পূর্বপার্বতী – প্রফুল্ল রায়
PURBAPARBATI –A Bengali Novel By PRAFULLA Roy Published by Sudhangshu Sekhar Dey, Deys Publishing
প্রথম প্রকাশ : ভাদ্র ১৩৬৪, সেপ্টেম্বর ১৯৫৭, প্রথম দেজ সংস্করণ বৈশাখ ১৩৮৫, এপ্রিল ১৯৭৮ পঞ্চম রাজ সংস্করণ : মাঘ ১৪১৫, জানুয়ারি ২০০৯
.
অগ্রজপ্রতিম শ্ৰীসাগরময় ঘোষ পরম শ্রদ্ধাস্পদে
.
লেখকের কথা
আমি উপন্যাসে ভূমিকার পক্ষপাতী নই। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভূমিকা অপরিহার্য। পূর্বপার্বতী এরকম একটি ক্ষেত্র।
ভারত সীমান্তের নাগা উপজাতির জীবনযাত্রা ভিত্তি করে এই উপন্যাস রচিত হয়েছে।
নাগাদের মধ্যে গোষ্ঠী এবং বংশগত অসংখ্য ভাগ ও ভেদ রয়েছে। নানা ভাষা এবং উপভাষার প্রচলন আছে। সমাজব্যবস্থা, উৎসব এবং ধর্মাচরণের আনুষঙ্গিক রীতিও সর্বত্র এক নয়। তা সত্ত্বেও সামগ্রিকভাবে (স্বল্পসংখ্যক শিক্ষাপ্রাপ্ত ছাড়া) সকল শ্রেণীর নাগার মধ্যে আদিম বন্য চরিত্রের উপাদানগুলি মূলতঃ অভিন্ন। লালসা, প্রতিহিংসা, তীব্র রতিবোধ, হিংস্রতা প্রভৃতি প্রবণতাগুলির প্রকাশভঙ্গিতে তেমন কোনো তফাত নেই।
নাগাভূমি। সংখ্যাতীত পাহাড়মালা, দুর্গম অরণ্য, নদী-জলপ্রপাত ঝরনা-মালভূমি উপত্যকা দিয়ে ঘেরা সীমান্তের এই দেশটি সমতলের বাসিন্দাদের কাছে অপরিসীম বিস্ময়ের বিষয় হয়ে রয়েছে। শ্বাপদসঙ্কুল এই দেশটিতে মানুষের জীবনযাত্রা কিরকম, তাদের সমাজ কোন নীতিতে চলে, কৌলিক ও সামাজিক আচার-আচারণ কেমন–এ সব সম্পর্কে কৌতূহলের অন্ত নেই।
নাগা পাহাড়ের নিসর্গরূপ অপূর্ব। ভয়ঙ্কর এবং সুন্দরের এমন সার্থক স্বচ্ছন্দ মিশ্রণ ভারতের অন্য কোথাও আছে কিনা সন্দেহ।
নাগাদের জাতীয় জীবনের প্রাথমিক ইতিহাস বর্ণাঢ্য। যুথচারী মানুষগুলির গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে, বংশে বংশে সংঘাত, প্রতিহিংসা, নারী ও ভূমি আয়ত্ত করার উত্তেজনায় প্রতিটি মুহূর্ত রোমাঞ্চকর। এদের উৎপত্তি সম্বন্ধে প্রচুর রূপকথা ও উপকথা ছড়িয়ে আছে।
কিন্তু গত কয়েক দশকের ইতিহাস শুধু বর্ণময়ই নয়, বেগবানও। ইংরেজদের অভিযান, খ্রিস্টান মিশনারি, সমতলের বেনিয়া ও সরকারি এবং বেসরকারি কর্মচারীদের দৌলতে ভারতবর্ষের মুক্তি আন্দোলনের খবর আসা, দ্বিতীয় মহাসমর, স্বাধীনতা, ফিজোর অভ্যুত্থান–নাগা পাহাড়ে প্রতি মুহূর্তে উন্মাদনা, নিমেষে নিমেষে দৃশ্যপট পরিবর্তন।
সময়ের চতুর কারসাজি সত্ত্বেও নাগা-মনের মৌলিক বৃত্তিগুলি এখনও বিশেষ বিকৃত হয় নি।
পূর্বপার্বতী জাতিতত্ত্বের গবেষণা নয়; নাগাদের কাম-লালসা-হিংসা, ন্যায়-অন্যায় বোধ এবং জীবনের দ্রুত পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে ইতিহাসভিত্তিক উপন্যাস।
নাগাদের অগণ্য গোষ্ঠীগুলির মধ্যে থেকে একটিকে বেছে নিয়ে তাদের অখণ্ড এবং সমগ্র জীবনবোধকে এই উপন্যাসে রূপ দেওয়া হয়েছে।
সুবৃহৎ আয়তন এবং সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার দিকে লক্ষ্য রেখে গ্রন্থটিকে দু’টি স্বয়ংসম্পূর্ণ পর্বে প্রকাশ করার ব্যবস্থা হয়েছে। বর্তমানে প্রথম পর্বটি প্রকাশিত হল।
শুধু পাদপ্রদীপের জলুসই নয়, নেপথ্যের আয়োজনটুকু পাঠকসমাজকে জানানো প্রয়োজন।
এই গ্রন্থ রচনার প্রথম প্রেরণা দিয়েছিলেন অগ্রজপ্রতিম শ্ৰীসাগরময় ঘোষ। নাগা পাহাড়ে পাঠানো থেকে শুরু করে উপন্যাসটির নামকরণ এবং প্রতিটি ছত্রে তাঁর স্নেহ ও আন্তরিকতার প্রীতিপ্রদ উত্তাপ অনুভব করি। তার সঙ্গে আমার সম্পর্ক সম্পাদক লেখকের গণ্ডি পেরিয়ে ঘনিষ্ঠতা বিচারের বহু মাপকাঠি ডিঙিয়ে গিয়েছে। আমার সাহিত্যিক জীবনে তার অফুরন্ত উৎসাহের উৎস হয়ে থাকার কথাটি স্মরণ করে ঋণ পরিশোধের দুঃসাহস করব না।
এর পরেই যাঁর নাম করতে হয় তিনি শিলংয়ের শ্ৰীহেমন্তকুমার গুপ্ত। হেমন্তবাবু আমার অশেষ শ্রদ্ধাভাজন। এই একনিষ্ঠ সাংবাদিক ও নির্যাতিত দেশপ্রেমীর কাছে গ্রন্থটির জন্য অজস্র অমূল্য উপকরণ এবং পরামর্শ পেয়েছি। এ প্রসঙ্গে তার পরিবারের প্রতিটি ব্যক্তির সস্নেহ সহৃদয়তা ও শিলংয়ের কয়েকটি আশ্চর্য সুন্দর দিন তাদের মধ্যে কাটাবার কথা মনে রেখে কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
আমার পরম শ্রদ্ধাস্পদ সুসাহিত্যিক শ্রীভবানী মুখোপাধ্যায় ও শ্রীনন্দগোপাল সেনগুপ্তের ঋণ এই সূত্রে স্বীকার করি।
লামডিংয়ের শ্রীপ্রাণবল্লভ তালুকদার ও তার পরিবার, ডিমাপুরের শ্রীমহাদেব কাকতি, কোহিমার শ্রীডেকা, শ্রীসেনগুপ্ত, মোককচঙের শ্রীমথুরপ্রসাদ সিংহ, মি.সেমা, মি,আও, মি.গ্ৰীয়ারসন এবং ইম্ফলের শ্ৰথম্বাল সিং, শ্ৰীগিরিধারী ফুকন, শ্রীগোস্বামী ও শ্রীসত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বিচার সহায়তার কথা উল্লেখযোগ্য।
সেই তিনটি পাহাড়ী সর্দার, যারা দিনের পর দিন, রাতের পর রাত আমাকে তাদের জীবনকথা, রূপকথা, উপকথা এবং অসংখ্য উপাদান যুগিয়ে পূর্বপার্বতী রচনা সম্ভব করেছে তাদের কাছে আমার ঋণ পর্বতপ্রমাণ। এই সঙ্গে সেই নাম-প্রকাশে অনুচ্ছিক দোভাষী বন্ধুটি এবং আবাল্যসুহৃদ শ্ৰীচিন্ময় ভট্টাচার্য ও শ্রীঅর্ধেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সহায়তার কথা স্মরণ করি।
দেশ পত্রিকায় এই গ্রন্থ প্রকাশকালে যেসব সহৃদয় পাঠক-পাঠিকা চিঠি দিয়ে আমার উৎসাহ বর্ধন করেছিলেন, নানা কারণে স্বতন্ত্রভাবে তাদের উত্তর দেওয়া সম্ভব হয় নি। এই সুযোগে মার্জনা চেয়ে তাদের ধন্যবাদ জানাই।
প্রফুল্ল রায়
বাটানগর
২০ ভাদ্র : ১৩৬৪
.
প্রকাশকের নিবেদন
পূর্বপার্বতী প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৫৭ সালের সেপ্টেম্বরে। প্রকাশক ছিলেন বেঙ্গল পাবলিশার্স। কয়েকটি সংস্করণ নিঃশেষিত হওয়ার পর অন্য একটি প্রকাশন-সংস্থা থেকে এটি বেরোয় এবং আরো কয়েকটি সংস্করণের পর আমরা এই ধ্রুপদী উপন্যাসটি প্রকাশ করি। আমাদের প্রতিষ্ঠান থেকে চারটি মুদ্রণ শেষ হয়েছে। বর্তমানে আগাগোড়া পরিমার্জিত হয়ে সুদৃশ্য রয়াল সাইজে এটির সুমুদ্রিত, শোভন রাজ সংস্করণ প্রকাশিত হল।
একান্ন বছর আগে প্রথম প্রকাশকালে পূর্বপার্বতীর প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন বম্বেপ্রবাসী প্রখ্যাত শিল্পী আশু বন্দ্যোপাধ্যায়। অনেকদিন হল তিনি প্রয়াত। শিল্পীর সম্মানে তার অনবদ্য প্রচ্ছদটি দিয়ে সাজিয়ে পূর্বপার্বতীর রাজ সংস্করণ পাঠককে উপহার দেওয়া হল।
বেঙ্গল পাবলিশার্স-এর সৌজন্যে এটি সম্ভব হয়েছে।
সুধাংশুশেখর দে
.
কাহিনি
১.
পাহাড়ী উপত্যকা। ভেরাপাঙ গাছের ছায়াতল দিয়ে বিশাল একটা চড়াই-এর দিকে উঠে গিয়েছে। ভেরাপাঙ আর জীমবো গাছ। ঘনবদ্ধ। পাহাড়ের তামাভ মাটি থেকে কণা কণা প্রাণ সঞ্চয় করে উদ্দাম হয়ে উঠেছে এই অরণ্য। মাঝে মাঝে সাঙলিয়া লতার ছায়াকুঞ্জ। যেখানেই একটু র পেয়েছে সেখানেই পাথুরে মাটি চৌফালা করে মাথা তুলেছে আখুশি আর খেজাঙের। ঝোঁপ। আতামারী লতা সাপের মতো বেয়ে বেয়ে উঠে গিয়েছে খাসেম গাছের মগডালে।
উদ্দাম বন। কাঁটালতার জটিল বাঁধনে বাঁধনে কুটিল হয়ে রয়েছে। রোদ, বৃষ্টি আর অবারিত বাতাস থেকে স্বাস্থ্য আহরণ করে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে।
পাহাড়িয়া অরণ্য। ভয়াল আর ভয়ঙ্কর। এতটুকু ফাঁক নেই, এতটুকু রন্ধ্র নেই। শুধু মৃত্যুর মতো আশ্চর্য এক হিমছায়া নিথর হয়ে রয়েছে তার পাঁজরের নিচে। সবুজ আর সবুজ। একটা তরঙ্গিত সবুজ সমুদ্র স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে কোনো পাহাড়ী ডাইনির কুহকে।
ভীষণ এই পাহাড়িয়া বন। তবু মেশিহেঙ ঝোঁপের বাহারি ফুলে এই নিষ্ঠুর বন্যতার মধ্যে কিছুটা স্নেহের আভাস পাওয়া যায়। কিছুটা শান্তি আছে সোনা গাছের নরম নরম মুকুলে।
অনেক দূরে বৃত্তাকারে বাঁক নিয়েছে টিজু নদী। ঘন নীল জল। রাশি রাশি পাথরের বাধাকে কলোল্লাসে মাতিয়ে মাতিয়ে, ফেনার ফুলকি ফুটিয়ে ফুটিয়ে, বাঁকে বাঁকে হারিয়ে গিয়েছে। এখান থেকে নীল হাঁসুলির একটা চকিত ঝিলিকের মতো মনে হয় টিজু নদীকে। এই পাহাড়ী বনের কোথাও কোনো খাড়াই টিলার ওপর থেকে উচ্ছ্বসিত হয়ে নেমেছে জলপ্রপাত। কোথাও বা সাপেথ কুঞ্জের পাশ দিয়ে শব্দহীন ঝরনা রেখার আঁকিবুকি টেনে নিচের দিকে মিলিয়ে গিয়েছে। দূরের ওই টিজু নদীর উচ্ছ্বাস, অজানা প্রপাতের এই কল কল উল্লাস–এগুলিই এই পাহাড়ী বনের হৃৎপিণ্ড হয়ে অহরহ বেজে চলেছে।
শীতের রোদে মধুর আমোদ আছে। সেই রোদই সোনালি আমেজের মতো ছড়িয়ে পড়েছে উপত্যকায়। সবুজ সমুদ্রটা রোদের অকৃপণ সোনা মেখে রূপময় হয়ে উঠেছে।
ওপরে অবারিত আকাশ। তার নীল রঙে আশ্চর্য ক্রুরতা। কোথাও দু-এক টুকরো মেঘের ভ্রুকুটি ভেসে বেড়াচ্ছে। অনেক উঁচুতে পাহাড়ের চড়াইটা ঘিরে এখনও সাদা কুয়াশার একটা চিকন রেখা স্থির হয়ে আছে।
বাঁ দিকে অবিন্যস্ত ওক বন আর আপুফু গাছের জটিল জটলা। হঠাৎ তার মধ্য থেকে যুঁড়ে বেরিয়ে এল দু’টি বন্য মানুষ। ঘন তামাভ গায়ের রং। বিশাল বুকে, অনাবৃত বাহুসন্ধির দিকে থরে থরে পেশীভার উঠে গিয়েছে। স্ফীত নাক, মোটা মোটা ঠোঁট। ওদের ভাসা ভাসা পিঙ্গল চোখের মণিতে আদিম হিংস্রতা। কানের ওপর দিয়ে সারা মাথায় চক্রাকার রেখা টেনে চুল কামানো। খাড়া খাড়া উদ্ধত চুল দু’টি কান আর ঘাড়ের ওপর কিছু কিছু ছড়িয়ে পড়েছে। বিরাট থাবায় দুজনেই মুঠো করে ধরেছে জীমবো পাতার মতো তীক্ষ্ণমুখ বর্শা। মোটা মোটা আঙুলের মাথায় ধারাল নখ। বর্শার লম্বা বাঁশে সেই নখগুলি স্থির হয়ে বসেছে। সারা মুখে দাড়িগোঁফের চিহ্নমাত্র নেই। গাল, চিবুক আর গলা থেকে তাদের নির্মূল করা হয়েছে। কানে। পিতলের গোলাকার গয়না। সারা দেহ অনাবরণ। একজনের কোমরের চারপাশে হাতখানেক চওড়া পী মুঙ কাপড়। গাঢ় কালো রঙের প্রান্তে ঘন লালের আঁকিবুকি। পরিষ্কার কৌমার্যের সংকেত। আর একজনের পরনে জঙগুপি কাপড়, একেবারে জানু পর্যন্ত নেমে এসেছে। ঘন নীল রঙের ওপর চারটে সাদা সাদা দাগ। সাদা দাগের আড়াআড়ি চারটে লাল রেখা আঁকা। বিবাহিতের পরিচয়। সেই সঙ্গে বোঝা যায়, মানুষটা প্রিয়জনদের অনেকগুলো ভোজ দিয়ে জঙগুপি বস্ত্রের সম্মান অধিকার করেছে।
সামনেই একটা বাদামি রঙের বিশাল পাথর। চারপাশে পাংশু ঘাসে পাহাড়ী রুক্ষতা। ঘাসের পাতায় পাতায় রাত্তিরে শিশির ঝরেছিল। সেই শিশিরকণা শুভ্র আর নিটোল মুক্তোর। মতো জমে বরফ হয়ে গিয়েছিল। আবার সূর্যের নতুন উত্তাপে এখন গলে গলে টলটলে জলবিন্দু হয়ে গিয়েছে। রুক্ষ পাহাড়ী ঘাসের ওপর ফাটা ফাটা পায়ের চিহ্ন এঁকে বাদামি পাথরের ওপর এসে দাঁড়াল দুজন।
শীতের হিমাক্ত বাতাস উঠে আসছে টিজুনদীর জলধারা থেকে, সাঁ সাঁ করে ঝাঁপিয়ে পড়ছে ওক আর ভেরাপাঙ গাছের জঙ্গলে। সেদিকে এতটুকু লক্ষ্য নেই পাহাড়ী মানুষ দু’টির। বিন্দুমাত্র মনোযোগ নেই।
দুজনের একবার চোখাচোখি হল।
একজন বলল, কি রে সেঙাই, কোন দিকে যাবি? এদিকে সুবিধে হবে না, মনে হচ্ছে।
সেঙাই এতক্ষণ তার পী মুঙ কাপড়ে একটা শক্ত গিঁট দিয়ে নিচ্ছিল। গম্ভীর গলায় বলল, হু, তাই মনে হচ্ছে। একটা কানা হরিণ পর্যন্ত নজরে আসছে না। এক কাজ করা যাক, ওই টিজু নদীর দিকে চল যাই রেঙকিলান। সম্বর কি চিতাবাঘ পাবই ওদিকে।
একবার চমকে উঠল রেঙকিলান। গলাটা তার কেঁপে কেঁপে উঠল, কিন্তু ওদিকে তো সালুয়ালাঙ বস্তি। আমাদের শত্রুপক্ষ। ওরা দেখলে একেবারে কিমা বানিয়ে ছাড়বে দুজনকে।
দুচোখ ঘৃণায় ভরে উঠল সেঙাই-এর, কেলুরি বস্তির নাম তুই ডুবিয়ে দিবি টিজু নদীতে। বিয়ে করে একটা ছাগী হয়ে গেছিস রেঙকিলান।
কী বললি! রেঙকিলানের দু’টি পিঙ্গল চোখে হত্যা ঝিলিক দিয়ে উঠল, আমি ভীতু হয়ে গিয়েছি! আমি ছাগী বনে গিয়েছি!
হু-হু। ছাগী না, একটা টেফঙ (পাহাড়ী বানর) হয়ে গেছিস। নির্বিকার গলায় বলল সেঙাই, আপোটিয়া (তুই মর)।
খিস্তিটা নিঃশব্দে পরিপাক করল রেঙকিলান, তারপর সেঙাইর দিকে তাকাল। দু’টি চোখ থেকে তার পিঙ্গল আগুন বেরিয়ে আসছে। কিন্তু আশ্চর্য শান্ত গলায় সে বলল, চল, কোন চুলোয় যাবি–
সেঙাই সামনের দিকে বর্শাসমেত হাতখানা প্রসারিত করে দিল, হুই টিজু নদীর দিকে
বেশ। জঙগুপি কাপড়ের গোপন গ্রন্থি থেকে একটা বাঁশের চাচারি বার করল রেঙকিলান। তারপর আড়াআড়ি দু’টি ঠোঁটের মধ্যে রেখে শব্দ করে উঠল। সেই তীক্ষ্ণ শব্দের তরঙ্গ প্রতিধ্বনিত হতে হতে উপত্যকার ওপর দিয়ে খাড়াই প্রান্তরের দিকে মিলিয়ে গেল। একটু পরেই সেই একই শব্দ পাহাড়ের মাথা থেকে বাতাসের ওপর তরঙ্গিত হতে হতে ভেসে এল। রেঙকিলানের শব্দটি সংকেত। পরের শব্দটি উত্তর।
সেঙাই বলল, তা হলে ওঙলেরা ঠিকই এসে গেছে।
হু। আর দেরি করে লাভ নেই। চল। ওরা এখনই দূর পাহাড় ঘুরে এখানে এসে পড়বে।
বাদামি পাথরটার ওপর থেকে দুজনে ভোরপাঙ গাছের নিবিড় অরণ্যে ঢুকল। মাথার ওপর পাতার নিচ্ছেদ ছাদ। রোদ আসার একটুকু ফঁক নেই। নাগা পাহাড়ের এই ঘন বনে সূর্যের প্রবেশ নিষিদ্ধ। নিচে আশ্চর্য হিমাক্ত ছায়া। মাঝে মাঝে বাঘনখের আঁচড়ের মতো ফালি ফালি পথ। চারপাশে কাঁটালতা ঝুলছে। খুগু পাতা দুলছে। আর উদ্দাম হয়ে উঠেছে বুনো কলার বন। ঋতুমতী পৃথিবী এই নাগা পাহাড়ের উপত্যকায় অকৃপণভাবে সুশ্যাম জীবন উপহার দিয়েছে।
পাহাড়ী ঘাস। কোথাও কোমরসমান উঁচু, কোথাও হাঁটু পর্যন্ত। ওক আর জীমবো গাছের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে চলেছে সেঙাই আর রেঙকিলান। বার বার কাঁটালতার আঘাত লাগছে। তামার দেহ থেকে রক্তরেখা ফুটে বেরিয়েছে। সেদিকে একবিন্দু হৃক্ষেপ নেই।
মাথার ওপরে আকাশ নেই। শুধু ওক আর ভেরাপাঙ পাতার নীরন্ধ্র ছাদ প্রসারিত হয়ে রয়েছে।
মাঝে মাঝে বুনো মৌমাছির ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। লাফিয়ে লাফিয়ে গাছের আড়ালে মিলিয়ে যাচ্ছে পাহাড়ী বানরের দল। দূরে দূরে বুনো ঘাসের ওপর মাথা তুলেই আউ পাখিরা অদৃশ্য হচ্ছে। আর দেখা যাচ্ছে লাল রঙের শানিলা পাখিদের। অস্বাভাবিক লম্বা তাদের ধূসর রঙের ঠোঁট। গাছের শাখায় শাখায় ঠোঁট দিয়ে ঠক ঠক শব্দ করছে খারিমা পতঙ্গেরা।
পাহাড়ী বনের বাধা ছিঁড়ে ছিঁড়ে এগিয়ে চলেছে সেঙাই আর রেঙকিলান। কিছুক্ষণ পর পর বাঁশের চাচারিতে তীব্র-তীক্ষ্ণ শব্দ করছে রেঙকিলান। সঙ্গে সঙ্গে আগের মতোই বাতাসে দোল খেতে খেতে ভেসে আসছে তার উত্তর। পাহাড়ের দূর সীমা ধরে তাদের অনুসরণ করে চলেছে ওঙলেরা।
নাগাদের মধ্যে শিকারের একটি প্রথা আছে। শিকারিরা ঘন বনের ভেতর দিয়ে শিকারের সন্ধানে এগিয়ে যাবে। আর দুজন মানুষ বহু দূরে পাহাড়ের প্রান্ত বেয়ে বেয়ে তাদের খাবার নিয়ে অনুসরণ করবে। বাঁশের চাচারিতে শব্দ তুলে দুদলের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করা হয়, এবং উভয় দলের অবস্থিতি বুঝিয়ে দেওয়া হয়।
আচমকা একটা খুঙগুঙ গাছের মগডাল থেকে একটা পাহাড়ী ময়াল সাপের বাচ্চা আছড়ে এসে পড়ল ঘাসবনের ওপর। থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সেঙাই আর রেঙকিলান। একটি মাত্র মুহূর্ত। তারপরেই সেঙাইর বর্শাটা আকাশের দিকে উঠে গেল। সেই হিমছায়ার মধ্যেও ঝকমক করে উঠল খরধার ফলাটা। সেঙাইর ঠিক পাশেই রেঙকিলান। তার চোখেও পিঙ্গল ঝিলিক।
কিন্তু আশ্চর্য! সেঙাই-এর বর্শা আকাশের দিকেই স্থির হয়ে রইল। চোখের পলকে ময়ালের বাচ্চাটা একটা কালো বিদ্যুতের রেখা এঁকে সাপেথ কুঞ্জের আড়ালে পলাতক হল।
প্রথম শিকার। তা-ও ফসকে গেল। সেঙাই তাকাল রেঙকিলানের দিকে। রেঙকিলানর চোখও তার দিকেই নিস্পলক হয়ে রয়েছে। আর দুজনের দৃষ্টিতেই পৃথিবীর সমস্ত সন্দেহ কপিশ দু’টি মণির আকার নিয়ে স্থির হয়ে আছে। সেঙাই ভাবছে, কোনো অনাচার করেনি তো রেঙকিলান কি তার বউ? রেঙকিলান ভাবছে, শিকারে আসার আগে অপবিত্র কোনো কাজ করেছে কি সেঙাই? কলুষিত করেছে দেহমনকে? কেউ কোনো কথা বলল না। দুজনের দৃষ্টিই বিস্ফারিত। শুধু একটি সন্দেহের ঢেউ ফুলে ফুলে উঠছে তাদের মনে। সেই সঙ্গে একটা সর্বনাশা ইঙ্গিত মাথার মধ্যে চমক দিয়ে উঠেছে। তবে কি, তবে কি রিখুস প্রেতাত্মা ময়াল সাপের মূর্তি ধরে এসেছিল!
কয়েকটি মুহূর্ত। তারপর টিজু নদীর দিকে পা বাড়িয়ে দিল সেঙাই। তার পেছন পেছন পূর্বপার্বতী রেঙকিলান। একটি কথাও বলছে না কেউ। সেঙাইও না, রেঙকিনও না। শুধু অজানা জলপ্রপাতের অবিরাম কলকল শব্দ শোনা যাচ্ছে। দুজনে ভাবছে, আজ রাতেই আনিজার নামে মুরগি জবাই করে উৎসর্গ করতে হবে।
একসময় মাথার ওপর ঘন পাতার ছাদ শিথিল হয়ে এল। এবার টুকরো টুকরো আকাশের নীলাভা নজরে আসছে। বাঘনখের আঁচড়ের মতো ফালি ফালি পথে, কোমরসমান পাহাড়ী ঘাসের ওপর জাফরি-কাটা রোদ এসে পড়েছে।
অনেকটা কাছাকাছি এসে পড়েছে দুজনে। এখান থেকে টিজু নদীর খরধারা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। শীতের টিজুতে বর্ষার সেই দুর্বার যৌবন নেই। এখানে সেখানে রাশি রাশি পাথরের কঙ্কাল আত্মপ্রকাশ করেছে। তবু ভৈরব গর্জনে পাথরের চাঁইগুলোর ওপর আছড়ে আছড়ে পড়ছে ঘন নীল জল। আক্রোশের মতো ছিটকে ছিটকে বেরুচ্ছে ফেনার ফুলকি।
বিশাল একটা নিখাঙি গাছের তলা দিয়ে টিজু নদীর কিনারায় চলে এল সেঙাই আর রেঙকিলান। সামনে রোদমাখা উপত্যকাটা নজরে আসছে। টিজু নদীর ঘন নীল দেহে সোনার রেখার মতো এসে পড়েছে শীতের রোদ।
শেষবারের মতো বাঁশের চাচারিতে শব্দ তুলল রেঙকিলান। আর সঙ্গে সঙ্গে ওঙলেদের উত্তরও ভেসে এল।
হঠাৎ খুশিতে একটা আওয়াজ করে উঠল রেঙকিলান, হুই–হুই দ্যাখ। দেখেছিস?
কী? কোথায়? ফিরে তাকাল সেঙাই।
হুস-স-স-স, আস্তে। সেঙাই-এর সরব কৌতূহলের ওপর যতি টানল রেঙকিলান, সম্বর। কানা না কী! হই যে নদীর ওপারে–
এবার সত্যিই দেখতে পেল সেঙাই। একটা মেশিহেঙ ঝোঁপের আবডাল থেকে টিজু নদীর দিকে মাথা বাড়িয়ে দিয়েছে সম্বরটা। চলমান জলের আয়নায় নিজের রূপ দেখতে দেখতে আবিষ্ট হয়ে গিয়েছে প্রাণীটা। বাঁকা বাঁকা শিঙ, শান্ত স্নিগ্ধ দু’টি চোখ। খয়েরি দেহে সাদা সাদা চএ।
সেঙাই বলল, আস্তে। একটা শিকার ফসকেছে। খুব সাবধান। এটাকে মারতেই হবে। দূরের বাঁকটা ঘুরে নদী পার হই চল।
দূরের বাঁকে যাব কেন?
সাধে কি বলি, বিয়ে করে একেবারে ছাগী হয়ে গেছিস। এখান দিয়ে পার হলে দেখতে পাবে না! আমাদের দেখলে তোর বাড়ি ভোজের নেমন্তন্ন নেবার আশায় বসে থাকবে! খুব বাহাদুর। এই বুদ্ধিতে শিকারি হয়েছিস! কণ্ঠ থেকে তাচ্ছিল্য ঝরল সেঙাইর।
হয়েছে, হয়েছে। ফ্যাক ফ্যাক করিস না। চল হুই বাঁকের দিকে। নরম গলায় বলল রেঙকিলান। আর মনে মনে সেঙাই-এর খাসা বুদ্ধির তারিফ করল। সত্যিই তো, এ কথাটা তো তার মগজে উঁকি মারেনি!
বাঁকের মুখ অনেকটা সমতল। টিজুনদী এখানে খানিক শান্ত। কাঁচের মতো স্বচ্ছ জলে নানা রঙের রাশি রাশি পাথর। কোমরসমান স্রোত ডিঙিয়ে ওপারে চলে এল দুজনে। তারপর আখখাকিয়া গাছের আড়াল দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে মেশিহেঙ ঝোঁপটার পাশে এসে দাঁড়াল।
সেঙাই তাকাল রেঙকিলানের দিকে। আর সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত টিজু নদীর উদ্দাম নীল স্রোতকে চমকিত করে মেঘ গর্জন করে উঠল। নদীর আরশিতে শিউরে উঠল সম্বরের মুগ্ধ ছায়া। মেঘ গর্জায়নি, বাঘ ডেকেছে।
চকিত রেঙকিলান বলল, চিতাবাঘ।
হিসহিস করে উঠল সেঙাই, খুব সাবধান।
তারপরেই পলকের মধ্যে ঘটে গেল ঘটনাটা। এক ঝলক বিদ্যুতের মতো সম্বরটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল একটা চিতাবাঘ। সঙ্গে সঙ্গে বর্শাটা আকাশের দিকে তুলে ধরল সেঙাই। তীক্ষ্ণমূর্খ ফলাটায় মৃত্যু ঝিলিক দিয়ে উঠল। পেশীর সমস্ত শক্তি কবজির মধ্যে জড়ো করে বর্শাটা ছুঁড়ে মারল সেঙাই। কিন্তু তার আগেই সম্বরটাকে পিঠের ওপর তুলে মেশিহেঙ ঝোঁপের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে চিতাবাঘটা। আর সেঙাই-এর বর্শাটা সাঁ করে একটা খাটসঙ গাছের গুঁড়িতে গেঁথে গিয়েছে।
তীব্র গতিতে ঘুরে দাঁড়াল সেঙাই, কি রে, বর্শা লাগল না যে চিতাবাঘের গায়ে?
তার আমি কী জানি। লাগাতে পারিসনি, তাই বল।
কাল রাতে বউ-এর কাছে শুয়েছিলি, আর সেই কাপড়ে নিশ্চয়ই উঠে এসেছিস। তা না হলে শিকার ফসকে যাচ্ছে কেন? সেঙাইর দুচোখে কুটিল সন্দেহ, ইজা রামখো!
বাজে কথা। কাল তো আমি মোরাঙে গিয়ে শুয়েছিলাম। এক কাজ করি আয়, চিতাবাঘটা বেশি দূর যেতে পারেনি এখনও। আশেপাশেই আছে। সাবধানে খুঁজে বার করি চল। একটু থামল রেঙকিলান। তারপর আবার বলতে শুরু করল, আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে, কাল শুয়োর মারিসনি তো সেঙাই?
কী বললি? গর্জন করে উঠল সেঙাই, নে রিহুগু (তোকে বাঘে খাক)। কাল সারাদিন আমি মোরাঙ থেকে বেরিয়েছি?
শিকারের আগের রাতে নাগারা স্ত্রীর সঙ্গে এক বিছানায় শোয় না। যারা অবিবাহিত, তারা শুয়োর হত্যা করে না। এ রাতটা তাদের কঠোর শুচিতা দিয়ে ঘেরা। শিকারিরা এ রাতে গ্রামের মোরাঙে এসে বিছানা বিছায়। তাদের বিশ্বাস, কলুষিত দেহমন নিয়ে শিকারে বেরুলে অসফল হয়ে ফিরতে হয়। তার ফলে ক্রুদ্ধ বনদেবীর অভিশাপ এসে পড়ে। রিখুস প্রেতাত্মা কুপিত হন। তাদের ওপর। বনদেবীর অভিশাপ আর রিখুস প্রেতাত্মার কোপ বড় ভয়াল। সে অভিশাপ আর কোপ পাহাড়ে পাহাড়ে দাবাগ্নি ছড়িয়ে দেয়। তাতে ছারখার হয়ে যায় সমস্ত নাগা পৃথিবী।
একসময় রেঙকিলান বলল, দেরি করতে হবে না, চল। আবার চিতাটা না ভেগে পড়ে।
চল।
খাটসঙ গাছের গুঁড়ি থেকে বর্শাটাকে টেনে খুলে নিল সেঙাই। কোমরে বাঁশের লম্বা খাপ, তার মধ্যে ফলাটাকে ঢুকিয়ে দিল সে। তারপর মেশিহেঙ ঝোঁপটা পাশে রেখে পাহাড়ী ঘাসের ওপর নিঃশব্দে পা ফেলে এগিয়ে যেতে শুরু করল। সামনে সেঙাই। পেছনে রেঙকিলান। তাদের সমস্ত ইন্দ্রিয় ধনুকের ছিলার মতো প্রখর হয়ে উঠেছে। তাদের ঘ্রাণ কান-দৃষ্টি আর স্নায়ু অতিমাত্রায় সচেতন। সন্দেহজনক একটুমাত্র শব্দে চমকে চমকে উঠছে দুজনে।
হঠাৎ থমকে দাঁড়াল রেঙকিলান। তারপর জঙগুপি কাপড়ের গ্রন্থি থেকে বাঁশের চাচারি বার করে তীক্ষ্ণ শব্দ করে উঠল। সে শব্দটা টিজু নদীর ওপারে বনময় উপত্যকার ওধারে ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু আশ্চর্য! ওঙলেদের উত্তর এবার ভেসে এল না। আবারও শব্দ করল রেঙকিলান। এবারও ওঙলেরা নিরুত্তর।
রেঙকিলান তাকাল সেঙাইর দিকে। দেখল, সেঙাই তারই দিকে তাকিয়ে আছে।
আচমকা রেঙকিলান চিৎকার করে উঠল, আতঙ্কে তার গলাটা থরথর করে কাঁপছে, কী সর্বনাশ! হাঃ–আঃ–আঃ।
চুপ, একেবারে চুপ। আমিও দেখেছি। আয়, হুই আড়ালে লুকোই। রেঙকিলানকে টানতে চানতে একটা কাঁটাময় খেজাঙ ঝোঁপের মধ্যে চলে এল সেঙাই। খেজাঙ পাতার জানালা দিয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। বুকসমান পাহাড়ী ঘাস সরিয়ে ভেরাপাঙ গাছের ফাঁক দিয়ে দুলতে দুলতে এগিয়ে আসছে একদল নাগা। মাথায় হুন্টসিঙ পাখির পালক গোঁজা। দুচোখে আদিম হিংস্রতা তাদের। মুষ্টিবদ্ধ বর্শার ফলাগুলো পাহাড়ী ঘাসের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে এসেই আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। এরা সব সালয়ালা গ্রামের মানুষ। সেঙাইদের শত্রুপক্ষ।
খেজাঙের কাটাঝোপে রুদ্ধশ্বাসে উবু হয়ে বসেছে সেঙাই আর রেঙকিলান। তামাভ দেহ ধারাল কাটার আঘাতে আঘাতে ফালা ফালা হয়ে গিয়েছে। চিতাবাঘের সন্ধানে কখন যে একেবারে সালুয়ালা গ্রামের মধ্যে এসে পড়েছে দুজনে, খেয়াল ছিল না। সারা দেহের ওপর। রাশি রাশি সরীসৃপ কিলবিল করছে। এতটুকু নড়ছে না কেউ। হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন পর্যন্ত থেমে গিয়েছে যেন। নিথর হয়ে গিয়েছে দুজনে। শরীরী নিশ্চেতনার মতো দাঁড়িয়ে রইল দু’টি তামাভ পাহাড়ী মানুষ।
খেজাঙ ঝোঁপের কাছাকাছি এসে পড়েছে মানুষগুলো। হাতের মুঠিতে তীক্ষ্ণধার বর্শা। পরনে সকলেরই পী মুঙ কাপড়। কৌমার্যের লক্ষণ। সহসা দাঁড়িয়ে পড়ল মানুষগুলো। তারপর অনাবৃত বুকের ওপর চাপড় মেরে চিৎকার করে উঠল একসঙ্গে, হো-হো-ও-ও-ও–ও–
হো–ও–ও-য়া-য়া-য়া–
সে চিৎকারে পাহাড়ী অরণ্য চমকে উঠল। শিউরে উঠল টিজু নদীর নীল ধারা। আর খেজাঙের ঝোপে দু’টি হৃৎপিণ্ডে তীব্র আতঙ্কে রক্ত ফেনিয়ে ফেনিয়ে উঠতে লাগল। জোরে জোরে নিশ্বাস পড়তে লাগল তাদের।
হো-ও-ও-ও–ও–স্বরগ্রাম আরো তীক্ষ্ণ হচ্ছে, প্রখর হচ্ছে।
এই মানুষগুলোও শিকারে বেরিয়েছে। তাদের চিৎকারে ভয়ার্ত শব্দ করে উড়ে যাচ্ছে খুগু পাখির ঝাঁক, উড়ে যাচ্ছে লোটে আর শানিলা পাখির দল।
এখনও সেই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে সালুয়ালাঙের মানুষগুলো। মাঝে মাঝে সতর্ক চোখে এদিকে সেদিকে তাকাচ্ছে। আর হঠাৎই সেঙাইর অস্ফুট স্মৃতির মধ্যে দোল খেয়ে উঠল একটা রক্তাক্ত অতীতের কাহিনী। যে অতীতের বর্শা এই সালুয়ালাঙ আর তাদের কেরি গ্রাম দু’টিকে টিজুনদীর দু’পারে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। যে অতীত টিজু নদীর দু’দিকে একটি অনিবার্য শত্রুতার জন্ম দিয়েছে।
.
কিংবদন্তির মতো ব্যাপার। টিজু নদীর দু’পারে সালুয়ালাঙ আর কেলুরি–এই পাহাড়ী জনপদ দু’টির প্রতিটি মানুষের ধমনীতে বিষাক্ত রক্তকণার মতো মিশে রয়েছে সে অতীত। সে অতীতের কাহিনী সেঙাই শুনেছে কেলুরির প্রাচীনতম মানুষটির মুখে। শীর্ণ দুই হাঁটুর ফাঁকে ধূসর মাথাখানা গুঁজে বুড়ো খাপেগা বলেছিল আর মোরাঙের জোয়ান ছেলেরা খাপেগার চারপাশে বৃত্তাকারে ঘন হয়ে বসে শুনেছিল।
বুড়ো খাপেগা কেলুরি গ্রামের সর্দার। আশ্চর্য মনোরম তার গল্প। কথার সঙ্গে উত্তেজনার মদ মিশিয়ে সে মোরাঙের জোয়ান ছেলেদের মাতাল করে তুলেছিল। সেদিন আকাশে ছিল ক্ষয়িত চাঁদ। নাগা পাহাড়ের ছড়ানো উপত্যকায় রহস্যময় জ্যোৎস্না ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই জ্যোৎস্নার সঙ্গে খাপেগার কাহিনী মিশে এক বিচিত্র প্রতিক্রিয়া ঘটে গিয়েছিল সেঙাই-এর চেতনায়। সেই সঙ্গে বোধহয় অন্য সব জোয়ানদেরও।
খাপেগা সর্দার শুরু করেছিল এইভাবে, সেই রাতটা এমনই ছিল সু খুঙতার (ক্ষয়িত চাঁদের) রাত। হু-হু, তা কত বছর আগের ব্যাপার ঠিক মনে নেই। তবে সেদিন আমার চুল এমনি আখুশি পাতার মতো হেজে যায়নি। গায়ে জোর ছিল বাঘের মতো। সেই রাত্তিরে হুই সেঙাই-এর ঠাকুরদা এসে ডাকল আমাকে। তখন এই মোরাঙ ছিল টিজু নদীর কিনারে। রাতে শুয়ে ছিলাম। এদিকে সেদিকে চিতার ডাক। বুনো মোষের ঘোঁতঘোঁতানি। টানাডেনলা পাখির চিৎকার। পেছনের খেজাঙ ঝোঁপ থেকে জেভেথাঙ ফিসফিস করে ডেকেছিল আমাকে।…
রূপকথার মতো অপরূপ সে কাহিনি। খাপেগার গল্প মোটামুটি এইরকম।
টিজু নদীর দু’পাশে ও বন আর ভেরাপাঙের ছায়ায় সেদিন সালুয়ালাঙ কি কেলুরি গ্রামের চিহ্নমাত্র ছিল না। দুইয়ে মিলিয়ে ছিল এক অখণ্ড জনপদ। তার নাম কুরগুলাঙ। টিজু নদীর দুধারে এক উপত্যকা থেকে দূরের পাহাড়চূড়া পর্যন্ত ছিল কুরগুলাঙের বিস্তার।
নদীর এপারে ছিল জোহেরি বংশ। ওপারে পোকরি বংশ। দু’টি বংশই সমাজকে সবগুলো ভোজ খাইয়েছে। নগদা উৎসবে মোষ বলি দিয়েছে। ভালুক উৎসর্গ করেছে টেটসে দেবতার নামে। দুই বংশের প্রাচীনতম মানুষটি গ্রামের পেনেসেঙ্গু (পুরোহিত)। এই দুই বংশের বর্শার প্রতাপে সমস্ত গ্রামের সম্মান নির্বিঘ্ন, মর্যাদা অক্ষুণ্ণ। দুই বংশের মধ্যে একটা আন্তরিকতার সেতু পাতা রয়েছে। সেই সেতু টিজু নদীর দু’টি কিনারাকে যুক্ত করে দিয়েছিল। সেই সেতু টিজু নদীর দু’পারে দু’টি বংশের হৃদয়ে পারাপার হবার অন্তরঙ্গ যোগপথ। জোহেরি আর পোকরি বংশ। দুইয়ে মিলিয়ে এক অখণ্ড সত্তা। একটি বংশ আর-একটি বংশের সম্পূরক। জা কুলি উৎসবের দিনে কি নতুন ফসল তোলার মরশুমে টিজু নদী পার হয়ে আসত পোকরি বংশের। প্রাচীনতম মানুষটি। জোহেরি বংশের প্রবীণ মানুষটির পাশে নিবিড় হয়ে বসে পরামর্শ করত। বাঁশের পানপাত্রে রোহি মধু। কাঠের বাসনে ঝলসানো বনমুরগি আর একমুঠো নুন এবং বড় টঘুটুঘোটাঙ পাতায় কাঁচা তামাক দিয়ে তাকে অভ্যর্থনা করা হত পাহাড়ী প্রথামতো। আবার গ্রামে নতুন মোরাঙ তৈরির দিনে জোহেরি বংশের প্রবীণ মানুষটি নদী পেরিয়ে ওপারে যেত। বাইরের ঘরে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে মনের কপাট খুলে দিত। ফিসফিস গলা। কিন্তু একটিমাত্র স্থির লক্ষ্য। কুরগুলাঙ গ্রামের মোরাঙ যেন দুই বংশের আভিজাত্যে আর মহিমায় উজ্জ্বলতর হয়ে উঠতে পারে। মোরাঙই হল গ্রামের মর্যাদা, গ্রামের প্রতিষ্ঠার স্বাক্ষর। বাঁশের পানপাত্রে তামাটে ঠোঁট ঠেকিয়ে দুজনেই ধূসর মাথা নাড়ত।
আকাশে বিলীয়মান পূর্ণিমার ক্ষয়িত চাঁদ। খাপেগার কণ্ঠ পর্দায় পর্দায় চড়ছিল। আশ্চর্য উত্তেজক এক প্রতিক্রিয়া ছড়িয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছিল তার কথাগুলো। সুদূর উপত্যকায় ভেরাপাঙের বনকে ভৌতিক মনে হয়েছিল। সেদিন ঘন কুয়াশার স্তর নেমে এসেছিল দূরতম আকাশ থেকে, থরে থরে ঝরছিল পাহাড়ী অরণ্যে। সব মিলিয়ে সেঙাই-এর আধফোঁটা পাহাড়ী মনটা একটু একটু করে ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছিল।
খাপেগা বলেছিল, হালচাল ভালোই চলছিল। আচমকা যেন পাহাড়ের তলায় ভূমিকম্প। শুরু হল। জোহেরি আর পোকরি–দুই বংশের যে এত পিরিত, সব সেই ভূমিকম্পের দোলায় চুরমার হয়ে গেল। এই যে সেঙাই, ওর ঠাকুরদা ছিল আমার স্যাঙাৎ। তার নাম জেভেথাঙ। সে এই জোহেরি বংশের ছেলে। আর নদীর ওপারে পোকরি বংশের মেয়ে নিতিৎসু। এই দুজনকে নিয়েই ফাটল ধরল দুই বংশে…..।
জোহেরি বংশের ছেলে জেভেথাঙ। মাথার চারপাশ দিয়ে গোল করে নিখুঁত কামানো চুল। কানের লতিতে পিতলের নিয়েঙ গয়না, সেই গয়না থেকে লাল রেশমের গুচ্ছ দোদুল দুলছে। উজ্জ্বল তামাভ দেহে থরে থরে পেশীভার। পরনে ওক ছালের লেঙতা। কড়ির বাজুবন্ধ। ছোট ছোট চোখে নিশ্চিত ঘাতনের ঝিলিক। হাতের থাবায় হাতখানেক লম্বা বর্শার ফলা। আর পোকরি বংশের মেয়ে নিতিৎসু। গলায় ছোট ছোট শঙ্খের মালা। মণিবন্ধে কড়ির কঙ্কণ। ঊর্ধ্বাঙ্গ অনাবৃত। সোনালি স্তনচূড়া। পিঙ্গল চুলের গুচ্ছে টুঘুটুঘোটাঙ ফুল। কোহিমা থেকে তার বাপ এরি কাপড় এনে দিয়েছিল। কোমরের চারপাশ ঘিরে জানুর ওপর পর্যন্ত সেই শৌখিন আবরণ ঝলমল করে।
জেভেথাঙ আর নিতিৎসু। জোহেরি আর পোকরি বংশ। টিজু নদীর এপার আর ওপার। গ্রীষ্মের এক নির্জন দুপুর। মেশিহেঙ ঝোঁপের পাশ দিয়ে নিয়তবাহী এক ঝরনা। নিঃশব্দ। শুধু আশ্চর্য করুণ আর ছলছল এক জলধারা। তার পাশেই জোহেরি আর পোকরি বংশের দুই যৌবন প্রথম মুখোমুখি হল। জেভেথাঙ দেখল নিতিৎসুকে। নিতিৎসুর পিঙ্গল চোখের মণিতেও একটি পরিপূর্ণ পাহাড়ী যৌবনের ছায়া পড়েছে। সে ছায়ার নাম জেভেথাঙ।
আবিষ্ট চোখে তাকিয়ে ছিল জেভেথাঙ। তার বন্য চোখ দু’টিতে মুগ্ধতা আর খুশি ঝিলিক দিয়ে দিয়ে যাচ্ছিল। আর নিতিৎসুর দৃষ্টি একটু একটু করে কঠিন হয়ে উঠছিল।
একসময় গাঢ় গলায় জেভেথাঙ বলেছিল, কী নাম তোর?
নিতিৎসু। নাম বললাম, যা এবার ভাগ।
আজ থেকে তুই আমার আসাহোয়া (বন্ধু) বনে যা।
কী! ময়াল সাপের মতো নির্মম চোখে তাকিয়েছিল নিতিৎসু, জানিস আমি পোকরি বংশের মেয়ে?
আমিও জোহেরি বংশের ছেলে। আমার নাম জেভেথাঙ।
এবার নরম হয়েছিল নিতিৎসু। কোমল গলায় বলেছিল, না, তা হবে না। আমার সোয়ামী ঠিক হয়ে গিয়েছে। হুই নানকোয়া বস্তি, পাহাড়ের হুই উধারে, সেই বস্তির মেজুর বংশের ছেলে রিলোর সঙ্গে আমার বিয়ে হবে। আর কোনো মরদের সঙ্গে আমি বন্ধুত্ব পাতাব না। তা হলে আনিজার গোসা হবে। যা, এবার ভাগ।
ইস, ভাগ বললেই ভাগব! দৃঢ় পদক্ষেপে পাহাড়ের উতরাই বেয়ে নেমে আসতে শুরু করেছিল জেভেথাঙ, আয়, আয়। বিয়ে হলেই হল রিলোর সঙ্গে! আমি থাকতে রিলো কেন? এই কুরগুলাঙে এলে রিলোর মাথা নিয়ে নেব। বর্শা দিয়ে সেই মাথা ছুঁড়ে মোরাঙে ঝোলাব। হু-হু–
সাঁ করে বিদ্যুৎ ঝলকের মতো ঘুরে দাঁড়িয়েছিল নিতিৎসু। ঝরনার পাশেই পড়ে ছিল একটা লোহার মেরিকেতসু (নাগা রমণীর অস্ত্র)। চকিতে তুলে নিয়ে সেটা ছুঁড়ে মেরেছিল জেভেথাঙের দিকে। মেরিকেতসুর আঘাতে কপালটা চৌফালা হয়ে গিয়েছিল জেভেথাঙের। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে এসেছিল খানিকটা তাজা রক্ত।
আ-উ-উ-উ–আর্তনাদ করে মেশিহেঙ ঝোঁপের ওপর লুটিয়ে পড়েছিল জেভেথাঙ। কপিশ ভুরু দুটো ভিজিয়ে রক্তের ধারা বুকের দিকে নেমে গিয়েছিল তার।
কয়েকটি মুহূর্ত। চেতনাটা কেমন শিথিল হয়ে গিয়েছিল। স্নায়ুর ওপর দিয়ে গুটসুঙ পাখির ডানার মতো একটা কালো পর্দা নেমে এসেছিল। অন্ধকার সরে গেলে লাফিয়ে ওঠে পড়েছিল জেভেথাঙ। এক হাত লম্বা বর্শাটা মুঠোর ওপর তুলে নিয়ে চনমনে চোখে চারিদিকে তাকিয়েছিল। শব্দহীন ঝরনার কিনারায় নিতিৎসু নামে কোনো যুবতীর চিহ্ন নেই। একটা পাহাড়ী বনবিড়াল হয়ে সে যেন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। খ্যাপা বাঘের মতো গর্জন করে উঠেছে জেভেগাঙ, আচ্ছা, আবার দেখা হবে।
জোহেরি আর পোকরি বংশের যৌবন প্রথম দিনের শুভদৃষ্টি শেষ করেছিল এইভাবে। সেই শুভদৃষ্টি নির্মম স্বাক্ষর এঁকে রেখে গিয়েছিল জেভেথাঙের কপালে। তার স্মৃতিকে অক্ষয় করে রেখেছিল সেই ক্ষতচিহ্ন।
আশ্চর্য রহস্যময় গলায় খাপেগা বলেছিল, রাতে মোরাঙে শুতে এল জেভেথাঙ। তামুনুর (চিকিৎসক) কাছ থেকে কপালে আরেলা পাতার প্রলেপ দিয়ে এসেছে। সকলে চমকে তাকালাম। ব্যাপারখানা কী?
জেভেথাঙ আস্তে আস্তে বলেছিল, একটু বাইরে আয় তত খাপেগা। আচ্ছা থাক, তোরা সবাই শোন।
জেভেথাঙের চারপাশে ঘন হয়ে বসেছিল সকলে।
এই মোরাঙ। গ্রামের সব অবিবাহিত জোয়ান ছেলেদের শোওয়ার ঘর। কুরগুলাঙ গ্রামে দুটো মোরাঙ ছিল। একটা টিজু নদীর ওপারে, আর একটা এপারে।
উত্তেজিত ভঙ্গিতে নিঃশব্দ ঝরনার পাশের সেই ঘটনাটা বলে গিয়েছিল জেভেথাঙ। কটি নিথর মুহূর্ত। তারপরেই মোরাঙ কাঁপিয়ে শোরগোল উঠেছিল। পাহাড়ের উপত্যকায় সে হইচই ক্ষয়িত চাঁদের রাতের হৃৎপিণ্ডকে ফালা ফালা করে দিয়েছিল। আকাশে হয়তো চমকে উঠেছিল মীনপুচ্ছ উল্কারা, শিউরে উঠেছিল সুদূর ছায়াপথের রেখা।
খাপেগা বলেছিল, লাফিয়ে উঠলাম আমি। সারা কুরগুলাঙ বস্তির মধ্যে সবচেয়ে তাগড়া জোয়ান ছিলাম আমিই। সে সব দিন আর নেই। মানুষের মাথা কেটে এই মোরাঙের দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখাই ছিল আমাদের সবচেয়ে বড় খেলা। সে সব খেলার রেওয়াজ আজকাল উঠে গিয়েছে। বড় আপশোশ হয়। জীর্ণ বুকটা কাঁপিয়ে কাঁপয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এসেছিল প্রাচীন মানুষ খাপেগার, যাক সে কথা। আমার নাম খাপেগা। জানিস তোরা আমার নামের মানে?
সেঙাই বলেছিল, জানি। খাপেগা মানে যে মানুষ দুটো শত্রুর মাথা কেটেছে।
ঠিক তাই। যেতে দে ওকথা। তারপর কী হল বলি। খাপেগা আবার শুরু করেছিল, তখন আমাদের জোয়ান রক্ত। চারদিকে একবার তাকালাম। জেভেথাঙের ফাটা মাথার চারপাশে উবু হয়ে বসেছে নিয়োনো, নড্রিলো, গ্যিহেনি, এমনি অনেকে। আমি বললাম, ঠিক আছে। জেভেথাঙের ফাটা মাথার বদলা পোকরিদের তিনটে মাথা চাই।
কিছুক্ষণ চুপচাপ। তারপরেই মোরাঙ-ফাটানো চিৎকার উঠেছিল। নড্রিলোরা একসঙ্গে গলা মিলিয়েছে, হু—উ—উ—উ–য়া–য়া–আ–আ–পোকরিদের তিন মাথা চাই।
সে চিৎকার টিজু নদীর নীল ধারার ওপারে বনময় পাহাড়ে ধেয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু আশ্চর্য! শান্ত গলায় জেভেগাঙ বলেছিল, তিনটে মাথা নিশ্চয়ই নেব। কিন্তু তার আগে নিতিৎসুকে চাই।
খাপেগা বলেছিল, কী সর্বনাশ, হুই শয়তানীকে নিয়ে কী করবি?
বিয়ে করব।
মোরাঙের নিচে পাহাড়ী পৃথিবীটা যেন আর একবার দুলে উঠেছিল।
আবার খানিকক্ষণ চুপচাপ। তারপরেই সকলের টুকরো টুকরো কথা মিলে একটা জটিল স্বরজাল বোনা হয়েছিল, হু—উ—উ—উ—য়া—আ–আ-হু-হু; হুই শয়তানীকে বর্শা দিয়ে কুঁড়ে নিয়ে আসব। বিয়ে হবে তারপর।
তীব্র, চিৎকার, হু-হু, একটা পেত্নী, নিতিৎসুটা একটা পেত্নী।
নড্রিলো বলেছিল, তোর বাপ এই বস্তির সর্দার। তাকে একবার জানানো দরকার। কী বলিস জেভেথাঙ?
হু-হু। গোল করে কামানো মাথা নেড়ে নেড়ে সায় দিয়েছিল সকলে।
পূর্ববর্তী পরের দিনের সকাল। অগুনতি পাহাড়ের ওধারে, বর্মার চেইনেরও ওপার থেকে সূর্য উঠেছে। তার সোনালি রোদ ঢলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড়ী উপত্যকায়।
খাপেগা আর জেভেখাঙ মোরাঙ থেকে বেরিয়ে চলে এসেছিল টিজু নদীর পাড়ে। সরাসরি জেভেখাঙ তাকিয়েছিল খাপেগার দিকে, কি রে, আমি যাব নিতিৎসুদের বস্তিতে?
তুই একটু দাঁড়া। আমি নিতিৎসুর শোওয়ার ঘরখানা দেখে আসি। রাত্তিরে তুই সেই ঘরে যাবি। যদি রাজি না হয়, বর্শা দিয়ে গেঁথে নিয়ে আসব। টিজু নদীতে চমক দিয়ে তীক্ষ্ণ শব্দ করে হেসে উঠেছিল খাপেগা, কি রে, সাহসে কুলোবে তো? না, আমাকেও তোর সঙ্গে নিতিৎসুর ঘরে যেতে হবে রাত্তিরে? আমি গেলে কিন্তু বখরা দিতে হবে।
থাম থাম। মেলা বকর বকর করতে হবে না। যাবি আর আসবি।
একটু পরেই ফিরে এসেছিল খাপেগা। মুখখানা তার ভয়ঙ্কর দেখাচ্ছে। চোখের কোণে ঝিলিক মেরে যাচ্ছে একটা অনিবার্য পূর্বাভাস, এক সর্বনাশা ইঙ্গিত।
একটা খাসেম গাছের আড়াল থেকে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে এসেছিল জেভেখাঙ, কি রে, কী ব্যাপার? দেখে এসেছিস?
হু। মাথা নেড়েছিল খাপেগা, খুব সাবধান। ওপারের মোরাঙে জোয়ানরা বর্শায় শান দিচ্ছে। আমাকে দেখে কটমট করে তাকাল।
আচ্ছা–
অসহ্য উত্তেজনায় কেঁপে কেঁপে উঠেছিল খাপেগা, মাগী একটা টেফঙের বাচ্চা, একটা পাহাড়ী পেত্নী। সব বলে দিয়েছে নিতিৎসু। আগে থেকে ওরা তৈরি হচ্ছে। কিন্তু আমাদের মোরাঙের মান রাখতে হবে। নদীর ওপার থেকে মাথা আমাদের চাই-ই। আর আজ রাত্তিরেই নিতিৎসুর শোওয়ার ঘরে তোকে যেতে হবে।
যাব। শরীরের স্নায়ুগুলো ধনুকের ছিলার মতো টান টান হয়ে গিয়েছিল জেভেথাঙের। তীক্ষ্ণ গলায় সে বলেছিল, হু-হু, এপারের মান রাখতেই হবে।
বুড়ো খাপেগা একমুঠো কাঁচা তামাকপাতা মুখে পুরে, খকখক কেশে আবার শুরু করেছিল, এর আগেই জেভেখাঙ বিয়ে করেছে। একটা ছেলে হয়েছে। সেই ছেলেই সেঙাইর বাপ। কিন্তু নিতিৎসুকে দেখে মজে গিয়েছিল জেভেখাঙ। তাই এই বিপত্তি। জানিস তো, পাহাড়ী মানুষ আমরা। হাতের মুঠোয় লম্বা বর্শাটা যার ধরা রয়েছে শক্ত করে, এই পাহাড় আর এই জোয়ান মেয়েমানুষের দুনিয়াদারি তারই। যাক, সেকথা এখন নয়। আসল গল্প শোন–
দুপুরের দিকে নড্রিলো গিয়েছিল জেভেথাঙের বাপের কাছে। তারপর রসিয়ে রসিয়ে নিতিৎসুজেভেথাঙের কাহিনিটা বলে তার মুখের দিকে তাকিয়েছিল, এবার তুই কী করতে বলিস সর্দার?
ভারি তরিবতের লোক জেভেথাঙের বাপ। একটা হুজুগ পেলে আর রক্ষা নেই। বলেছিল, ঠিক আছে, হুই মেয়েই চাই। আর একটা ছেলের বউ আসবে ঘরে। এ বেলাই আমি মেয়ের পণ পাঠিয়ে দিচ্ছি। বিকেলের দিকে জেভেথাঙের পিসি বউ-পণ দেবার জন্যে একশোটা বর্শা, পিতল আর কড়ির শৌখিন গয়না, কোহিমা থেকে কেনা এণ্ডি কাপড় নিয়ে টিজু নদীর ওপারে চলে গিয়েছিল। সঙ্গে চলনদার গেল নড্রিলো আর গ্যিহেনি। জোহেরি আর পোকরি বংশের মধ্যে একটা মনোরম সেতুযযাগের প্রস্তুতি। কিন্তু সন্ধ্যার একটু আগে, বেলাশেষের আকাশ থেকে যখন রাশি রাশি সোনালি কুহক ছড়িয়ে পড়েছে পাহাড়ী উপত্যকায়, ঠিক সেই সময় ফিরে এল জেভেথাঙের পিসি। নড্রিলো আর গ্যিহেনির কাছ থেকে কন্যাপণের বর্শা আর শৌখিন গয়না সব ছিনিয়ে রেখে দিয়েছে টিজু নদীর ওপারের মানুষগুলো। আর নিতিৎসুর জেঠা শাসিয়ে দিয়েছে, এপারের লোক ওপারে গেলে মুণ্ড নিয়ে ফিরে আসতে হবে না। ধারাল নখের তর্জনীটা তুলে সে হিসহিস করে উঠেছিল, খুব সাবধান, নিতিৎসুর সঙ্গে তোদের জেভেথাঙ কথা বলেছে, এই বর্শা আর কাপড়-গয়না রেখে তার দাম নিলাম রামখোর বাচ্চারা। এদিকে আর আসিস না জানের মায়া থাকলে।
সব শুনে গর্জন করে উঠেছিল জেভেথাঙের বাপ। সে গর্জনে শিউরে উঠেছিল কুরগুলাঙ গ্রামের হৃৎপিণ্ড। একটা উদ্দাম তুফানের মতো ছুটে এসেছিল সে মোরাঙে। তারপর বুকের ওপর প্রচণ্ড একটা চাপড় মেরে চিৎকার করে উঠেছিল, ইজাহান্টসা সালো! আ–ও—ও–ওয়া–আ–আ-আ–
পরিচিত সংকেত। ওক বন, ভেরাপাঙের জঙ্গল, মেশিহেঙের ঝোঁপ–পাহাড়ী অরণ্যের দিগদিগন্ত থেকে ঝড়ের মতো ছুটে এসেছিল জোয়ান ছেলেরা। ওই চিৎকারের মধ্যে একটা অনিবার্য ইঙ্গিত রয়েছে। জোয়ানদের ধমনীতে ধমনীতে পাহাড়ী রক্ত দাবাগ্নির মতো জ্বলে উঠেছিল। আদিম অরণ্যের আহ্বান। হত্যা তাদের ডাক দিয়েছে। বর্ষার ফলায় এই হত্যার ঘোষণাকে তারা ছড়িয়ে দেবে টিজু নদীর ওপারে।
জেভেথাঙের বাপের চোখ দুটো যেন দুটুকরো জ্বলন্ত অঙ্গার, শোন জোয়ানের বাচ্চারা, কতকালের বনেদি আমাদের এই জোহেরি বংশ। ওপারের হুই পোকরি বংশ আজ আমাদের অপমান করেছে। এর শোধ তুলতে হবে। মোরাঙ থেকে বর্শা, তীর-ধনুক, কুড়াল বার করে নিয়ে যা।
জোয়ান ছেলেরা এতক্ষণ উৎকর্ণ হয়ে শুনছিল। এবার তাদের চিৎকার উদ্বেল হয়ে উঠল। অনেকগুলো শান্ত শিষ্ট সভ্য দিনের পর এই আদিম আহ্বান তাদের রীতিমতো উত্তেজিত করে তুলেছে। পাহাড়ী বনের হিংস্র আত্মা যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল। জেভেথাঙের বাপের এই ডাক আবার নতুন করে তার ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে।
জেভেথাঙের বাপ বলেছিল, হু-হু, খাপেগার ওপর সব ভার দিলাম। আজ রাতের মধ্যে পোকরি বংশের তিনটে মাথা চাই। যা মরদের বাচ্চারা। এই মোরাঙের দেওয়াল চিত্তির করব পোকরি বংশের রক্ত দিয়ে। মনে থাকে যেন।
একটু পরেই পঞ্চাশটা জোয়ানের মুঠিতে তীক্ষ্ণধার বর্শা উঠল। বেলাশেষের রোদে ঝকমক করে উঠেছিল ফলাগুলো। একটা রক্তাক্ত প্রতিজ্ঞার আগুন নেচে নেচে যাচ্ছিল জোয়ান। চোখের মণিতে মণিতে।
আ-ও–ও–ও-য়া-আ-আ-আ–টিজু নদীর দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল জোয়ানেরা।
আ-ও–ও–ও-য়া–আ-আ-আ– ওপার থেকেও চিৎকার ভেসে আসছিল। আদিম পৃথিবীর এই আহ্বানে তারাও সাড়া দিয়েছে। তাদের বর্শার ফলায় ফলায়, তাদের তীরের ঝকমকে দ্যুতিতে একই মৃত্যুর শপথ।
একসময় টিজু নদীর দু’পারে মুখোমুখি হয়েছিল জোহেরি আর পোকরি বংশের অগুনতি বর্শা। কোনো কথা নয়। তীর আর ধনুকের মুখে মুখে মর্যাদার লড়াই শুরু হয়ে যাবে।
নাগা যুদ্ধের নিয়ম অনুযায়ী দুই দল দু’পাশের কিছুটা জঙ্গল পরিষ্কার করল। তারপর দু’দিকেই দুটো মশাল জ্বালিয়ে পুঁতল। তারও পর যুদ্ধ আরম্ভের প্রাথমিক রীতি মেনে দুদলই পরস্পরের দিকে ডিম ছুড়ল। এই ডিম ছোঁড়া ভয়ানক অসম্মানের চিহ্ন। টিজু নদীর দু’পারে দুই প্রতিপক্ষ। কারো মাথায় মোষের শিঙের বাহারি মুকুট। হাতের মুঠোয় ভয়াল কুড়ালের মতো দা, কাঁধে বেতের খাঁচায় রাশি রাশি তীর। বুকের সামনে খাসেম গাছের ছাল দিয়ে বানোনো ঢাল। মাথায় মোষের ছালের পেরঙ (শিরস্ত্রাণ), তাতে পিতলের কারুকাজ। তলপেটে গুঙ খেকঙ (লোহার আবরণ) আর বাহুসন্ধি পর্যন্ত বাঘছালের আমেজঙ খেকঙ (ঢাকনা)।
উপত্যকার চড়াই-উতরাই কাঁপিয়ে কাঁপয়ে, দুই দলই হিংস্র চিৎকার করে উঠেছিল।
আ–ও–ও–আ—আ–
হো–ও–ও—ও–আ–আ—আ–
একসময় পাহাড়ের চূড়া থেকে বেলাশেষের রং মুছে গেল। আবছা রহস্য ছড়িয়ে ছড়িয়ে নেমে এসেছিল ক্ষয়িত চাঁদের রাত্রি। আকাশে মিটিমিটি তারা ফুটেছে। অস্ফুট চাঁদের আভাস দেখা দিয়েছে। নদীর দু’পারে শোরগোল উদ্দাম হয়ে উঠেছে। পাহাড়, বনভূমি, সমস্ত কিছু যেন খণ্ড খণ্ড হয়ে যাবে সে চিৎকারে। টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়বে মহাশূন্যে। এই অরণ্য, এই দিনরাত্রির অস্তিত্বে ঘেরা পাহাড়ী পৃথিবী প্রচণ্ড কোলাহলে যেন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
আ-ও–ও–ও-আ-আ-মরদের বাচ্চা হলে এদিকে আয় দেখি।
হো–ও–ও-আ-আ-আ– জানের মায়া থাকলে ঘরের ছা ঘরে যা।
দু’পারে একসময় মশাল জ্বলে উঠেছিল। টিজু নদীর খরধারায় কয়েকটি অগ্নিবিন্দুর প্রতিচ্ছায়া পড়েছিল। কিন্তু দুই গ্রামের একটি মানুষও নদী পার হয়নি। পার হওয়ার নিশ্চিত পরিণতি ঘাড়ের ওপর দুহাত লম্বা একটা কুড়ালের কোপ এসে পড়া। কিংবা জীমবো পাতার মতো বাঁকা বর্শায় হৃৎপিণ্ডটা এ-ফোঁড় ওফোড় হয়ে যাওয়া।
একসময় খাসেম কাঠের ঢালটা তুলে গর্জন করে উঠেছিল খাপেগা, ছাগীর মতো এপারে বসে থাকলে নিতিৎসুকে পাবে নাকি, কি রে জেভেথাঙ? ওপারের কুত্তাগুলো এগিয়ে আসবে না আগে। আমাদেরই হুই পেত্নীটাকে ছিনিয়ে আনতে হবে। জোহেরি বংশের মান খোয়াসনি জেভেথাঙ। সর্দার বলে দিয়েছে, অন্তত তিনটে মাথা চাই পোকরি বংশের।
টিজু নদীর অবিরত গজরানির ওপর গলা তুলে চিৎকার করে উঠেছিল জেভেথাঙ। খাপেগার কথাগুলো থেকে আদিম প্রেরণা পেয়েছে সে, আ-ও–ও–
টিজুনদীর যৌবন বর্ষার সঙ্গে সঙ্গে মুছে গিয়েছে। গ্রীষ্মের টিজুতে রাশি রাশি হাড়ের মতো নানা রঙের পাথর ছুঁড়ে বেরিয়েছিল। চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে একটা পাথরের ওপর লাফিয়ে পড়েছিল জেভেথাঙ। উত্তেজনায় ঢালটা তুলে নিতে ভুলে গিয়েছিল সে। শুধু ডান হাতের মুঠোতে একটা অতিকায় বর্শা মাত্র ধরা ছিল। মশালের পিঙ্গল আলোতে ভয়ঙ্কর হিংস্র হয়ে উঠেছে জেভেথাঙের দৃষ্টি। তামাটে মুখখানা অস্বাভাবিক রক্তাভ দেখাচ্ছিল। আ-ও–ও–ও—আ-আ–
কিন্তু টিজু নদী আর পার হতে হল না জেভেথাকে। আচমকা একটা প্রকাণ্ড বর্শার ফলা উড়ে এসে কণ্ঠায় ফুঁড়ে গিয়েছিল। মশালের পিঙ্গল আলোতে শুধু পাহাড়ী রক্তের একটা তীব্র ফিনকি তীরের মতো বেরিয়ে টিজু নদীর নীল ধারার সঙ্গে মিশে গিয়েছিল।
আ-ও–ও–ও-উ-উ–আর্তনাদ করে আছড়ে পড়েছিল জেভেথাঙ। টিজু নদীর ওপারে নিতিৎসু নামে এক আদিম কামনা তার অধরাই রইল। বর্শার ফলা তার উন্মত্ত আকাঙ্ক্ষা থেকে চিরকালের জন্য একটি বন্য স্বপ্নকে মুছে নিয়ে গিয়েছে।
জেভেথাঙের দেহটা স্রোতে ভাসতে ভাসতে ওপারে গিয়ে ভিড়েছিল। চকিতে একটা কুড়ালের কোপ দিয়ে ওদিকের কে একজন মুণ্ডটা ছিন্ন করে তুলে নিয়েছিল।
তারপর টিজু নদীর ওপারটা আদিম উল্লাসে এবং চিৎকারে প্রমত্ত হয়ে উঠেছিল। জোহেরি বংশের অন্যায় কামনার উপযুক্ত জবাব তারা দিয়েছে।
প্রথমটা ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল খাপেগারা। তারপরেই পঞ্চশটা জোয়ান ভৈরব গর্জনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল টিজু নদীর ওপারে। আ-ও–ও–আ-আ-আ–
সেই ক্ষয়িত চাঁদের রাতে গলাটা মন্থর হয়ে গিয়েছিল বুড়ো খাপেগার, তারপর টিজু নদীর নীল জল লাল হয়ে গেল। অনেক রাত্তিরে ওপারের দশটা মাথা নিয়ে মোরাঙে ফিরে এলাম। আমার উরুটা বর্শার ঘায়ে দুফালা হয়ে গিয়েছিল। যাক সে কথা, কিন্তু বড় আপোশ রয়ে গেল। দশটা মাথা আনলাম বটে, কিন্তু পোকরি বংশের একটা মাথাও আনতে পারিনি। আর জোহেরি বংশের আসল মাথাটাই ওরা নিয়ে গিয়েছিল। যে মাথাগুলো এনেছিলাম, সবই ওপারের অন্য বংশের।
মন্থর হতে হতে একসময় থেমে গিয়েছিল খাপেগার কণ্ঠ। তারপর সেঙাই-এর দিকে তাকিয়ে সে বলেছিল, আমাদের দিন তো শেষ। শরীরে সে তাগদ আর নেই। তোর ঠাকুরদা জেভেথাকে ওরা মেরেছে সেঙাই। দশটা অন্য বংশের মাথায় তার দাম ওঠে না। তোর বাপ তো আবার সাহেব সাধুদের ল্যাজ ধরা। তুই এর শোধ তুলিস। হুই পোকরি বংশের তিনটে মাথা আনতেই হবে। সেদিন ওদেরই জিত হয়েছিল। দশটা মাথা আনলেও আমরা হেরে গিয়েছিলাম। সে হারের বদলা এখনও আমাদের নেওয়া হয়নি।
এই হল সেই রক্তাক্ত অতীতের কাহিনী। এই ভয়ঙ্কর অতীত সেদিন টিজু নদীর দু’পারে জোহেরি আর পোকরি বংশকে চিরকালের জন্য বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল। বিশাল এক পাহাড়ী ময়ালের মতো টিজু নদীর আঁকাবাঁকা স্রোত। এই স্রোতের ওপর আর কোনোদিনই অন্তরঙ্গতার সেতুবন্ধ হয়নি। সেই সেতুর ওপর দিয়ে দুই বংশের হৃদয়ের দিকে একটি পদক্ষেপও আর হয়নি। শুধু টিজু নদীর দু’পার থেকে একদিন কুরগুলাঙ গ্রাম মুছে গেল। তার প্রেতাত্মার ওপর জন্ম নিল আজকের এই সালুয়ালাঙ আর কেলুরি। নিতিৎসু আর জেভেথাকে নিয়ে টিজুনদীর দু’পারে যে আগুন জ্বলে উঠেছিল, কালের অনিবার্য নিয়মে তার ওপর খানিকটা বিস্মৃতির ভস্ম জমেছে। কিন্তু সে আগুন এখনও নেভেনি। শুধু মাত্র একটি ফুস্কারের প্রয়োজন, যে ফুকারে ধিকিধিকি আগুন দাবানল হয়ে জ্বলে উঠবে।
*
খেজাঙের ঝোঁপ থেকে খানিকটা দূরে সালুয়ালাঙের মানুষগুলো এখনও চিৎকার করছে। কপিশ চোখে তাদের শিকারের সন্ধান। |||
||||||| খেজাঙ ঝোঁপের মধ্যে একটা ক্ষিপ্ত বাঘের মতো এবার শরীরটা ফুলে ফুলে উঠছে সেঙাই এর। ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে। বুকের কঠিন পেশীগুলো উঠছে, নামছে। তার চেতনার মধ্যে কয়েকদিন আগে শোনা খাপেগার কাহিনীটা বিষের জ্বালা ছড়িয়ে দিচ্ছে। খেজাঙের কাটায় ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে দেহ, সেদিকে এতটুকু ভ্রূক্ষেপ নেই। পায়ের পাতার ওপর দিয়ে পিছলে পিছলে যাচ্ছে সরীসৃপ, সেদিকে একবিন্দু মনোযোগ নেই। শুধু বর্শার বাজুর ওপর হাতের মুঠিটা শক্ত হয়ে বসেছে। আর বর্শার ফলায় যেন প্রতিশোধের দুর্বার স্পৃহা ঝকমক করে উঠছে। দেহমন উত্তেজনায় তরঙ্গিত হচ্ছে সেঙাই-এর। একটু আগে অপরিসীম ভয়ে কুঁকড়ে গিয়েছিল সে। এখন সে ভয় মুছে গিয়েছে। খাপেগার সেই কাহিনী স্মৃতির মধ্য থেকে এক আদিম প্রেরণায় তাকে ভয়ঙ্কর করে তুলেছে। হ্যাঁ, ঠাকুরদার হত্যার প্রতিশোধ সে নেবে। তাকে নিতেই হবে।
আর সেঙাই-এর ঠিক পেছনেই উবু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে রেঙকিলান। অস্বাভাবিক আতঙ্কে তার হৃৎপিণ্ডটা যেন ঝিমিয়ে আসছে। শরীরের রক্ত চলাচল থেমে যাচ্ছে। চোখের মণিদুটো এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় ছিটকে বেরিয়ে আসতে চাইছে। মৃত্যু আজ অনিবার্য। অপঘাত আজ নিশ্চিত। সালুয়ালাঙের মানুষগুলো বর্শার মুখে নির্ঘাত তার মুণ্ডুটা গেঁথে নিয়ে যাবে।
রেঙকিলান মিথ্যা কথা বলেছে সেঙাইকে। কাল রাত্রে সে মোরাঙে শুতে যায়নি। বউয়ের সঙ্গে এক শয্যায় শীতের রাত কাটিয়ে সেই কলুষিত দেহমন আর সেই অপবিত্র জঙগুপি কাপড় নিয়েই সে চলে এসেছে শিকারে। শিকারে আসার আগে শুদ্ধাচারের রীতি সে রক্ষা করেনি। সেই পাপে দূরন্ত বেগে ধেয়ে আসছে বনদেবীর অভিশাপ। হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনের সঙ্গে মিলিয়ে মিলিয়ে সে শুনতে পাচ্ছে আনিজার অট্টহাসি। মৃত্যু আজ নিশ্চিত। আর ভাবতে পারছে না রেঙকিলান। সমস্ত দেহের পেশীগুলো তার থরথর কাঁপছে। সমস্ত চেতনাটা আলোড়িত করে একটি চিন্তাই তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। সে চিন্তা মৃত্যুর চিন্তা। তার নিবন্ত দৃষ্টির সামনে যেন নাচতে শুরু করেছে সালুয়ালাঙের মৃত্যুমুখ বর্শাগুলি।
এতক্ষণ একদৃষ্টে লক্ষ করছিল সেঙাই। পাহাড়ী ঘাসের ফাঁক দিয়ে বার বার একটা মাথা বেরিয়ে এসেই আবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। এবার মানুষটার মুখ দেখতে পেল সেঙাই। এর আগে টিজু নদীর ওপার থেকে আরো বারকয়েক লোকটাকে দেখেছিল সে। ওঙলে বলেছিল, ওই লোকটার নাম খোনকে। হুই পোকরি বংশের ছেলে।
ঘন ঘাসের আড়ালে খোকের মুখটা ডুবে ছিল। খোকে! রক্তকণাগুলো রাশি রাশি সরীসৃপের মতো কিলবিল করে উঠল সেঙাই-এর শিরায় শিরায়। খোনকে! পোকরি বংশের ছেলে। এই খোকের কোনো পূর্বপুরুষ তার ঠাকুরদাকে হত্যা করেছিল। হঠাৎ কর্তব্য স্থির করে ফেলল সেঙাই। বহুকাল আগে এক ক্ষয়িত চাঁদের রাতে টিজু নদীর নীল ধারায় জোহেরি বংশের অপমান মিশে গিয়েছিল। আজ শীতের দুপুরে খেজাঙের কাটাঝোপে এক উত্তরপুরুষের ধমনীতে বহু বছর পর সেই অপমান যেন জ্বালা ধরিয়ে দিল।
পাহাড়ী ঘাসের বন থেকে খোনকের মাথাটা ফের বেরিয়ে এসেছিল। খোনকের মাথা নয়, যেন পোকরি বংশের উদ্ধত মুকুট, আকাশছোঁয়া চুড়া।
আচমকা রেঙকিলানের পাঁজরায় কনুই দিয়ে একটা খোঁচা দিল সেঙাই। তারপর দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, এই রেঙকিলান, হুই খোনকেকে আমি বর্শা দিয়ে ফুড়ব। তারপর পেছনের খাসেম বন ঘুরে তাকে নিয়ে একেবারে নদীর বাঁকে পালাব। তৈরি হয়ে থাক।
বুকের মধ্যে থেকে একদলা আতঙ্ক কথার রূপ নিয়ে উঠে আসতে চাইল রেঙকিলানের। কিন্তু সে কিছু বলার আগেই ঘটে গেল ঘটনাটা। সেঙাই-এর মুঠি থেকে প্রকাণ্ড বর্শাটা উল্কার মতো ছুটে গিয়েছে। নির্ভুল লক্ষ্য। আকাশফাটানো আর্তনাদ করে ঘাসের বনে লুটিয়ে পড়ল খোনকে, আ-উ-উ-উ-উ-উ-উ–
ঘটনার আকস্মিকতায় একেবারে হতবাক হয়ে গিয়েছিল সালুয়ালাঙের মানুষগুলো। এমনকি খেজাঙ ঝোপে রেঙকিলানও সেই-এর পাশে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে।
বিহূল অবস্থাটা কেটে যাবার পর পাহাড়ী অরণ্য কাঁপিয়ে চিৎকার করে উঠল সালুয়ালাঙের মানুষগুলো। শিকারে আসার আগে তাদের একজন যে এমন শিকার হয়ে যাবে, তা কি তারা ভাবতে পেরেছিল! হো-ও-ও-ও–ও–
চারিদিকে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ছে মানুষগুলো। খোনকেকে শিকার করেছে যে শিকারি, তার সন্ধান চাই। তার মুণ্ডুটা ছিঁড়ে নিয়ে মোরাঙে ঝোলাতে না পারলে সালুয়ালাঙের মর্যাদা চুরমার হয়ে যাবে। পোকরি বংশের সম্মান ধ্বংস হবে।
হো-ও-ও-ও–ও–ভয়ঙ্কর গর্জন ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে পাহাড়ী উপত্যকার দিকে দিকে। মানুষগুলো হিংস্র চোখে তাকাচ্ছে এদিক সেদিক।
আর খেজাঙ ঝোপে আরেলা পাতার মতো সাদা হয়ে গিয়েছে রেঙকিলানের মুখখানা। প্রবল অপরাধবোধে সমস্ত মন তার অসাড় হয়ে গিয়েছে। শিকারে এসেছে সে অশুচি দেহমন নিয়ে। আর উপায় নেই, আর রেহাই নেই। মৃত্যুর পাত্র ষোলকলায় পূর্ণ হয়েছে তার। ভাবতে ভাবতে একেবারেই নিথর হয়ে গিয়েছে রেঙকিলান।
আচমকা সেঙাই-এর থাবা এসে পড়ল কবজির ওপর। তারপর সেই থাবাটা একটা হালকা পাখির মতো রেঙকিলানের দেহটাকে উড়িয়ে নিয়ে চলল যেন। অস্ফুট চেতনার মধ্যে রেঙকিলান একটু একটু বুঝতে পারছে, পায়ের তলা দিয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে ঝোঁপঝাড় আর বুনো ঘাসের বন। মাথার ওপর থেকে সরে সরে যাচ্ছে খাসেম পাতার ছাদ, ভেরাপাঙের নিবিড় ডালপালা। একসময় টিজু নদীর দূর বাঁকে এসে থামল সেঙাই; বজ্রমুঠি আলগা করে ছেড়ে দিল রেঙকিলানকে। কদর্য গালাগালি দিয়ে উঠল, ইজা হান্টসা সালো। একটা কুত্তী হয়ে গেছিস একেবারে।
পাহাড়ী শীতের দুপুরেও দর দর করে ঘাম নেমে আসছে রেঙকিলানের। আশ্চর্য, সে তো ভীরু নয়। বর্শার ফলা হাতের থাবায় ধরা থাকলে রক্তে রক্তে সে-ও তো আদিম অরণ্যের আহ্বান শোনে, হত্যার প্রেরণা পায়। এর আগে অনেকবার সে এসেছে শিকারে। তবে আজ কেন তার হাত-পা এমন শিথিল হয়ে আসছে? বার বার চেতনার দিগন্ত থেকে উঁকি দিচ্ছে একটা ভয়ানক আনিজার মুখ?
সেই অপরাধ। স্ত্রীর সঙ্গে এক বিছানায় শুয়ে অপবিত্র দেহমন নিয়ে শিকারে আসা। পাপবোধটা যেন শ্বাসনালির ওপর চেপে চেপে বসছে রেঙকিলানের। ভয়াতুর চোখে সে তাকাল সেঙাই-এর দিকে।
সেই আবার হুঙ্কার দিয়ে উঠল, তোকে নিয়ে শিকারে আসাই আমার ভুল হয়েছে। সাধে কি বলি, বিয়ে করে একটা ছাগী হয়ে গেছিস।
একটি শব্দও করল না রেঙকিলান। প্রতিবাদের একটি উত্তরও জুগিয়ে এল না তার ঠোঁটে।
টিজু নদীর এই বাঁক থেকে সালুয়ালাঙের মানুষগুলোর চিৎকার ক্ষীণতম একটা রেশের মতো শোনাচ্ছে। আর ভাবনার কোনো কারণই নেই। নিরাপদ ব্যবধানে সরে আসতে পেরেছে তারা। তবু রেঙকিলানের স্নায়ুগুলো থরথর করে কাঁপছে।
দুপুরের ঝকঝকে রোদ এখন ম্যাড়মেড়ে। পশ্চিম পাহাড়ের চূড়াটার ওপর সূর্য স্থির হয়ে রয়েছে। উতরাই-এর দিকে এখনই ছায়া-ছায়া অন্ধকার। উপত্যকার ঢাল বেয়ে রোদের নিস্তেজ রং পাহাড়ী বনের ঝাপসা সবুজের সঙ্গে মিশতে শুরু করেছে।
ঘন ঘন কয়েকটা নিশ্বাস ফেলল সেঙাই। তারপর কিছুক্ষণ জিরিয়ে রেঙকিলানকে নিয়ে টিজু নদী পার হয়ে ওপারে চলে গেল।
.
২.
রোদের মধুর আমেজটুকু গায়ে এসে লাগছে স্নিগ্ধ মমতার মতো। শীতের শুরুতে বিকেল বেলাতেই বাতাস হিমাক্ত হয়ে উঠেছে।
রেঙকিলান আর সেঙাই শ্রান্ত শরীর টানতে টানতে একটা বড় ভেরাপাঙ গাছের ওপর এসে বসল। অনাবৃত দেহে অনেকগুলো রক্তাক্ত আঁচড়ের দাগ ফুটে বেরিয়েছে।
সেঙাই বলল, ‘বড় খিদে পেয়েছে। ওঙলেদের খবরটা জানিয়ে দিতে হবে।’
কোমরের গোপন গ্রন্থি থেকে বাঁশের চাচারি বার করে সেঙাইর হাতে দিল রেঙকিলান। চাচারিটা দুই ঠোঁটের ওপর আড়াআড়ি রেখে তীক্ষ্ণ শব্দ করে উঠল সেঙাই। একটু পরেই সে শব্দের উত্তর ভেসে এল। ওঙলেরা সাড়া দিয়েছে। উৎকর্ণ হয়ে সেঙাই শব্দটার উৎস লক্ষ করতে লাগল। পাহাড় যেখানে একটা খাড়াই বাঁক নিয়ে উত্তর দিকে নেমে গিয়েছে, ঠিক সেখান থেকেই শব্দটা বাতাসে তরঙ্গিত হতে হতে ভেসে আসছে।
সেঙাই বলল, উত্তরের পাহাড়ে রয়েছে ওঙলেরা। সেখানে চল।
চল। উঠে দাঁড়াল রেঙকিলান।
টিজু নদী পেছনে রেখে ঘন বনের মধ্যে দিয়ে দুলতে দুলতে এগিয়ে চলল দুজনে। এক অপরিমেয় খুশিতে মনটা কানায় কানায় ভরে আছে সেঙাই-এর। ওদিকে অস্বাভাবিক আতঙ্কে নির্বাক হয়ে পথ চলছে রেঙকিলান। সামান্য একটু আওয়াজেই চমকে চমকে উঠছে সে। কখন কিভাবে যে আনিজার আবির্ভাব হবে কে বলতে পারে?
চড়াই-এর দিকে উঠতে উঠতে একটা অতিকায় ন্যাড়া পাথরের পাশে এসে থমকে দাঁড়াল সেঙাই। তার পেছনে রেঙকিলান। পাথরের চাইটার ঠিক পাশ দিয়েই একটা শান্ত, শব্দহীন ঝরনা। দু’পাশ থেকে বিশাল বিশাল গাছের নিবিড় ছায়া ঝুঁকে পড়েছে জলধারাটির বুকে। গাছপালার ফাঁক দিয়ে সোনার তারের মতো দুএকটি রোদের রেখা এসে পড়েছে। যেখানে রোদ পড়েছে, জল সেখানে চিকচিক করছে।
হঠাৎ ঝরনার ঠিক পাশে এক অপরূপ পাহাড়ী যুবতাঁকে দেখল সেঙাই। একটি অপূর্ব নারীতনু। ওপরের দিকটা একেবারে অনাবৃত। সোনালি স্তন। তীক্ষ্ণ বৃন্তটি ঘিরে গাঢ় খয়েরি রঙের বৃত্ত। উজ্জ্বল তামাভ দেহ থেকে আলো ঠিকরে বেরুচ্ছে যেন। খাসেম ফুল আর কড়ির অলঙ্কার দিয়ে কেশসজ্জা করা হয়েছে। নাভিমূলের তলা থেকে জানুর ওপর পর্যন্ত লাল রঙের কুমারী কাপড়। চারিদিকে একবার তাকাল মেয়েটি। তারপর একটানে কাপড় খুলে ফেলল। একেবারে নগ্ন সৌন্দর্য। বন্য পাহাড়ের এক মাদক মাধুর্য। সুডৌল ঊরু, নিটোল নিতম্ব, ছোট ছোট পিঙ্গল চোখ। সোনার বাটির মতো যুগল বুকের মাঝখানে শঙ্খের হার। কিছুক্ষণ নিজের দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইল মেয়েটি। তারপর ঝরনার পাশে একটা সাদা পাথরের ওপর বসল।
চারপাশে নিবিড় বন। খাড়াই উপত্যকা থেকে বয়ে এসেছে নিঃশব্দ এক ঝরনা। পাহাড়, অরণ্য, নিঝর-এর পটভূমিতে নগ্ন নারীদেহটি বিস্ময়কর মনে হয়। অরণ্যময় এই পাহাড় যেন রমণীয় হয়ে উঠেছে। সেঙাই-এর বন্য মনও আবিষ্ট হয়ে রইল। বনকন্যার এই অনাবৃত দেহ তার মোহিত চেতনা থেকে সমস্ত পৃথিবীকে যেন মুছে নিয়ে গিয়েছে। একটু আগে খোনকেকে বর্শা দিয়ে কুঁড়ে এসেছে সে। হত্যার আদিম উল্লাসে মনটা তার পূর্ণ হয়ে গিয়েছিল। সেই উল্লাসের ওপর অনাবরণ পাহাড়ী কুমারীর রূপ মদের নেশার মতো মিশে অপূর্ব মৌতাত ছড়িয়ে দিল দেহমনে।
টানডেনলা পাখির মতো জল ছিটিয়ে ছিটিয়ে গায়ে দিচ্ছে মেয়েটি। ছপছপ শব্দে গানের ঝঙ্কার শুনতে পাচ্ছে সেঙাই। তার আঠারো বছরের যৌবন। সমস্ত ইন্দ্রিয় যেন আচ্ছন্ন হয়ে আসতে লাগল সেঙাই-এর। তাদের কেলুরি গ্রামে অজস্র কুমারী মেয়ের নগ্ন শরীর সে দেখেছে। কিন্তু এমন করে তার স্নায়ু কোনোদিনই ব্যগ্র হয়ে ওঠেনি। কোনোদিনই তার কামনা এমন ভয়ঙ্কর হয়নি। এ মেয়েটি তার অজানা। একে সে আগে কখনও দেখেনি। তবু এক বিচিত্র উত্তেজনায় দেহটা ছিটকে যেতে চাইছে মেয়েটির কাছে। শিরায় শিরায় রক্তের মাতামাতি উদ্দাম হয়ে উঠেছে। নাকের মধ্যে নিশ্বাস গরম হয়ে উঠছে। টিজু নদীর মতো বুক তরঙ্গিত হচ্ছে। চোখের পিঙ্গল মণি দুটো অপলক হয়ে রয়েছে মেয়েটির দেহের ওপর।
সেঙাইর পাশ থেকে এবার রেঙকিলানও দেখে ফেলেছে, আরে, এ তো মেহেলী।
দ্রুত ঘুরে দাঁড়াল সেঙাই। তার গলায় অসহ্য কৌতূহল, মেহেলী? সে কে? আমাদের বস্তির মেয়ে তো নয়।
না। ও সালুয়ালাঙ বস্তিতে থাকে। পোকরি বংশের মেয়ে।
পোকরি বংশের মেয়ে!
হু-হু, যে বংশ তোর ঠাকুরদার মাথা কেটে নিয়ে গিয়েছিল।
পোকরি বংশ! আচমকা প্রচণ্ড রাগে সমস্ত দেহটা কেঁপে উঠল সেঙাই-এর। ভুলে গেল মাত্র কয়েক মুহূর্ত আগে তার কামনার প্রতিটি অগ্নিকণা দিয়ে মেয়েটির দেহ ঝলসে ঝলসে সে আস্বাদ নিতে চেয়েছিল।
প্রতিশোধ। সেঙাইর চোখ জ্বলে উঠল। কোনো ক্ষমা নেই, কোনোরকম করুণা নেই। এ তার কর্তব্য। পূর্বপুরুষের প্রতি উত্তরপুরুষের দায়িত্ব। শ্বাপদের মতো হাতের থাবা হিংস্র হয়ে উঠল সেঙাই-এর। তারপর পাহাড়ের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল সে।
এই, কে তুই? কঠিন হল সেঙাইর গলা।
পাহাড়ী ঝরনার পাশে এক রমণীর বিবস্ত্র সৌন্দর্য চমকে উঠল। মাথার অজস্র চুল থেকে কণায় কণায় জল ঝরছে। ছোট ছোট পিঙ্গল চোখে অসহায় দৃষ্টি।
মেয়েটি আশ্চর্য শান্ত গলায় বলল, আমি মেহেলী, পোকরিদের মেয়ে। নদীর ওপারে সালুয়ালাঙ বস্তিতে আমাদের ঘর। আমি রোজ বিকেলে এই ঝরনায় চান করতে আসি। কিন্তু তুই কে?
আমি কে? সেঙাই-এর হাতটা বর্শাসমেত আকাশের দিকে উঠে গেল। আর বর্শার ফলায় নিশ্চিত মৃত্যুর প্রতিচ্ছায়া পড়ল, বর্শা দিয়ে তার জবাব দেব।
মাথার ওপর উদ্যত বর্শা। পলকে উঠে দাঁড়াল মেয়েটা। তারপর আখুশু ঝোঁপ থেকে একমুঠো পাতা ছিঁড়ে সেঙাই-এর দিকে ডান হাতখানা বাড়িয়ে দিয়ে দোলাল। অবশেষে সাদা পাথরের ওপর সেই পাতাগুলো বিছিয়ে বসে পড়ল।
বর্শাসহ হাতখানা নেমে এল সেঙাই-এর। নাগাদের প্রথা অনুযায়ী মেহেলীতার কাছে সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করেছে। পাতা নাড়িয়ে তার ওপর বসার পর হত্যা করা রীতিমতো অপরাধ।
পলকহীন তাকিয়ে আছে মেহেলী। তার দু’টি ছোট ছোট চোখে আতঙ্ক আর অসহায়তা।
সেঙাইও তাকিয়ে ছিল। তার চোখে একটা বিরক্ত ভ্রুকুটি ফুটে রয়েছে। থাবার সীমানায় শিকার। অথচ তাকে বিন্দুমাত্র আঘাত হানা এক নিকৃষ্ট পাপাঁচরণ। কোনমতেই তার অনিষ্ট করা চলবে না। পুরোপুরি বশ্যতা স্বীকার করেছে মেহেলী।
লম্বা লম্বা পা ফেলে সামনের দিকে এগিয়ে আসতে আসতে থমকে দাঁড়াল সেঙাই। মনের মধ্যে অনেক দিন আগে শোনা খাপেগার কাহিনী স্নায়ুতে তড়িৎপ্রবাহ সৃষ্টি করল হঠাৎ। এমনি নিঃশব্দ আর নির্জন এক ঝরনাধারার পাশে বহুকাল আগে মুখোমুখি হয়েছিল নিতিৎসু আর জেভেথাঙ। পোকরি আর জোহেরি বংশ। আশ্চর্য মিল। আশ্চর্য যোগাযোগ। এত বছর পর দুই বংশের উত্তরকাল আবার সেই ঝরনার পারেই মিলিত হয়েছে। সেঙাই আর মেহেলী। টিজু নদীর এপার আর ওপার। অনেক বছর আগে দুই বংশের যে দুই যৌবন এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের যবনিকা তুলে দিয়েছিল, কালের অমোঘ প্রভাবে তারা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। নতুন কালে মেহেলী আর সেঙাই, দুই বংশের নতুন যৌবন আবার অন্য এক সংগ্রামের নায়ক-নায়িকা হয়ে এল কিনা, কে বলতে পারে।
চারিদিকে একবার সতর্ক চোখে তাকাল সেঙাই। কিছু বিশ্বাস নেই শত্রুপক্ষের কুমারী যৌবনকে। হয়তো আশেপাশে কোথাও লুকিয়ে রেখেছে লোহার মেরিকেতসু কি একখানা তীক্ষ্ণধার থেনি মী (স্ত্রীলোর বর্শা)। একটু অসাবধান হলেই সাঁ করে ছুঁড়ে মারবে। নাঃ, তেমন সন্দেহজনক কিছুই আবিষ্কার করতে পারল না সেঙাই।
রেঙকিলান আসেনি। অতিকায় ন্যাড়া পাথরটার ওপাশ থেকে সে সেঙাই আর মেহেলীর ভাবগতিক লক্ষ করছিল কি করছিল না। এক ভয়াল ভাবনা তাকে আতঙ্কগ্রস্ত করে রেখেছে। আনিজার কবল থেকে অশুচি দেহমন আর ভাবনাটাকে কিছুতেই মুক্ত করতে পারছে না রেঙকিলান। নিজের দেহটাকে অস্বাভাবিক ভারী মনে হচ্ছে তার। বিশাল পাথরটার ওপর শরীর হেলিয়ে দিয়ে নির্জীবের মতো দাঁড়িয়ে আছে সে।
আরো একটু এগিয়ে এসেছে সেঙাই। এবার তার প্রাকুটিটা সরে গেল। তার বদলে এক বিস্মিত কৌতূহল ফুটে বেরিয়েছে, হু-হু, তোর আচ্ছা সাহস তো! হুই বস্তি থেকে রোজ এ বস্তির ঝরনায় আসিস চান করতে! ভয়-ডর নেই একটুও?
চারদিক দেখে আসি। এই ঝরনায় চান করতে আমার বড় ভালো লাগে।
কিন্তু কেউ যদি দেখে ফেলে?
না, কেউ দেখবে না। নিশ্চিন্ত আনন্দে ঝরনার হিমাক্ত জল গায়ে ছিটিয়ে ছিটিয়ে দিতে লাগল মেহেলী।
এই যে আমি দেখে ফেললুম।
তুই তো আমাকে মারলি না। আর কেউ এলে পাতা নেড়ে নেড়ে তার ওপর বসে পড়ব। আমার বাপ বলে দিয়েছে। তা হলে আর কেউ মারবে না। শান্ত মুখে এতটুকু ভাবনার লেশ নেই এখন মেহেলীর। দুই চোখে আর ঠোঁটে মধুর রহস্যের মতো হাসি লেগে রয়েছে শুধু।
জানিস, আমাদের আর তোদের বস্তিতে ভীষণ ঝগড়া!
জানি তো। অপরূপ সরল চোখে তাকাল মেহেলী।
তবু তোর ভয় নেই?
ভয়ের কী আছে? আমি পাহাড়ী মেয়ে না? ঝঙ্কার তুলে হেসে উঠল মেহেলী।
আশ্চর্য মেয়ে! এই নগ্ন সৌন্দর্যের মধ্যে শুধু রূপই নয়, শুধু একটা আদিম আকর্ষণই নয়, আরো কিছুর সন্ধান পেল সেঙাই। একটা বিচিত্র ভাবনার দোলা লাগল অস্ফুট পাহাড়ী যৌবনের চেতনায়। সে ভাবনার স্পষ্ট কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারবে না সেঙাই। তবু দেহ নয়, শুধু রূপগত নয়, যেন আরো অভিনব কিছু আছে মেহেলীর মধ্যে। ভয়ের লেশ নেই, ভাবনার এতটুকু লক্ষণ নেই, পরম নিশ্চিন্তে সে পার হয়ে এসেছে টিজু নদীর ভয়ঙ্কর সীমানা। এমন মেয়ে নিঃসন্দেহে বিচিত্র, অদ্ভুত। সেঙাইর বন্য পাহাড়ী মন তার অধস্ফুট বুদ্ধি দিয়ে এই মেয়েটিকে ঠিক বুঝতে পারছে না। তবু নেশার মতো এক আলোড়ন জেগেছে শিরায় শিরায়, স্নায়ুতে স্নায়ুতে।
একসময় সেঙাই বলল, তুই চান কর। আমাদের খিদে পেয়েছে। যাচ্ছি।
সত্যি, পেটের মধ্যে খিদের ময়াল ফুঁসছে। ক্লান্ত দু’টি পা রেঙকিলানের দিকে বাড়িয়ে দিল সেঙাই।
.
০৩.
উত্তরের পাহাড়টা যেখানে একটা খাড়াই বাঁক ঘুরে নিচের মালভূমিতে নেমে গিয়েছে ঠিক সেখানে একটা বড় আরেলা ঝোঁপের পাশে বসে আছে ওঙলে আর পিঙলেই। পড়ন্ত বেলার নিবু নিবু আলোর রংটুকু আসন্ন সন্ধ্যা যেন শুষে নিচ্ছে। অন্ধকার নামতে দেরি নেই। পশ্চিম পাহাড়চূড়ার আড়ালে হারিয়ে গিয়েছে দিনান্তের সূর্য। শুধু দূরের আকাশ-ছোঁয়া চূড়াটা ঘিরে এখনও লালচে একটু আভা ছড়িয়ে রয়েছে।
গোটা পাঁচেক ঝরনা, দুটো জলপ্রপাত আর বনময় বিরাট মালভূমিটা ডিঙিয়ে উত্তরের পাহাড়ে চলে এল সেঙাই আর রেঙকিলান।
ওঙলে বড় বড় টঘুটুঘোটাঙ পাতার ওপর কাঁচা চাল, ঝলসানো বাসি মাংস, কাঁচা লঙ্কা আর আদা সাজিয়ে অপেক্ষা করছিল। বাঁশের চোঙায় ভর্তি রয়েছে উত্তেজক পানীয়। হলদে রঙের রোহি মধু।
একটি কথা বলল না সেঙাই। খাবারগুলোর দিকে তাকিয়ে আধফোঁটা উল্লাসের শব্দ করে উঠল মাত্র। তারপর টঘুটুঘোটাঙ পাতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
থাবায় থাবায় কঁচা চাল মুখে তুলছে সেঙাই। সেই সঙ্গে আদা, কাঁচা লঙ্কা আর খণ্ড খণ্ড মাংস। একসময় খাবার শেষ হয়ে গেল। তারপর বাঁশের বিশাল পানপাত্রটা ঠোঁটের ওপর তুলে নিল সে। একটি মাত্র চুমুক। রোহি মধুর শেষ বিন্দুটি পর্যন্ত শুষে নিয়েছে সে।
খাওয়ার পর্ব শেষ হল। পরিতৃপ্তির একটা ঢেকুর তুলল সেঙাই।
আচমকা ওঙলেদের দৃষ্টি এসে পড়ল রেঙকিলানের দিকে। মোটা মোটা আঙুল দিয়ে টঘুটুঘোটাঙ পাতার খাবারগুলো সে নাড়াচাড়া করছে। মাংস আর রোহি মধুর পাত্র তেমনি পড়ে রয়েছে। কিছুই খায়নি সে। চোখ দুটো অস্বাভাবিক লাল হয়ে উঠেছে রেঙকিলানের। হাত-পা থরথর করে কাঁপছে।
সন্ত্রস্ত গলায় ওঙলো বলল, কি রে রেঙকিলান, কী হয়েছে তোর? খাচ্ছিস না যে, শরীর খারাপ নাকি?
সেঙাইর গলা থেকে বিরক্তি ঝরল, কি জানি কী হয়েছে। বিয়ে করে একটা ছাগী হয়ে গিয়েছে ওটা। ওকে নিয়ে শিকারে গিয়ে ভুলই করে ফেলেছি।
নিরুত্তর রইল রেঙকিলান। শুধু অদ্ভুত ঘোলাটে দৃষ্টিতে সকলের দিকে তাকাতে লাগল। কিছুই যেন শুনতে পাচ্ছে না, কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। কতকগুলো অস্পষ্ট কথা, কতকগুলো আবছা মুখ তার ইন্দ্রিয়ের ওপর দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। মনের ওপর ক্ষীণ রেখাপাতও হচ্ছে না।
হা হা করে হাসির লহর তুলল সেঙাই, একেবারে বোবা মেরে গেছে রে ছাগীটা। কেলুরি বস্তির মোরাঙের নাম ডোবাবে। থুঃ—থুঃ—থুঃ–একদলা থুতু রেঙকিলানের গায়ে ছিটিয়ে দিল সে।
বিস্মিত ওঙলে বলল, কী হল রে সেঙাই?
কী হয়নি বল? ছাগীটাকে নিয়ে একটা সম্বরের খোঁজে নদীর ওপারে গিয়েছিলাম।
কোথায়! সালুয়ালাঙ বস্তিতে! চিৎকার করে উঠল ওঙলে। আতঙ্কে চোখে দুটো ঠিকরে বেরিয়ে আসবে যেন তার।
হু-হু। তাতে কী হয়েছে? তুইও দেখি রেঙকিলানের মতো ভীতু মেরে যাচ্ছিস। সেঙাই ভুরু কুঁচকে ধিক্কারের সুরে বলল।
আরে না না, তেমন বংশের ছেলে আমি না। আমিও খোখিকেসারি বংশের ছেলে। আমার জেঠা হল খাপেগা। মুখ সামাল দিয়ে কথা বলবি সেঙাই। গর্জে উঠল ওঙলে। ভীরু! এই অন্যায় অপবাদ তার বন্য পৌরুষকে রীতিমতো আহত করেছে।
ওঙলের দিকে একবার তির্যক চোখে তাকাল সেঙাই। একটা খ্যাপা চিতাবাঘের মতো দুর্বার আর ভয়ঙ্কর ওঙলে। ওকে ঘাঁটানো সুবিধের হবে না। সাঁ করে একটা বর্শা নির্বিকার ছুঁড়ে বসতে পারে সে।
দাঁতে দাঁত ঘষে শব্দ করে উঠল সেঙাই। তারপর চাপা গলায় বলল, আচ্ছা, কেমন মরদ, কাজের সময় দেখা যাবে।
দেখিস।
যেতে দে ও কথা। সেঙাই নিজে থেকেই ব্যাপারটা মিটিয়ে নিল, তারপর যা বলছিলাম। সম্বরটার তল্লাশে তো গেলাম সালুয়ালাঙে। আমি বর্শা দিয়ে ছুঁড়বার আগেই একটা চিতাবাঘ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল ওটার ঘাড়ে।
তাই বলি, দুপুরবেলা বাঁশের চাচারিতে শব্দ করলাম কত বার। তোদের কোনো সাড়াই নেই। ভাবলাম, ব্যাপার কী? আরেলা ঝোঁপটার পাশ থেকে বলে উঠল পিঙলেই, আবার দুপুর পেরিয়ে যখন বিকেল হল তখন চাচারি বাজালাম। তখনও তোদের সাড়া নেই। আমরা
তো ঘাবড়েই গিয়েছিলাম। ওঙলে আর আমি ঠিক করলাম, তোদের তল্লাশে বেরুব। তারপর ঠিক পড়ন্ত বেলায় বস্তির ছেলেরা যখন গোরু-ছাগল-মোষ নিয়ে ঘরে ফিরছে ঠিক তখন তোদের চারির শব্দ পেলাম।
আরে যেতে দে, যেতে দে ও-সব কথা। একটা কাণ্ড হয়েছে। তা-ই শোন। আমার যা আনন্দ হচ্ছে তা কি আর বলব! দুটো পা ছড়িয়ে বেশ তরিবত করে বসল সেঙাই।
না-না, এখন না। এখন গল্প বললে দেরি হয়ে যাবে। মোরাঙে গিয়ে তোর গল্প শুনব সকলে মিলে। বড় শীত করছে সেঙাই। তা ছাড়া সন্ধ্যা হয়ে আসছে। চড়াই-উৎরাই ডিঙিয়ে, বনবাদাড় ঠেঙিয়ে যেতে যেতে রাত্তিরে খাবার সময় পার হয়ে যাবে। বড় শীত সেঙাই। হি হি করে কাঁপা গলায় বলল ওঙলে।
শীতের সন্ধ্যা। বাতাসে যেন গুঁড়ো গুঁড়ো হিম উড়ছে। মহাশূন্যের অন্ধকার ঘন হয়ে নামতে। শুরু করেছে নাগা পাহাড়ের ওপর।
সেঙাই বলল, তাই ভালো। বড্ড শীত করছে। মোরাঙে ফিরে আগুনের ধারে বসে বসে গল্প বলবখন।
শীতের বাতাসে যেন ধারাল দাঁত বেরিয়েছে। অনাবৃত দেহের ওপর কেটে কেটে বসছে তার নির্মম কামড়। আকাশে একটা একটা করে বিবর্ণ তারা ফুটতে শুরু করেছে। আর মাঝে মাঝে দমকা বাতাস সাঁ সাঁ করে আছড়ে পড়ছে নিবিড় বনের ওপর।
তিনজনে আরেলা ঝোঁপটার পাশ থেকে উঠে দাঁড়াল। একটা নিষ্প্রাণ শিলামূর্তির মতো এখনও স্থির হয়ে বসে রয়েছে রেঙকিলান।
সেঙাই বলল, কি রে, কী হল তোর? বস্তিতে ফিরবি না?
ভাবলেশহীন চোখে তাকাল রেঙকিলান। খানিকক্ষণ তাকিয়েই রইল। তারপর ফিসফিস গলায় বলল, আমি উঠতে পারছি না সেঙাই। শরীরটা বড় ভারী লাগছে। আমাকে টেনে তোল তোরা।
হো হো করে শীতের সন্ধ্যা কাঁপিয়ে, নাগা পাহাড়ের উপত্যকা দুলিয়ে দুলিয়ে হেসে উঠল ওঙলে, সেঙাই আর পিঙলেই। নাঃ, আনিজাতেই পেয়েছে ছাগীটাকে।
আনিজা! আর্তনাদ করে উঠল রেঙকিলান। অদ্ভুত ভয়ে গলা শুকিয়ে উঠছে। বুকের ভেতরটা যেন জ্বলতে জ্বলতে খাক হয়ে যাচ্ছে তার।
রেঙকিলানের আর্তনাদে স্তব্ধ হয়ে গেল তিনজন। সেঙাই, পিঙলেই আর ওঙলে। নিঃশব্দে তারা তিনখানা হাত বাড়িয়ে দিল। তিনটে হাতের আশ্রয়ে নিজেকে সঁপে দিল রেঙকিলান। তারপর খাড়াই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে বেয়ে নিচের দিকে নামতে লাগল।
নিচের মালভূমিতে এখন গাঢ় অন্ধকার। সেখানে জটিল বনের আঁকিবুকি। এই মালভূমি পেরিয়ে দক্ষিণের পাহাড়। সেই পাহাড়ের চড়াইতে সেঙাইদের গ্রাম।
এর মধ্যে কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। অবিরাম, অবিশ্রাম। আর এই কুয়াশার স্তরের নিচে হারিয়ে যাচ্ছে নাগা পাহাড়। ক্কচিৎ দুএকটি মিটমিটে তারা নজরে আসে।
বনের মধ্যে চারিদিকে জোড়া জোড়া নীল আগুন ঘুরপাক খাচ্ছে। বাঘের চোখ, ময়ালের দৃষ্টি। কখনও মুমূর্ষ গলায় আর্তনাদ করে উঠছে কোনো নিরীহ হরিণ। নির্ঘাত তার ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে কোনো হিংস্র জানোয়ার। টানডেনলা পাখি এই নিবিড় অন্ধকারে, নাগা পাহাড়ের এই ভয়াল শীতের রাত্রে প্রেতকণ্ঠে ককিয়ে উঠছে।
উপত্যকা মাতিয়ে কলোল্লাসে নামছে জলপ্রপাত। গম গম শব্দ বিভীষিকার মতো ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
নীর অন্ধকার। যেন কঠিন হিমস্তূপের মধ্যে দিয়ে পথ কেটে কেটে এগিয়ে চলছে চারটে পাহাড়ী মানুষ। মাঝে মাঝে বাঘ গর্জাচ্ছে। উল্কার মতো সরে সরে যাচ্ছে বুনো সাপ। অনাবৃত শরীরের ওপর উড়ে উড়ে বসছে বিষাক্ত পতঙ্গ। তাদের তীক্ষ্ণ হুলে জ্বলে যাচ্ছে বুক পিঠ, হাত পা।
একসময় মালভূমিটা পার হয়ে এল চারজন। মাঝখানে রেঙকিলান, সামনে সেঙাই, পেছনে ওঙলে আর পিঙলেই।
চাপা গলায় সেঙাই বলল, আরো আগে বস্তিতে ফেরা উচিত ছিল। বড় দেরি হয়ে গেছে।
হু-হু। ওঙলে মাথা নেড়ে সায় দিল।
আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ। শুধু পাহাড়ী ঘাসের ওপর দিয়ে চার জোড়া পায়ের সন্ত্রস্ত শব্দ। শোনা যেতে লাগল।
একসময় রেঙকিলান ফিসফিস গলায় বলল, আমার ভয় করছে সেঙাই, বড় ভয় করছে। আরো জোরে আমাকে চেপে ধর।
আগের মতো সেঙাই এবার আর মশকরা করল না। বিন্দুমাত্র ব্যঙ্গ কি ঠাট্টা নয়। চকিত হয়ে সে বলল, কী ব্যাপার রেঙকিলান?
আমি একটা মিছে কথা বলেছিলাম তোকে। অস্ফুট শোনাল রেঙকিলানের কণ্ঠ। অস্বাভাবিক আতঙ্কে গলাটা যেন বুজে আসছে তার।
কী বলেছিলি?
প্রায় স্বগতোক্তি করল রেঙকিলান, সে কথা আমি বলতে পারব না। বললে তোরা আমাকে মেরে ফেলবি।
রেঙকিলানের শেষ কথাগুলো কেউ শুনতে পেল না। ওঙলে না, সেঙাই না, পিঙলেই না। এমন কি রেঙকিলান নিজেই হয়তো শোনেনি। শুধু তার স্নায়ুর তারে তারে এক তীব্র আতঙ্ক তরঙ্গিত হয়ে যাচ্ছে। আনিজা! আনিজা! দূর পাহাড়চূড়া থেকে বনদেবীর অভিশাপ তাকে লক্ষ করে যেন উদ্যত হয়ে রয়েছে।
আচমকা দক্ষিণ পাহাড়ের খাড়া উতরাই থেকে একটা সুতীক্ষ্ণ শব্দ ভেসে এল। শব্দটা ঘন বনের পাতায় পাতায় স্পন্দিত হচ্ছে। উৎকর্ণ হয়ে চারটে পাহাড়ী মানুষ শুনতে লাগল।
চমকে উঠল রেঙকিলান। নাঃ, এতটুকু ভুল নেই। এখন পুরোপুরি নিঃসংশয় সে। এ শব্দে বাতাসের কারসাজি নেই, এ শব্দ একটি মানবীর কণ্ঠ। সে মানবীর নাম সালুনারু। সালুনারু তার বউ। এই মুহূর্তে ওই শব্দের মধ্যে সালুনারুর গলা চিনতে পেরে চকিত হয়ে উঠল রেঙকিলান।
আবার সেই তীক্ষ্ণ অথচ করুণ আওয়াজ ভেসে এল। পাহাড়ী উপত্যকায় উপত্যকায় সে আওয়াজ একটা আর্ত সুরের মতো ছড়িয়ে পড়ল।
সেঙাই বলল, কে যেন ডাকছে—
হু-হু। ও নির্ঘাত সালুনারু। রেঙকিলান বলল।
সকালে শিকারে বেরুবার পর থেকে খানিক আগে পর্যন্ত একেবারে মিইয়ে ছিল রেঙকিলান। তার ধমনীতে রক্ত আবার স্বাভাবিকভাবে বইতে লাগল। সতেজ হল রেঙকিলান। সেঙাইরা আছে পাশে। কিন্তু তাদের বিশ্বাস নেই। কাল রাতের অনাচারের কথা জানামাত্র। তাকে বর্শা দিয়ে চৌফালা করে ফেলবে ওরা। একমাত্র সালুনারু নিরাপদ, তার আশ্রয়ে এতটুকু ভয় নেই। সেই সালুনারুই তাকে পাহাড়ের চড়াই-উতরাইতে ডেকে ডেকে ফিরছে। দেহমন। থেকে গুড়ো গুঁড়ো বরফের মতো সব ভয়, সব আতঙ্ক ঝরে গেল এই ডাকে। পুনর্জীবনে ফিরে এল রেঙকিলান।
সেঙাই বলল, কিরকম একটা শব্দ, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তবে ওটা মানুষের গলাই। ও কি সালুনারু?
হু-হু, ও সালুনারু। আমি চললাম। তোরা বস্তিতে যা, আমি বউকে নিয়ে ফিরব। রেঙকিলানের গলাটা খুশি খুশি হয়ে উঠেছে।
ভয় করবে না তো, কি রে ছাগী! সেঙাইর গলায় কৌতুক রয়েছে, খুব সোয়ামী হয়েছিস বটে!
যা যা, বেশি ফ্যাক ফ্যাক করতে হবে না। বলতে বলতে একটু যেন সংশয়ই হল রেঙকিলানের, গলাটা সালুনারুর তো? তারপর তীরের মতো ছুটে দক্ষিণ পাহাড়ের খাড়া উতরাই-এর দিকে মিলিয়ে গেল সে।
পেছনে তিনটি বন্য গলায় উৎকট অট্টহাসি বেজে উঠল। ওঙলে, সেঙাই আর পিঙলেই তিনজনেই সারা দেহ দুলিয়ে দুলিয়ে হাসছে।
.
০৪.
আকাশ থেকে শীতের বিকেল তখনও খানিকটা আলো দিচ্ছিল। এই পাহাড়ে, এই উপত্যকায়, এই মালভূমির ওপর রোদের সোনা ছড়াচ্ছিল। নিঃশব্দ ঝরনার পাশে বসে বসে আজকের এই পাহাড়ী পৃথিবীটাকে বড় মধুর লাগছিল মেহেলীর। এই নিবিড় বন, সাপেথ কুঞ্জের পাশ দিয়ে এই নিরুচ্ছাস জলধারা, বিকেলের মায়াবী রোদ–সব যেন আশ্চর্য রূপময় হয়ে উঠেছে।
খানিক আগে তার দিকে বর্শা উঁচিয়ে ধরেছিল সেঙাই, তাদের শত্রুপক্ষের ছেলে। জোহেরি বংশের উদ্ধত যৌবন। তামাভ দেহ, কানে নীয়েঙ গয়না। পিঙ্গল চোখে ভয়াল সৌন্দর্য। সেঙাইর সম্বন্ধে অনেক গল্প শুনেছে লিজোমুর কাছে, পলিঙার কাছে। তাদের ছোট পাহাড়ী জনপদ সালুয়ালাঙের অনেক যুবতী সেঙাইর রূপে মাতাল। দূর থেকে দেখেই মজে গিয়েছে। তারা। তাদের মুখে সেঙাইর গল্প শুনে শুনে কামনায় আর চেতনায় একটা রমণীয় ছবি এঁকেছে মেহেলী। আজ প্রথম সে দেখল শত্রুপক্ষের যৌবনকে–সেঙাইকে। তার কামনার মানুষটিকে।
চারিদিকে একবার চনমনে চোখে তাকাল মেহেলী। আশ্চর্য, সেঙাই নেই। একটু আগে এই নিঝুম ঝরনা, এই নিবিড় বন, এই খাড়াই উপত্যকার পটভূমি থেকে কী এক ভোজবাজিতে যেন মুছে গিয়েছে সে। যে পথ দিয়ে সেঙাই চলে গিয়েছে, সেদিকে অনেক, অনেকক্ষণ আবিষ্ট নজরে তাকিয়ে রইল মেহেলী। তারপর একটা পাহাড়ী ময়ালের মতো ফোঁস ফোঁস করে কয়েকটা নিশ্বাস ফেলল।
বিকেলের রং ঝাপসা হয়ে আসছে। আর একটু পরেই শীতের সন্ধ্যা নামবে এই পাহাড়ে। এবার উঠতে হবে। টিজু নদীর ওপারে তারই জন্য অপেক্ষা করছে পলিঙা আর লিজোমু।
টানডেনলা পাখির মতো আরো কিছুক্ষণ ছিটিয়ে ছিটিয়ে সারা শরীরে জল মাখল মেহেলী। তারপর পাথরের ওপর থেকে লাল লঙের কুমারী কাপড়টা তুলে কোমর থেকে জানু পর্যন্ত ঝুলিয়ে দিল। তারও পর ঝোঁপের কিনার দিয়ে নাচের ভঙ্গিতে টিজু নদীর দিকে পা চালিয়ে দিল।
নদী পেরিয়ে বাঁ দিকের বিশাল উপত্যকায় পলিঙাদের সঙ্গে মুখোমুখি হল মেহেলী। পলিঙা আর লিজোমু পাহাড়ী অরণ্য থেকে অজস্র টঘুটুঘোটাঙ ফুল তুলে এনেছে। আতামারী লতায় বুনে বুনে সেই ফুল দিয়ে ঘাগরা বানিয়ে পরেছে। কানে, চুলে খুশিমতো সেই বাহারি ফুল গুঁজে খুঁজে নিজেদের রূপবতী করে তুলেছে।
পলিঙা বলল, কি লো মেহেলী, তোর চান হল?
হল তো।
রোজ রোজ হুই কেলুরি বস্তির ঝরনায় চান করতে যাস। কী মজা আছে সেখানে? কাউকে লগোয়া পন্য (প্রেমিক) পেয়েছিস নাকি? তেরছা চোখে তাকাল লিজোমু।
মিটিমিটি হাসল মেহেলী, দুচোখের পিঙ্গল মণিতে খুশির আলো জ্বলছে। প্রথমে কিছু বলল সে। একেবারে নিরুত্তর রইল।
হাসলে চলবে না মেহেলী। ওপারে তুই মনটা হারিয়ে ফেলেছিস, মনে হচ্ছে। কিন্তু । সাবধান, ওরা এ বস্তির শত্রুপক্ষ। দেখামাত্র ছুঁড়ে ফেলবে বর্শা দিয়ে।
ফুঁড়বে কেন? পিরিত করবে। রহস্যময় গলায় খিলখিল করে হেসে উঠল মেহেলী।
সন্দিগ্ধ চোখে তাকাল লিজোমু, পিরিত করবে?
করবে লো, করবে। আমার সঙ্গে একদিন ওপারে গিয়ে দেখিস, তোরও একটা লগোয়া পন্যু (প্রেমিক) জুটিয়ে দেব। পাহাড়ী মেয়ে মেহেলী, তার চোখ দুটো আমারী ফলের দানার মতো চকচক করে উঠল, সত্যি বলছি, কেলুরি বস্তির ছোঁড়ারা বড় ভালো।
কেন, আমার লগোয়া পন্য (প্রেমিক) নেই? খোনকে আছে না? তোর দাদা লো, তোর দাদা। তোর দাদাকে আমি পিরিত করি, জানিস না? ফোঁস করে ওঠে লিজোমু।
খোনকেকে পিরিত করিস, তা তো জানি। পাহাড়ী মাগী তুই; মোটে একটা পুরুষকে নিয়ে খুশি থাকতে পারবি? বাঁকা চোখে তাকাল মেহেলী; তারপর আউ পাখির মতো ঘাড় কাত করে খিকখিক শব্দ হেসে উঠল, অনেক পুরুষকে একসঙ্গে মাতিয়ে দিবি, মজাবি। তারপর এক পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মজা দেখবি। দুবস্তিতে দাঙ্গা বাধাবি, রক্তে লাল হয়ে যাবে পাহাড়। তা। না হলে কী জোয়ান মাগী হলি!
ধাঁ করে একটা লোহার মেরিকেতসু তুলে ধরল লিজোম, মাথা একেবারে ঘেঁচে দেব মাগী। তেমন লগোয় লেন (প্রেমিকা) আমাকে পাসনি মেহেলী। তোর দাদা ছাড়া আর কারো সঙ্গে আমি পিরিত করেছি? এত ছোঁড়া তো আছে আমাদের সালুয়ালাঙ বস্তিতে!
আরে যেতে দে ওসব কথা। আচ্ছা মেহেলী, নদীর ওপারে রোজ রোজ কী জন্যে যাস বল দিকি, শুনি। সত্যি কথা বলবি। শান্ত মেয়ে পলিঙা জানতে চাইল।
হু-হু–একবার ধারাল চোখে লিজোমুর দিকে তাকিয়ে নিল মেহেলী। তারপর বলল, তোরা যার গল্প করিস, আজ তার দেখা পেয়েছি। সেঙাইকে দেখলুম হুই ঝরনাটার পাশে।
বলিস কী! এবার অন্তরঙ্গ হয়ে বসল পলিঙা।
তারপর? লিজোমুও মেরিকেতসুটা এক পাশে রেখে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল। খানিক আগে যা যা ঘটেছে সব বলল মেহেলী, সত্যি ভাই, দেখেই আমার মন মজে গেছে। ওকে পেতেই হবে। একটা বুদ্ধি দে তোরা।
চকচকে চোখে তাকিয়ে লিজোমু বলল, আচ্ছা, সেঙাই একবার ছুঁয়েও দেখল না তোকে? তোর সোয়াদ একটু চেখেও নিল না?
চেখে দেখলে তো মনের জ্বলুনি কমত। ওকে না পেলে সারা দিনরাত জ্বলে মরব। মনে হচ্ছে, সেঙাইকে জড়িয়ে ধরি, আঁচড়াই, কামড়াই। তোরা বল তো কী করি? ব্যাকুল দু’টি চোখ তুলে তাকাল মেহেলী, আমার সঙ্গে যাবি কাল ঝরনাটার পাশে? কি লো লিজোমু, কি লো পলিঙা-যাবি?
না, যাব না। আমাদের অত সাহস নেই। আচমকা বর্শা ছুড়লে নির্ঘাত মরে যাব। জোয়ান বয়েস, এখন তোর জন্যে মরবার ইচ্ছা নেই। ঘর বাঁধব, পুরুষ চাখব, ছেলেপুলে হবে। এই বয়েসে মরতে সাধ হয় না। নিস্তেজ গলায় বলে উঠল লিজোমু, তবে সেঙাই বড় খাসা পুরুষ–
কী করি বল তো? এখন আমি কী করি? মনের প্রবল অস্থিরতা থেকে মেহেলীর কথাগুলো যেন বেরিয়ে আসতে লাগল।
সহসা পলিঙা বলল, উত্তর পাহাড়ে এক বুড়িডাইনি আছে। সে অনেক ওষুধ জানে, পুরুষ বশ করার অনেক মন্তর তার জানা। তার কাছে চল। সে ঠিক বলে দেবে কী করতে হবে।
তীরের মত উঠে দাঁড়াল মেহেলী, চল, এখুনি যাব।
লিজোমু আর পলিঙাও উঠে পড়ল। লিজোমু বলল, তোরা যা, আমি এখন যেতে পারব না। সারাদিন খোনকের দেখা পাইনি। তার খোঁজে যাব। সেঙাইকে তুই পেলি মেহেলী, বড় তাগড়া জোয়ান সে–
বস্তিতে যা তুই। আমরা উত্তর পাহাড়ে ডাইনি বুড়ির সঙ্গে দেখা করে ফিরব।
সালয়ালা গ্রামের দিকে চলে গেল লিজোমু। আর উত্তর পাহাড়ের নিবিড় বনে-ঘেরা চড়াইর দিকে পা বাড়িয়ে দিল মেহেলী আর পলিঙা। দু’টি পাহাড়ী যুবতী। দু’টি বন্য আপোজি (বান্ধবী)।
.
বাদামি পাথরের মধ্যে ছোট্ট একটি সুড়ঙ্গ। চারপাশে উদ্দাম বন। সুড়ঙ্গের মুখ থেকে স্বচ্ছন্দে প্রবেশের জন্য বন কাটা হয়েছে অনেকটা। জনপদ থেকে অনেক, অনেক দূরে এই সুড়ঙ্গ হল ডাইনি নাকপোলিবার আস্তানা।
সুড়ঙ্গের মুখে এসে থমকে দাঁড়াল পলিঙা আর মেহেলী। বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ড যেন থর থর করে কেঁপে উঠল। তীব্র আতঙ্কে চেতনাটা ছমছম করছে। আকাশ থেকে শীতের অসহ্য সন্ধ্যা নামছে। চুপচাপ দাঁড়িয়েই রইল দুজনে।
সুড়ঙ্গের মুখে কপিশ রঙের আলো এসে পড়েছে ভেতর থেকে। সমস্ত পরিবেশটা আশ্চর্য ভৌতিক। চারপাশে ছায়া কাঁপছে। খাসেম বন আর বুনো কলার পাতা দুলছে। ভীষণ ভয়। করতে লাগল পলিঙা আর মেহেলীর। তারা হয়তো পালিয়েই আসত।
আচমকা সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে একটি কর্কশ কণ্ঠ বেরিয়ে এল, কে? কে ওখানে?
আমরা পিসি। মেহেলী আর পলিঙা এসেছি। কাঁপা, ভীরু গলায় বলল পালিঙা, তোর সঙ্গে দরকার আছে।
ভেতরে আয় শয়তানের বাচ্চারা। সুড়ঙ্গের মধ্যে গলাটা এবার নরম শোনাল।
হামাগুড়ি দিয়ে সুড়ঙ্গপথ ধরে ভেতরে চলে এল মেহেলী আর পলিঙা।
ভেতরটা প্রশস্ত গুহার মতো। তিন দিকে পাথরের দেওয়াল। অমসৃণ মেঝে। আর সামনের দিকে সুড়ঙ্গপথ। মেঝের এদিকে সেদিকে ইতস্তত ছড়ানো গুনু পাতা, মানুষ আর মোষের হাড়। যুচোঙ গুটসুঙ পাখির বাদামি রঙের কঙ্কাল। বাঁশের পাত্র, কাঠের মাচান। পাথরের খাঁজে খাঁজে আগুন জ্বালিয়ে এই ভয়ঙ্কর পাহাড়ী গুহায় খানিকটা উত্তাপ সৃষ্টি করেছে ডাইনি নাকপোলিবা।
এক পাশে একটা পাথরের ওপর বসে ছিল নাকপোলিবা। কাছাকাছি একটা পেন্যু কাঠের মশাল জ্বলছে। স্তিমিত, অথচ স্নিগ্ধ আলোতে রহস্যময় হয়ে উঠেছে গুহাটা। সেই আলো ছড়িয়ে পড়েছে নাকপোলিবার নগ্ন দেহে, ছড়িয়ে পড়েছে কুঞ্চিত মুখের ভাঁজে ভাঁজে, একমাথা রুক্ষ চুলে। সাপের জিভের মতো লিকলিক করছে জটিল চুলগুলো।
নাকপোলিবার বয়স যে কত, তার হিসেব আশেপাশের তিনটে পাহাড়ের এতগুলি গ্রামের প্রাচীনতম মানুষটাও জানে না। সকলেই তাদের ঠাকুরদা কি ঠাকুমার কাছে তার গল্প শুনেছে।
গালের মাংস ঝুলে পড়েছে নাকপোলিবার, কোমরটা বেঁকে গিয়েছে ধনুকের মতো। কিছুক্ষণ দপদপে চোখে মেহেলী আর পলিঙার দিকে তাকিয়ে রইল সে। তারপর দাঁতহীন কালচে মাড়ি বার করে বলল, নির্ঘাত তোরা পিরিতের ওষুধ নিতে এসেছিস?
হু-হু। মেহেলী আর পলিঙা মাথা ঝাঁকাল।
হিসহিস করে উঠল নাকপোলিবা, পুরুষমানুষ বশ করতে পারিস না তো কী পাহাড়ী মাগী হয়েছিস? মরদ মজাতে ওষুধ লাগে! ইজা রামখো।
একটা নিরাপদ ব্যবধান রেখে বসেছে মেহেলী আর পলিঙা। করুণ মুখে মেহেলী বলল, কী করব? আজ যে প্রথম দেখলাম। হুই কেলুরি বস্তির ছেলে সেঙাই, ওকে আমার চাই। আমাকে ওষুধ দে তুই।
কেলুরি বস্তির ছেলে সেঙাই আর তুই কোন বস্তির?
আমি সালুয়ালাঙের মেহেলী।
তোদের দুবস্তিতে তো খুব ঝগড়া। খিক—খিক—খিক–বিচিত্র গলায় হেসে উঠল ডাইনি নাকপোলিবা। তার হাসি এই পাহাড়ী গুহায় অত্যন্ত ভয়ানক শোনাল।
পিরিত তো করলি শত্রুদের জোয়ানের সঙ্গে। তা রোজ দেখা হবে তো? বাদামি একটি করোটিতে হাত বুলোতে বুলোতে বলল ডাইনি নাকপোলিবা। তার চোখ দুটো ধিকিধিকি জ্বলছে।
মেহেলী তাকাল পলিঙার দিকে। মেহেলীর চোখের ইঙ্গিতটুকু বুঝল পলিঙা। সে বলল, যাতে মেহেলীর সঙ্গে সেঙাইর রোজ দেখা হয় সেই ব্যবস্থাটা করে দে। সেই জন্যেই তো এলাম তোর কাছে।
আমার ওষুধে এমনি কাজ হবে না। আমি যে ওষুধ দেব, সেঙাইর গায়ে তা যদি ছোঁয়াতে পারিস, তবেই বশ হবে। তাকে আটক করে আমার কাছে আসবি। বুঝেছিস? রুক্ষ চুলের গোছা দোলাতে দোলাতে সামনের দিকে চলে এল বুড়ি ডাইনি নাকপোলিবা। তারপর হাতখানা মেহেলীর গালের ওপর বিছিয়ে দিল, কি লো পাহাড়ী জোয়ানী, মনটা বড় জ্বালা-পোড়া করছে? আচ্ছা আচ্ছা, আগে তো সেঙাইকে আটক কর, তারপর এমন ওষুধ দেব, তোর গায়ে একেবারে জোঁকের মতো সেঁটে থাকবে সে। আর একটা কথা, ওষুধের দাম আনবি চারটে বর্শা আর দুখুদি (আড়াই সেরের মতো) ধান। খিক–খিক ফের–সেই বিচিত্র হাসিতে এই নিভৃত গুহাটিকে ভয়ঙ্কর করে তুলল ডাইনি নাকপোলিবা।
খানিক পর সালুয়ালা গ্রামে এসে পড়ল মেহেলী আর পলিঙা। দূর থেকেই মোরাঙের চারপাশের উদ্দাম সোরগোল শোনা যাচ্ছে।
আকাশ থেকে শীতরাত্রির ঘন অন্ধকার ছড়িয়ে পড়েছে নিচের অরণ্যে। মেহেলী ভীরু গলায় বলল, কী ব্যাপার লো পলিঙা?
কি জানি, বুঝতে পারছি না।
দ্রুত পা চালিয়ে খোখিকেসারি কেসুঙের কাছাকাছি চলে এল দুজনে। তখন ঘর থেকে একটা মশাল নিয়ে বেরিয়ে আসছে লিজোমু।
মেহেলী বলল, এই লিজোমু, কী হয়েছে লো? এত হল্লা হচ্ছে কেন মোরাঙে?
খোনকেকে বর্শা দিয়ে ফুঁড়েছে। দাদাকে ছুঁড়েছে কে? গলাটা কেঁপে উঠল মেহেলীর।
কে আবার? নির্ঘাত হুই কেলুর বস্তির লোক–যাদের সঙ্গে তোর এত পিরিত। মশালের আলোতে পাহাড়ী মেয়ে লিজোমুর চোখ দুটো জ্বলে উঠল।
শিউরে উঠল মেহেলী, বলিস কী! কে বললে কেলুরি বস্তির লোকেরা দাদাকে ছুঁড়েছে?
তীক্ষ্ণ চোখে মেহেলীর দিকে তাকিয়ে ফুঁসে উঠল লিজোমু, কে আবার বলবে রে শয়তানের বাচ্চা, সদ্দার বলেছে। এ কাজ নির্ঘাত হুই কেলুরি বস্তির রামখোদের। আহে ভু টেলো। দ্যাখ গিয়ে, মোরাঙের ওপাশে বসে আমাদের বস্তির জোয়ানেরা:বর্শা শানাচ্ছে।
কেন?
সদ্দার হুকুম দিয়েছে কেলুরি বস্তির শয়তানগুলোকে বাগে পেলে সাবাড় করতে। হু-হু–
কোনো কথা বলল না মেহেলী। তার পাশে নিরুত্তর দাঁড়িয়ে রইল পলিঙা।
একটু পরেই ডুকরে উঠল লিজোমু, আপোটিয়া! হু-হু, এবার আমার কী হবে? খোনকে যদি হুই বর্শার খোঁচায় সাবাড় হয়ে যায়, তা হলে আমি কোথায় পিরিতের জন্যে মরদ পাব? তুই তো কেলুরি বস্তির সেঙাইকে বাগিয়ে নিলি মেহেলী–
লিজোমুর কান্না একটু একটু করে উত্তাল হয়ে উঠতে লাগল। কান্নার দমকে তার সারা শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে।
লিজোমুর কান্না শুনতে শুনতে একেবারে পাথর হয়ে গেল মেহেলী আর পলিঙা।
.