০১. প্যারিসে শীত পড়েছে

ডারলিং ডোয়ার্কি – প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরকে হত্যার কাহিনি / রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রথম প্রকাশ : বইমেলা ২০১৮

.

শ্রদ্ধায় বিস্ময়ে মুগ্ধতায় ও ভালোবাসায় সমসময়ের অনন্য বাঙালি শিল্পপতি,
উদ্যোগপুরুষ টুটু বোস (শ্রী স্বপনসাধন বোস)-কে উৎসর্গ করলাম গত
যুগের আর এক অবিকল্প অবিস্মরণীয় শিল্পপতির সাহস, সাফল্য, সম্ভোগ,
অবদান, বৈদুষ্য ও বেদনার কাহিনি।

.

প্যারিসে শীত পড়েছে। বেশ শীত।

অথচ ফরাসি নারীর শরীরে শীত নেই কেন?

অনন্য বাঙালিটির আমন্ত্রণে যে অভিজাত মহিলারা এসেছে নৈশ প্রমোদে যোগ দিতে, তারা সবাই পরেছে বুকখোলা পোশাক। কারও বেশি খোলা। কারও চিলতে কম।

বাঙালিটি লক্ষ করছেন, এদের মধ্যে এক রমণীর বুকের আড়াল বিপজ্জনক কিনারে এসে আরও একটু গড়িয়ে যাবার ইশারা দিচ্ছে অনবরত। এ-জিনিস বানাতে পারে শুধুমাত্র ফরাসি দরজি।

তিনি নিজেকে প্রশ্ন করেন, কীসের এই গরমি?

নিছক কামনার গরম?

পার্টি শুরু হয়েছে প্রথম রাতে। এখন রাতের শেষ প্রহর। এতক্ষণ মহার্ঘ সুরাস্রোতে ভেসেছে আমন্ত্রিত নরনারী।

ক্রমশ স্খলিত হয়েছে আচরণ। আলগা হয়েছে সংলাপ। টলমলে হয়েছে উচ্চচারণ। চিড় ধরেছে সংকোচে। মুক্ত হয়েছে দ্বিধা। ঝাপসা হয়েছে শ্লীল-অশ্লীলের বিভেদ। যা বলতে নেই, করতে নেই, এক রকমের রোম্যান্টিক বন্যতা, তাও কী অবলীলায় মিশে যাচ্ছে চর্চিত আভিজাত্যে!

পরজায়ার গালে আচমকা মায়াঘন চুম্বন।

পরপুরুষের আলিঙ্গনে মিশে-যাওয়া নারীর সাবলীল আশ্লেষ।

বাঙালিটি নিশ্চিত বুঝেছেন, সুরাপানের মাধুর্য বাড়ায় মেয়েদের মাতলামি।

তিনি দেশের কথা ভাবেন!

কিছু বাঙালি আজকাল ‘দিশি’ ছেড়ে ‘বিলিতি’ ধরেছে। ফরাসি সুরা আর ব্র্যান্ডি গিলছে বাইনাচের আসরে।

এদের অধিকাংশই স্থূল রুচির অল্পশিক্ষিত বাঙালি। বাপ-ঠাকুর্দার জমিদারির টাকা ওড়াচ্ছে বেশ্যা-বাইজির সঙ্গে মত্ত প্রমোদে।

অভিজাত শিক্ষিত সংলাপী নারীর সঙ্গে সুরাপানের গৌরব, মাধুরী, তৃপ্তি এরা কখনও পেল না!

কখনও জানলো না, ভালবাসার মেয়েটির ঠোঁটে সুরার সুবাস কী লোভনীয়! তা কীভাবে জ্বালিয়ে দেয় আরও ঘন আদরের অভীপ্সা!

বাঙালি পুরুষের শিরদাঁড়া কি কোনওদিন জানবে না সেই শিরশির? বাঙালি পুরুষ কি কোনওদিন পাবে না সুরাসিক্ত নিবিড় চুমুর ইন্দ্রিয়সুখ?

বাঙালিটির মনে পড়ে এসথার-এর কথা। ইথারদুহিতা এসথার। ব্রিটিশ অভিনেত্রী। আলাপ হয়েছে কলকাতায়।

দ্যাখামাত্র প্রেমে পড়ে গেলাম! নাটকটাটক তেমন ধাতে আসে না। তবু বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে যেতেই হল।

লেট-নাইট শো। আমার জন্যে নাকি স্পেশাল আয়োজন। ওথেলো। ডেসডিমোনা এসথার। স্টেজে এল আর উপড়ে নিল আমার হৃদয়।

অভিনয়, শেক্সপিয়র-টেক্সপিয়র, ওসব কিচ্ছু নয়। শুধু রূপ! আমার সমস্ত শরীর, সমস্ত মন চিৎকার করে উঠল, আমার চাই। এসথারের সবটা আমার চাই।

এতটুকু অন্য কাউকে দেব না।

সবটা আমার!

আমার স্ত্রীও খুব সুন্দরী। যাকে বলে টসটসে সুন্দরী। দুধে-আলতা গায়ের রঙ। হাঁটলে মনে হয় পায়ে-পায়ে পদ্মফুল ফুটছে। ফরসা মেয়ের একপিঠ কালো চুল। টানাটানা কালো চোখ। কেমন যেন দেবী-দেবী ভাব।

বউ সুন্দরী হলে পুরুষের মাথার ঠিক থাকে না। আমারও মাথাটা গোল্লায় গেল। আমিও হেঁকে বলে দিলুম, ওরে, কুমোর পাড়ায় খবর দে, এবার থেকে এ-বাড়ির দুর্গা প্রতিমার মুখ হবে তোদের মাঠাকরুণের মুখের মতো।

আমার আজ্ঞা বলে কথা। অক্ষরে-অক্ষরে পালিত হল। বৃদ্ধ কুলোপুরোহিত পুজোর প্রথম দিন মায়ের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে মুখের দিকে তাকালেন।

দেখলুম তার সমস্ত শরীর দরদর করে ঘামছে।

কাঁপতে-কাঁপতে বসে পড়লেন তিনি।

তারপর ফ্যালফ্যাল করে তাকালেন আমার দিকে।

বললুম যা দেখছেন, তা ঘটেছে আমার আজ্ঞায়। আপনাদের মাঠাকরুণই স্বয়ং দুর্গা।

বৃদ্ধ পুরোহিত আর একটিও কথা বললেন না। সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করে ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলেন।

আর মনে হল একটিবার যেন কাঁদতে-কাঁদতে অস্পষ্টভাবে ‘সর্বনাশ’ শব্দটি উচ্চচারণ করলেন।

কিন্তু আরও বড়ো সাহস দেখিয়েছি আমি।

প্রিয়তমা এসথারের মুখও আমাদের বাড়ির দুর্গা প্রতিমার মুখে…যাক সেসব কথা। অ্যাতোদিন পরে, প্যারিসের এই পার্টিতে, সারারাত আমোদ করার পর, হঠাৎ এসথারের কথা কেন? পাস্ট ইজ পাস্ট। ডেড অ্যান্ড গন।

বাঙালির সুরাসান্দ্র দৃষ্টি ভোররাতের পাখির মতো উড়ে গিয়ে ঝুপ করে বসে পড়ল টলমল পায়ে সুরার গ্লাস হাতে ক্রমে-কাছে- এগিয়ে-আসা লাস্যময়ী ফরাসি মধ্যবয়সিনীর উপচে-পড়া বিভাজিকা- নদীটির ধারে।

প্রিয়তম দোয়ার্কা, এসো, ধরা দাও আমার আলিঙ্গনে, সঁপে দাও নিজেকে, গ্রহণ করো আমার প্রণয়- এরকম করে অ্যাতো মানুষের সামনে কেউ প্রেম জ্ঞাপন করে!

এই হল ফরাশি আভিজাত্য! কী নির্লজ্জ! কী মেকি! কেমন যেন যাত্রা-যাত্রা!

কিন্তু তখুনি দ্বারকানাথ ঠাকুর, বয়েস ৪৮, দেখতে পেলেন ফরাসি সুন্দরীর শাঁখের মতো সাদা বুকের ডান ধারে একটি ছোট্ট ব্রাউন তিল।

লাল তিল দেখেছি।

কালো তিল দেখেছি।

কিন্তু খয়েরি তিল!

এই প্রথম!

আলোর গতিতে ভাবে দ্বারকানাথ ঠাকুরের মন।

মনের ইচ্ছে মুহূর্তে চলে যায় তাঁর জিভে।

দ্বারকানাথ বলে ফেলেন যা তিনি বলতে চাননি : I wish I could be that brown beauty-spot right there!

দ্বারকানাথকে নিবিড় আলিঙ্গনে শিথিল নরম উথলে-ওঠা দুটি বুকের ওপর টেনে নেয় সুন্দরী।

দ্বারকানাথ জড়িয়ে ধরেন সুন্দরীর কোমর।

এ কী!

যে-মেয়ের বুক এমন থই-থই।

যে-মেয়ের নিতম্বের ওপর হাজার লাইন লিখতে পারতেন কবি কালিদাস। সেই মেয়ের কোমরে হাত দিয়ে দ্বারকানাথের মনে হল, তিনি যেন একটি ভরপুর ফুলের তোড়ার গোড়াটি ধরেছেন!

করসেটের বন্ধন কী আঁটসাট! কী নিষ্ঠুর! নির্মম! সমস্ত কোমরটাকে যেন নিংড়ে ছিবড়ে করে শীর্ণ করে দিয়েছে।

দ্বারকানাথের ভারি মায়া হয়।

বাঙালি মেয়েরা এইভাবে কোমর বাঁধলে কেমন হত?

তারা শুধু কোমরবেঁধে ঝগড়া করতে পারে। কিন্তু কোমরকে বাগে আনার কোনও চেষ্টাই নেই তাদের।

স্ত্রী দিগম্বরীর কোমর ঝলকে মনে পড়ে।

কিন্তু তিনি গত হয়েছেন। দুজনেরই হাড় জুড়িয়েছে। ফরাসি রমণীর আলিঙ্গনের মধ্যে মৃত স্ত্রীর কোমর নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করতে রাজি নয় দ্বারকানাথের মন।

দ্বারকানাথের আলিঙ্গনে কাঁটা দেয় সুরাচ্ছন্ন রমণীর অঙ্গে। সে বলে, দ্বারকানাথকে, তুমি অনেক দূরের দেশের মানুষ। এখানকার কোনও পুরুষের মতো নও তুমি। আমার চেনা পুরুষের কারও সঙ্গে তোমার মিল নেই। তোমার আচরণ, ব্যবহার, শরীরীভাষা, সব ভিন্ন।

– নিশ্চয় খুব খারাপ লাগছে?

– না, সারাক্ষণ তোমাকেই দেখেছি, দূর থেকে, আর মুগ্ধ হয়েছি।

– মুগ্ধ হওয়ার কারণ?

– তুমি একেবারে অন্যরকম। তাই মুগ্ধ হয়েছি।

– অবাক না হয়ে মুগ্ধ হলে কেন? দ্বারকানাথের কণ্ঠে আবেগ।

– সমস্ত বিস্ময়ের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে মুগ্ধতা।

– তুমি খুব সুন্দর কথা বলো।

– ফরাসি মেয়েদের মন সুন্দর। তাই তাদের কথাও সুন্দর।

দ্বারকানাথ আর ফরাসি রমণী এতটাই ঘন পরস্পরের সঙ্গে, মাঝখানে কোনও বিভেদ রেখা আছে বলে তো মনে হয় না।

– কী নাম তোমার?

– নোয়েল।

নোয়েল বিবাহিত না অবিবাহিত, জানতে চায় না দ্বারকানাথ। এক সুন্দরী লাস্যময়ী টালমাটাল সংলাপময়ী রমণীর নাম নোয়েল। এইটুকুই যথেষ্ট।

– বোঝো তুমি ফরাসি মেয়ের মন?

ফরাসি মেয়ের মন আর বাঙালি মেয়ের মন, কত আলাদা? সত্যিই বোঝেন কি দ্বারকানাথ?

– কী চাইছে ফরাসি মেয়ের মন? দ্বারকানাথ আশ্রয় নেন তাঁর সাবলীল কৌতুকবোধে।

– একটা কিছু, যা হোক একটা কিছু উপহার, যা আমাকে চিরদিন মনে করিয়ে দেবে এই রাত। তোমাকে মনে পড়বে।

এই মুহূর্তটির জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন দ্বারকানাথ। বললেন, এসো আমার সঙ্গে।

রমণীর কোমর জড়িয়ে তিনি নিয়ে যান একটি দরজার সামনে। এই ব্যাঙ্কোয়েট হল-এ অনেকগুলি দরজা। প্রতিটি দরজায় ঝুলছে কাশ্মীরি শালের পরদা।

এমন পরদা ফরাসি নিমন্ত্রিতরা আগে কোথাও কখনও দেখেনি। দ্বারকানাথ সঙ্গে করে এনেছে ভারত থেকে।

তাঁরই আজ্ঞায় পরদাগুলি এমনভাবে টাঙানো হয়েছে একটু টানলেই যেন খুলে ঝুপ করে নেমে আসে।

এক হাত রমণীর কোমরে। অন্য হাতে পরদায় আলতো টান দিলেন দ্বারকানাথ।

আর অমনি সমস্ত পরদাটা চলে এল হাতের মুঠায়।

বিদেশি অতিথিরা যে যেখানে দাঁড়িয়ে, সবাই স্তব্ধ, দেখছে দ্বারকানাথকে। দ্বারকানাথ অনামিকা থেকে খুলে ফেললেন হিরের আংটি। শালটি ঢুকিয়ে দিলেন আংটির গর্তে।

এ তো ম্যাজিক!

সবাই বিস্মিত হয়ে দেখল এক অবিশ্বাস্য দৃশ্য।

সমস্ত শালটি সাপের মতো হিলহিলে শরীর নিয়ে আংটির একদিক দিয়ে ঢুকে অন্য দিকে সরসর করে বেরিয়ে এল!

তারপর শালটিকে আবার খুলে ধরলেন সবার সামনে। চকোলেট রঙের জমির উপর ছড়িয়ে আছে সূক্ষ্ম সুতোর রঙিন কাজ।

নোয়েল দাঁড়িয়ে দ্বারকানাথের প্রায় গা ছুঁয়ে। তার ঠোঁট দুটি বিস্ময়ে কিঞ্চিৎ ফাঁক হয়ে আছে। চোখে-মুখে প্রশ্ন, কত মূল্য হবে এহেন বস্তুর? আর কত অর্থের মালিক দ্বারকানাথ? টাঙিয়ে রাখেন এমন মহার্ঘ বস্ত্র ঘরের দরজায় পরদা করে!

নোয়েলকে নিজের হাতে সেই শাল পরিয়ে দেন দ্বারকানাথ। সবাই করতালি দেন বিস্মিত অভিনন্দনে।

ঘরের অন্যান্য রমণীরা এবার এগিয়ে আসতে থাকে দ্বারকানাথের দিকে। দ্বারকানাথ পড়তে পারেন তাদের মন। কিন্তু দেখান আপাত অমনস্কতা।

রমণীরা প্রায় ঘিরে ফেলেছে তাঁকে।

তিনি হিরের আংটিটি পরিয়ে দেন নোয়েলের বাঁ হাতের অনামিকায়।

দ্বারকানাথের হিরের আংটি নোয়েলের আঙুলে বড় হয়। নোয়েল বিহ্বল। এবং বাক্যহারা।

দ্বারকানাথ চুমু খান নোয়েলের ঠোঁটে। লক্ষ করেন শীতের রাতেও তার বিভাজিকায় দেখা দিয়েছে বিন্দু-বিন্দু ঘাম।

দ্বারকানাথ তাকান এবার অন্যান্য রমণীদের দিকে। তারপর একটির পর একটি পরদায় টান দিতে থাকেন।

ঝুপঝুপ করে খুলতে থাকে অনন্য অবিশ্বাস্য শালের পরদা। তিনি জানেন, রমণীর সংখ্যা তাঁর পার্টিতে এগারোর বেশি নয়।

বিপুল ব্যাঙ্কোয়েট হল-এর দরজার সংখ্যা কিন্তু নয়!

শেষ দরজায় তাই তিনটি পরদা। এমনভাবে ঝোলানো হয়েছে, মনে হচ্ছে একটাই। দুটো বাড়তি পরদা চোখেই পড়ছে না।

কোনও সুন্দরীই বঞ্চিত হয় না দ্বারকানাথের আশ্চর্য উপহার থেকে। সবার অঙ্গেই তিনি পরিয়ে দেন বাতাসের মতো হালকা অথচ আদরের মতো উষ্ণ শাল।

সবার ঠোঁটেই নেমে আসে দ্বারকানাথের ওষ্ঠস্পর্শ।

রমণীরা সবাই বিহ্বল। এমন সন্ধ্যা তাদের জীবনে এই প্রথম। সন্দেহ নেই তাদের মনে, দ্বারকানাথ টেগোরের মতো অভিজাত সুন্দর পুরুষ তারা দেখেনি।

একটি অস্পষ্ট বেদনাও তাদের কষ্ট দিচ্ছে।

নোয়েল কী ভাগ্যবতী! শালের সঙ্গে হিরের আংটি শুধু সে-ই পেল!

কিছুদিন পরের ঘটনা।

লন্ডন।

বাকিংহাম প্যালেস।

বেশ রাত। রানি ভিক্টোরিয়া তাঁর লেখার টেবিলে। চারটে বিশাল আকারের মোমবাতি সোনার বাতিদানে জ্বলছে টেবিলের পাশেই।

জুন মাস। তবু শীত যায়নি। ঘরের মধ্যে অগ্নিকুণ্ডে কাঠের আগুন। রানি গায়ের শালটি আরও নিবিড় করে জড়িয়ে নেয়।

উষ্ণ হালকা অনন্য এই কাশ্মীরি শাল তাকে আজই সন্ধেবেলায় উপহার দিয়েছে এক অভিজাত রূপবান উজ্জ্বল বাঙালি।

ভিক্টোরিয়া গায়ে শালটি জড়িয়ে একবার চোখ বোজে। নিজেকে প্রশ্ন করে, সত্যিই প্রেমে পড়লাম! আবার! এবং আবার একজন ইন্ডিয়ানের! অন্য দুজন ভারতীয় অবিশ্যি কেউ বাঙালি নয়।

একজন আমার মুসলমান অশ্বপালক। উত্তর ভারতের এক তরুণ। ঘোড়ার মতোই তেজি। বলবান। কঠোর।

অন্যজন লাহোরের মুসলমান। আমার শেফ। যেমন তার হাতের রান্না। তেমনি তার মনভোলানো মসৃণ ব্যবহার।

যৌনতার দুই মেরু, ভাবে রানি ভিক্টোরিয়া। বয়েস ২৩। লুকিয়ে প্রেম করার মধ্যে অন্য একটা আগুন, ভিন্ন মাদকতা।

তুলনায় স্বামী ফিলিপের বিছানা স্যাঁতসেতে, শীতল, মাপা আদর, ঠান্ডা কথা নিভিয়ে দেয় শরীর।

অশ্বপালকের সঙ্গে অরণ্যে হারিয়ে যেতে ভাল লাগে ভিক্টোরিয়ার। অশ্বারোহীর বুকে হেলান দিয়ে বসে সে। দুরন্ত বেগে ছুটে চলে ঘোড়া।

ঘন ছায়া। গভীর গাছপালার আড়াল। ভিজে ভিজে জমি। দুজনেই নেমে পড়ে ঘোড়া থেকে।

ভিক্টোরিয়ার তর সয় না। সে নেমেই বুকে টেনে নেয় অশ্বপালকের লোহার মতো পেটানো শরীর।

ছায়ার মধ্যে, বুনো ঘাসের ওপর, ভিক্টোরিয়া বিছিয়ে দেয় তার গোলাপি অঙ্গ।

তার তেইশ বছরের ছিপছিপে তনুর সমস্ত তৃষ্ণা, সমস্ত খিদের ওপর তেজি বলবান অশ্বপালক বিস্তার করে নির্ভীক দ্বিধাহীন আদিম প্রাবল্য।

এই বহ্নিমান তীব্রতা, বলিষ্ঠ পুরুষটির রমণক্ষমতার সবটুকু, পরনারীগমনের সমস্ত উন্মাদন, শোষণ ও তাপন সারা শরীর দিয়ে উপভোগ করে যৌবনবতী নারীটি।

এক সময়ে দুজনেরই আসঙ্গলিপ্সা সম্পূর্ণ তৃপ্ত হয়। অরণ্যের ছায়া তখন তাদের দেহের মতোই ঠান্ডা হয়ে এসেছে। এবার তো ফিরতে হবে দায়িত্বশীল, নিষ্ঠাবান, নিয়ন্ত্রিত প্রাত্যহিক জীবনে।

লাহোরের মুসলমান শেফ মধ্যবয়সী। তার হাতের রান্না খেয়ে মুগ্ধ ভিক্টোরিয়া।

এই মুগ্ধতাই তাকে টেনে নিয়ে গেছে শরীরের স্বাদ-আহ্লাদে। লাহোরের পাচক ভিক্টোরিয়ার ব্যক্তিগত শেফ।

স্বামী অ্যালবার্ট ডিনার সেরে নেয় সন্ধে ছটার মধ্যে। ডিনার খেয়ে চলে যায় লাইব্রেরিতে।

অনেক রাত পর্যন্ত বইয়ে ডুবে থাকে পণ্ডিত অ্যালবার্ট। তার শরীরের চাহিদা নেই। ডাক পড়ে শেফের।

ভিক্টোরিয়া গল্প করে। ধীরে ধীরে লাল সুরার ঘোর লাগে তার মনে।

শয়ন ঘরের পাশেই ছোট্ট একটি অ্যান্টিরুম।

একান্তভাবেই ভিক্টোরিয়ার।

শেফকে ডাকে ভিক্টোরিয়া।

শেফ জানে কী করতে হবে।

পোশাকটি ধীরে ধীরে খুলে দিতে হবে শরীর থেকে। সেলিম, কী সুন্দর আঙুল তোমার। শিল্পীর আঙুল। তুমি বাঁশি বাজাও না কেন? কেন আঁকো না ছবি? শেফকে প্রায়ই বলে ভিক্টোরিয়া।

– তুমিই তো আমার সুর। আমার ছবি।

– ঠিক তো? সেলিম দুটি গোলাপি জাগ্রত রূপের ওপর দীর্ঘ ঘন চুমু খায়।

– তোমার চুমুতে আলাদা মশলা আছে শেফ। এই ম্যারিনেশন আর কারও চুমুতে নেই।

মধ্যবয়সী শেফ শুধু তৃষ্ণা জাগায়। সেই তৃষ্ণা তৃপ্ত করে অশ্বপালক। নারীটি মনে মনে হাসে।

তার কোনও অভাব নেই। এই ভাল।

অশ্বপালক বা শেফ, কারও কথাই আজ ভাবতে ভাল লাগছে না ভিক্টোরিয়ার।

আজ বিকেলের সবটুকু আচ্ছন্ন করে রেখেছে অভিজাত, রূপবান, শীলিত, মার্জিত, অবিশ্বাস্য ধনবান এক বাঙালি।

এতটুকু জড়তা নেই তার সাবলীল ব্যবহারে।

মনেই হয় না কোনও পরাধীন দেশের মানুষ!

ভুলতে পারব না কোনওদিন এই মানুষটিকে। প্রতিদিন কত মানুষের সঙ্গেই তো দেখা হচ্ছে।

কিন্তু ডারলিং ডোয়ারকি কত অন্যরকম!

এ-রকম পুরুষ এই প্রথম দেখলুম। সে যখন হাঁটুগেড়ে বসে আমার হাতের আঙুলে চুমু খেল, আমার সমস্ত অন্তর তাকে আলিঙ্গন করে ‘প্রিন্স’ বলে ডাকল! ডারলিং ডোয়ার্কি। মাই প্রিন্স।

তোমার সঙ্গে কথা বলে আমি মুগ্ধ। আমাকে মুগ্ধ করেছে তোমার বাচন ভঙ্গি। তোমার মুখের ভাষা। তোমার আদবকায়দা। সহবত। ব্যবহার। প্রিন্স, তুমি আমাকে জিতে নিয়েছ।

ডারলিং ডোয়ার্কি, আমার সমস্ত মন তোমাকে ডাকছে মাই প্রিন্স বলে।

কোথায় তুমি শিখেছ এমন নিখুঁত, নির্ভুল, অভিজাত ইংরেজি? কোথায় পেলে এমন মসৃণ উচ্চচারণ? এমন আদুরে অ্যাকেসেপ্ট? এমন আদুরে অ্যাকসেপ্ট? এমন রমণীয় ভাষা?

সন্দেহ নেই প্রিন্স, তোমার রক্তের রং নীল!

সন্দেহ নেই তুমি কোনও রাজার ছেলে নিশ্চয়।

আভিজাত্যের সন্তান!

তুমি যখন চুমু খেলে আমার আঙুলে, শিউরে উঠল মন। শিরশির করল শিরদাঁড়া।

তোমাকে নিমন্ত্রণ করবো ক’দিন পরেই, আমার সঙ্গে ডিনারে। সেদিন আরও অনেকক্ষণ ধরে বুঝবো তোমাকে। আরও কাছ থেকে দেখব।

পাব তোমার লাবণ্যময় সান্নিধ্যের আরাম।

পাব তোমার অপূর্ব উপস্থিতির উত্তাপ।

তোমার প্রণয়ে আরও গহন হবো মাই ডারলিং।

তুমি অনেক দূরের দেশের মানুষ।

থাকতে আসনি এখানে বেশিদিনের জন্যে।

যেমন হঠাৎ এসেছো, হঠাৎ-ই চলে যাবে।

তাই সময় নষ্ট করার সময় নেই আমার।

আমার সমস্ত শরীরে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছ ডোয়ার্কি।

তোমাকেও পুড়তে হবে, আমার সঙ্গে। আমার রুগণ স্কলার স্বামী অ্যালবার্ট পাশের ঘরে কিছুই জানবে না। জানলেও মুখ খুলবে না। এই পর্যন্ত লিখে থামে ভিক্টোরিয়া। মাত্র তেইশ বছর তো বয়েস তার। কতটুকু বোঝে সে পুরুষের!

ভিক্টোরিয়া ভাবে কিছুক্ষণ।

তার মুখে ফুটে ওঠে হাসি।

সে যেন দেখতে পায় ভবিষ্যৎ।

মনে মনে বলে, ডোয়ার্কি, আমি জানি, আমার সঙ্গে একবার মিলনের পর আমাকে ছেড়ে থাকতে পারবে না। সর্বস্ব ত্যাগ করে, তোমার সন্তান, সংসার, যে যেখানে আছে, ঐশ্বর্য সম্পদ সমাজ দেশ, সব উড়িয়ে দিয়ে তোমাকে চলে আসতেই হবে লন্ডনে। এই পরবাসে। এই পরদেশে। আবার।

তোমার ভিক্টোরিয়াকে তুমি ছাড়তে পারবে না। ভুলতে পারবে না। বেরতে পারবে না তার মোহপাশ থেকে।

আমিই তোমার নিয়তি মাই প্রিন্স।

লন্ডনই তোমার মৃত্যুভূমি।

ভিক্টোরিয়া দ্বারকানাথের দেওয়া শালটিকে সরায় তার বুক থেকে। তার পাতলা রাত্রিবাসটি খোলা রেখেছে তার বুকের অনেকটা। ভিক্টোরিয়া উঠে যায় আয়নার সামনে।

ফুল-সাইজ মিরর-এ ফুল-সাইজ ভিক্টোরিয়া।

শরীর থেকে ঝরিয়ে দেয় রজনীবাস।

অগ্নিকুণ্ডের হলকা কাঁপে সারা শরীর জুড়ে।

স্তনসন্ধিতে জ্বলছে একটি রক্তবর্ণ অরুণোপল!

এমন বৃহৎ এবং অনুপম রুবি ভিক্টোরিয়া এই প্রথম দেখল!

ডোয়ার্কির উপহার।

একটি আশ্চর্য সুন্দর মণিমঞ্জুষায় এই অলংকারটি ভিক্টোরিয়াকে উপহার দিয়েছে প্রিন্স।

আজ রাত্রে আর কোনও অলংকার নেই ভিক্টোরিয়ার অঙ্গে।

তার দুটি উদ্ধত স্তনের মাঝখানটি জুড়ে প্রিন্সের অপরূপ অরুণোপল!

মাই প্রিন্স!

মাই ডারলিং।

ভিক্টোরিয়ার কণ্ঠ থেকে ঝরে পড়ে গাঢ় মধুবিন্দু। আর্শিতে নিজের শরীর দেখে ভিক্টোরিয়া।

নিজেকে দেখতে আজ কী ভাল যে লাগছে তার!

নিরাবরণ শরীর।

শরীর তো নয়।

যেন তারার ধুলো।

এই তারার ধুলো আমি তোমাকে দেব ডোয়ার্কি।

ধুলো খেলো তুমি সারারাত।

স্ত্রী দিগম্বরীর মৃত্যুর পরে দ্বারকানাথের বুক থেকে পাথর সরে গেল। দম আটকে ছিল। এবার বুক ভরে নিশ্বাস নিলেন।

সুন্দরী স্ত্রী। একেবারে পটে আঁকা ছবি। কিন্তু বড্ড জুড়িয়ে যাওয়া ঠান্ডা শরীর।

যশোরের মেয়ে দিগম্বরী।

যশোরের নরেন্দ্রপুর গ্রাম। সেখানে থাকেন পিরালি ব্রাহ্মণ রামতনু রায়চৌধুরী। স্ত্রী আনন্দময়ীকে নিয়ে ঘর করেন। মুসলমানের জল ছোঁয়া পিরালি ব্রাহ্মণ। সুতরাং একঘরে। দ্বারকানাথও পিরালি। রামতনু আর আনন্দময়ীর কন্যা ছ’বছরের দিগম্বরীর সঙ্গে বিনাবাক্যব্যয়ে বিয়ে হল পনেরো বছরের দ্বারকানাথের।

পর পর জন্মাল পঞ্চ ‘পাণ্ডব’ : দেবেন্দ্র, নরেন্দ্র, গিরীন্দ্র, ভূপেন্দ্র, নগেন্দ্র।

কিন্তু তবু বিয়েটা ঠিক জমলো না। এবং তার কারণ দিগম্বরীর অশিক্ষা, পুণ্যি-পুণ্যি বাতিক। শারীরিক শৈত্য। ইচ্ছে আর সাড়ার অভাব।

ধীরে ধীরে দ্বারকানাথের সঙ্গে স্ত্রী দিগম্বরীর সম্পর্কে ক্ষয় ধরল। দ্বারকানাথের সঙ্গে বিচ্ছেদ চাইলেন সাধ্বী স্ত্রী।

সেই সময়ে বিয়েবিচ্ছেদ! তা-ও স্ত্রী চাইছেন বিয়ে ভাঙতে! ভাঙল সেই বিয়ে। তবে কিম্ভূত শর্তে!

পরে আসছি দ্বারকানাথের বিয়ে-ভাঙার গল্পে। এখন অন্য কথা।

সবে মারা গেছেন দিগম্বরী।

একই দিনে চোদ্দবার গঙ্গাস্নান করে নিউমোনিয়া হয়েই চলে গেলেন তিনি। শরীর সহ্য করতে পারল না পুণ্যির ধাক্কা।

দ্বারকানাথের হাড়ে বাতাস লাগল।

অনেকদিনের স্বাদ তাঁর বিলেত-ভ্রমণ।

নিজের জাহাজে বিলেত চললেন দিগম্বরীমুক্ত দ্বারকানাথ। ভারি সুন্দর ইংরেজি লেখেন। অনর্গল। সুঠাম।

লিখলেন ইউরোপ-যাত্রার গল্প, পুত্র দেবেন্দ্রনাথকে :

Here I am at last in this place, having accomplished the object of my twenty years’ contemplation. Left Calcutta January 10th, (see what wonders I have done within these few months), arrived at Suez on the 11th February, saw Egypt, Malta, Naples, Rome, Florence, Venice, the Geman states, Belgium, the scenery of the Alps and Rhine and arrived at Calais on the 8th instant. The next morning crossed the British Channel and arrived at Dover. Passed the night at Canterbury.

The next morning June 16th (সঠিক তারিখ কিন্তু ১০ জুন) made my appearance in this blessed city of London.

কতদিনের স্বপ্নপূরণ!

সমস্ত ইউরোপ ঘুরে লন্ডনে এসে কি ভেঙে গেল সেই স্বপ্ন? দ্বারকানাথের কি মনে হল, এই তাহলে লন্ডন? এ আর এমন কী! যেমন মনে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের, প্রথম লন্ডনে এসে?

না, লন্ডন তাঁকে মুগ্ধ করল, তাঁর ইউরোপিয়ান অভিজ্ঞতার পরেও। দেবেন্দ্রনাথকে লিখলেন :

After seeing everything on the Continent I did not know that I should be so much taken by this little island; really London is the wonderful city : the bustling of the city, the carriages, the shops, the people, quite bewildered me.

বিস্মিত বিহ্বল দ্বারকানাথের কেমন করে কাটছে প্রথম কয়েকটি দিন তাঁর স্বপ্নের লন্ডনে?

From 8 AM to 12 at night, I am engaged either in receiving or returning visits and invitations. Two days after my arrival, I had a very gracious reception by Her Majesty.

সুন্দরীপ্রবণ দ্বারকানাথের লন্ডন ভাললাগার আরও এক কারণ, সেখানকার রমণীরা।

কী সুন্দর তারা!

দেখে দেখেও আশ মেটে না।

পুত্রকে সেকথা জানাতে এতটুকু দ্বিধা করলেন না প্রিন্স:

লন্ডনের সুন্দরীদের যত দেখছি, মনে হচ্ছে এরা সব রূপকথার রমণী!

ছেলেবেলায় পারস্যের গল্পে যে সব সুন্দরীদের কথা পড়েছি, তারাই বাস্তব হয়ে উঠেছে লন্ডনে!

লন্ডন ধনীদের স্বর্গ।

এখানে এসো, যদি ভোগ করতে চাও।

সম্ভোগের সব উপাদান এখানে পাবে, যদি হাতে অর্থ থাকে।

The beauty of the ladies in England puts me in mind of the fairy tales.

What I read in my younger days in the Persian tales, I begin to see in London.

If a man has wealth, this is the country to enjoy it in.

দেখতে-দেখতে ক’দিন কেটে গেছে লন্ডনে।

লন্ডনকে ক্রমে ভালবেসে ফেলছেন দ্বারকানাথ।

তিনি উঠেছেন ৩২ অলবিমার্ল স্ট্রিটে-এর সেন্ট জর্জ হোটেল।

ইতিমধ্যে তাঁর দেখা হয়েছে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার রবার্ট পিল-এর সঙ্গে। সাদর আপ্যায়ন পেয়েছেন প্রিন্স।

পরাধীন দেশের মানুষ বলে কেউ তাঁকে অবজ্ঞা করছে না।

খবর রটে গেছে, স্বয়ং রানি ভিক্টোরিয়া দ্বারকানাথে মুগ্ধ।

র‍্যাডিকাল নেতা লর্ড ব্রাউহাম দ্বারকানাথকে নিমন্ত্রণ করেছেন। তিনিই তো ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটির প্রবর্তক। এমন ইংরেজের আতিথ্যে কৃতজ্ঞ বোধ করেন দ্বারকানাথ।

এরপর দ্বারকানাথের আলাপ এবং বন্ধুত্ব হল লর্ড ফিৎজিরাল্ডের সঙ্গে। ইংরেজ লর্ড। ধনী ও উন্নাসিক।

কিন্তু যতোই কথা বলছেন দ্বারকানাথের সঙ্গে, ততোই একই সঙ্গে বিস্মিত ও মোহিত হচ্ছেন লর্ড ফিৎজিরাল্ড।

প্রথমে নাক কুঁচকে ছিলেন ভারতীয় নেটিভের নামে। কিন্তু আলাপের কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারলেন উন্নাসিক ব্রিটিশ লর্ড, দ্বারকানাথের মতো অভিজাত, ধনী, সুদর্শন ও ব্যবহারি সৌকুমার্যে অনন্য পুরুষ লন্ডনেও বেশি নেই।

– কেমন দেখলে দ্বারকানাথকে? লর্ড ফিৎজিরাল্ডের কাছে জানতে চান রানি ভিক্টোরিয়া।

– এমন অভিজাত বিত্তবান উজ্জ্বল মানুষ ভারত থেকে বিশেষ আসেনি এদেশে, বলেন ফিৎজিরাল্ড।

রানির নীল চোখ দুটি যেন দপ করে জ্বলে ওঠে, লক্ষ করেন লর্ড। বলেন, ইzওর ম্যাজেস্টি, আপনার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেবার ইচ্ছে আছে।

– অবশ্যই। তোমার কথা শুনে আলাপ করতে আমিও ইচ্ছুক। কত বয়েস মানুষটির? প্রশ্ন না করে পারেন না রানি।

– কত আর? হয়তো চল্লিশ পেরিয়েছেন। তবে…

– তবে কী? এরই মধ্যে বুড়ো হয়ে গেছে? যেমন হয় অধিকাংশ ইন্ডিয়ান। রানির কণ্ঠে উদ্বেগ।

– ঠিক তার উল্টো, ইওর ম্যাজেস্টি। কথাটা বলে মজা পান লর্ড ফিৎজিরাল্ড। রানি ভিক্টোরিয়ার ব্যক্তিগত জীবন তাঁর অজানা নয়। রানির উদ্বেগ লক্ষ করেন তিনি। একটু ভেবে বলেন, এই মানুষটির যৌবন এখনও চলে যায়নি। সত্যি কথা বলতে, যেমন রূপ, তেমন আভিজাত্য।

– তাহলে কালই তুমি সঙ্গে করে নিয়ে এসো। আলাপ করিয়ে দাও। তোমার রুচিতে আমার বিশ্বাস আছে। আশা করি, আমার সময় নষ্ট হবে না।

১৬ জুন দ্বারকানাথের সঙ্গে রানি ভিক্টোরিয়ার আলাপ করিয়ে দিলেন লর্ড ফিৎজিরাল্ড।

১৮ জুন শনিবার ‘কোর্ট জার্নল’ কাগজে ‘হার ম্যাজেস্টি’স ড্রয়িংরুম’ শিরোনামে প্রকাশিত হল এই সংবাদ:

Dwarkanath Tagore, Zamindar, was presented by Lord Fitzgerald to Her Majesty Queen Victoria also to Prince Albert, to the Duchess of Kent and the Duke of Wellington. The Queen conversed affiably with Dwarkanath.

সেই রাত্রে লর্ড ফিৎজিরাল্ড রানির কাছ থেকে একটি নোট পেলেন:

The Brahmin speaks English remarkably well and is a very intelligent, interesting man.

নোটটি পড়ে মুচকি হাসলেন ফিৎজিরাল্ড।

যা বুঝবার বুঝে ফেলেছেন তিনি।

তাঁর চোখের সামনে পাশাপাশি ফুটে ওঠে দুটি দৃশ্য।

এক, অনেক রাত। তাঁর পড়ার ঘরে বইয়ের মধ্যে ডুবে আছেন রুগণ, ফ্যাকাশে, উদাসীন পণ্ডিত অ্যালবার্ট।

দুই, ঘরের পাশে অ্যান্টিরুমে দরজা বন্ধ করলেন রানি ভিক্টোরিয়া। তৃষ্ণার্ত, ক্ষুধার্ত তিনি। তাঁর সামনে এক অভিজাত ভারতীয়। এতই সুদর্শন যে কোনও রকম বিচার করতে চায় না মন। আচ্ছন্ন করে সেই রূপ।

আরও এক সপ্তা কেটে গেল লন্ডনে।

২৩ জুন।

ব্রিটিশ ট্রুপস এর মার্চপাস্ট। দ্বারকানাথের জন্যে। এইভাবে রানি ভিক্টোরিয়া বিশেষ সম্মান জ্ঞাপন করছেন ডারলিং ডোয়ার্কিকে। অন্যান্য অভিজাত অতিথিদের থেকে দূরে স্বয়ং কুইন ভিক্টোরিয়ার সঙ্গে এক স্বতন্ত্র বৃত্তে, বসেছেন প্রিন্স দ্বারকানাথ।

দ্বারকানাথকে ব্রিটিশ সরকার প্রিন্স উপাধি দেয়নি। কিন্তু কী এসে যায় তাতে?

স্বয়ং রানি তাঁকে প্রিন্স বলে।

তিনি যে ইন্ডিয়ান প্রিন্স তাতে কারও মনে সন্দেহ নেই।

ইংরেজের কাছে এরই মধ্যে দ্বারকানাথ ‘প্রিন্স’ নামেই খ্যাত হয়েছেন।

– প্রিন্স, আপনার কোনও অসুবিধে হচ্ছে না তো?

– প্রিন্স, আপনি কি তৃষ্ণার্ত?

– প্রিন্স, কেমন লাগছে আপনার লন্ডন?

– প্রিন্স, এই ক-দিনেই হোমসিক হয়ে পড়লেন না তো?

– প্রিন্স, চার্লস ডিকেন্স একটিবার তাঁর একখানি নতুন উপন্যাস নিয়ে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চান? একটু সময় দিতে পারবেন তাঁকে?

– প্রিন্স, উইলিয়ম থ্যাকারের নাম নিশ্চয় শুনেছেন, নিশ্চয় লেখক হিসেবে তাঁর খ্যাতি ইন্ডিয়াতে পৌঁছেছে, তিনি আপনার দর্শনপ্রার্থী। যদি একটু সময় দেন…।

রানি ভিক্টোরিয়ার মনে একটি প্রশ্ন। খুবই জরুরি প্রশ্ন নিঃসন্দেহে। প্রিন্স কি বিবাহিত?

রানির একপাশে প্রিন্স। অন্য পাশে লর্ড ফিৎজিরাল্ড। প্রিন্সের আর এক পাশে স্বামী অ্যালবার্ট। অ্যালবার্ট আর প্রিন্স মশগুল হয়ে কথা বলছে। এই সুযোগ।

– ফিৎস, ফিশফিশ করে ডাকে ভিক্টোরিয়া।

– ইয়েস ইওর ম্যাজেস্টি, সাড়া দেয় ফিৎসজিরাল্ড।

– প্রিন্স কি বিবাহিত?

– মারা গেছে, ফিশফিশ করে বলেন ফিৎসজিরাল্ড।

– কে মারা গেছে?

– বউ।

– ফিৎস, কিছুই খোঁজ রাখোনা দেখছি। হিন্দুরা যতো খুশি বিয়ে করতে পারে।

– পারে ইওর ম্যাজেস্টি। কিন্তু প্রিন্স বুদ্ধিমান। করেনি।

– ঠিক জানো?

– ঠিক জানি।

– আই অ্যাম সরি টু হিয়ার হি হ্যাজ লস্ট হিজ ওয়াইফ।

ফিৎসজিরাল্ড মুচকি হেসে আড় চোখে তাকায়। ভিক্টোরিয়াকে বেশ প্রফুল্লই লাগে তাঁর।

– আজ রাত্রে কিন্তু বাকিংহাম প্যালেসে ডিনার। মনে আছে তো প্রিন্স? প্রশ্ন করে ভিক্টোরিয়া।

– অবশ্যই মনে আছে।

– ডিনারের পরে অনেকক্ষণ জাগতে পারবে তো?

– পারবো।

– তোমার সঙ্গে আজ আমার অনেক কথা আছে প্রিন্স।

– আমি শ্রোতা হিসেবে খারাপ নই।

– শুধু শুনলে হবে না প্রিন্স।

দ্বারকানাথ শুধু তাকান ভিক্টোরিয়ার দিকে। কিছু বলেন না।

বিকেলের দিকে কেমন যেন ক্লান্ত লাগছে দ্বারকানাথের।

সুরা পান কি বেশি হয়ে গেল!

রাত্রে আর সুরা নয়। ব্র্যান্ডি। তাতে ক্লান্তি কাটবে। বেশি সুরা পান করলে ঘুম-ঘুম লাগে।

ব্র্যান্ডিতে সুরার নেশা কাটবে, দ্বারকানাথের বিশ্বাস। ভিক্টোরিয়ার কথায় ইশারা পেয়েছেন দ্বারকানাথ।

অনেক রাত পর্যন্ত জাগতে হবে।

অনেক কথা আছে?

শুধু কথা?

ভেলভেটের ছোট্ট বাক্সটি আলোর কাছে নিয়ে খুললেন প্রিন্স।

মোমবাতির আলোয় ঝলমল করে উঠল বাক্সের মধ্যে সযত্নে রক্ষিত একটি বৈদুর্যমণি!

সারা পৃথিবীতে আরও একটি এমন বৈদুর্যমণি আছে কি? কোথাও পাওয়া যাবে এর জোড়া?

বোধহয় না, দ্বারকানাথ বলেন মনে মনে।

বাক্সটি বন্ধ করে জামার পকেটে রেখে দেন।

আজকের ডিনারে একটু দেরি করেই যাবেন দ্বারকানাথ। আভিজাত্যের স্বাক্ষর সেটাই, মনে হয় তাঁর।

বাকিংহ্যাম প্যালেসের ব্যাঙ্কোয়েট হল-এ একেবারে এক সঙ্গেই প্রবেশ করেন তারা।

কুইন ভিক্টোরিয়া। পাশে প্রিন্স কনসর্ট অ্যালবার্ট।

অন্য একটি দরজা দিয়ে রাজকীয় ভঙ্গিতে প্রবেশ করেন প্রিন্স দ্বারকানাথ। সকলে উঠে দাঁড়ায়।

প্রিন্স দ্বারকানাথ গটগট করে এগিয়ে যান রানির সামনে। অনিন্দ্যসুন্দর হাসিটি ঠোঁটে এসে হাঁটুগেড়ে সম্মান জ্ঞাপন করে রানিকে। তারপর তাঁর জন্যে নির্ধারিত আসনে বসে পড়েন তিনি।

পাশের আসনটিই রানি ভিক্টোরিয়ার।

লর্ড ফিৎসজিরাল্ড বেশ কিছুটা দূরে।

এমনকি অ্যালবার্ট তিনিও দূরে!

এমন কাণ্ড যে রানির আদেশেই ঘটেছে, কারও বুঝতে দেরি হয় না। অনেক অভিজাত ইংরেজ লুকোতে পারে না সংশয় ও বিরক্তি। ভিক্টোরিয়া তখনও অপরিণত।

ইন্ডিয়ান প্রিন্সকে নিয়ে এই বাড়াবাড়িটা ঠিক হচ্ছে না।

শোনা যাচ্ছে তেইশ বছরের ভিক্টোরিয়া এমনই মজেছে দ্বারকানাথে তাকে নাকি সত্যিই তিনি অফিশিয়াল ‘প্রিন্স’ উপাধি দেবেন।

অসম্ভব!

কিছুতেই ঘটতে দেয়া হবে না এই ঘটনা।

চোয়াল শক্ত হচ্ছে রাজপরিবারের অনেকেরই।

লর্ড ফিৎসজিরাল্ড ভিক্টোরিয়ার বন্ধু।

তিনি মজা দেখছেন পরিপাটি দূরত্ব থেকে।

দ্বারকানাথ তাকালেন সামনে।

তিনি কি স্বপ্ন দেখছেন!

ঠিক তাঁর উল্টো দিকে যাঁরা বসেছেন নির্ধারিত আসনে, তাঁদের একজন চার্লস ডিকেন্স।

অন্যজন, উইলিয়াম থ্যাকারে।

– ইন্ডিয়াতে আপনার লেখা বেশ জনপ্রিয়। শিক্ষিত ভারতীয় অনেকেই আপনার ভক্ত। কিন্তু মিস্টার ডিকেন্স, আপনি আমাদের দেশে এখনও তেমনভাবে পৌঁছননি। তবে আমি বোধহয় এ-পর্যন্ত আপনার লেখা সব বই পড়েছি। তুলনাহীন আপনার পিকউইক পেপার্স! কী যে মজা পেয়েছি।

– আর ‘অলিভার টুইস্ট’? পড়েননি?

– অবশ্যই পড়েছি। ‘ওল্ড কিউরিওসিটি শপ’ তো জাহাজে পড়তে পড়তে এলাম। ভাবি আমার ভাষা বাংলায় কবে এমন উপন্যাস লেখা হবে।

ভিক্টোরিয়ার মধ্যে মুগ্ধতা মিশে যায় শ্রদ্ধায়।

প্রিন্স একদিকে জমিদার। অন্যদিকে তার নানারকম বাণিজ্য। তবু ইংরেজি সাহিত্য এইভাবে কখন পড়ে? সময় পায় কী করে?

একস্ট্রাঅর্ডিনারি টাইম-ম্যানেজমেন্ট!

– প্রিন্স, তুমি নিশ্চয় মিস্টার থ্যাকারের লেখা ততো বেশি পড়নি। যদিও বললে, মিস্টার থ্যাকারে মিস্টার ডিকেন্সের চেয়ে এখন ইন্ডিয়ায় বেশি পপুলার।

– মিস্টার থ্যাকারের লেখা পড়ব না? কোনও শিক্ষিত ইন্ডিয়ান থ্যাকারে না পড়েছে? তবে আমার মনে হয়, এখনও আপনার সবচেয়ে বড় লেখাটা লেখেননি আপনি। আপনার আসল আত্মপ্রকাশ এখনও ঘটেনি মিস্টার থ্যাকারে।

থ্যাকারের মুখটা ফ্যাকাশে দেখায়। তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, আমি কিন্তু আপনার শহরের লোক।

– আমি শুনেছি মিস্টার থ্যাকারে। আপনি কলকাতায় জন্মেছিলেন। আপনার বাবা বোধহয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে চাকরি করতেন।

– ঠিক। বাবা মারা যান আমার তিন বছর বয়েসে।

– তাহলে তিন বছর বয়েস পর্যন্ত কলকাতায়?

– না না। আরও তিন বছর কাটিয়েছি। ছ’ বছর বয়েসে প্রথম লন্ডনে মা’র কাছে ফিরে এলাম।

– কলকাতার কিছু মনে আছে?

– হ্যাঁ। গঙ্গা। কী সুন্দর নদী! আমার কোন বইটি আপনার ভাললেগেছে প্রিন্স? প্রশ্ন করে থ্যাকারে।

– যে-বই বিশেষ কেউ পড়েনি। ‘দ্য ইয়েলোপ্লাশ পেপার্স’। থ্যাকারে অবাক হয়ে তাকান দ্বারকানাথের দিকে।

– আমি তো ভেবেছি, আমিই থ্যাকারের ওই বইটার একমাত্র পাঠক।

প্রিন্স অ্যালবার্টের একথা শুনে টেবিলে অনেকেই হেসে ওঠেন।

– আপনার এ-বইয়ে কারলাইলের ফ্লানকিইজম-এর ব্রিলিয়ান্ট সমালোচনা আমাকে মুগ্ধ করেছে, বলেন দ্বারকানাথ। তিনি তাকিয়ে থ্যাকারের দিকে। থ্যাকারের ইন্ডিয়ান প্রিন্সের অবিশ্বাস্য বৈদগ্ধ্যে বিস্মিত।

ভিক্টোরিয়া টেবিলের তলায় নিজের পা আলতোভাবে একটিবার রাখে দ্বারকানাথের পায়ে। দ্বারকানাথ ঝলকে চোখ রাখেন ভিক্টোরিয়ার চোখে।

– কখন পড়ো তুমি অ্যাতো বই? বাণিজ্য, জমিদারি সামলে সময় পাও? ভিক্টোরিয়া প্রশ্ন করে। সে সত্যিই জানতে চায়।

– তুমি অ্যাতো ব্যস্ততার মধ্যে নিশ্বাস নিতে সময় পাও কী করে?

ভিক্টোরিয়া কী বলবে ভেবে পায় না।

– আমার কাছে বই পড়া, সাহিত্য, সঙ্গীত, শিল্পচর্চা, জীবনচর্চা, সবকিছু নিশ্বাস নেওয়ার মতোই সহজ। এসবের জন্য আলাদা করে সময় করতে হয় না, বলেন দ্বারকানাথ।

ভিক্টোরিয়ার ইচ্ছে করে, সবার সামনে সে প্রিন্সকে আদর করে চুমু খায়।

তারপর তার মনে হয়, সে ভুবনেশ্বরী।

সে সম্রাজ্ঞী।

কিছুতেই সম্ভব নয় নিশ্বাসের মতো সহজ হওয়া।

পার্টি ভেঙে গেছে অনেকক্ষণ।

ব্যাঙ্কোয়েট হল থেকে চলে গেছে এঁটো বাসনের তাগাড়।

খালি পান পাত্র। শূন্য বোতল।

সব আবার পরিপাটি। গোছানো। একটি কি দুটি মিটমিটে সেজের আলোয় ঘুমিয়ে পড়েছে শুনশান ব্যাঙ্কোয়েট।

প্রিন্স অ্যালবার্ট সুরার পাত্র নিয়ে নিবিড় অধ্যয়নে রত লাইব্রেরি ঘরে।

তার শরীর কখনোই তেমন যুৎসই নয়।

প্রাসাদের যে ঘরটিতে তার মন সবচেয়ে আরামে থাকে তা হল এই বিশাল বইঘর।

– ডোয়ার্কি, এসো আমার সঙ্গে। ডারলিং ডোয়ার্কিকে হাত ধরে নিয়ে যায় ভিক্টোরিয়া তার শয়নকক্ষে।

তারা মুখোমুখি ঘরের ঠিক মাঝখানে।

পাশেই অর্ধেক ঘরজোড়া এক বিপুল বিলাসের পালঙ্ক। পালঙ্কের পাশে শ্বেতপাথরের গোল টেবিল।

টেবিলের ওপর লাল ভেলভেটের একটি ছোট্ট থলি।

ভিক্টোরিয়া থলিটি তুলে নেয়।

– ডারলিং, তোমার ডান হাতটি পাতো।

দ্বারকানাথ ঠিক তাই করেন। তিনি যেন সম্মোহিত।

ভিক্টোরিয়া ছোট্ট থলির মুখটি খুলে দেয় একটি সুতোর টানে।

ভিতর থেকে চারটি সোনার মোহর দ্বারকানাথের হাতে ওপর ঝরে পড়ে।

প্রত্যেকটির ওপর ভিক্টোরিয়ার মুখ।

দ্বারকানাথ সেজের আলোর কাছে সরে যান। বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকেন মোহর চারটির হিরণ্ময় দ্যুতির দিকে।

– মোহর তো কত দেখেছি। সব মোহরেই তোমার মুখ ভিক্টোরিয়া। কিন্তু এমন দ্যুতিময় মোহর এই প্রথম দেখলুম।

– ডারলিং, আজকেই এদের প্রথম জন্মদিন। মিন্ট থেকে সরাসরি এসেছে আমার কাছে। আমার সামান্য উপহার ডারলিং।

দ্বারকানাথ এগিয়ে যান ভিক্টোরিয়ার কাছে।

দুটি শরীরের মধ্যে আর কোনও বিভেদরেখা নেই। ভিক্টোরিয়ার নিটোল দুটি স্তনের স্পর্শ অনুভব করেন দ্বারকানাথ।

ভিক্টোরিয়া যেন আদিম আগুনের স্রোত। পৃথিবীর গভীর অন্ধকারে লুকিয়ে থাকা লাভা।

সেই অগ্নিস্রোত দ্বারকানাথকে ভাসিয়ে নিয়ে ফেলে পালঙ্কের ওপর।

তারপর সেই অগ্নিস্রোত মুক্ত করে নিজেকে আবরণের সমস্ত বাধাবন্ধন থেকে।

দ্বারকানাথ হাত রাখেন সেই শরীরবহ্নিতে।

নারী কম দেখেননি তিনি।

কিন্তু এমন কামনাবহ্নিত তারল্য দেখেছেন কি কখনও!

দ্বারকানাথের মনে পড়ে!

তিনি জামাটি খুলে ফেলার আগে পকেটের ভিতর থেকে বার করে আনেন বৈদুর্যমণিটি।

ভিক্টোরিয়ার চোখের সামনে ধরেন সেটি। ভিক্টোরিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে। তার মুখে কথা নেই।

নীলা যে এত বড় হতে পারে, সে ভাবতেই পারছে না।

নীলকান্তমণিটিকে সেজের আলোর সামনে ধরেন দ্বারকানাথ।

মায়াময় নীলচে আলোয় ভিক্টোরিয়ার স্তনদুটি যেন নীল দুটি পদ্ম, মনে হয় দ্বারকানাথের।

তিনি ধীরে ধীরে নীলকান্তমণিটিকে রেখে দেন নীল দুটি পদ্মের মাঝখানে।

তারপর মৃদুকণ্ঠে বলেন, ঈশ্বর তাঁর সবচেয়ে সুন্দর কবিতাটি আজ এই মুহূর্তে রচনা করলেন।

এবার একটি অনিবার্য ফ্ল্যাশব্যাক।

১৮৪২-এর লন্ডন থেকে এই উপন্যাসের কাহিনি পিছিয়ে যাচ্ছে আটান্ন বছর।

সাল ১৭৮৪।

স্থান কলকাতার চিৎপুর।

পাথুরিয়াঘাটা থেকে এগিয়ে চলেছি আমরা চিৎপুরের পশ্চিম প্রান্তের দিকে। কিছুদূর এগিয়েই বুঝতে পেরেছি, বাকি পথ নাক চেপে যেতে হবে। পথের পাশে মজে-যাওয়া নালা। ডাঁই হয়ে জমেছে পচা আবর্জনা।

তবে চিৎপুরের দক্ষিণ-পুবটা অন্যরকম।

সেখানে নালার বদলে বেশ টলমলে একটু পুকুর।

পুকুরের পাড়ে সারি দিয়ে নারকেল গাছ। সুপুরি আর তেঁতুল গাছের ছায়াতেও পুকুরপাড়টি মনোরম।

যে-মানুষটি ভর দুপুরে পুকুরে স্নান করতে নামল, তাকে চেনেন না তো?

মানুষটিকে এ পাড়ায় সবাই চেনে। নাম বৈষ্ণব শেঠ। গোষ্ঠীপতি বলে লোক তাকে মান্য করে।

আজকে একটা ঘটনা ঘটতে চলেছে আমাদের চোখের সামনে।

যে-ঘটনা না ঘটলে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির পত্তনই হত না।

বুঝতেই পারছেন ঘটনাটির সঙ্গে এই উপন্যাসের নায়ক দ্বারকানাথের যোগসূত্র অনস্বীকার্য।

বৈষ্ণব শেঠ পুকুরে ডুব দিয়ে তাকালেন অপর পাড়ের পানে। সেখানে এক দীর্ঘাঙ্গ, গৌরবর্ণ, ভারি সুপুরুষ এক ব্রাহ্মণ গাছের ছায়ায় গৃহদেবতা লক্ষ্মীজনার্দনকে ভোগ দিচ্ছেন!

এই ব্রাহ্মণকে যে প্রথম দেখলেন বৈষ্ণব শেঠ, তা নয়। প্রায়ই দেখেন।

ওই তেঁতুল গাছের তলাতেই যে ব্রাহ্মণ সপরিবার ঘর বেঁধেছে, তাও জানতে বাকি নেই শেঠের।

– ওই ব্রাহ্মণকে আমার সঙ্গে একবার এসে দেখা করতে বল, স্নান সেরে বাড়ি ফিরে বৈষ্ণব শেঠ বলল তার এক ভৃত্যকে।

পরের দিন ব্রাহ্মণ এল বৈষ্ণব শেঠের বাড়ি।

– আমি শুনেছি, আপনি সপরিবার তেঁতুল তলায় আশ্রয় নিয়েছেন। আপনাকে দেখে মনে হয়, আপনি খুবই সৎ ও ধার্মিক মানুষ। আপনার নাম যে নীলমণি, তা-ও আমার অজানা নেই। আমার একটি নিবেদন আছে।

নীলমণি কিঞ্চিৎ বিস্মিত। নম্রভাবে কণ্ঠে বলে, বলুন যা বলতে আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।

ব্রাহ্মণের নম্র কণ্ঠেও একটি তেজের ভাব অনুভব করে বৈষ্ণব শেঠ। সে বলে, আপনি নিশ্চয় সামনেই শান্তিরাম সিংহের বাগান বাড়িটা চেনেন। সেই বাগানের পাশে আমারও একটু জমিজায়গা আছে।

– আমি জানি, বলে নীলমণি।

– সেই জমির একটি অংশ আমি আপনাকে দান করতে চাই। আমার ইচ্ছে, আপনি একটি ঘর বানিয়ে সেখানে আপনার পরিবার ও গৃহদেবতার সঙ্গে বাস করুন।

– কিন্তু আমি অব্রাহ্মণের দান গ্রহণ করতে অপারগ, বলল নীলমণি।

– আমি জানতাম আপনি এ কথা বলতে পারেন। তাই আমি ঠিক করেই রেখেছি, আমি ওই জমিটুকু আপনার গৃহদেবতা লক্ষ্মীজনার্দনকেই দান করব। তাতে নিশ্চয় আপনার আপত্তি নেই।

বৈষ্ণব শেঠের কাছ থেকে লক্ষ্মীজনার্দনের পাওয়া সেই জমিতে সামান্য একটি চালাঘর তৈরি করে বাস করতে লাগল নীলমণি ঠাকুর। এই নীলমণি ঠাকুরই দ্বারকানাথের ঠাকুর্দা। আর চিৎপুরে তেঁতুলতলায় ওই চালাঘরই প্রথম ঠাকুরবাড়ি।

নীলমণির ছেলে রামমণি। আর রামমণির ছেলে দ্বারকানাথ। তবে গল্পটা অত সহজ নয়।

কিঞ্চিৎ আঁকাবাঁকা অস্বীকারের যো নেই।

রামমণির দুই বিয়ে।

প্রথম বিয়ে থেকে রামমণির দুই ছেলে। রাধানাথ। দ্বারকানাথ।

রামমণির কিন্তু একটি দাদা আছে। নাম রামলোচন।

রামলোচনের কোনও সন্তান হল না।

সে দত্তক নিল ছোটভাই রামমণির ছেলে দ্বারকানাথকে। দ্বারকানাথ রামলোচনের স্ত্রী অলোকাসুন্দরীকেই মা বলে চিনল।

তার গর্ভধারিণী মা মেনকাসুন্দরী মারা গেল অলোকাসুন্দরী দ্বারকানাথকে দত্তক নেবার কিছুদিনের মধ্যেই।

দ্বারকানাথ তখন একেবারে শিশু। আপনমনে খেলছে বাড়ির উঠোনে।

এক সাধু ঢুকল ভিক্ষে চাইতে।

সাধু শিশু দ্বারকানাথকে অবাক হয়ে নিরীক্ষণ করে।

তারপর শিশুটিকে কোলে তুলে নিয়ে হাঁক দেয়, মা জননী, কোথায় আপনি? বেরিয়ে আসুন। রাজদর্শন করে যান। সাধুর ডাকে রামলোচন স্ত্রী অলোকাসুন্দরীকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে আসে উঠোনে।

দেখে সাধুর কোলে দ্বারকা। ভারি আহ্লাদ তার। সাধু ওদের দেখেই বলে, এ-ছেলেকে কোথায় পেলে তোমরা?

সাধুকে মিথ্যে বলতে নেই। তারা সত্যি কথাই বলে। দ্বারকানাথ তাদের দত্তকপুত্র।

সাধু রামলোচন আর অলোকাসুন্দরীকে বলে, এই শিশুর মধ্যে রাজলক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে অতি স্পষ্টভাবে। আমি ভবিষ্যদ্বাণী করে গেলুম, এই শিশুই একদিন তোমাদের বংশের মান-মর্যাদা-সম্পদ বৃদ্ধির কারণ হবে। এ ছেলে তো রাজকুমার। ঈশ্বর তাকে সব দেবে। তবে দুঃখের কথাও জেনে রাখো। এই পরিবারের মানুষই তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে।

এ কথা বলে নিজের কোল থেকে দ্বারকানাথকে রামলোচনের কোলে দিয়ে দেয় সাধু।

অলোকাসুন্দরী ছুটে বাড়ির ভিতর থেকে কিছু চাল নিয়ে এসে ঢেলে দেয় সাধুর ভিক্ষের ঝুলিতে। কর্তাগিন্নি সাধুকে প্রণাম করে। সাধু সকলকে আশীর্বাদ করে হাসিমুখে বিদায় নেয়।

মানুষ আকাশ থেকে পড়ে না।

গাছের মতো মানুষও গজিয়ে ওঠে মাটি থেকে।

দ্বারকানাথ ঠাকুরও তার বংশমৃত্তিকার দান।

সেই মাটির রসই তাঁর রক্তধারা।

বংশমৃত্তিকায় নিহিত রক্তধারা শিকড়েবাকড়ে শুষে নিয়ে ডালপালা পাতা-ফুল ছড়িয়ে ক্রমে আকাশস্পর্শী হয়ে উঠলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ।

এই উপন্যাসে এবার এল মাটিখোঁড়ার পালা।

কোন মাটিতে দ্বারকানাথের শিকড়, তা না বুঝলে বোঝা যাবে না তাঁর অবিশ্বাস্য প্রাণশক্তি, অকল্পনীয় মেধা, অফুরন্ত কাঞ্চনকামিনী-তৃষ্ণা, বোঝা যাবে না তাঁর দুঃসাহস, আমরা নাগাল পাব না তাঁর জীবনযাত্রায় নৈতিক-অনৈতিকের সাবলীল মিশ্রণের। কোনও কুণ্ঠা, কোনও পাপবোধহীন জীবন কী সহজে যাপন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ঠাকুর্দা!

বিস্ময় লাগে দেবেন্দ্রনাথকে দেখলে।

আমি ভালোমন্দের কথা বলছি না।

শুধু বলছি, কোন বাপের কী ছেলে! কোনও মিল নেই, কী চরিত্রে, কী মনে!

দেবেন্দ্রনাথ বাপের ধর্মবিশ্বাস গ্রহণ না করে ব্রাহ্ম হওয়ার ফলেই কি এই বিস্ময়কর গরমিল বাপছেলের?

না কি জেনেটিক মিউটেশান!

যাক গে সে গল্প। আমাদের কাহিনি মোটামুটি প্রিন্স দ্বারকানাথেই সীমাবদ্ধ থাক।

সন্ধান করা যাক তাঁর ক্রোমোসোমের।

তাঁর পূর্বপুরুষদের কাজকর্মে, বিশ্বাসে-অবিশ্বাসে, চরিত্রে হয়তো পাওয়া যাবে বংশধারার সংকেতবাহী সূক্ষ্ম তন্তু যা শেষ পর্যন্ত বহু বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে তৈরি করেছে দ্বারকানাথের মতো প্রবল একটি বাঙালি।

এই উপন্যাসের অনন্য নায়কটির জিন বা বংশানু সন্ধান একান্ত প্রয়োজন। দ্বারকানাথ কোন শক্তিতে হয়ে উঠলেন ‘তিনি’, তার সবটুকু বুঝে ওঠা সম্ভব নয়। তার অনেকটাই ব্যাখ্যার অতীত। তবু কাহিনির এখানে এই এষণাটুকু অনিবার্য।

আমাদের কাহিনি পিছিয়ে যাচ্ছে পাঁচশো বছর। এই সময়ে দ্বারকানাথের পূর্বপুরুষরা কুলীন ব্রাহ্মণ।

এই বংশেরই একটি শাখা মুসলমানের জল ছুঁয়ে ‘পিরালি’ ব্রাহ্মণ নামে ব্রাত্য হল।

এই সমাজচ্যুত পিরালি-শাখায় দ্বারকানাথের জন্ম।

জন্ম থেকেই তিনি সমাজচ্যুত। কোনও কুলীন ব্রাহ্মণ-পরিবারে তাঁর বিয়ে হওয়া অসম্ভব!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *