০১. ফরাসী ফিরিঙ্গি জাঁ পিয়েত্রো

রাজনগর – উপন্যাস – অমিয়ভূষণ মজুমদার

ফরাসী ফিরিঙ্গি জাঁ পিয়েত্রোর হাওয়াঘরটা ছিলো নদীর দিকে মুখ করে। দশ হাত উঁচু সেই হাওয়াঘর। কিছুদূরে কদমগাছের নিচে তার সেই বেঁটে হাতি। কখনো এক পা এগোয়, কখনো এক পা পিছিয়ে আসে। কখনো শুঁড় তোলে। দু পাশে কলাগাছের স্তূপ–পচা হাজা শুকনোর উপরে নতুন টাটকা গাছ। বোঝা যায় কেউ আছে যে প্রাণীটাকে আহার দিচ্ছে। কিন্তু হাওয়াঘর? কে বসবে সেখানে? কোথায় ওয়ারিশান?

একদিন দেখা গেলো পিয়েত্রোর হাওয়াঘরে উঠছে শিবমন্দির। মন্দির সে তো পূজার জন্যই–আর তা গ্রামনগরেই উঠে থাকে। এখানে গ্রামের বাইরেনদীর ধারে একটেরে নিঃসঙ্গ হলো না?

কিন্তু তা হচ্ছে রানীর নিজের ইচ্ছায়, সুতরাং কেন কী জিজ্ঞাসা না করে যা হচ্ছে তা চোখে, যা হবে তা কল্পনায় দেখে নেয়া ভালো। দেখার মতো ব্যাপারও। দশ হাত উঁচু সেই হাওয়াঘরের ভিত আছে, চওড়া চওড়া সিঁড়িগুলো আছে, মন্দির কিন্তু উঠছে নিচের মাটি থেকে, ইদারার মতো গেঁথে তোলা। হাওয়াঘরের মেঝে থাকবে মন্দিরের চারিদিকে বারান্দা চত্বর হয়ে। সে চত্বরে উঠতে হবে পুরোনো সিঁড়ি বেয়ে, অন্য নতুন সিঁড়ি বেয়ে নামতে হবে মন্দিরের গর্ভে পুজো দিতে। অখাদ্য-খাওয়া অনাচারী সেই আধা-ফরাসীর হাওয়াঘরের মেঝেতে মন্দির হয়?

দেখতে দেখতে অনেকটা উঠেছেও মন্দিরটা। এখনই যেন আন্দাজ করা যায় আর কতদূর উঠবে, শেষ পর্যন্ত তা কী রকমের হবে। নদীর দিক থেকে সরে এসে চত্বরের শেষে কিছুটা ছেড়ে প্রায় গোলাকার হয়ে গড়ে উঠেছে মন্দির। প্রায় গোলাকার বলতে হয় কেননা মন্দিরের মেঝে যেন মধুর খোপ এমন ষট্‌কোণ। দেয়াল সোজা উঠছে। কিন্তু এখনই বোঝা যায় তা গম্বুজে শেষ হবে না, বরং যেন রথ। সেই রথের মাথায় থাকবে পদ্ম; পদ্মের একটা ভারি পিতলের গোলা-শিবলিঙ্গের মাথায় যেমন বজ্র। তা চত্বরযুক্ত মন্দিরটার গড়নই যেন গৌরীপাটসমেত আর এক শিবলিঙ্গ।

সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বহু লোক কাজ করছে মন্দিরে। মন্দিরের কিছু পিছনে বাঁয়ের দিকে পিয়েত্রোর বাংলো। বাংলোর কাছে আর একদল কর্মব্যস্ত মানুষ। তারা কুমোর। মনে হয় একটা টালির কারখানা বসিয়েছে। ছোটো, বড়ো, নকশাদার; রোদে শুখানো হচ্ছে, পোআনে পোড়াচ্ছে।

মিস্ত্রি, জোগানদার, কুমোর মিলে অনেক লোক। কিন্তু যত লোক লাগুক, এমন এক মঠ কি দু-চার-ছমাসে হয়? আর এক শীতই পার হয়ে যাবে হয়তো।

