পূর্ব-পশ্চিম – উপন্যাস –দ্বিতীয় খণ্ড
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
ভোরবেলা থেকে পেঁজা তুলোর মতন পাতলা তুষার দুলতে দুলতে নামছে। বৃষ্টির শব্দ থাকে, কিন্তু তুষারপাত একেবারে নিঃশব্দ। আস্তে আস্তে সাদা হয়ে আসছে গাছগুলোর মাথা। এদিকটায় নদীর ধারে সারি সারি উইলো গাছ, ঝুঁকে আছে জলের দিকে। এই গাছগুলির নাম উইপিং উইলো, দেখলেই কেমন যেন করুণ আর বিষণ্ণ মনে হয়। আরও অনেক গাছ এখানে, তার মধ্যে পপলার ও মেপল চেনা যায়।
হাডসন নদীর ধার দিয়ে সুদৃশ্য পথ, রিভার সাইড ড্রাইভ। গাড়ি চলার রাস্তা ছাড়াও রয়েছে। আলাদা পায়ে চলা রাস্তা, তার পাশে পাশে, গাছ তলায় অনেক বসবার জায়গা, সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো তাশ খেলা কিংবা দাবা খেলার টেবিল। এখন অবশ্য সেখানে কেউ বসে নেই।
এ দেশের গাড়ি হর্ন বাজায় না, মসৃণ রাস্তায় গাড়ির কোনো ঝাঁকুনি নেই, তবু চলন্ত গাড়ির সঙ্গে বাতাসের ঘর্ষণের একটা অদ্ভুত শব্দ আছে। সেটাই শহরের শব্দ। হু স স। হু স্ স্। এখানকার হাওয়া এক মুহূর্তও অক্ষত থাকে না।
ওভারকোটের পকেটে দু’হাত ভরে আস্তে আস্তে হেঁটে আসছে অতীন। গ্লাভস পরে আছে যদিও, কিন্তু দুটোতেই কয়েকটা ফুটো, হাত বাইরে রাখলেই কঙ্কন করছে আঙুলের ডগা। অতীনের গালে শৌখিনভাবে ছাঁটা দাড়ি, বেশ পুরুষ্ট একটা গোঁফ, চোখে সান গ্লাস, মাথায়। টুপী। সে মাথা নীচু করে হাঁটছে, একবার সে ডান দিকে তাকিয়ে রাস্তার অন্য পারের একটি ব্যাঙ্কের ঘড়ি দেখলো। এই ঘড়িতে একবার সময়, আর একবার তাপমাত্রা দেখায়। এখন সকাল আটটা সতেরো, তাপমাত্রা বিয়োগ চার।
মার্চ মাসের মাঝামাঝি ঠাণ্ডা বেশ কমে গিয়েছিল, গলতে শুরু করেছিল বরফ, মনে হয়েছিল এবার বুঝি বসন্ত আসবে। আশার ছলনা! এ দেশে এত তাড়াতাড়ি বসন্ত আসে না। দু’দিন ধরে রোদ মুছে গেছে একেবারে, আকাশ গম্ভীর, আবার শুরু হয়েছে তুষারপাত।
অতীনের খুব সিগারেট টানতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু গ্লাভস পরা হাতে সিগারেট জ্বালা যায় না। গ্লাভস খোলার তো প্রশ্নই ওঠে না, সিদ্ধার্থ তাকে ফ্রস্ট বাইটের ভয় দেখিয়ে রেখেছে। ফ্রস্ট বাইট হলে নাকি আঙুলের ডগাগুলো চিরকালের মতন অসাড় হয়ে যায়।
হাতে সময় আছে বলেই অতীন ইচ্ছে করে হাঁটছে। বাড়ি থেকে সে বেরিয়ে পড়েছে অনেক আগে। একটা গরম গেঞ্জি, তার ওপর টেরিউলের শার্ট, তার ওপর জ্যাকেট, তার ওপরে ওভার কোট, ঠাণ্ডা লাগার কোনো সম্ভাবনাই নেই। যথেষ্ট গরম পোষাক থাকলে বরফের মধ্যেও হাঁটতে ভালো লাগে, শরীরটা খুব তাজা লাগে। নিঃশ্বাসে একেবারে টাটকা বাতাস।
আরও কিছু কিছু নারী-পুরুষ হেঁটে যাচ্ছে এই পথে। রিভার সাইড ড্রাইভে অনেকে শখ করে বেড়াতে আসে। আজ ছুটির দিন নয়, তবু এতবড় শহরে নিষ্কম কিছু লোক থাকেই। তা ছাড়া আছে টুরিস্ট, সারা বছর ধরেই তাদের আসার বিরাম নেই।
দু’জন যুবককে দেখে অতীনের মনে হলো তারা ভারতীয় তো বটেই, বাঙালীও হতে পারে। ঠিক অতীনের মুখোমুখি আসছে। পথ ছেড়ে চট করে অতীন একটা পপলার গাছের আড়ালে
চলে গেল। যদি ওরা তাকে দেখে কথা বলতে চায়? অতীন অচেনা বাঙালীদের সঙ্গে আলাপ করতে একেবারেই আগ্রহী নয়। আড়ালে গেল বটে, তবু অতীন কান খাড়া করে রইলো। হ্যাঁ, তার অনুমান ঠিক, লোক দুটি বাংলাতেই কথা বলতে বলতে যাচ্ছে, কথার টান শুনে মনে হয় পূর্ব পাকিস্তানী।
ঠিক ন’টা বাজতে পাঁচ মিনিটে অতীন সেন্ট্রাল পার্কের একটা গেটের সামনে এসে। দাঁড়ালো। উল্টো দিকে প্লাজা হোটেল। অতীনের অ্যাপয়েন্টমেন্ট ঠিক ন’টায়। তুষারপাত থেমে গিয়ে খুচ করে একটু রোদ উঠে গেছে। এ দেশের আবহাওয়া বোঝা সত্যি দুষ্কর।
এখন একটা সিগারেট না খেলে আর চলে না। এরপর অনেকক্ষণ সিগারেট টানা যাবে না। বুকের মধ্যে একটা ধড়ফড়ানি শুরু হয়ে গেছে, এক একবার মনে হচ্ছে ফিরে গেলে কেমন হয়?
অতীন একটা লাকি স্ট্রাইক ধরিয়ে পার্কের ভেতর দিকে তাকালো। বরফের ওপরে ছুটোছুটি করছে কয়েকটি বাচ্চা, উজ্জ্বল লাল-নীল পোষাক পরা, একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে এক মহিলা। একজন বৃদ্ধ একটু দূর থেকে এমন লোভীর মতন দেখছে সেই বাচ্চাদের খেলা, যেন তাঁর কোনোদিন কোনো সন্তান হয়নি, অথবা তার সন্তানরা তাকে ত্যাগ করেছে।
সিগারেটটা শেষ করলো না অতীন, কয়েকটা ঘন ঘন টান দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রাস্তা পার হয়ে এলো। হোটেলটির দরজার রং সোনালি। অতীন আগে থেকেই শুনে এসেছে প্রাজা হোটেলটি বেশ অভিজাত, বড় বড় কম্পানির প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্টরা এখানে ওঠে, কিংবা ফিল্ম স্টারেরা, সাধারণ টুরিস্টদের পক্ষে এই হোটেল ধরা ছোঁয়ার বাইরে।
এ দেশের এই একটা সুবিধে, যে-কোনো বড় দোকান বা হোটেলেই ঢুকে পড়া যায়, কেউ বাধা দেয় না। কিছু না কিনেও কোনো দোকান বা হোটেলের আরকেডে ঘোরা যায়, হয়তো অনধিকারীদের ওপর এরা আড়াল থেকে নজর রাখে। কালো লোকেরা এই সব হোটেলে বোধ হয় ঢুকতে সাহসই পায় না। অতীন সোজা দৃষ্টি ফেলে, কয়েক ধাপ সিঁড়ি দিয়ে উঠে, ঘোরানো কাচের দরজা ঠেলে ভেতরে চলে এলো।
ডান পাশে কাউন্টার, তার ওপাশে সিঁড়ি, তারপর লিফটের দরজা, সামনে প্রশস্ত লবি। সিঁড়ির রেইলিং, লিফটের দরজা, লবির চেয়ারগুলি সবই যেন সোনা দিয়ে তৈরি। একেই বোধ হয় সোনার জলে গিল্টি করা বলে।
অতীন কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়ালো। এখন তার বুকটা থরথর করে কাঁপছে বলে সে নিজের ওপরেই বিরক্ত হচ্ছে। এরকম তো কথা ছিল না। নাভাস হবার কী আছে, যা হবার তা হবে, কিছুতেই কিছু আসে যায় না!
রিসেপশান কাউন্টারে পাঁচজন তরুণ-তরুণী, তাদের মধ্যে সবচেয়ে যার ভালো মানুষের মতন মুখ, তাকে বেছে নিল অতীন। টাইয়ের গিটটায় একবার অনাবশ্যকভাবে হাত দিয়ে, গলা পরিষ্কার করে সে বললো, আমি শ্রীযুক্ত স্যামুয়েল হুইলারের সঙ্গে দেখা করতে চাই।
যুবকটির মাথায় সোনালি চুল, নীল চক্ষু। সে এমনই রূপবান যে সে ফিলমের নায়ক না। হয়ে হোটেলের সামান্য কর্মচারি হয়েছে কেন, এই প্রশ্ন তাকে দেখলে মনে জাগবেই। সে সুমিষ্ট কণ্ঠস্বরে জিজ্ঞেস করলো, আপনার কি সাক্ষাৎকার নির্দিষ্ট আছে?
ভারতীয়রা অনেক সময় শুধু মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানায়, এ দেশে সেটা সৌজন্য সম্মত নয়। তাই অতীন মাথা ঝোঁকালো বটে, মুখেও বললো, হ্যাঁ, আমার সঙ্গে শ্রীযুক্ত হুইলারের সাক্ষাৎকার নির্দিষ্ট আছে।
যুবকটি বললো, এক মুহূর্ত অপেক্ষা করুন, দয়া করে।
এই সব হোটেলে বাইরের আগন্তুকদের কাছে অতিথিদের ঘরের নম্বর বলে দেওয়ার নিয়ম নেই। যাকে-তাকে ওপরে পাঠিয়ে দেবার তো প্রশ্নই ওঠে না।
যুবকটি প্রথমে একটি তালিকা দেখলো, তারপর কানে টেলিফোন যন্ত্র লাগিয়ে কিছুক্ষণ শুনলো, তারপর অত্যন্ত বিনীতভাবে বললো, আমি ভীত হচ্ছি, মহাশয়, ঘরে কেউ নেই।
অতীনের মুখখানা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ঘরে কেউ নেই মানে? সামুয়েল হুইলারের সঙ্গে সে গতকালই নিজে টেলিফোনে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছে। তিনি তাঁকে ন’টার সময় সময় দিয়েছেন। তবে কি অন্য কোনো তারিখে। না, তিনি স্পষ্ট বলেছেন, শুক্রবার সকাল ন’টায়। তবু লোকটা নেই? সাহেব জাতি এরকম কথা দিয়ে কথা রাখে না?
তারপরই অতীন ভাবলো, সকাল ন’টার সময় সাক্ষাৎকারের সময় দিয়ে লোকটা ঘরে বসে থাকবে কেন? নীচে নেমে আসবে কিংবা ব্রেকফাস্ট খাবার জন্য গিয়ে বসবে।
সে জিজ্ঞেস করলো, আমি কি খাবারের ঘরগুলো একটু খুঁজে দেখতে পারি?
যুবকটি অতীনের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, হ্যাঁ কিংবা না কিছুই বললো না। হোটেলে কাজ করার জন্য এরা একরকম নিখুঁত ভদ্রতা দেখানোর শিক্ষা পায়, তার মধ্যে মানবিক উত্তাপ একটুও থাকে না। অতীন যে অনেক দূর থেকে এসেছে, একটা সমস্যায় পড়েছে, তা কি এই লোকটা বুঝতে পারছে না? বুঝতে সে চায়ও না, সেটা তার চাকরির অন্তর্গত নয়।
অতীন লবিতে বা ডাইনিং হলগুলিতে খুঁজতে গেলে কেউ বোধ হয় আপত্তি করবে না, কিন্তু ঐ কথাটা সে উজবুগের মতন বলেছে। সে তো স্যামুয়েল হুইলারকে চেনেই না, এমনকি তার ছবিও দেখেনি! সে কি জনে জনে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে, আপনিই মিস্টার হুইলার?
যুবকটি অন্যদের সঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো, অতীন গরু-চোরের মতন মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তার বুকের মধ্যে এখন আর কোনো শব্দ নেই, বুকটা একেবারে খালি, সে কি এতদূর এসে ফিরে যাবে। এ প্রস্তুতি, অপরের কাছ থেকে সুট ধার করে আনা, সব ব্যর্থ?
কাউন্টারের যুবকটি একটু পরে, অন্য একজনের সঙ্গে কথা শেষ করে, অতীনকে তখনও দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, যান্ত্রিক দায়িত্ব বশত চাবির খোপ দেখলো। আপন মনে বললো, উনি চাবি দিয়ে যাননি। তারপরই স্বর্ণখনি আবিষ্কারের ভঙ্গিতে সেই খোপ থেকে এক টুকরো কাগজ বার করে এনে, একটা শিস দিয়ে বললো, আমি দুঃখিত, মহাশয়, এই যে একটা নির্দেশ রয়েছে। আপনার নামটি অনুগ্রহ করে জানাবেন কী?
অতীন পকেট থেকে একটা কার্ড বার করে দিল। সেটি দেখে, হাতের কাগজটির সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে সে বললো, হ্যাঁ, এই তো, শ্রীযুক্ত স্যামুয়েল হুইলার আপনার জন্য সাঁতার-পুকুরে অপেক্ষা করছেন!
এবারে অতীনের চক্ষু ছানাবড়া হবার জোগাড়। এই শীতের মধ্যে সুইমিং পুলে? সেখানে লোকটি দেখা করবে অতীনের সঙ্গে? পাগলের কাণ্ড নাকি?
–সাঁতার-পুকুরটি কোন দিকে?
যুবকটির বিনয়ের মুখোসপরা মুখেও একটা অধৈর্যের ছাপ ফুটে উঠেছে। নিতান্ত গাঁইয়া। ছাড়া এরকম প্রশ্ন যেন কেউ জিজ্ঞেস করে না। একজন উটকো লোকের জন্য সে অনেকখানি। সময় খরচ করে ফেলেছে। এ চাকরিতে তার প্রতি ছমিনিটের দাম এক ডলার।
সে একদিকের দেয়ালে অঙ্গুলি নির্দেশ করে অতীনের দিকে পিঠ ফেরালো।
দেয়ালের গায়ে স্বর্ণাক্ষরে সুইমিং পুল, সান বাথ, কনফারেন্স রুম ও বিভিন্ন রকম খাবারের কক্ষের নামের নীচে নীচে তীর চিহু আঁকা। কিন্তু এই সব কথা যে দেয়ালের গায়ে লেখা থাকে, সেটাই বা একজন নতন লোক জানবে কী করে?
একটি তীর চিহু ধরে অতীন এগোলো। গোলকধাঁধার মতন পথ। এ দেশে প্রায় বছর খানেকের বেশী কেটে গেলেও অতীন এখানে অনেক কিছুতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেনি। এখন তার মনে পড়লো, এখানে অনেক ঢাকা সুইমিং পুলে শীতকালের উপযোগী ঈষদুষ্ণ জল থাকে। যাদের স্বাস্থ্য বাতিক, তারা সাঁতার কাটে সারা বছর।
সুইমিং পুলে যদি অনেক লোক থাকে এখন, তা হলে স্যামুয়েল হুইলারকে অতীন কী করে খুঁজে পাবে? একমাত্র ভরসা তিনি অতীনকে চিনে নেবেন। এ পর্যন্ত আর কোনো ভারতীয় তো দূরের কথা, একজনও অশ্বেতকায় মানুষ দেখা যায়নি।
সুইমিং পুলে ঢোকার মুখে একটি লোক বসে আছে, সে অতীনের দিকে নিঃশব্দে হাত বাড়ালো, এখানে পোষাক খুলে রাখতে হয়। অতীনের উচিত ছিল ঢোকার মুখেই ক্লোক রুমে ওভার কোটটা জমা করে আসা। ভেতরে গরমের জন্য সে ওভার কোটটি খুলে হাতে নিয়েছে। সে লোকটিকে বললো, আমি সাঁতার কাটতে যাচ্ছি না, একজনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি।
এ কথা সে বললো বটে, তবু বোকার মতন সে লোকটির হাতে তুলে দিল তার ওভার। কোট। এ দেশে পদে পদে, যে-কোনো লোককে দিয়ে যে-কোনো কাজ করাতে গেলেই পয়সা লাগে। শুধু একটা কোট হাতে ধরার জন্যই ফেরার সময় এই লোকটিকে কত বকশিশ দিতে হবে কে জানে! কম বকশিশ দিলে এরা বড় অবজ্ঞার চোখে তাকায়। অতীন এ দেশে ট্যাক্সি চাপে না, প্রথম দিকে দু’একবার চাপতে হয়েছিল বাধ্য হয়ে। প্রথমবার সে ট্যাক্সির মিটার দিয়ে আর অতিরিক্ত কত দেবে ভেবে হাতের পয়সা গুণছিল, পটুরিকান ড্রাইভারটিই তার তালু। থেকে একটি ডলারের আধুলি ও দুটি সিকি তুলে নিল। তারপর থেকে অতীন জেনে গেছে যে ট্যাক্সি ভাড়ার ওপরে আরও পনেরো শতাংশ গুণাগার না দিলে এখানে চলে না।
সুইমিং পুলে গোটা পাঁচ-ছয় বাচ্চা, তিন-চারটি তরুণী ও একজন মাত্র পুরুষ। মাথা খারাপ করে দেবার মতন স্বাস্থ্যবতী একটি তরুণী একটি টাইয়ের মাপের জাঙ্গিয়া পরে জল ছেড়ে ঘাটলার ওপরে বসে আছে। বাকল ছাড়ানো কলাগাছের মতন মসৃণ তার উরু, তার বুকে কোনো বন্ধন নেই, সদ্য সমুদ্র থেকে তোলা শঙ্খের মতন তার দুই স্তন। অতীন শুনেছে, ষাটের দশকের গোড়া থেকে এ দেশের রমণীরা প্রকাশ্যে বুক উন্মুক্ত রাখতে শুরু করেছে, এমন পোষাক তারা পরে, যার নাম টপ লেস। নারী মুক্তিতে যারা বিশ্বাসী, সেই সব মেয়েদের বক্ষ বন্ধনীর ওপর খুব রাগ।
স্বভাবতই এই অপরূপা, নির্লজ্জা অপ্সরার দিকে অতীনের চোখ আটকে যাবেই। কিন্তু প্রয়োজন বড় দায়। সে জোর করে চোখ সরিয়ে পুরুষটিকে দেখলো। রীতিমতন বলিষ্ঠ, হৃষ্টপুষ্ট, মাঝারি উচ্চতার, মাঝবয়েসী এই লোকটির বুক ভর্তি পাকা চুল, অথচ মাথার চুল কালো, মুখখানা চৌকো ধরনের, চোখ দুটি কুকুতে, সে অতীনের দিকেই তাকিয়ে আছে। চোখাচোখি হতে সে অতীনকে হাতছানি দিল। অতীন এগোতেই সে চৌকো পুকুরটার মাঝখান থেকে সাঁতরে চলে এলো রস্তোরু অঙ্গরাটির কাছাকাছি তীরে।
অতীন ভেবেছিল, ন’টার সময় যখন সাক্ষাৎকার, তখন নিশ্চয়ই স্যামুয়েল সাহেব তাকে প্রাতরাশের টেবিলে বসিয়ে আলোচনা করবে। অতীন এই জন্য কিছু খেয়ে আসেনি। এই লোকটা তাকে ডেকেছে সুইমিং পুলে? এর মধ্যে একটা হেলা-তুচ্ছ করার ভাব আছে না? অপমান-বোধে অতীনের কান ও নাকের ডগা গরম হয়ে গেল।
অতীন লোকটির কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে বললো, আপনি কি শ্রীযুক্ত স্যামুয়েল হুইলার? আমার নাম…
লোকটি বললো, হাই…
তারপর এক নজর সেই আগুনের ঢেলার মতন তরুণীটির দিকে তাকিয়ে নিয়ে সে মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলো, ইউ প্যাকিং’ অর অ্যান ইনজান?
অতীন টানা ছ’মাস টেলিভিশনের সামনে প্রতিদিন তিন চার ঘণ্টা ধৈর্য ধরে বসে আমেরিকান ইংরিজি উচ্চারণ অভ্যেস করেছে। তবু লোকটির কথা শুনে সে হকচকিয়ে গেল। বিড় বিড় করে কী বলছে লোকটা?
তারপরই তার চকিতে মনে পড়লো, এই দেশে, ছোটদের কমিকসে আর টি ভি-র ফিমে, এখানকার যারা প্রকৃত আদিবাসী, বাংলা ভূগোলের বইতে যাদের বলে রেড-ইন্ডিয়ান, সেই তাদের এরা বলে ইনজান। আর প্যাকি মানে পাকিস্তানী। অর্থাৎ লোকটা তার সঙ্গে প্রথম থেকেই রসিকতা করতে শুরু করেছে। যখন তখন রসিকতা করাটা আমেরিকানদের একটা মুদ্রাদোষ!
অতীন বিনীতভাবে বললো, স্যার, আমি একজন ভারতবর্ষের ভারতীয়!
স্যামুয়েল বললো, উত্তম, উত্তম! আমি ভারতীয়দের পছন্দ করি। আমি একবার ভারতে গিয়েছিলাম, সেই উনিশ শো চুয়াল্লিশে, তখন আমি সেনাবাহিনীতে ছিলাম, বমবেই, ক্যাজুরায়ো, আজান্টা…আমার দিব্য মনে আছে! শোনো যুবক, তোমাকে এখানে ডেকেছি, আশা করি তুমি কিছু মনে করছে না, আমি পৃথিবীর যেখানেই থাকি, সকালবেলা খানিকক্ষণ সাঁতার না কাটলে আমার মর্জি ঠিক থাকে না-এবারে কাজের কথা হোক, তুমি ভারতের কোন্ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে ডিগ্রি নিয়েছো?
এই কি চাকরির ইন্টারভিউ? অতীন ক্ষোভের সঙ্গে ভাবলো, এই স্যামুয়েল নামের লোকটা একটি বড় মাল্টি ন্যাশনাল কম্পানির ভাইস চেয়ারম্যান। লোকটির চেহারা যদিও গেরিলার মতন, তবু যোগ্যতা আছে নিশ্চয়ই। প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় জলে শরীর ডুবিয়ে সে অতীনকে প্রশ্ন করছে। অতীন যদি ভারতীয় না হয়ে একজন শ্বেতাঙ্গ এম এস-সি পাশ যুবক হতো, তবে তার সঙ্গে এরকম বেয়াদপি করার সাহস পেত কি স্যামুয়েল?
অতীনের একবার ইচ্ছে হলো উঠে চলে যাওয়ার। কিন্তু কয়েকদিন আগে একটা ঘটনা ঘটেছে। নিউ জার্সিতে একজন বাঙালী ইঞ্জিনিয়ার ছেলে হঠাৎ খুন হয়েছে অজ্ঞাত আততায়ীর হাতে। পুলিস এখনও হত্যাকারীকে ধরতে পারেনি। স্থানীয় অনেক বাঙালীর ধারণা, ঐ ইঞ্জিনিয়ারটিকে খুন করেছে তারই জনৈক বন্ধু। ঐ ইঞ্জিনিয়ার ছেলেটি প্রাক্তন নকশাল, দেশে। থাকতে সে কারুকে খুন করে এসেছিল কি না তা অবশ্য কেউ জানে না, নিশ্চয়ই সেরকম কিছু ব্যাপার আছে, তারই প্রতিশোধ নিয়েছে অন্য কোনো বাঙালী। পশ্চিম বাংলায় যারা মরেছে, তাদের ভাই-টাই বা দলের ছেলেরাও তো এ দেশে চাকরি করতে বা পড়তে আসে।
এই ঘটনার পর সিদ্ধার্থ অতীনকে বলেছে, তুই নিউইয়র্ক ছেড়ে চলে যা, যদি প্রাণে বাঁচতে চাস। গোটা নিউইয়র্ক স্টেটে অনেক বাঙালী স্থায়ী বাসিন্দা। তা ছাড়া অনেক বাঙালী আসছে-যাচ্ছে। জলপাইগুড়ি–শিলিগুড়ির কেউ অতীনকে হঠাৎ চিনতে পারলে বদলা নেবার চেষ্টা করতে পারে। অতীনের পক্ষে মিড-ওয়েস্ট কিংবা অ্যারিজোনা–নিউ মেক্সিকোর দিকে চলে যাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে, ঐ সব দিকে বাঙালীর সংখ্যা কম, টুরিস্টও বেশী যায় না।
সিদ্ধার্থর কথায় যুক্তি আছে। লন্ডনে থাকার সময়ই অতীন এই ব্যাপারটা টের পেয়েছিল। কলকাতায়, পশ্চিমবঙ্গে বছর দুই-আড়াই নকশাল ছেলেরা দোর্দণ্ড প্রতাপ দেখাবার পর এখন তারা পিছু হটছে। ইন্দিরা গান্ধী আর সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় লেলিয়ে দিয়েছে পুলিস-মিলিটারি। যেখানে সেখানে নকশাল বিপ্লবীদের কিংবা নকশাল সন্দেহে অন্য ছেলেদের পিটিয়ে মারা হচ্ছে। সরোজ দত্তের মতন বুদ্ধিজীবীকে ভোরবেলা কলকাতায় পুলিস ময়দানে পাগলা কুকুরের মতন গুলি করে মেরেছে। এর প্রতিফলন পড়েছে বিদেশেও। লন্ডনে একটা জায়গায় তর্ক করতে করতে অতীন উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল, তখন একটি নিতান্ত ছাপোষা,উন্নতিকামী, এলেবেলে বঙ্গসন্তান হঠাৎ বলে উঠেছিল, আপনি মশাই অতীন মজুমদার, আপনার বাড়ি কি কালীঘাটে ছিল? কালীঘাটের সাবজজ প্রতাপ মজুমদারের ছেলে তো একটা খুনী, বেইল জাম্প করে বিদেশে পালিয়ে এসেছে! এবার দেশে গিয়ে, শুনলুম…
সিদ্ধার্থর পরামর্শ হয়তো সঠিক, কিন্তু মিড ওয়েস্ট বা অ্যারিজোনার দিকে চাকরি পাওয়া কি সোজা কথা? এখানকার বন্ধুরাই বলে যে আগের দশকে আমেরিকায় চাকরি ছিল অফুরন্ত। যে যখন খুশী ইচ্ছে মতন পেশা বদলাতে পারতো। সিটিজেনশীপ বা গ্রীন কার্ড পাওয়াও ছিল অনেক সহজ। কিন্তু বছর দুয়েক আগে থেকেই অবস্থা অনেক বদলে গেছে, আরব দেশের তেল এখন আমেরিকার প্রধান শিরঃপীড়া, সেখানকার হঠাৎ পাওয়া গলিত স্বর্ণের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে গিয়ে আমেরিকা হঠাৎ উপলব্ধি করেছে যে শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ানের দিকে একচক্ষু হরিণের মতন তাকিয়ে থাকাটা তাদের ভুল হয়েছে।
বিজ্ঞাপন দেখে দেখে আরিজোনার একটি ওষুধের কম্পানিতে একটা দরখাস্ত করেছিল। অতীন, তারপর সিদ্ধার্থর জামাইবাবুর সূত্র ধরে এই কম্পানিতে খানিকটা চেনা-শুনোও বেরিয়েছে, সেই জন্যই অতীন এখানে একটা ইন্টারভিউয়ের সুযোগ পেয়েছে। অতীনও আর নিউইয়র্কের মতন বড় শহরে থাকতে চায় না। কোনো লোক তার পূর্ব পরিচয়ের প্রসঙ্গ তুললেই অসম্ভব মাথা গরম হয়ে যার তার, রাত্রে ঘুম আসে না কিছুতেই। এমনকি কোনো লোক তার সঙ্গে ঠাট্টার সুরে কথা বললেই সে উত্তেজিত হয়ে ওঠে, দু’একবার সে এরকম লোকদের গলা টিপে ধরতে গিয়েছিল। সে, অতীন মজুমদার তো খুনী নয়! আত্মরক্ষা করবার জন্য…
নিজেকে দমন করে অতীন স্যামুয়েলের প্রশ্নের জবাব দিয়ে যেতে লাগলো। বেশীরভাগই এলেবেলে কথা, যার সঙ্গে চাকরির কোনে সম্পর্কই নেই। অতীনের বেশী খারাপ লাগছে এই জন্য যে খুব কাছেই বসা, প্রায় নির্বসনা সুন্দরীটি সব কথা শুনতে পাচ্ছে। যদি চাকরির ব্যাপার না হতো, তা হলে হোঁকা স্যামুয়েলের চেয়ে অতীনের নিশ্চিত বেশী সুযোগ ছিল মেয়েটির সঙ্গে আলাপ করবার। এ দেশের মেয়েরা চেহারার কদর দেয় বটে। তার চেয়েও বেশি দেয়। টাকা ও ক্ষমতার। মেয়েটি নিশ্চিত বুঝতে পারছে যে স্যামুয়েল একজন কেউকেটা ব্যক্তি, আর অতীন সামান্য একজন দয়াপ্রার্থী।
হোটেলের পরিচারক এসে মেয়েটিকে দিয়ে গেছে এক কৌটো হাইনিকেন বীয়ার। মেয়েটি বীয়ারে চুমুক দিতে দিতে তাকিয়ে আছে এদিকেই। বীয়ার খেলে মেদ জমে, এই তরুণীটি বীয়ারও পান করে, আবার সাঁতার কেটে মেদ ঝরিয়ে নেয়।
স্যামুয়েল মেয়েটির নগ্ন স্তনের দিকে বার বার চোরা-দৃষ্টি হানছে। হাসি ছুঁড়ে দিচ্ছে, আর অতীন সোজা তাকিয়ে আছে স্যামুয়েলের মুখের দিকে। স্যামুয়েল অর্থাৎ আংকল স্যাম যা খুশী করতে পারে, কিন্তু অতীন, সে এক অকিঞ্চিত্বর ভারতীয়, দয়াপ্রার্থী, চাকরির ইন্টারভিউতে একবার অন্যমনস্ক হলে তার আর কোনোরূপ আশা নেই। এ কি অসম প্রতিযোগিতা!
সুইমিং পুলের জল ঠিক সমুদ্রের মতন গাঢ় নীল। কয়েকটা বাচ্চা সেখানে দাপাদাপি করছে। আর অবাক হয়ে দেখছে অতীনকে। অতীন এখানে পুরো পোষাক পরে হাঁটু গেড়ে বসে আছে। বলেই সে দ্রষ্টব্য, না কালো মানুষ বলে? অন্য যে দু’তিনটি তরুণী সাঁতার কাটছে, তাদের পুরো দস্তুর সঁাতারের পোষাক। শুধু এই একটি মেয়েই পাড়ে উঠে বসে জেদীর মতন তার শরীর দেখাতে চায়। নীচু ছাদ থেকে কৃত্রিম আলো পড়েছে তার ওপরে, ঠিক রোদ্দুরের মতন।
অন্যান্য কথার মাঝখানে স্যামুয়েল হুইলার হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো, তুমি স্প্যানীশ জানো? চাকরির মৌখিক পরীক্ষার সব কিছুতেই যা বলতে হয়, কিন্তু অতীনের এক বর্ণও স্প্যানীশ। ভাষা-জ্ঞান নেই। সে একটু ইতস্তত করে বললো, না স্যার!
–তোমাকে কাজের জন্য মাঝে মাঝে মেক্সিকোতে যেতে হবে, স্প্যানীশ ভাষা জানা অতি আবশ্যিক!
–আমি খুব তাড়াতাড়ি শিখে নিতে পারবো, স্যার। অন্তত তিন মাসের মধ্যেই–
–বাঃ! তোমাকে দাড়িটা কামিয়ে ফেলতে হবে। গুটি রাখতে পারো, তাতে আপত্তি নেই, কিন্তু দাড়ি চলবে না। আমাদের চেয়ারম্যান যে-কোনো দাড়িওয়ালা ছোকরাকেই বীটনিক মনে করে। ওর ছেলে বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছিল, সেখানে গিয়ে বাউন্ডুলে হয়ে যায়।
অতীন হাসি হাসি মুখে চুপ করে রইলো। মনে হচ্ছে চাকরিটা হয়ে যাবে। লোকটাকে যত খারাপ মনে হয়েছিল, ততটা কঠোর নয়। সিদ্ধার্থ অবশ্য বলে দিয়েছে, এ দেশে বড়লোকদের। ব্যবহারেও একটা নকল আন্তরিকতা থাকে। ভারতে যারা চাকরির ইন্টারভিউ নেয়, সেই সব বড় অফিসাররা সবাই গোমড়ামুখো হয়, এ দেশে এরা হেসে কথা বলে।
কিন্তু এই লোকটা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ টেনে আনছে। স্প্যানীশ ভাষা শিখতে বলছে, দাড়ি কামাতে বলছে, এতটা যখন এগিয়েছে…না হয় অতীন দাড়িটা কামিয়েই ফেলবে! যে-কোনো উপায়ে সে নিউইয়র্ক ছেড়ে যেতে চায়। নিউ জার্সির বাঙালীদের মধ্যে অন্তত দু’জন তাকে ঘোরতর অপছন্দ করে, অতীন তার কারণ বুঝতে পারে না। অ্যারিজোনায় অপরিচিতদের মধ্যে গিয়ে সে শুরু করবে নতুন জীবন।
স্যামুয়েল আবার বললো, আর একটি কথা। তোমার নামটিও বদলানো দরকার। অন্তত নামের প্রথম অংশটি। আমাদের কম্পানিতে সবাই সবাইকে প্রথম নাম ধরে ডাকি। তোমার ঐ ভারতীয় নামটি কেউ উচ্চারণ করতে পারবে না, আমি তো পারিনি। একটা বেশ সহজ, মিষ্টি নাম:টম নামটা কি তোমার পছন্দ?
অতীনের মুখখানা পাট-পচা জলের মতন বিবর্ণ হয়ে গেল। চাকরির জন্য বাপ-মায়ের দেওয়া নামও বদলে ফেলতে হবে? কয়েকদিন আগেই সিদ্ধার্থর বন্ধু ধ্রুব বলেছিল, ওদের দেশের বাড়িতে সব চাকরেরই নাম বদলে দেওয়া হয়। যে চাকরই আসুক, তার নাম রাম। একজন রাম চাকরি ছেড়ে চলে গেল, তারপর যাকে রাখা হলো, তার আসল নাম হয়তো দুর্যোধন, কিন্তু ঐ খটমটে নাম কে মনে রাখবে? দুর্যোধনের নাম পাল্টে রাখা হলো রাম। দুর্যোধনেরা তাতে আপত্তি করে না। এ দেশেও আমরা সবাই ঐ রাম।
বীয়ার পান শেষ করে, ক্যানটি পাশে নামিয়ে রেখে মুক্তবসনা তরুণীটি এবার জিজ্ঞেস করলো, স্যামি, তোমার কি আরও দেরি আছে? আমি এবার ঘরে ফিরবো!
স্যামুয়েল বললো, না ডারলিং, আমার শেষ হয়ে গেছে। তোমার কেমন লাগলো এই ছেলেটির কথা শুনে?
অতীনের দিকে না তাকিয়ে, মেয়েটি তার পায়ের নখ পরিষ্কার করতে করতে বললো, ও কে!
অতীনের আবার স্তম্ভিত হবার পালা। এই মেয়েটি স্যামুয়েলের চেনা, ওর বউ নাকি? এই প্রৌঢ়ের এতটা তরুণী বউ? কিংবা হোটেলে এসে সংগ্রহ করা সাময়িক বান্ধবী! সে যাই হোক, অতীনের চাকরির ব্যাপারে এরও মতামতের মূল্য আছে? এই যুবতী স্যামুয়েল হুইলারের সহকর্মিণী নয় তো? বউকে ফাঁকি দিয়ে বড় কারা প্রাইভেট সেক্রেটারিকে নিয়ে দূরের কোনো শহরে ফুর্তি করতে যায়, এরকম গল্প প্রায়ই দেখা যায় খবরের কাগজে।
স্যামুয়েল জল থেকেই তার ভিজে হাতটা অতীনের দিকে বাড়িয়ে দিল করমর্দনের জন্য। তারপর বললো, ঠিক আছে, বাকিটা তোমাকে চিঠি লিখে জানানো হবে!
‘ধন্যবাদ’ বলে অতীন উঠে দাঁড়ালো, তারপর পেছন ফিরে হাঁটতে লাগলো যন্ত্রের মতন। ওভার কোটটা ফেরত নেবার সময় বকশিশ দেবার কথা তার মনে পড়লো না। কেউ যেন ঠাস ঠাস করে তার দুই গালে থাপ্পড় কষিয়েছে। তার চোখ দিয়ে এক্ষুনি জলের ফোঁটা নামবে। সে প্রায় দৌড়ে বেরিয়ে গেল হোটেল থেকে।
বাইরে রোদ নিভে গিয়ে আবার তুষারপাত শুরু হয়েছে–অতীন গ্লাভস পরলো না, ওভার কোটটাও গায়ে চাপাতে ভুলে গেল। র গরম লাগছে। সিগারেট ধরাতে গিয়ে তার হাত কাঁপতে লাগলো একটু একটু।
মালখানগরের প্রতাপ মজুমদারের ছেলে সে, অতীন মজুমদার, তাকে এতটা নীচে নামতে হবে? তার বাবা কোনোদিন কারুর কাছে মাথা নীচু করেননি, শুধু একবারই তাঁকে লোকের কাছে দয়া চাইতে হয়েছে, তাও তাঁর ছেলের জন্য।
একটা জলে গা-ডোবানো গেরিলা আর একটা আধ-ন্যাংটো মেয়ে নেবে তার চাকরির ইন্টারভিউ? অ্যামেরিকানরা ইনফরমাল হয়, তা বলে এতটা ইনফরমাল নাকি একটা কালো ভারতীয় ছেলের জন্য অন্য সময়ে সময় নষ্ট করা যায় না? চাকরির জন্য তাকে দাড়ি কামাতে হবে, নাম বদলাতে হবে। এরপর যদি বলে তুমি বাপের নাম বদলাও, মায়ের নাম বদলাও, সারা গায়ে খড়ি মেখে ফর্সা হও…এরকম চাকরির মুখে লাথি! চিঠি এলে সে ছিঁড়ে ফেলে দেবে!
ঘোরের মাথায় খানিকটা হেঁটে এসে এক জায়গায় থমকে দাঁড়ালো অতীন। সকালটা কত একটা সুন্দর সম্ভাবনা দিয়ে শুরু হয়েছিল, এখন সব কিছু বিস্বাদ হয়ে গেছে। সামনে লম্বা, টানা ফিফথ অ্যাভিনিউ। একটা পৃথিবী-বিখ্যাত পথ, এখানে সে একা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখের জল ফেললেও কেউ তার দিকে ফিরে তাকাবে না।
দাঁতে দাঁত চেপে অতীন বেশ জোরে বললো, শুয়ারের বাচ্চা!