প্রথম খণ্ড [ইং প্রথম খণ্ড : প্রথমার্ধ]
১ম বিভাগ – পণ্য এবং অর্থ
১ম অধ্যায় – পণ্য
১ম পরিচ্ছেদ – পণ্যের উপাদানদ্বয় : ব্যবহারমূল্যে এবং মূল্য
(মূল্যের মর্মবস্তু ও মূল্যের আয়তন)
যে সমস্ত সমাজে উৎপাদনের ধনতান্ত্রিক পদ্ধতি প্রচলিত থাকে, সেখানকার ধনসম্ভার প্রতীয়মান হয় ‘পণ্যের এক বিপুল সম্ভাররূপে’(১) এক একটি পণ্য তার এক একটি একক। কাজেই আমাদের তত্ত্বজিজ্ঞাসা শুরু করতে হবে যে-কোনো একটি পন্যের বিশ্লেষণ থেকে।
পণ্য হলো, প্রথমতঃ, আমাদের বাইরে অবস্থিত একটি বস্তু, যা তার গুণাবলীর দ্বারা মানুষের কোন না কোন অভাব পূরন করে। সেই অভাবের প্রকৃতি কী তাতে কিছুই যায় আসে না; যেমন, তা উদর থেকেই আসুক আর কল্পনা থেকেই আসুক।(২) এমন কি উক্ত বস্তু কিভাবে এইসব অভাব পূরণ করে—প্রত্যক্ষভাবে, জীবনধারণের উপাদান হিসাবে, না কি পরোক্ষভাবে, উৎপাদনের উপকরণ হিসেবে,—তাও আমাদের জ্ঞাতব্য বিষয় নয়।
লোহা, কাগজ প্রভৃতি প্রত্যেকটি ব্যবহারযোগ্য জিনিসকেই তার গুণমান এবং পরিমাণ—এই দুই দিক থেকে বিচার করা যেতে পারে। প্রত্যেকটি জিনিসের মধ্যে রয়েছে বহুবিধ গুণের সমাবেশ, সুতরাং তার ব্যবহারও হতে পারে বহুবিদ। এই সমস্ত জিনিসের বিবিধ ব্যবহারিকতা আবিষ্কার করা ইতিহাসের কাজ।(৩) এইসব ব্যবহারযোগ্য দ্রবের পরিমাণ মাপবার জন্য সমাজ-স্বীকৃত পরিমাপ নির্ধারণ করার ব্যাপারেও ঐ একই কথা খাটে। এই সমস্ত পরিমাপের বিভিন্নতার মূলে রয়েছে অংশতঃ পরিমেয় জিনিসের প্রকৃতিগত বৈচিত্র আর অংশতঃ চিরাচরিত প্রথা।
যেকোন জিনিসের ব্যবহার-মূল্যের উদ্ভব হয়েছে তার উপযোগিতা থেকে।(৪) কিন্তু এই উপযোগিতা আকাশ থেকে পড়ে না। পণ্যের পদার্থগত গুণাবলীর দ্বারা তা সীমাবদ্ধ, তাই পণ্য থেকে স্বতন্ত্র কোন সত্তা তার নেই। কাজেই লৌহ, শস্য, হীরক প্রভৃতি—যে-কোন পণ্যই বাস্তব জিনিস হিসেবে এক একটি ব্যবহার-মূল্যে, এক একটি ব্যবহারযোগ্য দ্রব্য। পণ্যের এই গুণটি, ব্যবহারযোগ্য গুণাবলীকে বাস্তবায়িত করতে যে-শ্রমের প্রয়োজন হয়, তা থেকে নিরপেক্ষ। যখনি আমরা কোন দ্রব্যের ব্যবহারমূল্য নিয়ে আলোচনা করি, তখনি ধরে নিই যে উক্ত দ্রব্যের একটি নির্দিষ্ট পরিমাপের কথা হচ্ছে, যেমন কয়েক ডজন ঘড়ি, কয়েক গজ কাপড়, অথবা কয়েক টন লোহা। পণ্যের ব্যবহার-মূল্য হ’ল বিশেষ একোটি অনুশীলনের বিষয়বস্তু—পণ্যের বানিজ্যবিষয়ক জ্ঞানের বিষয়বস্তু।(৫) ব্যবহার-মূল্য বাস্তবতা লাভ করে কেবলমাত্র ব্যবহার বা পরিভোগের ভিতর দিয়ে, ধনসম্ভারের সামাজিক রূপ যাই হোক না কেন, ব্যবহারিক মূল্যই হল তার সারবস্তু। তাছাড়া, সমাজের যে রূপটি সম্বন্ধে আমরা এখন বিচার করতে যাচ্ছি, তাতে আবার ব্যবহার-মূল্য হ’ল বিনিমিয় মূল্যের বাস্তব ভাণ্ডার।
প্রথম দৃষ্টিতে বিনিময়-মূল্য দেখা দেয় পরিমাণগত সম্বন্ধ হিসাবে, যে-অনুপাতে এক ধরনের ব্যবহার মূল্যের সঙ্গে আর এক ধরনের ব্যবহার-মূল্যের বিনিময় হয়, সেই অনুপাত রূপে(৬); স্থান এবং কাল অনুসারে এই সম্বন্ধ নিরন্তর পরিবর্তিত হয়। কাজেই বিনিময়-মূল্যকে মনে হয় একটি কিছু আপতিক ও নিছক আপেক্ষিক ব্যাপার বলে : কাজে কাজেই অন্তর্নিহিত মূল্য, অর্থাৎ, পণ্যের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত, তার মধ্যে নিহিত বিনিময়-মূল্য কথাটি প্রতীয়মান হয় একটি স্ববিরোধী উক্তি রূপে।(৭) বিষয়টি আর একটু তলিয়ে বিচার করা যাক।
কোন একটি পণ্যের, যথা এক কোয়ার্টার গমের বিনিময়ে পাওয়া যায় ‘ক’ পরিমাণ কালো রঙ, ‘খ’ পরিমাণ রেশম, ‘গ’ পরিমাণ সোনা ইত্যাদির প্রত্যেকটিই বিনিময়-মূল্য হিসেবে একে অন্যের জায়গায় বসতে পারে, অথবা একে অন্যের সমান হতে পারে। সুতরাং, প্রথমত, কোন পণ্যের সঠিক বিনিময়-মূল্য দ্বারা সমান সমান কোন কিছু প্রকাশিত হয়, দ্বিতীয়ত, বিনিময়-মূল্য হ’ল সাধারণত এমন একটা কিছুর অভিব্যক্তি, এমন একটা কিছুর মূর্তরূপ, যা তার নিজেরই মধ্যে নিহিত থাকে কিন্তু তবু যাকে তার নিজ থেকে ভিন্ন করে দেখা চলে।
ধরা যাক, দুটি পণ্য, যেমন শস্য এবং লৌহ। এই দুটি পণ্য দুটি যে-অনুপাতে বিনিমেয়, সেই অনুপাত যাই হোক না কেন, তাকে এমন একটি সমীকরণের মাধ্যমে প্রকাশ করা যায় যাতে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ শস্যের সমান হয় কিয়ৎ পরিমাণ লৌহ : যথা, ১ কোয়ার্টার শস্য—‘ক’ হন্দর লৌহ। এই সমীকরণ থেকে আমরা কি পাচ্ছি? এ থেকে আমরা পাচ্ছি এই দুটি ভিন্ন ভিন্ন দ্রব্য—১ কোয়ার্টার শস্য এবং ‘ক’ হন্দর লৌহ—এর ভিতর সমান সমান পরিমাণে এমন কোন কিছু আছে যা উভয়ের ভিতরই বর্তমান। সুতরাং এই দ্রব্যদুটি একটি তৃতীয় দ্রব্যের সমান হতে বাধ্য, আর এই তৃতীয় দ্রব্যে পরিণত করা যাবেই।
জ্যামিতি থেকে একটি সরল উদাহরণ দিলে কথাটি পরিষ্কার হবে। একটি সরলরেখাবদ্ধ ক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল নির্ণয় ক’রে পারস্পরিক তুলনার জন্য আমরা তাকে কয়েকটি ত্রিভূজে ভাগ করে ফেলি। কিন্তু ঐ ত্রিভূজেরই ক্ষেত্রফল প্রকাশ করা হয় এমন একটি কিছুর মারফৎ যা তার দৃশ্যমান আকৃতি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন, সেটা হচ্ছে ‘পাদভূমি’ এবং ‘লম্ব’র গুণফলের অর্ধেক। অনুরূপভাবে, পণ্যের বিনিময়-মূল্য এমন একটি কিছুর মাধ্যমে নিশ্চয়ই প্রকাশযোগ্য যা ঐ সমস্ত পণ্যের মধ্যেই বর্তমান এবং এক একটি পণ্যে যার কম বা বেশি পরিমাণের প্রতিনিধিত্ব করে।
এই সর্বপণ্যে বিদ্যমান “জিনিসটি” পণ্যের জ্যামিতিক, রাসায়নিক অথবা অপর কোনো নৈসর্গিক গুণ হতে পারে না। এই ধরনের গুণগুলি ততটাই মনোযোগ আকর্ষণ করে যতটা এগুলি নানা পণ্যের উপযোগিতাকে প্রভাবিত করে, যতটা তা পণ্যকে ব্যবহার-মূল্যে পরিণত করে। কিন্তু পণ্যের বিনিময় স্বভাবতই এমন একটি ক্রিয়া যার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে ব্যবহার-মূল্য থেকে সম্পূর্ণ বিশ্লিষ্টতা। তাহলে, একপ্রকার ব্যবহারমূল্যের সঙ্গে আর একপ্রকার ব্যবহার-মূল্যের কোন তারতম্য থাকে না—যদি পরিমাণের দিক থেকে তা হয় যথেষ্ট। অথবা, বৃদ্ধ বারবন-এর কথামতো, “একপ্রকার সামগ্রী অন্য প্রকার সামগ্রীর অনুরূপ, যদি দুটোর মূল্য হয় সমান। সমান সমান মূল্যের জিনিসের মধ্যে কোন ভেদ বা পার্থক্য থাকে না…একশন পাউণ্ড দামের সীসার কিংবা লোহার মূল্য যা, একশত পাউণ্ড দামের রূপা কিংবা সোনার মূল্যও তাই।”(৮) ব্যবহার-মূল্য হিসেবে পণ্য সমূহের মধ্যে আছে, সবচেয়ে, যেটা বড় কথা,—যেটা ভিন্ন ভিন্ন গুণ কিন্তু বিনিময়-মূল্য হিসেবে আছে শুধুমাত্র ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণ, আর কাজে কাজেই তাদের মধ্যে ব্যবহার-মূল্যের অনু মাত্রই নেই।
তাহলে আমরা যদি পণ্যসমূহের ব্যবহার-মূল্যটা না ধরি তো তাদের সকলেরই একটি মাত্র অভিন্ন গুণ অবশিষ্ট থাকে—তারা সকলেই শ্রম থেকে উৎপন্ন দ্রব্য। কিন্তু এমন কি এই শ্রমজাত দ্রব্যও আমাদের হাতে এসে পরিবর্তিত হয়ে গেছে। আমরা যদি তার ব্যবহার-মূল্য থেকে তাকে বিশ্লিষ্ট করে আনি, তাহলেই তো আর যেসব উপাদান এবং আকার-প্রকার তাকে ব্যবহার-মূল্যে পরিণত করেছে, তা থেকেও তাকে বিশ্লিষ্ট করা হয়। আমরা তাকে আর টেবিল, বাড়ি, সুতো অথবা অন্য কোন ব্যবহারযোগ্য জিনিস হিসেবে দেখি না। বাস্তব জিনিস হিসেবে তার অস্তিত্ব অদৃশ্য করে রাখা হয়। তাকে আর সূত্রধর, রাজমিস্ত্রী, তন্তুবায় অথবা অন্য কারো কোন বিশিষ্ট শ্রমের উৎপাদন বলেও ধরতে পারি না। ঐ দ্রব্যগুলির নিজ নিজ ব্যবহারযোগ্য গুণাবলীর সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে বিধৃত বিবিধ প্রকার শ্রমের ব্যবহারিকতা এবং বিশিষ্ট বিশিষ্ট বিমূর্ত রূপ—এই উভয়কেই আমরা হিসেবের বাইরে রাখি; তাদের আর কিছুই অবশিষ্ট থাকে না, থাকে কেবল তাদের এক ও অভিন্ন গুণটি; তারা সবাই পর্যবসিত হয় একই রকম শ্রমে, অমূর্ত মানবিক শ্রমে।
এখন, এই সমস্ত উৎপন্ন দ্রব্যের প্রত্যেকটিতে বিদ্যমান এই অবশিষ্টাংশের কথা বিবেচনা করা যাক। এদের প্রত্যেকটিতে বিদ্যমান এই অবশিষ্টাংশের কথা বিবেচনা করা যাক। এদের প্রত্যেকটিতে বিদ্যমান আছে সেই একই বিদেহী বাস্তবতা, বিশুদ্ধ সমজাতিক শ্রমের সংহত রূপ, ব্যয়ের প্রকার-নির্বিশেষে ব্যয়িত শ্রমশক্তির ঘনীভূত অবস্থা। আমাদের কাছে এই সমস্ত দ্রব্যের একমাত্র পরিচয় এই যে, এগুলি তৈরী করতে ব্যয়িত হয়েছে মানুষের শ্রমশক্তি, মানবিক শ্রম এগুলির মধ্যে মূর্ত হয়ে আছে। এই দ্রব্যগুলির প্রত্যেকটির মধ্যেই এই যে সামাজিক বস্তুটি বিদ্যমান তার স্ফটিক হিসেবে দেখলে এগুলিই হল—মূল্য।
আমরা দেখেছি যে পণ্যের সঙ্গে পণ্যের যখন বিনিয়ম হয়, তাদের বিনিময়-মূল্য ব্যবহার-মূল্য থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু ব্যবহার-মূল্য থেকে যদি তাদেরকে বিশ্লিষ্ট করে নিই, তাহলে বাকি থেকে মূল্য, যার সংজ্ঞা উপরে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং যখনি পণ্যের বিনিময় হয়, তখনি যে এক ও অভিন্ন বস্তুটি তার বিনিময়-মূল্যের ভিতর আত্মপ্রকাশ করে, তা হচ্ছে তার মূল্য। আমাদের অনুসন্ধান যখন আরও অগ্রসর হবে, তখন দেখতে পাব যে একমাত্র এই বিনিময়মূল্য রূপেই পণ্যের মূল্য প্রকট হতে বা আত্মপ্রকাশ করতে পারে! আপাতত, অবশ্য, আমরা মূল্যের রূপ থেকে স্বতন্ত্রভাবে মূল্যের প্রকৃতি নিয়ে পরীক্ষা কার্য চালাব।
অতএব, ব্যবহার-মূল্যের বা ব্যবহারযোগ্য দ্রব্যের মূল্য আছে শুধু এই জন্য যে তার ভিতরে বিশ্লিষ্ট শ্রম মূর্তি পরিগ্রহ করেছে অথবা বস্তুরূপে রূপায়িত হয়ে আছে। তাহলে এই মূল্যের আয়তন মাপা যাবে কি করে? সোজাসুজি বললে, তা মাপা যায় মূল্য সৃজনকারী জিনিসের, অর্থাৎ দ্রব্যের অভ্যন্তরস্থ শ্রমের পরিমাণ দ্বারা। শ্রমের পরিমাণ অবশ্যই শ্রম-সময় দিয়ে ঠিক করা হয়। আর শ্রম-সময় পরিমাপের মান হচ্ছে সপ্তাহ, দিন, ঘণ্টা।
কেউ কেউ মনে করতে পারেন যে, পণ্যের মূল্য যদি নির্ধারিত হয় যে-পরিমাণ শ্রম তার জন্য ব্যয় করা হয়েছে তা দিয়ে, তাহলে তো শ্রমিক যত বেশি অলস এবং অপটু হবে, তার পণ্য হবে তত বেশি মূল্যবান, কারণ সেক্ষেত্রে উৎপাদন কার্যে তার লেগে যাবে বেশি সময়। যে শ্রম-মূল্য সৃষ্টি করে তা অবশ্য সমজাতিক মনুষ্য-শ্রম, এক ও অভিন্ন শ্রমশক্তির ব্যয়। সমাজ কর্তৃক উৎপন্ন সমস্ত পণ্যের মোট মূল্যের ভিতর যে পরিমাণ শ্রমশক্তি আছে, এখানে সমাজের সেই মোট শ্রমশক্তিকে ধরা হচ্ছে মানুষের শ্রমশক্তির একটি সমজাতিক স্তুপ হিসেবে, সেই স্তূপটি অবশ্যই অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন এককের সমষ্টি। প্রত্যেকটি এককই অবিকল অন্য আরেকটি এককের মতো—এই হিসেবে যে, তার চরিত্র এবং কার্যকারিতা হল সমাজের গড় শ্রমশক্তির অনুরূপ। অর্থাৎ, একটি পণ্য উৎপাদনের জন্য যতটা সময় দরকার, তা গড়পড়তা শ্রমশক্তির বেশি নয়, তা সামাজিক ভাবে প্রয়োজনীয় সময়ের অনধিক। উৎপাদনের স্বাভাবিক অবস্থায় এবং সমসাময়িক গড় দক্ষতা ও তীব্রতা সহ শ্রম করলে একটি দ্রব্য উৎপাদন করতে যে সময় লাগে, তাকেই বলে সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় সময়। ইংল্যাণ্ডে বাষ্প-চালিত তাঁত প্রবর্তিত হওয়ার ফলে নির্দিষ্ট পরিমাণ সুতো দিয়ে কাপড় বুনবার সময় কমে গিয়ে সম্ভবত অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল। বস্তুতঃ হস্তচালিত তাঁতে তখনো তন্তুবায়দের লাগতো আগের মতো সময়। কিন্তু তা হলেও তাদের এক ঘণ্টার শ্রম থেকে উৎপাদিত সামগ্রী এই পরিবর্তনের ফলে আধ ঘণ্টায় উৎপন্ন সামগ্রীর সমান হয়ে পড়েছিল, এবং তার ফলে তার মূল্য কমে হয়ে গিয়েছিল আগের অর্ধেক।
তা হলেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, কোন দ্রব্যের মূল্যের আয়তন যা দিয়ে নির্ধারিত হয়, তা হচ্ছে সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় সময়ের পরিমাণ, অথবা সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়(৯)। এই সূত্রে, প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র পণ্যকে ধরতে হবে তার সমশ্রেণীর পণ্যের একটি গড় নমুনা হিসেবে।(১০) সুতরাং যে সমস্ত পণ্যে একই পরিমাণ শ্রম বিধৃত আছে অথবা যা একই সময়ের মধ্যে উৎপন্ন করা যায় সেগুলির মূল্য একই। এক পণ্যের মূল্যের সঙ্গে আর এক পণ্যের মূল্যের অনুপাত এবং এক পণ্যের উৎপাদন সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়ের সঙ্গে আর এক পণ্যের উৎপাদনে সামাজিকভাবে প্রয়োজনীয় শ্রম-সময়ের অনুপাত একই। “সমস্ত মূল্যই, সমস্ত পণ্যই হল ঘনীভূত শ্রম-সময়ের বিশেষ বিশেষ পরিমাণ।”(১১)
সুতরাং একটি পণ্যের মূল্য অপরিবর্তিত থাকত, যদি উৎপাদনে যে শ্রম-সময় লেগেছে তার কোন হ্রাসবৃদ্ধি না হত। কিন্তু এই শ্রম-সময় নামক জিনিসটির পরিবর্তন হয় শ্রমের উৎপাদনী শক্তি সমূহের প্রত্যেকটির হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে। এই উৎপাদিকা শক্তি নির্ধারিত হয় বহুবিধ অবস্থার দ্বারা, যার মধ্যে পড়ে, মজুরদের দক্ষতার গড় পরিমাণ, বিজ্ঞানের বিকাশ ও কার্যক্ষেত্রে তার প্রয়োগের মাত্রা, উৎপাদনের সামাজিক সংগঠন, উৎপাদনের উপায়সমূহের প্রসার ও ক্ষমতা এবং দেশকালের অবস্থা। উদাহরণস্বরূপ ভালো মৌসুমে ৮ বুশেল শস্যের ভিতর ঠিক সেই পরিমাণ শ্রম বিধৃত হবে, যা খারাপ মৌসুমে হবে মাত্র ৪ বুশেলের ভিতর। একটি খারাপ খনি থেকে যত লোহা বের করা যাবে তার চেয়ে বেশি যাবে একটি ভালো খনি থেকে। ভূপৃষ্ঠে হীরক অতি দুষ্প্রাপ্য, তাই তার আবিষ্কারে গড়পড়তা শ্রম-সময় প্রচুর ব্যয় হয়। তার ফলে তার অল্প একটুর ভিতর অনেক শ্রম থাকে। জ্যাকব-এর সন্দেহ সোনার পুরো দাম কেউ কখনো দিয়েছে কিনা। একথা আরো বেশি করে খাটে হীরক সম্বন্ধে। এশোয়েজ-এর মতে ১৮২৩ সালের শেষ পর্যন্ত ৮০ বছরে ব্রাজিলের হীরক খনিতে মোট উৎপাদন যা হয়েছে, তাতে ঐ দেশের চিনি এবং কফি বাগানের দেড় বছরের গড় উৎপাদনের দাম ওঠেনি যদিও হীরকের জন্যে শ্রমের ব্যয় হয় অনেক বেশি এবং সেইজন্য তার মধ্যে মূল্য ঢের বেশি আছে। অপেক্ষাকৃত ভাল খনিতে ঐ একই পরিমাণ শ্রম অনেক বেশি হীরকের ভিতর সমাহিত হবে, এবং তার মূল্যও নেমে যাবে। আমরা যদি অল্প শ্রমের ব্যায়ে অঙ্গারকে হীরকে পরিণত করতে পারতাম, তার মূল্য ইটের চেয়েও কম হয়ে যেত। সাধারণতঃ শ্রমের উৎপাদিকা শক্তি যতই বেশি হবে, কোন জিনিসের উৎপাদনে শ্রম-সময় ততই কম লাগবে, সেই জিনিসটির ভিতর ততই কম পরিমাণ শ্রম মূর্ত হবে, তার মূল্য হবে ততই কম; বিপরীত ক্ষেত্রে এর ঠিক বিপরীত হবে; শ্রমের উৎপাদনী শক্তি যত কম, দ্রব্যের উৎপাদনে শ্রম-সময় তত বেশি, তত বেশি তার মূল্য। সুতরাং কোন পণ্যের মূল্যের হ্রাসবৃদ্ধি হয় তার ভিতরে যে পরিমাণ শ্রম বিধৃত থাকে তার হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরিভাবে এবং ঐ শ্রমের উৎপাদিকা শক্তির হ্রাসবৃদ্ধির সঙ্গে বিপরীতভাবে।
মূল্যে না থাকা সত্ত্বেও একটি জিনিস ব্যবহারমূল্য হতে পারে। এব্যাপারে তখনও হয়, যখন মানুষের কাছে তার যা ব্যবহারিকতা, তা শ্রমজনিত নয়। যথা, বাতাস, কুমারীভূমি, প্রাকৃতিক তৃণক্ষেত্র প্রভৃতি।
একটি দ্রব্য পণ্য না হয়েও প্রয়োজনীয় হতে পারে এবং মানুষের শ্রম থেকে উৎপন্ন হতে পারে। যে-কেউ নিজ শ্রম থেকে উৎপন্ন দ্রব্যের দ্বারা সরাসরি নিজের অভাব পূরণ করে, সে অবশ্যই ব্যবহার-মূল্য সৃষ্টি করে, কিন্তু পণ্য সৃষ্টি করে না। পণ্য উৎপন্ন করতে হলে তাকে কেবল ব্যবহার-মূল্য উৎপন্ন করলেই চলবে না, উৎপন্ন করতে হবে অপরের জন্য ব্যবহার-মূল্য, সামাজিক ব্যবহার-মূল্য। (কেবল অপরের জন্য হলেই হবে না, আরও কিছু চাই। মধ্যযুগের কৃষক তার সামন্ত প্রভুর জন্য উৎপন্ন করতো উঠ্বন্দী খাজনা দেবার শস্য এবং তার পাদ্রীর জন্য দেবোত্তর খাজনার শস্য। কিন্তু অন্যের জন্য উৎপন্ন হয়েছে বলেই উঠ্বন্দী খাজনার শস্য বা দেবোত্তর খাজনার শস্য পণ্য হত না। পণ্য হতে হলে, দ্রব্যকে বিনিময়ের মারফত হস্তান্তরিত হতে হবে অন্যের কাছে, সে যার ভোগে লাগবে তার হাতে ব্যবহারমূল্য হিসেবে।)(১২) সর্বোপরি ব্যবহারের উপযোগী দ্রব্য না হয়ে, কোন কিছুই পণ্য হতে পারে না। দ্রব্যটি যদি অব্যবহার্য হয়, তার মধ্যে বিধৃত শ্রমও হবে অব্যবহার্য; ঐ শ্রম, শ্রম হিসেবে গণ্য হয় না, কাজে কাজেই তা মূল্য সৃষ্টি করে না।
——————-
১. “Zur kritik der politischen Oekonomie”, কার্ল মার্কস, বার্লিন, ১৮৫৯ পৃঃ ৩।
২. “কল্পনা বলতে বোঝায় অভাব, এটা হচ্ছে মনের ক্ষুধা, এবং শরীরের পক্ষে ক্ষুধা যেমন স্বাভাবিক, ঠিক তেমনি…মনের ক্ষুধা যোগানোর জন্যই সবচেয়ে বেশি সংখ্যক জিনিস মূল্যসম্পন্ন হয়।” নিকোলাস বারবো : “নোতুন মূদ্রা আরো হালকা করে তৈরী করা সম্পর্কে একটি আলোচনা “A Discourse Concerning Coining the New money lighter. মিঃ লকের ‘ভাবনা’র জবাবে”, লণ্ডন, ১৬৯৬, পৃঃ ২, ৩।
৩. “অন্তর্নিহিত দ্রব্যসমূহের অভ্যন্তরীণ মূল্য আছে” (এটা হচ্ছে ব্যবহারগত মূল্য সম্পর্কে বারবোর উক্তি) “যার গুণ সর্বত্র একই : যেমন লৌহ-আকর্ষক চুম্বক”, (l.c পৃঃ ৬)। লৌহ আকর্ষণ করার ক্ষেত্রে চুম্বকের এই যে গুণ তা তখন থেকেই ব্যবহারে লাগানো হয় যখন চুম্বকের চৌম্বকত্ব আবিষ্কার হল।
৪. “যে কোন জিনিসের মূল্যগুণ থেকে মানব জীবনের প্রয়োজন মিটাবার ও সুখ-সুবিধা বিধানের সরবরাহের ক্ষমতার মধ্যে।” জন্ লক্ ‘সুদ হ্রাসের ফলাফল সম্পর্কে কয়েকটি ভাবনার কথা,’ (“Some Considerations on the consequences of the Lowering of Interest’) ১৬৯১, গ্রন্থাবলীতে সম্পাদিত, লণ্ডন, ১৭৭৭, খণ্ড ২, পৃঃ ২৮। ১৭শ শতাব্দীরের ইংরেজ লেখকদের লেখায় আমরা হামেশাই ‘অর্থ’ কথাটা পাই ‘ব্যবহার মূল্য’ অর্থে এবং ‘মূল্য’ কথাটা ‘বিনিময় মূল্য’ অর্থে। টিউটনিক শব্দ দিয়ে আসল জিনিসটি বোঝানো এবং রোমান শব্দ দিয়ে তার প্রতিভাসটি বোঝানো যে ভাষার ঝোঁক, সেই ভাষায় কথা দুটি সুসঙ্গত।
৫. বুর্জোয়া সমাজে এই অর্থনৈতিক অতিকথাটি প্রচলিত আছে যে, ক্রেতা হিসেবে প্রত্যেকেই পণ্য সম্বন্ধে বিশ্বকোষের মত ওয়াকিবহাল।
৬. “La valeur consiste dans le rapport d’echange qui se trouve entre telle chose et telle autre, entre telle mesure d’une production et telle mesure d’une autre.” (Le Trosne : ‘De l’Interet Social,’ Physiocrates, Ed. Daire. Paris, 1846, P. 889.)
৭. ‘কোন কিছুরই অন্তর্নিহিত মূল্য থাকতে পারে না’, (এন, বারবো, l.c. পৃঃ ৬), অথবা বাটলার বলেন—
‘একটা দ্রব্যের মূল্য,
তার বদলে যা পাই,
তারই সমতুল্য।’
৮. এন. বারবো, l.c. পৃঃ ৫৩ এবং ৭।
৯. ‘জীবনধারণের প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী যখন পরস্পরের সঙ্গে বিনিমিত হয়, তখন তাদের মূল্য নিয়ন্ত্রিত হয় তাদের উৎপাদনে যতটা শেওম ও সময় লাগে তার দ্বারা।’ ‘সাধারণভাবে অর্থের সুদ সম্বন্ধে এবং বিশেষভাবে সরকারী তহবিল সম্বন্ধে’, (“Some Thoughts on the Interest of Money in General, and Particularly in the Publick Funds, &c.”) লণ্ডন, পৃঃ ৩৬। লেখক-পরিচিতি-বিহীণ এই চমৎকার গ্রন্থখানি লেখা হয়েছিল বিগত শতাব্দীতে কিন্তু এতে কোন নির্দিষ্ট তারিখ দেওয়া নেই। অবশ্য অভ্যন্তরীণ সাক্ষ্য থেকে এটা পরিষ্কার যে দ্বিতীয় জর্জের সময়ে, ১৭৩৯/৪০ সালে, বইখানি প্রকাশিত হয়েছিল।
১০. Le Trosne, l.c. পৃঃ ৮৯৩।
১১. মার্কস, l.c. পৃঃ ৬।
১২. চতুর্থ জার্মান সংস্করের টিকা : এই বক্তব্যটিতে আমি বন্ধনী প্রয়োগ করেছি কারণ এটা না করলে অনেক সময় এই ভ্রান্ত ধারণার সৃষ্টি হয়েছে যে, যে-কোন দ্রব্যই উৎপাদনকারী নিজে পরিভোগ না করে অন্যে পরিভোগ করলে মার্কস তাকে পণ্য বলে অভিহিত করেছেন।–এঙ্গেলস।
.
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। পণ্যের মধ্যে মূর্ত শ্রমের দ্বৈত চরিত্র
প্ৰথম দৃষ্টিতে পণ্য আমাদের কাছে হাজির করেছিল দুটি জিনিসের এক সংমিশ্ৰণ-ব্যবহার মূল্যের এবং বিনিময়মূল্যের। পরে আমরা এও দেখেছি যে শ্রমেরও আছে দ্বৈত চরিত্র, মূল্যের ভিতর তার যে প্ৰকাশ ঘটে সেদিক থেকে তার চরিত্র আর ব্যবহার মূল্যের স্রষ্টা হিসেবে তার যে চরিত্র এই দুই চরিত্র এক নয়। পণ্যের ভিতরে যে শ্ৰম থাকে, তার দ্বৈত চরিত্র আমিই প্ৰথম দেখিয়েছি এবং আমিই প্রথম তার পুংখানুপুংখ বিচার করেছি। যেহেতু যে-মূল বিষয়টির উপর অর্থনীতি সম্বন্ধে পরিষ্কার একটি ধারণা নির্ভর করছে, তা হচ্ছে এইটি, সেহেতু এই বিষয়টির মধ্যে আমরা আর একটু বিশদভাবে প্ৰবেশ করব।
ধরা যাক, একটি কোট আর ১০ গজ ছিট এই দুটি পণ্য, আর ধরা যাক যে প্রথমটির মূল্য দ্বিতীয়টির দ্বিগুণ, সুতরাং, যদি ১০ গজ ছিট্=ব, হয় তা হলে কোটটি=২ব।
কোটটি হচ্ছে একটি ব্যবহার মূল্য যা দ্বারা একটি বিশেষ অভাবের পূরণ হয়; এটি একটি বিশেষ ধরনের উৎপাদনশীল কাজের ফল, যার প্রকৃতি নির্ভর করে তার উদ্দেশ্য, কর্মপদ্ধতি, উপায়, বিষয় এবং ফলশ্রুতির উপর।
এইভাবে যে শ্রমের উপযোগিতা উৎপন্ন দ্রব্যের ব্যবহারগত মূল্য দ্বারা প্রকাশিত হয় অথবা যে শ্রম উৎপন্ন দ্রব্যটিকে ব্যবহার মূল্যে রূপায়িত করবার মাধ্যমে আত্মপ্ৰকাশ করে আমরা তাকে বলি ব্যবহার্য বা উপযোগী শ্রম। এই উপলক্ষে আমরা কেবল তার ব্যবহার্যতার দিকটাই বিচার করি।
যেমন কোট এবং ছিট্ হচ্ছে গুণগত ভাবে দুটি ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহার মূল্য, তেমনি তাদের উৎপাদনকারী সেলাইয়ের কাজ এবং বোনার কাজ এই দুই প্রকার শ্রমও গুণগত ভাবে বিভিন্ন। যদি এই দুটি জিনিস গুণগতভাবে পৃথক না হত, তাহলে তাদের পরস্পরের মধ্যে পণ্যের সম্বন্ধ দেখা দিত না। কোটের সঙ্গে কোটের বিনিময় হয় না, কোন ব্যবহার মূল্যের সঙ্গে অবিকল সেইরকম ব্যবহার মূল্যের বিনিময় চলে না।
ব্যবহার মূল্য যত প্রকারের আছে তার সব কটিরই অনুরূপ তত প্রকারের ব্যবহার্য শ্ৰম আছে : সামাজিক শ্রমবিভাগের ক্ষেত্রে সেগুলি যে যে জাতি গোষ্টী এবং প্রকারের অন্তৰ্গত তদনুযায়ী তাদের শ্রেণীবিভাগও আছে। এই শ্রমবিভাগ পণ্য উৎপাদনের একটি অনিবাৰ্য শর্ত, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে বিপরীত ভাবে, পণ্য উৎপাদনও শ্রম বিভাগের একটি অনিবাৰ্য শর্ত। আদিম ভারতীয় সমাজের ভিতর পণ্য উৎপাদন ব্যতীতই শ্রমবিভাগ ছিল। অথবা, বাড়ির হাতের একটি উদাহরণ ধরলে, প্ৰত্যেক কারখানায় একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসারে শ্রমের বিভাগ থাকে, কিন্তু কর্মে নিযুক্ত লোকের নিজ নিজ উৎপন্ন দ্রব্য পরস্পরের মধ্যে বিনিময় ক’রে সে শ্রমবিভাগ সৃষ্টি করে নি। কেবলমাত্র সেই সমস্ত দ্রব্যই পারস্পত্ত্বিক সম্পর্কে পণ্য হতে পারে যেগুলি ভিন্ন ভিন্ন প্রকার শ্রমের ফলে উৎপন্ন, এবং প্রত্যেক প্রকার শ্রম স্বতন্ত্রভাবে এবং ভিন্ন ভিন্ন লোকের ব্যক্তিগত প্ৰয়াসে সম্পন্ন।
এবার গোড়ার কথায় ফিরে আসা যাক : প্ৰত্যেকটি পণ্যের ব্যবহারমূল্যের ভিতরে বিধৃত রয়েছে ব্যবহার্য শ্ৰম, অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট প্রকারের এবং একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে ব্যয়িত উৎপাদনশীল শ্রম। ব্যবহার মূল্যগুলির পরস্পরের মধ্যে পণ্য সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না, যদি না তাদের মধ্যে বিধৃত ব্যবহার্য শ্ৰম প্রত্যেকটির ভিতরই গুণগতভাবে পৃথক হয়। যে সমাজের উৎপন্ন দ্রব্যের সম্ভার সাধারণভাবে পণ্যের আকার গ্রহণ করে সেই সমাজে অর্থাৎ পণ্যোৎপাদনকারীদের সমাজে ব্যক্তিগত উৎপাদনকারীদের দ্বারা নিজ নিজ হেফাজতে আলাদা আলাদা ভাবে সম্পাদিত শ্রম পরিণত হয় একটি জটিল ব্যবস্থা-বিন্যাসে, সামাজিক শ্রম-বিভাগে।
যা হোক, কোর্টুটি দরজীই পরিধান করুক আর তার খরিদারই পরিধান করুক,। উভয়ক্ষেত্রেই তা ব্যবহারমূল্যের কাজ করে। আর যদি দরজীর কাজ একটি বিশেষ ব্যবসায়ে, সামাজিক শ্রম-বিভাগের একটি বিশেষ শাখায় পরিণত হয়ে যায়, তাহলেও সেই অবস্থায় কোট এবং কোট তৈরির শ্রম-এই উভয়ের পারস্পরিক সম্বন্ধের কোনই তারতম্য হয় না। জামা-কাপড়ের অভাব যেখানেই তাদের বাধ্য করেছে, সেখানেই তারা হাজার হাজার বছর ধরে জামা-কাপড় তৈরী করে এসেছে, অথচ একটি লোকও তখন দরজী হয় নি। কিন্তু স্বতঃস্ফৰ্তভাবে প্ৰকৃতিসদ্ভুত নয় এমন যে-কোন সম্পদের মতো, কোটের এবং ছিটের অস্তিত্বের উৎস হচ্ছে এমন একটি বিশেষ ধরনের উৎপাদনশীল শ্ৰম, যা একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে সম্পাদিত, যা প্ৰকৃতিদাত্ত বস্তুকে মানুষের অভাব নিরসনের কাজে লাগায়। অতএব যেহেতু শ্রম হচ্ছে ব্যবহার মূল্যের স্রষ্টা, অর্থাৎ ব্যবহার্য (উপযোগী) শ্রম, সেহেতু মানবজাতিত্ব অস্তিত্বের জন্য তা হচ্ছে রূপ-নির্বিশেষে সৰ্ববিধ সমাজের, একটি আবশ্যিক শর্ত; এ হচ্ছে প্ৰকৃতি কর্তৃক আরোপিত একটি চিরন্তন আবশ্যিকশর্ত, যা না হলে মানুষ এবং প্রকৃতির মধ্যে কোন বাস্তব আদান-প্ৰদান হ’তে পারে না, সুতরাং কোন জীবনও সম্ভব নয়।
কোট্, ছিট প্রভৃতি ব্যবহার মূল্য, অর্থাৎ পণ্যের অবয়ব গঠিত হয়েছে দু’রকম পদার্থের সমন্বয়ে-বস্তুর এবং শ্রমের। এদের উপর যে ব্যবহার্য শ্রম ব্যয়িত হয়েছে তা যদি সরিয়ে নেওয়া যায়, তাহলে সর্বদাই পড়ে থাকে এমন কিছু উপাদান, প্ৰকৃতি যা মানুষের সাহায্যে ছাড়াই সরবরাহ করেছে। মানুষ কাজ করতে পারে। কেবল প্রকৃতির মতোই, অর্থাৎ বস্তুর রূপান্তর সাধন ক’রে।(১) শুধু এইটুকুই নয়, এই রূপান্তর সাধনের কাজে সে নিরস্তুর প্রাকৃতিক শক্তির সাহায্য পাচ্ছে। কাজেই, আমরা দেখতে পাই যে, শ্ৰমই বৈষয়িক ধনসম্পদের তথা শ্ৰীমদ্বারা উৎপন্ন ব্যবহার মূল্যের একমাত্র উৎস নয়। উইলিয়ম পেটি যেমন বলেছেন, শ্রম তার জনক এবং ধরিত্রী তার জননী।
এবার ব্যবহার মূল্যরূপে বিবেচিত পণ্য ছেড়ে পণ্যের মূল্যের প্রসঙ্গে প্রবেশ করা যাক। আমরা আগেই ধরে নিয়েছি যে, কোটের মূল্য ছিটের মূল্যের দ্বিগুণ। কিন্তু। এটা হচ্ছে একমাত্র পরিমাণগত প্ৰভেদ, যা আপাততঃ আমরা ধরছি না। আমরা অবশ্য মনে রাখছি যে কোটের মূল্য যদি ১০ গজ ছিটের দ্বিগুণ হয়, তা হলে ২০ গজ ছিটের মূল্য এবং একটা কোটের মূল্য একই। মূল্যের দিক থেকে ঐ কোট এবং ঐ ছিট অনুরূপ জিনিস দিয়েই গড়া মূলতঃ অভিন্ন শ্রমের ভিন্ন ভিন্ন বস্তুগত প্ৰকাশ। কিন্তু দরজীর কাজ এবং তাঁতের কাজ গুণগতভাবেই ভিন্ন রকমের শ্ৰম। অবশ্য, এরকম অবস্থারও সমাজ আছে, যেখানে একই লোক কখনো দরজীর কাজ কখনো বা তাঁতের কাজ করে, সে ক্ষেত্রে এই দুই ধরনের শ্রম একই ব্যক্তির শ্রমের রকমফের মাত্র। তা ভিন্ন ভিন্ন লোকের বিশেষ বিশেষ এবং নির্দিষ্ট নির্দিষ্ট কাজ নয়; যেমন আমাদের দরজী যদি একদিন কোট তৈরী করে এবং আর একদিন পায়জামা তৈরী করে তা হলে তা দ্বারা বুঝায় একই লোকের শ্রমের অদলবদল। অধিকন্তু, আমরা এক নজরে দেখতে পাই যে, আমাদের ধনতান্ত্রিক সমাজে, মনুষ্যশ্রমের যে-কোন একটি অংশ, চাহিদার হেরফের অনুসারে, কখনো দরজীর কাজে, কখনো বা তাঁতের কাজে প্ৰযুক্ত হয়। এই পরিবর্তন হয়তো নিবিরোধে না ঘটতে পারে কিন্তু ঘটবে নিশ্চয়ই।
উৎপাদনশীল কাজকর্মের বিশেষ রূপটি, অর্থাৎ শ্রমের ব্যবহার্যতার চরিত্রটি বাদ দিলে, শ্রম মানে মানুষের শ্রমশক্তির ব্যয় ছাড়া আর কিছু হয় না। যদিও দরজীর কাজ আর তাঁতের কাজ গুণগতভাবে ভিন্ন ভিন্ন উৎপাদনশীল কাজ, তাহলেও এসবের প্রত্যেকটিই মানুষের মস্তিস্ক, স্নায়ু ও পেশীর উৎপাদনশীল ব্যয়, এবং এই হিসেবে ওগুলো মানুষের শ্রম অর্থাৎ মানুষের শ্রমশক্তি প্রয়োগ করার ভিন্ন ভিন্ন ধরন। অবশ্য এই যে শ্রমশক্তি ভিন্ন ভিন্ন কাজে প্রয়োগ সত্ত্বেও ষা একই থেকে যায়, তার এই নানান ধরনে প্ৰয়োগ সম্ভব হয়েছে নিশ্চয়ই একটা মাত্রা পর্যন্ত বিকশিত হবার পরেই। কিন্তু পণ্যের মূল্য বলতে বোঝায় মানুষের বিশ্লিষ্ট শ্রমে, নির্বিশেষে মানবিক শ্রমের ব্যয়। যেমন সমাজে কোন একজন সেনাপতির বা কোন একজন ব্যাংক মালিকের মস্ত।বড় ভূমিকা আছে কিন্তু অপরদিকে, নিছক মানুষের ভূমিকা অতি নগণ্য;(২) মানুষের শ্রমের বেলায়ও সেকথা খাটে। এ হচ্ছে সৰ্বল শ্রমশক্তির ব্যয়, অর্থাৎ, যে শ্রমশক্তি কোন বিশ্লিষ্ট রূপে বিকশিত হওয়া ছাড়াও গড়ে প্ৰত্যেকটি সাধারণ ব্যক্তির জৈবদেহের মধ্যেই বর্তমান। একথা সত্য যে, সরল গড় শ্রম বিভিন্ন দেশে, বিভিন্ন কালে, বিভিন্ন চরিত্র ধারণ করে; কিন্তু একটি বিশেষ সমাজে তা নির্দিষ্ট। দক্ষ শ্রমকে হিসেব করা হয় কেবল ঘনীভূত সরল শ্রম বলে অথবা, বলা যায়, কয়েকগুণ সরল শ্রম বলে; কোন একটু নির্দিষ্ট পরিমাণ দক্ষ শ্রমকে ধরতে হবে অধিকতর পরিমাণ সরল শ্রম হিসেবে। অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যায় যে এই রকমে এক শ্রমিকে অন্য শ্রমে পরিণত করার কাজ অনবরতই চলছে। কোন একটি পণ্য দক্ষতম শ্রমের ফল হতে পারে, কিন্তু তার মূল্য বলতে বুঝতে হবে তাকে সমীকরণ দ্বারা সরল অদক্ষ শ্ৰমে পরিণত করে নিলে যা দাঁড়ায় কেবল তারই একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ।(৩) বিভিন্ন রকমের শ্রমকে সরল শ্রমের মানদণ্ডে পরিণত করতে হলে তার অনুপাত কি হবে তা নির্ধারিত হয় একটা সামাজিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে, এই ক্ষেত্রে, সামাজিক প্রক্রিয়াটি উৎপাদনকারীদের অগোচরে ঘটে, এবং তার ফলে তাকে সামাজিক প্রথা দ্বারা নির্ধারিত বলে মনে হয়। সহজ করে বলাৰু জন্য আমরা এখন থেকে প্ৰত্যেক রকমের শ্রমকে অদক্ষ সরল শ্রম বলে ধরব, তাতে আর কিছু হবে না, আমরা শুধু তাকে বারংবার রূপান্তরিত করার বন্ধটি থেকে বাঁচবো।
সুতরাং, যেমন কোট এবং ছিটকে মূল্য হিসেবে দেখতে গিয়ে আমরা তাদের ব্যবহার-মূল্য থেকে বিশ্লিষ্ট করে নিই, ঐ মূল্য বলতে যে শ্রম বোঝায়। তার বেলাও ঠিক তাই করি : আমরা তাদের ব্যবহার্য রূপগুলির তথা বোনার কাজের ও সেলাইয়ের কাজের পার্থক্যটা ধরি না। কোট এবং ছিট, এই ব্যবহার-মূল্যদ্বয় যেমন কাপড় এবং সুতোর সাহায্যে সম্পাদিত বিশিষ্ট বিশিষ্ট উৎপাদনশীল কর্মের সংযোজন, অথচ অপরদিকে যেমন মূল্য হিসেবে কোট এবং ছিট পার্থক্যবিমুক্ত সমজাতীয় শ্রমের ঘনীভূত রূপ, সেইরকম এই মূল্যদ্বয়ের মধ্যে যে শ্রম মূর্তি পরিগ্রহ করে ররেছে তাদেরও কোট এবং ছিটের সঙ্গে উৎপাদনী সম্বন্ধ বলে ধরা হবে না, ধরা হবে কেবল মানুষের শ্রমশক্তির ব্যয় হিসেবে। কোট এবং ছিট, এই ব্যবহার-মূল্যের সৃষ্টিতে বোনার কাজ এবং সেলাইয়ের কাজ হল আবশ্যিক উপাদান, যেহেতু এই দুই রকমের শ্রম হ’ল ভিন্ন ভিন্ন গুণ বিশিষ্ট; সেহেতু সেলাইয়ের কাজ এবং বোনার কাজ ঐ দ্রব্যগুলির মূল্যের মর্মবস্তু হতে পারে শুধুমাত্র এই হিসেবে যে তাদের বিশেষ বিশেষ গুণগুলি ছাটাই করে ফেলা যায়; তাদের এই একটি সমগুণ আছে যে উভয়েই মানুষের শ্ৰম।
অবশ্য, কোট এবং ছিট কেবলমাত্র মূল্য নয়, পরন্তু নির্দিষ্ট পরিমাণ মূল্য, এবং আমরা আগেই ধরে নিয়েছি যে কোট হচ্ছে ১০ গজ ছিটের দ্বিগুণ মূল্যবান। তাদের মূল্যের ভিতর এই পার্থক্য কোথেকে এল? এর কারণ হল এই যে, কোটের মধ্যে শ্ৰম বিধৃত আছে তার অর্ধেক আছে ১০ গজ ছিটের মধ্যে, এবং তারা মাঝে ১০ গজ ছিটের উৎপাদনে যতটা ব্যবহাৰ্য শ্রমশক্তি লেগেছে তার দ্বিগুণ লেগেছে কোটের উৎপাদনে।
সুতরাং ব্যবহার-মূল্যের ক্ষেত্রে, একটি পণ্যের মধ্যে বিধুতি শ্রমকে ধরা হয় গুণগত শ্ৰম হিসেবে, আর মূল্যের ক্ষেত্রে। তাকে ধরা হয় পরিমাণগত শ্ৰম হিসেবে, এবং তাকে পরিণত ক’রে নিতে হয় মানুষের সরল শ্ৰমে। প্ৰথম ক্ষেত্রে প্রশ্নটি হ’ল কেমন করে এবং কিভাবে, অপর ক্ষেত্রে কতটা? কত সময়? যেহেতু একটি পণ্যের মধ্যে বিধূত মূল্যের পরিমাণ বলতে বোঝায়। তার মধ্যে যে পরিমাণ শ্রম বিধৃত আছে শুধু তাই, সেহেতু তা থেকে দাড়ালো এই যে একটি বিশেষ অনুপাত ধরে নিলে, মূল্যের দিক থেকে সমস্ত পণ্য সমান হতে বাধ্য।
একটি কোট উৎপন্ন করতে যত ব্লকমের ভিন্ন ভিন্ন ব্যবহার্য শ্ৰম লাগে তাদের সবারই উৎপাদিকা শক্তি যদি অপরিবর্তনীয় থাকে, তবে কোটের উৎপাদন-সংখ্যা যত বেশি হবে, ততই বেশি হবে তাদের মোট মূল্য। যদি একটি কোট বলতে বোঝায় ‘ক’ দিনের শ্রম, দুটি কোট বলতে বোঝাবে ২ক দিনের শ্রম, ইত্যাদি। কিন্তু ধরা যাক কোটের উৎপাদনে উপযোগী সময়ের দৈর্ঘ্য দ্বিগুণ অথবা অর্ধেক হয়ে গেল। প্রথম ক্ষেত্রে একটি কোটি আগেকার দুটি কোটের সমান মূল্যবান; দ্বিতীয় ক্ষেত্রে, দুটি কোটের মূল্য হবে। আগেকার মাত্র একটি কোটের সমান, যদিও উভয় ক্ষেত্রেই একটি কোটি আগেকার মতোই সমান কাজ দেয়, এবং তার মধ্যে বিধৃত শ্ৰম গুণের দিক থেকে একই আছে। কিন্তু তার উৎপাদনে যে শ্ৰম লেগেছে, তার পরিমাণ গেছে বদলে।
ব্যবহার মূল্যের বৃদ্ধির মানে হচ্ছে বৈষয়িক ধন-সম্পদের বৃদ্ধি। দুটো কোট দু’জন মানুষ পরতে পারে, একটি কোট পরতে পারে একজন মানুষ। যাই হোক না কেন, বৈষয়িক সম্পদের বৃদ্ধি এবং মূল্যের পরিমাণ হ্রাস একই সঙ্গে ঘটতে পারে। এই বিপরীতমুখী গতির মূলে রয়েছে শ্রমের দ্বৈত চরিত্র। উৎপাদিকা শক্তি বলতে অবশ্যই বুঝতে হবে কেবলমাত্র কোন একটা ব্যবহারযোগ্য মূর্ত শ্রম; একটি নির্দিষ্ট সময়ে সম্পাদিত যে কোন উৎপাদনশীল কর্মের কার্যকারিতা নির্ভর করে তার উৎপাদিক শক্তির উপর। কাজেই ব্যবহাৰ্য শ্ৰম, উৎপাদিকা শক্তির হ্রাসবৃদ্ধি অনুসারে, দ্রব্যের কম। বা বেশি পরিমাণ উৎপন্ন দ্রব্যের উৎস। অপরদিকে, উৎপাদন ক্ষমতার কোন পরিবর্তনেই মূল্য বলতে যে শ্রম বোঝায়। তার কোন তারতম্য হয় না। যেহেতু উৎপাদিকা শক্তি হচ্ছে শ্রমের ব্যবহার্যতার মূর্ত রূপের একটি গুণ, সেহেতু যে মুহূর্তে। শ্রমকে তার উপযোগপূর্ণ ঘূর্তিরূপ থেকে বিশ্লিষ্ট করে নিই সেই মুহুর্তে অবশ্যই তার ‘ উৎপাদিকা শক্তির আর কোন প্রভাব থাকতে পারে না। তখন উৎপাদিকা শক্তির। হ্রাস-বৃদ্ধি যতই হোক না কেন, একই শ্রম একই সময় ধর্ক্সে চালালে, একই আয়তনের মূল্য সৃষ্টি করবে। কিন্তু তা সমান সমান সময়ে ব্যবহারগত মূল্য তৈরি করবে ভিন্ন ভিন্ন আয়তনে; উৎপাদিকা শক্তি যদি বাড়ে, তবে বেশি পরিমাণে; আর যদি কমে তো কম পরিমাণে। উৎপাদিকা শক্তি যো-পরিবর্তন শ্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়ায় এবং তার ফলে সেই শ্রম থেকে উৎপন্ন ব্যবহার মূল্যের পরিমাণও বৃদ্ধি করে, তা এই বর্ধিত ব্যবহার মূল্যের মোট মূল্যকে দেয় কমিয়ে,-যদি এরূপ পরিবর্তনের ফলে উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্ৰম-সময় কমে যায়; আর, বিপরীত ক্ষেত্রে ঠিক এর বিপরীতই হবে।
একদিকে সমস্ত শ্ৰমই হ’ল, শারীরবৃত্তের দিক থেকে, মানুষের শ্রমশক্তির ব্যত্ব এবং একইরকম বিশ্লিষ্ট শ্রম হিসেবে তা পণ্য মূল্যের সৃজন ও রূপায়ণ সাধন করে। অপরদিকে, সমস্ত শ্ৰমই হ’ল এক একটি বিশ্লিষ্ট রূপে এবং নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে সম্পাদিত মানুষের শ্রমশক্তি এবং তার ফলে, ব্যবহার্য শ্রম হিসেবে তা তৈরী করে ব্যবহারমূল্য।(৪)
—————–
(১) ‘Tutti i fenomeni dell’universo, sieno essi prodotti della mano dell’uomo, ovvero delle universali leggi della fisica, non ci danno idea di attuale creazione, ma unicamente di una modificazione della materia. Accostare e separare sono gli unici elementi che l’ingegno umano ritrova analizzando l’idea della riproduzione:
e tanto e riproduzione di valore (ব্যবহার-মূল্য, যদিও এই লেখায় ফিজিওক্র্যাটদের সঙ্গে বিতর্কে ভেরি নিজে পরিষ্কার নন যে কি রকম মূল্যের কথা তিনি বলেছেন) e di ricchezze se la terra, l’ariae l’acqua ne’ campi si trasmutino in grano, come se colla mano dell’uomo il glutine di un insetto si trasmuti in velluto ovvero alcuni pezzetti di metalio si i organizzino a formare una ripetizione.’–পিয়েত্র ভেরি, ‘Meditazioni sulla Econonia Politica’ প্রথম মূদ্রণ ১৭৭৩, in custodi’s edition of the Italias Economists, Porte Modern t.xv., পৃঃ ২২।
(২) তুলনীয় হেগেল : Philosophie des Rechts’, বার্লিন, ১৮৪০, পৃঃ ২৫০। ১৯০।
(৩) পাঠক লক্ষ্য করবেন যে আমরা এখানে শ্রমিক নির্দিষ্ট শ্ৰম-সময়ের জন্য যে-মূল্য বা মজুরি পায় তার কথা বলছি না, আমরা বলছি সেই দ্রব্যাদির মূল্যের কথা যার মধ্যে শ্ৰম-সময় বিধৃত হয়েছে। আমাদের আলোচনায় আমরা এখনো ‘মজুরী’ পৰ্যন্ত আসিনি।
(৪) যা দিয়ে সর্বতোভাবে এবং প্রকৃতই সব সময়ে সমস্ত পণ্যের মূল্য নির্ধারণ ও তুলনা কয়া হয় তা যে শ্ৰম, সেকথা প্ৰমাণ করার জন্য অ্যাডাম স্মিথ বলেছেন, ‘শ্রমের সমান সমান পরিমাণের মূল্য শ্রমিকের কাছে সৰ্বকালে এবং সর্বস্থানে একই হতে বাধ্য। তার স্বাস্থ্যের, শক্তির এবং কর্মের স্বাভাবিক অবস্থায়, এবং তার যে গড়পড়তা কর্মকুশলতা আছে তাতে সে সর্বদাই তার বিশ্রামের, স্বাধীনতার এবং সুখের নির্দিষ্ট এক অংশ ত্যাগ করতে বাধ্য।’ ‘জাতিবৃন্দের ধনসম্পদ’ (‘ওয়েলথ অব নেশনস b l.ch ৫) একদিকে, অ্যাডাম স্মিথ এখানে (কিন্তু সবখানে নয়) পণ্য-উৎপাদনে যে পরিমাণ শ্রম ব্যয়িত হয় তার দ্বারা মূল্য নির্ধারণের সঙ্গে শ্রমের-মূল্য দ্বারা পণ্যের মূল্য নির্ধারণের প্রসঙ্গটি গুলিয়ে ফেলেছেন, এবং তার ফলে তিনি প্রমাণ করতে চেয়েছেন যে সম-পরিমাণ শ্রমের মূল্য সর্বদাই সমান। অপরদিকে, তাঁর এই রকম একটা অনুভাবনা আছে যে, যে-শ্ৰম পণ্যের মূল্যের ভিতর অভিব্যক্তি হয়, তা কেবল শ্ৰম-শক্তির ব্যয় বলেই পরিগণিত হয়; কিন্তু তিনি এই ব্যয়কে কেবল বিশ্রাম, স্বাধীনতা, সুখ প্রভৃতির ত্যাগ বলে মনে করেন, কিন্তু সেই সঙ্গে জীবিত প্ৰাণীর স্বাভাবিক কাজকর্ম হিসেবে মনে করেন না। কিন্তু তঁর চোখের সামনে রয়েছে আধুনিক মজুৰী-শ্রমিক। অ্যাডাম স্মিথের পূর্বগামী পূর্বোক্ত নাম-পরিচয়হীন লেখক তা ঢের বেশি সঠিক ‘ভাবে বলেছেন। একজন লোক নিজেকে এক সপ্তাহ কাজে নিযুক্ত রেখেছে জীবিকা সংগ্রহের জন্য…এবং বিনিময়ে যে তাকে অন্য জিনিস দেয়, সে তার জন্য কত শ্ৰম এবং সময় ব্যয় করেছে তার হিসেব ছাড়া আর কোন ভাল হিসেব করতে পারে না তার মূল্যের তুল্যমূল্যের জন্য; ফলতঃ, তার মানে আর কিছু নয়, কেবল কোন নির্দিষ্ট শ্ৰম-সময়ে তৈরি জিনিসের বদলে ঠিক সেই পরিমাণ শ্ৰম-সময়ে তৈরি জিনিসের বিনিময়।’ (J.C., পৃঃ ৩৯) এখানে শ্রমের যে দুটি দিক আলোচনা করা হল তার জন্য ভিন্ন ভিন্ন শব্দ থাকায় ইংরেজী ভাষার একটি সুবিধা আছে।” যে শ্রম ব্যবহার মূল্য তৈরি করে এবং যা গুণগতভাবে বিচাৰ্য, তাকে বলে। ‘ওয়ার্ক (কাজ) আর তা থেকে পৃথক হলে ’লেবর’ (‘শ্ৰম’) যা মূল্য সৃষ্টি করে এবং যা পরিমাণগত ভাবে বিচাৰ্য– এঙ্গেলন্স।
.
১.৩ মূল্যের রূপ বা বিনিময় মূল্য
প্রথম অধ্যায়। তৃতীয় পরিচ্ছেদ
পণ্য জগতে আবির্ভূত হয় ব্যবহারমূল্য হিসেবে, জিনিস অথবা দ্রব্য হিসেবে, যেমন, লোহা, ছিট, শস্য ইত্যাদি হিসেবে। এই হচ্ছে তাদের সাদাসিধে আটপৌরে, দৈহিক রূপ। অবশ্য, এগুলি পণ্য কেবল এইজন্য যে তারা দ্বিবিধ একটি জিনিস-একই সঙ্গে উপযোগিতার বাহক এবং মূল্যেরও ধারক। সুতরাং তারা পণ্য আকারে আত্মপ্ৰকাশ করে। অথবা তারা পণ্যের আকার ধারণ করে কেবলমাত্র এই হিসেবে যে, তাদের দুটা রূপ আছে, একটি হচ্ছে দৈহিক অথবা স্বাভাবিক রূপ আর একটা মূল্য-রূপ।
পণ্যমূল্যের বাস্তবতার সঙ্গে ‘ডেম কুইকলির’র পার্থক্য এই যে, আমরা জানি না “তাকে কোথায় পাওয়া যাবে।” পণ্যের মূল্য হচ্ছে তার স্কুল বাস্তবতার বিপরীত, বস্তুর এক অণুমাত্রও তার অবয়বের মধ্যে ঢোকে না। শুধু একটা পণ্য নিয়ে খুশিমতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে যতই পরীক্ষা করা যাক না কেন, তবু মূল্যের ধারক হিসেবে তার স্বরূপ বোঝা অসম্ভব। অবশ্য, যদি আমরা মনে রাখি যে পণ্যের মূল্যের একটি বিশুদ্ধ সামাজিক সত্তা আছে এবং একটি অভিন্ন সামাজিক বস্তুর-মনুষ্য শ্রমের-অভিব্যক্তি বা বিগ্ৰহ হিসেবেই কেবল একটি পণ্য এই সামাজিক সত্তা অর্জন করে, তাহলে ব্যাপারটা দাঁড়ায় এই যে, বিভিন্ন পণ্যের মধ্যেকার সামাজিক সম্পর্কের মধ্যেই মূল্য আত্মপ্ৰকাশ করতে পারে। আসলে কিন্তু আমরা আরম্ভ করেছিলাম বিনিময়-মূল্য থেকে অথবা পণ্যের বিনিময়-ঘটিত সম্বন্ধ থেকে, তার পিছনে লুক্কায়িত মূল্যের ঠিকানা বের করবার জন্য। মূল্য আমাদের কাছে প্ৰথম যে রূপ নিয়ে হাজির হয়েছিল, আমরা এখন সেই রূপের দিকেই ফিরে যাব।
আর কিছু না জানলেও একথা সবাই জানে যে, সমস্ত পণ্যেরই সাধারণ রূপ হিসেবে একটা মূল্যরূপ আছে, এবং তাদের ব্যবহার মূল্যের বিবিধ দৈহিক রূপ থেকে মূল্যরূপের পার্থক্য সুস্পষ্ট। আমি তাদের অর্থ-রূপের কথা বলছি। অবশ্য এই সুত্রে আমাদের কাধে একটি দায়িত্ব এসে পড়ে, বুর্জোয়া অর্থনীতি কখনো সে কাজের চেষ্টাও করেনি; দায়িত্বটি হ’ল সেই অর্থ-রাপের জন্ম বৃত্তান্ত খুজে বা’র করা, তার যে রূপটি একরকম নজরেই পড়ে না। সেই সরলতম রূপ-রেখা থেকে শুরু ক’রে ভার জাজ্বল্যমান অৰ্থরািপ পৰ্যন্ত মূল্যের যত রূপ এক পণ্যের সঙ্গে অন্য পণ্যের মূলগত সম্বন্ধের মধ্যে নিহিত আছে, সেগুলি পরিস্ফুট করা। এ কাজ করলে অর্থের মধ্যে যে কুহেলী আছে তারও সমাধান আমরা করতে পারব।
এক পণ্যের সঙ্গে ভিন্ন রকম আর এক পণ্যের যে মূল্য-সম্বন্ধ আছে, তাই হলো তার সরলতম মূল্য-সম্বন্ধ। অতএব দুটো পণ্যের মধ্যে যে সম্বন্ধ আছে, তা থেকে আমরা পাই একটি মাত্র পণ্যের মূল্যের সরলতম অভিব্যক্তি।
ক। মূল্যের প্রাথমিক অথবা আপতিক রূপ।
‘ও’ পরিমাণ পণ্য ক == ‘ঔ’ পরিমাণ পণ্য খ, অথবা
‘ও’ পরিমাণ পণ্য ‘ক’-এর সমান মূল্যবান “ঔ’ পরিমাণ পণ্য ‘খ’।
২০ গজ ছিট = ১ কোট, অথবা
২০ গজ পণ্য ১ কোটের সমান মূল্যবান।
১। মূল্যের প্রকাশের দুই মেরু, আপেক্ষিক রূপ এবং সম-অৰ্ঘ রূপ।
মূল্যের রূপ সংক্রান্ত সমস্ত কুহেলিকা এই প্ৰাথমিক রূপের মধ্যেই প্রচ্ছন্ন আছে। সুতরাং এর বিশ্লেষণই আমাদের সামনে আসল সমস্যা।
এখানে দুটি ভিন্ন ভিন্ন পণ্যের (আমাদের উদাহরণ ছিট এবং কোটি) ভূমিকা —স্বভাবতই ভিন্ন ভিন্ন। ছিট তার মূল্য কোটের মাধ্যমে প্ৰকাশ করে। কোট কাজ করে একটি সামগ্ৰী হিসাবে, যার মধ্যে মূল্য প্রকাশ পায়। প্রথমটির ভূমিকা হলো সক্রিয়, অপরটির নিস্ক্রিয়। ছিটের মূল্য প্রকাশিত হয়েছে আপেক্ষিক মূল্য হিসেবে, অথবা তা দেখা দিয়েছে আপেক্ষিক রূপের আকারে। কোট করছে সমার্ঘ রূপের কাজ, অথবা দেখা দিয়েছে সমার্ঘ রূপের আকারে।
আপেক্ষিক রূপ আর সম-অৰ্ঘ রূপ-এই দুটি হল মূল্যের অভিব্যক্তিটির দুটি। উপাদান। এ দুটি উপাদান ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধযুক্ত, পরস্পরের উপর নির্ভরশীল এবং পরস্পরু থেকে অবিচ্ছেদ্য; কিন্তু সেই সঙ্গে এ দুটো আবার পরস্পর-ব্যতিরোকী, পরস্পর-বিরোধী দুটি বিপরীত সত্ত্বও–অর্থাৎ একই অভিব্যক্তির দুটি মেরু। এই রাশিমালার মাধ্যমে যে দুই ভিন্ন ভিন্ন পণ্যকে পরস্পরের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত করা হয়েছে, যথাক্রমে সেই দুটি পণ্যের দুটি অভিব্যক্তি রূপে আপেক্ষিক রূপ আর সমঅৰ্ঘ রূপ এই দুটিকে দাড় করানো হয়েছে। ছিট দিয়ে ছিটের মূল্য প্ৰকাশ করা যায় না। ২০ গজ ছিট = ২০ গজ ছিট মূল্যের কোন প্ৰকাশ নয়। বরং, এরকম সমীকরণ থেকে মাত্র এই কথাই বুঝতে হবে যে, ২০ গজ ছিট ২০ গজ ছিট ছাড়া আর কিছুই নয়; তা ছিট-রূপী ব্যবহার মূল্যের একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ। ছিটের মূল্য প্ৰকাশ করা যায় একমাত্র আপেক্ষিকভাবেঅর্থাৎ, অন্য এক পণ্যের মাধ্যমে। ছিটের মূল্যের আপেক্ষিক রূপ বললে ধরে নিতে হবে তার সম-অৰ্ঘ রূপ হিসেবে আর একটি পণ্যের উপস্থিতি- এক্ষেত্রে কোট। অপরদিকে, যে পণ্যটি সম-অৰ্ঘ রূপের কাজ করে তা তখনি আবার আপেক্ষিক রূপ ধারণ করতে পারে না। যে পণ্যের মূল্য প্ৰকাশ করা হচ্ছে তা ঐ দ্বিতীয় পণ্যটি নয়। এর কাজ হলো সেই সামগ্ৰীট হিসেবে কাজ করা, যার মাধ্যমে প্রথম পণ্যটির মূল্য প্ৰকাশ করা। হচ্ছে।
এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই যে, ২০ গজ ছিট = ১ কোট, অথবা ২০ গজ ছিটের মূল্য ১ কোটের সমান, এই রাশিমালার মধ্যে তার বিপরীত সম্বন্ধও নিহিত আছে : ১ কোট = ২০ গজ ছিট, অথবা ১ কোটের মূল্য = ২০ গজ ছিটা। কিন্তু সেক্ষেত্রে, সমীকরণটি আমি উল্টে দেবীই যাতে কোটের মূল্য আপেক্ষিকভাবে প্ৰকাশ করা যায়, আর যখনি আমি তা করব, কোটের বদলে ছিট হয়ে দাড়াবে সম-অৰ্ঘ রূপ। কাজেই, একই পণ্য একই সঙ্গে মূল্য-সম্বন্ধীয় একই রাশির মধ্যে দুই রূপ ধারণ করতে পারে না। এই দুই রূপের মেরু-বিভাগই তাদেরকে পরস্পর-বিরোধী করে তোলে।
তাহলে, একটি পণ্য আপেক্ষিক রূপ ধারণ করবে, অথবা তার বিপরীত সম-অর্ঘ রূপ ধারণ করবে, তা নির্ভর কবে মূল্যের অভিব্যক্তির এই আপতিক অবস্থানের উপর।–অর্থাৎ যে পণ্যের মূল্য প্ৰকাশ করা হচ্ছে তা কি সেই পণ্য, না কি যে পণ্যের মাধ্যমে মূল্য-প্ৰকাশ করা হচ্ছে, সেই পণ্য।
২. মূল্যের আপেক্ষিক রূপ
(ক) এই রূপের প্রকৃতি ও তাৎপৰ্য।
একটি পণ্যের প্রাথমিক প্ৰকাশ কি করে দুটিপণ্যের মূল্য-সম্বন্ধের মধ্যে লুকায়িত থাকে, তা আবিষ্কাপ করার জন্য আমার প্রথমত: তার বিচার করব মূল্য-সম্বন্ধের পবিমাণগত দিকটা সম্পূর্ণভাবে বাদ দিয়ে। সাধারণতঃ চলতি পদ্ধতি হল ঠিক তার বিপরীত, এবং, মূল্যসম্বন্ধ ব’লতে পরস্পবের সমান বলে পরিগণিত দুটি ভিন্ন ভিন্ন পণ্যের নির্দিষ্ট পরিমাণের ভিতরকার অনুপাত ভিন্ন আর কিছুই দেখা হয় না। এটা প্রায়ই ভুলে যাওয়া হয় যে ভিন্ন ভিন্ন দ্রব্যের খানিকটার পরিমাণ নিয়ে তুলনা করা যেতে পারে শুধু তখনি যখন ঐ পরিমাণগুলি প্ৰকাশ করা হয় একই এককের মাধ্যমে। শুধু এই রকম এককেল মাধ্যমে প্ৰকাশিত হলে পরেই তারা এক রকম আখ্যা লাভ করবার তথ্য পরিমাপ করবার যোগ্য হতে পারে।(১)
২০ গজ ছিট = ১ কোট অথবা = ২০ কোট অথবা == ‘ও’ সংখ্যক কোট-অর্থাৎ, একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ছিটের মূল্য খুব কমই হোক বা বেশি হোক, এরকম প্ৰত্যেকটি বিবৃতির মধ্যে এই সত্য নিহিত আছে যে ছিট এবং কোট, মূল্যের
পরিমাণ হিসেবে, একই এককের মাধ্যমে প্ৰকাশিত, একই ধরনের জিনিস। ‘ছিট = কোট’ হচ্ছে সেই সমীকরণের ভিত্তি।
কিন্তু এই যে দুটি পণ্যের গুণগত মিল। এইভাবে ধরে নেওয়া হল, তাদের ভূমিকা কিন্তু এক নয়। কেবলমাত্র ছিটের মূল্যই প্ৰকাশ করা হল। এবং কিভাবে? তার সঙ্গে তার মূল্যের সমার্ঘরূপ হিসেবে কোটের উল্লেখ করে, যে জিনিসের সঙ্গে তার বিনিময় হতে পারে, সেই জিনিস হিসেবে। এই সম্বন্ধের মধ্যে কোটের আকৃতি ধরে মূল্য বিরাজ করছে, কোটি হচ্ছে মৃত মূল্য, কারণ শুধু এই হিসেবেই কোট ছিটের সমার্ধ-রূপ। অপরদিকে, ছিটের নিজ মূল্য সামনে এসে হাজির হয়েছে, रफ्रिङ ठूgझgछ স্বতন্তভাবে, কারণ শুধু মূল্য হিসেবেই সমর্থ স্বরূপ কোটের সঙ্গে তার তুলনা হতে পারে, অথবা তার বিনিময় হ’তে পারে কোটের সঙ্গে। রসায়ন বিজ্ঞান থেকে একটি উদাহরণ দেওয়া যাক, বিউটরিক এসিড (butyric) হল প্ৰপাইল ফরমেট (Propy formate) থেকে একটি ভিন্ন পদার্থ। যদিও উভয়ই গঠিত হয়েছে একই রাসায়নিক ধাতু থেকে, অঙ্গার (অং), উদজান (উ), এবং অম্লজান এই একই রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা, এবং তাও একই অনুপাতে-যথা, অং৪ উ৮ অ২ (C4 H8 O2)। এখন আমরা যদি বিউটরিক এসিডের সঙ্গে প্ৰপাইল ফরমেটের সমীকরণ করি, তা হলে প্রথমতঃ এই সম্বন্ধের মধ্যে প্ৰপাইল ফরমেট হয়ে দাঁড়ায় কেবলমাত্র অং৪ উ৮ অ২ (C4 H8 O2) এর অস্তিত্বের একটি রূপ; দ্বিতীয়তঃ, আমাদের তরফ থেকে একথাও বলা হয় যে বিউটরিক এসিডও অং৪ উ৮ অ২ (C4 H8 O2) দিয়ে গঠিত। সুতরাং এইভাবেই ঐ দুটি পদার্থের সমীকরণ দ্বারা তাদের রাসয়নিক গড়ন প্রকাশ করা হবে, অথচ তাদের দৈহিক রূপটাকে করা হবে অগ্ৰাহ্য।
আমারা যদি বলি, মূল্য হিসেবে পণ্য হল কেবলমাত্র মানুষের শ্রমের সংহত রূপ, তাহলে সত্য সত্যই আমাদের বিশ্লেষণ দ্বারা আমরা পণ্যকে অমুর্তান্বিত করে মূল্যে পরিণত করি; কিন্তু এই মূল্যের উপর তার দৈহিক রূপ ছাড়া অন্য কোন রূপ আরোপ কৰ্ম্ম না। এক পণ্যের সঙ্গে অন্য পণ্যের মূল্য-সম্বন্ধের বেলায় সে কথা খাটে না। এ ক্ষেত্রে একে অন্যের সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ প্ৰকাশের ভিতর দিয়ে মূল্য বলে পরিচিত হচ্ছে।
কোটকে ছিটের মূল্যের সমার্ঘরূপ হিসেবে দাঁড় করিয়ে, আমরা প্রথমটার ভিতরকার মূর্ত প্রমের সমীকরণ করে থাকি দ্বিতীয়টির ভিতরকার মূর্ত শ্রমের সঙ্গে। এখন, একথা সত্য কোট-উৎপাদনকারী দরজীর কাজ ছিট উৎপাদনকারী তাঁতীর কাজ থেকে ভিন্ন ধরনের বিশেষ শ্ৰম। কিন্তু তাঁতের কাজের সঙ্গে সমীকরণ দ্বারা দরজীর কাজকে এমন একটি বস্তুতে পরিণত করা হয় যা ঐ দুই ধরনের শ্রমের মধ্যে প্রকৃতই সমান, সে বস্তুটি হল মানুষের শ্রম হিসাবে তাদের সাধারণ চরিত্র। হলে, এই ঘোরালো পথে, এই তথ্যটিই প্রকাশিত হচ্ছে যে তাঁতের কাজ যে হিসেবে মূল্য বয়ন করে, সেই হিসেবে তার সন্ত্রে দরজীর কাজের কোনো পার্থক্যই টানা যায় না, ফলে তা হচ্ছে অমূর্তায়িত মনুষ্য-শ্ৰম। শুধুমাত্র ভিন্ন ভিন্ন প্রকার পণ্যের মধ্যে এসে যে অপরের সমার্ঘরূপ হতে পারে তা প্ৰকাশ করেই শ্রমের মূল্যসৃষ্টির বিশেষ চরিত্রটি ফুটে ওঠে এবং তা কাৰ্যতঃ বিভিন্ন প্রকার পণ্যের মধ্যে মূর্ত বিভিন্ন শ্রমকে একটি অমূর্তায়িত সত্তায় পরিণত করে, সে সত্তা হচ্ছে শ্রম নামক তাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্যটি।(২)
অবশ্য ছিটের মূল্য যে শ্ৰম দিয়ে তৈরী, তার বিশেষ চরিত্র প্রকাশ করা ছাড়াও আরো কিছু আবশ্যক। মানুষের ক্রিয় শ্ৰম-শক্তি, তথা মানুষের শ্রম, মূল্য সৃষ্টি করে, কিন্তু তা নিজেই মূল্য নয়। তা মূল্য হয়ে দাঁড়ায় কেবলমাত্র তার সংহত আকারে, কোনো দ্রব্যরূপে যখন তা মূর্তি লাভ করে, তখন ছিটের মূল্যকে মনুষ্যশ্রমের সংহত রূপে প্ৰকাশ করতে হলে, ঐ মূল্যকে এমন ভাবে প্ৰকাশ করতে হবে যেন তার বাস্তব অস্তিত্ব আছে, যেন তা ঐ ছিট থেকে বস্তুত: পৃথক একটি সত্তা, অথচ যা ছিট এবং অন্যান্য সমস্ত পণ্যের মধ্যে সাধারণভাবে বর্তমান। সমস্যাটির সমাধান তো হয়েই গেল।
মূল্যের সমীকরণে সমার্ঘরূপের অবস্থানে কোট হয়ে দাঁড়ায় ছিটের সঙ্গে গুণগতভাবে সমান, একই ধরনের একটা জিনিসের মতো, কারণ ওটা হচ্ছে মূল্য। এই অবস্থানের ভিতর কোটটা হচ্ছে এমন একটা জিনিস, যার ভিতর মূল্য ছাড়া আর কিছু আমরা দেখি না, তথাপি কোটটা-নিজে কোটরাপ সামগ্ৰীটি, একটি ব্যবহারমূল্য মাত্র। কোট হিসেবে কোটি মূল্য নয়, যেমন আমাদের হাতে আসা ছিটের টুকরোটাও মূল্য নয়। এ থেকে বোঝা যায় যে ছিটের সঙ্গে মূল্য-সম্বন্ধের ভিতরে দাড় করালে, কোটের তাৎপৰ্য, সেই সম্বন্ধের বাইরে তার যা তাৎপৰ্য, তার চেয়ে বেশি, ঠিক যেমন, অনেক লোকের ক্ষেত্রে দেখা যায় সাদা পোশাকে ঘুরে বেড়ানোয় তারা যতটা গণ্যমান্য হয় তার চেয়ে বেশি গণ্যমান্য হয় চটকদার পোশাকে ঘুরে বেড়ানোয়।
কোটের উৎপাদনে, দরজীর কাজব্বাপে মানুষের শ্রমশক্তি অবশ্যই ব্যয়িত হয়েছে। কাজেই এর ভিতর মনুষ্য-শ্রম সঞ্চিত আছে। এই দিক থৈকে কোটটি মূল্যের একটি সঞ্চয়াগার, কিন্তু ওকে ছিড়ে টুকরো টুকরো করলেও সে এই তথ্যটি ফাস করবে না। এবং মূল্য সম্বন্ধের ভিতর ছিটের সমার্ঘরূপ হিসেবে, কেবলমাত্র এই দিক থেকেই তার অস্তিত্ব আছে, সুতরাং সে গণ্য হয় মৃদু মূল্য হিসেবে, মূল্যের মূর্তি হিসেবে। যেমন ‘ক’ কখনো ‘খ’ এর কাছে ‘ইয়োর ম্যাজেষ্টি হতে পারে না-যদি না ‘খ’ এর চোখে যা ম্যাজেস্ট্রি তা ‘ক’ এর মধ্যে মৃতি লাভ করে; তার চেয়েও বড় কথা, যদি না প্ৰত্যেকটি নোতুন জনক পিতার সঙ্গে সঙ্গে তার গড়ন, চুল ও আরও অনেক কিছু বদলে যায়।
কাজে কাজেই, যে মূল্য সমীকরণে কোট হচ্ছে ছিটের সমার্ঘরূপ, যেখানে মূল্যের রূপ নিয়ে কোটি এসে দাঁড়ায়। ছিট–এই পণ্যের মূল্য প্রকাশিত হচ্ছে কোট-এই পণ্যের দৈহিক রূপের মাধ্যমে; একটার মূল পরিচিত হচ্ছে আর একটার মূল্য দ্বারা। ব্যবহার-মূল্য স্বরূপ ছিট হচ্ছে স্পষ্টতঃ কোট থেকে ভিন্ন; মূল্য হিসেবে তা কোটের সমার্ঘ, এবং এখন তা কোটের অনুরূপ। এইভাবে ছিট এমন একটি মূল্য রূপ ধারণ করছে, যা তার দৈহিক আকাল থেকে ভিন্ন। সে যে মূল্য এ তথ্য উদঘাটিত হচ্ছে কোটের সঙ্গে তার সমতা থেকে-ঠিক যেমন একজন খ্রীস্টধর্মীর মেষ-প্রকৃতি বোঝা যায় ঈশ্বরের মেষের সঙ্গে তার সাদৃশ্য থেকে।
তাহলেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে পণ্যের মূল্য বিশ্লেষণ করে আমরা যা কিছু জানতে পেরেছি, ছিট তা নিজেই আমাদের বলেছে, যে মূহুর্তে সে আর একটি পণ্য, কোটের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হয়েছে। কেবল, যে-একটিমাত্ৰ ভাষার সঙ্গে সে পরিচিত সেই ভাষায়, অর্থাৎ পণ্যের ভাষায় সে তার মােনর কথা ফাঁস করে দিয়েছে। মানুষের শ্রমের অমূর্তান্বিত অবদানম্বরূপ শ্ৰমই যে তার নিজের মূল্য সৃষ্টি করেছে। এই কথাটি বলবার জন্য ছিট বলছে যে তার সমান মূল্যবান বলেই তো কোট হচ্ছে মূল্য, আর সেই হিসেবে ছিটের ভিতর যে পরিমান শ্রম আছে, তার ভিতরও তাই আছে। মূল্য নামক তার মহিম বাস্তবটি এবং নিরেট দেহটি যে এক নয় এই সংবাদ আমাদের দেবার জন্য ছিট বলছে যে, মূল্য কোটের আকার ধারণ করেছে এবং যে হিসেবে ছিট হচ্ছে মূল্য সেই হিসেবে ছিট আর কোট হলো দুটো মটরদানার মতো একই রকম। আমরা এখানে মন্তব্য করতে পারি। যে পণ্যের ভাষার মধ্যে হিব্রু ছাড়া আরো অনেক কমবেশি শুদ্ধ কথ্য ভাষা আছে। উদাহরণ স্বরূপ, জার্মান শব্দ “Wertsein” মানে মূল্যবান হওয়া, এই কথাটা রোমান ক্রিয়াপদ “Valere”, “Valler”, “Valoir”-এর চেয়ে সাদা-সিধে ভাবে এই কথায় বোঝায়। যে ‘খ’ পণ্যের সঙ্গে ‘ক’ পণ্যের সমীকরণ হচ্ছে ‘ক’ পণ্যের নিজ মূল্য প্রকাশের নিজস্ব ভঙ্গি। Paris vaut bien une messe.
সুতরাং আমাদের সমীকরণে যে মূল্য-সম্বন্ধ প্ৰকাশিত হয়েছে তার সাহায্যে ‘খ’ পণ্যের দৈহিকরূপ ‘ক’ পণ্যের মূল্যরূপ হয়ে দাড়িয়েছে, অথবা ‘খ’ পণ্যের দেহটা ‘ক’ পণ্যের মূল্যের দর্পণের কাজ করছে।(৩) ‘ক’ পণ্য নিজেকে স্থাপন করলে ‘খ’ পণ্যের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত ক’রে যেন ‘খ’ পণ্য হ’লো সশরীরে বর্তমান মূল্য, যে পদাৰ্থ দিয়ে মচুন্যশ্ৰম গঠিত হয় ‘খ’ যেন সেই পদার্থ এবং এইভাবে ব্যবহারমূল্য-রূপী ‘খ’ কে সে পরিণত করল তার নিজ মূল্য প্রকাশ করবার সামগ্ৰীতে। ‘খ’-এর ব্যবহার-মূল্যের মাধ্যমে প্ৰকাশিত ‘ক’-এর মূল্য এইভাবে আপেক্ষিক মূল্যের রূপ ধারণ করেছে।
(খ) আপেক্ষিক মূল্যের পরিমাণগত নির্ধারণ
যার মূল্য প্ৰকাশ করতে চাই এমন যে-কোনো পণ্যই হচ্ছে একটি নিদিষ্ট পরিমাণ উপযোগী বা ব্যবহারযোগ্য বিষয়, যথা, ১৫ বুশেল শস্য, অথবা ১ ও ০ পাউণ্ড কফি। এবং কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ যে-কোনো পণ্যের মধ্যে আছে নির্দিষ্ট পরিমাণ মনুষ্যশ্ৰম সুতরাং মূল্য-রূপকে কেবল সাধারণভাবে মূল্য প্ৰকাশ করলেই চলবে না, তাকে নির্দিষ্ট পরিমাণেও তা প্ৰকাশ করতে হবে। কাজেই খ পণ্যের সঙ্গে কি পণ্যের কোটের সঙ্গে ছিটের, মূল্যজনিত সম্বন্ধের ভিতর কোটি কেবলমাত্র সাধারণ মূল্য হিসেবে ছিটের সমগুণ লাভ ক’রে ক্ষান্ত হয়নি, একটি নিদিষ্ট পরিমাণ কোট (১টি কোট) একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ (২০ গজ) ছিটের প্রতিরূপ হয়ে দাড়িয়েছে।
২০ গজ ছিট = ১ কোট অথবা ২০ গজ ছিট ১টি কোটের সমান মূল্যবান এই সমীকরণের ভিতর নিহিত সত্যকথা হচ্ছে এই যে মূল-বস্তুটি (সংহত শ্রম) সমপরিমাণে উভয়ের মধ্যে মূর্ত হয়ে আছে; আর দুটো পণ্যই তৈরী কবিতে লেগেছে সমপরিমাণ সময়ব্যাপী সমপরিমাণ শ্ৰম। কিন্তু ২০ গজ ছিট অথবা ১ টি কোট তৈরী করবার জন্য প্ৰয়োজনীয় শ্ৰম-সময় তাঁতের এবং দরজীর কাজের উৎপাদকতার পরিবর্তনের সঙ্গে পরিবতিত হয়। আমাদের এখন বিচার করতে হবে যে, তার দ্বারা মূল্যের আপেক্ষিক প্রকাশের পরিমাণের দিকটা কি ভাবে প্রভাবিত হয়।
১। ছিটের মূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধি করা যাক(৪), কোটের মূল্য ধরা যাক স্থির আছে। ধরা যাক তুলোর জমি খারাপ হয়ে যাবার ফলে, ছিট তৈরীর জন্য যে শ্ৰম-সময় লগত তা দ্বিগুণ হ’য়ে গেল, তা হ’লে ছিটের মূল্যও দ্বিগুণ হয়ে যাবে; তখন ২০ গজ ছিট = ১ কোটি এই সমীকরণের পরিবর্তে, আমরা পাব ২০ গজ ছিট-২ কোট, যেহেতু ১ কোটের ভিতর এখন আছে। ২০ গজ ছিটের মধ্যে যে শ্ৰম-সময় মূর্ত হয়েছে, তার অর্ধেক। কিন্তু যদি তাঁতের উন্নতির ফলে এই শ্ৰম-সময় অর্ধেক কমে যায়, তবে ছিটের মূল্যও অর্ধেক কমে যাবে; ফলে আমরা পাব ২০ গজ ছিট = অর্ধেক কোট। ‘খ’ এর মূল্য যদি স্থির থাকে তাহলে কি পণ্যের আপেক্ষিক মূল্য, অর্থাৎ তার যে মূল্য খ পণ্যের দ্বারা প্রকাশিত হয় তার হ্রাস-বৃদ্ধি ক-এর মূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধির সঙ্গে সরাসরিভাবে হয়।
২। ছিটের মূল্য স্থির আছে ধরে নেওযা যাক, কোটের মূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধি হচ্ছে; এ হেন অবস্থায় যদি উদাহরণ স্বরূপ, পশম উৎপাদন কম হওয়ার ফলে, কোটি তৈরীর জন্য প্রয়োজনীয় শ্ৰম-সময় দ্বিগুণ হয়ে যায়, আমরা তাহলে পাব ২০ গজ ছিট= ১ কোটের পরিবর্তে ২০ গজ ছিট = অর্ধ কোট। কিন্তু যদি কোটের মূল্য অর্ধেক কমে যায়, তাহলে ২০ গজ ছিট = ২ কোট। অতএব, যদি ক পণ্যের মূল্য স্থির থাকে, তবে খ পণ্যের মারফৎ প্রকাশিত তার আপেক্ষিক মূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধি হবে খ-এর মূল্যের হ্রাস বৃদ্ধির বিপৰীত দিকে।
১ এবং ২ এর মধ্যে বর্নিত ভিন্ন ভিন্ন বিষয় দুটির মধ্যে তুলনা করলে দেখা যাবে। যে অপেক্ষিক মূল্যের একই পরিবর্তন সম্পূর্ণ বিপরীত কারণে ঘটতে পারে। যথা ২০ গাজ ছিট = ১ কোট এর বদলে ২০ গজ ছিট = ২ কোট পেতে পারি, হয় এই জন্য যে ছিটের মূল্য দ্বিগুণ হয়ে গেছে, অথবা এইজন্য যে কোটের মূল্য অর্ধেক কমে গেছে; আবার ২০ গজ ছিট = অর্ধ কোট হতে পারে, হয় এইজন্য যে ছিটের মূল্য অর্ধেক কমে গেছে, অথবা এইজন্য যে কোটে বা মূল্য দ্বিগুণ হয়ে গেছে।
৩। যথাক্রমে ছিট এবং কোট তৈরী করবার জন্য প্রয়োজনীয় শ্ৰম-সময় একই সঙ্গে, একই দিকে এবং একই অনুপাতে বেড়ে গেল। এক্ষেত্রে ২০ গজ ছিট ১টি কোটের সমান থেকে যাবে তাদের মূল্য যতই পরিবর্তিত হোক না কেন। তাদের মূল্যের পরিবর্তন ধরা পড়বে যখন তাদের তুলনা করব এমন তৃতীয় পণ্যের সঙ্গে, যার মূল্য স্থির আছে। যদি সমস্ত পণ্যের মূল্য একই সঙ্গে এবং একই অনুপাতে বাড়তো কিংবা কমতে, তাদের আপেক্ষিক মূল্যের কোন পরিবর্তন হতো না। তাদের মূল্যের প্ৰকৃত পরিবর্তন ধরা পড়বে সেই পণ্যের কোন একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ সময়ের মধ্যে কম। সময়ে অথবা বেশি সময়ে উৎপন্ন হচ্ছে তা থেকে।
৪। যথাক্রমে ছিট এবং কোট, সুতরাং এই পণ্যদ্বয়ের মূল্য, একই দিকে অথচ ভিন্ন ভিন্ন অনুপাতে, অথবা বিপরীত দিকে অথবা অন্য কোনভাবে পরিবতিত হতে পারে। পণ্যের অপেক্ষিক মূল্যের উপর এই সমস্ত সম্ভাব্য হ্রাসবৃদ্ধির প্রভাব ১, ২ এবং ৩ এর ফলাফল থেকে কষে বার করা যেতে পারে।
এইভাবে মূল্যের পরিমাণগত পরিবর্তন তার আপেক্ষিক প্ৰকাশে, অৰ্থাৎ অপেক্ষিক মূল্যের পরিমাণ যাতে প্ৰকাশিত হয় সেই সমীকরণের ভিতরে প্ৰতিফলিত হয় না, স্বচ্ছ ভাবেও নয়, পরিপূর্ণভাবেও নয়। যে-কোনো একটি পণ্যের মূল্য স্থির থাকলেও তাঁর আপেক্ষিক মূল্যের হ্রাসবৃদ্ধি হতে পারে। তার মূল্যের হ্রাসবৃদ্ধি হলেও তার আপেক্ষিক মূল্য স্থির থাকতে পারে; এবং, সর্বোপরি, তার মূল্যের এবং আপেক্ষিক মূল্যের হ্রাসবৃদ্ধি যুগপৎ একসঙ্গে হলে তা যে সমপরিমাণেই হবে এমন কোন কথা নেই।(৫)
৩. মূল্যের সমার্ঘ রূপ
আমরা দেখেছি যে কি পণ্য (ছিট)। ভিন্ন প্রকারের একটি পণ্যের (কোটি) ব্যবহার মূল্যের মাধ্যমে নিজ মূল্য প্রকাশ করে দ্বিতীয় পণ্যেটির ওপর ছাপ দিয়ে দেয় একটি বিশেষ ধরনের মূল্যের অর্থাৎ সমার্ঘরূপের। যেহেতু কোটি নিজেস্ব আকৃতির বহিভূত কোন পৃথক মূল্যরূপ ধারণ করছে না, এবং যেহেতু তার সঙ্গে ছিটে সমীকরণ হচ্ছে, সেই হেতু ছিট নামক পণ্যটি তার মূল্যগুণ জাহির করতে পারছে। সুতরাং ছিটেল যে মূল্য আছে সে কথা প্ৰকাশ করা হচ্ছে এই বলে যে, তার সঙ্গে কোটের সরাসরি বিনিময় হতে পারে। কাজেই, আমরা যখন একটি পণ্যকে সমার্ঘরূপ আখ্যা দিই, তখন আমরা এই তথ্যটিই বিকৃত করি যে, তার সঙ্গে অন্যান্য পণ্যের সরাসরি বিনিময় হতে পারে।
যখন কোন একটি পণ্য যেমন কোট, অন্য কোন একটি পণ্যের, যেমন ছিটের সমার্ঘরূপ হিসেবে কাজ করে এবং তার ফলে যখন তা ছিটের সঙ্গে বিনিময়ের স্বভাবসিদ্ধ যোগ্যতা লাভ করে, তখনে আমরা জানি না। যে ওদের বিনিময় হতে পারে কী অনুপাতে। ছিটের মূল্যের পরিমাণ যদি দেওয়া থাকে, তাহলে এই অনুপাত নির্ভর করে কোটের মূল্যের উপর। কোট সমাৰ্দরূপ এবং ছিট আপেক্ষিক মূল্যের কাজ করুক, অথবা ছিট সমার্ঘরূপ এবং কোটি আপেক্ষিক মূল্যের কাজ করুক, কোটের মূল্যের পরিমাণ নির্ভর করে তার মূল্য-রূপ থেকে স্বতন্ত্রভাবে, তার উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় শ্ৰম-সময় দিয়ে। কিন্তু কোটি যখন খ মূল্যের সমীকরণে সমার্ঘরূপের স্থান গ্ৰহণ করে তখন তার নিজস্ব মূল্যের কোন পরিমাণ প্ৰকাশিত হয় না, বরং কোটি এই পণ্যটি তখন মাত্র একটি নির্দিষ্ট পরিমাণের জিনিস হিসেবে হাজির হয়।
উদাহরণ স্বরূপ, ৪০ গজ ছিটের মূল্য–কত? ২ কোট। কারণ কোটি নামক পণ্যটি এখানে সমার্ঘরূপের ভূমিকা অবলম্বন করেছে, কারণ ছিট থেকে পৃথক এই কোটের ভিতর অঙ্গীভূত মূল্য আছে, তাই নিদিষ্ট সংখ্যক কোটি দ্বারা নির্দিষ্ট পরিমাণ ছিটের মূল্য প্রকাশ করা চলে। কাজেই কোটগুলি ৪০ গজ ছিটের মূল্য প্ৰকাশ করতে পারে, কিন্তু কখনো তাদের নিজ মূল্যের পরিমাণ প্রকাশ করতে পারে না। মূল্যের সমীকরণে সমাৰ্নরূপটি যে কোনো একটি জিনিসের তথা ব্যবহার-মূল্যের, সহজ সরল একটি পরিমাণ ছাড়া আর কিছুই না, এই তথ্যটি ভাসাভাসা ভাবে লক্ষ্য করে, বেইলী, তার পূর্বের এবং পরের আরো অনেকের মতো ভুল কবে মনে করেছেন যে মূল্যের রাশিমালা শুধুমাত্র একটি পরিমাণগত সম্বন্ধ। আসল কথা হচ্ছে, কোন-পণ্য যখন সমার্ঘরূপ হয়ে দাঁড়ায় তখন তার মূল্যের কোন পরিমাণই প্ৰকাশিত হয় না।
মূল্যের সমার্ঘরূপ বিচার করতে গিয়ে যে প্রথম বৈশিষ্ট্যটি আমাদের নজরে পড়ে, তা হচ্ছে এই : ব্যবহার-মূল্য মূল্যের বিপরীত হয়েও তা-ই তার পরিচয় প্রকাশ করবার অভিজ্ঞান, তার দৃশ্যমান মূর্তরূপ।
পণ্যটির মূর্ত রূপটাই হয়ে দাঁড়ালো তার মূল্য-রূপ। কিন্তু বেশ ভাল করে লক্ষ্য করুন। ‘খ’ নামক যে-কোনো পণ্যের বেলায় এই প্রকার সমার্ঘরূপে স্থাপন শুধু তখনি চলে, যখন ‘ক’ নামক অন্য কোন পণ্য তার সঙ্গে মূল্য-সম্বন্ধে নিয়ে দাঁড়ায়, এবং তাও চলে একমাত্র এই সম্বন্ধের পরিধির মধ্যেই। যেহেতু কোন পণ্যই নিজে নিজের সমার্ঘরূপ হতে পারে না, পারে না , এইভাবে তার নিজের অবয়বটাকে দিয়েই নিজের মূল্য প্ৰকাশ করতে, সেহেতু তাকে নিজ মূল্যের সমার্ঘরূপ হিসেবে অন্ত কোন পণ্য বাছাই করতেই হবে, এবং মেনে নিতেই হবে নিজ মূল্যের রূপ হিসেবে অন্য কোন ব্যবহার-মূল্য, তথা সেই অন্য পণ্যের অবয়ব।
বাস্তব পদার্থ হিসেবে, তথা ব্যবহার মূল্য হিসেবে, পণ্য সম্পর্কে আমরা যে সমস্ত ব্যবস্থা প্রয়োগ করে থাকি, তার একটি উদাহরণ থেকে এ বিষয়টি বোঝা যাবে। একটি চিনির তক্তি একটা ভারী জিনিস, সুতরাং তার ওজন আছে, কিন্তু এই ওজন আমরা দেখতেও পাই না, স্পর্শ করতেও পারি না। আমরা তখন এমন নানারকম লোহার টুকরো নিই, যাদের ওজন আগে থেকেই ঠিক করা আছে। তৎসত্ত্বেও লৌহ হিসেবে লোহার মধ্যে চিনির চেয়ে অতিরিক্ত এমন কিছু নেই যাতে তা ওজন প্রকাশের রূপ ধারণ করতে পারে। লৌহ-খণ্ড এই ভূমিকা অবলম্বন করতে পাৰ্ব্বলো শুধু এইজন্য যে, চিনি নামক আর একটা জিনিস অথবা অন্য যে-কোনো জিনিস, যার ওজন ঠিক করতে হবে, তার সঙ্গে লোহা একটা তুলনার মধ্যে এলো। যদি এই উভয়েই ভারসম্পন্ন না হতো, তাহলে এরা এরকম তুলনার মধ্যে আসতে পারতো না; উভয়কেই যখন আমরা দাড়িপাল্লায় রাখি, আমরা তখন প্ৰকৃত পক্ষে দেখি যে, ওজনের দিক থেকে উভয়েই এক, এবং সেইজন্যই, উপযুক্ত অনুপাতে নিলে, তাদের ওজনও এক। ঠিক যেমন লৌহখণ্ডটি ওজনে বাটখারা হিসেবে চিনির তক্তিটির শুধু ওজনেরই পরিচয় দেয়, সেই প্রকার আমাদের মূল্য রাশিমালার ক্ষেত্রে কোট নামক বাস্তব পদার্থটি ছিটের সম্পর্কে শুধু মূল্যেরই পরিচয় দেয়।
অবশ্য, এখানেই উপমার শেষ। চিনির তক্তিটির ওজনের পরিচয় দিতে গিয়ে লোহার টুকরোটি উভয়ের ভিতর সমভাবে বর্তমান—এমন একটি প্রাকৃতিক সত্তার পরিচয় প্রকাশ করে , কিন্তু ছিটের মূল্যেৰ্ব পরিচয় দিতে গিয়ে কোটি প্ৰকাশ করে উভয়ের একটি অপ্রাকৃতিক সত্তা, নিছক একটি সামাজিক জিনিস, অর্থাৎ তাদের মূল্য।
যেহেতু ছিটের মতো কোন একটি পণ্যের যে মূল্য অপেক্ষিক মূল্যরূপে প্রকাশিত হয়, সে রূপটি হলো কোটের মতো সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বস্তু বা সত্তা, কাজেই ওর পেছনে যে সামাজিক সম্বন্ধ রয়েছে তার ইঙ্গিত। ঐ রাশিমালার মধ্যেই দেখতে পাই। মূল্যের সমর্মরূপের ব্যাপারটি হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই রূপের সংক্ষিপ্ত সারমর্ম হলো এই যে বাস্তব পণ্যটিই- কোটটিই-অবিকল নিজ মূর্তিতে মূল্যের পরিচয় প্ৰদান করছে এবং প্রকৃতি নিজেই তাকে মূল্য-রূপটি দান করছে। অবশ্য, একথা শুধু ততক্ষণই খাটে, যতক্ষণ এমন একটি মূল্য সম্পর্ক থাকছে, যার ভিতর কোট ছিটের মূল্যের সমার্ঘরূপ হয়ে দাঁড়িয়েছে।(৬) অবশ্য যেহেতু কোন একটি জিনিসের অন্তর্নিহিত সত্তা, তার সঙ্গে অন্য জিনিসের যে-সম্পর্ক আছে তার ফলে গজায় না, সেই সম্পর্কের মধ্যে কেবলমাত্র তার প্রকাশ ঘটে, সেহেতু মনে হয়। প্রকৃতি যো-হিসেবে তাকে তার ওজনের ধর্ম এবং আমাদের শরীর গরম করবার ক্ষমতা দিয়েছে, সেই হিসেবেই তাকে দিয়েছে মূল্যের সমার্ঘরূপ হবার গুণ, সরাসরি বিনিময়ের যোগ্যতা। এই জন্যেই মূল্যের সমাৰ্ধক্কাপের মধ্যেকার কুহেলিময় চরিত্রটি বুর্জেীয়া অর্থনীতিবিদের নজরে পড়ে না, যতক্ষণ না তা পরিপূর্ণ বিকশিত অবস্থায় অর্থীপে তার সামনে হাজির হয়। তিনি তখন সোনা এবং রূপের কুহেলিময় চরিত্রটি ব্যাখ্যা করে উডিয়ে দিতে চান তার স্থানে কম চাকচিক্যময় পণ্য বসিয়ে এবং কোন না কোন সময়ে যে-সমস্ত সম্ভাব্য পণ্যমূল্যের সমাৰ্থরূপের কাজ করেছে, তার তালিকা আবৃত্তি করে নিত্য নতুন পরিতৃপ্তি সহকারে। এ সন্দেহ তার একটুও হয় না যে আমাদের সমাধান কল্পে সমার্ঘরূপের কুহেলিকা ২০ গজ ছিট= ১ কোট এই সরলতম মূল্য পরিচয়ের মধ্যে প্রকাশিত হয়ে রয়েছে।
যে পণ্যের মূর্ত রূপটি মূল্যের সমার্ঘরূপের কাজ করে, তা অমূর্তায়িত মনুষ্য শ্রমের বস্বরূপ এবং সেই সঙ্গে কোন একটি ব্যবহারযোগ্য বিশিষ্ট শ্রমের ফল। কাজেই এই বিশিষ্ট শ্রমের মাধ্যমেই অমূর্তায়িত মনুষ্য-শ্রম প্ৰকাশিত হয়। এক দিকে, কোটি যদি অমূর্ত্যায়িত মত্যু শ্রমের মূর্তরূপ ছাড়া। আর কিছু না হয়, তাহলে অন্যদিকে যে দবাজীর কাজ প্রকৃতপক্ষে এর মধ্যে মূর্ত হয়ে আছে তা সেই মূর্তিায়িত শ্রম রূপায়ণের আধার ছাড়া আর কিছু নয়। ছিটের মূল্য প্ৰকাশ করতে গিয়ে দরজীর কাজের যে উপযোগিতার পরিচয় পাওয়া যায়, তা পোশাক পরিচ্ছদ তৈরীর নয়, তা এমন একটা জিনিসের তৈরী যাকে আমরা সঙ্গে সঙ্গেই চিনতে পারি মূল্য বলে, অর্থাৎ ঘনীভূত শ্রম বলে, কিন্তু এই শ্রম এবং ছিটের মূল্যের ভিতর রূপায়িত হয়েছে যে শ্রম এই দুইয়ের মধ্যে কোন পার্থক্য বোঝা যায় না। এই রকমভাবে মূল্যের দৰ্পণ হিসেবে কাজ করতে হলে দরজীর শ্রমের মধ্যে সাধারণ মনুষ্য শ্রম হবার অমৃর্ত্যায়িত পণ্যটি ছাড়া অন্য কিছু প্ৰতিফলিত হলে চলবে না।
যেমন দরজীর কাজে, তেমনি তস্কবায়ের কাজে মানুষের শ্রম-শক্তি ব্যয়িত হয়। কাজেই উভয়ের ভিতরই সাধারণ গুণ হিসেবে রয়েছে মনুষ্য শ্ৰম সেইজন্য কোন কোন ক্ষেত্রে যেমন মূল্য উৎপাদনের মধ্যে, তাকে শুধু এইদিক দিয়েই বিচার করতে হয়। কিন্তু মূল্য প্ৰকাশের ক্ষেত্রে ব্যাপার সম্পূর্ণ বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। উদাহরণ স্বরূপ যেমন এ ব্যাপারটি কেমন করে প্রকাশ করা যেতে পারে যে, বয়ন-শ্রম ছিটের মূল্য সৃষ্টি করে থাকে। বয়নের গুণে নয়, সাধারণ মনুষ্য শ্ৰম হবার গুণে। তা করা যায়, কেবলমাত্র বয়নের পাণ্টাদিকে শ্ৰমেয় এমন অ্যর একটা বিশিষ্টরূপ (এ ক্ষেত্রে দরজীর শ্রম) খাড়া করে যা বয়ন থেকে উৎপন্ন দ্রব্যের মূল্যের সমার্ঘরূপ হতে পারে। ঠিক যেমন কোটের অবয়বটা সরাসরি মূল্যের পরিচয় ধারণ করে, সেইরকম শ্রমের একটা বিশিষ্টরূপ, দরজীর শ্রম, সাধারণভাবে মনুষ্য শ্রমের প্রত্যক্ষ এবং সুস্পষ্ট মূর্তরূপ নিয়েছে।
অতএব সমার্ঘরূপের দ্বিতীয় বিশেষত্ব হল বিশিষ্ট শ্রম রূপেই তার বিপরীত তথ্য অমূর্তায়িত মনুষ্য-শ্ৰম আত্মপ্ৰকাশ করে থাকে।
কিন্তু যেহেতু এই বিশিষ্ট শ্রম, উপস্থিত ক্ষেত্রে দরজীর কাজ, অবিশিষ্ট মনুষ্য শ্রমের মধ্যে গণ্য, এবং সরাসরি অবিশিষ্ট শ্রম বলেই তাকে চেনা যায়। সেহেতু এই শ্ৰম অন্য যে কোন ধরনের শ্রমের মধ্যেই অভিন্ন বলে ধর্তব্য, কাজেই ছিটের মধ্যে যে শ্রম অঙ্গীভূত হয়ে আছে তার সঙ্গে তা অভিন্ন। তার ফলে যদিও অন্যান্য সর্বপ্রকার পণ্য-উৎপাদক শ্রমের মতো এই শ্রমও পৃথক পৃথক ব্যক্তির শ্রম, তথাপি সেই সঙ্গে তার চরিত্র প্ৰত্যক্ষভাবে সামাজিক বলে পরিগণিত! সেইজন্যই এই শ্ৰীমদ্বারা উৎপন্ন দ্রব্য সরাসরি অন্য যেকোনো দ্রব্যের সঙ্গে বিনিময়যোগ্য। তাহলে আমরা পাচ্ছি সমার্ঘরূপের তৃতীয় বিশেষত্ব, অর্থাৎ লোকের ব্যক্তিগত শ্রম ঠিক তার বিপরীত, তথা শ্রমের প্রত্যক্ষ সামাজিক রূপ ধারণ করে।
সমাৰ্ণরূপের শেষ দুটি বিশেষত্ব আরও সহজবোধ্য হয় যদি আমরা ফিরে যাই সেই মহান তত্ত্ববিদের কথায়, যিনি সর্বপ্রথম বহুবিধ রূপ বিশ্লেষণ করেছিলেন,- চিস্তায় সমাজের অথবা প্ৰকৃতিক-এবং এসবের মধ্যে মূলোর রূপও ছিল। আমি অ্যারিস্ততলের কথা বলছি।
প্রথমতঃ তিনি পরিষ্কারভাবেই এই সিদ্ধান্ত টেনেছেন যে, মূল্যের সরল রূপটিই ক্ৰমবিকাশ সূত্রে উন্নত স্তরে পৌছে অর্থব্ধপ ধারণ করে, এই অর্থব্ধপটি হলো এলোমেলোভাবে বাছাই করা অন্য যেকোন পণ্যের মূল্যের অভিব্যক্তি , কারণ তিনি বলেছেন–৫ বিছানা = ১ ঘর আর ৫ বিছানা = এতটা অর্থ–এর একটাকে অপরটি থেকে পৃথক বলে বিবেচনা করা চলে না। তিনি আরও দেখিয়েছেন যে, যে-মূল্যসম্পর্ক থেকে এই রাশিমালার উৎপত্তি তা থেকে দাঁড়ায় এই যে গুণগতভাবে ঘরটিকে বিছানার সমান হতে হবে, এবং এইরকম সমান না হলে এই দুটি স্পষ্টতঃ ভিন্ন জিনিসের মধ্যে পরিমাপযোগ্য পরিমাণের দিক থেকে তুলনা হতে পারে না। তিনি বলেছেন, ‘সমানে সমানে ছাড়া বিনিময় হয় না এবং পরিমাপযোগ্য না হলে সমান সমান হয়। না।” তিনি অবশ্য এখানেই থেকে গিয়েছেন এবং মূল্য রূপের আর কোন বিশ্লেষণ দেননি। যাহোক, এরকম ভিন্ন ভিন্ন জিনিসের পক্ষে প্রকৃতভাবে পরিমাপযোগ্য হওয়া অসম্ভব। অর্থাৎ গুণগতভাবে সমান হওয়া অসম্ভব। এরকম সমীভবন তাদের প্ৰকৃত চরিত্রের বিরোধী, কাৰ্যতঃ তা হচ্ছে “কেবল কাজ চালাবার মত একটি দায়-সারা ব্যবস্থা।”
অতএব, অ্যারিস্ততল নিজেই আমাদের বলেছেন কী সেই ব্যাপারটি যা তার পরবর্তী বিশ্লেষণের পথরোধ করে দাড়িয়েছে; তা হচ্ছে মূল্য সম্পর্কে কোন ধারণার অভাব। সেই সমান জিনিসটি কী, কী সেই সাধারণ সামগ্ৰীটি, যা একটি ঘরের মাধ্যমে বিছানার মূল্য প্ৰকাশ করায়। অ্যারিস্ততল বলছেন যে, সত্য সত্যই এরকম জিনিস থাকতে পারে না। এবং কেন পারে না? বিছানা এবং ঘর এই উভয়ের মধ্যে যা সত্য সত্যই সমান তারই পরিচায়ক হিসেবে, ঘরের মধ্যে এমন একটা জিনিস তো আছেই। যা বিছানার সঙ্গে তুলনায় সমান — এবং সেই জিনিসটি হচ্ছে মানুষের শ্রম। পণ্যের উপর মূল্য আন্দ্রেপ করা মানেই যে সর্বপ্ৰকল্প, শ্রমকেই সমান মনুষ্য শ্রমরূপে প্ৰকাশ করা এবং তার মানে দাঁড়ায় শ্রমকে ‘গুণগতভাবে সমান বলে গণ্য করা, সেকথা বুঝবার পথে অ্যারিস্ততাল-এর পক্ষে বাধা স্বরূপ ছিল একটি জরুরী তথ্য। গ্রীক সমাজের ভিত্তি ছিল গোলামি এবং সেইজন্যই মানুষের এবং তাদের শ্রম-শক্তির বৈষম্য ছিল তার স্বাভাবিক বনিয়াদ। যেহেতু সমস্ত শ্রমই সাধারণভাবে মনুষ্য শ্ৰম, সেইহেতু এবং সেই হিসেবেই, সর্বপ্রকার শ্রমই সমান এবং পরস্পরের সমার্ঘ্যরূপ, এই হলো মূল্য প্রকাশের গুপ্ত বৃহস্য, কিন্তু মানুষ মানুষের সমান এই ধারণা যতক্ষণ না জনগণের মনে সংস্কােররূপে বদ্ধমূল হয়ে যায় ততক্ষণ সে রহস্যের দ্বার উদঘাটন করা যায় না। এটা অবশ্য শুধু সেই সমাজেই সম্ভব যেখানে শ্ৰমদ্বারা উৎপন্ন রাশি রাশি দ্রব্যসম্ভার পণ্যরূপ ধারণ করে এবং যার ফলে মানুষের সঙ্গে মানুষের মুখ্য সম্পর্ক হয়ে দাঁড়ায় পণ্যের সম্পর্ক। তবু অ্যারিস্ততল এর প্রতিভার প্রোজ্জলতা এই থেকেই বোঝা যায় যে তিনি পণ্যমূল্য প্রকাশের ভিতর সমানতার সম্বন্ধ আবিষ্কার করেছিলেন। কিন্তু অ্যারিস্ততল যে-সমাজে বাস করতেন তার বিশিষ্ট অবস্থাই তার বাধা ছিল এই সমানতার মূলে ‘সত্য সত্যই কি আছে তা আবিষ্কার করুবার পথে।
৪. মূল্যের প্রাথমিক রূপের সামগ্রিক বিচার
কোন পণ্য-মূল্যের প্রাথমিক রূপ এমন একটি সমীকরণের মধ্যে বিধৃত থাকে, যা ভিন্ন ধরনের আরেকটি পণ্যের সঙ্গে তার মূল্য-সম্পর্ক প্রকাশ করে : কিংবা বলা যে কোন পণ্য-মূল্যের প্রাথমিক রূপ বিধুতি থাকে ভিন্ন ধরনের আরেকটি পণ্যের সঙ্গে তার বিনিময়-সম্পর্কের মধ্যে। ‘ক’ পণ্যের মূল্য গুণগতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে এই তথ্য দ্বারা যে ‘খ’ পণ্যের সঙ্গে তা বিনিময়যোগ্য। অর্থাৎ কিনা পণ্যের মূল্য বিনিময় মূল্যের রূপ ধারণ করে স্বতন্ত্র এবং নির্দিষ্ট সত্তায় প্রকাশমান। যখন এই অধ্যায়ের গোড়ার দিকে আমরা মামুলিভাবে বলেছিলাম যে, পণ্য একাধারে ব্যবহার মূল্য ও বিনিময় মূল্য তখন আমরা আসলে ভুল বলেছিলাম। পণ্যের দুই পরিচয়, ব্যবহার মূল্য বা উপযোগের বিষয় এবং মূল্য। পণ্য এই দ্বিবিধরপে তখনি আত্মপ্রকাশ করে, যখন তার মূল্য একটি স্বতন্ত্ররূপ- অৰ্থাৎ বিনিময় মূল্যের রূপ ধারণ করে না। এটা যখন আমাদের জানা থাকে, তখন এ ধরনের প্রকাশ ভঙ্গিতে কোন ক্ষতি হয় না; বরং সংক্ষিপ্তাকারে কথাটা প্রকাশ করার সুবিধা হয়।
আমাদের বিশ্লেষণে দেখানো হয়েছে যে কোন একটি পণ্যের মূল্য কোন রূপে প্রকাশিত হবে, তা নির্ভর করে মূল্যের প্রকৃতির উপর, মূল্য এবং তার আয়তন বিনিময় মূল্যের প্রকাশভঙ্গির উপর নির্ভর করে না। এই ভুলই করেছেন বাণিজ্যবিদরা এবং ফেরিয়ে, গানিলহ(৭) প্রভৃতি তাদের আধুনিক পরিত্রাতারা, আবার ঠিক তাদের বিপরীত, মেরুর বাস্তিয়াতের মতো স্বাধীন বাণিজ্যের আধুনিক ফেরিওয়ালারাও। অর্থাৎ বাণিজ্যবিদরাও বিশেষ জোর দিয়ে থাকেন প্ৰকাশমান মূল্যের গুণগত দিকটার উপর, ফলতঃ পণ্যের সমঅৰ্ঘ রূপের উপর, এই সমঅৰ্থ রূপের পূর্ণ পরিণতি হল আর্থ। অপর দিকে স্বাধীন বাণিজ্যের আধুনিক ফেরিওয়ালারা সবচেযে বেশি জোব দেন আপেক্ষিক মূল্য রূপের গুণগত দিকটার উপর, কারণ যে-কোন দামে জিনিস তাদের ছাড়তেই হবে। তাল ফলে ওদের পক্ষে শুধুমাত্ৰ এক পণ্যের সঙ্গে অপর পণ্যের বিনিময়-ঘটিত সম্পর্ক প্রকাশের মাধ্যমে তথা দৈনিক চলতি দামের তালিকার মাধ্যমে ছাড়া আর কোথাও মূল্যও নেই মূল্যের পরিমাণও নেই। লম্বার্ড স্ত্রীটের ঘোলাটে ধারণাগুলিকে পাণ্ডিত্যেৰু পালিশ দিয়ে চটকদার করে সাজাবার ভার নিয়েছিলেন ম্যাকলিয়ড, তিনি হচ্ছেন সংস্কারাচ্ছন্ন বাণিজ্যবাদী এবং আলোকপ্ৰাপ্ত স্বাধীন বাণিজ্যের ফেরি সন্তান।
‘খ’-এর সঙ্গে ‘ক’-এর মূল্য-সম্পর্ক প্রকাশের সমীকরণের মধ্যে ‘খ’-এর সাহায্যে ‘ক’-এর মূল্য প্ৰকাশ করার ব্যাপারটা তলিয়ে বিচার করলে দেখা যায় যে ঐ সম্পর্কের ভিতর ‘ক’-এর দেহরূপটা কেবলমাত্র ব্যবহার-মূল্য স্বরূপ দেখা দেয়, ‘খ’-এর দেহরূপটা দেখা দেয় কেবলমাত্র মূল্যের রূপ বা আকৃতি হিসেবে। প্রতি পণ্যের মধ্যে ব্যবহার-মূল্য এবং মূল্য এই দুই-এর ভিতর যে আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব বা বৈপরীত্য আছে তা বাহ্যতঃ প্ৰতিভাত হয়, তখন, যখন এই দুটি পণ্য একটি বিশেষ পারস্পরিক সম্পর্কের মধ্যে আসে অর্থাৎ যার মূল্য প্ৰকাশিত হয়েছে সে সরাসরি হাজির হয় কেবলমাত্র ব্যবহার-মূল্য রূপে আর যার সাহায্যে তার মূল্য প্রকাশিত হয়েছে সে সরাসরি হাজির হয় মাত্র বিনিময়-মূল্যরূপে। সুতরাং কোন একটি পণ্যের প্রাথমিক মূল্য-রূপ হচ্ছে সেই রূপ, যে প্ৰাথমিক রূপে পণ্যের ভিতরকার ব্যবহার-মূল্য এবং মূল্য এই দুয়ের বৈপরীত্য আত্ম-প্ৰকাশ করে।
সমাজের প্রত্যেক অবস্থায়ই শ্রমজাত প্রত্যেকটি দ্রব্যই এক একটি ব্যবহার মূল্য , কিন্তু ঐ দ্রব্য পণ্যে পরিণত হয় সমাজ-বিকাশের একটি বিশিষ্ট যুগে অর্থাৎ যে যুগে কোন একটি ব্যবহারযোগা দ্রব্যের উৎপাদনে ব্যয়িত শ্ৰম প্রকাশিত হয়। সেই পণ্যের একটি বাস্তর গুণের আকারে, অর্থাৎ তার মূল্যের আকারে। সুতরাং কথাটা দাঁড়ালো এই যে, প্রাথমিক মূল্য রূপ হচ্ছে সেই আদিম রূপে শ্রমজাত দ্রব্য কালক্রমে পণ্যরূপে আবিস্তৃত হয় এবং ক্রমবিকাশ সূত্রে এই সমস্ত দ্রব্য যে মাত্রায় পরিণত হয়, পণ্যে সেই মাত্রায় বিকশিত হয় মূল্যরূপে।
প্রথম দৃষ্টিতেই মূল্যের প্রাথমিক রূপের যে দুর্বলতা আমরা অনুভব করি, এই প্রাথমিক রূপটি হচ্ছে একটা অংকুর মাত্র, এর অনেক রূপান্তর ঘটবে এবং শেষ পৰ্যন্ত তার পরিণত মূর্তিতে-দাম আকারে আবির্ভূত হবে।
‘খ’ নামক অন্য যে কোন পণ্যের মারফত “ক পণ্যের মূল্য প্রকাশ দ্বারা কেবলমাত্র ‘ক’-এর মূল্যের সঙ্গে তার ব্যবহার-মূল্যের পার্থক্য সুচিত হয়। কাজেই তার ফলে ‘ক’-কে মাত্র অন্য একটি ভিন্ন রকমের পণ্য ‘খ’-এর সঙ্গে বিনিময়-সম্পর্ক দিয়ে মুক্ত করা হয়ে থাকে। কিন্তু তখনো অন্য কোন পণ্যের সঙ্গে ‘ক’-এর গুণগত সমানতা এবং পরিমাণগত অনুপাত প্ৰকাশিত হয় না। পণ্যের আপেক্ষিক এবং প্ৰাথমিক মূল্যরূপের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে সমঅৰ্ঘ্যরূপে বৰ্তমান মাত্র অপর একটি পণ্যে, তথা ছিটের সঙ্গে।
তাহলেও মূল্যের প্রাথমিক রূপ সহজ রূপান্তরের ভিতর দিয়ে তার পূর্ণতর রূপ প্ৰাপ্ত হয়। একথা সত্য যে প্রাথমিক রূপের মাধ্যমে, ‘ক’ পণ্যের মূল্য প্ৰকাশিত হয় অন্য একটিমাত্র পণ্যের সাহায্যে। কিন্তু সেই অপর পণ্যটি কোট, লৌহ, শস্য অথবা যে কোনো অন্য পণ্য হতে পারে। সুতরাং ‘ক’-এর মূল্য ঐ সমস্ত ভিন্ন ভিন্ন পণ্যের মাধ্যমে প্ৰকাশ করলে আমরা একই পণ্যের ভিন্ন ভিন্ন প্রাথমিক মূল্য-রূপ পাই।দ(৮) এরকম প্ৰাথমিক মূল্য-রূপ ততগুলিই হতে পারে, যতগুলি ভিন্ন ভিন্ন পণ্য পাওয়া যায়। কাজেই ‘ক’-এর মূল্যের একটি বিচ্ছিন্ন রূপকে মূল্যের প্রাথমিক রূপের একটি রাশিমালায় পরিণত করা যেতে পারে এবং তাকে যথেচ্ছ দীর্ঘ করা চলে।
খ. মূল্যের সামগ্রিক অথবা সম্প্রসারিত রূপ
উ পণ্য ক=ঊ পণ্য, খ কিংবা=চ পণ্য, ছ কিংবা=জ পণ্য, ঝ কিংবা ও পণ্য, ট কিংবা = ইত্যাদি ইত্যাদি। (২৪ গজ ছিট = ১ কোট অথবা ১০ পাউণ্ড চা, অথবা = ৪০ পাঃ কফি অথবা = ১ কোয়ার্টার, শস্য, অথবা = ২ আউন্স স্বর্ণ অথবা = অর্ধটন লৌহ অথবা = ইত্যাদি।)
১. মূল্যের সম্প্রসারিত আপেক্ষিক রূপ
যে কোন একটিমাত্র পণ্যের মূল্য, যেমন ছিটের মূল্য, এখন পণ্যজগতের অন্যান্য সংখ্য উপাদানের মাধ্যমে প্ৰকাশিত হয়। অন্য প্ৰত্যেকটি পণ্য এখন ছিটের মূল্যের দর্পণ স্বরূপ!(৯) এইভাবেই মূল্য সর্বপ্রথম নিবিশেষিত মনুষ্য-শ্রমের সংহতির আকারে নিজস্ব প্রকৃতরূপে আবির্ভূত হয়। কারণ, যে-শ্রম তাকে সৃষ্টি করল তা এখন আত্মপ্ৰকাশ করল নির্বিশেষ শ্রমের তা সে দরজীর কাজ, হাল চালনা, খনি খনন প্রভৃতি যে কোন ধরনের শ্ৰমই হোক না কেন; আর তার ফলে কোট, শস্য, লৌহ অথবা স্বর্ণ যে কোন দ্রব্যেরই উৎপাদন হয়ে থাক না কেন। ছিট এখন তার নিজস্ব মূল্যের রূপ হিসেবে কেবল একটি মাত্র পণ্যের সঙ্গে নয়, সমগ্র পণ্য জগতের সঙ্গে সামাজিক সম্পর্ক পাতিয়েছে। পণ্য হিসেবে এখন সে সারা দুনিয়ার নাগরিক! সেই সঙ্গে মূল্য সমীকরণের অন্তনিহিত রাশিমালার মধ্যে এই তাৎপৰ্যও নিহিত আছে যে পণ্যের মূল্য যে আকার, যে প্ৰকার, যে বস্তুর মূল্যের মাধ্যমই প্রকাশিত হোক না কেন তাতে তার কোন ইতর বিশেষ ঘটে না।
২০ গজ ছিট = ১ কোটি এই প্রথম রূপের মধ্যে নিদিষ্ট পরিমাণ দুটি বিশেষ দ্রব্যের বিনিময়কে একটা আপতিক ঘটনা বলে মনে করাটা কিছুই বিচিত্র নয়। কিন্তু এই দ্বিতীয় রূপটি দেখেই এই আপতিক বিনিময়ের পটভূমিতে কি আছে এবং যা আছে তা যে বস্তুতঃ ভিন্ন একটি বিষয় তা আমরা তৎক্ষণাৎ ধরে ফেলতে পারি। ছিটের মূল্য কোট, কফি, লৌহ অথবা অন্য যে কোনো পণ্যের মাধ্যমেই প্ৰকাশিত হোক, আর ঐসব পণ্য যে কোনো মালিকেরই সম্পত্তি হোক, তাতে তার পরিমাণের কোন তারতম্য ঘটে না। দুটি বিশেষ বিশেষ পণ্যের ভিতরকার আপতিক সম্পর্ক তখন আর থাকে না! একথা তখন পরিষ্কার হয়ে যায় যে, পণ্যবিনিময় দ্বারা মূল্যের পরিমাণ নিয়ন্ত্রিত হয় না, বরং পণ্য-মূল্যের আয়ুতন দ্বারাই বিনিময় অনুপাত নিয়ন্ত্রিত হয়।
২. বিশেষ সম-অৰ্ঘ রূপ
কোট, চা, শস্য, লৌহ প্রভৃতি প্ৰত্যেকটি পণ্য ছিটের মূল্য-ব্লাশিতে এক একটি সমঅৰ্থরূপ হিসেবে বিদ্যমান, তা এমন একটি জিনিস যাকে বলে মূল্য। এই সমস্ত পণ্যের প্রত্যেকটিই বস্তুর মধ্যে অন্যতম বিশেষ একটি সমঅৰ্থরূপ। সেইরকম, যেসমস্ত বিমূর্ত স্কুল, ব্যবহারযোগ্য শ্রম এইসব পণ্যের মধ্যে বিধৃত হয়ে আছে সে সমস্ত ও একই অভিন্ন মনুষ্য-শ্রমের ভিন্ন ভিন্ন ভাবে বাস্তবায়িত বা অভিব্যক্তি রূপ।
৩. মূল্যের সামগ্রিক তথা সম্প্রসারিত রূপের বিবিধ ত্রুটি
প্রথমতঃ মূল্যের আপেক্ষিক প্রকাশটি অসম্পূর্ণ, কেননা যে রাশিমালায় তার অভিব্যক্তি তার কোন শেষ নেই। মূল্যের প্রত্যেকটি সমীকরণ যে শৃংখলের এক একটি গ্ৰন্থি তার দৈর্ঘ্য নিত্যই বধিত হয় নিত্য নতুন পণ্যের আবির্ভাবের ফলে মূল্য প্রকাশের নিত্য নতুন আধার উদভূত হওয়ায়। দ্বিতীয়তঃ, তা হল মূল্যের ভিন্ন ভিন্ন স্বতন্ত্র অভিব্যক্তির একখানি বহু বৰ্ণ মোজাইক! সৰ্বশেষে, যদি প্ৰত্যেকটি পণ্যের আপেক্ষিক মূল্য পালাক্রমে এই সম্প্রসারিত রূপের মধ্যে প্রকাশিত হয়, যা হতে বাধ্য, তাহলে আমরা তার প্রত্যেকটির জন্য পাচ্ছি এক একটি স্বতন্ত্র আপেক্ষিক মূল্যরূপ এবং এইভাবে তৈরী হচ্ছে মূল্য অভিব্যক্তির এক অনন্ত রাশিমালা। সম্প্রসারিত আপেক্ষিক মূল্যের ত্রুটি সমূহ অনুরূপ সমঅৰ্থমূল্য-রূপের মধ্যে প্রতিফলিত হয়! যেহেতু প্ৰত্যেকটি ভিন্ন ভিন্ন পণ্যের দেহরূপ অন্যান্য অসংখ্য সমঅৰ্ঘ মূল্যরূপের মধ্যে একটি, সেহেতু মোটের উপর আমরা পাচ্ছি মূল্যের শুধুমাত্র কতকগুলি টুকরো টুকরে! সমরূপ, যার প্রত্যেকটি বাকিগুলির ব্যতিরোকী। ঐ একইভাবে প্রত্যেকটি নির্দিষ্ট সমরূপের মধ্যে অঙ্গীভূত হয়ে আছে যে বিশেষ মূর্ত ও ব্যবহার্য শ্রম, তাও উপস্থাপিত হয় একটি বিশেষ ধরনের শ্রম হিসেবেই, নিবিশেষভাবে এই নিবিশেষ শ্রমের যথাযথ প্ৰকাশ ঘটে তার অসংখ্য সবিশেষ মূর্ত রূপের সমগ্ৰতার মধ্যে। কিন্তু, সে ক্ষেত্রে, এক অনন্ত রাশিমালাক্স ভিতর তার অভিব্যক্তি সর্বদাই থাকে অসম্পূর্ণ এবং খণ্ডিত।
সম্প্রসারিত আপেক্ষিক মূল্য রূপ তো আর কিছুই নয়, শুধু প্রথমটির মতো বহু প্ৰাথমিক আপেক্ষিক অভিব্যক্তি বা সমীকরণের সমষ্টি। যথা, ২০ গজ ছিট = ১ কোট, ২০ গজ ছিট = ১০ পাঃ চা, ইত্যাদি।
এর প্রত্যেকটির মধ্যে নিহিত আছে তার অনুরূপ, বিপরীত সমীকরণ,
১ কোট = ২০ গজ ছিট
১০ পাঃ চা=২০ গজ ছিট, ইত্যাদি।
বস্তুতঃ, যখন কোন ব্যক্তি তার ছিটের বিনিময়ে অন্যান্য অনেক জিনিস গ্রহণ করে এবং এইভাবে তার মূল্য প্রকাশ করে অন্যান্য অনেক পণ্যের মাধ্যমে, তখন স্বভাবতই দাঁড়ায় এই যে, শেষোক্ত পণ্যসমূহের বিভিন্ন মালিক তাদের নিজ নিজ পণ্যের বিনিময়ে ছিট গ্রহণ করেছে এবং ফলত, তাদের বিভিন্ন পণ্যের মূল্য প্রকাশ করছে ছিট নামে পরিচিত একটি তৃতীয় পণ্যের মাধ্যমে। সুতরাং, আমরা যদি এখন ২০ গজ ছিট= ১ কোট অথবা = ১০ পাঃ চা ইত্যাদি এই রাশিমালাটিকে উন্টে দিই, অর্থাৎ কিনা। এই রাশিমালার মধ্যে যে বিপরীত রাশিমালা আছে তা প্ৰকাশ্যভাবে উপস্থিত করি, তাহলে আমরা পাই :-
গ. মূল্যের সাধারণ রূপ
১ কোট=২০ গজ ছিট
৪ ও পাম কফি=২০ গজ ছিট
১ কোয়াটার শস্য=২০ গজ ছিট
২ আঃ স্বর্ণ=২০ গজ ছিট
১/২টন লৌহ =২০ গজ ছিট
ও পরিমাণ ক পণ্য ইত্যাদি=২০ গজ ছিট
১. মূল্যরূপের পরিবর্তিত চরিত্র
এখন সমস্ত পণ্যেই তাদের মূল্য প্ৰকাশ করেছে (১) প্ৰাথমিক রূপে, কারণ একটিমাত্র পণ্যের মাধ্যমে; (২) একত্ব সহকারে, কাৰ্বণ অবিকল একই পণ্যের মাধ্যমে। মূল্যের এই রূপটি প্রাথমিক এবং সর্বক্ষেত্রেই একরকম, সুতরাং তা
ক এবং খ এই ছকে মূল্যকে দেখানো যায় কেবল পণ্যের ব্যবহারমূল্য হিসাবে বা বহু রূপ থেকে স্বতন্ত্র একটি সত্তা হিসেবে।
প্ৰথম ছক “ক” এ আছে নিম্নলিখিত সমীকরণটি–১ কোট = ২০ গজ ছিট, ১০ পাঃ চা=১/২ টন লৌহ। কোটের মূল্য সমীকৃত হচ্ছে ছিটের সঙ্গে, চা-এর মূল্য লৌহের সঙ্গে। কিন্তু প্ৰথমে ছিট এবং পরে লৌহের সঙ্গে সমীকরণে দাঁড়াচ্ছে যেয়ে পণ্য তাদেরকে ছিট এবং লৌহের মতোই ভিন্ন ভিন্ন হতে হয়েছে। সুতরাং একথা পরিষ্কার যে, এ হচ্ছে প্ৰথম আরম্ভের সময়কার বিনিময় সম্পর্ক, যখন শ্ৰমজাত দ্রব্য বিনিময় দ্বারা পণ্যে পরিণত হতো মাঝে মাঝে, হঠাৎ হঠাৎ।
দ্বিতীয় ছকে, ‘খ’ এ, প্ৰথমে ছকের চেয়ে আরো যথাযথভাবে পণ্যের মূল্যের সঙ্গে তার ব্যবহার-মূল্যের পার্থক্য দেখানো হয়েছে সর্বপ্ৰকার সম্ভাব্য আকারে, তার সমীকরণ হয়েছে ছিটের সঙ্গে, লৌহের সঙ্গে, চা-এর সঙ্গে, সংক্ষেপে, একমাত্র কোটের নিজের সঙ্গে ছাড়া বাকি সব কিছুর সঙ্গে। অথচ, ঐ সমস্ত পণ্যের মধ্যে সমভাবে বর্তমান মূল্যের সাধারণ প্ৰকাশ সরাসরি বর্জন করা হয়েছে; কারণ প্রত্যেকটি পণ্যের মূল্য-সমীকরণে অন্যান্য সমস্ত পণ্যই হাজির হচ্ছে কেবলমাত্র সমঅৰ্ঘ রূপে। গবাদি পশুর মত বিশেষ কোন শ্রমজাত দ্রব্যের সঙ্গে অন্যান্য পণ্যের বিনিময় যখন আর ব্যতিক্রম হিসেবে নয়, নিয়ম হিসেবে ঘটতে থাকে, তখনি শুধু সর্বপ্রথম মূল্যের সম্প্রসারিত রূপ দেখা দেয়।
তৃতীয় এবং সর্বশেষ ছকে সমগ্র পণ্য জগতের মূল্য প্ৰকাশিত হয়েছে একটিমাত্র পণ্যের মাধ্যমে এবং শুধু এইকারণে ঐ পণ্যটিকে পৃথক করে রাখা হয়েছে; ছিট হল সেই পণ্য। ঐ সময় পণ্যের প্রত্যেকটির মূল্য ছিটের মূল্যের সমান বলে ছিট দিয়ে ঐ সমস্ত পণ্য-মূল্যের প্রতিনিধিত্ব করা হয়েছে। ছিটের মূল্যের সমান হওয়ায়, প্ৰত্যেকটির পণ্যের মূল্যই এখন কেবলমাত্র সেই সেই বিশিষ্ট পণ্যের ব্যবহার-মূল্যের সঙ্গে নিজের পার্থক্য টানেনি, পার্থক্য টেনেছে সাধারণভাবে অন্য সমস্ত ব্যবহারমূল্যের সঙ্গেও এবং শুধু সেই কারণেই তা সমস্ত পণ্যের ভিতরকার সাধারণ সত্তা রূপে আত্মপ্রকাশ করছে। এই ছকের মধ্যে পণ্যসমূহ সর্বপ্রথম যথোচিতভাবে মূল্যরূপে পারস্পরিক সম্পর্কে স্থাপিত অথবা বিনিময় মূল্যের সাজে তাদের সজ্জিত করা হয়েছে।
আগেকার দুটো ছকে প্রত্যেকটি পণ্যের মূল্য একটিমাত্র পণ্যের অথবা বহু পণ্যের একটি রাশির মাধ্যমে প্ৰকাশ করা হয়েছে। উভয় ক্ষেত্রেই প্ৰত্যেকটি পণ্যেরই যেন বিশেষ বিশেষ কাজ হল নিজ নিজ মূল্যের এক একটি সমার্ঘরূপ খুজে বের করা, এবং একাজ সে সম্পন্ন করছে অন্য কোন পণ্যের সাহায্য ব্যতিরেকে। অন্য পণ্যগুলির ভূমিকা হল নিস্ক্রিয়ভাবে তার মূল্যের সমার্ঘরূপ হিসেবে হাজির থাকা। ‘গ’ ছকে মূল্যের সাধারণ রূপটি আবির্ভূত হচ্ছে শুধুমাত্র সমগ্র পণ্য জগতের সমবেত ক্রিয়ার ফলে। কোন একটি পণ্য সাধারণভাবে সমস্ত পণ্যের মূল্য প্রকাশের কাজ করতে পারে শুধুমাত্র তখনি যখন অন্য সমস্ত পণ্য একযোগে তাদের নিজ নিজ মূল্য ঐ একই পণ্যের মাধ্যমে প্ৰকাশ করে, যে-কোন নতুন আর একটি পণ্যকেও ঐ একই পথ * অনুসরণ করতে হবে। সুতরাং একথা পরিষ্কার যে, যেহেতু পণ্য মূল্যের অস্তিত্বটাই হলো সামাজিক সত্তা, সেহেতু তা প্ৰকাশ করা যেতে পারে কেবলমাত্র তাদের সামগ্রিক সামাজিক সম্পর্কের সাহায্যেই। সুতরাং একথু ও সহজ্জসিদ্ধ যে তাদের মূল্যের। রূপটিকে অবশ্যই হতে হবে সামাজিকভাবে স্বীকৃত রূপ।।
সমস্ত পণ্য ছিটের সঙ্গে সমান করে দেখানোর ফলে এখন তারা কেবলমাত্র মূল্য হিসেবে সাধারণভাবে গুণগত সামাই প্ৰতিষ্ঠা করেনি, পরিমাণগতভাবে তারা এখন তুলনীয়। যেহেতু তাদের মূল্যের পরিমাণ ছিট নামক একটিমাত্র পণ্যের মাধ্যমে প্ৰকাশিত হচ্ছে, সেহেতু তার ফলে সমস্ত পণ্যেরই মূল্যের পরিমাণ পরস্পরের সমান হয়ে দাড়াচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ, ১০ পঃ চা = ২০ গজ ছিট এবং ৪০ পা: কফি = ২০ গজ ছিট; সুতরাং ১ ও পা: চা = ৪০ পা: কফি। ভাষান্তরে বলতে গেলে বলতে হয়, এক পা: কফির মধ্যে যত মূল্যের মর্মবস্তুর তথা শ্ৰম আছে, তার এক চতুর্থাংশ আছে ১পাঃ চা-এর ভিতর।
আপেক্ষিক মূল্য প্রকাশের সাধারণ ছকে সমগ্র পণ্য জগতেরই আপেক্ষিক মূল্য প্ৰকাশিত হচ্ছে একটিমাত্র পণ্যের মাধ্যমে এবং তার ফলে সেই একটি পণ্য, অন্য সমস্ত পণ্য থেকে স্বতন্ত্রভাবে তাদের পণ্যমূল্যের পরিচয় বহন করে সর্বজনীন সমার্ঘরূপে পরিণত হচ্ছে। ছিটের দেহরূপটি এখন অন্যান্য সমস্ত পণ্যের মূল্যের সাধারণ রূপ; কাজেই তার সঙ্গে এখন প্ৰত্যেক পণ্যের সরাসরি বিনিময় হতে পারে। ছিট নামক বস্তুটি এখন সর্বপ্রকার মনুষ্য-শ্রমের সাক্ষাৎ বিগ্রহ, গুটিপোকার মত শুয়ো থেকে প্ৰজাপতির স্তরে পরিণত। বস্ত্ৰ বয়ন একটি বিশেষ লোকের বিশেষ শ্ৰম, তার ফলে উৎপন্ন হচ্ছে একটি বিশেষ দ্রব্য, ছিটা। সেই বস্ত্ৰ বয়নের শ্রম এখন অন্যান্য সর্বপ্রকার শ্রমের সমার্ঘ বলে গণ্য হচ্ছে। মূল্যের সাধারণ রূপটি যে সমস্ত অসংখ্য সমীকরণের ভেতর দিয়ে বেরিয়ে আসবে, সেই সব সমীকরণেই ছিটের মধ্যে অঙ্গীভূত শ্ৰম অন্যান্য সমস্ত পণ্যের ভিতরকার শ্রমের সমার্ঘ হয়ে দাড়াচ্ছে, তার ফলে বয়ন কার্যটি পরিণত হয়েছে নির্বিশেষ মনুষ্য শ্রমের সাধারণ বিগ্ৰহে। এইভাবে যে শ্রম দিয়ে পণ্যের মূল্য গঠিত হয় তার প্রত্যক্ষ প্রকৃতিটি এখন দৃশ্যমান হল, এখন তার পরিচয় কেবল নেতিবাচক রইল না, অর্থাৎ তা যে বিশেষ কোন এক প্রকারের শ্রম নয়, শুধু সেইটুকু জানার বদলে এখন জানা গেলো যে তা নির্বিশেষে শ্ৰম নামক একটি বস্তু।
সর্বপ্রকার শ্রমের যা নির্বিশেষে চরিত্র, অর্থাৎ যাকে বলে মানুষের শ্রমশক্তির ব্যয় শুধু তাই উঠল মূল্যের সাধারণ রূপদানের ভেতর দিয়ে। শ্রমের প্রকারভেদ গেল উঠে।
শ্রমোৎপন্ন সমস্ত দ্রব্যেই সাধারণ মূল্য-রূপের মাধ্যমে অভিব্যক্তি হয় নির্বিশেষ মনুষ্য-শ্রমের ঘনীভূত রূপ হিসেবে; সাধারণ মূল্যস্বরূপের গঠন থেকেই এটা স্পষ্ট প্রতিভাত হয় যে, সাধারণ মূল্য রূপ-সমগ্র পণ্য-জগতের সামাজিক চুম্বকরূপ। সুতরাং এই সাধারণ মূল্যস্নপ থেকে একথা তর্কান্তিতভাবে প্রমাণ হয়ে যায় যে পণ্যজগতে সমস্ত শ্রমের চরিত্রই এই যে তা মনুষ্যশ্রম, আর এটাই হচ্ছে তার সুনির্দিষ্ট সামাজিক চরিত্র।
২। মূল্যের আপেক্ষিক রূপ এবং সমঅৰ্থ রূপে পরস্পরসাপেক্ষ ক্রমবিকাশ
যে মাত্রায় মূল্যের আপেক্ষিক রূপ বিকশিত হয়, সমঅৰ্ঘ রূপও বিকশিত হয় ঠিক সেই মাত্রায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সমঅৰ্ঘ রূপের বিকাশ মূল্যেরই অভিব্যক্তি মাত্র, তারই বিকাশের ফলশ্রুতি মাত্ৰ।
কোন একটি পণ্যের প্রাথমিক আপেক্ষিক মূল্য-রূপ। যখন বিচ্ছিন্নভাবে দেখানো হয়, তখন আর একটি পণ্য বিচ্ছিন্নভাবে তার সমার্ঘরূপে পরিণত হয়। কোন একটি পণ্যের মূল্য যখন অন্য সমস্ত পণ্যের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয় তখন আমরা পাই আপেক্ষিক মূল্যের সম্প্রসারিত রূপ, তার ফলে ঐ সমস্ত পণ্যই ভিন্ন ভিন্ন প্রকারের সমাৰ্থ জ্ঞাপক জিনিসের আকার ধারণ করে। সর্বশেষে, একটি বিশেষ প্ৰকার পণ্যের মাধ্যমে যখন অন্য সমস্ত পণ্যের মূল্য প্ৰকাশিত হয়, তখন ঐ পণ্যটি সর্বজনীন সমর্ঘরাপের চরিত্র লাভ করে।
আপেক্ষিক মূল্য এবং সমার্ঘ মূল্য-মূল্যের এই দুই বিপরীত রূপের মধ্যে যে বিরোধ আছে তা বিকশিত হয় ঐ রূপের ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে।
২০ গজ ছিট = ১ কোট–এই প্ৰথম সমীকরণের মধ্যেই বিরোধ রয়েছে, যদিও তা নির্দিষ্ট করে ধরা যায় না। সমীকরণটিকে উল্টে-পাণ্টে নিলে ছিট এবং কোটের ভূমিকা উল্টে-পাণ্টে যায়। এক ভাবে ধরলে ছিটের আপেক্ষিক মূল্য প্ৰকাশিত হয় কোটের মাধ্যমে, আর এক ভাবে ধরলে কোটের আপেক্ষিক মূল্য প্ৰকাশিত হয় ছিটের মাধ্যমে। কাজেই মূল্য প্রকাশের এই প্ৰথম পর্যায়ে দুই বিপরীত মেরুত্ব বৈপরীত্য অনুধাবন করা কঠিন।
‘খ’ সমীকরণ অনুসারে একই সময়ে একটি মাত্র পণ্য তার আপেক্ষিক মূল্য সম্পূর্ণভাবে সম্প্রসারিত করতে পারে। তার সঙ্গে তুলনায় অন্য সমস্ত পণ্যই তার সমঅৰ্থ মূল্য বলেই ঐ পণ্যটি এই রূপ ধারণ করতে সক্ষম হয়েছে। ২০ গজ ছিট= ১ কোট-এই সমীকরণটিকে আমরা উল্টো করেও ধরতে পারি, কিন্তু তা করলে তার সাধারণ চরিত্রই বদলে যাবে, সম্প্রসারিত মূল্যরূপ মূল্যের সাধারণ রূপে। পরিণত হবে।
সর্বশেষে, ‘গ’ সমীকরণে পণ্যজগতে মূল্যের সাধারণ আপেক্ষিক রূপটি দেখা দিয়েছে, কারণ এখানে একটি পণ্য ছাড়া আর কোন পণ্যই সমঅৰ্থ রূপ ধারণ করতে পারে না। সুতরাং একটি একক পণ্য, যেমন ছিট কাপড় অন্য প্ৰত্যেক রকম পণ্যের সঙ্গে প্ৰত্যক্ষভাবে বিনিময়যোগ্য হবার চরিত্র অর্জন করে; এবং এই চরিত্র অন্য প্রত্যেকটি পণ্যের ক্ষেত্রে অস্বীকৃত হয়।(১০)
উপরন্তু যে পণ্যটি সর্বজনীন সমঅৰ্থ রূপের কাজ করে সে পণ্যটি আর আপেক্ষিক মূল্য রূপ ধারণ করতে পারে না। ছিট অথবা অন্য কোন পণ্য যদি একই সঙ্গে সমঅৰ্ঘ রূপ এবং মূল্যের আপেক্ষিক রূপ-এই দুই রূপই ধারণ করতে পারতো, তাহলে ওই পণ্যটি নিজের সমঅৰ্থ বলে গণ্য হতো , তার মানে দাডাতে ২০ গজ ছিট = ২০ গজ ছিট। এইরকম একই কথার পুনরুক্তি দ্বারা মূল্যও প্রকাশিত হয় না, মূল্যের আয়তনত প্রকাশিত হয় না। সর্বজনীন সমঅৰ্থ রূপের আপেক্ষিক মূল্য প্রকাশ করতে হলে বরং ‘গ’ রূপটিকে উলটে দেওয়া যেতে পারে। অন্যান্য পণ্যের মতো সমঅৰ্ঘ রূপটির নিজস্ব কোন আপেক্ষিক মূল্যরূপ নেই, কিন্তু তার মূল্য অপেক্ষিক ভাবে প্রকাশিত হয় পণ্যের এক সীমাহীন রাশিমালার দ্বারা। এইভাবে খ অর্থাৎ আপেক্ষিক মূল্যরূপের সম্প্রসারিত ছকটি এখানে দেখা দিল সমঅৰ্থ পণ্যটির আপেক্ষিক মূল্যরূপের একটি বিশিষ্ট অভিব্যক্তি হিসেবে।
৩। মূল্যের সাধারণ রূপ থেকে অৰ্থরূপে অতিক্রান্ত
সর্বজনীন সমঅৰ্ঘ রূপটি সাধারণভাবে মূল্যেরই একটি রূপ। কাজেই যে-কোন পণ্য এই রূপ ধারণ করতে পারে। অথচ, কোন একটি পণ্য একবার মন্দি সর্বজনীন সমঅৰ্ঘ্যরূপে গ সমীকরণ ধারণ কৰে, তাহলে বুঝতে হবে যে অন্য কোন পণ্য আর এইরূপে গণ্য হতে পারবে না এবং তার কারণ ঐ সমস্ত পণ্যেরই ক্রিয়া! যে মুহূর্তে একটি মাত্র পণ্য আলাদাভাবে এইরকম শুধুমাত্র সমঅৰ্ঘ রূপে বাছাই হয়ে গেল, কেবল তখন থেকেই পণ্য জগতের সাধারণ আপেক্ষিক রূপ সু-সংগীতু হয়ে দাড়ালো এবং লাভ করলে সামাজিক স্বীকৃতি।
এখন, যে পণ্যটির অবয়ব দিয়ে সমাজে সমঅৰ্ঘ্যরূপ কাজ করার রেওয়াজ দেখা দিল, তাকেই বলা হয় অর্থ নামক পণ্য বা অর্থ। পণ্য জগতে সৰ্বজনীন সমঅৰ্ঘ রূপের পালন করা এখন ঐ পণ্যটির বিশ্লিষ্ট সামাজিক কর্তব্য হয়ে দাড়ালো। যে সমস্ত পণ্য খ সমীকরণের ছিটের সমঅৰ্ঘ রূপ ধারণ করতে পারে এবং গ সমীকরণে ছিটের মাধ্যমে অন্য সমস্ত পণ্যের প্রকাশ করে তাদের মধ্যে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করছে একটি পণ্য-স্বর্ণ। সুতরাং গ সমীকরণে ছিটের বদলে স্বর্ণ বসিয়ে নিলে পাওয়া যায়,-
ঘ] অর্থরূপ
২০ গজ ছিট= ২ আউন্স স্বর্ণ
১ কোট = ২ আউন্স স্বর্ণ
১০ পাঃ চা= ২ আউন্স স্বর্ণ
৪০ পাঃ কফি= ২ আউন্স স্বর্ণ
১ কোয়ার্টার শস্য= ২ আউন্স স্বর্ণ
১/২ টন লৌহ= ২ আউন্স স্বর্ণ
ও পণ্য ক= ২ আউন্স স্বর্ণ
ক থেকে খ-এ এবং খ থেকে গ-এ পরিবর্তনটি হলো মৌলিক। কিন্তু গ-এর সঙ্গে খ-এর একমাত্র পার্থক্য এই যে সমঅৰ্থ রূপের স্থানে ছিটের বদলে স্বর্ণ বসানো হয়েছে তা ছাড়া আর কোন পার্থক্য নেই। সমীকরণে যেমন ছিল ছিট, সেই রকম ঘ সমীকরণে স্বর্ণ ধারণ করেছে সর্বজনীন সমঅৰ্থ রূপ। এ ক্ষেত্রে অগ্ৰগতি হলো এইটুকু যে সামাজিক প্রথা অনুসারে চূড়ান্তভাবে একটি পদার্থ, অর্থাৎ স্বর্ণ, এখন সর্বত্র সরাসরি বিনিময়যোগ্য অর্থাৎ সর্বজনীন সমআর্ঘ রূপের স্থান প্রতিষ্ঠিত।
অন্যান্য পণ্যের সম্পর্কে স্বর্ণ এখন অর্থ কারণ স্বৰ্ণও আগে ছিল অন্যান্য পণ্যের মতোই সাধারণ একটি পণ্য। অন্যান্য পণ্যের মতোই এই পণ্যটিও খণ্ড খণ্ড বিচ্ছিন্ন বিনিময়ে একটি পণ্যের অথবা সাধারণ ভাবে সমস্ত পণ্যের সমঅৰ্থ রূপ ধারণে সক্ষম। ছিল। ক্রমশঃ বিবিধ সীমাবদ্ধতার মধ্যে এই পণ্যটি সর্বজনীন সমঅর্থের রূপ গ্ৰহণ করেছে। যখনি এই পণ্যটি অন্যান্য সমস্ত পণ্যের সাধারণ মূল্যরূপ ধারণ করলো, তখনি তা হয়ে দাঁড়ালো অর্থ পণ্য আর শুধু তখনি দেখা দিল গ-এর সঙ্গে খ-এর সুস্পষ্ট পার্থক্য এবং মূল্যের সাধারণ রূপটি পরিবর্তিত হয়ে অর্থক্লপে আবির্ভূত হলো।
স্বর্ণ অর্থে পরিণত হবার পর ছিটের মতো কোন একটি পণ্যের আপেক্ষিক মূল্য যদি প্রাথমিক রূপে স্বর্ণের মাধ্যমে প্ৰকাশ করা হয়, তাহলে সেটি হল উক্ত পণ্যের দাম। সুতরাং ছিটের দাম হলো–
২০ গজ ছিট = ২ আউন্স স্বর্ণ অথবা ঐ দুই আউন্স সোনা দিয়ে যদি দুটি মোহর তৈরী করা হয়, তা হলে
২০ গজ ছিট = ২ মোহর
অৰ্থরূপ সম্বন্ধে কোন স্পষ্ট ধারণা করতে হলে সর্বজনীন সমঅৰ্ঘ রূপটি অর্থাৎ মূল্যের সাধারণ রূপম্বরূপ গ সমীকরণটি ভালো করে বুঝতে হবে। মূল্যের সম্প্রসারিত রূপ, তথা খ সমীকরণ থেকে কষে এটাকে বের করা হয়েছে; তার আবার মূল উপাদান হচ্ছে কি সমীকরণটি ২০ গজ ছিট = ১ কোট অথবা ও পরিমাণ ক পণ্য ঔ পরিমাণ খ পণ্য রূপই হচ্ছে অর্থ-রূপের বীজ।
১.৪ পণ্যপৌত্তলিকতা এবং তার রহস্য
প্রথম অধ্যায়। চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
প্রথম দৃষ্টিতে পণ্যকে মনে হয় যেন একটি তুচ্ছ বস্তু এবং সহজেই বোধগম্য। কিন্তু বিশ্লেষণের ফলে দেখা গেলো যে তা বহু আধ্যাত্মিক ও আধিবিদ্যাক সুক্ষ্ম তত্ত্বে পরিবৃত একটি অদ্ভুত ব্যাপার। ব্যবহার-মূল্য হিসেবে তার ভিতর রহস্যময় কিছুই নেই, সেই ব্যবহার-মূল্য অভাব পূরণের ক্ষমতা স্বরূপই বিবেচিত হোক অথবা তা মনুষ্যশ্রম থেকে উৎপন্ন বস্তু স্বরূপই বিবেচিত হোক। একথা দিনের আলোর মতই পরিষ্কার যে মানুষ তার শ্ৰীমদ্বারা প্ৰকৃতিদত্ত সামগ্ৰীকে পরিবতিত করে তাকে মানুষের পক্ষে ব্যবহারযোগ্য করে তোলে। উদাহরণ স্বরূপ, কাঠের রূপ, কাঠের রূপ বদলে টেবিল তৈরী হয়। তথাপি ঐ পরিবর্তন সত্ত্বেও টেবিল আটপৌরে কাঠই থেকে যায়। কিন্তু যে মুহুর্তে তা পণ্যরূপে এক পা এগোয়, অমনি তা পরিণত হয় একটি তুরীয় ব্যাপারে। তখন তা কেবল জমির ওপর পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়ায় না, অন্যান্য পণ্যের সম্পর্কে তা মাথায় ভর দিয়ে দাঁড়ায়। তখন তার নিজের কাষ্ঠ মস্তিষ্ক থেকে নির্গত হয় এমন সমস্ত কিস্তৃত ধারণা যা ‘টেবিল ওলটানো’র চেয়েও অনেক বেশি অদ্ভুত।
সুতরাং পণ্যের রহস্যময় চরিত্রের সূত্র তার ব্যবহার-মূল্য নয়। মূল্য যে সব উপাদান দিয়ে নির্ধারিত হয়, তাদের প্রকৃতি থেকেও এই রহস্যের উদ্ভব নয়। কারণ প্রথমতঃ, ব্যবহারযোগ্য শ্ৰম তথা উৎপাদনক্ষম কর্ম যতই বিবিধ রকমের হোক না কেন, শারীরবৃত্তের ঘটনা এই যে শ্রম হচ্ছে মানুষের জৈবদেহের-মস্তিক, স্নায়ু, পেশী-প্ৰভৃতির কার্যকলাপ। দ্বিতীয়তঃ, শ্রমের পরিমাণগত নির্ধারণ যার ওপর নির্ভর করে হয়। অর্থাৎ যতক্ষণ ধরে শ্রম ব্যয় করা হয়েছে সেই পরিমাণ সময় তথা শ্রমের পরিমাণ, তা হিসেব করতে গেলে দেখা যাবে যে তার গুণমান এবং পরিমাণের মধ্যে স্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। সমাজের সমস্ত অবস্থাতেই মানুষ এ বিষয়ে আগ্রহশীল যে জীবনধারণের সামগ্ৰী উৎপন্ন করতে কতটা শ্ৰম-সময় লাগলো, যদিও সমস্ত যুগে এ আগ্রহ সমান নয়।(১) সর্বশেষে, মানুষ যখন থেকে কোন-না-কোন প্রকারে পারস্পরিক সহযোগিতায় কাজ করা শুরু করেছে, তখন থেকেই তাদের শ্ৰম ধারণ করেছে একটি সামাজিক চরিত্র।
তা হলে, শ্ৰমজাত সামগ্ৰী পণ্যে পরিণত হবার সঙ্গে সঙ্গে তার রহস্যময় চরিত্রটি কোখেকে আবির্ভূত হয়? স্পষ্টতঃই, এই রূপ থেকেই তার আবির্ভাব। শ্রমদ্বারা উৎপন্ন নানারকম জিনিস সমমূল্যরূপ ধরে বলেই বিভিন্ন প্ৰকার শ্রমেরও পরিমাণ সমান হতে পারে; শ্ৰম-সময় দ্বারা শ্রমশক্তি ব্যয়ের যে পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়, তা হয়ে দাঁড়ায় শ্রমোৎপন্ন সামগ্ৰীর মূল্যের পরিমাণ; এবং শেষ পর্যন্ত, শ্রমিকদের পারস্পরিক যে সম্পৰ্কসমূহ থেকে শ্রম সামাজিক চরিত্র লাভ করে, তাকে শ্রমোৎপন্ন বিভিন্ন দ্রব্য-সামগ্ৰীীর পারস্পরিক সম্পর্ক বলে মনে হয়।
সুতরাং, পণ্য একটি রহস্যময় বস্তু, শুধু এই কারণেই যে তার মধ্যে মানুষের শ্রমের সামাজিক চরিত্রটি তাদের কাছেই দেখা দেয় তাদের শ্রমোৎপন্ন জিনিসটির উপরে মুদ্রিত একটি বিষয়গত চরিত্র হিসেবে, উৎপাদনকারীদের নিজেদেরই শ্রমোৎপন্ন সর্বমোট ফল তাদেরই কাছে উপস্থাপিত হয় একটি সামাজিক সম্পর্ক হিসেবে-যেন তা তাদের নিজেদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক নয়, বরং তাদের শ্রমোৎপন্ন দ্রব্যাদির মধ্যকারী পারস্পরিক সম্পর্ক। এই জন্যই শ্রমোৎপন্ন সামগ্ৰী হয়ে দাঁড়ায় পণ্য, অর্থাৎ এমন একটি জিনিস, যার গুণগুলি একই সঙ্গে ইন্দ্ৰিয়গ্ৰাহও বটে। এই রকমভাবেই যখন কোন বস্তু থেকে আলো এসে আমাদের চোখের উপর পড়ে, তখন তাকে আমরা আমাদের নিজ নিজ চোখের ভিতরকার স্বায়ুর কম্পন ব’লে অনুভব করি না, তখন তাকে দেখি চোখের বাইৱেকার একটা বস্তুর আকারে। কিন্তু আমরা কোন কিছু দেখি তখনি, যখন প্ৰকৃতপক্ষে আলোর যাত্রা ঘটে এক বস্তু থেকে অপর বস্তুতে, বাহ বস্তু থেকে চক্ষুতে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন পদার্থের মধ্যে পদার্থগত সম্বন্ধই দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু পণ্যের বেলায় দেখছি অন্যরকম ব্যাপার। এক্ষেত্রে, যাকে বলে মূল্য-সম্পর্ক অর্থাৎ নানাপ্রকার পণ্যের ভিতর যে সম্পর্ক স্থাপিত হয় এবং যে সম্পর্কের ভিতর বিবিধ শ্রমলব্ধ দ্রব্য পণ্যের চরিত্র লাভ করে সে সম্পর্কের সঙ্গে ঐ সমস্ত জিনিসের পদার্থগত গুণাবলীর এবং তজনিত বস্তুগত সম্পর্কের কোন যোগ নাই। ওখানে যে সম্পর্কটা স্পষ্টতই মানুষের সঙ্গে মানুষের সামাজিক সম্পর্ক সেটাকে তারা ভুল চোখে দেখে এক বস্তুর সঙ্গে অপর বস্তুর সম্পর্ক হিসেবে। কাজেই উপমার জন্য বাধ্য হয়ে কুহেলিকাময় ধর্ষজগতের শরণাপন্ন হচ্ছি। সে জগতে মানুষের মগজ থেকে গজানো ভাব সতন্ত্র জীবন্ত সত্তার মূর্তি ধারণ করে এবং মনে হয় যেন সেই মূর্তিগুলিই পরস্পরের মধ্যেও মনুষ্যজাতির সঙ্গে একটা সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। এই রকমটিই ঘটে পণ্য জগতে মানুষের হাতে গড় জিনিসের বেলায়। আমি একেই বলি পণ্য-পৌত্তলিকতা, মানুষের শ্ৰমদ্বারা উৎপন্ন দ্রব্য যখনই পণ্যে পরিণত হয়েছে, তখনই তা এই রহস্যদ্বারা আবৃত হয়েছে, কাজেই এ রহস্য পণ্যোৎপাদনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।
পূর্ববর্তী বিশ্লেষণ থেকেই বোঝা গেছে যে এই পণ্য-পৌত্তলিকতা উদ্ভূত হয়েছে পণ্যোৎপাদক শ্রমের বিশিষ্ট সামাজিক চরিত্র থেকে।
সাধারণতঃ, ব্যবহারযোগ্য দ্রব্য পণ্যত্ব প্রাপ্ত হয় শুধু এই জন্য যে, সে দ্রব্য উৎপন্ন করতে যে শ্ৰম লেগেছে তা বিভিন্ন ব্যক্তির অথবা বিভিন্ন ব্যক্তিগোষ্ঠীর শ্রম; এবং তারা এজন্য কাজ করেছে স্বতন্ত্রভাবে। এইসমস্ত ব্যক্তিগত শ্ৰমের যোগফল হলো সমাজের সমগ্ৰ শ্ৰম। যেহেতু উৎপাদনকারীরা পরস্পরের সঙ্গে ততক্ষণ কোন সামাজিক যোগাযোগ স্থাপন করে না, যতক্ষণ না তাদের উৎপন্ন দ্রব্যের মধ্যে বিনিময় ঘটে, সেহেতু প্ৰত্যেকটি উৎপাদনকারীর নিজস্ব যে সামাজিক চরিত্র আছে, তারও অভিব্যক্তি বিনিময়ের মধ্যে ছাড়া হয় না। অন্যভাবে বললে বিনিময়ের ভেতর দিয়ে প্ৰত্যক্ষভাবে নানা দ্রব্যের এবং পরোক্ষভাবে বিভিন্ন উৎপাদনকারীর মধ্যে যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে সেই সম্পর্ক থেকেই একজনের শ্ৰম সমাজের সমগ্ৰ শ্ৰমের একাংশ হ’য়ে দাঁড়ায়। কাজেই উৎপাদকের নিকট একজনের শ্রমের সঙ্গে অপর সকলের শ্রম কর্মরত শ্রমিকদের ভিতরকার প্রত্যক্ষ সামাজিক সম্পর্ক বলে গণ্য হয় না, গণ্য হয় বস্তুতঃ তারা যা ঠিক তা-ই বলে, অর্থাৎ বিভিন্ন ব্যক্তিত্ব বস্তুগত সম্পর্ক এবং বিভিন্ন বস্তুর সামাজিক সম্পর্ক বলে। ব্যবহারযোগ্য দ্রব্য হিসেবে শ্রমজাত পদার্থ ভিন্ন এবং বহুবিধ, কিন্তু শুধুমাত্র বিনিময়ের ভেতর দিয়েই তা একেবারে অন্যরকম হয়ে যায়, অর্থাৎ মূল্যরূপে সমগুণসম্পন্ন সামাজিক সত্তা লাভ করে। ব্যবহারযোগ্য দ্রব্য এবং মূল্য-এই দুইভাগে শ্ৰমজাত পদার্থের এই যে বিভাগ, এর গুরুত্ব কার্যতঃ ধরা পড়ে তখনি, যখন বিনিময়প্ৰথা এতদূর প্রসারিত হয়েছে যে ব্যবহারযোগ্য। দ্রব্য উৎপন্ন করা হয় বিনিময়ের জন্য, সুতরাং তা মূল্য হিসেবে পরিগণিত হয়। বিনিময়ের আগেই, উৎপাদনের সময়েই। এই সময় থেকে ব্যক্তির শ্রম সমাজগত ভাবে দ্বিবিধ চরিত্র লাভ করে। একদিকে শ্রম হবে একটা নির্দিষ্ট প্রকারের ব্যবহারযোগ্য শ্ৰম, তা দ্বারা সমাজের কোন নির্দিষ্ট অভাব দূরীভূত হবে, এবং এইভাবে তা পরিগণিত হবে সমাজের সকলের সমবেত শ্রমের অংশ রূপে, স্বতঃস্ফৰ্তভাবে সমাজে যে শ্রমবিভাগ গড়ে উঠেছে তারই মধ্যে একটি শাখাস্বরূপ। অন্যদিকে, কর্মরত ব্যক্তির যে বিচিত্ৰ চাহিদা আছে। এই শ্রম দ্বারা তার পরিপূর্ণ শুধু ততটাই সম্ভব, যতটা শ্রমিকদের ব্যবহারযোগ্য ব্যক্তিগত শ্রম নিয়ে একের সঙ্গে অপরের বিনিময় সমাজে বেশ প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। সুতরাং যখন প্ৰত্যেকটি শ্রমিকের ব্যবহারযোগ্য ব্যক্তিগত শ্রম অন্য সকলের শ্রমের সঙ্গে গুণগত অভিন্নতা লাভ করেছে। বিভিন্ন ধরনের শ্রমকে সমগুণসম্পন্ন করা যায় শুধুমাত্র তাদেরকে তাদের ভিন্ন ভিন্ন গুণ থেকে অমূর্তায়িত করে তাদের সমগুণত্বটুকু নিষ্কাষিত করে, অর্থাৎ তাদের সাধারণ ‘হর’-এ তাদেরকে পরিণত করে; সেই সাধারণ ‘হর’ হলো মানুষের শ্রমশক্তির ব্যয় অথবা অমূর্তায়িত মনুষ্য শ্ৰম। ব্যক্তিগত শ্রমের এই দ্বৈত চরিত্র মানুষের মনে যখন প্ৰতিফলিত হয় তখন বিশেষ বিশেষ রূপ দেখা দেয়, কার্যতঃ বিনিময়ের ক্ষেত্রেই এই সমস্ত রূপের উদ্ভব ঘটে। এইভাবে, তার নিজ শ্ৰম যে আসলে সামাজিক শ্ৰম এই সত্যটি একটি শর্তরূপে হাজির হয়, শর্তটি এই যে দ্রব্যটি কেবল ব্যবহারযোগ্য হলেই হলো না, তা অপরের ব্যবহারযোগ্য হওয়া চাই। অন্যান্য নানারকম শ্রমের সঙ্গে তার নিজস্ব শ্রমের অভিন্নতা, অর্থাৎ তার সামাজিক চরিত্র এই রূপ ধারণ করছে। যে বিভিন্ন ধরনের শ্রমের ফলে উৎপন্ন নানাবিধ দ্রব্যের একটি সমগুণ আছে, তাদের মূল্যই হলো সেই সমগুণ।
সুতরাং, আমরা যখন শ্রমোৎপন্ন দ্রব্য নিয়ে মূল্য-সম্পর্ক রচনা করি, তখন ত। এই জন্য করি না সে সমগুণসম্পন্ন মনুষ্যশ্ৰমের আধার বলে আমরা তাকে চিনতে পেরেছি, বরং ঠিক তার বিপরীত কারণে তা করি। যখনি আমরা বিভিন্ন প্রকার দ্রব্যের মধ্যে বিনিময় করি, তখনি ঐ সমস্ত দ্রব্যের উৎপাদক একরকম শ্রমের সঙ্গে অন্যরকম শ্রম সমান করে দেখাই। এ বিষয়ে আমরা সচেতন নই, কিন্তু তবু তা করি।(২) কাজেই মূল্য তার গলায় পরিচয়-পত্র ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় না। বরং মূল্যই প্রতিটি দ্রব্যকে এক একটি সামাজিক ভাষা-চিত্রে পরিণত করে। পরবর্তীকালে আমরা আমাদের নিজস্ব সামাজিক দ্রব্যের গৃঢ় রহস্য আবিষ্কার করবার জন্য সেই ভাষা-চিত্রের পাঠোদ্ধার করতে চেষ্টা করি; কেননা, ভাষা যেমন একটি সামাজিক ক্রিয়াফল, একটি ব্যবহারযোগ্য পদার্থকে মূল্য হিসেবে অভিহিত করাও তেমনি একটি সামাজিক ক্রিয়াফল। যে শ্ৰমদ্বারা দ্রব্যের উৎপাদন হয়, দ্রব্য যে সেই মনুষ্যশ্ৰমেরই বস্তুরূপ, এই আবিষ্কার মানবজাতির ইতিহাসে বাস্তবিকই এক নব যুগের সূচনা; কিন্তু শ্রমের সামাজিক চরিত্র যে কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে বাহা জগতে বস্তুচরিত্ররূপে দেখা দেয়, সেই কুয়াশার ঘোর তাতে কাটে না। আমরা এখন আলোচনা করছি উৎপাদনের একটি বিশেষ রূপ নিয়ে, অর্থাৎ পণ্যের উৎপাদন সম্বন্ধে। এই ধরনের উৎপাদনে প্ৰত্যেকের শ্রমই ব্যক্তিগত এবং এক ব্যক্তির শ্রম থেকে অন্য ব্যক্তির শ্রম স্বতন্ত্রভাবে ব্যয়িত হয়। কিন্তু সকলের শ্রমেরই একটি সাধারণ গুণ আছে অর্থাৎ, প্ৰত্যেকের শ্রমই মানুষের শ্ৰম। ব্যক্তিগত শ্রমের এই গুণটিই হলো তার বিশিষ্ট সামাজিক চরিত্র। শ্রমজাত দ্রব্যের এই সামাজিক চরিত্রই পণ্যের ভিতর মূল্যরূপে প্ৰতিভাত। এই তথ্যটি অর্থাৎ সকলের শ্রমের এই সাধারণ গুণটি, উৎপাদনকারীর মনে সত্য এবং শাশ্বত। আবিষ্কারটি নূতন যুগের সূচনা হওয়া সত্ত্বেও সত্যটি তার কাছে সনাতন ঠিক যেমন, নানারকম গ্যাস দিয়ে বায়ু গঠিত-এ সত্য বিজ্ঞান কর্তৃক আবিস্কৃত হবার পরও বায়ুমণ্ডলের কোন পরিবর্তন ঘটে না।
উৎপাদনকারী নিজে দ্রব্যের সঙ্গে অপরের দ্রব্য যখন বিনিময় করে, তখন সৰ্বপ্রথম একটিমাত্র প্রশ্ন তাকে কার্যতঃ পরিচালিত করে, সে প্রশ্নটি হলো-আমার কতটা জিনিসের বিনিময়ে অপরের কতটা জিনিস পাওয়া যাবে? বিনিময়ের এই অনুপাত যখন প্ৰচলিত প্ৰথাম্বারা কতকটা নির্দিষ্ট হয়ে যায়, তখন মনে হয় যেন দ্রব্যগুণ থেকেই এই অনুপাতের উৎপত্তি হয়েছে; যেমন এক টন লোহার বিনিময়ে যদি দুই আউন্স সোনা পাওয়া যায় তাহলে মনে হয় যেন এক টন লোহা এবং দুই আউন্স সোনার মূল্য স্বভাবতই সমান, ঠিক যেমন লোহা এবং সোনা ভিন্ন ভিন্ন পদার্থ হওয়া সত্ত্বেও এক টন লোহা এবং এক টন সোনার ওজন সমান। বিবিধ দ্রব্যের মূল্য যখন একবার ঠিক হয়ে যায়। তখন তাদের যোগাযোগ চলতে থাকে মূল্যের বিভিন্ন পরিমাণ রূপে, এই যোগাযোগের ভিতর দিয়েই নির্ধারিত হয়ে যায় যে দ্রব্য মাত্রেরই মূল্য আছে। মূল্যের পরিমাণ অনবরতই পরিবর্তিত হয়। এই পরিবর্তন উৎপাদনকারীদের ইচ্ছা দূরদৃষ্টি এবং কার্যকলাপের উপর নির্ভর করে না। তাদের কাছে, তাদের নিজেদের এই সামাজিক ক্রিয়া দ্ৰব্য-সমূহের সামাজিক ক্রিয়াকাপে প্ৰতীয়মান হয়; দ্রব্যই ওদের পরিচালক, ওরা দ্রব্যের পরিচালক নয়; পণ্যের উৎপাদন পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হবার পরেই সঞ্চিত অভিজ্ঞতা থেকে এই বৈজ্ঞানিক ধারণা জন্মলাভ করে যে প্ৰত্যেকের ব্যক্তিগত কাজ ভিন্ন, কারো সঙ্গে কারোর কাজের দম্বন্ধ নেই, তবু, স্বতস্ফুর্তভাবে প্ৰত্যেকের কাজেই সামাজিক শ্রম-বিভাগের এক একটি শাখায় পরিণত হচ্ছে এবং সমাজের চাহিদা অনুসারে নিরন্তর নির্ধারিত হয়ে যাচ্ছে সবার কাজের পরিমাগত অনুপাত। কেন এমন হয়? কারণ, ঘটনাচক্ৰে এক দ্রব্যের সঙ্গে অন্য দ্রব্যের যে পরিবর্তনশীল বিনিময়-জনিত সম্বন্ধ তৈরী হয়, তার ভিতর দিয়ে অপ্ৰতিহত প্ৰাকৃতিক নিয়মের মতই দৃঢ় ভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে যে দ্রব্যের উৎপাদনে সামাজিক প্রয়োজীনয় শ্রম সময় কতটা। যখন কানের কাছে কোন বাড়ি ধ্বসে পড়ার শব্দ হয়, তখন মহাকর্ষের নিয়ম এমনি ভাবেই তার কাজ করে যায়।(৩) কাজেই শ্ৰম-সময়ের দ্বারা মূল্যের পরিমাণ নির্ধারণ এমন একটি গৃঢ়তত্ত্ব যা লুকিয়ে থাকে পণ্যের আপেক্ষিক মূল্যের বাহ উত্থান-পতনের ভিতর – এই গৃঢ়তন্থের আবিষ্কারের ফলে ঘটনাচক্ৰে বাহত যা ঘটে, তা দিয়ে মূল্যের পরিমাণ নির্ধারণ করা বন্ধ হয়, কিন্তু যে প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে মূল্য নির্ধারিত হয়। সেই প্রক্রিয়ার কোন হেরফের তাতে আদৌ হয় না।
সামাজিক জীবনের রূপ যে ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের রাস্তা ধরে অগ্রসর হয়, মানুষের চিন্তার ভিতর তা প্ৰতিফলিত হয় ঠিক তার বিপরীতভাবে, সুতরাং বিপরীত ভাবেই তার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ হয়ে থাকে। হাতের কাছে যুগপরিবর্তনের যে ফলাফল পাওয়া যায়। তাই নিয়েই লোক সামাজিক রূপের বিশ্লেষণ আরম্ভ করে পিছন দিকে মুখ করে। যে চরিত্র দ্বারা শ্ৰমোৎপন্ন দ্রব্য পণ্যরূপে চিহ্নিত হয় এবং পণ্য বিনিময়ের প্রাথমিক শর্তস্বরূপ শ্ৰমজাত দ্রব্যকে যে চরিত্র লাভ করতেই হবে, লোকে তার অর্থ আবিষ্কার আরম্ভ করার আগেই তা সমাজের স্বাভাবিক এবং স্বতঃসিদ্ধ রূপ হিসেবে প্ৰতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। তখন, তার অর্থ কি তাই খোজ করা হয়, তার ঐতিহাসিক চরিত্র কি লোকে তা খোজে না, কেননা, তার চোখে সেই চরিত্রটি হলো সনাতন সত্য। কাজেই, পণ্যের দাম বিশ্লেষণ করতে গিয়েই মূল্য নির্ধারণের তত্ত্ব পাওয়া গেছে এবং যখন অর্থ দিয়ে সমস্ত পণ্যের পরিচয় দেওয়া শুরু হয়েছে, তখন সেই সূত্র অনুসরণ করে জানা গেছে যে পণ্যের পরিচয় হচ্ছে মূল্য। অবশ্য, পণ্য-জগতের ঠিক এই সর্বশেষ অৰ্থরূপটিই ব্যক্তিগত শ্রমের সামাজিক চরিত্র এবং উৎপাদনকারীদের সামাজিক সম্পর্ক খুলে ধরার পরিাবর্তে, তাকে ঢেকে রাখে। যখন বলি যে জামা এবং জুতোর সঙ্গে ছিট কাপড়ের সম্পর্ক আছে, কারণ পণ্য মাত্রই নিবিশিষ্ট সর্বজনীন মনুষ্যশ্ৰম, তখন স্বতঃই মনে হয়। কথাটা একেবারে আজগুবি। কিন্তু যখন কারিগর জামা এবং জুতোর তুলনা করে ছিটা কাপড়ের সঙ্গে অথবা, ধরা যাক, সোনা এবং রূপোর সঙ্গে ছিট কাপড় অথবা সোনা রূপোকে সর্বজনীন সমঅৰ্থ হিসেবে ধরে নিয়ে,–তখন সে তো নিজ ব্যক্তিগত শ্রমের সঙ্গে সমবেত সামাজিক শ্রমের সম্বন্ধ নির্ণয় করে সেই নেশাগ্ৰস্ত লোকটিক্স মতই।
বুর্জোয়া অর্থনীতির বর্গগুলি সবই এই রকম। পণ্যের উৎপাদন ঐতিহাসিক ক্ৰমবিকাশ সুত্রে বিকশিত উৎপাদনের একটি বিশেষ ধরন, উৎপাদনের এই বিশিষ্ট ধরুন থেকে যে সমস্ত অবস্থা এবং সম্পর্ক আবির্ভূত হয়, সেগুলিই সামাজিক অনুমোদনসহ চিন্তার ভিতর দিয়ে তত্ত্বরূপ ধারণ করে, এই রকম নানা তত্ত্বই বুর্জেীয়া অর্থনীতির নানা বর্গ। পণ্যের সমগ্র কুহেলিকা, পণ্যত্ব প্ৰাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে শ্ৰমোৎপন্ন দ্রব্যকে ঘিরে রাখে। যত ইন্দ্ৰজাল-উৎপাদনের অন্য ধরনের সময় তার কিছুই থাকে না।
রাষ্ট্ৰীয় অর্থনীতিবিদদের কাছে রবিনসন ক্রুশোর অভিজ্ঞতা একটি প্রিয় বিষয়।(৪) তার দ্বীপে তার দিকে একবার তাকানো যাক। যদিও ক্রুশোর চাহিদা খুব কম, তবু তারও কিছু অভাব পূরণ করতে হয়, সেজন্য যন্ত্রপাতি ও আসবাব তৈরী, ছাগল পোষা, মাছ ধরা এবং শিকার প্রভৃতি নানা ধরনের কিছু কিছু কাজও তাকে করতে হয়। উপাসনা প্ৰভৃতি ধরছি না, কারণ সেগুলি তার আমোদ-প্ৰমোদের সূত্র এবং ঐ জাতীয় কাজগুলিকে সে অবসর সময়ের চিত্ত বিনোদন হিসেবেই দেখে। তার কাজের এই বৈচিত্ৰ্য সত্ত্বেও সে জানে যে তার শ্রমের ধরন যাই হোক না কেন, তার সমস্ত শ্রমই এক রবিনসন ক্রুশোর শ্রম, সুতরাং তা মনুষ্য শ্রমের বিভিন্ন রূপ ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রয়োজনের তাগিদে বিভিন্ন কাজের মধ্যে সে তার সময়ের যথাযথ বণ্টন করতে বাধ্য হয়। সমস্ত কাজের মধ্যে কোন কাজের জন্য সে বেশি। সময় দেবে আর কোন কাজের জন্য কম সময় দেবে তা নির্ভর করে যে কাজের যা উদ্দেশ্য তা সফল কত্ববার জন্য কম কিংবা বেশি। কত বাধা অতিক্রম করতে হবে তার উপরে। আমাদের বন্ধু এই রবিনসন সত্বরই অভিজ্ঞতা থেকে শেখে, একটি ঘড়ি, একটি জমাখরচের খাতা, কলম এবং কালি জাহাজের ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধার করে। খাটি ব্রিটনের মত কয়েকটি খাতা তৈরী করতে আরম্ভ করে। তার খরচায়। সে টুকে রাখে। তার হাতে কি কি ব্যবহারযোগ্য দ্রব্য আছে, ওসব তৈরি করতে তার কি কি কাজ করতে হবে, এবং সর্বশেষে কোন উৎপাদনে গড়ে কত সময় তার লাগে, এই সবের একটি তালিকা। রবিনসনের সঙ্গে তার সৃষ্ট এই সমস্ত সম্পদের যত সম্পর্ক আছে তা এত সরল এবং এত স্পষ্ট যে সেভ লি টেইলর সাহেবও তা অনায়াসে বুঝতে পারেন। অতএব, এই সম্পর্কের ভিতরই মূল্য নির্ধারণের জন্য যা কিছু অপরিহার্য তার হদিশ পাওয়া যায়।
এখন একবার আলোকস্মাত রবিনসনের দ্বীপ থেকে ইউরোপের তিমিরাচ্ছন্ন মধ্যযুগের দিকে চোখ ফেরানো যাক। এখানে স্বাধীন মানুষটির পরিবর্তে পাই ভূমিদাস আর ভূস্বামী, জায়গীরদার আর সামন্তরাজ, শিস্য এবং পাত্রী; প্রত্যেকেই পরনির্ভরশীল। উৎপাদনের সামাজিক সম্পর্ক এখানে ব্যক্তিগত পরাধীনতা দ্বারা চিহ্নিত, এই উৎপাদনের ভিত্তিতে সমাজের আর যা কিছু গড়ে উঠেছে তাবুও এই বৈশিষ্ট্য। কিন্তু যেহেতু ব্যক্তিগত পরাধীনতা এই সমাজের ভিত্তি, সুতরাং শ্রমের এবং শ্রমজাত দ্রব্যের পক্ষে এখানে বাস্তবতাবজিত কোন পৌত্তলিক রূপ গ্ৰহণ করার আবশ্যকতা নেই। এখানকার সামাজিক আদান প্ৰদানে সরাসরি শ্রম দিয়ে দ্রব্য পেতে হয়। শ্রমের প্রত্যক্ষ সামাজিক রূপ। এখানে তার বিশিষ্ট স্বাভাবিক রূপে বিরাজিত, পণ্যময় সমাজের মতো নিবিশিষ্ট সাধারণ রূপে নয়। পণ্যপ্ৰসু শ্রমের মত বাধ্যতামূলক শ্রমও সময় দিয়ে ঠিকমতো মাপ হয়; কিন্তু প্ৰত্যেক ভূমিদাসই জানে তার ভূস্বামীকে সে যত শ্ৰম দিয়েছে তা তার ব্যক্তিগত শ্রমশক্তির একটি নিদিষ্ট অংশ। পুরোহিতকে যে প্ৰণামী দিতে হয় তা তার আশীর্বাদের চেয়ে অধিকতর বাস্তব। এই সমাজে বিভিন্ন শ্রেণীর ভূমিকা সম্বন্ধে আমাদের ধারণা যাই হোক না কেন, শ্রমরত ব্যক্তি-সমূহের সামাজিক সম্পর্ক এখানে সর্বদাই তাদের নিজেদের পারস্পরিক সম্পর্করূপেই দেখা দেয়, শ্ৰমোৎপন্ন দ্রব্যসমূহের ভিতরকার সামাজিক সম্পর্কের ছদ্মবেশ ধারন করে না।
সমবেত এবং প্রত্যক্ষভাবে সহযুক্ত শ্রমের উদাহরণ দেখবার জন্য সমস্ত জাতির সভ্যতার ইতিহাসের প্রথমাবস্থায় স্বতঃস্ফুর্তভাবে বিকশিত সেই শ্রমরূপের দিকে ফিরে যাবার কোন সুযোগ আমাদের নেই।(৫) আমাদের হাতের কাছে একটি উদাহরণ আছে, সেটি হচ্ছে কৃষক পরিবারের মধ্যে পিতৃতান্ত্রিক নিয়মে গঠিত শিল্প, যা থেকে শস্য, গবাদি পশু, সুতো, ছিট এবং পোশাক-পরিচ্ছদ তৈরী হয় নিজ পরিবারের ব্যবহারের জন্য। এই সমস্ত দ্রব্যই পরিবারের নিজস্ব শ্ৰমোৎপন্ন দ্রব্য কিন্তু পরিবারস্থ ব্যক্তির কাছে এগুলো পণ্য নয়। এই সমস্ত দ্রব্যের উৎপাদনে যে বিভিন্ন ধরনের শ্ৰম আছে, যথা ভূমিকৰ্ষণ, পশুপালন, সুত্রবয়ন, বস্ত্রবয়ন এবং দেহবাস সীবন প্ৰভৃতি প্ৰত্যেকটিই অবিকল প্ৰত্যক্ষ সামাজিক কাজ; কারণ, এগুলি হলো পরিবারের ভিতর স্বতঃস্ফুর্ত শ্রম-বিভাগের অন্তর্ভুক্ত, ঠিক যেমন পণ্যময় সমাজেও স্বতস্ফুর্তভাবে বিকশিত শ্রমবিভাগ। পরিবারের ভিতর কে কোন শ্রম কত পরিমাণে করবে, তা নির্ধারিত হয়। যেমন বয়স এবং স্ত্রী-পুরুষ ভেদ অনুসারে, তেমনি ঋতুভেদে প্রাকৃতিক অবস্থার বৈচিত্র অনুযায়ীও। এক্ষেত্রে পরিবারস্থ প্রত্যেক ব্যক্তির শ্রমশক্তি, স্বভাবতই পরিবারের সমগ্ৰ শ্ৰমশক্তির একটি অংশ; সুতরাং, শ্ৰমের জন্য কে কত সময় ব্যয় করল সেই সময় দিয়ে যখন সবার শ্রমের পরিমাপ করা হয় তখন স্বভাবতই শ্রমের সামাজিক চরিত্র মেনে নেওয়া হয়েছে।
এবার ছবিটা একটু পরিবর্তন করে ধরে নেওয়া যাক যে একাধিক স্বাধীন ব্যক্তি সমবেত হয়ে একটা গোষ্ঠী তৈরী করেছে, তারা যে সমস্ত উপকরণ নিয়ে উৎপাদন চালাচ্ছে তারা সমবেতভাবে তার মালিক, এই সমস্ত ব্যক্তি তাদের নিজ নিজ শ্ৰমশক্তি সচেতনভাবে সমগ্ৰ গোষ্ঠীর সমবেত শক্তিরূপে প্রয়োগ করছে। এখানে বিবিনসনের শ্রমের সমস্ত বৈশিষ্ট্যই বর্তমান, পার্থক্য কেবল এই যে এদের শ্রম ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক, রবিনসন যা কিছু তৈরী করেছে তা-ই তার ব্যক্তিগত শ্রমের ফল, সুতরাং তা শুধুমাত্র তার নিজস্ব ভোগের বস্তু। আমাদের ঐ গোষ্ঠীর সমস্ত দ্রব্য সামাজিক পদার্থ। তার একাংশ ব্যবহৃত হয় পুনরায় উৎপাদনের জন্য এবং তার সামাজিক সামগ্ৰী থাকে অব্যাহত। কিন্তু অপর অংশটি সদস্যদের জীবনধারণের জন্য ব্যবহৃত হয়। সুতরাং এদের মধ্যে এই অংশের ভাগ-বাটোয়ারা প্রয়োজন। এই ভাগ-বাটোয়ারা কিভাবে হবে তা নির্ভর করে গোষ্ঠীর উৎপাদন কিভাবে সংগঠিত হয়েছে এবং উৎপাদনকারীরা ঐতিহাসিক ক্ৰমবিকাশ সুত্রে কতটা অগ্রসর হয়েছে তার উপরে। কেবল পণ্য উৎপাদনের সঙ্গে তুলনা করবার জন্য ধরে দেওয়া যাক যে প্ৰত্যেকটি উৎপাদনকারী জীবনধারণের জন্য ব্যক্তিগতভাবে ঠিক সেই অনুপাতে প্ৰাপ্য পাচ্ছে, যে অনুপাতে সে শ্ৰমসময় দিচ্ছে। সেক্ষেত্রে শ্রমসময়ের ভূমিকা দ্বিবিধ। একটা নির্দিষ্ট সামাজিক পরিকল্পনা অনুসারে তার বণ্টন গোষ্ঠীর বিভিন্ন কাজ এবং বিভিন্ন অভাব এর সঙ্গে একটা অনুপাত রক্ষা করে। চলে। সঙ্গে সঙ্গে, এই শ্ৰম-সময় দিয়েই ঠিক করা হয় যে গোষ্ঠীর সমগ্র শ্রমের কতটা অংশ একজন দিয়েছে এবং যে সমস্ত জিনিস সকলেরই ভোগে লাগবে তার কতটা অংশ এক ব্যক্তির পাওনা। তাদের শ্রম এবং শ্রমোৎপন্ন দ্রব্য এই উভয় বিষয়েই উৎপাদনকারীদের সামাজিক সম্পর্ক এখানে সম্পূর্ণ সরল এবং বোধগম্য এবং কেবল উৎপাদনেই নয়, বণ্টনেও।
ধর্মীয় জগৎটা বাস্তব জগতেরই প্ৰতিফলন। পণ্যোৎপাদন যে সমাজের ভিত্তি, সে সমাজে উৎপাদনকারীরা শ্ৰমোৎপন্ন দ্রব্যকে পণ্য এবং মূল্যস্বরূপ ব্যবহার করে নিজেদের সামাজিক সম্পর্ক রচনা করে বলে তাদের নিজ নিজ ব্যক্তিগত শ্ৰম সমজাতিক মনুষ্যশ্রমে পরিণত হয়, এরূপ সমাজের সর্বাপেক্ষা উপযুক্ত ধর্ম হল অমূর্ত মানববন্দনার বাণী প্রচারক খ্ৰীষ্টধর্ম, বিশেষতঃ তার বুর্জোয়। যুগের রূপগুলি, যেমন প্রটেস্টাণ্ট মতবাদ, ঈশ্বরবাদ প্রভৃতি। আমরা জানি যে প্রাচীন এশীয় উৎপাদনপদ্ধতিতে এবং অন্যান্য প্ৰাচীন উৎপাদন পদ্ধতিতে শ্রমোৎপন্ন দ্রব্যের পণ্যে রূপান্তর এবং তার ফলে মানুষেরও পণ্যে রূপান্তরণ সমাজে গৌণ স্থান লাভ করেছিল, অবশ্য আদিম গোষ্ঠীসমাজগুলি যতই ভাঙনের মুখে এগোতে লাগল ততই পণ্যে রূপান্তরণের এই ব্যাপারটা বেশী বেশী গুরুত্ব লাভ করতে থাকল! বাণিজ্য প্ৰধান জাতি বলতে যথার্থ অর্থে যে-সব জাতিকে বোঝায় তাদের অস্তিত্ব ছিল প্ৰাচীন জগতের ফাঁকে-ফাঁকে, ইণ্টারমুণ্ডিয়াতে এপিকিউরাসের দেবদেবীর মতো অথবা পোলিশ সমাজের ফাঁকে ফাঁকে অবস্থিত ইহুদীদের মতো। প্ৰাচীন সমাজে উৎপাদনের সেই সামাজিক সংগঠনগুলি ছিল বুর্জোয়া সমাজের তুলনায় অত্যন্ত সরল এবং স্বচ্ছ। কিন্তু তার ভিত্তি ছিল ব্যক্তি-মানুষের অপরিণত বিকাশের উপরেযে মানুষ আদিম গোষ্ঠীসমাজের শহরবাসীদের সঙ্গে তখনো ছিন্ন করতে পারেনি। তার নাড়ীর বন্ধন অথবা তার ভিত্তি ছিল সরাসরি বশ্যতামূলক সম্পৰ্কসমূহের উপরে। এই ধরনের সংগঠনের উদ্ভব এবং অস্তিত্ব কেবল তখনি সম্ভব, যখন শ্রমের উৎপাদিকা শক্তি একটি নিচুস্তরের উপরে উঠতে সক্ষম হয়নি এবং তার ফলে বাস্তব জীবনে মানুষে মানুষে সম্পর্ক এবং মানুষে প্ৰকৃতিতে সম্পর্কও অনুরূপভাবে সংকীর্ণ। এই সংকীর্ণতার প্রতিফলন প্ৰাচীনকালের প্রকৃতি পূজায় এবং অন্যান্য লৌকিক ধর্মমতে। যাই হোক বাস্তব জগতের ধর্মীয় প্রতিক্ষেপণের চূড়ান্ত অবসান ঘটতে পারে। কেবল তখনি যখন দৈনন্দিন জীবনের বাস্তব সম্বন্ধের ভিতর দিয়ে মানুষের সঙ্গে মানুষের এবং মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পৰ্কট হয়ে দাঁড়াবে সম্পূৰ্ণ বোধগম্য এবং যুক্তিসঙ্গত।
উৎপাদনে যখন স্বাধীনভাবে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগসুত্ৰ স্থাপিত হবে এবং তার নিয়ন্ত্ৰণ চলবে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা অনুসারে সচেতনভাবে, তার আগে বাস্তব উৎপাদন পদ্ধতির উপর প্রতিষ্ঠিত সমাজে জীবনধারা থেকে কুঞ্জটিকার আবরণ ও অপসারিত হবে না। অবশ্য, সমাজে তার জন্য চাই উপযুক্ত ক্ষেত্র-প্রস্তুতি এবং অনুকূল অবস্থার স্বাক্ট। আবার তারও উদ্ভব ঘটবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সুদীর্ঘ এবং যন্ত্রণাময় ক্রমবিকাশের ভিতর দিয়ে।
রাষ্ট্ৰীয় অর্থশাস্ত্র, অবশ্য, মূল্য এবং তার পরিমাণ বিশ্লেষণ করেছে, তা সে বিশ্লেষণ যতই অসম্পূর্ণ হোক না কেন(৬); এই দুটো রূপের মূলে কি আছে। অর্থনীতি তাও আবিষ্কার করেছে। কিন্তু অর্থশাস্ত্র এ প্রশ্ন একবারও জিজ্ঞাসা কৰ্বেনি যে কেন শ্রমোৎপন্ন দ্রব্যের মূল্য দ্বারা শ্রমের পরিচয় দেওয়া হয় এবং মূল্যের পরিমাণ বোঝানো হয় শ্ৰম-সময় দ্বারা।(৭) এই দুটো সমীকরণের মধ্যে নিঃসন্দেহে এই সত্যই চিহ্নিত হয়ে আছে যে এগুলো যে সমাজের জিনিস, সে সমাজে উৎপাদনের পদ্ধতির উপর মানুষের কোনো কর্তৃত্ব নেই, উৎপাদনের পদ্ধতিই সেখানে মানুষের উপর কর্তৃত্ব করে। কিন্তু বুর্জোয়া অৰ্থশাস্ত্রীরা মনে করেন যে উৎপাদনক্ষম শ্রমের মতই ঐ সমীকরণ স্বতঃসিদ্ধ প্ৰাকৃতিক নিয়ম। কাজেই গীর্জার পাদ্ৰীরা খ্রীস্টধর্মের রূপের আবির্ভাবের পূর্ববর্তী ধৰ্মসমূহকে যে-চোখে দেখেন, বুর্জোয়া সামাজিক উৎপাদনের পূর্ববর্তী সামাজিক উৎপাদনের রূপগুলিকে বুর্জোয়া পণ্ডিতেরা সেই চোখেই দেখে থাকেন।(৮)
পণ্যের ভিতর যে কুহেলিকা তাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে এবং শ্রমের সামাজিক চরিত্র যে ভাবে বাস্তব ক্ষেত্রে ব্যক্ত হয়, তা কোন কোন অর্থনীতিবিদদের মনে কতখানি বিভ্ৰান্তি উৎপাদন করেছে, তা বেশ বোঝা যায় যখন দেখি যে বিনিময়-মূল্য রচনার প্ৰাকৃতিক অবদান কতখানি এই নিয়েও তারা শুষ্ক এবং ক্লান্তিকর বিতর্কে মেতে উঠেছেন। যেহেতু বিনিময়-মূল্য হচ্ছে প্ৰাকৃতিক পদার্থের মধ্যে কি পরিমাণ শ্ৰম দেওয়া হয়েছে তা প্ৰকাশ করবার একটা নির্দিষ্ট সামাজিক পদ্ধতি, সেহেতু বিনিময়মূল্য নির্ধারণে প্ৰকৃতির কোন ভূমিকা নেই, যেমন বিনিময়ের ধারা নির্ধারণেও তার কোন ভূমিকা নেই।
যে উৎপাদন-পদ্ধতিতে উৎপন্ন দ্রব্য পণ্যরূপ ধারণ করে, অর্থাৎ সরাসরি বিনিময়ের জন্য উৎপন্ন হয়, তা বুর্জোয়া উৎপাদনের সর্বাপেক্ষা সাধারণ এবং ভ্ৰাণাকার রূপ। তাই ইতিহাসে তার আবির্ভাব ঘটেছে অনেক আগেই, যদিও আজকালকার মতো এমন আধিপত্যশীল ও বিশিষ্ট চরিত্র তখন তার ছিল না। ক্লাজেই তখন তার পৌত্তলিক চরিত্র উপলব্ধি করা অপেক্ষাকৃত সহজ ছিল। কিন্তু যখন আমরা তাকে আরো মূর্তরূপে দেখি, তখন এই বাহ সরলতাটুকুও বিলুপ্ত হয়ে যায়। অর্থ ব্যবহারের ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ভ্ৰান্ত ধারণার উৎপত্তি হলো কোথা থেকে? সোনা এবং রূপে অৰ্থরূপে ব্যবহৃত হবার সময় অর্থবিনিময়ের ব্যবস্থার মধ্যে উৎপাদনকাৰীদেব সামাজিক সম্পর্ক ফুটিয়ে তোলেনি, ফুটিয়ে তুলেছে অদ্ভুত সামাজিক গুণের অধিকারী প্রাকৃতিক পদার্থরূপে। যে আধুনিক অর্থশাস্ত্র অর্থব্যবহারের ব্যবস্থাকে এত ঘূণার চোখে দেখে, তার অন্ধবিশ্বাস কি মূলধনের আলোচনার মধ্যে দিনের আলোর মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠেনি? খাজনার উৎপত্তি সমাজে নয়, জমিতে-প্ৰকৃতি-তন্ত্রীদের (ফিজিওক্র্যাটদের) এই ভ্ৰান্ত ধারণ; অর্থশাস্ত্ৰ কদিন হলো বর্জন করেছে?
কিন্তু পরের কথা পরে হবে, আপাততঃ আমরা পণ্যরূপের আর একটা উদাহরণ নিয়ে সন্তুষ্ট থাকি। পণ্যেত্ব যদি ভাষা থাকতো। তবে বলতে; আমাদের ব্যবহারমূল্য মানুষের চিত্তাকর্ষণ করব মতো একটি জিনিস হতে পারে। এটা আমাদের কোন বস্তুগত অংশ নয়। বস্তুরূপে আমাদের যা আছে তা হচ্ছে আমাদের মূল্য। পণ্যস্বরূপ আমাদের স্বাভাবিক সম্পর্ক থেকেই তার প্রমাণ মেলে।! নিজেদের পরস্পরের চোখে আমরা বিনিময় মূল্য ছাড়া আর কিছুই নই। এবার শুনুন অর্থনীতিবিদদের মুখ দিয়ে পণ্য কি কথা বলায় :
“মূল্য (অর্থাৎ বিনিমযযুল্য) হচ্ছে জিনিসের ধনসম্পদ (অর্থাৎ ব্যবহার মূল্য)। মানুষের গুণ। এই অর্থে মূল্য অবশ্যই বিনিময়-সাপেক্ষ, ধনসম্পদ। কিন্তু তা নয়।( “ধনসম্পদ (ব্যবহারমূল্য) হল মানুষের গুণ, মূল্য হল পণ্যের গুণ। একজন মানুষ বা একটি সম্প্রদায় ধন্যবান। কিন্তু একটি মুক্ত বা হীরা হল মূল্যবান। — মুক্তা বা হীরা হিসাবেই একটি মুক্ত বা একটি হীরা মূল্যবান”(১০) এ পর্যন্ত কোন রসায়নবিজ্ঞানীর পক্ষেই সম্ভব হয়নি একটি মুক্ত বা একটি হীরার মধ্যকার বিনিময়মূল্য আবিষ্কার করা। যাই হোক এই রাসায়নিক উৎপাদনটির অর্থনৈতিক আবিস্ক্রিয়া দেখিয়ে দিয়েছে যে কোন সামগ্রীর ব্যবহার মূল্য তার বস্তুগত গুণাবলী থেকে নিরপেক্ষ এবং ঐ সামগ্ৰীটিই তার ব্যবহার মূল্যের অধিকারী, অপর পক্ষে তার মূল্য কিন্তু বস্তু হিসেবেই তারই অংশ বিশেষ। এটা আরও সমথিত হয় এই বিশিষ্ট ঘটনার দ্বারা যে কোন সামগ্রীর ব্যবহার মূল্য বাস্তবায়িত হয় বিনিময়ের মাধ্যম ছাড়াই, তা বাস্তবায়িত হয়। ঐ সামগ্রী এবং মানুষের মধ্যে প্ৰত্যক্ষ সম্পর্কের দ্বারা কিন্তু, অন্য দিকে, তার মূল্য কিন্তু বাস্তবায়িত হয়। কেবল বিনিময়ের মাধ্যমেই অর্থাৎ একটি সামাজিক প্রক্রিয়ার দ্বারা। এই প্রসঙ্গে কার না মনে পড়ে আমাদের বন্ধুবর ডগবেরির কথা তার প্রতিবেশী সীকোলকে ডেকে বলেছিল, “লক্ষ্মীমন্ত হওয়া ভাগ্যের দান, কিন্তু লেখাপড়া আসে স্বভাব থেকে।”(১১)
—————-
১. প্ৰাচীন জার্মানরা জমির পরিমাণ নির্ধারিত করত একদিনে কতটা জমির ফসল কাটা যেত, সেই নিরিখ দিয়ে এবং সেই এককের নাম ছিল ট্যাববের্ক, ট্যাগবান্নে ইত্যাদি (jurnale, or terra jurnalis, or dioroalis), মান্নস্মাড্ ইত্যাদি (জি. এল. ফন মউরার প্রণীর ‘Einleitung…zur Geschichte dar Mark,-&c. Verfassungo’ মুনচেন, ১৮৫৪, পৃঃ ১২৯)
(২) কাজেই গালিয়ানি যখন বলেন যে; মূল্য হচ্ছে বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যেকারী সম্পর্ক-“La Ricchezza e una ragione tra due persone,” তাঁর উচিত ছিল এ কথাটাও যোগ করা যে : বিভিন্ন ব্যক্তির মধ্যেকার সম্পর্ক বিভিন্ন দ্রব্যের মধ্যেকার সম্পর্ক রূপে প্রকাশিত। (Galiane : Della Moneta, P. 221, Milano, 1803)
(৩) “নিয়মবদ্ধ সময়ের ব্যবধানে যে বিপ্লব দেখা দেয়। তার নিয়মকে আমরা কি বলে অভিহিত করব? এতো প্রকৃতির নিয়ম ছাড়া আর কিছু নয়। মানুষের জ্ঞানের অভাবের উপর এই নিয়ম প্রতিষ্ঠিত এবং মানুষের কার্যকলার এই নিয়মের ক্ষেত্রে “Umrisse Zu einer Kritik der Nationalokonomie“-“Deutsch Franzosische Jahrlencher”–সম্পাদনা : আর্নল্ড রুজ, কার্ল মার্কস।
(৪) এমনকি রিকার্ডোর মধ্যেও পাওয়া যায় স্ত্ৰবিন্সন-জাতীয় গল্প। “তঁর লেখায় আদিম শিকারী এবং আদিম ধীবর দেখা দেয় পণ্যের মালিক হিসেবে। তারা বিনিময় করে শিক্ষার-লব্ধ পশু আর ধূত। মৎস্য! বিনিময়ের হার নির্ধারিত হয়। পশু আত্ন মৎস্যের মধ্যে বিধৃত শ্ৰম-সময়ের দ্বারা। এই ভাবে তিনি তাদের দিয়ে ইতিহাসের পরের কাজটি আগেভাগেই করিয়ে রাখেন। শিকারী আর ধীবর তাদের হাতিয়ার ইত্যাদির হিসেব করে ১৮১৭ সালের লিওন এক্সচেঞ্জ-এর দাম। অনুযায়ী। যে বুর্জেীয়া “কর্মটির সঙ্গে তাঁর পরিচয় সেটি ছাড়া একমাত্র মিঃ ওয়েনএর প্যারালালোগ্রাম ই তার চোখে সমাজের একমাত্র ‘ফৰ্ম বলে প্রতীয়মান হয়।” (কার্ল মার্ক্স, “Zur Kritik, Etc.” পৃঃ ৩৮, ৩৯)
(৫) বিদেশে এমন একটা হাস্যকর ধারণা গড়ে উঠেছে যে ‘‘সাধারণ সম্পত্তি ব্যাপারটি তার আদিমরূপে কেবল স্লাভ কিংবা রুশদের মধ্যেই বিদ্যমান ছিল। ‘আমরা দেখিয়ে দিতে পারি যে রোমান, টিউটন এবং কেলটি-দের মধ্যেও তার অস্তিত্ব ছিল; ভগ্নাবস্থায় হলেও এর কিছু কিছু চিহ্ন এখনো ভারতে দেখা যায়। এশিয়ার, বিশেষ করে ভারতের, সাধারণ সম্পত্তির বিভিন্ন রূপের গবেষণা যখন আরও ভালোভাবে হবে তখন দেখতে পাওয়া যাবে যে রূপগত বৈচিত্র্য থেকে তার অবসানেরও বৈচিত্ৰ্য দেখা গিয়েছে। যেমন, রোমান এবং টিউটন ব্যক্তিগত সম্পতির বিভিন্ন আদিমরূপ ভারতীয় সাধারণ সম্পত্তির বিভিন্ন রূপ থেকে অনুমেয়। (কার্ল মার্ক্স, Zur Kritik পৃঃ ১০)
(৬) মূল্যের পরিমাপ সম্বন্ধে রিকার্ডোর বিশ্লেষণই সবচেয়ে ভালো; তবে তার অসম্পূর্ণতা ধরা পড়ে তার গ্রন্থের তৃতীয় এবং চতুর্থ খণ্ডে। মূল্য সম্বন্ধে সাধারণভাবে চিরায়ত অর্থনীতিবিদদের দুর্বলতা এই যে তারা কখনো সুস্পষ্টরূপে এবং সম্পূর্ণ সচেতনভাবে শ্রমের এই দুই রূপের মধ্যে কোন পার্থক্য দেখান নি; শ্রম যা মূল্যের ভিতর থাকে এবং ঐ একই শ্রম যা আবার ব্যবহার মূল্যের ভিতরও থাকে। অবশ্য, কার্যতঃ এ পার্থক্য করা হয়েছে, কেননা, তারা একবার দেখিয়েছেন শ্রমের পরিমাণগত দিক এবং আর একবার দেখিয়েছেন তার গুণগত দিক। কিন্তু এ বিষয়ে তাদের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না যে শ্রমের পরিমাণগত সমতার মধ্যেই উহা আছে তার গুণগত অভিন্নতা অর্থাৎ নির্বিশেষে মনুষ্য-শ্রমে তার রূপায়ণ। উদাহরণস্বরূপ রিকার্ডে বলেন যে, তিনি ডেস্টাট দ্য ক্রেসির সঙ্গে এ বিষয়ে একমত : “যেহেতু এটা সুনিশ্চিত যে আমাদের একমাত্র আদি ধন হল আমাদের শারীরিক ও নৈতিক ক্ষমতাগুলি, সেহেতু সেগুলির নিয়োগ, অর্থাৎ কোন-না-কোন ধরনের শ্রমই, হচ্ছে আমাদের একমাত্র আদি বিত্ত; আমরা যেসব জিনিসকে বলি ধন তা সৃষ্টি হয় শুধুমাত্র এই নিয়োগ থেকেই। . . . এটাও নিশ্চিত যে, ঐ সমস্ত জিনিসগুলি কেবল সেই শ্রমেরই প্রতিনিধিত্ব করে, যে-শ্রম তাদের সৃষ্টি করেছে; এবং যদি তাদের একটি মূল্য থাকে, কিংবা দুটি বিভিন্ন মূল্য থাকে, তা হলে তারা সেই মূল্য পেয়ে থাকতে পারে কেবল যে-শ্রম থেকে তাদের উদ্ভব ঘটে, সেই শ্রমের মূল্য থেকেই।” (রিকার্ডে, ‘প্রিন্সিপলস অব পলিটিক্যাল ইকনমি, লণ্ডন, ১৮২১, পৃঃ ৩৩৪)। আমরা কেবল এখানে এটাই বলতে চাই যে, রিকার্ডে ডেস্টাটের কথাগুলির উপরে নিজের গভীরতর ব্যাখ্যা আরোপ করেছেন। ডেস্টাট যা বলেছেন, আসলে এই এক দিকে, ধন বলতে যেসব জিনিস বোঝায়, তা সবই, যে-শ্রম তাদের সৃষ্টি করে, সেই শ্রমের প্রতিনিধিত্ব করে; কিন্তু, অন্য দিকে, তারা তাদের “দুটি বিভিন্ন মূল্য” (ব্যবহার-মূল্য ও বিনিময়-মূল্য)। অর্জন করে “শ্রমের মূল্য’ থেকে। তিনি এই ভাবে হাতুড়ে অর্থনীতিবিদরা যে-মামুলি ভুল করে থাকেন, সেই একই ভুল করেন, ধারা একটি পণ্যের (এক্ষেত্রে শ্রমের) মূল্য ধরে নেন বাকি সব পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করার জন্য। কিন্তু রিকার্ডে ব্যাখ্যা করেন যেন ডেস্টাট বলেছেন যে, (শ্রমের মূল্য নয়) শ্রমই ব্যবহার-মূল্য ও বিনিময়-মূল্য- উভয় মূল্যের মধ্যে মূর্ত হয়। যাই হোক, রিকার্ডে নিজেই শ্রমের দ্বিবিধ চরিত্রের উপরে-যা মূত হয় দ্বিবিধ ভাবে, তার উপরে-এত কম গুরুত্ব আরোপ করেন যে, তিনি তঁর “মূল্য এবং ধন, তাদের পার্থক্যসূচক গুণাবলী”। সংক্রান্ত অধ্যায়টিকে নিয়োগ করেছেন জে-বি-সে’র মত তুচ্ছ খুঁটিনাটির শ্রমসাধ্য পর্যালোচনায়। এবং পরিশেষে তিনি বিস্মিত হয়ে যান এই দেখে যে ডেস্টাট একদিকে তঁর সঙ্গে একমত হয়ে বলেন, শ্ৰমই হল মূল্যের উৎস, এবং অন্য দিকে জে-বি-সে’র মূল্য সম্পর্কিত ধারণার সঙ্গেও ঐকমত প্ৰকাশ করেন।
(৭) চিরায়ত অর্থনীতির অন্যতম প্ৰধান ব্যর্থতা এই যে, যে-রূপের মাধ্যমে মূল্য বিনিময়-মূল্য হয়ে ওঠে, তঁরা পণ্য এবং বিশেষ করে পণ্য-মূল্য বিশ্লেষণের ভেতর দিয়ে কখনই সেই রূপটিকে আবিষ্কার করতে পারেননি। এমনকি, এই সম্প্রদায়ের শ্ৰেষ্ঠ প্ৰতিনিধি অ্যাডাম স্মিথ এবং রিকার্ডে মূল্যের রূপের উপরে কোন তাৎপর্য আরোপ করেননি, যেন পণ্যের অভ্যন্তরীণ প্ৰকৃতির সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক নেই। এর কারণ শুধু এই নয় যে মূল্যের পরিমাণ বিশ্লেষণের প্রতিই তাদের সমগ্ৰ দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল। এর কারণ আরও গভীর। শ্ৰমজাত দ্রব্যের মূল্যরূপটি কেবলমাত্র তার নিষ্কর্ষিত রূপই নয়, তার সর্বাপেক্ষা সর্বজনীন রূপও বটে, মূল্যরূপ সেই উৎপাদনকে সামাজিক উৎপাদনের একটি বিশিষ্ট শ্রেণীতে পরিণত করে তার ফলে সেই বুর্জোয়া উৎপাদন একটি বিশেষ ঐতিহাসিক চরিত্র লাভ করে। সুতরাং, আমরা যদি এই ধরনের উৎপাদনকে প্ৰকৃতি-কর্তৃক নির্ধারিত সমাজের সর্বস্তরের চিরন্তন সত্য বলে গণ্য করি, তাহলে স্বভাবতই আমরা মূল্যরূপের, ফলতঃ পণ্যরূপের, এবং তার পরবর্তী পরিণত রূপ অর্থ এবং মূলধন প্রভৃতির চরিত্রের যা কিছু বিশেষত্ব তা উপেক্ষা করতে বাধ্য। কাজেই আমরা দেখতে পাই, যেসমস্ত অর্থনীতিবিদ পুরোপুরি মানেন যে শ্ৰম-সময়ের দ্বারাই মূল্যের পরিমাণ নির্ধারিত হয়, তারাও পণ্যের সর্বজনীন সমার্ঘ সামগ্ৰী যে অর্থ, তার সম্বন্ধে অদ্ভুত এবং পরস্পর-বিরোধী ধারণা পোষণ করেন। এটা স্পষ্টভাবে ধরা পড়ে ব্যাংকিং সম্বন্ধে তাদের আলোচনায়, এক্ষেত্রে অর্থ সম্বন্ধে হাতুড়ে সংজ্ঞা একেবারেই অচল। তার ফলে (গ্যানিল প্ৰভৃতির) বাণিজ্যবাদী মতবাদ আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে, এই মতবাদ অনুসারে মূল্য কেবল একটি সামাজিক রূপ অথবা তার অশরীরী ছায়ামূর্তি। আমি শেষবারের মত একথা বলে রাখতে চাই যে, চিরায়ত অর্থনীতি বলতে আমি সেই অর্থনীতিই বুঝি যা উইলিয়ম পেটির আমল থেকে বুর্জোয়া সমাজের প্রকৃত উৎপাদন-সম্পর্ক বিচার করেছে, কিন্তু হাতুড়ে অর্থনীতি দেখেছে কেবল যা উপর উপর দেখা যায়, বৈজ্ঞানিক অর্থনীতি বহু পূর্বে যে সমস্ত তথ্য আবিষ্কার করেছে কেবল তারই চব্বিত চর্বণ করে এবং বুর্জোয়াদের দৈনন্দিন তারই ভিতর খোজে অপরিচিত ঘটনাবলী সম্পর্কে যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা; কিন্তু তাছাড়া তার একমাত্র কাজ হল, বুর্জোয়াদের কাছে যে জগৎটি সর্বপ্রকার সম্ভাব্য জগতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ, সেই বুর্জোয়া জগৎ সম্বন্ধে বুর্জোয়াদের নিজেদের যা ধারণা তাই পণ্ডিতী চালে প্ৰণালীবদ্ধভাবে সাজানো এবং তাকেই চিরন্তন সত্য বলে জাহির করা।
(৮) Les economistes ont une singuliere maniere de proceder Il n’y a pour eux que deux SOrtes dinstitutions, celles de l’art et celles de la nature. Les institutions de la feodalite sont des institutions artificielles, celles de la bourgeoisie sont des institutions naturelles. Ils ressemblent en ceci aux theologiens, qui exu aussi etablissent deux sortes de religions. Toute religion qui n’est pas la leur, est une invention des hommès, tandis que leur propre religion est une emanation de Dieu-Ainsi il y a eu de l’histoire mais il n’y en a plus.” (Karl Marx. Misere de la philosophie, Repones a la philosophie de la Misere par M. proudhon, 1847. P. 113). এম. বাস্তিয়ত কিন্তু বস্তুতঃই কৌতুকজনক। তার ধারণা, প্ৰাচীনকালের গ্রীকরা আর রোমানরা কেবল লুণ্ঠনবৃত্তি করেই জীবিকা চালাত। কিন্তু মানুষ যখন শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে কেবল লুণ্ঠনই চালায় তখন দখল করার মতো কিছু তো হাতের কাছে থাকতেই হবে; লুণ্ঠনের সামগ্ৰীগুলিকে ক্রমাগত পুনরুৎপাদিত হতেই হবে; অতএব গ্রীক এবং রোমানদের মধ্যেও একটা উৎপাদন-ব্যবস্থা অর্থাৎ একটা অর্থনীতি নিশ্চয়ই ছিল। তাদের জগতের সেটাই ছিল বৈষয়িক ভিত্তি যেমন আমাদের আধুনিক জগতের বৈষয়িক ভিত্তি হচ্ছে বুর্জোয়। অর্থনীতি। অথবা বাস্তিয়াত হয়তো এটাও বলে থাকতে পারেন যে, গোলামির উপরে প্রতিষ্ঠিত যে উৎপাদন-পদ্ধতি ত। লুণ্ঠনেরই নামান্তর। সেক্ষেত্রে তিনি কিন্তু বিপজ্জনক জায়গায় পা বাড়াচ্ছেন। গোলাম-শ্রমের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে যদি অ্যারিস্তুতলের মতো। একজন বিরাট চিন্তাবিদের ভুল হতে পারে, তা হলে মজুপ্রিশ্রমের তাৎপর্য উপলব্ধি ব্যাপারে বাস্তিয়াতের মতো একজন বামন চিন্তাকারের ভুল হবে না কেন?’-এই সুযোগে আমি আমেরিকার একটি জার্মান পত্রিকা আমার বই “জর ক্রিটিক ডেব পলিটিক্যাল ইকোনমি’র বিরুদ্ধে যে আপত্তি তুলেছে, সংক্ষেপে তার উত্তর দিচ্ছি। ঐ পত্রিকার মতে, আমার এই বক্তব্য যে, প্ৰত্যেকটি বিশেষ বিশেষ উৎপাদন-পদ্ধতি এবং তার আনুষঙ্গিক উৎপাদন-সম্পর্কই, এক কথায় সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামোই, হল সেই আসল ভিত্তি যার উপরে আইনগত ও রাজনৈতিক উপরি কাঠামো গড়ে ওঠে এবং যার সঙ্গে তদনুযায়ী বিশেষ বিশেষ সামাজিক চিন্তা-প্ৰণালীর উদ্ভব ঘটে, উৎপাদনপদ্ধতিই সাধারণ ভাবে সামাজিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক জীবন নির্ধারণ করেএই সবই আমাদের কালের পক্ষে, যে-কালে বৈষয়িক স্বার্থের প্রাধান্য, সেই কালের পক্ষে সঠিক, কিন্তু মধ্যযুগে, যে-যুগে ক্যাথলিক ধর্মের ছিল একাধিপত্য কিংবা এথেন্স ও রোমের পক্ষে, যেখানে রাজনীতি ছিল সর্বেসর্বা, সেখানে সঠিক নয়। প্রথমতঃ কারো পক্ষে এটা ভাবা অদ্ভুত যে মধ্যযুগ ও প্রাচীন যুগ সম্পর্কে ঐ বস্তাপচা বুলিগুলি অন্যান্যের কাছে অপরিজ্ঞাত। অন্ততঃ এটা পরিষ্কার যে মধ্যযুগ বা প্ৰাচীন যুগ। ক্যাথলিক ধর্ম বা রাজনীতি খেয়ে বেঁচে থাকেনি। বরং, তারা কিভাবে তাদের জীবিকা অর্জন করত, তা থেকেই ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কেন একজায়গায় ক্যাথলিক ধর্ম, অন্যত্র রাজনীতি প্ৰধান ভূমিকা গ্ৰহণ করেছিল। বাকিটার জন্য, রোমের ইতিহাসের সঙ্গে সামান্য পরিচয়ই যথেষ্ট; সেটুকু থাকলেই জানা যাবে, দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যায়, তার গোপন ইতিবৃত্ত হল ভূমিগত সম্পত্তির ইতিবৃত্ত। অন্য দিকে অনেক দিন আগের ডন কুইক্সোটকে তার এই ভ্ৰান্ত কল্পনার জন্য দণ্ডভোগ করতে হয়েছিল যে, ‘নাইট’-সুলভ, অভিযান বুঝি সমাজের সমস্ত রকমের অর্থনৈতিক রূপের সঙ্গেই সামঞ্জস্যপূর্ণ।
(৯) অর্থনীতিতে কতকগুলি শব্দগত বিতর্ক সম্বন্ধে মতামত-বিশেষত: মূল্য এবং চাহিদা ও সরবরাহ সম্পর্কে” লিণ্ডন, ১৮২১, পৃঃ ১৬।
(১০) এস, বেইলি l.c, পৃঃ ১৬৫।
(১১) ‘অবজার্ভেশনস’-এর লেখক এবং এস. বেইলি রিকার্ডোর বিরুদ্ধে এই অভিযোগ এনেছেন যে তিনি বিনিময়-মূল্যকে আপেক্ষিক সত্তা থেকে অন্যাপেক্ষিক সত্তায় পরিণত করেছেন। প্ৰকৃত ঘটনা তার বিপরীত। তিনি হীরা, স্বর্ণ প্রভৃতি বস্তুর বাঙ্ক সম্পর্কটি বিশ্লেষণ করেছেন, এই সম্পর্কের মধ্যে তাদের আত্মপ্রকাশ হয় বিনিময়-মূল্য রূপে, তারপর তিনি আবিষ্কার করেছেন বাহরূপের পিছনে লুকানো প্রকৃত সম্পর্কটি অর্থাৎ কেবল মনুষ্যশ্রমের অভিব্যক্তিরূপে তাদের পারস্পরিক সম্বন্ধটি। রিকার্ডোর শিষ্যরা যদি বেইলির জবাবে কিছু বোঝাতে না পেরে কিছু কড়া কথা বলে থাকেন। তো তার কারণ হচ্ছে এই যে, মূল্য এবং বিনিময় মূল্যরূপে তার আত্মপ্রকাশ, এই দুয়ের মধ্যে যে গূঢ় সম্পর্ক বর্তমান তার কোন সুত্র তুরা খুঁজে পাননি রিকার্ডোর নিজ গ্রন্থের মধ্যে।