কিন্তু ইতিমধ্যে ব্যাপারটা ঘটে গেলো। এসে পড়লো তারা। যেন হুমহাম শব্দও উঠছে এমনভাবেই ওরা গ্রামে ঢুকলো। আর তা স্বাভাবিকই। কারণ তারা তো পঞ্চতীর্থের মাটিই আনেনি শুধু, প্রায় তিন হাত উঁচু তিন হাত বেড় নিকষের সেই থামটিও এনেছে যা নাকি শিব হবে।

খবর পেয়ে রাজবাড়ির স্বর্ণকার অষ্টধাতুর সেই পদ্ম তৈরি করতে লেগে গেলো। সে তো থাকবে লিঙ্গের গোড়ায় মাটির নিচে, বসিয়ে দিলে তা আর চোখে দেখা যাবে না। কিন্তু সাগরেদদের বললো– সে, দেখবে তো কারিগরি সেই একজনই যে সব দেখে।

আর তখন হঠাৎ শোনা গেলো যে সাতদিনের মধ্যে শিব বসে যাবেন তাঁর মন্দিরে। একটু কেন, বেশ খানিকটা অবাক হওয়ারই কথা। মন্দির শেষ হলো কোথায়? গ্রামের পণ্ডিতেরা পাঁজি খুললো। সার্বভৌমপাড়ায় এখনো তো টোল আছে। এমন কী মাহেন্দ্রক্ষণ বয়ে যায় যে এখনই এই অপ্রস্তুত অবস্থায় শিব বসাতে হবে? মিস্ত্রিরাজদের মধ্যেও বিস্ময় দেখা দিলো। মনে করো উপর থেকে এক থান ইট খুলেই বা পড়ে লিঙ্গের উপরে।

নরেশ ওভারশিয়ার এলো। হরদয়াল শুনলো। একটু ভেবে বললো–আর কত গাঁথা বাকি?

বারো হাত।

গাঁথাও তো পনেরো হলো শুনেছি। হরদয়াল আর একটু ভেবে নিয়ে বললো–কড়ি বরগার মতো মোটা কাঠ বসিয়ে তার উপরে অস্থায়ী ছাদ করে, তার উপর বাকি দেয়াল গাঁথা চলে?

মিস্ত্রিরা, আজ্ঞা হাঁ বলে উঠে পড়লো। সোজার মধ্যে এমন পাকা বুদ্ধি বলেই না দেওয়ান।

কিন্তু এমন করে শিব বসানো অশাস্ত্রীয় যে তাও তো উড়িয়ে দেয়া যায় না। ওদিকে আবার রানীই ঠিক করেছেন তিথিটাকে।

.

০২.

দিন সাতেক আগে রানী বসবার ঘরে রূপচাঁদকে ডেকে বলেছিলেন উকিলসাহেবকে খবর দিতে।

এখনো এটাকে দেওয়ানকুঠি বলে। বাড়িটা তৈরির সময় থেকেই যে নামে পরিচিত ছিলো তা সহজেই বদলায় না। যদিও রাজবাড়ির লোকেরা এবং কাছারির আমলারা জানে এখনো সেখানে হরদয়াল থাকে বটে, সে কিন্তু দেওয়ান নয় আর।

পদমর্যাদায় কিছু লাঘব হয়েছে বৈকি। সেই একই লোক তো, আগে দেওয়ান ছিলো, এখন আর তা নয়, যদিও তেমনই প্রায় সবই–চালচলন, কথাবার্তা। বেতনটা কমেছে, তাহলেও গ্রামের কেন, সদরের হিসাবেও এখনো তা অনেক। কোনো বিষয়েই রানীর মত জানা সহজ নয়। সদর নায়েবমশাই এই বিষয়ে একদিন শুনেছিলেন এরকম : মানী লোক তো, তাছাড়া ওই টাকাই তো ওঁর অভ্যাস ছিলো। কেউ কেউ বলে উকিল। এটা একটা ব্যথার মতো ব্যাপার নাকি? রানী তাকে বরখাস্ত করেছিলেন। দু-তিনটি বছর গড়িয়ে গেলো না? ওদিকে কিন্তু তারপর আর কেউ দেওয়ান হয়নি।

হরদয়াল ইজিচেয়ারে আধশোয়া অবস্থায়। চেয়ারের হাতলে কাঁচের গ্লাসে কিছু পানীয়। অন্ধকার হয়ে আসছে। মশালচি ওদিকের দরজায় বসে হিংসের একটা বড় বাতিকে ঠিক করছে। অন্ধকারে একটা কোমল ভুলে যাওয়া, দূরে সরে যাওয়ার ভাব দেখা দিয়েছে। হরদয়ালের হাত দুখানা কোলের উপরে রাখা। কিছু ভাবছে সে।

রূপচাঁদ খুক করে কাশলো।

-কে? রূপচাঁদ? হরদয়াল মুখ তুলো-তুমি ছাড়া আর কে?

রূপচাঁদ বললো–রানীমা একবার ডেকেছেন, আজ্ঞে।

-এখনই?

–আজ্ঞে, খাসকামরায়।

–আসছি, বলো।

রূপচাঁদ গেলে পোশাক পাল্টালো হরদয়াল। মশালচিকে নির্দেশ দিলো শোবার ঘরে আর লাইব্রেরিতে আলো যেন বেশি না হয়। আলনা থেকে বালাপোশ নিয়ে হরদয়াল রাজবাড়ির দিকে গেলো।

রানীর খাসকামরায় তখন ঝাড়ে আলো জ্বলছে। বোধ হয় মৃদু মৃদু বাতাস একটা আছে ১৮৬০-এর শেষে হেমন্তের ঠাণ্ডাটাকে বাড়ানোর মতো। কিন্তু বালাপোশ অথবা শাল সত্ত্বেও বিধবে এমন নয়। রানীর পায়ের তলায় লাল গালিচা। তার উপরে আঙুলের ডগা চোখে পড়ে। গায়ে পান্না রঙের শাল। রানী বললেন–এসো হরদয়াল, তোমাকে ডেকেছি আমি। যেন বা হাসলেন, বললেন–বসো।

রানীর হাসি সম্বন্ধে আলোচনা হয় না। কিন্তু তিনি যখন মুখ টিপে হাসেন তখন যে বাঁ দিকে সামান্য টোল খায় তো এতদিনেও হরদয়াল জানতো না। এজন্য, রানী না হলে বলা যেতো, হাসিটাতে একটা অল্পবয়সী ভাব জড়িয়ে থাকে। তার চুল টেনে তুলে বাঁধা, কিন্তু পাক দেখে অনুমান একসময়ে ঝাপটা ঢেউ তুলে থাকতো তা কপালের উপরে।

হরদয়াল বসলে তিনি বললেন–ব্যাপারটা একটা উৎসব। কথার সূচনা করে চোখ তুললেন তিনি, তাঁর টানা চোখের পক্ষ্মগুলো সাধারণের চাইতে বড়ো। মনে হয় উপরদিকে ঈষৎ বাঁকানো।

বললেন–তোমার মনে পড়ে হরদয়াল, মরেলগঞ্জে কালীপূজা হয়েছিলো। ডানকান করেছিলো। তুমি গিয়েছিলে। রাজুর নিমন্ত্রণ ছিলো। সে যায়নি।

বছর দু এক আগে ডানকান কালীপূজা করেছিলো, মরেলগঞ্জের নীলকুঠির ইংরেজ কুঠিআল ডানকান হোয়াইট। পূজা অবশ্য হয়েছিলো তার দেওয়ান মনোহর সিংহের আট চালা চণ্ডীমণ্ডপে। আর ওদিকে যখন পূজা এদিকে ডানকানের বাংলোয় তখন আতসবাজি ফুটছে, মদ আর নাচ চলেছে।

হরদয়ালের কাছে ব্যাপারটা এখনো কিম্ভুত। ঠিক হাস্যকর নয়, কেননা, শোনা যায় সেবারে সেই সিপাহী বিদ্রোহের অবসানে কলকেতার ফোর্টের কোন কোন জাঁদরেল ইংরেজও নাকি কালীঘাটে পূজা দিয়েছিলো।

রানী বলে গেলেন–পিয়েত্রোর হাওয়াঘরে শিবমন্দির হচ্ছে শুনছো বোধ হয়? আগামী বুধবারে, আর সাতদিনও নেই, বিগ্রহ স্থাপিত হবে। একটা উৎসব তো। ডানকানকে নিমন্ত্রণ দিলে হয়?

হরদয়াল বললো–শিববিগ্রহ স্থাপনে

থামলো সে। (এরকম মতামত দিতে পারতো দেওয়ান, সে আর দেওয়ান নয়) বললো– আবার দিনের বেলায় তো?

রানী বললেন–হ্যাঁ, নিমন্ত্রণ মন্দিরে হবে না। তোমার ভয় নেই। উপরন্তু এখনই প্রাণ প্রতিষ্ঠা হচ্ছে না যে ছোঁয়া লাগবে। (রানী কি হাসলেন!) পিয়েত্রোর বাংলোয় হতে পারে। দুপুরে একটা দুটোয় নাকি ডানকানেরা একবার খায়। বাগচীবাড়ি থেকে জানা গেলে তাকে নাকি লাঞ্চো বলে। ডানকানকে সপরিবারে বলল। মনোহরকে বলবে কিনা ভেবে। তোমাদের পক্ষে সস্ত্রীক বাগচী থাকবে। রাজু থাকতে পারে। তুমি থেকো। নায়েব-ই রিয়াসৎ থাকবেন না।

রানী উঠলেন। আসনের পিছনের পর্দা ঠেলে অন্তরে যেতে যেতে দাঁড়ালেন, বললেন, মরেলগঞ্জে কীবল নামে এক ছোকরা সাহেব এসেছে, জানো? হরদয়াল নিজের অজ্ঞতায় বিব্রত হলো। রানী হেসে বললেন, তাকেও বলো। দরবার শেষ হলো।

কখন কী মনে আসবে, কোনটা আগে আসবার সুযোগ নেবে তা বলা যায় না। লাঞ্চো এই শব্দটা মনে এলো হয়দয়ালের। উচ্চারণটা বিকৃত; কিন্তু তা কি ইচ্ছাকৃত কিংবা না জেনে? কৌতুক বোধ করলো হরদয়াল। তারপর তার মনে এলো নায়েব-ই-রিয়াসৎ এই ভারি শব্দটা। আর কেউ দেওয়ান হয়নি। পদটা শূন্য আছে। কিছুদিন আগেও তাকে সদরনায়েব বলা হতো। এখন তার দায়িত্ব বেড়েছে, নামটাও বদলেছে। দেওয়ানের পরিবর্তে সদর-ই-রিয়াস। ও, হ্যাঁ, কীবল নামে কোনো ছোকরা যদি এসে থাকে তার খোঁজ জানা তার কর্তব্য নয় আর এখন। রানী ও নায়েবের চরেরা তা করবে।

.

০৩.

সে যাই হোক, এর ফলে বিগ্রহস্থাপনের দিনটিতে ভিড়টা বেশ দর্শনীয় হয়ে উঠলো। আমন্ত্রিতদের, কর্মচারী আমলা কারিগরদের সঙ্গে প্রচুর সংখ্যক রবাহূত যেমন এদিকে, ওদিকে তেমনি পিয়েত্রোরকুঠিতে লাঞ্চোর জন্য বাবুর্চি খানসামা, লাঞ্চে নিমন্ত্রিত নীলকুঠির সাহেব ডানকান, তার দেওয়ান মনোহর সিং, এপক্ষের বাগচীমাস্টার, তার স্ত্রী (ইংরেজ স্ত্রী ক্যাথারীন, সংক্ষেপে কেট), উকিল হরদয়াল তো বটেই, ডানকানের অতিথি সদ্য বিলেত-আগত কীবল নামে এক ছোকরা সাহেবও ভিড়টাকে বিশিষ্ট করে তুললো।

ভিড় যখন জমে উঠেছে, বেলা দ্বিপ্রহরের কিছু আগে, রানী এলেন। আগেপিছে দুটো হাতি। হাতির আগে ঘোড়া। ঘোড়ার পিঠে দুপাশে ঝোলানো লালসালুর ঝালরদার দুই দামামা, দুপাশ থেকে দুজন তা পিটে চলেছে। তাদের পিছনে চোপদার দুই সারিতে। হাতি দুটির পিঠে হাওদা। রামপিয়ারী আগে। তার ঝুটো জরির কাজ করা লাল বনাতের জামা মাটি ছোঁবে যেন। তার চৌদোলা হাওদায় রানী। তাঁর পাশে একজন মহিলা। ঠিক চেনা যায় না এমন অবগুণ্ঠন। কিন্তু রানীর পাশে মানায় বটে। হাওদার বাইরে রেলিং ধরে রূপচাঁদই। গায়ে তার লাল পটুর পিরহান। বুকে আড়াআড়ি বাঁধা নীল পশমী ধোকড়। মাথায় গাঢ় নীল মলমলের পগগ। পরের হাতিটি জয়নাল। একটু বয়স হয়েছে। রামপিয়ারীর দেড়া উঁচু, দাঁতাল। খোলা হাওদায় রাজু, রাজকুমার রাজচন্দ্র। রাজুর পরনে গলাখোলা ইংরেজি ব্লাউজ কামিজ। হাতে বন্দুক।

ডগরের ঘোড়াই পথ করছিলো। চোপদারদের দুই সারি সেই ফাঁকে ঢুকে ডাইনে বাঁয়ে সরে সরে চাপতেই ভিড়ের মধ্যে গলিপথটা তৈরি হলো। সেই গলিপথের মাথায় হাতি থামলো। প্রথমে রামপিয়ারী বসলো। মাহুত নেমে রেলিংদার কাঠের সিঁড়িটা নামিয়ে হাতির গায়ে হেলান দিয়ে ধরলো। রানী এবং তার সঙ্গিনী আগে পিছে নামলেন।

তাঁরা এগিয়ে গেলে রাজচন্দ্র নামলো তার হাতি থেকে। রূপচাঁদ এগিয়ে এসেছিলো। তার হাতে বন্দুক দিয়ে রাজচন্দ্র মন্দিরের চত্বরের দিকে এগিয়ে গেলো।

এতক্ষণ চত্বরটি খালি ছিলো। সিঁড়ি বেয়ে রানীমা উঠতেই চত্বরের নিচে থেকে পুরনারীরা উলু দিয়ে অনুসরণ করলো। তাদের কারো কারো কাঁখে ঝকঝকে নতুন ঘড়া। তারা এগিয়ে যেতেই অন্য এক সিঁড়ি দিয়ে স্বগ্রামের আমন্ত্রিত পুরুষরা উঠতে লাগলো চত্বরে। তখন জনতার মধ্যে গুঞ্জন উঠলো–দেখা যাচ্ছে, দেখা যায়, আসছে ওই। কারা শঙ্খ বাজালো৷ নিকষের থামের মত শিবলিঙ্গ বেশ দূর থেকেই দেখতে পাওয়ার কথা। ওদিকের আর এক সিঁড়ি দিয়ে হরদয়াল আর ডানকানকে উঠতে দেখা গেলো। তাদের ঠিক পিছনে বাগচীমাস্টার আর তার পাশে নতুন এক সাহেব। ভিড়ের মধ্যে ফিসফিসানি শোনা গেল বাগচীর শ্বশুরকুলের নয়তো? নাকি ডানকান বেটার মেতোভাই। সাধারণ, রবাহূতরাও একে-দুয়ে চত্বরে উঠতে শুরু করলো এবার।

ততক্ষণে মিস্ত্রিরা মন্দিরের ভিতরে ঢুকে গিয়েছে, সিঁড়ি দিয়ে নেমে গিয়েছে। ভিড়ের থেকে ছোকরা বয়সের কয়েকজন বুদ্ধি করে কাছের এক গাছে গিয়ে চড়লো। তারপর গাছ ভরে উঠলো মানুষে।

মন্দিরের দরজার সামনে, অর্থাৎ যেখানে দরজা বসবে, লিঙ্গকে স্নান করানো হলো। মিস্ত্রিরা ততক্ষণে লিঙ্গ বসানোর গোল ফাঁদটাকে ঠিক করেছে। মন্দিরের ঘরে তখন নামলেন রানী তার সঙ্গিনীকে নিয়ে তার হাতেই পূজার উপকরণ। রানী ভিড়ের আর একজনকে ডেকে বললেন–এসো, বড়গিন্নি।

পঞ্চতীর্থের মাটি বার করে সে ফাঁদে সেই মাটি বসানো হলো। প্রধান মিস্ত্রি বললো–—এবার–

রানী বললেন–একটু রসো।

পিছন ফিরে বললেন–দাও এবার যা এনেছে।

রানীর সঙ্গিনী ফুলের সাজি থেকে একটা ছোট রুপোর বাটি দিলো মিস্ত্রির হাতে। সে বাটি যেন রক্তচন্দনে টৈটুম্বর। সঙ্গিনীই মিস্ত্রিকে বলে দিলো–ওটার উপরে স্বর্ণের শতদল বসবে, তার উপরে শিবলিঙ্গ।

শোনা যায় মিস্ত্রিরা নলের বংশধর এবং হাতে যখন করনি তখন জোগান যেই দিক বাঁ হাতেই তা ধরে। এ নিয়ে সুগ্রীব না কার সঙ্গে একবার হাঙ্গামা হুজ্জত বেধেছিলো। তাতে কিন্তু ধারা বদলায়নি। তীর্থের মাটি সমান করে, করনি দিয়ে গোল গর্ত করে বাটিটাকে বসিয়ে বাঁ হাতেই রানীর সঙ্গিনীর দু হাতে ধরা অত বড় স্বর্ণপদ্মটাকে নিলো সে। সেটাকে বসিয়ে বললো–এবার তাহলে–

দু-তিনজনে মিলে নিকষের লিঙ্গটাকে সোজা করে ধরলো। প্রধান মিস্ত্রি নিজেও হাত লাগালো। মেয়েরা উলু দিয়ে উঠলো। ভিড় শিবের নামে জয় জয়কার দিলো। ততক্ষণে কুচো ইট আর মশলার জমাট গুঁজে করনির মাথা দিয়ে খুঁচিয়ে পোক্ত করতে লেগেছে মিস্ত্রিরা। ফুল ছড়িয়ে দিয়ে রানী পিছন ফিরলেন।

একেই তাহলে শিব প্রতিষ্ঠা বলে। এই কি প্রথা–এরকমই মনে হলো দর্শকদের।

প্রথার কথা কজনেই বা জানে। রোজ তো আর হয় না। দুএকজনের স্মৃতিতে অন্য কোনো কোনো শিবপ্রতিষ্ঠার কথা থাকলেও থাকতে পারে, কিন্তু সে নিরিখে কি আজ যা হলো তার বিচার হয়! রাজপুরোহিত ছিলেন। আমন্ত্রিতদের মধ্যে বৃদ্ধ শিরোমণিমশায় ছিলেন। রাজপুরোহিত প্রথমে কৌশলে কাটলেন–তা বাপু, আমি শিবতন্ত্র জানি না। এ শিবের জন্য তো নতুন পুরোহিতই এসেছে। পরে আর একটু কৌশল করে বললেন–তোমরা যদি অন্যত্র অন্যরকম দেখেই থাকো সে কি রাজবাড়ির ব্যাপার? আমি তো বলি বাপু, তোমরা যদি প্রতিষ্ঠে করো, আর আমাকেই ডাকো, এখন জানা রইলো, এমন বিধানই দেবো। শিরোমণি অত সহজে মুখ খোলেন না। মনে মনে শাস্ত্র ঘেঁটে শিবলিঙ্গের মূলে রক্তচন্দনেরও আধার বসানোর যুক্তি খুঁজলেন। অশাস্ত্রীয়ই বোধ হলো তার কাছে। শিবপূজায় শ্বেতচন্দনই বিধেয়।

ভিড়ের টানে একটা মেলা বসে গেলো। জিবেগজা আর আর দই, মুড়কি মোয়া মিঠাই, জোলাকি মাটা আর গামছা, বাঁশের দাঁড়ে বসা শোলার পাখি। মেলার টানেই মেলা চললো যেমন চলে, যদিও মন্দিরের চত্বর খালি হয়ে আসছে।

.

০৪.

মেলা থেকে ফিরতে ফিরতে গ্রামের পোস্টমাস্টার চরণদাস বললো–ছিলো ফরাসী সাহেবের হাওয়াঘর, হলো শিবমন্দির। লাও।

তার এক সঙ্গী বললো–এতদিনে পিয়েত্রোর আত্মার শান্তি হলো গো।

চরণদাস বললো–সেবাপু খেস্টানি আত্মা। ভারি মজেসে ঘুমোতে লেগেছে এখন। কোন ক্ষেতিবৃদ্ধি নেই। সেই কবে রোজকিয়ামৎ হবে তখন দেখা যাবে।

সঙ্গীরা নতুন খবরের আকর্ষণে ঘিরে ধরলো চরণদাসকে।

একজন বললো–ইনসাল্লা, বলিস কী রে? তাচরণ তোর জানারই কথা। তুই তো আবার খেস্টান বাগচীমাস্টারের সাগরেদ।

অন্য একে বললো–কী যেন রোজ বললে? তাতে কী হয়?

 চরণদাস হেসে বললো–সে ভারি মজার। সেই একদিন, তা সে যে কত লাখ বছর পরে আসবে এখনো কেউ জানে না, সেদিন নাকি ভগবান বিচার করবেন।

মানে লাখ লাখ বছর ধরে কোনো বিচারই হবে না?

চরণদাস ঠা-ঠা করে হেসে উঠলো। বললো–তাই তো। বলতে পারো ভগবানের এজলাশে তামাদি হয় না। কিন্তু কোটি কোটি মানুষের পাপের হিসাব লাখ লাখ বছর ধরে কে রাখে কে জানে। আমার তো মনে হয় ডানকান বেটা বুঝে নিয়েছে ওর আত্মার বিচারের কাগজপত্তর ততদিনে সব নিপাত্তা হয়ে যাবে। আর থাকলেও কিছু তা পড়া যাবে না।

ধরেছিস ঠিক। অন্য একজন বললো–আমার এতদিন মনে হতো রহিমুদ্দিন যেমন বলে, সেই ইবলিশের বাচ্চা তাই। এখন এবার রহিমুদ্দিনকে বুঝিয়ে বলবো–সেখানেও কাগজপত্তরের খেলা। তাছাড়া ধরো ঘুন বেনের জাত তো, অন্য কারো আত্মার ভালো কাগজ নিজের বলে হাতিয়ে নিতে পারে।

এক সরল গ্রামবাসী গাঁক গাঁক করে হেসে উঠলো। সামনে থেকে আর এক সরল গ্রামবাসী পিছন ফিরে বললো–তাই বুঝি ডানকানা কুঁদে বেড়ায়, চরণদা? তা, পিয়েত্রো কিন্তু ডানকানার মতো ছিলো না। তাছাড়া তাকে তো পোড়ানো হয়েছিলো। তার আত্মা ধরো যে ঘুমাবে কোথায়? আমার তোমার আত্মার মতোই নাক দিয়ে বেরিয়েই যদি যমদূতের হাতে না পড়ে থাকে, তবে চিতার আগুন নিবে অন্ধকার হতেই কী হয়েছে কে জানে। সে শিউরে উঠলো।

এখানে তাদের পথে আর একটি পথ এসে মিশেছে। চরণদাস বললো–সে পরে ভাবিস। মেয়েরা এই পথে আসবে। তোরা এগো, আমি বউ-এর জন্য দাঁড়াই।

হাসতে হাসতে চরণদাসের প্রথম সঙ্গী বললো–তা, চরণ, গাঁয়ে তোবউ একা তোমারই, কেমন নাকি?

চরণ বউ-এর অপেক্ষায় পথের পাশে সরে দাঁড়ালো হাসতে হাসতে।

.

০৫.

ভিড়ের প্রথম আর শেষ এক নয়। তখন আর চোপদারের সারিতে বাঁধা পথ নেই। বিশৃঙ্খলা, ঘোরাফেরা, ঠেলাঠেলি শুরু হয়েছে। ব্যাপার বুঝে চোপদাররা এগিয়ে এলো। পথ দাও বলে রূপচাঁদ চেঁচাতে লাগলো।

রানী সামনে, পিছনে সঙ্গিনী। তার অবগুণ্ঠন কিছু শ্লথ। তিলফুল নাসা, সুগঠিত চিবুক আর টানা চোখ দুটি, নাকি লোচন বলে, চোখে পড়ছে। থেমে দাঁড়িয়েছিলো তারা। পাশে চাইতে গিয়ে অদূরে রাজকুমারকে দেখতে পেলো সে। কেমন বিড়ম্বনা দেখো–নিঃশব্দ হাসিতে যেন এই কথাটা ছিলো। রাজকুমারের শিকারের পোশাক দেখে টাকুঁচকে উঠলো তার। কিন্তু রাজকুমারের চোখ নিজের উপরে দেখেবরং পাশ দিয়ে টানা অবগুণ্ঠনে চিবুকের আর কিছুটা ঢাকা পড়লো।

শিক্ষিত হাতি, ক্ষতি করে না; কিন্তু তার পায়ে তো চোখ নেই। সুতরাং তার গলার ঘণ্টা বেজে উঠতেই আপনি ভিড়টা এদিকে পাতলা হলো। তখন চত্বরের শেষ ধাপ থেকে নেমে রানী বললেন–এসো, নয়ন।

হাওদায় বসে আবার বললেন–রাজু বোধ হয় শিকারে চলেছে। উত্তরের অপেক্ষা না করেই বললেন আবার–সাহেব দুটোর মধ্যে বুড়োটা বোধ হয় ডানকান।

রানীকে নিয়ে রামপিয়ারী তখন খানিকটা এগিয়েছে। রামপিয়ারীর জরির জামার চৌদোলা হাওদার কিংখাবের ফুলকারি আলোয় চমকাচ্ছে। জয়নাল কিছু পিছনে। পাশে একটা গলিপথ। জয়নাল দাঁড়িয়ে পড়ে একটা গাছের ডাল ভাঙলো। মাহুত ডাঙ্গস ঠুকলো তার মাথায়। যেন হাসলো এমন ভঙ্গিতে মুণ্ডু ঘুরিয়ে জয়নাল পাশে সেই গলিপথটাকে ধরলো একটু দ্রুতগতিতে। ফলে সিঁদুরে খড়িতে আঁকা তার গায়ের পদ্মগুলো অস্পষ্ট হচ্ছে।

রানী আর একবার কথা বললেন, বাগচীমাস্টারের স্ত্রীর কাছে শুনেই সব ব্যবস্থা হয়েছে। নিশ্চয় লাঞ্চোর?

পাড়ছাড়া দুধ-গরদের ঘেরে তাকে অন্যমনস্ক দেখালো। উপোস করে আছে, মনে হলো সঙ্গিনীর, হয়তো সেজন্যই একটু শুকনো দেখাচ্ছে। আর এতক্ষণে তা ঠাহর হলো। রানীর সঙ্গিনীর অবগুণ্ঠন শ্লথ, নিচে থেকে বর্ণটা ঠাহর হলো, তার জড়োয়ার কন্ঠি কলার ঝিকমিক করলো।

.

০৬.

লাঞ্চ শুরু হলো ভাজা মাছ দিয়ে। লাঞ্চ বটে নাম, আয়োজনটা ডিনারের। অন্যদিকে যেন হালের কটেইল পার্টির অভ্যাসও আছে। ছজনের টেবিল, কিন্তু মাঝখানে সাজানো বোতল বোধ করি এক ডজন এবং তা নানা আকারের। সেগুলোকে ঘিরে কয়েক ডজন ঝকমকে কাঁচের গ্লাস। জলের গ্লাসই বরং অনুপস্থিত। সাদা ব্রোকেডের টেবল ক্লথে ঝকঝকে হেমন্ত দুপুরের আলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *