রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি – মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন
Rabindranath Ekhane Kokhono Asenni by Mohammad Nazim Uddin
প্রথম প্রকাশ : ফেব্রুয়ারি ২০১৯
.
উত্সর্গ :
এ বইটি যাকে উৎসর্গ করার কথা ভেবে রেখেছিলাম তার আকস্মিক মৃত্যু আমাকে একটা উপলব্ধি দিয়ে গেছে : প্রিয়মানুষের জন্য কিছু করতে চাইলে অপেক্ষা না করাই ভালো!
বড়বোনের স্বামী হিসেবে নয়, তিনি ছিলেন আমার অভিভাবক, বড়ভাই এবং অবশ্যই বন্ধু। অসম্ভব ভালো আর নরম মনের মানুষ, অন্য মানুষের প্রতি যার ছিলো অপরিসীম মমতা, সেই সাব্বির আহমেদ নাজমীর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। আমার কাছে আপনার স্মৃতি অম্লানই থাকবে।
.
মুখবন্ধ
শব্দটাই প্রথমে তাকে সম্মোহিত করে ফেললো।
দূর থেকে শত শত নারী-পুরুষের কণ্ঠ ভেসে আসছে বসন্তের বাতাসে, সেই সাথে বয়ে নিয়ে আসছে উদ্যানের নাম-জানা না-জানা অসংখ্য ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ। দিনের প্রথম আলো ছড়িয়ে পড়েছে সবখানে, ছড়িয়ে দিচ্ছে উদ্যানের ঘাসের উপরে মিষ্টি রোদের প্রলেপ।
নুরে ছফা বুকভরে সেই ঘ্রাণ আর রোদের গন্ধ নিলো। কিন্তু ভেসে আসা সুর তাকে সম্মোহিত করে নিয়ে চললো শব্দটার উৎসের দিকে। ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো সে।
গুঞ্জন থেকে সুর। সুর থেকে কথা। শতকণ্ঠের আমন্ত্রণ শুনতে পাচ্ছে এখন।
আয়, আয়, আয়।
সে তোমায় খুঁজে যায়।
তাহার মৃদঙ্গরবে
করতালি দিতে হবে…
ঘোরগ্রস্ত সম্মোহন ভেঙে দৃঢ় পদক্ষেপে, কঠিন সঙ্কল্প নিয়ে আরেকবার চোখ বোলালো চারপাশে। শত শত নারী-পুরুষও সম্মোহিত হয়ে একদিকেই ধাবিত হচ্ছে যেনো। সহস্র কপালে সহ লাল সূর্য! কালো মেঘপুঞ্জে চেপে বসেছে শ্বেতশুভ্র ফুলের মেঘ! সেই ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করছে চারপাশ।
সূর্যের তেজ বাড়ছে ধীরে ধীরে, ছফা টের পেলো তার কপাল ঘেমে উঠেছে, সেই ঘেমে ওঠা কপালে হাত রেখে রোদ আড়াল করে দেখতে লাগলো এবার। কিন্তু দৃশ্যের চেয়ে শব্দটাই প্রকট তার কাছে।
এসো এসো হে তৃষ্ণার জল,
কলকল ছলছল
ভেদ করো কঠিনের ক্রূর বক্ষতল
কলকল্ ছলছল্…
তৃষ্ণার্ত ছফা এগিয়ে চললো আরো সামনের দিকে। বেলিফুলের সৌরভ তার আশেপাশে। হাঁটতে হাঁটতেই চারপাশটা দেখে নিলো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে, এমন একটি মুখ খুঁজে বেড়াচ্ছে যেটা তার আধো-ঘোর আর আধো জাগরণের মাঝে দুলছে বিগত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে।
তুমি যে খেলার সাথি
সে তোমারে চায়।
তাহারি সোনার তান
তোমাতে জাগায় গান…
সামনেই দেখতে পেলো বিশাল বটবৃক্ষের নিচে জড়ো হওয়া মানুষের দল। লাল-সাদার সমারোহ। তবলার বোল। করতালের টুং টাং। হারমোনিয়ামের বিভ্রান্তিকর স্বর! সঙ্গীতের মুর্ঘনা গ্রাস করে নিয়েছে চারপাশ। হাজার হাজার নারী-পুরুষ ঘাসের উপরে বসে কয়েক শ’ নারী-পুরুষের সমবতে কণ্ঠের গান শুনছে।
এসো হে প্রবল
কলকল ছলছল…
বৈশাখের প্রথম দিনে নুরে ছফা আবারো ধন্দে পড়ে গেলো। একে একে দেখতে লাগলো সবাইকে। তার মন বলছে, এই ভীড়ের মধ্যে সে আছে। কিন্তু তার যুক্তিবুদ্ধি তাতে সায় দিচ্ছে না।
বিগত তিন বছর ধরে হন্যে হয়ে খুঁজে যাচ্ছে একটা মুখ। যেখানেই যায়, যখনই সুযোগ পায়, এই একটা মুখই খোঁজে। গতকাল রাতে হুট করে তার মনে পড়ে যায়, পরদিন পহেলা বৈশাখ। ঢাকার বৈশাখ মানেই ছায়ানট। রমনার বটমূল। সুরে সুরে রবীন্দ্রনাথের আমন্ত্রণ সঙ্গীত : এসে হে বৈশাখ, এসো এসো!
আমি আসলেই রবীন্দ্রনাথের ভক্ত। সেই ছোটোবেলা থেকে। আমার মা খুব ভালো রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতো..আমাকেও শিখিয়েছিলো। ছায়ানটের প্রথম দিককার ছাত্র ছিলাম আমি…৬২-তে যখন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উদযাপন করা হলো, সেই ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে অনেকের সঙ্গে আমিও ছিলাম…
কথাগুলো ছফার মস্তিষ্কে অনুরণিত হতে থাকে তখন। তার অন্তরাত্মা বলে ওঠে, সে আসবে! নিদেন পক্ষে, আসার সম্ভাবনা আছে।
গত রাতে উত্তেজনার চোটে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারেনি, ভোর হতেই বিছানা ছেড়েছে সে, ছুটে এসেছে এখানে-রমনার এই সবুজ চত্বরে।
নূরে ছফা এমন একটি মুখ খুঁজে বেড়াচ্ছে, যে মুখটি তার নিজের কাছেই ঘোলাটে, অস্পষ্ট। হাজার হাজার মানুষের ভীড়ে সেই মুখটি খুঁজে বের করা রীতিমতো পাগলামি বলেই মনে হচ্ছে এখন।
ঘন্টাখানেক পর কোলাহল থেকে সরে গিয়ে একটা সিগারেট ধরালো সে। মিষ্টি রোদ এখন মাথার তালুতে আঁচ দিচ্ছে, বিদ্ধ করছে দুচোখ। পায়ের নিচে ঘাসগুলো। হাজার হাজার পদভারে পিষ্ট হচ্ছে তারা। সবুজ চত্বরটি এখন লাল-সাদা-নীল-হলুদ রঙে ছেয়ে গেছে। সঙ্গীতের মিষ্টিধ্বণি ছাপিয়ে প্রবল হতে শুরু করেছে মানুষের কোলাহল।
নিজেকে বেমানান লাগছে এখানে। অন্যদের মতো পায়জামা-পাঞ্জাবি নয়, ক্রিমরঙের পোলো শার্ট, গাঢ় নীলের গ্যাবাডিনের প্যান্ট আর পায়ে মোকামিস পরে আছে সে।
সিগারেটে টান দিয়ে আবারো জনসমুদ্রের দিকে তাকালো ছফা। খুঁজে খুঁজে তার চোখ ক্লান্ত। টের পেলো, একটু ঘেমে উঠছে। কিন্তু এখনও হাল ছেড়ে দেবার কথা ভাবছে না।
সিগারেটটা শেষ করে রমনার বটমূলের দিকে পা বাড়ালো। মানুষের ভীড় এখন জনস্রোতে পরিণত হয়েছে। বটমূলের সামনে বসে থাকা দর্শক শ্রোতাদের দিকে চোখ বুলালো। রোদের হাত থেকে বাঁচার জন্য বেশির ভাগ নারী-পুরুষ মাথার উপরে রুমাল, কাপড়, সানগ্লাস আর সানক্যাপ দিয়ে রেখেছে। তাদের প্রায় সবার চোখ বটবৃক্ষের শান বাঁধানো চত্বরে যে মঞ্চ বানানো হয়েছে তার দিকে থাকার কথা কিন্তু অনেকের দৃষ্টিই অন্যদিকে নিবদ্ধ-উপস্থিত দর্শকদের বিরাট একটি অংশ হাতে মোবাইলফোন নিয়ে নিজেদের অহংকে তুষ্ট করার জন্য অদ্ভুত এক ভঙ্গিতে ছবি তোলায় ব্যস্ত।
সেল্ফি!
তিক্ততায় একদলা থুতু ফেললো সে। কালের এই উন্মাদনাকে মেনে নিতে একটু কষ্টই হয় তার। মানুষ এখন নিজেদের প্রতিটি মুহূর্তকে ধরে রাখতে চায়, জানান দিতে চায় তার উপস্থিতিকে! তাদের মতো ডিবি অফিসাররাও বড়সর কোনো ‘ক্রিমিনাল’কে ধরার পর সেল্ফি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দেয় আজকাল। এ নিয়ে ডিপার্টমেন্টে প্রায়শই বচসা বাধে, আর সেটা সব সময় শুরু করে ছফা নিজেই।
সেক্তি নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে সামনের দিকে তাকালো সে। বটবৃক্ষের শান বাঁধানো চত্বরে বসে বিভিন্ন বয়সের শ’খানেক নারী-পুরুষ গান গেয়ে যাচ্ছে। সূর্যালোকের কারণে চোখের উপরে হাত রেখে মঞ্চে বসা মানুষগুলোর দিকে নজর দিলো এবার। ভীড়ের মধ্যে কাউকে খোঁজার যে কৌশল সেটা তার জানা আছে। ধৈর্য ধরে এক এক করে দেখতে হয়। বিক্ষিপ্তভাবে দেখলে দৃষ্টি বিভ্রান্ত হবে।
হতাশার সাথেই এবার ফিরে তাকালো মঞ্চের সামনে বসে থাকা হাজারখানেক দর্শকের দিকে। এক এক করে দেখতে শুরু করলো সে। কিন্তু কয়েক মিনিট পরই তার দৃষ্টি চঞ্চল, অসহিষ্ণু আর উদভ্রান্ত হয়ে উঠলো। ক্রমশ হতাশা গ্রাস করলো তাকে। তিক্তমুখে ঘুরে দাঁড়ালো। আরেকটা সিগারেট ধরাবে কিনা সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না। তবে তার পা দুটো ঠিকই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে, ভীড় থেকে তাকে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে যেনো।
এখানে হুট করে চলে আসাটা যে কতো বড় পাগলামি হয়েছে, সেটা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। মুশকান জুবেরি এতোটা বোকা নয় যে, হত্যা-গুমের অভিযোগ মাথায় নিয়ে পহেলা বৈশাখে ছুটে আসবে রমনার বটমূলে।
হাঁটতে হাঁটতেই পাশ ফিরে তাকালো সে। সমবেত কণ্ঠের গান থেমে গেছে, শুরু হয়েছে একক পরিবেশনা।
নাই বা ডাকো রইব তোমার দ্বারে,
মুখ ফিরালে ফিরব না এইবারে…
নিজেকে ভীষণ বোকা আর নাছোড়বান্দা বলে মনে হচ্ছে তার। তবে মুশকান জুবেরির ব্যাপারে আর কততদিন হাল না ছেড়ে থাকতে পারবে, জানে না। সুন্দরপুর থেকে পালিয়ে যাবার পর তিন বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। ছফার যৌক্তিক মন জানে, ঐ ভয়ঙ্কর নারী দেশ ছেড়েছে, হয়তো আর কখনও ফিরে আসবে না। ভিনদেশে গিয়ে দিব্যি পুরুষ শিকার করে যাচ্ছে সে, আর নিজেকে করছে কালোত্তীর্ণ!
মাঝে মাঝে সে ভাবে, নিজের অহংবোধকে তুষ্ট করার জন্যই সম্ভবত এখনও হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে মহিলাকে। এটা যে তার জন্যে প্রথম ব্যর্থ কেস হতে চলেছে, সেটা মেনে নিতে পারছে না। কিন্তু কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়, নিজের পেশার প্রতি দায়বদ্ধতাও…
“আশ্চর্য! চোখে দেখেন না নাকি!”
বিরক্তিভরা একটি নারী কন্ঠ বলে উঠলো তাকে উদ্দেশ্য করে।
আক্ষরিক অর্থেই প্রবলভাবে ঝাঁকি খেলো নুরে ছফার ভাবনাগুলো। বুঝতে পারলো, আনমনা থাকার কারণে চলতে চলতে এক মহিলার সাথে ধাক্কা লেগে গেছে। এখানে আসা অন্য সবার মতো এই মহিলাও লালপেড়ের সাদা সুতির শাড়ি পরেছে, মাথায় বেলি ফুলের মালা, কপালে লাল টিপ। মহিলাকে কিছু বলতে গিয়ে থমকে গেলো সে।
এখানে যে তাকে দেখতে পাবে ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি!
.
অধ্যায় ১
“স্যার…আপনি?!”
নুরে ছফা যারপরনাই বিস্মিত। যে মেয়েটার সাথে তার ধাক্কা লেগেছে তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে সাবেক ডিবি অফিসার কেএস খান।
“ইয়ে মানে…”
সলজ্জ মুখে কেবল বিব্রতকর হাসিটা ধরে রেখেছে ভদ্রলোক। যেনো লুকিয়ে প্রেম করতে গিয়ে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেছে।
“আপনি উনাকে চেনেন?” শাড়ি পরা তরুণী অবাক হয়ে বললো, একবার নুফে ছফা আরেকবার কেএস খানের দিকে তাকালো সে।
“আপনেরে বলছিলাম না ছফার কথা?” বিব্রত হাসিটা ধরে রেখেই বললো মি. খান। “এই হইলো সেই নুরে ছফা।”
ছেলে-ছোকরাদের মতো টকটকে লাল রঙের পাঞ্জাবি, সাদা পায়জামা আর পায়ে চপ্পল পরে আছে কেএস খান-একেবারে পহেলা বৈশাখের সাজে!
“আর ইনি হইলেন ডাক্তার লুবনা,” মেয়েটাকে দেখিয়ে বললো কেএসকে। মুখে বিব্রতকর হাসিটা যথাসম্ভব দূর করার চেষ্টা করছে সাবেক ডিবি অফিসার।
নুরে ছফা তরুণীর দিকে তাকালো আবার। মেয়েটার বয়স বেশি হলে ত্রিশ-বত্রিশ হবে। তবে সে নিশ্চিত নয়। মেয়েদের বয়স ধরার বেলায় সে যথেষ্ট আনাড়ি। তার কাছে পঁচিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বছরের মেয়েরা হলো সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্তিকর। কেএস খানের সঙ্গি মেয়েটিও একই রকম বিভ্রান্তি তৈরি করেছে।
“সরি…” অবশেষে একটা ঢোঁক গিলে আস্তে করে বললো, “…ম্যাডাম।” মেয়েটাকে ‘ম্যাডাম’ সম্বোধন করা নিয়ে একটু দ্বিধা ছিলো মনে, তারপরও অনেকটা মুখ ফসকে বের হয়ে গেছে, সম্ভবত কেএস খানের উপস্থিতির কারণে। “আমি আসলে…খেয়াল করিনি।”
“ইটস ওকে,” মিষ্টি করে হেসে বললো ডাক্তার লুবনা। নিজের বিরক্তি আর রাগ হজম করে ফেলেছে পুরোপুরি, মুখে এখন সৌজন্যতার হাসি।
“নুরে ছফা হইলেন ডিবির সবচায়া ব্রিলিয়ান্ট অফিসার…অনেক কঠিন কেস সল্ভ করছেন,” মেয়েটাকে বললো মি. খান।
ছফা অবাক হয়েই লক্ষ্য করলো, এমন সুন্দরী তরুণীর সান্নিধ্যেও কেএস খান সাবলীল ভঙ্গিতে চলভাষায় কথা বলছে।
ডাক্তার লুবনা যেনো একটু স্মৃতি হাতরে নিলো। “হুম, মনে পড়েছে…আপনি বলেছিলেন, মিস্ট্রিয়াস লেডি মুশকান জুবেরির কেসটা সল্ভ করেছিলেন,” মেয়েটার চোখেমুখে এখন প্রশংসার অভিব্যক্তি।
কেএস খান হাসি হাসি মুখ করে সায় দিলো।
“আপনার ঐ কেসটার কথা শুনেছি মি. খানের কাছ থেকে,” এবার আন্তরিকমাখা হাসি দিয়ে ছফাকে বললো তরুণী। “খুবই ইন্টারেস্টিং ছিলো, একেবারে ভয়ঙ্কর কোনো সিনেমার মতোই!”
নুরে ছফা মুখে কৃত্রিম হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করলো। কেসটা যে সে পুরোপুরি সল্ভ করতে পারেনি সেটা আর বললো না। তার মাথায় ঘুরছে অন্য চিন্তা- মেয়েটার সাথে কেএস খানের সম্পর্ক কী?
ভাগ্নি? ভাতিজি?
বান্ধবী??
“আমি ডাক্তার লুবনার রুগি,” যেনো ছফার প্রশ্নের জবাবটা দিয়ে দিলো কেএসকে। কথাটা বলেই বোকার মতো হাসলো ভদ্রলোক। “আমার যে কন্ডিশন…রেগুলার তার কাছে যাইতে হয়।”
“আমি অবশ্য উনাকে রোগী হিসেবে দেখি না। আই থিঙ্ক উই আর ফ্রেন্ড,” বললো সেই লাস্যময়ি তরুণী।
ছফার ভুরু অনিচ্ছাকৃতভাবেই কপালে উঠে গেলো। বান্ধবী?
কেএস খানের মুখে বোকা বোকা হাসি, আর সেটা ঝুলে রইলো কয়েক মুহূর্তের জন্য। “ডাক্তার আমারে জোর কইরা নিয়া আসলো এইখানে।” কৈফিয়ত দেবার ভঙ্গিতে বললো সে।
অবশ্য লাল টকটকে পাঞ্জাবি আর চপ্পল দেখে ছফার মনে হচ্ছে না ‘জোর’ শব্দটা এখানে খাটে। যথেষ্ট প্রস্তুতি নিয়েই পহেলা বৈশাখের প্রথম প্রহরে চলে এসেছে মি. খান।
“তা, আপনের খবর কি, ছফা? অনেক দিন কোনো খোঁজখবর নাই।”
প্রায় দু-মাস হলো মি. খানের সাথে তার দেখা হয়নি। ডিবির অন্য অফিসারদের মতো কোনো কেসে নাকানি চুবানি খেলেই সাবেক এই ইনভেস্টিগেটরের শরণাপন্ন হয় না ছফা। এলিভেটরের ভেতরে অদ্ভুত এক খুনের ঘটনা আর মুশকান জুবেরির কেসের বেলায় পরামর্শ, সাহায্য বাদ দিলে বিগত কয়েক বছরে মি. খানের কাছে কোনো কেস নিয়ে যায়নি সে। তবে ডিপার্টমেন্টে ক্রিমিনোলজির ক্লাস নেবার সময় তাদের মধ্যে দেখাসাক্ষাত হয়। সেটাও দু-মাস ধরে বন্ধ আছে ছফার অফিস অন্যত্র সরিয়ে নেবার কারণে। ডিবি অফিস এখন মিন্টো রোড থেকে ইস্কাটনের নতুন একটি ভবনে বর্ধিত করা হয়েছে। পুরনো ভবনে কেএস খান এখনও ক্লাস নেয়।
“এই তো, স্যার…” বললো সে। “একটু ব্যস্ত আছি কিছু কে নিয়ে।”
“বাসায় আইসেন, এক কাপ চা খায়া যায়েন। অনেক দিন আলাপ হয়।”
“আসবো, স্যার।”
“এই সপ্তাহে কোনো ক্লাস নাই…ফ্রি আছি। আপনে চইলা আইসেন।”
“ঠিক আছে, স্যার।”
ডাক্তার লুবনা হাতঘড়ি দেখলো। “মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়ে যাবে, কেএস খানকে মৃদু তাড়া দেবার সুরে বললো সে।
বিব্রত হাসি দিলো সাবেক ডিবি অফিসার।
ছফা যারপরনাই বিস্মিত। মি. খান এক সুন্দরী তরুণীকে বগলদাবা করে মঙ্গল শোভাযাত্রায় যাবেন?
না। নিজেকে শুধরে দিলো। মেয়েটাই কেএস খানকে বগলদাবা করে নিয়ে যাচ্ছে।
“ঠিক আছে, স্যার…আমি যাই, পরে কথা হবে,” বললো ছফা। ডাক্তার লুবনার দিকে চেয়ে সৌজন্যমূলক হাসি দিলো।
বিদায় নেবার সময়ও বিব্রতকর হাসিটা লেগে রইলো কেএস খানের মুখে। কয়েক পা এগিয়ে যেতেই বুঝতে পারলো, মি. খানকে মনে মনে হিংসাই করছে সে। ডিভোর্সি এই ভদ্রলোক নিশ্চয় মেয়েটার সাথে হৃদয়ঘটিত সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছে।
একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এলো তার ভেতর থেকে। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে এখন পর্যন্ত ছফার জীবনে সেভাবে কোনো নারীর অনুপ্রবেশ ঘটেনি। কী কারণে সে নিজেও জানে না।
তার রুক্ষ্ম ব্যবহার কর্মজীবনের ব্যস্ততা? নাকি মানবীয় সম্পর্কের ব্যাপারে তার উসীনতা?-ছফা জানে না।
সম্বিত ফিরে পেতেই নিজেকে আবিষ্কার করলো রাস্তার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। হাঁটতে হাঁটতে রমনার উদ্যান থেকে বের হয়ে শিশুপার্কের দিকে যে অস্তাচল নামে গেটটা আছে, সেখানে চলে এসেছে কখন টেরই পায়নি। এখান থেকে কোথায় যাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারলো না।
বাড়ি ফিরে যাবে? সারাটা দিন নিজেকে বন্দী করে রাখবে ঘরে? নাকি লক্ষ লক্ষ ঢাকাবাসির মতো বৈশাখের প্রথম দিনটি পথেঘাটে উদ্দেশ্যবিহীনভাবে ঘোরাঘুরি করেই কাটিয়ে দেবে?
অবশেষে বাড়ি ফিরে যাবার সিদ্ধান্তই নিলো। আরেকটু হেঁটে শাহবাগের মোড়ে গিয়ে রিক্সা নেবার জন্য পা বাড়ালো সে। পথেঘাটে মানুষের উপস্থিতি বাড়ছে খুব দ্রুত। আরেকটু পরই এই পথঘাট জনস্রোতে তলিয়ে যাবে। উপর থেকে দেখলে মনে হবে পথের উপর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে নানান রঙের ছটা।
নুরে ছফা মানুষজনের ভীড় এড়ানোর জন্য ফুটপাত থেকে পথে নেমে পড়লো। জনসাধারণের সুবিধার্থে এই রাস্তাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে যানবাহন প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
রোদের উত্তাপ থেকে বাঁচার জন্য সানগ্লাসটা বের করে পরে নিলো সে, সেই সাথে একটা সিগারেটও বের করে নিলো প্যাকেট থেকে। হাঁটতে হাঁটতেই লাইটার দিয়ে আগুন ধরালো। প্রচণ্ড রোদে উত্তপ্ত ধোয়া টেনে নিলো বুকে।
শাহবাগের মোড়ে, পিজি হাসপাতালের সামনে এসে একটা রিক্সা পেয়ে গেলে উঠে বসলো তাতে। বেতার ভবনের সামনে দিয়ে এগোতে শুরু করলো রিক্সাওয়ালা। প্রচুর যানবাহনের কারণে রিক্সার গতি শ্লথ। কিছু দূর যাবার পর একটা রিংটোন বেজে উঠলে অবাক হলো সে। তার ফোন সব সময় সাইলেন্ট থাকে, আজকেও তা-ই আছে। রিক্সাওয়ালা প্যাডেল মারার গতি কমিয়ে দিয়ে কোমর থেকে সস্তা একটি চায়নিজ মোবাইলফোন বের করলে মুচকি হাসলো ছফা। মোবাইলফোন নেই এমন লোকজন আর চোখে পড়ে না আজকাল।
“মুক্তাররে কইবেন আমি সামনের হপ্তায় বাড়ি আইতাছি…ওর সব ত্যাজ আমি পুটকি দিয়া ভইরা দিমু!” রেগেমেগে বললো রিক্সাওয়ালা। তার প্যাডেল মারার গতি এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। গতি জড়তার কারণে রিক্সাটা ঢিমেতালে এগিয়ে যাচ্ছে।
বিরক্ত হয়ে রাস্তার ডান দিকে তাকালো ছফা। প্রচুর গাড়ি-বাস-রিক্সা। পুরো শহরের মানুষ যেন রাস্তায় নেমে পড়েছে। পহেলা বৈশাখ মানেই ঘর থেকে বের হওয়া-তারপর রমনা-শাহবাগসহ শহরের কিছু জায়গায় সারাদিন টো টো করে বাড়ি ফেরা। এসব অল্প বয়সী ছেলেছোকরাদেরকে মানায়, বুড়ো খোকাখুকিরাও যোগ দেয়, কিন্তু ছফার কাছে এখন এটা একেবারেই হাস্যকর লাগে।
মুচকি হেসে সিগারেটে জোরে টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়লো সে। রোদের উত্তাপ বেড়ে গেছে, টের পেলো শরীর ঘামতে শুরু করেছে। সূর্যের আলো থেকে চোখ বাঁচাতে এক হাত কপালে ঠেকিয়ে যে-ই না ডান দিকে তাকালো অমনি কিছু একটা ধরা পড়লো তার চোখে।
তার রিক্সার পাশেই একটি প্রাইভেট কার, গাড়ির কাঁচ স্বচ্ছ বলে স্পষ্ট দেখতে পেলো পেছনের সিটে বসে থাকা একমাত্র যাত্রিকে।
আজকের দিনের অনেক মহিলা-তরুণীর মতোই লাল পেড়ে সাদা শাড়ি, খোঁপায় বেলিফুলের মালা, কপালে লাল টিপ, গলায় একটি মাটির তৈরি হার-পহেলা বৈশাখের সাজে। তবে চোখে সানগ্লাস আছে।
নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারলো না ছফা। একটু ঝুঁকে তাকালো। সে। তার রিক্সা আর প্রাইভেটকারটি এখন পাশাপাশি আছে। ট্রাফিক সিগন্যাল পড়ে গেছে বলে থেমে আছে সব যানবাহন।
একমাত্র যাত্রি সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। ছফাকে লক্ষ্যই করেনি।
মুশকান জুবেরি! তার মতোই ফিরে যাচ্ছে রমনা থেকে?
ছফা টের পেলো তার সমস্ত রোমকূপ দাঁড়িয়ে গেছে। কিন্তু সে কিছু করার আগেই গাড়িটা আস্তে করে এগিয়ে গেলো সামনের দিকে। এদিকে ছফার রিক্সাওয়ালা পারিবারিক ঝগড়া-ফ্যাসাদ নিয়ে উত্তেজিত, গালাগালি করে যাচ্ছে মোবাইলফোনে, গতি বাড়ানোর দিকে তার কোনো খেয়াল নেই। ছফা তার পিঠে চাপড় মেরে তাড়া দিলো। একবার মনে হলো রিক্সা থেকে নেমে দৌড় দেবে কিনা, কিন্তু গাড়িটা ততোক্ষণে অনেক দূর চলে গেছে।
যেনো মরিচীৎকার মতো ছিলো পুরো দৃশ্যটি-ধরা দিয়েই উধাও!
রিক্সাওয়ালাকে আবারো তাড়া দিলে আরেকটু জোরে প্যাডেল মারলো কিন্তু হতাশ হয়ে ছফা দেখতে পেলো, তার দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে গাড়িটা।
আক্ষেপে চোখমুখ বিকৃত হয়ে গেলো তার। গাড়িটা ধরতে পারেনি বলে নয়, বরং একটি মূল্যবান জিনিস খেয়াল করেনি!
.
অধ্যায় ২
টাইটা আলগা করে নিলো আশেক মাহমুদ, ড্রাইভারকে বললো গাড়ির এসিটা বাড়িয়ে দিতে।
“জি, স্যার,” তার আদেশ পালন করার আগেই বললো ড্রাইভার।
আজকাল তার প্রায় সব আদেশ-নির্দেশের বেলায়ই এই আনুগত্যপূর্ণ ‘জি স্যার’ বলা হয়। এখন যে সিস্টেমের অংশ, সেখানে স্যার-ম্যাডাম মাননীয় বলাটা অলঙ্ঘনীয় আচার। মুচকি হাসলো আশেক মাহমুদ। এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে সে।
ক্ষমতা!
এ কয় বছরে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা একজন মানুষ হিসেবে সে বুঝে গেছে, এটার উত্তাপ কতোটা তীব্র হতে পারে। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত সচিব সে। চাইলে যেকোনো মন্ত্রী-এমপিকেও মৃদু বকাঝকা করার ধৃষ্টতা দেখাতে পারে। এই তো, আজ বিকেলেই, অফিস থেকে বের হবার ঘণ্টাখানেক আগে বিরাট বড় এক শিল্পপতিকে যা-তা ভাষায় ভর্ৎসনা করেছে। জঘন্য একটা আব্দার করেছিলো লোকটি। তার আদরের ভাগ্নে কাজের মেয়েকে ধর্ষণ করে হত্যা করার পর হাতেনাতে রক্তাক্ত বটিসহ গ্রেফতার হয়েছে। এখন চিফ মেট্রোপলিটন কোর্টকে একটু বলে দিলেই ভাগ্নেটা জামিন পেয়ে যাবে-কষ্ট করে আর জেল খাটতে হবে না। বিচার বিচারের মতো চলুক, সেটা পরে ‘দেখা’ যাবে।
আশেক মাহমুদ যে নৈতিকতার পরাকাষ্ঠা, তা নয়। কোনো তদবিরে যে সাড়া দেয় না সেটাও বলার উপায় নেই। এই কয় বছরে কেবল ঢাকাতেই কিনেছে তিনটি ফ্ল্যাট, কানাডাতেও আছে একটি। ব্যাঙ্ক-ব্যালান্স হিসেব করলে এক-দেড়শো কোটি টাকার কম হবে না। এসবই হয়েছে দেশের ধনিকশ্রেণির কাছ থেকে পাওয়া ‘উপহার’-এর বদান্যতায়। সে এমন একটি পদে আছে, যেখানে কিছু চাইতে হয় না, চাওয়ার আগেই প্রাপ্তি এসে বসে থাকে তার কোলে। কিন্তু হত্যা-ধর্ষণের মতো ঘটনা থেকে লাভবান হবার কোনো ইচ্ছে তার নেই। কী দরকার, মোটা অঙ্কের ট্রানজাকশানের বিনিময়ে এসব কাজ করে বিবেকের দংশন ডেকে আনা! তার মধ্যে এখনও এসব ব্যাপার-স্যাপার রয়ে গেছে। অতো নীচে নামা সম্ভব হয়নি।
অভাবি একটা মেয়ে, যার তিনকূলে কেউ নেই, পেটের দায়ে শহরে এসে মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করতো, তাকে ধর্ষণ করে হত্যা করা হয়েছে আর সেটা করেছে বড়লোকের বখে যাওয়া এক কুলাঙ্গার। সেই কুলাঙ্গারের মামা যতো বড় টাকার কুমিরই হোক না কেন, তার আব্দারে সাড়া দেবে না।
হয়তো তার এমন পণ করার কারণও আছে। আজ সকালে একটা ফোন পাবার পর থেকে নিজের ভাগ্নের কথা খুব মনে পড়ে যাচ্ছিলো বার বার। নিরীহ আর দ্র একটা ছেলে, অথচ তাকেই কিনা বরণ করে নিতে হলো নির্মম পরিণতি! তার মতো ক্ষমতাবান মামা থাকতেও নিরাপরাধ ভাগ্নের অন্তর্ধান রহস্য বের করে অপরাধীকে শাস্তি দেয়া সম্ভব হয়নি। আর এদিকে, এক শিল্পপতির লম্পট ভাগ্নে ধর্ষণ-খুন করেও পার পেয়ে যাবে টাকার জোরে!
যাই হোক, প্রত্যাখ্যাত হয়ে শিল্পপতি মামা ‘ক্ষমতায় গেলে মানুষ কিভাবে বদলে যায়’ বহুল ব্যবহৃত সেই আপ্তবাক্য ঝেড়ে দু-কথা শুনিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলো টেলিফোনে। দুমুখ হিসেবে যথেষ্ট পরিচিতি আছে এই লোকের। তার ‘বিখ্যাত’ ব্যবহারের কথাও সবার জানা। কিন্তু আশেক মাহমুদের বসবাস ক্ষমতার পিরামিডের একদম শীর্ষবিন্দুর কাছে। এরকম একজনকে তোয়াক্কা না করলেও সে পারে। লোকটার ইতিহাসও তার ভালো করেই জানা আছে-গণ্ডগ্রামের এক বেয়াড়া যুবক, অতীষ্ঠ করে তুলেছিলো গ্রামের লোকজনের জীবন। শেষে, গ্রামের মসজিদে বসা এক সালিশে জুতাপেটার মতো অবমাননাকর শাস্তি দেয়া হয় তাকে। ঐ ঘটনার রাতেই, প্রতিশোধ হিসেবে মসজিদের দানবাক্স ভেঙে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিয়ে চলে আসে ঢাকা শহরে।
আজব এক শহর ঢাকা। হাজার হাজার গলি ঘুপচি এখানে-সবগুলো দৃশ্যমান নয় সবার কাছে। কোটা দিয়ে ঢুকলে টাকার খনির সন্ধান পাওয়া যাবে সেটা জানা থাকলে এখানে ‘বড়লোক হওয়া দুনিয়ার সবচেয়ে সহজতম কাজ। পৃথিবীর আর কোথাও মসজিদের দানবাক্স চুরি করা পুঁজি দিয়ে কোনো লোক মাত্র দশ বছরে শিল্পপতি হতে পেরেছে কিনা আশেক মাহমুদের জানা নেই।
যাই হোক, লোকটার অতীত নিয়ে তীর্যক কথা বলেই শুরু করেছিলো সে। তারপর ঢাকা ক্লাবে জুয়া খেলা, মদের আড্ডায় বেসামাল হয়ে পড়া আর নিত্যনতুন নারীসঙ্গের কথাও বাদ দেয়নি। ফোনালাপটি শেষ করেছিলো এই বলে : “আমি যততদিন আছি, আপনি কিভাবে পিএমের অফিসে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পান দেখে নেবো। দেখি, কী বালটা ফেলতে পারেন!”
বলাবাহুল্য, মসজিদের টাকা চুরি করা চোরটা আর কথা বাড়ায়নি। আশেক জানে, বদমাশটা এখন ভাগ্নেকে বাঁচানোর জন্য সরাসরি ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করবে। ওই রাস্তাটাও সে বন্ধ করে দিয়েছে জায়গামতো ফোন করে।
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার ভেতর থেকে। চোখের সামনে জন্ম নেয়া তার নিজের ভাগ্নে হাসিবের কথা ভাবলো। অফুরন্ত সম্ভাবনা ছিলো ছেলেটার। চুপচাপ, শান্তশিষ্ট। কারো সাতে-পাঁচে নেই। ইউরোপ আমেরিকায় বসবাস করার সুযোগ পেয়েও দেশে থেকে গেছিলো কীসের টানে কে জানে! নিজের মতোই থাকতো। স্বাবলম্বী আর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন একটি ছেলে। ক্ষমতাবান মামার কাছেও কোনোদিন কিছু চায়নি, কোনো তদবির নিয়ে আসেনি কখনও। এরকম নম্ৰদ্র আর নির্বিবাদি ছেলেরও যে শত্রু থাকতে পারে, কে জানতো!
গাড়িটা গুলশান দুই নাম্বারে ঢুকতেই অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেলো প্রধানমন্ত্রীর পিএস। আর মাত্র কয়েক মিনিট পরই বিব্রতকর একটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে তাকে।
.
অধ্যায় ৩
হাড্ডিসার বয়স্ক যে বৃদ্ধা বিছানায় শুয়ে আছে তার চোখে মৃত্যুর ছায়া সুস্পষ্ট।
পাশে বসে থাকা হাউজনার্স মেয়েটি আরো একবার হাই তুললো। মেয়েলী কোনো ম্যাগাজিনে চোখ বুলাচ্ছে সে। সারা রাত জেগে থেকে এই রোগীর কষ্ট-যন্ত্রণা উপশম করার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র দিতে হয় তাকে। মোবাইলফোন বের করে ফেসবুকে ঢু মারতে ইচ্ছে করলেও উপায় নেই-এই রোগী এটা বরদাশত করতে পারে না। কয়েক দিন আগে মহিলা ঘুমিয়ে পড়লে সে ফোন বের করে ফেসবুকে লগিং করতে গেছিলো, আর অমনি চোখ খুলে ফেলে রোগী। দুর্বল গলায় কিন্তু কঠিন স্বরে বলে দেয়, তার সামনে যেনো কখনও এ কাজ না করে। এমন কি, এ ঘটনার পর তাকে টিটকারি মেরে ফেবুন্নেসা নামেও ডেকেছিলো কয়েকটা দিন। সম্ভবত, অজানা কোনো কারণে ফেসবুক জিনিসটা সহ্যই করতে পারে না বুড়ি।
মহিলার ঘুম একদম পাতলা। এই পর্যায়ে এসে ঘুম বলে কিছু নেই আর তার মধ্যে। চোখে আই মাস্ক পরে নিথর দেহটা নিয়ে পড়ে থাকে, সম্ভবত মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করে। একটু আগে ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টানোর শব্দেও একবার নড়েচড়ে উঠেছিলো তবে কিছু বলেনি, আবারও স্থির হয়ে গেছে।
হঠাৎ পারফিউমের গন্ধ টের পেয়ে হাউজ নার্স জেবুন্নেসা ফিরে তাকালো দরজার দিকে, সঙ্গে সঙ্গে ম্যাগাজিনটা রেখে উঠে দাঁড়ালো সে। তার নিয়োগকর্তা, এ বাড়ির মালিক দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে।
“স্যার–”
হাত তুলে মেয়েটাকে থামিয়ে দিলো আশেক মাহমুদ, তারপর ধীরপায়ে এগিয়ে এলো বিছানার কাছে। “কখন ঘুমিয়েছে?” একেবারে ফিসফিসিয়ে জানতে চাইলো সে।
“এই তো–” মেয়েটা নীচুকণ্ঠে জবাব দিতে গিয়ে থমকে গেলো।
“আমি ঘুমাইনি,” বৃদ্ধা বলে উঠলো ঘরের দু-জনকে অবাক করে দিয়ে। “আমার কি আর ঘুম আসে!” চোখ থেকে আই-মাস্কটা কপালের উপর তুলে দিলো রোগী।
বোনের দিকে চেয়ে রইলো আশেক মাহমুদ। তার ইচ্ছে করছে চোখ সরিয়ে ফেলতে, এককালের রূপবতি বড়বোনের এমন করুণ অবস্থা দেখতে চায় না।
“বুবু, কেমন আছো?” প্রশ্নটা করার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝতে পারলো ভুল হয়ে গেছে। মৃত্যুপথযাত্রি কাউকে এ প্রশ্ন করা অনেকটা তামাশার মতোই শোনায়।
এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলে বৃদ্ধার মুখে। “এখনও মরিনি,” বেশ ক্ষীণ আর দুর্বল কণ্ঠে বললো। “তবে আজ সকালে মনে হচ্ছিলো দুপুর পর্যন্ত দুনিয়ার আলো দেখে যেতে পারবো না।”
আশেক মাহমুদ চুপচাপ তার বোনের শিয়রে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো। হাউজনার্স মেয়েটি বুঝতে পারছে না তার এখন চলে যাওয়া উচিত কিনা, চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে সে।
“তুমি যাও,” বেশ মৃদু কণ্ঠে নার্সকে বললো রোগী। “রেস্ট নাও।”
মেয়েটা ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।
বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো আশেক মাহমুদ। “খুব ব্যস্ত ছিলাম, বুবু। পিএম আজকে বিকেল পর্যন্ত অফিস করেছেন…নইলে…”
“বুঝেছি রে!” একটা নিশ্বাস ফেলে বললো বৃদ্ধা। “কিন্তু আমার মনে হচ্ছিলো দুপুরের পর আর…”
আশেক মাহমুদের বলতে ইচ্ছে করছিলো-বুবু, এভাবে বোলো–কিন্তু কিছুই বললো না সে। বড়বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো পরম মমতায়। তার মনে পড়ে যাচ্ছে, ছেলেবেলায় ঠিক এভাবে তার বুবু কতোবারই না তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। তার চেয়ে মাত্র দশ বছরের বড় এই বোন অকালে মাতৃহারা আশেককে সন্তানের মতো কোলেপিঠে মানুষ করেছে। মায়ের সবটা আদর আর ভালোবাসা পেয়েছে। এই বোনের কাছ থেকেই।
“আমি যেকোনো সময় চলে যাবোরে, আশেক!”
বোনের এমন কথায় কেবল ফ্যালফ্যাল চোখে চেয়ে থাকলো পিএস।
“আমার মন বলছে কাল সকালটা দেখতে পারবো না।”
আশেক মাহমুদের চোখ ছল ছল করে উঠলো। এরকম মুহূর্তে সান্ত্বনা দেয়া, কিছু একটা বলে প্রবোধ দেয়ার মতো স্বভাব কোনো কালেই তার ছিলো না। জোর করে দিতে গেলে হিতে বিপরীত হয়ে যায়। সে বরং এমন সময় চুপ করে থাকে। যদিও এ মুহূর্তে তার চোখদুটো অবাধ্য হয়ে উঠেছে, ঠেলেঠুলে বের হয়ে আসতে চাইছে অশ্রু।
“গতরাতে হাসিবকে স্বপ্নে দেখেছি। আমাকে বলছিলো, তুমি আসছো না কেন, মা? এত দেরি হচ্ছে কেন আসতে!”
পিএস নিশ্চুপ রইলো। দেশে ফিরে আসার পর থেকেই তার বুবু এরকম কথা বেশ কয়েকবার বলেছে। কানাডায় থাকার সময় যখন। মরণব্যাধি ক্যান্সার ধরা পড়লো তখন তার মাতৃসম বড়বোন সিদ্ধান্ত নিলো নিকটাত্মীয়দের মধ্যেই বাকি সময়টা কাটাবে, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করবে জন্মভূমিতেই।
বোনকে কোনো কিছু বলে সান্ত্বনা দিতে পারছে না বলে নিজের কাছেই লজ্জিত আশেক। রাজনীতির মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কেন যে এসব কায়দা কানুন এখনও শিখতে পারলো না, সেটা ভেবে অবাকই হয় সে।
“ভেবেছিলাম মৃত্যুর আগে হাসিবের কী হয়েছিলো সেটা জেনে যেতে পিরবো,” ক্যান্সারের রোগী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো।
সম্বিত ফিরে পেয়ে তাকালো প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব।
“আমি জানি আমার ছেলেটা আর বেঁচে নেই,” কথাটা বলে উদাস হয়ে তাকালো হাসিবের মা। “কিন্তু তার কী হয়েছিলো? কে আমার এতো বড় সর্বনাশ করলো…জেনে যেতে পারবো না!” একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো।
এবার আশেকের কিছু বলার পালা কিন্তু গলার কাছে একটা গিট আটকে আছে যেনো।
“তুই আমাকে কিছু না বললেও আমি বুঝতে পারিরে, বুল্লা!”
ছোটোবেলার আদুরে ডাকটা অনেকদিন পর শুনতে পেয়ে আশেক মাহমুদ প্রবল আবেগে আক্রান্ত হলো, ছলছল চোখে চেয়ে রইলো বোনের দিকে। হাসিবের কী পরিণতি হয়েছে, কে তার জন্য দায়ী সেটা জানার পর পরই সে জানতে পারে তার বোনের শরীরে বাসা বেধেছে মরণব্যাধি ক্যান্সার। এমনিতেও খবরটা দিতো কিনা সন্দেহ ছিলো তার মনে, তবে ক্যান্সারের সংবাদ শোনার পর আর কোনো দ্বিধা থাকেনি। পুরো ব্যাপারটা চেপে যায় সে। তদন্ত হচ্ছে…কিন্তু কোনো কূলকিনারা করতে পারছে না তদন্তকারী অফিসার-এমন কথা বলে বোনকে প্রবোধ দিয়েছিলো।
“আমার এই অবস্থায় হয়তো খারাপ খবরটা জানাতে চাসনি,” আশেকের বুবু আস্তে করে বললো। “কিন্তু বিশ্বাস কর, আমি ধরেই নিয়েছি আমার হাসিব আর নেই।” একটু থেমে দম নিয়ে নিলো মহিলা। “আমি শুধু জানতে চাই, আমার বুকটা কে খালি করেছে। কে এতো বড় সর্বনাশ করলো…কেন করলো!”
আশেক বোনের দিকে চেয়ে রইলো একদৃষ্টিতে। তার বুবুর দুচোখের কোণ দিয়ে আস্তে করে গড়িয়ে পড়লো অশ্রু। দু-হাতে বোনের হাতটা ধরে নিজের গালে ঠেকালো সে।
“বিশ্বাস কর, বুল্লা…তুই যা ভাবছিস আসলে ঘটনা সেরকম কিছু না।”
কথাটার মানে বুঝতে না পেরে চেয়ে রইলো আশেক মাহমুদ। ঢোঁক গিলে কোনোমতে বললো সে, “কী বলছো, বুবু? কীসের ঘটনা?”
“এই যে…হাসিবের খারাপ পরিণতির কথা জানতে পারলে আমি খুবই কষ্ট পাবো।”
মাথা দোলালো পিএস।
“এই কয়েক বছরে প্রতিটি মুহূর্তে মা হিসেবে আমি যে কষ্ট পেয়েছি সেটা কোনো কিছুর সাথে তুলনা করা যাবে না। কষ্ট পেতে পেতে আমি প্রায় অবশ হয়ে গেছি, নতুন করে আর কী কষ্ট পাবো!” একটু দম নিয়ে নিলো বৃদ্ধা। “আসলে কী, জানিস?” ছোটোভায়ের কাছ থেকে কোনো জবাবের অপেক্ষা না করেই বললো, “সত্যিটা না জেনে, অপরাধীকে শাস্তি পেতে না দেখে এই পৃথিবী ছেড়ে যেতেই বরং ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আমার।”
আশেক একটা দ্বন্দ্বে পড়ে গেলো। মনে হচ্ছে বোনকে অন্তিম মুহূর্তে সবটা বলে দেয়াই ভালো, মা হিসেবে এটা জানার অধিকার সে রাখে। আবার একইসাথে এটাও মনে হচ্ছে, খবরটা জানতে পারলে এই শেষ সুময়ে, ক্যান্সারের ছোবলে যখন যন্ত্রণাকাতর সময় পার করছে তখন তার কষ্ট বাড়িয়ে দেবার কোনো মানেই হয় না।
কেমো থেরাপি দেবার কারণে সব চুল পড়ে গেছে। মাথায় পরে আছে। একটা স্কার্ফ। এককালের সুন্দর ভুরুজোড়া এখন প্রায় নেই বললেই চলে। হাড্ডিসার হাতটায় কোনো শক্তি আছে বলে মনে হচ্ছে না। তারপরও হঠাৎই আবিষ্কার করলো, দুর্বল হাতটা আলতো করে চেপে ধরার চেষ্টা করছে। হয়তো তাগিদ দিচ্ছে তাকে, অনুনয় করছে!
“বুবু,” অবশেষে বলতে পারলো আশেক মাহমুদ। “হাসিব নিখোঁজ হবার পর যখন পুলিশ কিছু বের করতে পারলো না তারপরই আমি ডিবির এক ইনভেস্টিগেটরকে দিয়ে কেসটা তদন্ত করিয়েছিলাম।”
তার বুবু স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো, সবটা শোনার জন্য উন্মুখ সে।
“খুবই মেধাবি ইনভেস্টিগেটর সে,” একটু থেমে ঢোঁক গিলল। “ঐ অফিসার আপ্রাণ চেষ্টা করে খুব দ্রুত বের করতে পেরেছিলো হাসিব কোথায় গিয়ে উধাও হয়েছিলো।”
আশেক মাহমুদ টের পেলো তার বুবুর হাত আরো শক্ত করে ধরে আছে তার হাতটা, দৃষ্টি চঞ্চল হয়ে উঠেছে।
“ঢাকা থেকে সুন্দরপুর নামের এক মফস্বল শহরে গেছিলো হাসিব,” কথাটা বলে চুপ মেরে গেলে আশেক।
“কেন?” উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলো তার শয্যাশায়ী বোন। “ওখানে কেন গিয়েছিলো হাসিব?!”
“একজনের সাথে দেখা করতে।”
“কার সাথে?”
“এক মহিলার সাথে।”
“মহিলা??” বিস্মিত হলো ক্যান্সারের রোগী।
মাথা নেড়ে সায় দিলো আশেক মাহমুদ। “রহস্যময়ী এক মহিলা। খুবই ভালো একজন কুক…অসাধারণ সব খাবার নাকি রান্না করতো।”
“একজন কুকের সাথে দেখা করতে গেছিলো হাসিব?!” অবিশ্বাসের সুরে জানতে চাইলো আশেকের বুবু। যে দুচোখে মৃত্যুর স্থায়ী ছাপ পড়ে গেছে, তাতে এখন অপার বিস্ময়।
“মহিলা ওখানে একটি খাবারের রেস্টুরেন্ট দিয়েছিলো…খুবই সুস্বাদু খাবার পাওয়া যেত…হাসিব ওখানেই গেছিলো শেষবার। শুধু এটুকুই জানা গেছে।”
“তুই আমার কাছ থেকে কিছু লুকাচ্ছিস। ঠিক করে বল, ঐ মহিলার সাথে হাসিব কেন দেখা করতে গেছিলো? খাওয়ার জন্য নিশ্চয় সে যায়নি? আর যদি খেতেই গিয়ে থাকে তাহলে ফিরে এলো না কেন!”
আশেক মাহমুদ আলতো করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। “আসল সত্যটা ঐ অফিসারও বের করতে পারেনি, তবে তার ধারণা, হাসিবের সাথে ঐ মহিলার পরিচয় হয়েছে ফেসবুকে, তাদের মধ্যে এক ধরণের ঘনিষ্ঠতাও তৈরি হয়েছিলো।”
ফেসবুকের কথা শুনে তিক্ততায় মুখ বিকৃত হয়ে উঠলো হাসিবের মায়ের। এই ফালতু জিনিসটা মানুষকে মানুষের কাছে এনে দেবার প্রতিশ্রুতি দেয় কিন্তু কাজ করে ঠিক উল্টোটা। কাছের মানুষদের দূরে সরিয়ে, দূরের মানুষকে কাছে এনে মিথ্যে এক জগত তৈরি করে, আর দিন দিন সেই জগতে বন্দী হয়ে পড়ছে মানুষজন। কানাডায় যখন মেয়ের কাছে ছিলো, দেখেছে, তার টিনএজার নাতি-নাতনিরা সারাদিন ডুবে থাকে এই ফেসবুক নিয়ে, নানির খোঁজ নেবারও সময় পেতো না। কিন্তু যেদিন অসুস্থ নানির সাথে সেল্ফি তুলে তার নাতি-নাতনিরা ফেসবুকে পোস্ট দিলো ‘প্রে ফর মাই গ্র্যান্ডমাদার,’ সেদিনই আর্জুমান্দ বেগম বুঝে গেছিলো, পৃথিবীটা আসলেই রসাতলে তলিয়ে গেছে।
গভীর করে দম নিয়ে বললো বৃদ্ধা, “ঠিক আছে, হাসিব ঐ মহিলার সাথে দেখা করতে গেছিলো…এর সাথে তার নিখোঁজের কী সম্পর্ক? কী এমন ঘটনা ঘটেছে…ওখানে গিয়ে সে আর ফিরে এলো না?”
বুবুর দিকে চেয়ে রইলো আশেক মাহমুদ। তারপরই মিথ্যেটা বললো, “সেটা তো জানা যায়নি, তবে ঐ অফিসার মনে করছে, মহিলা কোনো চক্রের সাথে জড়িত।”
“কীসের চক্র?”
বলতে একটু ইতস্তত করলো আশেক। “মহিলা এক সময় ডাক্তার ছিলো, বুবু। পরে কোনো এক কারণে চাকরি ছেড়ে দেয়। বয়সে বড়, এক ধনী লোককে বিয়ে করে অগাধ সম্পত্তির মালিক বনে যায় সে। ঐ লোকের পূর্বপুরুষেরা সুন্দরপুর নামে এক এলাকার জমিদার ছিলো।”
“কিন্তু ঐ মহিলা কেন হাসিবকে…” কথাটা বলতে গিয়েও বলতে পারলো না। কারণ কী? কীসের জন্য সে এটা করলো? টাকার জন্য নিশ্চয় এ কাজ করেনি সে?”
মাথা দুলিয়ে জবাব দিলো আশেক মাহমুদ। “জানি না, বুবু।” বোনের চোখের দিকে তাকাতে পারছে না সে। যদিও নুরে ছফা তাকে বলেছিলো, মহিলা সম্ভাব্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পাচারকারী দলের সদস্য কিন্তু মৃত্যুপথযাত্রি বোনকে সে কথা বলা মানেই স্বাভাবিকভাবে তার মনে কিছু ভয়ঙ্কর দৃশ্যকল্প উসকে দেয়া। বিভৎস সেই দৃশ্য। এমন নিদারুণ যন্ত্রণার মধ্যে, নিজের সন্তানকে নিয়ে ওরকম কিছু ভাবা নিশ্চয় সুখকর হবে না।
কয়েক মুহূর্ত নীরবতায় কেটে গেলো, তারপর সেই অসহ্য নীরবতা ভাঙলো আশেক মাহমুদ নিজেই। “রহস্যময়ী এক নারী। পেশায় মেডিকেল ডাক্তার।” আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার বললো পিএস, “আসল নাম মুশকান সোহেলি, বিয়ের পর হয়ে যায় মুশকান জুবেরি। দীর্ঘদিন আমেরিকায় থাকলেও এক সময় দেশে চলে আসে, ঢাকার এক হাসপাতালে চাকরি নেয়। ঐ ইনভেস্টিগেটর আমাকে শুধু এটুকুই জানাতে পেরেছে, বুবু।” পরক্ষনেই পিএস টের পেলো তার বোনের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরেছে তার হাত। অবাক হয়ে ফিরে তাকালো বোনের দিকে।
আর্জুমান্দ বেগমের নিষ্প্রাণ চোখের মণিদুটো শুধু জ্বল জ্বলই করছে না, দুটো ছোট্ট বিন্দু যেনো অস্থির হয়ে লাফাচ্ছে শূন্যে! রাগে না ক্ষোভে, বুঝতে পারলো না। রীতিমতো কাঁপতে শুরু করেছে কঙ্কালসার হাতটি।
.
অধ্যায় ৪
আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার একজন সদস্য হিসেবে প্রায় এক যুগ ধরে কাজ করে গেলেও কখনও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢোকার সৌভাগ্য হয়নি নুরে ছফার।
ক্ষমতার একেবারে কেন্দ্রভূমি এই অফিসটির ছোটোখাটো কর্মচারী থেকে শুরু করে প্রায় সবাই কমবেশি ক্ষমতার দম্ভ আর প্রকাশ ঘটিয়ে থাকে। তাদের মধ্যে সবচাইতে ক্ষমতাবান হলো প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত সচিবের পদটি। এটা পেতে মারাত্মক রকমের লবিং করা হয়, মরিয়া হয়ে ওঠে শাসকদলের ভেতরে নানান গোষ্ঠি আর চক্র। যারা এখানে কাজ করার সুযোগ পায় তারা ধরেই নেয়, এটাই তাদের সারা জীবনের সবচাইতে বড় সাফল্য-বিশেষ করে ক্ষমতা আর অর্থোপার্জনকেই জীবনের সবচাইতে বড় সফলতা হিসেবে গণ্য করে যারা।
এ মুহূর্তে নুরে ছফা বসে আছে এরকমই একজন সফল মানুষ, প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত সচিবের অফিসে। ভদ্রলোক কী একটা কাজে ব্যস্ত আছে। একজন আরদালি এসে তাকে এক কাপ চা দিয়ে বলে গেছে, আরেকটু অপেক্ষা করতে হবে, একটু পরই চলে আসবেন পিএস।
ছফা যথেষ্ট অবাক হয়েছে আজকের এই কলটির জন্য। এর আগে, সুন্দরপুর থেকে যখন মুশকান জুবেরিকে ধরতে না পেরে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলো তখন প্রথমবারের মতো প্রধানমন্ত্রীর এই ব্যক্তিগত সচিবের সাথে দেখা করেছিলো তার নিজের অ্যাপার্টমেন্টে। ভদ্রলোক তার মুখ থেকেই জানতে চেয়েছিলো তদন্তের কী অবস্থা।
হাসিব নামের এক নিখোঁজ ছেলের মামা, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব কেটার তদন্ত করতে বলেছিলো ডিবিকে নির্দিষ্ট করে বলে দিয়েছিলো, নুরে ছফা যেনো কেসটা দেখে। ফলে ওখান থেকে ফিরে আসার পর তার কাছ থেকেই সবটা শুনতে চেয়েছিলো ভদ্রলোক। তবে ছফা পুরো ঘটনাটা বলেনি। সব কিছু বিবেচনায় নিলে, এটা কাউকে বলাও সম্ভব ছিলো না। তাই সে বলেছিলো, নিখোঁজ হাসিবের শেষ গন্তব্যস্থল ছিলো ঢাকা থেকে বহু দূরে, সুন্দরপুরে অদ্ভুত নামের একটি রেস্টুরেন্টে। রেস্টুরেন্টের মালিক মুশকান জুবেরি নামের রহস্যময়ী এক মহিলা। ছফা তদন্ত করে দেখেছে, ফেসবুকে এই মহিলার সাথে হাসিবের পরিচয় হয়েছিলো।
তাহলে ওখানে যাবার পর হাসিব কেন নিখোঁজ হলো?
এমন প্রশ্নের জবাবে ছফা তাকে জানায়, এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত নয়, তাই জোর দিয়ে কিছু বলতে পারছে না। তার কাছে শক্ত কোনো প্রমাণও নেই, হাসিব নামের ছেলেটি কী ভাগ্য বরণ করেছিলো। তবে মুশকান জুবেরির ব্যাকগ্রাউন্ড চেক করে জানা গেছে, দীর্ঘদিন সে আমেরিকায় ছিলো। পেশায় একজন মেডিকেল ডাক্তার। তখন অবশ্য নাম ছিলো মুশকান সোহেলি। অনেকদিন আমেরিকায় থাকার পর দেশে চলে আসে। ঢাকার একটি প্রাইভেট হাসপাতালে কাজও করেছে বেশ কিছু দিন। তারপর হুট করেই সেই চাকরি ছেড়ে দেয়। গুজব আছে, অনৈতিক কাজের সাথে মহিলা জড়িত ছিলো। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নিজেদের সুনাম বজায় রাখার জন্য পুরো ব্যাপারটা ধামাচাপা দিয়ে দেয়, তাই সত্যিটা বের করা সম্ভব হয়নি।
যাই হোক, ঐ হাসপাতালে কাজ করার সময়ই ক্যান্সারে আক্রান্ত এক রোগীকে বিয়ে করে মহিলা। পঞ্চাশোর্ধ রাশেদ জুবেরি ছিলো উত্তরাঞ্চলের এক জমিদারের একমাত্র বংশধর। ওখানকার বিপুল পরিমাণের স্থাবর সম্পত্তির মালিক ছিলো সে। এভাবে ভদ্রলোকের বিপুল সম্পত্তি করায়ত্ত করে নেয় মহিলা। পেশায় ডাক্তার হলেও মুশকান নামের ঐ মহিলার ঝোঁক ছিলো রান্নাবান্নার দিকে। অসাধারণ একজন কুক। মি. জুবেরি ক্যান্সারে মারা গেলে সুন্দরপুরে রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি নামের অদ্ভুত একটি রেস্টুরেন্ট দেয় সে। তার খাবারের অসাধারণ স্বাদের কারণে ক্রমেই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজন ছুটে যেতে শুরু করে ওখানে। ফলে, মফশ্বল শহর হলেও ঐ রেস্টুরেন্টের সুবাদে ভোজন রসিকদের কাছে সুন্দরপুর হয়ে ওঠে তীর্থস্থানে।
কিন্তু হাসিবের সাথে মহিলার কী সম্পর্ক ছিলো?-প্রধানমন্ত্রীর পিএস আশেক মাহমুদ অধৈর্য হয়ে জানতে চেয়েছিলো ছফার কাছে।
সে জানিয়েছিলো, সম্ভবত ঐ মহিলার সাথে এক ধরণের ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়েছিলো হাসিবের। মহিলা দেখতে যেমন সুন্দরী তেমনি প্রবল ব্যক্তিত্বের অধিকারী।
ঠিক আছে, সুন্দরপুরের এক রহস্যময়ী, সুন্দরী, গুণবতী মহিলার সাথে ফেসবুকে হাসিবের ঘনিষ্ঠতা হলো, তারপর একদিন সেখানে গেলো মহিলার সাথে দেখা করতে-কিন্তু ওখানে যাবার পর কী এমন ঘটনা ঘটলো যে, সে নিখোঁজ হয়ে গেলো? তার আসলে কী হয়েছিলো?
আশেক মাহমুদের কাছ থেকে এমন যৌক্তিক প্রশ্ন যে আসবে সেটা আগে থেকেই জানতো নুরে ছফা। জবাবটাও সে প্রস্তুত করে রেখেছিলো। সে জানায়, খোঁজ নিয়ে জেনেছে, শুধু হাসিবই নয়, এই মুশকান জুবেরি আরো তিন-চারজনকে এভাবে ফেসবুকের মাধ্যমে সখ্যতা তৈরি করে সুন্দরপুরে নিয়ে গেছে…তাদের কারোরই আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
অবাক হয়ে জানতে চেয়েছিলো আশেক মাহমুদ-কেন?
ছফা তখন আরেকটি মিথ্যে বলে-অবশ্য এটা সত্যের অনেক কাছাকাছি : তার ধারণা মুশকান জুবেরি অনেকটা সিরিয়াল কিলারদের মতো, তবে পার্থক্য হলো, সে ভিক্টিমের অগ্যানও কালেক্ট করে।
এ কথা শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেছিলো পিএস। ফ্যাকাশে হয়ে গেছিলো তার চোখমুখ।
ছফা আরো জানায়, স্থানীয় পুলিশ-এমপি সবার সাথে সুসম্পর্ক থাকার কারণে মহিলাকে ধরা কঠিন ছিলো তার পক্ষে। তারপরও সে যখন মুশকান জুবেরিকে তার বাড়িতে গিয়ে হাসিবের ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করতে শুরু করে, তখন মহিলা তার লোকজন দিয়ে ছফাকে পর্যুদস্ত করে ফেলে। ওরা তার অস্ত্রটা কেড়ে নিয়ে তাকে হত্যা করারও চেষ্টা করে। ঐ বাড়ির একটি ঘরে তাকে বন্দী করে রেখে পুরো বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়ে পালিয়ে যায় সেই মহিলা। কিন্তু ভাগ্য ভালো, অল্পের জন্য প্রাণে বেচে গেছে, সেজন্যে সুন্দরপুর থানার ওসি আর ওখানকার এসপি’র কাছে সে কৃতজ্ঞ। তারা সঠিক সময়ে না এলে মারাই যেতো।
ছফাকে এরকম গল্প বলতে হয়েছে বাধ্য হয়েই। কারণ, তার কাছে এমন কোনো প্রমাণ নেই যে, সে বলবে মুশকান জুবেরি মানুষের শরীরের বিশেষ একটি অঙ্গ ভক্ষণ করে নিজের যৌবন দীর্ঘায়িত করে। নির্দিষ্ট সময় পর পর তাকে সেই অঙ্গটি খেতে হয়। এটাতে আসক্ত হয়ে পড়েছে মহিলা। হাসিবসহ আরো কয়েকজন নিখোঁজের ভাগ্যে এমন পরিণতিই ঘটেছে-তারা সবাই মুশকান জুবেরির শিকার। এ কথা শুনে খুব কম মানুষই বিশ্বাস করবে। ভাববে, তদন্তে ব্যর্থ হয়ে, আসামিকে ধরতে না পেরে এমন গালগল্প ফাঁদছে সে। তারচেয়েও বড় কথা, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার একজন সদস্য হিসেবে, পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে কোনো ভিক্টিমের পরিণতি নিয়ে চূড়ান্ত কথা বলা যায় না। মুশকানকে যদি ধরতে পারতো, তার কাছ থেকে জবানবন্দী আদায় করে নিতে পারতো তাহলে নিশ্চিত করে সেটা বলা যেতো। অন্যের জবানবন্দীর উপর ভিত্তি করে এরকম কোনো ধারণা করা ঠিক হবে না।
ছফার কাছে একমাত্র যে প্রমাণটি ছিলো সেটা ডাক্তার আসকার ইবনে সায়িদের স্বীকারোক্তি। সেটাও আবার সরাসরি নুরে ছফার কাছে স্বীকার করেননি তিনি, করেছিলেন ডিবির সাবেক ইনভেস্টিগেটর কেএস খানের কাছে। সেই ডাক্তারও ঘটনার পর পর দেশ ছেড়েছেন। ছফা একবার ভেবেছিলো, নিছক সন্দেহ হিসেবেই কথাটা বলবে কিনা প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিবকে। কিন্তু পরে ভেবে দেখেছে, ভিক্টিমের নিকটাত্মীয় হিসেবে কথাটা শুনে কী রকম অনুভূতি হতে পারে ভদ্রলোকের।
অনেক চেষ্টা করেও মুশকান জুবেরি আমেরিকার কোথায় ছিলো সেটা বের করতে সক্ষম হয়নি নুরে ছফা। তাছাড়া, আন্দিজের ঐ ঘটনায় বেঁচে যাওয়াদের মধ্যে হাতেগোণা যে কয়জন জীবিত আছে এখনও তাদের খোঁজ করাটাও সম্ভব হয়নি তার পক্ষে। এদের বেশির ভাগই বয়সের কারণে মারা গেছে। হাতেগোনা যে কয়জন বেঁচে আছে তারা লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশের নাগরিক। বর্তমানে কে কোথায় আছে কেউ জানে না। তারপরও কাকতালীয়ভাবে একজনকে পেয়ে গেছিলো ফেসবুকে, কিন্তু ভদ্রলোক আলঝেইমার রোগে আক্রান্ত। অতো আগের ঘটনা তো দূরের কথা, সকালে নাস্তা করেছে কিনা সেটাই ভুলে বসে থাকে!
আন্দিজের প্লেন ক্র্যাশে বেঁচে যাওয়া যাত্রিদের নিয়ে পিয়ার্স পল রিড যে বইটি লিখেছেন-অ্যালাইভ : দ্য স্টোরি অব দি আন্দিজ সারভাইভার্স-সেটাকে সূত্র হিসেবে ধরেও কিছুটা খোঁজখবর নেবার চেষ্টা করেছিলো সে। কিন্তু ভদ্রলোক ছফার মেইলের জবাবে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, বেঁচে যাওয়া যাত্রিদের মধ্যে যারা নিজেদের পরিচয় গোপন রাখতে চেয়েছে তাদের ব্যাপারে তিনি কোনো রকম তথ্য দিতে পারবেন না।
“কী ব্যাপার, চা খেলেন না যে?”
নম্রভদ্র কিন্তু কর্তৃত্বপূর্ণ একটি কণ্ঠ শুনে ছফা সম্বিত ফিরে পেলো। তাকিয়ে দেখলো প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত সচিব ঘরে ঢুকেছে। সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো সে।
ভদ্রলোক নিজের ডেস্কে বসে ছফাকেও বসার জন্য ইশারা করলো। “আপনি বোধহয় একটু আগে চলে এসেছেন?”
“জি, স্যার,” বললো নুরে ছফা। “জ্যামের কারণে দেরি হতে পারে বলে একটু আগেভাগে রওনা দিয়েছিলাম, পরে দেখলাম আজকে তেমন একটা জ্যাম নেই।”
“পিএম অফিস শেষ করলেন একটু আগে,” কথাটা এমনভাবে বললো আশেক মাহমুদ, যেনো জবাবদিহির মতো না শোনায়।
ছফা কোনো কিছু না বলে চুপ করে রইলো।
“কাজকর্ম কেমন চলছে?”
“জি, স্যার…ভালোই।”
“ঐ কেসটার আর কোনো ডেভেলপমেন্ট হয়নি বোধহয়, তাই না?”
গভীর করে দম নিয়ে নিলো ছফা। ব্যর্থতার কথা বলতে তার কখনও ভালো লাগে না, জঘন্য রকমের অনুভূতি তৈরি হয়। আর ক্ষমতাবানদের সামনে ব্যর্থতার কথা বললে নিজেকে কেমন তুচ্ছ, অপাংক্তেয় মনে হয় তার।
“কিন্তু কদিন আগে, পহেলা বৈশাখে সম্ভবত এক ঝলক দেখেছিলাম তাকে।” কথাটা বলার কোনো ইচ্ছে না থাকলেও শেষ পর্যন্ত বলে দিলো ছফা। নিজেকে পুরোপুরি ব্যর্থ হিসেবে প্রতিপন্ন করতে চাইলো না। সে যে এই কেসটা নিয়ে এখনও কতোটা মগ্ন হয়ে আছে, কোটা মরিয়া, এই ক্ষমতাবান মানুষটি জানে না, তাকে জানানো দরকার।
বিস্ময়ে ভুরু কপালে উঠে গেলো আশেক মাহমুদের। “আপনি তাকে দেখেছেন!?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো নুরে ছফা। “শাহবাগের দিকে…আমি তখন রিক্সায় ছিলাম…মহিলা একটা প্রাইভেটকারে ছিলো।”
“তারপর?” উৎসুক হয়ে উঠলো পিএস।
“আমি রিক্সায় ছিলাম বলে গাড়িটা ধরতে পারিনি।”
পিএস এখনও উন্মুখ হয়ে আছে বাকি কথাটা শোনার জন্য।
“গাড়ির নাম্বারটা টুকে রাখতে পারিনি উত্তেজনার চোটে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো আশেক মাহমুদ। আরেকবার আশ্বস্ত করার মতো সংবাদ শুনতে না পেয়ে হতাশই হলো। “যাই হোক, আপনি তো এতোদিনেও ঐ মহিলার কোনো ছবি জোগাড় করতে পারেননি?”
মাথা নেড়ে সায় দিতে বাধ্য হলো নুরে ছফা। আশ্চর্যজনক হলেও এটাই সত্যি-মুশকান জুবেরির কোনো ছবি সে জোগাড় করতে পারেনি। যে হাসপাতালে সে কাজ করতো সেখানকার এম্প্রয়ি ফাইল থেকে সব কিছু গায়েব হয়ে যায় মহিলার অন্তর্ধানের পর পর। আর এ কাজটা যে মহিলার ডাক্তার বন্ধু এবং সহকর্মী আসকার ইবনে সায়িদ করেছেন সে-ব্যাপারে তার মনে কোনো সন্দেহ নেই।
“আমি তার ছবি জোগাড় করার অনেক চেষ্টা করেছি,” ছফা বললো। “কিন্তু মহিলা অনেক চতুর, সবখান থেকে নিজের ছবি সরিয়ে ফেলেছে। ছবি থাকলে কাজটা সহজ হতো অনেক।”
“হুম,” গম্ভীর হয়ে মাথা দোলালো একান্ত সচিব। “এ-ব্যাপারে আমার মনেও কোনো সন্দেহ নেই। কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইলো সে। “আপনি বলেছিলেন মহিলা দেখতে বেশ আকর্ষণীয়…সুন্দরী…যেকোনো পুরুষকে কাবু করার মতো?”
“জি, স্যার।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো পিএস। তারপর ডেস্কের ড্রয়ার থেকে একটা এনভেলপ বের করে বাড়িয়ে দিলো ছফার দিকে। “এটা দেখুন।”
একটু অবাক হয়েই ছফা এনভেলপটা হাতে নিলো, খুলে দেখতেই মৃদু একটা ঝাঁকুনি খেলো সে। অবিশ্বাসে ভুরু কুঁচকে গেলো তার।
ছয় বাই দশ হবে। বেশ পুরনো হলেও ছবিটা সাদাকালো নয়-রঙ্গিন। সেই রঙ লালচে হয়ে গেছে।
“চিনতে পেরেছেন?”
আশেক মাহমুদের দিকে পলকহীন চোখে তাকালো নুরে ছফা। “এ এটা তো…” ঢোঁক গিললো সে। “…মুশকান জুবেরি!”
“মুশকান সোহেলি!” দাঁতে দাঁত পিষে বললো পিএস। “এটাই তার আসল নাম।”
ছফা স্থির চোখে চেয়ে রইলো কেবল।
এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে আস্তে করে বললো আশেক মাহমুদ, “মাই গড! তাহলে বুবুর কথাই ঠিক!”
.
অধ্যায় ৫
দুনিয়াটা আসলেই ছোটো!
আশেক মাহমুদ মনে মনে বললো। নুরে ছফার হতভম্ব মুখটা দেখতে তার ভালোই লাগছে।
ছফার ডানহাতে বহুকাল আগের রঙ্গিন ছবিটি, সেই ছবি থেকে তার চোখ সরছেই না। অবিশ্বাসে তার কপালে পড়েছে ঘন ভাঁজ। চোখদুটো প্রায় স্থির, পলক পড়ছে বেশ ধীর গতিতে।
“ঐ মহিলা আমেরিকায় থাকার সময় ভোলা ছবি…কমপক্ষে চল্লিশ পাঁচচল্লিশ বছর আগেকার ছবি।”
ছফা বুঝতে পারলো সে বিপদে পড়ে গেছে। অদ্ভুত রকমের অনুভূতি হতে লাগলো তার। দ্রুত খেলা করে গেলো কিছু ভাবনা। মুখ তুলে তাকালো সে। প্রধানমন্ত্রীর পিএসের মুখে বিজয়ীর হাসি।
“এ ছবি আপনি কোত্থেকে পেলেন, স্যার?”
“অনেক লম্বা গল্প,” বললো আশেক মাহমুদ। “তার আগে বলুন, আপনি এই মহিলা সম্পর্কে আর কী জানেন?”
ছফা নিজেকে ধাতস্থ করে নেবার আপ্রাণ চেষ্টা করলো। দ্রুত ভেবে গেলো পরবর্তী কথাগুলো নিয়ে। সত্যিটা তাকে বিপদে ফেলে দেবে। আর মিথ্যেটা? সে জানে না। তার সামনে যে ক্ষমতাধর ব্যক্তি বসে আছে সে মুশকান জুবেরি সম্পর্কে কতোটুকু জানে, তার কোনো ধারনাই নেই। এই ছবিটাই বা কোত্থেকে জোগাড় করেছে তা-ও বুঝতে পারছে না।
নুরে ছফার আরেকটু সময় দরকার-কী বলবে সেটা গুছিয়ে নেবার। জন্য। “আমি এই কেসটা তদন্ত করতে গিয়ে যতোটুকু জেনেছি সবটাই আপনাকে বলেছি।” অবশেষে নিজের বক্তব্যে স্থির থাকার সিদ্ধান্তই নিলো
সে। কোনো কিছু না-জানাটা দোষের হতে পারে কিন্তু অন্যায় নয়। তবে জেনেবুঝে কোনো কিছু লুকোনোটা ভীষণ অন্যায়-ছফা অবশেষে দুটোর মধ্যে প্রথমটাই বেছে নিলো।
“তাহলে আমি বলবো আপনি আসলে কিছুই জানেন না,” আয়েশ করে নিজের চেয়ারে হেলান দিলো আশেক মাহমুদ।
হাফ ছেড়ে বাঁচলো ছফা। ক্ষমতাধর মানুষেরা তাদের নীচের দিকে থাকা মানুষজনের অযোগ্যতা আর অক্ষমতা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে পারলে এক ধরণের তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলে, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব এখন সেই ঢেঁকুর তুলছে।
“আপনার এই মুশকান জুবেরি-মানে, ডাক্তার মুশকান সোহেলি কোনো অগ্যান পাচারকারী কিংবা সিরিয়াল কিলার নয়,” ঘোষণা দেবার ভঙ্গিতে বললো আশেক মাহমুদ। “অবশ্য আপনার ধারণা পুরোপুরি মিথ্যেও নয়।” ক্ষমতাধর লোকটি বাঁকাহাসি দিলো। “তার কর্মকাণ্ড অনেকটা সিরিয়াল কিলারদের মতোই।”
ছফা আরেকটু আশার আলো দেখতে পেলো। উৎসুক হবার ভান করলো সে।
“আপনি তো তিন বছর আগে তাকে দেখেছেন, তখন তার বয়স কতত ছিলো?”
একটু ভেবে নিলো নুরে ছফা। তিন বছর আগে কী বলেছিলো মনে করার চেষ্টা করলো। মিথ্যে বলতে গেলে যে তুখোড় স্মৃতিশক্তির অধিকারী হতে হয় সেটা আরেকবার টের পেলো হাড়ে হাড়ে। “উমম…ত্রিশ-বত্রিশের মতো হবে?”
আশেক মাহমুদের ভুরু কপালে উঠে গেলো। “তাহলে আপনি অবাক হচ্ছেন না কেন?”
“মানে?” ছফা হুট করেই বলে ফেললো। পরক্ষণেই বুঝতে পেরে মনে মনে নিজেকে ভর্ৎসনা করলো সে। ধ্যাত্ব! এটা তার আগেই বোঝা উচিত ছিলো।
“জি, স্যার…মহিলার মধ্যে তো কোনো পরিবর্তনই দেখছি না?” একেবারে নিদোষ ভঙ্গিতে অবাক হবার ভান করে বললো। আমি তাকে তিন বছর আগে এরকমই দেখেছি…অথচ এই ছবিটা বেশ পুরনো!”
“পঁচাত্তুর সালের দিকে তোলা,” আশেক মাহমুদ জানালো তাকে। “প্রায় তেতাল্লিশ বছর আগেকার…ভাবতে পারেন??”
ছফা চোখেমুখে বিস্ময়ের ভাব আনার চেষ্টা করলো। এই প্রথম অভিনেতাদেরকে ঈর্ষা করলো মনে মনে। এর আগে তাদেরকে জোকার বলেই করুণা করতো। “মাই গড!” বিস্ময়ের মাত্রা বাড়ানোর জন্য ইংরেজিতে বললো এবার। “এটা কী করে সম্ভব!?”
বাঁকাহাসি দিলো আশেক মাহমুদ। “অবিশ্বাস্য ঘটনা…বুঝলেন? কিন্তু এটাই ঘটেছে।”
মাথা দোলালো নুরে ছফা। তার বিশ্বাস হচ্ছে না-এমন একটা ভঙ্গি করার চেষ্টা করলো। “বলেন কী, স্যার!”
“হুম,” আশেক মাহমুদ ডান হাতটা ডেস্কের উপরে রেখে তর্জনি দিয়ে টোকা দিতে শুরু করলো। এখন আমি যেটা বলবো সেটা আপনি বিশ্বাসই করতে চাইবেন না।”
আমাকে আর নতুন করে কী অবিশ্বাস্য গল্প শোনাবেন? মনে মনে বললো সে, কিন্তু মুখের অভিব্যক্তি একেবারেই ভিন্ন। “কী, স্যার?”
“বলবো, তার আগে এক কাপ চা-কফি হয়ে যাক।” আশেক মাহমুদ ইন্টারকমটা তুলে নিলো। “আপনি কি চা নেবেন নাকি কফি?”
সামনে থাকা ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া চায়ের কাপের দিকে চট করে তাকিয়ে বললো নুরে ছফা, “কফি।”
.
অধ্যায় ৬
নুরে ছফার চোখেমুখে সত্যিকারের বিস্ময়ই ফুটে উঠেছে হাসিবের ক্ষমতাধর মামার কাছ থেকে মুশকান জুবেরির আন্দিজের প্লেন ক্র্যাশ আর ক্যানিবালিজমের কথা শোনার পর। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এই ক্ষমতাধর মানুষটি কী করে জানতে পারলো এটা, আর মুশকানের পুরনো ছবিটাই বা কী করে জোগাড় করলো-কিছুই তার মাথায় ঢুকছে না।
“আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, স্যার।” নুরে ছফা নিজেই অবাক হলো, উপযুক্ত পরিস্থিতিতে পড়লে যে, সে-ও দারুণ অভিনয় করতে পারে সেটা বুঝতে পারছে আজ। তবে নিজের সৌভাগ্যকেই কৃতিত্ব দিচ্ছে সে। প্রথমে ভেবেছিলো, তার বলা মিথ্যেগুলো বুঝি ধরা পড়ে গেলো কিন্তু এখন অনেকটা নির্ভার লাগছে।
“আমি যখন প্রথম শুনলাম আমার অবস্থাও আপনার মতোই হয়েছিলো,” এবার সামনের দিকে ঝুঁকে এলো আশেক মাহমুদ। “বিশ্বাসই হতে চাইছিলো না। বিশেষ করে, মহিলা এতোগুলো বছর পরও কী করে নিজের বয়স ধরে রেখেছে!”
নুরে ছফা মাথা নেড়ে সায় দিলো। “সত্যি অবিশ্বাস্য!”
“শেক্সপিয়ার ঠিকই বলেছে, ট্রুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন,” একটু থেমে আবার বললো, “কে বিশ্বাস করবে এসব কথা?!”
কেউ না, স্যার, মনে মনে বলে উঠলো ছফা। আর সেজন্যেই আমি আপনাকে এটা বলিনি। নিজের সিদ্ধান্তের পেছনে আরেকবার শক্তিশালী যুক্তিটা খুঁজে পেলো।
“এই মহিলা আস্ত একটা ডাইনি!” দাঁতে দাঁত পিষে বললো পিএস। “প্লেন ক্র্যাশের পর বাঁচার জন্য নরমাংস খেয়েছিলো, তারপর থেকে এর স্বাদ পেয়ে গেছে। পরবর্তীতে ক্যানিবালিজম প্র্যাকটিস শুরু করে! ভয়ঙ্কর ব্যাপার!”
ছফাও চোখেমুখে অবিশ্বাসের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করলো। “আপনি এসব জানলেন কী করে, স্যার?” প্রশ্নটা না করে আর পারলো না।
চোখেমুখে আমুদে ভঙ্গি ফুটে উঠলো আশেক মাহমুদের। ক্ষমতাধরদের এমন ভঙ্গির সাথে ছফা বেশ পরিচিত-তোমাদের ধারণাও নেই আমার হাত কতো লম্বা-এরকম একটি ভঙ্গি থাকে তাতে।
“হাসিবের মা, আমার বড়বোন…” আস্তে করে বললো আশেক মাহমুদ। “…আপনি হয়তো জানেন না, আমার বুবুর ক্যান্সার ধরা পড়েছে। গত বছর।”
“ওহ্,” কথাটা শুনে সত্যি সত্যি দুঃখিত হলো ছফা। এততক্ষণ ধরে অভিনয় করে গেছে, এখন যেনো কয়েক মুহূর্তের জন্য সেই যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেয়ে স্বস্তি পাচ্ছে।
“আমার এই বোন যুদ্ধের পর পরই স্বামীর সাথে আমেরিকায় চলে যায়। ওখানেই ছিলো দীর্ঘদিন। হাসিব জন্ম নেবার পর বাকি সন্তানসহ তারা আবার চলে আসে দেশে। বুবুর বড় মেয়ে আর ছেলে পড়াশোনা করার জন্য কানাডায় চলে গেলেও হাসিব দেশেই থেকে যায়। আমার দুলাভাই আর বোনও দেশে ছিলো দীর্ঘদিন, কিন্তু দশ বছর আগে তারা চলে যায় তাদের বড় মেয়ের কাছে….কানাডায়।” একটু থেমে আবার বললো, “হাসিব তো বিয়ে-শাদি করেনি, একা থাকতো। বাবা-মাকে টেক কেয়ার করাটা তার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। তাদেরও বয়স হয়ে গেছিলো…দু জনেরই টেক কেয়ারের দরকার ছিলো।”
মাথা নেড়ে সায় দিয়ে গেলো একনিষ্ঠ শ্রোতা নুরে ছফা।
“হাসিব নিখোঁজ হবার দু-মাস পরই আমার দুলাভাই হার্ট ফেইলিওরে মারা যান,” একটু থেমে আবার বললো, “আর গত বছর বুবুর ক্যান্সার ধরা পড়ার পর যখন ডাক্তার জানিয়ে দিলো কোনো আশা নেই, টার্মিনাল স্টেজে আছে রোগটা, তখন বুবু এখানে চলে আসে। এখন উঠেছে আমার বাসায়।” একটু থেমে কফির কাপে চুমুক দিলো পিএস। “আমার ওয়াইফ আবার হাইডেলবার্গ ইউনিভার্সিটিতে গেস্ট লেকচারার হিসেবে কাজ করছে এক বছর ধরে, ফলে তাকে দেখাশোনা করার জন্য সার্বক্ষণিক নার্স রাখতে হয়। আমি তো সারা দিন ব্যস্ত থাকি…বুঝতেই পারছেন।” জবাবদিহি করার মতো শোনালো তার শেষ কথাটা।
আরো একবার মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। তবে সে ভালো করেই জানে, প্রধানমন্ত্রীর পিএস যা বললো তা পুরোপুরি সত্যি নয়। এদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা বহু মানুষ নিজেদের নিরাপদ ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে স্ত্রী-সন্তানকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে। এখনও চলছে সেই ধারা। এদের কর্মকাণ্ডের কারণেই কানাডার মন্ট্রিলের একটি এলাকার নাম হয়ে গেছে বেগমগঞ্জ-সব বেগমদের ঠিকানা! সন্তান-সন্ততি নিয়ে বেগমসাহেবারা উন্নত দেশে নিরাপদ জীবনযাপন করছে আর তৃতীয় বিশ্বের সমস্যাসঙ্কুল, দরিদ্র একটি দেশ লুটপাট করে, চুষে চুষে তাদের পতিদেবেরা স্ত্রী সন্তানদের জন্য স্বর্গীয় আরাম আয়েশের ব্যবস্থা করে যাচ্ছে-এই স্বর্গে স্বামীরাও যোগ দেবে, ক্ষমতা হারিয়ে ফেললে কিংবা রক্ত খাওয়া শেষ হলে।
“কাল বুবু আমার কাছে জানতে চেয়েছিলো, তার ছেলের কেসটার কী অবস্থা।”
সম্বিত ফিরে পেলো ছফা, আবারো মনোযোগ দিলো প্রধানমন্ত্রীর পিএসের কথাবার্তার দিকে।
“বুঝতেই পারছেন, খুব বেশি সময় তো আর নেই,” বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো আশেক মাহমুদ। “বুবু খুব করে চাইছে, তার ছেলের কী হয়েছিলো সেটা জানতে…কে তার এতো বড় সর্বনাশ করলো, কেন করলো।”
“জি, স্যার…এটা খুবই স্বাভাবিক।”
“কিন্তু আমি তো তার এমন অবস্থায় খারাপ কোনো সংবাদ দিতে পারি, পারি কি?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা।
“আমি তাকে শুধু জানালাম, হাসিবের শেষ গন্তব্য ছিলো মুশকান জুবেরির ঐ রেস্টুরেন্টটায়…কী যেনো নাম…রবীন্দ্রনাথ ওখানে…?”
“রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি…” ছফা বলে দিলো।
“হুম। বুবুকে বললাম, সুন্দরপুরের ঐ রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলো হাসিব, তারপর আর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি তার।” একটু থেমে আবার কফির কাপে চুমুক দিলো। “যখন তাকে বললাম, মুশকান কে, কী করে, দীর্ঘদিন আমেরিকায় ছিলো, একজন মেডিকেল ডাক্তার, বিয়ের আগে তার নাম ছিলো মুশকান সোহেলি…তখনই বুবু চমকে ওঠে।”
ছফাও চমকে উঠলো সত্যি সত্যি। “উনি ঐ মহিলাকে চিনতেন?!”
মাথা নেড়ে সায় দিলো আশেক মাহমুদ। “হুম। কী আর বলবো, আমেরিকায় যাওয়ার পর বুবুরা ঐ মহিলারই প্রতিবেশী ছিলো!”
“বলেন কী, স্যার!”
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ভদ্রলোক। “দুনিয়াটা আসলেই ছোটো!”
কাকতাল আর ঘটনাচক্র নিয়ে ছফা বরাবরই অবাক হয় কিন্তু এরকম কাকতালীয় ঘটনার কথা শুনে যারপরনাই বিস্মিত সে। নিজের বিস্ময় আর লুকাতে পারলো না।
“আন্দিজ থেকে বেঁচে যাওয়ার কয়েক বছর পরের ঘটনা এটি,” বললো আশেক মাহমুদ। “মুশকান সোহেলির নরমাংস খাওয়ার কথাটা কিভাবে যেনো বাঙালি কমিউনিটিতে জানাজানি হয়ে গেলে মহিলা রীতিমতো একঘরে হয়ে পড়ে।”
ছফাও আনমনে তার কফির কাপটা তুলে নিলো এবার।
“যাই হোক, এসব জানাজানির আগেই আমার বুবুর সাথে ঐ মহিলার বেশ সখ্যতা হয়ে গেছিলো, প্রায় সমবয়সী ছিলো তারা। যে ছবিটা দেখছেন সেটা তখনকার সময়ই ভোলা। ওরা আরো কিছু বন্ধুবান্ধবসহ একটা পার্কে গেছিলো পিকনিক করতে, তখন এই ছবিটা তুলেছিলো আমার বুবু।”
ছফা অবাক হয়ে আশেক মাহমুদের দিকে তাকিয়েই কফিতে প্রথম চুমুকটা দিলো। সে উন্মুখ হয়ে আছে বাকি কথাগুলো শোনার জন্য।
আশেক মাহমুদ যখন তার বোনের কাছ থেকে শুনতে পেলো মুশকান সোহেলি নামের একজনকে সে চিনতো বহুকাল আগে, তখন ভেবেছিলো এটা হতেই পারে না। যে মুশকান হাসিবের অন্তর্ধানের জন্য দায়ী সে কোনো যুবতীই হবে-তা না হলেও মাঝবয়সী কোনো মহিলা হবে নির্ঘাত। কিন্তু সত্তুর বছরের কোনো নারী? অসম্ভব। এদিকে, নুরে ছফা তাকে বলেনি মুশকান জুবেরির বয়স কতো ছিলো। কঠিন এক অনিশ্চয়তা আর দ্বিধার মধ্যে পড়ে যায় সে।
যাইহোক, তার বুবু এতোটা কাকতালীয় ঘটনা মেনে নিতে পারেনি। কানাডায় ফোন করে মেয়ের কাছে থাকা তার পুরনো ছবির অ্যালবাম থেকে মুশকানের একটি ছবি মেইল করে দিতে বলে, তারপর সেই ছবিটা দেখায় আশেককে। ছবি দেখে পিএস বিশ্বাস করতে পারেনি। কারণ পঁচাতুর সালেও মহিলা পরিপূর্ণ যুবতী ছিলো, প্রায় তার বুবুর বয়সী একজন। এরকম একজনের সাথে কী করে হাসিব হৃদয়ঘটিত সম্পর্কে জড়াবে?
কিন্তু ছফার কাছ থেকে মুশকান জুবেরি সম্পর্কে যা যা শুনেছে সেগুলোর প্রায় সবটাই মিলে যাচ্ছে বিয়ের আগের নাম মুশকান সোহেলি। পেশায় মেডিকেল ডাক্তার। আমেরিকায় ছিলো দীর্ঘদিন। পরে দেশে চলে আসে! এটাকে যেকোনো কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ কাকতালীয় ঘটনা বলে মেনে নেবে না। এরপরই আশেক মাহমুদের বড় বোন জানায়, মুশকান সোহেলি আন্দিজের প্লেন ক্র্যাশ থেকে বেঁচে যাওয়াদের একজন। আর তার নরমাংস খেয়ে বেঁচে থাকার অবিশ্বাস্য, গা গুলিয়ে দেয়ার মতো ঘটনাটি।
নিশ্চিত হবার জন্য আশেক ছবিটা নিয়ে নেয় ছফাকে দেখাবে বলে। এখন সে দেখতে পাচ্ছে, তার বুবুর কথাই ঠিক।
“আস্ত একটা ডাইনি এই মহিলা,” কফির কাপ রেখে কথাটা আবারো বললো আশেক মাহমুদ। “এতোদিন আপনার কাছে তার কোনো ছবি ছিলো না, এখন আছে। আর ভাগ্য ভালো, পুরনো ছবিটাই কাজে লাগবে। কারণ। ঐ ডাইনি অলৌকিকভাবেই নিজের বয়স ধরে রেখেছে!”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ছফা। অনেক চেষ্টা করেও মুশকান জুবেরির কোনো ছবি জোগাড় করতে পারেনি সে। এমনকি সুন্দরপুরের জমিদারের বিশাল সহায়সম্পত্তি ট্রাস্ট করে দেয়ার যে কাগজপত্র সেগুলো খতিয়েও দেখেছে, কোনো লাভ হয়নি। ছফা অবাক হয়ে দেখেছে, ওখানে মালিক হিসেবে মুশকান জুবেরির কোনো ছবি নেই-রাশেদ জুবেরির ছবি দেয়া! আর ট্রাস্টের সমস্ত কাগজপত্র রাশেদ জুবেরি মারা যাবার আগেই তৈরি করা হয়েছে!
“সে কোনো সিরিয়াল কিলার নয়…মানুষখেকো এক ডাইনি,” দাঁতে দাঁত পিষে বললো আশেক মাহমুদ। “মানুষ খেয়ে খেয়েই সে নিজের যৌবন ধরে রেখেছে। এছাড়া আর কোনো ব্যাখ্যা খুঁজে পাচ্ছি না আমি।”
ছফা চোখেমুখে বিস্মিত হবার অভিব্যক্তি ধরে রাখলেও মুখে কিছু বললো না। নিজের অভিনয় দক্ষতার উপরে তার খুব বেশি আস্থা নেই।
“আরেকটা ঘটনার কথাও বুবু আমাকে বলেছে।”
“কী ঘটনা, স্যার?” কৌতূহলি হয়ে উঠলো ডিবির নুরে ছফা।
“ঐ ডাইনি আমেরিকা ছেড়ে চলে যাবার প্রায় বিশ বছর পর, বুবু আর দুলাভাই লন্ডনে গেছিলো কী একটা কাজে…হিথ্রো’তে তখন ঐ মুশকানকে নাকি বুবু দেখেছিলো!”
“বলেন কি!”
“তখনও মহিলার মধ্যে কোনো পরিবর্তন দেখেনি বুবু…একদম অবিকল বিশ বছর আগে যেমন ছিলো তেমনি রয়ে গেছিলো!”
ছফার ভুরু কপালে উঠে গেলো।
“বুবু বলেছে, ঐ মহিলা তাকে দেখামাত্রই সটকে পড়ে। আমার দুলাভাইকে বুবু এ কথা বললে, তিনি মোটেও বিশ্বাস করেননি। দুলাভাইয়ের ধারণা, ওটা বুবুর হেলুসিনেশান ছিলো, নয়তো লোকজনের ভীড়ে মুশকানের মতো কাউকে দেখেছে।”
ছফা কী বলবে ভেবে পেলো না।
“বুবুও ব্যাপারটা নিয়ে আর বেশি কিছু ভাবেনি…বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলো, যা দেখেছে ভুলই দেখেছে, কিন্তু আমার কাছ থেকে সব শোনার পর বুবুর মনে হয়েছে, ঐদিন তার সেই দেখাটা মোটেও ভুল ছিলো না।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো ডিবি অফিসার।
“যাই হোক, আপনি যে খুব একটা ভুল করেছেন তা-ও বলা যাবে না,” বললো আশেক মাহমুদ। “মহিলা সিরিয়াল কিলারদের মতোই…পার্থক্য হলো, সে তার শিকারদের নিছক খুন করে আনন্দ পায় না, তাদেরকে…” কথাটা আর শেষ করলো না, তার কোনো দরকারও নেই।
চুপ মেরে রইলো নুরে ছফা।
“এখন যেভাবে পারেন ওই ডাইনিকে খুঁজে বের করুন। যতো দ্রুত সম্ভব!” বললো আশেক মাহমুদ। “আমি চাই আমার বুবু যেনো জেনে যেতে পারে, তার সন্তানের হত্যাকারীকে ধরা হয়েছে। তার উপযুক্ত শাস্তি হবে।”
মুখ তুলে তাকালো ডিবির জাঁদরেল ইনভেস্টিগেটর। তিন বছরে যেটা করা সম্ভব হয়নি সেটা এই ছবি পাবার পর কি এতো দ্রুত করা যাবে?
“বুবুর জন্য খুব বেশি সময় নেই, একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব। “আপনাকে যতো রকম সাহায্য সহযোগীতা করা দরকার করবো। সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহার করবো আমি। দরকার হলে ক্ষমতার বাইরে গিয়েও যা করার করবো!”
নুরে ছফা স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো আশেক মাহমুদের দিকে। পিএসের দৃঢ়তা সুস্পষ্ট। ব্যক্তিগত আবেগে ভাসছে।
“আপনি যা চাইবেন পাবেন। সব ধরণের সহযোগীতা,” একটু থেমে আবারো বললো, “সব কিছু মানে সব কিছু!
এটাকে আমি লাইসেন্স টু কিল’ হিসেবে ধরে নেবো কি? মনে মনে বলে উঠলো নুরে ছফা। প্রধানমন্ত্রীর একান্ত ব্যক্তিগত সচিবের ক্ষমতার পরিধি সম্পর্কে ভালোমতোই অবগত আছে সে। এরা চাইলে পারে না এমন কাজ নেই। পুলিশের বড় কর্তাদের বদলি থেকে শুরু করে টিভি স্টেশন ব্যাঙ্ক-বীমার লাইসেন্স পাইয়ে দেবার কাজও অনায়াসে করে দিতে পারে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীকে প্রভাবিত করে কোনো মন্ত্রীর গদিও টলিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখে।
ছবিটার দিকে আবারো তাকালো ছফা। একটা মাত্র ছবি তাকে কতোটুকু সাহায্য করবে, জানে না। তবে এটা দিয়ে নতুন করে আবার শুরু করা যাবে-এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত। “আমি আপ্রাণ চেষ্টা করবো, স্যার।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো আশেক মাহমুদ। “আপনি একটা সরকারী প্লটের জন্য আবেদন করুন, আমি বাকিটা দেখবো। আর প্রমোশন নিয়ে ভাববেন না। ধরে নিন, ওটা হয়ে গেছে।”
এরকম লোভনীয় প্রস্তাব শুনে ছফা বিব্রত বোধ করলেও অভিব্যক্তি লুকাতে পারলো। এ দেশে কাউকে ম্যানেজ করতে হলে তিনটি জিনিসই ব্যবহার করা হয়-পদ, পদক আর প্লট। ছফাকে পদোন্নতি আর প্লটের টোপ দেয়া হচ্ছে! পদকও হয়তো জুটে যাবে।
“স্যার, এসবের জন্য না,” অবশেষে বিনীতভাবেই বলার চেষ্টা করলো সে। “আমি এই কেসটা সল্ভ করার জন্যই মুশকান জুবেরিকে খুঁজে বের করবো। আমি চাই না আমার কোনো কেস আনসভ থাকুক।”
“দ্যাটস গুড,” বললো আশেক মাহমুদ। “খুঁজে বের করুন এই ডাইনিকে…যতো দ্রুত সম্ভব!”
.
অধ্যায় ৭
অনেকক্ষণ বসে থাকতে থাকতে রোমানার আর ভালো লাগছে না। রিগ্যাল এয়ারওয়েজের সেলস এক্সিকিউটিভ সে। তার ছোট্ট, কিউবিকল সদৃশ অফিসটি ঢাকা বিমানবন্দরের আভ্যন্তরীণ বিমান চলাচল ভবনের নীচতলায় অবস্থিত। তারা মোট তিনজন কাজ করে এখানে। অসুস্থতার কারণে একজন অনুপস্থিত। আজকে সুমিত নামের এক জুনিয়র আর রোমানা কাজ করছে। তাতে অবশ্য কোনো সমস্যা হচ্ছে না, এখন বলতে গেলে অফ সিজন। এই মওসুমে পর্যটক কম থাকে, ফলে বেসরকারী এয়ারলাইন্সগুলোর ফ্লাইটের সংখ্যাও কমে আসে, কমে আসে তাদের ব্যস্ততাও।
শেষ ফ্লাইটটা ছিলো বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে, এরপরও পাঁচটা পর্যন্ত অফিস করতে হয়। কেউ কেউ মোবাইলফোন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু রোমানা আবার বইয়ের পোকা, সাধারণত পকেটবুক সাইজের পেপারব্যাক বের করে পড়ে সে। এ নিয়ে তার কিছু কলিগ হাসাহাসি করে, খোঁচা মেরে তাকে প্রফেসর আপা বলে ডাকে। আজকেও সে পিডি জেমসের একটি ডিটেক্টিভ বই হাতে নিয়েছিলো কিন্তু গল্পটা তাকে টানেনি। কম্পিউটারে বসে একটা গেম খেলারও চেষ্টা করেছিলো, সেটা আরো বেশি বিরক্তিকর লেগেছে। অগত্যা চুপচাপ বসে আছে সে। আর এক ঘণ্টা পর ছুটি, এই এক ঘণ্টাকে সহ্য করতে একটু বেশিই কষ্ট করতে হয়। সারাটা দিন কাজে ডুবে থাকলে কী হবে, ছুটির আগের সময়টায় এসে এক ধরণের অস্থিরতা শুরু হয়ে যায়-কখন বাড়ি যাবো!
রোমানা ঠিক করলো কফি খাবে, ছুটির আগে সব সময়ই এটা করে সে।
“কই যান, আপা?” জুনিয়র ছেলেটা তাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে জানতে চাইলো। এতোক্ষণ কম্পিউটারে সেলসের হিসেব দেখছিলো সে।
“একটু আসছি,” ইচ্ছে করেই কফির কথা বললো না, বললে এই ছেলে সঙ্গে সঙ্গে বলে দেবে তার জন্যেও এক কাপ নিয়ে আসার জন্য তার মানে পুরো একশ’ টাকা গচ্চা। কী দরকার, এই ছেলে তো এখানে জয়েন করার পর থেকে খেয়েই যাচ্ছে, কখনও কি তার জন্য এক কাপ নিয়ে এসেছে?
রোমানা কিউবিকল থেকে বের হয়ে প্রথমেই কফি-বুথের দিকে গেলো, সে গেলো ওয়াশরুমের দিকে। সেখান থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই থমকে দাঁড়ালো। তাকে হাত নেড়ে ইশারা করছে তাদের এয়ারলাইন্সের কাস্টমার সার্ভিসের সুরভি নামের এক মেয়ে। তিনমাস হলো এখানে জয়েন করেছে, ফ্রন্টডেস্কে ডিউটি তার।
ফ্রন্টডেস্কের কাছে যেতেই সুরভি নিচুকণ্ঠে বললো, “আপা, একটু হেল্প করবেন?
রোমানা হাসিমুখে বললো, “কী ব্যাপার, বলো।”
“আপনি কি একটু ডেস্কে বসবেন? আমাকে ওয়াশরুমে যেতে হবে। কিন্তু ডেস্কে কেউ নেই এখন।”
“বাকিরা কোথায় গেছে?” অবাক হলো রোমানা। ডেস্কে সাধারণত তিনজন থাকে। এখানেও দু-জন ছেলে একজন মেয়ে।
“ওরা সিগারেট খেতে গেছে।”
“ওহ্।” ছেলেগুলো সুযোগ পেলেই যে এ কাজ করে। এয়ারপোর্টে সিগারেট খাওয়ার জন্য আলাদা জোন আছে, আর সেটা তাদের ডেস্ক থেকে। বেশ দূরে। সুতরাং, ছুটির আগে একটু ফাঁকা হয়ে এলে ধুমপায়ি এপ্লয়িরা হন্যে হয়ে ওঠে সিগারেট খাওয়ার জন্য। রোমানা কিছু না বলে ডেস্কের পেছনে চলে এলো। “তুমি যাও।”
“থ্যাঙ্ক ইউ, আপা,” চপল কিশোরীর মতো দ্রুত ওয়াশরুমের দিকে ছুটে গেলো সুরভি।
ডেস্কে বসে এদিক ওদিক তাকালো রোমানা। আজকের জন্য তাদের। এয়ারওয়েজের সব ধরণের ফ্লাইট শেষ হয়ে গেছে। এখন পাততারি গোটানোর পালা। সবগুলো বেসরকারী এয়ারলাইন্সই একটু পর বন্ধ করে দেবে নিজেদের কাউন্টার আর ফ্রন্ট ডেস্ক।
আনমনে ডেস্কের দিকে চোখ যেতেই রোমানা কিছু একটা দেখতে পেয়ে কৌতূহলি হয়ে উঠলো।
একটা ফটোগ্রাফ।
ছবিটা হাতে নিতেই ভুরু কুঁচকে গেলো তার। নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো। এই ছবি এখানে কেন? এরকম ছবি সাধারণত পুলিশ আর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দিয়ে যায়। কেন দিয়ে যায় এটা এখানে যারা কাজ করে তারা সবাই জানে।
ক্রিমিনাল! বিরোধী দলের পলিটিশিয়ান? নাকি জঙ্গি?
আপন মনেই কাঁধ তুললো সে। তার অবশ্য সেরকমই কিছু মনে হচ্ছে।
“এই ছবি এখানে কেন? কিসের জন্য?” সুরভি ওয়াশরুম থেকে ফিরে এলে কৌতূহলি হয়ে জানতে চাইলে রোমানা।
ছবিটা দেখে ভুরু কপালে তুললো সুরভি। “ওহ্…এটা…আর বলবেন না, ডিবির এক অফিসার এসে দিয়ে গেছে আজকে।”
“মহিলা জঙ্গি নাকি?”
কাঁধ তুললো মেয়েটা। “আমাদেরকে তো কিছুই বলেনি। তবে মনে হচ্ছে, কোনো ক্রিমিনাল।”
“ক্রিমিনাল!” অবাক হলো রোমানা। “কি করেছে?”
“কী আর হবে, হয়তো খুনটুন করেছে। টেররিস্ট কানেকশানও থাকতে পারে। আজকাল তো বেশির ভাগ কেস এমনই হচ্ছে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো রোমানা। জঙ্গি-সন্ত্রাসী নিয়েই গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আজকাল এয়ারপোর্টে বেশি আসে, এরকম ছবি দিয়ে যায় বিভিন্ন এয়ারলাইন্সগুলোতে।
“আবার পলিটিশিয়ানও হতে পারে,” বললো সুরভি।
রোমানা অবশ্য সেরকম কিছু মনে করছে না। যদিও আজকাল এরকমটি প্রায়ই হচ্ছে-অমুক পলিটিশিয়ান যেনো এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন ক্রশ করতে না পারে, তমুক এলে যেনো আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানো হয়-এরকম আদেশ-নির্দেশ হরদম দেয়া হচ্ছে।
নীচের ঠোঁট কামড়ে ধরলো সে। “আজকে দুপুরে এক লেডি প্যাসেঞ্জার অদ্ভুত আচরণ করেছিলো, বুঝলে?”
“কি রকম?” সুরভি আগ্রহ দেখালো।
“মহিলা সকাল দশটার ফ্লাইট মিস্ করে জ্যামের কারণে, পরে ফিফটি পার্সেন্ট ফাইন দিয়ে টিকেটটা রিশিডিউল করিয়ে নেয় পরের ফ্লাইটের জন্যে, কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার কী জানো?” সুরভির কাছ থেকে কোনো জবাবের অপেক্ষা না করেই বললো, “মহিলা ঐ ফ্লাইটটাও মিস্ করে। অথচ আমি তাকে ফ্লাইটের কিছুক্ষণ আগেও দেখেছি লাউঞ্জে বসে থাকতে।”
“বলেন কি!” অবাক হলো সুরভি। “আপনি শিওর, মহিলা ফ্লাইট মিস্ করেছে?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো রোমানা। “ফ্লাইট ছাড়ার পনেরো-বিশ মিনিট আগে আমাকে ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে জানানো হয়েছিলো আমি যেনো ফোন করে ক্লায়েন্টকে ইনফর্ম করি। আমি তাকে ফোন করার পর পেয়েও যাই…কিন্তু মহিলা যখনই শুনতে পেলো আমি এয়ারলাইন্স থেকে কল করেছি তখনই লাইনটা কেটে দিলো।”
সুরভি অবাক হলো কথাটা শুনে। “এটা কেন করলো ভদ্রমহিলা…আজব তো!”
ঠোঁট ওল্টালো রোমানা। “আসলেই আজব। কিন্তু এখন আমার মনে হচ্ছে কি জানো, এই ছবির মহিলাই ছিলো ওই প্যাসেঞ্জার।”
সুরভির চোখদুটো গোল গোল হয়ে গেলো।
“সম্ভবত লাউঞ্জে ওয়েট করার সময় ডিবি অফিসারকে দেখে সটকে পড়েছে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো সুরভি। “তা হতে পারে।”
“আমি নিশ্চিত, এটাই হয়েছে, রোমানা জোর দিয়ে বললো।
“তাহলে কি আপনি বসূকে জানিয়ে দেবেন এটা?”
“হুম। জানানো তো দরকার, তাই না?”
.
অধ্যায় ৮
তিন দিন ধরে সারা ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজেও নিজের মোবাইলফোনটা পাচ্ছে না খোদাদাদ শাহবাজ খান। ঠিকভাবে মনেও করতে পারছে না, শেষবার ফোনটা কবে কখন ব্যবহার করেছিলো। তবে একটা ব্যাপারে নিশ্চিত, আগের বারের মতো প্রশিক্ষিত কোনো পিগমি বানর ঘরে ঢুকে চুরি করে নিয়ে যায়নি।
এমন না যে, মোবাইলফোন না থাকলে তার অনেক সমস্যা হবে, যোগাযোগ করতে পারবে না কারোর সাথে। সত্যি বলতে, এই যুগেও তার সাথে বেশির ভাগ মানুষজন যোগাযোগ করে পুরনো আমলের ল্যান্ডফোনেই। কিন্তু একটা জিনিস হারিয়ে গেলো আর তার ইনভেস্টিগেটর সত্তা সেটার খোঁজ করবে না তা কি হয়? অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজি করার পর ব্যর্থ হয়ে এখন বসে আছে চুপচাপ। ভাবার চেষ্টা করছে জিনিসটা গেলো কোথায়!
আইনস্টাইনও তার সাথে অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে। এমন সব জায়গায় খুঁজে দেখেছে যেখানে কেবলমাত্র ইঁদুর আর টিকটিকির পক্ষেই ঢোকা সম্ভব। এখন তাকে খোঁজাখুঁজি বাদ দিয়ে চা আনতে পাঠিয়েছে।
এমন সময় ল্যান্ডফোনটা বেজে উঠলে কেএস খান আনমনেই ফোনটা তুলে নিলো।
“হ্যালো।” ডাক্তার লুবনার সুমিষ্ট কণ্ঠটা বলে উঠলো ওপাশ থেকে।
“আরে আপনে…আছেন কেমন?” পহেলা বৈশাখের পর আর মেয়েটার সাথে তার যোগাযোগ হয়নি। জরুরী একটা দরকারে গ্রামের বাড়িতে গেছিলো।
“ভালো আছি। আপনার কি অবস্থা?”
“ভালাই…সামান্য সর্দি ছাড়া আর সব ঠিক আছে।”
“অ্যালার্জি থেকে হয়েছে,..ঘরে অ্যালাট্রল আছে না?”
“আছে মানে, আমার ঘর তো ছোটোখাটো ডিসপেন্সারি,” কথাটা বলেই চওড়া হাসি দিলো কেএস খান। যদিও ফোনে সেটা দেখতে পাবে না ডাক্তার লুবনা।
“আমি আপনার মোবাইলফোনেও কল দিয়েছিলাম…বন্ধ পেলাম যে?”
“বন্ধ না…আসলে খুঁইজা পাইতাছি না।”
“হারিয়ে ফেলেছেন নাকি?”
“পয়লা বৈশাখের পর থেইকা পাইতাছি না। সারা ঘর খুঁইজা শেষ। কই রাখছি মনে করবার পারতাছি না। আমার আবার মেমোরি খুব উইক।”
“আমার কিন্তু তা মনে হচ্ছে না।”
“আমার মেমোরি?” বুঝতে না পেরে বললো সাবেক ডিবি কর্মকর্তা।
“আরে না,” হেসে বললো ডাক্তার। “ফোনের কথা বলছি। রমনা থেকে ফেরার সময় ফোনটা পিট পকেট হয়ে গেছে মনে হয়। আপনি তো পাঞ্জাবির পকেটে রেখেছিলেন ফোনটা।”
“হুম।” মাথা নেড়ে সায় দিলো কেএস খান। চাকরিজীবনে পকেটমারদের সাথে বেশ কয়েকবার মোলাকাত হয়েছে তার। এরকম এক পকেটমার তাকে একবার বলেছিলো, কেউ পাঞ্জাবির পকেটে কিছু রাখলে নাকি তারা ধরে নেয় জিনিসটা আসলে তাদের পকেটেই রাখা হয়েছে! “তাইলে সেইটাই হইছে…পকেটমার মাইরা দিছে।”
“খারাপ লাগছে?” আদুরে কণ্ঠে জানতে চাইলো ডাক্তার।
“আরে না।” একটু থেমে আবার বললো সাবেক ডিবি অফিসার, “আমি টিনেজ পোলাপান নাকি, মোবাইল হারাইলে মুখ বেজার কইরা বইসা থাকুন? এর আগে কতোবার আমার ফোন হারাইছে! এইটা কোনো ব্যাপারই না।”
“আমি যদি আপনাকে জোর করে পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে না নিয়ে যেতাম তাহলে ফোনটা হারাতো না,” বিষণ্ণ কণ্ঠে ওপাশ থেকে বললো ডাক্তার।
“কী যে বলেন না,” কেএস খান সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলো মেয়েটাকে। “ফোন তো হারায়ই…এইটা আর এমন কী।”
একটু চুপ থেকে ডাক্তার লুবনা বললো, “ঐদিন আপনার ছাত্র…ঐ যে, নুরে ছফা…সে আমাদের একসাথে দেখে ফেলায় কি আপনার কোনো সমস্যা হয়েছে?”
“আরে না, কেএসকে বললো। “ছফা আমার খুবই ঘনিষ্ঠ মানুষ…এইটা কোনো ব্যাপার না। আমি কার সাথে কই যামু না যামু এইটা নিয়া সে ক্যান ভাবতে যাইবো? আর ভাবলেই আমি পরো
“হুম। তা তো ঠিকই,” সায় দিলো ডাক্তার লুবনা।
“আপনে এইটা নিয়া খামোখা ভাবতাছেন। এইটা কোনো ব্যাপারই না।”
“আসলে আমার মনে হলো আপনি খুবই বিব্রত হয়েছিলেন, তাই বললাম।”
“আরে না, সেইরকম কিছু না…বুঝতেই পারছেন, জুনিয়রদের সামনে পইড়া গেলে তো একটু ইয়ে হয়-ই।”
ডাক্তার লুবনা হেসে ফেললো। “যাক, বাঁচলাম। আমি তো ভেবেছিলাম আপনাকে খুবই বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছি।” একটু চুপ থেকে আবার। বলে উঠলো সে, “কাল বিকেলে কি ফ্রি আছেন? ভাবছি, একটু কফি খেতে যাবো।”
আনন্দে মুখে হাসি ফুটে উঠলো সাবেক ডিবি অফিসারের। “আপনে ঢাকায় এখন?”
“হুম। আজ দুপুরে এসেছি।”
চওড়া হাসি ধরে রেখেই বললো, “আমি তো ফ্রিই আছি, কোনো সমস্যা নাই।”
“দ্যাটস গ্রেট।” উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো ডাক্তার লুবনা।
“কয়টার দিকে বাইর হইবেন?”
“বিকেলে পাঁচটায়?”
“ওকে…ননা প্রবলেম…কোন্ জায়গায় আসতে হইবো, কন?”
“ধানমণ্ডির রবীন্দ্র সরোবরে চলে আসুন। আমি ওখানেই থাকবো।”
“ওকে।”
“রাখি। বাই। কাল বিকেলে দেখা হচ্ছে তাহলে, মিষ্টি করে হেসে বললো ডাক্তার লুবনা।
“বাই, কলটা কেটে গেলেও কেএস খান ফোনটা কানে চেপে রাখলো আরো কিছুক্ষণ। সেই সুপরিচিত হৃদস্পন্দনটা টের পেলো। এক ধরণের ধুকপুকানি। নতুন প্রেমে পড়লে যেমনটা হয়। ডাক্তার লুবনার সাথে প্রতিবার কথা বললেই এটা হয় তার।
ফোনটা রেখে ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই আবার রিং বেজে উঠলো, বিরক্ত হয়েই ফোনটা তুলে নিলো সে।
“কী খবর তোমার?” এবার নিয়মমাফিক কলটা এসেছে।
“এই তো…আছি,” বললো মহিলার সাবেক স্বামী।
“তোমার ফোন খুঁজে পেয়েছো?”
গতকাল ফোন করলে সাবেক স্ত্রীকে মোবাইলফোন হারানোর কথা জানিয়েছিলো সে। “না। ওইটা আসলে পিট পকেট হইছে মনে হয়।”
“বলো কি!” অবাক হলো ফোনের অপর পাশের কণ্ঠটা। “কাল না বললে হারিয়ে ফেলেছিলে?”
“হ…কিন্তু আজ মনে হইতাছে পয়লা বৈশাখে যে রমনায় গেছিলাম, সেইখান থেইকা ফিরা আসার সময়…” কথাটা শেষ করার আগেই কেএস খান বুঝে গেলো বেফাঁস কিছু বলে ফেলেছে। এখন কী প্রতিক্রিয়া আর প্রশ্নের সম্মুখীন হবে সেটা বুঝতে এক সেকেন্ডও লাগলো না।
“পহেলা বৈশাখে রমনায় গেছিলে?!” বিস্ময় আর অবিশ্বাসটা একেবারেই সঙ্গত। বিবাহিত জীবনে কখনও ইনভেস্টিগেটর স্বামী তাকে নিয়ে পহেলা বৈশাখে বের হয়নি। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে একটা মৃদু দীর্ঘশ্বাস শোনা গেলো। কয়েক মুহূর্তের নীরবতার পর অবশেষে খুবই স্রিয়মান কণ্ঠে জানতে চাইলো, “একা গেছিলে, নাকি…?”
কেএস খান কী বলবে ভেবে পেলো না। “ইয়ে মানে—”
“ওহ্…ভুলে গেছিলাম,” কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলে উঠলো এবার। “জুবায়েরকে পড়াতে হবে…এখন রাখি।”
কলটা কেটে যাবার পরও কেএসকে উদাস হয়ে তাকিয়ে রইলো জানালা দিয়ে। ঈর্ষা শব্দটি এখনও পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারে না সে। এটার উৎপত্তির কারণ তার ভালো করেই জানা আছে, কিন্তু এর ব্যাপ্তি কতোটা জানে না। তবে জানে, আগামি দুয়েকদিন তাকে আর কল করবে না এই মহিলা। ঈর্ষা হলো আগুন, সেই আগুন স্তিমিত হতে একটু সময় লাগেই।
“স্লামালেকুম, স্যার।”
জাঁদরেল একটি কণ্ঠ বলে উঠলে কেএস খান অনেকটা চমকে তাকালো দরজার দিকে।
.
অধ্যায় ৯
“তুমি শিওর?” রিগ্যাল এয়ারলাইন্সের অপারেশন হেড মঞ্জুর কাদের ভুরু কুঁচকে আবারো জানতে চাইলো।
“জি, স্যার।” জবাব দিলো রোমানা।
তারা এখন দাঁড়িয়ে আছে ফ্রন্টডেস্ক থেকে একটু দূরে।
“মহিলা ফ্লাইট মিস করে আবার রিশিডিউল করে,” ডিবির সরবরাহ করা ছবিটার দিকে তাকিয়ে বললো মঞ্জুর কাদের।
রোমানা বুঝতে পারলো না এটা প্রশ্ন কিনা, তারপরও মাথা নেড়ে সায় দিলো সে।
“ছবির এই মহিলাই ছিলো তাহলে?” মুখ তুলে তাকালো অপারেশন হেড। “তুমি হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর?”
রোমানা এবার ধন্দে পড়ে গেলো। হান্ড্রেড পার্সেন্ট শব্দটা তাকে সব সময়ই অনিশ্চয়তার মধ্যে ফেলে দেয়। জগতের কোনো কিছু সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যে টেকনিক্যালি ভুল এটা সে কর্মজীবনে প্রবেশ করেই বুঝে গেছে।
“না, মানে,..”
মঞ্জুর কাদের সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালো তার দিকে।
“হান্ড্রেড পার্সেন্ট শিওর কিভাবে হবো, স্যার?”
“কিভাবে হবেন মানে? আপনি না তাকে দেখেছেন?”
“দেখেছি কিন্তু ঐ মহিলার চোখ ছাড়া তো কিছু দেখিনি।”
“কি!” অবাক হলো অপারেশন হেড। “চোখ ছাড়া কিছু দেখেননি মানে!?”
“মহিলা হিজাব পরা ছিলো, স্যার,” তড়িঘড়ি ব্যাখ্যা দিলো রোমানা।
“হিজাব?” কপালে ভাঁজ পড়লো অপারেশন হেডের।
“জি, স্যার…শুধু চোখদুটো দেখা গেছে।”
গভীর করে দম নিয়ে মাথা দোলালো মঞ্জুর কাদের। আর তাতেই আপনি বুঝে গেলেন এটা সেই মহিলা?”
রোমানা ঢোঁক গিলল।
“শুধু একজোড়া চোখ দেখে?”
“স্যার, একজন প্যাসেঞ্জার ফ্লাইট মিস্ করার পর রিশিডিউল করলো, তারপর সেটাও মিস্ করলো ইচ্ছেকৃতভাবে। ভদ্রমহিলাকে আমি ফ্লাইটের কিছুক্ষণ আগেও লাউঞ্জে ওয়েট করতে দেখেছি।”
“এ থেকেই আপনি ধরে নিলেন এই মহিলা কোনো ক্রিমিনাল না হয়ে যায় না…ডিবি যার ছবি দিয়ে গেছে এটা সে-ই হবে?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো রোমানা। তাছাড়া আমি মহিলার চোখদুটো ভালো করে দেখেছি, আমার কিউবিকলের খুব কাছেই বসেই ছিলো…ছবির এই মহিলার মতোই, স্যার। তার অদ্ভুত আচরণের ব্যাপারটা কনসিডার করলে একটা বিষয়ই মাথায় আসে আর সেটা-”
“আপনি আসলে ঐ মহিলার এই ব্যাপারটাকে সন্দেহজনক হিসেবে দেখেছেন,” কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বললো অপারেশন চিফ। “তাই তো?”
“জি, স্যার।”
“কিন্তু উনার ফ্লাইট মিস্ করার আরো অনেক কারণ থাকতে পারে, এটা ভেবে দেখেছেন কি?”
বসের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো রোমানা।
মঞ্জুর কাদের বুকে দু-হাত ভাঁজ করে গম্ভীর হয়ে বললো, “মনে করুন, একেবারে শেষ সময়ে মহিলার পরিবারে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, ভদ্রমহিলা ফোন পেয়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এরকমটা কি হতে পারে না?”
রোমানা মাথা নেড়ে সায় দিতে বাধ্য হলো। অপারেশন হেডের সৃজনশীলতায় মুগ্ধ সে। এটার সম্ভাবনা আছে, তবে তার কাছে মনে হচ্ছে সেই সম্ভাবনা বেশ ক্ষীণ। “স্যার, আমি আরো জানতে পেরেছি, ডিবি অফিসার যখন এসেছিলো তার কিছুক্ষণ পরই ঐ ফ্লাইটটা ছেড়ে যায়। তার মানে, মহিলা নিশ্চয় ঐ অফিসারকে দেখে ভয় পেয়ে কেটে পড়েছে।”
মাথা নেড়ে সায় দিলো মঞ্জুর কাদের। “বুঝলাম, আপনার কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু আপনি-আমি কেউই পুরোপুরি নিশ্চিত নই। নিশ্চিত না হয়ে সন্দেহের উপর ভিত্তি করে আমরা আমাদের কোনো কাস্টমারকে ঝামেলায় ফেলতে পারি না। বোঝা গেলো আমার কথাটা?”
চুপসে গেলো রোমানা। “জি, স্যার।”
“ওরা একটা ছবি দিয়ে গেছে…” বলতে লাগলো অপারেশন হেড। “…আমাদের ফ্রন্টডেস্ক যদি ঐ ছবির সাথে মিল আছে এমন কাউকে প্যাসেঞ্জার হিসেবে পেতে তাহলে আমরা ওদেরকে জানাতাম। কিন্তু আপনি দেখেছেন একজোড়া চোখ…তার সাথে পর পর দু-বার ফ্লাইট মিস্ করার ঘটনাটা জুড়ে দিয়ে মনে করছেন এই ছবির মহিলাই ঐ প্যাসেঞ্জার হতে পারে। দ্যাটস নট এনাফ টু রিপোর্ট ইট।”
“জি, স্যার,” বিমর্ষ মুখে বললো রোমানা।
“মনে রাখবেন, আমাদের কাছে সবার আগে আমাদের কাস্টমার, ওই সব ল-ইনফোর্সমেন্টের রিকোয়েস্ট না। ওকে?”
মাথা নেড়ে সায় দিলো সেলস এক্সিকিউটিভ। আসল কথাটা এবার তার কাছে পরিস্কার। খালি চোখে দেখলে কপোরেট দুনিয়ার আসল দেবতা হলো টাকা, কিন্তু সেটা আকাশ থেকে টুপ করে পড়ে না, ওগুলো আসে কাস্টমারের পকেট থেকে! সুতরাং এখানে আসল দেবতা তারাই।
“আমরা পুরোপুরি নিশ্চিত না হয়ে কখনও আমাদের কোনো কাস্টমারের বিরুদ্ধে কিছু করবো না-এটা সব সময় মাথায় রাখবেন।”
“জি, স্যার।”
“ঐ প্যাসেঞ্জার কী কারণে রিশিডিউল করা ফ্লাইট মিস করলেন সেটার ব্যাখ্যাও আমাদের খোঁজার দরকার নেই। আমরা আমাদের টিকেট বিক্রি করেছি, ফাইনের টাকা পেয়েছি, দ্যাটস ইট।”
চুপ মেরে রইলো রোমানা।
মঞ্জুর কাদের হাতঘড়ির দিকে তাকালো। “সময় হয়ে গেছে, বাসায় চলে যান।”
“জি, স্যার,” কথাটা বলে রোমানা পা বাড়ালো নিজের কিউবিকলের দিকে। ওখানে তার ব্যাগ-পার্স আছে।
“শুনুন?”
পেছনে থেকে বসের ডাক শুনে ঘুরে দাঁড়ালো সে।
“এখন থেকে ডিটেক্টিভ নভেল একটু কম পড়বেন, ওকে?”
অপারেশন হেড মাপা হাসি দিয়ে রোবটের মতো ঘুরে চলে গেলো।
এমন উপদেশ পেয়ে অপমাণিত বোধ করলো রোমানা। সেই অপমান হজম করে আবারো পা বাড়ালো কিউবিকলের দিকে। মনে মনে বললো সে, জি, স্যার, এখন থেকে কম কম বই পড়বো আর আপনার মতো রোবট হবার চেষ্টা করবো!
.
অধ্যায় ১০
নুরে ছফা দাঁড়িয়ে আছে কেএস খানের খোলা দরজার সামনে।
তাকে দেখেই ফোনটা ক্রাডলের উপরে রেখে দিলো সাবেক ডিবি অফিসার। “আরে, ছফা যে,” এগিয়ে গেলো দরজার দিকে। “আপনে যে আসবেন জানতাম না তো।”
নুরে ছফা ঘরের ভেতরে পা ফেললো। “আমি আপনার মোবাইলফোনে কল দিয়ে দেখি সেটা বন্ধ, তারপর ল্যান্ডফোনেও কল দিয়েছিলাম। আইনস্টাইন বললো, আপনি একটু বাইরে গেছেন হাটাহাটি করতে।”
“হ…রোজ বিকালে একটু হাটাহাটি করি পার্কে।”
“তাকে আমি বলেছিলাম, আমি আসছি…সে আপনাকে বলেনি?”
হেসে ফেললো কেএসকে। “পোলাপান মানুষ, মনে হয় ভুইলা গেছে।” একটু থেমে আবার বললো, “বসেন।” নিজেও বসে গেলো সোফায়। “আজকে কি আপনার অফ ডিউটি?”
“না, স্যার…ছুটি পেয়েছি।”
কেএস খান বুঝতে পারলো না। তাদের পেশায় ছুটি নিয়েছি’ পরিচিত শব্দ কিন্তু ছুটি পেয়েছি,’ এটা অনেক প্রশ্নের জন্ম দেয়। “আচ্ছা,” কোনো রকমে নিজের কৌতূহল দমিয়ে বললো সাবেক ডিবি অফিসার।
“ইয়াল্লা!” দরজার দিক থেকে একটা অল্প বয়েসী কণ্ঠ বলে উঠলে তারা দু-জন সেদিকে তাকালো।
আইনস্টাইন জিভে কামড় দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার হাতে একটা চায়ের ফ্লাস্ক।
“আমি ভুইল্যা গেছিলাম…স্যারে আমারে ফোনে কইছিলো আইবো।”
“থাক, তরে আর কিছু কইতে হইবো না। যা, দুই কাপ চা দে তাড়াতাড়ি।”
আইনস্টাইন দৌড়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যাবার সময় নুরে ছফার দিকে তাকিয়ে নিষ্পাপ হাসি দিয়ে গেলো। ছফাও হেসে আশ্বস্ত করলো তাকে।
“ছুটি পাইছেন মানে বুঝলাম না?” উৎসুক কেএসখান অবশেষে প্রশ্নটা করেই ফেললো।
নুরে ছফা গম্ভীর হয়ে গেলো কয়েক মুহূর্তের জন্য।
সাবেক ডিবি অফিসার ভাবলো, ছফা কোনো কারণে পানিশমেন্টের শিকার হয়েছে কিনা।
“আমাকে স্পেশাল ছুটি দেয়া হয়েছে, স্যার।”
সপ্রশ্নদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কেএস খান।
“মুশকান জুবেরিকে ট্র্যাক ডাউন করার জন্য।”
“এরজন্যই কি পয়লা বৈশাখে আপনে ছায়ানটের প্রোগ্রামে গেছিলেন?”
মাথা দোলালো ছফা। “না, স্যার। ছুটি আমি পেয়েছি আজকে।”
“ও।”
“ঐদিন গিয়েছিলাম এমনি। হঠাৎ করেই মনে হয়েছিলো মুশকান জুবেরি ওখানে থাকতে পারে।”
“বলেন কি?” অবাক হলো কেএস খান। “এইটা আপনের মনে হইলো কেন?”
কাঁধ তুললো ছফা। “তা তো জানি না। কেনজানি মনে হলো মহিলা ওখানে যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথের বিরাট বড় ভক্ত। তার মুখ থেকেই শুনেছিলাম, ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান নাকি কখনও মিস করেনি।”
“বুঝছি।” মাথা নেড়ে সায় দিলো সাবেক ডিবি অফিসার। “মজার ব্যাপার কি জানেন, স্যার? আমার ধারণা মোটেও মিথ্যে ছিলো
“মানে?!” ডিবির সাবেক অফিসারকে বিস্মিত দেখালো।
“ফেরার পথে ঐ মহিলাকে আমি এক ঝলক দেখেছি…শাহবাগের দিকে।”
“কি!”
“একটা প্রাইভেট কারে করে যাচ্ছিলো…আমি ছিলাম রিক্সায়।”
গাল চুলকাতে শুরু করলো সাবেক ইনভেস্টিগেটর। “তারপর?”
“গাড়িটা ধরা সম্ভব হয়নি।”
“নম্বরটা দেখেন নাই? ওইটা ট্রেস করলে তো–”
“না, স্যার…ওটার কথা খেয়াল ছিলো না তখন,” উৎসুক কেএস খানকে মাঝপথে দমিয়ে দিলো ছফা।
“ওহ্,” একটু হতাশ হলো সাবেক ইনভেস্টিগেটর।
এমন সময় দু-কাপ চা নিয়ে ঘরে ঢুকলো আইনস্টাইন।
“কীরে, আইজকাল তোর চা আনতে এতো দেরি হয় ক্যান?” জানতে চাইলো কেএস খান।
চায়ের কাপ দুটো সোফার সামনে কফি টেবিলের উপর রাখতে রাখতে জবাবদিহি করলো ছেলেটা, “নিচের দোকান থিকা তো এহন আর চা আনি না…ঐ হালারপুতে মুর্দালাশে যে চা-পাতা দেয় ওইগুলা সস্তায় কিইন্যা আনে…ওয়াক থু! চিন্তা করছেন কারবারটা!”
“তরে এইসব কথা কে কইলো?”
কেএসকের দিকে বিস্ময়মাখা দৃষ্টিতে তাকালো আইনস্টাইন। “ওই হালারপুতেরে আমি এক বেটার কাছ থিইক্যা চা কিনতে দেখছি…পাঁচ কেজি কিনলো মাত্র দুইশো ট্যাকা দিয়া। আপানেই কন, অরিজিনাল চা কি এতো সস্তা? তহনই আমি বুইজ্যা হালাইছি, হালারপুতে দুই নম্বরি করে।”
“আইজকাল দেহি কথায় কথায় হালারপুত কস্…ঘটনা কি?” কেএস খান ভুরু কপালে তুলে বললো।
জিভে কামড় দিলো পিচ্চিটা। একটু শরমিন্দা হয়েছে সে, আর কিছু না বলে চুপচাপ ঘর থেকে চলে গেলো।
“চা নেন, ছফা,” নিজের কাপটা নেবার আগে বললো কেএস খান। “আপনে তারে খুবই অল্প সময়ের জন্য দেখছেন,” কাপে চুমুক দিলো মি, খান। “এইটা তো রিলায়েবল হইতে পারে না…অন্য কিছুও হইবার পারে।”
“কী রকম?” ভুরু কুঁচকে তাকালো ছফা।
অমায়িক হাসি দিলো কেএসকে। “আপনের তো হেলুসিনেশানও হইবার পারে, পারে না?”
ছফা একটুখানি বিষম খেলো যেনো। “হেলুসিনেশান?”
“অবাক হওনের কিছু নাই,” ছফাকে আশ্বস্ত করে চায়ে চুমুক দিলো সাবেক ডিবি অফিসার। “আপনের ধ্যান-জ্ঞান হইলো ঐ মহিলা, তারে তিনটা বছর ধইরা পাগলের মতো খুঁজছেন। এরকম সিচুয়েশনে হেলুসিনেশান তো হইবারই পারে।”
ছফা চায়ের কাপটা তুলে নিলো। “কিন্তু আমার মনে হয় না হেলুসিনেশান ছিলো ওটা।”
খোদাদাদ শাহবাজ খানকে দেখে মনে হলো আশ্বস্ত হতে পারছে না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো সে। “সার্ভিসে জয়েন করার পর আমার তিন নম্বর কেসটা খুব ভুগাইছিলো, বুঝলেন?”
নুরে ছফা বুঝতে পারলো অতীত রোমন্থনের মেজাজে চলে গেছে মি. খান। জোর করে আগ্রহী হবার অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুললো চোখেমুখে।
“একটা মার্ডার কেস ছিলো। আমি খুব দ্রুত বাইর করতে পারছিলাম খুনটা কে করছে, কিন্তু সাসপেক্ট ততোক্ষনে পগাড় পার।”
ছফা কিছু বললো না। জানে, গল্পটা শেষ হয়নি। চায়ে চুমুক দিলো সে।
“এরপর কী হইলো জানেন?” জবাবের অপেক্ষা না করেই বললো আবার, “আমি যেইখানেই যাই ঐ ব্যাটারে খুঁজি। এক পর্যায়ে তারে দেখতেও শুরু করলাম!”
“দেখতে শুরু করলেন মানে?”
“এই ধরেন, মানুষজনের ভীড়ে, পথেঘাটে মনে হইতো তারে দেখছি।” একটু থেমে আবার বললো সে, “আসলে পুরাটাই ছিলো হেলুসিনেশন। এইটারে আপনে ডিশনও কইবার পারেন।”
কাঁধ তুলে আস্তে করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো ছফা। “হতে পারে ওটা হেলুসিনেশান। কিন্তু আমি আজকে সেজন্যে আপনার সঙ্গে দেখা করতে আসিনি। আসলে, আপনার সাথে জরুরী একটা বিষয়ে কথা বলতে এসেছি, সেই সঙ্গে একটা জিনিসও দেখাতে এসেছি, স্যার।”
“কি জিনিস?” কৌতূহলি হয়ে উঠলো সাবেক ইনভেস্টিগেটর।
কোনো কথা না বলে চায়ের কাপটা রেখে পকেট থেকে একটা ছবি বের করে আনলো নুরে ছফা। “এই যে, স্যার।”
কেএস খান আগ্রহভরে ছবিটা হাতে তুলে নিয়ে দেখলো কয়েক মুহূর্ত। “মুশকান জুবেরির ছবি??” বিস্ময়ে বলে উঠলো সাবেক ডিবি অফিসার।
“জি, স্যার। এটাই মুশকান জুবেরি। অবশেষে তার ছবি আমি পেয়েছি।”
“কইত্থেন পাইলেন এই জিনিস?”
“একেবারেই অবিশ্বাস্য গল্প। আপনার বিশ্বাস করতেও কষ্ট হবে।” ছফার মুখে রহস্যময় হাসি।
উদগ্রীব হয়ে চেয়ে রইলো খোদাদাদ শাহবাজ খান।