পশ্চিম বাংলার রাঢ় দেশ।
এ দেশের মধ্যে অজয় নদীর তীরবর্তী অঞ্চলটুকুর একটা বৈশিষ্ট্য আছে। পশ্চিমে জয়দেবকেন্দুলী হইতে কাটোয়ার অজয় ও গঙ্গার সঙ্গম-স্থল পর্যন্ত ‘কানু বিনে গীত নাই’। অতি প্রাচীন বৈষ্ণবের দেশ। এমনকি যেদিন ‘শান্তিপুর ড়ুবু-ড়ুবু’ হইয়াছিল, নবদ্বীপ ভাসিয়া গিয়াছিল, সেদিনেরও অনেককাল পূর্ব হইতেই এ অঞ্চলটিতে মানুষেরা ‘ধীর সমীরে যমুনাতীরে’ যে বাঁশি বাজে, তাহার ধ্বনি শুনিয়াছে। এ অঞ্চলে সুন্দরীরা নয়ন-ফাঁদে শ্যাম-শুকপাখি ধরিয়া হৃদয়পিঞ্জরে প্রেমের শিকল দিয়া বাধিয়া রাখিতে তখন হইতেই জানিত। এ অঞ্চলের অতি সাধারণ মানুষও জনিত, ‘সুখ দুখ দুটি ভাই, সুখের লাগিয়া যে করে পিরীতি, দুখ যায় তারই ঠাঁই’।
লোকে কপালে তিলক কাটিত, গলায় তুলসীকাঠের মালা ধারণ করত; আজও সে তিলকমালা তাহাদের আছে। পুরুষেরা শিখা রাখিত, আজও রাখে; মেয়ের চূড়া করিয়া চুল বাঁধিত। এখন নানা ধরনের খোঁপা বাঁধার রেওয়াজ হইয়াছে, কিন্তু স্নানের পর এখনও মেয়েরা দিনান্তে একবারও অন্তত চূড়া করিয়া চুল বাঁধে। আজও রাত্রে বাঁশের বাঁশির সুর শুনিলে এ অঞ্চলের এক সন্তানের জননী যাহারা, তাহারা জলগ্ৰহণ করে না। পুত্ৰ-বিরহবিধুরা যশোদার কথা তাহাদের মনে পড়িয়া যায়। হলুদমণি পাখি-বাংলাদেশের অন্যত্র তাহারা ‘গৃহস্থের খোকা হোক’ বলিয়া ডাকে, এখানে আসিয়া তাহারা সে ডাক ভুলিয়া যায়—’কৃষ্ণ কোথা গো’ বলিয়া ডাকে।
অধিকাংশই চাষীর গ্রাম। দশ-বিশখানা গ্রামের পরে দুই-একখানা ব্ৰাহ্মণ এবং ভদ্র সম্প্রদায়ের গ্রাম পাওয়া যায়। চাষীর গ্রামে সদ্গোপেরই প্রধান, নবশাখার অন্যান্য জাতিও আছে! সকলেই মালা-তিলক ধারণ করে, হাতজোড় করিয়া কথা বলে, ‘প্রভু’ বলিয়া সম্বোধন করে। ভিখারিরা ‘রাধে-কৃষ্ণ’ বলিয়া দুয়ারে আসিয়া দীড়ায়; বৈষ্ণবেরা খোল, করতাল লইয়া আসে; বৈষ্ণব-বৈষ্ণবীরা একতারা-খঞ্জনী লইয়া গান গায়; বাউলেরা এক আসে একতারা বাজাইয়া। মুসলমান ফকিরেরা পর্যন্ত বেহালা লইয়া গান গায়–পুত্ৰ-শোকাতুরা যশোদার খেদের গান। সন্ধ্যায় বৈষ্ণব-আখড়ায় পদাবলী গান হয়, গ্রামের চণ্ডীমণ্ডপে সংকীর্তন হয়, ঘরের খ’ড়ে বারান্দায় ঝুলানো এদেশী শালিক পাখি ‘রা-ধা কৃষ্ণ, কৃষ্ণ রা-ধা, গো-পী-ভজ’ বলিয়া ডাকে। লোকে শখ করিয়া মালতী মাধবী ফুলের চারা লাগায়। প্রতি পুকুরের পাড়েই কদমগাছ আছে! কদমগাছ নাকি লাগাইতে হয়। বর্ষায় কদমগাছগুলি ফুলে ভরিয়া ওঠে, সেই দিকে চাহিয়া প্রবীণেরা অকারণে কাঁদে।
সে কাল আর নাই। কালের অনেক পরিবর্তন ঘটিয়াছে। মাঠের বুক চিরিয়া রেললাইন পড়িয়াছে। তাহার পাশে পাশে টেলিগ্রাফের তারের খুঁটির সারি। বিদ্যুৎ-শক্তিবহ তারের লাইন। মেঠো পথ পাকা হইয়াছে। তাহার উপর দিয়া ঊর্ধ্বশ্বাসে মোটর বাস ছুটিতেছে। নদী বাঁধিয়া
খাল কাটা হইয়াছে। লোকে হুঁকা ছাড়িয়া বিড়ি-সিগারেট ধরিয়াছে। কাঁধে গামছা, পরনে খাটো কাপড়ের বদলে বড় বড় গ্রামের ছোঁকরার জামা, লম্বা কাপড় পরিয়া সভ্য হইয়াছে। ছ—আনা দশ-আনা ফ্যাশনে চুল ছাঁটিয়াছে। নতুন কালের পাঠশালা হইয়াছে। ভদ্ৰগৃহস্থঘরের হালচাল বদলাইয়াছে, গোলার ধান ফুরাইয়াছে, গোয়ালের গাই কমিয়াছে, তবুও একশ্রেণীর মানুষ এই ধারাটি ভুলিয়া যায় নাই; ‘হরি বলতে যাদের নয়ন ঝরে’—তাদের দুই ভাইকে স্মরণ করিয়া, তাহারা আজও কাঁদে। ‘সুখ দুখ দুটি ভাই’-এই তত্ত্বটি তাহাদের কাছে আজও অতি সহজ কথা। ‘ধীর সমীরে যমুনাতীরে’-আজও সেখানে বাঁশি বাজে।
এই অঞ্চলে চাষীদের ছোট একখানি গ্রাম। মাটির ঘর, মেটে পথ, পথের দুই ধারে পতিত জায়গায় ভাঁটিফুল ফোটে, কস্তুরীফুল ফোটে, নয়নতারা অর্থাৎ লাল সাদা ফুল চাপ বাঁধিয়া ফুটিয়া থাকে, অজস্র ‘বাবুরি’ অর্থাৎ বনতুলসী গাছের জঙ্গল হইতে তুলসীর গন্ধ ওঠে। ছোট ছোট ডোবায় মেয়েরা বাসন মাজে, কাপড় কাচে; পাড়ের উপরে বাঁশবনে সকরুণ শব্দ ওঠে; কদম, শিরীষ, বকুল, অর্জন, আম, জাম, কাঁঠাল-বনের ঘনপল্লবের মধ্যে বসিয়া পাখি ডাকে। কোকিল, পাপিয়া, বেনেবউ, বউ কথা কও, ঘুঘু, ফিঙে আরও কত পাখি, কাকেরা বাড়ির উঠানে ঘুরিয়া বেড়ায়। সড়ক শালিকে পথের ধুলায় ঘরের চালে কিচিমিচি কলরবে ঝগড়া করে। ঘরে। চালের কিনারায় ঝুলাইয়া দেওয়া ঝুড়িতে হাঁড়িতে পায়রারা বকবকম গুঞ্জন তোলে; সুখের ঘরেই নাকি পায়রার বাস—তাই সুখের আশায় মানুষেরা নিজেরাই বাসা বাঁধিয়া দেয়। চাষীরা মাঠে যায়। মেয়েরা ঘরের পাশে শাকের ক্ষেতে জল দেয়, লাউ-কুমড়া-লতার পরিচর্যা করে। ধান শুকায়, ধান তোলে, সিদ্ধ করে, ঢেঁকিতে ভানে। ছেলেরা সকালে কেউ পাঠশালায় যায়, কেউ যায় না, গরুর সেবা করে। গ্রামখানির উত্তর প্রান্তের ছোট্ট একটি বৈষ্ণবের আখড়া কাহিনীটির কেন্দ্ৰস্থল। সুনিবিড় ছায়াঘন কুঞ্জবনের মত আখড়াটির নাম ছিল–হরিদাসের কুঞ্জ। হরিদাস মহান্ত ছিল আখড়াটির প্রতিষ্ঠাতা। আখড়াটির চারিদিক রাঙ-চিতার বেড়া দিয়া ঘেরা। বেড়ার ফাঁকে ফঁাকে আম, জাম, পেয়ারা, নিম, সজিনা গাছের ঘন পল্লবের প্রসন্ন ছায়া আখড়াটির সর্বাঙ্গ জড়াইয়া আছে নিবিড় মমতার মত। পিছনের দিকে কয় ঝাড় বাঁশ যেন দুলিয়া দুলিয়া আকাশের সঙ্গে কথা কয়। এই আবেষ্টনীর মধ্যে দুই পাশে দুইখানি মেটে ঘর আর তাহারই কোলে রাঙা মাটি দিয়া নিকানো ছোট্ট একটি আঙিনা-সর্বদা সুপরিচ্ছন্ন মার্জনায় তকতক করে। লোকে বলে সিঁদুর পড়িলেও তোলা যায়। ঠিক মাঝ-আঙিনায় একটি চারাগাছে জড়ােজড়ি করিয়া উঠিয়াছে দুইটি ফুলের লতা—একটি মালতী, অপরটি মাধবী। শক্ত বাঁশের মাচার উপরে লতা দুইটি লতাইয়া বেড়ায় আর পালাপালি করিয়া ফুল ফোঁটায় প্রায় গোটা বছর। লতাবিতানটির নিবিড় পল্লবদলের মধ্যে অসংখ্য মধুকুলকুলির বাসা। ছোট ছোট পাখিগুলি ফুলে ফুলে মধু খায় আর কলরব করে উদয়কাল হইতে অস্তকাল পর্যন্ত।
আখড়ায় থাকে মা ও মেয়ে-কামিনী ও কমলিনী। পল্লীবাসীরা দেশের ভাষা অনুযায়ী বলে ‘মা-বিঠীরা’। বৈষ্ণবের সংসার, চলে ভিক্ষায়। কামিনী খঞ্জনী বাজাইয়া গান গাহিয়া ভিক্ষা করিয়া আনে। কিশোরী মেয়ে কমলিনী ঘরে থাকে, গৃহকর্ম করে, পাড়ার সঙ্গিনীদের সঙ্গে খেলা করে, গুনগুন করিয়া গান গায়। গান শেখা এখনও তাহার শেষ হয় নাই। তবে গানের দিকে মেয়েটির একটি সহজ দখল ছিল। তাহার বাপ হরিদাস মহান্ত ছিল এ অঞ্চলে একজন প্রতিষ্ঠাবান গায়ক। কমলিনীর মা কামিনীর শিক্ষাও তাহারই কাছে।
কামিনীর গলা ছিল বড় মিঠা। হরিদাস ওই মিঠা গলার জন্যই শখ করিয়া তাহাকে গান শিখাইয়াছিল। কামিনী সলজভাবে আপত্তি করিলে সে বলিয়াছিল, জান, এসব হল গোবিন্দের দান, এই রূপ এই কণ্ঠ-এর অপব্যবহার করতে নাই। এতে তাঁরই পুজো করতে হয়। এই গলা তিনি তোমাকে দিয়েছেন। এতে তার নাম-গান হবে বলে।
তারপর আবার ঈষৎ হাসিয়া বলিয়াছিল, আরও শিখে রাখা কামিনী, আমার সম্পত্তির মধ্যে তো এইটুকু, ভালমন্দ কিছু হলে এ ভাঙিয়ে তুমি খেতে পারবে।
কথাটা যে অতি বড় নিষ্ঠুর সত্য, সেদিন তাহা কেহ ভাবে নাই। কিন্তু ভবিতব্যের চক্রান্তে পরিহাস সত্য হইল। ছোট মেয়েটিকে কোলে লইয়া কামিনী অনাথ হইল। আখড়াধারী বৈষ্ণবদের পত্যন্তর গ্রহণের প্রথা আছে,-কিন্তু কামিনী তাহা করিল না। হরি বলিয়া দিন যাপনের সংকল্প করিল। হরিদাস অকালে অল্পবয়সে দেহ রাখে। মরণাকে উহারা মরণ বলে না, বলে দেহ রাখা। সত্যই আজ কামিনীর ওই গানই সম্বল।
মা-বাপের উভয়ের এই গুণ উত্তরাধিকারসূত্রে কমলিনীর ছিল। সঙ্গীতে সে যেন একটি স্বচ্ছন্দ অধিকারে সুপ্রতিষ্ঠিত; এবং সে প্রতিষ্ঠা জন্মগত। একবার শুনিলেই গানের সূরখানি সে আপন কণ্ঠে বসাইয়া লইত। মায়ের নিকট পাইয়াছিল। সে সুস্থর-তরুণ কণ্ঠটি ছিল তাহার সরল বাঁশের বাঁশির মত সুডৌল, মধুক্ষরা এবং বাপের কাছ হইতে পাইয়াছিল সুর-জ্ঞান ও ছন্দে তালে অধিকার।
গৃহকর্মের মধ্যে সে শাকসবজি ও মালতী-মাধবীর জোড়া—লতার চারটিতে জল দেয়। রাঙা মাটি দিয়া ঘর—দুয়ার ও আঙিনাটি পরিপাটি মার্জনা করে আর হাসিয়া সারা হয়। চঞ্চলা মেয়েটির মুখে হাসি লাগিয়াই আছে।
ভাগ্যগুণে হরির কৃপায় একটি সহায়ও তাঁহাদের মিলিয়া গিয়াছে। কোথা হইতে বুড়া বাউল রসিকদাস একতার হাতে গান গাহিয়া ভিক্ষা করিতে করিতে এই গ্রামে আসিয়া কামিনীদের আখড়ার পাশেই আখড়া বাঁধিল। কমলিনীর বয়স তখন ছয় কি সাত। কমলিনীই তাহাকে ডাকিয়া তাহার হাত ধরিয়া নিজেদের আখড়ায় লইয়া আসিয়াছিল। বুড়ার সঙ্গে তাঁহাদের দেখা হইয়াছিল পথে। বুড়া বাউল গ্রামে ঢুকিয়া গান করিয়াছিল—
মধুর মধুর বংশী বাজে কোথা কোন কদমতলিতে
কোন মহাজন পারে বলিতে?
আমি পথের মাঝে পথ হারালেম ব্রজে চলিতে।
ওগো ললিতে।
হায় পোড়ামন–
ভুল করিলি চোখ তুলিলি পথের ধুলা থেকে
রাই যে আমার রাঙা পায়ের ছাপ গিয়েছে এঁকে।
আলোর ছটা চোখ ধাঁধালো চন্দ্রাবলীর কুঞ্জগলিতে।
গ্রামের মাতব্বর মণ্ডল চাষী মহেশ্বর নিজের দাওয়ায় হুঁকা টানিতেছিল। আর ঢেঁড়ায় শণের দড়ি পাকাইতেছিল। বুড়া বাউলের মিঠা কণ্ঠস্বরের গান শুনিয়া সেই ডাকিয়া বলিল, বলিহারি বলিহারি! ও বাবাজী! এ যে খাসা গান। বাস বস। তামাক ইচ্ছে করা।
বাউল দাওয়ায় চাপিয়া বসিয়া বলিল, ও ক্ষ্যাপা ভাত খাবি? না-পাত পড়িলাম, পাতা সঙ্গেই আছে। বলিয়া সে হুঁকা বাহির করিল। হাসিয়া বলিল, দেন তা হলে। পরানটা তামাকতামাক করাচে।
কল্কে লইয়া বেশ কয়েক টান টানিয়া বলি, চমৎকার দেশ আপনাদের বাবা। অজয়ের তীর।
মহেশ বলিল, হ্যাঁ, মাটি ভাল। অজয়ের পলিতে সোনা ফলে। বুয়েচ না বাবাজী, আলু যা হয়, সে তোমার ওল বললে ভুল হবে না। ইয়া বড়।
বাউল বলিল, তাই বাবা, অজয়ের জলের শব্দে রাত বিরেতে এখনও শোনা যায়, বাঁশি, বাঁশির সুর?
মহেশ বলিল, বাঁশি? ঘাড় নাড়িয়া হাসিয়া বলিল, মহতের কথা মহতে বোঝে। মেঘের ডাকে ময়ূর নাচে, গেরস্ত তাকায় ফুটো চালের পানে। বাবুরা সর্ষেফুল দেখে মূৰ্ছা যায়, আমাদের ক্ষেতে সর্ষেফুল দেখে সাত মণ তেলের কথা ভাবি-চোখের সামনে রাধা নাচে। ও বোবার গায়েন কালায় বোঝে, ঢেঁকির নাচন ঘোড়ায় বোঝে; বাঁশি শুনে রাই উদাসী, জটিলে কুটিলের হৃদ্কম্প। বুয়েচ বাবা-লোকে বলে বাজত-কেউ বলে আজও বাজে, তা আমি শুনি নি। বাবা, আমি শুনি বর্ষায় অজয়ের জল ডাকে-খাবং খাবং খাবং, জমি খাব, ঘর খাব, গেরাম খাব। আমি তখন বলি-থামং থামং থামং। শীতের সময় দরজা-জানালা বন্ধ করে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে এক ঘুমে রাত কাবার; দিনে ধান কাটি, ধান পিট-ধুপধাপ শব্দে; অজয়ের কথা মনেই থাকে না।
শুনিয়া বাউল হাসিয়া গড়াইয়া পড়িল, বলিহারি বলিহারি! মোড়ল মশায়, আপনার রসের ভাণ্ডার অক্ষয় হোক। আপনি আনন্দময় পুরুষ গো!
মহেশ মণ্ডল খুশি হইয়া আর একবার তামাক সাজিয়া খাইয়াছিল, খাওয়াইয়াছিল। এবং এবার সে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, বাবাজীর নাম কি?
বাউলও ওই সুরে সুর মিলাইয়া বলিয়াছিল, কানা ছেলের নাম পদ্মলোচন-রসময় অনেক দূর, পঙ্করসে ড়ুবে রইলাম, বাপ-মা নাম দিয়েছেন রসিকদাস।
ঘর কোথা গো? যাবে কোথা?
ঘরের ঠিকানা বাউলের নাই বাবা, পথেই ঘুরছি; যােব ব্রজে তা পথের মাঝে পথ হারিয়েছি। ঠিক এই সময়েই ওই কমলিনীর সঙ্গে দেখা। মহেশ মোড়লের ছেলে রঞ্জনদের সঙ্গে খেলা সারিয়া সে তখন ঘরে ফিরিতেছিল। কচি মুখে রসিকলি ও খাটো চুলে বাঁধা চূড়া কুঁটি দেখিয়া বাউল বলিয়াছিল, এ যে দেখি খাসা বষ্টুমী! কি নাম গো তোমার?
বাউল বলিয়াছিল, শুধু কমল নাড়া শোনায়, তুমি রাইকমল।
মহেশ মোড়ল একটু কৃপণ মানুষ, বেলা দুপহর হইয়া আসিয়াছে, বাউলকে সে নিজে ডাকিয়া বসাইয়াছে; এখন খাইতে দেওয়ার হাঙ্গামাটা অনায়াসে ওই ছোট মেয়েটার ঘাড়ে চাপাইয়া দিলে কোনো প্রতিবাদ হইবে না বুঝিয়া বলিয়া দিল, নিয়ে যা। কমলি, বাবাজীকে তোদের আখড়ায় নিয়ে যা। বেলা হয়েছে। আমাদের আমিষের হেনসেল। তোদের ঘরে নিয়ে যা।
কমল হাত ধরিয়া বলিয়াছিল, এস বাবাজী।
***
সেই অবধি বুড়া এইখানেই থাকিয়া গিয়াছে। মা-বিটীদের আখড়ার পাশে আর-একটা আখড়া বাঁধিয়াছে। গ্রামের ছেলেছোঁকরাদের তামাক খাইবার আড্ডা। বুড়াদের বড় তামাকের মজলিস। ভাবুকদের কীর্তনের আসর। কামিনী-কমলিনীর ভরসাস্থল।
আধাবুড়া বাউল রসিকদাস কমলিনীকে গান শিখাইতে আসে। সে ডাকে-রাইকমল!
কমলিনী আমনই হাসিয়া সারা, বলে, কি গো বগ-বাবাজী?
বাউল রসিকদাসের শরীরের গঠনভঙ্গি কেমন অতিরিক্ত লম্বা রকমের। বকের মত লম্বা গলা, আমনই লম্বা হাত-পা। ছোট কমল বড় হইয়া মুখরা হইয়াছে। ওই বাউলই তাহাকে মুখরা করিয়া তুলিয়াছে। সে এখন বাউলেরই নামকরণ করিয়াছে বগ-বাবাজী!
কমলিনীর তাহাকে দেখিলেই হাসি পায়। সে তাহার নাম দিয়াছো-বগ-বাবাজী। রসিকদাস রাগ করে না, সে হাসে।
কমলিনী বলে, মরে যাই বগ-বাবাজীর শখ দেখে। দাড়িতে আবার বিনুনি পাকানো হয়েছে! পাকা চুলে মাথায় আবার রাখাল-চুড়ো! ওখানে একটি কাকের পাখা গোজ, ওগো ও বগ-বাবাজী!
বলিয়া আবার সে হাসে।
মা কামিনী রুষ্ট হইয়া ওঠে-সে। রূঢ় ভাষায় তিরস্কার করে, মর মর মুখপুড়ী, চোদ্দ বছরের ধাড়ী–
রসিক হাসিয়া বাধা দিয়া বলে, না না, বোকো না। ও আনন্দময়ী–রাইকমল।
সায় পাইয়া কমলিনী জোর দিয়া বলে, বল তো বগ-বাবাজী!
বলিয়াই মুখে কাপড় দিয়া হাসিতে হাসিতে এলাইয়া পড়ে।
ঝাঁট দিতে দিতে ঝাঁটাগাছটা উঁচাইয়া মা বলে, ফের! দেখাবি?
বাহিরে বেড়ার ওপাশে পথের উপর হইতে মহেশ মোড়লের ছেলে রঞ্জন ডাকে, কমলি! অমনিই কমলি পলায়নের ভান করিয়া ছুটিতে শুরু করে। বলে, মার, তোর নিজের মুখে মার। থাকল তোর গান শেখা, চললাম আমি কুল খেতে।
রাগে গরগর করিতে করিতে মা বলে, বেরো-একেবারে বেরো।
মেয়ে মায়ের তিরস্কার আমলেই আনে না, চলিয়া যায়। মা পিছন পিছন বাহির-দরজা পর্যন্ত আসিয়া উচ্চকণ্ঠে বলে, কমলি, ফিরে আয় বলছি—ফিরে আয়। এত বড় মেয়ে, লোকে বলবে কি-সে। জ্ঞান করিস? বলি, ওগো ও কুলখাগী কমিলি!
রসিকদাস হাসে। তাহার হাসি দেখিয়া কামিনীর অঙ্গ জুলিয়া যায়। সে ঝঙ্কার দিয়া বলে, কি যে হাস মহন্ত? তোমার হাসি আসছে তো!
রসিকদাস কোনো উত্তর করে না। সে আপন মনে লম্বা দাড়িতে বিনুনি পাকায়। কামিনীও গৃহমার্জনা করিতে করিতে কন্যাকেই তিরস্কার করে। গান শিখাইবার লোকের অভাবে রসিকদাস আপনার আখড়ার পথ ধরে। পথে নিজেই গুনগুন করিয়া গান ধরিয়া দেয়–
ফুটল রাইকমলিনী বসল কৃষ্ণ ভ্ৰমর এসে।
লোকে বলে নানা কথা তাতে তার কি যায় আসে?
কুল তো কমল চায় না বৃন্দে মাঝজলেই হাসে ভাসে।
বাউল পথ চলে আর মাথা নাড়ে। এই কিশোর-কিশোরীর লীলার মধ্যে সে দেখে ব্ৰজের খেলা।
রঞ্জন-মহেশ্বর মোড়লের ছেলে। কমলিনীর চেয়ে সে বৎসর তিন-চারেকের বড়। কমলিনীর সে খেলাঘরের বর-সে তাহার কিল মারিবার গোসাই। ধর্মতলার প্রকাণ্ড বটগাছটার তলদেশে এই গ্রামের ছেলেদের পুরুষানুক্রমিক খেলাঘর। গাছটিকে বেষ্টন করিয়া ছোট ছোট খেলাঘরে শিশুকল্পনার গ্রাম। এই বসতিসৃষ্টির দিন হইতে নিত্যনিয়মিত গড়িয়া উঠিয়াছে। বটগাছের উঁচু উঁচু শিকড়গুলি হইত। তাহাদের তক্তপোশ। পথের ধুলা গায়ে স্বেচ্ছামত মাখিয়া বালক রঞ্জন আসিয়া সেই তক্তপোশের উপর বসিয়া বিজ্ঞ চাষীর মত বলিত, বউ, ও বউ, একবার তামাক সাজ তো। আর খানিক বাতাস। আঃ, যে রোদ-আর চাষের যে খাটুনি!
কমলি তখন সাত-আট বছরের। সে প্ৰগলভা বধূর মত ঝঙ্কার দিয়া উঠিত, আ মরে যাই! গরজ দেখে অঙ্গ আমার জুড়িয়ে গেল! আমার বলে কত কাজ বাকি, সেসব ফেলে আমি এখন তামাক সাজি, বাতাস করি! লবাব নাকি তুমি? তামাক নিজে সেজে নিয়ে খাও।
রঞ্জন হুঙ্কার দিয়া উঠিত, এই দ্যাখ-রোদো-পোড়া চাষা আর আগুনে তপ্ত ফােল এ দুই-ই সমান। বুঝে কথা বলিস। কিন্তু নইলে দেব তোর ধুমসো গতর ভেঙে।
অমনিই কমলি খেলা ছাড়িয়া রঞ্জনের কাছে রোষাভরে আগাইয়া আসিত। তাহার নাকের কাছে পিঠ উঁচাইয়া দিয়া বলিত, কই, দে-দে দেখি একবার, ওঃ-গতর ভেঙে দেবেন, ও রে আমার কে রে!
খেলাঘরের প্রতিবেশীর দল কৌতুকে খিলখিল করিয়া হাসিত। দারুণ অপমানে রুষিয়া, রঞ্জন কমলির মোটা বিড়েখোঁপা ধরিয়া গদগদ কিল বসাইয়া দিত। টান মারিয়া কমলি চুলের গোছা মুক্ত করিয়া লইত। কয়েকগাছা চুল রঞ্জনের হাতেই থাকিয়া যাইত। তারপর ক্ষিপ্তার মত সে রঞ্জনের চোখে মুখে ধূলা ছিটাইয়া দিয়া রোষ-রোদনে হাঁপাইতে হাঁপাইতে বলিত, কেন, কেন, মারবি কেন তুই? আমাকে মারবার তুই কে?
ননদিনী কাদু প্ৰবীণার মত আসিয়া বলিত, এটি কিন্তু দাদা, তোমার ভারি অন্যায়!
ও পাড়ার ভোলা কমলির প্রতি দরদ দেখাইয়া বলিত, খেলতে এসে মারবি কেন রে রঞ্জন?
রঞ্জনের আর সহ্য হইত না। সে বলিত, নাঃ, মারবে না! পরিবারের মুখ-ঝামটা খেতে হবে সোয়ামি হয়ে?
কমলি ফুলিতে ফুলিতে গৰ্জিয়া উঠিত, ওরে আমার সোয়ামি রে! বলে যে সেই, ভাত দেওয়ার ভাতার না, কিল মারবার গোঁসাই। যা যা, আমি তোর বউ হব না। তোর সঙ্গে আড়ি—আড়ি—আড়ি–
এমনই করিয়া খেলা ভাঙিত। পরদিন প্ৰভাতে আবার সেখানে ছেলেদের কলরব জাগিয়া উঠিত। সেদিন প্রথমেই কমলির হাত ধরিত ভোলা। সে বলিত, আজ ভাই তোমাতে আমাতে, বেশ–
কমলি আড়ুচোখে তাকাইয়া দেখিত, ওপাশে রঞ্জন দাঁড়াইয়া আছে। মাঝের পাড়ার বৈষ্ণবদের মেয়ে পরী। আগাইয়া আসিত। রঞ্জনের হাত ধরিয়া বলিত, তোতে আমাতে, বেশ ভাই রঞ্জন।
পরীও কমলির সমবয়সী; কিন্তু কমলির সহিত তাহার যেন একটা শক্ৰতা আছে। পরীদের বাড়ি রঞ্জনদের বাড়ির পাশেই। রঞ্জনকে লইয়া কমলির সঙ্গে তাহার খুনসুটি লাগিয়াই আছে। রঞ্জন বলিত, বেশ।
কমলি ভোলাকে বলিত, আমি ভাই বিধবা। একা খেলব।
দুই-তিন দিন পর একদিন পরীকে খেদাইয়া দিয়া রঞ্জন মাথা নাড়িয়া বলিত, বিয়েই আমি করব না।
ব্যঙ্গভরে ভোলা হাসিয়া বলিত, গোঁসাইঠাকুর গো!
ভোলার হাত ছাড়াইয়া কমলি অগ্রসর হইত। ভোলা বলিত, আবার মার খাবি কমলি?
কমলি বলিত, তা ভাই মারে তো আর কি করব বল? বির যখন ওকে একবার বলেছি, তখন ঘর ওর করতেই হবে। তা বলে তো দুবার বিয়ে হয় না মেয়েদের? অ্যাঁ, নাকি বল ভাই?–বলিয়া সে রঞ্জনের খেলাঘরে আসিয়া উঠিত। আসর জীকাইয়া বসিয়া সে ফরমাশ করিত পাকা গিন্নিটির মতই, আ। আমার কপাল! নুন নাই, বলি তেল নাই, সেসব কি আমি রোজগার করে আনব?
রঞ্জন কথা কহিত না, উদাসভাবে বসিয়া থাকিত। কমলি হাসিয়া বলিত ভোলাকে, সত্যি ভোলা, মোড়ল আমাদের গোঁসাই হয়েছেন। তারপর ফিসফিস করিয়া রঞ্জনের কাছে বলিত, কোন গোসাঁই, গো? আমাকে কিল মারবার গোঁসাই নাকি?–বলিয়াই খিলখিল করিয়া হাসি।
রঞ্জন অমনিই ফিক করিয়া হাসিয়া ফেলিত। খেলার মধ্যে সকলের অগোচরে রঞ্জন ফিসফিস করিয়া বলিত, আর মারব না বউ, কালীর দিব্যি। কমলি আবার হাসিত।
এসব পুরনো কথা। কিন্তু সে কথা মনে করিয়া এখনও কমলি হাসে। রঞ্জন একটু যেন লজ্জা পায়, পাইবারই কথা। রঞ্জন আজ তরুণ কিশোর। তাহার চোখের কোণে আজ শীতান্তের নবকিশলয়ের মত ঈষৎ রক্তিমাভা দেখা দিয়াছে। সরল কোমল দেহে পেশিগুলি পরিপুষ্টরূপে প্রকট হইয়া দেখা দিতে শুরু করিয়াছে। আর সেই চপলা মুখরা কমলি আজ চৌদ্দ বছরের কমলিনী। আজও দেহে তার ফুল ফোটে নাই। কিন্তু তাহার চঞ্চল চরণের ঈষৎ সঙ্কুচিত গতিতে, রঙের চিক্কণতায়, নয়নের চটুল ভঙ্গিমায়, গালের ফিক লালিমাভায় মুকুলের বার্তা ঘোষণা করিয়াছে। তবুও তাহার চাপল্যের অন্ত নাই। বয়সের ধর্ম তাহার স্বভাব-ধর্মের কাছে পরাজয় মানিয়াছে। এখন ঈষৎ চাপা চপল সে।
তাই কুলের ভয় দেখানো সত্ত্বেও সে রঞ্জনের সঙ্গে কুল খাইতে যায়, মায়ের ঝাঁটার ভয় উপেক্ষা করিয়াও রসিকদাসকে বলে ‘বগা-বাবাজী’। সে চলিয়া যায়-চাপল্যে দেহে ওঠে। একটা হিল্লোল-নদীর নৃত্যপরা স্রোতের মত। কথা বলতে কথার আগে উপচিয়া পড়ে হাসি ঝরনা ধারার ছলছল-ধ্বনির মত।
সেদিন রঞ্জন গাছে চড়িয়া কুল ঝরাইতেছিল,-তলায় ছুটিয়া ছুটিয়া কমলিনী সেগুলি কুড়াইয়া আঁচলে তুলিতেছিল। একটা কুলে কামড় মারিয়া কমলিনী বলিয়া উঠিল, আহা কি মিষ্টি রে!
গাছের উপর হইতে ঝাপ করিয়া রঞ্জন ঝাঁপ দিয়া মাটিতে পড়িয়া বলিল, দে, দে ভাই, আমাকে আধখানা দে।
আধ-খাওয়া কুলটা কমলি তাড়াতাড়ি রঞ্জনের মুখে পুরিয়া দিল। কুলটায় পােকা ধরিয়াছিল। বিস্বাদে রঞ্জন টাকরায় টোকা মারিয়া বলিল, বাবাঃ।
কমলি খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল! বলিল, কেমন রে?
রঞ্জন তখনও টোকা মারিতেছিল, তবু সে তা স্বীকার করিল না, বলিল, খুব মিষ্টি-তোর এঁটো যে।
হাততালি দিয়ে কমলি হাসিতে হাসিতে বলিল, বোল হরিবোল! আমাএ এঁটো টকো কুল মিষ্টি হয়ে গেল! আমার মুখে চিনি আছে নাকি?
রঞ্জন বলিল, হুঁ, তুই-ই আমার চিনি।
কমলি কৌতুকে হাসিয়া এলাইয়া পড়িল। রঞ্জনের এই ধারার তোষামোদ তাহার ভারি ভাল লাগে। তারপর বলিল, তোর এঁটো আমার কেমন লাগে জানিস?
কেমন?
ঝাল—ঠিক লঙ্কার মত। তুই আমার লঙ্কা।
বিষণ্ণভাবে রঞ্জন বলিল, যার যেমন ভালবাসা।
কমলি তাহার বিষণ্ণতা আমলেই আনিল না। কৌতুক ভরে সে বাণের পর বাণ নিক্ষেপ করিয়া চলিয়াছিল। বলিল, তা তো হল, কিন্তু তুই আমার এঁটো খেলি যে? তোর যে জাত গেল।
চকিতভাবে এদিক ওদিক দেখিয়া লইয়া রঞ্জন বলিল, কেউ তো দেখে নাই! তারপর অকস্মাৎ বলিয়া উঠিল, গেল তো গেলই। ভেক নিয়ে আমি বোষ্টম হব। তোকে বিয়ে করব।
কমলি বলিয়া উঠিল, যাঃ, তোকে কে বিয়ে করবে? আকাট চাষা!
রঞ্জন খপ করিয়া তাহার হাতটা চাপিয়া ধরিল, বলিল, আমাকে বিয়ে করিস তো আমি জাত দিই কমলি।
কমলি বলিল, দূর, ছাড়।
রঞ্জন বলিল, বল–নইলে ছাড়ব না। কমলির হাতখানা সে আরও জোরে চাপিয়া ধরিল।
কাতরস্বরে কমলি বলিয়া উঠিল, উঃ-উঃ, ঘা-ঘা আছে। অপ্ৰস্তুত হইয়া রঞ্জন হাত ছাড়িয়া দিল। কমলির কলহাস্যে নির্জনতার স্বপ্নভঙ্গ হইল। সে ছুটিয়া পলায়ন করিতে করিতে বলিয়া গেল, চাষার বুদ্ধির ধার কেমন? না, ভোঁতা। লাঙ্গলের ধার যেমন।
রঞ্জন অনুসরণ করিল না। সে পলায়নপরা কমলির গমনপথের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চাহিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
হঠাৎ সে চমকিয়া উঠিল–তাহাদের সাদা বলদটা কেমন করিয়া এখানে আসিলা?
পিছন হইতে ডাক আসিল-হ-হ-হ। তাহার বাপ মহেশ্বর মোড়লের গলা। রঞ্জন মুহূর্তে দৌড় দিল।