০১. নতুন জায়গা

বুবুনের বাবা
মুহম্মদ জাফর ইকবাল

১. নতুন জায়গা

যে সুটকেসটা বুবুন আর আম্মা মিলে টেনে নাড়াতে পারেনি জাহিদ চাচা সেটা এক হাতে তুলে একেবারে বাসার দরজার সামনে রেখে দিলেন। জাহিদ চাচার শরীরে মনে হয় মোষের মতো জোর। যাদের শরীরে মোষের মতো জোর হয় তাদের চেহারায় একটা গুণ্ড-গুণ্ডা ভাব থাকে, কিন্তু জাহিদ চাচার বেলায় সেটা সত্যি না। তার চেহারাটা একেবারেই ভালোমানুষের মতো। ফরসা গায়ের রং চুল সুন্দর করে আঁচড়ানো চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। কথা বলেন সুন্দর করে আর যখন হাসেন তখন মনে হয় তার এত আনন্দ হচ্ছে যে সেই আনন্দে চোখ দুটি বুজে আছে। বুবুন মানুষজনের বেলায় খুব খুঁতখুতে, কিন্তু এই মানুষটাকে তার বেশ পছন্দ হল।

জাহিদ চাচা পকেট থেকে একটা চাবি বের করে দরজার তালা খুলে আম্মাকে বললেন, “ডক্টর রওশান, এই হচ্ছে আপনার নতুন বাসা।”

আম্মা ভিতরে ঢুকে বললেন, “বাহ!”

বুবুন বুঝতে পারল বাসাটা আম্মার পছন্দ হয়েছে। পছন্দ না হলে আম্মা চুপচাপ থাকতেন আর জিজ্ঞেস করলে বলতেন, “হুশ! বেশ ভালোই তো মনে হচ্ছে।”

জাহিদ চাচা ভারী সুটকেসটা আবার এক হাতে টেনে ঘরের ভিতরে ঢুকিয়ে ফেলে বললেন, “বাসাটা ভালো, আপনাদের পছন্দ হবে। একটু ছোট, তবে

আম্মা বললেন, “ছোট কোথায়? দুজন মানুষের জন্য ঠিকই আছে। ময়লা করার জন্যে বুবুনের যথেষ্ট জায়গা আছে। এইখানে সে তার নোংরা কাপড় ফেলবে, ঐখানে কমিক। এইখানে বৈজ্ঞানিক গবেষণা করে আগুন ধরাবে, এইখানে চিউয়িংগাম চিবিয়ে ফেলে রাখবে, এইখানে চশমা হারাবে। ঐখানে”

আম্মার কথা শুনে জাহিদ চাচা চোখ ছোট ছোট করে আবার হা হা করে হেসে উঠলেন যেন খুব একটা মজার কথা শুনেছেন। বুবুনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তাই নাকি ইয়ংম্যান?”

বুবুন কিছু বলার আগেই আম্মা বললেন, “আসলে নাম দেওয়া উচিত ছিল বেবুন–”

জাহিদ এবারে না হেসে বুবুনের পিঠে হাত দিয়ে বললেন, “না না ডক্টর রওশান, এটা আপনি ঠিক বললেন না। এরকম হ্যাঁন্ডসাম একটা মানুষের আপনি নাম রাখবেন বেবুন?”

বুবুন জাহিদ চাচার দিকে তাকাল, না, মানুষটা ঠাট্টা করছে না, সত্যি সত্যিই বলছে। সে ঠিকই ধরেছে, মানুষটা মনে হয় আসলেই ভালো। জাহিদ চাচা টেবিলের উপর চাবিটা রেখে বললেন, “ডক্টর রওশান, আপনারা ধীরে-সুস্থে গুছিয়ে নেন। কিছু দরকার আছে কি-না দেখার জন্যে পরে আসব। আজ রাতে আপনাদের রান্না করতে হবে না, খাবার পাঠিয়ে দেব। আর কিছু লাগবে?”

“না না, আর কিছু লাগবে না।” আম্মা হেসে বললেন, “ভয়ে ভয়ে ছিলাম নতুন জায়গায় এসে কোন ঝামেলায় পড়ি–আপনি তো দেখি সব ব্যবস্থা করে রেখেছেন।”

জাহিদ চাচা জোরেজোরে মাথা নেড়ে বললেন, “না না, সব ব্যবস্থা মোটেই করতে পারিনি, আপনি নিজেই টের পাবেন।”

জাহিদ চাচা চলে যাবার পর বুবুন বলল, “আম্মা, তুমি দেখেছ জাহিদ চাচা যখন হাসেন তখন তার চোখ দুটো কেমন জানি বন্ধ হয়ে যায়?”

আম্মা সুটকেসটা খোলার চেষ্টা করছিলেন, নতুন একটা চাবি নিয়ে দিয়ে খোঁচাখুচি করতে করতে বললেন, “তোর এ কী বাজে অভ্যাস হয়েছে? একজন মানুষকে দেখলে প্রথমেই তার দোষটা চোখে পড়ে!”

বুবুন থতমত খেয়ে বলল, “কখন দোষ চেখে পড়ল?”

“ঐ যে বললি হাসলে চোখ বন্ধ হয়ে যায়!”

“এটা কী দোষ?”

“তা হলে এটা কী?”

“ওটা, ওটা”–বুবুন কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল, কেউ যখন অনেক জোরে হাসে তখন তার চোখ বন্ধ হয়ে যায়।”

“তোকে বলেছে!”

“তুমি বিশ্বাস কর না? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চেষ্টা করে দেখো।”

“আমার তো আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খামোখা বোকার মতো হাসার চেষ্টা করি!”

বুবুন হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, “তোমার সাথে কথা বলাই মুশকিল। আমার কোনো কথা তুমি শুনতে চাও না।”

“ভালো কথা বল শুনব, ফ্যাচর-ফ্যাচর করবি তো শুনব কোনটা!”

আম্মা খুব কাজের মহিলা, কোমরে শাড়ি প্যাচিয়ে কিছুক্ষণের মাঝেই ঘর গোছানোর কাজ শুরু করে দিলেন। সুটকেস খুলে জামাকাপড় সাবান তোয়ালে বের করলেন, রান্নাঘরে গিয়ে চুলার উপর চায়ের কেতলি বসিয়ে দিলেন, ঘর ঝাঁট দিয়ে বিছানার চাঁদর বিছিয়ে দিলেন। দেখতে দেখতে পুরো বাসাটা খালি-খালি ভাবটা কাটিয়ে উঠে বেশ থাকার যোগ্য হয়ে উঠল।

বুবুন খানিকক্ষণ আম্মার পিছনে ঘুরঘুর করে ঠিক কী করবে বুঝতে না পেরে বাইরের ঘরে একটা কমিক নিয়ে পা ছড়িয়ে বসল। সুপারম্যানের কমিক, জিরকনিয়াম পাথর দিয়ে উত্তর মেরুর একটা পাহাড়ে তাকে বন্দি করে রেখেছে, কীভাবে সেখান থেকে ছুটে আসবে সেটা নিয়ে একটা জটিল রহস্য তৈরি হচ্ছে, তার মাঝে হঠাৎ আম্মা এসে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হচ্ছে? এটা কী হচ্ছে?”

কেউ যখন কী হচ্ছে চোখের সামনে দেখেও জিজ্ঞেস করে কী হচ্ছে তখন তার উত্তর দেওয়া খুব সোজা না। কেন সোজা না বুবুন সেটাও খুব ভালো করে জানে, তার চোখ বাড়াবাড়ি রকম খারাপ, চোখে ভারী কাঁচের চশমা, যখন-তখন যেখানে-সেখানে যা ইচ্ছে তা-ই পড়ার উপর কারফিউ দেওয়া আছে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও না বোঝার ভান করে মুখে সরল একটা ভাব ফুটিয়ে বলল, “কমিক দেখছি।”

“এই বিকেলবেলা কমিক দেখার সময় হল? চোখের যে বারোটা বাজিয়েছিস খেয়াল আছে?”

“আম্মা, আজকাল চোখ খারাপ হওয়া কোনো ব্যাপারই না। চশমা আছে, কন্টাক্ট লেন্স আছে—”

“পাকামো করবি না। কতবার বলেছি বিকেলে বই পড়বি না!”

“এটা বই না। এটা কমিক।”

“পার্থক্যটা কী?”

“বই পড়তে হয়। কমিক পড়তে হয় না, দেখলেই হয়। যেরকম করে ঘরবাড়ি দেখি গাছপালা দেখি। বিকালবেলা কি আমরা দেখি না? চোখ বন্ধ করে রাখি?”

ব্যাখ্যা শেষ হবার আগেই আম্মা এসে বুবুনের কান ধরে তাকে টেনে তুলে ফেললেন, একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “বের হ ঘর থেকে। বাইরে গিয়ে খেলাধুলা কর–”

বুবুন কোনোমতে নিজের কানকে উদ্ধার করে বলল, “এটা তোমার কীরকম অভ্যাস আম্মা? ঝপ করে কান ধরে ফেল? কেউ দেখে ফেললে—”

“কেউ দেখলে কী হবে? তোর জাত চলে যাবে?”

“আমি এত বড় হয়েছি, আর তুমি–”

আম্মা খুব অবাক হবার ভান করে বললেন, “তাই নাকি? তুই অনেক বড় হয়েছিস? কত জানি বয়স হল তোর? একশো চল্লিশ?”

“যাও! বিদেশে আমার বয়সী ছেলেরা কত কী করে, আর তুমি কথা নেই বার্তা নেই কান ধরে ফেল, চুল ধরে ফেল–”

“পাকামো করবি না। ঘর থেকে বের হ। মাহয় শুধু কান ধরব না, টেনে ছিঁড়ে ফেলব। একেবারে ভ্যান গ হয়ে যাবি। যা–”

বুবুন মুখ শক্ত করে বলল, “কোথায় যাব?”

“বাইরে। নতুন জায়গায় এসেছিস একটু কৌতূহলও নেই কী আছে আশেপাশে? পাড়ার ছেলেপিলেদের সাথে পরিচয় করবি না? দেখলি না ক্রিকেট খেলছে”

“চিনি না শুনি না গিয়ে ক্রিকেট খেলা শুরু করে দেব?”

“যদি না খেলিস তা হলে চেনাশোনাটা হবে কীভাবে? আর পচা তর্ক করবি, যা, বের হ।”

বুবুন বিরসমুখে বেশ অনেকক্ষণ সময় নিয়ে জুতো পরল। খামোখা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ চুল আঁচড়াল। শার্টটা বদলে নিল–তারপর যখন দেখল আর কিছুই করার নেই তখন ঘর থেকে বের হল। আম্মার উপর যা রাগ উঠল সেটা আর বলার মতো নয়। এমনিতে আম্মা দেখতে একেবারে সিনেমার নায়িকাঁদের মতে, পড়াশুনাও করেছেন অনেক। সোশিওলজিতে পিএইচ. ডি. অথচ কথাবার্তা বাসের কন্ডারক্টরদের মতো। গলা উঁচিয়ে ধমক না দিয়ে কোনো কথা বলতে পারে না। তার বাবা না থাকায় এটাই হয়েছে মুশকিল। বাসায় কোনো পুরুষমানুষ না থাকলে মনে হয় মেয়েরাই পুরুষ মানুষদের মতো হয়ে যায়। বুবুন একটা ছোট দীর্ঘশ্বাস ফেলল, বাবা থাকাটা কেমন কে জানে!

একটু আগে বাইরে খুব হৈচৈ করে ক্রিকেট খেলা হচ্ছিল বুবুন খেলাধুলায় একেবারে যাচ্ছেতাই আর ক্রিকেটে হলে তো কথাই নেই, না পারে বল করতে না পারে ব্যাট করতে। ফিল্ডিং তো আরও খারাপ, সোজা ক্যাচগুলো কীভাবে জানি ফস্কে যায়। পায়ের পাশ দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে বল বাউন্ডারি পার হয়ে যায়। তাই ঘর থেকে বের হয়ে যখন দেখল বাইরে এখন কেউ ক্রিকেট খেলছে না বুবুন একটু স্বস্তি পেল। ছেলেপিলেরা কোথায় গিয়েছে কে জানে।

এই এলাকাটা একটু অন্যরকম। শহরতলির বাসা, আশেপাশে অনেক গাছ গাছালি, দূরে একটা টিলামতন রয়েছে, তার ওপাশে নাকি একটা নদীও আছে। তাদের আগের বাসা ছিল একেবারে শহরের মাঝখানে, একটার পাশে আরেকটা কংক্রিটের দালান, গাছপালা যে দুএকটা ছিল ধুলার আস্তরণে তারা একেবারে ডুবে থাকত। বুবুন প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ধীরেসুস্থে জায়গাটা দেখতে বের হল। বাসার পিছনে কয়েকটা বড় বড় গাছ, তার পাশে একটা নিচু জায়গা, সেখানে পানি জমে আছে, কাছে আসতেই কয়েকটা ব্যাঙ লাফ দিয়ে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আরেকটু এগিয়ে যেতেই সে ছেলেপিলের দলটাকে আবিষ্কার করল, তারা একটা গাছের নিচে জমা হয়েছে। একজনের হাতে একটা বাঁশ সেই বাঁশের উপরে কয়েকটা খবরের কাগজ শক্ত করে বাঁধা, হচ্ছে। পুরো ব্যাপারটির যে নেতৃত্ব দিচ্ছে সেটি একটি মেয়ে, বয়স বুবুনের সমান কিংবা একটু ছোট। বুবুনকে দেখে একজন বলল, “বেশি কাছে এসো না।”

বুবুন একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, “কেন? কী হবে কাছে এলে?”

“আগুন জ্বালাব।”

বুবুন এইবার ভালো করে তাকাল, “বাঁশের ডগায় আগুন লাগানোর ব্যবস্থাটি পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে, নীল রঙের শিশি থেকে যে তরল পদার্থটি খবরের কাগজে ঢালা হল সেটা নিশ্চয়ই কেরোসিন। বুবুন জিজ্ঞেস না করে পারল না, “আগুন জ্বালাচ্ছ কেন?”

যে-মেয়েটা আগুন জ্বালানোর জন্যে ম্যাচ বের করছিল সে বুবুনের দিকে না তাকিয়েই বলল, “বোলতার ইয়া বড় চাক হয়েছে। আগুন লাগিয়ে ছ্যাড়ভাড়া করে দেব।”

বুবুন ভিতরে ভিতরে চমকে উঠল, সে আগে কখনো বোলতার চাক দেখেনি বইপত্রে দুষ্টু ছেলেদের। বোলতার চাক ভাঙা নিয়ে অনেক রকম ভয়ের কাহিনী পড়েছে এখন কি তারই একটা তার চোখের সামনে ঘটবে? বুবুন গাছের উপরে তাকাল, কিন্তু চাকটা কোথায় ঠিক দেখতে পেল না।

এর মধ্যে বাঁশের ডগার মাঝে আগুন লাগানো হয়েছে, বিশাল মশালের মতো দাউদাউ করে আগুন জ্বলে উঠতেই সবাই মিলে একটা আনন্দের মতো শব্দ করল। মেয়েটা বাঁশটা নিয়ে আগুনটাকে উঁচু করতে থাকে এবং তখন বুবুন বোলতার বিশাল চাকটা দেখতে পেল। যে-ঘটনাটি এক্ষুনি ঘটতে যাচ্ছে সেটা যে বুদ্ধিমানের কাজ নয় সেটা বুঝতে দেরি হল না। মেয়েটা চকচকে চোখে বলল,”সবাই দৌড় দেবার জন্যে রেডি হও।”

বুবুন আবার চমকে উঠল এবং কিছু বোঝার আগেই দেখতে পেল বাঁশের ডগার দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুন বোলতার চাককে গিয়ে ধাক্কা দিয়েছে। চাকটি ভাঙামাত্রই প্লেনের ইঞ্জিনের মতো একটা গুঞ্জন শোনা গেল এবং সাথে সাথে ছেলেপিলের পুরো দলটি আধা-উল্লাস এবং আধা-আতঙ্কের শব্দ করে ছুটতে শুরু করল। মেয়েটি হাতের বাঁশটি ছুঁড়ে ফেলে চিৎকার বলে বলল, “পালাও।”

.

দৌড়াদৌড়ি করা বুবুনের খুব অভ্যাস নেই, কিন্তু এখন সেটা নিয়ে চিন্তা করারও সময় নেই, সে প্রাণপণে মেয়েটার পিছুপিছু ছুটতে লাগল। কে তাদের এত বড় সর্বনাশ করেছে বুঝতে বোলতাদের এতটুকু দেরি হল না তারা পুরো ঝাক বেধে পিছুপিছু ছুটে এল। বোলতার ঝক যদি ধৈর্য ধরে তাদের পিছুপছু ছুটে আসত তা হলে বড় ধরনের বিপদ হয়ে যেত, কিন্তু দেখা গেল মাঝপথেই তারা হাল ছেড়ে দিয়ে ফিরে গেল। মনে হয় তাদের কতটা ক্ষতি হয়েছে সেটা দেখতে ফিরে গেছে।

ছেলেমেয়েদের ছোট দলটি অবিশ্যি আরও খানিকক্ষণ দৌড়ে গিয়ে একটা খোলামতন জায়গায় হাজির হয়। সবাই হাঁপাচ্ছে, হাঁপাতে হাঁপাতে মেয়েটা বলল, “একেবারে ছ্যাড়াভ্যাড়া করে দিয়েছ। আগেবার থেকে ভালো হয়েছে এইবাব।”

বুবুন মুখ হাঁ করে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বলল, “আগেও করেছ এরকম?” মেয়েটির মুখ গর্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, “করি নাই আবার!”

গাট্টাগোট্টা ধরনের একটা ছেলে বলল, “বোলতার চাক জ্বালানোর মাঝে সুমি হচ্ছে এক নম্বর এক্সপার্ট।”

সুমি নিশ্চয়ই মেয়েটার নাম, তাকে দেখে বুবুন মনে-মনে অবাক না হয়ে পারল না। সব মেয়েই যদি এরকম হত তা হলে ছেলেদের মনে হয় বড় বিপদ হয়ে যেত। বুবুন মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করল, “বোলতা কামড়ায়নি কখনো?”

গাট্টাগোট্টা ছেলেটা হিহি করে হাসতে হাসতে বলল, “কামড়ায় নাই আবার! একবার দৌড়াতে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়ল, তখন সব বোলতা এসে

সুমি বলল, “বোলতার মতো ফাজিল আর জেঞ্জারাস কিছু নেই। সোজা এসে চোখের মাঝে অ্যাটাক করে–”

বুবুন একটু শিউরে উঠল, বলল ”বোলতা কামড় দিলে কি খুব ব্যথা করে?” সুমি অবাক হয়ে বলল, “তুমি কখনো বোলতার কামড় খাও নাই?”

“না।”

সবাই ঘুরে বুবুনের দিকে তাকাল, তাদের চোখের দৃষ্টি দেখে মনে হল সে বুঝি মঙ্গল গ্রহ থেকে নেমে-আসা আট হাত-পাওয়ালা একটা প্রাণী! সুমি জিজ্ঞেস করল, “তুমি নতুন এসেছ, তাই না?

“হুঁ।“

“এর আগে কোথায় ছিলে?”

“ঢাকায়।”

“সেখানে বোলতা নাই?”

“থাকবে না কেন? কিন্তু থাকলেই কি খোঁচাখুঁচি করতে হয়?”

গাট্টাগোট্টা ছেলেটা মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “আসলে ঢাকায় বোলতা নাই। ঢাকায় শুধু মশা। দেখিসনি খবরের কাগজে?”

সুমি নামের মেয়েটা একটা চোরা-কাঁটা হ্যাঁচকা টানে তুলে এনে তার গোড়াটা চিবুতে চিবুতে বল, “তোমার নাম কী?”

বুবুন মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, নাম বলামাত্রই সবাই হো হো করে হেসে উঠবে। মানুষ কেমন করে একটা বাচ্চার নাম রাখে বুবুন? তাও নিজের বাচ্চার?

“কী নাম?”

“বুবুন।”

“বুবুন?” সত্যি সত্যি গাট্টাগোট্টা ছেলেটা হি হি করে হাসতে শুরু করল।

সুমি চোখ পাকিয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুই হাসছিস যে?”

ছেলেটা হাসতে হাসতে বলল, “নাম বুবুন হি হি হি। আরেকটু হলে বেবুন হয়ে যেত।

“তোর নিজের নাম হচ্ছে গাব্বু আর তুই অন্যের নাম নিয়ে হাসিস?” গাব্বু যুক্তিতর্কের ধারেকাছে গেল না, হি হি করে হাসতেই থাকল। সুমি বলল, ‘হাসি থামা। আবার ফ্যাকফ্যাক করে হাসবি তো বক্সিং দিয়ে নাক চ্যাপটা করে দেব।”

গাব্বু সাথে সাথে হাসি থামিয়ে ফেলল। বোঝা গেল সুমি দরকার হলে কমবেশি ভোলাই দিতে পারে। বুবুন বলল, “আমার নামটা আসলেই একটু অন্যকরম। আসলে আমার আব্বা একটু অন্যরকম মানুষ ছিলেন তো–”

“তোমার আব্বা কোথায়?”

বুবুন আবার ভিতরে ভিতরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তার আব্বা নিয়ে আলোচনাটি এখন শুরু হতে যাচ্ছে। আগে হোক পরে হোক এটা শুরু হত, এখনই শুরু হয়ে শেষ হয়ে যাওয়াটা ভালো। বুবুন গলা পরিষ্কার করে বলল, “আমার আব্বা নেই।”

সুমি জিব দিয়ে চুকচুক শব্দ করে জিজ্ঞেস করে বলল, “মারা গেছেন?”

“না।”

“তা হলে?”

গাব্বু চোখ ছোট ছোট করে বলল, ‘ডিভোর্স?”

“না।” বুবুন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমার আব্বা হারিয়ে গেছেন।

“হারিয়ে গেছেন?” সুমি চোখ বড় বড় করে বলল, “সত্যি?”

“সত্যি।”

গাব্বু একটা ঢোক গিলে বলল, “বড় মানুষ আবার হারিয়ে যায় কেমন করে?”

বুবুন মাথা নাড়ল, “জানি না। একদিন বাসা থেকে বের হয়েছিলেন, আর ফিরে আসেননি।”

গাব্বু জিজ্ঞেস করল, “তোমার আম্মার সাথে ঝগড়া করেছিল নাকি?”

বুবুন হেসে ফেলল, বলল, “সেটা তো জানি না। আমি তখন ছোট-ন্যাদা ন্যাদা বাচ্চা। দুই-তিন বছর বয়স।”

সুমি জিজ্ঞেস করল, “তোমার আব্বার কথা মনে নাই?”

“না!”

সুমি কেমন জানি মায়া-মায়া চোখে বুবুনের দিকে তাকিয়ে বলল,”ইশ!”

কথাবার্তা কম বলে সেরকম একটা ছেলে এতক্ষণ চুপ করে কথা শুনছিল, এখন হঠাৎ ধমকে উঠল,”ইশ ইশ করছিস কেন? তোর ধারণা আব্বা না থাকাটা খারাপ?”

গাব্বু হি হি করে হেসে ছেলেটার মাথায় একটা চাটি দিয়ে দিয়ে বলল, “তোর আব্বার মতো হলে তো না থাকাটা খারাপ না।”

সুমি বলল, “বাজে কথা বলিস না–পিয়াল যে-সমস্ত কাজকর্ম করে যে কোনো আব্বা ফাটাফাটি করে ফেলবে।”

বুবুন জিজ্ঞেস করল, “কেন? কী করেছে পিয়াল?”

“গত সপ্তাহে রান্নাঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিল। এর আগের সপ্তাহে বাথরুমের পাইপ ফেটে পানি দিয়ে ভাসাভাসি। একবার ইলেকট্রিক শক দিয়ে তার আব্বাকে প্রায় মেরে ফেলেছিল।”

“সাপের ঘটনাটা বল–”

”হ্যাঁ। সাপ পুষতে গিয়ে—”

পিয়াল নামের ছেলেটা চোখ পাকিয়ে বলল, “এমনভাবে বলছিস যেন সব দোষ আমার!”

“তা হলে দোষ কার?”

“যে-কোনো গবেষণা করলে তার মাঝে একটা ইয়ে থাকে। যেটা জানিস না সেটা নিয়ে রেগে গিয়ে পিয়াল কথা শেষ করতে পারল না।

সুমি চোখ টিপে বলল, “পিয়াল হচ্ছে আমাদের সায়েন্টিস্ট। বদরাগি সায়েন্টিস্ট!”

“ইনডাকশান কয়েল দিয়ে এমন একটা ইলেকট্রনিক শক দেব একদিন তখন মজাটা টের পাবি।”

বুবুন জিজ্ঞেস করল, “তোমার কাছে ইনডাকশান কয়েল আছে? গাড়ির কয়েল?”

“না। গাড়ির না।” পিয়াল চকচকে চোখে বলল, “তোমার আছে?”

“হ্যাঁ। চারটা ব্যাটারি দিলে একেবারে ছয় ইঞ্চির একটা স্পার্ক হয়!”

“ছয় ইঞ্চি? যাহ!”

“সত্যি! যখন টেলিভিশনে প্যানপ্যানানি বাংলা নাটক হত আমি স্পার্ক দিয়ে সবার নাটক দেখা বন্ধ করে দিতাম। কেউ বুঝতে পারত না। শেষে একদিন আম্মা ধরে ফেলেছিল। তারপর–”

“তারপর কী? রাম ধোলাই?”

“নাহ্, ঠিক রাম ধোলাই না–তবে যা একটা পালিশ দিলেন!”

সুমি বলল, “তোমার আম্মা তোমাকে পালিশ দিলেন? হতেই পারে না–”

বুবুন অবাক হয়ে বলল, “কেন হতেই পারে না?”

“তোমরা যখন এসেছ আমি দেখেছি, তোমার আম্মা দেখতে একেবারে সিনেমার নায়িকাঁদের মতো। যারা দেখতে এত সুন্দর তারা পালিশ দিতে পারে না।”

বুবুন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “খালি চেহারাটাই!”

“মানে?”

“মানে খালি চেহারাটাই ভালো। আম্মার কথাবার্তা হাবভাব একেবারে বাস কন্ডাক্টারদের মতো। দুধছাড়া চায়ের মতন কড়া মেজাজ।”

“সত্যি?”

“সত্যি না তো মিথ্যা? এই যে দ্যাখো আমার বাম কানটা ডান থেকে একটু লম্বা-আম্মা টেনে টেনে এটা লম্বা করে ফেলেছেন!”

বুবুনের কথা শুনে সবাই হি হি করে হেসে উঠল। বুবুন নিজেও হাসতে লাগল। নতুন জায়গায় এসে আশেপাশে ছেলেমেয়েদের সাথে পরিচয় করা নিয়ে ভিতরে ভিতরে দুশ্চিন্তা ছিল। মনে হচ্ছে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। বিশেষ করে পিয়ালের সাথে জমবে ভালো। দুজনে মিলে মনে হয় একটা রকেট তৈরি করা যেতে পারে। আশেপাশে ফাঁকা জায়গা আছে–রকেট উপরে না উঠে যদি পাশে যায় তা হলেও বড় সমস্যা নেই। নতুন জায়গায় এসে এই প্রথম বুবুনের বেশ ভালোই লাগতে থাকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *