কাবিল কোহকাফী – মুহম্মদ জাফর ইকবাল
১. পূর্বকথা
ছাগলের ঘাস খাওয়া অঙ্কটা শেষ করে টুশি বানরের বাঁশ বেয়ে উপরে ওঠার অঙ্কটা শুরু করল। অঙ্ক করে বানরটিকে নিয়ে যখন ঠিক বাঁশের মাঝামাঝি পৌঁছাল তখন তার নানা দরজা খুলে ঘরে মাথা ঢুকিয়ে বললেন, “এই টুশি!”
টুশি মাথা না তুলে বলল, “উ?”
নানা গলা উঁচিয়ে বললেন, “উ আবার কীরকম উত্তর? ডাকছি কথা কানে যায় না?”
টুশি মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমাকে ডিস্টার্ব করো না নানা। একটা বানরকে তেল-মাখানো বাঁশ দিয়ে উপরে ওঠাচ্ছি। হঠাৎ করে ছেড়ে দিলে বানর আছাড় খেয়ে নিচে পড়বে। মহা কেলেঙ্কারি হবে তখন।”
নানা বললেন, “রাখ দেখি তোর বাঁদর! আয় এখন আমার সাথে।”
“তুমি বড় ডিস্টার্ব করো নানা, দেখছ না হোমওয়ার্ক করছি।”
“বাদরের বাদরামি আবার হোমওয়ার্ক হল কবে থেকে? আয় আমার সাথে।”
টুশি অঙ্কখাতা বন্ধ করে বলল, “কোথায়?”
নানা চোখেমুখে একটা রহস্যের ভান করে বললেন, “বড় সিন্দুকটা খুলব।”
টুশি চোখ বড় বড় করে বলল, “সত্যি?”
“হ্যাঁ, সত্যি। তালাটাতে সকাল থেকে কেরোসিন তেল দিয়ে রেখেছি, এতক্ষণে মনে হয় একটু নরম হয়েছে। একশ বছরের জং কি সোজা কথা নাকি!”
টুশি এবারে তড়াক করে লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তার বয়স বারো, দেখে অবশ্যি আরও কম মনে হয়। তার জীবনের বারো বছরের গত নয় বছর সে তার নানার সাথে কাটিয়েছে। প্রথম তিন বছর সে তার বাবা-মায়ের সাথেই ছিল, একটা গাড়ি-অ্যাক্সিডেন্টে একসাথে দুজনেই মারা যাবার পর নানা তাকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলেন। টুশির অবশ্যি কিছুই মনে নেই–জ্ঞান হবার পর থেকে দেখছে একটা বিশাল বাড়িতে সে আর তার নানা।
বাড়ি দেখাশোনার জন্যে অবশ্যি ইদরিস মিয়া নামে একজন পাহারাদার আছে–সে এত দুবলা যে টুশি পর্যন্ত ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দিতে পারবে। কিন্তু ইদরিস মিয়ার গলার জোর সাংঘাতিক, যে-কোনো সময়ে সে চিৎকার করে মানুষের কানের পরদা ফাটিয়ে ফেলতে পারে, সেইজন্যে মনে হয় তাকে কেউ ঘটায় না। এ ছাড়াও বাসায় আছে জমিলার মাসে ইদরিস মিয়ার একেবারে উলটো, পেটে বোমা মারলেও তার মুখ দিয়ে একটা শব্দ বের হয় না। জমিলার মায়ের হাতে অবশ্যি জাদু আছে–সে যদি কেরোসিন তেল দিয়ে মাছ ভাজা করে তা হলেও মনে হয় সেই মাছ ভাজার স্বাদ হবে অমৃতের মতো। টুশি তার নানা আর এই দুজনকে নিয়ে এই বিশাল বাড়িতে বড় হয়েছে। মানুষ একা একা বড় হলে মনে হয় একটু আজব হয়ে যায়, টুশিও হয়েছে যদিও সে নিজে সেটা জানে না। স্কুলের বন্ধু বান্ধবেরা তাকে নিয়ে মাঝে মাঝে হাসাহাসি করে–টুশি অবশ্যি সেগুলো একেবারেই পাত্তা দেয় না–আজব হয়ে যাবার মনে হয় এটা আরেকটা লক্ষণ অন্যেরা কী ভাবছে সেটাকে কোনো পাত্তা না দেওয়া।
বড় সিন্দুক খোলার উত্তেজনায় টুশি তার নানার হাত ধরে দোতালার সিঁড়ি দিয়ে দুদ্দাড় করে ছুটে যাচ্ছিল, নানা তখন তাকে থামালেন, বললেন, “আস্তে, পাগলি মেয়ে আস্তে। আমি কি আর তোর মতো দৌড়াতে পারি?”
“কেন পার না?”
“আমার কি সেই বয়স আছে?”
নানার কথা শুনে টুশি ঘুরে তার দিকে তাকাল, নানা নিশ্চয়ই বুড়ো মানুষ, কিন্তু তাকে কখনওই টুশির বুড়ো মনে হয় নি। নানা যখনই নিজেকে বুড়ো বলে দাবি করেন তখনই টুশি আপত্তি করে, এবারেও করল, বলল, “তোমার আর এমন কী বয়স হয়েছে? তোমার যত বয়স রোনাল্ড রিগান সেই বয়সে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হয়েছিল।”
নানা মাথা নাড়লেন, বললেন, “আমেরিকাতে সব সম্ভব। ঐ দেশে সব পাগল। বুড়োকে প্রেসিডেন্ট বানিয়ে দেয়, স্কুল-পালানো পোলাপান হয় বিলিওনিয়ার!”
দোতালার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে নানা মাঝখানে দাঁড়িয়ে বড় বড় কয়েকটা নিশ্বাস নিয়ে বললেন, “বুঝলি টুশি”।
“কী?”
“আমি বলছিলাম কি–”
কিন্তু নানা কিছু না বলে খুব নির্মমভাবে দাড়ি চুলকাতে লাগলেন। নানা যখনই কোনো সমস্যায় পড়ে যান তখন এভাবে দাড়ি চুলকাতে থাকেন। টুশিকে নিয়ে একবার কান্তজীর মন্দির দেখতে গিয়েছিলেন, ট্রেনে উঠে আবিষ্কার করলেন মানিব্যাগ-টিকিট সবকিছু বাসায় ফেলে এসেছেন, তখন ঠিক এইভাবে ঘ্যাস ঘ্যাস করে দাড়ি চুলকাতে শুরু করলেন। টুশি খানিকক্ষণ নানার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “নানা, তোমার দাড়িতে উকুন হয়েছে নাকি?”
নানা দাড়ি চুলকানো বন্ধ করে বললেন, “কেন, উকুন কেন হবে? দাড়িতে কখনও উকুন হয় না জানিস না?”
“তা হলে এভাবে দাড়ি চুলকাচ্ছ কেন?”
“কে বলছে দাড়ি চুলকাচ্ছি?” বলে নানা অন্যমনস্কভাবে আবার দাড়ি চুলকাতে শুরু করলেন।
টুশি নানার হাত ধরে বলল, “কী হয়েছে তোমার?”
নানা একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “না, মানে মাঝে মাঝে তোকে নিয়ে খুব চিন্তা হয়।”
টুশি ভুরু কুচকে বলল, “আমার কী নিয়ে চিন্তা হয়?”
“এই যে–এই যে–মানে এই-যে–” নানা আবার দাড়ি চুলকাতে লাগলেন।
টুশি অধৈর্য হয়ে নানার হাত ধরে টান দিয়ে বলল, “কী যে? পরিষ্কার করে বলো।”
নানা একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বললেন, “আমি মরে গেলে তোর কী হবে?”
টুশি চোখ কপালে তুলে বলল, “তুমি মরে যাবে কেন?”
নানা হা হা করে হেসে বললেন, “মানুষ বুড়ো হয়ে যে মারা যায় তুই জানিস না?”
“তুমি কি বুড়ো হয়েছ নাকি?”
নানা হাত তুলে বললেন, “ঠিক আছে ঠিক আছে, আমি বুড়ো হই নাই। কিন্তু কম বয়সী মানুষ মারা যায় না? তোর বাবা-মা মারা যায় নাই?”
“সেটা তো অ্যাকসিডেন্ট।”
“আমার কখনও অ্যাকসিডেন্ট হতে পারে না?”
টুশি এবারে সোজাসুজি উত্তর দিতে পারল না, বলল, “চেষ্টা করো যেন অ্যাকসিডেন্ট না হয়। সাবধানে থাকো।”
নানা সিঁড়ি দিয়ে দোতালায় উঠতে উঠতে আবার ঘ্যাস ঘ্যাস করে দাড়ি চুলকাতে লাগলেন। টুশি চোখের কোনা দিয়ে নানাকে লক্ষ করে বলল, “কী বলতে চাইছ বলে ফেলো।”
নানা একটু অবাক হয়ে বললেন, “আমি কিছু বলতে চাই তুই কেমন করে জানিস?”
“যখন তুমি কিছু বলতে চাও কিন্তু ঠিক জান না কীভাবে বলবে তখন তুমি এইভাবে ঘ্যাস ঘ্যাস করে দাড়ি চুলকাও।”
নানা দাড়ি চুলকানো বন্ধ করে বললেন, “তাই নাকি?”
“হ্যাঁ।”
নানা খানিকক্ষণ টুশির দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “তুই ঠিকই ধরেছিস। কয়দিন থেকেই তোক একটা কথা বলব ভাবছি।”
“কী কথা?”
নানা দোতালার বারান্দা দিয়ে হেঁটে সিন্দুকের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে চাবি দিয়ে তালা খুলতে খুলতে বললেন, “তুই স্বীকার করিস আর না-ই করিস–আমি আসলে বুড়ো হয়েছি, যে-কোনো দিন মরে যাব, তখন তোর কী হবে?”
টুশি ভয়ে ভয়ে নানার দিকে তাকাল, বলল, “কী হবে?”
“তা ছাড়া তোর মতো এরকম হাট্টা-কাট্টা-টাটকা-মাটকা একটা মেয়ে আমর মতো বুড়ো মানুষের সাথে থাকবে সেটাও ঠিক না। একেবারেই ঠিক না–”
টুশি চোখ পাকিয়ে কিছু-একটা বলতে যাচ্ছিল, নানা সুযোগ দিলেন না, বললেন, “আসলে তোর যেটা দরকার সেটা হচ্ছে একটা ফ্যামিলি। যেখানে বাবা মা আছে, ভাই-বোন আছে, বাচ্চাকাচ্চা আছে। সত্যিকারের একটা ফ্যামিলি।”
“ফ্যামিলি?”
“হ্যাঁ।”
“ফ্যামিলি কি ভাড়া পাওয়া যায়? তুমি কি ভাড়া করবে?”
নানা আবার হা হা করে হাসলেন, বললেন, “না পাগলি মেয়ে, ফ্যামিলি ভাড়া পাওয়া যায় না। কিন্তু খুঁজে বের করা যায়।” একটু থেমে বললেন, “আমি খুঁজে বের করেছি।”
টুশি একেবারে ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো চমকে উঠল, চিৎকার করে বলল, “কী বললে তুমি? কী বললে?”
সিন্দুকের ঘরে ঢুকে লাইট জ্বালিয়ে নানা বললেন, “বলেছি যে তোর জন্যে একটা ফ্যামিলি ঠিক করেছি। সত্যিকারের ফ্যামিলি। একটা বাবা-মা আর ছোট একটা ভাই। তুই তাদের সাথে থাকবি।”
টুশি নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না, খানিকক্ষণ বিস্ফারিত চোখে নানার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বাঘের মতো গর্জন করে বলল, “তুমি আমার জন্যে একটা ফ্যামিলি ঠিক করেছ? আমি কী তোমার এত ঝামেলা করছি যে আমাকে বিদায় করে দিতে হবে?”
নানা অপ্রস্তুত হয়ে ঘ্যাস ঘ্যাস করে দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বললেন, “আহা হা–রাগ করিস না, পাগলি মেয়ে। আমি কী তোকে বিদায় করে দিতে চাইছি? তুই ছাড়া আমার কে আছে! কিন্তু আমি যদি মরে যাই”।
টুশি হুংকার দিয়ে বলল, “তুমি মরবে না।”
নানা হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, “ঠিক আছে আমি মরব না।”
“অন্য একটা ফ্যামিলি আমাকে নেবে কেন? কালো কুচ্ছিৎ একটা মেয়ে আমি–আমাকে দেখলে মানুষ দৌড়ে পালায়”
নানা টুশির ঘাড় ধরে একটা মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “বাজে কথা বলবি না, ঘাড় ভেঙে ফেলব।”
“কখন বাজে কথা বললাম? আমার চেহারা যে কালো কুচ্ছিৎ তুমি জান না?” নানা টুশির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “ছি টুশি ছি! এইভাবে কথা বলে না।
তোর গায়ের রংটা হয়তো ফরসা না কিন্তু তুই কালো কুচ্ছিৎ হবি কেন? আমার কাছে তুই হচ্ছিস পৃথিবীর সবচেয়ে রূপসী মেয়ে–”
“আমাকে দেখে দেখে তোমার অভ্যাস হয়ে গেছে তাই এই কথা বলছ। সেদিন কী হয়েছে জান?”
“জানি না।” নানা ভয়ে ভয়ে বললেন, “কী হয়েছে?”
“স্কুল থেকে আসার সময় একটা রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম যাবে কি না, সে রাজি হল না। সায়মা এসে জিজ্ঞেস করতেই রাজি হয়ে গেল। কেন রাজি হল জান? কারণ আমার চেহারা খারাপ, সায়মার চেহারা ভালো।”
“ধুর বোকা মেয়ে!” নানা হাত দিয়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দিয়ে বললেন, “পাগলি মেয়ে। কী বলতে কী বলিস! যত্তো সব–”
টুশি মুখ শক্ত করে বলল, “যাদের চেহারা ভালো না তাদের মনে অনেক কষ্ট থাকে, বুঝেছ? আমার চেহারা যদি খুব সুন্দর হত তোমার সেই ভাড়া-করা ফ্যামিলি আমাকে দেখে বলত, আহা, টুশি কী ভালো মেয়ে! এই ভালো মেয়েটাকে আদর করে যত্ন করে নিজের মেয়ের মতো করে রাখব। এখন আমাকে দেখে কী বলবে জান?”
নানা জানতে চাচ্ছিলেন না, কিন্তু টুশি তাকে সুযোগ দিল না, মেঘের মতো গর্জন করে বলল, “এখন আমাকে দেখে বলবে, এই মেয়েটা দেখতে এত খারাপ, এর স্বভাবও নিশ্চয়ই খারাপ। পাজি এই মেয়েটাকে আচ্ছামতো শিক্ষা দিতে হবে। টাইট করে ছেড়ে দিতে হবে।”
নানা একধরনের আতঙ্ক নিয়ে টুশির দিকে তাকিয়ে রইলেন, খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বললেন, “এইজন্যে বলছিলাম তোর থাকা দরকার একটা সত্যিকার ফ্যামিলির সাথে। যেখানে সত্যিকারের বাবা আছে, মা আছে, ছোট ভাই আছে। আমার মতো বুড়ো মানুষের সাথে থেকে তোর কী ক্ষতি হয়েছে দেখেছিস?”
“কী ক্ষতি হয়েছে?”
“তুই কথা বলিস বুড়ো মানুষের মতো। তুই চিন্তা করিস বুড়ো মানুষের মতো। কয়দিন পরে তোর চেহারাও হয়ে যাবে বুড়ো মানুষের মতো–”
টুশি এবারে হি হি করে হেসে বলল, “কী মজা হবে তখন, তাই না?”
নানা একটু রেগে বললেন, “ঠাট্টা করবি না। সিরিয়াস একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছি তার মাঝে ফাজলেমি করবি না।”
“কখন আবার আমি ঠাট্টা করলাম?” টুশি ঘরের মাঝামাঝি রাখা বিশাল কালো সিন্দুকের কাছে গিয়ে বলল, “এখন এটা খোলো।”
নানা বিশাল লম্বা একটা চাবি বের করে বললেন, “একশ বছর যে-তালা খোলা হয় নাই সেটা কি এত সহজে খোলা যাবে? দেখা যাক চেষ্টা করে।”
“খুলতে না পারলে তালা ভেঙে ফেলব।”
নানা বিশাল তালাটা দেখিয়ে বললেন, “এটা ভাঙা কি সোজা কথা? বোমা মেরেও এই তালা ভাঙা যাবে না!”
টুশি কালো সিন্দুকটার উপরে কৌতূহল নিয়ে একবার হাত বুলিয়ে দেখে, শক্ত কাঠের সিন্দুক, কাঠের মাঝে বিচিত্র একধরনের নকশা, এরকম একটা সিন্দুক তৈরি করতে কত দিন লেগেছে কে জানে! টুশি নিশ্বাস আটকে রেখে বলল, “ভিতরে কী আছে নানা?”
“আমি কী করে বলল?”
“তুমি কখনও খুলে দেখনি?”
“নাহ্!”
“কেন? তোমার দেখার ইচ্ছা হয় নাই?”
“নাহ্! আমার বাবা যখন ছোট ছিল তখন আমার দাদা এই সিন্দুকটা শেষবার খুলে বন্ধ করে রেখেছে। বলা হয়েছে আর যেন খোলা না হয়। আর খোলাও হয় নাই।”
টুশি চোখ বড় বড় করে বলল, “খুললে কী হবে?”
“আগের যুগের মানুষের অনেক রকম কুসংস্কার থাকে তো সে রকম একটা কুসংস্কার আর কি! ভিতরে নাকি অভিশাপ দেয়া জিনিস আছে।”
“আচ্ছা নানা, আমরা যদি খুলে দেখি ভিতরে একটা নরকঙ্কাল তা হলে কী করব?”
নানা মাথা চুলকে বললেন, “পুলিশকে খবর দিতে হবে মনে হয়।”
“আর যদি দেখি কলসি কলসি সোনা?”
“তা হলেও মনে হয় পুলিশকে খবর দিতে হবে!”
টুশি উত্তেজনায় বড় বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, “আমি আর অপেক্ষা করতে পারছি না। তাড়াতাড়ি খোলো।”
নানা তালায় বড় চাবিটা ঢুকিয়ে খোলার চেষ্টা করতে লাগলেন। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পর যখন খুলতে না পেরে হাল ছেড়ে দিচ্ছিলেন তখন হঠাৎ ঘঠাং করে তালাটা খুলে গেল। টুশি উত্তেজনায় নিশ্বাস নিতে পারে না। নানা তালাটা খুলে সিন্দুকটার ডালা টেনে উপরে তোলেন, কাঁচ ক্যাচ করে একটা শব্দ হল এবং সিন্দুকের ভেতর থেকে একটা ভ্যাপসা গন্ধ বের হয়ে এল। ডালাটা পুরোপুরি খুলে টুশি আর নানা একসাথে ভিতরে উঁকি দেয় এবং একেবারে হতবাক হয়ে যায়। ভিতরে কিছু নেই।
টুশি অবাক হয়ে একবার সিন্দুকের ভিতরে আরেকবার তার নানার দিকে তাকাল, বলল, “ভিতরে দেখি কিছু নাই!”
নানা মাথা চুলকালেন, বললেন, “তা-ই তো দেখছি!”
“তোমার দাদা আমাদের এপ্রিল ফুল করেছে।”
“সেরকমই তো মনে হচ্ছে।”
টুশি আবার ভিতরে উঁকি দিয়ে বলল, “দাঁড়াও। একেবারে খালি নয়। ঐ দেখো, কী যেন একটা আছে!”
নানা আবার উঁকি দিলেন, সত্যিই এক কোনায় ছোট কী-একটা আছে, আলো পড়ে চকচক করছে। নানা উবু হয়ে ধরার চেষ্টা করে নাগাল পেলেন না–তখন টুশি ঝুঁকে পড়ে জিনিসটা তুলে আনল।
“কী এটা?”
টুশি জিনিসটার দিকে তাকিয়ে বলল, “একটা ছোট বোতল।”
“বোতল?” নানা হাত বাড়িয়ে বললেন, “দেখি।”
টুশি বোতলটা নানার হাতে দিল, নানা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে টুশির হাতে ফেরত দিয়ে বললেন, “আশ্চর্য! এত বড় একটা সিন্দুকে এইটুকুন একটা বোতল? এটাকে বোতল না বলে বলা উচিত শিশি।”
টুশি ভালো করে ছোট বোতলটা দেখল। বেশ ভারী, মনে হয় পাথরের তৈরি, কালচে রং–ভিতরে কিছু আছে কি না বোঝা যায় না। মুখটা খুব ভালো করে বন্ধ করা আছে। মনে হয় কেউ ঝালাই করে লাগিয়েছে। বোতলটা দেখতেও বেশ অদ্ভুত, পারফিউমের যেমন আজব ধরনের শিশি থাকে অনেকটা সেরকম। টুশি হাতে নিয়ে কয়েকবার ঝাঁকিয়ে বলল, “ভিতরে কী আছে নানা?”
নানা ততক্ষণে পুরো ব্যাপারটাতে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন। সিন্দুকের ডালাটা বন্ধ করতে করতে বললেন, “এইটুকুন বোতলে কী আর হাতি-ঘোড়া থাকবে?”
“খুলে দেখি?”
“দ্যাখ।”
টুশি তখন ছিপিটা খোলার চেষ্টা করল, কিন্তু খুব শক্ত করে লাগানো, খোলা খুব সহজ হল না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিল। নানা বললেন, “ইদরিসকে দিস, খুলে দেবে।”
টুশি বলল, “আমি যদি না পারি ইদরিস ভাইও পারবে না। ইদরিস ভাইয়ের গায়ে কোনো জোর আছে নাকি?”
“তা ঠিক।” নানা হেসে বললেন, “তা হলে জমিলার মা’কে দিস, ঠিক খুলে দেবে।”
নানা আবার সিন্দুকে তালাটা লাগিয়ে বললেন, “কী কাণ্ড! একশ বছরের একটা রসিকতা।”
টুশি চোখ বড় বড় করে বলল, “নানা, এমন কি হতে পারে যে এই সিন্দুকের ভিতরে একটা ভূত আটকে ছিল এখন সেটা বের হয়ে গেছে! আমরা ঘুমালেই কটাশ করে আমাদের ঘাড় মটকে দেবে?”
“ঘাড় মটকাতেই যদি পারে তা হলে ঘুমানো পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে কেন?” নানা বললেন, “জেগে থাকলেও ঘাড় মটকাতে পারবে।”
টুশি নিজের ঘাড়ে হাত বুলিয়ে বলল, “আসুক না আমার ঘাড় মটকাতে, আমি উলটো ভূতের ঘাড় মটকে ছেড়ে দেব না!”
নানা টুশির দিকে তাকিয়ে বললেন, “তা তুই পারবি।”
“আচ্ছা নানা ভূতটা তো ভালো ভূতও হতে পারে। খুব সুইট একটা ভূত। মায়া-মায়া চেহারা। হতে পারে না?”
“তুই যখন বলছিস হতেও তো পারে। আমি তো আর ভূতের এক্সপার্ট না। তুই হচ্ছিস ভূতের এক্সপার্ট।”
টুশি মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ, যদি খুব সুইট একটা ভূত এসে বলে, তুমি কী চাও? তা হলে আমি কী বলব জান?”
নানা বললেন, “না, জানি না। কী বলবি?”
“বলব, আমার চেহারাটা সুন্দর করে দাও। এমন সুন্দর করে দাও যেন যে-ই দেখে সে-ই ট্যারা হয়ে যায়।”
নানা টুশির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “তোর চেহারা এমনিতেই খুব সুন্দর আছে”
“ছাই আছে, কচু আছে।” টুশি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “ভূত যদি তোমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করে তুমি কী চাও, তা হলে তুমি কী বলবে নানা?”
“আমি? আমি বলব আমার নাতনির যে গরম মেজাজ সেটাকে ঠাণ্ডা করে দাও–যেন সে দিনরাত ক্যাট ক্যাট ক্যাট ক্যাট না করে!”
টুশি নানাকে একটা ছোট ধাক্কা দিয়ে বলল, “বাজে কথা বলো না, আমার মেজাজ মোটেও গরম না–আমি মোটেও দিনরাত ক্যাট ক্যাট করি না। ঠিক করে বলো তুমি কী চাইবে। প্লিজ।”
নানা দাড়ি চুলকালেন তারপর মাথা চুলকালেন তারপর বললেন, “আমি বলব, আমার নাতনি টুশি যেন খুব ভালো একটা ফ্যামিলিতে বড় হতে পারে–যে ফ্যামিলি তাকে একেবারে নিজের বাচ্চার মতো করে দেখে। আমি তা-ই চাইব।”
টুশি তার নানার দিকে তাকাল, তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “না, নানা। সেটা হবে না। আমি কোনো ফ্যামিলির সাথে থাকব না। আমি থাকব তোমার সাথে। তার মানে কী জান?”
“কী?”
“আমি যতদিন বড় না হচ্ছি তুমি মারা যেতে পারবে না।”
“মারা যেতে পারব না?”
“না।”
নানা হাসি গোপন করে বললেন, “এটা কি তোর আদেশ।”
“হ্যাঁ আমার আদেশ।”
.
টুশির এরকম কঠিন একটা আদেশ দিয়েও অবশ্যি লাভ হল না। তার নানা এক বছরের মাথায় মারা গেলেন, টুশিকে যেতে হল তার নানার ঠিক করে রাখা পরিবারটির সাথে। যেদিন এই বড় বাড়িটি ছেড়ে যাচ্ছিল সেদিন জানালায় মাথা রেখে খুব কাঁদল টুশি। তারপর চোখ মুছে তার ছোট ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে বের হয়ে এল। ঘর থেকে বের হবার সময় কী মনে করে টেবিল থেকে ছোট বিচিত্র আকারের কালচে রঙের বোতলটা নিয়ে নিল টুশি।
আমাদের কাহিনী শুরু হল সেই থেকে।