“যদ্যপি আমার গুরু শুড়ি বাড়ি যায়
তথাপি তাহার নাম নিত্যানন্দ রায়।”
উনিশশো সত্তর সালের কথা। বাংলা একাডেমী তিন বছরের ফেলোশিপ প্রোগ্রামে প্রার্থীদের কাছ থেকে আবেদনপত্র আহবান করে সংবাদপত্রে একটা বিজ্ঞাপন প্রকাশ করলো। বন্ধুবান্ধব সকলে বললো, তুমি একটা দরখাস্ত ঠুকে দাও। যদি বৃত্তিটা পেয়েই যাও, তা হলে তিন বছরের নিরাপদ জীবিকা। গবেষণা হয়তো হবে, না হলেও ক্ষতি নেই। প্রস্তাবটা আমার মনে ধরলো। কিন্তু গোল বাধলো এক জায়গায় এসে। তখনও আমার এমএ পরীক্ষা শেষ হয়নি। ছাত্রদের দাবির মুখে পিছোচ্ছে তো পিছোচ্ছেই। এদিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন গতিবেগ সঞ্চয় করে ক্রমাগত ফুঁসে উঠছে। পরীক্ষা কবে শেষ হবে তার কোনো ঠিক নেই। আমি যদি পরীক্ষার ফলাফলের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি, দরখাস্ত করার সময় পেরিয়ে যাবে।
আমি একাডেমীর পরিচালক জনাব কবীর চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করলাম। তাঁকে বুঝিয়ে রাজি করাতে পারলাম, যদিও এমএ ডিগ্রী আমার হয়নি, অন্তত তিনি আমার দরখাস্তটা গ্রহণ করতে যেনো অমত না করেন। কবীর চৌধুরী সাহেব বললেন, ঠিক আছে, তুমি দরখাস্ত করো। অন্যান্য প্রার্থীর আবেদনপত্রের সঙ্গে তোমারটাও আমি বোর্ডে তুলবো। বোর্ডের সদস্যবৃন্দ দেখেশুনে যাকে ইচ্ছে নির্বাচন করবেন। সুতরাং এমএ ডিগ্ৰী না থাকা সত্ত্বেও বাংলা একাডেমীর পিএইচডি ফেলোশিপ প্রোগ্রামে দরখাস্ত করে বসলাম।
অন্য প্রার্থীদের মতো আমিও ইন্টারভুক্ত কার্ড পেলাম। আর নির্দিষ্ট দিনে কম্প্রবক্ষে ইন্টারভ্যু বোর্ডের সামনে হাজির হলাম। ড. আহমদ শরীফ, প্রফেসর মুনীর চৌধুরী এবং ড. এনামুল হক সেদিন ইন্টারভু বোর্ডে উপস্থিত ছিলেন। ড. এনামুল হক ছাড়া বাকি সদস্যদের সঙ্গে আমার পরিচয় ছিলো। আর তারা সকলেই ছিলেন আমার শিক্ষক। আমার লেখালেখির সঙ্গে তারা সকলে অল্পবিস্তর পরিচিতও ছিলেন। আমাকে প্রশ্ন যা করার ড. মুহম্মদ এনামুল হকই করলেন। তিনি দরখাস্তের ওপর চোখ বুলিয়ে গুরুগম্ভীর স্বরে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার সাহস তো কম নয় হে, এমএ পরীক্ষা না দিয়েই একেবারে পিএইচডি করার দরখাস্ত নিয়ে হাজির। ড. এনামুল হক ভীষণ রাশভারি মানুষ। পারতপক্ষে জুনিয়র কলিগরাও তার কাছে ঘেঁষতে সাহস পেত না। ঘিয়ে রঙের সুট এবং কালো টাই পরিহিত ড. এনামুল হককে একটা আস্ত বুড়ো বাঘের মতো দেখাচ্ছিলো। চোখের ভুরু থেকে মাথার চুল একেবারে পাকনা। মাথার মাঝখানে সযত্নে সিঁথি করা। আমার অবস্থা তখন ক্ষুধার্ত বুড়ো বাঘের সামনে কচি নধর গোবৎসের মতো। এই বুঝি লাফিয়ে পড়ে আমার মুণ্ডুটা চিবিয়ে খাবেন। আমার ষষ্ঠ ইন্দ্ৰিয় কাজ করলো। মনেমনে চিন্তা করলাম, এই বুড়োর সামনে আমি যদি রুখে না দাড়াই, তিনি আমার চোখের পানি নাকের পানি এক করে ছাড়বেন। তাই সরাসরি তার কড়া পাওয়ারের চশমার কাচের ওপর চোখ রেখেই বললাম, চারুচন্দ্ৰ বন্দ্যোপাধ্যায় এমএ পাশ না করেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন। মোহিতলাল মজুমদারও এমএ পাশ ছিলেন না, তথাপি এখানে শিক্ষকতা করেছেন। আমি তো এমএ পাশ করবোই, দু’চার মাস এদিক-ওদিকের ব্যাপার। দরখাস্ত করে অন্যায়টা কী করেছি? শুনে ড. এনামুল হক কনে আঙুলটা মুখের ভেতর পুরে দিয়ে আমার দরখাস্তের সঙ্গে দাখিল করা থিসিসের পরিকল্পনার শিটগুলোর ওপর চোখ বুলোতে বুলোতে প্রশ্ন করলেন, তুমি কোন বিষয়ের ওপর কাজ করবে? কণ্ঠস্বর শুনে মনে হল ঝােঝ অনেকটা কমে এসেছে। আমি বিনীতভাবে জবাব দিলাম, আঠারোশো থেকে আঠারোশো আটান্ন সাল পর্যন্ত বাংলায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব, বিকাশ এবং বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতি এবং রাজনীতিতে তার প্রভাব। তখন ড. হক বললেন, তুমি মধ্যবিত্ত বলতে কী বোঝে সে বিষয়ে কিছু বলো। আমি হ্যারন্ড লাঙ্কি, বি.বি. মিশ্রের ইংরেজি গ্রন্থ থেকে যে সকল বচনামৃত বিনিদ্র রজনীর শ্রমে কণ্ঠস্থ করেছিলাম গড়গড় করে উগরে দিতে থাকলাম। ড. এনামুল হক ব্যাকরণের মানুষ। সমাজবিজ্ঞানের কচকচির ওপর দেখা গেল তার কোনো আগ্রহ নেই। চেয়ারটাতে হেলান দিয়ে মুনীর চৌধুরী সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনাদের প্রশ্ন থাকলে করেন। মুনীর চৌধুরী সাহেব ড. এনামুল হকের মনে আমার সম্পর্কে একটা ভালো ধারণা সৃষ্টি করার জন্য বললেন, ছেলেটার লেখার হাত ভালো এবং তরুণদের ওপর যথেষ্ট প্রভাব। আর কেউ প্রশ্ন করলেন না। কবীর চৌধুরী সাহেব বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যাও।
সেদিনই ঘণ্টা দুই পরে জানা গেলো আমাকে বিশেষ বিবেচনায় বাংলা একাডেমী গবেষণাবৃত্তির জন্য মনোনয়ন দিয়েছে। তার পরের দিন বাংলা বিভাগে মুনীর চৌধুরী সাহেবকে কৃতজ্ঞতা জানাতে গেলাম। তিনি তখন বিভাগীয় প্রধান। আমাকে দেখেই তিনি জিগগেস করলেন, তুমি তো এমএ করছে। পলিটিক্যাল সায়েন্সে? আমি হ্যাঁ বললাম। তিনি তখন বললেন, তোমার থিসিসটা বিশ্ববিদ্যালয়ে রেজিস্ট্রেশন করার সময় বাংলা বিভাগ থেকেই করতে হবে।
মুনীর চৌধুরী সাহেবের প্রস্তাবটা আমার মনঃপুত হয়নি। তথাপি সৌজন্যের খাতিরে আমি চুপ করে রইলাম। তিনি আমার মুখ দেখেই বুঝে নিলেন, তাঁর প্রস্তাবটা আমি গ্রহণ করিনি। তিনি বললেন, আমরা তোমাকে তিন বছর পড়িয়েছি। মাঝখান থেকে তুমি হুট করে পলিটিক্যাল সায়েন্সে পরীক্ষা দিয়ে বসলে। বুঝেছি, তুমি আমাদের ছাড়তে চাও। কিন্তু তোমাকে আমরা ছাড়বো কেনো? তুমি বাংলা বিভাগের অধীনে কাজ করতে রাজি না হলে বিশ্ববিদ্যালয়ে থিসিস রেজিষ্ট্রেশন করতেই দেবো না। আমি মুনীর চৌধুরী সাহেবের গুণগ্রাহিতার পরিচয় পেয়ে অভিভূত হয়ে গেলাম। কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইলাম।
ইন্টারভ্যুর প্রায় পনেরো দিন আগে মুনীর চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ করেছিলাম, তিনি যেনো সুপারিশ করেন, যাতে বাংলা একাডেমীর বৃত্তিটা পাই। চৌধুরী সাহেব আমাকে বলেছিলেন, যেহেতু তোমার এমএ-টা এখনও শেষ হয়নি, বাংলা একাডেমী তোমার আবেদন বিবেচনা নাও করতে পারে। তুমি যদি রাজি থাকো আমি তোমাকে অস্ট্রেলিয়া পাঠিয়ে দিতে পারি। ভাষাতত্ত্বের ওপর পিএইচডি করতে হলে শুধু গ্র্যাজুয়েশন থাকলে ওরা আপত্তি করবে না।
মুনীর চৌধুরী সাহেবের প্রস্তাব শুনে উল্লসিত হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু পরীক্ষণে নিজের ভেতর থেকে অনুভব করলাম, একটা সূক্ষ্ম আপত্তি জেগে উঠছে। আমি মাথা নিচু করে রইলাম এবং মেঝের দিকে তাকিয়ে বললাম, দুয়েক দিন ভেবে আপনাকে বলবো।
মুনির চৌধুরী সাহেবের প্রস্তাবটা গ্রহণ করবো কি না খুঁটিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে আমার চোখে পানি এসে গেল। দেশের বাইরে যাওয়ার এরকম একটা স্কলারশিপ পেলে আমি বর্তে যাই। সুযোগটা আপনি এসে ধরা দিয়েছে। আমার নিজেকে ভাগ্যবান মনে করা উচিত। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিলাম অত্যন্ত সৌজন্য সহকারে প্রফেসর মুনীর চৌধুরীর প্রস্তাবটা প্রত্যাখ্যানই করবো। আর এই প্রত্যাখ্যান করতে হচ্ছে বলেই চোখে পানি এসে গিয়েছিল। সুযোগ তো জীবনে বারবার আসে না।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে ভরতি হয়েছিলাম এবং তিন বছর পড়াশোনা করেছি। খুব ভালো ছাত্র না হলেও আমার বুদ্ধি বিবেচনা নিতান্ত তুচ্ছ পর্যায়ের ছিল না। মাতৃস্তন্যে শিশুর যেরকম অধিকার, শিক্ষকদের স্নেহের ওপরও ছাত্রদের সেরকম অধিকার থাকা উচিত। সেই স্নেহ আমি শিক্ষকদের কাছ থেকে পাইনি। তার পরিণতি এই হল যে আমি বাংলা বিভাগ ছেড়ে দিলাম এবং প্রাইভেট প্রার্থী হিসেবে পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাস কোর্সে পাশ করলাম। বিএ পাশ করার পর ঠিক করেছিলাম, অধিক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার আমার প্রয়োজন নেই। কিন্তু আমাকে আবার প্রাইভেটে পলিটিক্যাল সায়েন্সে এমএ পরীক্ষা দিতে হলো। সমস্ত বিষয়টা আমি এভাবে চিন্তা করলাম। শিক্ষকদের কাছ থেকে সামান্য উৎসাহ অনুপ্রেরণা যখন আমার ভীষণ প্রয়োজন ছিলো, সেই সময়ে কেউ আমার দিকে মুখ তুলে তাকাননি। যখন আমি নিজের চেষ্টায় উঠে আসতে শুরু করেছি, সকলে আমাকে অনুগ্রহ বিতরণ করে কৃতজ্ঞতাপাশে বাধতে চাইছেন। আমি মনে মনে স্থির করলাম, যে বস্তু প্রয়োজনের সময় হাজারবার কামনা করেও পাইনি, সেই বিশেষ সময়টি চলে যাওয়ার পর তার কিছু ক্ষতিপূরণ যদি আমার কাছে সোধে এসে ধরাও দেয়, আমি গ্রহণ করতে পারবো না। এই গ্রহণ করতে পারছি না বলেই চোখে পানি এসে গিয়েছিল। এরই মধ্যে একদিন তাঁর অফিসে গিয়ে বললাম, স্যার, ভাষাতত্ত্ব বিষয়টার প্রতিই আমি আকর্ষণ অনুভব করি না। সুতরাং উচিত হবে, স্কলারশিপটার জন্য অন্য কাউকে বেছে নেয়া। তিনি কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
মুনীর চৌধুরী সাহেব ছিলেন অত্যন্ত সংবেদনশীল মানুষ এবং তার বোধশক্তি ছিল অত্যন্ত তীক্ষ্ম। আমার ধারণা তিনি আমার অকথিত অভিযোগটি আঁচ করতে পেরেছিলেন। সে কারণেই আমার থিসিসটা বাংলা বিভাগের অধীনে রেজিষ্ট্রেশন করার জন্য চাপাচাপি করছিলেন। আমাদের ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হতে হতে উনিশশো একাত্তর সালের মার্চ মাস এসে গেলো। মার্চ মাসের একুশ তারিখে আমাদের ভাইভা-ভোসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হল। পঁচিশে মার্চ তারিখের মধ্যরাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তো ঘুমন্ত ঢাকা নগরীর ওপর আক্রমণ করেই বসলো। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। নয় মাস পর যখন ভারত থেকে দেশে এলাম, তখন প্রফেসর মুনীর চৌধুরী বেঁচে নেই। পাকিস্তানপন্থী রাজাকার-বাহিনী তাকে অন্যান্য বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে রায়ের বাজারের বধ্যভূমিতে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তার জন্য শোকার্ত সকল মানুষের সঙ্গে কণ্ঠ মেলাতে গিয়েও আমার একান্ত ব্যক্তিগত বেদনাটুকু বড় বেশি করে অনুভব করছিলাম। আমি এমন একজন মানুষকে হারালাম যিনি অভিমানের ভাষা বুঝতে পারতেন।
আমার একটা অপরাধবোধ রয়েছে। প্রচলিত নিয়ম ভেঙে সুযোগ দেয়ার পরও আমার পক্ষে পিএইচডি করা সম্ভব হয়নি। একা একা যখন চিন্তা করি আমার মনে একটা অপরাধবোধ ঘনিয়ে আসে। হয়তো আমি নিজের উগ্র অহংটাকে বড় বেশি প্রাধান্য দিয়ে প্রফেসর মুনীর চৌধুরীর উদারতার প্রতি অবিচার করেছিলাম। আজকাল সেরকম একটা অনুভূতি আমার মধ্যে জাগ্রত হয়। বোধহয় সেজন্য আমার পক্ষে পিএইচডি করা সম্ভব হয়নি। এটা হচ্ছে আমার অনুভব। পিএইচডি শেষ করতে না পারার অন্য যে বাস্তব কারণ তার জন্য প্রফেসর আবদূর রাজ্জাককে আমি দায়ী মনে করি।