০১. প্রিয় রবিবাবু

প্রিয় রবিবাবু :

আমি আপনার গল্পগুচ্ছের সব গল্পগুলো পড়েছি, আর বুঝতে পেরেছি। কেবল ক্ষুধিত পাষাণটা বুঝতে পারিনি। আচ্ছা সেই বুড়োটা যে ইরানি বাদির কথা বলছিল, সেই বাঁদির গল্পটা বলল না কেন? শুনতে ভারী ইচ্ছে করে। আপনি লিখে দেবেন। হ্যাঁ।

আচ্ছা জয় পরাজয় গল্পটার শেষে শেখরের সঙ্গে রাজকন্যার বিয়ে হল। না? কিন্তু আমার দিদিরা বলে শেখর মরে গেল। আপনি লিখে দেবেন যে, শেখর বেঁচে গেল আর রাজকন্যার সঙ্গে তার বিয়ে হল। কেমন? সত্যি যদি শেখর মরে গিয়ে থাকে, তবে আমার বড় দুঃখ হবে।

আমার আপনাকে দেখতে খু উ উ উ উ উ উব ইচ্ছে করে। একবার নিশ্চয় আমাদের বাড়িতে আসবেন। নিশ্চয় আসবেন কিন্তু, না এলে আপনার সঙ্গে আড়ি। আপনি যদি আসেন তবে আপনাকে আমাদের শোবার ঘরে শুতে দেব। আমাদের পুতুলও দেখাব।

ইতি রাণু

 

সকালবেলার ডাকে অনেকগুলি চিঠি ও পত্রপত্রিকা এসেছে। টাটকা টাটকা চিঠিগুলো পড়ে ফেলাই কবির অভ্যেস। এক একটা চিঠির উত্তরও লিখতে বসেন সঙ্গে সঙ্গে।

এই চিঠিটি পড়ে কবি কিছুক্ষণ বিস্মিত ভাবে তাকিয়ে রইলেন জানলার দিকে।

তিনতলার এ ঘরের জানলা দিয়ে দেখা যায় অনেকখানি আকাশ। কিছু চিন্তা করার সময় আকাশের দিকে কবির চোখ চলে যায়। চার দেয়ালের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিস্তীর্ণ পরিসরে ছুটে যায় মন, যেন শূন্যে ফুটে ওঠে অনেক লেখা বা রেখাচিত্র।

আজ সকাল থেকেই আকাশ মেঘলা।

কাল সারারাত শুধু যে খুব গরম ছিল তাই-ইনয়, একেবারে নিবাত নিষ্কম্প, প্রকৃতির সব কিছুই স্তব্ধ। গরমে কবির একটুও কষ্ট হয় না, গরম টেরই পান না, পিঠ বিন্দু বিন্দু ঘামে ভরে গেলেও অস্বস্তি বোধ করেন না।

এই শ্রাবণ মাসে বেশি গুমোট হলেই বোঝা যায়, বৃষ্টি আসবে। ঠিকই ঘনিয়েছে মেঘ। কবি বৃষ্টি এত ভালবাসেন যে তৃষ্ণার্ত চাতকের মতন ঘন ঘন তাকান মেঘের দিকে। সব কটি ঋতুর মধ্যে বর্ষাই তার সবচেয়ে প্রিয়।

চিঠিখানি তিনি দু’বার পড়লেন। পত্রলেখিকা পদবি দেননি, শুধু লিখেছেন নাম। ঠিকানা আছে অবশ্য, বেনারসের।

এই রাণু কে? কত বয়েস? চিঠির ভাষায় অল্প বয়েসিনীই মনে হয়, কিন্তু গম্ভীর ভাবে সমোধন করেছে, ‘প্রিয় রবিবাবু’! অগ্রে বা অন্তে শ্রদ্ধা বা প্রণাম জানাবার কোনও বালাই নেই। আপনাকে আমাদের শোবার ঘরে শুতে দেব’ এই অংশটি পড়ে কবির মুখের দাড়ি-গোঁফের আড়াল থেকে ঝলসে উঠল কৌতুক হাস্য। এটা বেশি খাতির? এখনও পর্যন্ত তিনি কারওর বৈঠকখানায় কিংবা বারান্দায় শোওয়ার আমন্ত্রণ পাননি!

রাণু? এই নামে কবির নিজেরই এক কন্যাসন্তান ছিল। সে আর নেই। বুক ভরা অভিমান নিয়ে সে চলে গেছে পৃথিবী ছেড়ে।

গুরু গুরু মেঘগর্জন শুরু হয়েছে। যেন ডঙ্কা বাজিয়ে রথে চেপে আসছে বর্ষা। হঠাৎ বাতাস হয়েছে প্রবল। কবি এসে দাঁড়ালেন ঝুল বারান্দায়। প্রথম বর্ষণকে বরণ করলেন মাথা পেতে।

তারপরই ডাক এল নীচ থেকে।

চিঠিগুলির উত্তর আর এখন লেখা হল না।

শান্তিনিকেতন থেকে গুরুতর খবর এসেছে। চারজন ছাত্র খুবই অসুস্থ। ইনফ্লুয়েঞ্জা! অতি পাজি রোগ। এই মহাযুদ্ধের সময় থেকেই শুরু হয়েছে বলে কবি এই অসুখের নাম দিয়েছেন যুদ্ধ জ্বর। যুদ্ধে যেমন সৈন্যরা অনেকে আহত, অনেকে নিহত হয়, সেই রকম এই রোগেও অনেকে ভুগে ভুগে কাহিল হচ্ছে, কেউ কেউ মারাও যাচ্ছে।

শান্তিনিকেতনে পাঠাতে হবে ওষুধপত্র ও একজন ভাল চিকিৎসক। এখন আর তিনি কবি নন, তিনি গুরুদেব, শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ের সব ভার তার ওপর। তার ওপর ভরসা করেই অভিভাবকরা ছেলেদের পাঠান।

ওখানকার ছাত্রদের আবাস ভবনটির ছাদ থেকে বর্ষার জল পড়ছে, মেরামত করা দরকার। একজন কলা-শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে। টাকা?

পর পর কয়েকটি দিন গেল নানা রকম ব্যস্ততায়। তারপর তিনি নিজেই জ্বরে পড়লেন। এখন জ্বর হলেই ভয়ের কথা। প্রথম দিন তিনি জ্বর গায়ে নিয়েই গেলেন রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে। ওঁর ছেলে মলু শান্তিনিকেতনের ছাত্র। বিকেলবেলা কালিদাস আর সুকুমার এল নতুন গান শিখে নিতে। জ্বরের কথা কারওকে বললেন না, গান গাইবার সময় তিনি নিজেই ভুলে গেলেন।

কালিদাস ইতিহাসের পণ্ডিত, আর সুকুমার সন্দেশ পত্রিকায় কবিতা-গল্প-নাটক লিখে শুধু ছেলেদের নয়, বড়দেরও মাতিয়ে রেখেছে। এই দুজনেরই গানে খুব উৎসাহ।

সুকুমার সব সময়েই যেন কৌতুকে ভরপুর, সে দু হাত ছড়িয়ে মাথা নেড়ে গান গায়। তুলনায় কালিদাস একটু গভীর প্রকৃতির হলেও সুকুমারের সব কিছুতে সে তাল দিয়ে যায়।

‘এমনি করেই যায় যদি দিন যাক না/ মন উড়েছে উড়ুক-না রে মেলে দিয়ে গানের পাখনা…’ এই গানটি সুকুমারের খুব প্রিয়। এর অন্তরাটা এখনও গলায় ঠিক ওঠেনি। টধরণী আজ মেলেছে তার হৃদয় খানি।…’

কালিদাস কবির কাছে শুনতে চায় নতুন গান। কবি খাতার পাতা ওল্টাতে লাগলেন। তাঁর সদ্য রচিত গানটি গম্ভীর ধরনের, দেশাত্মবোধক। ‘দেশ দেশ নন্দিত করি মন্দ্রিত তব ভেরী/আসিল যত বীরবৃন্দ আসন তব ঘেরি…’। গাইতে গাইতে কবির কণ্ঠস্বর এক সময় গম্ভীর ভাবে গমগম করতে লাগল। ‘প্রেরণ করা ভৈরব তব দুর্জয় আহ্বান হে—’

সুকুমার আর কালিদাস সে গান শুনতে শুনতে বুঝতেই পারল না যে কবির শরীর সুস্থ নেই।

পরদিন টের পেয়ে গেল প্রতিমা। ব্যস্ত হয়ে গেল রথী। এ রকম জ্বর কিছুতেই অবহেলা করা চলে না। বিধান রায় নামে একজন তরুণ ডাক্তার বেশ নাম করেছে, ডাকা হল তাকে। এরই মধ্যে তাঁর ভিজিট ষোলো টাকা এবং গাড়ি ভাড়া দিতে হয়।

চিকিৎসকটি নির্দেশ দিয়ে গেলেন সম্পূর্ণ বিশ্রামের।

বিশ্রাম মানে শুয়ে থাকা। কিন্তু শুয়ে শুয়েও তো লেখা যায়। সঙ্গীত বিষয়ক একটি প্রবন্ধ লেখার জন্য বারবার তাড়া দিচ্ছে প্রমথ। সে প্রবন্ধটি লিখতে লিখতে কবির মনে পড়ল অনেকগুলি চিঠির উত্তর দেওয়া হয়নি।

তিনি সব চিঠিরই উত্তর দেন। কেউ একজন কষ্ট করে চিঠি লিখল, অথচ উত্তর পেল না, এটা তার মতে পত্র প্রাপকের অসভ্যতা।

রাণু নামী মেয়েটিকেও তিনি চিঠি লিখে দিলেন। তার পরিচয় ও বয়েস বুঝতে না পেরে খানিকটা আলগা আলগা ভাবে।

মন টানছে শান্তিনিকেতন। জ্বরের জন্য যাওয়া হচ্ছে না। বর্ষার শান্তিনিকেতন অপরূপ।

নিজের অসুখের চেয়েও চারজন ছাত্রের অসুস্থতার জন্য তার উদ্বেগ বেশি। ডাক্তার পাঠানো হয়েছে। কয়েকদিন পর ছাত্রদের অবস্থার উন্নতির খবর পেয়ে কবিও সুস্থ হয়ে উঠতে লাগলেন।

শরীর কাহিল, কিন্তু জ্বর ছেড়েছে। কবির ইচ্ছে করল, আর একবার বৃষ্টিতে ভিজতে। মনে এসে গেল একটা নতুন গান : ব্যাকুল বকুলের ফুলে ভ্রমর মরে পথ ভুলে। আকাশে কী গোপন বাণী বাতাসে করে কানাকানি, বনের অঞ্চলখানি পুলকে ওঠে দুলে দুলে…।

সে গানের সুর গুনগুনোতে তালটাও নতুন রকমের হয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *