পূর্ব বাংলায় নবজীবনে যাত্রা শুরু
১৯৪৭-এর আগস্টে ব্রিটিশ শাসকেরা ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ১৯০ বছর পরে উপমহাদেশ থেকে বিদায় নেয়। পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের দু-তিন বছরের মধ্যে পূর্ব বাংলার, অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্তের একটি অংশের মনোজগতে বিরাট পরিবর্তন ঘটে। অতি অল্প সময়ে এত বেশি পরিবর্তন পৃথিবীর আর কোনো জাতির মধ্যে ঘটেনি বলেই ধারণা করি। দীর্ঘকাল যাঁরা ছিলেন অনুদার ও রক্ষণশীল, তারা হয়ে গেলেন অনেকটা প্রগতিপন্থী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে নিষ্প্রাণ ঢাকা নগরী হয়ে ওঠে বাঙালি সংস্কৃতিচর্চার একটি নতুন কেন্দ্র।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পটভূমি দীর্ঘ। তা কমবেশি সবাই জানে। এই এলাকার মানুষ বহুকাল ছিল অবহেলিত ও শোষিত-বঞ্চিত। দেশের অর্থনীতিও ছিল না তাদের হাতে, রাজনৈতিক ক্ষমতাও নয়। শিল্প-সাহিত্য, রাজনীতি-অর্থনীতি সবই কলকাতাকেন্দ্রিক। পূর্ব বাংলার মুসলমানরা একটা পর্যায়ে পাকিস্তান-আন্দোলনে ঐকান্তিকভাবে অংশ নিয়েছিল মোটেই আবেগের বশে নয়– ঐতিহাসিক প্রয়োজনেই। কৃষিজীবী সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানসমাজ জাতীয় অর্থনীতিতে অতুলনীয় অবদান রাখছিল। পাট চাষে ও পাটশিল্পে, যদিও পাটকলগুলোর মালিক ছিল অবাঙালি শিল্পপতিরা, পূর্ব বাংলার মানুষের অবদানই বেশি। চল্লিশের দশক নাগাদ এই অঞ্চলের সচ্ছল কৃষক ও একটি মধ্যস্বত্বভোগী জোতদার শ্রেণির সন্তানদের অনেকে কিছুটা উচ্চশিক্ষা নিয়ে সরকারি চাকরি-বাকরিতে ঢুকছিলেন। খুব উঁচু পদে না হোক, মোটামুটি সংখ্যার দিক থেকে বাঙালি মুসলমান সরকারি চাকরিতে যথেষ্টই ছিলেন। তাঁদের সন্তানেরাই কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পান চল্লিশ ও পঞ্চাশের দশকে।
চল্লিশের শেষে এবং পঞ্চাশের শুরুতে যারা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা অর্জনের সুযোগ পান, তাঁদের একটি অংশ পঞ্চাশের দশকে পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে, সমাজে ও সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁরা অনেকে সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে ধারণ করেন অসাম্প্রদায়িক চেতনা। তারা বামপন্থী ধারার সঙ্গে যুক্ত হন এবং আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাস স্থাপন করেন। অর্থাৎ পঞ্চাশ দশকের শুরুতেই বাঙালি মুসলমান তরুণ-তরুণীদের অনেকের মধ্যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। সবার অজান্তেই যেন ঢাকায় এক নীরব বিপ্লব ঘটে যায়। যাদের বাপ-চাচারা স্লোগান দিতেন ‘নারায়ে তকবির’; তাঁদের কণ্ঠে ধ্বনিত হতে থাকে আইপিটিএর গণসংগীত:
‘নওজোয়ান নওজোয়ান।
বিশ্বে এলো নওজোয়ান।’
অথবা নজরুলের–
‘ওড়াও ওড়াও লাল নিশান।
দুলাও মোদের রক্ত-পতাকা।
ভরিয়া বাতাস জুড়ি বিমান।
ওড়াও ওড়াও লাল নিশান।’
কিংবা নজরুলেরই
‘জাগো অনশন-বন্দী, ওঠরে যত
জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত।’
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরেই আন্তর্জাতিকতা ও বামপন্থার এই যে সূচনা, তার অর্থ এই ছিল না যে তারা পাকিস্তানকে অস্বীকার করছিল। বরং পাকিস্তানই করে দেয় তাদেরকে এক নতুন সুযোগ– খুলে দেয় আত্মবিকাশের দরজা। তবে তারা খুব সতর্কতার সঙ্গে লক্ষ করেন, যতটা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি তারা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সময় প্রত্যাশা করেছিলেন তা থেকে তারা বঞ্চিত হয়েছেন। সে জন্যই তারা উপলব্ধি করেন, আর্থসামাজিক মুক্তির জন্য তাঁদের আরও আন্দোলন ও লড়াই-সংগ্রামের প্রয়োজন রয়েছে। সেই উপলব্ধি থেকেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন এবং পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের জন্য সংগ্রামের প্রস্তুতি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর একটি গোত্র নিজেদের অতি অসাম্প্রদায়িক, সম্পূর্ণ ষোলো আনা সেকুলার ও প্রবল প্রগতিশীল প্রমাণ করতে গিয়ে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে অবিরাম গালাগাল করতে থাকে। (যে তত্ত্ব জিন্নাহ নিজেই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার এক দিন আগে ১৩ আগস্ট ১৯৪৭ বর্জন করেন এবং গণপরিষদে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দেন, পাকিস্তান হবে একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র, ইসলামি রাষ্ট্র নয়, যেখানে রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে ধর্মের কোনো সম্পর্কই থাকবে না।) তারা একাত্তরে ইয়াহিয়া-টিক্কা-ফরমানের গণহত্যা ও বর্বরতার সঙ্গে পাকিস্তান রাষ্ট্রটিকে এক করে ফেলেন। ১৯৯৬-র পর থেকে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা যে একটি জঘন্য ব্যাপার ছিল, তা অব্যাহত বলা অনেকের মুদ্রাদোষে পরিণত হয়েছে। তবে এখন এমন অনেকে এসব বলছেন পাকিস্তান সরকার থেকে যারা সবচেয়ে বেশি সুবিধা নিয়েছেন এবং বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনে যাদের কোনো ভূমিকাই নেই। পাকিস্তান না হলে তাঁরা কলকাতায় কিংবা কোনো মফস্বল শহরে মর্যাদাহীন জীবন যাপন করতেন।
অবহেলিত ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী একটি পরাবৃত্তিকালে বা ট্রানজিশনের সময় কিছু বিশেষ সুবিধা দাবি করে। ১৯৪৭-এর আগে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের– বিহার, উত্তর প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ ও পাঞ্জাবের মুসলমানদের –অর্থনৈতিক অবস্থা বাংলার মুসলমানদের চেয়ে ভালো ছিল। উর্দুর মাধ্যমে তারা ধারণ করতেন সর্বভারতীয় সংস্কৃতি। বাঙালি মুসলমান মধ্যবিত্ত নিজস্ব সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক। ঐতিহ্যের অধিকারী, কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল, শিক্ষায় পিছিয়ে। তাদের ভূখণ্ডে তারা রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হতে চেয়েছিল। তাদের পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার কারণ সেটাই। ওই ঝাঁপিয়ে পড়ার মধ্যে যে দোষ ছিল না, তা একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে বাংলার মানুষ দ্বিতীয়বার প্রমাণ করেছে।
বাঙালির মহত্তম সৃষ্টিশীল প্রতিভা রবীন্দ্রনাথ বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ ও সমস্যা নিয়ে ভেবেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বহু আগে, ১৯১১ সালে, তিনি লিখেছিলেন :
‘হিন্দু মুসলমানদের মধ্যে যে একটি সত্য পার্থক্য আছে তাহা ফাঁকি দিয়া উড়াইয়া দিবার জো নাই। প্রয়োজন সাধনের আগ্রহবশত সেই পার্থক্য যদি আমরা না মানি তবে সেও আমাদের প্রয়োজন মানিবে না।
‘হিন্দু মুসলমানের মধ্যে সকল দিক দিয়া একটা সত্যকার ঐক্য জন্মে নাই বলিয়াই রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাহাদিগকে এক করিয়া তুলিবার চেষ্টায় সন্দেহ ও অবিশ্বাসের সূত্রপাত হইল। এই সন্দেহকে অমূলক বলিয়া উড়াইয়া দিলে চলিবে না। আমরা মুসলমানকে যখন আহ্বান করিয়াছি তখন তাহাকে কাজ উদ্ধারের সহায়ক বলিয়া ডাকিয়াছি, আপন বলিয়া ডাকি নাই। যদি কখনো দেখি তাহাকে কাজের জন্য আর দরকার নাই তবে তাহাকে অনাবশ্যক বলিয়া পিছনে ঠেলিতে আমাদের বাধিবে না। তাহাকে যথার্থ আমাদের সঙ্গী বলিয়া মনে করি নাই, আনুষঙ্গিক বলিয়া মানিয়া লইয়াছি। যেখানে দুই পক্ষের মধ্যে অসামঞ্জস্য আছে সেখানে যদি তাহারা শরিক হয়, তবে কেবল ততদিন পর্যন্ত তাহাদের বন্ধন থাকে যতদিন বাহিরে কোনো বাধা অতিক্রমের জন্য তাহাদের একত্র থাকা আবশ্যক হয়,–সে আবশ্যকটা অতীত হইলেই ভাগবাটোয়ারার বেলায় উভয় পক্ষেই ফাঁকি চলিতে থাকে।
‘মুসলমান এই সন্দেহটি মনে লইয়া আমাদের ডাকে সাড়া দেয় নাই। আমরা দুই পক্ষ একত্র থাকিলে মোটের উপর লাভের অঙ্ক বেশি হইবে বটে, কিন্তু লাভের অংশ তাহার পক্ষে বেশি হইবে কিনা, মুসলমানের সেইটেই বিবেচ্য। অতএব মুসলমানের এ কথা বলা অসঙ্গত নহে যে আমি যদি পৃথক থাকিয়াই বড়ো হইতে পারি তবেই তাহাতে আমার লাভ।’
[রবীন্দ্র রচনাবলী, ত্রয়োদশ খণ্ড, ১৩৬৮ বঙ্গাব্দ, কলকাতা, পৃ. ১৭৯-৯২]
কংগ্রেসের সুবিধাবাদী ও এক শ্রেণির সাম্প্রদায়িকতাবাদী হিন্দু নেতাদের সঙ্গে যুক্তিবাদী রবীন্দ্রনাথের পার্থক্য এখানেই। তিনি অন্য সম্প্রদায়ের দুর্বলতা ও নিজের সম্প্রদায়ের দোষ দেখতে পেয়েছেন। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলা ও আসাম নিয়ে যখন নতুন প্রদেশ হয় ১৯০৫ সালে, শ্রেণিস্বার্থে বিশেষ করে জমিদারি হারানোর শঙ্কায় রবীন্দ্রনাথও তার বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু বছর দেড়েকের মধ্যেই তিনি বুঝতে পারেন ওই বিরোধিতা করাটা ভুল ছিল। তিনি নতুন প্রদেশবিরোধী আন্দোলন, যার প্রচলিত নাম বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন, তা থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নেন। কিন্তু কংগ্রেস নেতারা নতুন প্রদেশ বাতিল না করা পর্যন্ত আদা নুন খেয়ে লেগে থাকেন। এবং ১৯১১-তে পূর্ব বাংলা ও আসাম প্রদেশ বাতিল করতে সরকারকে বাধ্য করেন। উপরের উদ্ধৃত কথাগুলো তখনই লিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বেঁচে থাকলে এই কথাগুলোই পুনর্বার লিখতেন। তাঁর আয়ের উৎস সব জমিদারিই ছিল পূর্ব বাংলায়। সুতরাং, পূর্ব বাংলা পাকিস্তানে পড়ায় তিনি হতেন সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। তখন তাঁর নিজের স্বার্থ ও বাঙালি মুসলমানের স্বার্থ –এই দুইয়ের মধ্যে যে দ্বন্দ্ব তিনি কোনটিকে প্রাধান্য দিতেন, তা নিয়ে অনুমান না করাই ভালো।
পূর্ব বাংলায় আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় মুসলমানদের বাধ্য করেছেন মহাসভা ও কংগ্রেস নেতারা। বাঙালি মুসলমান কস্মিনকালেও, ১৯৪০ সালের আগে, আলাদা রাষ্ট্রের কথা চিন্তা করেনি। শতাব্দীর পর শতাব্দী তারা হিন্দুদের সঙ্গে একত্রে পাশাপাশি বাস করেছে এবং অনাগত শত শত বছরও তারা একসঙ্গেই থাকতে চেয়েছে। তারা যা চেয়েছে তা হলো তাদের ন্যায্য অধিকার ও মর্যাদা। এই দুটোর কোনোটাই প্রতিপক্ষ থেকে না পাওয়ায় তারা দাবি তোলে আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার, যে রাষ্ট্রে তারাই হবে তাদের ভাগ্যবিধাতা। তারই পরিণাম পাকিস্তান এবং তারপর বাংলাদেশ।