পেন্সিলে আঁকা পরী
মোবারক সাহেবের গলার স্বর ভারি ও খসখসে।
কোমল করে কিছু বলতে গেলে স্বর আরো ভারি হয়ে যায়। তবু তিনি চেষ্টা করলেন কোমল করে কিছু বলতে। মেয়েটার সঙ্গে শুরুতে একটু ভাব করে নেয়া দরকার। অল্প বয়সী মেয়ে–গলা শুনেই যেন ঘাবড়ে না যায়। কী বলা যায়? নাম জিজ্ঞেস করা যেতে পারে। যে-কোনো কথোপকথন নাম জানার মাধ্যমে শুরু হতে পারে।
রাত এগারটা। মেয়েটি এবং তিনি বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে আছেন। অথচ তিনি তার নাম জানেন না। বেশ মজার ব্যাপার। মেয়েটিও নিশ্চয়ই তার নাম জানে না। নাকি জানে? এ জাতীয় মেয়েরা তলে তলে খুব চালাক চতুর হয়। নামধাম সব জেনে নিয়েছে হয়তো।
মোবারক সাহেব হাসির মতো ভঙ্গি করে বললেন, তোমার নাম কী?
মেয়েটি রিনারিনে গলায় বলল, টেপী।
কী নাম বললে?
টেপী। ট-একারে টে, প ঈ-কারে পী–টেপী।
মোবারক সাহেব গভীর গলায় বললেন, ফাজলামি করছি নাকি?
ফাজলামি করব কেন? নাম জিজ্ঞেস করেছেন, নাম বললাম।
মেয়েটা হাসছে। ঝনঝনি শব্দে হাসছে। মোবারক সাহেব উঁচু গলায় বললেন, সত্যি তোমার নাম টেপী?
হুঁ। আমার বড় বোনের নাম হ্যাঁপী। তার সঙ্গে মিলিয়ে আমার নাম টেপী।
আবারো খিলখিল হাসি। মেয়েটার গলার ভেতর কি একগাদা কৃস্টালের টুকরা রেখে দেয়া? হাসলেই ঝন ঝন শব্দ। নাকি এই বয়সের মেয়েরা এ রকম করেই হাসে!
মোবারক সাহেবের ধারণা হলো, মেয়েটা তাঁর সঙ্গে ফাজলামি করছে। পুচকা একটা মেয়ে ফাজলামি করছে, ভাবাই যায় না। মেয়েটার বয়স কত? কুড়ি-একুশ, নাকি তারচেয়ে কম?
মেয়েটি ফাজলামি করছে কিনা নিশ্চিত হওয়া দরকার। কীভাবে নিশ্চিত হবেন। মোবারক সাহেব বুঝতে পারছেন না। হ্যাঁপীর সঙ্গে মিলিয়ে টেপী নাম কেউ রাখলে রাখতেও পারে। লো-ক্লাস ফ্যামিলিতে নাম নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। প্রথম বাচ্চাটার নাম ঠিকঠাক মতো রাখে; তারপর উৎসাহ হারিয়ে ফেলে।
তোমরা কি দুই বোন?
না, তিন বোন।
তৃতীয় বােনের নাম কী?
পেপী।
মোবারক সাহেব থমথমে গলায় বললেন, তৃতীয় বােনের নাম পেপী?
জ্বি। বোনদের নাম মিলিয়ে রাখতে হয়। নাম মিলিয়ে না রাখলে বেহেশতে বোনে বোনে দেখা হয় না।
তুমি পড়াশুনো কতদূর করেছ?
ক্লাস ফাইভ।
কথাবার্তা শুনে তো মনে হয় ক্লাস ফাইভের চেয়ে বেশি পড়েছ এবং আমার ধারণা তুমি আমার সঙ্গে রসিকতা করার চেষ্টা করছ।
আপনি মুরব্বি মানুষ। আপনার সঙ্গে রসিকতা করব কেন?
তিনি বাতি জ্বালালেন।
বাতি জ্বলামাত্র মেয়েটি চেঁচিয়ে উঠল, বাতি নেভান, বাতি নেভান। গায়ে কাপড় নাই। তিনি বাতি নিভিয়ে দিলেন। টেপী সঙ্গে সঙ্গে বলল, এখন জ্বলেন। কাপড় পরেছি।
তিনি বাতি জ্বালালেন না। হাত বাড়িয়ে টেবিল ল্যাম্পের কাছে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে সিগারেট নিলেন। লাইটার দিয়ে সিগারেট ধরালেন। লাইটারের আলোয় মেয়েটিকে দেখার ইচ্ছা করছিল, সেই ইচ্ছা দমন করলেন। তিনি সূক্ষ্ম এক ধরনের অস্বস্তি বোধ করছেন। মেয়েটির কোনো একটা ব্যাপার তার পছন্দ হচ্ছে না। সেটা যে কী তাও বুঝতে পারছেন না। মেয়েটির চুল থেকে কোনো রিপালসিভ গন্ধ কি আসছে? কিং শাড়ি থেকে ন্যাপথলিনের ঘাণ? এইসব মেয়েরা তাদের ভালো শাড়িগুলোর ভাঁজে ভাঁজে ন্যাপথলিন দিয়ে রাখে। যেন পোকায় কেটে শাড়ি নষ্ট না করে।
সিগারেট টেনে তিনি আরাম পাচ্ছেন না। তামাকের গন্ধটা অনেক কড়া লাগছে। বমি বমি লাগছে। সিগারেট ফেলে দিতে হবে। টেবিল ল্যাম্পের কাছে অ্যাশট্রে থাকে, আজ নেই। হাউসকিপিং ঠিকমতো হচ্ছে না। তিনি খাট থেকে নামলেন। টেপী সঙ্গে সঙ্গে বলল, কোথায় যান?
তিনি জবাব দিলেন না। অন্ধকারেই বাথরুমে ঢুকলেন। বাথরুমের বাতি জ্বালালেন। আয়নায় নিজেকে দেখলেন। যতটা না বয়স তারচেয়েও কি বেশি দেখাচ্ছে? তাঁর বয়স তিপ্লান্ন, আয়নায় একজন বুড়ো মানুষকে দেখা যাচ্ছে। তিনি জ্বলন্ত সিগারেট কমোডে ফেলে দিলেন। ফ্লাশ টানলেন। পানির সঙ্গে সিগারেট চলে গেল না। ভাসতে থাকল। মুখে পানি ছিটিয়ে টাওয়েল হাতে শোবার ঘরে ঢুকলেন। শোবার ঘরের প্রধান সুইচটি টিপে দিলেন। একসঙ্গে তিনটি বাতি জ্বলে ঘরটাকে ঝলমলে করে ফেলল।
মেয়েটি তাকে মিথ্যা বলেছে। সে কাপড় পরে নি। গলা পর্যন্ত চাদর টেনে শুয়ে আছে। কৌতুহলী চোখে তাকে দেখছে। মেয়েটা দেখতে ভালো। বয়সের নিজস্ব সৌন্দর্য ছাড়াও বাড়তি কিছু তার মধ্যে আছে। রং শ্যামলা। রং শ্যামলা বলেই চোখের কাজল এত সুন্দর লাগছে। কাটা কাটা নাক-মুখ। মেয়েটির চুল বেণি করা ছিল, এখন নেই। এক ফাঁকে নিশ্চয়ই খুলেছে। কখন খুলল?
টেপী বলল, আপনার কি শরীর খারাপ করেছে? তিনি জবাব দিলেন না, তবে প্রশ্নটা শোনার পর থেকে তাঁর শরীর একটু খারাপ লগতে লাগল। মাথা ঝিম ধরে আছে। বমি ভাবটা যায় নি। তিনি শোবার ঘরের জানালার দিকে এগুলেন–একটা জানোলা খুলে দিতে হবে। ঘরে বিশুদ্ধ কিছু বাতাস ঢুকুক। এয়ারকুলার চলছে বলে সব ক’টা জানালা বন্ধ। সিগারেটের ধোয়া ঘরে আটকে আছে। সিগারেটের ধোঁয়া যত বাসি হয় তার উৎকট ভাব ততই বাড়ে। জানালার পাশে তাঁর ফ্রিজার। শোবার ঘরে কেউ ফ্রিজার রাখে না। তিনি রেখেছেন। তাঁর খুব ঘনঘন পিপাসা হয়। তখন বরফশীতল পানি খেতে হয়। এই ফ্রিজারটা ভালো, পানি রাখামাত্র ঠাণ্ড হয়। জানালা না খুলে তিনি তাঁর ফ্রিজারের দরজা খুললেন।
এখন তাঁর কোনো পিপাসা হয় নি। তবু ঠিক করলেন আধগ্লাস পানি খাবেন–এতে যদি অস্বস্তি ভাবটা কাটে। তিনি পানির বোতল বের করলেন। ফ্রিজারের উপর দু’টা পানির গ্লাস থাকার কথা-তাই আছে। তিনি গ্লাসে মেপে মেপে আধাগ্রাস পানি ঢাললেন। বেশিও না, কমও না।
মেয়েটি বলল, কী খান? মদ?
মোবারক সাহেব সহজ গলায় বললেন, না, পানি খাই।
আমি ভাবছিলাম মদ।
মেয়েটি আবার হাসছে। না, হাসি সুন্দর। ঝনঝনে শব্দটা শুনে ভালো লাগছে।
মোবারক সাহেব কখনো এক চুমুকে পানি খান না। গ্লাসে ছোট ছোট চুমুক দেন। আজ এক চুমুকে গ্লাস শেষ করে বললেন, তোমার নাম হচ্ছে টেপী, তাই তো?
জ্বি।
শোন টেপী, তুমি বাসায় চলে যাও।
টেপী অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। তার ভুরু কুঁচকে গেছে। এতক্ষণ সে শুয়ে ছিল, এখন আধশোয়া হয়ে বসল।
বাসায় চলে যাব?
হ্যাঁ।
আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন?
রাগ করি নি। তুমি কাপড় পর, কাপড় পরে বাসায় চলে যাও।
এত রাতে বাসায় কীভাবে যাব?
ড্রাইভার আছে। ড্রাইভার তোমাকে পৌঁছে দেবে। অসুবিধা হবে না। তুমি থাক কোথায়?
অনেক দূরে থাকি। জয়দেবপুর।
ড্রাইভারকে বললেই হবে।
মোবারক সাহেব লক্ষ করলেন মেয়েটার চোখে-মুখে ভয়ের চিহ্ন। সে চাদরের নিচেই ব্লাউজ পরার চেষ্টা করছে। ফুলতোলা চাদর দাঁত দিয়ে কামড়ে ধরে আছে। মেয়েটাকে ভালোমতো কাপড় পরার সুযোগ দেয়ার জন্যেই তার এ ঘর ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত। তিনি গেলেন না। এদের প্রশ্ৰয় দেয়ার কোনো কারণ নেই। স্ট্রিটগার্লদের স্ট্রিটগার্লের মতোই ‘ট্রিট’ করা উচিত। মেয়েটাকে অবশ্যি স্ট্রিটগার্লের মতো দেখাচ্ছে না। ভদ্র পরিবারের আহ্লাদী মেয়ের মতো লাগছে। কে জানে মেয়েটা হয়তো এই জীবনেই সুখী।
তোমার ঐ জয়দেবপুরের বাসায় কে থাকেন? তোমার বাবা-মা?
মেয়েটি চাদর দাঁত দিয়ে চেপে ধরেই কথা বলছে। কথাগুলো অস্পষ্ট এবং জড়ানো শোনা যাচ্ছে। সে বলল, মা থাকে আর আমার ছোট মামা।
বাবা কি মারা গেছেন?
না, বাবা আমাদের সঙ্গে থাকে না।
বোন দু’জন থাকে? হ্যাঁপী এবং পেপী?
হুঁ।
তোমার ভালো নাম কী?
আমার একটাই নাম। আচ্ছা। আপনি কি আমার উপর রাগ করেছেন?
মোবারক সাহেব জবাব দিতে গিয়েও জবাব দিতে পারলেন না, একটু চমকে উঠলেন। কারণ মেয়েটি চাদর ফেলে দিয়েছে। ব্লাউজ সে ঠিকমতো পরে নি। বোতাম লাগানো হয় নি। ব্লাউজের নিচে কাঁচুলি নেই। গভীর আমন্ত্রণের ছবি। সে বলল, এত রাতে বাসায় গেলে আমার খুব অসুবিধা হবে। আমি বলে এসেছি। সারারাত শুটিং।
মোবারক সাহেবের মনে পড়ল–এই মেয়ে ছবিতে কাজ করে। এক্সট্রা। মূল নায়িকার সঙ্গে নাচে কিংবা গান গায়। নায়িকা যখন পুকুরে নেমে জলকেলি করে তখন সেও সঙ্গে থাকে। নায়িকার ভেজা শরীরের সঙ্গে তার ভেজা শরীরও দেখা যায়। এই মেয়েটির ভেজা শরীর নিশ্চয়ই নায়িকার শরীরের চেয়ে অনেক সুন্দর।
তোমার হাতে এখন যে ছবি তার নাম কী?
প্রেম দেওয়ানা।
ছবিতে তুমি যে চরিত্রটা করছি সেটা কি নায়িকার সখী?
উঁহুঁ—আমি খারাপ লোকদের আস্তানার একজন বাইজী।
গান গাও, না নাচ?
নাচি।
নাচ জান?
না। ড্যান্সমাস্টার আছে, শিখিয়ে দেয়। ঐগুলা নাচ না–হাত-পা নাড়া।
মোবারক সাহেব লক্ষ করলেন মেয়েটার কথা শুনতে তার ভালো লাগছে। দীর্ঘদিন একসঙ্গে এত কথা তিনি কারো সঙ্গে বলেন নি। আজ বলে ফেলেছেন। কথা বলতে ভালো লাগার কারণ কি? মেয়েটির গলার স্বর অস্বাভাবিক সুন্দর এটা একটা কারণ হতে পারে। দ্বিতীয় কারণটা স্থূল। খোলা ব্লাউজে মেয়েটি যে ভঙ্গিতে বসে আছে সে ভঙ্গিটা দেখতে ভালো লাগে। মোবারক সাহেবের মনে হলো পুরুষ প্রলুব্ধ করার এই ভঙ্গিটা মেয়েটি আগেও ব্যবহার করেছে। এটি তার বহু ব্যবহৃত কৌশল।
আপনি কি আমার নাচ দেখবেন?
নাচ।
আপনার ঘরে নাচের বাজনা আছে না? ইংরেজি বাজনা।
তুমি তো নাচ জান না। বাজনা থাকলে কী হবে? তাছাড়া নাচ দেখতে আমার ইচ্ছা! করছে না। তুমি কাপড় পর। কাপড় পরে চলে যাও।
সারারাত শুটিঙের কথা বাসায় বলে এসেছি।
বলবে শুটিং ক্যানসেল হয়ে গেছে। তোমাদের শুটিং ক্যানসেল হয় না?
হয়। আমরা বলি প্যাকআপ।
বাসায় গিয়ে তাই বলবে। বলবে শুটিং প্যাকআপ হয়েছে।
আচ্ছা আমি বলব। এখন আপনি অন্য ঘরে যান। আমি শাড়ি পরব।
অন্য ঘরে যেতে হবে না। আমার সামনেই পায়।
আপনার সামনে আমি পরব। কেন? আপনি কি আমার স্বামী?
মেয়েটি কঠিন গলায় কথাগুলো বললেও তার মুখ হাসি হাসি। মোবারক সাহেব ঘর ছেড়ে গেলেন না। ওয়ারড্রোব খুললেন। হ্যাঁঙারে পাঞ্জাবি ঝুলানো আছে। পাঞ্জাবির পকেটে মানিব্যাগ। মেয়েটিকে টাকা-পয়সা আগেই দেয়া হয়েছে–আরো কিছু দেয়া যাক। তিনি চারটা পাঁচ শ টাকার নোট বের করলেন। এক্সট্রা অভিনেত্রী হিসেবে এই মেয়ে কত রোজগার করে কে জানে।
তুমি যে অভিনয় কর কত পাও?
শিফট হিসাবে পাই। এক শিফটে দু’শ পঞ্চাশ টাকা।
কতক্ষণে এক শিফট?
আধ ঘণ্টায় এক শিফট।
নাও টাকাটা রাখ।
কেন?
খুশি হয়ে দিচ্ছি।
খুশি তো আপনি হন নাই। আপনি বেজার হয়েছেন।
না আমি খুশি, নাও।
মেয়েটি হাত বাড়িয়ে টাকা নিল। মোবারক সাহেব পাশের ঘরে চলে এলেন। এই কামরা শোবার ঘরেরই এক্সটেনশন। ছোট্ট একটা বসার ঘর। চারটা গদি আঁটা নিচু চেয়ার। একটা লেখার টেবিল। টেবিলের পাশে আরেকটা তাকে পার্সেনাল কম্পিউটারমেকেনটস এল সি থ্রি। এই কম্পিউটার তিনি শুধুমাত্র দাবা খেলার জন্যে ব্যবহার করেন। কম্পিউটারে দাবার উপর খুব ভালো একটা প্রোগ্রাম আছে। ঘরের এক প্রান্তে বইয়ের সেলফ। একগাদা ইংরেজি ভূতের বইয়ে শেলফ ভর্তি। আসবাব বলতে এই।
মোবারক সাহেব লেখার টেবিলে বসলেন। টেবিলের উপর পেজ মার্ক লাগানো একটা বই–স্টিভেন ওয়াইনবার্গের–“The First 3 minutes”. প্রথম চ্যাপ্টারে পেজ মার্ক দেয়া। প্রথম চ্যাপ্টারের নাম–The Giant and the Cow. দৈত্য ও গরু। চ্যাপ্টারের শিরোনাম হিসেবে সুন্দর। তিনি পেজ মার্ক দিয়েছেন, পড়তে শুরু করেন নি।
টেবিলের উপর ইন্টারকমে ছোট্ট লালবাতি জ্বলছে। ইন্টারকমের বোতাম টেপামাত্র একতলা থেকে ইদরিস বলবে, স্যার স্নালামিকুম।
এখন রাত বেশি না–এগারটা চল্লিশ। রাত তিনটায় বোতাম টিপলেও সঙ্গে সঙ্গে ইদরিসের সাড়া পাওয়া যাবে।
তিনি ইন্টারকমের বোতাম টিপলেন। সঙ্গে সঙ্গে ইদরিস বলল, স্যার স্নামালিকুম।
ইদরিস তুমি মেয়েটিকে পৌঁছে দিয়ে এস।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
আজ আমার সাইড টেবিলে অ্যাশট্রে ছিল না কেন ইদরিস?
ইদরিস জবাব দিল না। তিনি বুঝতে পারছেন ইদরিসের কপালে ফোঁটা ফোঁটা ঘাম জমছে।
কেউ কি টেলিফোন করেছিল?
আন্মা টেলিফোন করেছিলেন। আমি বলেছি আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন।
ঠিক আছে।
আম্মা বলেছেন খুব জরুরি।
মোবারক সাহেব ইন্টারকম নামিয়ে রাখতেই দরজা ধরে মেয়েটি দাঁড়াল। মেয়েটিকে এখন কেমন অসহায় লাগছে। সে ক্ষীণ গলায় বলল, আমি যাই?
আচ্ছা।
আপনি আমার উপর রাগ করেছেন কেন আমি বুঝলাম না।
রাগ করি নি। আমি আরেকদিন তোমার নাচ দেখব।
বের হব কোন দিক দিয়ে?
দরজা খুলে হলঘরে চলে যাও। সেখান থেকে নিচে নামার সিঁড়ি আছে। নিচে নামলেই দেখবে ইদরিস তোমার জন্যে অপেক্ষা করছে।
জ্বি আচ্ছা!
এত বড় বাড়ি কিন্তু কোনো শব্দ নেই। সুনসান নীরবতা। মোবারক সাহেব কাঠের সিঁড়ি বেয়ে মেয়েটির নেমে যাওয়ার শব্দ শুনলেন। কলাপসিবল গেট খোলার শব্দ শুনলেন। গাড়ি স্ট্যার্ট দিয়ে বের হবার শব্দ শুনলেন। তখন তাঁর মনে হলো, মেয়েটিকে রেখে দিলে পারতেন। টুকটাক করে সুন্দর কথা বলছিল। মাঝে মাঝে অতি তুচ্ছ কথা শুনতেও ভালো লাগে। তিনি আবারো কলিংবেলে হাত রাখলেন, ইদরিস বলল, স্যার স্নামালিকুম। ইদরিস তাহলে মেয়েটির সঙ্গে যায় নি। ড্রাইভারের সঙ্গে পাঠিয়ে দিয়েছে। ইদরিস তাকে একা রেখে যাবে না। এটা ধরে নেয়া যায়।
ইসরিস!
জ্বি স্যার।
বাসার সঙ্গে টেলিফোন কানেকশন করে দাও, রেহানার সঙ্গে কথা বলব।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
তিনি টেলিফোন ধরার জন্যে লবিতে চলে এলেন। তার শোবার ঘরে কোনো টেলিফোন নেই।
কে রেহানা?
হ্যাঁ। ওমা একটু আগে ইদরিস বলল তুমি ঘুমিয়ে পড়েছ।
ভুল বলেছে। আমি জেগেই ছিলাম। বাতি নিভিয়ে শুয়ে ছিলাম, ইদরিস ভেবেছে ঘুমিয়ে পড়েছি। তুমি টেলিফোন করেছিলে কেন?
নাজু অ্যাকসিডেন্ট করেছে।
নাজুটা কে মোবারক সাহেব চিনতে পারলেন না। তাঁর শ্বশুরবাড়ির দিকের কেউ হবে। রেহানার দশ হাজার আত্মীয় আছে ঢাকা শহরে। তাদের সবাইকে চেনা সম্ভব নয়। চেনার কোনো প্রয়োজনও নেই।
ভয়াবহ অ্যাকসিডেন্ট। কী হয়েছে শোন…
মোবারক সাহেব দীর্ঘ গল্প শোনার জন্যে মানসিক প্ৰস্তৃতি নিয়ে নিলেন। রেহানা অল্প কথায় কিছুই বলতে পারে না। ‘সামারি এন্ড সাবসটেন্স’ বলে তার কিছু নেই। সে ছোট্ট একটা গল্পকে রবারের মতো টেনে লম্বা করবে। মূল গল্প বলতে বলতে শাখা গল্পে চলে যাবে। সেখান থেকে যাবে প্ৰশাখায়…৷ এক সময় কোনটা আসল গল্প কোনটা প্রশাখা কিছুই বোঝা যাবে না।
নাজু নিউ এলিফ্যান্ট রোডে মোজা কিনতে গিয়েছিল। বাটা সিগন্যালের কাছে যে দোকানগুলো ছিল সেখান থেকে মোজা কিনে গাড়িতে উঠেছে। আজ আবার তার ড্রাইভার আসে নি। নিজেই গাড়ি চালাচ্ছে। স্টার্ট নেবার সময় হঠাৎ অ্যাক্সিলেটরে পা দিয়ে ফেলেছে–সামনে এক লোক গ্যাস বেলুন বিক্রি করছিল, ওকে হিট করল…
মোবারক সাহেব ওয়াইনবার্গের বইয়ের পাতা ওল্টাচ্ছেন। পড়তে শুরু করবেন। কিনা বুঝতে পারছেন না। অ্যাকসিডেন্টের গল্প দীর্ঘ সময় পর্যন্ত চলার কথা। ক্লান্তিহীন কথা একজন মানুষ কী করে বলতে পারে? মোবারক সাহেব টেলিফোনের কথা শোনায় আবার মন দিলেন–মাঝখানে তিনি বোধহয় কিছু মিস করেছেন, এখন হচ্ছে জন্মদিনের কেকের কথা। অ্যাকসিডেন্ট থেকে জন্মদিনের কেকের গল্প কীভাবে চলে এল কে জানে।
সোনারগাঁয়ে গিয়েছে কেকের জন্যে–ওরা বলল, দু’কেজির কম হলে কালই দিতে পারবে। এক শ মানুষের জন্যে দু’কেজি কেক–এ কি হবে? আধা চামচ করেও তো হবে না। তুমিই বল, জন্মদিনে এক শ মানুষ হবে না?
কার জন্মদিনে এক শ মানুষ হবে মোবারক সাহেব কিছুই জানেন না। তারপরেও বললেন, আমার ধারণা এক শ’র বেশি হবে।
এই তো তুমি বললে এক শ’র বেশি হবে। আমিও তাই বলছি। রুনীর ধারণা কেউ আসবে না…
মোবারক সাহেব কথার মাঝখানে কথা বলার মতো অভদ্রতা শেষ পর্যন্ত করলেন। ক্লান্ত গলায় বললেন, রেহানা শোন, আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। আমি বরং শুয়ে পড়ি।
কখন মাথা ধরল?
সন্ধ্যা থেকেই।
সে কি! কেনো ডাক্তার ডাক নি।
সামান্য মাথাধরা। তার জন্য আবার ডাক্তার।
মাথাধরা কখনো সমান্য ভাববে না। অনেক মেজর ডিজিজের ফাস্ট ওয়ার্নিং হচ্ছে মাথাধরা। মাথাধরাকে সিরিয়াসলি নিতে হবে।
আচ্ছা এখন থেকে সিরিয়াসলি নেব। রেহানা রাখি?
রেহানা কিছু বলার আগেই তিনি টেলিফোন রেখে দিলেন। ঘুম আসছে কিনা। তিনি বুঝতে পারছেন না। ক্লান্তি লাগছে। ক্লান্তি এবং ঘুম পাওয়া এক জিনিস নয়। রাত জেগে খানিকক্ষণ ভূতের গল্প পড়া যেতে পারে। ঘুম আনার জন্যে ভূতের গল্প খুব কাজে আসে।
মোবারক সাহেব বিস্মিত হয়ে লক্ষ করলেন পাঁচ শ টাকার নোট চারটি চাদরের উপর পড়ে আছে। মেয়েটি কি ভুল করে ফেলে গেছে, না ইচ্ছা করে ফেলে গেছে। অতি তুচ্ছ যে মানুষ, তারও খানিকটা অহঙ্কার থাকে। সেই অহঙ্কারের কারণে টাকা রেখে যাওয়া? তা বোধহয় না। মেয়েটি শুধু যে টাকা ফেলে গেছে তাই না–চুলের ফিতাও ফেলে গেছে। মেয়েরা চুলের ফিতা, খোঁপার কাঁটা এইসব ব্যাপারে খুব সাবধানী হয়।
এই মেয়েটি সম্ভবত ভুলো মনের। সে হয়তো ভেবেছে তার হ্যাঁন্ডব্যাগে টাকাগুলো রেখেছে–আসলে রাখে নি।
তিনি ভূতের গল্পে মন দেবার চেষ্টা করলেন। এলিন নামের একটা মেয়ে একা একা তার অ্যাপার্টমেন্ট হাউসে থাকে। সেভেন ইলিভেন শপে কাজ করে রাত দশটার দিকে ফেরে। শীতের রাত–ঘন কুয়াশা পড়েছে। ঘন কুয়াশার জন্যে এলিনের মনে হচ্ছে কে যেন তাকে ফলো করছে। সে যখন হাঁটে তখন পেছন থেকে জুতার শব্দ পাওয়া যায়। সে থেমে গেলেই জুতার শব্দ থেমে যায়। এলিন ভয় পেয়ে থমকে দাঁড়াল। বলল, কে?
আমি।
যে আমি বলল তার গলার স্বর খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। অথচ এলিন সেই পরিচিত শব্দ চিনতে পারছে না। এলিন ভয়ে ভয়ে বলল, কুয়াশার জন্যে আমি তোমাকে পরিষ্কার দেখতে পারছি না। তুমি কি দয়া করে এগিয়ে আসবে?
খটখট জুতার শব্দ করে যে এগিয়ে এল সে দেখতে অবিকল এলিনের মতো। পোশাকও পরেছে এলিনের মতো। গলায় লাল স্কার্ফ। হাতে হলুদ দস্তানা। গায়ে ছাইরঙা ব্লেজার।
মোটামুটি জমাট গল্প। খুব জমাট গল্পে মোবারক সাহেবের ঘুম ধরে যায়। মস্তিষ্কের একটি অংশ গল্পটা পড়তে চায়। অন্য অংশ বলে–শুয়ে পড়। চোখের পাতা ভারি হয়ে আসে।
গল্পটা পড়ার জন্যে উৎসাহ যত বাড়ে, ঘুমাও ততই বাড়ে। আজ তা হচ্ছে না। আজ তিনি সূক্ষ্ম এক ধরনের যন্ত্রণা অনুভব করছেন। যন্ত্রণাও ঠিক না–অস্বস্তি। মশারি খাটিয়ে ঘুমুতে যাবার পর কেউ যদি সেখানে ফুটো আবিষ্কার করে তখন যেমন অস্বস্তি লাগে, সে রকম অস্বস্তি। চোখে ঘুম না। আসা পর্যন্ত মনে হয় এই বুঝি ফুটো দিয়ে মশা ঢুকে গেল। তার অস্বস্তির কারণটা কী? মেয়েটা এই বিছানাতেই শুয়ে ছিল–চাদর বদলানো হয় নি। তার গায়ের গন্ধ চাদরে লেগে আছে–এই জন্যেই কি অস্বস্তি?
মোবারক সাহেব বিছানার চাদর বদলালেন। বালিশের ওয়ার বদলালেন। লাভ হলো না। রাত সাড়ে চারটা পর্যন্ত তিনি অঘুমো বসে রইলেন। অথচ তাঁর ঘুম দরকার। কাল সন্ধ্যায় তিনি জাপান যাবেন। তাঁর একটা জাহাজ টেরিফ আইন ভঙ্গের দায়ে জাপানে আটকা পড়েছে। জাহাজের স্কিপারের লাইসেন্সেও নাকি কী সমস্যা আছে। তাঁকে যেতে হবে। দীর্ঘ ক্লান্তিকর ভ্রমণের আগে আরাম করে ঘুমানোর প্রয়োজন ছিল।
তিনি ভূতের বই বন্ধ করে উঠে দাঁড়ালেন। মেডিসিন বক্স থেকে ঘুমের ওষুধ বের করে খাবেন। একটা হিপনল তার সঙ্গে দু’টা প্যারাসিটামল। ওষুধ খাবার পর গরম এক কাপ কফি খেলে ভালো হতো। কফি খেলে সবার ঘুম চটে যায়। তার উল্টোটা হয়–ঘুম পায়।
মোবারক সাহেব ওষুধ খেয়ে পাশের ঘরে গেলেন। ইন্টারকম তোলামাত্র ইদরিস বলল, স্যার স্নামালিকুম। মোবারক সাহেবের ধারণা তিনি যে ক’দিন এ বাড়িতে থাকেন। সে ক’দিন ইদরিস ঘুমায় না। ইন্টারকমের পাশে জেগে বসে থাকে।
ইদরিস।
জ্বি স্যার।
কড়া করে এক কাপ কফি খাওয়াও তো।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
ঐ মেয়েকে কি দিয়ে এসেছে?
অনেক আগেই গাড়ি চলে এসেছে।
আচ্ছা ঠিক আছে।
তিনি আবার শোবার ঘরে চলে এলেন। বাতি নিভিয়ে ঘর অন্ধকার করে গরম কফির জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন। হঠাৎ তাঁর মনে হলো–মেয়েটিকে তার সঙ্গে জাপানে নিয়ে গেলে কেমন হয়। মেয়েটির জন্যে সেটা একটা অকল্পনীয় ব্যাপার হবে না। সে হয়তো জীবনের প্রথম প্লেনে চড়বে, জীবনের প্রথম দেশের বাইরে যাবে। পদে পদে বিস্মিত হবে। তিনি খুব কাছ থেকে সেই বিস্ময় দেখবেন। বিস্মিত মানুষকে দেখতে ভালো লাগে। তার আশপাশে যারা থাকে তারা কেউ বিস্মিত হয় না। তিনি নিজেও বিস্মিত হওয়া ভুলে গেছেন।
একদিনে মেয়েটির পাসপোর্ট ও ভিসার ব্যবস্থা করা সমস্যা নয় বলেই তিনি মনে করেন। লোকমানকে খবর দিলেই সে ব্যবস্থা করবে। লোকমান পারে না এমন কাজ নেই। যে-কোনো কাজ দিয়ে তিনি যদি লোকমানকে বলেন–লোকমান, পারবে না? লোকমান তখন হতাশ তাকিয়ে থাকবে, মাথা চুলকাবে–ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেলবে। তার ভাব দেখে মনে হবে সে গভীর সমুদ্রে পড়েছে কিন্তু বলবে সম্পূর্ণ উল্টো কথা। অস্পষ্ট গলায় প্ৰায় ফিসফিস করে বলবে–কেন পারব না?
এ ধরনের কথা বলার লোক দ্রুত কমে যাচ্ছে। কোনো কাজ দিলে বেশিরভাগ লোক বলে, স্যার চেষ্টা করে দেখব। সেই চেষ্টাটাও করে না।
দরজায় টোকা পড়ছে। গরম কফি নিয়ে ইদরিস চলে এসেছে। লোকমানের মতো এই আরেকজন। কুকুরের মতো অনুগত।
ইদরিস ভেতরে আস।
ইদরিস ঢুকুল। মোবারক সাহেবের দিকে চোখ তুলে তাকাল না। কখনো তাকায় না। টেবিলে কফির কাপ নামিয়ে রাখল। মোবারক সাহেব কাপ হাতে নিয়ে ছোট্ট একটা চুমুক দিয়ে বললেন, কফি ভালো হয়েছে। শোন ইদরিস, আমি সকাল দশটা পৰ্যন্ত ঘুমুব।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
লোকমানকে আমার একটু দরকার।
দশটার সময় আসতে বলব স্যার?
তিনি জবাব দিলেন না। চুপ করে রইলেন। ইদরিস বলল, এখন কি স্যার টেলিফোনে ধরে দেব? কথা বলবেন?
মোবারক সাহেব একটু চমকে গেলেন। এই মুহুর্তে তিনি ঠিক টেলিফোনে কথা বলার কথাই ভাবছিলেন। খুব যারা অনুগত তাদের মধ্যে টেলিপ্যাথিক সেন্স কাজ করে। ব্যাপারটা তিনি আগেও লক্ষ করেছেন। কুকুর তার প্রভুর মুড বুঝতে পারে–কুকুরের মতো যারা অনুগত তারাও পারে।
দাও, টেলিফোনে ধরে দাও।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
তিনি হালকা চুমুকে কফি খাচ্ছেন। কফি খেতে তাঁর ভালো লাগছে। ইদরিস এখনো টেলিফোনের লাইন দেয় নি। এখন দেবেও না–স্যারের কফি খাওয়া কখন শেষ হবে। তার জন্য অপেক্ষা করবে। তিনি কফি শেষ করে কাপ টেবিলে রাখার সঙ্গে সঙ্গেই টেলিফোন বাজল। এও কি টেলিপ্যাথিক যোগাযোগ?
স্যার আমি লোকমান। আপনার শরীর ভালো স্যার?
হ্যাঁ। তুমি কেমন আছ লোকমান?
আপনার দোয়া স্যার।
এত রাতে তোমাকে জাগালাম…
কোনো অসুবিধা নেই স্যার। আমি জেগেই ছিলাম।
জেগে ছিলে কেন?
আমার স্যার একটা অসুখ আছে। রাতে ঘুম হয় না।
জানতাম না তো।
আমাকে খোঁজ করছিলেন কেন স্যার?
শোন লোকমান, কাল দিনের ভেতর তুমি একটা পাসপোর্ট এবং জাপানের ভিসার ব্যবস্থা করতে পারবে?
পাসপোর্ট কোনো ব্যাপার না স্যার।
ভিসা পাওয়া যাবে না?
কাল তো স্যার রোববার–জাপান এম্বেসি বন্ধ। সব ফরেন এম্বেসিই বন্ধ।
ভিসা তাহলে সম্ভব না?
সম্ভব না। এমন কথা তো স্যার আমি বলি নি।
পারবে?
কোন পারব না?
মোবারক সাহেব তৃপ্তির হাসি হাসলেন। লোকমান বলল, স্যার যাবে কে?
তুমি সকালে চলে এস, তখন বলব।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
কত দিন ধরে তুমি রাতে ঘুমুতে পার না?
অনেকদিন স্যার।
অনেকদিন মানে কত দিন?
প্রায় চার বছর।
ও আচ্ছা। টেলিফোন তাহলে রাখি?
জ্বি আচ্ছা স্যার। আমি সকালে চলে আসব।
মোবারক সাহেব টেলিফোন নামিয়ে রেখে বাথরুমে ঢুকে হাত-মুখ ধুলেন। অনেকক্ষণ ধরে দাঁত ব্ৰাশ করলেন। কফির মিষ্টি স্বাদ মুখে নিয়ে ঘুমুতে যাওয়া যায় না। একটু পান খেতে পারলে হতো। মৌরি দেয়া ছোট্ট এক খিলি পান।
চোখে ঘুম জড়িয়ে আসছে। পরপর দু’বার হাই উঠল। শরীরে অক্সিজেনের অভাব হচ্ছে। লোহিত রক্ত কণিকারা ক্লান্ত হয়ে পড়েছে–তারা এখন আর আগের মতো অক্সিজেন নিয়ে ছোটাছুটি করতে পারছে না।
তিনি জানালার ভিনিশিয়ান ব্লাইন্ডগুলো টেনে দিলেন। দিনের আলো যেন ঘরে না ঢোকে। পাঁচ ঘণ্টা তিনি একনাগাড়ে ঘুমুবেন। ফাইভ লং আওয়ার্স। থ্রি হানড্রেড মিনিটস।
পুরোপুরিভাবে বিছানায় যাবার আগে আবারো কী মনে করে ইন্টারকমের বোতাম টিপলেন। ইদরিস সঙ্গে সঙ্গে বলল, স্নামালিকুম স্যার। তার বোধহয় লোকমানের মতো অনিদ্রা রোগ আছে।
ইদরিস!
জ্বি স্যার।
লোকমানের সকালে আসার দরকার নেই। ওকে নিষেধ করে দিও।
জ্বি আচ্ছা স্যার।
ঘুমের ওষুধ, গরম কফি, সারাদিনের ক্লান্তি সব একসঙ্গে চেপে ধরেছে। তাঁর কেমন যেন একা লাগছে। একটু ভয় ভয়ও লাগছে। একজন কেউ পাশে থাকলে ভালো লাগত। গভীর ঘুমে তলিয়ে যাবার সময় একজন কাউকে ছুঁয়ে থাকতে ইচ্ছা করে। মোবারক সাহেব অস্বস্তি বোধ করছেন। কী একটা জিনিস যেন তাঁকে পীড়া দিচ্ছে। টেপী নামের মেয়েটির শরীরে গন্ধ? হতে পারে। মানুষ চলে যায় কিন্তু সে তার গায়ের গন্ধ রেখে যায়। এই গন্ধ মোবারক সাহেবের পরিচিত–খুবই পরিচিত। এই জন্যেই কি তাঁর অস্বস্তি লাগছে?
কী বিশ্ৰী নাম মেয়েটার! নাম বদলে দিতে বলতে হবে–মেয়েটার জন্যে সুন্দর একটা নাম দরকার–ময়ূরাক্ষী নামটা কেমন? ময়ূরের মতো চোখ। ময়ূরের চোখ কি সুন্দর? তিনি জানেন না। ময়ূর দেখেছেন। কিন্তু ময়ূরের চোখের দিকে বিশেষ করে তাকিয়ে দেখেন নি। মানুষের চোখের তুলনা মানুষের চোখের সঙ্গেই হওয়া উচিত–পাখির চোখের সঙ্গে নয়। গন্ধটা নাকে লাগছে। মোবারক সাহেব পাশ ফিরলেন।