিতে লাগিলেন। গিরো দিয়া তহবন্দ পরায় অতঃপর উলঙ্গ হইয়া পড়ার লজ্জা হইতে তাঁরা রক্ষা পাইলেন বটে কিন্তু কলকাঠির টানে তাদের তহবন্দ ফাঁড়িয়া যাইতে লাগিল। এতেই বোধ হয় দুষ্কৃতকারীদের প্রাণে দয়া হইল। কারণ ফরাযীদের লজ্জা দিয়া তহবন্দ ছাড়ানোই তাদের উদ্দেশ্য ছিল। তহবন্দ ছিঁড়িয়া তাঁদের লোকসান করা তাদের উদ্দেশ্য ছিল না।

.

. গাজী সাহেবের প্রত্যাবর্তন

দাদাজীর বয়স তখন চল্লিশের কাছাকাছি। সেটা গদর বা সিপাহী বিদ্রোহের মুদ্দত। ঐ সময়ে একদিন গ্রামের উত্তরপাড়ার কয়েকজন তোক একটি কাবুলি পোশাক পরা লোককে আমাদের বাড়িতে নিয়া আসেন। উনিই দাদাজীর বড় ভাই আশেক উল্লা সাহেব। প্রায় ত্রিশ বৎসর আগে তিনি দেশ ছাড়িয়াছিলেন। এই ত্রিশ বৎসরে তিনি কোনো প্রকার চিঠিপত্র বা খবর-বার্তা দেন নাই। গিয়াছিলেন সবেমাত্র দাড়ি-গোঁফ-গজানো তরুণ। আসিয়াছেন কাঁচা-পাকা চাপ দাড়িওয়ালা আধবুড়া মানুষ। কাজেই বড় ভাইকে চিনা দাদাজীর পক্ষে কঠিন হইয়াছিল। সঙ্গে আসা লোকজনেরা যা বলিয়াছিলেন তা এই : ঐ কাবুলি মার্কা লোকটাকে তাঁরা তাঁদের বাড়ির আশপাশে ঘোরাফেরা করিতে দেখেন। কৌতূহলী হইয়া তাঁরা কাছে যাইয়া পরিচয় জিজ্ঞাসা করেন। লোকটি দুর্বোধ্য ভাষায় যা বলেন, সেসব কথার মধ্যে আছরউদ্দিন, আরমান উল্লা, আশেক উল্লা এই তিনটি নাম তাঁরা বুঝিতে পারেন। তাতেই পাড়ার মুরুব্বিদের মনে পড়ে আছরউদ্দিন ফরাযীর জেহাদে যাওয়া ছেলের কথা। আছরউদ্দিন ফরাযীর বড় ছেলে জেহাদে গিয়াছেন, এ কথা এই অঞ্চলে বয়োজ্যেষ্ঠ সকলেরই জানা ছিল। তিনি যখন জেহাদে যান, তখন আছরউদ্দিন ফরাযী সাহেবের বাড়ি উত্তরপাড়া মৌযাতেই ছিল। তারপর তিনি দক্ষিণ দিকে প্রায় আধমাইল দূরে অন্য মৌযায় আসিয়া বাড়ি করেন। এটাই আমাদের বর্তমান বাড়ি। আশেক উল্লা সাহেব স্বভাবতই তা জানিতেন না। সুদূর অতীত বাল্যের স্মৃতির বলেই তিনি সাবেক পৈতৃক ভিটাতে নিজেদের বাড়ি তালাশ করিতেছিলেন।

ইতিমধ্যে আছরউদ্দিন ফরাযী নিজে, তাঁর স্ত্রী এবং দ্বিতীয় পুত্র আরজ উল্লা এন্তেকাল করিয়াছেন। আরজ উল্লা বিবাহের আগেই মারা যান। কাজেই এই সময় ফরাযী বাড়িতে কেবল আমার দাদা আরমান উল্লা, তার স্ত্রী বিবি মহরম, আয়েযুননেছা নামে আট-দশ বছরের এক মেয়ে এবং আবদুর রহিম নামে দুই-এক বছরের একটি ছেলে। বহুদিন পরে পাওয়া বড় ভাইকে আমার দাদাজী আরমান উল্লা অতি আদরে গ্রহণ করিলেন। প্রতিবেশীদের সহায়তায় বাড়ির ভিতরে তার থাকিবার ঘর করিয়া দিলেন।

আশেক উল্লা সাহেব প্রায় ত্রিশ-বত্রিশ বছর বিদেশ থাকিয়া মাতৃভাষা একরকম ভুলিয়াই গিয়াছিলেন। শোনা যায়, তিনি আরবি-ফারসি-উর্দুতে খুব ব্যুৎপত্তি লাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু দাদাজীর নিকট হইতে এ বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য খবর সংগ্রহ করা সম্ভব ছিল না। দাদাজী নিজে লেখাপড়া জানিতেন না। আমাদের এক আত্মীয় ছিলেন কারী ময়েযুদ্দিন সাহেব। তিনি গাজী সাহেবের সাথে অনেক দিন কাটাইয়াছিলেন। তাঁর মুখে শুনিয়াছি, তিনি গাজী সাহেবের নিত্য সহচর ছিলেন। ধানীখোলা গ্রামের মৈশাটিকি মৌযার মুনশী আজিম উদ্দিন সাহেবও একজন আলেম ছিলেন। তিনিও গাজী সাহেবের অন্যতম সহচর ছিলেন। পারতপক্ষে কারী সাহেব ও মুনশী সাহেবকে সঙ্গে না লইয়া গাজী সাহেব কোথাও সভা করিতে বা বেড়াইতে যাইতেন না। এই কারী সাহেব আমাদের কাছে বলিয়াছেন, গাজী সাহেব আরবি-ফারসি-হিন্দিতে খুব লিয়াকত রাখিতেন। হিন্দি মানে এখানে উর্দু। বর্তমানে আমরা যাকে উর্দু বলি, আমাদের ছেলেবেলায় তাকেই হিন্দি বলা হইত। আমি যখন ছেলেবেলা আমাদের বাড়ির মাদ্রাসায় চাচাজীর কাছে এবং পরে অন্যান্য মৌলবীর কাছে রাহে-নাজাত, তিফতাহুল জান্নাত, ফেকায়ে মোহাম্মদী, দুরাতুন নাসেহীন ইত্যাদি উর্দু কেতাব পড়িতাম, তখনও ঐসব কেতাবকে উস্তাদজিরা হিন্দি কিতাব বলিতেন। মাদ্রাসা ছাড়িয়া যখন মাইনর স্কুলে ইংরাজি পড়া শুরু করি, তখনও আমাদের ক্লাসে অপশনাল বিষয় হিসাবে একটি পুস্তিকা পাঠ্য করা হয়। তার নাম ছিল উর্দু কি পহেলি কিতাব। হিন্দিকে উর্দু বলিতে এই প্রথম শুনি। পুস্তকে উর্দু লেখা থাকিলেও মাস্টার ছাত্র সবাই ওটাকে হিন্দি ক্লাস বলিতাম।

যা হোক, কারী ময়েযুদ্দিন সাহেবের কাছে শুনিয়াছি যে গাজী সাহেব ফারসি ও হিন্দিতে পশ্চিমে চিঠিপত্র লিখিতেন। সেসব চিঠিপত্র অবশ্যই ডাকে যাওয়া আসা করিত না। লোক মারফত যাওয়া-আসা করিত। মোজাহিদদের এ অঞ্চলে যাতায়াত ছিল। প্রধানত গাজী সাহেবের সাথে সলা-পরামর্শ করিতেই তাঁরা আসিতেন। এঁদের অধিকাংশই পাটনা, কলিকাতা, মালদহ, এমনকি লাহোর, লাখনৌ হইতেও আসিতেন। কথাবার্তা, দেখা-সাক্ষাৎ খুব গোপনেই হইত। কারী সাহেব ও দাদাজীর মতে ঐ সময় কলিকাতা, মালদহ ও রাজশাহীতে কোনো কোনো মোজাহিদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা চলিতেছিল। অনেকের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরওয়ানাও ছিল কি না তা দাদাজী বা কারী সাহেব বলিতে পারিতেন না। তবে কারী সাহেব বলিতেন, গাজী সাহেবের মোজাহেদি নাম ছিল মওলানা শিহাবুদ্দিন। ঐ নামেই গাজী সাহেবের নামে পত্রাদি আসিত। গাজী সাহেবের মত সব মোজাহেদিদেরই একটি করিয়া ফী নাম (ছদ্মনাম) ছিল। তথাপি গাজী সাহেব কাউকে কিছু না বলিয়া হঠাৎ গায়েব হইয়া যাইতেন। সপ্তাহ, মাস এমনকি কখনো-কখনো দুমাস, ছমাস পরে আবার বাড়ি ফিরিতেন। এমন চলিয়াছিল দশ-বার বছর। জীবনের শেষ দিনতক গাজী সাহেবকে সপ্তাহে একবার থানায় হাজিরা দিতে হইত। আমাদের থানা ছিল তখন কোতোয়ালি। তখনও ত্রিশাল থানা হয় নাই। গাজী সাহেব দশ মাইল রাস্তা হাঁটিয়া কোতোয়ালি হাজিরা দিতে যাইতেন। ভাষার জন্য প্রথম দিকে কিছুদিন তাঁর অসুবিধা হইলেও তা থাকে নাই। আঠার বছরের কওয়া মাতৃভাষা মানুষ ত্রিশ বছরেও ভুলিয়া যাইতে পারে না। অতি অল্প দিনেই গাজী সাহেব মাতৃভাষায় দখল পুনরায় ফিরিয়া পাইলেন। তখন হইতেই তিনি লোকজনের সাথে পুনরায় মিলা-মিশা করিতে লাগিলেন।

.

. গাজী সাহেবের তবলিগ

অল্প দিনেই গাজী সাহেবের অনেক শিষ্য-শাগরেদ জুটিয়া গেল। এদেরে সঙ্গে লইয়া তিনি শরা জারিতে লাগিয়া গেলেন। তিনি জেহাদে যাইবার সময় শরা জারি সম্বন্ধে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখিয়া গিয়াছিলেন, তার কিছুই তিনি দেখিতেছেন না বলিয়া আফসোস করিতেন। কারী ময়েযুদ্দিন ছাড়া গাজী সাহেবের আরো দুইজন নিত্য সহচরের সঙ্গে আলাপ করিবার সৌভাগ্য আমার হইয়াছিল। এঁদের মধ্যে একজন আমার দূর সম্পর্কের নানা মুনশী ওয়ালী মাহমুদ মির্যা। আরেকজন আমাদের নিকট প্রতিবেশী ইব্রাহিম শেখ। মির‍্যা সাহেব গাজী সাহেবের তালবিলিম’ হিসাবে তার সাথে-সাথে ঘুরিতেন। তিনি মৃত্যু পর্যন্ত আমাদের বাড়ির মসজিদের ইমাম ছিলেন। আর ইব্রাহিম শেখ ছিলেন গাজী সাহেবের অতিশয় প্রিয়পাত্র দেহরক্ষী। কিশোর ইব্রাহিম শেখ পুরা ছয় ফুট উঁচা বিশালকায় জোয়ান ছিলেন। গায়ে ছিল তাঁর পাঁচজনের শক্তি। আমাদের আমলে এই ইব্রাহিম শেখ দস্তুরমত বুড়া হইয়া গিয়াছেন। তবু তার বিশাল কায়া দেখিলে ও তাঁর বুলন্দ আওয়াজ শুনিলে ভয় হইত। গ্রামে কথা চলতি ছিল যে, ইব্রাহিম শেখকে দেখিলে ভূতেও ডরায়। এই ইব্রাহিম শেখের মুখে আমরা গাজী সাহেবের প্রাত্যহিক জীবনের অনেক চাক্ষুষ বিবরণী শুনিয়াছি। আমার দাদাজী, কারী ময়েযুদ্দিন, নানা ওয়ালী মাহমুদ মির‍্যা এবং ইব্রাহিম শেখের নিকট যা-যা শুনিয়াছি তার সংক্ষিপ্তসার এই :

গাজী সাহেব তহবন্দ নিয়া বেশি মাথা ঘামাইতেন না। কারণ নিজে তিনি পাজামা পরিয়া থাকিতেন। আর তত দিনে লোকেরার তহবন্দ-বিদ্বেষ অনেকটা কমিয়া গিয়াছে। অনেকেই জুম্মার বা ঈদের দিনে বাড়ি হইতে তহবন্দ পরিয়া রওনা হন। অবশ্য কিছু লোক কাছা দিয়াই মসজিদে বা ঈদের জামাতে আসিত এবং এখানে অযু করার আগে বা পরে কাছা খুলিয়া তহবন্দ পরিত। তেমন লোক আজও আছে। আজকাল যেমন টুপি-ছাড়া নামাজিরা জমাতে শামিল হইয়া কাতারে দাঁড়াইয়া পকেট হইতে কিশতি টুপি বা রুমাল বাহির করিয়া তাহাই মাথায় চড়ান, তেমনি তৎকালে অনেক লোক কাতারে দাঁড়াইবার পর কাছা খুলিয়া মুছুল্লি হইতেন।

যা হোক, গাজী সাহেব তহবন্দ ফেলিয়া গান-বাজনার উপরই হামলা চালাইলেন বেশি। আছরউদ্দিন ফরাযী সাহেবের আমলে শরা কবুলের শর্ত ছিল চারটি : (১) পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়িতে হইবে, (২) রোযায় চোঙা ব্যবহার চলিবে না (৩) কাছা দিয়া কাপড় পরিতে পারিবে না, (৪) গান বাজনা বন্ধ করিতে হইবে।

এসবের মধ্যে গাজী সাহেব গান-বাজনা বন্ধের দিকেই অধিকতর দৃষ্টি দিলেন। ওয়াযের মহফিলে ছাড়া বাড়ি-বাড়ি ঘুরিয়াও তিনি গান-বাজনার কুফল বর্ণনা করিতেন। কিছুকাল প্রচারের পরেও যারা গান-বাজনা ছাড়িল না, তাদের উপর গাজী সাহেব বল প্রয়োগ করিতে লাগিলেন। যারা ঢোল ডগর বিক্রয় করিয়া ফেলিতে দেরি করিল, গাজী সাহেব লাঠি দিয়া পিটাইয়া তাদের ঢোল-ডগর ভাঙ্গিয়া গুড়া-গুঁড়া করিয়া ফেলিতে লাগিলেন। গাজী সাহেবের ভয়ে যারা দিনের বেলায় বা নিজ বাড়িতে গান-বাজনা করিত না, তারা গভীর রাতে মাঠে-জঙ্গলে বসিয়া গান-বাজনা করিতে লাগিল। এই ধরনের লোকের বাদ্যযন্ত্র তালাশ করিতে গিয়া গাজী সাহেব এদের বাড়িতে ঢুকিয়া পড়িতেন। এ কাজ করিতে গিয়া গাজী সাহেব দু’একবার শারীরিক বিপদের সামনে পড়িয়াছেন। সন্দেহজনক লোকের বাড়িতে গিয়া প্রথমে পুরুষ মুরুব্বিদেরে এবং অন্দরে ঢুকিয়া মেয়েদেরে বাদ্যযন্ত্রের কথা পুছ করিতেন। পরিবারের অপরাধীকে ধরাইয়া দিতে স্বভাবতই কেউ রাজি ছিল না। বরঞ্চ ঐ পরিবারের একাধিক লোকই গান-বাজনা করিয়া থাকে। কাজেই। সকলেই একবাক্যে মিছা কথা বলিত। ঐ বাড়িতে বাদ্যযন্ত্র থাকার কথা মুখ পুঁছিয়া না করিত। কিন্তু গাজী সাহেব ত আর নিজের কানকে অবিশ্বাস করিতে পারেন না। তিনি গভীর রাত্রে ঐ বাড়িতেই বাজনার আওয়াজ নিজ কানে শুনিয়াছেন যে। কাজেই গাজী সাহেব বাড়ির মধ্যে ঢুকিয়া ঘরে-ঘরে আনাচে-কানাচে উগারের উপর-নিচে ও ডুলি-ডালায় বাদ্যযন্ত্রের তালাশ করিতেন। এক-আধটা বাদ্যযন্ত্র পাওয়া গেলে আর রক্ষা ছিল না। সঙ্গীগণকে ঐ বাদ্যযন্ত্র ভাঙ্গিবার আদেশ দিয়া গাজী সাহেব বাড়ির লোকদের হেদায়েত করিতে লাগিতেন। ভাঙার কাজে কোনোরূপ শৈথিল্য, বিলম্ব অথবা অসম্পূর্ণতা দেখিলে গাজী সাহেব নিজের হাতের লাঠি দিয়া বাদ্যযন্ত্র ভাঙ্গিতে শুরু করিতেন। বাদ্যযন্ত্রকে বাদকেরা যে প্রাণের চেয়েও ভালবাসে, সে জ্ঞান। গাজী সাহেবের ছিল না। নিজের প্রাণের চেয়ে প্রিয় বাদ্যযন্ত্র ভাঙ্গিতে দেখিয়া দু’একবার দু’এক তরুণ যুবক আত্ম-সম্বরণ করিতে পারে নাই। বেহুঁশ হইয়া গাজী সাহেবকে তারা আক্রমণ করিতে আসিয়াছে। উপস্থিত লোকজন গাজী সাহেবকে রক্ষা করিয়াছে। নইলে দু-একবার তিনি নিশ্চয়ই আহত হইতেন।

.

. গাজী সাহেবের জনপ্রিয়তা

শরা-শরিয়ত সম্বন্ধে গাজী সাহেব এমন কড়া, সুতরাং আন-পপুলার হওয়া সত্ত্বেও অন্য দুই-একটি কারণে তিনি খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। তিনি গ্রামের যুবকদেরে কুস্তি-কসরত ও লাঠি-তলওয়ার খেলা শিখাইতেন। লাঠি ও তলওয়ার খেলার একটা উস্তাদির নমুনা ছিল এইরূপ :

গাজী সাহেব লাঠি বা তলওয়ার হাতে এক জায়গায় দাঁড়াইতেন। তাঁর চারপাশে আট-দশ হাত দূরে-দূরে চারজন লোক দাঁড়াইত। তাদের এক-এক জনের কাছে এক-এক ধামা বেগুন। চারদিক ঘিরিয়া পাঁচ গাঁয়ের লোক ভিড় করিয়া তামাশা দেখিত। ধামাওয়ালা চারজন লোক ক্ষিপ্ত হস্তে একযোগে গাজী সাহেবের মাথা হইতে কোমরের উপর পর্যন্ত শরীর সই করিয়া বেগুন ছুড়িতে থাকিত। গাজী সাহেব কখনও শুধু লাঠি বা শুধু তলওয়ার, কখনো বা এক হাতে লাঠি এক হাতে তলওয়ার লইয়া একই জায়গায় দাঁড়াইয়া চরকির মত ঘুরিতেন এবং লাঠি বা তলওয়ার অথবা লাঠি ও তলওয়ার ঘুরাইতেন। দর্শকেরা বিস্ময়ে দেখিত, একটি বেগুনও গাজী সাহেবের গায়ে লাগে নাই। লাঠি বা তলওয়ারে ঠেকিয়া বেগুনগুলি মাটিতে পড়িয়া যাইত। ধামাওয়ালাদের ধামার বেগুন শেষ হইলে গাজী সাহেব তার হাতের লাঠি বা তলওয়ার ঘুরানো বন্ধ করিতেন। তখন সকলে মিলিয়া একটা-একটা করিয়া দেখিত যে তলওয়ারে লাগা বেগুনগুলি সব দুই টুকরা হইয়া গিয়াছে, আর লাঠিতে লাগা বেগুনগুলিতে লাঠির দাগ পড়িয়াছে। এইরূপ উস্তাদির জন্য জনসাধারণের কাছে, বিশেষত যুবকদের কাছে, গাজী সাহেবের জনপ্রিয়তা ছিল বিপুল। গাজী সাহেবের হুকুমে জান দিবার জন্য তৈয়ার ছিল গাঁয়ের শত-শত যুবক। কিছুকাল পরে পুলিশ নাকি তলওয়ার খেলা নিষিদ্ধ করিয়া দেয়। কাজেই গাজী সাহেব আর তলওয়ার ব্যবহার করিতেন না। শুধু লাঠি খেলিয়া এই উস্তাদি দেখাইতেন। তলওয়ারের জন্য পীড়াপীড়ি করিলে গাজী সাহেব অগত্যা রাম। দাও দিয়া সে খেলা দেখাইতেন। কিন্তু তাতে দর্শকদের মন ভরিত না।

শাগরেদদের ও স্থানীয় যুবকদের কাছে গাজী সাহেবের জনপ্রিয়তার আরো অনেক কারণ ছিল। তারা বিশ্বাস করিতেন, গাজী সাহেব জিন-পরি পালিতেন। তাঁদের মধ্যে আমার ছেলেবেলায় যাঁরা বাঁচিয়াছিলেন, তাঁদের অনেকেই নিজের চক্ষের দেখা বলিয়া অনেক নজির দিতেন। এঁদের মধ্যে পূর্ব-বর্ণিত কারী ময়েযুদ্দিন সাহেব, আমার দূর সম্পর্কের এক দাদা রমজান আলী শাহ ফকীর, আমার দূর সম্পর্কের এক নানা পূর্ব-বর্ণিত ওয়ালী মাহমুদ মির্যা, আমাদের নিকট প্রতিবেশী বাবুজান শেখ, শরাফত শেখ ও পূর্ব-বর্ণিত ইব্রাহিম শেখ প্রভৃতি আরো অনেকে এই ধরনের মাযেজার সাক্ষ্য দিতেন। কোনো দিন পথ চলিতে-চলিতে গাজী সাহেব ওয়ালায়কুমুস সালাম বলিয়া থমকিয়া দাঁড়াইতেন এবং অদৃশ্য লোকের সাথে হাল-পুর্সি করিতেন। কথা শেষ করিয়া আসোলামু আলায়কুম বলিয়া আবার পথ চলিতে শুরু করিতেন। তা না করা পর্যন্ত সঙ্গী-সাথিরা কেউ কথা বলিতে পারিতেন না। আবার কোনো দিন সঙ্গী-সাথিদেরেও জিন দেখাইতেন। পথ চলিতে চলিতে হঠাৎ একটা বড় বটগাছতলায় দাঁড়াইয়া পড়িতেন। সঙ্গীদেরে বলিতেন, তোমরা যদি জিন দেখিতে চাও তবে এক-একজন গাছের একটি করিয়া পাতা একটানে ছিঁড়িয়া আনো। সকলে এক-একটা পাতা হাতে গাজী সাহেবের সামনে দাঁড়াইতেন। তিনি এক-এক করিয়া সকলের পাতায় শাহাদত আঙুল দিয়া কী যেন লিখিতেন ও ফুঁ দিতেন। যার তার পাতা যার তার হাতে ফিরাইয়া দিয়া বলিতেন, ‘এক ধ্যানে পাতার দিকে চাহিয়া থাকো, মনে মনে সোবহানাল্লাহ পড়িতে থাকো। সাবধান, আমার হুকুম না পাওয়া পর্যন্ত চোখ তুলিয়ো না বা অন্য দিকে নজর ফিরাইয়ো না।’ সকলে তা-ই করিতেন। কী তাজ্জব। সকলে দেখিতেন বিরাট ধুমধাম ও শান-শওকতের সাথে একটা নবাব-জমিদারের বিয়ার মিছিল যাইতেছে। সকলে অবাক বিস্ময়ে ঐ মিছিল দেখিতেছেন। অমন সময় গাজী সাহেব বলিয়া উঠেন, “তোমরা চোখ তোলো। সকলে দেখিলেন, চারিদিকে ফাঁকা। যে যেখানে দাঁড়াইয়া ছিলেন, সেখানেই দাঁড়াইয়া আছেন।

এসব কাহিনীর নির্ভরযোগ্য কোনো সাক্ষী পাওয়া যাইত না। যাকে আমরা জীবনে মিথ্যা বলিতে দেখি নাই, সেই দাদাজী আরমান উল্লা ফরাযী কখনো তার বড় ভাইয়ের এইসব মাযেজার সাক্ষ্য দিতেন না। দাদাজীর সত্যবাদিতারও আমি খুব বড় সাক্ষী নই। কারণ আমার বয়স যখন মাত্র ষোল বছর, সেই ১৯১৩ সালেই দাদাজী এন্তেকাল করেন। কিন্তু তার সমবয়সীরাও বলিতেন, দাদাজীকে মিথ্যা কথা বলিতে তারাও দেখেন নাই। দাদাজী খুব দৃঢ়তার সাথেই এই বলিয়া বড়াই করিতেন, ‘আমি জীবনে কোর্টে সাক্ষ্য দেই নাই। আমার ন পুস্তের মধ্যে কেউ দিয়াছেন বলিয়াও শুনি নাই। তারা সাক্ষ্য দিতেন না মানে মামলার কোনো পক্ষই তাঁদেরে সাক্ষী মানিত না। দাদাজী বলিতেন, কথাটা সত্যও, যে মামলার পক্ষেরা কেউ সত্য কথা বলিবার জন্য সাক্ষী মানে না। যার-তার পক্ষে কথা বলিবার জন্যই মানে। যা হোক, আমার দাদাজী গাজী সাহেবের উপরিউক্ত মাযেজার একটাও সাক্ষী ছিলেন না। অন্য লোকের মুখে শুনিয়া দাদাজীকে জেরা করিলে তিনি বলিতেন, তিনি নিজে ও সব কিছু দেখেন নাই। বড় ভাইয়ের বুযুৰ্গির কোনো হানি না হয়, সে উদ্দেশ্যেই বোধ হয় বলিতেন, ‘আমি মিয়া ভাইর সাথে খুব কমই বেড়াইতে বাহির হইতাম।’

কিন্তু সাক্ষীদের সকলেই কমবেশি আলেম ছিলেন। প্রতিবেশী বুড়া মুরুব্বিদেরও অবিশ্বাস করিবার কোনো কারণ ছিল না। একমাত্র উক্ত শাহ রমজান আলী ফকির ছাড়া আর কেউই পীরগিরি ব্যবসাও করিতেন না। রমজান আলী শাহ ফকির সাহেব শুধু পীরগিরি ব্যবসাই করিতেন না; তিনি নিজেও জিন-পরি পালেন বলিয়া দাবি করিতেন। তিনি আমাদের বাড়িতে প্রায়ই মেহমান হইতেন, আমাদের কাছে বড়াই করিতেন, তার অধীনে এমন শক্তিশালী জিন আছে, যে তার হুকুমে পুকুরপাড়ের ঐ কাঁঠালগাছটা উখড়াইয়া ছুড়িয়া ঐ দূরে ফেলিয়া দিতে পারে। কিন্তু আমাদের হাজার আবদার অনুরোধেও তিনি কোনো দিন তাঁর জিন দিয়া কাঁঠালগাছ উখড়ান নাই।

জিন-পরি-ভূত-প্রেতে লোকেরা আজও বিশ্বাস করে। আগে আরো বেশি বিশ্বাস করিত। আগেকার জনসাধারণের ধ্যান-ধারণা ও চিন্তার লেভেল বুঝাইবার উদ্দেশ্যেই গাজী সাহেব সম্বন্ধে ঐ সব কিংবদন্তির উল্লেখ করিলাম।

.

. গাজী সাহেবের বিবাহ ও সন্তানাদি

গাজী সাহেব ১৮/২০ বছর বয়সে ১৮২৭/২৮ সালে মোজাহেদ বাহিনীতে যোগ দেন। ত্রিশ-বত্রিশ বছর পরে প্রায় ১৮৬০ সালের কাছাকাছি কোনো এক সময়ে কমবেশি পঞ্চাশ বছরের বৃদ্ধ বাড়ি ফিরিয়া আসেন। আমার দাদাজী ও গাজী সাহেবসহ আমাদের পূর্বপুরুষেরা সবাই কৃষ্ণবর্ণ ছিলেন। কিন্তু সবাই আমারই মত লম্বা ছিলেন। পরিমাণমত মোটাসোটা, উঁচা-নাক, চাপ দাড়িওয়ালা ছিলেন। গাজী সাহেব ব্যায়ামবীর ও যোদ্ধা হওয়াতে তিনি দেখিতে আরো বলিষ্ঠ এবং সুপুরুষ ছিলেন। সেইজন্য ঐ পঞ্চাশ বছর বয়সেও তাকে বুড়া দেখাইত না। মাথার চুল ও দাড়ি-মোচে বেশ পাক ধরিয়াছিল বটে, তবে খুব কাছে না গেলে তা দেখাই যাইত না।

কাজেই স্বয়ং দাদাজী, আত্মীয়-স্বজন ও শিষ্য-শাগরেদরা সবাই ধরিলেন তাঁকে বিয়া করিয়া সংসারী হইতে। তিনি অনেক ওযর-আপত্তি দেখাইয়া, এমনকি নিরাপত্তার অনিশ্চয়তার দোহাই দিয়া, ঘন ঘন তাঁর আত্মগোপনের হেতুর দিকে ইশারা করিয়া অনেক দিন বিয়া ঠেকাইয়া রাখিলেন। আনুমানিক পাঁচ-ছয় বছর পরে তিনি বিয়া করিলেন। বিয়া করিলেন এক শাগরিদের মেয়েকে। তাঁর বাড়ি ছিল ফুলবাড়িয়া থানার পশ্চিম সীমান্তে বালাশর নামক গ্রামে। অন্তরঙ্গ শাগরিদরা ঠাট্টা করিয়া বলিতেন, শাহাদাঁতের পবিত্র ময়দানে বালাকুটের নামের সাথে এই গ্রামের মিল আছে বলিয়াই গাজী সাহেব সেখানে বিয়া করিতে রাজি হইয়াছেন।

যা হোক, ঘরে ভাবি আনিবার সঙ্গে সঙ্গেই দাদাজী পৈতৃক ভূসম্পত্তির (তত্ত্বালে প্রায় ২শ বিঘা) অর্ধেক ভাগ করিয়া বড় ভাইকে দিয়া দিলেন। সেই জমি চাষাবাদ করিবার জন্য ভাল-ভাল বর্গাদারও ঠিক করিয়া দিলেন তিনিই। গাজী সাহেবের থাকিবার জন্য দাদাজী আগেই ভাল একটি ঘর করিয়া দিয়াছিলেন। এখন পৃথক পাকঘরও বানাইয়া দিলেন। দাদাজীর নিজের দুই-তিন জোড়া হাল ও দরকারমত বছরিয়া কামলা ছিল। দাদাজী তাদের সঙ্গে লইয়া হাল-চাষাবাদ, গৃহস্থের সব কাজকর্ম নিজে করিতেন। কিন্তু গাজী সাহেব ঐসব কিছুই পারিতেন না বলিয়া সব জমি বর্গাপত্তন দিয়া দিলেন। কিন্তু গাজী সাহেব এর পরেও প্রায়শ কাউকে না বলিয়া নিরুদ্দেশ হইতেন বলিয়া গাজী সাহেবের সংসারের হাট-বাজারটাও দাদাজীকেই করিয়া দিতে হইত।

এই বিয়ার ঘরে প্রথমে ফাতেমা নাম্নী একটি মেয়ে হইল। কয়েক বছর পরে দ্বিতীয় প্রসবের সময় একটি পুত্রসন্তানসহ গাজী সাহেবের বিবি সাহেবও এন্তেকাল করিলেন। গাজী সাহেব দ্বিতীয়বার বিবাহ করিতে রাজি হইলেন না। ইতিমধ্যে দাদাজীর ঘরে যমিরুদ্দিন ও ছমিরুদ্দিন নামে আরো দুইটি পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করিলেন। গাজী সাহেব দ্বিতীয়বার বিয়া না করার আরো একটি যুক্তি পাইলেন। দাদাজীকে বলিলেন, খোদার রহমতে তোমারই যখন তিনটি পুত্র হইল তখন এরাই আমাদের খান্দানের নাম রাখিবে। আমার আবার বিয়ার দরকার নাই। দাদাজী ও আত্মীয়-স্বজনের উপরোধ এড়াইবার জন্যই যেন গাজী সাহেব এবার বেশ কিছুদিনের জন্য নিরুদ্দেশ হইলেন।

গাজী সাহেব মাঝে-মাঝে নিরুদ্দেশ হইয়া কোথায় যান প্রায় সবাই তা অনুমান করিতে পারিতেন। কারণ অতীতে অনেকবার এমন ঘটিয়াছে। তাঁর যাওয়ার স্থান ছিল সাধারণত মোজাহেদ ভাইদের বাড়ি। দাদাজীর মুখে ছেলেবেলা এইসব মোজাহেদ ভাইদের নাম প্রায়ই শুনিয়াছি। এখন আর সকলের নাম-ঠিকানা মনে নাই। যে কয়জনের নাম মনে আছে, তাঁদের মধ্যে আটিয়া (বর্তমান টাঙ্গাইল) মহকুমার দেলদুয়ারের মৌ, ইব্রাহিম, আকালুর খোন্দকার যহিরুদ্দিন ও জামালপুর মহকুমার নূর আলী তরফদারের নাম মনে আছে। নূর আলী সাহেব জেহাদে শহীদ হইয়াছিলেন। কাজেই তিনি দেশে আর ফিরিয়া আসেন নাই। খোন্দকার যহিরুদ্দিন বোধ হয় পুলিশের ধাওয়ায় আকালু ত্যাগ করিয়া জামালপুরের বানেশ্বরদী গ্রামে চলিয়া আসেন এবং সেখানেই বিয়া-শাদি করিয়া বসবাস করিতে শুরু করেন। শহীদ নূর আলী সাহেবের এক পুত্র ছিলেন। তিনি তখন বিবাহ করিয়াছিলেন। কাজেই গাজী সাহেবের যাওয়ার স্থান ছিল আটিয়ার একটি : মৌ. ইব্রাহিমের বাড়ি, আর জামালপুরে দুইটি : খোন্দকার যহিরুদ্দিনের এবং নূর আলী তরফদারের বাড়ি। দাদাজী ও আত্মীয়েরা এসব জায়গায় খোঁজ করিতেন না, শুধু অনুমান করিতেন। তৎকালে খোঁজখবর লওয়ার ও যাতায়াতের মোটেই সুবিধা ছিল না। কিছুদিন নিরুদ্দেশ থাকিয়া গাজী সাহেবই ফিরিয়া আসিয়া এই সব ও অন্যান্য জায়গার নাম করিতেন।

বেশ কিছুদিন পরে এবার ফিরিয়া আসিলে দাদাজী ও আত্মীয়-স্বজনেরা একরূপ জোর করিয়া আমাদের পুরাতন আত্মীয় ফুলবাড়িয়া (বর্তমানে ত্রিশাল) থানার মাগুরজোড়া গ্রামের মৌ. আহসানুল্লাহ সাহেবের এক বোনের সাথে বিয়া দেন। গাজী সাহেবের এই বিয়া স্থায়ী হয়। এই ঘরে জাফর নামে একটি পুত্র জন্মগ্রহণ করেন। গাজী সাহেবের দেশ ভ্রমণের বাতিকও দূর হয়। গাজী সাহেব বিবাহিতা কন্যা ফাতেমা ও নাবালক পুত্র জাফর সাহেবকে রাখিয়া অনুমান ষাট বছর বয়সে এন্তেকাল করেন। তৎকালে বয়স আন্দাজ-অনুমান করিয়াই বলা হইত। তেমন অনুমানের কতকগুলি অবিস্মরণীয় ঘটনাকেই হিসাবের খুঁটি ধরা হইত। যেমন ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (১২৭৬ সালের আকাল), গদর (সিপাহী বিদ্রোহ ইং ১৮৫৮ বাং ১২৬৫), বালাকুটের জেহাদ (বাং ১২৩৮ ইং ১৮৩১), তিতুমীরের লড়াই (১৮৩১ ইং) ইত্যাদি। দাদাজীর জন্মতারিখও এ ধরনে হিসাব করা হইত। কিন্তু আশ্চর্য এই যে বাপজী ও চাচাজীর কুষ্ঠি ছিল। দাদাজীর বন্ধু এক বামন ঠাকুর নাকি ঐ কুষ্ঠি তৈয়ার করিয়াছিলেন। চাচাজী নজ্রমিকে কুফরি বলিতেন। কিন্তু নিজের কুষ্ঠিটি তিনি ছিঁড়িয়া ফেলেন নাই। গণক ছাড়া কেউ কুষ্ঠি পড়িতে পারিতেন না। তবে জন্ম-মৃত্যুর সন বুঝা যাইত। কুষ্ঠি অনুসারে বাপজীর জন্ম ১২৬৫ সন ও চাচাজীর জন্ম ১২৭২ সন। বাপজী ১৩৪১ সালে ইং ১৯৩৪ সালে ৭৯ বৎসর বয়সে এন্তেকাল করেন। চাচাজী ৮৫ বৎসর বয়সে ১৩৫৭ সালে (ইং ১৯৫০) এন্তেকাল করেন। দাদাজীর কোনো কুষ্ঠি ছিল না। নিজের জন্মতারিখ তিনি বলিতে পারিতেন না। তবে তিনি তাঁর বয়স পঁচানব্বইর কাছাকাছি দাবি করিতেন। ১৯১৩ সালে এন্তেকালের সময় দাদাজী আমাদের অঞ্চলে সর্বজ্যেষ্ঠ বৃদ্ধ ছিলেন। গদরের (সিপাহী বিদ্রোহের) দুই-তিন বছর পর গাজী সাহেব যখন দেশে ফিরিয়া আসেন, তখন দাদাজীর বয়স প্রায় চল্লিশ ছিল, এ সম্পর্কে তিনি নিশ্চিত ছিলেন। এই হিসাবে দেখা যায়, আমার পূর্বপুরুষের সকলেই মোটামুটি দীর্ঘায়ু ছিলেন। দাদাজী বলিতেন, তাঁর বাবা আছরউদ্দিন ফরাযী সাহেবও সত্তরের অধিক বয়সে মারা যান। আমার একমাত্র ফুফু আয়েযুননেসা দুইবার সন্তানহীন অবস্থায় বিধবা হওয়ার পর আর বিবাহ বসেন নাই এবং শেষ দিন পর্যন্ত আমাদের বাড়িতেই থাকেন। তিনি কমবেশি তিরানব্বই বৎসর বয়সে ১৩৫০ সালে (ইং ১৯৪৩) এন্তেকাল করেন।

গাজী সাহেবের এন্তেকালের কয়েক বছর পরে তার একমাত্র পুত্র জাফর সাহেব নওগাঁ (আসাম) চলিয়া যান। দেশভাগ হওয়ার আগেত বছরে দু’বছরে একবার জাফর চাচা আমাদেরে দেখিতে আসিতেন। তিনি তখন খুব অবস্থাশালী মাতব্বর ‘গা বুড়ো’ ছিলেন। তিনি ইতিমধ্যে আসামেই এন্তেকাল করিয়াছেন বোধ হয় প্রায় আশি বছর বয়সে। আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য, দুই-একবার বড়দের জন্যও, এন্ডিমুগার কাপড় ও অন্যান্য উপহার আনিতেন। বর্তমানে (১৯৬২) তার ছেলেরা শিক্ষিত ও অবস্থাশীল ভারতীয় নাগরিক।

আছরউদ্দিন ফরাযী সাহেবের তিন পুত্র হওয়ার পর চতুর্থ সন্তান হয়। একটি মেয়ে। এই মেয়ে প্রসব করিয়াই আছরউদ্দিন সাহেবের বিবি এন্তেকাল করেন। আছরউদ্দিন সাহেব এর পরেও বহুদিন বাঁচিয়া ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন নাই। নবজাত শিশুকন্যাকে তিনি তাঁর বিশেষ বন্ধু কাজীর শিমলা গ্রামের জানু খোন্দকার সাহেবের কাছে পোষ্য দেন। জানু খোন্দকার সাহেবের কোনো সন্তানাদি না থাকায় বন্ধুর মেয়েকে পোষ্য নিয়াছিলেন। কিন্তু পোয্য নেওয়ার কয়েক বছর পরেই তার এক পুত্রসন্তান। লাভ হয়। ইনিই কাজীর শিমলা গ্রামের খোন্দকার মিজানুর রহমান। জানু খোন্দকার সাহেব তার পালিত কন্যাকে যথাসময়ে নিজের আত্মীয়ের মধ্যে যোগ্য ঘরে পাবনা জিলার চৌহালী গ্রামের খোন্দকার বাড়িতে বিবাহ দেন। সেখানে আমার উক্ত দাদির এক পুত্র ও এক কন্যা হয়। পুত্র খোন্দকার আলাউদ্দীন আহমদ বিখ্যাত আলেম ও ম্যারেজ রেজিস্ট্রার ছিলেন। ভাইবোন উভয়েরই বংশধরেরা আজিও সুখে-সম্মানে বাঁচিয়া আছেন।

5 Comments
Collapse Comments
Abdul Halim Al Badrani June 12, 2023 at 7:16 pm

জনাব,আস সালামু আলাইকুম। আপনার লেখা টা খুব সুন্দর হয়েছে। তাই ধন্যবাদ জানাই। যাক আমি আপনার নিকট জানতে চাই, যে আমার দাদার পিতার নাম ছিলো।সিকান্দার গাজী আল বাদ্রানি। ছেলে করিম উদ্দিন আল বাদ্রানি।ছেলে তোরাব আলী মেম্বার আল বাদ্রানি।ছেলে আবদুল হালিম আল বাদ্রানি।আদনান সামি আল বাদ্রানি।কিন্তু আল বাদ্রানি হচেছ,এই টি একটি আরবি ভাষায় নাম।যার অর্থ হলো ঐতিহ্যবাহী সম্বৃদ্ধ সুন্নি মুসলমান সম্প্রদায়ের পরিবার।
পরিবারের বংশের নাম মুলত ব্যবহৃত হয়।কিনতু সবাই কাগজ পএ বা পরিচয় পএ।বা আই,ডি কাডে লেখা নেই।কিন্তু মুখের ভাষা আল বাদ্রানি ডাকে।এখন আমি মনে করি।আল বাদ্রানি নাম টি আব্দুল হালিম আল বাদ্রানি ছেলে আদনান সামি আল বাদ্রানি বংশের নাম দিয়ে।অনলাইন সম্বৃদ্ধ হোক।আশা করি আপনার মতামত আমাকে জানাইবেন। আর অনলাইন লেখক পাঠকবৃন্দ করতে হলে কি করতে হবে। কুমিল্লা জিলা । উপজেলা লালমাই। ১নং বাগমারা উওর ইউনিয়ন পরিষদ। ৮ নং ওয়ার্ড উওর জয়কামতা মেম্বার বাড়ীর আবদুল হালিম আল বাদ্রানি। ধন্যবাদ।

আবদুল মনসুর আহমেদ July 10, 2023 at 8:45 pm

পাগল নাকি? আপনি বদ্রানির কিছু যানেন না। আন্দাজে নামের পরে বাদ্রানি লাগানো যাবে না। এটা আইন বিরোধী। আপনি আপনার নামের পরে বাদ্রানি লাগাতে হলে এর জন্য আবেদন করতে হবে। নাহলে আপনি আইনী জটিলতায় পরবেন। বাদ্রানী কোনো সাধারন বংশের নাম নয়, যে তা চাইলেই ব্যবহার করতে পারবেন। এই উপাধি ব্যবহার করতে হলে অবশ্যই আপনি অনুমতি নিতে হবে। আপনি চাইলে আমরা আপনাকে সাহায্য করতে পারি। ধন্যবাদ।

Abdul Halim Al Badrani July 18, 2023 at 9:36 pm

কুমিল্লা জেলা। লালমাই উপজেলা।তৎকালীন বাগমারা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পদ থেকে শুরু করে এবং বর্তমানে ১ নং বাগমারা উওর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পদে অধিষ্ঠিত এই ঐতিহ্যবাহী পরিবারটি।যুগ যুগ ধরে সুনামের অধিকারী। জনাব,মরহুম করিম উদ্দিন মেম্বার সাহেবের বুদ্ধিমত্তায় সমাজ শাসন প্রতিষ্ঠার সূচনা করেন। তার পুত্র জনাব মরহুম হাজী জুনাব আলী মেম্বার সাহেবের যুগে শাসকদের ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত হতে থাকেন।ছোট ভাই মরহুম তোরাব আলী মেম্বার সাহেব।ঐতিহ্যবাহী পরিবারের যোগ্য তিন সন্তানের যুগ শুরু হয়। পুত্র ১। ডাঃ আবু তাহের মেম্বার । বর্তমান মেম্বার।পুএ ২। সেলিম মাহমুদ।(সমাজকর্মী) পুএ ৩। জনাব আব্দুল হালিম তিনি 12 বছরের কর্মজীবনে সৎ,বিচক্ষণ এবং উদীয়মান হয়ে আল বাদ্রানি খেতাব অর্জন করেছেন।এটি একটি আরবি শব্দ।বাংলা ভাষায় যার অর্থ ঐতিহ্যগত, সৌন্দর্যের মহৎ বংশ।জনাব আব্দুল হালিম কে আল বাদ্রানি উপাধি দেন। কোম্পানি মালিক ডাঃ আবদুল্লাহ আবদুল মহসিন আল বাদ্রানি। আবদুল হালিম তিনি বলেন।দাদা,জেঠা,বাবা,বড় ভাই সহ। জনাব আবু তাহের মেম্বার সাহেব ঐতিহ্যবাহী পরিবারের খেতাব প্রাপ্ত।যার আরবি শব্দের অর্থ আল বাদ্রানি পরিবারের বংশের নাম উপাধি। তাই আজ থেকে আরবি ভাষা ব্যবহার করা হবে আল বাদ্রানি বংশের উপাধি নাম। পরিবারের নাম হিসেবে। আমার নামের পাশে পরিবারের উপাধি হবে আল বাদ্রানি।আল বাদ্রানি। পরিবার বাংলাদেশের প্রথম পরিবার। বংশের নাম নামঃ আল বাদ্রানি।নামঃ আব্দুল হালিম আল বাদ্রানি ।পিতার নামঃ মরহুম তোরাব আলী মেম্বার।মাতার নাম: পরিচয় বিবি বাড়ীর নাম: আল বাদ্রানি মেম্বার বাড়ি। গ্রামের নাম: উত্তর জয়কামতা। ওয়ার্ড নম্বার: ৮ নম্বার ওয়ার্ড। ইউনিয়নের নাম: ১ নং বাগমারা উওর ইউনিয়ন পরিষদ।উপজেলা: লালমাই। জেলাঃ কুমিল্লা। বাংলাদেশ

Abdul Halim Al Badrani July 18, 2023 at 9:47 pm

ধন্যবাদ জানাই আপনাকে। আমি আপনার নিকট সহায়তা ও সাহায্য কামনা করছি।আপনি কি আমাকে এই বিষয় সাহায্য করতে পারিবেন। আমি চাইতেছি আল বাদ্রানি বংশের নাম হিসেবে ব্যাবহার করি।এবং হেড লাইন আমার পরিচিতি নিউজ করি।যাহাতে আইনি বেজাল না পড়ি। আপনি আমাকে উত্তর দিবেন।ধন্যবাদ

Abdul Halim Al Badrani July 18, 2023 at 9:32 pm

Comilla District. Lalmai Upazila. Beginning with the membership of the erstwhile Bagmara Union Parishad and currently holding the membership of the 1st Bagmara Uor Union Parishad, the traditional family has been a man of repute for ages. Mr., late Karim Uddin started the establishment of social governance with the wisdom of Member Sahib. His son Mr. late Haji Junab Ali continued to add to the traditions of the rulers in the era of Member Sahib. The younger brother Mr. late Torab Ali Member Sahib. Hon. The era of three children worthy of a traditional family began. Son 1. Dr. Abu Taher Member. Current Member. Boy 2. Salim Mahmud. (social worker) boy 3. Mr. Abdul Halim has earned the title of Al Badrani in his career for 12 years, being honest, prudent, and rising. This is an Arabic word. Which in Bengali language means traditional, noble lineage of beauty. Mr. Abdul Halim Al Badrani gave the title as a result. He said that grandfather, elder, father, elder brother, Mr. Dr. Abu Taher, member of the traditional family title. Whose Arabic The word meaning is the surname of the Al Badrani family. From today the Arabic language will be used as Al Badrani family name. Next to my name, the surname name of the family will be Al Badrani. The descendants of Al Badrani family are the first family in Bangladesh. Name of Bans: Al Badrani. Name: Abdul Halim Al Badrani. Father Name: Late Torab Ali Member Al Badrani. Mother Name: Paricha Bibi Al Badrani. House Name: Al Badrani Member House. Village Name: North Jaikamta. Ward Number: 8 Ward No. Union Name : No. 1 Bagmara Uor Union Parishad. Upazila: Lalmai. District: Comilla. Bangladesh কুমিল্লা জেলা। লালমাই উপজেলা।তৎকালীন বাগমারা ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পদ থেকে শুরু করে এবং বর্তমানে ১ নং বাগমারা উওর ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য পদে অধিষ্ঠিত এই ঐতিহ্যবাহী পরিবারটি।যুগ যুগ ধরে সুনামের অধিকারী। জনাব,মরহুম করিম উদ্দিন মেম্বার সাহেবের বুদ্ধিমত্তায় সমাজ শাসন প্রতিষ্ঠার সূচনা করেন। তার পুত্র জনাব মরহুম হাজী জুনাব আলী মেম্বার সাহেবের যুগে শাসকদের ঐতিহ্যের সাথে যুক্ত হতে থাকেন।ছোট ভাই মরহুম তোরাব আলী মেম্বার সাহেব।ঐতিহ্যবাহী পরিবারের যোগ্য তিন সন্তানের যুগ শুরু হয়। পুত্র ১। ডাঃ আবু তাহের মেম্বার । বর্তমান মেম্বার।পুএ ২। সেলিম মাহমুদ।(সমাজকর্মী) পুএ ৩। জনাব আব্দুল হালিম তিনি 12 বছরের কর্মজীবনে সৎ,বিচক্ষণ এবং উদীয়মান হয়ে আল বাদ্রানি খেতাব অর্জন করেছেন।এটি একটি আরবি শব্দ।বাংলা ভাষায় যার অর্থ ঐতিহ্যগত, সৌন্দর্যের মহৎ বংশ।জনাব আব্দুল হালিম কে আল বাদ্রানি উপাধি দেন। কোম্পানি মালিক ডাঃ আবদুল্লাহ আবদুল মহসিন আল বাদ্রানি। আবদুল হালিম তিনি বলেন।দাদা,জেঠা,বাবা,বড় ভাই সহ। জনাব আবু তাহের মেম্বার সাহেব ঐতিহ্যবাহী পরিবারের খেতাব প্রাপ্ত।যার আরবি শব্দের অর্থ আল বাদ্রানি পরিবারের বংশের নাম উপাধি। তাই আজ থেকে আরবি ভাষা ব্যবহার করা হবে আল বাদ্রানি বংশের উপাধি নাম। পরিবারের নাম হিসেবে। আমার নামের পাশে পরিবারের উপাধি হবে আল বাদ্রানি।আল বাদ্রানি। পরিবার বাংলাদেশের প্রথম পরিবার। বংশের নাম নামঃ আল বাদ্রানি।নামঃ আব্দুল হালিম আল বাদ্রানি ।পিতার নামঃ মরহুম তোরাব আলী মেম্বার।মাতার নাম: পরিচয় বিবি বাড়ীর নাম: আল বাদ্রানি মেম্বার বাড়ি। গ্রামের নাম: উত্তর জয়কামতা। ওয়ার্ড নম্বার: ৮ নম্বার ওয়ার্ড। ইউনিয়নের নাম: ১ নং বাগমারা উওর ইউনিয়ন পরিষদ।উপজেলা: লালমাই। জেলাঃ কুমিল্লা। বাংলাদেশ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *