০১. নর-নারীর আবির্ভাব

০১.

মাঝে মাঝে আমাদের এই অঞ্চলে এমন সব নর-নারীর আবির্ভাব হয় যে, তার পর যত দীর্ঘকালই কেটে যাক না কেন, তাদের কথা স্মরণে এলেই যেন অন্তরাত্মা পর্যন্ত শিউরে ওঠে। এবং এদের মধ্যে নিশ্চয়ই পড়ে এক ব্যবসায়ীর স্ত্রী, কাতেরিনা লভভূনা ইসমাইল। এর জীবন এমনই বীভৎস নাটকীয় রূপ নিয়েছিল যে, আমাদের সমাজের পাঁচজন ভদ্রলোক কোনও এক মশকরাবাজের অনুকরণে একে নাম দিয়েছিল, মৃৎসেন জেলার লেডি ম্যাকবেৎ।

কাতেরিনা তেমন কিছু অপূর্ব রূপসী ছিল না, কিন্তু চেহারাটি ছিল সত্যই সুশ্রী। তখন তার বয়েস সবে চব্বিশ; মাঝারি রকমের খাড়াই, ভালো গড়ন আর গলাটি যেন মার্বেল পাথরে কোদাই। ঘাড় থেকে বাহু নেমে এসেছে সুন্দর বাঁক নিয়ে, বুক আঁটসাঁট, নাকটি বাঁশির মতো শক্ত আর সোজা, শুভ্র উন্নত ললাট আর চুল এমনিই মিশমিশে কালো যে আসলে ওটাকে কালোয়-নীলে মেশানো বলা যেতে পারে। তার বিয়ে হয়েছিল ব্যবসায়ী ইসমাইলফের সঙ্গে। সে বিয়েটা প্রেম বা ওই ধরনের অন্য কোনও কারণে হয়নি– আসলে ইসমাইল তাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল ওই যা, আর কাতেরিনা গরিবের ঘরের মেয়ে বলে বিশেষ বাছবিচার করার উপায় তার ছিল না।

ইসমাইলফ পরিবার আমাদের শহরে গণ্যমান্যদের ভিতরই। তাদের ব্যবসা ছিল সবচেয়ে সেরা ময়দার, গম পেষার জন্য বড় কল তারা ভাড়া নিয়েছিল, শহরের বাইরে ফলের বাগান থেকে তাদের বেশ দু পয়সা আসত এবং শহরের ভিতরে উত্তম বসতবাড়ি। মোদ্দা কথায়, তারা ধনী ব্যবসায়ীগুষ্ঠির ভিতরেরই একটি পরিবার। তার ওপর পরিবারটিও মোটেই পুষ্যিতে ভর্তি নয়। শ্বশুর তিমোতেইয়েভি ইসমাইল, আশির মতো বয়েস, বহুকাল পূর্বে তার স্ত্রী মারা গেছে। তার ছেলে, কাতেরিনার স্বামী জিনোভিই বরিসিছ, পঞ্চাশের চেয়েও বেশ কিছু বেশি আর সর্বশেষে কাতেরিনা, ব্যস। পাঁচ বছর হল কাতেরিনার বিয়ে হয়েছে কিন্তু এখনও ছেলেপুলে কিছু হয়নি। প্রথম পক্ষের স্ত্রীও কোনও সন্তান রেখে যায়নি– জিনোভিইয়ের সঙ্গে কুড়ি বছর ঘর করার পরও। তার মৃত্যুর পর সে কাতেরিনাকে বিয়ে করে। এবারে সে আশা করেছিল, বুঝি ভগবানের আশীর্বাদ এ-বিয়ের ওপর নেমে আসবে বংশের সুখ্যাতি সম্পত্তি বাঁচাবার জন্য সন্তান হবে, কিন্তু কপাল মন্দ, কাতেরিনার কাছ থেকেও কিছু পেল না।

এই নিয়ে জিনোভিইয়ের মনস্তাপের অন্ত ছিল না, এবং শুধু সে-ই না, বুড়ো বরিসেরও। কাতেরিনারও মনে এই নিয়ে গভীর দুঃখ ছিল। আর কিছু না হোক– এই যে অন্তহীন একঘেয়ে জীবন তাকে মূঢ় মুহ্যমান করে তুলছে তার থেকে সে নিষ্কৃতি পেত, ভগবান জানেন। কতখানি আনন্দ পেত সে, যদি নাওয়ানো খাওয়ানো জামা-কাপড় পরানোর জন্য একটি বাচ্চা থাকত তার নিষ্কৃতি পেত এই বন্ধ, উঁচু পাঁচিলওলা, মারমুখো কুকুরে ভর্তি বাড়িটার অসহ্য একঘেয়েমি থেকে। শুধু তাই নয়, ওই এক খোটা শুনে শুনে তার প্রাণ অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল– বিয়ে করতে গেলি কেন, তুই? একটা ভদ্রলোকের জীবন সর্বনাশ করলি তুই মাগী, বাঁজা পাঁঠী। যেন মারাত্মক পাপটা তারই, সে পাপ তার স্বামীর বিরুদ্ধে, শ্বশুরের বিরুদ্ধে, এমনকি তাদের কুল্লে সাধু ব্যবসায়ীগুষ্ঠির বিরুদ্ধে!

ধনৈশ্বর্য, আরাম-আয়েশে পরিপূর্ণ এই বাড়িতে কাতেরিনার ছিল সবচেয়ে নিঃসঙ্গ জীবন। দেখাটেখা করতে সে যেত খুবই কম এবং যদি-বা তার স্বামীর সঙ্গে তার ব্যবসায়ী বন্ধুদের বাড়িতে যেত তাতেও কোনও আনন্দ ছিল না। ওরা সব প্রাচীন ধরনের কড়া লোক। তারা। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখত, সে কীভাবে বসে, তার আচরণ কীরকম, সে কীভাবে আসন ত্যাগ করে; ওদিকে কাতেরিনা তেজি মেয়ে এবং দুঃখদৈন্যে শৈশব কেটেছে বলে সে অনাড়ম্বর ও মুক্ত জীবনে অভ্যস্ত। পারলে সে এখখুনি দুটো বালতি, দু হাতে নিয়ে ছুটে যায় জাহাজঘাটে। সেখানে শুধু শেমিজ গায়ে স্নান করতে। কিংবা বেড়ার ফাঁক দিয়ে রাস্তার ওই ছোঁড়াটার গায়ে বাদামের খোসা ছুঁড়ে মারতে। কিন্তু হায়, এখানে সবকিছু সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভোর হওয়ার পূর্বেই তার শ্বশুর আর স্বামী ঘুম থেকে উঠে জালা জালা চা খেয়ে ছ-টার ভিতর কাজ কারবারে বেরিয়ে যান, আর সে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ একা একা আলস্যে আলস্যে এ-ঘর ও-ঘর করে করে ঘুরে মরে। সবকিছু ছিমছাম, ফাঁকা। দেব-দেবীদের সামনে স্তিমিত প্রদীপ জ্বলছে। সমস্ত বাড়িতে আর কোনও জনমানবের চিহ্ন নেই, কারও কণ্ঠস্বরের লেশমাত্র নেই।

কাতেরিনা ফাঁকা এ-ঘর থেকে ফাঁকা ও-ঘরে যায়, তার পর আরেক দফা আরো খানিকক্ষণ ঘোরাঘুরি করে, তার পর একঘেয়েমির জন্য হাই তোলে। তার পর সরু সিঁড়ি বেয়ে ধীরে ধীরে ওঠে উঁচুতে নিজেদের শোবার ঘরে। সেখানে খানিকক্ষণ অলস নয়নে তাকিয়ে থাকে নিচের দিকে যেখানে দড়ি বানাবার পাটসুতো ওজন করা হচ্ছে কিংবা অতি উৎকৃষ্ট মিহিন ময়দা গুদামে পোরা হচ্ছে। আবার সে হাই তোলে– তাই করে যেন সে খানিকটে আরাম পায়। তার পর ঘণ্টাখানেক, ঘন্টা দুই ঘুমিয়ে ওঠার পর আবার আসবে সেই একঘেয়েমি রুশদেশের খাঁটি একঘেয়েমি, ব্যবসায়ী বাড়ির একঘেয়েমি। সে-একটানা, বৈচিত্র্যহীন একঘেয়েমি এমনই নিরস্ত্র যে তাই লোকে বলে, তখন কোনও গতিকে কোনও একটা বৈচিত্র্য আনার জন্য মানুষ সানন্দে গলায় দড়ি দিয়ে দেখতে চায় তাতে করে কিছু একটা হয় কি না। কাতেরিনার আবার বই পড়ারও বিশেষ শখ ছিল না; আর থাকলেই-বা কী? বাড়িতে ছিল সর্বসুদ্ধ একখানা বই– কিয়েফ শহরে সংকলিত সন্তদের জীবনী।

ধনদৌলতে ভরা শ্বশুরের এই বাড়িতে কাতেরিনার পুরো পাঁচটি বছর কেটে গেল অসহ্য একঘেয়েমিতে– মমতাহীন স্বামীর সঙ্গে সহবাস করে। কিন্তু আকছারই যা হয়– এক্ষেত্রেও কেউ সেদিকে ক্ষণতরেও ভ্রুক্ষেপ করল না।

.

০২.

কাতেরিনার বিয়ের ছ-বছর পর যে-বাঁধের জলে ইসমাইলদের গম-পেষার কল চলত সেটা ফেটে গেল। আর অদৃষ্ট যেন ওদের ভেংচি কাটবার জন্যই ঠিক ওই সময়ে মিলের ওপর পড়ল প্রচণ্ড কাজের চাপ। তখন ধরা পড়ল যে ভাঙনটা প্রকাণ্ড। জল পৌঁছেছে সক্কলের নিচের ধাপে। জোড়াতালি দিয়ে কোনও গতিকে ভাঙনটাকে মেরামত করার সর্ব প্রচেষ্টা হল নিষ্ফল। জিনোভিই আশপাশের চতুর্দিক থেকে আপন লোকজন গম-কলে জড় করে সেখানে ঠায় বসে রইল দিনের পর দিন, রাত্তিরের পর রাত্তির। বুড়ো বাপ ওদিকে শহরের ব্যবসা-কারবার সামলাল। আর কাতেরিনার কাটতে লাগল আরও নিঃসঙ্গ একটানা জীবন। গোড়ার দিকে স্বামী না থাকায় তার জীবনের একঘেয়েমি যেন চূড়ান্তে পৌঁছল, পরে আস্তে আস্তে তার মনে হল, এটা তবু ভালো–এতে করে যেন সে খানিকটে মুক্তি পেল। স্বামীর দিকে তার হৃদয়ের টান কখনও ছিল না। স্বামী না থাকায় তার ওপর হাম্বাই-তাম্বাই করার মতো লোক অন্তত একজন তো কমলো।

একদিন কাতেরিনা ছাতের উপরের ছোট্ট ঘরে জানালার পাশে বসে ক্রমাগত হাই তুলছিল। বিশেষ কিছু নিয়ে যে চিন্তা করছিল তা নয়। করে করে আপন হাই তোলা নিয়ে নিজেই যেন নিজের কাছে লজ্জা পেল। ওদিকে, বাইরের আঙিনায় চমৎকার দিনটি ফুটে উঠেছে; কুসুম কুসুম গরম, রৌদ্রোজ্জ্বল, আনন্দময়। বাগানের সবুজ বেড়ার ভিতর দিয়ে কাতেরিনা দেখছিল, ছোট্ট-ছোট্ট চঞ্চল পাখিগুলো কীরকম এক ডাল থেকে আরেক ডালে ফুরুৎ ফুরুৎ করে উড়ছিল।

কাতেরিনা ভাবছিল, আচ্ছা, আমি সমস্ত দিন ধরে টানা হাই তুলি কেন? কী জানি। তার চেয়ে বরঞ্চ বেরিয়ে আঙিনায় গিয়ে বসি কিংবা বাগানে বেড়িয়ে আসি।

কিংখাপের একটি পুরনো জামা পিঠে-কাঁধে ফেলে কাতেরিনা বেরিয়ে পড়ল।

বাইরে উজ্জ্বল আলো আর বাতাস যেন নবজীবন দেবার জন্য বইছে। ওদিকে গুদামঘরের কাছে উঁচু চকে সবাই প্রাণ-ভরা খুশিতে ঠাঠা করে আসছিল।

অত রগড় কিসের? কাতেরিনা তার শ্বশুরের কেরানিদের জিগ্যেস করল।

অর্থাৎ, ব্যাপারটা হচ্ছে, মা-ঠাকরুন– একাতেরিনা, ল — আমরা একটা জ্যান্ত শূয়োরী ওজন করছিলুম।

শূয়োরী? সে আবার কী?

ওই যে আকসিনিয়া শূয়োরীটা। বাচ্চা ভাসিলিইকে বিইয়ে গির্জের পরবে আমাদের নেমন্তন্ন করল না, তাকে–উত্তর দিল হাসিভরা বেপরোয়া গলায় একটি ছোকরা। বেশ সাহসী সুন্দর চেহারা। মিশকালো চুল, অল্প অল্প দাড়ি সবে গজাচ্ছে। সেরগেই তার নাম।

ওই মুহূর্তেই দাঁড়ে ঝোলানো ময়দা মাপার ধামা থেকে উঁকি মেরে উঠল রাঁধুনী আকসিনিয়ার চর্বিতে ভর্তি চেহারা আর গোলাপি গাল।

বদমাইশ ব্যাটারা, শয়তান ব্যাটারা–রাঁধুনী তখন গালাগালি জুড়েছে। সে তখন ধামা ঝোলানোর ডাণ্ডাটি ধরে কোনও গতিকে পাল্লা থেকে বেরোবার চেষ্টা করছে।

খাবার আগে তার ওজন ছিল প্রায় চার মণ। এখন যদি ভালো করে খড় খায় তবে আমাদের সব বাটখারা ফুরিয়ে যাবে।– সেই সুন্দর ছোকরা বুঝিয়ে বলল। তার পর পাল্লাটা উল্টে রাঁধুনীকে ফেলে দিল এককোণের কতকগুলি বস্তার উপর।

রাঁধুনী হাসতে হাসতে গালমন্দ করছিল আর কাপড়-চোপড় ঠিকঠাক করাতে মন দিল।

আচ্ছা, ভাবছি আমার ওজন কত হবে। হাসতে হাসতে দড়ি ধরে মালের দিকটায় উঠে কাতেরিনা শুধলো।

একশো পনেরো পাউন্ডের সামান্য কম। বাটখারা ফেলে সেরগেই বলল, আশ্চর্য!

এতে আশ্চর্য হবার কী আছে?

আপনার যে অতখানি ওজন হবে আমি মোটেই ভাবতে পারিনি, কাতেরিনা লভভুনা। আমার কী মনে হয় জানেন? আপনাকে দু হাতে তুলে সমস্ত দিন কারও বয়ে বেড়ানো উচিত। এবং সে তাতে করে ক্লান্ত তো হবেই না, বরঞ্চ শুধু আনন্দই পাবে।

হুঃ! আমি তো আর পাঁচজনেরই মতো মাটির মানুষ। তুমিও ক্লান্ত হয়ে পড়বে।– এ ধরনের কথাবার্তা বলতে কাতেরিনা অভ্যস্ত ছিল না বলে উত্তর দিতে গিয়ে তার মুখ একটুখানি রাঙা হয়ে গেল এবং হঠাৎ তার এক অদম্য ইচ্ছা হল অফুরন্ত আনন্দ আর সরস কথাবার্তা বলে তার হৃদয়-মন ভরে নেয়।

সেরগেই সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিয়ে উঠল, কখনও না, ভগবান সাক্ষী, আমি আপনাকে আমাদের পুণ্যভূমি পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যাব।

সাদামাটা পাতলা-দুবলা একজন চাষা ময়দা মাপতে মাপতে বলল, ও হিসাব চলে না, সোনা। আমাদের কার কত ওজন তা দিয়ে কী হয়? তুমি কি মনে কর আমাদের মাংস সবকিছু করে? আমাদের মাংসের ওজনের কোনও দাম নেই, বুঝলে দোস্ত। আমাদের ভিতর যে শক্তি আছে সেই শক্তিই সবকিছু করে আমাদের মাংস কিছুই করে না!

আবার কাতেরিনা নিজেকে সংযত না করতে পেরে বলে ফেলল, বাহ্! আমার বয়েস যখন কম ছিল তখন আমার গায়ে ছিল বেশ জোর; সব পুরুষই যে আমার সঙ্গে তখন পেরে উঠত সেকথাটা আদপেই মনের কোণে ঠাই দিয়ো না।

সুশ্রী ছোকরা অনুরোধ জানিয়ে বলল, খুব ভালো কথা। তাই যদি হয় তবে আপনার ছোট হাতটি আমায় একটু ধরতে দিন তো!

কাতেরিনা হকচকিয়ে গেল কিন্তু হাত তবু দিল বাড়িয়ে।

লাগছে, লাগছে– ওহ! আংটিটা ছেড়ে দাও। ওটাতে লাগছে– সেরগেই কাতেরিনার হাত চেপে ধরতেই সে চিৎকার করে উঠল আর অন্য হাত দিয়ে দিল তার বুকে ধাক্কা। সেরগেই সঙ্গে সঙ্গে তার কত্রীর হাত ছেড়ে দিয়ে ধাক্কার চোটে তাল সামলাতে না পেরে পাশের দিকে দু পা সরে গেল।

সেই ছোটখাটো সাদামাটা চাষা অবাক হয়ে বলল, হুম! লাও ঠেলা। মেয়েদের কথা আর বলছ না যে?

সেরগেই মাথার চুল ঝাঁকুনি মেরে পিছনের দিকে ঠেলে দিয়ে বলে উঠল, না, না। আমাদের ধরাধরিটা ঠিকমতো হোক, তবে তো।

কাতেরিনা বলল, তবে এসো৷ ততক্ষণে তারও মনে ফুর্তির ছোঁয়া লেগেছে। দুটি সুডৌল কনুই উপরের দিকে তুলে ধরে বলল, তবে এসো।

সেরগেই তার তরুণী কত্রীকে দু হাতে জড়িয়ে ধরে তার সুঠাম বুক আপন লাল শাটের উপর চেপে ধরল। কাতেরিনা তার কাঁধ সরাবার পূর্বেই সেরগেই তাকে শূন্যে তুলে ধরে দু হাতে উপরের দিকে উঠিয়ে নিয়ে আপন বুকে চেপে ধরেছে। তার পর আস্তে আস্তে নামিয়ে নিয়ে একটা উল্টো ধামার উপর বসিয়ে দিল।

আপন দেহের যে শক্তি সম্বন্ধে কাতেরিনা দম্ভ করেছিল তার একরত্তিও সে কাজে লাগাতে পারেনি। এবারে সে লালে লাল হয়ে গিয়ে ধামায় বসে কিংখাপের জামাটি মাটি থেকে তুলে নিয়ে গায়ে ঠিকমতো বসাল। তার পর চুপচাপ গুদামবাড়ি ছেড়ে রওনা দিল। মেকার মাফিক যতখানি দরকার ঠিক ততখানি দেমাকের সঙ্গে সেরগেই গলা সাফ করে মজুরদের উদ্দেশে হাঁক দিয়ে বলল, ওরে ও গাধার পাল! ময়দার স্রোত বন্ধ হতে দিসনি, হালের উপর এলিয়ে পড়ে আরাম করিসনি। যদি কিছু থাকে বাকি, মোরা তো যাব না ফাঁকি।

ভাবখানা করল যে এক্ষুনি যা হয়ে গেল সে যেন তার কোনও পরোয়াই করে না।

কাতেরিনার পিছনে হাঁপাতে হাঁপাতে যেতে যেতে রাঁধুনী তাকে বলল, ব্যাটাচ্ছেলে সেরেজুকা মেয়েছেলের পিছনে কীরকম ডালকুত্তার মতোই না লাগতে জানে! ওই চোরটার নেই কি? শরীরের গঠন, চেহারা, মুখের ছবি– সবকিছুই আছে। দুনিয়ার যে কোনও মেয়েই হোক, ওই বদমায়েশটা এক লহমায় তাকে মাৎ করে দেবে, তার পর তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে ঠেলে দেবে পাপের রাস্তায়। আর কাউকে ভালোবেসে তার প্রতি অনুগত থাকার কথা যদি তোলেন, তবে ওরকম হাড়েটক বেইমানের জুড়ি পাবেন না।

আগে যেতে যেতে যুবতী কী শুধাল, আচ্ছা, কী বলছিলুম, ওই যে… তোমার ছেলেটি বেঁচে আছে তো?

বেঁচে আছে, মা ঠাকরুন, দিব্য জলজ্যান্ত বেঁচে আছে ওর আর ভাবনা কিসের? ওদের যখন কেউ চায় না তখনই তারা প্রাণটাকে আঁকড়ে ধরে আরও জোর দিয়ে।

বাচ্চাটাকে দিল কে?

কে জানে? ঘটে গেল–বলতে পারেন মোটামুটি। মেলা বন্ধু-বান্ধব থাকলে ওরকম ধারা ঘটে যায় বইকি।

ওই ছোঁড়াটা আমাদের সঙ্গে কি অনেকদিন ধরে আছে?

কার কথা বলছেন? সেরগেই?

 হ্যাঁ।

মাসখানেক হবে। আগে সে কচনদের ওখানে কাজ করত। সেখানকার মুনিব ওকে খেদিয়ে দেন। তার পর গলা নামিয়ে আস্তে আস্তে বলল, লোকে বলে সেখানে খুদ কত্রীর সঙ্গে প্রেম করেছিল… জাহান্নমে যাক ব্যাটা। সাহসটা দেখুন তো।

.

০৩.

মধুর মধুর গরম, দুধের মতো সাদা প্রায়ান্ধকার নেমে এসেছে শহরের ওপর। জলের বাঁধের মেরামতির কাজ থেকে জিনোভিই এখনও ফেরেনি। সে রাত্রে শ্বশুরও বাড়িতে নেই। তার এক প্রাচীন দিনের বন্ধুর জন্মদিনের পরবে বুড়ো সেখানে গেছে। বলে গেছে রাত্রেও বাড়িতে খাবে না; কেউ যেন তার জন্য অপেক্ষা না করে। আর কিছু করবার ছিল না বলে কাতেরিনা সকাল সকাল খেয়ে নিয়ে শোবার ঘরের খোলা জানালার উপর হেলান দিয়ে বসে বাদামের খোসা ছাড়াচ্ছে। রান্নাঘরে মজুরদের খাওয়া শেষ হয়ে যাওয়ার পর এখন তারা আঙিনার উপর দিয়ে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে পড়ে আপন আপন শোবার জায়গায় যাচ্ছে। কেউ গোলাবাড়িতে, কেউ মরাইয়ে, কেউ মিঠে মিঠে গন্ধের খড়ের গাদার দিকে। রান্নাঘর থেকে বেরুল সেরগেই সর্বশেষে। সে প্রথম আঙিনার চতুর্দিকে ব্লোদ দিয়ে তদারকি করল, কুকুরগুলোর চেন খুলে দিল, শিষ দিতে দিতে কাতেরিনার জানালার নিচে দিয়ে যাবার সময় উপরের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে তাকে অভিবাদন জানাল।

জানালার পাশে বসে কাতেরিনা মৃদুকণ্ঠে প্রত্যাভিবাদন জানাল– বিরাট আঙিনা খানিকক্ষণের ভিতরই নির্জন প্রান্তরের মতো নিঃশেষ হয়ে গেল।

মিনিট দুই যেতে না যেতে কাতেরিনার চাবি-বন্ধ ঘরের বাইরে কে যেন ডাকল, ঠাকরুন!

কাতেরিনা ভীতকণ্ঠে জিগ্যেস করল, কে?

কেরানি উত্তর দিল, দয়া করে ভয় পাবেন না। আমি। আমি সেরগেই।

কী চাই তোমার, সেরগেই?

আমি আপনার দয়া ভিক্ষা করতে এসেছি, কাতেরিনা ভড়না; একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে আপনার অনুগ্রহ ভিক্ষা করতে এসেছি– আমাকে কৃপা করে এক মিনিটের জন্য ভিতরে আসতে দিন।

কাতেরিনা চাবি ঘুরিয়ে দোর খুলে দিয়ে সেরগেইকে ঘরে ঢুকতে দিল।

কী ব্যাপার, কী চাই? জানালার কাছে ফিরে গিয়ে কাতেরিনা শুধালো।

আমি আপনার কাছে এলুম জিগ্যেস করতে, আপনার কাছে চটি বই-টই কিছু আছে? আমাকে যদি দয়া করে পড়তে দেন। এখানে কী দুর্বিষহ একঘেয়ে জীবন।

কাতেরিনা উত্তর দিল, আমার কাছে কোনওপ্রকারেরই বই নেই, সেরগেই। আমি তো পড়িনে।

সেরগেই ফরিয়াদ করল, কী একঘেয়ে জীবন!

তোমার জীবন একঘেয়ে হবে কেন?

অপরাধ যদি না নেন তবে নিবেদন করি, একঘেয়ে লাগবে না কেন? আমার এখন যৌবন কাল, অথচ আমরা এখানে আছি মঠের সন্ন্যাসীদের মতো। আর ভবিষ্যতের দিকে তাকালে দেখতে পাই, এই নির্জনতাতেই আমাকে পচে হেজে খতম হতে হবে, যতদিন না আমার কফিন-বাক্সের*[* বাঙালি মুসলমান কফন বা কাফন বলতে শবাচ্ছাদনের বস্ত্র বোঝে। (ইংরেজি শ্রাউড) শব্দটি ফারসির মাধ্যমে আরবি থেকে এসেছে। ইউরোপীয় ভাষায় কফিন বলতে যে কাঠের বা পাথরের বাক্সে মৃতদেহ রেখে গোর দেওয়া হয় সেই বাক্স বোঝায়। উভয় শব্দই খুব সম্ভব গ্রিক কফিনস থেকে এসেছে। ইংরেজি কফার পেটিকা- এই শব্দ থেকেই এসেছে। –অনুবাদক।] ডালায় পেরেক ঠোকা হয়। মাঝে মাঝে আমি যে নৈরাশ্যের কোন চরমে পৌঁছই তা আর কী করে বোঝাই!

বিয়ে কর না কেন?

বিয়ে করব? বলা বড় সোজা! এখানে আমি বিয়ে করব কাকে? আমি তো বিশেষ কিছু জমিয়ে উঠতে পারিনে, আর বড়লোকের মেয়ে আমাকে বিয়ে করতে যাবে কেন? ওদিকে গরিব বলেই আমাদের শ্রেণির মেয়ে মাত্রই লেখাপড়ার ধার ধারে না– সে তো আপনি জানেন, কাতেরিনা ভভূনা। তারা কি কখনও সত্যি সত্যি বুঝতে পারে, প্রেম বলতে কী বোঝায়! শুধু তাই নয়, বড়লোকদের ভিতর এ বিষয়ে কী ধারণা সেটাও একবার চিন্তা করুন তো। এই ধরুন আপনার কথা; আমার মনে কোনও সন্দেহ নেই, সামান্যতম স্পর্শকাতরতা যার হৃদয়ে আছে তার কাছে আপনি সান্তনার চিরন্তন উৎস। অথচ দেখুন দিকিনি তারা আপনাকে নিয়ে কী করছে? ময়না পাখিটির মতো খাঁচায় পুরে রেখেছে।

কাতেরিনার মুখ থেকে ফস্কে গেল, কথাটা সত্যি। আমি নিঃসঙ্গ।

তাই একঘেয়ে লাগবে না তো কী লাগবে মাদাম যেভাবে আপনি জীবনযাপন করছেন? আপনার অবস্থায় অন্যেরা যা করে থাকে, আপনার যদি সেরকম উপরি কেউ থাকতও, তবুই-বা কী হত? তার সঙ্গে দেখা করাও তো আপনার পক্ষে অসম্ভব।

এই! তুমি… একটু সীমা পেরিয়ে যাচ্ছ। আমার একটি বাচ্চা থাকলেই, আমার তো মনে হয় আমি সুখী হতুম।

কিন্তু একটু চিন্তা করুন; আমাকে যদি অনুমতি দেন তবে বলি, বাচ্চা জন্মাবার জন্য তার পিছনে তো কোনও-কিছু-একটা চাই বাচ্চা তো আর আকাশ থেকে পড়ে না। আপনি কি মনে করেন আমি জানিনে আমাদের ব্যবসায়ীদের বউ-ঝিরা কীভাবে জীবন কাটায়– এত বছর আমার মুনিবদের মাঝখানে বাস করেও? আমাদের একটা গীত আছে, আপন হৃদয়ে প্রেম না থাকলে, জীবন সে তো শুধু বিষণ্ণ দুরাশা! আর সেই দুরাশা, সেই কামনা– আপনাকে বলতে বাধ্য হচ্ছি কাতেরিনা ভভূনা, আমার হৃদয় এমনই বেদনায় ভরে দিয়েছে যে, ইচ্ছে করে ইস্পাতের ছুরি দিয়ে হৃদয়টাকে বুকের মাঝখান থেকে কেটে বের করে আপনার কচি দুটি পায়ের উপর রাখি। আমি তা হলেই শান্ত হব শতগুণ শান্তি ফিরে পাব।

তোমার হৃদয় সম্বন্ধে কী যা-তা সব তুমি আমাকে বলছ? তার সঙ্গে আমার তো কোনও সম্পর্ক নেই। তুমি এইবার আস্তে আস্তে রওনা দাও।

না, দয়া করুন, ঠাকরুন। সেরগেই ততক্ষণে কাতেরিনার দিকে এক পা এগিয়ে এসেছে, তার সমস্ত শরীর তখন কেঁপে কেঁপে দুলে দুলে উঠছে। আমি জানি, হৃদয় দিয়ে অনুভব করছি, স্পষ্ট বুঝতে পারছি, আপনার জীবনও এ পৃথিবীতে আমার জীবনের মতোই অত সহজ সরলভাবে বয়ে যাচ্ছে না। কিন্তু এখন শুধুমাত্র একটি কথা– একথাগুলো সে। বলে গেল এক নিশ্বাসে– এখন, এই মুহূর্তে, সবকিছু আপনার হাতে, আপনার তাঁবেতে।

কী চাও তুমি? এসব কী হচ্ছে? এখানে আমার কাছে তুমি এসেছ কেন? আমি এখুনি জানালা দিয়ে লাফ দেব–কাতেরিনা যখন একথাগুলো বলছিল তখন তার মনে হচ্ছিল, কেমন যেন একটা অবর্ণনীয় ভয় তাকে অসহ্য বজ্রমুষ্টিতে চেপে ধরেছে। সে তখন জানালার চৌকাঠ আঁকড়ে ধরে আছে।

ওগো, আমার তুলনাহীনা, ও আমার জীবনসমা! জানালা দিয়ে লাফ দেবার কী প্রয়োজন?—সহজ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে সেরগেই এ কথাগুলো কাতেরিনার কানে কানে মৃদুস্বরে বলল, আর সঙ্গে সঙ্গে তাকে জানালা থেকে টেনে এনে গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরল।

ও, ও! আমাকে ছাড়– মৃদু কাতর কণ্ঠে কাতেরিনা বলল; সঙ্গে সঙ্গে কিন্তু সেরগেইর নিবিড় চুম্বনবর্ষণে তার শক্তি যেন ক্রমেই লোপ পাচ্ছিল! আপন অনিচ্ছায় তার দেহ কিন্তু সেরগেইয়ের দেহের সঙ্গে মিলে যাচ্ছিল।

সেরগেই তার কত্রীকে শূন্যে তুলে নিয়ে দুই বাহুতে করে যেন একটি ছোট্ট বাচ্চাকে তুলে ধরেছে– ঘরের অন্ধকার কোণে নিয়ে গেল।

সমস্ত ঘরে নীরবতা– শুধু শিয়রের খাড়া তক্তাতে ঝোলানো কাতেরিনার স্বামীর পোশাকি ট্র্যাকঘড়িটি টিকটিক করে যাচ্ছে; কিন্তু সে আর কী বাধা দেবে!

যাও। আধঘণ্টা পরে কাতেরিনা সেরগেইয়ের দিকে না তাকিয়েই আলুথালু চুল ছোট্ট একটি আয়নার সামনে ঠিক করতে করতে বলল।

এখন আর আমি যাব কেন? বিশ্ব-সংসার খুঁজলেও তো এখন আর কোনও কারণ পাওয়া যাবে না। সেরগেইয়ের কণ্ঠে এখন উল্লাসের সুর।

শ্বশুরমশাই বাড়ির সদর দরজা বন্ধ করে দেবেন যে।

কী বললে, আমার পরানের মণি? এতদিন ধরে তুমি কি শুধু তাদেরই নিয়ে নাড়াচাড়া করেছ যারা রমণীর কাছে পৌঁছতে হলে দরজা ভিন্ন অন্য কোনও পথ জানে না? আমার ভিন্ন। ব্যবস্থা। তোমার কাছে আসতে হলে, তোমার কাছ থেকে যেতে হলে আমার জন্য বহু দরজা খোলা রয়েছে। ব্যালকনির খুঁটি দেখিয়ে উত্তর দিল তরুণ।

.

০৪.

জিনোভিই সাত দিন হল বাড়ি ফেরেনি, আর এই সমস্ত সপ্তাহ ধরে তার স্ত্রী প্রতিটি রাত্রি সেরগেইয়ের সঙ্গে কাটিয়েছে সরস রভসে– শুভ্র প্রভাতের প্রথম আলোর প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত।

এই সাত রাত ধরে জিনোভিই বরিসিচের বেডরুমে শ্বশুরমশাইয়ের ভাড়ার থেকে নিয়ে আসা প্রচুর ওয়াইন পান করা হল, প্রচুর মিষ্ট-মিষ্টান্ন খাওয়া হল, তরুণী গৃহকত্রীর মধুভরা ঠোঁট থেকে প্রচুর চুম্বন চুমুকে চুমুকে তোলা হল, তুলতুলে বালিশের উপর ঘন কৃষ্ণ অলকগুচ্ছ নিয়ে খেলাভরে প্রচুর আদর-সোহাগ করা হল। কিন্তু হায়, কোনও পথই আদ্যন্ত মসৃণ নয়– মাঝে মাঝে হোঁচট-ঠোক্করও খেতে হয়।

বরিস তিমোতেইচের চোখে সে-রাত্রে কিছুতেই ঘুম আসছিল না। বুড়ো রাত্রির লম্বা রঙিন ঝোল্লা পরে এ-ঘর ও-ঘর বেড়াচ্ছিল; জানালার কাছে এসে বাইরের দিকে তাকাল, তার পর আরেকটা জানালার কাছে এসে দেখে, লাল শার্ট পরা সেই খাপসুরৎ ছোকরা সেরগেই তার পুত্রবধূর জানালার একটা খুঁটি বেয়ে অতিশয় নীরব নিঃশব্দে নেমে যাচ্ছে। বরিস তিমোতেই ঝড়ের বেগে বেরিয়ে পড়ে চেপে ধরল রোমিও নটবরের পা দুখানা। সে তখন সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রথমটায় চেয়েছিল বুড়োকে একখানা খাঁটি বিরাশি সিক্কা লাগায়– আকস্মিক উৎপাতে তারও মেজাজটা গিয়েছিল বিগড়ে– কিন্তু সেটা আর লাগল না, ভাবল, তা হলে একটা হট্টগোল আরম্ভ হয়ে যাবে।

বরিস তিমোতেই জিগ্যেস করল, বল্ ব্যাটা চোর, কোথায় গিয়েছিলি?

 সেরগেই উত্তর দিল, লাও! শুধোচ্ছি, কোথায় গিয়েছিলুম আমি! যেখানেই গিয়ে থাকি না কেন, সেখানে আমি আর এখন নেই। হল, বরিস তিমোতেই মহাশয়, প্রিয়বরেষু!

 আমার ছেলের বউয়ের ঘরে তুই রাত কাটিয়েছিস?

ওই কথাটাই যদি জিগ্যেস করলেন কর্তা-ঠাকুর, তা হলে আবার বলি, আমি জানি, আমি রাত্তিরটা কোথায় কাটিয়েছি; কিন্তু এইবেলা তোমাকে একটি খাঁটি তত্ত্বকথা বলছি আমি, বরিস তিমোতেইচ; যা হয়ে গিয়েছে সেটা তুমি আর কিছুতেই ফিরিয়ে আনতে পারবে না। খামোখা কেন তোমাদের শিষ্ট ব্যবসায়ী পরিবারের ওপর এখন ফালতো কেলেঙ্কারি টেনে আনবে– অন্তত সেটা তো ঠেকাতে পারো। এখন আমাকে সরল ভাষায় বল, আমাকে কী করতে হবে। তুমি কী দান পেলে সন্তুষ্ট হবে?

তোকে আমি পাঁচশো ঘা চাবুক কশাব, ব্যাটা পিচেশ।

দোষ আমারই তোমার ইচ্ছা পূর্ণ হোক! সাহসী নাগর স্বীকৃত হল। এবারে বল তোমার সঙ্গে কোথায় যেতে হবে; প্রাণ যা চায় সেই আনন্দ করে নাও আমার রক্ত চেটে নাও।

বরিস তখন সেরগেইকে শানে তৈরি তার ছোট্ট একটি গুদামঘরে নিয়ে গিয়ে বেধড়ক চাবকাতে আরম্ভ করল। যখন বুড়োর আর চাবুক মারার মতো শক্তি একরত্তিও রইল না তখনই থামল। সেরগেইয়ের গলা থেকে কিন্তু একবারের তরেও এতটুকু আৰ্তরব বেরোয়নি, তবে হ্যাঁ, শার্টের আস্তিনে সে যে দাঁত কিড়িমিড়ি করে কামড়ে ধরেছিল তার অর্ধেকখানা শেষ পর্যন্ত সে চিবিয়ে কুটি কুটি করে ফেলেছিল।

সেরগেই মাটিতে পড়ে রইল। চাবুকে চাবুকে তার পিঠ তখন কামারের আগুনে পোড়া কড়াইয়ের মতো লাল হয়ে গেছে। সেটা শুকোবার সময় দিয়ে বুড়ো তার পাশে একঘটি জল রেখে গুদামঘরের দোরে বিরাট একটা তালায় চাবি মারল। তার পর ছেলেকে আনবার জন্য লোক পাঠাল।

কিন্তু এই আজকের দিনেও*[* ১৮৬৫ খ্রি.] রাশার বড় রাস্তা ছাড়া অন্য রাস্তায় ছ মাইল পথ আসা-যাওয়া সাততাড়াতাড়িতে হয়ে ওঠে না, ওদিকে আবার কাতেরিনা যে সময়টুকু না হবার নয় তার বেশি একটি মাত্র ঘণ্টাও সেরগেই বিহনে কাটাতে পারে না। তার সুপ্ত প্রবৃত্তি তখন অকস্মাৎ পরিপূর্ণ মাত্রায় বিকশিত হয়ে উঠেছে এবং ফলে সে এমনই দৃঢ়সঙ্কল্প হয়ে উঠেছে যে, তখন তার পথ রোধ করে কার সাধ্য! আতিপাতি খুঁজে সে বের করে ফেলেছে সেরগেই কোথায়। সেখানে লোহার দরজার ভিতর দিয়ে সেরগেইয়ের সঙ্গে কথাবার্তা বলে সবকিছু ঠিকঠাক করে ছুটল চাবির সন্ধানে।

শ্বশুরের কাছে গিয়ে মিনতি জানাল, সেরগেইকে ছেড়ে দাও, বাবা, লক্ষ্মীটি।

বুড়োর মুখের রঙ সেফ সবুজ হয়ে গেল। এতখানি বেহায়ামির দুঃসাহস সে তার পাপিষ্ঠা পুত্রবধূর কাছে প্রত্যাশা করেনি– কারণ পাপিষ্ঠা হোক আর বেহায়াই হোক, এতদিন সে ছিল বড় বাধ্য মেয়ে।

এ কী আরম্ভ করলি তুই, তুই অমুক-তমুক?– বুড়ো অশ্লীল ভাষায় তার বেহায়াপনা নিয়ে কটুকাটব্য আরম্ভ করল।

ওকে যেতে দাও, বাবা। আমি আমার বিবেক সাক্ষী রেখে শপথ করছি আমরা এখনও কোনও পাপাচার করিনি।

পাপাচার করেনি! ওহ! বলে কী?– বুড়ো যেন আর কিছু না করতে পেরে শুধু দাঁত কিড়িমিড়ি দিতে লাগল। এ ক-রাত্তির ধরে তোমরা উপরে কী করে সময় কাটাচ্ছিলে? দুজনাতে মিলে তোমার স্বামীর বালিশের ফেঁসো ফুলিয়ে ফালিয়ে তার জন্য জুৎসই করে রাখছিলে।– বুড়ো ব্যঙ্গ করে উঠল।

কাতেরিনা কিন্তু নাছোড়বান্দা; সেই এক বুলি ক্রমাগত বলে যেতে লাগল, ওকে ছেড়ে দাও, ফের আবার ওকে ছেড়ে দাও।

বুড়ো বরিস বলল, এই যদি তোর বাসনা হয় তবে শুনে নে; তোর স্বামী ফেরার পর তোকে বাইরের ওই আস্তাবলে নিয়ে গিয়ে আমরা দুজনাতে আপন হাতে চাবুক মারব–সতী সাধ্বী রমণী কি না তুই! আর ওই ব্যাটাকে নিয়ে কী করা হবে শুনবি–ইতর বদমাইশটাকে কালই পাঠাব জেলে!।

এই ছিল বরিস তিমোতেইচের সিদ্ধান্ত; শুধু এইটুকু বলার আছে যে, সে সিদ্ধান্ত কখনও কর্মে রূপান্তরিত হল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *