০১. ফিরোজ বসে আছে

ছাপ্লান্ন মিনিট পার হল।

ফিরোজ বসে আছে। কারো কোনো খোঁজ নেই। ঘুমন্ত রাজপুরীর মতো অবস্থা। কোনো শব্দটব্দও পাওয়া যাচ্ছে না, যা থেকে ধারণা করা যায় এ বাড়িতে জীবিত লোকজন আছে। সে যে এসেছে, এ-খবরটি ছাপ্পান্ন মিনিট আগে পাঠানো হয়েছে। বেঁটেখাটো একজন মহিলা বলে গোল আফা আসন্তাছে। ব্যস, এই পর্যন্তই। ফিরোজ অবশ্যই আশা করে না যে, সে আসামাত্র চারদিকে ছোটাছুটি পড়ে যাবে। বাড়ির কর্তা স্বয়ং নেমে আসবেন এবং এনাকে চা দিতে এত দেরি হচ্ছে কেন? বলে চোঁচামেচি শুরু করবেন। তবে এক ঘণ্টা শুধু শুধু বসে থাকতে হবে, এটাও আশা করে না। সময় এখনো এত সস্তা হয়নি।

আপনি কী আমাকে ডাকছিলেন?

পর্দা ধরে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ফিরোজ মনে-মনে একটি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। চমৎকার মেয়েগুলি সব এমন-এমন জায়গায় থাকে যে, ইচ্ছা করলেই হুঁট করে এদের কাছে যাওয়া যায় না। দূর থেকে এদের দেখে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলতে হয় এবং মনে মনে বলতে হয় আহা, এরা কি সুখেই না আছে!

ফিরোজ উঠে দাঁড়াল। সালামের মতো একটা ভঙ্গি করল। এটা করতে তার বেশ কষ্ট হল। উনিশ-কুড়ি বছরের একটি মেয়েকে এ-রকম সম্মানের সঙ্গে সালাম করার কোনো মানে হয়!

ফিরোজ বলল, আমি আপনার বাবার কাছে এসেছি।

বাবা তো দেশে নেই, আপনাকে কী এই কথা বলা হয়নি?

হয়েছে।

তাহলে?

মেয়েটির চোখে-মুখে স্পষ্ট বিরক্তি। যেন কৈফিয়ত তলব করছে, কেন তাকে ডাকা হল। ফিরোজ ঠাণ্ডা গলায় বলল, আপনার বাবা নেই বলেই আপনাকে খবর দিতে বলেছি। গল্পগুজব করার উদ্দেশ্যে খবর দেয়া হয়নি।

অপালা পর্দা ছেড়ে ঘরের ভেতর ঢুকল। লোকটিকে চট করে রেগে যেতে দেখে তার বেশ মজা লাগছে। বয়স্ক মানুষেরা মাঝে-মাঝে খুবই ছেলেমানুষি করে।

আপনার বাবা আমাকে কমিশন করেছেন বসার ঘরটি বদলে নতুন করে সাজিয়ে দিতে। এই সাজ তার পছন্দ নয়।

আপনি কী একজন আর্টিস্ট?

না। আর্টিস্টরা মানুষের ঘর সাজায় না। তারা ছবি আঁকে। আমার কাজ হচ্ছে আপনাদের মতো পয়সাওয়ালাদের ঘর সাজিয়ে দেয়া।

বেশ, সাজিয়ে দিন।

আপনি জানেন তো, আপনার বাবা ড্রইংরুমটা বদলাতে চাচ্ছেন?

না, জানি না। বাবার মাথায় একেকটা খেয়াল হঠাৎ করে আসে, আবার হঠাৎ করে চলে যায়। আপনি বসুন।

ফিরোজ বসল। মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। এইসব পরিবারের মেয়েরা অসম্ভব। অহঙ্কারী হয়। একজন হাউস ডেকোরেটরের সঙ্গে এরা বসবে না। এতে এদের সম্মানের হানি হবে।

আমি ভাবছিলাম আজই কাজ শুরু করব।

করুন।

আপনার বাবা আমাকে টাকা পয়সা কিছু দিয়ে যাননি। জিনিসপত্র কিনতে আমার কিছু খরচ जाgछ।

আপাতত খরচ করতে থাকুন। বাবা এলে বিল করবেন।

এত টাকা তো আমার নেই। আপনি কী কোনো ব্যবস্থা করতে পারেন?

আমি কী ব্যবস্থা করব?

আপনার বাবা বলেছিলেন, যে-কোনো প্রয়োজনে আপনাদের একজন ম্যানেজারের সঙ্গে কথা বলতে নিশানাথবাবু। কিন্তু তাঁর ঠিকানা আমাকে দিয়ে যাননি।

আপনি অপেক্ষা করুন, আমি ম্যানেজার কাকুকে খবর দিযে নিয়ে আসছি। আপনাকে কী ওরা চা দিয়েছে?

না।

চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।

আপনার অসীম দয়া।

অপালা হোসে ফেলল। অসীম দয়া বলার ভঙ্গির জন্যে হাসল না। অন্য কোনো কারণে, তা বোঝা গেল না। সে দোতলায় উঠে ম্যানেজার সাহেবকে টেলিফোনে আসতে বলল। নিশানাথবাবুকে এ-বাড়িতে সবাই ম্যানেজার ডাকে, তবে ম্যানেজারি ধরনের কোনো কাজ উনি করেননি। উনি বসেন মতিঝিল অফিসে। গুরুত্বহীন কাজগুলি অত্যন্ত যত্বের সঙ্গে করেন। টাটকা মাছ কেনার জন্যে প্রায়ই ভোর রাতে দাউদকান্দি চলে যান। এই জাতীয় কাজে তার সীমাহীন উৎসাহ।

অপালার টেলিফোন পেয়েই বললেন, এক্ষুণি চলে আসছি মা। এই ধর পাঁচ মিনিট। এর সঙ্গে আরো দুমিনিট যোগ করে নাও, রাস্তাঘাটের অবস্থা তো বলা যায় না! ঠিক না মা?

তা তো ঠিকই।

এক মাইল চওড়া রাস্তা; এর মধ্যেও ট্রাফিক জ্যাম। দেশটার কী হচ্ছে, তুমি বলা? একটা অনেস্ট অপিনিয়ন তুমি দাও..

নিশানাথবাবু বক-বক করতে লাগলেন। তিনি দশ মিনিটের আগে টেলিফোন ছাড়বেন না। কথার বিষয় একটাই দেশ রসাতলে যাচ্ছে। মুক্তির কোনো পথ নেই। দেশের সব কটা মানুষকে বঙ্গোপসাগরে চুবিয়ে আনতে পারলে একটা কাজের কাজ হত ইত্যাদি।

অপালা রিসিভার কানে নিয়ে সুযোগের অপেক্ষা করতে লাগল। কখন বলা যাবে, কাকা, টেলিফোন রাখলাম।

ফিরোজ ভেবেছিল একটি খুব সুদৃশ্য কাঁপে এক কাপ চা-ই শুধু আসবে। অন্য কিছুই থাকবে না। অসম্ভব বড়লোেকরা এককথার মানুষ যখন চায়ের কথা বলেন তখন শুধু চ-ই আসে, অন্য কিছু আসে না। অথচ প্রচণ্ড খিদে লেগেছে। ভোর সাতটায় পরোটা-ভাজি খাওয়া হয়েছিল, এখন বারটা দশ। খিদেয় নাড়ি পাক দিয়ে উঠছে। মেয়েটিকে দেখে মনে হচ্ছে সে এতটা হৃদয়হীন হবে না। সঙ্গে কিছু-না-কিছু থাকবে। এদের ফ্রিজ খাবারদাবারে সবসময় ভর্তি থাকে। চট করে চমৎকাব একটা স্যান্ডউইচ বানিয়ে দেয়া এদের কাছে ছেলেখেলা। দু’টি রুটির মাঝখানে কয়েক টুকরো পনির, শসার কুচি, এক চাকা টমেটো। ফ্রেঞ্চ ড্রেসিং-এর আধচামচ। গোলমরিচের গুড়ো। চমৎকার!

কাজের মেয়েটি ট্রে নিয়ে ঢুকল। যা ভাবা গিয়েছে তাই। সুদৃশ্য কাঁপে চা এবং রুপোর একটা গ্রাসে এক গ্রাস হিমশীতল পানি। খিদে নষ্ট করার জন্যে ফিরোজ সিগারেট ধরাল। সেন্ট্রাল টেবিলে চমৎকার একটি অ্যাশট্রে। নিশ্চয়ই অনেক টাকা খরচ করে কেনা। একটি পরী নিচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পরীটির গা থেকে কাপড় খুলে যাচ্ছে। সে কাপড় সামলাতে ব্যস্ত। অগোছালো কাপড়ের কারণে লজ্জায় তার গালি রক্তিম। এ-জাতীয় অ্যাশট্রেগুলিতে কেউ ছাই ফেলে না। এতটা দুঃসাহস কারো নেই। ফিরোজ ছাই দিয়ে সেটা মাখামাখি করে ফেলল। তার খুব ইচ্ছা করছে উঠে যাবার সময় এদের কোনো একটা ক্ষতি করতে। কার্পেটের খানিকটা সিগারেটের আগুনে পুড়িয়ে দেয়া, কাপটা ভেঙে ফেলা। এ-রকম ইচ্ছা তার প্রায়ই হয়।

ম্যানেজার নামক জীবটির এখনো কেন দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। মেয়েটি খবর দিয়েছে কী না কে জানে! নিজের ঘরে গিয়ে হয়ত গান শুনছে কিংবা ভিসিআর-এ আকালের সন্ধানে চালু করে সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের চিন্তায় মগ্ন।

ফিরোজ কাপ হাতে নিয়ে জানালার পাশে এসে দাঁড়াল। ছাগল-দাড়ির এক লোক দু’টি অ্যালসেশিয়ানকে গোসল দিচ্ছে। সাবান দিয়ে হেভি ডলাডলি। কুকুর দু’টি বেশ আরাম পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। নড়াচড়া করছে না। লোকটি কুকুর দু’টির সঙ্গে ইংরেজি ভাষায় কথা বলছে। কাম কাম, সিট ডাউন, নটি বয়, বি কোয়ায়েট জাতীয় শব্দ শোনা যাচ্ছে। কুকুররা বিদেশী ভাষা। এত ভাল বোঝে কেন কে জানে! দেশী ঘিয়ে ভাজা কুত্তাকেও কাম হিয়ার বললে কুঁই-কুই করে এগিয়ে আসে। ফিরোজের বাথরুম পেয়ে গেল। কোনো বাড়িতে গিয়ে ফাট করে বলা যায় না। ভাই, আপনাদের বাথরুম কোথায়? মালদার পার্টিদের ড্রইংরুমের পাশেই ব্যবস্থা থাকে। এখানে নেই। ড্রইং রুম নাম দিয়ে কুৎসিত একটা জিনিস বানিয়ে রেখেছে। ছাদ পর্যন্ত উঁচু শো-কেসে রাজ্যের জিনিস। যেন একটা মিউজিয়াম; পয়সার সঙ্গে-সঙ্গে রুচি বলে একটা বস্তু নাকি চলে আসে। ডাহা মিথ্যে কথা। এই জিনিস সঙ্গে নিয়ে জন্মাতে হয়।

একটা পাঁচ বাজে। ম্যানেজার বাবুর দেখা নেই। ফিরোজের উচিত স্নামালিকুম বলে উঠে যাওয়া। স্নামালিকুম বলারও কেউ নেই। অহঙ্কারী মেয়েটি এ-ঘরে আর ঢোকেনি। হয়তো ভেবেছে এ-ঘরে ঢুকলেই থার্ড রেট একটি ছেলের সঙ্গে প্রেম হয়ে যাবে। আরে বাবা, প্ৰেম এত সস্তা নয়! হুঁট করে হয় না! হুঁট করে প্ৰেম হয় কনজারভেটিভ ফ্যামিলিগুলিতে। ঐ সব ফ্যামিলির মেয়েরা পুরুষদের সঙ্গে মিশতে পারে না, হঠাৎ যদি সুযোগ ঘটে যায় তাহলেই বড়শিতে আটকে গেল। উপরিতলার মেয়েদের এই সমস্যা নেই। কত ধরনের ছেলের সঙ্গে মিশেছে!

ফিরোজ উঠে দাঁড়াল। শো-কেসটির সামনে কিছুক্ষণ কাটানো যায়। ভদ্রলোক দেশ-বিদেশে ঘুরে এত সব জিনিস। এনেছেন, কেউ একজন দেখুক। এই বাড়িতে যারা বেড়াতে আসে তাদের শো-কেস ও এ-রকম জিনিসে ভর্তি। এরা নিশ্চয়ই দেখার ব্যাপারে কোনো উৎসাহ বোধ করে না। আর থাকা যায় না, চলে যাওয়া উচিত। ডেকোবেশনে ব ফার্মটা তার হলে এতক্ষণে চলেই যেত। দুর্ভাগ্যের ব্যাপার, ফার্মটা তার নয়। এক’দিন যে এ-বিকম একটা ফার্ম তার হবে, সে-রকম কোনো নমুনাও বোঝা যাচ্ছে না।

ম্যানেজার বাবু ঠিক দেড়টার সময় এলেন। ফিরোজ প্রথম যে-কথাটি বলল, তা হচ্ছে বাথরুমটা কোথায়, আপনার কী জানা আছে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *