০১. পৌষের শুরু

কালো যাদুকর
ভূমিকা

আমি যা বিশ্বাস করি তাই লিখি। অবিশ্বাস থেকে কিছু লিখতে পারি না। আমার বিশ্বাসের জগৎটা আবার খুবই বিচিত্র। সেই বিচিত্র বিশ্বাসের একটা গল্প লিখলাম। গল্পটিকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ না করাই ভাল হবে।

হুমায়ূন আহমেদ।
৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮
ধানমণ্ডি, ঢাকা।

০১.

পৌষের শুরু।

জাঁকিয়ে শীত পড়েছে। সবাই বলাবলি করছে গত বিশ বছরে এমন শীত পড়েনি। এ বছর বুড়ো মরা শীত পড়েছে, এই শীতে দেশের সব বুড়োবুড়ি মরে যাবে।

প্রতি শীতেই এ-জাতীয় কথা লোকজন বলে। তবে এবারের কথাটা বোধ হয় সত্যি। নেত্রকোনা বিউটি বুক সেন্টারের মালিক মবিন উদ্দিনের তাই ধারণা।

মবিন উদ্দিনের গায়ে ফুল-হাতা সোয়েটার। লাল রঙের মাফলারে মাথা কান সব ঢাকা। তারপরেও “বাড়তি সাবধানতা” হিসেবে ট্রাঙ্ক থেকে পুরানো একটা শাল বের করে তিনি গায়ে দিয়েছেন। শাল থেকে ন্যাপথলিনের বিকট গন্ধ আসছে। গন্ধ আগে টের পাওয়া যায়নি, রাস্তায় নেমে টের পেলেন। তাঁর গা গুলাতে লাগলো। তার গন্ধ বিষয়ক সমস্যা আছে। কড়া কোন গন্ধই সহ্য হয় না। শুরুতে গা গুলাতে থাকে, তারপর মাথা ধরে, বমি বমি ভাব হয়। একবার কী মনে করে কাঁঠাল চাপা ফুলের গন্ধ শুকেছিলেন। গন্ধটা সাঁই করে মাথার ভিতর ঢুকে গেল। তারপর কী যে অবস্থা। তিনি বমি করতে শুরু করলেন। দুপুর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আটবার বমি করে চোখ-টোখ উল্টে বিছানায় পড়ে গেলেন। ডাক্তার আনতে হলো, স্যালাইন দিতে হলো। হুলুস্থুল ব্যাপার।

শাল থেকে এত কড়া ন্যাপথলিনের গন্ধ আসবে জানলে তিনি ভুলেও শাল গায়ে দিতেন না। বড় বড় ভুল মানুষ জেনেশুনে করে না, নিজের অজান্তে করে। গন্ধওয়ালা শাল গায়ে দেয়া তার জন্যে বড় ধরনের ভুল। শুরুতে ভুলটা ধরা পরে। নি, কারণ তাঁর নাক ঢাকা ছিল মাফলারে। নাকে গন্ধ যেতে পারছিল না। রাস্তায় নেমে বড় গাঙ্গের বাঁধের উপর নতুন রাস্তায় ওঠার পর নাক থেকে মাফলার সরে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে সই করে ন্যাপথলিনের গন্ধ তার নাকের ভেতর দিয়ে একেবারে মগজে ঢুকে গেলো। তিনি কী করবেন ভেবে বের করতে পারলেন না। অর্ধেকের বেশি পথ চলে এসেছেন। আবার বাসায় ফিরে যাওয়ার কোনো অর্থ হয়। শালটা খুলে রাস্তায় ফেলে দেয়া যায় না। তিনি দরিদ্র মানুষ। তার অল্প কিছু দামী জিনিসপত্রের একটা হচ্ছে এইখাদ্য। উনিশ বছর আগে বিয়েতের এক মামাশ্বশুর দিয়েছিলেন। উনিশ বছরেও শালটার কিছু হয়নি। পৌষের এই প্রচণ্ড শীতে শাল গায়ে দেয়ার জন্যেই মোটামুটি গরম লাগছে। শুধু গন্ধটা কষ্ট দিচ্ছে। মাথা ঝিমঝিম করা শুরু হয়েছে। গা এখনো গুলাতেও করেনি। তবে শুরু করবে। কে জানে রাস্তার পাশে বসেই হয়তো বমি করতে হবে। এটা নিশ্চয়ই কোন রোগ। তবে হাস্যকর হলেও এই রোগের চিকিত্সা হওয়া উচিত। রোগটা সারা জীবন তাঁকে কষ্ট দিয়েছে।

মবিন উদ্দিন দ্রুত হাঁটছেন। সূক্ষ্ম চেষ্টা চালাচ্ছেন গন্ধকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে। লাভ হচ্ছে না, গন্ধ সঙ্গে সঙ্গে আসছে। নাক বন্ধ করে তিনি এখন মুখে শ্বাস নিচ্ছেন। কাজটা ভুল হচ্ছে, এতে বুকে দ্রুত ঠাণ্ডা লেগে যায়। তিনি যাচ্ছেন নেত্রকোনা রেল স্টেশনের উত্তরে বৈদ্যহাঁটা–তাঁর ছোট বোনা রাহেলার বাসায়। রাহেলার বড় মেয়ে মিতুর বিয়ের কথা হচ্ছে। পাত্র পক্ষের কয়েকজন আসবে। চা-টা খাবে, পাকা কথা হবে। তার উপস্থিত থাকা অত্যন্ত জরুরি। জুরুরি না হলে তিনি বেরুতেন না। কয়েকদিন ধরে তার শরীর ভাল যাচ্ছে না। রোজ সন্ধ্যার দিকে গা কাঁপিয়ে জ্বর আসছে। মনে হয় ম্যালেরিয়া। লোকজন যে বলছে দেশ থেকে ম্যালেরিয়া চলে গেছে এটা ঠিক না। কিছুই পুরোপুরি চলে যায় না, কিছু ফিরে ফিরে আসে। ম্যালেরিয়া আবার ফিরে এসেছে, এবং তাঁকে শক্ত করে ধরেছে।

মুবিন উদ্দিন বাঁধের রাস্তা ছেড়ে মাছ-পট্টি দিয়ে বাজারে ঢুকে গেলেন। বাজার থেকে রিকশা নেবেন। তাঁর হাঁটতে ভাল লাগছে না, ভাল লাগলে হাঁটতে হাঁটতেই যেতেন। কিছু একসারসাইজ হত। তাঁর বয়স পঞ্চাশের মতো এই বয়সে হাঁটা-হাঁটির মতো একসারসাইজ অত্যন্ত জরুরি। হাঁটা-হাঁটি একেবারেই হচ্ছে না। সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যা সাতটা পর্যন্ত বইয়ের দোকানে বসে বসে শরীর ধসে গেছে। তাও যদি বিক্রিবাটা হত একটা কথা ছিল, কোন বিক্রি নেই। বইয়ের দোকান না দিয়ে একটা ভিডিও ক্যাসেটের দোকান দিলে হত। রমরমা ব্যবসা একেক সময় একে জিনিসের সিজন আসে, এখুন ভিডিও ক্যাসেটের সিজন।

রাত আটটার মতো বাজে। প্রচণ্ড শীতের কারণেই বোধ হয় বাজারের বেশির ভাগ দোকানপাট বন্ধ। নিধু সাহার কাপড়ের দোকানটা খোলা। ক্যাশ বাক্সের সামনে নিধু সাহা বিরস মুখে বসে আছে। বিক্রি বাটা মনে হয় ভাল না। মাছ-পট্টির সামনে চায়ের স্টলটা খোলা। সেখানে হিন্দি গান হচ্ছে—“মেরা বাচপান চলা গিয়া।” কয়েকজন কাস্টমার বসে বসে বিরক্ত মুখে চা খাচ্ছে। হিন্দি গান তাদের বিরক্তি দূর করতে পারছে না।

চায়ের স্টলে হিন্দি গান ছাড়া অন্য গান বাজানো হয় না কেন ভাবতে ভাবতে রিকশার খোঁজে মবিন উদ্দিন এদিক ওদিক তাকালেন। কোন রিকশা নেই। চারদিক পুরোপুরি ফাঁকা। এই শীতে কোন রিকশাওয়ালাই বোধ হয় রিকশা বের করেনি। সবাই কাঁথামুড়ি দিয়ে ঘুমুচ্ছে।

মবিন উদ্দিনের মনে হল মাছ-পট্টিতে ঢুকে তিনি আরেকটা বড় ভুল করেছেন। তীব্র ও বিকট মাছের গন্ধে তার প্রায় দম আটকে আসছে। মাছ-পট্টিতে মাছ নেই, কিন্তু মাছের গন্ধ রয়ে গেছে। পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ গন্ধের একটা হল কাঁচা মাছের গন্ধ। এই গন্ধ নাকে নিয়ে লোকজন চা খাচ্ছে কী করে তিনি ভেবে পেলেন না। তিনি মাথার মাফলার খুলে নাকে চেপে দ্রুত হাঁটছেন। মাছ-পট্টি ছাড়ালেই দরজি-পট্টি। আর একটু এগুলেই বড় রাস্তায় পড়বেন। বড় রাস্তায় রিকশা পাওয়া যাবে। রিকশা নিয়ে নেত্রকোনা বড় স্টেশনে চলে যাবেন, সেখান থেকে বিশ পঁচিশ গজ গেলেই রাহেলার বাসা।

দরজি-পট্টির মোড়ে এসে মবিন উদ্দিন থমকে দাঁড়ালেন। বেশ কিছু লোকজন একটা লাইট পোস্টের কাছে ভিড় করে আছে। বাজারের ভেতর কয়েকটা লাইটপোস্ট, কিন্তু কোনোটাতে আলো নেই। এই একটাতেই টিউব লাইট জ্বলছে। সেই আলোয় মজাদার কিছু বোধ হয় হচ্ছে। মজা ছাড়া এই শীতে এতগুলি মানুষ জড় হবে না। লোকজন বেশি থাকলে হৈ চৈ সাড়াশব্দ হয়। এখানে কোন শব্দ নেই। মনে হচ্ছে সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে কী যেন দেখছে। তিনিও উকি দিলেন।

নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখার মতো কিছু না। একজন ম্যাজিশিয়ান ম্যাজিক দেখাচ্ছে। বিস্ময়কর কোন ম্যাজিকও না। বেদেরা যেমন ফালতু ধরনের ম্যাজিক দেখায় সেরকম, হাতে একটা বল থাকে, একটা বল থেকে দু’টা হয় তিনটা হয় আবার সব বল শূন্যে মিলিয়ে যায়। এই লোকের ম্যাজিকও সেরকমই। শুধু তার হাতে বল নেই। আছে পুতুল। ছোট ছোট পুতুল। পুতুলগুলি দেখতে খুব সুন্দর। একেবারে ঝক ঝক করছে। একটা পুতুল থেকে দুটা হচ্ছে, তিনটা হচ্ছে আবার একটা হয়ে যাচ্ছে। এই হল খেলা। খুবই ফালতু

এতগুলি মানুষ হাড় কাঁপানো শীতে নিঃশ্বাস বন্ধ করে ম্যাজিক দেখছে কেন মবিন উদ্দিন ভেবে পেলেন না। এমন না যে এরা কোনদিন ম্যাজিক দেখেনি। নেত্রকোনা বেশ বড় শহর। নানান ধরনের রং তামাশা এই শহরে দু’দিন পর পর হচ্ছে। এইতো কয়েক দিন আগে মৃত্যু কৃপ বলে একটা ব্যাপার হয়ে গেলো। একটা ছেলে কুয়া কেটে তার ভেতর চোখ বেঁধে মোটর সাইকেল চালিয়েছে। খুবই নাকি ভয়ংকর ব্যাপার। তিনি দেখতে পারেননি। পাঁচ টাকা করে টিকেট করেছিল। অকারণে পাঁচটা টাকা খরচ করতে মায়া লাগলো। পথের উপর ম্যাজিক দেখার একটা সুবিধা হল টিকিট কাটতে হয় না। এই লোকের পুতুলের। খেলা তিনিও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখতে পারেন।

মবিন উদ্দিন ম্যাজিক দেখার জন্যে দাঁড়ালেন। আবার ঠিক যে ম্যাজিক দেখার জন্যে দাঁড়ালেন, তাও না। দ্রুত হেঁটে আসায় বুকে হাঁপ ধরে গিয়েছিল। তিনি দাঁড়ালেন খানিকটা বিশ্রামের জন্যে। লোকটার ম্যাজিক শুরুতে যতটা খারাপ ভেবেছিলেন ততটা খারাপ না। বেদেরা একটা বল দু’টা করার সময় হাতের মুঠি বন্ধু করে। এই লোক তা করছে না। তার খোলা হাতের তালুতে পুতুলটা বসানো। সেখানেই একটা পুতুল দু’টা হচ্ছে, তিনটা হচ্ছে। যা ঘটছে চোখের সামনেই ঘটছে। কী ভাবে ঘটছে কে জানে! তিনি কোথায় যেন পড়েছিলেন, যে ম্যাজিক যত বিস্ময়কর সে ম্যাজিকের ভেতরের কৌশল তত সহজ। এই লোকের পুতুলের ম্যাজিকের কৌশলও হয়ত খুব সহজ। অন্য পুতুল দু’টা নিশ্চয়ই হাতের তালুর পেছনেই লুকানো, দেখা যায় না এমন কোন সুতা দিয়ে বাঁধা। একটা পুতুল চোখের সামনে দু’টা হয়ে যাচ্ছে, তিনটা হয়ে যাচ্ছে। লোকটা হাতের মুঠি পর্যন্ত বন্ধ করছে না। আশ্চর্য তো! মবিন উদ্দিন। ম্যাজিশিয়ানের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকালেন। হিপনোটিজম! চোখের ধান্ধা?

ম্যাজিশিয়ান রোগা এবং লম্বা। গায়ের রং কালো, বেশ কালো। মাথার চুল নিগ্রোদের চুলের মতো কোঁকড়ানো। সবচে’ আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে পৌষ মাসের এই প্রচণ্ড শীতে লোকটা বলতে গেলে বিনা কাপড়ে দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে গোলাপী রং এর পাতলা একটা সুতির সার্ট। পরনে পায়জামা। খালি পা। এই পোষাকে কার্তিক মাসের শীত মানার কথা না, পৌষ মাসের শীত কি মানবে? বেচারা কষ্ট পাচ্ছে। তিনি নিজে ফুল হাতা সোয়েটারের উপর শাল চাপিয়েও শীত মানাতে পারছেন না। শালের ফাঁক দিয়ে হাওয়া ঢুকে শরীর কাঁপিয়ে দিচ্ছে। দরিদ্র হওয়ার কী কষ্ট। এই প্রচণ্ড শীতে বেচারাকে প্রায় খালি গায়ে ম্যাজিক দেখাতে হচ্ছে। ম্যাজিক শেষ হবার পর সে সবার কাছে হাত পাতবে। ভিক্ষা চাইবে। কষ্ট করে খেলা দেখানোর পরেও তাকে ভিক্ষুকদের মতো নতজানু হয়ে কৃপা প্রার্থণা করতে হবে। মবিন উদ্দিন তার পাঞ্জাবির পকেটে হাত দিলেন। দুটা পাঁচ টাকার নোট খচখচ করে উঠল। না পাঁচ টাকা দেয়া যায় না। এক টাকা দু’টাকা হলে দেয়া যেত। পাঁচ টাকা অনেক টাকা। মবিন উদ্দিনের একটু মন খারাপ হল। বেশির ভাগ লোকই তাঁর মতো আচরণ করবে। খেলা শেষ হবার পর কিছু না দিয়েই চলে যাবে। তার জন্যে লজ্জিতও বোধ করবে না। মানুষের দুঃখ কষ্ট দেখে দেখে সবাই অভ্যস্ত হয়ে গেছে। অনের কষ্টে এখন আর কেউ লজ্জিত বোধ করে না। মবিন উদ্দিন লজ্জা ও অস্বস্তি নিয়ে ম্যাজিশিয়ানের দিকে তাকালেন।

আশ্চর্য! ম্যাজিশিয়ানও তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। স্থির চোখে তাকিয়ে আছে। চোখে পলক পর্যন্ত ফেলছে না। তার চোখ বড়বড়, এবং হাসি হাসি। যেন সে মবিন উদ্দিনকে দেখে খুব মজা পাচ্ছে। মবিন উদ্দিন যে তাকে পাঁচটা টাকা দিতে গিয়েও দিচ্ছেন না তা বুঝে ফেলেছে। মবিন উদ্দিনের একটু অস্বস্তি বোধ হল। একদল লোকের সামনে কেউ যখন ম্যাজিক-ট্যাজিক দেখায় তখন সে বিশেষ কারোর দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে না। সবার দিকেই তাকায় কিংবা কারোর দিকেই তাকায় না। যখন বিশেষ কারো দিকে তাকায় তখন ধরেই নিতে হয় ম্যাজিশিয়ানের কোন বদ মতলব আছে। এমন কোন ম্যাজিক তাকে নিয়ে যে করবে সে অপমানের চুড়ান্ত হবে। অন্যরা সেই অপমান দেখে খুব মজা পাবে। এই বিষয়ে তার তিক্ত অভিজ্ঞতা আছে। বছর দশেক আগে কী একটা কাজে গৌরীপুর গিয়েছিলেন। দিনে দিনে কাজ শেষ করে রাতের ট্রেনে নেত্রকোনা ফেরার জন্যে স্টেশনে এসে বসে আছেন। রাত বারোটায় ট্রেন, বাজছে মাত্র নটা। সময় আর কাটতেই চাচ্ছে না। সময় কাটানোর জন্যে তিনি গৌরীপুর জংশনের এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত হাঁটাহাটি করছেন। হঠাৎ দেখলেন এক জায়গায় ম্যাজিক দেখানো হচ্ছে। চেংড়া মতো এক ম্যাজিশিয়ান তাসের খেলা, পিংপং বলের খেলা দেখাচ্ছে। খুব হাততালি পড়ছে। তিনিও কৌতূহলী হয়ে দাঁড়ালেন। সেই দাঁড়ানোই কাল হল। চেংড়া ম্যাজেশিয়ান তাঁর দিকে তাকিয়ে মধুর গলায় বলল, ভাইজান একটু সামনে বাড়েন। তিনি এগুলেন। ম্যাজিশিয়ান তার হাত ধরে বলল, ভাইজানের নাম কি?

তিনি তখন অস্পষ্ট ভাবে বুঝতে পারলেন, তাকে নিয়ে রসিকতা শুরু হয়ে গেছে। তার বিব্রত ভঙ্গি দেখে দর্শক হাসতে শুরু করেছে। কোন বুদ্ধিমান ম্যাজিশিয়ানই দর্শকদের হাসানোর এই সুযোগ নষ্ট করবে না। চেংড়া ম্যাজিশিয়ানও করল না। মধুর গলায় বলল, বলেন ভাইজান বলেন। নাম বলেন। বুলন্দ আওয়াজে বলেন।

তিনি নাম বললেন। ততক্ষণে তার কপাল ঘামতে শুরু করেছে। পা কাঁপছে। একী বিপদে পড়া গেল!

আচ্ছা ভাইজান সত্যি কইরা বলেন দেহি আপনি মানুষ না মুরগী?

এই অপমানকর, হাস্যকর প্রশ্নের তিনি কী জবাব দেবেন? ভয় এবং আতংকে তার বুকে ব্যথা শুরু হয়ে গেল। ম্যাজিশিয়ান ফিস ফিস করে বলল, মুরগী হইলে কোঁকর কোঁ কইরা একটা ডাক দেন। দেন ডাক দেন।

কোঁকর কোঁ করে ডাক দেবার বদলে তিনি কপালের ঘাম মুছলেন। ম্যাজিশিয়ান তার হাত ধরল, কানের কাছে মুখ নিয়ে গানের মতো করে বলল,

মুরগী বলে কোঁকর কোঁ
মোরগ বলে কী গো? তোমার হইছে কী?

দর্শক হেসে প্রায় গড়াগড়ি খেতে লাগলো। তিনি মনে মনে বললেন, আল্লাহ তুমি আমাকে একী অপমানের মধ্যে ফেললে?

অপমানের তখন মাত্র শুরু। এরপর যা আরম্ভ হল তা ভাবলে তিনি এখনো শিউরে ওঠেন। চেংড়া ম্যাজিশিয়ান তাঁর পাঞ্জাবির পেছনে হাত দিয়ে একটা ডিম বের করে নিয়ে এল। তারপর ডিম আনতেই শুরু করল। একসময় গম্ভীর গলায় বলল, ভাইজান দেহি বিলাতী মুরগী। ডিম পাড়তেই আছে পাড়তেই আছে।

পুতুল হাতে এই যাদুকর চেংড়া ম্যাজিশিয়ানের মতো না। সে তাঁর দিকে এখনও তাকিয়ে আছে। সেই তাকানোয় মমতা আছে। তার চোখের দৃষ্টিই বলে দিচ্ছে–সে কাউকে অপমান করবে না। কয়েকটা পুতুল নিয়ে মজার কিছু খেলা দেখাবে। সম্ভবত টাকা পয়সাও চাইবে না। কেউ দিলে দেবে, না দিলে না।

ম্যাজেশিয়ানদের নিয়মই হচ্ছে বকবক করা। অকারণে কথা বলে লোকজনদের বিভ্রান্ত করা। এই লোক তাও করছে না। মবিন উদ্দিন অনেকক্ষণ হল দাঁড়িয়ে আছেন এখন পর্যন্ত তিনি ম্যাজিশিয়ানের কোন কথা শোনেননি। এই যাদুকরের গলার স্বর নিশ্চয়ই গৌরীপুরের চেংড়া ম্যাজিশিয়ানের মতো কর্কশ না। তার গলার স্বর শুনতে পারলে ভাল লাগতো। যাদু দেখানো শেষ হলে সে এক সময় কথা বলবে। ততক্ষণ অপেক্ষা করা যাবে না। এম্নিতেই দেরি হয়ে গেছে। আরে আরে একী! পুতুলগুলি দেখি বেলী ফুল হয়ে গেছে। ম্যাজিশিয়ানের হাত ভরতি বেলী ফুল। আর কী গন্ধ ফুলের। তিনি এতদূর থেকেও গন্ধ পেলেন।

মবিন উদ্দিন বড় রাস্তার দিকে রওনা হলেন। তাঁর মন একটু খুঁত খুঁত করতে লাগলো, যাদুকরকে পাঁচটা টাকা দিয়ে এলেও পারতেন। এই প্রচণ্ড শীতে বেচারা শুধু পাতলা একটা সার্ট গায়ে দিয়েছিল। আহারে।

একটা বিস্ময়কর ব্যাপার মবিন উদ্দিন লক্ষ্য করলেন না। তার গন্ধ সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। তিনি ন্যাপথলিনের কড়া গন্ধ পাচ্ছেন না। তাকে নর্দমা টপকে যেতে হল। যেখানে একটা কুকুর মরে গলে পড়ে আছে। তার পচা শরীর থেকে বিকট গন্ধ আসছে। তিনি সেই বিকট গন্ধও পেলেন না। তার নাকে বেলী ফুলের মিষ্টি সৌরভ লেগে রইল।

.

বিয়ের আলাপ শেষ হল রাত এগারোটায়। মবিন উদ্দিনের বিরক্তির সীমা রইল না। একই কথা ছ’বার সাত বার করে বলা হচ্ছে। সামান্য একটা তারিখ ঠিক করা নিয়ে এত কথা বলারই বা কী আছে?

বিয়ের তারিখ ঠিক হল মাঘ মাসের ১ তারিখ, শুক্রবার। জুমার নামাজের পর এজিন কাবিন হবে। চল্লিশ হাজার টাকা কাবিন, অর্ধেক জেওরপাতিতে উসুল। ছেলেকে দিতে হবে একটা মোটর সাইকেল আর কিছু না। মোটর সাইকেলের তার নাকি খুব শখ। মোটর সাইকেলের বাইরে যদি মেয়ের বাবা-মা শখ করে কিছু দিতে চায় দিবে। তবে পাত্র পক্ষের কোন দাবী নাই।

আলোচনার শেষে খাওয়া দাওয়া। কোরমা, পোলাও, ঝাল গোসত, ফিরনি। প্রচুর আয়োজন। রাহেলার রান্না ভাল। মবিন উদ্দিন আরাম করে খেলেন। ঘরে ফেরার জন্যে যখন উঠলেন তখন রাত বাজে বারোটা।

রাহেলা বলল, ভাইজান রাতটা থেকে যান। শীতের মধ্যে কোথায় যাবেন?

মবিন সাহেব থেকে যেতে পারতেন। বাসায় বলেও এসেছেন বেশি দেরী হলে থেকে যাবেন। থেকে গেলে তাকে নিয়ে বাসায় কেউ দুঃশ্চিন্তা করবে না। কিন্তু থাকতে ইচ্ছা করছে না। কেন জানি অস্থির লাগছে।

এত রাতে রেল স্টেশন ছাড়া কোথাও রিকশা পাওয়া যাবে না। মবিন উদ্দিন রেল স্টেশনের দিকে রওনা হলেন।

বাইরে কনকনে হাওয়া বইছে। মবিন উদ্দিনের মনে হল গত কুড়ি বছরে না, চল্লিশ বছরেও নেত্রকোনায় এত শীত পড়েনি। রাহেলার বাড়িতে রাতটা থেকে গেলেই হত। এত রাতে বের হওয়া বোকামী হয়েছে। এই বয়সে বুকে ঠাণ্ডা বসে গেলে সমস্যা হবে।

মবিন উদ্দিন কোন রিকশা পেলেন না। একজন বুড়ো রিকশাওয়ালা পাওয়া গেলো সে এত দূরের পথে যাবে না। তিনি যখন মনে মনে ঠিক করে ফেলেছেন রাতটা রাহেলার বাসাতেই কাটাবেন তখনই কালো যাদুকরকে দেখলেন। টিকিট ঘরের সিড়িতে বসে আছে। হাসি মুখে তাকিয়ে আছে তার দিকেই। তাকে ঠিক আগের মতো লাগছে না। একটু যেন অন্য রকম লাগছে। আগে গায়ে গোলাপী রঙের সার্ট ছিল। এখন সার্টের রঙ মনে হল নীল। মাথার চুল ছিল কোঁকড়ানো। এখন সেরকম মনে হচ্ছে না। বয়সও অনেক কম মনে হচ্ছে। ব্যাপারটা কী? মবিন উদ্দিন কালো যাদুকরের দিকে এগিয়ে গেলেন। ইতস্ততঃ করে বললেন, দরজি পট্টিতে তুমি কি ম্যাজিক দেখাচ্ছিলে?

সে হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে হাসল।

তোমার নাম কি?

সে আবারো হাসল।

আচ্ছা ছেলেটাকে সঙ্গে করে বাসায় নিয়ে গেলে কেমন হয়? বাসায় নিয়ে চারটা গরম ভাত খাইয়ে দেয়া। তাকে বললে সে কি যাবে? মনে হচ্ছে যাবে। মবিন উদ্দিন ইতস্তত করতে লাগলেন।

অচেনা একজন মানুষকে দুপুর রাতে হুট করে বাড়িতে নিয়ে আসা যায় না। তাছাড়া পথে ঘাটে যারা ম্যাজিক দেখায় তারা খুব সুবিধার মানুষ হয় না। ধান্ধাবাজ মানুষই ম্যাজিশিয়ান হয়। এরা দিনে ম্যাজিক দেখায় রাতে চুরি চামারি করে। ছেলেটাকে অবশ্যি ধান্ধাবাজ মনে হচ্ছে না। ধান্ধাবাজ মানুষ কথা বেশি বলে। প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে হড়হড় করে কথা বলে। এই ছেলে কথা বলছেই না। বোবা-কালা নাতো? নিশ্চিত হবার জন্যে মবিন উদ্দিন আবারো জিজ্ঞেস করলেন, তোমার নাম কী?

সে জবাব দিল না। মাথা নিচু করে হাসল। মবিন উদ্দিন বললেন, কথা বলতে পার না?

পারি।

পার তাহলে কথা বলছ না কেন?

সে আবারো হাসল। ছেলেটার হাসি সুন্দর। ধান্ধাবাজ মানুষ সুন্দর করে হাসতে পারে না তাদের হাসির মধ্যেও একটা কিন্তু থাকে। আচ্ছা ছেলেটাকে বইয়ের দোকানে একটা চাকরি দিয়ে দিলে কেমন হয়? সেলসম্যান। পেটে ভাতে থাকবে। মাঝে মধ্যে কিছু হাত খরচ। না বইয়ের দোকানের চাকরি দেয়া যাবে না। বইয়ের দোকানে চাকরি করতে হলে পড়াশোনা জানতে হয়। পথে ঘাটে যারা ম্যাজিক দেখায় তারা পড়াশোনা জানে না। তারা ক অক্ষর শুকর মাংস টাইপ হয়।

তুমি কি লেখা পড়া কিছু জান? বই পড়তে পার?

ছেলেটা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। মর্কিন উদ্দিনের মনটা ভাল হয়ে গেল। তিনি হাসি মুখে বললেন, তোমার ম্যাজিক দেখে সন্তুষ্ট হয়েছি। ভাল ম্যাজিক। যাই হোক তুমি কী খাওয়া দাওয়া কিছু করেছ?

ছেলেটা না সূচক মাথা নাড়ল। মবিন উদ্দিনের মনে হল প্রশ্নটা করা উচিত হয়নি। একটা মানুষ এত রাত পর্যন্ত না খেয়ে বসে আছি এটা জানার পর তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়া যায় না। সারা পৃথিবীতে বহু লোক রাতে না খেয়ে ঘুমুতে যায়। তাতে আমাদের খারাপ লাগে না কারণ আমরা কাউকে জিজ্ঞেস করি না সে খেয়েছে কি না।

তোমার শীত লাগছে না?

সে না সূচক মাথা নাড়ল। এই প্রচণ্ড শীতে হাফসার্ট গায়ে দিয়ে সে বসে আছে আর বলছে, শীত লাগছে না। এটা একটা কথা হল। শীত অবশ্যই লাগছে। স্বীকার করছে না। গায়ের শালটা কি তাকে দিয়ে দেবেন? এটা কি ঠিক হবে? না ঠিক হবে না। সুরমা জানতে পারলে হৈ চৈ করে বাড়ি মাথায় তুলবে। বরং তাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া যায়। বাড়িতে নিয়ে পুরানো চাদর টাদর কিছু দিয়ে দিলেই হবে। চারটা ভাত খাইয়ে, একটা চাদর দিয়ে বিদায়। সেলসম্যানের চাকরি দিয়ে বাড়িতে রেখে দেয়া ঠিক হবে না। এমনিতেই সংসার চলে না। আরেকটা বাড়তি মুখ।

মবিন উদ্দিন গলা খাকাড়ি দিয়ে বললেন, তুমি চল আমার সঙ্গে।

ছেলেটা উঠে দাঁড়াল। দেরি করল না। যেন সে তার সঙ্গে যাবার জন্যে তৈরী হয়েই বসে ছিল।

তোমার নাম কী তাতো এখনো জানা হল না।

কি বললে নাম?

ও আচ্ছা আচ্ছা।

মবিন উদ্দিন বেশ অস্বস্তি বোধ করছেন। টুনু তার বড়ছেলের নাম, পাঁচ বছর আগে মারা গেছে। পাঁচ বছর দীর্ঘ সময়–প্রায় অর্ধযুগ, তবু মনে হয় এইতো সেদিন। সবকিছু ছবির মতো ভাসে।

টুনু নেত্রকোনা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটে পড়তো। হঠাৎ খবর এল তার প্রচণ্ড পেটে ব্যথা। কলেজ থেকে তাকে সরকারী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তখন সন্ধ্যা। তার নিজের শরীর ভাল লাগছে না বলে আগে ভাগে দোকান বন্ধ করে ঘরে ফেরার কথা ভাবছেন। তখনি খবরটা এল। তিনি হাসপাতালে ছুটে গেলেন। ছেলের সঙ্গে দেখা হল না। তাকে বলা হল কিছুক্ষণ আগে এপেনডিক্স অপারেশন হয়েছে। সে আছে পোস্ট অপারেটিভ রুমে। জ্ঞান ফেরেনি, কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরবে। পোস্ট অপারেটিভ রুমে কারোর প্রবেশ নিষেধ। তিনি হাসপাতালের বারান্দায় হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। একজন ডাক্তার এসে সান্ত্বনা দিলেন—আপনি এত নার্ভাস হয়ে গেছেন কেন। এপেনডিক্স অপারেশন কোন ব্যাপারই না। ফোড়া কাটার মতো। পার্থক্য একটাই– এই ক্ষেত্রে ফোঁড়াটা শরীরের ভেতরে। যান এক কাপ চা খেয়ে এসে খোঁজ নিন। ততক্ষণে ছেলের জ্ঞান ফিরে আসবে। তার সঙ্গে কথা বলতে পারবেন। তিনি চা খেতে গেলেন। ফিরে এসে শুনলেন ছেলে মারা গেছে। মৃত্যুর আগে তার জ্ঞান ফিরে এসেছিল।

সে ফিস ফিস করে বলেছিল, বাবা আসেনি? বাবা?

চা খেতে না গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলে ছেলের সঙ্গে তার দেখা হতো। সামান্য এক কাপ চায়ের জন্যে ছেলের সঙ্গে তার শেষ দেখা হল না।

এরপর থেকে তিনি চা খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। আজ প্রায় ছয় বছর হল তিনি চা খান না।

যাদুকরের নামও টুনু। এটা কি বিস্মিত হবার মতো কোন ঘটনা?

বিস্মিত হবার মতো কোন ঘটনা না। টুনু খুব কমন নাম অনেকেরই থাকে। টুনটুনি থেকে টুনু। এই যাদুকরের বাবা-মা ছেলের নাম টুনু রেখেছেন। তাহলে তিনি এত অস্বস্তি বোধ করছেন কেন? সমস্যাটা কী?

মবিন উদ্দিন রিকশায় উঠে সমস্যা ধরতে পারলেন। তিনি বুকের ভেতর এক ধরনের কাঁপন অনুভব করলেন। যাদুকরের সঙ্গে কোথায় যেন টুনুর একটা মিল আছে। মিলটা কোথায়? টুনুর গায়ের রং ছিল ধবধবে শাদা। রূপকথার বই-এ দুধে আলতা রং বলে একটা কথা পাওয়া যায় অবিকল সেই ব্যাপার। নজর লাগবে বলে তার মা অনেক বয়স পর্যন্তু তার কপালে এত বড় একটা কাজলের টিপ দিয়ে রাখতো। যাদুকরের গায়ের রং কুচকুচে কালো। টুনু সারাক্ষণ বকবক করতো তার কথার যন্ত্রণায় তিনি নিজে কতবার বলেছেন— একজন জুতা সেলাই ওয়ালা ডেকে টুনুর মুখটা সেলাই করে দেয়া দরকার। আর এদিকে যাদুকর ছেলেটা কথাই বলে না। যে কোন প্রশ্ন দু’তিন বার করে করতে হয়। চেহারায় কি কোন মিল আছে? না চেহারাতেও মিল নেই। টুনুর মুখ ছিল লম্বাটে। এই ছেলেটির মুখ গোলাকার। টুনুর চুল ছিল কোঁকড়ানো। এর চুল কোকড়ানো না। তাহলে ছেলের সঙ্গে মিলের ব্যাপারটা মাথায় আসছে কেন? কেন মনে হচ্ছে এই ছেলের সঙ্গে টুনুর মিল আছে? মবিন উদ্দিন বাধার মধ্যে পড়ে গেলেন।

তোমার দেশ কোথায়?

সে হাসল। প্রশ্নের জবাব দিতে ইচ্ছা না হলে মানুষ যে ভঙ্গিতে হাসে সেই রকম হাসি।

তোমার দেশ কোথায় বলতে চাচ্ছ না?

সে না সূচক মাথা নাড়ল।

বলতে কী তোমার কোন অসুবিধা আছে? অসুবিধা থাকলে বলার দরকার নেই।

মবিন উদ্দিন চিন্তিত মুখে সিগারেট ধরালেন। নতুন এক দুঃশ্চিন্তায় তিনি এখন আক্রান্ত হয়েছেন। অচেনা অজানা একটা ছেলেকে দুপুর রাতে বাসায় নিয়ে তুলছেন। সুরমা ব্যাপারটা কীভাবে নেবে কে জানে। খুব ভাল ভাবে নেবার কথা না। সুরমা অল্পতেই রেগে যায়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের স্নেহ মমতা কমতে থাকে, রাগ বাড়তে থাকে। সুরমার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। তবে অন্যের তুলনায় বেশি ঘটেছে।

ফাঁকা রাস্তায় রিকশা খুব দ্রুত চলছে। বাতাসের কারণে শীতটা দশগুণ বেড়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে। ঠাণ্ডা বাতাস নাক মুখ আর কানের ফুটো দিয়ে ভেতরে টুকে যাচ্ছে। তিনি থরথর করে কাঁপছেন, অথচ ছেলেটা চুপচাপই বসে আছে। গায়ের গরম শালের একটা অংশ কী ছেলেটাকে দিয়ে দেবেন? মন ঠিক করতে করতে রিকশা বাসার সামনে এসে থামল।

ছেলেটাকে নিয়ে সরাসরি বাসায় ঢোকার সাহস তাঁর হল না। সুরমা কী জাতীয় হৈ চৈ শুরু করবে কে জানে। রেগে গেলে তার কথাবার্তারও কিছু ঠিক থাকে না।

ছেলেটাকে তিনি রাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখলেন। শুকনো গলায় বললেন, একটু দাঁড়াও আমি ডেকে নিয়ে যাব। তিনি ভয়ে ভয়ে দরজার কড়া নাড়লেন, দ্রুত ভাবতে চেষ্টা করলেন, সুরমাকে ব্যাপারটা কীভাবে বলবেন। আসলে বড় ভুল হয়ে গেছে রিকশাতেই ভেবে টেবে ঠিক করে রাখা দরকার ছিল। রিকশায় সারাক্ষণ তিনি তাঁর ছেলের কথা ভেবেছেন।

তৃতীয়বার কড়া নাড়তেই তাঁর মেয়ে সুপ্তি দরজা খুলে দিল। সুপ্তির দিকে তাকিয়ে মবিন উদ্দিনের মন খারাপ হয়ে গেল।

আহারে কী সুন্দর তার এই মেয়েটা। শুধু তাকিয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর চোখ আল্লাহ্ তার এই মেয়েকে দিয়েছেন। কী ঘন কালো চোখ। দীর্ঘ পল্লব। অথচ সুপ্তির এই চোখ কোনো কাজে আসে না। সুপ্তি চোখে দেখে না।

মবিন উদ্দিন বললেন জেগে আছিস নাকি মা?

সুপ্তি বললো, না ঘুমোচ্ছি। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দরজা খুললাম।

সুপ্তির বয়স বারো। সে চাদরে শরীর ঢেকে মাথাটা এমন ভাবে বের করেছে যে তাকে অনেক বড় বড় লাগছে। মবিন উদ্দিন ভেবে পেলেন না, মেয়েটা এত রাত পর্যন্ত জেগে আছে কেন, অবশ্যি জেগে থাকায় ভালই হয়েছে শুরুতেই তাকে স্ত্রীর মুখোমুখি হতে হয়নি। নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পাওয়া গেছে। তাছাড়া সুপ্তি তার বাবাকে অনেকবার মার ব্লগ থেকে উদ্ধার করেছে। হয়তো এবারো করবে। মবিন উদ্দিন নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, মা জেগে আছে?

হুঁ। এত রাত হয়েছে আমরা ভেবেছিলাম তুমি আসবে না।

তুই এত রাত পর্যন্ত জেগে আছিস কেন?

সুপ্তি জবাব দেবার আগেই সুরমা চলে এলেন, কঠিন গলায় বললেন, রাত দুপুরে আসার দরকার ছিল কী? থেকে গেলেই পারতে। খেয়ে এসেছ তো?

হুঁ।

দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছ কেন? এটা আবার কী রকম ঢং, ভেতরে আস।

মবিন উদ্দিন ইতস্তত করে বললেন, আমার সঙ্গে একটা ছেলে আছে। ও চারটা ভাত খাবে।

সুরমা গলার স্বর তীক্ষ্ণ করে বললেন, তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। ছেলে আছে মানে কী? তুমি ছেলে পেয়েছ কোথায়?

রাস্তায় ম্যাজিক দেখাচ্ছিল। সারাদিন কিছু খায়নি। ভাবলাম চারটা ভাত খাইয়ে দেই।

ম্যাজিক ফ্যাজিক দেখানো লোকজন তুমি রাত একটার সময় বাসায় নিয়ে আসছ এর মানে কী? হঠাৎ এত দরদ উথলে উঠল কেন?

একটা ছেলে না খেয়ে আছে।

কত জনেইতো না খেয়ে আছে। তাদের কোলে করে বাসায় নিয়ে আসতে হবে?

মবিন উদ্দিন অসহায় দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকালেন। সুপ্তি বাবার সাহায্যে এগিয়ে এল। সে মার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, বাবার ভাততো বাড়াই আছে দিয়ে দাও খেয়ে চলে যাক। আচ্ছা থাক তোমাকে দিতে হবে আমি এনে দিচ্ছি। আমার কোনো অসুবিধা হবে না আমি পারবো। মা তুমি গিয়ে শুয়ে পড়।

সুরমা মুখ গম্ভীর করে চলে গেলেন। সুপ্তি বলল, তোমার মজিশিয়ান কোথায় বাবা?

রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।

রাস্তায় দাঁড়িয়েছেন আছে কেন?

তোর মা’র ভয়ে আমিই দাঁড় করিয়ে রেখেছি। তোর মা হ্যাঁ বললে বাসায় নিয়ে আসব। এই ছিল পরিকল্পনা।

ডেকে নিয়ে এসো।

মুবিন উদ্দিন টুনুকে ডাকতে গেলেন। দরজা ধরে সুপ্তি দাঁড়িয়ে আছে। তার বাবা রাত একটার সময় ম্যাজিশিয়ান ধরে নিয়ে এসেছেন এই ব্যাপারটা তার কাছে খুব অদ্ভুত লাগছে। খাওয়ার পর ম্যাজিশিয়ান ভদ্রলোক কী দু’একটা ম্যাজিক দেখাবেন? দেখাবেন হয়ত। গায়কদের গান গাইতে বললে তারা নানান অজুহাত তোলে, গলা ঠিক নেই ঠাণ্ডা লেগে গলা বসে গেছে, মুড নেই। ম্যাজিশিয়ানদের ম্যাজিক দেখাতে বললে তারা সঙ্গে সঙ্গে দেখায়। না বললেও দেখায়। ইনিও নিশ্চয়ই দেখাবেন, দেখালেও সে দেখতে পাবে না। তাতে অসুবিধা নেই। কী ম্যাজিক হচ্ছে তা বলে দিলেই সে কল্পনা করতে পারবে। সুপ্তির ধারণা তার কল্পনার ম্যাজিক—আসল ম্যাজিকের চেয়ে ভালো।

ছেলেটি খেতে বসেছে। বসার ঘরের টেবিলে তাকে খেতে দেয়া হয়েছে। ভাত তরকারী সবই ঠাণ্ডা। রাস্তার একটা ফালতু মানুষ খাবে তার জন্যে ভাত তরকারী গরম করার প্রশ্ন ওঠে না। ছেলেটা ঠাণ্ডা খাবারই খাচ্ছে। বেশ আরাম করে খাচ্ছে। তার খাওয়া দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে খুব ক্ষুধার্ত। প্লেট থেকে একবার মুখ তুলে সুপ্তিকে দেখলো তার চোখে সামান্য হলেও বিস্ময় ঝিলিক দিল। মবিন উদ্দিন বলেন, এ হল সুপ্তি আমার মেয়ে। আমার একটাই মেয়ে। আর সুপ্তি এই ম্যাজিশিয়ানের নাম—টুনু।

ম্যাজিশিয়ায় বললো, তুমি ভাল আছ? বলেই উত্তরের অপেক্ষা না করে খেতে শুরু করলো।

সুপ্তির সারা শরীর কেঁপে উঠল। এই ম্যাজিশিয়ানের গলার স্বর অবিকল তার ভাইয়ার মত। মনে হচ্ছে অনেকদিন পর টুনু ভাইয়া ফিরে এসেছে। তাকে জিজ্ঞেস করছে—তুমি ভাল আছ?

মবিন উদ্দিন ম্যাজিশিয়ানের সামনের একটা চেয়ারে বসে আছেন। তিনি সিগারেট ধরিয়েছেন। তাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। কারণ ছেলেটিকে এখন আর কালো লাগছে না। মনে হচ্ছে তার গায়ের রং ফর্সা। শুধু ফর্সাই না বেশ ফর্সা। তিনি কী এতক্ষণ ভুল দেখেছিলেন? ম্যাজিশিয়ান ছেলে কোন রকম ম্যাজিক ট্যাজিক করছে না তো? ম্যাজিশিয়ানরা অনেক সময় চোখে ধান্ধা লাগিয়ে ফেলে সে রকম কিছু।

বাড়ির ভেতর থেকে সুরমা বিরক্ত গলায় ডাকলেন, সুপ্তি। এই সুপ্তি।

সুপ্তির ভেতরে যেতে ইচ্ছা করছে না। সে অপেক্ষা করছে ম্যাজিশিয়ান যদি আর কোন কথা বলে। কতো কথাইতো বলার আছে “রান্না ভালো হয়েছে। কিংবা আজ খুব শীত পড়েছে।” অথচ সে আর কিছুই বলছে না। নিঃশব্দে খেয়ে যাচ্ছে। সুরমা আবারো ডাকলেন এই সুপ্তি! ডাকছি কানে যাচ্ছে না? সে নিতান্ত অনিচ্ছায় ভেতরে গেল। সুরমা বললেন, তুই ওখানে বসে আছিস কেন?

সুপ্তি ফিস ফিস করে বলল, ম্যাজিশিয়ানের কথা শুনছি মা।

কথা শোনার কী আছে?

সুপ্তি বলল, মা তুমি ওনার গলার স্বরটা একটু শুনে যাও। তুমি খুব চমকে যাবে। তোমার বুকে একটা ধাক্কার মতো লাগবে।

আজগুবি কথা বলিস কেন? রাস্তার একটা ফালতু লোকের গলার স্বর শোনার কী আছে?

শোনার একটা জিনিস আছে মা। না শুনলে বুঝবে না। জানালার পাশে এসে একটু দাঁড়াও।

সুরমা জানালার পাশে এসে দাঁড়ালেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ছেলেটি মুখ তুলে তাকাল। সুরমার হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল——টুনু বসে আছে। অবিকল টুনু। এতে কোন রকম সন্দেহ নেই। সুরমার মাথা ঘুরে পড়ে যাবার মতো হল। তিনি ক্ষীণ গলায় বললেন, তোর বাবাকে জিজ্ঞেস করতো এই ছেলের নাম কী?

সুপ্তি ফিসফিস করে বলল, মা উনার নাম টুনু। বাবা তাই বলল।  সুরমা তাকিয়ে আছেন। তিনি তার চোখের দৃষ্টি ফেরাতে পারলেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *