উৎসর্গ
মানুষ পৃথিবীতে এসেছে পঞ্চ ইন্দ্রিয় নিয়ে। শোনা যায় কিছু মহাসৌভাগ্যবান মানুষ ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় নিয়েও আসেন। আমার কপাল মন্দ, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দূরের কথা পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের এক ইন্দ্রিয় কাজ করে না। দীর্ঘ পনেরো বছর ধরে আমি কোনো কিছুর গন্ধ পাই না। ফুলের ঘ্রাণ, লেবুর ঘ্রাণ, ভেজা মাটির ঘ্রাণ… কোনো কিছুই না।
এদেশের এবং বিদেশের অনেক ডাক্তার দেখালাম। সবাই বললেন, যে নার্ভ গন্ধের সিগন্যাল মস্তিষ্কে নিয়ে যায় সেই নার্ভ নষ্ট হয়ে গেছে। সেটা আর ঠিক হবে না। আমি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে গন্ধবিহীন জগৎ স্বীকার করে নিলাম।
কী আশ্চর্য কথা, অল্পবয়স্ক এক ডাক্তার আমার জগতকে সৌরভময় করতে এগিয়ে এলেন। দীর্ঘ পনেরো বছর পর হঠাৎ লেবু ফুলের গন্ধ পেয়ে অভিভূত হয়ে বললাম, এ-কী!
যিনি আমার জগৎ সৌরভময় করেছেন, তাঁর নিজস্ব ভুবনে শত বর্ণের শত গন্ধের, শত পুষ্প আজীবন ফুটে থাকুক–এই আমার তাঁর প্রতি শুভ কামনা।
ডা. জাহিদ
————–
০১.
নাকের ভেতর শিরশির করছে।
লক্ষণ ভালো না। তিনি চিন্তিত বোধ করছেন। হাঁচি উঠার পূর্বলক্ষণ! হাঁচি শুরু হয়ে গেলে সর্বনাশ। এই বিষয়ে তাঁর সমস্যা আছে। তাঁর হাঁচি একটা দুষ্টায় থামে না–চলতেই থাকে। তার সর্বোচ্চ রেকর্ড আটচল্লিশ। তিনি ভৈরব থেকে ট্রেনে করে গৌরীপুর যাচ্ছিলেন। আঠারোবাড়ি স্টেশন থেকে হাঁচতে শুরু করলেন, পরের স্টেশন নান্দাইল রোডে এসে থামলেন। তখন নাক দিয়ে রক্ত পড়তে শুরু করেছে। সাদা পাঞ্জাবি রক্তে মাখামাখি।
তিনি এখন যে জায়গায় বসে আছেন সে জায়গাটা হাঁচির বিশ্ব রেকর্ড করার জন্যে উপযুক্ত না। তিনি বসে আছেন দুর্গ টাইপ একটা বারান্দায়। বারান্দায় চৌদ্দটা কাঠের বেঞ্চ। বেঞ্চগুলিতে গাদাগাদি করে মানুষজন বসে আছে। এতগুলি মানুষের জন্যে এক কোনায় দুটা মাত্র ফ্যান। বারান্দার এক দিকে চারটা বন্ধু জানালা। সেই জানালাগুলিও ভারি লোহার শিক দিয়ে আটকানো। অন্যদিকে খুপড়ি খুপড়ি ঘর। ঘরগুলির দরজা খুললে দেখা যায় ঘরের ভেতর আরেকটা ঘর, কাচের দেয়াল দিয়ে আলাদা করা। কাচের দেয়ালের ওপাশে গম্ভীর মুখে আমেরিকান সাহেবরা বসে আছেন। ঘরগুলির নাম্বার আছে। একেক নাম্বারের ঘরে একেক জনের ডাক পড়ছে। ঘরে ঢোকা মাত্র দরজা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ভেতরে কী কথাবার্তা হচ্ছে বোঝার উপায় নেই। মোটামুটি ভয়াবহ অবস্থা। এই অবস্থায় তিনি তাঁর বিখ্যাত ধারাবাহিক হাঁচি দিয়ে সাদা পাঞ্জাবি রক্ত মাখিয়ে লাল করে ফেলতে পারেন না। আজ অবশ্যি তার গায়ে সাদা। পাঞ্জাবি নেই। হালকা সবুজ রঙের ফুল শার্ট পরে এসেছেন।
তার সিরিয়েল তের। এখন সাত নাম্বার যাচ্ছে। ছোটঘরে ঢোকার সময় এসে গেছে। তিনি প্রায় নিশ্চিত আমেরিকান সাহেবের মুখোমুখি হওয়া মাত্র তার হচি শুরু হবে। সাহেব প্রথম কিছুক্ষণ মজা পাবে, তারপর বিরক্ত হবে। কঠিন কঠিন প্রশ্ন শুরু করবে। তিনি হাঁচির যন্ত্রণায় কোনো প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারবেন না। তার ইংরেজিও এলোমেলো হয়ে যাবে। তিনি নিজে ইংরেজির শিক্ষক। ভুল-ভাল ইংরেজি বলা তার জন্যে লজ্জার ব্যাপার হবে। সাহেব জেনারেল নলেজের কোনো প্রশ্ন করবে কি-না কে জানে। আমেরিকার ইতিহাস বিষয়ে দুএকটা প্রশ্ন করলে করতেও পারে। সে বিষয়ে মোটামুটি প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন। আমেরিকার সব প্রেসিডেন্টের নাম, তাদের সংক্ষিপ্ত জীবনী তাঁর জানা আছে। প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনকে যে গুলি করে মেরেছিল তার নাম উইলিয়াম বুথ। সেই সময় আব্রাহাম লিংকন থিয়েটার দেখছিলেন। তাঁর হাতে ছিল একটা উপন্যাস–নাম আংকেল টমস কেবিন। উপন্যাসটা তার পড়া। তবে মূল ইংরেজিতে পড়েন নি। অনুবাদ পড়েছেন। বাংলা অনুবাদের নাম টমকাকার কুটির। নামটা সুন্দর হয়েছে। ইংরেজি নামের চেয়েও ভালো হয়েছে।
প্রথমে কি নাম জিজ্ঞেস করবে? ওদের তো আবার নামের আলেক ঝামেলা আছে। ফার্স্ট নেম, লাস্ট নেম, মিডল নেম। তাঁর নাম শামসুদ্দিন আহমেদ। শামসুদ্দিন ফার্স্ট নেম। আহমেদ লাস্ট। মিডল নেম বলে কিছু নেই। মিডল নেম জিজ্ঞেস করলে কি ডাক নাম বলবেন? তার ডাক নামটা খুব অদ্ভুত। তবে সাহেবদের চোখে অদ্ভুত কিছু ধরা পড়বে না। ওদের কাছে শামসুদ্দিনও অদ্ভুত, আবার আহমেদও অদ্ভুত।
চাচা মিয়া, আপনার সিরিয়েল কত?
শামসুদ্দিন চমকে উঠে দেখলেন তাঁর সামনে অতিরিক্ত রোগা, অতিরিক্ত লম্বা, প্রায় বক পাখি টাইপ একটা ছেলে অতিরিক্ত লম্বার কারণেই কুঁজো হয়ে দাড়িয়ে আছে। সে-ই সিরিয়েল জিজ্ঞেস করছে চাপা গলায় যেন খুবই গোপন কোনো খবর জানতে চাচ্ছে। তিনি আগ্রহ নিয়ে ছেলেটার দিকে তাকালেন। বয়স অল্প, বাইশ তেইশের বেশি হবে না। চোখে চশমা। চশমার ফ্রেম অনেক বড় বলে মুখটা ছোট লাগছে। অল্প বয়সেই বেচারার মাথায় টাক পড়ে গেছে। মাথার এক দিকের চুল লম্বা করে টাকের উপর দিয়ে টাক ঢাকার একটা চেষ্টা
সে চালিয়েছে; তাতে লাভ হয় নি। ছেলেটা আগের মতোই ফিসফিসে গলায় বলল, বসি আপনার পাশে?
সীটটা খালি আছে না?
শামসুদ্দিন বললেন, খালি আছে। বসো।
আগে যেখানে বসেছিলাম সেখানে মাথার উপরে ফ্যান নাই। অন্যসময় গরমে আমার সমস্যা হয় না। কিন্তু টেনশানের সময় গরম সহ্য করতে পারি না। প্যালপিটিশন হয়।
শামসুদ্দিন নিচু গলায় বললেন, টেনশন হচ্ছে?
ছেলেটা অবাক হয়ে তাকাল। মনে হয় অনেক দিন সে এরকম অদ্ভুত প্রশ্ন কারো কাছ থেকে শুনে নি। বোকামি ধরনের প্রশ্নের জবাব দেয়াও অর্থহীন- এ রকম ভঙ্গি করে সে বলল, আপনার সিরিয়েল কত?
তের।
ছেলেটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আপনি খুবই লাকি মানুষ।
কেন?
লাকি নাম্বার পেয়েছেন। অনেকে বলে থার্টিন অনলাকি। আসলে লাকি। কিরোর নিউমারলজি বই-এ আমি নিজে পড়েছি। আপনার সিরিয়েল খার্টিন। তিন আর এক যোগ করলে কত হচ্ছে চার না?
হ্যাঁ চার।
আজকের তারিখটা খেয়াল করেন। বাইশ তারিখ। দুই-এ আর দুই-এ কত হচ্ছে–চার না? সহজ হিসাব। আপনি ইনশাল্লাহ ভিসা পেয়ে যাবেন।
তিনি ভালোমতো ছেলেটাকে লক্ষ করলেন। কপাল কুঁচকে বসে আছে। হাতে নানান ফাইলপত্র। স্থির হয়ে সে যে বসে আছে তাও না। ক্রমাগত নড়াচড়া করছে। তিনি ছেলেটাকে আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সিরিয়েল নাম্বার কত?
আমার ফর্টি ওয়ান।
ফর্টি ওয়ান কি লাকি?
আমার জন্যে খুবই অনলাকি। তবে আমেরিকানদের কথা কিছুই বলা যায়। যাদের ভিসা পাওয়ারই কথা না তাদের পাঁচ বছরের মাল্টিপল ভিসা দিয়ে দিচ্ছে। জেনুইনদের রিফিউজ করে দিচ্ছে। আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। আপনি পেয়ে যাবেন।
লাকি নাম্বার, এই জন্যে পাব?
তা না- বুড়োদের এরা ভিসা দিয়ে দেয়। আপনার মুখে দাড়ি নেই, এটা একটা এডভানটেজ। যাদের মুখে চাপদাড়ি এদের ভিসা দেয় না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, এরা লম্বা দাড়ি দেখলেই ভাবে খোমনীর লোক।
খোমেনীর লোক মানে?
ইরানের খোমনীর নাম শোনেন নাই? আপনি তো দেখি গুহামানব। যা হোক বাদ দেন। আপনার নাকে সর্দি। নাক ঝেড়ে আসেন। নাকে সর্দি নিয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে নট কৱে দেবে। পিছনে চলে যান, দেখবেন একটা দরজার গায়ে লেখা রেস্ট রুম। এরা পায়খানাকে বলে রেস্ট রুম।
তুমি কি আগেও এখানে এসেছ?
এটা আমার গার্ড টাইম। এবার না হলে আর হবে না। তবে এবার ইনশাল্লাহ আমার হবে। আজমীরে গিয়েছিলাম, খাজা বাবার দোয়া নিয়ে এসেছি। খাজা বাবার দোয়া নিয়ে যারা ভিসার জন্যে এসেছে সবারই ভিসা হয়েছে। এক হিন্দু ফ্যামিলিকে আমি চিনি। খাজা বাবার দোয়া নিয়ে এসে গুষ্ঠিসুদ্ধ ভিসা পেয়েছে। ইনকুডিং তাদের বাড়ির কাজের বুয়া।
শামসুদ্দিন উঠে দাঁড়ালেন। খুপড়ি ঘর থেকে সুন্দরমতো একটা মেয়ে বের হয়েছে। তিন চার বছরের একটা ফুটফুটে ছেলে তার হাত ধরে আছে। মেয়েটির চোখে পানি। সে শাড়ির আঁচলে যতই চোখ মুছছে ততই পানি বেশি বের হচ্ছে। আর ছেলেটা খুবই অবাক হয়ে মার কান্না দেখছে। শামসুদ্দিন সাহেবের মন খারাপ হয়ে গেল। বুঝাই যাচ্ছে বেচারির মেয়েটির ভিসা হয় নি। হয়তো স্বামী পড়ে আছে আমেরিকায়, সে যেতে পারছে না। ছেলেটি হয়তো তার বাবাকে দেখে নি।
তিনি রেস্ট রুম খুঁজে পাচ্ছেন না। সারি সারি বেশ কিছু ঘর। কোনোটাতেই রেস্টরুম লেখা নেই। বড় দরজার পাশে কালো পোশাক পরা মিলিটারীদের মতো দেখতে একটা লোক বসে আছে। সে তাঁর দিকে কটমট করে তাকাচ্ছে। রেস্টরুম কোন দিকে এই লোককে জিজ্ঞেস করা কি ঠিক হবে? জিজ্ঞেস করতে হবে ইংরেজিতে। দয়া করে বলবেন বাথরুম কোন দিকে?– এর ইংরেজি কী হবে? Kindly show me the Way to the bathroom। ইংরেজি কি ঠিক আছে? বাথরুমের আগে কি The আর্টিকেলটা বসবে?
জিজ্ঞাসা করার আগেই বকের মতো দেখতে ছেলেটা ছুটে এলো। তাকে খুবই উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে। সে হড়বড় করে বলল, চাচা মিয়া যান, তাড়াতাড়ি যান। ডাক পড়েছে। ইয়া মুকাদ্দেমু বলে ঘরে ঢুকবেন। কোনো প্রশ্ন করলে জবাব দেবার আগে মনে মনে বলবেন ইয়া মুকাদ্দেমু।
নাক ঝাড়া হলো না তো।
রুমাল নাই? না থাকলে পাঞ্জাবির কোনায় মুছে ফেলেন।
তোমার নাম কী?
আমার নাম দিয়ে এখন দরকার নাই। আগে ইন্টারভ্যু সেরে আসেন। ইয়া মুকাদ্দেমু ইয়া মুকাদ্দেমু বলতে বলতে যান। ইয়া মুকাদ্দেমু আল্লাহর একটা পাক নাম। এর অর্থ হে অগ্রসরকারী। যে-কোনো ইন্টারভ্যুতে এই নাম কাজে আসে।
তাঁর ডাক পড়েছে চার নাম্বার ঘরে। গম্ভীর মুখে আমেরিকান এক সাহেব জানালার ওপাশে দাঁড়িয়ে। তার ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে আমেরিকান সাহেব বলল–হ্যালো। সহজভাবে ভদ্র ভঙ্গিতে বলল।
শামসুদ্দিন থতমত খেয়ে গেলেন। সাধারণত টেলিফোনেই হ্যালো বলা হয়। মুখোমুখি কারো সঙ্গে দেখা হলেও কি হালো বলা হয়? এর উত্তরে কি তাকেও হ্যালো বলতে হবে? নাকি তিনি বলবেন গুড মর্নিং? বারটা বেজে থাকলে তো গুড মর্নিং বলা যাবে না। বলতে হবে গুড আফটারনুন।
তিনি কিছু বলার সুযোগ পেলেন না। পর পর চারবার হাঁচি দিলেন। সাহেবটা বলল, ব্লেস ইউ। শামসুদ্দিন আরো হকচকিয়ে গেলেন। তাঁকে পুরোপুরি বিস্মিত করে দিয়ে আমেরিকান সাহেব সুন্দর বাংলায় বলল–আপনার ফার্স্ট নাম শামসুদ্দিন? পারিবারিক নাম আহমেদ?
তিনি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়লেন।
আমেরিকা যেতে চান কেন?
বেড়াতে যাব স্যার।
কথাটা মিথ্যা বলা হলো। তিনি দরিদ্র মানুষ। তার মতো দরিদ্র মানুষরা বেড়াতে যায় না। আর গেলেও তাদের দৌড় কক্সবাজার পর্যন্ত। আমেরিকায় যাবার পেছনে তার তুচ্ছ একটা কারণ আছে। তিনি একজনের সঙ্গে দেখা করতে চান। দুই মিনিটের জন্যে দেখা হলেও হবে। তুচ্ছ কারণটা কি সাহেবকে বলা ঠিক হবে?
আপনি কী করেন?
শিক্ষকতা করতাম। সম্প্রতি অবসর নিয়েছি। প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা পেয়েছি। আগের কিছু সঞ্চয় আছে। আমার এক ছাত্র আছে ট্রাভেলিং এজেন্সিতে কাজ করে। সে সস্তায় টিকিট কিনে দেবে।
আপনার স্ত্রী, ছেলে মেয়ে তারা সঙ্গে যাবে না?
আমার স্ত্রী ছেলে কেউ নেই। আমি একা মানুষ।
বিবাহ করি নাই।
আপনার পাসপোর্টে তো দেখি আর কোনো দেশের সিল নেই। দেশের বাইরে কখনো যনি নি?
জি না।
আমেরিকার কোন জিনিসটা দেখার ব্যাপারে আপনার আগ্রহ?
নায়াগ্রা জলপ্রপাতের নাম শুনেছি। এটা দেখার ইচ্ছা আছে।
গ্র্যান্ড কেনিয়ন দেখে আসবেন। দেখার মতো দৃশ্য। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে এমট্রেকে চড়বেন–দুই থেকে আড়াইঘণ্টা লাগবে। ট্রেন জার্নিটাও সুন্দর। অবজারভেশন ডেক আছে, আমেরিকা দেখতে দেখতে যাবেন।
জি আচ্ছা জনাব। তবে ক্যালিফোর্নিয়া যেতে পারব বলে মনে হয় না। আমি খুব সামান্য টাকা পয়সা নিয়ে যাব। আমার এক ছাত্র থাকে মেরিল্যান্ডে, তার বাড়িতে থাকব। সে যেখানে যেখানে নিয়ে যায় সেখানে যাব। এর বেশি আমার সাধ্য নাই।
বিকেল তিনটার সময় এসে পাসপোর্ট নিয়ে যাবেন।
জি আচ্ছা।
চারটা হাঁচি দিয়ে তিনি থেমে গিয়েছিলেন। এখন আবার শুরু হলো। তিনি হাঁচি দিয়েই যাচ্ছেন। আমেরিকান ভদ্রলোক অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বিড়বিড় করে কী যেন বলল–হাঁচির শব্দে ভালো শোনা গেল না। তিনি হাঁচতে হাঁচতেই ঘর থেকে বের হলেন। বক ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এসে তার হাত ধরল। উদ্বিগ্ন গলায় বলল, ঘটনা কী? ভিসা দিয়েছে? না-কি রিজেকশন?
জানি না।
পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে দিয়েছে?
না। তিনটার সময় এসে নিয়ে যেতে বলেছেন। বলেন কী! তাহলে তো ভিসা পেয়ে গেছেন। বলেছিলাম না পাবেন। তের নাম্বার আনলাকি এটা খুবই বোগাস কথা। পৃথিবীর সবচে লাকি নাম্বার তের। হাঁচি বন্ধ করেন। এখন হাঁচির টাইম না।
তাঁর হাঁচি বন্ধ হয়ে গেল। তিনি বললেন, তোমার নামটা জানা হলো না।
আমার আগে নাম ছিল মোহাম্মদ জয়নাল হোসেন খন্দকার। এখন নাম পাল্টে রেখেছি রোজারিও গোমেজ জয়নাল। চার্চে গিয়ে খ্রিষ্টান হয়ে গেছি। তারপর এফিডেবিট করে নাম বদলেছি।
সে-কী! কেন?
খ্রিষ্টানদের জন্যে ভিসা পাওয়া খুব সুবিধা। আমার দুই বন্ধু খ্রিষ্টান হয়ে বিদেশে ভিসা পেয়ে চলে গেছে। একজন গেছে ফ্রান্সে, আরেকজন অস্ট্রেলিয়া।
ভিসার জন্যে খ্রিষ্টান হয়ে গেলে?
উপরে উপরে হয়েছি। ভিতরে খাঁটি মুসলমান। সময় সুযোগ হলেই মাগরেবের নামাজটা পড়ি। তাছাড়া যিশু খ্রিষ্টও আমাদের নবী ছিলেন। আগে আমি একজন নবীর কেয়ারে ছিলাম। এখন দুইজনের কেয়ারে আছি।
খ্রিষ্টান হয়ে গেছ, বাবা-মা কিছু বলল না?
বাবা-মা কেউ নাই। মামাদের সংসারে মানুষ হয়েছি। তারা এইসব কিছু জানেও না।
শামসুদ্দিন আবারো হাঁচতে শুরু করলেন। জয়নাল বলল, আপনার তো চাচাজি অবস্থা খারাপ, নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। আপনি একজন ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করেন। তারপর বাসায় গিয়ে শান্তিমতো ঘুম দেন। আপনার কাজ তো হয়েই গেল। আসল জায়গায় ভিসা পেয়ে গেছেন। ইউরোপের যে-কোনো দেশের ভিসা এখন চোখ বন্ধ করে পাবেন। পাসপোর্টে আমেরিকান ভিসা দেখলে এরা ঝিম মেরে যায়। আপনি হলেন লাকি ম্যান অব দ্য সেঞ্চুরি।
তোমার ইন্টারভ্যু হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি–তোমার কী হলো জেনে যাই। মনে হচ্ছে তোমার ভিসা পাওয়াটা অত্যন্ত জরুরি।
জয়নাল চোখ বড় বড় করে বলল, সত্যি অপেক্ষা করবেন?
হ্যাঁ করব।
জয়নাল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। বিড়বিড় করে বলল, কতক্ষণে ডাক আসে কে জানে!
সমস্যা নাই, অপেক্ষা করি। আমার কোনো জরুরি কাজ নাই।
সামনে বসেন। একটা পর্যন্ত ইন্টারভ্যু চলে, তার আগেই ইনশাল্লাহ আমারটা হয়ে যাবে। চুপচাপ বসে না থেকে আমার জন্যে একটু দোয়া করেন। আপনি হলেন লাকি ম্যান অব দ্য সেঞ্চুরি। আপনার দোয়া আল্লাহ শুনবে।
আমি দোয়া করব।
জয়নাল কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরে আবারো এসে তার পাশে বসল। তখন তাকে খুবই দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মনে হচ্ছে। মুখ বড় বড় করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। শরীর ঘামছে। শামসুদ্দিন বললেন, কী ব্যাপার?
অবস্থা খুবই খারাপ। তিন নম্বর ঘরে একটা মেয়ে ইন্টারভ্য নিচ্ছে। যার ডাক সেই ঘরে পড়ছে সে-ই ধরা খাচ্ছে। আমার মনে হচ্ছে ঐ হারামজাদির ঘরেই ডাক পড়বে। খাজা বাবার দোয়া নিয়ে এসেছিলাম। এবারো হবে না কারণ খ্রিষ্টান হয়ে যাবার কারণে খাজা বাবা রাগ করেছেন।
আবার মুসলমান হয়ে যাও।
মুসলমান তো হয়েই আছি। নতুন করে কী হবো? ভিসা পাওয়ার একটা কৌশল। খাজাবাবা এই সাধারণ জিনিসটা বুঝতে পারছেন না এটা একটা অফিসোস। স্যার, চলেন চা খাই। রাস্তার মোড়ে চায়ের দোকান আছে, ভালো চা বানায়।
তোমার যদি ভিসা হয় আমাকে খবর দিও।
ভিসা হলেও খবর দিব, না হলেও খবর দিব। একটা পরিচয় যখন হয়েছে।
তুমি পড়াশোনা কতদূর করেছ?
দুবার ইন্টারমিডিয়েট দিয়ে ধরা খেয়েছি। দুবারই নকলের ভালো সুবিধা পেয়েছিলাম। নিশ্চিন্ত মনে নকল করেছি। পরীক্ষার সময় টিচারও ভালো পেয়েছিলাম–নকলে হেল্প করেছেন। তারপরেও কিছু হয় নি। সবই কপাল! কপাল ফেটে তিন চার টুকরা হয়ে আছে। আমেরিকায় যেতে পারলে ফাটা কপাল জোড়া লাগাতাম। কপাল জোড়া লাগানোর আইকা গাম শুধুমাত্র সাদা চামড়াদের দেশেই পাওয়া যায়। আমার কপাল জোড়া লাগে–আল্লাহপাকের সেটাও ইচ্ছা না।
এখনই এত নিরাশ হয়ো না। হয়তো ভিসা পাবে।
পাব না। স্বপ্নেও দেখেছি পাব না। গত রাতে স্বপ্ন কী দেখেছি শুনলেই বুঝবেন। স্বপ্ন দেখেছি পুকুরপাড় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি–হঠাৎ পা পিছলে পুকুরে পড়ে গেছি। সাঁতার কেটে পাড়ে উঠতে যাব, সেখানে অদ্ভুত কিছু জন্তু দাঁড়িয়ে আছে–চ্যাপ্টা মুখ, বড় বড় দাত। পাড়ে উঠতে পারছি না। যতবার উঠতে চাই জন্তুগুলি লাথি দিয়ে ফেলে দেয়।
জয়নালের হতাশ মুখের দিকে তাকিয়ে শামসুদ্দিন সাহেবের মনটা খারাপ হয়ে গেল। নিয়ম থাকলে তিনি অবশ্যই তার পাসপোর্টটা ছেলেটার হাতে দিয়ে দিতেন এবং আনন্দের সঙ্গে বলতেন–যাও, আমেরিকায় যাও।
শামসুদ্দিন টিভির সামনে বসে আছেন। টিভিতে সিসেমিস স্ট্রিট নামে শিক্ষামূলক কী একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। বকের মতো পোশাক পরা একটা লোক টেনে টেনে কথা বলছে। দেখতে ভালো লাগে না আবার খারাপও লাগে না। তার ঝিমুনির মতো এসে গেল। কখন ঘুমিয়ে পড়লেন নিজেও জানেন না। ঘুমের মধ্যে লম্বা চওড়া এক স্বপ্নও দেখে ফেললেন। স্বপ্নে নৌকায় করে নানার বাড়ি যাচ্ছেন। নৌকার মাঝি দেখতে সিসেমিস স্ট্রিটের বকের মতো। নৌকা চালাবার ফাঁকে ফাঁকে সে তার লম্বা ঠোঁটটা দিয়ে শামসুদ্দিনের পেটে খোঁচা দিয়ে দিয়ে বলছে- ও চৈতার বাপ। ঘুমাও কেন? নদীর দুই ধারে সুন্দর সুন্দর সিনারি। সিনারি দেখ। ও চৈতার বাপ।
চৈতার বাপ তার শৈশবের একটা নাম। এই নামে তার বাবা তাকে ডাকতেন। এই অদ্ভুত নামটা তিনি তাঁর নিজের ছেলেকে কেন দিয়েছিলেন শামসুদ্দিন সেটা জানেন না। তার ডাক নামটা খুবই অদ্ভুত এটা বোঝার আগেই তার বাবা মারা গেলেন। অদ্ভুত নামের রহস্য আর জানা হলো না। নামটা শামসুদ্দিন সাহেব নিজেও ভুলে গিয়েছিলেন। প্রায় পঞ্চাশ বছর পর আমেরিকান এম্বেসির ভিসাপ্রার্থীর ওয়েটিং রুমে ছেলেবেলার নামটা ঘুমের মধ্যে মনে পড়ল।
বকের মতো মাঝিটা বড় বিরক্ত করছে। ক্রমাগত চৈতার বাপ চৈতার বাপ বলে গায়ে খোঁচা দিচ্ছে। শামসুদ্দিন বিরক্ত হয়ে চোখ মেলে দেখলেন জয়নাল তার গায়ে ধাক্কা দিচ্ছে। জয়নালের চোখ ভেজা। তার হাত-পা কাপছে। তিনি লক্ষ করলেন তাদের ঘিরে কিছু লোকজন দাড়িয়ে আছে।
শামসুদ্দিন দুঃখিত গলায় বললেন, ভিসা হয় নি?
জয়নাল জবাব দিল না। তার মুখ স্বাভাবিক করুণ দেখাচ্ছে। মনে হচ্ছে ছেলেটা এখনই কেঁদে ফেলবে।
ঐ মেয়েটার ঘরে ডাক পড়েছিল? তিন নম্বর ঘর?
জি।
কী বলে ছেলেটাকে সান্ত্বনা দেবেন শামসুদ্দিন বুঝতে পারছেন না। সান্ত্বনার দুএকটা কথা বলতে ইচ্ছা করছে। জয়নাল উদাস গলায় বলল, চলুন বের হই।
চল। বেশি মন খারাপ করো না।
জয়নাল বলল, আপনি কি এখনই বাসায় চলে যাবেন? পাঁচটা মিনিট আমার সঙ্গে থাকেন। এক কাপ চা খান। চায়ের পয়সা আমি দিব।
বেশতো চুল।
দূর্গের ভেতর থেকে তারা বের হয়েছেন। ছেলেটা মাথা নিচু করে হাঁটছে। একবার সার্টের হাতায় চোখ মুছল। শামসুদ্দিনের মনটা অস্বাভাবিক খারাপ হয়ে গেল। তিনি ছেলেটার পিঠে হাত রাখলেন।
জয়নাল বলল, আপনি কোথায় থাকেন ঠিকানাটা বলুন। আপনার সঙ্গে যোগাযোগ রাখব। ইনশাল্লাহ দুইজন একসঙ্গেই আমেরিকা যাব। আপনি খুবই নরম লোক–আপনাকে গাইড না করলে বিরাট বিপদে পড়বেন।
শামসুদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, ভিসা ছাড়া তুমি আমেরিকা যাবে কীভাবে?
জয়নাল লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, চাচা মিয়া, আমার ভিসা হয়েছে। অনেক লোকজন ছিল তো এই জন্যে কিছু বললাম না। তাদের চোখ লাগতে পারে। হয়তো কারো চোখ লেগে গেল দেখা যাবে শেষ মুহূর্তে কিছু একটা হয়েছে। পাসপোর্টে সিল পড়ে নাই।
ঐ মেয়ে তোমাকে ভিসা দিয়েছে?
জি। কিছুই জিজ্ঞেস করে নাই। একবার শুধু মুখের দিকে তাকাল। খসখস করে একটা কাগজে কী ফেন লিখল। তারপর বলল, তিনটার সময় এসে পাসপোর্ট নিয়ে যেও।
জয়নালের চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। অথচ মুখটা হাসি হাসি। নান্দাইল হাই স্কুলের প্রাক্তন শিক্ষক শামসুদ্দিন সাহেবের মনে হলো তিনি তাঁর দীর্ঘ জীবনে যে অল্প কটি অসাধারণ দৃশ্য দেখেছেন এটি তার একটি। তার নিজের চোখেও পানি এসে গেল।