০১. প্রজনার্থা

প্রজনার্থা

বিবাহ অর্থাৎ আনুষ্ঠানিক ভাবে একটি পুরুষ একটি আধার সঙ্গীর সঙ্গে আমরণ বাস করবে, অন্য কোনও পুরুষ বা নারী তাদের মিলিত জীবনে অনুপ্রবেশ করবে না— এইটিই ছিল প্রাক্‌পৌরাণিক যুগের পর থেকে বৈবাহিক সম্পর্ক। অবশ্য একটি পুরুষের একাধিক নারীর সঙ্গে সহবাস প্রথা চালু ছিল, যদিও দ্রৌপদী ছাড়া অন্য কোনও নারী বৈধ ভাবে একাধিক স্বামীর সঙ্গে সহবাস করতে পারেনি। পুরাণের মধ্যে বারে বারে পাওয়া যাচ্ছে বিবাহের অভিমুখ। এখন ওই দিকেই বোধ হয় সংখ্যা গরিষ্ঠতা বেশি।

ছিয়াশি বছরের দিদিমা; শিক্ষিতা, কিন্তু ইংরেজি জানেন না। সদ্য এম এ পাশ করা নাতনি সামনে এসে দাঁড়াতেই প্রশ্ন করেন তাকে: ‘হ্যাঁরে, কাকে বিয়ে করবি ঠিক করেছিস?’

নাতনি লজ্জায় মিথ্যে বলল, ‘না, দিদিমা, এখনও ঠিক করিনি। কিন্তু কেন জিজ্ঞেস করছ বলতো?’

‘দেখ, ধরে দিলে (অর্থাৎ সম্বন্ধ করা) বিয়ে করবি না।’

‘কেন?’

‘কেন আবার? যে-শাড়িটা তিন বছর পরে ছিঁড়ে যাবে, সেটা কেনার বেলায় দোকানে নিয়ে গিয়ে তোর পছন্দে কেনা হবে, আর যে-মানুষটাকে জীবনে ফেলতে পারবি না, তার বেলায় পছন্দের কথা কেউ তুলবে না? তোর বিয়ে, তুইই করবি, তোর পছন্দে।’ একটু থেমে যোগ করেন:

দেখ, বিয়ের পর আশীর্বাদ করবার সময়ে বলি, ‘সাবিত্রীসমানা ভব’, অর্থাৎ স্বামীকে যমের হাত থেকে ছিনিয়ে আনো। বেমালুম ভুলে যাই যে, ওই সাবিত্রীই কিন্তু বিয়ের আগে প্রকাশ্যে রাজসভায় নারদের সামনে বাবার সঙ্গে প্রবল তর্ক করেছিল, তার পছন্দের মানুষকে সে বিয়ে করবেই। এক বছর পর বিধবা হবে জেনেও তর্ক করেছিল। এবং জিতেছিল। আশীর্বাদ করবার সময়ে সেই সাবিত্রীর সমান হতে বলি কি? নিজের পছন্দের মানুষকে পেয়ে তার প্রাণ ভরে গিয়েছিল, সেই জোরেই না সে যমের সঙ্গে অতক্ষণ লড়াই করেছিল। এবং জিতেছিল। এরা দুই সাবিত্রী নয়রে, একটিই মেয়ে, আশীর্বাদ করতে হলে এই মেয়ের দুটো দিক ভেবেই আশীর্বাদ করতে হবে।

প্রাচীন শাস্ত্রে যে আট রকমের বৈধ অনুলোম বিয়ের কথা বলে তার একটি হল গান্ধর্ব। ওই দিদিমা এই বিয়ের কথা মনে রেখেই কথা বলছিলেন। গান্ধর্ব বিয়েতে গুরুজনের অনুমতি বা সমর্থনের অপেক্ষা না রেখেই পরস্পরের প্রতি প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে একজন অপরকে জীবনের সঙ্গী হিসাবে বেছে নিয়ে বলে, তারা এখন থেকে স্বামী-স্ত্রী। এ বিয়ে সম্পূর্ণ শাস্ত্রসম্মত, বৈধ ও সমাজে স্বীকৃত। (প্রসঙ্গত, ইংল্যান্ডে ‘কমন ল’ ম্যারেজ’ ও এই রকমই ছিল। মধ্যযুগের আদিপর্বে আইনে তা স্বীকৃত হয়। মাত্র দু-এক দশক আগে এটি উঠে যায়। এ বিয়েতেও দু-একজনের সামনে দুটি নরনারী পরস্পরের সঙ্গে মিলিত জীবনযাপনের অঙ্গীকার করত এবং সমাজ সে সম্পর্কটা স্বীকার করত। বেশ কয়েকশো বছর এ পদ্ধতি চালু ছিল।) কিন্তু আজ একবিংশ শতকের দোরগোড়াতে এসেও দুটি মানুষ পরস্পরকে ভালবেসে মিলিত জীবনযাপনের ইচ্ছা প্রকাশ করলে অশিক্ষিত বা নিম্নবিত্ত সমাজে শুধু নয়, বহু শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত সমাজেও দু-পরিবারে যে প্রবল প্রতিবাদ ওঠে তাতে বোঝা যায় আমরা শাস্ত্রের দোহাই তখনই পাড়ি, যখন সে শাস্ত্র আমাদের অভীষ্টের অনুকূল; প্রতিকূল হলে বেমালুম চেপে যাই। বিধবাবিবাহ প্রবর্তনের সময়ে বিদ্যাসাগর মশাই সমাজের এই দীর্ঘকালীন স্বার্থসর্বস্ব ভণ্ডামির মুখোশ খুলে দিয়েছিলেন। তাঁর উৎকলিত শাস্ত্রবাক্য তৎকালীন ও পূর্ববর্তী সব শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতই জানতেন; জেনেও চেপে গিয়েছিলেন, সে শাস্ত্র তাঁদের স্বার্থবিরুদ্ধ ছিল বলে। গান্ধর্ব বিবাহ সম্বন্ধে ঔদাসীন্য এবং/বা প্রতিরোধ ও ওই একই কারণে।

প্রাচীন শাস্ত্রে বৈধ বিবাহ আট রকমের ছিল: ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য, গান্ধর্ব, রাক্ষস, অসুর ও পৈশাচ।[১] ব্রাহ্ম বিবাহে সবস্ত্রা সালংকারা কন্যাকে পিতা উপযুক্ত পাত্রে দান করতেন। দৈব বিবাহে যজ্ঞ কর্মে রত পুরোহিতকে যজ্ঞকালেই কন্যাদান করতেন কন্যার পিতা। আর্য বিবাহে কন্যার পিতা বরকে একটি বলদ ও একটি গাভী দান করতেন। প্রজাপত্য বিবাহে কন্যার পিতা বর ও কন্যাকে ‘উভয়ে একত্রে ধর্মাচরণ কর’— এই বলে আশীর্বাদ করে কন্যা দান করতেন। আসুর বিবাহে কন্যার পিতাকে অর্থদানে তুষ্ট করে বর কন্যাকে বিবাহ করতে পারত। রাক্ষস বিবাহে আত্মীয়স্বজনের মধ্যে থেকে রোরুদ্যমানা কন্যাকে বলপূর্বক হরণ করত বর ও তার বন্ধুরা। পৈশাচ বিবাহে ঘুমন্ত অথবা মদমত্ত কন্যাপক্ষীয়দের মধ্যে থেকে ঘুমন্ত কন্যাকে ধর্ষণ করে দিয়ে যেত বর।

[১. আশ্বলায়ন গৃহ্যসূত্র (১:৬) অংশে এগুলির বিবরণ আছে, অন্যান্য গৃহ্যসূত্রেও আছে।]

লক্ষ্য করলে দেখি, আসুর বিবাহে কন্যাপণ চলিত ছিল। মনে হয়, অনেক আগে কন্যাপণই প্রচলিত ছিল। বিবাহের এ নামকরণগুলি পরবর্তী কালে খ্রিস্টিয় পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকের। ততদিনে সমাজে কন্যাপণ উঠে গেছে, বরপণ চালু হয়েছে। আর্য বিবাহে কন্যার পিতা নিঃসম্বল জামাতাকে তখনকার কালে সংসার পাততে অত্যাবশ্যক গাভী-বলদ দিতেন; পণ হিসাবে ততটা নয়, যতটা সংসারযাত্রায় রওনা করিয়ে দেওয়ার জন্য। আসুর বিবাহে কন্যাপণ স্পষ্ট ভাবেই অনুষ্ঠিত হত। অনুমান করা যেতে পারে, এটি অন্যান্য বিবাহের সঙ্গেও যুক্ত ছিল। সেই কন্যাপণেরই স্মৃতি আর্য বিবাহে।[২]

রোমানদের মধ্যেও অর্থ দিয়ে কন্যাকে বিয়ে করার পদ্ধতি চালু ছিল।[৩] পরবর্তীকালে যখন ধীরে ধীরে নারীর সামাজিক অবনমন ঘটে, তখন কন্যাপণও ক্রমে অপ্রচলিত হয়ে যায় এবং প্রচুর অর্থের বিনিময়ে বধূ লাভ করাটা বরের পক্ষে অসম্মানজনক হয়ে ওঠে। তাই সে দিনের কন্যাপণবিশিষ্ট বিবাহের সংজ্ঞা হল আসুর অর্থাৎ আর্যরীতি-বহির্ভূত। এর সমর্থনে বলা যায়, পরবর্তী কালের বহু পুরাণে অনুমাত্র কন্যাপণ গ্রহণ করে যে পিতা, তাঁকে ধিক্কার দিয়ে বলা হয়েছে সে ‘কন্যাবিক্রয়ী’। মনে হয় ‘কন্যাবিক্রয়ী’ সমাজে অপাঙ্ক্তেয় হয়ে উঠেছিল। ততদিনে বরপণ চালু হয়েছে, কিন্তু কোনও শাস্ত্রেই পুত্রের বিবাহে পণ গ্রহণকারী পিতাকে, পুত্রবিক্রয়ী বলা হয়নি। যদিও ছেলের বিয়েতে পণ নেওয়া মানেই বাপ ছেলেকে বিক্রি করছে, কারণ ‘পণ’ কথাটির একটাই মানে— দাম। তাই পণ নিয়ে ছেলের বিয়ে দেওয়ার অর্থই হল মেয়ের বাপের কাছে ছেলেটিকে বেচে দিচ্ছে তার বাবা। কিন্তু ততদিনে সমাজে পুরুষতন্ত্র এত প্রবল ভাবে প্রতিষ্ঠিত যে, এর অর্থ এবং এর অন্তর্নিহিত অপমান কোনও ছেলের বাপ ভেবেই দেখে না, কারণ পুরুষমাত্রই ততদিনে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত; নারী ঊনমানব। বরপণ অতি প্রাচীন যুগে অপেক্ষাকৃত অপ্রচলিত থাকলেও মাঝে মাঝে ব্যতিক্রম দেখা যেত। যে কোনও কারণেই হোক, ঋষি কক্ষীবান বরপণে ধনী হয়ে ওঠেন: বিয়েতে পান দশটি রথ, বহু নারী ও এক হাজার ষাটটি গাভী। মনে হয় কক্ষীবান গোষ্ঠীপতি হিসাবে বিবাহে দলের কাছ থেকে প্রতীকী রাজস্ব পেয়েছিলেন।[৪] প্রাচীনকালে কোনও গোষ্ঠীপতি যখন গোষ্ঠীর কারও কাছ থেকে কন্যা ও সম্পত্তি পেতেন তখন তার মধ্যে গোষ্ঠী হয়তো প্রচ্ছন্ন ভাবে দলপতিকে রাজস্বই দিত।[৫]

[২. কন্যাপণের কথা পাই ঋগ্বেদে (১:১০৯:২); অথর্ববেদে (১৪:১৩২:৩৩) এবং পরবর্তীকালে কাত্যায়ন গৃহ্যসূত্রে (২:৪:২) এবং আরও অন্য বহু শাস্ত্রাংশে। গোভিল গৃহ্যসূত্রে পড়ি, বরপক্ষ ও কন্যাপক্ষ উভয়ই উভয়কে স্বর্ণদান করত, তবে বরপক্ষ অনেক বেশি সোনা দিত। (২:৩:৪); কাত্যায়ন গৃহ্যসূত্রে (২:৪:২) কন্যাপণের কথা আছে। এ ছাড়া পরবর্তী সাহিত্যে কন্যাপণের বেশ কিছু দৃষ্টান্ত আছে।

৩. Grant and Kitzinger : Civilization in the Ancient Mediteranean : Greece and Rome, Vol. II, p. 613

৪. ঋগ্বেদ (১:১২৬)

৫. ‘The acquisition by a chief, a wive and dowries may be a disguised tax levied in support of tribal service and ceremonial.’ Encyclopaedia of Social Sciences, Vol. XI, p. 530]

বিয়ের সঙ্গে পণ ছাড়াও নানা রকম ভাবে অর্থ ও ধনরত্ন জড়িত ছিল। মেয়েটিকে তার বাপের বাড়ির আত্মীয়বন্ধুরা ভালবেসে যা উপহার দিত তা ‘স্ত্রীধন’। বরবধূ এক সঙ্গে বসে (তাদের তখনকার সংজ্ঞা হল ‘যুতক’) দু-বাড়ির কাছে যা পেত তা হল ‘যৌতক’বা ‘যৌতুক’। মেয়ের বাবা যে দামে জামাই কেনে তা হল ‘পণ’। শ্বশুরবাড়িতে ভালবেসে লোকে বরবধূকে যা দেয় তা হল ‘সৌদায়িক’। এর মধ্যে শাস্ত্রমতে স্ত্রীধন হল বধূর একান্ত ব্যক্তিগত সম্পত্তি, যার ওপরে শ্বশুরবাড়ির কোনও অধিকার ছিল না; মেয়েটি তার ইচ্ছা মতো স্ত্রীধন খরচ ও দান করতে পারত। প্রাচীন গ্রিস ও রোমের বিষয়ে জানতে পারি যে, সেখানে স্ত্রীধনে সত্যিসত্যিই বধূরই একান্ত কর্তৃত্ব ছিল। স্ত্রীর নিজস্ব সম্পত্তি থাকত, এবং স্বামীর মৃত্যু হলে বা বিবাহবিচ্ছেদ হলে সে এই সম্পত্তি রাখতে পারত।[৬]

[৬. ‘A wife could have her own property which she was entitled to keep if her husband died or the marriage was discovered.’ (Law Code of Gortyn II : 45 – 54 ), Grant and Kitzinger : Civilization of the Ancient Mediteranean : Greece and Rome, Vol. II, p. 592]

কিন্তু পুরুষপ্রধান সমাজ নারীকে কোনও সম্পত্তির ওপরেই সম্পূর্ণ অধিকার দেবে এটা সম্ভব ছিল না, তাই অন্য শাস্ত্রে দেখি শ্বশুরবাড়ির লোকেরা নানা বিশেষ পরিস্থিতিতে স্ত্রীধনে হাত দিচ্ছেন। পণ একান্ত ভাবে বর ও বরকর্তার সম্পত্তি। সৌদায়িক এবং যৌতুক বর ও বধূ উভয়েরই। সদ্ভাব থাকলে সম্ভবত প্রয়োজনমতো বা ইচ্ছেমতো দু’জনেই তা ব্যবহার করত, আর তা না থাকলে ওই সম্পত্তি (ধনরত্ন অলংকার, এমনকী সম্পন্ন পরিবারে, জমিও) যে পুরুষটির ও তার পরিবারের কর্তৃত্বে চলে যেত এটা সহজেই বোঝা যায়— এমন উল্লেখও শাস্ত্রে আছে। এখানে বলে রাখি, অত্যাচার, অবিচার, অনাচার, নারীর সামাজিক অবনমন, শোষণ এ নিয়ে যত কথা বলছি বা বলব, তার সবেরই নিশ্চয়ই বহু ব্যতিক্রম ছিল; সুবুদ্ধিসম্পন্ন সহৃদয় স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি ও পরিবার চিরকালই ছিল, আছে ও থাকবে। কাজেই যে সব কথা বলছি, তা হল শাস্ত্রের মত, যে কোনও ব্যক্তি বা পরিবার যদি বধূটির ওপর অবিচার, অত্যাচার করতে চাইত তার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শাস্ত্র তাদের সপক্ষে থাকত। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম খ্রিস্টাব্দ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর পর পর্যন্ত যে সব শাস্ত্র রচিত হয়েছিল, তাতে নারীকে নিজের দেহের বা সম্পত্তির ওপরে অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বারবার বলা হয়েছে, শৈশবে পিতা, যৌবনে স্বামী, বার্ধক্যে পুত্ররা নারীর রক্ষাকর্তা, নারী স্বাধীনতার যোগ্য নয়; ‘ন স্ত্রী স্বাতন্ত্র্যমহতি’।

বিবাহ সম্বন্ধে আর্থিক সঙ্গতির প্রাসঙ্গিকতা কোথায়? যে দুটি বিষয়ে পরনির্ভরতা মেয়েদের দাম্পত্যজীবনে বহু অশান্তির সৃষ্টি করে তার মধ্যে একটি হল, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিবাহিত মেয়ে আর্থিক ভাবে স্বামীর আয়ের ওপরে নির্ভরশীল। যতক্ষণ পর্যন্ত দু’জনের মনের মিল থাকে, ততক্ষণ এতে অশান্তি আসে না; কিন্তু যখনই কোথাও চিড় ধরে তখনই ওই নির্ভরতার ব্যাপারটা পরিণত হয় নিপীড়নের হেতুতে। বহু পরিবারের পরিণত বয়সের গৃহিণীরও স্বামীর অর্থ ইচ্ছামতো খরচ বা দান করবার অধিকার থাকে না। অন্যটাও অবশ্যই সত্য: বহু পরিবারে স্বতন্ত্র আয় না থাকলেও গৃহিণীই আয়-ব্যয়ের পুরো দায়িত্ব পান। কিন্তু যেখানে আর্থিক ভাবে পুরুষের ওপর নির্ভরশীল বধূ সহসা আবিষ্কার করে খাওয়া-পরার নির্দিষ্ট বরাদ্দের বাইরে তার কোনও সম্বল নেই, পারিবারিক ধন ভাণ্ডারে তার কোনও কর্তৃত্ব নেই, এমনকী তার খাওয়াও শ্বশুরবাড়ির হাত-তোলা ব্যবস্থায়, অর্থাৎ অন্যদের তুলনায় তার খাদ্য, পুষ্টি স্বাদ বা পরিমাণে কম হলেও তার প্রতিবাদ করবার কোনও অধিকার নেই— তখনই তার বিবাহিত জীবন তার কাছে আর্থিক বন্দিত্ব হয়ে দেখা দেয়। এর সমাধানে বিস্তর মেয়ে বাইরে কাজ করে। সেটাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্বামী ও তার পরিবারের অনুমতিসাপেক্ষ এবং সব ক্ষেত্রে সে অনুমতি মেলেও না। অনুমতি মিললেও, বধূটি স্বাধীন ভাবে উপার্জন করলেও সে অর্থে তার অধিকার কমই থাকে। এবং বহু উপার্জনশীল বধূরও শ্বশুরবাড়িতে নিগ্রহ চলতেই থাকে। এর একটা কারণ, খুব কম ক্ষেত্রেই মেয়েটি ওই অপমানের পরিসর ছেড়ে বেরিয়ে এসে স্বতন্ত্র সংসার পেতে স্বাধীনতা রক্ষা করতে চায় বা পারে। সমাজ ও পরিবার এ দুর্বলতার পূর্ণ সুযোগ নিয়ে দুর্ব্যবহার চালিয়ে যায়। তখন বেড়ে ওঠে তিক্ততা, বিবাহ টলে ওঠে, মাঝে মাঝে ভেঙেও যায়। যখন ভাঙে না, তখন বধূটি আর্থিক ভাবে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পরিবারের পোষ্য হিসাবে গ্লানির অন্ন গ্রহণ করে। স্বাধীন উপার্জনে অবশ্যই কতকটা সুরাহা হয়, যদিও এ দেশে কন্যার মন আশৈশব পুরুষের প্রতি যে বশ্যতা-শিক্ষার মধ্যে লালিত হয়, তাতে বহু ক্ষেত্রেই নিজের উপার্জিত অর্থের ওপরেও সে পুরো কর্তৃত্ব পায় না। চাইতে সাহস পায় না, বা চাইলেও প্রত্যাখ্যাত হয়। তবু ওই স্বতন্ত্র উপার্জনের জোরে বেশ কিছু মেয়ে দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে পালিয়ে অন্যত্র যাওয়ার পথ খুঁজে পায়। এই সম্ভাবনা রোধ করবার জন্যই নারীকে ধনের কর্তৃত্ব থেকে বঞ্চিত করার শাস্ত্র রচিত হয়েছে আড়াই হাজার বছর ধরে।

দ্বিতীয় যে বিষয়ে শাস্ত্র নারীর কোনও কর্তৃত্ব মানেনি, তা হল, তার নিজের দেহের ওপর অধিকার। বৃহদারণ্যক উপনিষৎ, খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের কাছাকাছি রচনা বলে অনুমান করা হয়। সেখানে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য দাম্পত্য ব্যাপারে স্বামীকে পরামর্শ দিচ্ছেন:

স্ত্রী যদি স্বামীর কামনা পূরণ করতে অস্বীকার করে তা হলে প্রথম তাকে মধুর বাক্যে বশীভূত করবার চেষ্টা করবে। সেটা নিষ্ফল হলে তাকে ‘কিনে নেবে’। (অবক্রীণীয়াৎ— অর্থাৎ আভরণ, ইত্যাদি দেওয়ার লোভ দেখাবে বা দেবে।) তাতেও যদি সে না রাজি হয় তা হলে লাঠি দিয়ে বা হাত দিয়ে মেরে স্ববশে আনবে।[৭]  

[৭. আক্ষরিক অনুবাদ। বৃহদারণ্যক উপনিষৎ (৬:৪:৭)]

এ হল ঋষিবাক্য, এর ভিত্তি আরও দুশো বছর আগেকার প্রাচীন সংহিতা ও ব্রাহ্মণ সাহিত্যের বচন: ধন বা নিজ দেহের ওপরে নারীর কোনও অধিকার নেই।[৮] এ ধরনের শাস্ত্রবাক্যের উদ্দেশ্য বধূর যৌনজীবনের সব স্বাধীনতা হরণ করা; স্বামীই তার যৌনজীবনের নিয়ন্তা হয়ে থাকবে।

[৮. মৈত্রায়ণী সংহিতা (৩:৬:১; ৪:৬:৭; ৪:৭:৪; ১০:১০:১১)। তৈত্তিরীয় সংহিতা (৬:৫:৮:২) ও শতপথ ব্রাহ্মণ (৪:৪:২:১৩), ইত্যাদি]

এর দুটি দিক: বিবাহ স্বামীকে স্ত্রীর দেহের ওপর সর্বতোভাবে এমন অধিকার দিয়েছে যে, স্বামী তার স্ত্রীর দেহকে সম্ভোগ্য সামগ্রীর মতো ইচ্ছা মতো ভোগ করবে; সে বিষয়ে স্ত্রীর ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনও দাম থাকবে না। যাজ্ঞবল্ক্য থেকে এই বিধি শাস্ত্রের, সমাজের ও পরিবারের অনুমোদন পেয়ে এসেছে। শ’খানেক বছর আগে ১৮৮৭ সালে রুমা বাঈ স্বামীর যৌন সম্ভোগের অধিকার প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর যুক্তি, বাল্যে তাঁর মত না নিয়ে যে বিবাহ ঘটেছে তার ভিত্তিতে এখন তাঁর দেহের ওপরে স্বামীর কোনও কর্তৃত্ব তিনি স্বীকার করেন না। ১৮৮৯ সালে দশ বছরের বালিকা বধূ হরিমতির ওপরে বলাৎকার করে তাকে মেরে ফেলে ঊনত্রিশ বছর বয়স্ক স্বামী হরি মাইতি। এ মৃত্যুর ভিত্তি ঘোরতর শাস্ত্রীয়: বধূর রজোদর্শনের পরেই স্বামীর কর্তব্য গর্ভধান করা। এ ঘটনা সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলে স্বপক্ষে বিপক্ষে মতভেদ ঘটতে থাকে। সহবাসে নারীর সম্মতি অপেক্ষিত এবং সেই সম্মতিদানের বয়স দশ থেকে বারোয় উন্নীত করবার জন্যে ইংরেজরা একটি আইন প্রবর্তন করতে চায়। বহু আপত্তিজনক রাজনৈতিক অত্যাচারমূলক আইন এর আগে পাশ হয়েছিল। কাগজে মৃদু গুঞ্জন অথবা তীব্র আপত্তিতেই সে-সব প্রতিবাদ অবসিত হয়। কিন্তু সহবাসে সম্মতির প্রস্তাবিত আইনের প্রতিবাদে কলকাতার প্রথম বৃহত্তম জনসভা অনুষ্ঠিত হয় ১৮৯১ সালে।

এ পুরনো কাসুন্দি ঘাঁটছি কেন? কারণ কাসুন্দিটা সত্যিই পুরনো নয়। এখনও দাম্পত্যে ধর্ষণ, অর্থাৎ বধূর সম্মতির অপেক্ষা না রেখে সম্ভোগ খুবই সাধারণ ঘটনা। শয্যাকক্ষে অসহায় নারীটির আজও কোনও আশ্রয় নেই। বলা বাহুল্য, বহু বিয়েই এই দৈহিক ও মানসিক যন্ত্রণায় ভেঙে যায়। অথবা সহায়সম্বলহীন বধূটিকে নিরুপায় ভাবে স্বামীর কাছ থেকে অহরহ নিষ্প্রতিকার অত্যাচার সহ্য করে যেতে হয়। অর্থাৎ সমাজের চোখে বিয়েটা ঠিকই আছে, কিন্তু দম্পতির অর্ধাংশের কাছে সে বিয়ে চুরমার হয়ে গেছে। যাজ্ঞবল্ক্য থেকে আজ পর্যন্ত এই অত্যাচার অব্যাহত আছে। নারীর এই অসহায়তার একটা হেতু তার অর্থনৈতিক পরতন্ত্রতা। আর্থিক ভাবে ভরণপোষণের জন্যে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির ওপরে নির্ভরশীল হওয়ার ফলে নিজের শরীরের ওপরেও নারীর কর্তৃত্ব থাকে না। যে সব বিধি বিধান যৌনতার প্রকাশ, বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ন্ত্রণ করে, সেগুলির সাফল্য নারীটির আর্থিক অবস্থারই প্রতিবিম্বন। সংবিধান, তত্ত্ব ও প্রয়োগের মধ্যে বিস্তর অসামঞ্জস্য থাকে; নারীর অধিকার খণ্ডিত হতে পারে সংবিধানবহির্ভূত পক্ষপাতিত্বে।[৯] অর্থনৈতিক পরাধীনতা থেকে সার্বিক অধীনতা তাকে মেনে নিতে হয়। আর ওই পরাধীনতার অন্তরাল থেকে বিবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে রাষ্ট্রশক্তি— প্রাচীনকালে শাস্ত্রের মাধ্যমে, পরে আইনের দ্বারা।

[৯. The effectiveness of the sanctions regulating sex expression of marriage and divorce is largely a reflection of woman’s economic power. Law, theory and practice are often widely at variance, woman’s right may be neglected by extra-legal discriminations,’ Encyclopaedia of Social Science, Vol. XV, p. 443]

এখনও এ দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিয়ের ব্যাপারে মেয়েটির মত একান্তই গৌণ। সে আদৌ বিয়ে করতে চায় কিনা, কখন করতে চায়, কাকে করতে চায়, তার জন্য যে পাত্র নির্বাচন করা হয়েছে তাকে তার পছন্দ কিনা এ সব গ্রাহ্যের মধ্যে আনাই হয় না। শিক্ষিত উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারে কিছু কিছু ব্যতিক্রম দেখা গেলেও, মনে রাখতে হবে এখনও এই শ্রেণিটি দেশে সংঘ্যালঘু। কাজেই অধিকাংশ মেয়ের যেহেতু বিদ্যা, স্বতন্ত্র বৃত্তি বা আর্থিক স্বনির্ভরতা নেই, তাই তার সামনে বিবাহ ছাড়া যৌবনোত্তর জীবনে আর কোনও পথই খোলা থাকে না: বিবাহ বাধ্যতামূলক হয়েই দেখা দেয়। নতুনত্ব সম্বন্ধে কৌতূহল বাদ দিলে খুব কম মেয়েই স্বেচ্ছায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বিয়ের ব্যাপারে অগ্রসর হয়। পাশ্চাত্য জগতে উনিশ শতকে এই রকমই ছিল। জন স্টুয়ার্ট মিল ১৮৬৯ সালে লেখেন ‘যারা মেয়েদের সামনে আর সব দরজা বন্ধ করে তাদের বিয়ে করতে বাধ্য করে, তাদের সম্বন্ধে একটা কথা বলা যায়: তাঁরা যা ভাবেন সেটাই যদি বলেন, তা হলে নিঃসন্দেহে তাঁদের মতটা হতে হবে— পুরুষ নারীর কাছে বিবাহিত জীবনকে এমন বাঞ্ছনীয় করে তোলে না যাতে মেয়েরা বিবাহের নিজস্ব আকর্ষণেই বিবাহে প্রবৃত্ত হবে।’[১০] বিবাহে নারীর সাগ্রহ, সানন্দ সম্মতি থাকবে শুধু তখনই, যখন সে স্বনির্বাচিত পুরুষকে বিবাহ করতে পারবে। এখনও দেশের অধিকাংশ নারীই এ সুযোগে বঞ্চিত। কাজেই বিবাহ নারীর জীবনের একটা অবস্থামাত্রই নয়, তার যৌবনোত্তর জীবনের লক্ষ্যও। জীবনের পথ নয়, গন্তব্যস্থল। সেখানে পৌঁছে যেন তার ব্যক্তিগত জীবনের সব দ্বন্দ্বের, শঙ্কার, অনিশ্চয়তার অবসান ঘটে; এবং গভীর এক অর্থে তার স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তারও অবসান ঘটে। অথচ এ যে কত বড় ভ্রম তা অল্প দিনেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

[১০. ‘Those who attempt to force women into marriage by closing all other doors against them lay themselves open to a similar retort. If they mean what they say, their opinion must evidently be, that men do not render the married condition so desirable to women as to induce them to accept it for its own recommendations.’ The Subjection of Women, p. 245]

শাস্ত্র নারীকে নিজদেহের ওপর অধিকার দেয়নি এবং সব দেশেই প্রাচীন কালে শাস্ত্রই ছিল সংবিধান। এই শাস্ত্রবিধি বলেছে, নারীর যৌনতার ওপরে পূর্ণ অধিকার তার স্বামীর এবং প্রকারান্তরে তার শ্বশুরবাড়ির এবং তারও ওপরে সমাজের। এক্ষেত্রে, সে গর্ভধারণ করতে চায় কিনা, কখনও ও কতবার চায় সে সম্বন্ধে তার মত প্রায় কখনওই গ্রাহ্য করা হত না এবং এখনও অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয় না। ফলে অবাঞ্ছিত গর্ভভারে ক্লান্ত ক্লিষ্ট জননীর মধ্যে স্বভাবতই একটি তীব্র প্রতিবাদের উম্মা সঞ্চিত হত এবং হয়। এত দিন পর্যন্ত শাস্ত্র-সংবিধানের প্রতিবাদ করবার কোনও অধিকার নারীর ছিল না, কিন্তু এখন যখন বহু দেশে বিবাহ মানেই একমাত্র স্বামীর ইচ্ছাক্রমে সন্তানধারণ আর বাধ্যতামূলক নয়, বহু নারী এ ব্যাপারে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে। ইয়োরোপ ও আমেরিকায় এটা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, সেখানে বহু নারী একটি সন্তানধারণ করতেও অনিচ্ছুক। জনসংখ্যা কমছে, প্রতিকারে তৃতীয় বিশ্বের দুঃস্থ জনক জননীর সন্তানকে দত্তক হিসেবে বরং কেউ কেউ গ্রহণ করছেন, কিন্তু নিজেরা মাতৃত্ব সম্পর্কে সম্পূর্ণ বিমুখ, কোনও মতেই সন্তানধারণ করবেন না। সন্তানধারণ, প্রসব, শিশুর প্রাথমিক লালনের পরিশ্রম— এবং বলা বাহুল্য এ সবই সংসারের বিস্তর হাড়ভাঙা পরিশ্রম ও বিনিদ্র রাত্রির ক্লান্তির সঙ্গে সংযুক্ত। তার ওপর আছে প্রায় সব সংসারেরই নারীর অপুষ্টি, প্রয়োজনের তুলনায় কম খাদ্য ও পুষ্টি। এই স্মৃতি অবশ্যই তাকে বারবার গর্ভধারণে বিমুখ করে তোলে। এখনও স্বামী ও শাশুড়ির গঞ্জনা এবং তাদের ওপর সার্থক নির্ভরতা তাকে অবাঞ্ছিত গর্ভধারণ থেকে অব্যাহতি দেয় না। এ অবস্থা বেশ কিছুকাল চলছে, ফলে কিছু মানুষ আতঙ্কিত; জনসংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাওয়ার ফলে কিছুকালের মধ্যে প্রজাতি বিলোপ ঘটবার আশঙ্কা। কিন্তু মনে হয়, স্থিতি-প্ৰতিস্থিতি-সমন্বয়ের (thesis, antithesis, synthesis) যে নিয়মে সংসার আবর্তিত ও বিবর্তিত হচ্ছে, এটি সেই প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় দশা: প্রতিস্থিতি। মাতৃত্বের নিজস্ব মাধুর্য ও আকর্ষণ আছে, অবশ্যই কিছু নারী প্রলুব্ধ হবে নিজস্ব সন্তানকে গর্ভে ধারণ করতে ও লালন করতে। এর পূর্বশর্ত অবশ্যই হবে এই যে, গর্ভধারণ ও সন্তান-প্রসবের ব্যাপারে তার পরিচর্যা ও আরামের দায়িত্বটা পরিবার ও সমাজ নেবে এবং জাতকের প্রথম পর্যায়ের লালনকালে স্বামী স্ত্রীকে সাহায্য করবে।

আরও একটি কারণে পাশ্চাত্য জগতে মাতৃত্বে এই অনীহা দেখা দিয়েছে। এটা হল নারীর মাতৃত্ব- -নিরপেক্ষ যে যৌনতা, তার স্বীকৃতি সে দাম্পত্যে চাইছে। তার যৌনতার স্বতন্ত্র মূল্যেই সে নারী। মাতৃত্ব অবস্থামাত্র, একটি অতিরিক্ত গৌরব। কিন্তু নারীর যৌনতাকে পুরুষ যতটা ভোগ করে, তার পরেও যে সে নারী এবং তার রূপযৌবন ও যৌনতা অন্য পুরুষের কাছে আকর্ষণীয় থাকে, এ সম্বন্ধে একটা প্রচ্ছন্ন সংশয়, ঈর্ষা ও অসহিষ্ণুতাও হয়তো পুরুষকে প্রবৃত্ত করেছে মাতৃত্বকেই নারীর চূড়ান্ত সার্থকতা হিসাবে রূপায়িত করতে। এ ব্যাপারে ভিক্টোরিয়ান ইংল্যান্ডে যে ভাব ছিল সে সম্বন্ধে শুনি, নারীর এই যৌন ক্ষমতা সম্বন্ধে ‘অসুস্থ ভিক্টোরিয়ানরা প্রায়ই এই অনুভূত শক্তিকে বুদ্ধিগ্রাহ্য ভাবে তরলিত করে নারীত্বকে মাতৃত্বের আরও আত্মত্যাগনিষ্ঠ ও সহনীয় পবিত্রতায় উত্তীর্ণ করে দিয়েছিল।’[১১]

[১১. ‘Uneasy Victorians often rationalized this felt power by diluting womanhood into the more self-sacrificial and digestible holiness of motherhood.’ Anerbach; Woman and the Demon, p. 219]

এ ব্যাপার ভারতবর্ষে আরও বেশি প্রকট। রাধা ও সরস্বতী বাদে দেবী মূর্তিগুলি সবই মাতৃমূর্তি, এ-যেন মাতৃত্ব সম্বন্ধে এই আতিশয্যেরই এক প্রকাশ। দৈনন্দিন জীবনে নারীর ঊনমানব অবস্থানের প্রায়শ্চিত্ত করবার জন্যই যেমন পূজার ক’দিন মাটির প্রতিমাকে মাতৃসম্বোধন করে রক্তমাংসের নারীর প্রতি সারা বছরের আচরণের পাপক্ষালন ও ক্ষতিপূরণ করা হয়, এ-ও তারই এক প্রকাশ। শুধু তাই নয়, শাস্ত্রে, পরিবারে সমাজে বরাবর শুনি, নারীর জীবন মাতৃত্বে পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়; কখনও কেউ বলে না পুরুষ পিতৃত্বে পূর্ণ হয়। মাতৃত্বের বহু দায় আছে, পিতৃত্ব শুধুই আনন্দের; তাই এই অসম দৃষ্টি। মাতৃত্বে নারী অবশ্যই গৌরবান্বিত হয়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে পিতৃত্বকেও সম্মান করে দুটি অবস্থারই দায়িত্ব এবং অধিকার সমান ভাবে ভাগ করে নেওয়ার একটা লক্ষ্য থাকা উচিত। কোনও দেবতাই পিতৃত্বের জন্যে মহীয়ান নয়, কিন্তু সর্বদেশে মাতৃদেবী মহীয়সী। ওই মহিমা বর্তায় মর্ত্যনারীতে, এবং নারীকে কেবলমাত্র মাতৃত্বে আবদ্ধ করে রাখলে তার যৌনতা সম্পর্কে আতঙ্ক থেকে অব্যাহতি পায় পুরুষ সমাজ। তাই বেদ থেকে পুরাণে বারবার নারী সম্বন্ধে কামনা ও আশীর্বাদ উচ্চারিত হয়েছে, সে যেন অশূন্যোপস্থা হয়, অর্থাৎ তার কোল যেন কখনও খালি না থাকে, ক্রমান্বয়ে সন্তানজন্ম দিয়ে যেন সে তার নারীজন্ম সার্থক করে। এ কথা ঠিক যে, উৎপাদনব্যবস্থা যখন আদিমস্তরে থাকে তখন কৃষক-শ্রমিক-সৈন্যের প্রয়োজনে মানুষ জনসংখ্যা বৃদ্ধি কামনা করবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু কোলে শিশুকন্যা এলেও তো কোল ভরে, এবং ‘অশূন্যোপস্থা’ হওয়ার আশীর্বাদটা তো ও সম্ভাবনা মনে রেখেই। অবশ্য সমাজ নারীর কাছে পুত্র সন্তানই চায়। শিশুকন্যা অবহেলার বস্তু। কিন্তু যৌবনে পৌঁছনোমাত্রই নারীর পক্ষে বিবাহ অবশ্য কর্তব্য হয়ে ওঠে এবং অতঃপর সমাজে তার স্থান বধূ ও সম্ভাব্য জননীরূপেই। শুধু নারী বলেই তার যা আকর্ষণ সেটা সমাজের পক্ষে বরদাস্ত করা শক্ত ছিল। তাই তাকে হতে হল জননী। (কুমারী সরস্বতী উপাসনার কোনও সম্প্রদায় গড়ে ওঠেনি, কৃষ্ণ ছাড়া শুধু রাধাকে অবলম্বন করেও নয়।) এই নিরবচ্ছিন্ন মাতৃত্বে অভিশপ্ত নারী আজ যদি প্রতিবাদ করে বলে, ‘দাম্পত্যে আমি শুধু নারী বলেই মহীয়সী থাকতে চাই, জননী হতে চাইনা’– তা হলে বহু যুগ ধরে গর্ভভারে জর্জরিত নারীর এই প্রতিবাদ বোঝা যায়। এবং এ অবস্থা সার্বিক বা চিরস্থায়ী হবে না, এ হল প্রতিবাদ— প্রতিস্থিতি। এর পরে সংহতি আসবে সমন্বয়ের রূপ ধরে। এ ক্ষেত্রে দাম্পত্য রক্ষা পাচ্ছে দম্পতির মর্যাদাতেই; নিঃসন্তান হলেও নারীর নারীত্ব ক্ষুণ্ণ বা হীন হয় না সেটা প্রতিপন্ন করাই এ প্রতিবাদের উদ্দেশ্য।

স্ত্রী কখন সন্তানধারণ করতে চায়, কতবার চায় ও আদৌ চায় কিনা এ সম্বন্ধে স্বামী ও সমাজই শেষ সিদ্ধান্ত নেয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে উৎপাদন— সে শস্যই হোক, শিল্পই হোক, সন্তানই হোক— ঘটবে পুরুষের ইচ্ছায়। এর পেছনে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ও প্রবর্তনা প্রচ্ছন্ন থাকে। সন্তান উৎপাদনের সফলতার ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য এবং সমকালীন অর্থনীতির বিধানের কাছে এই উৎপাদনব্যবস্থা সমর্পণ করবার জন্য রাষ্ট্র নারীর নিজদেহের ওপরে তার নিয়ন্ত্রণ প্রসারিত করতে বাধ্য হয়েছে। কাজেই নারী নিজদেহের ওপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে।[১২] মনু নারীকে ‘মহাভাগা পূজার্হা গৃহদীপ্তি’ বলেছেন, কিন্তু তার ঠিক আগে এ সব বিশেষণের হেতুটিও উল্লেখ করেছেন: ‘প্রজনার্থা’; সন্তানের জন্ম দেয় বলেই সে মহনীয়া পূজনীয়া এবং গৃহের দীপ্তিস্বরূপিণী।[১৩] এই সন্তানজন্মও পুরোপুরি পুরুষের ইচ্ছাধীন। অবাঞ্ছিত গর্ভধারণের দুঃসহ বোঝা ও গ্লানিতে কত সংসারে যে দাম্পত্য বধূটির কাছে বিষাক্ত হয়ে ওঠে তার ইয়ত্তা নেই। বহু দম্পতির মধ্যে সেই পারস্পরিক সমতার সম্পর্ক নেই যার ফলে দু’জনে একমত হয়ে সন্তানের আগমন আকাঙ্ক্ষা করতে পারে। এর ফলে পুরো গর্ভধারণের ব্যাপারটাই নারীর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, তার ইচ্ছা অনিচ্ছার দিকে দৃকপাত না করে। সংসার চলতে থাকে হয়তো, কিন্তু তার দাম্পত্যের ভিতটা যায় টলে। অর্থাৎ দাম্পত্যকে আটকে রাখা হয়েছে একটা প্রকাণ্ড মিথ্যার ওপরে।

[১২. ‘The state, in order to be in control of the success of reproducing human beings, and in order to submit these means to the interests of the economic system which happens to be in force at the time, has been obliged to extend its control and subjugation to that of her own body. She has, therefore, lost the real ownership of her own body.’ The Hidden Face of the Moon, p. 63]

১৩. মনু (৯:২৬)]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *